ভোর রাতের দিকে রিহান থামল। সে পশ্চিম দিকে হেঁটে যাবার চেষ্টা করছে কিন্তু অন্ধকারে কোন দিকে হেঁটেছে সে জানে না, একটা গোলকধাঁধার মতো কি সারাক্ষণ ঘুরপাক। খেয়েছে? কী হবে এখন? হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল জীবনের সাথে যুদ্ধে সে হেরে গেছে। এই ভয়ংকর নির্জন মরুভূমিতে সে বেঁচে থাকতে পারবে না, প্রভু ক্লডের মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে আসলে তার মুক্তি নেই। রুক্ষ বিবর্ণ পাথরে তার মৃতদেহ পড়ে থাকবে, শুকনো বালুতে সেটি বিবর্ণ ধূসর হয়ে একসময় মাটিতে মিশে যাবে। রিহান ভালো করে চিন্তা করতে পারছিল না, মাথার ভেতরে দপদপ করছে, সে কেমন যেন একটা ঘোরের মাঝে রয়েছে। চারপাশে কী হচ্ছে সেটাও সে দেখতে পারছে না, হঠাৎ করে মনে হচ্ছে কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না।
ভোরের আলো ফোঁটার আগেই রিহান একটা বড় পাথরের পাশে অচেতন হয়ে পড়ল। ভোরের প্রথম আলোতে একটা সরীসৃপ সাবধানে তাকে পরীক্ষা করে সরে যায়। একটা বিষাক্ত বিছে তার খুব কাছে দিয়ে ছুটে গেল। কিছু গুবরে পোকা গর্তের ভেতর থেকে বের হয়ে ইতস্তত ছোটাছুটি করতে থাকে। একটা ছোট মাকড়সা একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে খুব সাবধানে চারদিক পরীক্ষা করতে শুরু করে।
রিহান ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখল সে একটা সবুজ বাগানে ঝরনার কাছে বসে আছে। চারপাশে কচি সবুজ পাতা নড়ছে, পাখি ডাকছে কিচিরমিচির করে। রিহান ঝরনার কাছে এগিয়ে যায়, ঝরনার পানিতে পা ডুবিয়ে সে এক আঁজলা পানি নিয়ে মুখে দেওয়ার চেষ্টা করতেই ঝরঝর করে পানিটুকু তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল। আবার চেষ্টা করল সে, আবার পানিটুকু পড়ে গেল। পাগলের মতো আবার চেষ্টা করল, কিন্তু লাভ হল না, কিছুতেই সে মুখে পানি দিতে পারছে না। কে যেন হা–হা করে হেসে উঠেছে, মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে সামনে প্রভু ক্লড দাঁড়িয়ে আছেন। কঠোর মুখে বললেন, না, রিহান তুমি পানি খেতে পারবে না। আমি তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি। তোমার কোনো মুক্তি নেই।
রিহান কাতর গলায় বলল, আমাকে ক্ষমা করুন প্রভু। ক্ষমা করুন।
প্রভু ক্লড হা–হা করে হেসে উঠে বললেন, ক্ষমা করব? তোমাকে? কক্ষনো না। তারপর হাত তুলে বললেন, নিয়ে যাও ওকে আমার সামনে থেকে।
দুজন মানুষ তখন তাকে ধরে নিয়ে যেতে থাকে। তাকে নেবার জন্যে অনেকগুলো মানুষ মোটরবাইকে করে আসতে থাকে। আস্তে আস্তে মোটরবাইকের গর্জন বাড়তে থাকে, ভোঁতা কর্কশ গর্জন। একসময় প্রচণ্ড গর্জনে তার কানে তালা লেগে যায়–চোখ খুলে তাকাল রিহান। সে এখনো বেঁচে আছে? একটা ভোঁতা কর্কশ গর্জন শুনতে পেল সে। মোটরবাইকের গর্জন? প্রভু ক্লডের অনুচরেরা তাকে ধরতে আসছে? এটি কি স্বপ্ন না। সত্যি?
রিহান চিন্তা করতে পারে না, কোনো কিছুতেই এখন আর কিছু আসে যায় না। সে আবার চোখ বন্ধ করল, চোখ বন্ধ করেও সে মোটরবাইকের গর্জন শুনতে পেল–মাটিতে সে কম্পন অনুভব করল। হঠাৎ করে গর্জন থেমে যায়, তখন মানুষের পায়ের শব্দ আর কণ্ঠস্বর শুনতে পায় রিহান। মনে হয় অনেক দূর থেকে কারো গলার স্বর ভেসে আসছে। কেউ একজন বলছে, দেখো। একটা মানুষ মরে পড়ে আছে।
রিহানের মনে হল অনেক মানুষ তাকে ঘিরে ভিড় করছে। কে একজন তাকে স্পর্শ করল, তারপর বলল, না, না এখনো মরে নি।
কী আশ্চর্য! বেঁচে আছে? বেঁচে আছে এখনো?
রিহান অনেক কষ্ট করে চোখ খুলে তাকাল, ভালো করে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কিছু অশরীরী প্রাণী তাকে ঘিরে রেখেছে। রিহান কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু বলতে পারল না, শুকনো অসাড় জিবটাকে সে নাড়াতে পারল না, শুধু ঠোঁট দুটো নড়ল একবার। অচেতনার অন্ধকারে ডুবে যাবার আগে সে আরো একবার বলার চেষ্টা করল, পানি। কিন্তু সে বলতে পারল না।
শুনতে পেল ভারী গলায় একজন বলল, পানির বোতলটা দাও দেখি। এর মুখে একটু পানি দিতে হবে।
কথাটি সত্যি না স্বপ্ন রিহান বুঝতে পারল না। কিছুতেই এখন আর কিছু আসে যায়।
কিছু আসে যায় না।
৩. গ্রুস্তান পরিবার
রিহান বাটি থেকে চুমুক দিয়ে স্যুপটা শেষ করে খালি বাটিটা ত্রানাকে ফেরত দিল। ত্রানার বয়স দশ যদিও তাকে দেখে আরো কম মনে হয়। সে খালি বাটিটা হাতে নিয়ে সাথে সাথে চলে গেল না, রিহানের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইল। রিহান চোখ মটকে জিজ্ঞেস করল, কী হল ত্রানা, তুমি কিছু বলবে?
ত্রানা মাথা নাড়ল, বলল, উঁহু।
তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে চাও, লজ্জা করো না, জিজ্ঞেস করে ফেলো।
ত্রানা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, তোমার পা যে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে তোমার ব্যথা করে না?
রিহান শিকল দিয়ে বাঁধা ডান পাটি নাড়িয়ে বলল, নাহ। অভ্যাস হয়ে গেছে।
ত্রানা এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, তোমাকে বেঁধে রেখেছে কেন? তুমি কি খুব ভয়ংকর?
রিহান মুখে হাসি টেনে আনার চেষ্টা করে বলল, তোমার কী মনে হয়?
আমি জানি না। ত্রানা তার মুখে বয়সের তুলনায় বেশি গাম্ভীর্য ফুটানোর চেষ্টা করে বলল, বাবা বলেছে তুমি খুব ভয়ংকর সেজন্যে তোমাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে।
রিহান কী বলবে বুঝতে না পেরে বিস্ময়াভিভূত বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্রানা গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো বলল, বাবা বলেছে তুমি নিশ্চয়ই তোমার কমিউনে কাউকে খুন করে পালিয়ে এসেছ। তোমার কমিউনের লোকেরা তোমাকে নিশ্চয়ই খুঁজছে।