- বইয়ের নামঃ ফোবিয়ানের যাত্রী
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
১. সকালে ঘুম ভাঙতেই
আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ল, অস্পষ্ট আবছা এবং হালকাভাবে নয়— অত্যন্ত তীব্রভাবে। মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ নেই প্রায় বারো বৎসর— আমার ধারণা ছিল খুব ধীরে ধীরে আমার মস্তিষ্ক থেকে মায়ের স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে আসছে। কিন্তু আজ ভোরবেলা আমি বুঝতে পারলাম সেটি সত্যি নয়, মায়ের স্মৃতি হঠাৎ করে আমাকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে গেছে। মা এবং সন্তানের মাঝে প্রাণীজগতের যে তীব্র তীক্ষ্ণ এবং আদিম ভালোবাসা রয়েছে সেই ভালোবাসার একটুখানির জন্যে আজ সকালে আমি বুকের ভিতরে একধরনের শূন্যতা অনুভব করতে থাকি, আমার মাকে একনজর দেখার জন্যে কিংবা একবার স্পর্শ করার জন্যে হঠাৎ করে নিজের ভেতর একধরনের বিচিত্র অস্থিরতা আবিষ্কার করে আমি নিজেই একটু অবাক হয়ে যাই।
আমি নিজের ভেতরকার এই অস্থিরতা দূর করার জন্যে বিছানায় শুয়ে শুয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম, আলোর প্রতিফলন এবং বিচ্ছুরণ ব্যবহার করে আমার ছোট বাসস্থানটিতে খানিকটা বিশালত্ব আনার চেষ্টা করা হয়েছে— বাসার ছাদটিকে মনে হয় আকাশের কাছাকাছি। সেই সুদূর আকাশের কাছাকাছি ধূসর ছাদের দিকে তাকিয়ে থেকেও আমার ঘুরেফিরে মায়ের কথা মনে হতে থাকে, আমার বর্ণাঢ্য শৈশবের নানা ঘটনা আমার মনকে বিক্ষিপ্ত করে তুলতে শুরু করে। আমি আমার বিছানায় সোজা হয়ে বসে একটা নিঃশ্বাস ফেলে মাথার কাছে সুইচটা স্পর্শ করলাম, সাথে সাথে ঝুপ করে বিছানাটা নিচে নেমে এল। আমি অনাবৃত শরীরটি নিও পলিমারের চাদর দিয়ে ঢেকে বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম। স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরের বিস্তৃত লোকালয় চোখে পড়ে। সারি সারি বসতি গায়ে গায়ে জড়িয়ে উঁচু হয়ে উঠেছে, অনেক উঁচুতে বায়োডোম পুরো বসতিটিকে এই গ্রহের ভয়ঙ্কর পরিবেশ থেকে রক্ষা করে রেখেছে। বাইরে হালকা বেগুনি আলো দেখেই কেমন জনি মন খারাপ হয়ে যায়। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে জানালা থেকে সরে এলাম আমার ঘরের দেওয়ালে ত্রিমাত্রিক ভিডি টিউব বসানো রয়েছে, অনেকটা অন্যমনস্কভাবে সেটা স্পর্শ করতেই ঘরের মাঝামাঝি আমার মায়ের ত্রিমাত্রিক ছবি জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠল। ষোলো-সতেরো বছরের একজন কিশোরীর মতো চেহারা, কোমল ত্বক এবং লালচে চুল। শাদা রংয়ের পোশাকে আমার মাকে স্বর্গ হতে নেমে আসা একজন দেবীর মতো দেখায়। মা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস বাবা ইবান?
আমি জানি এটি ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক ছবি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি অসংখ্যবার আমার মায়ের এই একমাত্র ভিডিও ক্লিপটা দেখেছি। কিন্তু তবু আমি ফিসফিস করে বললাম, ভালো আছি মা। আমি ভালো আছি।
হলোগ্রাফিক ছবিতে আমার মা একদৃষ্টিতে আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে কোমল গলায় বললেন, কতদিন তোকে দেখি না— এতদিনে তুই নিশ্চয়ই আরো কত বড় হয়েছিস। আমার মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে তুই কোথায় আছিস, কেমন আছিস।
মা খানিকক্ষণ চুপ করে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বিষণ্ণ গলায় বললেন, যেখানেই থাকিস বাবা ইবান, তুই ভালো থাকিস।
আমি ফিসফিস করে বললাম, তুমি ভেবো না মা, আমি ভালো থাকব।
আমার মা ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তার চোখ মুছে কাতর গলায় বললেন, আমার উপর রাগ পুষে রাখিস না বাবা— আমি আসলে বুঝতে পারি নি। যদি বুঝতে পারতাম তাহলে আমি তোকে এমনভাবে জন্ম দিতাম না। বিশ্বাস কর–
আমার মা ভেঙে পড়ে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন আমি তার আগেই ভিডি টিউবটা বন্ধ করে দিলাম আমি অসংখ্যবার আমার কাছে রাখা আমার মায়ের একমাত্র হলোগ্রাফিক ভিডিও ক্লিপটা দেখেছি, ভিডিও ক্লিপের এই অংশে মায়ের তীব্র অপরাধবোধের গ্লানিটুকু দেখতে আমার ভালো লাগে না। জিনের প্রতিটি ক্রমাবর্তনকে নিয়ন্ত্রণ করে যখন একজন মানুষকে অতিমানবের পর্যায়ে জন্ম দেয়া যায় তখন আমার মতো সাধারণ একজন মানুষের জন্ম দিয়ে আমার প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে আমার মা সেজন্যে নিজেকে কখনো ক্ষমা করেন নি। আমার চারপাশে যারা আছে তারা সবাই সূক্ষ্ম হিসেবনিকেশ করে জন্ম দেওয়া মানুষ। তারা সুদর্শন, সুস্থ সবল, মেধাবী, প্রতিভাবান এবং সাহসী। তাদের তুলনায় আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ, আমার ভিতরে অন্য মানুষের জন্য ভালোবাসা ছাড়া আর কোনো বিশেষ। গুণাবলি নেই। আমাকে জন্ম দেওয়ার আগে আমার মা জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে শুধুমাত্র এই মানবিক একটি ব্যাপার নিশ্চিত করেছিলেন তার ধারণা ছিল একজন ভালো মানুষ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ মানুষ, সুখী মানুষ। আমাকে তাই একজন হৃদয়বান ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বড় হতে গিয়ে আমি আবিস্কার করেছিলাম মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের এই স্তরে আসলে আমার মতো মানুষের প্রয়োজন খুব কম। আমি বড় হতে গিয়ে পদে পদে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। আমাকে ভালো স্কুলে যেতে দেওয়া হয় নি, বড় সুযোগ থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছেএকরকম জোর করে বারবার আমাকে প্রমাণ করতে হয়েছে যে আমি আসলে অক্ষম নই। আমার বয়স যখন মাত্র তেরো বৎসর তখন এই বৈষম্য থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্যে আমি আমাদের গ্রহ থেকে পালিয়ে এসেছিলাম, প্রথমে একটা মহাকাশযানের শিক্ষানবিশী হিসেবে কাজ করেছি, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে আমি শেষপর্যন্ত চতুর্থ মাত্রার বাণিজ্যিক মহাকাশযান চালানোর লাইসেন্স পেয়েছি। আমার মা আজ আমাকে দেখলে খুব খুশি হতেন— তার ছেলেকে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে অতিমানবের কাছাকাছি পৌঁছে না দেওয়াতেই খুব একটা ক্ষতি হয় নি। যেটুকু অর্জন। করার আমি সেটুকু অর্জন করে নিয়েছি, কষ্ট হয়েছে সত্যি কিন্তু অসাধ্য হয় নি।