- বইয়ের নামঃ ফিনিক্স
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
১. প্রভু ক্লড
ফিনিক্স – সায়েন্স ফিকশান – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
পূর্বকথা
ভাইরাসটির নাম ছিল ইকুয়িনা, বৈজ্ঞানিক পরিভাষা ব্যবহার করে বললে বলতে হয় ইকুয়িনা। বি. কিউ. ২৩–৪৯। যে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ার দীর্ঘদিন গবেষণা করে এই ভাইরাসটি দাঁড়া করিয়েছিলেন ভাইরাসটিকে তার নামে নামকরণ করা হয়েছিল। বিজ্ঞানী ইকুয়িনা কখনো কল্পনাও করেন নি এই ভাইরাসটি ল্যাবরেটরির চার দেয়ালের বাইরে যেতে পারবে তা হলে তিনি নিশ্চয়ই কিছুতেই নিজের নামটি ব্যবহার করতে দিতেন না। কিন্তু এই ভাইরাসটি ল্যাবরেটরির চার দেয়ালের বাইরে গিয়েছিল, কারো কোনো ভুলের জন্য নয়, কোনো দুর্ঘটনাতেও নয়–এটি বাইরে গিয়েছিল সেনাবাহিনীর নির্দেশে। সময়টি ছিল পৃথিবীর জন্যে খুব অস্থির একটা সময়, পৃথিবীর দরিদ্র দেশ আর উন্নত দেশগুলোর মাঝে তখন এক ভালবাসাহীন নিষ্ঠুর সম্পর্ক। পারমাণবিক বোমা আর মারণাস্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয় না, এটি সবার কাছেই আছে, যেকোনো মুহূর্তে যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে–নতুন ধরনের একটা অস্ত্রের খুব প্রয়োজন, ঠিক তখন ইকুয়িনা ভাইরাসটি যুদ্ধবাজ জেনারেলদের চোখে পড়ে। যদিও তখনো এটি পৃথিবীর একটি মানুষেরও মৃত্যুর কারণ হয় নি কিন্তু সবাই জানত মানুষকে হত্য করার জন্যে এর চাইতে নিশ্চিত কোনো ভাইরাস পৃথিবীর বুকে কখনো সৃষ্টি হয় নি। কোনো জীবিত মানুষের ওপর এটি পরীক্ষা করে দেখা হয় নি তবুও বিজ্ঞানীরা এর ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ার কথা জানতেন। সংক্রমণের প্রথম সপ্তাহে কিছু বোঝা যাবে না, দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রথমে খুশখুশে কাশি এবং অল্প মাথাব্যথা দিয়ে শুরু হয়ে কয়েকদিনের ভেতরে তীব্র মাথাব্যথা এবং জ্বর শুরু হবে। ধীরে ধীরে সেটা মস্তিষ্কের প্রদাহে রূপ নেবে, সপ্তাহ শেষ হবার আগে শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দিয়ে এমনভাবে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যাবে যে দেখে মনে হবে মানুষটির পুরো দেহটি বুঝি একটি গলিত মাংসপিণ্ড। যে দেহ একটি মাত্র ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল তার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, প্রতি বিন্দু রক্ত তখন কোটি কোটি ইকুয়িনা ভাইরাসে কিলবিল করতে থাকবে। এই ভাইরাস বাতাসে ভর করে চোখের পলকে কয়েক শ কিলোমিটার ছড়িয়ে পড়তে পারে। কোনো ভাবে একটি ভাইরাসও যদি মানুষের শরীরে স্থান নিতে পারে সেই মানুষটির বেঁচে যাবার কোনো উপায় নেই। এর কোনো প্রতিষেধক নেই, এই ভাইরাস থেকে রক্ষা পাবার কোনো উপায় নেই। আক্রান্ত মানুষটির মৃত্যু হবে যন্ত্রণাদায়ক এবং নিশ্চিত একেবারে এক শ ভাগ নিশ্চিত, এবং সেইটি ছিল সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয়।
সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় শ্রেণীর বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসটি নিয়ে গবেষণা করার চেষ্টা করলেন। তাঁরা ভাইরাসটির মাঝে সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করলেন যেন ভাইরাসটি সব মানুষের ওপরে কার্যকরী না হয়ে শুধুমাত্র বিশেষ একটি জনগোষ্ঠীর মাঝে সংক্রমিত হয়–তা হলে যুদ্ধবাজ জেনারেলরা সেটাকে বিশেষ দেশের বিশেষ মানুষের ওপর ব্যবহার করতে পারবে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো দরিদ্র দেশগুলোকে শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবছিল, পরিবর্তিত ইকুয়িনা ভাইরাসটি ছিল তাদের সেই ভয়ংকর পৈশাচিক স্বপ্নের উত্তর। সেই পৈশাচিক গবেষণাটি সফল হয় নি সেটা কিন্তু সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় শ্রেণীর বিজ্ঞানীরা জানতেন না। গোপন একটা ফিল্ড টেস্ট করতে গিয়ে ইকুয়িনা ভাইরাসটি পৃথিবীতে মুক্ত হয়ে যায়। আফ্রিকায় একটা প্রত্যন্ত অঞ্চলের পুরো দ্বীপবাসী দুই সপ্তাহের মাঝে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার খবরটি পৃথিবীর সাধারণ মানুষের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল এবং সেই গোপনীয়তাটুকু ছিল পুরোপুরি অর্থহীন কারণ ততক্ষণে সারা পৃথিবীর সকল মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মৌসুমি বাতাসে ইকুয়িনা ভাইরাস ইউরোপ–এশিয়া হয়ে উত্তর আমেরিকায় এবং অস্ট্রেলিয়া হয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছে যায়। পরবর্তী দুই সপ্তাহের মাঝে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। পৃথিবীর বুকে যে ভয়াবহ আতঙ্কের জন্ম নিল তার কোনো তুলনা নেই, এই ভাইরাসের ভয়াবহ থাবা থেকে কোনো মুক্তি নেই সেটি সাধারণ মানুষ তখনো জানত না, বেঁচে থাকার জন্যে তাদের উন্মত্ত আকুলতা সেই ভয়াবহ দিনগুলোকে আরো। ভয়াবহ করে তুলল।
দুই মাসের মাঝে পৃথিবীর ছয় বিলিয়ন মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, বেঁচে রইল একেবারে হাতেগোনা কিছু শিশু এবং কিশোর। প্রকৃতির কোন রহস্যের কারণে এই হাতেগোনা অল্প কয়জন শিশু–কিশোর ইকুয়িনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়েছে সেটি কেউ জানে না, সেই রহস্য খুঁজে বের করার মতো কোনো মানুষ তখন পৃথিবীতে একজনও বেঁচে নেই।
তারপর পৃথিবীতে আরো দুই শতাব্দী কেটে গিয়েছে। ইকুয়িনা ভাইরাসের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া সেই শিশু এবং কিশোরের বংশধরেরা পৃথিবীতে একটা নূতন সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। পুরোনো পৃথিবী, তার জ্ঞান বিজ্ঞান–ইতিহাসের কোনো স্মৃতি কারো মাঝে নেই। পৃথিবীর নানা অংশে যাযাবরের মতো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা মানুষেরা পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার মাঝে ঘুরে বেড়ায়। নানা ধরনের কুসংস্কার, কিছু সহজাত প্রবৃত্তি এবং বেঁচে থাকার একেবারে আদিম তাড়নার ওপর ভর করে মানুষগুলো বিচিত্র একটি পৃথিবীতে টিকে থাকার চেষ্টা করে, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে তারা নিজের পরিবার নিজের গোষ্ঠীকে রক্ষা করে আবার প্রয়োজনে হিংস্র পশুর মতো অন্য গোষ্ঠীকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। বড় বড় ট্রাকে করে তারা পৃথিবীর লোহিত মৃত্তিকায় ধূলি উড়িয়ে ঘুরে বেড়ায়, পৃথিবীর মানুষের হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার মাঝে বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে বেড়ায়।