- বইয়ের নামঃ বিজ্ঞানী অনিক লুম্বা
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ অনুপম প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. বিজ্ঞানী অনিক লুম্বা
আমি জানি, বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করবে না যে বিখ্যাত বিজ্ঞানী অনিক লুম্বার নামটা আমার দেওয়া। একজন মানুষ, যার বয়স প্রায় আমার বয়সের কাছাকাছি, তাকে হঠাৎ করে একটা নতুন নাম দিয়ে দেওয়াটা এত সোজা না। হেজিপেজি মানুষ হলেও একটা কথা ছিল কিন্তু অনিক লুম্বা মোটেও হেজিপেজি মানুষ নয়, সে রীতিমতো একজন বিজ্ঞানী মানুষ, তাই কথা নেই বার্তা নেই সে কেন আমার দেওয়া নাম নিয়ে ঘোরাঘুরি করবে? কিন্তু সে তাই করছে, আমি নিজের চোখে দেখেছি কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে, ভাই আপনার মাম? সে তখন সরল মুখ করে বলে, অনিক লুম্বা। মানুষজন যখন অবাক হয়ে তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায় তখন সে একটু গরম হয়ে বলে, এত অবাক হচ্ছেন কেন? একজন মানুষের নাম কি অনিক লুম্বা হতে পারে না? সত্যি কথা বলতে কি, একজন বাঙালির এরকম নাম হবার কথা না, কিন্তু সেটা কেউই তাকে বলতে সাহস পায় না। তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলে, পারে পারে, অবশ্যই পারে। বিজ্ঞানী অনিক লুম্বা তখন দাঁত বের করে হাসে।
কেমন করে এই নামকণ হয়েছে সেটা বুঝতে হলে সুব্রতের কথা একটু জানতে হবে। সুব্রত হচ্ছে আমার স্কুলজীবনের বন্ধু। আমরা একসাথে স্কুলে নিল-ডাউন হয়ে থেকেছি, কানে ধরে উঠবস করেছি এবং বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থেকেছি। বড় হবার পর আমার সব বন্ধুবান্ধব বিদেশে পাচার হয়ে গেছে, যারা পাচার হয় নি তারা চাকরিরাকরি বা ব্যবসাপাতি করে এত উপরে উঠে গেছে যে আমার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। হঠাৎ কোথাও দেখা হলে তারা না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করে। নিতান্তই সেই সুযোগ না হলে অবাক হবার ভান করে বলে, আরে! জাফর ইকবাল না?
আমি বলি, খা। আমি জাফর ইকবাল। সে তখন আপনি-তুমি বাচিয়ে বলে, আরে! কী খবর? আজকাল কী করা হয়?
আমি বিশেষ কিছু করি না, সেটা বলা দক্ষ করতেই তারা ইতিউতি তাকাতে থাকে, ঘড়ি দেখতে থাকে আর হঠাৎ করে আমার কথার মাঝখানে বলে ওঠে, ইয়ে, খুব ব্যস্ত আজকে। সময় করে একদিন অফিসে চলে আসলে কেমন হয়? আডডা মারা যাবে তখন! হা হা হা।
তারপর সুড়ুৎ করে সরে পড়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যিই একদিন আমি তাদের অফিসে গিয়ে হাজির হব, তখন দেখি ভারা কী করে, কেমন করে আমার কাছ থেকে পালায়! তবে সুব্রত মোটেও এরকম না, ভার কথা একেবারে আলাদা। সুব্রতের সাথে আমার পুরোপুরি যোগাযোগ আছে, সত্যি কথা বলতে কি আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এতটা যোগাযোগ না থাকলেই মনে হয় ভালো ছিল। প্রায়ই মাঝরাতে ফোন করে ডেকে বলে, কী হল? ঘুমাচ্ছিস নাকি?
একজন মানুষ তো ঘুমাতে ঘুমাতে টেলিফোনে কথা বলতে পারে না, সেজন্যে তো তাকে জেগে উঠতে হবে, তাই আমি বলি, না, মানে ইয়ে— সুব্রত তখন বলে, তোকে কোনো বিশ্বাস নেই। সন্ধে হবার আগেই নাক ডাকতে থাকিস। এদিকে কী হয়েছে জানিস?
আমি ভয়ে ভয়ে বলি, কী?
সুব্রত গলা নামিয়ে চাপা স্বরে বলে, একেবারে ফাটাফাটি ব্যাপার সে তখন ফাটাফাটি ব্যাপারটার বর্ণনা দেয়, তবে কখনোই সেটা সত্যিকার ফাটাফাটি কিছু হয় না। ব্যাপারটা হয় কবিতা পাঠের আসর, বাউল সম্মেলন, মাদার গাছ রক্ষা আন্দোলন কিংবা সবার জন্য জোছনার আলো এই ধরনের কিছু। কোথাও বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো হলেই। সুব্রত মহা উৎসাহে ত্রাণ কাজে লেগে যায়। তাকে দেখলেই মনে হয় তার বুঝি অনুই হয়েছে অন্য মানুষের কাজ করার জন্যে। মানুষের সেবা করা খুব ভালো ব্যাপার, কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় তার ধারণা আমাদের সবারও বুঝি জন্ম হয়েছে তার সাথে সাথে দুনিয়ার সব রকম পাগলামিতে যোগ দেওয়ার জন্যে।
রাত্রিবেলা ঘুমাচ্ছি, গভীর রাতে হঠাৎ বিকট শব্দে টেলিফোন বাজতে থাকে। মাঝরাতে টেলিফোন বাজলেই মনে হয় বুঝি ভয়ংকর কোনো একটা দুঃসংবাদ। আমি লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠে হাচড়-পাচড় করে কোনোমতে দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন ধরে বললাম, হ্যালো।
অন্যপাশে সুব্রতের অমায়িক গলা, জাফর ইকবাল?
হঠাৎ করে ঘুম থেকে তুললে আমার ব্রেন শর্ট সার্কিট হয়ে যায়, আমি অনেকক্ষণ কিছু বুঝতে পারি না। কোনোমতে বললাম, হাঁহ?
কাল কী করছিস?
আমি আবার বললাম, হাঁহ?
সুব্রত নিজেই নিজের উত্তর দিল, কী আর করিস? তুই কোনো দিন কাজকর্ম করিস? বসে বসে খেয়ে তুই কী রকম খাসির মতো মোটা হয়েছিস খেয়াল করেছিল? সকালবেলা চলে আয়। ওসমানী মিলনায়তনে। সকাল নটা শার্প।
আমি বললাম, হাঁহ?
দেরি করিস না। খুব জরুরি।
হাঁহ? এতক্ষণে আমার ঘুম ভাঙতে শুরু করেছে কে ফোন করেছে, কেন ফোন করেছে, কী বৃত্তান্ত জিজ্ঞেস করব, সুব্রত ততক্ষণে ফোন রেখে দিয়েছে। আমি আধো-ঘুম আধো-জাগা অবস্থায় আবার কোনোমতে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালবেলা যখন ঘুম থেকে উঠেছি তখন আবছা আবছাভাবে মনে পড়ল যে রাতে কেউ একজন ফোন করে কিছু একটা বলেছিল। কিন্তু কে ফোন করেছিল, কেন ফোন করেছিল, ফোন করে কী বলেছিল কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। হাত-মুখ ধুয়ে নাস্তা করতে বলেছি, দুই টুকরা রুটি টোস্ট একটা কলা খেয়ে ডাবল ডিমের পোচটা মাত্র মুখে দিয়েছি, তখন দরজায় প্রচণ্ড শব্দ। খুলে দেখি সুব্রত। আমাকে দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, তুই এখনো ব্রেডি হোস নাই?