- বইয়ের নামঃ প্রডিজি
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ প্রথমা প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. সিঁড়ি দিয়ে বেশ কয়েকটা মেয়ে
উৎসর্গ
সায়মা ছবি আঁকে, কবিতা লেখে, গণিত অলিম্পিয়াডে পুরস্কারও পায়। একদিন সে আমার সাথে ফোনে যোগাযোগ করেছে, আমি তখন হতবাক হয়ে জানলাম, তার জীবনটি তছনছ হয়ে গেছে। অ্যাকসিডেন্টে সে পুরোপুরি চলৎশক্তিহীন, নিঃশ্বাসটুকুও নিতে হয় যন্ত্র দিয়ে। সারা শরীরে সে শুধু একটি আঙুল নাড়াতে পারে। সেই আঙুল দিয়েই সে ছবি আঁকে, কবিতা লেখে। মোবাইল টেলিফোনে এসএমএস করে, সে আমাকে তার ভারি সুন্দর কবিতাগুলো পাঠাত। আমি তাকে বলেছিলাম, যখন বেশ কিছু কবিতা লেখা হবে, তখন একুশে বইমেলায় তার একটি বই বের করে দেব।
কিছুদিন আগে তার এক বান্ধবী আমাকে ফোন করে জানিয়েছে, সায়মা মারা গেছে; তার কবিতার বইটি আর বের করা হলো না।
যারা সায়মার মতো কখনো জীবনযুদ্ধে পরাজিত হতে জানে না, এই বই তাদের উদ্দেশে।
০১.
সিঁড়ি দিয়ে বেশ কয়েকটা মেয়ে হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে নেমে আসছে, রাফি একটু সরে গিয়ে তাদের জায়গা করে দিল। মেয়েগুলো রাফিকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে হাসতে হাসতে নিচে নেমে গেল, তাকে ভালো করে লক্ষও করল না। লক্ষ করার কথা নয়—সে আজ প্রথম এই ডিপার্টমেন্টে লেকচারার হিসেবে যোগ দিতে এসেছে, মাত্র ডিগ্রি শেষ করেছে, তার চেহারায় এখনো একটা ছাত্র-ছাত্র ভাব, তাই তাকে ছেলেমেয়েরা আলাদাভাবে লক্ষ করবে, সেটা সে আশাও করে না। দোতলায় উঠে করিডর ধরে সে হাঁটতে থাকে, ছেলেমেয়েরা ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গল্পগুজব করছে, সাহসী একটা মেয়ে নির্বিকারভাবে রেলিংয়ে পা তুলে বসে আছে। তাকে কেউ চেনে না, তাই কেউ তার জন্য জায়গা ছেড়ে দিল না, রাফি ছেলেমেয়েদের মাঝখানে জায়গা করে করে সামনের দিকে হেঁটে যায়।
করিডরের শেষ মাথায় হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্টের রুম। দরজাটা খোলা, রাফি পর্দা সরিয়ে মাথা ঢুকিয়ে।একনজর দেখল। বড় একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলে পা তুলে দিয়ে প্রফেসর জাহিদ হাসান তাঁর চেয়ারে আধা শোয়া হয়ে একটা বই দেখছেন। রাফি এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, আসতে পারি, স্যার?
প্রফেসর জাহিদ হাসান চোখের কোনা দিয়ে তাকে দেখে আবার বইয়ের পাতায় চোখ ফিরিয়ে বললেন, আসো।
রাফি বুঝতে পারল, প্রফেসর জাহিদ হাসান তাকে চিনতে পারেননি। সে এগিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, আমি রাফি আহমেদ।
প্রফেসর জাহিদ হাসান বই থেকে চোখ না তুলে বললেন, বলো রাফি আহমেদ, কী দরকার?
স্যার, আমি এই ডিপার্টমেন্টে জয়েন করতে এসেছি।
প্রফেসর হাসান হঠাৎ করে তাকে চিনতে পারলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি টেবিল থেকে পা নামালেন এবং খুব একটা মজা হয়েছে, সে রকম ভঙ্গি করে বললেন, আই অ্যাম সরি, রাফি! আমি ভেবেছি, তুমি একজন ছাত্র!
রাফি মুখে একটু হাসি-হাসি ভাব ধরে রাখল। প্রফেসর জাহিদ হাসান হঠাৎ ব্যস্ত হওয়ার ভঙ্গি করে বললেন, বসসা, বসো রাফি, তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন?
রাফি সামনের চেয়ারটায় বসে। চোখের কোনা দিয়ে প্রফেসর জাহিদ হাসানের অফিস ঘরটি দেখে। বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিলটি কাগজপত্র, বইখাতায় বোঝাই, সেখানে তিল ধারণের জায়গা নেই। শুধু যে টেবিলে বইখাতা, কাগজপত্র তা নয়, প্রায় সব চেয়ারেই বই, খাতাপত্র রয়েছে। পাশে ছোট একটা টেবিলে একটা কম্পিউটার, পুরোনো সিআরটি মনিটর। চারপাশে শেলফ এবং সেখানে নানা রকম বই। শেলফের ওপর কিছু কাপ, শিল্ড আর ক্রেস্ট। ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরা দৌড়-ঝাঁপ করে সম্ভবত এগুলো পেয়েছে।
প্রফেসর জাহিদ হাসান বললেন, তুমি কখন এসেছ? কোনো সমস্যা হয়নি তো?
সকালে পৌঁছেছি। কোনো সমস্যা হয়নি।
কোথায় উঠেছ?
গেস্ট হাউসে। গুড।
প্রফেসর হাসান গলা উঁচিয়ে ডাকলেন, জাহানারা, জাহানারা।
পাশের অফিস ঘর থেকে হালকা-পাতলা একটা মেয়ে হাতে কিছু কাগজপত্র নিয়ে ঢুকে বলল, জি স্যার। এ এই হচ্ছে রাফি আহমেদ। আমাদের নতুন টিচার। তুমি এর জয়েনিং লেটারটা রেডি করো।
জি স্যার।
আর রাফি, তুমি জাহানারাকে চিনে রাখো। কাগজে-কলমে আমি এই ডিপার্টমেন্টের হেড, আসলে ডিপার্টমেন্ট চালায় জাহানারা। ও যেদিন চাকরি ছেড়ে চলে যাবে, আমিও সেদিন চাকরি ছেড়ে চলে যাব।
জাহানারা নামের হালকা-পাতলা মেয়েটি বলল, স্যার, আপনি যেদিন চাকরি ছেড়ে চলে যাবেন, আমিও সেদিন চাকরি ছেড়ে চলে যাব।
গুড। তাহলে আমিও আছি, তুমিও আছ। প্রফেসর জাহিদ হাসান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, তোমার সঙ্গে অন্য সবার পরিচয় করিয়ে দিই।
রাফি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে, স্যার।
প্রফেসর হাসান তার অফিস থেকে বের হয়ে করিডর ধরে হাঁটতে থাকেন, একটু আগে যে ছেলেমেয়েগুলো ভিড় করে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছিল, তারা এবার তাদের গলা নামিয়ে ফেলল। তারা হাত তুলে প্রফেসর হাসানকে সালাম দেয় এবং দুই পাশে সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দেয়। যে সাহসী মেয়েটি রেলিংয়ের ওপর নির্বিকারভাবে বসেছিল, সেও তড়াক করে লাফ দিয়ে নিচে নেমে মুখে একটা শিশুসুলভ নিরীহ ভাব ফুটিয়ে তোলে। প্রফেসর হাসান একটা ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেলেন, ঘরের চার কোনায় চারটা ডেস্ক, তিনটিতে যে তিনজন বসেছিল, তারা তাঁকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। দুজন ছেলে এবং একজন মেয়ে, এরাও শিক্ষক, এবং এদেরও দেখে শিক্ষক মনে হয় না, চেহারায় একটা ছাত্র-ছাত্র ভাব রয়ে গেছে। প্রফেসর জাহিদ হাসান বললেন,এই যে, এ হচ্ছে রাফি আহমেদ। আমাদের নতুন কলিগ!