কেন?
হলোগ্রাফিক মানুষটা নিজেকে দেখিয়ে বলল, কারণ ইন্টারফেসটা এরকম। একজন সহৃদয় মানুষ কথা বলছে। যে কোনো ভাষায় যে কোনো পরিবেশে। যে কোনো মানুষের। সাথে! যে কোনো বিষয়ে।
যাই হোক, তোমাকে যেটা বলছিলাম–দুই শ তিরিশ বছর আগে যখন পৃথিবীর সব মানুষ ইকুয়িনা ভাইরাসে মারা যেতে শুরু করেছিল, তখন কিছু বিজ্ঞানী তাদের জীবনের শেষ দুই সপ্তাহে পৃথিবীর পুরো সভ্যতা, পুরো জ্ঞানবিজ্ঞান ঢুকিয়ে এই পাহাড়ের মাঝে রেখে গেলেন। কিন্তু রেখে গেলে তো হবে না, যদি কিছু মানুষ বেঁচে যায় তাদেরকে এর কাছে। আনতে হবে, এটি দিয়ে পৃথিবীর লক্ষকোটি বছরের জ্ঞানবিজ্ঞান সভ্যতা শিক্ষা দিতে হবে। সেটা করবেন কী দিয়ে? কেউ কি বেঁচে থাকবে শেষ পর্যন্ত?
বিজ্ঞানীরা কিছু জানতেন না। তাই সারা পৃথিবীতে অসংখ্য যোগাযোগ মডিউল ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন। উপগ্রহ ব্যবহার করে সেগুলো সারা পৃথিবী থেকে সরাসরি এখানে যোগাযোগ করতে পারত। ছোট চৌকোনা বাক্সে একটা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে কিছু ছবি! প্রথম কয়েক মাস কোনো সাড়া পাওয়া গেল না, তারপর হঠাৎ করে এই ইন্টারফেসে যোগাযোগ। হতে শুরু করল–আমরা অবাক হয়ে দেখলাম যারা যোগাযোগ করছে তারা ছোট ঘোট শিশু!
আমরা সেই যোগাযোগ মডিউল ব্যবহার করে তাদের সাথে কথা বলতাম, তাদের সান্তনা দিতাম, সাহস দিতাম। বিপদে সাহায্য করতাম। ধীরে ধীরে শিশুগুলো বড় হতে লাগল, তাদের নিজেদের ব্যক্তিত্ব জন্ম হতে শুরু করল, দেখতে পেলাম তারা নিজেদের মাঝে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাটি করছে। তুচ্ছ কারণে খুনোখুনি শুরু করছে। তাদেরকে যে আবার সারা পৃথিবীর দায়িত্ব নিতে হবে সেটা তারা জানে না, সেটা তারা বুঝতে পারছে না।
তখন ধীরে ধীরে সেখানে নেতৃত্ব গড়ে উঠতে শুরু করল, পুরো দলের ভেতর সবচেয়ে যে কর্মক্ষম মানুষ সে পুরো দলটির দায়িত্ব নিতে শুরু করল, দলের মাঝে শৃঙ্খলা ফিলে এল! দলগুলো তখন গুছিয়ে নিয়েছে, বেঁচে থাকার নিয়মগুলো ধরে ফেলেছে। সারা পৃথিবীতে ছয় বিলিয়ন মানুষের সম্পদ ব্যবহার করছে কয়েক হাজার মানুষ তাদের প্রাচুর্যের কোনো অভাব নেই।
দেখতে দেখতে এই নেতৃত্ব তখন একটি ভিন্ন ধরনে পাল্টে যেতে রু করল। একটি দলে বা একটি কমিউনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হচ্ছে যোগাযোগ মডিউলের এই হলোগ্রাফিক ইন্টারফেস। দলের নেতারা সেই ইন্টারফেসটা নিজেদের মাঝে কুক্ষিগত করে ফেলল। বেঁচে থাকার জন্যে সবচেয়ে জরুরি জিনিস হচ্ছে তথ্য, সেই তথ্যটি পেতে পারে শুধুমাত্র দলের নেতা। কাজেই যারা নেতা তাদের ক্ষমতা আকাশচুম্বী হতে রু করল। ধীরে ধীরে তারা নিজেদের ঈশ্বর বলে ভাবতে শুরু করে দিল।
আগে নেতৃত্ব দিত যারা সত্যিকারের নেতা তারা। একবার নিজেদের ঈশ্বর বলে ভাবতে শুরু করার পর সেই ব্যাপারটি আর তা থাকল না–একজন ঈশ্বরের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে কে হবে পরের ঈশ্বর। নেতৃত্ব আসতে শুরু করল অযোগ্য মানুষের ওপর। মানুষের সমাজে কমিউনগুলোতে তখন সমস্যা দেখা দিতে শুরু করল। তারা কুসংস্কারে বিশ্বাস করতে প্রু করল, স্বার্থপর হয়ে যেতে লাগল।
আমরা ইচ্ছে করলে সে জায়গায় হস্তক্ষেপ করতে পারতাম কিন্তু করি নি। স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে দিয়েছি। তবে একটা ব্যাপার করেছি। পৃথিবীর যত মানুষের যত দল আছে, যত কমিউন আছে তাদেরকে ধীরে ধীরে এই এলাকায় নিয়ে আসতে শুরু করেছি। ধীরে ধীরে তারা এখানে এসে জড়ো হয়েছে।
রিহান জিজ্ঞেস করল, তাদেরকে কীভাবে এখানে এনেছ?
হলোগ্রাফিক মানুষটি হেসে বলল, যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল করে দিতাম, ভালো সিগন্যালের জন্যে ছোটাছুটি করত– যেখানে আনতে চাই সেখানে আসার পর পুরো সিগন্যাল পাঠাতাম।
ঈশ্বরেরা কিছু বুঝতে পারত না?
না। তারা জানে পুরো ব্যাপারটা ঐশ্বরিক। পুরো ব্যাপারটা অলৌকিক।
রিহান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি তা হলে ঠিকই অনুমান করেছিলাম।
হ্যাঁ। তুমি ঠিকই অনুমান করেছিলে। আমরা তোমার মতো একজন মানুষের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। যে নূতন করে নেতৃত্ব নেবে। সার্বিকভাবে নেতৃত্ব নেবে।
নেতৃত্ব? রিহান অবাক হয়ে হলোগ্রাফিক মানুষটির দিকে তাকাল।
হ্যাঁ। নেতৃত্ব।
আমি নেতৃত্ব দেব?
হ্যাঁ। তুমি নেতৃত্ব দেবে। যে মানুষ আমাদের খুঁজে বের করতে পারবে সে হচ্ছে সঠিক মানুষ।
না।
হলোগ্রাফিক মানুষ অবাক হয়ে বলল, না!
আমি তো নেতৃত্ব দিতে আসি নি।
তুমি কেন এসেছ?
আমি একটা মেয়েকে উদ্ধার করতে এসেছি। মেয়েটির নাম প্রিমা। বাচ্চা একটি মেয়ে, অসহায় দুঃখী একটা মেয়ে। তাকে সবাই মিলে ধরে নিয়ে গেছে।
হলোগ্রাফিক মানুষ অবাক হয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে থাকে। রিহান মানুষটির দৃষ্টি এড়িয়ে বলল, আমার এখন নিজেকে ধরা দিতে হবে। নিজেকে ধরা দিয়ে প্রিমাকে মুক্ত করতে হবে।
হলোগ্রাফিক মানুষটি তখনো এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে রিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। রিহান কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবল, তারপর সোজা হয়ে বসে মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবে?
মানুষটি শব্দ করে হেসে বলল, তুমি কী রকম সাহায্য চাও রিহান? এখানে সবকিছু আছে, বিজ্ঞানের সবচেয়ে চমকপ্রদ আবিষ্কার মানুষের জন্যে এখানে রাখা আছে। বলো তুমি কী চাও? বলো–