ঈশিতা বলল, ইন্টারেস্টিং!
হ্যাঁ। খুবই ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। চলেন গিয়ে শুনি আজকে কী নিয়ে কথা বলছে!
রাফি ঈশিতাকে নিয়ে এগিয়ে গেল, টংয়ের বেঞ্চে সমীর বসে আছে। সে হাত নেড়ে কথা বলছে এবং তাকে ঘিরে একটু জটলা। সবার মুখেই এক ধরনের হাসি, কেউ সেটা গোপন করার চেষ্টা করছে, কেউ করছে না। সমীর গলা উঁচিয়ে বলল, তোমরা হাসছ? আমার কথা শুনে তোমরা হাসছ?
একজন তার মুখের হাসিকে আরও বিস্তৃত করে বলল, কে বলল আমি হাসছি? মোটেই হাসছি না।
তোমরা আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ? তোমরা ভাবছ, আমি শুধু শুধু ভয় দেখাচ্ছি?
আরেকজন বলল, না সমীর! আমরা মোটেও সেটা ভাবছি না। আমরা সবাই জানি তুমি খুবই সিরিয়াস মানুষ।
সমীর বলল, আমার কথা বিশ্বাস না করলে তোমরা আজকের খবরের কাগজ দেখো। টিঅ্যান্ডটি বস্তি থেকে দশটা বাচ্চাকে মেডিকেলে নিয়েছে—পাঁচজনের ব্রেন হেমারেজ। একজন অলরেডি ডেড। একজন ডিপ কোমায়। ড়ু ইউ থিংক—এগুলো এমনি এমনি হচ্ছে?
রাফি জিজ্ঞেস করল, কীভাবে হচ্ছে?
ভাইরাস অ্যাটাক। আমি বলেছিলাম খুব খারাপ একটা ভাইরাস এসেছে। আমাদের দেশের জন্য ডেঞ্জারাস। যে সিম্পটমগুলো পড়েছি সেগুলো হুঁবহুঁ মিলে যাচ্ছে। কেউ নজর দিচ্ছে না। মিডিয়ার অনেক সিরিয়াসলি নেওয়া দরকার।
রাফি ঈশিতাকে দেখিয়ে বলল, সমীর, এর নাম ঈশিতা। খবরের কাগজের লোক। ওকে ভালো করে বুঝিয়ে দাও—খবরের কাগজে ফাটাফাটি রিপোর্টিং করে দেবে।
সমীর ভুরু কুঁচকে বলল, আপনি সাংবাদিক?
হ্যাঁ।
তাহলে আপনারা চুপচাপ বসে আছেন কেন? কেউ কিছু বোঝার আগেই তো সব সাফ হয়ে যাবে। কী ডেঞ্জারাস ভাইরাস আপনি জানেন?
ঈশিতা ইতস্তত করে বলল, আমরা কী করব?
সত্যি কথাটা জানাবেন। সবাইকে বলবেন বাংলাদেশ এখন ভীষণ একটা বিপদের মধ্যে আছে। টিঅ্যান্ডটি বস্তির বাচ্চাগুলো কোনো র্যান্ডম অসুখে অসুস্থ হয়নি। তারাসেই ভাইরাসে ইনফেক্টেড। এ মুহূর্তে যদি কোয়ারেন্টাইন করে প্রটেকশন না দেওয়া হয়, সর্বনাশ হয়ে যাবে!
ঈশিতা তার পকেট থেকে একটা নোট বই বের করে বলল, ভাইরাসটার নাম কী?
এখনো ফরমাল নাম দেয়নি। এটাকে বলছে এফটি টুয়েন্টি সিক্স। আপনাকে আমি ওয়েব লিংক দিতে পারি, সব ইনফরমেশন পেয়ে যাবেন।
ভেরি গুড। আমি কি আপনাকে রেফারেন্স দিয়ে রিপোর্ট করতে পারি?
সমীর হা হা করে হাসল। সে যে হাসতে পারে সেটা অনেকেই জানত না, তাই আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকেই একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। সমীর যেভাবে হাসিটা হঠাৎ করে শুরু করেছিল, ঠিক সেভাবে হঠাৎ করে থামিয়ে বলল, আমি মফস্বলের একটা ইউনিভার্সিটির ফালতু একটা লেকচারার। আমার রেফারেন্স দিয়ে কী লাভ? কে আমার কথা বিশ্বাস করবে? আমার কলিগরাই বিশ্বাস করছে না, আর দেশের পাবলিক বিশ্বাস করবে?
ঈশিতা বলল, বিশ্বাস করা না করা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না! আপনি যখন প্রথম এই কথাটা বলছেন, সেটা ডকুমেন্টেড থাকুক। যদি দেখা যায় আসলেই আপনার আশঙ্কা সত্যি, তাহলে আপনার ক্রেডিবিলিটি এস্টাবলিশড হবে!
সমীর মুখ গম্ভীর করে বলল, ঠিক আছে!
ঈশিতা ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে বলল, আপনার কয়েকটা ছবি তুলি?
তুলবেন? তুলেন।
সমীরকে ঘিরে দাঁড়ানো সবাই তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতে লাগল এবং তার মধ্যে ঈশিতা তার ক্যামেরা দিয়ে খ্যাঁচ খ্যাঁচ করে অনেকগুলো ছবি তুলে ফেলল। ছবি তোলা শেষ করে ঈশিতা তার নোট বই নিয়ে সমীরের পাশে বসে তার সঙ্গে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কথা বলে। এত দিন পর সত্যিকারের একজন শ্রোতা পেয়ে সমীর টানা কথা বলে যেতে থাকে। তাকে দেখে মন হয়, সে বুঝি নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্যও একটু বিরতি দেবে না!
দুই দিন পর খবরের কাগজে সমীরের ভাইরাস এফটি টুয়েন্টি সিক্সের ওপর বিশাল প্রতিবেদন বের হলো। খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় সমীরের ছবি। ঈশিতা খুব গুছিয়ে রিপোর্টিং করেছে, সারা দিন সমীরের কাছে টেলিফোন এল, বিকেলের দিকে একটা টেলিভিশন চ্যানেল পর্যন্ত চলে এল।
পরদিন ভোরে রাফি ক্লাসে যাওয়ার জন্য তার লেকচার ঠিক করছে, তখন সমীর এসে হাজির। তার উসকোখুসকো চুল, চোখের নিচে কালি এবং শুকনো মুখ। রাফি অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে সমীর?
সমীর জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজানোর চেষ্টা করে নিচু গলায় বলল, দরজাটা বন্ধ করি?
দরজা বন্ধ করবে? রাফি কারণটা জানতে চাইতে গিয়ে থেমে গিয়ে বলল, করো।
সমীর দরজা বন্ধ করে রাফির খুব কাছাকাছি এসে বসে ভাঙা গলায়। বলল, আমি খুব বিপদে পড়েছি।
কী বিপদ?
গতকাল এফটি টুয়েন্টি সিক্সের খবর বের হয়েছে—
হ্যাঁ দেখেছি। চমৎকার রিপোর্টিং—
চমকারের খেতা পুড়ি।
কেন, কী হয়েছে?
রাতে এগারোটার সময় আমার বাসায় দুজন লোক এসেছে। লম্বাচওড়া, চুল ছোট করে ছাঁটা। একজন মাঝবয়সী, আরেকজন একটু কম। দুজনেরই সাফারি কোট। এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, এই বাসায় আর কে থাকে? আমি বললাম, আর কেউ থাকে না। তখন লোকগুলো দুইটা চেয়ারে বসল। একজন পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে টেবিলে রাখল।
রাফি চমকে উঠে বলল, পিস্তল?
হ্যাঁ। আরেকজন আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে আমার ঘাড়ে একটা হাত দিয়ে বলল, মালাউনের বাচ্চা, তুমি তোমার বাপের দেশে না গিয়ে এই দেশে পড়ে আছো কেন?
আমি বললাম, এইটাই আমার বাপদাদা চৌদ্দগুষ্টির দেশ। তখন লোকটা রিভলবারটা হাতে নিয়ে আমার কপালে ধরে বলল, এইটা যদি তোমার বাপের দেশ হয় তাহলে এই দেশের নিয়ম মেনে চলতে হবে। আমি বললাম, এই দেশের নিয়ম কী? লোকটা বলল, বেদরকারি কথা বলবা না। আমি বললাম, বেদরকারি কথাটা কী? লোকটা বলল, ভাইরাসের কথাটা হচ্ছে বেকারি, ফালতু কথা। খামোখা মানুষকে ভয় দেখানোর কথা।