- বইয়ের নামঃ প্রজেক্ট নেবুলা
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. সন্ধে থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি
প্রজেক্ট নেবুলা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
সন্ধে থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল, হঠাৎ করে বৃষ্টিটা চেপে এল। জব্বার নিচু গলায় একটা অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করে উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারটা আরেকটু দ্রুত করে দেয়। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে ওয়াইপার দুটো গাড়ির কাচ পরিষ্কার করতে থাকে কিন্তু অন্ধকার দুর্যোগময় রাতে সেটা খুব কাজে আসে না, গাড়ির হেডলাইট মনে হয় সামনের অন্ধকারকে আরো জমাট বাঁধিয়ে দিচ্ছে। রাস্তার অন্যদিক থেকে দৈত্যের মতো একটা ট্রাক চোখ ধাঁধানো। হেডলাইট জ্বালিয়ে প্রচণ্ড গর্জন করে বিপজ্জনকভাবে পাশ কাটিয়ে গেল–পানির ঝাঁপটায় গাড়ির কাচ মুহূর্তের জন্য অন্ধকার হয়ে যায়, প্যাসেঞ্জার সিটে বসে থাকা দবির কব্জির কাছে কাটা হাতটি সামনে এগিয়ে অদৃশ্য কিছু একটা ধরে ফেলার ভঙ্গি করে বিরক্ত হয়ে বলল, আস্তে, জব্বার আস্তে।
জব্বার অন্ধকারে দেখা যায় না এরকম একটা রিকশা ভ্যানকে পাশ কাটিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল, ভয় পাবেন না ওস্তাদ। আমি কালা জব্বার।
দবির শীতল গলায় বলল, সেইটাই ভয়।
কেন ওস্তাদ। এইটা কেন বললেন?
বলছি কারণ তোর কোনো কাণ্ডজ্ঞান নাই।
জব্বার আড়চোখে দবিরের মুখটা দেখার চেষ্টা করে বোঝার চেষ্টা করল দবির এটা ঠাট্টা করে বলেছে কি না। অন্ধকারে দবিরের মুখ দেখা যাচ্ছিল না তাই সে ঠিক বুঝতে পারল না। তবুও সে কথাটাকে একটা হালকা রসিকতা হিসেবে ধরে নিয়ে প্রয়োজন থেকে জোরে শব্দ করে হেসে বলল, ওস্তাদ, আমার হাতে স্টিয়ারিং হুইল কখনো বেইমানি করে নাই।
দবির দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তা হলে কোনটা বেইমানি করেছে?
জব্বার ভিতরে ভিতরে চমকে ওঠে, হঠাৎ করে ভয়ের একটা শীতল স্রোত তার মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যায়। প্যাসেঞ্জার সিটে বসে থাকা ছোটখাটো এই মানুষটি–যার বাম হাতটি কব্জি থেকে কাটা, শহরতলি এলাকায় কব্জি কাটা দবির নামে কুখ্যাত, মানুষটির নিষ্ঠুরতার কথা অপরাধীদের অন্ধকার জগতে সুপরিচিত। অন্ধকার জগতে টিকে থাকার একেবারে আদিম পন্থাটি মাত্র কয়েক বছরে কব্জি কাটা দবিরকে তার সাম্রাজ্যের অলিখিত সম্রাটে পরিণত করে ফেলেছে–দবির তার প্রতিপক্ষকে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ দেয় না। জব্বার দবিরের প্রতিপক্ষ নয়, তার বিশ্বস্ত অনুচর কিন্তু সেই বিশ্বস্ততার হিসাবটুকু দবিরের কাছে যথেষ্ট কি না সে ব্যাপারে জব্বার পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। জব্বার শুকনো গলায় বলল, কী বললেন ওস্তাদ?
কিছু বলি নাই।
জব্বার আর কোনো কথা বলল না, কব্জি কাটা দবিরকে ঘাঁটানোর মতো দুঃসাহস তার নেই। সামনে থেকে ছুটে আসা আরেকটা ভয়ঙ্কর ট্রাককে পাশ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করল, আর কত দূর যাবেন ওস্তাদ?
দবির অনিশ্চিতের মতো হাত নেড়ে তার ভালো হাতটি দিয়ে সিটের নিচে থেকে একটা চ্যাপটা বোতল বের করে দাঁত দিয়ে কামড়ে তার ছিপিটা খুলে ফেলল। প্রায় আধযুগ আগে ঘরে বানানো বোমার বিস্ফোরণে বাম হাতটি উড়ে যাবার পর থেকে সব কাজই তার এক হাতেই করতে হয়। এক হাতে সব কাজ সে এত নৈপুণ্যের সাথে করতে পারে যে কব্জি কাটা দবিরকে দেখলে মনে হতে পারে মানুষের দ্বিতীয় হাতটি একটি বাহুল্য।
দবির বোতল থেকে ঢকঢক করে খানিকটা হুইস্কি গলায় ঢেলে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে বোতলটা জব্বারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে।
জব্বার নিজের ভিতরে এক ধরনের তৃষ্ণা অনুভব করল কিন্তু সে বোতলটা ধরল না। মাথা নেড়ে বলল, এখন খাব না ওস্তাদ।
দবির ভুরু কুঁচকে জব্বারের দিকে তাকাল, জম্বার তাড়াতাড়ি অনেকটা কৈফিয়ত দেওয়ার মতো বলল, গাড়ির টায়ার স্লিপ কাটছে, এখন মাল খাব না ওস্তাদ। মাল খেলে গাড়ি চালাতে পারব না।
দবির মুখ শক্ত করে বলল, তোকে নেশা করতেকে বলেছে? খা। এক ঢোক খা।
গলায় আপ্যায়নের সুর নেই, এটি রীতিমত আদেশ। কাজেই জব্বার এক হাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে অন্য হাতে বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে গলায় খানিকটা তরল ঢেলে দেয়। বোতলটি ফিরিয়ে দিতে গিয়ে আবিষ্কার করল দবির জানালা দিয়ে চিন্তিত মুখে বাইরে তাকিয়ে আছে। জব্বার আবার এক ধরনের ভীতি অনুভব করে, কারণটি জানা নেই বলে ভীতিটিকে তার কাছে অশুভ বলে মনে হতে থাকে।
আরো মিনিট পনের নিঃশব্দে গাড়ি চালানোর পর হঠাৎ করে বৃষ্টিটা একটু ধরে এল, দবির জানালা পুরোপুরি নামিয়ে দিতেই গাড়ির ভিতরে বাতাসের ঝাঁপটা এসে ঢুকল। অনেক রাত, রাস্তায় গাড়ি খুব বেশি নেই, রাতের ট্রাকগুলো হঠাৎ করে সশব্দে ছুটে যাচ্ছে। রাস্তার দুই পাশে নিচু জমিতে পানি জমেছে, দেখে মনে হয় সুবিশাল হ্রদ। রাতের অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছে না, দিনের বেলা পুরো এলাকাটিকে খুব মনোরম মনে হয়, শহরের অবস্থাপন্ন মানুষেরা গাড়ি করে এখানে বেড়াতে আসে।
দবির গাড়ির ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে বলল, গাড়িটা থামা।
অজানা আশঙ্কায় আবারের বুক কেঁপে ওঠে। সে শুকনো গলায় বলল, থামাব?
হ্যাঁ।
অন্ধকার রাতে এই নির্জন জায়গায় কেন রাস্তার পাশে গাড়ি থামাবে–জব্বার বুঝতে পারল না, কিন্তু তার কারণটি জানার সাহস হল না। সে তবুও দুর্বল গলায় বলল, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।
দবির খেঁকিয়ে উঠে বলল, বৃষ্টি পড়বে না তো কি রসগোল্লার সিরা পড়বে?
জব্বার আর কিছু বলার সাহস পেল না, সে সাবধানে রাস্তার পাশে গাড়িটার গতি কমিয়ে থামিয়ে ফেলল। ইঞ্জিনটা বন্ধ করবে কি না বুঝতে পারছিল না। দবিরের দিকে তাকাতেই সে বলল, ডিকি খোল। দুইটা প্যাকেট আছে, প্যাকেট দুইটা নামা।
জব্বার তখন ইঞ্জিনটা বন্ধ করে দেয়, ডিকি খুলতে গাড়ির চাবি লাগবে। অন্ধকারে তার ভুরু কুঞ্চিত হয়ে উঠল। গাড়ির পিছনে কোনো প্যাকেট থাকার কথা নয়, দবির ঠিক কী চাইছে? অন্ধকার জগতের প্রাণীর মতো হঠাৎ করে সে সতর্ক হয়ে যায়। সে সাবধানে গাড়ির ডিকি খুলল এবং চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেল দবিরও দরজা খুলে নেমে আসছে। ডিকির ভিতরে কিছু জঞ্জাল–কোনো প্যাকেট নেই, জব্বার সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়াল এবং হঠাৎ করে তার সমস্ত শরীর শীতল হয়ে এল। এবারের দুই হাত পিছনে দবির তার ভালো হাত দিয়ে একটা বেঁটে রিভলবার ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে ভালো দেখা যায় না কিন্তু জব্বারের এটি চিনতে অসুবিধে হল না, মাত্র এক সপ্তাহ আগে একটা টেন্ডারের বখরা নিয়ে গোলমালের কারণে দবির এই বেঁটে রিভলবার দিয়ে ট্যারা রতনকে পরপর ছয়বার গুলি করে মেরেছে। প্রথম গুলিটি ছিল হত্যাকাণ্ডের জন্য, বাকি পাঁচটি ছিল শুধুমাত্র মজা করার জন্য। জব্বার হঠাৎ করে বুঝতে পারল তার গৌরবহীন ক্ষুদ্র জীবনটি এই অন্ধকার রাতে রাস্তার পাশে কাদা মাটিতে শেষ হয়ে যাবে। দবিরের বিশ্বস্ত অনুচর হিসেবে সে অসংখ্যবার দবিরকে শীতল চোখে এবং কঠিন মুখে হাতে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়াতে দেখেছে–তখন তার মুখের অভিব্যক্তিটি নিষ্ঠুর না হয়ে কেমন যেন বিষণ্ণ মনে হয়। অন্ধকারে দবিরের মুখটি দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু জব্বর জানে এখন তার মুখে এক ধরনের বিষণ্ণতা এসেছে।
জব্বার পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছিল না, ভাঙ্গা গলায় বলল, আমি কী করেছি। ওস্তাদ?
তুই খুব ভালো করে জানিস তুই কী করেছিস।
আমি জানি না–আল্লাহর কসম।
চুপ কর হারামজাদা–এখানে আল্লাহকে টেনে আনবি না।
বিশ্বাস করেন ওস্তাদ–আপনি বিশ্বাস করেন।
কে বলেছে আমি তোর কথা বিশ্বাস করি নাই? অবশ্যই করেছি, সেই জন্য তোরে আমি কোনো কষ্ট দিব না। তুই ঘুরে দাঁড়া, পিছন থেকে মাথায় গুলি করে ফিনিশ করে দিব। তুই টেরও পাবি না।
জব্বারের সামনে হঠাৎ করে সমস্ত জগৎ–সংসার অর্থহীন হয়ে গেল, সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছে না, মনে হচ্ছে সময় যেন স্থির হয়ে গেছে। দবিরের প্রত্যেকটি কথা যেন অন্য কোনো জগৎ থেকে খুব ধীরে ধীরে ভেসে আসছে, আদি নেই, অন্ত নেই, শুরু নেই, শেষ নেই– বিস্ময়কর এক অতিপ্রাকৃত জগৎ।
হঠাৎ করে সমস্ত আকাশ চিরে একটি নীল বিদ্যুৎঝলক ছুটে এল, কিছু বোঝার আগে তীব্র আলোতে চারদিক দিনের মতো আলোকিত হয়ে যায়। বাতাস কেটে কিছু একটা ছুটে যাবার শব্দ হল, জব্বার দেখতে পায় দবির বিস্ময়ে হতচকিত হয়ে এক মুহূর্তের জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা দেখছে। কী দেখছে সে জানে না, তার এই মুহূর্তে জানার কোনো কৌতূহলও নেই। দবিরের এক মুহূর্তের জন্য হতচকিত হওয়ার সুযোগে জব্বার তার ওপর সমস্ত শক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে দবিরের মুখে আঘাত করে তাকে নিচে ফেলে দিল। দবিরের হাত থেকে রিভলবারটি ছিটকে পড়ে গেছে, জব্বার সেই সুযোগে দবিরের বুকের ওপর চেপে বসে আবার তার মুখে আঘাত করে। অন্ধকারে দেখা যায় না। কিন্তু দবিরের নাক দিয়ে রক্ত বের হয়ে জব্বারের হাত চটচটে হয়ে যায়।
জব্বার অমানুষিক নিষ্ঠুরতায় দবিরকে আঘাত করতে করতে একটি হাত দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে রিভলবারটি খুঁজে বের করে ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে সেটা হাতে নিয়ে সরে দাঁড়াল। দবির কাটা হাতটি দিয়ে মুখ মুছে সোজা হয়ে বসে প্রথমে জব্বারের দিকে তারপর পিছনে দূরে তাকাল।
জব্বারও দবিরের দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকাল, নীল আলোর ছটা ছড়িয়ে যে বিচিত্র জিনিসটি নেমে এসেছে সেটি পানিতে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। জব্বার নিরাপত্তার জন্য আবার ঘুরে দবিরের দিকে তাকাল বলে দেখতে পেল না বিচিত্র জিনিসটির উপরের অংশ খুলে গেছে এবং সেখান থেকে ধাতব পিচ্ছিল এক ধরনের ঘিনঘিনে প্রাণী বের হয়ে আসছে। দবির বিস্ফারিত চোখে সেই প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে রইল এবং জব্বারের গুলিতে তার মস্তিষ্ক চূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও তার মুখ থেকে সেই বিস্ময়াভিভূত ভাবটি সরে গেল না।
জব্বার রিভলবারের পুরো ম্যাগাজিনটি দবিরের ওপর খালি করল–এই মানুষটিকে সে জীবন্ত অবস্থায় বিশ্বাস করে নি, মৃত অবস্থাতেও তাকে সে বিশ্বাস করে না।
জব্বার রিভলবারটি প্যান্টে খুঁজে নিয়ে টলতে টলতে গাড়িতে ফিরে গিয়ে হাতড়ে হাতড়ে চ্যাপ্টা বোতলটা বের করে ঢকঢক করে তার অর্ধেকটা খালি করে দেয়। খুব ধীরে ধীরে তার স্নায়ু শীতল হয়ে আসছে, এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না শহরতলির ত্রাস অন্ধকার জগতের একচ্ছত্র অধিপতি কব্জি কাটা দবিরকে সে নিজে খুন করে ফেলেছে। বিচিত্র একটা আলোর ঝলকানি দিয়ে আকাশ থেকে কিছু একটা নেমে এসেছে, সেটি কী সে জানে না। সেই মুহূর্তে আকাশ থেকে সেটি নেমে না এলে কেউ তাকে তার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারত না। জব্বার পুরো ব্যাপারটা নিয়ে এখন চিন্তা করতে পারছে না, দবিরের। মৃতদেহটি পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে তার এখন ফিরে যেতে হবে–আকাশ থেকে নেমে আসা জিনিসটা কাছাকাছি পানিতে ডুবে গেছে, তার গুলির শব্দও নিশ্চয়ই শোনা গেছে; কৌতূহলী মানুষ এসে যেতে পারে। রাস্তা দিয়ে মাঝে মাঝে ট্রাক ছুটে যাচ্ছে, কোনো একটি ট্রাক থেমে গেলেই বিপদ হয়ে যাবে। জব্বারকে এখনই উঠতে হবে কিন্তু সে উঠতে পারছে না। এক বিচিত্র ক্লান্তিতে তার শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে। জব্বার চ্যাপ্টা বোতল থেকে পানীয়টুকু আবার গলায় ঢেলে শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করতে থাকে।
জব্বার গাড়িতে বসে ছিল বলে জানতে পারল না আকাশ থেকে নেমে আসা সেই বিচিত্র মহাকাশযান থেকে একটি বিচিত্র প্রাণী গড়িয়ে গড়িয়ে দবিরের মৃতদেহের কাছে এসে তার বুক চিরে ভিতরে প্রবেশ করেছে। আবার দেখতে পেলেও সম্ভবত নিজের চোখকে বিশ্বাস করত না, কারণ হঠাৎ করে দবিরের চোখ দুটো লাল আলোর মতো জ্বলে উঠল। তার কাটা হাতের ভিতর থেকে একটা যান্ত্রিক হাত গজিয়ে যায় এবং চূর্ণ হয়ে যাওয়া মস্তিষ্কের ভিতর। থেকে ধাতব টিউবের মতো কিছু জিনিস সস শব্দ করে বের হয়ে আসে। দবিরের চেহারা পরিবর্তিত হয়ে সেটা খানিকটা পশু এবং খানিকটা যন্ত্রের মতো হয়ে যায়, মৃতদেহটি হঠাৎ নড়ে উঠল এবং বিচিত্র একটি যান্ত্রিক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। দবিরের দেহটি খুব সাবধানে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ছোট শিশুর মতো পা ফেলে হাঁটার চেষ্টা করে পানির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
জব্বার শেষ পর্যন্ত সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং টলতে টলতে গাড়ি থেকে বের হয়ে এল। যেখানে দবিরের মৃতদেহটি পড়ে ছিল সেখানে কিছু নেই। জম্বার বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে, তার যতটুকু অবাক হওয়ার কথা কোনো একটি বিচিত্র কারণে সে ততটুকু অবাক হতে পারছে না। খসখস করে কাছাকাছি একটা শব্দ হল, জব্বার মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে তার পিছনেই দবির দাঁড়িয়ে আছে। জব্বার রক্তশূন্য মুখে দবিরের দিকে তাকিয়ে থাকে, দবিরের চোখ দুটো অঙ্গারের মতো জ্বলছে, অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায় না কিন্তু মনে হচ্ছে মাথা থেকে সাপের মতো কিলবিলে কিছু একটা বের হয়ে এসেছে। সমস্ত শরীরে একটি বিচিত্র ধাতব আবরণ। দবির খুব ধীরে ধীরে তার কাটা হাতটি উঁচু করল, জব্বার দেখতে পেল সেখান থেকে একটি ধাতব হাত বের হয়ে এসেছে, হাতটি সরসর শব্দ করে আরো খানিকটা বের হয়ে আসে এবং হঠাৎ করে তার ভিতর থেকে বিদ্যুৎঝলকের মতো কিছু একটা জব্বারের দিকে ছুটে বের হয়ে এল।
কী হয়েছে জব্বার কিছু বুঝতে পারল না। সমস্ত শরীর কুঁকড়ে সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, তার শরীর মাটি স্পর্শ করার আগেই তার মৃত্যু ঘটে গেল বলে সে যন্ত্রণাটুকুও অনুভব করতে পারল না। সে বেঁচে থাকলেও তার অমার্জিত, নির্বোধ মস্তিষ্ক ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারত না যে একটি মহাজাগতিক প্রাণী পৃথিবীতে এসে নিজের আশ্রয় বেছে নিয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণিজগৎ হঠাৎ করে কী ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে সেটি বোঝার মতো ক্ষমতা জব্বারের ছিল না।
০২. নিশীতা ক্যামেরা হাতে
নিশীতা ক্যামেরা হাতে এগিয়ে যেতেই পুলিশ হাত উঁচু করে তাকে থামাল, কোথায় যান?
নিশীতা সামনে ভেজা মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা জব্বারের মৃতদেহটিকে দেখিয়ে বলল, ছবি তুলব।
পুলিশটি মুখ শক্ত করে বলল, কাছে যাওয়া নিষেধ।
নিশীতা কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে পুলিশটির চোখের সামনে দিয়ে নাড়িয়ে নিয়ে এসে বলল, আমি সাংবাদিক। তারপর তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রায় ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে গেল। পুলিশটি প্রায় হা–হা করে পিছন থেকে ছুটে এল কিন্তু কম বয়সী একটা মেয়েকে ধরে ফেলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারল না। ততক্ষণে নিশীতা জব্বারের মৃতদেহের কাছে পৌঁছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে তার ডিজিটাল ক্যামেরায় ঝটপট কয়টা ছবি তুলে নিয়েছে। পুলিশটি কাছে এসে চিৎকার করে বলল, আমি বললাম না, কাছে যাওয়া নিষেধ!
নিশীতা পুড়ে কুঁকড়ে যাওয়া জব্বারের মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে বলল, এই মানুষটার নাম কালা জব্বার?
পুলিশটা হাত নেড়ে বলল, আপনাকে আমি কী বললাম?
সাথে কব্জি কাটা দবির ছিল, তাকে পাওয়া গেছে?
সরে যান–সরে যান এখান থেকে।
নিশীতা ক্যামেরাটি দিয়ে ঘ্যাচঘ্যাচ করে পুলিশটির দুটি ছবি তুলে নিল। ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে ফিল্ম খরচ হয় না বলে নিশীতা কখনো ছবি তুলতে কার্পণ্য করে না। পুলিশটি রুষ্ট হয়ে বলল, কী হল? আমার ছবি তুলছেন কেন?
পত্রিকায় নিউজ হবে। সাংবাদিক হয়রানি।
সাংবাদিক হয়রানি?
হ্যাঁ। সাংবাদিক হয়রানি এবং তথ্য গোপন। এটা স্বাধীন দেশ–স্বাধীন দেশে কোনো তথ্য গোপন রাখা যাবে না।
পুলিশটি মাথা নেড়ে বলল, আমি এত কিছু জানি না– আমাকে অর্ডার দেওয়া হয়েছে কেউ যেন কাছে না আসে। যদি কথা বলতে চান তা হলে বড় সাহেবের সাথে কথা বলবেন।
বলবই তো। অবশ্যই বলব– বলে নিশীতা মুখ গম্ভীর করে এগিয়ে গেল, তবে পুলিশের বড় সাহেবের কাছে নয়–দূরে জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মানুষের কাছে। কাল রাতে এই এলাকায় বিদ্যুঝলকের মতো একটা নীল আলোর ঝলকানি দেখা গেছে বলে শোনা যাচ্ছে, ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল–বজ্রপাত তো হতেই পারে। তবে আলোর ঝলকানিটি নাকি বজ্রপাতের মতো ছিল না, সোজা আকাশ থেকে একটা সরলরেখার মতো নিচে নেমে এসেছে।
নিশীতাকে হেঁটে আসতে দেখে জটলা পাকানো মানুষগুলো একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল। নিশীতার আজকাল অভ্যাস হয়ে গেছে–সে যখন মোটর সাইকেলে করে শার্টপ্যান্ট পরে ছুটে বেড়ায় অনেকেই নড়েচড়ে দাঁড়ায়, ভুরু কুঁচকে তাকায়।
নিশীতা কাছে গিয়ে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে দাঁড়াল, আপনাদের একটা ছবি তুলতে পারি?
মানুষগুলোর অনেকের মুখে হাসি ফুটে উঠল। কী কারণ কে জানে ছবি তোলার কথা বললেই মানুষ খুশি হয়ে ওঠে। কমবয়সী একজন জিজ্ঞেস করল, কী করবেন ছবি দিয়ে?
ফাইলে রাখব। কখন কী কাজে লাগে কে জানে। মনে হচ্ছে আপনাদের এলাকাটা খুব ইম্পরট্যান্ট হয়ে যাবে।
মানুষগুলোকে এবারে কৌতূহলী দেখা গেল, কমবয়সী মানুষটি জিজ্ঞেস করল, কেন আপা? ইম্পরট্যান্ট কেন হবে?
নিশীতা হাত দিয়ে দূরে পড়ে থাকা জব্বারের মৃতদেহটি দেখিয়ে বলল, ঐ যে দেখেন, মানুষটি কীভাবে মারা গেছে সেটা একটা রহস্য। শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, দেখে মনে হয় পুড়ে ঝলসে গেছে, বজ্রপাত হলে যেরকম হয়। কিন্তু কেউ বজ্রপাতের শব্দ শোনে নি। শুনেছেন আপনারা?
না। মানুষগুলো মাথা নাড়ল, কেউ শোনে নি।
নিশীতা মাথা ঘুরে তাকাল, বলল, বজ্রপাত হয় সবচেয়ে উঁচু জায়গায়–এই এখানে উঁচু জায়গা হচ্ছে এই লাইটপোস্ট–বজ্রপাত হলে ইলেকট্রিসিটি বন্ধ হয়ে যেত, লাইট ফিউজড হত, কিছু হয় নাই। রহস্য এবং রহস্য।
বুড়ো মতন একজন মানুষ বলল, আসলে এই জায়গাটার একটা দোষ আছে।
দোষ?
জে। প্রত্যেক বছর এক জন মানুষ মারা যায়।
এই জায়গায়?
এই আশপাশে। গেল বছর একটা ট্রাক এসে ধাক্কা দিল নজর আলীর ছোট ছেলেকে।
বুড়ো মতন মানুষটি ট্রাকের ধাক্কায় কীভাবে নজর আলীর ছোট ছেলের শরীর থেতলে গেল তার পুখানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে থাকে, শুনে নিশীতার শরীর গুলিয়ে আসতে চায়। নিশীতা তবু ধৈর্য ধরে মুখে আগ্রহ ধরে রেখে বর্ণনাটি শুনতে থাকে, মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য। হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে আগ্রহ নিয়ে তাদের কথা শোনা। নিশীতা লক্ষ করে অন্যেরাও কিছু না কিছু বলতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। সে ব্যাগ থেকে ছোট একটা নোট বই বের করে নেয়, সাংবাদিকসুলভ একটি ভাব ফুটিয়ে সেখানে কিছু কিছু জিনিস লিখে রাখার। ভান করতে হবে। মানুষগুলো একটু সহজ হলে কাজও অনেক সহজ হয়ে যায়।
দৈনিক বাংলাদেশ পরিক্রমার সম্পাদক মোজাম্মেল হকের সামনে নিশীতা অধৈর্য মুখে বসে আছে। তার পাশে দৈনিক পত্রিকার আরো দুজন সিনিয়র সাংবাদিক–মোহাম্মদ বোরহান এবং শ্যামল দে। মোজাম্মেল হক হাতের বল পয়েন্ট কলমটি অন্যমনস্কভাবে টেবিলে ঠুকতে ঠুকতে বললেন, উঁহু নিশীতা এটা তোমার জন্য নয়।
নিশীতা সোজা হয়ে বসে বলল, কেন নয়?
কব্জি কাটা দবির, কালা জব্বার এই রকম চরিত্রগুলো থেকে পুলিশেরাও দূরে থাকে। তুমি সাংবাদিক–ঠিক করে বললে বলতে হয় মহিলা সাংবাদিক। তোমার আরো বেশি দূরে থাকা দরকার।
নিশীতা মাথা নাড়ল, আমি আপনার সাথে একমত নই মোজাম্মেল ভাই। নিশীতা তার দুই পাশের দুজন সাংবাদিককে দেখিয়ে বলল, বোরহান ভাই কিংবা শ্যামল দা যেটা পারবেন আমিও সেটা পারব।
অবশ্যই পারবে। মোজাম্মেল হক মাথা নেড়ে বললেন, সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি জেনেশুনে একটা মেয়েকে খুনি ডাকাত সন্ত্রাসীদের কাছে পাঠাতে পারব না। আমি আমার নিজের মেয়ে হলেও পাঠাতাম না।
নিশীতা বলল, আপনি বুঝতে পারছেন না মোজাম্মেল ভাই, এই কেসটা খুনি, ডাকাত আর সন্ত্রাসীদের নয়। খুনি, ডাকাত আর সন্ত্রাসীরা মারা পড়েছে, তাদের কাছে আমার আর যেতে হবে না। কেন মারা পড়ছে, কীভাবে মারা পড়ছে আমি সেটা দেখতে চাই। আপনি জানেন গভীর রাতে একটা নীল আলো আকাশ থেকে সোজা নিচে নেমে এসেছিল?
বজ্রপাত।
না, বজ্রপাত না। বজ্রপাতের শব্দ হয় কিন্তু এখানে কোনো শব্দ হয় নি। কালা জব্বারের পোস্টমর্টেম করে দেখা গেছে এস বজ্রপাতে মারা যায় নি।
তা হলে কীভাবে মারা গেছে?
কেউ বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে হার্ট থেমে গেছে। শরীরের ভিতরে বিচিত্র এক ধরনের ক্রিস্টাল পাওয়া গেছে। তার সাথে ছিল কব্জি কাটা দবির–তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু তার পায়ের ছাপ সেখানে আছে। রক্তের দাগ আছে, এ ছাড়া মাটিতে বিচিত্র কিছু চিহ্ন আছে। মনে হচ্ছে–
নিশীতা হঠাৎ করে থেমে গেল। মোজাম্মেল হক ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, মনে হচ্ছে কী?
মনে হচ্ছে অন্য কোনো একটা প্রাণী এখানে এসেছে।
অন্য কোনো প্রাণী?
হ্যাঁ। একজন ট্রাক ড্রাইভার দেখেছে পানিতে ডুবে থাকা একটা যন্ত্র থেকে একটা প্রাণী বের হয়ে এসেছে।
মোজাম্মেল হক অবাক হয়ে নিশীতার দিকে তাকিয়ে রইলেন, মনে হল নিশীতা কী বলছে তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। নিশীতার দুই পাশে বসে থাকা দুজন সাংবাদিকের দিকে তিনি একনজর তাকিয়ে আবার নিশীতার দিকে চোখ ফিরিয়ে আনলেন, বললেন, তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি না নিশীতা। ওখানে কী হয়েছে বলে তোমার ধারণা?
আমার ধারণা, মহাকাশ থেকে একটা স্পেসশিপ নেমে এসেছে। সেখান থেকে একটা মহাজাগতিক প্রাণী বের হয়ে এসে কালা জব্বারকে খুন করে কব্জি কাটা দবিরকে ধরে নিয়ে গেছে।
নিশীতার দুই পাশে বসে থাকা দুজন এতক্ষণ বেশ কষ্ট করে হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করছিল, এবারে আর পারল না, হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল। বোরহান হাসতে হাসতে বলল, মোজাম্মেল ভাই, চিন্তা করতে পারেন আমাদের দৈনিক বাংলাদেশ পরিক্রমায় বড়। বড় হেডলাইন, মহাজাগতিক প্রাণী কর্তৃক কব্জি কাটা জব্বার অপহরণ!
শ্যামল হাত নেড়ে বলল, সবচেয়ে ভালো হয় পত্রিকাটি হাফ সাইজ করে ট্যাবলয়েড তৈরি করে ফেললে। তা হলে মহাজাগতিক প্রাণীর ইন্টারভিউ পর্যন্ত ছাপতে পারব। সম্পাদকীয় বের হবে, মহাজাগতিক প্রেম : বাংলাদেশের নতুন স্বপ্ন।
নিশীতা মুখ শক্ত করে বলল, ঠাট্টা করবেন না শ্যামল দা। আপনি যখন বিদেশে টিকটিকি রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা নিয়ে রিপোর্ট করেছিলেন আমি তখন সেটা নিয়ে ঠাট্টা করি নি।
শ্যামল গলার স্বর উঁচু করে বলল, আমি টিকটিকি রপ্তানি করার কথা বলি নি–-দুষ্প্রাপ্য সরীসৃপের কথা বলেছিলাম।
একই কথা। যেটা এখানে টিকটিকি সেটা অন্য জায়গায় দুষ্প্রাপ্য সরীসৃপ। উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে দেখে মোজাম্মেল হক হাত তুলে দুজনকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ব্যস, অনেক হয়েছে।
নিশীতা বলল, তা হলে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা? আমি কি এই এ্যাসাইনমেন্টটা পেতে পারি?
মোজাম্মেল হক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, দেখ নিশীতা, সাংবাদিকতা ব্যাপারটা অনেকটা কোর্টে বিচার করার মত। তুমি যদি মনে কর একটা মানুষ অপরাধী, সেটা কিন্তু যথেষ্ট নয়। তোমাকে প্রমাণ করতে হবে মানুষটা অপরাধী। এখানেও তাই তুমি যদি মনে কর মহাকাশ থেকে মহাজাগতিক প্রাণী চলে এসেছে, সেটা যথেষ্ট নয়, তোমাকে দেখাতে হবে। ঘটনাটি যত বিচিত্র হবে তোমার দায়িত্ব তত কঠিন। শ্যামল ঠিকই বলেছ। আমরা ট্যাবলয়েড বের করি না!
মোজাম্মেল ভাই– নিশীতা বাধা দিয়ে বলল, আমি কখনোই বলি নি পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য আমি উদ্ভট খবর ছাপাব। এই ঘটনার মাঝে সায়েন্টিফিক রহস্য আছে সেটা আপনারা ধরতে পারছেন না। আমি ধরতে পারছি কারণ আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী, ফিজিক্সে মাস্টার্স করেছি–তারপর সাংবাদিকতায় এসেছি।
বোরহান টিপ্পনী কাটল, সেটাই তোমার সমস্যা। যদি জার্নালিজমের ছাত্রী হতে তা হলে তুমি সাংবাদিকতা করতে, সব জায়গায় সায়েন্স ফিকশান খুঁজে বেড়াতে না।
মোজাম্মেল হক মাথা নাড়লেন, বললেন, হ্যাঁ। তুমি যদি রিপোর্ট কর স্টক মার্কেট ইনডেক্স দুই পয়েন্ট বেড়েছে কেউ দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে না। কিন্তু তুমি যদি রিপোর্ট করতে চাও একটা কুকুরছানা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে তা হলে সেটা সত্যি হলেও কেউ সেটা বিশ্বাস করবে না। তোমাকে জোর করে সবাইকে বিশ্বাস করাতে হবে।
নিশীতা ক্ষুব্ধ গলায় বলল, আমি কখনো বলি নি কুকুরছানা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারে।
শ্যামল বলল, মহাজাগতিক প্রাণী কব্জি কাটা দবিরকে তুলে নিয়ে গিয়েছে আর কুকুরছানা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে–এই দুটোর মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই।
মোজাম্মেল হক মাথা নাড়লেন, বললেন, শ্যামল ঠিকই বলেছে। খুব বেশি পার্থক্য নেই। তবুও তুমি যদি মহাজাগতিক প্রাণীর খোঁজাখুঁজি করতে চাও আমার কোনো আপত্তি নেই, তবে দুটো শর্ত রয়েছে।
নিশীতার রাগে–দুঃখে–অপমানে প্রায় চোখে পানি চলে আসছিল, খুব কষ্ট করে মুখ স্বাভাবিক রেখে বলল, কী শর্ত?।
প্রথম শর্ত হচ্ছে ব্যাপারটা জানাজানি হতে পারবে না। যদি অন্যেরা জেনে যায় আমাদের সাংবাদিকদের আমরা আরিচাঘাটে মহাজাগতিক প্রাণী খুঁজতে পাঠাচ্ছি সেটা আমাদের জন্য সম্মানজনক হবে না। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে তোমার রেগুলার এ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে তারপর এই হাইস্টেক এ্যাসাইনমেন্টে যাবে।
সূক্ষ্ম অপমানে নিশীতার গাল লাল হয়ে উঠল, কষ্ট করে গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, ঠিক আছে।
ভেরি গুড। তা হলে তুমি যাও মহিলা পরিষদের আজ একটা বিক্ষোভ মিছিল আছে। সেটা কাভার কর। পতিতা পুনর্বাসনের সরকারি প্রোগ্রামের ওপর আমি একটা ক্রিটিক চাই।
বেশ। নিশীতা উঠে দাঁড়াল। দৈনিক বাংলাদেশ পরিক্রমার সম্পাদক মোজাম্মেল হকের ঘর থেকে বের হবার সাথে সাথে ভিতরে যে একটা হাসির রোল শুরু হয়ে গেছে ঘর থেকে বের হয়েও সেটা বুঝতে নিশীতার কোনো অসুবিধে হল না। নিশীতার ভিতরে হঠাৎ কেমন জানি একটা জেদ এসে যায়–কে কী বলছে তাতে তার আর কিছুই আসে-যায় না। সে যেভাবেই হোক সত্যটা বের করেই ছাড়বে।
০৩. নিশীতা পরবর্তী কয়েকদিন খোঁজখবর নিয়ে
নিশীতা পরবর্তী কয়েকদিন খোঁজখবর নিয়ে তিনটি ব্যাপারে নিশ্চিত হল। প্রথম ব্যাপারটি কব্জি কাটা দবিরকে নিয়ে–সে যেন বাতাসে উবে গিয়েছে। অপরাধের অন্ধকার জগতে উপস্থিতিটার গুরুত্ব খুব বেশি, সবাই যেহেতু সবাইকে খুন করে ফেলার চেষ্টা করে কাজেই কাউকে দীর্ঘ সময় অনুপস্থিত দেখলেই ধরে নেওয়া হয় সে খুন হয়ে গেছে, তখন তার রাজত্ব খুব দ্রুত হাতছাড়া হয়ে যায়। কব্জি কাটা দবিরের বেলাতেও এটা ঘটেছে। তার এলাকায় মাদক ব্যবসা, চাঁদার বখরা, টেন্ডারের ভাগ সবকিছু তার হাতছাড়া হয়ে গেছে, তার এলাকায় এখন কানা বকুল নামে নতুন একজন মস্তানের আবির্ভাব হয়েছে। কব্জি কাটা দবিরকে নিয়ে কারো কোনো কৌতূহল নেই।
দ্বিতীয় ব্যাপারটি সেই রহস্যময় আলোর রেখা নিয়ে–নিশীতা অসংখ্য মানুষের সাথে কথা বলেছে এবং সবার বক্তব্য মোটামুটি একরকম। রাত দুটোর একটু পর পশ্চিম আকাশ থেকে একটা আলোর রেখা ছুটে এসেছে। এটি বজ্রপাত নয়–বজ্রপাতের মতো আঁকাবাকা আলোর ঝলকানি ছিল না–আলোর রেখাঁটি ছিল একেবারে সরলরেখার মতো সোজা। আলোটি ছিল তীব্র এবং উজ্জল, এক পর্যায়ে পুরো এলাকা দিনের মতো আলোকিত হয়ে উঠেছিল। এ ধরনের কিছু একটা হতে পারে বড় কোনো উল্কাপাত থেকে কিন্তু এত বড় উল্কা যদি পৃথিবীতে এসে আঘাত করে তার বিস্ফোরণে বিশাল জনপদ ভস্মীভূত হয়ে যাবার কথা। কিন্তু কোনো বড় বিস্ফোরণ ঘটে নি।
তৃতীয় ব্যাপারটি হচ্ছে সত্যিকার অর্থে হতাশাব্যঞ্জক এ রকম কৌতূহলী একটা ব্যাপারে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। ঠিক কী ঘটেছে সেটা জানার জন্য কারো ভিতর কোনো কৌতূহল নেই। নিশীতা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বড় বড় প্রফেসরদের শরণাপন্ন হয়েছে কিন্তু কোনো লাভ হয় নি, তারা সবাই নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। আলোকরশ্মিটি মহাজাগতিক কোনো কিছু হতে পারে কি না জানতে চাইলে বড় বড় প্রফেসররা এমনভাবে তার দিকে তাকিয়েছেন যেন তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র একজন বৃদ্ধ প্রফেসর তার কথা শুনে খিকখিক করে হেসে বললেন, রিয়াজ থাকলে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারত।
রিয়াজ? নিশীতা জানতে চাইল, রিয়াজ কে?
আমার একজন ছাত্র। খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। ক্যালটেক থেকে এস্ট্রোফিজিক্সে পিএইচ.ডি. করে নাসার সাথে কিছুদিন কাজ করেছে। তার কাজকর্ম ছিল মহাজাগতিক প্রাণী নিয়ে। এত ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট কিন্তু কাজ শুরু করল সায়েন্স ফিকশান নিয়ে! কী দুঃখের কথা।
নিশীতা নোট বইয়ে রিয়াজ সম্পর্কে তথ্যগুলো টুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল, পুরো নাম কী রিয়াজের? কোথায় আছেন এখন?
পুরো নাম যতদূর মনে পড়ে রিয়াজ হাসান। এখন কোথায় আছে জানি না। যেখানে কাজ করত সেখানে ডিরেক্টরের সাথে ঝগড়া করে কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল।
নিশীতা রিয়াজ হাসান সম্পর্কে যেটুকু সম্ভব তথ্য টুকে নিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এল। এমনিতেই সে বাইরের বিজ্ঞানীদের কাছে লিখবে বলে ভেবেছিল, রিয়াজ হাসানকে খুঁজে পেলে সমস্যা অনেকটুকুই মিটে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের অফিস থেকে নিশীতা অনেক কষ্ট করে রিয়াজ হাসানের একটা ছবি যোগাড় করল। ছাত্র জীবনের ছবি–একমাথা উষ্কখুষ্ক চুল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। পরের কয়েকদিন নিশীতা ইন্টারনেটে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করল, পরিচিত সবার কাছে রিয়াজ হাসানের খোঁজ জানতে চেয়ে সে ই-মেইল পাঠিয়ে দিল। জার্নালে বের হওয়া পেপারগুলোতে সে রিয়াজ হাসানের নাম খোজার চেষ্টা করে। তার পুরোনো কর্মস্থলে তার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করে।
পুরো এক সপ্তাহ অমানুষিক পরিশ্রম করেও রিয়াজ হাসান কোথায় আছে সে সম্পর্কে নিশীতা নতুন কিছুই জানতে পারল না। মানুষটি একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, নাসাতে কাজ করার সময় তথ্য পাঠানোর জন্য নতুন এক ধরনের এনকোডিং বের করেছিল, সেটি ব্যবহার করে ভিন্ন গ্যালাক্সিতে তথ্য পাঠানো যেতে পারে এটুকুই নতুন কিন্তু মানুষটি যেন একেবারে। বাতাসে উবে গেছে।
পরের সপ্তাহে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সম্পর্কে একটি সেমিনার বিষয়ে লিখতে গিয়ে নিশীতার মোজাম্মেল হকের সাথে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলতে হল। কাজের কথা শেষ করে মোজাম্মেল হক চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মহাজাগতিক প্রাণীর কী খবর?
নিশীতা হাসার চেষ্টা করে বলল, মহাজাগতিক প্রাণীর খবর নেবার জন্য যে মানুষটি দরকার তার খবর পাচ্ছি না।
মোজাম্মেল হক ভুরু কুঁচকে বললেন, কে সেই মানুষ?
নিশীতা একটা নিশ্বাস ফেলে মোজাম্মেল হককে রিয়াজ হাসানের কথা বলল। মোজাম্মেল হক পুরোটুকু মন দিয়ে শুনে বললেন, তোমার বয়স কম তাই মানুষের ওপর বিশ্বাস খুব বেশি। আমার ধারণা এই মানুষটিকে খুঁজে পেলেও তোমার খুব একটা লাভ হবে না।
কিন্তু আগে খুঁজে তো পাই!
তুমি যে বর্ণনা দিলে তাতে মনে হল একটু খ্যাপা গোছের মানুষ। তার ওপর ডিরেক্টরের সাথে ঝগড়া করেছে। এই ধরনের মানুষেরা ঝগড়াঝাটি করে সাধারণত দেশে চলে আসে। দেশে এসে এরা একেবারে আলাদাভাবে থাকে–কারো সাথে মেশে না, কিছু করে না।
নিশীতা একটু অবাক হয়ে বলল, আপনি বলছেন রিয়াজ হাসান এখন দেশে আছে?
তুমি যেহেতু দেশের বাইরে খুঁজে পাও নি আমার ধারণা দেশেই আছে। এক হিসেবে অবশ্য তা হলে খুঁজে পাওয়া আরো কঠিন।
নিশীতা মাথা নাড়ল, না মোজাম্মেল ভাই। কঠিন নয়। দেশে থাকলে আমি তাকে খুঁজে বের করে ফেলব।
কীভাবে?
সোজা। এ রকম একজন মানুষ যদি দেশে থাকে তা হলে তার একমাত্র যে জিনিসটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে ইন্টারনেট এ্যাকাউন্ট! দেশের আইএসপিগুলোর কাছে খোঁজ নিলেই বের হয়ে যাবে। আমি বের করে ফেলতে পারব।
মোজাম্মেল হক একটু সন্দেহের চোখে নিশীতার দিকে তাকালেন তার কথা ঠিক বিশ্বাস করলেন বলে মনে হল না।
.
নিশীতা কিন্তু সত্যি সত্যি দুদিনের মাঝে রিয়াজ হাসানকে খুঁজে বের করে ফেলল। তাকে শুরু করতে হয়েছিল একুশ জন রিয়াজ আহমেদকে দিয়ে–এক জন এক জন করে তাদের ছেঁটে ফেলে সত্যিকার রিয়াজ হাসানকে খুঁজে বের করতে হয়েছে।
রিয়াজ হাসানের বাসাটি সত্যি সত্যি তার চরিত্রের সাথে খাপ খেয়ে যায়। বাসার জায়গাটি বেশ বড় গাছগাছালিতে ভরা, কিন্তু সে তুলনায় বাসাটি খুব ছোট, বাইরে থেকে বাসাটি প্রায় দেখাই যায় না। নিশীতা যখন রিয়াজ হাসানের সাথে দেখা করতে এসেছে তখন সন্ধে পার হয়ে গেছে। গেট খুলে খোয়া বাঁধানো পথ দিয়ে হেঁটে বাসার দরজায় শব্দ করল, প্রথমে মনে হল ভিতরে কেউ নেই। বেশ কিছুক্ষণ পর খুট করে শব্দ হল এবং একজন মানুষ দরজা খুলে দাঁড়াল, নিশীতা দেখেই চিনতে পারল, মানুষটি রিয়াজ হাসান। তার কাছে যে ছবিটা রয়েছে তার সাথে অনেক মিল, মাথায় চুল এখনো এলোমেলো, মুখে এখনো এক ধরনের বিষণ্ণতা।
রিয়াজ হাসান নিশীতাকে দেখে একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। নিশীতা মুখে হাসি টেনে এনে বলল, আপনি নিশ্চয়ই রিয়াজ হাসান।
মানুষটির মুখে বিস্ময়ের ছায়া পড়ে। মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, আমি রিয়াজ হাসান। আপনাকে চিনতে পারলাম না।
চিনতে পারার কথা নয়–আমি আপনাকে খুঁজে বের করেছি। আমার নাম নিশীতা। আপনার সাথে কি একটু কথা বলতে পারি?
রিয়াজ দরজা থেকে সরে দাঁড়াল, বলল, আসুন।
নিশীতা ঘরের ভিতর ঢুকল, মানুষের বাসায় সাধারণত বাইরের মানুষ এলে বসানোর একটা জায়গা থাকে। এখানে সেরকম কিছু নেই। ঘরটিতে বসার জায়গা নেই–
অনেকগুলো টেবিল এবং সেখানে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। কয়েকটা নানা আকারের কম্পিউটার, সবগুলো খোলা, নানা ধরনের তার দিয়ে জুড়ে দেওয়া রয়েছে।
রিয়াজ একটা চেয়ারের ওপর স্থূপ করে রাখা কাগজপত্র এবং কিছু সার্কিট বোর্ড সরিয়ে নিশীতার বসার জন্য জায়গা করে দিয়ে বলল, বসুন।
নিশীতা ইতস্তত করে বলল, আপনি?
রিয়াজ হাসান চারদিকে একনজর তাকিয়ে অপরাধীর মতো বলল, আসলে আমার এখানে কেউ আসে না, তাই কাউকে বসানোর জায়গা নেই। আপনি বসুন–আমি ভিতর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে আসি।
রিয়াজ চলে যাবার পর নিশীতা চেয়ারটাতে না বসে ঘরটিতে ইতস্তত হেঁটে বেড়ায়, খুব সতর্ক থাকতে হয় হঠাৎ করে কোনো কিছুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে না দেয়। ঘরের কোনায়। একটি মনিটর রাখা ছিল, তার সামনে যেতেই মনিটরটি হঠাৎ করে আলোকিত হয়ে ওঠে, সেখানে একজন মানুষের মুখের প্রতিচ্ছবি দেখা যায় এবং মানুষটি পরিষ্কার গলায় বলল, কে? কে আপনি?
নিশীতা চমকে উঠে থেমে যায়। কম্পিউটারের মনিটর থেকে কেউ প্রশ্ন করলে তার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না সে ঠিক বুঝতে পারল না। নিশীতা ভালো করে মানুষটির প্রতিচ্ছবির দিকে তাকাল, এটি সত্যিকার মানুষের মুখের ছবি নয়, কম্পিউটার গ্রাফিক্স ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে, কম্পিউটার গেমগুলোতে যে ধরনের মানুষের চেহারা দেখা যায় অনেকটা সেরকম, তবে তার থেকে অনেক ভালো। মানুষটির চেহারায় ঠিক বয়স বোঝা যায় না–দশ বছরের বালক হতে পারে, বিশ বছরের যুবক হতে পারে আবার তিরিশ থেকে চল্লিশ বছরের প্রৌঢ়ও হতে পারে। মানুটির চেহারায় একটা সুনির্দিষ্ট অভিব্যক্তি রয়েছে প্রথমে ছিল কৌতূহল এবং নিশীতা দেখতে পেল অভিব্যক্তিটি এখন পুরোপুরি বিরক্তিতে পাল্টে গেছে। মানুষটি বিরক্ত গলার স্বরে বলল, কী হল? কথা বলছ না কেন?
নিশীতা কী করবে বুঝতে পারল না, তখন মনিটর থেকে মানুষের প্রতিচ্ছবিটি অত্যন্ত শক্ত গলায় ধমক দিয়ে বসল, একটা প্রশ্ন করছি সেটা কানে যায় না? কে তুমি?
নিশীতা থতমত খেয়ে বলল, আমি নিশীতা।
নিশীতা? সেটা আবার কী রকম নাম?
নিশীতা অবাক হয়ে মনিটরে মানুষের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে রইল, সে এর আগে কখনো কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রামকে এ রকম স্পষ্ট ভাষায় কথোপকথন করতে শোনে নি। চোখ বড় বড় করে বলল, তুমি সত্যি সত্যি আমার সাথে কথা বলছ?
মানুষটির মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটে উঠল, সত্যি সত্যি নয়তো কি মিথ্যা কথা বলছি? তুমি দেখতে পাচ্ছ না?
তা দেখতে পাচ্ছি। খুবই বিচিত্র।
তুমি সত্যিই মনে কর এটা বিচিত্র?
নিশীতা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন রিয়াজ হাসান একটা হালকা চেয়ার নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল, নিশীতাকে মনিটরের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে হো হো করে হেসে উঠল, বলল, আপনাকে এপসিলন পাকড়াও করছে?
এপসিলন?
নিশীতার কথার উত্তরে মনিটর থেকে মানুষের প্রতিচ্ছবিটি বলল, কেন এপসিলন কি কারো নাম হতে পারে না?
নিশীতা একবার রিয়াজের দিকে আবার একবার মনিটরের দিকে তাকাল, ঠিক কী বলবে বুঝতে পারল না। রিয়াজ ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় চেয়ারটা বসিয়ে বলল, এপসিলন আমার ন্যাচারাল ল্যাংগুয়েজ কথোপকথন সফটওয়্যার।
নিশীতা কিছু বলার আগেই মনিটর থেকে মানুষটি ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কি বলতে চাও কথোপকথন সফটওয়্যার একটা ফ্যালনা জিনিস?
রিয়াজ গলা উঁচিয়ে বলল, ব্যস এপসিলন, অনেক হয়েছে। এখন চুপ কর।
কেন চুপ করব? আমি কি তোমার খাই না পরি?
বেয়াদব কোথাকার, তোমাকে আমি দেখাচ্ছি মজা বলে রিয়াজ হাসান একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে পাওয়ার কর্ডটা খুলে নিল।
সাথে সাথে মনিটরে মানুষটির চেহারা চুপসে ছোট হয়ে মিলিয়ে মনিটরটি অন্ধকার হয়ে গেল।
নিশীতা জিভ দিয়ে চুকচুক করে শব্দ করে বলল, আহা হা–কেন আপনি বেচারাকে টার্মিনেট করে দিলেন! বেশ তো কথা বলছিল।
আপনি চাইলে এর সাথে যত ইচ্ছে কথা বলতে পারেন কিন্তু সে চালু থাকলে আমি কিংবা আপনি কেউই কথা বলতে পারব না!
নিশীতা ঘরের মাঝামাঝি এগিয়ে গিয়ে বলল, আমি ইংরেজিতে এ রকম কথোপকথন সফটওয়্যার দেখেছি, বাংলায় দেখি নি। কোথায় পেয়েছেন এটা?
কোথায় আবার পাব? আমি লিখেছি।
নিশীতা অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে রিয়াজ হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি লিখেছেন? আমি ভেবেছিলাম আপনি কমিউনিকেশান্সের লোক।
রিয়াজ স্থির দৃষ্টিতে নিশীতার দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, আমার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে এসেছেন মনে হচ্ছে।
নিশীতা মাথা নাড়ল, জি। নিয়ে এসেছি। আমি একজন সাংবাদিক–খোঁজ-খবর নেওয়াই আমার কাজ। আমার ধারণা আমি এখন আপনার সম্পর্কে যেটুকু জানি আপনি নিজেও ততটুকু জানেন না।
কী ব্যাপার? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
বলছি, কিন্তু তার আগে এপসিলন নিয়ে কয়েকটা কথা জেনে নিই। প্রথম প্রশ্ন, এর নাম এপসিলন কেন?
রিয়াজ হাসান একটু হেসে বলল, যদি এর নাম হত তেতাল্লিশ, আপনি তবুও জিজ্ঞেস করতেন এর নাম তেতাল্লিশ কেন! যদি এর নাম হত বকুল ফুল, আপনি জিজ্ঞেস করতেন কেন বকুল ফুল হল। যদি এর নাম হত ঝিনাইদহ
তার মানে বলতে চাইছেন নামটির সাথে সফটওয়্যারটির কোনো সম্পর্ক নেই?
রিয়াজ মাথা চুলকে বলল, একেবারে নেই তা নয়। যেদিন কোডিং শুরু করেছি সেদিন হঠাৎ টেলিভিশনে দেখি আমার এক ক্লাসফ্রেন্ডকে দেখাচ্ছে, সে প্রতিমন্ত্রী হয়ে গেছে! ইউনিভার্সিটিতে থাকার সময় তাকে আমরা ডাকতাম এপসিলন অর্থাৎ খুবই ছোট! সে এত তুচ্ছ ছিল যে তাকে এপসিলন ডাকাটাই বেশি। তাই প্রোগ্রামটা লিখতে গিয়ে এই নাম।
নিশীতা সব কিছু বুঝে ফেলার মতো করে মাথা নেড়ে বলল, আপনার এপসিলন অসম্ভব স্মার্ট! যখন কথা বলে তখন মুখে অভিব্যক্তি দেখা যায়। এটি কীভাবে করেছেন? এর মাঝে কি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করেছেন?
রিয়াজ হাসান হো হো করে হেসে বলল, আপনি আমাকে কী ভেবেছেন? আমি প্রফেশনাল প্রোগ্রামার নই, একেবারেই এমেচার। সময় কাটানোর জন্য জোড়াতালি দিয়ে এটা দাঁড়া করিয়েছি। মুখের অভিব্যক্তিটি ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করেছি। জানেন তো আজকাল প্রোগ্রামিং পানির মতো সোজা!
নিশীতা মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু এপসিলন কী চমৎকার কথা বলল! একেবারে সত্যিকার মানুষের মতো।
রিয়াজ হাসান সকৌতুকে নিশীতার দিকে তাকিয়ে রইল। মুখ টিপে হাসি চেপে বলল, আপনার তাই ধারণা?
হ্যাঁ। নিশীতা জোর গলায় বলল, একটু মেজাজী বা একটু বেয়াদপ হতে পারে কিন্তু খাঁটি মানুষের মতো কথা বলেছে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই!
আসলে আপনি মাত্র অল্প সময় কথা বলেছেন দেখে ধরতে পারেন নি–এটি আসলে একটি অত্যন্ত নির্বোধ প্রোগ্রাম।
নির্বোধ?
হ্যাঁ। আপনি যে কথাগুলো বলেন সেই কথাগুলো ব্যবহার করে একটা প্রশ্ন তৈরি করে। আপনার সব কথার উত্তর দেয় প্রশ্ন করে– প্রশ্নের উত্তর দেয় প্রশ্ন দিয়ে তাই আপনার মনে হয় এটা বুঝি বুদ্ধিমান!
নিশীতা চমৎকৃত হয়ে বলল, আমি ধরতে পারি নি।
এখন থেকে পারবেন। রিয়াজ মুখে খানিকটা গাম্ভীর্য এনে বলল, তবে এখানে হার্ডওয়্যারের কিছু কাজ আছে। একটা ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে কিছু ইমেজ প্রসেসিং হয়–
যার অর্থ এটি দেখতে পায়? ও
না–না–না—-এটাকে দেখতে পাওয়া বলে দেখা ব্যাপারটিকে অপমান করবেন না। বলেন ভিডিও ক্লিপকে প্রসেস করে। এ ছাড়া ভয়েস রিকগনিশান, ভয়েস সিনথেসিসের কিছু ভালো কাজ আছে। বেশিরভাগ হার্ডওয়্যারে, বুঝতেই পারছেন আমি হার্ডওয়্যারের মানুষ।
নিশীতা মাথা নাড়ল, বলল, আমি জানি।
সেটাই শুনি আপনার কাছে। কতটুকু জানেন? কীভাবে জানেন? কেন জানেন?
আপনাকে আমি অনেকদিন থেকে খুঁজছি। সারা আমেরিকা খুঁজে আপনাকে পাই নি, তখন একজন বলল, আপনি নিশ্চয়ই দেশেই আছেন। দেশে খুঁজতেই সত্যি সত্যি পেয়ে গেলাম।
রিয়াজ হাসান অবাক হয়ে নিশীতার দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। নিশীতা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, একটা ব্যাপারে আমি আপনার সাহায্য চাই।
কী ব্যাপার?
প্রায় তিন সপ্তাহ আগে আকাশ থেকে একটা নীল আলো নিচে নেমে এসেছে, যারা দেখেছে তারা বলেছে একেবারে সোজা নেমে এসেছে উল্কাপাতের মতো। কিন্তু কোনোরকম বিস্ফোরণ হয় নি।
রিয়াজ হাসান কোনো কথা না বলে ভুরু কুঁচকে তাকাল।
আলোটা যেখানে নেমেছে তার কাছাকাছি জায়গায় একটা মানুষের ডেডবড়ি পাওয়া গেছে। মানুষটার পোস্টমর্টেম করেও কেউ বুঝতে পারে নি সে কেমন করে মারা গেছে। শরীরের ভিতরে এক ধরনের বিচিত্র ক্রিস্টাল, মনে হয় রক্তের এক ধরনের প্রসেসিং হয়েছে। মানুষটা আন্ডারওয়ার্ল্ডের, নাম কালা জব্বার। তার সাথে আরেকজন ছিল, তার নাম কব্জি কাটা দবির–সে বাতাসের মাঝে উবে গেছে। মানুষটা–
নীল আলোটা কবে নেমেছে?
তিন তারিখ। রাত দুটো পঁয়ত্রিশ মিনিটে।
আকাশের কোনদিক থেকে নেমেছে?
দক্ষিণ-পূর্ব থেকে সোজা নিচের দিকে।
রিয়াজ একটা কাগজে কী যেন লিখল, ছোট কয়েকটা সংখ্যা দিয়ে কিছু একটা হিসাব করল, তারপর হঠাৎ করে খুব গম্ভীর হয়ে গেল।
নিশীতা রিয়াজের দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল, আমার ধারণা মহাকাশ থেকে কোনো মহাকাশযান পৃথিবীতে নেমে এসেছে।
রিয়াজ নিশীতার কথা শুনে হেসে ফেলল না বা হাসার চেষ্টাও করল না, এক দৃষ্টিতে একটা বিচিত্র ভঙ্গি করে নিশীতার দিকে তাকিয়ে রইল। নিশীতা অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বলল, আপনার কী মনে হয়? কোনো মহাজাগতিক প্রাণী কি এসেছে?
রিয়াজ কয়েক মুহূর্ত তার হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে বলল, সম্ভাব্য মহাজাগতিক প্রাণীদের তাদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যদি প্রথম স্তরের বুদ্ধিমত্তা হয়ে থাকে তা হলে আমাদের সভ্যতা কখনো তাকে দেখতে পাবে না। হয়তো তারা এখনই আছে, হয়তো আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে, হয়তো আমাদের দিয়ে একটা পরীক্ষা। করছে, আমরা জানতেও পারব না। মহাজাগতিক ঋীর সভ্যতা, বুদ্ধিমত্তা যদি তৃতীয় কিংবা চতুর্থ স্তরের হয় শুধু তা হলেই আমরা তারে দেখব।
তা হলে কি তৃতীয় কিংবা চতুর্থ স্তরের কিছু এসেছে?
বলা খুব মুশকিল। তবে, একটা ব্যাপারে নিশ্চিত থাকেন।
কী?
আপনার অনুমান যদি সত্যি হয়ে থাকে সেটি পৃথিবীতে গোপন থাকবে না।
গোপন থাকবে না?
না। আমি যে ল্যাবরেটরিতে কাজ করতাম তারা সারা পৃথিবীতে এই ধরনের ঘটনা খুঁজছে। আপনি যে ঘটনার বর্ণনা দিলেন সেটি যদি সত্যি হয়ে থাকে তা হলে এই মুহূর্তে ঢাকায় আমার পুরোনো সব সহকর্মী হাজির হয়ে গেছে!
নিশীতা একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, আমেরিকান সায়েন্টিস্টরা এখন ঢাকায় চলে এসেছে?
আমার তাই ধারণা।
কিন্তু আপনি আমাদের বাংলাদেশের সায়েন্টিস্ট। এ ব্যাপারে আপনি কিছু করবেন না?
রিয়াজ মাথা নাড়ল, বলল, না।
কেন নয়?
কারণ আমি ছেড়ে দিয়েছি। আমি মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগের ব্যাপারে আর কাজ করি না।
কেন করেন না?
সেটা অনেক দীর্ঘ ব্যাপার। বেশিরভাগই ব্যক্তিগত ব্যাপার। বলার মতো কিছু নয়।
নিশীতা কী বলবে কিছু বুঝতে পারল না, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, কিন্তু এই মহাজাগতিক প্রাণী যদি আমাদের কোনো ক্ষতি করে? পৃথিবীর কোনো ক্ষতি করে?
যদি তারা তৃতীয় স্তরের হয়ে থাকে তা হলে কিছু করার নেই। আমরা তাদের সামনে কিছু নই, তেলাপোকা কিংবা পিঁপড়ার মতো! আমাদের যদি দয়া করে বেঁচে থাকতে দেয় তা হলে বেঁচে থাকব। যদি চতুর্থ মাত্রার হয় তা হলে যোগাযোগের একটা ছোট সম্ভাবনা আছে–
আমরা কেমন করে বুঝব তারা কোন মাত্রার?
রিয়াজ এই প্রথম একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, আপনাকে তার চেষ্টা করতে হবে। সেগুলো বিশ্লেষণ করার লোক আছে। সেটা করার জন্য কোনো কোনো মানুষকে বছরে এক শ থেকে দুই শ হাজার ডলার বেতন দেওয়া হয়। আমি আপনাকে বলেছি, সেই মানুষগুলো মনে হয় এর মাঝে এই দেশে চলে এসে কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে! আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই।
নিশীতা অবাক হয়ে রিয়াজের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি সত্যিই কিছু করবেন না?
রিয়াজ নরম গলায় বলল, আমি যেখানে কাজ করতাম সেই ল্যাবরেটরির বছরে বাজেট ছিল কয়েক বিলিয়ন ডলার। সেই ল্যাবরেটরি থেকেও সুযোগের অভাবে আমরা সবকিছু করতে পারতাম না। এখান থেকে আমি কী করব?
ইন্টারনেটে দেখেছি মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগ করার জন্য আপনার একটা কোডিং এলগরিদম আছে, সেটা ট্রান্সমিট করতে পারেন না?
রিয়াজ শব্দ করে হেসে বলল, তার জন্য বিশাল এ্যান্টেনা লাগবে, মেগাওয়াট পাওয়ার লাগবে। আমার বাসায় ডিশ এ্যান্টেনা দিয়ে তো সেটা করা যাবে না!
কেন? করলে কী হবে?
মহাজাগতিক প্রাণী যদি আমার বাসার ছাদে ঘোরাঘুরি করে তা হলে সেটা করা যায় কিন্তু দূর গ্যালাক্সিতে তো আর এটা দিয়ে খবর পাঠানো যাবে না?
নিশীতা একটু সামনে ঝুঁকে বলল, কিন্তু হয়তো এই মহাজাগতিক প্রাণী কাছাকাছিই আছে! ঢাকা শহরেই আছে।
না, নেই। পৃথিবীতে মহাজাগতিক প্রাণী সত্যি সত্যি চলে আসার সম্ভাবনা এত কম যে ধরে নিতে পারেন তার সম্ভাবনা শূন্য। আমরা তবু চোখ কান খোলা রাখি। আপনি যেটা বলছেন সেটার ব্যাপারে।
রিয়াজ হঠাৎ চুপ করে গেল। নিশীতা বলল, সেটার ব্যাপারে?
নাহ্। কিছু না।
রিয়াজ বলতে চাইছে না বলে নিশীতা জোর করল না। সে তার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল, বলল, আমি যদি মহাজাগতিক প্রাণী নিয়ে একটা স্টোরি করি আপনি একটা ইন্টারভিউ দেবেন?
ইন্টারভিউ? আমি?
হ্যাঁ।
রিয়াজ মাথা নাড়ল, বলল, না। সেটা একেবারেই ঠিক হবে না, মানুষ পাগল ভাববে। আর এসব ব্যাপার আসলে গোপনে করতে হয় সাধারণ মানুষের এগুলো জানা ঠিক নয়! তারা কখনোই এসব ব্যাপার ঠিকভাবে নিতে পারে না।
নিশীতা তর্ক করার জন্য কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, বলল, ঠিক আছে আপনাকে আমি জোর করব না। কিন্তু যদি আপনি মত পাল্টান আমাকে জানাবেন, প্লিজ।
ঠিক আছে, জানাব।
আমার টেলিফোন নম্বর দিয়ে যাচ্ছি। নিশীতা তার ব্যাগ থেকে কার্ড বের করে রিয়াজের হাতে ধরিয়ে দিল। রিয়াজ অন্যমনস্কভাবে চোখ বুলিয়ে কার্ডটা তার শার্টের পকেটে রেখে দেয়। নিশীতা বুঝতে পারল নেহায়েত ভদ্রতা করে পকেটে রেখেছে, রিয়াজ নিজে থেকে তাকে টেলিফোন করবে না।
নিশীতা অবশ্য কল্পনা করে নি দুদিনের ভিতরেই সে রিয়াজের টেলিফোন পাবে, সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে, সম্পূর্ণ বিচিত্র পরিবেশে।
০৪. রিয়াজের বাসা থেকে ফিরে
রিয়াজের বাসা থেকে ফিরে এসেই পরের দিন নিশীতা আমেরিকান এজেন্সিতে খোঁজ করে জানার চেষ্টা করল সত্যি সত্যি আমেরিকা থেকে কিছু বিজ্ঞানী এসে হাজির হয়েছে কি না, কিন্তু সে ভালো সদুত্তর পেল না। পরদিন বড় বড় হোটেলগুলোতে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু সেখানেও লাভ হল না, হোটেলগুলো তাদের গ্রাহকদের পরিচয় বাড়াবাড়ি রকমভাবে গোপন রাখে। পরদিন ভোরে সে এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে একবার খোঁজ নেবার পরিকল্পনা করছিল, কার সাথে যোগাযোগ করলে সবচেয়ে ভালো হয় সেটা নিয়ে চিন্তা করতে করতে অন্যমনস্কভাবে খবরের কাগজটি হাতে নিয়ে সে চমকে ওঠে। প্রথম পৃষ্ঠার মাঝামাঝি বক্স করে। একটা খবর ছাপা হয়েছে, খবরের শিরোনাম–শহরে রহস্যময় আলোর রেখা! নিচে লেখা। গত রাত বারোটার দিকে দক্ষিণ-পূর্ব আকাশ থেকে একটা রহস্যময় আলো ঢাকা শহরের বুকে নেমে এসেছে। রাতে ঝড়বৃষ্টি ছিল না কাজেই এটি বজ্রপাত নয়। আলোটি বজ্রপাতের মতো আঁকাবাকা নয়, একেবারে সরলরেখার মতো। মনে হয়েছে উত্তরার কাছাকাছি কোথাও আলোটি নেমে এসেছে। খোঁজখবর নিয়েও সেই এলাকায় কোনো ক্ষতি হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায় নি। আলোটি কোথা থেকে এসেছে কেউ বলতে পারে নি। এটাকে উল্কাপাত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, যদিও উল্কাটির কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় নি।
নিশীতা নিশ্বাস বন্ধ করে খবরটা কয়েকবার পড়ে ফেলল। তাকে কেউ বলে দেয় নি কিন্তু সে একেবারে নিশ্চিত হয়ে যায় এটিও ঠিক আগের মতো একটি মহাকাশযান। ব্যাপারটি নিয়ে কারো সাথে কথা বলতে পারলে হত কিন্তু সেরকম একজন মানুষও নেই। একটা মহাকাশযান পৃথিবীতে চলে এসেছে এই কথাটি গুরুত্ব দিয়ে শুনেছে, হেসে উড়িয়ে দেয় নি সেরকম একমাত্র মানুষ হচ্ছে রিয়াজ হাসান। কিন্তু রিয়াজ হাসানও কোনো একটা বিচিত্র কারণে এই ব্যাপারটায় মাথা ঘামাতে চাইছে না। নিশীতা নাশতার টেবিলে বসে চা খেতে খেতে ঠিক করে ফেলল সে আবার রিয়াজ হাসানের সাথে দেখা করতে যাবে।
তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে সে তার মোটর সাইকেলে বসতেই তার সেলুলার ফোন বেজে উঠল, বাংলাদেশ পরিক্রমার সম্পাদক মোজাম্মেল হক ফোন করেছেন। দুপুর বারোটার সময় প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলন, তাকে যেতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির নতুন ইনস্টিটিউট তৈরি হবে, সাংবাদিক সম্মেলনে সে ব্যাপারে একটি মহাপরিকল্পনার কথা ঘোষণা করা হবে। মোজাম্মেল হক নিশীতাকে দায়িত্ব দিলেন তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা আছে সেগুলো আগে থেকে জেনে নিতে, সাংবাদিক সম্মেলনে যেন ঠিকভাবে প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করতে পারে। নিশীতা মনে মনে একটা হিসাব করে বুঝতে পারে রিপোর্টটি লিখে শেষ করে জমা দিয়ে রিয়াজ হাসানের কাছে যেতে যেতে তার রাত হয়ে যাবে। এমনও হতে পারে যে আজ হয়তো যেতেই পারবে না।
নিশীতা মাথা থেকে রহস্যময় আলোর রেখা ব্যাপারটি এক রকম জোর করে সরিয়ে দিয়ে মোটর সাইকেলে চেপে বসল, কয়েক মুহূর্ত পরেই দেখা গেল তার সুজুকি এক্স এল ২০০ গর্জন করে বিজয় সরণি দিয়ে ছুটে চলছে।
প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক সম্মেলনটি খুব প্রাণবন্ত সম্মেলন হল, এতজন প্রবীণ সাংবাদিকের মাঝে তাকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া হবে কি না সে ব্যাপারে নিশীতার একটু সন্দেহ ছিল,
কিন্তু শার্ট-প্যান্ট পরা মেয়ে বলেই কি না কে জানে, প্রধানমন্ত্রী তাকে বেশ সুযোগ দিলেন। জনশক্তি নিয়ে নিশীতার প্রশ্নটি ছিল খুব সুন্দর এবং একেবারে যথাযথ উত্তর দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীরও একটু চিন্তা করতে হল।
সাংবাদিক সম্মেলনের রিপোর্টটা টাইপ করে জমা দিয়ে বার্তা সম্পাদকের সাথে কথা বলে সে যখন পত্রিকা অফিস থেকে বের হয়েছে তখন রাত দশটা, রিয়াজ হাসানের বাসায় যাবার জন্য বেশ দেরি হয়ে গেছে। পরদিন সকালেই যাবে ঠিক করে সে যখন তার মোটর। সাইকেলে বসেছে তখন তার সেলুলার ফোনটি আবার বেজে উঠল, নিশীতা অবাক হয়ে দেখল টেলিফোন নম্বরের জায়গায় বিচিত্র তারকা চিহ্ন! সে ফোনটি কানে লাগাতেই শুনল পুরুষ কণ্ঠে কেউ একজন বলল, নিশীতা?
গলার স্বরটি সে আগে শুনেছে কিন্তু কোথায় শুনেছে মনে করতে পারল না। নিশীতা ভুরু কুঁচকে বলল, হ্যাঁ, কথা বলছি।
আপনি কি এক্ষুনি আসতে পারবে?
আমি? কোথায় আসব?
আপনি বুঝতে পারছেন না?
না। বুঝতে পারছি না।
রিয়াজ হাসানের কথা মনে আছে?
আছে। অবশ্যই মনে আছে। কী হয়েছে তার?
নিশীতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মানুষটি বলল, আপনি কি তার বাসায় আসতে পারবেন?
মানুষটির কথোপকথনে একটা বিচিত্র ব্যাপার রয়েছে কিন্তু সেটি কী নিশীতা ঠিক ধরতে পারল না। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামাল না, বলল, আসছি। আমি এক্ষুনি আসছি।
নিশীতার কথা শেষ হবার আগেই অন্য পাশের মানুষটি টেলিফোন রেখে দিল। নিশীতা কয়েক মুহূর্ত টেলিফোনটা হাতে নিয়ে বসে থাকে এবং খানিকটা বিভ্রান্তভাবেই টেলিফোনটা তার ব্যাগে রেখে দিয়ে মোটর সাইকেলের ইঞ্জিন স্টার্ট করল। কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল নিশীতার সুজুকি এক্সএল ২০০ গর্জন করে এয়ারপোর্ট রোড ধরে উত্তরার দিকে ছুটে যাচ্ছে।
রিয়াজ হাসানের বাসায় পৌঁছানোর আগেই নিশীতা বুঝতে পারল সেখানে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। তার নির্জন বাসার সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বেশ কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে বোঝা যায় না কিন্তু কেন জানি নিশীতার মনে হল গাড়িগুলোর মাঝে এক ধরনের অশুভ ইঙ্গিত লুকিয়ে রয়েছে।
নিশীতা রিয়াজ হাসানের বাসার সামনে মোটর সাইকেল থামিয়ে গাড়িগুলোর ভিতরে তাকাল। আবছা অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায় না, কিন্তু মনে হল ভিতরে পুলিশ কিংবা মিলিটারি। নিশীতা তাদের না দেখার ভান করে গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই প্রায় অন্ধকার থেকে একজন মানুষ গেটের সামনে এসে দাঁড়াল, মানুষটি পুলিশ কিংবা মিলিটারির পোশাক পরে নেই কিন্তু তার হাঁটা বা দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় সে সশস্ত্র বাহিনীর লোক।
গেটে দাঁড়ানো মানুষটি নিশীতার পথ আটকে দাঁড়াল, নিশীতা মোটর সাইকেল থামিয়ে মাথা থেকে হেলমেট খুলে নিতেই মানুষটি একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল, শার্ট–প্যান্ট এবং হেলমেট পরে থাকায় নিশীতাকে সে মেয়ে ভাবে নি।
নিশীতা মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি একটু সরুন আমি ভিতরে যাব।
মানুষটি রুক্ষ গলায় বলল, আপনি এখন ভিতরে যেতে পারবেন না।
কেন?
মানুষটি একটু অবাক হয়ে নিশীতার দিকে তাকাল, তাকে যে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা যায় সে যেন সেটাই বুঝতে পারছে না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে আগের থেকেও রুক্ষ গলায় বলল, কারণ অর্ডার আছে।
কার অর্ডার?
আমার কমান্ডারের।
আপনার কমান্ডারের অর্ডার আপনার জন্য আমার জন্য নয়। আপনি সরে দাঁড়ান আমি ভিতরে ঢুকব।
মানুষটি নিশীতার কথা শুনে এত অবাক হল যে, সে প্রথমে রেগে উঠতেই ভুলে গেল। খানিকক্ষণ হাঁ করে নিশীতার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সে রেগে উঠল, নিশীতার কথার জন্য যেটুকু তার চাইতে অনেক বেশি একজন মেয়ে হয়ে একজন পুরুষের সাথে এই ভাষায় কথা বলার জন্য। মানুষটি প্রায় চিৎকার করে বলল, এখান থেকে যান। না হলে–
না হলে কী?
না হলে ঝামেলা হবে।
কী ঝামেলা?
মানুষটি মুখ খিঁচিয়ে বলল, আমি আপনার সাথে রং-তামাশা করার জন্য এখানে দাঁড়িয়ে নেই। এখান থেকে যান এটা আমার অর্ডার। তারপর দাঁত চিবিয়ে নিচু স্বরে এক দুটি শব্দ বলল যেটা নিশ্চিতভাবেই মেয়েদের সম্পর্কে একটি কুৎসিত গালি।
নিশীতা শীতল চোখে মানুষটির দিকে তাকাল, হঠাৎ করে মনে হল তার মাথার ভিতরে একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেছে। সে নিশ্বাস আটকে রেখে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। মানুষটি এবার তার দিকে প্রায় এক পা এগিয়ে এল, ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় তার গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দেবে। নিশীতা খুব ধীরে ধীরে তার মাথায় হেলমেটটি পরে নেয়, তারপর স্টার্টারে কিক দিয়ে সেটাকে চালু করা মোটর সাইকেলটিকে ঘুরিয়ে নেয়। রিয়াজের বাসা থেকে এক শ গজ দূরে গিয়ে সে মোটর সাইকেলটি আবার ঘুরিয়ে রিয়াজের বাসার। দিকে মুখ করে দাঁড়াল। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি তখনো বুঝতে পারছে না। নিশীতা কী করার পরিকল্পনা করছে।
নিশীতা ক্লাচে পা দিয়ে মোটর সাইকেলের এক্সেলেটারে চাপ দিয়ে ইঞ্জিনের গর্জনটা শুনে নিল। তার সুজুকি এক্সএল ২০০ এই এক শ গজে প্রায় আশি মাইল বেগ তুলতে
পারবে, তাকে নিয়ে মোটর সাইকেলের যে ভরবেগ হবে সেটা দিয়ে খুব সহজেই পলকা গেটটাকে কজা থেকে খুলে নিতে পারবে। রিয়াজের বাসার সামনে প্রচুর ফাঁকা জায়গা, একবার ভিতরে ঢোকার পর সে সহজেই মোটর সাইকেল থামিয়ে নিতে পারবে।
নিশীতা ক্লাচ ছেড়ে দিয়ে এক্সেলেটর ঘুরিয়ে তার সুজুকিকে গর্জন করিয়ে ছুটিয়ে নিয়ে গেল। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি কল্পনাও করতে পারে নি যে একজন মানুষ এ রকম একটা কাজ করতে পারে। শেষ মুহূর্তে লাফ দিয়ে সে ছুটন্ত মোটর সাইকেল থেকে নিজেকে রক্ষা করল, নিশীতার সুজুকি এক্সএল ২০০ প্রচণ্ডবেগে গেটে আঘাত করে, হালকা ছিটকিনি ছিটকে গিয়ে গেটটি হাট হয়ে খুলে গেল। প্রচণ্ড শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে এবং এর মাঝে নিশীতা তার মোটর সাইকেল নিয়ন্ত্রণ করে একেবারে বাসার দোরগোড়ায় এসে মোটর সাইকেলটিকে থামাল।
বাইরের ঘরে আলো জ্বলছে, সেখানে বেশ কিছু মানুষ, গেট ভাঙার প্রচণ্ড শব্দ শুনে সবাই জানালা এবং দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। নিশীতা তার হেলমেট খুলে মোটর সাইকেলের ওপর রেখে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এল। তার বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড ধকধক শব্দ করছে কিন্তু সে জোর করে মুখের ওপর কিছুই হয় নি এ রকম একটা ভাব ধরে রাখল। গেটের মানুষটা এবং আরো অনেকে তার পিছনে পিছনে ছুটে আসছে টের পেলেও সে পিছনে ফিরে তাকাল না।
বাইরের ঘরের মাঝামাঝি রিয়াজ বসে আছে, তাকে ঘিরে কয়েকজন সাদা পোশাকের পুলিশ কিংবা মিলিটারি। কয়েকজন বিদেশী মানুষ হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশীতা সবাইকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে রিয়াজ হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, ড. হাসান, আমি খুব দুঃখিত আপনার গেট ভেঙে ঢুকতে হল। গেটে একজন ব্রেন-ডেড মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, আমাকে ঢুকতে দিচ্ছিল না!
রিয়াজ হাসান খানিকক্ষণ অবাক হয়ে নিশীতার দিকে তাকিয়ে রইল, তার চেহারায় এক ধরনের বিপর্যস্ত ভাব, নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আমি–আমি–মানে ঠিক বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে।
রিয়াজ হাসানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মাঝে একজন এবারে নিশীতার দিকে এগিয়ে আসে, দেখে মনে হয় মানুষটি ইন্টেলিজেন্সের বড় কর্মকর্তা, মানুষটির মুখ কঠিন, চোখের দৃষ্টি ক্রুদ্ধ। মানুষটি শীতল গলায় বলল, আপনি কে? এখানে কেন এসেছেন?
নিশীতা মাথা ঝাঁকিয়ে তার চুলকে পিছনে সরিয়ে বলল, আমি ডঃ রিয়াজ হাসানের বাসায় এসেছি, তিনি যদি চান তা হলে তিনি আমাকে এই প্রশ্নটি করতে পারেন–আপনি পারেন না। নিশীতা তার মুখে একটা মধুর হাসি টেনে বলল, কিন্তু আপনি যদি সত্যি জানতে চান আমি বলতে পারি। আমার নাম নিশীতা জানীন। আমি একজন সাংবাদিক।
নিশীতা তার গলায় ঝুলিয়ে রাখা কার্ডটি বের করে মানুষটিকে দেখাল এবং প্রথমবার মানুষটিকে একটু হতচকিত হতে দেখা গেল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ বলল, আপনাকে আজ বিটিভিতে দেখেছি। প্রাইম মিনিস্টারের নিউজ কনফারেন্সে আপনি ছিলেন।
তাকে টেলিভিশনে দেখিয়েছে তথ্যটি নিশীতা জানত না, আজকের পরিবেশে এই তথ্যটি খুব কাজে লাগবে ভেবে নিশীতা মনে মনে খুশি হয়ে উঠল। মুখের হাসি বিস্তৃত করে বলল, হ্যাঁ ছিলাম। প্রাইম মিনিস্টার আমাকে খুব পছন্দ করেন।
গেটে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি এতক্ষণে ভিতরে হাজির হয়েছে, সাহস করে এবার বলার চেষ্টা করল, স্যার এই মহিলা জোর করে—
কঠিন চেহারার মানুষটি সম্পূর্ণ বিনা কারণে তাকে একটা প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, শাট আপ, ইউ স্টুপিড। যাও এখান থেকে। গেট আউট।
মানুষটি এবারে নিশীতার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বলল, আপনাকে আমরা এখান থেকে চলে যেতে বলছি।
এটা ড. রিয়াজ হাসানের বাসা। তিনি আমাকে চলে যেতে বললে আমি অবশ্যই চলে যাব। নিশীতা রিয়াজের দিকে তাকাতেই রিয়াজ মাথা নেড়ে বলল, না–না–আপনাকে আমি যেতে বলছি না।
চমৎকার, তা হলে আমার এই মুহূর্তে চলে যাবার কোনো প্রয়োজন নেই। নিশীতা মুখে মধুর হাসি ফুটিয়ে তার ব্যাগ থেকে ডিজিটাল ক্যামেরাটা বের করে আনে। আমি কি আপনাদের একটা ছবি তুলতে পারি?
একসাথে কয়েকজন প্রায় চিৎকার করে বলল, না। খবরদার ছবি তুলবেন না।
নিশীতা চোখে-মুখে একটা বিস্ময়ের ভঙ্গি ফুটিয়ে বলল, মনে হচ্ছে খবরের কাগজের জন্য একটা খুব ভালো স্টোরি তৈরি হচ্ছে? আপনারা এখানে কেন এসেছেন জানতে পারি?
মানুষগুলো পাথরের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। কঠিন চেহারার মানুষটি বলল, আমরা একটি ইনভেস্টিগেশনে এসেছি। ব্যাপারটি গোপন। আমরা আপনাকে চলে যেতে বলছি।
আপনারা কারা?
সেটি আপনাকে বলতে আমরা বাধ্য নই।
নিশীতা রিয়াজ হাসানের দিকে ঘুরে তাকাল, আপনি কি জানেন এরা কারা?
না–মানে ঠিক পুরোপুরি জানি না। পুলিশ কিংবা আর্মি ইনটেলিজেন্সের লোক হতে পারে।
আপনার বাসায় ঢোকার জন্য সার্চ ওয়ারেন্ট এনেছে?
জানি না। আনলেও আমাকে দেখায় নি।
এই বিদেশীগুলোও কি আমাদের পুলিশ বা আর্মি ইনটেলিজেন্সের?
না। রিয়াজ বলল, একজন আমার পুরোনো সহকর্মী, ড. ফ্রেড লিস্টার।
ড. ফ্রেড লিস্টার মানুষটি নিজের নাম উচ্চারিত হতে শুনে রিয়াজ হাসানের দিকে ঘুরে তাকাল। নিশীতা ভুরু কুঁচকে ড. ফ্রেড লিস্টারের দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, আপনাকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?
ফ্রেড লিস্টার উত্তর দেবার আগেই কঠিন চেহারার মানুষটি রুক্ষ গলায় বলল, দেখুন মিস নিশীতা, আপনাকে আমি শেষবার বলছি, এখান থেকে যান। তা না হলে আপনার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
নিশীতা তার ব্যাগ খুলে সেলুলার ফোনটা বের করে দ্রুত কয়েকবার বোতাম টিপে কোথায় জানি ফোন করল! কঠিন চেহারার মানুষটি প্রায় ধমক দিয়ে বলল, আপনি কাকে ফোন করছেন?
নিশীতা তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে টেলিফোনে কথা বলতে শুরু করল, হ্যাঁলো, শ্যামল দা, আমি নিশীতা। কালকের পত্রিকার ফাইনাল পেস্টিং কি হয়ে গেছে?
অন্যপাশের কথা শুনে নিশীতা মাথা নেড়ে বলল, আপনি আটকে রাখেন। প্রথম পৃষ্ঠায় নতুন লিড নিউজ যাবে, আপনাকে আমি ফোন করব। ভেরি ভেরি ইম্পরট্যান্ট। মোজাম্মেল ভাইকে জানিয়ে রাখেন। আর শোনেন, হোম ডিপার্টমেন্টে আপনার পরিচিত মানুষ আছে?
অন্যপাশের কথা শুনে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল চমৎকার। আমাদের সাহায্যের দরকার হতে পারে।
অন্যপাশ থেকে কিছু একটা বলল, শুনে নিশীতা শব্দ করে হেসে বলল, না–না– শ্যামল দা, আপনি ভয় পাবেন না। গতবারের মতো হবে না। আমি কোনো বিপদে পড়ব না।
টেলিফোনটা বন্ধ করে নিশীতা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে মধুরভাবে হেসে বলল, আমি আশা করছি আপনারা যেটা করছেন সেটা পুরোপুরি আইনসম্মত! না হলে অবশ্য আমার ক্যারিয়ারের জন্য ভালো, একটা হট স্টোরি দেওয়ার ক্রেডিট পেতে পারি!
মানুষগুলো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের মাঝে কথা বলল, তারপর একজন এগিয়ে এসে রিয়াজ হাসানকে বলল, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ব্যাপারটি শুধু ন্যাশনাল নয়, ইন্টারন্যাশনালি গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি সহযোগিতা না করেন সহযোগিতা আদায় কেমন করে করতে হয় আমরা জানি।
রিয়াজ হাসান কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষগুলো এবারে বের হয়ে যাবার জন্য দরজার দিকে হাঁটতে থাকে। ফ্রেড লিস্টার রিয়াজ হাসানের কাছে এগিয়ে এসে নিচু গলায় ইংরেজিতে বলল, রিয়াজ, আমরা যে টিম এসেছি তার সাথে স্টেট ডিপার্টমেন্টের বব ম্যাকেঞ্জি বলে একজন লোক এসেছে। বব ম্যাকেঞ্জি কে জান?
কে?
আশির দশকে পাকিস্তানে ছিল। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ব্লককে থামানোর জন্য সে পুরো পাকিস্তানকে কিনে নিয়েছিল। বব আমাকে বলেছে মোটামুটি সস্তাতেই কিনেছিল।
রিয়াজ শীতল চোখে ফ্রেড লিস্টারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমাকে এসব কথা বলছ কেন?
কারণ বব এবারেও ডিপ্লোমেটিক ব্যাগ হিসেবে দুটি বড় বড় সূটকেস এনেছে। সুটকেস বোঝাই ডলার দিয়ে। সব নতুন এক শ ডলারের নোট। যাদের যাদের কিনতে হয় আমরা কিনে নেব। দেখতেই পাচ্ছ কিনতে শুরু করেছি!
রিয়াজ দাতে দাঁত ঘষে বলল, আমি যখন আমেরিকাতে তোমার সাথে কাজ করতাম তখনো তোমাকে ঘেন্না করতাম। এখনো ঘেন্না করি।
ফ্রেন্ড লিস্টার হা হা করে হেসে বলল, আমার বিরোধিতা করে তোমার কী অবস্থা। হয়েছে তো দেখেছ! আগের অবস্থার পুনরাবৃত্তি কোরো না রিয়াজ। বব ম্যাকেঞ্জি এর মাঝেই খুব উঁচু জায়গায় আমার জন্য খুবই ভালো ভালো বন্ধু যোগাড় করেছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। ফ্রেড লিস্টার নিশীতাকে দেখিয়ে বলল, তোমার এই গার্লফ্রেন্ডকে ছারপোকার মতো পিষে মারবে। আমার একটা উপদেশ মনে রেখো–বন্ধু ভেবেচিন্তে ঠিক করতে হয়। কোনো কোনো বন্ধু বিপদ থেকে রক্ষা করে আবার কোনো কোনো বন্ধু কিন্তু বিপদ ডেকে আনে।
তোমার মূল্যবান উপদেশের জন্য অনেক ধন্যবাদ ফ্রেড।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কঠিন চেহারার মানুষটি ফ্রেন্ড লিস্টারকে ডাকল, চলে এস ফ্রেড।
ফ্রেড খানিকটা কৌতুকের ভঙ্গিতে রিয়াজের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সবাই বের হয়ে যাবার পর রিয়াজ হাসান নিশীতার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করল, বলল, তুমি না এলে খুব বড় বিপদে পড়ে যেতাম। থ্যাংকস নিশীতা।
রিয়াজ হাসান নিশীতাকে আপনি করে বলত, ঘটনার উত্তেজনায় এখন তুমি করে বলছে! নিশীতা সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না, বলল, ইউ আর ওয়েলকাম। তারপর বুক থেকে আটকে থাকা একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, এখানে কী হচ্ছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আমিও বুঝতে পারছি না। তবে বোঝা যাচ্ছে মহাকাশ থেকে কিছু একটা আসা নিয়ে তুমি যে সন্দেহ করছিলে সেটা সত্যি।
নিশীতা চমকে উঠে রিয়াজের দিকে তাকাল, সত্যি?
হ্যাঁ। দেখতেই পাচ্ছ আমেরিকা থেকে পুরো দল চলে এসেছে। পালের গোদা হচ্ছে ফ্রেড লিস্টার। আমরা ওকে ডাকতাম ফ্রেড ব্লিস্টার। ব্লিস্টার মানে ফোঁসকা। বিষফোড়া ভয়ানক বদমাইশ।
কেন? কী হয়েছে?
মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করার সময় কিছু নিয়মকানুন মানতে হয়। পৃথিবীর নিরাপত্তার ব্যাপারটি দেখতে হয়। কিন্তু ফ্রেড লিস্টার এই বিষফোড়া সেসব করত না। একবার করেছে কী–
রিয়াজ হঠাৎ কথা থামিয়ে বলল, ওসব ছেড়ে দাও। নতুন যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচি না, পুরোনো যন্ত্রণার কথা বলতে ভালো লাগে না।
নিশীতা জিজ্ঞেস করল, নতুন যন্ত্রণাটি কী?
মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগ করার জন্য আমি যে এলগরিদম তৈরি করেছিলাম এই ব্যাটা সেটা চায়।
কিন্তু আমি তো দেখেছি আপনি সেটি পাবলিশ করেছেন। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জার্নালে সেটা প্রকাশ হয়েছে।
সেটা ছিল প্রাথমিক ভার্সান। পুরো কাজটুকু শেষ করার পর সেটা কোথাও প্রকাশ হয় নি।
সেটা কী ধরনের কাজ?
রিয়াজ হাসান জিনিসটা কীভাবে বোঝাবে সেটা নিয়ে দুই এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, আমরা যেহেতু মানুষ তাই যখন যোগাযোগের কথা বলি সবসময় একজন মানুষ অন্য মানুষের সাথে কীভাবে যোগাযোগ করবে সেইভাবে চিন্তা করি। কিন্তু যদি একটা মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগ করতে হয় তা হলে মানুষের মতো চিন্তা করলে হবে না। যে কোনো বুদ্ধিমত্তার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা উপায়ে যোগাযোগ করতে হবে। আমার এলগরিদমটা তাই.–মানুষের থেকে অনেকগুণ বেশি বুদ্ধিমত্তার সাথে যোগাযোগ করার একটা উপায়।
ও! ফ্রেড লিস্টার সেটা চাইছে?
হ্যাঁ। আমি ফ্রেন্ড লিস্টারকে চিনি, তাই তাকে দিতে রাজি হই নি।
তার মানে আমার সন্দেহ সত্যি। আসলেই এখানে কোনো মহাজাগতিক প্রাণী এসে নেমেছে?
আমার তাই ধারণা।
নিশীতা তখনো পুরো ব্যাপারটি পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারে নি। নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, রিয়াজ হাসান তাকে বাধা দিয়ে বলল, কী বিচিত্র ব্যাপার তুমি একেবারে
আমি একেবারে?
রিয়াজ হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ছিঃ ছিঃ, কী লজ্জা আপনি এত বড় একজন সাংবাদিক অথচ আপনাকে এতক্ষণ থেকে তুমি করে বলছি!
নিশীতা মাথা নাড়ল, বলল, সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। কী বলছিলেন বলেন।
আমি বলছিলাম কী, আপনি মানে তুমি ঠিক সময়ে হাজির হয়েছ, তুমি যদি ঠিক এই সময়ে না আসতে–
আসব না কেন, খবর পাওয়ার পর আমি দেরি করি নি।
খবর? রিয়াজ অবাক হয়ে বলল, কিসের খবর?
ঐ যে টেলিফোনে খবর পাঠালেন।
খবর পাঠিয়েছি? আমি?
তা হলে কে? আমাকে টেলিফোনে আসতে বলল—
কে বলেছে?
নিশীতা ভুরু কুঁচকে রিয়াজের দিকে তাকাল, আপনি কাউকে দিয়ে খবর পাঠান নি?
না।
আশ্চর্য! আমার মনে হল মানুষটাকে আমি চিনি, গলার স্বর আগে কোথাও শুনেছি। নিশীতা হঠাৎ চমকে উঠে বলল, এপসিলন!
কী হয়েছে এপসিলনের?
এপসিলন আমাকে ফোন করেছিল! এখন মনে পড়েছে–সেটা ছিল এপসিলনের গলার স্বর। প্রশ্ন করে কথা বলছিল।
রিয়াজ খানিকক্ষণ অবাক হয়ে নিশীতার দিকে তাকিয়ে রইল–তার দৃষ্টি দেখে মনে হল নিশীতার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। নিশীতা একটু অপ্রস্তুত হয়ে রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হল? আপনি এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন?
রিয়াজ হাসি গোপন করার চেষ্টা করতে করতে বলল, তোমার কল্পনাশক্তি দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি।
আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না? এপসিলনকে জিজ্ঞেস করে দেখুন।
দেখ নিশীতা, তার কোনো প্রয়োজন নেই। এপসিলনের পুরো কোডটা আমি লিখেছি। এটা একটা ছেলেমানুষি প্রোগ্রাম। তোমাকে টেলিফোন করার ক্ষমতা এর নেই।
কিন্তু এপসিলন আমার টেলিফোন নম্বরটি জানত কি না?
রিয়াজ মাথা নেড়ে বলল, তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন এপসিলন একটি সত্যিকার মানুষ, তার বুদ্ধিমত্তা আছে।
নিশীতা অধৈর্য হয়ে বলল, আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেন নি–এপসিলন কি আমার টেলিফোন নম্বর জানে?
আমি তোমার টেলিফোন নম্বরটি ওর ডাটাবেসে রেখেছিলাম– প্রয়োজনীয় নাম ঠিকানা রেখে দিই। তার অর্থ এই নয় যে, সে সেটি জানে।
নিশীতা চোখ বড় বড় করে বলল, আমার সেলফোনে টেলিফোন করার মতো হার্ডওয়্যারের সাথে এপসিলনকে লাগিয়ে রেখেছেন কি না?
রিয়াজকে হঠাৎ কেমন যেন হতচকিত দেখাল, খানিকক্ষণ অবাক হয়ে নিশীতার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মজার ব্যাপার জান–সেদিন তুমি চলে যাবার পর আমি সত্যি সত্যি একটা এ্যান্টেনার সাথে ট্রান্সমিটারটা জুড়ে দিয়েছিলাম। মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগ করার জন্য আমার এলগরিদম ব্যবহার করে একটা সিগনাল পাঠাচ্ছিল–খুব দুর্বল সিগনাল, ঢাকা শহরের ভিতরে যেতে পারে। সেই সিগনালটি ব্যবহার করে তোমার সেলফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব।
নিশীতা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, দেখেছেন?
রিয়াজ হাত নেড়ে বলল, দেখেছি, কিন্তু আগেই এত উত্তেজিত হয়ো না। আমি যেটা বলছি সেটা হচ্ছে হার্ডওয়্যার ব্যবহার করে কিছু একটা করার সম্ভব-অসম্ভবের কথা। সত্যি সত্যি সেটা করার মতো বুদ্ধিমত্তা এপসিলনের নেই, আমার কোনো কম্পিউটারেরও নেই।
কিন্তু আপনি দেখতে পাচ্ছেন সেটা ঘটেছে।
সেটা ঘটে নি। রিয়াজ একটু অধৈর্য হয়ে বলল, তুমি যেটা বলছ সেটা অসম্ভব। অনেকটা যেন আমি একটা কাগজের প্লেন ছুঁড়েছি–সেটা তিন শ প্যাসেঞ্জার নিয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে নিউইয়র্কে ল্যান্ড করে গেছে।
নিশীতা হাত দিয়ে তার চুলকে পিছনে সরিয়ে বলল, আপনি এপসিলনকে জিজ্ঞেস করে দেখেন।
রিয়াজ হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, তোমার যদি জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে করে তুমি করে দেখো–আমি করছি না। এপসিলনকে প্রশ্ন করা আর আমার মাইক্রোওয়েভ ওভেনকে জিজ্ঞেস করা একই কথা!
নিশীতা মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায়? এপসিলন কোথায়?
রিয়াজ হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, ঐ যে ওদিকে।
নিশীতা এগিয়ে যেতে শুরু করতেই রিয়াজ বলল, নিশীতা তুমি ছেলেমানুষি কাজটা শুরু করার আগে তোমার পত্রিকা অফিসে ফোন করে বল। তারা তোমার লিড নিউজের জন্য বসে আছে।
নিশীতা হেসে বলল, না, বসে নেই।
কেন বসে নেই? তুমি যে ফাইনাল পেস্টিং বন্ধ করে রাখতে বললে?
নিশীতা খিলখিল করে হেসে বলল, কেমন করে বলব, আমার টেলিফোনের ব্যাটারি শেষ হয়ে গেছে। আমি ওদের সাথে কথা বলি নি, কথা বলার ভান করছিলাম।
রিয়াজ হাসান চোখ কপালে তুলে বলল, কী বললে? ভান করছিলে? আসলে কারো সাথে কথা বল নি?
না। আমাদের সাংবাদিকদের এ রকম আরো অনেক ট্রিকস্ আছে, সময় হলেই দেখবেন!
রিয়াজ হাসান খানিকক্ষণ নিশীতার দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসতে শুরু করল নিশীতা ততক্ষণে মনিটরটির সামনে পৌঁছে গেছে, এপসিলনের চেহারা ফুটে উঠেছে, সেটি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কে, কে হাসে?
তুমি জান না কে হাসছে?
এপসিলন খানিকক্ষণ নিশীতার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, জানি।
রিয়াজ হাসান হঠাৎ হাসি থামিয়ে অবাক হয়ে নিশীতার দিকে তাকাল। নিশীতা বলল, কী হয়েছে?
রিয়াজ নিশীতার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রায় ছুটে এসে মনিটরটির সামনে দাঁড়াল, বিস্ফারিত চোখে এপসিলনের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বললে এপসিলন?
এপসিলন কোনো কথা না বলে চোখ ঘুরিয়ে রিয়াজের দিকে তাকাল। নিশীতা একটু অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে ড. হাসান?
রিয়াজ হতচকিতের মতো নিশীতার দিকে তাকিয়ে বলল, এটি এপসিলন নয়।
কেন?
কারণ এপসিলন সব সময় প্রশ্নের উত্তর দেয় প্রশ্ন দিয়ে। এটি দেয় নি।
তা হলে এটি কে? রিয়াজ ঘুরে এপসিলনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি জানি না।
» ০৫. হান্নান গালে বসে থাকা
হান্নান গালে বসে থাকা একটা মশাকে থাবা দিয়ে মেরে চটকে ফেলল, জায়গাটা অন্ধকার বলে দেখতে পেল না মশাটা তার রক্ত খেয়ে পুরুষ্ট হয়েছিল, গালে সেই রক্তের দাগ লেগেছে। হান্নানের শরীরে অনুভূতি সেরকম তীক্ষ্ণ নয়, মশা কামড়ালে প্রায় সময়েই টের পায় না; গালের চামড়া নরম বলে মাঝে মাঝে বুঝতে পারে। হান্নান একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আছে গত আধঘণ্টা থেকে, আরো কতক্ষণ বসে থাকতে হবে জানে না। তাকে সাড়ে তিন হাজার টাকার চুক্তিতে ঠিক করা হয়েছে রমিজ মাস্টারকে খুন করার জন্য। রমিজ মাস্টার রাত্রিবেলা বাজারে চায়ের দোকানে চা খেতে যায়, সেখানে একটা ছোট টেলিভিশন আছে, টেলিভিশনে বাংলা খবর শুনে বাড়িতে ফিরে আসে। মোটামুটি রুটিনমাফিক–কাজেই হান্নানের সুবিধে হল। একজন মানুষকে নিরিবিলি পাওয়াটাই কঠিন, খুন করাটা পানির মতো সোজা। আজকাল হান্নানের একটা গুলিতেই কাজ হয়ে যায়। সে অবশ্য তবু আরো দুইটা গুলি খরচ করে। গুলির দাম আছে বাজে খরচ করা ঠিক না। রিভলবারটা অবশ্য তার নিজের, অনেক কষ্ট করে যোগাড় করেছে। হান্নান এক ধরনের স্নেহ নিয়ে কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবারটার গায়ে হাত বুলিয়ে দেখল, চাইনিজ রিভলবার খুব বিশ্বস্ত জিনিস, তার রুজি–রোজগারের এক নম্বর অবলম্বন। এই লাইনে কাজ অনেক বেড়েছে কিন্তু উপার্জন সেরকম বাড়ে নি। আগে হলে এই রকম একটা খুন করার জন্য সে চোখ বুজে দশ হাজার টাকা চাইতে পারত, এখন পুঁচকে পুঁচকে মস্তানে দেশ ভরে গেছে। দুই শ টাকাতেই কাজ সেরে ফেলতে চায়–অভিজ্ঞতা নাই, লোভ বেশি। তবে নূতন মস্তানরা কাজকর্ম গুছিয়ে করতে পারে না বলে লোকজন এখনো তার কাছে আসে। আগে। বেশিরভাগ কেস ছিল জমি নিয়ে শত্রুতা, আজকাল সেটা হয়েছে রাজনীতি। রমিজ মাস্টারও রাজনীতির কেস–মনে হয় ইউনিয়ন ইলেকশনের ব্যাপার, হান্নান অবশ্য মাথা ঘামায় না, তার টাকা পেলেই হল!
হান্নান পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে এদিক–সেদিক তাকিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। হাত দিয়ে সিগারেটের আগুন ঢেকে সে একটা লম্বা টান দিল, সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে, রমিজ মাস্টার দশ–পনের মিনিটের মাঝেই এসে যাবে। হান্নান নিজের ভিতরে কোনো উত্তেজনা অনুভব করে না। মানুষ তো আর সারা জীবন বেঁচে থাকে না, আগে হোক পরে হোক মারা যাবেই। গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়, রোগশোকে মারা যায় না হয় তার হাতেই মারা গেল। হান্নান আজকাল আর ঠিক করে হিসাব রাখে না– তার হাতে কত জন মারা গেল। হিসাব রেখে কী হবে?
গলায় বসে থাকা পুরুষ্ট আরো একটা মশাকে থাবা দিয়ে চটকে দিতেই হান্নানের মনে হল সে কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেল। হান্নান সিগারেটটা হাতে আড়াল করে রেখে উঠে দাঁড়াল, ডান হাতে কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবারটা বের করে নেয়। রমিজ মাস্টার কি না সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি, ভুলে অন্য কাউকে খুন করে ফেলা মানে অহেতুক কয়টা গুলি খরচ। আজকাল গুলির অনেক দাম।
একজন মানুষ লম্বা পা ফেলে হেঁটে আসছে, হান্নান রমিজ মাস্টারকে কয়েকদিন থেকে লক্ষ করে আসছে, সে প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে গেল যে এটাই রমিজ মাস্টার। কাছাকাছি এলে একবার জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাবে। হান্নান সিগারেটটা ফেলে দিল। গুলি করার সময় রিভলবারটা দুই হাতে ধরলে নিশানা ভালো হয়।
রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে থাকা হান্নানকে দেখে রমিজ মাস্টার যেরকম অবাক হবে ভেবেছিল সে কিন্তু সেরকম অবাক হল না। বেশ সহজ গলাতে বলল, কে? মাকসুদ আলী নাকি?
না। আমার নাম হান্নান।
ও।
আপনি কি রমিজ মাস্টার?
জি। আমি রমিজ মাস্টার। কেন?
হান্নান তখন দুই হাতে রিভলবারটা ধরে উঁচু করল। এ রকম সময় মানুষ ভয় পেয়ে দৌড় দেয়, তখন নিশানা ঠিক করে গুলি করতে হয়। যারা এই লাইনে নতুন তারা শরীরে গুলি করে, শরীর বড় তাই গুলি করা সোজা। কিন্তু শরীরে গুলি করলে মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি নেই, মাথায় গুলি লাগাতে পারলে এক শ ভাগ গ্যারান্টি। মানুষের শরীরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে মাথা।
রমিজ মাস্টার কিন্তু দৌড় দিল না, অবাক হয়ে হান্নানের দিকে তাকাল। হান্নান ট্রিগার টানতে গিয়ে থেমে গেল কারণ রমিজ মাস্টার আসলে হান্নানের দিকে তাকায় নি, হান্নানের। পিছন দিকে তাকিয়েছে। সেখানে কিছু একটা দেখে সে খুব অবাক হয়েছে। হান্নান খসখস করে কিছু একটা শব্দ শুনল, শব্দটা ভালো না। এই প্রথমবার তার বুকের মাঝে ধক করে। উঠল–এতদিন ধরে সে এই লাইনে কাজ করে আসছে কখনো এ রকম কিছু হয় নাই। রিভলবারটা দুই হাতে ধরে রেখে সে পিছনে ফিরে তাকাল এবং হঠাৎ করে তার সমস্ত শরীর পাথরের মতো জমে গেল।
তার থেকে চার–পাঁচ হাত দূরে বিচিত্র একটা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, মূর্তিটি মানুষের না দানবের বোঝা যায় না। মূর্তিটির হাত পা মাথা নাক চোখ মুখ সবকিছুই আছে, কাজেই নিশ্চয়ই মানুষই হবে, কিন্তু দেখে মানুষ মনে হয় না। শরীরটি ধাতব, চোখ দুটি থেকে লাল আলো বের হচ্ছে। মাথাটুকু কেমন যেন ফুলে গিয়েছে, তার ভিতর থেকে কিলবিলে এক ধরনের অনেকগুলো ঔড় বের হয়ে এসেছে; সেগুলো আস্তে আস্তে নড়ছে। একটা হাত কাটা, সেখান থেকে এক ধরনের যন্ত্রপাতি বের হয়ে এসেছে। হান্নান আতঙ্কে চিৎকার করে বলল, কে? কে এটা?
সেই বিচিত্র মূর্তি কোনো শব্দ করল না, হান্নানের দিকে এক পা এগিয়ে এল। হান্নান তখন লক্ষ করল মূর্তিটির শরীরের ভিতরে কিছু একটা নড়ছে এবং গলার কাছাকাছি এসে হঠাৎ করে চামড়া ফুটো করে জীবন্ত কিছু বের হয়ে এল। প্রাণীটি একটা সরীসৃপের আকারের, কিন্তু পৃথিবীর কোনো পরিচিত প্রাণীর সাথে তার মিল নেই।
রাতজাগা পাখির মতো কর্কশ শব্দ করে সেই জীবন্ত প্রাণীটি ক্ষিপ্র পশুর মতো হান্নানের ওপর লাফিয়ে পড়ল। হান্নান তার রিভলবার দিয়ে প্রাণীটাকে গুলি করে, বুলেটের আঘাতে সেটি থমকে দাঁড়ায় কিন্তু থেমে যায় না। প্রাণীটি হান্নানের বুকের ওপর চেপে বসে এবং কিছু বোঝার আগেই তার শরীর ফুটো করে ভিতরে ঢুকে যেতে শুরু করে। প্রচণ্ড আতঙ্কে হান্নান চিৎকার করতে থাকে কিন্তু কেউ তার চিৎকার শুনে এগিয়ে আসে না।
রমিজ মাস্টার হঠাৎ করে সংবিৎ ফিরে পেল। সে ভয় পেয়ে পিছনে দুই পা সরে আসে তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে। হান্নানের চিৎকার ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হতে থাকে, কিন্তু রমিজ মাস্টার তবুও থামার সাহস পায় না।
.
ক্যাপ্টেন মারুফ জিপ থেকে নেমে তার সাথে আসা মিলিটারি জওয়ানদের রাস্তাটি ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলল। একটু আগে তার কাছে নির্দেশ এসেছে এই এলাকাটা ঘিরে ফেলতে। এখানে একটা খুব খারাপ ভাইরাসের আউটব্রেক হয়েছে, সব মানুষকে সরিয়ে নিতে হবে। তার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, যতক্ষণ পুরোপুরি কাজ শুরু করা না হয় তাকে এই এলাকাটি চোখে চোখে রাখতে বলা হয়েছে। ভাইরাসটি এবোলা ভাইরাসের মতো, তবে সংক্রমণ শুরু হয় মস্তিষ্ক থেকে। যাদের সংক্রমণ হয় তারা এক ধরনের আতঙ্কে অস্থির হয়ে যায়, ভূত দানব দেখেছে বলে দাবি করতে থাকে। ক্যাপ্টেন মারুফকে বিশেষ করে বলে দেওয়া হয়েছে সেরকম মানুষ দেখলে তাকে যেন আলাদা করে আটকে রাখা হয়।
ক্যাপ্টেন মারুফ তার নির্দেশমতো রাতের অন্ধকারে রাস্তাটি ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সে কিছু হিসাব মিলাতে পারছে না। সে বইপত্র পড়ে, এবোলা ভাইরাস নিয়েও পড়াশোনা করেছে–এই ভাইরাসের সংক্রমণ হলে মানুষের মস্তিষ্ক থেকে সংক্রমণ হয় না। পুরো শরীরে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যায়। এবোলা ভাইরাস আফ্রিকায় শুরু হয়েছে, বাংলাদেশে নয়। তা ছাড়া ভাইরাসের সংক্রমণ হলে খবরের কাগজে তার খবর ছাপা হত, এখানকার। হাসপাতালে রোগী যেত, ডাক্তারেরা বলত কিন্তু সেরকম কিছু হয় নি। সামরিক বাহিনী হিসেবে তারা আলাদা থাকে কিন্তু এখন হঠাৎ মনে হচ্ছে কিছু বিদেশী এই পুরো ব্যাপারটি নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমেরিকার বড় বড় কিছু হারকিউলেস পরিবহন বিমান এসেছে ভিতর থেকে বিদঘুঁটে হেলিকপ্টার নামানো হচ্ছে। বিচিত্র যন্ত্রপাতি নিয়ে আসা হচ্ছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য আমেরিকার মানুষের এত দরদ কেন? আগে তো কখনো হয় নি।
ক্যাপ্টেন মারুফ অন্যমনস্কভাবে হেঁটে একটু সামনে এগিয়ে যায়, ঠিক তখন দেখতে পায় একজন মানুষ পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে আসছে। দুই জন জওয়ান মানুষটিকে থামানোর জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল, ক্যাপ্টেন মারুফ হাত তুলে তাদের থামাল।
রমিজ মাস্টার ছুটতে ছুটতে ক্যাপ্টেন মারুফের কাছে এসে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে কিন্তু সে এত ভয় পেয়েছে এবং ছুটে এসে এমনভাবে হাঁপিয়ে উঠেছে যে তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয় না। ক্যাপ্টেন মারুফ ভুরু কুঁচকে বলল, কী হয়েছে আপনার?
রমিজ মাস্টার একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, স্যার, ঐখানে একটা দানব। একটা রাক্ষস।
রাক্ষস?
জি স্যার। শরীরের ভিতর থেকে একটা জন্তু বের হয়ে এসে একজন মানুষের শরীরে ঢুকে গেছে। মানুষটাকে মেরে ফেলছে স্যার আপনারা তাড়াতাড়ি যান।
মেরে ফেলছে?
জি স্যার। আপনি চিন্তা করতে পারবেন না কী ভয়ানক। রমিজ মাষ্টার প্রচণ্ড আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকে। ক্যাপ্টেন মারুফ রমিজ মাস্টারের দিকে খানিকটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে, তাকে উপর থেকে বলা হয়েছে ভাইরাসটি মস্তিষ্ককে আক্রান্ত করে, যারা আক্রান্ত হয় তারা অমানুষিক ভয় পেয়ে বিচিত্র কথা বলতে শুরু করে, এই মানুষটির ঠিক তাই হচ্ছে, নিশ্চয়ই সেই বিচিত্র ভাইরাসের কারণে। ক্যাপ্টেন মারুফ মানুষটির দিকে তাকিয়ে তবু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারে না, তার কেন জানি মনে হতে থাকে মানুষের এই ভয়টি মস্তিষ্কের রোগ নয়। মনে হয় এটি সত্যি।
রমিজ মাস্টার ক্যাপ্টেন মারুফের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আপনারা যাবেন না? দেখতে যাবেন না? লোকটাকে বাঁচাতে যাবেন না?
ক্যাপ্টেন মারুফ প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে বলল, বাপ্যারটা আগে আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে। আপনি এখন আমাদের ঐ ভ্যানটার পিছনে গিয়ে বসেন।
জি না। আমি বসব না। আমার বাড়ি যেতে হবে।
আপনি এখন বাড়ি যেতে পারবেন না।
রমিজ মাস্টার অবাক হয়ে বলল কেন?
এই পুরো এলাকার সব মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
কেন?
একটা খুব খারাপ অসুখ ছড়িয়ে পড়ছে। একটা খারাপ ভাইরাস।
অসুখ? রমিজ মাস্টার মাথা নাড়ল, বলল, জি না স্যার। আমি এই এলাকার সব খবর জানি। এইখানে কোনো অসুখ নাই। কয়দিন থেকে আজব সব ব্যাপার হচ্ছে, কিন্তু কোনো অসুখ নাই।
ক্যাপ্টেন মারুফ ভুরু কুঁচকে বলল, আজব ব্যাপার?
জি। আজব ব্যাপার। একদিন এলাকার সব জন্তু–জানোয়ার খেপে গেল। একদিন কয়েকটা গাছের সব পাতা ঝরে গেল। এলাকার কিছু মানুষজন একেবারে নিখোঁজ হয়ে গেল। বিলের কাছে কী যেন হয় কেউ বুঝতে পারে না। রাত্রিবেলা চিকন একরকম শব্দ শোনা যায়। মানুষজন ভয় পায়–আজকে আমি দেখলাম ভয় পাওয়ার কারণটা কী।
ক্যাপ্টেন মারুফ মানুষটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, এবারে তার কথাবার্তাকে সত্যিই অসংলগ্ন মনে হচ্ছে। সে মোটামুটি শীতল গলায় বলল, আপনি ভ্যানটার পিছনে বসুন। এখন আপনি কোথাও যেতে পারবেন না।
কেন যেতে পারব না?
আপনাকে ভাইরাসে ধরেছে কি না আমাদের দেখতে হবে।
রমিজ মাস্টার ক্রুদ্ধ চোখে ক্যাপ্টেন মারুফের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি বসব না।
ক্যাপ্টেন মারুফ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা দুই জন জওয়ানকে ইঙ্গিত করতেই তারা রমিজ মাস্টারকে ধরে জোর করে টেনে নিয়ে গেল। রমিজ মাস্টার চিৎকার করে বলল, আমি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, পাকিস্তান মিলিটারি পর্যন্ত আমার গায়ে হাত দিতে সাহস পায় নাই, আর আপনাদের এতবড় সাহস
ক্যাপ্টেন মারুফ রমিজ মাস্টারের কথা শুনে কেমন জানি লজ্জিত বোধ করল–সত্যিই তো তার কী অধিকার আছে একজন মানুষকে এভাবে হেনস্থা করার? সে লম্বা পায়ে এগিয়ে গেল, কাছাকাছি একটা সেন্ট্রাল কমান্ড বসানো হয়েছে, সেখানে যোগাযোগ করে উপরের লোকজনের সাথে একটু কথা বলা যেতে পারে।
ওয়াকিটকি দিয়ে ক্যাপ্টেন মারুফ যোগাযোগ করল, কমান্ডিং অফিসার রমিজ মাস্টারের কথা শুনেই শিস দেওয়ার মতো একটা শব্দ করে বলল, মানুষটাকে আটকে রাখ, আমরা আসছি।
ক্যাপ্টেন মারুফ একটু ইতস্তত করে বলল, স্যার, ইনি থাকতে চাইছেন না।
জোর করে আটকে রাখ। এটা খুব জরুরি।
সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মাঝে একটা জিপের হেডলাইট দেখা গেল এবং জিপ থামার আগেই সেখান থেকে কমান্ডিং অফিসার লাফিয়ে নেমে এলেন। পিছন থেকে একজন বিদেশী মানুষ নেমে এল, ক্যাপ্টেন মারুফ মানুষটিকে আগে দেখে নি, সে ফ্রেড লিস্টার।
ক্যাপ্টেন মারুফের পিছু পিছু ফ্রেড লিস্টার এবং কমান্ডিং অফিসার ভ্যানের পিছনে রমিজ মাস্টারের কাছে হাজির হল। রমিজ মাস্টার চুপচাপ বসে আছে, তার মুখে এক ধরনের হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি। কমান্ডিং অফিসারকে দেখে কিছু একটা বলতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত থেমে গেল হঠাৎ করে বুঝতে পারল এখানে এদের সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই।
ফ্রেন্ড লিস্টার নিচু গলায় ইংরেজিতে কমান্ডিং অফিসারকে বলল, জিজ্ঞেস কর সে যে মূর্তিটা দেখেছে সেটি দেখতে কী রকম।
ক্যাপ্টেন মারুফ অবাক হয়ে ফ্রেন্ড লিস্টারের দিকে তাকাল, এটা যদি ভাইরাসের আক্রমণ হয়ে থাকে তা হলে কেন সে মূর্তির বর্ণনা জানতে চাইছে? রমিজ মাস্টারকে বাংলায় প্রশ্নটা করা হলে এক ধরনের অনিচ্ছা নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। কমান্ডিং অফিসারকে প্রত্যেকটা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিতে হল এবং ফ্রেড লিস্টার খুব গম্ভীর মুখে পুরোটা শুনে গেল। মৃর্তির শরীর থেকে একটা বিচিত্র জন্তু লাফিয়ে বের হওয়ার কথা বলতেই ফ্রেড লিস্টার হাত তুলে বলল, আর শোনার প্রয়োজন নেই একে এক্ষুনি কোয়ারেন্টাইন করতে হবে।
ক্যাপ্টেন মারুফ জিজ্ঞেস করল, কোথায় কোয়ারেন্টাইন করা হবে?
মাইলখানেক দূরে একটা স্কুল রয়েছে। সেটাকে কোয়ারেন্টাইন হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে।
স্যার, আপনারা কি সত্যিই এটাকে ভাইরাসের সংক্রমণ বলে সন্দেহ করছেন?
হ্যাঁ। অবশ্যই।
ক্যাপ্টেন মারুফ আপত্তি করে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল–সেনাবাহিনীতে নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়, সব সময় নিজের কথা বলার পরিবেশ থাকে না। কমান্ডিং অফিসার বলল, আমি একে নিয়ে যাচ্ছি।
ঠিক আছে স্যার।
আর কয়েক ঘণ্টার মাঝে বিশাল টুপ নামানো হবে। এখানে প্রায় দশ স্কয়ার কিলোমিটার এলাকা পুরোপুরি ঘিরে ফেলা হবে, ভিতরে কেউ যেতে পারবে না।
কীভাবে ঘিরে ফেলা হবে?
কাঁটাতার, ইলেকট্রিক লাইন এবং লেজার সারভেলেন্স।
ক্যাপ্টেন মারুফ হতবাক হয়ে কমান্ডিং অফিসারের দিকে তাকিয়ে রইল, লেজার সারভেলেন্স?
হ্যাঁ। কমান্ডিং অফিসার দাঁত বের করে হেসে বলল, আমেরিকান গভর্নমেন্ট সাহায্য করছে। আজ রাতের মাঝে কমপ্লিট হয়ে যাবে।
আর এই এলাকার মানুষগুলো?
ট্রাকে করে সরিয়ে নেওয়া হবে। ঐ দেখ ট্রাক আসছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ তাকিয়ে দেখল সত্যি সত্যি দৈত্যের মতো বড় বড় অনেকগুলো ট্রাক আসছে। মানুষজনের ভয়ার্ত কথাবার্তা, ছোট শিশু এবং মেয়েদের কান্না শোনা যাচ্ছে। মানুষজন ছোটাছুটি করছে, একজন আরেকজনকে ডাকাডাকি করছে। এত অল্প সময়ের নোটিশে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। সবকিছু নিয়ে একটা ভয়াবহ আতঙ্ক।
ঠিক কী কারণ জানা নেই কিন্তু ক্যাপ্টেন মারুফের হঠাৎ মনে হল পুরো ব্যাপারটি একটি বড় ধরনের ষড়যন্ত্র। এর মাঝে অন্য কিছু রয়েছে–ভাইরাস নয়, রোগশোক নয়, অন্য কিছু। ব্যাপারটি কী সে জানে না কিন্তু সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাপ্টেন মারুফ কেমন করে জানি বুঝতে পারে একটা ভয়ঙ্কর বিপদ এগিয়েছে।
০৬. সকালবেলা খবরের কাগজ হাতে
সকালবেলা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে নিশীতা একেবারে থ হয়ে গেল, পত্রিকায় বড় বড় হেডলাইন, ঢাকার উপকণ্ঠে ভয়াল ভাইরাস ভিতরে ভাইরাস সংক্রমণের বর্ণনা। ভাইরাসে আক্রান্ত হলে কী ধরনের উপসর্গ হতে পারে লেখা রয়েছে, শরীরের প্রতিটি অংশ। দিয়ে রক্তক্ষরণ একটি প্রধান উপসর্গ–সেটাকে তাই এবোলা ভাইরাসের কাছাকাছি কোনো প্রজাতি বলে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে।
ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করার জন্য সেই এলাকা থেকে কয়েক হাজার মানুষকে রাতের মাঝে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পুরো এলাকাকে কাটাতার দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে, সেখানে সামরিক প্রহরা বসানো হয়েছে। ভাইরাস দিয়ে সংক্রমণ হয়েছে এ রকম কিছু মানুষকে এর মাঝে কোয়ারেন্টাইন করা হবে।
নিশীতা পুরো খবরটা পড়ার আগেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। নিশীতার আম্মা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, কী হল? কোথায় যাচ্ছিস?
ফোন করতে।
কাকে ফোন করবি?
মোজাম্মেল ভাইকে। আমাদের এডিটর।
কেন? কী হয়েছে?
দেখছ না কী ছাপা হয়েছে?
আম্মা তখনো পত্রিকা দেখেন নি, বললেন, কী ছাপা হয়েছে?
তুমি সেটা বুঝবে না আম্মা–
আম্মা এবারে সত্যি সত্যি রেগে উঠলেন, গলা উচিয়ে বললেন, তুই এসব কী শুরু করেছিস? পৃথিবীতে তুই ছাড়া আর কোনো সাংবাদিক নেই? সকাল সাতটার সময় ঘর থেকে বের হয়ে যাস ফিরে আসিস রাত বারোটায়? দেশের কী অবস্থা জানিস না? একটা মোটর সাইকেলে টো টো করে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা ঘুরে বেড়াচ্ছিস? এখন সকালে নাশতা খাওয়ার সময় নাই তার আগেই টেলিফোন করতে হবে?
আম্মা, তুমি বুঝতে পারছ না
আমি খুব ভালো বুঝতে পারছি যে আমার কপালে অনেক দুঃখ আছে। আমার মরণ না হওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই–
এরপর আম্মা নিশীতার আব্বা কেমন করে তার ঘাড়ে সবকিছু চাপিয়ে দিয়ে মারা গেলে সেটা নিয়ে অভিযোগ করতে শুরু করলেন, আর মারা যখন গেলেনই কেন মেয়েটাকে এ রকম একটা আধা ছেলে আধা মেয়ে–ডানপিটে একরোখা উচ্ছল একটা চরিত্র তৈরি করে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গেলেন সেটা নিয়ে আক্ষেপ করতে লাগলেন। সবার মেয়েরা বিয়েশাদি করে ঘর–সংসার করছে আর তার মেয়েটি কেন এ রকম বাউণ্ডেলেপনা করে বেড়াচ্ছে সেটা নিয়ে খোদার কাছে নালিশ করতে শুরু করলেন। কাজেই। নিশীতাকে আবার খাবার টেবিলে এসে বসতে হল, পাউরুটিতে মাখন লাগিয়ে খেতে হল, চা শেষ করতে হল এবং তারপর টেলিফোন করতে যেতে পারল।
বাংলাদেশ পরিক্রমার সম্পাদক মোজাম্মেল হককে তার বাসায় পাওয়া গেল। ডায়াবেটিসের সমস্যা আছে বলে তিনি প্রতিদিন সকালে হাঁটতে বের হন, নিশীতা যখন ফোন করেছে তখন তিনি মাত্র হেঁটে ফিরে এসেছেন। মোজাম্মেল হক জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার নিশীতা? এই ভোরে?
আজকের সকালে খবরের কাগজ দেখেছেন?
দেখেছি, কী হয়েছে?
কী হয়েছে বুঝতে পারছেন না?
না।
ভাইরাসের খবরটা দেখেছেন?
দেখেছি। অনেক রাতে খবর এসেছে সবাই লিড নিউজ দিয়েছে।
আপনি বুঝতে পারছেন না এটা মিথ্যা?
মোজ্জামেল হক হাসার মতো শব্দ করে বললেন, মিথ্যা?
হ্যাঁ। এই এলাকায় একটা মহাজাগতিক প্রাণী নেমেছে বলে পুরো এলাকাটা ঘিরে ফেলে সব মানুষকে বের করে দিয়েছে।
হ্যাঁ, তুমি আগেও বলেছ।
নিশীতা একটু অধৈর্য হয়ে বলল, হ্যাঁ, যারা যারা সেই মহাজাগতিক প্রাণীকে দেখেছে কোয়ারেন্টাইন করার নামে তাদের সবাইকে আলাদা করে রেখেছে যেন কারো সাথে কথা বলতে না পারে!
মোজাম্মেল হক নরম গলায় বললেন, নিশীতা, তুমি আমাদের এত বড় জাঁদরেল একজন সাংবাদিক, তুমি যদি ছেলেমানুষের মতো কথা বল তা হলে তো মুশকিল। সন্দেহ থেকে তো খবর হয় না। খবর হতে হলে তার প্রমাণের দরকার।
আপনি কী প্রমাণ চান?
সবচেয়ে ভালো হয় তুমি যদি মহাজাগতিক প্রাণীটাকে ধরে প্রেসক্লাবে নিয়ে এসে তাকে দিয়ে একটা সাংবাদিক সম্মেলন করাতে পার। মোজাম্মেল হক নিজের রসিকতায়। নিজেই হা হা করে হাসতে শুরু করলেন।
নিশীতা রেগে বলল, মোজাম্মেল ভাই আপনি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন কেন?
মোজাম্মেল হক নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে প্রাণীটাকে যদি ধরে না আনতে পার অন্ততপক্ষে তার একটা ছবি তো দেবে? তা না হলে কেমন করে হবে?
ঢাকা শহর যে আমেরিকান সায়েন্টিস্ট দিয়ে গিজগিজ করছে, রাতারাতি এত বড় একটা। এলাকা ইলেকট্রিক তার দিয়ে ঘিরে ফেলল আপনার কাছে সেটা সন্দেহজনক মনে হচ্ছে না?
হচ্ছে।
তা হলে? সে জন্যই তো তোমরা আছ। তোমরা সত্যটা খুঁজে বের করে দাও।
ঠিক আছে মোজাম্মেল ভাই, আপনাকে আমি সত্য খুঁজে বের করে এনে দেব।
বেশ।
টেলিফোনটা রেখে দিয়ে নিশীতা প্রায় স্পষ্ট অনুমান করতে পারল মোজাম্মেল হক দুলে দুলে হাসছেন–তার একটা কথাও বিশ্বাস করেন নি।
.
বাংলাদেশ পরিক্রমার অফিস থেকে ভাইরাস আক্রান্ত এলাকাটা দেখতে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু কাজকর্ম শেষ করে বের হতে হতে নিশীতার দেরি হয়ে গেল। পথে কিছু খেয়ে নেবে বলে এলিফ্যান্ট রোডে একটা ভালো ফাস্টফুডের দোকানে থেমে আবিষ্কার করল সেখানে এত ভিড় যে বসার জায়গা নেই, লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। কয়েকজন মিলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়া যায়—সত্যি কথা বলতে কী, কয়েকজন মিলে শুধু দাঁড়িয়ে কেন হেঁটে বসে বা ছুটতে ছুটতেও খাওয়া যায়, কিন্তু একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়ার মাঝে কেমন যেন হ্যাংলাপনা রয়েছে। নিশীতা তাই খাবারের একটা প্যাকেট কিনে নিল, কোথায় বসে কিংবা কার সাথে খাবে চিন্তা করে তার ড, রিয়াজ হাসানের কথা মনে পড়ল, মানুষটিকে যেটুকু দেখেছে তাতে মনে হচ্ছে নাওয়া-খাওয়া ঠিক নেই। নিশীতা তাই তার জন্যও একটা খাবারের প্যাকেট কিনে নিয়ে রিয়াজ হাসানের বাসার দিকে রওনা দেয়। সেদিন রাত্রিবেলা এপসিলনকে প্রশ্ন না করে প্রশ্নের উত্তর দিতে দেখে রিয়াজ হাসান এত অবাক হয়েছিল যে বলার মতো নয়। ব্যাপারটি কীভাবে হয়েছে বোঝার জন্য তখন তখনই সে কাজে লেগে গিয়েছিল এরপর আর তার সাথে যোগাযোগ হয় নি। ফ্রেন্ড লিস্টারের দলবল আর কোনো উৎপাত করেছে কি না সেটারও একটা খোঁজ নেওয়া দরকার।
রিয়াজ হাসানের বাসার গেট হাট করে খোলা, দরজায় কলিংবেল অনেকবার টিপেও কেউ উত্তর দিল না। রিয়াজ হাসান বাসায় নেই ভেবে নিশীতা খানিকটা আশাহত হয়ে চলে আসছিল তখন কী ভেবে সে দরজার হ্যাঁন্ডেল ঘুরিয়ে অবাক হয়ে আবিষ্কার করল দরজাটি খোলা। সে ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে উচ্চৈঃস্বরে ডাকল, ড. হাসান।
কেউ উত্তর দিল না। নিশীতা তখন সাবধানে ভিতরে ঢুকে চমকে উঠল, মনে হচ্ছে এই বাসার ভিতরে প্রলয়কাণ্ড ঘটে গেছে। ঘরের সবকিছু ওলটপালট হয়ে আছে, ঘরময় যন্ত্রপাতি এবং কাগজপত্র ছড়ানো–ছিটানো। নিশীতার বুকটি হঠাৎ ধক করে ওঠে, সে সাবধানে। ভিতরে উঁকি দেয়। মনে হচ্ছে ঘরের ভিতর একটা টর্নেডা হয়ে গেছে। নিশীতা ভিতরের ঘরগুলো ঘুরে আবার বাইরের ঘরে এসে দাঁড়াল, মনে হচ্ছে এই ঘরটির উপর দিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝড় গেছে। নিশীতা নিচু হয়ে একটি–দুইটি কাগজ তুলে আনল। ছোটখাটো যন্ত্রপাতি ইতস্তত ছড়িয়ে আছে, একটা স্পর্শ করতেই কে যেন তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে উঠল, কে? কে ওখানে?
নিশীতা থমকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারল এটি এপসিলনের কণ্ঠস্বর। কাত হয়ে পড়ে থাকা মনিটরটির ভিতর থেকে এপসিলন নিশীতার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, নিশীতা? তুমি কি নিশীতা?
হ্যাঁ। আমি নিশীতা। নিশীতা এগিয়ে গিয়ে মনিটরটিকে সোজা করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে কী হয়েছে?
দেখতে পাচ্ছ না কী হয়েছে?
হ্যাঁ। দেখতে পাচ্ছি। ড. রিয়াজ হাসান কোথায়?
নাই।
নিশীতা ভুরু কুঁচকে এপসিলনের দিকে তাকাল, সে আবার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে প্রশ্ন। করে, রিয়াজ হাসানের মতে এটি অসম্ভব। নিশীতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এপসিলনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিয়েছেন রিয়াজ হাসান?
তাকে ধরে নিয়ে গেছে।
নিশীতা প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, কে ধরে নিয়ে গেছে?
ফ্রেড লিস্টারের লোকজন।
তুমি কেমন করে জান?
আমি দেখেছি।
তুমি কেমন করে দেখবে? তোমার চোখ নেই, আছে একটা সস্তা ভিডিও ক্যামেরা।
এপসিলন কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে নিশীতার দিকে তাকিয়ে রইল। নিশীতা অধৈর্য হয়ে বলল, কী হল? কথা বলছ না কেন?
ভাবছি।
কী ভাবছ?
তোমাকে কেমন করে বলব।
নিশীতা অবাক হয়ে এপসিলনের দিকে তাকিয়ে রইল, তার ভিতরে হঠাৎ একটা বিচিত্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়, মনে হয় এই ঘরে সে একা নয়, এখানে অন্য একজন আছে, সে যেরকম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এপসিলনের দিকে তাকিয়ে আছে ঠিক সেইভাবে অন্য কেউ তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল, কোথাও কেউ নেই কিন্তু তবু কী বিচিত্র এবং বাস্তব সেই অনুভূতি। নিশীতা জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, কী হল, কিছু বলবে না?
হ্যাঁ আমি রিয়াজকে বলেছি। সে জানে। কিন্তু এখন সে নেই, আমার মনে হয় তোমাকেও বলতে হবে।
নিশীতা একটু ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী বলবে?
তোমাদের অনেক বড় বিপদ নিশীতা।
নিশীতা চমকে উঠল, বলল, কী বললে?
বলেছি তোমাদের অনেক বড় বিপদ।
সেটা তুমি কেমন করে জানবে? তুমি পাঁচ শ বারো মেগাবাইটের একটা প্রোগ্রাম!
আমি পাঁচ শ বারো মেগাবাইটের একটা প্রোগ্রাম না। আমি পাঁচ শ বারো মেগাবাইটের একটা প্রোগ্রাম ব্যবহার করছি তোমার সাথে কথা বলার জন্য। তোমাদের সাথে কথা বলার এর চাইতে সহজ কোনো উপায় আমি খুঁজে পাই নি।
নিশীতা কাঁপা গলায় বলল, তুমি কে?
আমি সেটা বললে তুমি বুঝতে পারবে না, নিশীতা।
কেন? কেন বুঝতে পারব না?
একটা পিঁপড়া থেকে তুমি কি অনেকগুণ বেশি বুদ্ধিমান নও?
হ্যাঁ।
কিন্তু তুমি কি একটা পিঁপড়াকে বোঝাতে পারবে তুমি কে?
নিশীতা নিশ্বাস আটকে রেখে বলল, তুমি দাবি করছ তোমার বুদ্ধিমত্তার কাছে আমি পিঁপড়ার মতো?
এটি একটি উপমা।
নিশীতা মনিটরটির কাছে গিয়ে বলল, আমি তোমার উপমা বিশ্বাস করি না।
তোমাকে আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে।
কেন?
কারণ তোমাদের অনেক বড় বিপদ। তোমাদের সাহায্য করার কেউ নেই।
কেন আমাদের অনেক বড় বিপদ?।
কারণ তোমরা চতুর্থ মাত্রার একটা মহাজাগতিক প্রাণীকে পৃথিবীতে ডেকে এনেছ।
নিশীতা ভুরু কুঁচকে বলল, আমরা?
হ্যাঁ। তোমরা। পৃথিবীর মানুষেরা। ফ্রেড লিস্টার আর তার দলবলেরা।
তাতে কী হয়েছে?
চতুর্থ মাত্রার প্রাণী এখানে তার প্রভৃতি রেখে যাবে।
রেখে গেলে কী হয়?
সেটি অনেক বড় বিপদ। দুইটি ভিন্ন বুদ্ধিমত্তার প্রাণী এক সময় এক জায়গায় থাকতে পারে না। একটি অন্যকে পরাভূত করে।
নিশীতা কোনো কথা না বলে এক ধরনের বিষয় নিয়ে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে রইল–এটি কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য যে একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম হঠাৎ করে এ রকম হয়ে যেতে পারে? নিশীতা হতবাক হয়ে মনিটরের এপসিলনের ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, একটু পর সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, আমরা এখন কী করব?
আমি জানি না।
তুমি জান না? তুমি বলেছ তুমি এত বড় বুদ্ধিমান প্রাণী, তা হলে তুমি জান না কেন?
কারণ তোমাদের সভ্যতাকে আমার স্পর্শ করার কথা নয়। তোমাদের সমস্যার সমাধান তোমাদের নিজেদেরই বের করতে হবে। আমি দুঃখিত নিশীতা।
তা হলে? তা হলে আমাদের কী হবে?
আমি জানি না।
.
নিশীতা দীর্ঘ সময় একা একা বসে রইল, কী করবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল তার ভয়ঙ্কর খিদে পেয়েছে। নিশীতা ঘরের বারান্দায় বসে তার খাবারের প্যাকেট বের করে বুভুক্ষের মতো খেতে শুরু করে। একা খাবে না বলে এখানে এসেছিল কিন্তু আবার
তাকে একাই খেতে হল। সে ঘড়ির দিকে তাকাল, প্রায় দুটো বেজে গিয়েছে। ভাইরাস আক্রান্ত বলে যে বিশাল এলাকা ঘিরে রাখা হয়েছে সেই এলাকাটা গিয়ে একবার দেখে আসতে হয়। রিয়াজ হাসান কোথায় আছে কে জানে। সত্যিই যদি ফ্রেন্ড লিস্টারের দল তাকে ধরে নিয়ে থাকে তা হলে তাকে ছাড়িয়ে আনা যায় কীভাবে? পুলিশের লোক কি বিশ্বাস করবে তার কথা? ফ্রেড লিস্টার নাকি দুই সুটকেস ভরে ডলার নিয়ে এসেছে, এই ডলারের সাথে সে কি যুদ্ধ করতে পারবে?
» ০৭. কালা জব্বারের মৃতদেহটি
কালা জব্বারের মৃতদেহটি যেখানে পাওয়া গিয়েছিল তার কাছাকাছি যাবার আগেই মিলিটারি পুলিশ নিশীতাকে আটকাল। বিস্তৃত এলাকা কাটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে, উপরে হাই ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক তার, নিশীতা জেমসবন্ডের সিনেমাতে এ রকম দেখেছে, সত্যি সত্যি যে হতে পারে তার ধারণা ছিল না। মিলিটারি পুলিশটি ভদ্রভাবে বলল, আপনি কোথায় যেতে চাইছেন?
নিশীতা হেলমেট খুলে তার কার্ড বের করে দেখিয়ে বলল, আমি সাংবাদিক, এই এলাকার ওপর রিপোর্ট করতে এসেছি।
ও! সাংবাদিকদের জন্য আলাদা সেল করা হয়েছে–আপনি এই রাস্তা ধরে সোজা এক মাইল চলে যান। ঘণ্টায় ঘণ্টায় সেখানে নিউজ বুলেটিন দেওয়া হচ্ছে।
ঘণ্টায় ঘণ্টায় গৎবাঁধা যে বুলেটিন দেওয়া হয় সেটাতে নিশীতার উৎসাহ নেই, সে ভিতরে একবার দেখে আসতে চায়, তাকে যেতে দেবে বলে মনে হয় না, কিন্তু তবু একবার চেষ্টা করল, বলল, আমি মোটর সাইকেলটা এখানে রেখে ভিতর থেকে চট করে দুটো ছবি তুলে নিয়ে আসি?
নিশীতার কথা শুনে হঠাৎ করে মিলিটারি পুলিশটির মুখ শক্ত হয়ে গেল, সে কঠিন গলায় বলল, না, কাউকে ভিতরে যেতে দেওয়া যাবে না। আপনি সাংবাদিকদের সেলে যান।
নিশীতা মাথায় হেলমেট চাপিয়ে তার মোটর সাইকেল স্টার্ট করল, পুরো এলাকাটা একেবারে নিচ্ছিদ্রভাবে ঘিরে রাখা হয়েছে। এর ভিতরে কোথাও নিশ্চয়ই একটা মহাজাগতিক প্রাণী আছে, কী বিচিত্র ব্যাপার এখনো তার বিশ্বাস হতে চায় না।
সাংবাদিকদের জন্য সেলটি খুব সুন্দর করে করা হয়েছে, তাদেরকে সংবাদ দেওয়া থেকে আপ্যায়ন করার মাঝে অনেক বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু সাংবাদিক এসেছেন, তারা মনে হয় বেশ ভালোভাবে আপ্যায়িত হয়ে আছেন। কয়েকটি কম্পিউটারে বুলেটিন প্রস্তুত করে তার প্রিন্ট আউট, রঙিন ছবি দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য একজন বড় অফিসার আছেন, তার সাথে সাদা পোশাক পরা দুজন ডাক্তার। সাংবাদিকরা তাদের নানা ধরনের প্রশ্ন করছে।
নিশীতা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তাদের কথাবার্তা শুনল, যখন ভিড় একটু কমে এল সে এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিল। বড় অফিসার মুখে বিস্তৃত হাসি ফুটিয়ে বলল, আপনাকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
আমি ফ্রেড লিস্টার নামে একজন আমেরিকান বিজ্ঞানীকে খুঁজছি।
এখানে ফ্রেড লিস্টার নামে তো কেউ নেই।
এখানে না থাকতে পারেন, কিন্তু আমি নিশ্চিত এই এলাকায় আছেন। তাকে একটু খোঁজ দেওয়া যেতে পারে?
বড় অফিসারটি গম্ভীর মুখে বলল, আমি কমান্ডিং অফিসে খোঁজ করতে পারি।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ফ্রেন্ড লিস্টারকে পাওয়া গেলে তাকে একটা খুব জরুরি। ম্যাসেজ দিতে হবে।
কী ম্যাসেজ?
আমি একটা কাগজে লিখে দিই, ম্যাসেজটা কটমটে, এমনি বললে আপনার মনে থাকবে না। নিশীতা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ইংরেজিতে লিখল, আমি রিয়াজ হাসানের এলগরিদমের কথা জানি। বব ম্যাকেঞ্জির সুটকেস ছাড়া ই.টি. বিষয়ক সাংবাদিক সম্মেলন আটকানো যাবে না।
কাগজটি হাতে নিয়ে বড় অফিসারটি ম্যাসেজটি পড়ে বলল, ঠিকই বলেছেন, এই ম্যাসেজ পড়ে মনে রাখা অসম্ভব! সাঙ্কেতিক ভাষার লেখা মনে হচ্ছে, পড়ে কিছুই তো বুঝতে পারলাম না!
নিশীতা হাসার ভঙ্গি করে বলল, জানা না থাকলে সবই সাঙ্কেতিক।
তা ঠিক। আপনি ওখানে বসুন, চা কফি কোল্ড ড্রিংকস আছে। আমি খোঁজ করে দেখি ফ্রেন্ড লিস্টারকে পাওয়া যায় কি না।
নিশীতা জানালার কাছে একটা নরম চেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। তার ভিতরে এক ধরনের অস্থিরতা তাকে এক মুহূর্ত শান্তি দিচ্ছে ঠিক, কিন্তু কী করবে সে বুঝতে পারছে না। ফ্রেন্ড লিস্টারের সাথে এভাবে দেখা করাটাও ঠিক হচ্ছে কি না সেটা নিয়েও সে আর নিশ্চিত নয়।
কয়েক মিনিটের মাঝে বড় অফিসারটি এসে বলল, ফ্রেড লিস্টারকে পাওয়া গেছে। প্রথমে আপনার সাথে কথা বলতে চাইছিল না কিন্তু আপনার ম্যাসেজটুকু পড়ে শোনানোর পর ম্যাজিকের মতো কাজ হয়েছে। একটা হেলিকপ্টারে করে চলে আসছে!
সত্যি?
হ্যাঁ। আপনি বসুন, বলেছে আধঘণ্টার মাঝে হাজির হবে।
আধঘণ্টার আগেই ছোট একটা খেলনার মতো হেলিকপ্টারে করে ফ্রেড লিস্টার হাজির হল। কাছাকাছি একটা ছোট মাঠে অনেক ধুলো ছড়িয়ে সেটি নামল এবং তার ভিতর থেকে ফ্রেন্ড লিস্টার মাথা নিচু করে নেমে এল। নিশীতা ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা। করতে থাকে।
ফ্রেড লিস্টারকে ঘরে ঢুকতে দেখে নিশীতা মুখে জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে গেল। ফ্রেড মুখ শক্ত করে বলল, তুমি কী চাও?।
আমি কী চাই সেটা পরে হবে, আগে সামাজিকতাটুকু সেরে নিই। নিশীতা হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত এগিয়ে দিল। ফ্রেড হাত স্পর্শ করতেই নিশীতা ঘুরে উপস্থিত সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা একটা ছবি নিন। ইনি ফ্রেন্ড লিস্টার, আমেরিকান খুব বড় বিজ্ঞানী। আমাদের সাহায্য করতে এসেছেন।
সাংবাদিকেরা এগিয়ে এসে ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে চোখের পলকে অনেকগুলো ছবি তুলে নিল। ফ্রেড লিস্টারের মুখ হঠাৎ করে পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। নিশীতা গলার স্বর নিচু করে বলল, এই ছবিগুলো নষ্ট করার জন্য তোমার বব ম্যাকেঞ্জির সুটকেসে টান পড়বে না তো?
ফ্রেড লিস্টার চোখ দিয়ে আগুন বের করে বলল, তুমি কী চাও?
আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই।
এস আমার সাথে।
কোথায়?
হেলিকপ্টারে।
তোমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে! আমি তোমার সাথে হেলিকপ্টারে উঠি আর তুমি ধাক্কা দিয়ে হেলিকপ্টার থেকে ফেলে দিয়ে বল, এবোলা ভাইরাসের আক্রমণে মাথা খারাপ হয়ে হেলিকপ্টার থেকে লাফ দিয়েছে!
তা হলে কোথায় কথা বলবে?
বাইরে চল, ঐ গাছটার নিচে কেউ নেই।
নিশীতা ফ্রেড লিস্টারকে নিয়ে কাছাকাছি একটা ঝাঁপড়া কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাঁড়াল। ফ্রেড লিস্টার মুখ শক্ত করে বলল, তুমি কী বলতে চাও?
ড. রিয়াজ হাসান কোথায়?
সেটি আমি কী করে বলব?
দেখ ফ্রেড, আমার সাথে মামদোবাজি কোরো না। আমি জানি তুমি ড. রিয়াজ হাসানকে ধরে নিয়ে গেছ।
আমি তোমার কাছে সেই কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।
বেশ। তা হলে আমি বলি আমি কী করব। আমি জানি এই এলাকায় একটা মহাজাগতিক প্রাণী এসেছে। সেই প্রাণীর সাথে তোমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করছ। ড. হাসানের এলগরিদমটা সে জন্য তোমাদের খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। ভাইরাসের কথা আসলে একটা ভাঁওতাবাজি সেটা আমি খুব ভালো করে জানি।
তুমি এর কিছু প্রমাণ করতে পারবে না।
নিশীতা মাথা নাড়ল, তুমি এত নিশ্চিত হয় না। তোমার ছবি নেওয়া হয়েছে, ওয়েবসাইট থেকে তোমাদের ওরগানোগামটি ডাউনলোড করলেই দেখা যাবে তুমি ভাইরাসের এক্সপার্ট নও তুমি মহাজাগতিক প্রাণীর এক্সপার্ট। আমি একটা সাংবাদিক সম্মেলন করে কমপক্ষে এক শ সাংবাদিক নিয়ে আসতে পারি। আমরা থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রি হতে পারি কিন্তু আমাদের সংবাদপত্র খুব স্বাধীন।
তুমি কত চাও?
নিশীতা একটা নিশ্বাস ফেলল, মানুষটি টোপ গিলতে শুরু করেছে। ধরেই নিয়েছে সে টাকার জন্য করছে, মনে হয় এই লাইনেই কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হবে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফ্রেডের দিকে তাকিয়ে বলল, প্রথমে রিয়াজ হাসানকে ছেড়ে দাও, তারপর আমি বলব।
ফ্রেড ঠোঁট কামড়ে খানিকক্ষণ কিছু একটা ভাবল, তারপর বলল, কিন্তু আমি কেমন করে নিশ্চিত হব যে তুমি কোনো পাগলামি করবে না?
আমার কথা তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে।
ঠিক আছে। তুমি এক ঘণ্টা পর হোটেল সোনারগাঁওয়ে যাও, সেখানে রিয়াজ হাসানকে পাবে।
চমৎকার।
তুমি নিশ্চয়ই জান, এই ব্যাপার নিয়ে তুমি উল্টাপাল্টা কিছু করলে তার ফল হবে ভয়ানক।
আমি জানি। নিশীতা ফিসফিস করে বলল, খুব ভালো করে জানি।
ফার্মগেটের কাছে পৌঁছানোর আগেই হঠাৎ নিশীতা শুনতে পেল তার সেলুলার টেলিফোনটি শব্দ করছে–কেউ একজন তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। অন্য কোনো সময় হলে সে টেলিফোনটি নিয়ে মাথা ঘামাত না, যে চেষ্টা করছে সে এক ঘণ্টা পরেও তার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে কিন্তু এখন নিশীতা কোনো ঝুঁকি নিল না। মোটর সাইকেল থামিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে নিশীতা তার টেলিফোনটি কানে লাগাল, হালো।
নিশীতা?
কথা বলছি।
নিশীতা, খুব সাবধান। একটা নীল মাইক্রোবাসে করে কিছু মানুষ তোমার পিছু পিছু আসছে।
আপনি কে?
তুমি জান আমি কে।
এপসিলন! তুমি এপসিলন।
আমি এপসিলনকে ব্যবহার করছি।
নীল মাইক্রোবাসে কারা আছে?
ফ্রেড লিস্টারের মানুষ।
তারা কী করতে চায়?
তোমাকে খুন করতে চায়। এরা খুব ভয়ঙ্কর মানুষ নিশীতা।
ঠিক আছে, আমি দেখছি।
টেলিফোনটা ব্যাগে রেখে নিশীতা পিছনে তাকাল, এখনো কোনো নীল মাইক্রোবাস দেখা যাচ্ছে না। নিশীতা প্রথমবার এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, সত্যি সত্যি যদি ফ্রেড লিস্টারের মানুষ তাকে খুন করার চেষ্টা করে তা হলে সে কী করবে? এই মুহূর্তে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এটি নিয়ে ভেবে সে কোনো সমাধান বের করতে পারবে না। নিশীতা আবার মোটর সাইকেলে চেপে বসল, স্টার্ট দিয়ে এক মুহূর্তে রাস্তার ভিড়ের মাঝে মিশে গেল।
হোটেল সোনারগাঁওয়ে পৌঁছানোর আগেই হঠাৎ রিয়ার ভিউ মিররে নিশীতা দেখল তার খুব কাছাকাছি একটা নীল রঙের মাইক্রোবাস। মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে ঝুঁকে একজন মানুষ বের হয়ে আছে, মানুষটি কী করছে সে দেখতে পেল না কিন্তু হঠাৎ তার ঘাড়ে তীক্ষ্ণ সুঁচ ফোঁটার মতো একটা যন্ত্রণা হল। নিশীতা ঘাড়ে হাত দিয়ে দেখে সেখানে ছোট কাচের সিরিঞ্জের মতো একটি এল বিধে আছে, সেটাকে টেনে বের করে আনতেই হঠাৎ তার মাথা ঘুরে গেল, কোনো একটা বিষাক্ত ওষুধ তার শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিশীতা কোনো ভাবে তার মোটর সাইকেলটা থামাল, কিন্তু সেখান থেকে নামতে পারল না। হুমড়ি খেয়ে নিচে পড়ে গেল। নিশীতা শুনতে পায় তার আশপাশে অসংখ্য গাড়ির হর্ন বাজছে, ব্রেক কষে থামার চেষ্টা করছে। নিশীতা চোখ খোলা রাখার চেষ্টা করে, দেখতে পায় নীল মাইক্রোবাসটি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, জানালার কাছে বসে থাকা মানুষটা মুখে এক ধরনের বিচিত্র হাসি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
দেখতে দেখতে তাকে ঘিরে মানুষের ভিড় জমে গেল, তাকে কিছু একটা বলছে সে শুনতে পাচ্ছে কিন্তু উত্তরে কিছু বলতে পারছে না। নিশীতা দেখল ঠিক পিছনে একটা জিপ এসে থেমেছে সেখান থেকে দুজন মানুষ নেমে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
নিশীতার পাশে উবু হয়ে বসে থাকা একজন মানুষ বলল, জানি না। হঠাৎ করে মোটর সাইকেল থামিয়ে পড়ে গেলেন।
মনে হয় ডায়াবেটিক শক। কিংবা হার্ট এ্যাটাক–দেখি সবাই সরে যান, একটু বাতাস আসতে দিন।
মানুষজন সরে লোকটাকে জায়গা করে দিল, নিশীতা চিনতে পারল এই মানুষটাকে সে রিয়াজ হাসানের বাসায় দেখেছে। নিশীতা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে দেখল মানুষটি এসে তার হাত ধরে পালস গোনার ভান করল, চোখের পাতা টেনে দেখল, তারপর সোজা হয়ে পঁড়িয়ে বলল, একে এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে।
উপস্থিত লোকজনের ভিতর থেকে একজন বলল, কেমন করে নেব? এম্বুলেন্স?
মানুষটি বলল, আমি হাসপাতালে পৌঁছে দেব, একে গাড়িতে তুলে দিন।
নিশীতা চিৎকার করে বলতে চাইল, না–আমাকে এদের হাতে দিও না, কিন্তু সে একটা কথাও উচ্চারণ করতে পারল না। নিশীতাকে ধরাধরি করে গাড়ির পিছনের সিটে শুইয়ে দেবার পর মানুষটি উপস্থিত মানুষদের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাদের কেউ সাথে যেতে চান?
একজন বলল, ঠিক আছে আমিও সাথে যাই।
নিশীতা চোখ ঘুরিয়ে মানুষটিকে দেখল, এই মানুষটিও তাদের দলের একজন, সবাইকে নিয়ে এখানে পুরোপুরি একটা নাটকের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিশীতা বুঝতে পারে খুব ধীরে ধীরে সে অচেতন হয়ে পড়ছে। তার মাঝে টের পেল তার মোটর সাইকেলটাকেও পিছনে তোলা হচ্ছে। কয়েক মুহূর্তের মাঝে জিপটা ছেড়ে দিল, নিশীতা শুনতে পেল একজন উচ্চৈঃস্বরে হাসতে হাসতে বলল, চমৎকার অপারেশন। একেবারে নিখুঁত।
একজন নিশীতার ওপর ঝুঁকে পড়ে গলায় শ্লেষ এনে বলল, সাংবাদিক সাহেবা– আপনি কি এখনো জেগে আছেন??
নিশীতা চোখ খুলে তাকাল, মানুষটি কুৎসিত একটা ভঙ্গি করে বলল, পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে …।
.
নিশীতার মনে হল অনেক দূর থেকে কেউ একজন তাকে ডাকছে। সে সাবধানে চোখ খুলে তাকাল, সত্যি সত্যি তার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে কোনো একজন মানুষ তাকে কোমল গলায় ডাকছে। নিশীতা মানুষটিকে চিনতে পারল, রিয়াজ হাসান।
সে চমকে উঠে বসার চেষ্টা করতেই মনে হল তার মাথার ভিতরে কিছু একটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণার একটা শব্দ করে সে আবার শুয়ে পড়ল। রিয়াজ হাসান বলল, কেমন আছ নিশীতা?
ভালো নেই, মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা!
কমে যাবে। ওষুধের অ্যাফেক্টটা কেটে যেতেই কমে আসবে।
আমরা কোথায়?
ঠিক জানি না, মনে হয় বারিধারার কাছে কোনো বাসায়।
নিশীতা চোখ খুলে চারদিকে তাকাল, একটা বড় গুদামঘরের মতো জায়গার একপাশে খানিকটা জায়গা ঘিরে ঘরটা তৈরি করা হয়েছে। এটি নিয়মিত কোনো বাসা নয়। তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে শক্ত মেঝেতে, নিচে হয়তো একটা কম্বল বিছানো হয়েছে এর বেশি কিছু নেই। ঘরের ভিতরে কোনো আলো নেই, বাইরের আলো স্কাই লাইটের ফাঁক দিয়ে ভিতরে এসে ঢুকছে। নিশীতা সাবধানে উঠে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল, এই ভয়ঙ্কর এবং অনিশ্চিত পরিবেশেও সে প্রথমে হাত দিয়ে চুল বিন্যস্ত করতে করতে বলল, আমাকে কি ভূতের মতো দেখাচ্ছে?
রিয়াজ হাসান হেসে বলল, তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে সেটাই তোমার প্রথম চিন্তার বিষয়?
নিশীতা একটু কষ্ট করে হেসে বলল, আমার ব্যাগটা কি আছে?
কেন?
ভিতরে একটা আয়না আছে, কেমন দেখাচ্ছে দেখতাম। চিরুনি দিয়ে চুলটা ঠিক করতাম।
রিয়াজ হাসান উঠে গিয়ে ঘরের অন্যপাশ থেকে তার ব্যাগটা এনে দিল। নিশীতা ব্যাগটা খুলতেই তার সেলুলার ফোনটি চোখে পড়ল, সে চোখ উজ্জ্বল করে বলল, সেলুলার ফোন! আমরা বাইরে ফোন করতে পারব!
রিয়াজ হাসান মাথা নাড়ল, বলল, না, পারবে না। তোমাকে যখন এখানে রেখে গেছে তখন লোকগুলো সেটা নিয়ে কথাবার্তা বলেছে। তোমার ফোনের ব্যাটারি ডিসচার্জ করে দিয়েছে।
নিশীতা ফোনটি হাতে নিয়ে দেখল সতি সত্যি এটি পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে আছে। ফোনটি পাশে সরিয়ে রেখে সে তার কমপ্যাক্ট বের করে তার ছোট আয়নাটাতে নিজেকে দেখে একটা গম্ভীর হতাশাব্যঞ্জক শব্দ বের করল। সে ব্যাগ হাতড়ে একটা চিরুনি বের করে তার চুলগুলোকে এক মিনিটের মাঝে বিন্যস্ত করে নেয়। রিয়াজ হাসানকে আড়াল করে ঠোঁটে দ্রুত একটু লিপস্টিকের একটা ছোঁয়া লাগিয়ে নিল।
রিয়াজ শব্দ করে হেসে বলল, আমি জানতাম না তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে সেটা তোমার কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ।
কেমন দেখাচ্ছে নয়–বলেন, ভূতের মতো দেখাচ্ছে কি না!
রিয়াজ হাসান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি না, তোমাকে ঠিক পরিবেশে বলার সুযোগ পাব কি না তাই এখনই বলে রাখি, তুমি যেভাবেই থাক তোমাকে কখনোই ভূতের মতো দেখায় না।
রিয়াজের গলার স্বরে কিছু একটা ছিল সেটা শুনে নিশীতা একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। রিয়াজ একটু লজ্জা পেয়ে বলল, আমি জানি না তোমাকে এর আগে কেউ বলেছে কি না–তোমার মাঝে একটা অসম্ভব সতেজ ভাব আছে। দেখে ভালো লাগে।
নিশীতা এবারে শব্দ করে হেসে ফেলল, বলল, শুনে খুশি হলাম যে অন্তত কেউ একজন বলল আমার সতেজ ভাবটি ভালো লাগে। সারা জীবন শুনে আসছি আমার তেজ হচ্ছে আমার সব সর্বনাশের মূল।
সেটিও নিশ্চয়ই সত্যি! রিয়াজ বলল, আজকে যে তুমি এখানে এই গাড্ডায় পড়েছ, আমার ধারণা সেটাও তোমার তেজের জন্য।
নিশীতা মাথা নাড়ল, বলল, না, পুরোটা তেজের জন্য না। আপনি জানেন একটা বিশাল ষড়যন্ত্র হচ্ছে আমি ধরে ফেলেছি সেটাই হচ্ছে সমস্যা। নিশীতা দেয়াল ধরে সাবধানে উঠে দাঁড়াল, দাঁড়িয়ে চারদিকে একবার তাকিয়ে বলল, আপনাকে কেন ধরে এনেছে?
আমার সেই কোডটার জন্য।
আপনি কি দিয়েছেন?
দিতে হয় নি। বাসা তোলপাড় করে নিজেরাই বের করে নিয়েছে।
তা হলে আপনাকে ধরে এনেছে কেন?
রিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি যেন কাউকে বলে না দিই সে জন্য। আমার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করবে।
কীভাবে করবে?
এ ব্যাপারে আমাদের ফ্রেন্ড লিস্টারের সৃজনী ক্ষমতা খুব কম। তার ধারণা টাকা দিয়েই সব করে ফেলা যায়।
নিশীতা ছোট ঘরটি ঘুরে ঘুরে পরীক্ষা করতে করতে হঠাৎ করে বলল, আমাদেরকে মেরে ফেলবে না তো?
রিয়াজ হাসান চমকে উঠে বলল, মেরে ফেলবে? মেরে ফেলবে কেন? একজন মানুষকে মেরে ফেলা কি এত সোজা?
জানি না। আমার কেন জানি ব্যাপারটা ভালো লাগছে না।
রিয়াজ মাথা নাড়ল, বলল, না। মেরে ফেলবে না। তোমার কথাটি ধর, তোমাকে মারতে চাইলে ঐ রাস্তাতেই মেরে ফেলতে পারত। মারে নি। তোমাকে অজ্ঞান করেছে– অনেক মানুষ দেখেছে তুমি রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছ, তোমাকে কিছু মানুষ তুলে নিয়ে গেছে। এখন যদি দেখে তোমার ডেডবডি, ব্যাপারটি নিয়ে সন্দেহ করবে না? পত্রপত্রিকায় হইচই শুরু হয়ে যাবে না? ফ্রেড লিস্টার একটা জিনিসকে খুব ভয় পায়–সেটা হচ্ছে খবরের কাগজ।
আপনার কথা যেন সত্যি হয়। নিশীতা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু কেন জানি পুরো ব্যাপারটি নিয়ে আমার কেমন ভয় ভয় করছে। আমার মনে হচ্ছে এর মাঝে খুব বড় একটা অশুভ ব্যাপার রয়েছে।
রিয়াজ আর নিশীতা দেয়ালে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। এ রকম পরিবেশে ক্ষুধা–তৃষ্ণার অনুভূতি থাকার কথা নয়, কিন্তু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে আবিষ্কার করল তাদের বেশ খিদে পেয়েছে। রাত দশটার দিকে একজন গোমড়ামুখো আমেরিকান মানুষ এসে তাদের কিছু খাবার দিয়ে গেল। খাবারগুলো পশ্চিমা খাবার, খুব সম্ভ্রান্ত রেস্টুরেন্ট থেকে আনা হয়েছে–দুজনে বেশ গোগ্রাসে খাওয়া শেষ করল। এ রকম সময়ে ঘরের দরজা দ্বিতীয়বার খুলে গেল এবং দেখা গেল সেখানে ফ্রেন্ড লিস্টার দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রেন্ড লিস্টারের পিছনে আরো দুজন পাহাড়ের মতো আমেরিকান মানুষ, মাথার চুল ছোট করে ছাটা দেখে মনে হয় মেরিন বা কমান্ডো জাতীয় কিছু। মানুষগুলো প্রকাশ্যেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে ঘুরছে। ফ্রেন্ড লিস্টার মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, রিয়াজ, পুরোনো বন্ধু আমার, তোমাকে আর তোমার গার্লফ্রেন্ডকে দেখতে আসতে দেরি হয়ে গেল। আমি খুবই দুঃখিত। তবে– ফ্রেড লিস্টার নোংরা একটা ভঙ্গি করে চোখ টিপে বলল, আমি সবাইকে বলে দিয়েছিলাম কেউ যেন তোমাদের ডিস্টার্ব না করে। কথা শেষ করে সে বিকট স্বরে হাসতে শুরু করে।
রিয়াজ ফ্রেন্ড লিস্টারের হাসি শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, তুমি আমাদের ধরে এনেছ কেন?
তোমরা বুদ্ধিমান মানুষ–এখনো সেটা বুঝতে পার নি?
তুমি আমাদেরকে যত বুদ্ধিমান তাব, আমরা তত বুদ্ধিমান নই।
ফ্রেড আবার সহৃদয় ভঙ্গিতে হেসে বলল, তোমাদের দুজনকে এখানে নিয়ে এসেছি যেন প্রজেক্ট নেবুলার কোনো সমস্যা না হয়।
প্রজেক্ট নেবুলা?
হ্যাঁ ফ্রেড ঘরের মেঝেতে পুরোনো বন্ধুর মতো সহজ ভঙ্গিতে বসে বলল, হ্যাঁ, আমরা নাম দিয়েছিলাম প্রজেক্ট নেবুলা, কারণ এটা শুরু হয়েছিল খুব কাছাকাছি একটা ছোটখাটো নেবুলা থেকে। ফ্রেড রিয়াজ হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি চলে আসার পরপরই আমরা প্রথম মহাজাগতিক একটা সঙ্কেত পেয়েছিলাম।
রিয়াজ সোজা হয়ে বসে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। এটা খুব গোপন খবর, সারা পৃথিবীতে সব মিলিয়ে ডজনখানেক মানুষের বেশি জানে না।
রিয়াজ কোনো কথা না বলে চুপ করে ফ্রেডের দিকে তাকিয়ে রইল, ফ্রেড মাথা নেড়ে বলল, অত্যন্ত কঠিন একটা সিদ্ধান্ত ছিল সেটি।
কোনটি?
চতুর্থ মাত্রার বুদ্ধিমত্তার একটি প্রাণীকে পৃথিবীতে ডেকে আনা।
রিয়াজ চিৎকার করে বলল, তোমরা চতুর্থ মাত্রার প্রাণীকে পৃথিবীতে ডেকে এনেছ? তোমরা কি উন্মাদ?
আমাদের কোনো উপায় ছিল না।
কী বলছ তুমি? কিসের উপায় ছিল না?
ফ্রেড একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, দেশের অর্থনীতিতে মন্দাভাব এসে গেছে, দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে–আমাদের এটা থামানো দরকার। নতুন একটা টেকনোলজি দরকার। একেবারে নতুন যেটা পৃথিবীতে নেই।
নতুন একটা টেকনোলজির জন্য তুমি চতুর্থ মাত্রার একটা প্রাণীকে পৃথিবীতে ডেকে এনেছ? মানুষ কত বড় নির্বোধ হলে এ রকম একটি কাজ করে?
ফ্রেড মুখে হাসি ফুটিয়ে রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, যখন ভালোয় ভালোয় সব শেষ হয়ে যাবে, মহাজাগতিক প্রাণী আমাদেরকে টেকনোলজি দিয়ে তাদের গ্যালাক্সিতে ফিরে যাবে তখন আমাকে কেউ নির্বোধ বলবে না।
তোমরা কি যোগাযোগ করতে পেরেছ?
হ্যাঁ পেরেছি। তোমার কোড ব্যবহার করে আজকে আমরা প্রথমবার মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগ করেছি। ফ্রেড কেমন জানি একটু শিউরে উঠে বলল, তুমি চিন্তা করতে পারবে না ব্যাপারটি কেমন ভয়ঙ্কর।
রিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি খুব ভালো করে জানি এটা কত ভয়ঙ্কর। তোমাকে নিশ্চয়ই অনুমতি দেওয়া হয় নি, তুমি অনুমতি ছাড়াই এটা করেছ?
হ্যাঁ।
সেজন্য তুমি বাংলাদেশের কো-অর্ডিনেট দিয়েছ যদি ভালোয় ভালোয় যোগাযোগ করা না যায় নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে ধ্বংস করে দেবে?
হ্যাঁ। এর মাঝে নিউক্লিয়ার মিসাইল এখানে টার্গেট করে ফেলা হয়েছে।
রিয়াজ বিস্ফারিত চোখে ফ্রেডের দিকে তাকিয়ে রইল, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, পৃথিবীতে জনবসতিহীন কত জায়গা রয়েছে–সাহারা মরুভূমি, এন্টার্কটিকা, আন্দ্রিজ পর্বতমালা ওসব ছেড়ে তোমরা এ রকম ঘনবসতি একটা লোকালয় কেন বেছে নিলে?
তার কারণ প্রাণীটি জনবসতিহীন জায়গায় যেতে চাইছিল না। এটি মানুষের কাছাকাছি আসতে চাইছিল।
কেন?
কারণ মানুষকে ব্যবহার করে সে বিচরণ করতে চায়।
রিয়াজ আর্তচিৎকার করে উঠল, বুকের মাঝে আটকে থাকা একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, মহাজাগতিক প্রাণী কি সেটা করতে পেরেছে?
ফ্রেড মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ। সেটা মানুষের শরীরকে ব্যবহার করে কিছু চলাচল করেছে। সীমিততাবে–কিন্তু করেছে।
যার অর্থ পৃথিবীর মানুষ এখন এই মহাজাগতিক প্রাণীর দয়ার ওপর নির্ভর করছে। এটি যদি আমাদের পৃথিবী দখল করে নিতে চায় তা হলে দখল করে নেবে?
ফ্রেড কোনো কথা না বলে তার হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে রইল। রিয়াজ চাপা স্বরে চিৎকার করে বলল, নির্বোধ আহাম্মক কোথাকার।
ফ্রেড খুব ধীরে ধীরে রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, এই মহাজাগতিক প্রাণী যখন তার টেকনোলজি আমার হাতে দিয়ে ফিরে যাবে তখন কেউ আমাকে নির্বোধ বলবে না।
তোমাকে সে কোন টেকনোলজি দেবে?
তাদের স্পেসশিপের আবরণটি যেটি দিয়ে তৈরি সেটা হলেই আর কিছু প্রয়োজন নেই। আমি ইঞ্জিনটার প্রক্রিয়াটাও পাওয়ার চেষ্টা করছি।
যদি না পাও?
না পেলে নাই। পৃথিবীতে যারা ঝুঁকি নেয় না তারা কোনো কিছু অর্জন করতে পারে না।
রিয়াজ হিংস্র গলায় বলল, মানুষ নিজের জীবনকে দিয়ে ঝুঁকি নিতে পারে–তুমি নিয়েছ অন্যের জীবনকে নিয়ে।
প্রজেক্ট নেবুলা অনেক বড় প্রজেক্ট। পৃথিবীর কিছু মানুষ বা অনেক মানুষের জীবনের এখানে কোনো মূল্য নেই।
তুমি কি মনে কর তোমার এই কাজকর্মকে ক্ষমা করা হবে?
প্রজেক্ট নেবুলার ভিতরের কথা খুব বেশি মানুষ জানে না। তোমরা দুজন জান। তোমাদের এই প্রজেক্টের কথা জানাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
রিয়াজ ভুরু কুঁচকে বলল, কেন আমাদের জানাতে আপত্তি নেই।
পুরো যোগাযোগটা করা হয়েছে তোমার কোড ব্যবহার করে–তোমার এটা জানার একটা নৈতিক অধিকার আছে।
এটাই কি একমাত্র কারণ?
ফ্রেড একটা নিশ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকাল, বলল, না, অন্য কারণ আছে।
কী কারণ? ফ্রে
ড তার হাতের বড় ম্যানিলা এনভেলপটি রিয়াজের দিকে এগিয়ে দেয়, বলে, দেখ।
রিয়াজ এনভেলপটি খুলে চমকে উঠল। ভিতরে তার এবং নিশীতার খুব অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বসে থাকার ছবি। কোনো একটি রেস্টুরেন্টে বসে দুজনে খাচ্ছে, সামনে বিয়ারের বোতল। রিয়াজ ছবিগুলো দেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফ্রেডের দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, এগুলো কী?
তোমাদের ছবি। এডবি ফটোশপ দিয়ে তৈরি করেছি।
কেন তৈরি করেছ?
কারণ আজ রাতে তোমার গার্লফ্রেন্ড যখন তোমাকে মোটর সাইকেলে করে নিয়ে যাবে তখন আশুলিয়ার কাছে খুব খারাপভাবে অ্যাকসিডেন্ট করবে। তোমরা দুজনেই সাথে সাথে মারা যাবে।
রিয়াজ এবং নিশীতা চমকে উঠল, বলল, কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। তোমরা প্রজেক্ট নেবুলার ভিতরের খবর জান। তোমরা বেঁচে থাকলে আমার খুব সমস্যা। তোমাদের বেঁচে থাকা চলবে না।
রিয়াজ এবং নিশীতা বিস্ফারিত চোখে ফ্রেডের দিকে তাকিয়ে রইল, ফ্রেড একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, অ্যাকসিডেন্টের পর যখন তোমাদের ডেড বডি পাওয়া যাবে তখন। এই ছবিগুলো আমরা রিলিজ করব। সবাই দেখবে তোমরা গভীর রাত পর্যন্ত ফুর্তি করেছ, মদ খেয়ে পুরোপুরি মাতাল হয়ে মোটর সাইকেল চালাতে চেষ্টা করেছ–তোমাদের অ্যাকসিডেন্ট না হলে কার হবে?
নিশীতা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না—অবাক হয়ে ফ্রেডের ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রেড অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, পোস্টমর্টেম করে দেখলেও কোনো গরমিল পাবে না। তোমাদের শরীরে এলকোহলের পার্সেন্টেজ থাকবে খুব বেশি। আমরাই ইনজেক্ট করে দেব।
কেন? রিয়াজ শুকনো গলায় বলল, কেন তোমরা এটা করতে চাইছ?
ফ্রেড উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমাদের কোনো উপায় নেই। সারা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ এর সাথে জড়িত, এখানে কোনো ঝুঁকি নেওয়া যায় না। এত বড় প্রজেক্টে আমি কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না রিয়াজ।
রিয়াজ চিৎকার করে ফ্রেডের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছিল কিন্তু সাথে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ দুজন সামনে এগিয়ে এসে তাকে ধরে ফেলল। একজন তাকে আঘাত করতে হাত উপরে তুলতেই ফ্রেড তাকে থামাল, বলল, না ওর গায়ে হাত দিও না। আজ রাতের অ্যাকসিডেন্টের আঘাত ছাড়া শরীরে অন্য কোনো আঘাত থাকা চলবে না।
রিয়াজকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে ফ্ৰেড তার দুজন বডির্গাডকে নিয়ে বের হয়ে গেল।
নিশীতা বিস্ফারিত চোখে রিয়াজের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে আর কয়েক ঘণ্টার মাঝে খুব সুপরিকল্পিতভাবে তাদের হত্যা করা হবে।
০৮. নিশীতা ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে
নিশীতা ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে, রিয়াজ এক ধরনের অস্থিরতা নিয়ে ঘরের মাঝে পায়চারি করছে। ঘরের একমাথা থেকে অন্য মাথায় হেঁটে রিয়াজ ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে নিশীতার দিকে তাকাল। নিশীতা একটা নিশ্বান্স ফেলে বলল, আমি একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছি না।
কী জিনিস?
মনে আছে আপনি বলেছিলেন এপসিলন আসলে খুব সহজ একটা প্রোগ্রাম? প্রশ্নের উত্তর দেয় প্রশ্ন করে?
হ্যাঁ।
কিন্তু সেটা তো আর সহজ প্রোগ্রাম হিসেবে থাকে নি। সেটা অত্যন্ত দক্ষ একটা প্রোগ্রাম হয়ে গেল–এত দক্ষ যে আমাকে সেলুলার ফোনে যোগাযোগ করে সতর্ক পর্যন্ত করে দিল।
হ্যাঁ। আমি লক্ষ করেছি।
সেটা কীভাবে সমম্ভব? সহজ একটা প্রোগ্রাম কেমন করে নিজ থেকে এত জটিল হয়ে যেতে পারে?
রিয়াজ হাসান মাথা নাড়ল, বলল, পারে না।
তা হলে কী হয়েছে?
ব্যাপারটা নিয়ে আমিও খুব বিভ্রান্তির মাঝে ছিলাম–ফ্রেডের কথা শুনে এখন আমি ব্যাপারটা খানিকটা আন্দাজ করতে পারছি।
কী আন্দাজ করতে পেরেছেন?
এখানে মহাজাগতিক প্রাণী পৌঁছানোর পর আমি আমার বাসায় যোগাযোগ করার কোডটি চালু করেছিলাম মনে আছে?
হ্যাঁ, মনে আছে।
সেই কোডটি মহাজাগতিক প্রাণীর পরিপূরককে নিয়ে আসছে।
নিশীতা মাথা নাড়ল, বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। পরিপূরক মানে কী?
রিয়াজ বলল, ব্যাপারটি জটিল, বলা যেতে পারে ব্যাপারটি একটি দার্শনিক ব্যাপার।
নিশীতা হাসার চেষ্টা করে বলল, ঘণ্টা দুয়েক পর মারা যাবার আগে মনে হয় দর্শন নিয়ে কথা বলাই সহজ।
হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। আমি দেখি তোমাকে বোঝাতে পারি কি না। বুদ্ধিমত্তার গোড়ার কথা হচ্ছে এর মাঝে এক ধরনের সামঞ্জস্য থাকবে। ভালো–মন্দ খুব আপেক্ষিক কিন্তু বুদ্ধিমত্তার মাঝে যদি ভালো–মন্দ থাকে তা হলে তার মাঝে সামঞ্জস্য থাকবে। মোট কথা, ফ্রেডের মতো যদি পাজি মানুষের জন্ম হয় তা হলে তোমার মতো একজন ভালো মানুষেরও জন্ম হতে হবে। হিটলারের মতো দানবের জন্ম হলে দার তেরেসার মতো মহৎ মানুষের জন্ম হতে হবে।
চতুর্থ মাত্রার বুদ্ধিবৃত্তির জন্যও সেটা সত্যি। এর মাঝে যদি অশুভ অংশ থাকে তা হলে শুভ অংশ থাকতে হবে। ফ্রেড যে বর্ণনা দিয়েছে সেটি একেবারে খাঁটি অশুভ অংশ –কাজেই আমার ধারণা আমাদের আশপাশে তার পরিপূরক শুভ অংশটিও আছে। সেটাই এপসিলন ব্যবহার করে তোমার সাথে যোগাযোগ করছে। আমার সাথে যোগাযোগ করছে।
নিশীতা বলল, তার মানে পৃথিবীতে একটি মহাজাগতিক প্রাণী আসে নি–দুটি প্রাণী এসেছে। একটি ভালো একটি খারাপ? খারাপটি ফ্রেডের সাথে ভালোটি আমাদের সাথে?
রিয়াজ মাথা নেড়ে বলল, চতুর্থ মাত্রার প্রাণীর জন্য এত সহজে বলা যায় না।
কেন বলা যায় না?
মানুষের কথা ধরা যাক। আমাদের সবার মাঝে কি খানিকটা অশুভ যানিকটা শুভ অংশ নেই? তা হলে কোনটা সত্যি–শুভ অংশটুকু নাকি অশুভ অংশটুকু? একঙন মানুষ কি প্রাণের ইউনিট নাকি পুরো মানবজাতি প্রাণের ইউনিট? নাকি আমাদের শরীরের এক একটি কোষ এক একটি প্রাণ? তুমি ব্যাপারটা কীভাবে দেখতে চাও তার ওপর সেটা নির্ভর করে। মানুষ যদি চতুর্থ মাত্রার বুদ্ধিমত্তায় পৌঁছায় তা হলে কীভাবে দেখা হচ্ছে ব্যপারটি তার ওপর আর নির্ভর করবে না। এখানেও তাই—এই প্রাণীর বুদ্ধিমত্তার শুভ–অশু অংশ আছে সেটি একই প্রাণী না ভিন্ন প্রাণী আমরা আর সেই প্রশ্ন করতে পারি না।
নিশীতা মাথা নেড়ে বলল, আপনার কথা শুনে প্রথমে মনে হয়েছিল খানিকটা বুঝেছি, কিন্তু ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার পর আর কিছুই বুঝতে পারছি না!
আমি দুঃখিত–_
আপনার দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তপনি আমার সহজ একটা প্রশ্নের উত্তর দেন। মহাজাগতিক প্রাণীর শুভ অংশটুকু আমাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য ডিজিটাল ইলেট্রনিক্স, কম্পিউটার, সেলুলার ফোন, রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি এইসব তুচ্ছ সহজ জিনিস বেছে নিয়েছে। এপসিলন প্রোগ্রামটা সে ব্যবহার করছে।
হ্যাঁ। সেটাই আমার ধারণা।
সেটাই যদি সত্যি হবে তা হলে যখন আমাদের সবচেয়ে বিপদ তখন সে আমাদের সাথে যোগাযোগ করছে না কেন?
কীভাবে করবে?
আমার সেলুলার ফোন দিয়ে।
তোমার সেলুলার ফোনে ব্যাটারির চার্জ নেই।
যে প্রাণী অন্য গ্যালাক্সি থেকে এখানে চলে আসতে পারে সে একটা ব্যাটারি নিজে চার্জ করতে পারে না আমি সেটা বিশ্বাস করি না।
রিয়াজ ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। প্রাণীটার এখন আমাদের সাথে যোগাযোগ করার কথা।
নিশীতা তার ব্যাগ খুলে তার সেলুলার ফোনটা হাতে নিয়ে কয়েকবার নেড়েচেড়ে দেখল, কানে লাগিয়ে বৃথাই কিছু শোনার চেষ্টা করল। নম্বরের বোতামগুলো ইতস্তত চাপ দিয়ে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে মেঝেতে রেখে দিল। হঠাৎ সে বিস্ময়ে দেখল সেলুলার ফোনটির আলো জ্বলে উঠে রিং করতে শুরু করেছে। নিশীতা আনন্দে চিৎকার করে রিয়াজের দিকে তাকাল, রিয়াজ নিশীতার কাছে ছুটে আসে। নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, তুলে নাও, নিশীতা কথা বল।
নিশীতা কাঁপা হাতে টেলিফোনটা তুলে নিয়ে বলল, হ্যালো।
কে? নিশীতা?
হ্যাঁ। আমি নিশীতা।
তোমাদের অনেক বড় বিপদ নিশীতা।
আমরা জানি–কিন্তু বিপদ থেকে উদ্ধারের একটা ব্যবস্থা করবে না?
তোমাদের সভ্যতার মাঝে আমার প্রবেশ করার কথা নয়। তাই তোমাদের টেকনোলজি ব্যবহার করে তোমাদের সাথে তোমাদের মতো করে দু একটি কথা বলতে পারি, এর বেশি কিছু নয়।
কিন্তু সেটি হলে তো হবে না। তুমি তো জান ফ্রেন্ড লিস্টার আমাদের মেরে ফেলবে।
হ্যাঁ জানি।
তা হলে আমাদের এখান থেকে বের করে নিয়ে যাও।
কীভাবে?
সেটা আমি কীভাবে বলব? আমাদের উড়িয়ে নিয়ে যাও। কিংবা ভাসিয়ে নিয়ে যাও, কিংবা টেলিট্রান্সপোর্ট করে নিয়ে যাও।
টেলিফোনের অন্যপাশ থেকে হাসির মতো এক ধরনের শব্দ হল, এপসিলানের স্বর বলল, আমার পক্ষে অবাস্তব কিছু করার ক্ষমতা নেই। আমি তোমাদের সভ্যতাকে স্পর্শ করতে পারব না।
নিশীতা গলায় জোর দিয়ে বলল, সেটা বললে তো হবে না। তোমাদের অশুভ অংশ এসে মানুষের শরীরের ভিতরে ঢুকে মানুষকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে, আর তুমি আমাদের প্রাণটাও বাঁচাবে না? তোমার কি পৃথিবীর জন্য কোনো দায়দায়িত্ব নেই?
আছে বলেই তো আমি কাছাকাছি আছি।
শুধু থাকলে হবে না, কিন্তু একটা কিছু কর। আমাদের এখান থেকে বের করে দাও।
টেলিফোনে কিছুক্ষণ নীরবতা থাকার পর আবার এপসিলনের গলা শোনা গেল, আমি তোমাদের কিছু তথ্য দিতে পারি, এর বেশি কিছু করতে পারব না। বাকি কাজটুকু তোমাদের করতে হবে।
কী তথ্য?
তোমাদের এই ঘরটির উপরে যে সিলিংটি দেখছ– সেটি হালকা প্লাইউডের। মাঝামাঝি জায়গায় একটা ডাক্ট আছে সেখান দিয়ে এই বিল্ডিঙের যাবতীয় ইলেকট্রিক তার গিয়েছে। এই ডাক্টটি দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলে তোমরা কাছাকাছি একটা ঘরে বের হতে পারবে। সেখান থেকে দরজা খুলে বের হয়ে যেতে পারবে।
নিশীতা উপরের দিকে তাকাল, সিলিংটি বেশি উঁচু নয়, আধুনিক বিল্ডিঙে জায়গা বাঁচানোর জন্য বিন্ডিংগুলো বেশি উঁচু করা হয় না। একজনের কাঁধে আরেকজন দাঁড়িয়ে মনে হয় সিলিংটা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। নিশীতা বলল, ঠিক আছে ধরে নিলাম আমরা বিল্ডিং থেকে বের হলাম, কিন্তু তারপর আর কোনো গেট নেই?
আছে।
সেখানে দারোয়ান নেই? গার্ড নেই?
আছে।
সেখান থেকে কীভাবে বের হব?
বাইরে গ্যারেজে কয়েকটা গাড়ি রয়েছে। কোনো একটা ড্রাইভ করে নিয়ে যেতে পার। এখানকার গাড়ি হলে গেটে আটকাবে না। আর যদি আটকায় তোমাদের সেরকম কিছু একটা করতে হবে।
কিন্তু
কিন্তু কী?
আমি গাড়ি ড্রাইভিং জানি না।
রিয়াজ বলল, আমি জানি। তবে গাড়ি চালিয়েছি আমেরিকাতে, রাস্তার ডানদিক দিয়ে।
নিশীতা বলল, এখন ডান বামের সময় নেই! ইঞ্জিন স্টার্ট করে গাড়িটাকে মোটামুটিভাবে নাড়াতে পারলেই হবে।
কিন্তু গাড়ির চাবি? চাবি ছাড়া স্টার্ট করব কেমন করে?
হট ওয়ার করে।
রিয়াজ মাথা চুলকে বলল, আমি কখনো করি নি।
সেলুলার টেলিফোনে এপসিলন বলল, আমি বলে দেব।
চমৎকার! এখন তা হলে কাজ শুরু করে দেওয়া যাক। সা
থে সাথে নিশীতার সেলুলার টেলিফোনটি নীরব হয়ে গেল।
নিশীতা রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আমাকে ঘাড়ে নিতে পারবেন?
মনে হয় পারব।
সিলিংটা ধরার জন্য আপনার ঘাড়ে আমাকে দাঁড়াতে হবে।
হ্যাঁ। সার্কাসে এ রকম করতে দেখেছি। তুমি কি পারবে?
পারতে হবে।
ব্যালান্সের একটা ব্যাপার আছে।
দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে শুরু করব যেন দেয়াল ধরে ব্যালান্স করতে পারি। একবার দাঁড়িয়ে সিলিংটা ছোঁয়ার পর আপনি ঘরের মাঝখানে যাবেন।
রিয়াজ চিন্তিত মুখে বলল, ধরা যাক তুমি হাঁচড়–পাঁচড় করে কোনোভাবে উঠে গেলে। কিন্তু আমি কীভাবে উঠব?
নিশীতা চারদিকে তাকাল, এই ঘরে কোনো আসবাবপত্র নেই। শুধুমাত্র মেঝেতে একটা কম্বল বিছিয়ে রাখা হয়েছে, সেখানে নিশীতাকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। কম্বলটার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ নিশীতার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, কম্বলটা উপর থেকে আটকে দিতে পারলে আপনি এটা ধরে উঠতে পারবেন না?
রিয়াজ দুর্বলভাবে হাসল, বলল, কখনো কম্বল ধরে কোথাও উঠি নি।
নিশীতা চোখ বড় বড় করে বলল, মাঝে মাঝে কয়েক জায়গায় ফুটো করে দেওয়া যাক, তা হলে ফুটোয় হাত ঢুকিয়ে ধরতে পারবেন। আর একবার উপরে উঠতে পারলে আমিও আপনাকে টেনে তুলব।
তুমি?
হ্যাঁ আমাকে আপনি যত দুর্বল ভাবছেন, আমি তত দুর্বল নই!
শুনে খুশি হলাম– রিয়াজ দুর্বলভাবে হেসে বলল, আর আমাকে তুমি যত শক্তিশালী ভাবছ আমি তত শক্তিশালী নই!
সেটা দেখা যাবে। যখন প্রাণ বাঁচাতে হয় তখন নাকি শরীরে অসুরের শক্তি এসে যায়।
কম্বলের মাঝে কয়েকটা ফুটো করার জন্য কোথাও ধারালো কিছু পাওয়া গেল না। হাতে কম্বল পেঁচিয়ে আঘাত করে তখন জানালার কাচ ভেঙে সেখান থেকে একটা ধারালো কাচ বের করে আনা হল। সেটা দিয়ে খুঁচিয়ে কম্বলে কয়েকটা ফুটো করা হল। চাকুর মতো একটা কাচের টুকরোকে নিশীতা তার ব্যাগে রেখে দিল–ভবিষ্যতে কী প্রয়োজন হতে পারে কে জানে!
রিয়াজ ঘরের দেয়াল ধরে হাঁটু গেড়ে বসল। নিশীতা রিয়াজের ঘাড়ে উঠে দাঁড়াল। রিয়াজ তখন সাবধানে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। নিশীতা দেয়াল ধরে নিজের ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করে, রিয়াজ পুরোপুরি সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পর নিশীতা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার ওজন কি খুব বেশি?
রিয়াজ বলল, না বেশি নয়। তবে তোমাকে দেখতে যেরকম হালকাঁপাতলা দেখায় ঘাড়ের উপর দাঁড়ানোর পর সেরকম মনে হচ্ছে না।
রিয়াজ সামনে অগ্রসর হতে থাকে, নিশীতা সিলিং ধরে ভারসাম্য বজায় রেখে বলল, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যদি এই গাড়া থেকে বের হতে পারি তা হলে ডায়েটিং করে ওজন পাঁচ কেজি কমিয়ে ফেলব।
তার প্রয়োজন নেই নিশীতা। এখান থেকে যদি বের হতে পারি তা হলে তোমাকে ঘাড়ে নিয়ে আমাকে আর হাঁটাহাঁটি করতে হবে না।
তা ঠিক। নিশীতা সিলিংটা হাত দিয়ে উপরে ঠেলে আলাদা করে ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে দেখল, এপসিলন ঠিকই বলেছে, একটা বড় ডাক্ট সিলিঙের উপর দিয়ে চলে গেছে। নিশীতা রিয়াজকে বলল, এখন আপনাকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে হবে। আমি উপরে উঠছি।
গুডলাক নিশীতা।
সিলিঙে উঠতে যত কষ্ট হবে মনে হয়েছিল নিশীতা তার থেকে অনেক সহজে উঠে গেল। রিয়াজ নিচে থেকে তার পা ধরে উপরে ধাক্কা দিয়ে সাহায্য করায় ব্যাপারটি বেশ সহজ হয়ে গেল। নিশীতা সিলিঙে লোহার বিমগুলোতে পা ঝুলিয়ে বসে বলল, ভাগ্যিস আমি শাড়ি পরে আসি নি।
শাড়ি পরে এলে কী হত?
শাড়ি পরলে সিলিং বেয়ে ওঠা হয়তো এত সহজ হত না
কিন্তু মেয়েদের জন্য শাড়ি থেকে সুন্দর কোনো পোশাক নেই।
যদি কখনো এই গাড্ডা থেকে বের হতে পারি তা হলে আমি একদিন শাড়ি পরে আপনার সাথে দেখা করতে আসব। আপনার কাছে প্রমাণ করিয়ে যাব যে আমি শাড়িও পরতে পারি।
চমৎকার! রিয়াজ বলল, তখন আমার কি বিশেষ কিছু করতে হবে?
না। আপনাকে কিছু করতে হবে না। আমার সাথে পরিচয় হওয়ার কারণে আপনার জীবনে যেসব ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটতে শুরু করেছে সেদিন আপনার কাছ থেকে সে জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে পারি।
নিশীতা উপর থেকে কম্বলটা একটা লোহার বীমের সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে দিল। রিয়াজ কম্বলটা ধরে উপরে ওঠার চেষ্টা করতে করতে বলল, আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা কি তুমি চাইবে না আমি চাইব? বিষফোড়া ফ্রেন্ড লিস্টার তো তোমার বন্ধু নয়–আমার বন্ধু।
নিশীতা নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে রিয়াজকে ধরে ফেলে উপরে টেনে তোলার চেষ্টা করতে লাগল, দুজনে প্রায় জড়াজড়ি করে কোনোমতে ঊপরে এসে হাজির হল। নিশীতা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল, রিয়াজ একটু অবাক হয়ে বলল, কী হল? হাসছ কেন?
ফ্রেন্ড লিস্টার এখন আমাদের দেখলে খুব খুশি হত। ব্যাটা ধড়িবাজ কত কষ্ট করে কম্পিউটার দিয়ে আমাদের দুজনের ছবি তৈরি করেছে। এখন আমরা নিজেরাই একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে টানাটানি করছি! শুধু দরকার একজন ক্যামেরাম্যান?
রিয়াজ হাসিতে যোগ দিয়ে বলল, না নিশীতা। তুমি একটা ব্যাপার মিস করে গিয়েছ। সে কম্পিউটার দিয়ে ছবিতে যে জিনিসটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে সেটা হচ্ছে রোমান্স। আর একটু আগে তুমি যেভাবে আমার শার্টের কলার ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তুলে এনেছ তার মাঝে আর যাই থাকুক, কোনো রোমান্স নেই!
বোঝা যাচ্ছে আপনি হিন্দি সিনেমা দেখেন না।
কেন?
দেখলে বুঝতেন রোমান্স আজকাল কত জায়গায় গিয়েছে। সেই আগের যুগের মিষ্টি গলায় গান গাওয়ার রোমান্স আর নেই। এখন খুন জখম মারপিট ছাড়া রোমান্স হয় না।
দুজনে মিলে প্লাইউডের সিলিং প্যানেলটা জায়গামতো বসিয়ে দিতেই ভিতরে অন্ধকার হয়ে এল। এখন এই ডাক্টের ভিতর দিয়ে গুঁড়ি মেরে তাদের এগিয়ে যেতে হবে। প্রথম নিশীতা এবং তার পিছু পিছু রিয়াজ এগিয়ে যেতে থাকে। সোজা বেশ খানিকদূর এগিয়ে গিয়ে নিশীতা একটা সিলিং প্যানেল তুলে ভিতরে উঁকি দিল। নিচে একটা বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিল ঘিরে বেশ কয়েকজন আমেরিকান বসে আছে। টেবিলের উপর একটা বড় ম্যাপ, ম্যাপের উপরে নানা জায়গায় ছোট ছোট ফ্ল্যাগ লাগানো। সিলিং প্যানেলটা সাবধানে আগের জায়গায় বসিয়ে তারা গুঁড়ি মেরে নিঃশব্দে আরো সাবধানে এগিয়ে যেতে থাকে। খুব কাছেই কোনো একটা জায়গা থেকে একটা বড় ফ্যানের শব্দ আসছে–সম্ভবত এই বিল্ডিঙের কোনো একটি এক্সহস্ট ফ্যান। এর কাছাকাছি পৌঁছানোর সাথে সাথে টেলিফোনটি বেজে উঠল। নিশীতা টেলিফোনটি কানে ধরতেই এপসিলনের কথা শুনতে পেল, নিশীতা?
হ্যাঁ, কথা বলছি।
আমি এখন তোমাদের কোনদিক যেতে হবে বলব, তোমার কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই, কারণ তোমরা এখন যে ঘরটির উপর দিয়ে যাচ্ছ সেখানে সিকিউরিটির অনেকগুলো মানুষ।
নিশীতা কোনো কথা বলল না। এপসিলন বলল, তোমাদের একটু তাড়াতাড়ি যেতে হবে, কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রেড লিস্টার তোমাদের ঘরে যাবে, সেখানে তোমাদের না দেখেই খোজাখুঁজি শুরু করবে।
নিশীতা ফিসফিস করে বলল, ঠিক আছে।
এখন সোজা যেতে থাক। সামনে গিয়ে ডানদিকে ঘুরে যাও।
নিশীতা আর রিয়াজ সামনে গিয়ে ডানদিকে ঘুরে গেল।
এবারে সোজা সামনে এগিয়ে যাও। সামনে একটা গোল গর্ত রয়েছে, সেদিক দিয়ে নিচে নেমে যাবে।
নিশীতা আর রিয়াজ সামনে গিয়ে গোল গর্তটা দিয়ে নিচে নেমে গেল। গর্তের ভিতরে রাজ্যের জঞ্জাল, মাকড়সার জাল এবং নানারকম পোকামাকড়। এসব ব্যাপার নিয়ে এখন মাথা ঘামানোর সময় নেই।
সেলুলার ফোন বলল, সোজা সামনে গিয়ে সিলিং প্যানেলটা তুলে নিচে লাফিয়ে পড়। এই ঘরে কেউ নেই।
ফোনের নির্দেশকে অন্ধের মতো–নুসরণ করে তারা ঘরের মাঝে লাফিয়ে পড়ল। দরজা খুলে বের হয়ে ডান দিকে যাও। নিশীতা আর রিয়াজ ঘর থেকে বের হয়ে ডানদিকে গেল।
সাবধান! সামনে দিয়ে দুজন আসছে, বাম পাশের পিলারের পিছনে লুকিয়ে পড়।
নিশীতা আর রিয়াজ দ্রুত পিলারের পিছনে লুকিয়ে পড়ল। দেখতে পেল স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে দুজন আমেরিকান হেঁটে গেল।
এবারে তোমাদের দশ সেকেন্ড সময় পুরো করিডোরের একমাথা থেকে অন্য মাথায় যাবার জন্য। শুরু কর
নিশীতা আর রিয়াজ নিশ্বাস বন্ধ করে শেষ মাথা পর্যন্ত ছুটে গেল।
চমৎকার। দরজার পাশে টেবিলের পিছনে দুই মিনিট লুকিয়ে থাক, এই দরজা দিয়ে কিছু মানুষ যাবে এবং আসবে।
নিশীতা আর রিয়াজ টেবিলের পিছনে লুকিয়ে থেকে টের পেল বেশ কিছু মানুষ ব্যস্ত পায়ে হাঁটাহাঁটি করছে।
তোমরা দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুত হও। মাত্র তিন সেকেন্ডের মধ্যে নিঃশব্দে দরজা খুলে বাইরে গিয়ে ডান দিকে লাফিয়ে পড়বে। ফুল গাছগুলোর পিছনে লুকিয়ে থাকবে। মনে থাকে যেন তিন সেকেন্ড সময়।
নিশীতা আর রিয়াজ নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল।
যাও!
দুজনে উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে ডান দিকে ফুলগাছগুলোর পিছনে লাফিয়ে পড়ল।
চমৎকার! এখানে দশ সেকেন্ড অপেক্ষা কর। তারপর মাথা না তুলে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যেতে থাক। কোনো অবস্থাতেই মাথা তুলবে না।
নিশীতা আর রিয়াজ মাথা না তুলে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যেতে লাগল। কাদা, মাটি, খোয়া পাথরে হাতের চামড়া উঠে খানিকটা রক্তাক্ত হয়ে গেল, তারা সেটাকে গ্রাহ্য করল না।
থাম।
দুজনেই থেমে গেল।
গ্যারেজে তিনটি গাড়ি দেখতে পাচ্ছ?
নিশীতা কোনো কথা না বলে হ্যাঁ সূচকভাবে মাথা নাড়ল।
মাঝখানের গাড়িটাতে উঠবে। স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকল ফোর হুইল ড্রাইভ। দুই হাজার সিসি ইঞ্জিন। মনে রেখো ড্রাইভিং সিট ডান পাশে।
নিশীতা মাথা নাড়ল।
এখানে তিরিশ সেকেন্ড অপেক্ষা কর।
সামনে দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল, দুজন মানুষ গাড়ি থেকে নেমে বিল্ডিঙের ভিতর ঢুকল।
দৌড়াও।
দুজনে দৌড়ে গাড়ির কাছে গেল, রিয়াজ ডানদিকে ড্রাইভিং সিটে নিশীতা বাম দিকে।
এখন গাড়ি স্টার্ট করতে হবে।
নিশীতা বলল, চাবি নেই। হট ওয়ার ব্যবহার করে করতে হবে। বল কী করতে হবে।
এপসিলন বলল, সময় নেই। ফ্রেন্ড লিস্টার তোমাদের ঘরে গিয়ে দেখেছে তোমরা নেই। সবাই ছোটাছুটি করছে। এক্ষুনি টেলিফোন করে গেটে বলে দেবে কেউ যেন বের হতে না পারে।
সর্বনাশ! তা হলে?
হঠাৎ করে গাড়িটা গর্জন করে স্টার্ট হয়ে গেল।
গার্ডকে টেলিফোন করছে। টেলিফোন তোলার আগে বের হয়ে যেতে হবে। যাও।
রিয়াজ গিয়ার টেনে ড্রাইভে এনে এক্সেলেটরে চাপ দিল, গাড়িটা সোজা গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গার্ড গেট খুলে দিচ্ছে, রিয়াজ বুক থেকে আটকে থাকা নিশ্বাস বের করে এগিয়ে যায়। হঠাৎ কী হল, একজন গার্ড ছুটে এসে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থামার ইঙ্গিত করল, গেটটা আবার বন্ধ করে ফেলছে, কাউকে বের হতে দেবে না।
নিশীতা চিৎকার করে বলল, থেমো না।
রিয়াজ থামল না, এক্সেলেটর চাপ দিয়ে গাড়ির বেগ মুহূর্তে বাড়িয়ে দিল, টায়ার পোড়া গন্ধ ছুটিয়ে শক্তিশালী গাড়িটা প্রচণ্ড বেগে গেটের দিকে ছুটে গেল। শেষ মুহূর্তে গার্ড লাফিয়ে সরে যায়, গাড়িটা প্রচণ্ড বেগে গেটে ধাক্কা দিল, গেটের একটি অংশ ভেঙ্গে দুমড়েমুচড়ে গেল এবং তার উপর দিয়ে গাড়িটা বের হয়ে গেল। গাড়িটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যাচ্ছিল, কোনোভাবে রিয়াজ সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করে আবার রাস্তার উপর নিয়ে এল। নিশীতা শক্ত করে গাড়ির সিট ধরে রেখেছিল এবার চিৎকার করে বলল, বাম দিকে রাস্তার বাম দিকে।
সামনে দিয়ে একটা ট্রাক আসছিল, বিপজ্জনকভাবে সেটাকে পাশ কাটিয়ে রিয়াজ আবার রাস্তার বামপাশে চলে এসে বুকের ভিতর আটকে থাকা একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, এটাই হচ্ছে আমার সমস্যা।
কী?
ঠিক যখন ইমার্জেন্সি তখন সব সময় ভুল ডিসিশন নিই।
আপনার এখন দুশ্চিন্তার কারণ নেই, যখনই ডান দিকে যাবেন আমি আপনাকে মনে করিয়ে দেব।
থ্যাংকস। এখন কোথায় যাব?।
নিশীতা পিছন দিকে তাকিয়ে বলল, মনে হচ্ছে আমাদের পিছনে পিছনে একটা গাড়ি আসছে। কাজেই আপাতত চেষ্টা করা যাক এখান থেকে সরে যেতে।
০৯. রিয়াজ ফিসফিস করে বলল
রিয়াজ ফিসফিস করে বলল, আপাতত এখানে থামা যাক।
নিশীতা বলল, বেশ।
দুজনে তাদের ব্যাকপ্যাক নামিয়ে বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস নিল।
তারা প্রায় মাইলখানেক ঘুরে এই জায়গায় পৌঁছেছে। পুরো এলাকাটা কাটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে, উপরে হাইভোল্টেজ বিদ্যুতের লাইন এবং নিচে কয়েক জায়গায় লেজার আলোর নিরাপত্তা। কেউ যেন কাছাকাছি আসতে না পারে সেজন্য একটু পরে পরে মিলিটারি আউটপোষ্ট বসানো হয়েছে। রিয়াজ আর নিশীতা দুটো পোস্টের মাঝামাঝি এই জায়গাটা বেছে নিয়েছে।
জায়গাটাতে বেশ কিছু ঝোপঝাড় আছে, পিছনের রাস্তা দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ যখন মিলিটারি জিপ বা ট্রাক যায় তখন এই ঝোপগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকা যায়।
রিয়াজ ব্যাগ থেকে একটা গগলস বের করে নিশীতার হাতে দিয়ে বলল, এটা ইনফ্রা রেড গগলস। তুমি চোখে লাগিয়ে পাহারা দাও। অন্ধকারেও দেখতে পারবে।
আপনি কী করবেন?
প্রথমে লেজার নিরাপত্তাটুকু অকেজো করতে হবে, না হয় ভিতরে ঢুকতে পারব না।
নিশীতা গগলসটি চোখে পরতেই তার সামনে চারদিক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চারপাশের অন্ধকার জগৎটি তার কাছে হঠাৎ করে অতিপ্রাকৃত মনে হতে থাকে।
রিয়াজ তার ব্যাগ থেকে ছোট দুটি লেজার ডায়োড বের করল। কাঁটাতারের পাশাপাশি এই লেজার রশ্মি রাখা আছে, কোনোভাবে রশ্মিটি বাধাপ্রাপ্ত হলেই সরুত চলে যাবে। লেজার রশিটুকু বোঝার জন্য একটু পরপর ফটো ডায়োড রাখা আছে। রিয়াজ তার লেজার ডায়োডটি অন করে ফটো ডায়োডটির উপরে ফেলে নিরাপত্তা রশ্মিটি ঢেকে ফেলল। রিয়াজ নিশ্বাস বন্ধ করে শোনার চেষ্টা করে দূরে কোথাও এলার্ম বেজে উঠল কি না, কিন্তু সেরকম কিছু শোনা গেল না। রিয়াজ একইভাবে দ্বিতীয় লেজারটি অকেজো করে দিয়ে নিশীতাকে ডাকল, নিশীতা।
কী হল?
লেজার দুটি অকেজো করে দেওয়া হয়েছে।
চমৎকার।
কাঁটাতার কাটার জন্য বড় ডায়াগোনাল কাটারটি বের কর।
নিশীতা ব্যাকপ্যাক থেকে বড় একটা ডায়াগোনাল কাটার বের করে আনে। রিয়াজ সেটা দিয়ে খুব সহজে কাঁটাতারগুলো কেটে একজন মানুষ যাবার মতো একটা ফুটো করে ফেলল। যন্ত্রপাতিগুলো ব্যাকপ্যাকের মাঝে ঢুকিয়ে রিয়াজ বলল, এস নিশীতা।
নিশীতা ভারী ব্যাকপ্যাকটা টেনে কাছে নিয়ে এল, চোখ থেকে ইনফ্রারেড গগলসটা খুলে রিয়াজকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, এই যে, আপনার অন্ধকারে দেখার গগলস।
তুমি আর পরবে না?
না, চোখে দিলে মনে হয় ভূতের দেশে চলে এসেছি।
কিন্তু খুব কাজের জিনিস।
হ্যাঁ, পৃথিবীতে কত ইঁদুর আর চিকা রয়েছে এটা চোখে না দিলে কেউ জানতে পারবে না।
রিয়াজ হাসল, বলল, হ্যাঁ ঠিকই বলেছ।
নিশীতা চুলগুলো পিছনে নিয়ে একটা রাবার ব্যান্ড দিয়ে শক্ত করে বেঁধে মাথায় একটি বেসবল ক্যাপ পরে বলল, চলুন ভিতরে যাওয়া যাক।
চল। রিয়াজ এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, তোমার কি ভয় করছে?
নিশীতা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ করছে। না করাটা বোকামি হবে। তাই না?
হ্যাঁ ঠিকই বলেছ। কিন্তু এ ছাড়া কিছু করার নেই। সারা পৃথিবীতে শুধু আমিই একমাত্র মানুষ যে এই মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে কথা বলার ভাষা জানি। কাজেই আমাকে যেতেই হবে। রিয়াজ তার ব্যাকপ্যাকটি সাবধানে কাছে টেনে নিয়ে বলল, এখন যন্ত্রপাতিগুলো ঠিক থাকলে হয়—টানাহ্যাঁচড়া তো কম হল না।
নিশীতা কোনো কথা বলল না, গভীর রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকারে তারকাটা এবং লেজার নিয়ন্ত্রণ ভেদ করে একটি সংরক্ষিত জায়গায় সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ঢুকে যাওয়ার একটি উত্তেজনা আছে। ভিতরে একটি মহাজাগতিক প্রাণীর ঘাঁটিতে তাদের জন্য কী ধরনের ভয়ঙ্কর বিস্ময় অপেক্ষা করছে কে জানে।
রিয়াজ জিজ্ঞেস করল, তুমি আগে ঢুকবে, না আমি? আপনিই ঢোকেন।
রিয়াজ নিচু হয়ে ভিতরে ঢোকার জন্য প্রস্তুত হল, ঠিক তখন নিশীতা গলায় একটা শীতল স্পর্শ অনুভব করে, সাথে সাথে কেউ অনুচ্চ স্বরে কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলল, আমার মনে হয় আপনাদের কারোই ভিতরে ঢোকার প্রয়োজন নেই।
নিশীতা পাথরের মতো জমে গেল। রিয়াজ খুব ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না কিন্তু তবু তারা বুঝতে পারল তাদেরকে ঘিরে কয়েকজন মানুষ। দাঁড়িয়ে আছে, তাদের হতে উদ্যত অস্ত্র। সেফটি ক্যাচ টানার শব্দ শুনতে পেল তারা, মানুষগুলো সশস্ত্র, গুলি করতে প্রস্তুত। অনুচ্চ গলার স্বরে আবার কেউ একজন বলল, দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়ান। সন্দেহজনক মানুষদের গুলি করার জন্য আমাদের কাছে স্পষ্ট নির্দেশ আছে।
নিশীতা এবং রিয়াজ দুই হাত উপরে তুলে দাঁড়াল, এখনো তারা নিজেদের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি কাউকে নির্দেশ দিয়ে বলল, ব্যাগ দুটি তুলে নাও।
একজন এসে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ব্যাগ দুটো তুলতে চেষ্টা করতেই রিয়াজ বাধা দিয়ে বলল, সাবধান–প্লিজ সাবধান।
কেন?
এর মাঝে অসম্ভব ডেলিকেট কিছু ইনস্ট্রুমেন্ট আছে।
কী ইনস্ট্রুমেন্ট?
বলতে পারেন এই দেশ থাকবে না ধ্বংস হয়ে যাবে–এমনকি এই পৃথিবী থাকবে না। ধ্বংস হয়ে যাবে সেটা এর ওপর নির্ভর করছে।
মানুষটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ব্যাগ দুটি খুব সাবধানে নাও। দেখো যেন ঝাঁকুনি না লাগে।
রিয়াজ নিচু গলায় বলল, ধন্যবাদ। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
একটা মিলিটারি জিপে করে ক্যাম্পে নিয়ে আসা পর্যন্ত কেউ আর কোনো কথা বলল না। নিশীতা দেখল তাদেরকে যে ধরে নিয়ে যাচ্ছে সে একজন কমবয়সী মিলিটারি অফিসার। সাথে আরো কয়জন সেনাবাহিনীর সদস্য। প্রায় মাইল দুয়েক গিয়ে জিপটি একটি কলেজ ভবনের সামনে থামল, এটাকে সাময়িক মিলিটারি ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে।
রিয়াজ আর নিশীতাকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে তার দরজা বন্ধ করে দিয়ে মিলিটারি অফিসার তাদের দিকে ঘুরে তাকাল, বলল, আমি ক্যাপ্টেন মারুফ। এই পুরো এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার হাতে দেওয়া হয়েছে। কাজেই আশা করছি আপনারা কী করেছিলেন তার খুব ভালো একটা ব্যাখ্যা আছে।
নিশীতা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ আছে। আপনি যেটুকু চিন্তা করতে পারেন তার চাইতেও অনেক ভালো ব্যাখ্যা আছে। আপনি কতটুকু বিশ্বাস করতে প্রস্তুত রয়েছেন সেটি অন্য ব্যাপার।
মারুফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিশীতার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনাকে আমি আগে কোথাও দেখেছি।
আমি একজন সাংবাদিক। বড় বড় মানুষের সাংবাদিক সম্মেলনে মাঝে মাঝে আমাকে টেলিভিশনে দেখিয়ে ফেলে।
হ্যাঁ। ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নাড়ল, আপনাকে আমি টেলিভিশনে দেখেছি।
নিশীতা রিয়াজকে দেখিয়ে বলল, ইনি ড. রিয়াজ হাসান। আপনারা যে এলাকাটা কর্ডন করে আলাদা করে রেখেছেন সেখানে ড. হাসানের একটা কোড ব্যবহার করা হচ্ছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ ভুরু কুঁচকে বলল, ড. হাসান কি ভাইরাসের বিশেষজ্ঞ? তার কোড কি ভাইরাস বিষয়ক?
না। নিশীতা মাথা নাড়ল, ড. হাসান ভাইরাস বিশেষজ্ঞ নয়। তার কোডটি হচ্ছে মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে সম্পর্কিত।
ক্যাপ্টেন মারুফ চমকে উঠল, বলল, আপনি কী বলছেন?
হ্যাঁ। আপনারা এই পুরো এলাকাটা কর্ডন করে রেখেছেন কারণ এখানে একটি মহাজাগতিক প্রাণী আশ্রয় নিয়েছে। এখানে কোনো ভাইরাস নেই।
ক্যাপ্টেন মারুফ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিশীতার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি আপনার কথা প্রমাণ করতে পারবেন?
পারব! আমাকে সময় দিলে আপনাকে সবকিছু প্রমাণ করে দিতে পারব। কিন্তু আমাদের হাতে সময় নেই আপনি যদি আমার কথা বিশ্বাস করেন পুরো কাজটুকু অনেক সহজ হয়ে যায়।
আপনারা কী করতে চাইছেন?
আমরা কোয়ারেন্টাইন করে রাখা মানুষগুলোর সাথে কথা বলতে চাই।
কেন?
কারণ তাদের শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে সেটি একটি মিথ্যা কথা। তাদেরকে আলাদা করে রাখা হয়েছে কারণ তারা সেই মহাকাশের প্রাণীকে কিংবা প্রাণীর অবলম্বনকে দেখেছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ চমকে উঠে নিশীতার দিকে তাকালেন, তার হঠাৎ রমিজ মাস্টারের কথা মনে পড়ে গেল। সত্যিই সেই মানুষটি একটি ভয়ঙ্কর মূর্তির কথা বলছিল, মানুষটিকে একবারও অপ্রকৃতিস্থ মনে হয় নি।
নিশীতা নিচু গলায় বলল, ক্যাপ্টেন মারুফ, আমাদের হাতে সময় খুব বেশি নেই। আপনি কি এই দেশ এবং এই পৃথিবীর বিরুদ্ধে একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে সাহায্য করবেন?
ক্যাপ্টেন মারুফ নিশীতার কথার উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়াল, জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল। বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, সেদিকে তাকিয়ে সে হঠাৎ করে ভিতরে একটি বিচিত্র অনুভূতি অনুভব করতে থাকে। শার্টপ্যান্ট পরা এই বিচিত্র মেয়েটির কথাবার্তায় এক ধরনের দৃঢ়তা আছে, বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। মনে হচ্ছে মেয়েটি সত্যি কথাই বলছে। ভাইরাস সংক্রমণের পুরো ব্যাপারটির মাঝে সত্যি সত্যি বড় ধরনের গরমিল আছে, কিছুতেই হিসাব মেলানো যায় না– এটা সে নিজেই লক্ষ করেছে। কিন্তু সে একজন মিলিটারি অফিসার, মিলিটারি অফিসারদের তো নিয়ম মেনে চলতে হয়। কিছু একটা করার আগে তার অনুমতি নিতে হবে, কিন্তু সে জানে তাকে অনুমতি দেওয়া হবে না। এটি সত্যিই যদি একটি বড় ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে থাকে তা হলে কিছুতেই তাকে অনুমতি দেওয়া হবে না, বরং ষড়যন্ত্রের আঁচ পেয়ে গেছে জেনে তাকে সরিয়ে দেওয়া হবে। তা হলে কি সে নিয়ম ভেঙে এই সাংবাদিক মেয়েটি এবং বিজ্ঞানী মানুষটিকে কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্পে নিয়ে যাবে? একজন মিলিটারি অফিসার হয়ে সে নিয়ম ভঙ্গ করবে?
ক্যাপ্টেন মারুফ একটা নিশ্বাস ফেলল। উনিশ শ একাত্তরে সেনাবাহিনী নিয়ম ভঙ্গ করে বিদ্রোহ করেছিল বলে এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। যারা নিয়ম তৈরি করেছে তারা নিয়মটি খাঁটি করে তৈরি না করলে সেই নিয়ম না ভেঙে কী করবে? ক্যাপ্টেন মারুফ ঘুরে নিশীতা আর ড. রিয়াজের দিকে তাকাল, বলল, ঠিক আছে। চলুন, আপনাদের আমি কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্পে নিয়ে যাই।
নিশীতা এবং রিয়াজের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, তারা উঠে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন মারুফের কাছে এগিয়ে এল। নিশীতা ক্যাপ্টেন মারুফের হাত স্পর্শ করে বলল, ধন্যবাদ। আপনাকে। অনেক ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন মারুফ।
রিয়াজ বলল, তা হলে এক্ষুনি যাওয়া যাক। আমাদের হাতে কোনো সময় নেই।
তিনজন ক্যাম্প থেকে বের হয়ে একটা জিপে উঠে বসে। নিশীতা আর রিয়াজের ব্যাকপ্যাক দুটি পিছনে রাখা হয়েছে, জিপ স্টার্ট করার আগের মুহূর্তে দেখা গেল একজন জুনিয়র মিলিটারি অফিসার ছুটে আসছে। কাছে এসে স্যালুট করে বলল, স্যার, আপনার। কাছে একটা জরুরি ম্যাসেজ এসেছে।
কী আছে ম্যাসেজে?
অফিসার আড়চোখে নিশীতা এবং রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, ম্যাসেজে বলা হয়েছে এখানে দুজন পলাতক মানুষ এসেছে। একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা। তাদেরকে যেভাবে সম্ভব এ্যারেস্ট করতে।
আর কিছু?
জি। বলা আছে, মানুষগুলো খুব ডেঞ্জারাস। প্রয়োজন হলে দেখামাত্র তাদের গুলি করা যেতে পারে।
বেশ। ক্যাপ্টেন মারুফ জিপ স্টার্ট করে বলল, ম্যাসেজ রিসিভ করে তাদের কনফার্মেশন করে দাও।
কিন্তু স্যার
আমি আসছি।
তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ক্যাপ্টেন মারুফ এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে জিপটিকে বের করে নিয়ে গেল।
জিপটি রাস্তায় ওঠার পর নিশীতা বলল, শুনেছেন, আমাদেরকে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ সামনে তাকিয়ে থেকে বলল, তাই সাথে একটা লাইট আর্মস নিয়ে নিয়েছি।
নিশীতা শব্দ করে হেসে বলল, এখন আপনাকে কেউ আর কিছু বলতে পারবে না।
.
প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটা বিল্ডিঙের সামনে ক্যাপ্টেন মারুফ জিপটি থামিয়ে সেখান থেকে নেমে পড়ল। বড় একটি লোহার গেটের সামনে দুজন সশস্ত্র মিলিটারি দাঁড়িয়ে ছিল, ক্যাপ্টেন মারুফকে দেখে তারা এগিয়ে এল, নিচু গলায় কিছু কথাবার্তা হল এবং তারা। গেট খুলে দিল। ভিতরে একটা ছোট ঘরে একটা টেবিলের ওপর পা তুলে একজন মানুষ বসে আছে, ক্যাপ্টেন মারুফ এবং তার সাথে নিশীতা আর রিয়াজকে দেখে সে ভুরু কুঁচকে এগিয়ে এল, ক্যাপ্টেন মারুফকে জিজ্ঞেস করল, এরা কারা?
একজন হচ্ছে সাংবাদিক, অন্যজন সায়েন্টিস্ট।
মানুষটি আঁতকে উঠে বলল, সাংবাদিক? এখানে সাংবাদিক আনা পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নাড়লে, বললেন, হ্যাঁ সে জন্যই এসেছেন।
মানুষটি অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন মারুফের দিকে তাকাল, বলল, কী বলছেন আপনি?
কেন পুরোপুরি নিষিদ্ধ, সেটা বোঝা দরকার। এরা এসেছেন কোয়ারেন্টাইন করা মানুষদের দেখতে।
দেখতে? তারা মারাত্মক ভাইরাসে আক্রান্ত।
এখন পর্যন্ত তাদের কত জন মারা গিয়েছেন?
লোকটি এবারে থতমত খেয়ে বলল, ইয়ে এখনো কেউ মারা যায় নি কিন্তু একজন মহিলা পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে গিয়েছে।
এবারে নিশীতা প্রশ্ন করল, মহিলা কী করছে যে জন্য আপনার মনে হচ্ছে তিনি উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন?
দেয়ালে মাথা ঠুকছে, চিৎকার করছে।
কেন?
শুধু বলছে আমার ছেলে আমার ছেলে!
কী হয়েছে তার ছেলের?
ভাইরাসের আক্রমণের কারণে তার ধারণা হয়েছে কেউ একজন তার ছেলেকে নিয়ে চলে গেছে।
আপনি কেমন করে জানেন সত্যি সত্যি তার ছেলেকে কেউ নিয়ে যায় নি?
মানুষটি এবারে কেমন যেন হতচকিত হয়ে গেল। নিশীতা তীব্র স্বরে বলল, আপনি পুরুষ মানুষ বলে জানেন না মা আর তার সন্তানের সম্পর্কটা কী রকম। একটা মায়ের ছোট্ট বাচ্চাকে কেউ নিয়ে নিলে তার উন্মাদ হয়ে যাবার কথা। সেটাই স্বাভাবিক। না হওয়াটাই অস্বাভাবিক।
মানুষটি এবার যুক্তিতর্ক আলোচনা থেকে সরে এল। অনাবশ্যক কঠিন গলায় বলল, আপনাদের এখানে আসার কথা নয়, আপনার সাথে আমার কথা বলারও কথা নয়।
ক্যাপ্টেন মারুফ একটু এগিয়ে এসে বলল, কিন্তু আমার মনে হয় এখন একটু কথা বলা দরকার। কোথাও কোনো ভুলত্রুটি হয়েছে কি না খোঁজখবর নেওয়া এমন কিছু অপরাধ নয়।
মানুষটি নিচু হয়ে তার ড্রয়ারের ভিতরে কিছু একটা খুঁজতে থাকে, জিনিসটা খুঁজে নিয়ে সে যখন সোজা হয়ে দাঁড়াল তখন ক্যাপ্টেন মারুফ দেখতে পেল সেটা একটা রিভলবার, মানুষটি প্রায় চিৎকার করে বলল, হাত তুলে দাঁড়ান তিনজন, তা না হলে আমি গুলি করব, আমার ওপর অর্ডার আছে।
নিশীতা কিংবা রিয়াজ কখনোই এ রকম পরিবেশে পড়ে নি, কী করবে কিছু বুঝতে পারছিল না, কিন্তু ক্যাপ্টেন মারুফকে একটুও বিচলিত হতে দেখা গেল না, শব্দ করে হেসে বলল, তাই নাকি? অর্ডার আছে?
মানুষটি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই হঠাৎ করে কিছু একটা ঘটে গেল, নিশীতা আবছাভাবে দেখল ক্যাপ্টেন মারুফের শরীর শূন্যে উঠে গেছে, চোখের পলকে সারা শরীর ঘুরে আবার নিচে নেমে এসেছে কিন্তু সেই মুহূর্তে তার পায়ের এক লাথিতে হাতের রিভলবার ছিটকে গিয়ে পড়েছে দেয়ালে। মানুষটি নিজের হাত ধরে কাতর শব্দ করে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ক্যাপ্টেন মারুফ হেঁটে গিয়ে মানুষটির শার্টের কলার ধরে ফিসফিস করে বলল, একটা শব্দ করলে খুন করে ফেলব।
আমার হাত!
সম্ভবত ফ্রাকচার হয়েছে। চিন্তার কিছু নেই, অর্থোপেডিক সার্জন সেট করে দেবে।
মানুষটি বিস্ফারিত চোখে ক্যাপ্টেন মারুফের দিকে তাকিয়ে রইল। ক্যাপ্টেন মারুফ বলল, টাই কোয়ান্ডো কারাটের মতোই তবে পা অনেক বেশি ব্যবহার করতে হয়। থার্ড ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট। সময় পাই নি দেখে ফোর্থ ডিগ্রি কমপ্লিট করতে পারি নি!
ক্যাপ্টেন মারুফ বেশ দক্ষ হাতে মানুষটিকে বেঁধে ফেলল। টেবিল থেকে চওড়া ব্ল্যাক টেপ নিয়ে মুখে লাগানোর সময় নিশীতা বলল, আমি লাগাতে পারি?
ক্যাপ্টেন মারুফ একটু অবাক হয়ে বলল, আপনি?
হ্যাঁ। আমি শুধু সিনেমায় দেখেছি এগুলো লাগায়, আসলেও যে লাগানো হয় জানতাম না। আমি দেখি কেমন করে লাগানো হয়!
ক্যাপ্টেন মারুফ টেপটা নিশীতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, নিশ্চয়ই। চেঁচামেচি করে লোকজন জড়ো করতে না পারে সেজন্য এই ব্যবস্থা।
মানুষটি একটা কিছু বলতে চাইছিল তার আগেই নিশীতা তার মুখে ডাক্ট টেপটা লাগিয়ে দিয়ে এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, তার মানে আসলেই এটা কাজ করে।
হ্যাঁ করে। এখন চলুন ভিতরে যাওয়া যাক। ঘরের চাবিটা নিয়ে নিই।
মানুষটার ডেস্কের উপরে একটা চাবির গোছা পাওয়া গেল, সেটা হাতে নিয়ে তিনজন ঘর থেকে বের হয়ে আসে।
সরু একটা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে একটা কলাপসিবল গেট পাওয়া গেল। সেটা ভোলার পর একটা বড় কাঠের দরজা, সেটা খোলার পর দেখা গেল হাসপাতালের মতো একটা লম্বা রুম, দু পাশে সারি সারি বিছানা। বিছানায় কেউ শুয়ে নেই, দরজা থেকে কয়েক হাতে দূরে সবাই কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে, সবার চোখে এক ধরনের তীব্র দৃষ্টি। মানুষগুলো কোনো কথা না বলে ক্যাপ্টেন মারুফ, নিশীতা এবং রিয়াজের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ক্যাপ্টেন মারুফ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সবার দিকে একনজর তাকিয়ে বলল, আমরা একটা বিশেষ কাজে আপনাদের সাথে দেখা করতে এসেছি।
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ গলায় শ্লেষ ঢেলে বলল, আপনার ভয় করছে না যে ভাইরাসের আক্রমণ হয়ে যাবে?
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নাড়ল, বলল, না, করছে না।
মানুষটি অবাক হয়ে বলল, কেন করছে না?
নিশীতা এগিয়ে এসে বলল, কারণ, আমরা জানি আপনাদের ভাইরাসের সংক্রমণ হয় নি।
মানুষগুলো নিশীতার কথা শুনে চমকে উঠল, এক মুহূর্ত নীরব থেকে একসাথে সবাই কথা বলে উঠতেই ক্যাপ্টেন মারুফ হাত তুলে তাদের থামিয়ে দেয়। মধ্যবয়স্ক মানুষটি একটু এগিয়ে এসে বলল, যদি আমাদের ভাইরাসের সংক্রমণ না হয়ে থাকে তা হলে আমাদের এখানে আটক রেখেছেন কেন? আমাদের যেতে দিচ্ছেন না কেন?
আসলে ঠিক আমরা আটকে রাখি নি।
তা হলে কে আটকে রেখেছে?।
সেটা অনেক বড় একটা কাহিনী–কোনো এক সময়ে আপনারা সবাই এটা জানবেন। এখন আমাদের সময় খুব কম–আমরা যে জন্য এসেছি সেটা সেরে নিই।
রমিজ মাস্টার বলল, কী জন্য এসেছেন?
রিয়াজ বলল, আপনারা ঠিক কী দেখেছেন আমরা সেটা শুনতে এসেছি।
মানুষগুলো আবার একসাথে কথা বলতে শুরু করতেই রমিজ মাস্টার হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, একজন একজন করে বলেন।
মানুষগুলো মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, একজন একজন করে।
রিয়াজ বলল, হ্যাঁ, আসুন দাঁড়িয়ে না থেকে কোথাও বসা যাক।
কমবয়সী একজন বলল, পাশের ঘর থেকে রাহেলাবুকেও ডেকে আনব?
নিশীতা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, উনাকেও ডেকে আনেন।
রিয়াজ জিজ্ঞেস করল, ইনি কি সেই ভদ্রমহিলা যার বাচ্চাকে নিয়ে গেছে?
হ্যাঁ। রমিজ মাস্টার জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে মাথা নেড়ে বলল, রাহেলার অবস্থা খুব খারাপ, মাথা মনে হয় খারাপ হয়ে যাবে।
কমবয়সী মানুষটি গিয়ে রাহেলাকে ডেকে আনল, তেইশ–চব্বিশ বছর বয়সের গ্রাম্য। মহিলা, চেহারার মাঝে এক সময়ে এক ধরনের কমনীয়তা ছিল কিন্তু এখন অনেকটা উন্মাদিনীর মতো। মাথায় রুক্ষ চুল, চোখ লাল, সমস্ত চোখেমুখে এক ধরনের ব্যাকুল। অস্থিরতা। ক্যাপ্টেন মারুফ, নিশীতা আর রিয়াজকে দেখে প্রায় হাহাকার করে বলল, আমার যাদুরে এনে দেন আপনারা। আল্লাহর কসম লাগে—আমার যাদুরে এনে দেন।
নিশীতা রাহেলার হাত ধরে বলল, আপনি একটু শান্ত হোন–আগে একটু শুনি কী হয়েছে। কিছু একটা যদি করতে হয় তা হলে আগে আমাদের জানতে হবে ঠিক কী হয়েছে।
রিয়াজ বলল, হ্যাঁ, আগে আমরা শুনি ঠিক কী হয়েছে। একজন একজন করে শুনি।
মানুষগুলো একজন একজন করে তাদের কথা বলতে শুরু করল। প্রথমে বলল আজহার মুন্সী। রাত্রিবেলা শহর থেকে ফিরে আসছিল, সড়কের কাছে বটগাছের নিচে তার রতন ব্যাপারির সাথে দেখা। রতন ব্যাপারির অনেক দিন থেকে আজহার মুন্সীর এক টুকরো জমির ওপর লোভ। জাল দলিল, কোর্ট–কাছারি করেও খুব সুবিধে করতে পারছে না বলে অন্যভাবে অগ্রসর হতে চাইছে। বটগাছের নিচে জমাট অন্ধকারে তাকে কয়েকজন চেপে ধরল। কিছু বোঝার আগেই তাকে নিচে ফেলে দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলল। আজহার মুন্সী আতঙ্কিত চোখে দেখে রতন ব্যাপারি ধারালো একটা চাকু নিয়ে এগিয়ে আসছে, ঠিক তখন হঠাৎ খুব একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, আজহার মুন্সী অবাক হয়ে দেখল রতন ব্যাপারির কাছে একটা প্রাণী দাঁড়িয়ে আছে। প্রাণীটি মানুষের মতো কিন্তু মানুষ নয়, অন্ধকারেও কোনো কারণে তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, সম্ভবত তার শরীর থেকে এক ধরনের আলো বের হয়। প্রাণীটির চোখ দুটো ছিল তীব্র লাল, মনে হয় যেন দুটো বাতি জ্বলছে। মাথা থেকে অনেকগুলো গুড়ের মতো বের হয়ে আসছে। সেগুলো কিলবিল করে নড়ছে। প্রাণীটা সেই ঔড় দিয়ে রতন ব্যাপারিকে খপ করে চেপে ধরে ফেলল। আজহার মুন্সীকে যে মানুষগুলো মাটিতে চেপে ধরে রেখেছিল তারা ততক্ষণে পালিয়ে গেছে– বটগাছের নিচে এখন তারা দুজন। রতন ব্যাপারি তখন ভয়ে আতঙ্কে তার হাতের চাকু দিয়ে সেই ভয়াবহ প্রাণীটিকে আঘাত করতে থাকে।
গল্পের এই পর্যায়ে এসে আজহার মুন্সী থেমে যায়। রিয়াজ জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হল?
আজহার মুন্সী স্বভাবতই খুব বিচলিত হয়ে আছে, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, এই। জিনিসটা মনে হয় লোহার তৈরি। চাকু দিয়ে প্রত্যেকবার ঘা দিতেই ঠন করে শব্দ হয়। রতন ব্যাপারির শরীরেও মোষের মতো জোর, পাগলের মতো কুপিয়ে যাচ্ছে। কোপাতে কোপাতে মনে হল চাকু দিয়ে সেই লোহার শরীর কেটে ফেলল। গলার কাছাকাছি কেটেছে। কাটতেই সেদিক দিয়ে সাবানের ফেনার মতো সবুজ রঙের আঠালো জিনিস বের হতে শুরু করল। তখন হঠাৎ সেখানে ইঁদুরের মতো একটা প্রাণী লাফ দিয়ে বের হয়ে এসে রতন ব্যাপারিকে কামড় দিয়ে ধরল।
আজহার মুন্সী আবার থেমে গিয়ে জিভ দিয়ে তার শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। রিয়াজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আজহার মুন্সীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তারপর?
সেই ইঁদুরের মতো ছোট্ট জন্তুটা পাখির মতন শব্দ করতে করতে রতন ব্যাপারির শরীরের ভিতর ঢুকে গেল।
নিশীতা অবাক হয়ে বলল, শরীরের ভিতরে ঢুকে গেল?
হ্যাঁ।
তারপর?
রতন ব্যাপারি তখন ধড়াম করে মাটিতে পড়ে গিয়ে চিৎকার করছে। আর সেই প্রাণীটা তার শরীরের ভিতর কিলবিল করে নড়ছে। রতন ব্যাপারি গরুর মতো চিৎকার করতে করতে এক সময় নীরব হয়ে গেল।
তারপর?
আজহার মুন্সী একটা নিশ্বাস দিয়ে বলল, আমি তো ভেবেছি আমি শেষ। মাটিতে হাত বাধা হয়ে পড়ে আছি, আর সেই মূর্তিটা আমার কাছে এগিয়ে এসেছে। নিচু হয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে, কেমন জানি একটা ওষুধের মতো গন্ধ শরীরে। আমি দেখতে পেলাম শরীরের ভিতরে কী যেন নড়ছে, মনে হয় সেই ইঁদুরের মতো প্রাণীগুলো।
তারপর?
আজহার মুন্সী বলল, তখন আবার সেটা দাঁড়িয়ে গেল, তারপর ঘুরে চলে গেল।
রিয়াজ জিজ্ঞেস করল, আপনি তখন কী করলেন?
আমি অনেক কষ্ট করে হাতের বাঁধন খুলে উঠে দাঁড়িয়েছি। রতন ব্যাপারির অবস্থা দেখার জন্য তার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। দেখি তার শরীরটা কাঁপছে।
কাঁপছে?
হ্যাঁ। আমার তখন ভয় লেগে গেল।
কী করলেন তখন?
ভাবলাম উঠে দৌড় দেই। ঠিক তখন রতন ব্যাপারির চোখ খুলে গেল। আপনি বিশ্বাস করবেন না চোখ দুটো টর্চ লাইটের মতো জ্বলছে। আমি তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম ঠাস্ শব্দ করে মাথার কাছে একটা ফুটো হয়ে সেদিক দিয়ে সাপের মতো কী একটা জিনিস বের হয়ে এল।
আজহার মুন্সী কয়েক মুহূর্তের জন্য থামল; তারপর একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি তখন আমার জান নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে এসেছি।
রতন ব্যাপারির কী হল?
একবার পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম সে টলতে টলতে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে। আগের মূর্তিটা যেদিকে গিয়েছে সেদিকে। সেও দানব হয়ে গেছে।
রিয়াজ একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, এই প্রসেসটার একটা নাম আছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ জানতে চাইল, কোন প্রসেসটার?
মহাজাগতিক প্রাণী এসে যখন লোকাল প্রাণীর শরীরকে ব্যবহার করে।
কী নাম?
এলিয়েন হোষ্টিং। এলিয়েন হোষ্টিং খুব ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এর অর্থ এই প্রাণী ইচ্ছে করলে পুরো পৃথিবী দখল করে ফেলতে পারবে।
নিশীতা হাতের ঘড়ি দেখে বলল, ড. হাসান, আমাদের হাতে কিন্তু সময় নেই।
হ্যাঁ, আমরা অন্যদের কথাও শুনে নিই। এর মাঝেই কিন্তু একটা প্যাটার্ন দেখা যাচ্ছে।
নিশীতা জিজ্ঞেস করল, কী প্যাটার্ন?
প্রথম কেসটা তুমি যেটা বলেছিলে সেখানে এলিয়েন হোস্টিং করেছিল একজন টেররিস্টকে। এখানেও এলিয়েন হোষ্টিং করেছে একজন মার্ডারারকে, অন্ততপক্ষে যে মার্ডার করতে চাইছিল সেই মানুষকে!
রমিজ মাস্টার গলা উঁচু করে বলল, আমি যেটা দেখেছি সেটাও এ রকম কেস। সেখানেও আমাকে মানুষটা মার্ডার করতে চাইছিল।
উপস্থিত অন্য মানুষগুলো হঠাৎ সবাই একসাথে কথা বলার চেষ্টা করল, সবারই বলার মতো এই ধরনের গল্প রয়েছে। রিয়াজ হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিল, বলল, একজন একজন করে শোনা যাক।
এর পরের ঘটনাটি বর্ণনা করল তিনজন মিলে। তাদের নাম হান্নান, ইদরিস আর সোলায়মান। সম্পর্কে এরা ফুপাতো এবং মামাতো ভাই, বাজারে মালা ফ্যাশন নামে তাদের একটা কাপড়ের দোকান আছে। এলাকার বখে যাওয়া চাঁদাবাজ সবুজ আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা মালা ফ্যাশনে এসে মোটামুটি নিয়মিতভাবে চাদাবাজি করে। এদের অত্যাচারে ছোট–বড় সব ব্যবসায়ী একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। শেষে আর কোনো উপায় না দেখে সবাই মিলে একত্র হয়ে একদিন তাদের ধরে পুলিশে দিয়ে দিল। আসল সমস্যার শুরু হল তখন পুলিশ টাকাপয়সা খেয়ে তাদের ছেড়ে দিল। সবুজ আর সাঙ্গপাঙ্গরা মিলে তখন ঠিক করল এর প্রতিশোধ নেবে। হান্নান, ইদরিস আর সোলায়মানদের খুন করে ফেলবে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এক রাতে তারা যখন বাড়ি ফিরে আসছে, জলার কাছাকাছি একটা নির্জন জায়গায় সবুজ তার দলবল নিয়ে তাদের ধরে ফেলল। অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে কিল ঘুসি লাথি মেরে তাদেরকে জলার ধারে নিয়ে এসে দাঁড় করায়। সবুজ তার রিভলবার বের করে গুলি করার জন্য, ঠিক তখন একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, হঠাৎ করে সবুজের দলবলের সবাই কিছু একটা দেখে চিৎকার করে পালিয়ে যেতে শুরু করল। হান্নান, ইদরিস আর সোলায়মান পিছন দিকে তাকিয়ে দেখে জলার ভিতর থেকে কিম্ভুতকিমাকার একটা মূর্তি উঠে আসছে। এটা দেখতে অনেকটা মানুষের মতো কিন্তু পুরোপুরি মানুষ নয়, মাথা থেকে অনেকগুলো শুড়ের মতো কিছু ঝুলছে। চোখ দুটো থেকে লাল আলো বের হয়ে আসছে। একটা হাতের ভিতর নানা রকম যন্ত্রপাতি, দেখে মনে হয় একই সাথে মানুষ, যন্ত্র এবং পশু।
এই মূর্তিটাকে দেখে সবুজ সেটাকে গুলি করতে করে কিন্তু তার কিছুই হয় না, মূর্তিটা এক পা এক পা করে এগুতে থাকে। শেষ মুহূর্তে সবুজও ভয় পেয়ে যায়। সে ছুটে পালিয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু হঠাৎ করে মূর্তিটার হাতের ভিতর থেকে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো কিছু একটা বের হল, সবুজ তাতে আটকা পড়ে যায়। সেই মূর্তিটা তখন সবুজের কাছে এগিয়ে যায়, তখন হঠাৎ তার শরীরের ভিতর থেকে ছোট ছোট সরীসৃপের মতো প্রাণী বের হয়ে আসে, সেগুলো কিলবিল করে সবুজের শরীরের ভিতরে ঢুকে যায়। সবুজ বিকট স্বরে চিৎকার করতে থাকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কী হয়েছে দেখার জন্য। তিনজনের কারোই আর সাহস হয় না, কোনোমতে তারা তাদের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে।
রিয়াজ চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করল, আপনারা বলছেন আপনারা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছেন–কিন্তু কথাটি কি সত্যি? সেই মূর্তিটা তো ইচ্ছে করলে আপনাদেরও হাই ভোল্টেজ শক দিয়ে ধরে ফেলতে পারত। পারত না?
পারত। মানুষ তিনজন মাথা নেড়ে বলল, ইচ্ছা করলেই পারত। কিন্তু সেটা করে নি।
আমরা আগেও এই প্যাটার্ন দেখেছি। এই মূর্তি বা এলিয়েন বা মহাজাগতিক প্রাণীটা শুধুমাত্র মার্ডারার বা ক্রিমিনালদের শরীরে আশ্রয় নিচ্ছে সাধারণ মানুষদের ছেড়ে দিচ্ছে। তাদের কোনো ক্ষতি করছে না।
না, মিথ্যা কথা। রাহেলা চিৎকার করে ডুকরে কেঁদে উঠল, আমার যাদু কি অপরাধ করেছে? সাত দিনের একটা মাসুম বাচ্চাকে তা হলে কেন নিয়ে গেল?
উপস্থিত সবাই মাথা নাড়ল, বলল, এটা সত্যি কথা।
প্রায় সবার বেলাই এটা সত্যি যে তারা দেখেছে কোনো একটা খুনি বা সন্ত্রাসী ঠিক যখন বড় কোনো অপরাধ করতে যাচ্ছে ঠিক তখন তাকে আক্রমণ করছে, শুধু একটি ব্যতিক্রম, সেটি হচ্ছে রাহেলার শিশুর ব্যাপারটি। ঠিক কী ঘটেছে সেটা জানার জন্য নিশীতা এবং রিয়াজকে খুব কষ্ট করতে হল। রাহেলা ঠিক করে কথাই বলতে পারছিল না–একটু পরে পরে ডুকরে কেঁদে উঠছিল। অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত তার মুখ থেকে ঘটনার যে বর্ণনা পাওয়া গেল, সেটি এ রকম :
সন্ধেবেলা রাহেলা তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে। বাচ্চার বয়স মাত্র সাত দিন কোলের মাঝে আঁকুপাকু করে কাঁদছে এবং রাহেলার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে এই ছোট শিশুটা গত নয় মাস তার শরীরের ভিতরে বিন্দু বিন্দু করে বড় হয়ে উঠেছে। এই শিশুটির জন্মের পর তার দৈনন্দিন প্রতিটি মুহূর্ত এখন এই শিশুটিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এত ছোট একজন মানুষ কীভাবে একজনের জীবনের সবটুকু পরিবর্তিত করে ফেলতে পারে সেই বিষয়টি নিয়ে রাহেলা যখন মনে মনে খুব অবাক হয়ে যাচ্ছিল তখন সে উঠানের পাশে হাস্নাহেনা গাছের কাছে সরসর করে পাতার শব্দ শুনতে পেল–তাদের পোষা কুকুর ভেবে ঘুরে তাকাতেই রাহেলার সমস্ত শরীর আতঙ্কে জমে গেল। হাস্নাহেনা গাছের নিচে মানুষের আকৃতির একটা জীব দাঁড়িয়ে আছে। জীবটির শরীর ধাতব, চোখ দুটো অংগারের মতো লাল হয়ে জ্বলছে।
রাহেলা তার বাচ্চাটিকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে পিছন দিকে ছুটে যেতে গিয়ে আবিষ্কার করল ঠিক তার পিছনেও এ রকম একটা জীব দাঁড়িয়ে আছে। মানুষের আকৃতির এই জীবটির মাথা থেকে কিলবিল করে সাপের মতো কিছু একটা নড়ছে।
রাহেলা তখন তার ডানে বামে তাকাল এবং দেখল সেখানেও ঠিক একই রকম কয়েকটা জীব দাঁড়িয়ে আছে। জীবগুলো তখন খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তাকে গোল হয়ে ঘিরে ফেলতে লাগল। রাহেলাকে কেউ বলে দেয় নি কিন্তু সে বুঝতে পারল এই জীবগুলো তার বাচ্চাকে কেড়ে নিতে আসছে। সে তখন তার বাচ্চাটাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে চিৎকার করে বলল, –না–না–কেউ আমার কাছে আসবে না, খবরদার।
কিন্তু জীবগুলো ভ্রূক্ষেপ করল না, খুব ধীরে ধীরে তাদের হাতগুলো উপরে তুলে এগিয়ে আসতে লাগল। রাহেলা তখন বাচ্চাটাকে বুকে চেপে ছুটে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর জীবগুলো তাদের শুড় দিয়ে তাকে ধরে ফেলল। রাহেলা বাচ্চাটাকে বুকে চেপে ধরে প্রাণপণ চেষ্টা করল ছুটে যেতে কিন্তু প্রাণীগুলোর শরীর লোহার মতো শক্ত আর বরফের মতো শীতল। তাকে নিচে ফেলে তার বুক থেকে বাচ্চাটাকে কেড়ে নিল। রাহেলা আঁচড়ে–কামড়ে প্রাণীটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল কিন্তু প্রাণীগুলো তাকে ঝটকা মেরে নিচে ফেলে দিয়ে হেঁটে চলে গেল। রাহেলা উন্মাদিনীর মতো পিছনে পিছনে ছুটে যেতে চাইছিল কিন্তু তার চিৎকার শুনে লোকজন ছুটে এসে তাকে ধরে রেখেছিল বলে সে যেতে পারে নি। পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে সে অচেতন হয়ে গিয়েছিল।
কথা বলা শেষ করে রাহেলা আবার দুই হাতে মুখ ঢেকে আকুল হয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল। নিশীতা রাহেলাকে শক্ত করে ধরে রাখে, ঠিক কী ভাষায় তাকে সান্ত্বনা দেবে বুঝতে। পারে না।
রিয়াজ গম্ভীর মুখে হেঁটে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। একটু পরে ক্যাপ্টেন মারুফ আর নিশীতা তার পাশে এসে দাঁড়াল। রিয়াজ ঘুরে ক্যাপ্টেন মারুফের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ক্যাপ্টেন মারুফ, আপনার কি এখনো এই ব্যাপারটি নিয়ে কোনো সন্দেহ আছে?
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নাড়ল, বলল, না, নেই।
তা হলে কি আপনার কাছে আমি আরো একটু সাহায্য পেতে পারি?
কী সাহায্য?
আমাকে কি আপনার জিপে করে আপনি এই মহাজাগতিক প্রাণীর আস্তানায় নিয়ে যাবেন?
নিশ্চয়ই নিয়ে যাব। আপনি জানেন সেটি কোথায়?
রিয়াজ মাথা নাড়ল, বলল, না জানি না।
তা হলে?
নিশীতার কাছে একটি সেলুলার টেলিফোন আছে
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু এখানে নেটওয়ার্কে সিগন্যাল নেই, সেলুলার ফোন কাজ করবে না।
রিয়াজ হাসার ভঙ্গি করে বলল, সেটা নিয়ে ভাববেন না। নিশীতার সেলুলার ফোনের ব্যাটারির চার্জ অনেক আগে শেষ হয়ে গেছে, তার পরেও সেখানে সময়মতো ফোন আসছে। কোথায় যেতে হবে আমাদের বলে দিচ্ছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ অবাক হয়ে বলল, কে বলে দিচ্ছে?
এপসিলন।
এপসিলন? সেটা কে?
নিশীতা বলল, ড, হাসানের একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম।
কম্পিউটার প্রোগ্রাম?
রিয়াজ ইতস্তত করে বলল, কোনো একটি প্রাণী আমার এই প্রোগ্রামটি ব্যবহার করে আমাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না—
আমরাও ঠিক বুঝতে পারছি না শুধু একটি জিনিস জানি–আমরা একেবারে একা নই।
চমৎকার। চলুন তা হলে যাই
চলুন।
ঘর থেকে বের হওয়ার সময় রাহেলা পাগলের মতো ছুটে এসে তাদের পথ আটকে দাঁড়িয়ে বলল, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?
রিয়াজ একটু ইতস্তত করে বলল, আমরা যাচ্ছি ঐ প্রাণীগুলোর আস্তানায়।
রাহেলা চোখ বড় বড় করে বলল, আমি যাব আপনাদের সাথে।
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নেড়ে বলল, আপনি কেমন করে যাবেন?
নিশীতা বলল, আমরা এখনো জানি না কেমন করে যাব। সেখানে কী হবে আমাদের কোনো ধারণা নেই।
রাহেলা মাথা নেড়ে কাতর গলায় বলল, না, আমি যাব। আমি আমার যাদুর কাছে যাব। আল্লাহর কসম লাগে আমাকে নিয়ে যান
ক্যাপ্টেন মারুফ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, রিয়াজ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে রাহেলা, আপনি যদি আমাদের সাথে যেতে চান আসুন।
নিশীতা একটু অবাক হয়ে রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু
কিন্তু কী?
রাহেলা সবকিছু নিয়ে এত অস্থির হয়ে আছে, তাকে এভাবে নেওয়া কি ঠিক হবে? রিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে ফিসফিস করে বলল, আমার ধারণা এই পৃথিবীকে যদি কেউ বাঁচাতে পারে তা হলে সেটি রাহেলাই পারবে। আর কেউ পারবে না।
১০. কাঁচা রাস্তা দিয়ে জিপটা এগিয়ে যাচ্ছে
কাঁচা রাস্তা দিয়ে জিপটা এগিয়ে যাচ্ছে, নিশীতার মনে হচ্ছে যে কোনো মুহূর্তে বুঝি জিপটা উল্টে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যাবে। বাইরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, জিপের হেডলাইটের। আলোতে অল্প কিছুদূর আলোকিত হয়ে তার চারপাশে অন্ধকার যেন আরো এক শ গুণ গাঢ় করে ফেলা হচ্ছে। তারা কোথায় যাচ্ছে পুরোপুরি নিশ্চিত নয়–অনেক চেষ্টা করেও নিশীতার সেলুলার টেলিফোনে এপসিলনের কথা শোনা যায় নি, তাই আপাতত রাহেলার বাড়ির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছে। মহাজাগতিক প্রাণীকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যকবার দেখা গেছে এই এলাকাতেই। কাছাকাছি একটা জলা জায়গা রয়েছে, রিয়াজের ধারণা তার আশপাশেই মহাজাগতিক প্রাণীটি তার আস্তানা তৈরি করেছে।
জিপের মাঝে চারজন নিঃশব্দে বসে আছে, সবার ভিতরেই একটি বিচিত্র অনুভূতি। কী হবে তার অনিশ্চয়তার সাথে সাথে এক ধরনের অস্বাভাবিক অশরীরী আতঙ্ক। শুধুমাত্র রাহেলার বুকের মাঝে কোনো আতঙ্ক নেই, তার বুক খালি করে শিশুটিকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর থেকে তার সকল বোধশক্তি অসাড় হয়ে গেছে–তার বুকের মাঝে এখন শুধু এক ভয়াবহ শূন্যতা।
জিপটি উঁচু-নিচু সড়ক দিয়ে একটা ভাঙা মসজিদের পাশে এসে দাঁড়াল, এখন কোনদিক দিয়ে যেতে হবে ক্যাপ্টেন মারুফ সেটা যখন বের করার চেষ্টা করছে ঠিক তখন নিশীতার সেলুলার টেলিফোনটি বেজে উঠল নিশীতা দ্রুত কানে লাগাল, হ্যাঁলো।
নিশীতা?
হ্যাঁ।
এইমাত্র একটা হেলিকপ্টার আকাশে উঠেছে। তোমরা কী করছ ফ্রেন্ড লিস্টার তার খবর পেয়েছে। হেলিকপ্টারটা তোমাদের থামানোর চেষ্টা করবে।
কীভাবে থামানোর চেষ্টা করবে?
দুটো রিকয়েললেস রাইফেল আছে। মনে হয় গুলি করে তোমাদের জিপটা উড়িয়ে দেবে।
সর্বনাশ! আমরা তা হলে এখন কী করব?
সেটা তো জানি না।
নিশীতা আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই খুট করে লাইন কেটে গেল।
রাস্তার ওপর একটা বড় গর্তকে সাবধানে পাশ কাটিয়ে ক্যাপ্টেন মারুফ জিজ্ঞেস করল, কে ফোন করেছে? কী বলেছে?
এপসিলন বলেছে একটা হেলিকপ্টার আসছে আমাদের গুলি করতে।
নিশীতার কথা শেষ হবার আগেই ক্যাপ্টেন মারুফ জিপটাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সবাই নেমে যান।
কোনো কথা না বলে সবাই নেমে পড়ে। জিপের পিছন থেকে নিশীতা আর রিয়াজের ব্যাকপ্যাক দুটো সাবধানে নামিয়ে নেওয়ার পর ক্যাপ্টেন মারুফ বলল, আপনারা রাস্তার ওপর থেকে সরে যান।
রিয়াজ জিজ্ঞেস করল, আপনি?
আমিও আসছি। জিপটাকে চালিয়ে রেখে নেমে পড়তে হবে যেন বুঝতে না পারে জিপে কেউ নেই। তা না হলে আমাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে।
ঠিক আছে। সাবধানে থাকবেন।
ক্যাপ্টেন মারুফ জিপটা চালিয়ে সামনের দিকে চলে যাওয়ার সাথে সাথেই অন্যরা দূরে হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেল। নিশীতা আর রিয়াজ তাদের ব্যাকপ্যাক দুটো ঘাড়ে তুলে নিয়ে দ্রুত রাস্তা থেকে নিচে নেমে দূরে ঝোঁপঝাড়ের দিকে সরে গেল।
কিছুক্ষণের মাঝেই মূর্তিমান ধ্বংসের মতো তাদের মাথার ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারটি দূরে জিপের দিকে এগিয়ে যায়। নিশীতার বুক ধকধক করতে থাকে, গ্রামের কাঁচা সড়ক দিয়ে জিপটি তখনো হোঁচট খেতে খেতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, জিপ থেকে ক্যাপ্টেন মারুফ নেমে গেছে কি না কেউ বুঝতে পারছে না। দূরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তারা দেখতে পেল হেলিকপ্টার থেকে একটা মিসাইল উড়ে গেল জিপের দিকে এবং কিছু বোঝার আগে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে পুরো জিপটি ছিন্নভিন্ন হয়ে দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল–তারা যদি সময়মতো জিপ থেকে নেমে না পড়ত তা হলে এতক্ষণে তাদের কী অবস্থা হত চিন্তা করে নিশীতা আতঙ্কে শিউরে ওঠে।
রিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে চাপা গলায় বলল, ক্যাপ্টেন মারুফ সময়মতো নামতে পেরেছে তো?
না নেমে থাকলে কী ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে চিন্তাটুকু জোর করে মন থেকে দূর করে সরিয়ে দিয়ে নিশীতা বলল, নিশ্চয়ই পেরেছে।
তারা দেখতে পেল হেলিকপ্টারটি আবার ঘুরে জ্বলন্ত জিপের কাছে এগিয়ে এসে নিছ হয়ে সেটাকে ঘিরে উড়ে আবার উপরে উঠে দূরে চলে যেতে শুরু করেছে। বেশি দূর না গিয়েই সেটা সামনে কোথায় জানি নেমে পড়ল। রিয়াজ বাইনোকুলার দিয়ে দেখতে দেখতে বলল, আমার ধারণা হেলিকপ্টারটি যেখানে নেমেছে আমাদেরকেও সেখানে যেতে হবে।
হেলিকপ্টারে করে ফ্রেন্ড লিস্টার মহাজাগতিক প্রাণীটির আস্তানায় গিয়েছে?
ঠিক আস্তানা না হলেও আস্তানার খুব কাছাকাছি।
আমরা কি এখানে ক্যাপ্টেন মারুফের জন্য অপেক্ষা করব নাকি সামনে এগিয়ে যাব?
সামনে এগুতে থাকি। রিয়াজ ব্যাকপ্যাক থেকে তার নাইটভিশন গগলস বের করে দূরে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, ঐ তো ক্যাপ্টেন মারুফকে দেখতে পাচ্ছি–এই দিকেই আসছেন।
নিশীতা খুব খুশি হয়ে বলল, যাক বাবা, যা ভয় পেয়েছিলাম!
রাহেলা এই দীর্ঘ সময় একটি কথাও বলে নি, এই প্রথমবার সে শান্ত গলায় বলল, আল্লাহ মেহেরবান।
ক্যাপ্টেন মারুফ চলে আসার পর চারজনের ছোট দলটি আবার অগ্রসর হতে থাকে। কোন দিকে যেতে হবে সেটি রিয়াজ বলে দিতে থাকে। সে একটা ছোট যন্ত্র তার বুকে ঝুলিয়ে নেয় সেখান থেকে একটা হেডফোন বের হয়ে আসছে। দূরে কোথাও রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির কিছু তরঙ্গ থেকে সে তার গন্তব্যস্থান বের করে নিতে পারছে। তারা হেঁটে হেঁটে একটার পর একটা গ্রাম পার হয়ে যেতে থাকে। গ্রামের পর গ্রাম থেকে সব মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে–এলাকাগুলো একেবারে প্রেতপুরীর মতো নির্জন। কোথাও কোনো জীবন্ত প্রাণীর চিহ্ন পর্যন্ত নেই, মনে হচ্ছে ঝিঁঝি পোকা পর্যন্ত ডাকতে ভুলে গেছে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে চারজন পা টেনে টেনে হাঁটতে থাকে, তাদের মনে হতে থাকে তারা বুঝি কোনো অশরীরী জগতে চলে এসেছে।
রিয়াজের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা উঁচু জায়গায় উঠে এল। জায়গাটা বড় বড় গাছ দিয়ে আড়াল করা। সেই জংগলের মতো জায়গাটা থেকে বের হতেই তাদের হৃৎস্পন্দন হঠাৎ করে থেমে যায়। তাদের সামনে হঠাৎ করে যে দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠল নিজের চোখে না দেখলে তারা কখনো সেটা বিশ্বাস করত না।
সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ, মাঠের বিশ ফুট উঁচুতে একেবারে নিঃশব্দে একটি মহাকাশযান দাঁড়িয়ে আছে। মহাকাশযানটির সাথে পৃথিবীর কোনো কিছুর মিল নেই। মহাকাশযানটি থেকে কোনো আলো বের হচ্ছে না তবু সেটি দেখা যাচ্ছে, খুব ভালো করে দেখলে মনে হয় এটি বুঝি বিশাল কোনো জীবন্ত প্রাণী; এর সমস্ত শরীরে বিচিত্র এক ধরনের টিউব জালের মতো ছড়িয়ে আছে। সেই স্বচ্ছ টিউব দিয়ে খুব ধীরে ধীরে কিছু গোলাকার জিনিস নড়ছে। মনে হয় পুরো জিনিসটি এক ধরনের আঠালো জিনিসে ডুবে আছে, খুব কান পেতে থাকলে ভিতর থেকে এক ধরনের ভেতা শব্দ শোনা যায়।
মহাকাশযানটির ঠিক নিচে নীল এক ধরনের অশরীরী আলো, সেখানে বিচিত্র কিছু মূর্তি। এই মূর্তিগুলো নিশ্চয়ই এক সময় মানুষ ছিল, মহাজাগতিক প্রাণী এসে তাদের শরীরকে দখল করে নিয়ে ব্যবহার করছে। মানুষগুলো মৃত কিন্তু তাদের দেহ নড়ছে– ব্যাপারটি চিন্তা করলেই সমস্ত শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মানুষগুলোর সবার শরীরই এক রকম। মাথার অংশটি বিচিত্রভাবে ফুলে উঠেছে। সেখান থেকে শুঁড়ের মতো কিলবিলে অংশ বের হয়ে এসেছে, খুব আস্তে আস্তে সেগুলো জীবন্ত প্রাণীর মতো নড়ছে। মানুষগুলোর দেহ একইসাথে যান্ত্রিক এবং জৈবিক। প্রায় পঞ্চাশটি এই ধরনের প্রাণী মহাকাশযানের নিচে খুব ধীরে ধীরে নড়াচড়া করছে। হঠাৎ করে তাকালে মনে হয় সেখানে বুঝি কোনো এক ধরনের নৃত্যানুষ্ঠান হচ্ছে, এই বিচিত্র প্রাণীগুলোর হাত পা শরীর ড়গুলোর নড়াচড়ার মাঝে এক ধরনের অশরীরী ছন্দ রয়েছে। মনে হচ্ছে তারা বুঝি কোনো প্রেতলোকে চলে এসেছে এবং সেই প্রেতলোকের অশরীরীরা মৃত্যুর অপর পাশে থেকে তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পুরো দৃশ্যটি এত অবাস্তব এবং এত অস্বাভাবিক যে তারা চারজন একেবারে পাথরের মতো জমে গেল। দীর্ঘ সময় কেউ কোনো কথা বলতে পারে না–হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সবার আগে সংবিৎ ফিরে পায় রাহেলা, সে চাপা এবং উত্তেজিত গলায় বলে, যাদু! আমার যাদুমণি।
নিশীতা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
ঐ তো। মাঝখানে।
নিশীতা ভালো করে তাকিয়ে দেখতে পেল সত্যিই একেবারে মাঝখানে একটা ছোট পিলারের উপর একটি ছোট শিশু। এত দূর থেকে ভালো করে দেখা যায় না। কিন্তু তবু মনে হয় তার চারপাশের ভয়াবহ ঘূর্তিগুলোর অশরীরী কার্যকলাপের মাঝে শিশুটি নির্বিকারভাবে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে।
রিয়াজ তার পিঠ থেকে ব্যাকপ্যাক নামিয়ে বলল, আমরা এখান থেকেই কাজ শুরু করি।
ক্যাপ্টেন মারুফ জিজ্ঞেস করল, কী কাজ?
এই মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগ।
ক্যাপ্টেন মারুফ চমকে উঠে বলল, আপনি পারবেন?
ফ্রেড লিস্টার যদি পারে তা হলে আমি কেন পারব না? সেই বদমাইশ তো আমার কোডিং ব্যবহার করেই যোগাযোগ করছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ চারদিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় ফ্রেন্ড লিস্টার?
রিয়াজ তার নাইটভিশন গগলসটি ক্যাপ্টেন মারুফকে দিয়ে বলল, এটা দিয়ে দেখেন, মোটামুটিভাবে ইলেভেন ও ক্লক পজিশন। দু শ মিটার দূরে।
ক্যাপ্টেন মারুফ গগলস চোখে দিয়েই দেখতে পেল অন্যপাশে ফ্রেন্ড লিস্টার এবং আরো কয়েকজন মানুষ বেশ কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছে। সেখানে এক ধরনের ব্যস্ততা। যন্ত্রপাতির মাঝে উবু হয়ে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে তারা কিছু একটা লক্ষ করছে। মানুষগুলোকে দেখে ক্যাপ্টেন মারুফ নিজের ভিতরে এক ধরনের বিজাতীয় ক্রোধ অনুভব করে, দাঁতে দাঁত ঘষে সে বলল, ধড়িবাজ বদমাইশের দল। আমি যদি তোদের মুণ্ডু ছিঁড়ে না নিই!
রিয়াজ হেসে বলল, মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলার অনেক সময় পাওয়া যাবে, আপাতত আমাকে একটু সাহায্য করুন। এই এ্যান্টেনাটা উঁচু কোনো জায়গায় বসিয়ে দিন।
ক্যাপ্টেন মারুফ গগলসটা খুলে রিয়াজকে সাহায্য করতে করে। কিছুক্ষণের মাঝেই বড় একটা গাছের পিছনে কিছু ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে তাদের যন্ত্রপাতি দাঁড়া হতে থাকে। একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার ছোট আর. এফ. জেনারেটর আর তার কন্ট্রোল সার্কিটের সাথে জুড়ে দেওয়া হল। এ্যান্টেনা থেকে কো–এক্সিয়াল তার এনে কন্ট্রোল সার্কিটের সাথে জুড়ে দেওয়ামাত্রই এমপ্লিফায়ারের সাথে লাগানো দুটি স্পিকার থেকে মানুষের এক ধরনের যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর শোনা গেল। নিশীতা চমকে উঠে বলল, কে কথা বলছে?
এখনো জানি না। মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে কথা বলার জন্য আমি যে কোডটা তৈরি করেছি এটা সেই কোডের মানবিক অনুবাদ।
মানে?
মানুষেরা যখন একজন আরেকজনের সাথে কথা বলে তার একটা পদ্ধতি আছে। যে তাষাতেই কথা বলি না কেন তার মূল ব্যাপারটা এক। আমাদের যোগাযোগ মাধ্যমটুকু হচ্ছে আমাদের বুদ্ধিমত্তা, আমাদের অনুভূতি। কিন্তু এই মহাজাগতিক প্রাণী হচ্ছে অন্যরকম। তারা আমাদের মতো ভাবে না, তাদের যদি অনুভূতি থাকেও সেটা অন্যরকম।
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নেড়ে বলল, আমি বুঝতে পারলাম না।
যেমন মনে করুন আমি আপনার সাথে কথা বলছি–কথা বলতে গিয়ে আমি এমন কিছু বলে ফেলতে পারি যেটা শুনে আপনি আমার ওপর খুব রেগে উঠতে পারেন। পারেন না?
হ্যাঁ পারি।
কিন্তু ধরা যাক আপনার মস্তিষ্ক অপারেশন করে এমনভাবে আপনাকে পাল্টে দেওয়া হল যে আপনার ভিতরে রাগের অনুভূতিটুকু নেই। তখন কী হবে? আপনাকে আমি যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করতে পারি, আপনি কিছুই মনে করবেন না!
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি। তবে কোনো মানুষের রাগ নেই সেটা চিন্তা করা খুব কঠিন, বিশেষ করে আমার পক্ষে!
শুধু রাগ নয়, ধরে নিন তার শুধু যে রাগ নেই তা নয়, তার দুঃখও নেই, আনন্দও নেই, ভালবাসাও নেই, ঘৃণাও নেই, হিংসাও নেই।
তা হলে আছে কী?
মনে করুন তার আছে কোয়াজি ফিলিং।
কোয়াজি ফিলিং সেটা আবার কী?
জানি না। রিয়াজ মাথা নেড়ে বলল, ধরে নেন এমন একটা অনুভূতি যেটা আমাদের নেই, তাই আমরা সেটা বুঝতেও পারি না, কল্পনাও করতে পারি না।
যেটা আপনি জানেন না, যেটা কল্পনা করতে পারেন না সেটা কীভাবে ধরে নেব?
এটাই আমার কোড। এটা যোগাযোগ শুরু করে কিছু তথ্য আদানপ্রদান করে, যেখান থেকে যোগাযোগ করার মতো একটা পর্যায়ে পৌঁছানো যায়। এটা মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ নয়। চতুর্থ পর্যায়ের বুদ্ধিমত্তার সাথে পঞ্চম পর্যায়ের বুদ্ধিমত্তার যোগাযোগ।।
নিশীতা এগিয়ে এসে বলল, কিন্তু আপনার যোগাযোগ শুরু করতে তো খুব বেশি সময় নেবে না। তাই না?
না। কারণ ব্যাটা ফ্রেড লিস্টার এই কাজটুকু করে রেখেছে। তাই আমরা এর মাঝে কথা শুনতে শুরু করেছি। এই যে শোন
রিয়াজ এমপ্লিফায়ারের ভলিউম বাড়িয়ে দিতেই সবাই এক ধরনের যান্ত্রিক কথা শুনতে পেল, বিনিময় মূল বিষয় বিনিময় নিষিদ্ধ যোগাযোগ কেন্দ্রীয় বুদ্ধিমত্তা পারস্পরিক বিনিময় মূল শক্তি কেন্দ্রীয় ক্ষমতা শক্তি অপশক্তি
নিশীতা মাথা নেড়ে বলল, কী বলছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
এটা ফ্রেন্ড লিস্টারের কথা।
ফ্রেড লিস্টারের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কীলছে আবোলতাবোল?
আসলে সে আবোলতাবোল বলছে না। তার কথা এই মহাজাগতিক প্রাণীর জন্য কোডিং হয়ে যাবার পর আবার আমাদের ভাষায় অনুবাদ করার সময় এ রকম হয়ে যাচ্ছে। রিয়াজ মুখে হাসি এনে বলল, আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড–একটা কথা আছে না?
হ্যাঁ, আছে। কী হয়েছে সেই কথার?
সেটাকে একবার রাশিয়ান ভাষায় অনুবাদ করে আবার ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছিল। অনুবাদটি কী হয়েছিল জান?
কী?
ব্লাইন্ড ইডিয়ট। অন্ধ গর্দভ! অন্ধকারে রিয়াজ নিচু স্বরে হাসল, এই ভয়ংকর বিপজ্জনক পরিবেশে সে নিজের ভিতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছে, তাই প্রয়োজন থেকে বেশি কথা বলছে সে। যন্ত্রপাতির ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, এখানেও এই ব্যাপার, ফ্রেন্ড লিস্টারের কথা মহাজাগতিক প্রাণীর জন্য কোডিং এবং আনকোডিং করার পর এ রকম জট পাকানো আবোলতাবোল হয়ে যাচ্ছে।
কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না কী বলছে।
কে বলছে বোঝা যাচ্ছে না? শোন আবার
তারা শুনল, বুদ্ধিমত্তা তৃতীয় চতুর্থ পঞ্চম যোগাযোগ কেন্দ্রীয় পারস্পরিক বিনিময় মূল শক্তি বিনিময় ক্ষমতা যোগাযোগ নিষিদ্ধ বিনিময়, পারস্পরিক পাঁচ দুই পাঁচ ছয় তিন সাত পাঁচ ছয় সাত আট…
ক্যাপ্টেন মারুফ মাথা নাড়ল, বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
সংখ্যাগুলো হচ্ছে পাইয়ের মান–দশমিকের পর দশ হাজার পর্যন্ত। যোগাযোগ করার জন্য এটা ব্যবহার করতে হয়। ফ্রেন্ড লিস্টারের কথায় একটু পরে পরে বলছে বিনিময় পারস্পরিক যোগায়োগ শুনতে পাচ্ছ না?
হ্যাঁ।
তার মানে সে পারস্পরিক বিনিময় করার চেষ্টা করছে। সে কিছু একটা দেবে তার বদলে সে কিছু একটা চায়।
কী দেবে সে?
জানি না।
নিশীতা মনোযোগ দিয়ে স্পিকারের কথাগুলো শুনতে শুনতে বলল, এগুলো যদি ফ্রেড লিস্টারের কথা হয় তা হলে মহাজাগতিক প্রাণীর কথা কোনগুলো?
এখনো শুনতে পাচ্ছি না। আমাকে টিউন করতে হতে পারে।
রিয়াজ তার যন্ত্রপাতি টিউন করতে করতে হঠাৎ চমকে সোজা হয়ে বলল, এই যে শোন।
তারা সবাই শুনল, ভাঙা যান্ত্রিক গলায় কেউ একজন বলছে, নিচু ক্ষুদ্র দুর্বল কম নিচু ক্ষুদ্র ছোট অল্প কম ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎকর।
কী হল? নিশীতা চোখ বড় বড় করে বলল, গালাগাল করছে নাকি আমাদের?
সেরকমই মনে হচ্ছে। রিয়াজ হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমাদের ফ্রেড লিস্টারের চরিত্রটি ধরে ফেলেছে মনে হচ্ছে।
ফ্রেড লিস্টার আবার বলল, বিনিময় পারস্পরিক বিনিময়।
মহাজাগতিক প্রাণী উত্তর করল, অসম দুর্বল ক্ষুদ্র।
বিনিময় বিনিময় প্রযুক্তি বিনিময়।
দুর্বল ক্ষুদ্র।
বিনিময় শিশু মানব শিশু বিনিময় আমন্ত্রণ মানব শিশু।
রিয়াজ চমকে উঠে বলল, শুনেছ কী বলছে ফ্রেড? সে মানব শিশুকে বিনিময় করতে চাইছে। মানব শিশুর বদলে প্রযুক্তি চাইছে।
নিশীতা হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল বলল, রাহেলা কোথায়?
সবাই উঠে দাঁড়াল, চারপাশে তাকাল, কোথাও রাহেলাকে দেখা যাচ্ছে না। নিশীতা চাপা স্বরে ডাকল, রাহেলা, রাহেলা।
রাহেলা কোনো উত্তর করল না, হঠাৎ রিয়াজ চমকে উঠল, হাত দিয়ে দেখাল, ঐ যে দেখো।
সবাই অবাক হয়ে দেখল রাহেলা সোজা এগিয়ে যাচ্ছে। মহাকাশযানের নিচে নীলাভ আলোতে যে অতিপ্রাকৃত জগৎ তৈরি হয়ে আছে সে সেদিকে হেঁটে যাচ্ছে। সেখানে তার শিশু সন্তানকে আটকে রেখেছে–সে তাকে মুক্ত করে আনতে যাচ্ছে।
নিশীতা অবাক হয়ে দেখল রাহেলার মাঝে কোনো আতঙ্ক নেই, কোনো ভয়ভীতি দুর্ভাবনা নেই। কোনো বিভ্রান্তি নেই, দুর্বলতা নেই। সে স্থির পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে! কী করতে হবে সে ব্যাপারে সে আশ্চর্যরকম নিশ্চিত, আশ্চর্যরকম আত্মবিশ্বাসী।
» ১১. দূরে রাহেলার দিকে তাকিয়ে থেকে
দূরে রাহেলার দিকে তাকিয়ে থেকে নিশীতা বলল, এখন কী হবে?
রিয়াজ বুকে আটকে থাকা নিশ্বাসটা আটকে রেখে বলল, জানি না। তবে একদিক দিয়ে ভালোই হল। কীভাবে শুরু করব সেটা নিয়ে আর সিদ্ধান্ত নিতে হল না। রাহেলাই শুরু করে দিল।
কী সিদ্ধান্ত?
ফ্রেড লিস্টার আর মহাজাগতিক প্রাণী যে কথাবার্তা বলছে তার মাঝখানে আমাদের কথা বলা।
কীভাবে করব সেটা?
দেখা যাক রিয়াজ চিন্তিত মুখে বলল, ক্যাপ্টেন মারুফ।
বলুন।
ফ্রেড লিস্টার যেই মুহূর্তে রাহেলাকে দেখতে পাবে তখন টের পাবে আমরা এখানে চলে এসেছি। কিছু একটা করতে পারে তখন। আপনি সেটা সামলাবেন।
ক্যাপ্টেন মারুফ তার ঘাড়ে ঝোলানো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাতে নিয়ে বলল, ঠিক আছে। নিশ্চিন্ত থাকেন।
চমৎকার। রিয়াজ নিশীতাকে ডাকল, নিশীতা।
কী হল?
কাছে এস, তোমার সাহায্য দরকার এখন।
আমি? আমি কী করব?
তুমি কথা বলবে।
কী কথা বলব? কার সাথে কথা বলব?
মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে।
নিশীতা অবাক হয়ে বলল, আমি কীভাবে কথা বলব? আমি তো আপনার কোডিং সম্পর্কে কিছুই জানি না।
সেজন্যই তুমি কথা বলবে। কোডিং জানা থাকলে কথা বলা যায় না, কথাগুলোতে তখন এক ধরনের পক্ষপাত এসে যায়।
নিশীতা মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু আমি কী বলব?
তোমার যা ইচ্ছে। তুমি একজন মানুষ। তোমার সামনে একটি মহাজাগতিক প্রাণী। সে কিছু ক্রিমিনালের শরীর দখল করে নিয়েছে সেই শরীর ব্যবহার করে এখানে কাজ করছে। আমার ধারণা মানুষ সম্পর্কে তার হিসাবটি ভুল। এই প্রাণী ধরে নিয়েছে সব মানুষই বুঝি কব্জি কাটা দবির–ধরে নিয়েছে যারা ক্রিমিনাল তারা সত্যিকারের মানুষ, অন্যরা দুর্বল, অন্যরা অক্ষম। তার সেই ভুল ধারণা ভেঙে দিতে হবে।
নিশীতা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি সেই ভুল ধারণা ভেঙে দেব?
হ্যাঁ। আর কেউ নেই। রিয়াজ নিশীতার দিকে একটা অত্যন্ত সংবেদনশীল মাইক্রোফোন এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও কথা বলতে ভ্রু কর। নিশীতা অবাক হয়ে রিয়াজের দিকে তাকাল, রিয়াজ অধৈর্য হয়ে বলল, দেরি কোরো না রাহেলা পৌঁছে যাচ্ছে
নিশীতা মাইক্রোফোনটি নিয়ে ইতস্তত করে বলল, মহাজাগতিক প্রাণী আমি তোমাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলছি, কিন্তু আমি জানি না তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ কি না। যদি বুঝেও থাক তার কতটুকু বুঝেছ–কীভাবে বুঝেছ। পৃথিবীর পক্ষ থেকে তোমাকে অভিবাদন জানাচ্ছি।
রিয়াজ তার হেডফোনে নিশীতার কথা শুনছিল কোডিং করার পর সে কথাটি হল, এক চার এক পাঁচ নয়, দুই ছয় পাঁচ তিন পাঁচ। আমন্ত্রণ সম আমন্ত্রণ।
নিশীতা আবার বলল, খুব দুঃখের কথা তোমার মতো বুদ্ধিমান একটা প্রাণীর সাথে আমাদের সরাসরি যোগাযোগ হল না। তুমি কব্জি কাটা দবিরের মতো একটা ক্রিমিনালকে পেয়ে ভাবলে সে পৃথিবীর মানুষের উদাহরণ। আসলে সে উদাহরণ ছিল না। পৃথিবীর সাধারণ মানুষ এত নিষ্ঠুর নয়, এত স্বার্থপর নয়, এত নীতিবিবর্জিত নয়।
রিয়াজ শুনল সেটি কোডিং করা হল, ভুল পরিচয় মানুষ।
নিশীতা বলল, তুমি কব্জি কাটা দবিরের মতো একজন একজন মানুষকে দখল করে নিলে, কী লাভ হল তাতে? পৃথিবীর সত্যিকার মানুষের সাথে তোমার পরিচয় হল না। সত্যিকার মানুষের সাথে পরিচয় হবে ভালবাসা দিয়ে। তুমি তার সুযোগ দিলে না। মানুষের সত্যিকার পরিচয় তোমার কাছে অজানা থেকে গেল।
নিশীতার কথাগুলো কোডিং হল এভাবে, দুই এক ছয় চার দুই শূন্য এক নয় আট নয় ভুল ভুল ভুল।
তুমি কেন এসেছ এখানে? পৃথিবীর মানুষের কাছে গোপন রেখে একটা ভয়ঙ্কর ত্রাস সৃষ্টি করে তোমার কী লাভ? এক বুদ্ধিমান প্রাণী অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীকে কি ভয় পেতে পারে? নাকি পাওয়া উচিত?
কোডিং হল, ভয় ঠিক নয়, কারণ নয় বোধগম্য।
নিশীতা বলল, এখানে এসে তুমি ফ্রেড লিস্টারের মতো বাজে মানুষের সাথে ব্যবসা করতে নেমে গেলে, তুমি তাকে দেবে প্রযুক্তি আর সে তোমাকে দেবে একটা মানব শিশু, এই মানব শিশু দেওয়ার অধিকার তাকে কে দিয়েছে? তার কত বড় দুঃসাহস, সে মায়ের বুক খালি করে তোমাকে একটা শিশু দিয়ে দেয়?
কোডিং করা হল, অগ্রহণযোগ্য অসম বিনিময়।
নিশীতা আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখন স্পিকারে কথা ভেসে এল, আমন্ত্রিত চুক্তিবদ্ধ আমন্ত্রিত।
নিশীতা চমকে উঠল, রিয়াজ নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, মহাজাগতিক প্রাণী কথা বলছে, সে বলছে তাকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে। তার সাথে চুক্তি করা হয়েছে।
কে তোমাকে আমন্ত্রণ করেছে? কে তোমার সাথে চুক্তি করেছে? আমরা সেই চুক্তি মানি না, বিশ্বাস করি না। পৃথিবীর মানুষকে বিপদের মাঝে ফেলে এ রকম চুক্তি করার অধিকার কারো নেই।
মহাজাগতিক প্রাণী বলল, মানুষ দুর্বল! মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত। অক্ষম। ধ্বংসযোগ্য।
নিশীতা চিৎকার করে বলল, কখনো নয়। মানুষ কখনো দুর্বল নয়, আতঙ্কগ্রস্ত নয়। অক্ষম নয়, ধ্বংসযোগ্য নয়। তুমি যে মানুষদের দেখেছ তারা ভীতু, আতঙ্কগ্রস্ত। তারা। অক্ষম। কিন্তু তার বাইরেও মানুষ আছে।
মস্তিষ্ক নিউরন সিনান্স সংযোগ আতঙ্ক ভীতি।
না। নিশীতা জোর দিয়ে বলল, মানুষ মাত্রেই আতঙ্কিত নয়। ভীত নয়।
প্রমাণ। তথ্য যুক্তি।
তুমি প্রমাণ চাও? ঠিক আছে আমি তোমাকে প্রমাণ দেব। ঐ দেখ কমলা রঙের শাড়ি পরে একজন মা তোমাদের কাছে যাচ্ছে। তার সন্তানকে তোমরা নিয়ে গেছ। সেই মা তার সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছে। তার মস্তিষ্কের মাঝে ঢুকে দেখ সে ভয় পায় কি না! আমি তোমাকে বলে দিতে পারি একজন সন্তানকে বাঁচানোর জন্য মা যখন রুখে দাঁড়ায় তার। ভিতরে কোনো ভয় থাকে না, আতঙ্ক থাকে না, কোনো দুর্বলতা থাকে না। তোমার যদি ক্ষমতা থাকে তুমি এই মাকে থামাও। তোমার সমস্ত শক্তি দিয়েও তুমি তাকে থামাতে পারবে না। তুমি তাকে ধ্বংস করে দিতে পারবে, তুমি তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারবে, তাকে হত্যা করতে পারবে কিন্তু তুমি তাকে থামাতে পারবে না। সন্তানের জন্য মায়ের বুকের ভিতরে কী ভালবাসার জন্ম হয় তুমি সেটা জান না। তোমার ভিতরে মানুষের অনুভূতি থেকে লক্ষগুণ তীব্র অনুভূতি থাকতে পারে কিন্তু তাতে কিছু আসে–যায় না। কারণ সন্তানের জন্য মায়ের তীব্র ভালবাসার কাছে তোমার সব অনুভূতি ধুয়ে মুছে যাবে। বানের জলের মতো ভেসে যাবে, ধুলোর মতো উড়ে যাবে!
রিয়াজ নিশীতার হাত স্পর্শ করে বলল, নিশীতা।
নিশীতা নিজেকে সংবরণ করে থামল, রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে, ড. হাসান?
তুমি এখন থামতে পার, নিশীতা।
কেন?
তুমি যে কথাগুলো বলেছ সেটাকে কোডিং করে মহাজাগতিক প্রাণীকে জানানো হয়েছে। মহাজাগতিক প্রাণী সেটা গ্রহণ করেছে।
নিশীতা তীক্ষ্ণ চোখে রিয়াজের দিকে তাকাল, বলল, কী গ্রহণ করেছে?
চ্যালেঞ্জ।
চ্যালেঞ্জ? কিসের চ্যালেঞ্জ? কে দিয়েছে চ্যালেঞ্জ?
তুমি দিয়েছ। রাহেলা বনাম মহাজাগতিক প্রাণী
কখন দিলাম?
এই মাত্র!
কী হবে এই চ্যালেঞ্জে?
মহাজাগতিক প্রাণী মুখোমুখি হবে রাহেলার। মানুষের শরীর ব্যবহার করে নয় সত্যি সত্যি। আসল মহাজাগতিক প্রাণী। রাহেলা যদি তাকে পরাজিত করতে পারে তা হলে আমরা বেঁচে যাব। পৃথিবীর মানুষ বেঁচে যাবে।
আর যদি না পারে?
সেটা নিয়ে দুর্ভাবনা করার কেউ থাকবে না নিশীতা।
.
রাহেলা সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে, জায়গাটা উঁচু–নিচু, মনে হয় কাটাকুটো আছে। পায়ে খোঁচা লাগছে, হয়তো কেটেকুটে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামাচ্ছে না। দূরে মাটির ওপরে কিছু একটা ভাসছে–শার্টপ্যান্ট পরে থাকা মেয়ে আর চমশা পরা। মানুষটা এটা নিয়ে খুব উত্তেজিত হয়ে আছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপার কিন্তু সে এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। জিনিসটার নিচে নীল আলো, কী বিচিত্র নীল আলো, এ রকম নীল আলো সে কখনো দেখে নি। মনে হচ্ছে জ্যোৎস্নার আলোকে কেউ নীল রং দিয়ে রং করে। দিয়েছে। নীল আলোর নিচে ঐ প্রেতগুলো আস্তে আস্তে নড়ছে। কে জানে কোথা থেকে। এসেছে এগুলো। দেখতে মানুষের মতো কিন্তু মানুষ নয়। দেখলে কী ভয় লাগে! সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে ভয়ে। ভয় আর ঘেন্না–শরীর থেকে শুড়ের মতো কী যেন বের হয়ে আসছে, সেগুলো আবার কিলবিল করে নড়ছে। তার বাচ্চাটিকে ঘিরে রেখেছে এই প্রেতগুলো, এই দানবগুলো, এই রাক্ষসগুলো। কিন্তু রাহেলা ঠিক করেছে আজকে সে ভয় পাবে না। সে ঘেন্নাও করবে না। সে কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা হেঁটে যাবে তার বাচ্চার কাছে, তাকে ধরে শক্ত করে বুকে চেপে ধরবে। তারপর আর কিছু আসে–যায় না। তাকে মেরে ফেললেও আর কিছু আসে–যায় না। মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে সে তার বাচ্চাটিকে বুকে চেপে ধরে একবার আদর করতে চায়। আর কিছুতে কিছু আসে যায় না।
রাহেলা হঠাৎ এক ধরনের শব্দ শুনতে পায়। ঝিঁঝি পোকার ডাকের মতো এক ধরনের শব্দ কিন্তু সে জানে এটা ঝিঁঝি পোকার ডাক নয়। এটা অন্য কিছু। এই শব্দের সাথে সাথে মাথায় কেমন জানি যন্ত্রণা করে ওঠে। শুধু যন্ত্রণা নয় তার মনে হয় মাথার ভিতরে কিছু একটা হচ্ছে। হঠাৎ করে রাহেলা কিছু একটা দেখতে পায়। নিঃসীম শূন্য একটা প্রান্তরের মতো একটা কিছু, তার মাঝে কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে, বিশাল কিছু আদি নেই অন্ত নেই সেরকম একটা কিছু। প্রচণ্ড আতঙ্কে রাহেলার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে। মনে হয় অচেতন হয়ে পড়বে সে।
কিন্তু না, তাকে অচেতন হলে চলবে না। তাকে জেগে থাকতে হবে, যেভাবেই হোক তাকে জেগে থাকতে হবে। তাকে ভয় পেলেও চলবে না, পৃথিবীর সব ভয়কে এখন তার বুকের ভিতর থেকে ঠেলে সরিয়ে দিতে হবে। কাউকে সে ভয় পাবে না–সে যতক্ষণ তার সোনামণিকে বুকে চেপে না ধরবে ততক্ষণ সে পৃথিবীর কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করবে না।
রাহেলা জোর করে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখল—ঐ তো দেখা যাচ্ছে তার শিশু সন্তানকে, শুয়ে শুয়ে হাত পা নাড়ছে, কাঁদছে অসহায়ের মতো। রাহেলা আবার ছুটে যেতে থাকে।
মাথার ভিতরে আবার একটা ভোঁতা যন্ত্রণা হয় কিছু একটা ঘটে যায় মাথার ভিতরে, জ্বর হলে যেরকম বিকার হয় ঠিক সেরকম লাগুর্তিার। মনে হয় জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে সে, কেউ একজন তাকে ভয় দেখাচ্ছে। কে বলছে ফিরে যেতে। বলছে ফিরে না গেলে তাকে খুন করে ফেলবে, তাকে পুড়িয়ে ফেলবে, তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে। তাকে ধ্বংস করে ফেলবে। রাহেলার হাসি পেক উঠাৎ সে কি মৃত্যুকে ভয় পায়? তাকে ধ্বংস করতে চাইলে করুক। তার যাদুমণিকে, সোনামণিকে বুকে চেপে ধরতে না পারলে সে কি বেঁচে থাকতে চায়? বেঁচে থেকে কী হবে তা হলে?
রাহেলা টলতে টলতে হাঁটতে থাকে। মাথা থেকে কিলবিলে শুড় বের হয়ে আসা দানবগুলো তাকে ঘিরে ধরতে চেষ্টা করছে কিন্তু রাহেলা আজকে থামবে না। আজকে কেউ তাকে থামাতে পারবে না। রাহেলা ছুটতে শুরু করে। কিলবিলে একটা গঁড় দিয়ে তাকে ধরে ফেলে একটা দানব, কী ভয়ঙ্কর শীতল পিচ্ছিল সেই অনুভূতি, রাহেলার সমস্ত শরীর ঘিনঘিন করে ওঠে। চিৎকার করে ঝটকা মেরে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। সাথে সাথে আরেকটি দানব তাকে জাপটে ধরে। প্রাণপণে নিজেকে মুক্ত করে নেয়, পিছন থেকে দানবগুলো ছুটে আসছে, তাকে ধরে ফেলছে। চিৎকার করতে করতে ছুটে যায় রাহেলা, পা বেঁধে পড়ে যায় হঠাৎ দানবগুলোর হাত থেকে বিদ্যুতের ঝলক বের হয়ে আসছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় থরথর করে কাঁপতে থাকে, চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসতে চায়, ভারী একটা লাল পরদা নেমে আসছে চোখের সামনে, নিশ্বাস নিতে পারছে না রাহেলা, মনে হচ্ছে বুকের ওপর কিছু একটা চেপে বসছে পাথরের মতো। রাহেলা বুঝতে পারে সে মরে যাচ্ছে, তাকে মেরে ফেলছে সবাই।
কিন্তু সে মরবে না, তার সোনামণিকে স্পর্শ না করে সে কিছুতেই মরবে না। হাতে ভর দিয়ে নিজেকে টেনে নিতে থাকে, বিদ্যুতের ঝলকানিতে থরথর করে কেঁপে কেঁপে সে এগুতে থাকে। তীক্ষ্ণ কিছু দিয়ে তাকে গেঁথে ফেলছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার শরীর। মুখ দিয়ে দমকে দমকে কাঁচা রক্ত বের হয়ে এল রাহেলার, কিন্তু সে তবু থামল না। নিজেকে টেনে টেনে নিতে থাকল সামনে, এই তো আর মাত্র কয়েক ফুট।
প্রচণ্ড আঘাতে রাহেলা ছিটকে পড়ল, ভয়ঙ্কর আক্রোশে কেউ তাকে আঘাত করেছে, মনে হচ্ছে তার সমস্ত শরীর বুঝি ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে যাচ্ছে। কিছু আসে–যায় না তাতে তার। শরীরের একটা ক্ষুদ্র অংশও যদি বেঁচে থাকে সেটিই এগিয়ে যাবে, স্পর্শ করবে তার সোনামণিকে, তার যাদুকে, তার বুকের ধনকে।
রাহেলা মাটি কামড়ে কামড়ে এগিয়ে গেল, চোখ খুলে দেখতে পেল ভয়ঙ্কর একটি শক্তি, বিচিত্র একটা প্রাণী তাকে থামিয়ে দিতে চাইছে, তাকে শেষ করে দিতে চাইছে কিন্তু পারছে না, কর্কশ শব্দে কান ফেটে যাচ্ছে রাহেলার, মনে হচ্ছে সমস্ত শরীরে কেউ গরম সীসা ঢেলে দিয়েছে, মনে হচ্ছে তার শরীরকে কেউ মাটির সাথে গেঁথে ফেলছে।
তার মাঝেও সে এগিয়ে গেল, বিন্দু বিন্দু করে এগিয়ে গেল। পৃথিবীর সকল শক্তি, মহাজাগতিক প্রাণীর সমস্ত শক্তি তুচ্ছ করে সে এগিয়ে গেল, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে সে এগিয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে সে তার হারিয়ে যাওয়া ছিনিয়ে নেওয়া সন্তানকে জাপটে ধরল।
সাথে সাথে মনে হল তার শরীরের মাঝে হঠাৎ মত্ত হাতির বল এসেছে। পৃথিবীর সব কোলাহল, সব ধ্বনি হঠাৎ করে নীরব হয়ে যায়। হঠাৎ করে সব যন্ত্রণা সব কষ্ট মিলিয়ে যায়। সব অশুভ শক্তি হঠাৎ করে দূরে সরে যায়। রাহেলা গভীর ভালবাসায় তার হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে বুকে টেনে নেয়, গভীর মমতার বুকের মাঝে চেপে ধরে। চারপাশের জগৎ হঠাৎ করে দুলে ওঠে। অশরীরী দানবের মতো মূর্তি, মাথার উপরে বিচিত্র মহাকাশযান, অতিপ্রাকৃত নীল আলো, কোনো কিছুকেই আর সত্যি মনে হয় না, সবকিছু যেন স্বপ্ন। সবকিছুই যেন অর্থহীন। কিন্তু তাতে কিছু আসে-যায় না। রাহেলা জানে সে আছে এবং তার বুকের মাঝে আছে তার সন্তান। পৃথিবীর কোনো শক্তি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো শক্তি তাকে নিতে পারবে না। বুকের মাঝে এক গভীর প্রশান্তি নিয়ে রাহেলা জ্ঞান হারাল।
.
নিশীতা আর রিয়াজ নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে ছিল, তারা এবার একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, রিয়াজ নিশীতার হাত স্পর্শ করে বলল, আমরা বেঁচে গেলাম নিশীত।
নিশীতা বুকের ভিতর আটকে থাকা নিশ্বাসটি বের করে দিয়ে বলল, এখন কী হবে?
আমার ধারণা মহাকাশযানটি চলে যাবে।
চলে যাবে?
হ্যাঁ।
রিয়াজের কথা শেষ হবার আগেই মহাকাশযানটি কাঁপতে শুরু করে, অত্যন্ত উচ্চ কম্পনের একটা শব্দ শোনা যায়, নীল আলোটিও হঠাৎ তীব্র হয়ে ওঠে। নিশীতা আর রিয়াজ দেখতে পেল মহাকাশযানটি ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করেছে, উপরে উঠতে উঠতে সেটি কয়েক শ মিটার উপরে উঠে গেল, তারপর হঠাৎ কানে তালা লাগানো শব্দ করে মহাকাশযানটি আকাশ চিরে উড়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য আকাশে একটা নীল আলোর রেখা দেখা গেল, তারপর আর কোথাও কিছু নেই। পৃথিবীর বুক থেকে মহাকাশযানটি চিরদিনের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেছে।
একটু আগে যেখানে নীল আলো ছিল এখন সেখানে গাঢ় অন্ধকার, সেখানে রাহেলা তার সন্তানকে বুকে চেপে ধরে শুয়ে আছে। তাকে ঘিরে কিছু অপ্রকৃতিস্থ মূর্তি। মহাকাশযান আর মহাজাগতিক প্রাণী চলে যাবার পর সেগুলো এখন কী করছে কে জানে!
রিয়াজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল নিশীতা। রাহেলার কাছে যেতে হবে।
চলুন।
ফ্রেড লিস্টার? ফ্রেন্ড লিস্টার কী করবে এখন?
জানি না। মনে হয় মাথা কুটছে।
কিন্তু ওকে ধরতে হবে না?
ক্যাপ্টেন মারুফ ধরবে। মনে নেই সে কী রকম টাইকোয়ান্ডো জানে! থার্ড ডিগ্রি ব্ল্যাক বেল্ট।
ঝোঁপঝাড় কাদা জলা মাটি ভেঙে ওরা সামনে যেতে যেতে হঠাৎ করে প্রেতের মতো মানুষগুলোর একটার মুখোমুখি হল। এর আগে যারা বর্ণনা দিয়েছিল সবাই বলেছে–চোখ দুটো থেকে অন্ধকারের মাঝে লাল আলোর মতো জ্বলতে থাকে, দূরে বসে তারাও দেখেছে, কিন্তু এখন সেই আলো নেই। পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ইতস্তত হাঁটছে, তাদের দেখতে পেল বলে মনে হল না, পাশে একটা গাছে ধাক্কা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল, একবার ওঠার চেষ্টা করল কিন্তু উঠতে পারল না। একটা পা অত্যন্ত বিচিত্র ভঙ্গিতে নড়তে থাকল, মনে হতে লাগল শরীরের সাথে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
রিয়াজ অকারণেই গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, এই জম্বিগুলো শেষ হয়ে গেছে, এখন আর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।।
এদের শরীরের ভিতরে ইঁদুরের মতো কী যেন থাকে।
এখন আছে কি না জানি না। থাকলেও আর ভয় নেই।
দুজনে পড়ে থাকা মানুষটিকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায়, আশপাশে আরো কিছু মূর্তি ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ কেউ পড়ে গিয়েছে, কেউ কেউ গাছপালায় আটকে গিয়েছে, কেউ কেউ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় এক জায়গায় ঘুরছে। মানুষের মতো এই প্রাণীগুলোর আচরণে এমন একটি অস্বাভাবিকতা রয়েছে যে দেখলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। প্রাণীগুলোকে সাবধানে পাশ কাটিয়ে তারা রাহেলার কাছে ছুটে গেল।
রাহেলা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে, শরীরে মুখে ছোপ ছোপ রক্ত। অচেতন হয়েও সে হাত দিয়ে পরম আত্মবিশ্বাসে তার সন্তানকে জড়িয়ে রেখেছে। সন্তানটিও পরম নির্ভাবনায় তার মায়ের বুকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। নিশীতা নিচু হয়ে রাহেলার বুক থেকে সাবধানে শিশুটিকে তুলে নেয়, পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরে, শিশুটি ক্ষুধার্ত, মুখ নেড়ে বৃথাই খাওয়ার চেষ্টা করতে করতে তারস্বরে কেঁদে উঠল।
রিয়াজ নিচু হয়ে রাহেলাকে একটু পরীক্ষা করল, বলল, আমাদের এখনই মেডিক্যাল হেল্প দরকার।
নিশীতা বলল, আমি রাহেলার সাথে আছি, আপনি দেখুন কিছু করা যায় কি না।
নিশীতার কথা শেষ হবার আগেই দেখা গেল কেউ একজন টর্চ লাইটের আলো ফেলে ছুটে ছুটে আসছে, কাছে এলে দেখা গেল মানুষটি ক্যাপ্টেন মারুফ। কপালের কাছে কেটে গেছে, সেখান থেকে রক্ত ঝরছে। রিয়াজ উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কী হয়েছে আপনার?
ও কিছু না। একজন মিলে চার-পাঁচজনকে ধরতে গেলে ওরকমই হয়।
চার-পাঁচজনকে ধরেছেন?
হ্যাঁ। বেঁধেছেদে রাখতে সময় লাগল। এক বদমাইশের কাছে আবার আর্মস ছিল, তাকে কাবু করতে গিয়ে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।
কী রকম বাড়াবাড়ি?
মনে হয় ব্যাটার নাকের হাড়টা ভেঙে গেছে। পাঁজরের হাড়ও যেতে পারে দুই-একটা।
নিশীতা অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন মারুফের দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, আপনি একা ঐ মোষের মতো এতগুলো মানুষকে কাবু করেছেন?
আর কাকে পাব! একাই তো করতে হবে।
কীভাবে করলেন আপনি?
রিয়াজ সাহেব যখন আমাকে বললেন আপনাদের প্রকেটশন দিতে তখনই বুঝেছিলাম কাজটা সহজ হবে না। আমাদের মিলিটারি লাইনে একটা কথা আছে যে, অফেন্স ইজ বেস্ট ডিফেন্স। তাই আমি আর দেরি করি নি, পিছন থেকে গিয়ে সবগুলোকে আটক করেছি। খুব কপাল ভালো গুলি করতে হয় নি। দরকার হলে করতাম!
রিয়াজ রাহেলার দিকে তাকিয়ে বলল, রাহেলার মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্স দরকার। এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে।
ক্যাপ্টেন মারুফ চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, বদমাইশগুলোর হেলিকপ্টারটা আছে। পাইলটকে একটু ধোলাই দিতে হয়েছে কিন্তু মনে হয় হেলিকপ্টারটা নিয়ে যেতে পারবে। আমি সাথে থাকব, মাথায় একটা রিভলবার ধরে রাখব–
নিশীতা বলল, মনে হয় তার দরকার হবে না।
কেন?
ঐ দেখেন।
রিয়াজ এবং ক্যাপ্টেন মারুফ তাকিয়ে দেখল, বহুদূর থেকে মশাল জ্বালিয়ে শত শত গ্রামবাসী ছুটে আসছে। হেডলাইট দেখে মনে হয় পিছনে দুই–একটা গাড়িও আসছে। নিশীতা কান পেতে শুনল হেলিকপ্টারের শব্দও শোনা যাচ্ছে। কাঁদের হেলিকপ্টার কে জানে, কিন্তু এখন আর কিছু আসে–যায় না। কিছুক্ষণের মাঝেই এখানে এই এলাকার শত শত মানুষ চলে আসবে। কেউ তখন আর কিছু করতে পারবে না।
১২. নিশীতা ঘর থেকে বের হতেই
নিশীতা ঘর থেকে বের হতেই আম্মা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন কিন্তু কিছু বললেন না। নিশীতা ভান করল সে তার মায়ের চোখের বিস্ময়টুকু লক্ষ করে নি। খুব সহজ গলায় বলল, আম্মা আমি রাত দশটার মাঝে চলে আসব। আম্মা মুখ টিপে হাসলেন, বললেন, ঠিক আছে। তোর ট্যাক্সি এসেছে?
নিশীতা আবার ভান করল সে মায়ের হাসিটি লক্ষ করে নি; বলল, এসেছে আম্মা?
বাসা থেকে বের হয়ে সে তার মোটর সাইকেলটার দিকে তাকাল, আজকে সে এটাতে উঠবে না। অনেকদিন পর আজকে সে খুব যত্ন করে সেজেছে। রুপালি পাড়ের একটা নীল শাড়ি পরেছে, গলায় নীল পাথর দেওয়া রুপার চোকার, হাতে নীল আর সাদা কাচের চুড়ি, কানে নীল পাথরের দুল। এমনিতেই সে দীর্ঘাঙ্গী, আজ সাদা স্ট্র্যাপের পেন্সিল হিল এক জোড়া স্যান্ডেল পরেছে বলে আরো লম্বা দেখাচ্ছে। রোদে ঘুরে ঘুরে তার ত্বকের একটা রোদে পোড়া সজীবতা আছে, আজ প্রসাধন করে সেটা আড়াল করে কপালে নীল একটা টিপ দিয়েছে। তার চুল খুব লম্বা নয় আজকে সেটাকে ফুলে–ফেঁপে বেঁধে দিয়েছে, একটা বেলি ফুলের মালা পেলে সেটা দিয়ে অবাধ্য চুলগুলোকে শাসন করা যেত। ঘর থেকে বের হবার সময় আয়নায় নিজের চেহারা দেখে সে নিজেই অবাক হয়ে গেছে, কে জানে তাকে হয়তো সুন্দরী বলেই চালিয়ে দেওয়া যায়।
ক্যাপ্টেন মারুফ আর তার স্ত্রী বনানীতে একটা থাই রেস্টুরেন্টে নিশীতা আর রিয়াজকে খেতে ডেকেছে। রিয়াজ হাসান ঢাকার রাস্তাঘাট ভালো চেনে না, নিশীতা বলেছে তাকে বাসা থেকে তুলে নেবে। নিশীতা ট্যাক্সিতে উঠে রিয়াজের বাসার ঠিকানা দিতেই ট্যাক্সির ডাইভার ট্যাক্সি ছেড়ে দেয়।
রিয়াজ নিশীতাকে দেখে এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে। রইল। নিশীতা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, কী হল আপনার?
তোমাকে অপরিচিত একজন মহিলার মতো দেখাচ্ছে!
আপনাকে বলেছিলাম একদিন শাড়ি পরে দেখিয়ে দেব–তাই দেখিয়ে দিচ্ছি!
হ্যাঁ, শাড়িটি একটি অপূর্ব পোশাক। একজন মেয়ে যখন শাড়ি পরে তখন তাকে যে কী চমৎকার দেখায়!
নিশীতা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি না হয়ে অন্য যে কোনো মেয়ে হলে আপনার এই কথায় একটা ভিন্ন অর্থ বের করে আপনার বারোটা বাজিয়ে দিত।
ভিন্ন অর্থ? রিয়াজ একটু অবাক হয়ে বলল, কী ভিন্ন অর্থ?
যে আমাকে যখন সুন্দর দেখায় তার কৃতিত্বটা আমার নয়–কৃতিত্বটা শাড়ির!
রিয়াজ হেসে বলল, অন্য কোনো মেয়ে হলে আমি কি এ ধরনের কোনো কথা বলতাম? তুমি বলেই করেছি।
কেন?
কারণ গত কয়েকদিন তুমি আর আমি যার ভিতর দিয়ে গিয়েছি যে পৃথিবীর খুব বেশি মানুষ তার ভিতর দিয়ে যায় না। তখন তোমাকে যেটুকু দেখেছি, মনে হয়েছে তুমি খুব চমৎকার একটা মেয়ে।
থ্যাংক ইউ।
রিয়াজ একটা নিশ্বাস ফেলে অনেকটা স্বগতোক্তির মতো করে দ্বিতীয়বার বলল, খুব চমৎকার একটা মেয়ে!
নিশীতা দ্বিতীয়বার থ্যাংক ইউ বলবে কি না ভাবছিল কিন্তু তার আগেই টেবিলের ওপর থেকে এপসিলন কর্কশ গলায় বলল, কে? কে এসেছে?
নিশীতা বলল, আমি।
আমি কে?
আমি নিশীতা।
তুমি কেন নিজেকে নিশীতা বলে দাবি করছ? আমার ডাটাবেসে নিশীতার যে তথ্য আছে তার সাথে তোমার মিল নেই কেন?
কারণ আমি শার্ট-প্যান্ট না পরে আজকে শাড়ি পরেছি।
কেন তুমি শাড়ি পরেছ?
নিশীতা একটা নিশ্বাস ফেলল, মহাজাগতিক প্রাণীটি চলে যাবার পর এপসিলনকে ব্যবহার করে দ্বিতীয় মহাজাগতিক প্রাণীটি আর তার সাথে যোগাযোগ করে নি। প্রাণীটিকে ঠিকভাবে বিদায়ও দেওয়া হয় নি। কোথায় আছে এখন কে জানে। কেমন আছে সেটাই-বা কে জানে।
এপসিলন আবার কর্কশ গলায় বলল, কী হল তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ না কেন?
রিয়াজ বলল, অনেক হয়েছে এপসিলন। তুমি এবারে থাম।
কেন আমি থামব?
কারণ আমরা কথা বলছিলাম।
তোমরা কি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে কথা বলছিলে?
রিয়াজ বিরক্ত হয়ে বলল, আমরা কী নিয়ে কথা বলছি তাতে তোমার কী আসে-যায়?
তুমি কি নিশীতাকে বলেছ যে সে চমৎকার মেয়ে?
রিয়াজ থতমত খেয়ে বলল, হ্যাঁ বলেছি।
তুমি কি বলেছ নিশীতা সুন্দরী মেয়ে?
হ্যাঁ বলেছি।
তার মানে কি তুমি নিশীতাকে ভালবাস?
রিয়াজ বিস্ফারিত চোখে একবার নিশীতার দিকে আর একবার এপসিলনের দিকে তাকাল।
এপসিলন চোখ টিপে বলল, তুমি কি নিশীতকে বিয়ে করতে চাও?
রিয়াজ হতচকিত হয়ে কী করবে বুঝতে বা পরে এপসিলনের কাছাকাছি গিয়ে হ্যাঁচকা টান দিয়ে পাওয়ার কর্ডটা খুলে ফেলতেই এপসিলন একটা আর্তচিৎকারের মতো শব্দ করে মিলিয়ে গেল।
রিয়াজ অপরাধীর মতো নিশীতার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি–আমি খুবই দুঃখিত নিশীতা, খুবই লজ্জিত।
নিশীতা হঠাৎ করে নিজেকে সামলাতে না পেরে শাড়ির আঁচল মুখে দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল, কিছুতেই সে আর তার হাসি থামাতে পারে না। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল, শাড়ির আঁচলে ঠোঁটের লিপস্টিলেগে চোখের পানিতে তার চোখের নীল রং ভিজে মাখামাখি হয়ে গেল।
রিয়াজ খানিকক্ষণ নিশীতার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কিছু মনে কর নি তো নিশীতা?
নিশীতা হাসতে হাসতে কোনোমতে বলল, না, আমি কিছু মনে করি নি।
রিয়াজ নিশীতার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বলল, নিশীতা–মানে আমি বলছিলাম কী–এপসিলন ব্যাটা গর্দভ–কিন্তু সে যেটা বলেছে–
নিশীতা হঠাৎ করে তার হাসি থামিয়ে রিয়াজের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাল।
রিয়াজ বলল, আমি জানি এটা খুবই তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তুমি আমাকে চেন না, আমার সম্পর্কে কিছুই জান না। আমিও তোমাকে চিনি মাত্র কয়েকদিন, যদিও আমার মনে হচ্ছে তোমাকে আমি অনেকদিন থেকে চিনি। তাই আমি বলছিলাম কী
নিশীতা স্থির চোখে রিয়াজের দিকে তাকিয়ে রইল। নিশীতাকে এর আগেও যে
এক–দুজন তার মনের কথা বলার চেষ্টা করে নি তা নয়, কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ব্যাপার।
তাই আমি বলছিলাম কী– রিয়াজ ইতস্তত করে বলল, আমি ঠিক জানি না এসব কথা কীভাবে বলতে হয়। ব্যাটা গর্দভ এপসিলন অবশ্য বলেই দিয়েছে, সেই ব্যাটা একেবারে না বুঝে বলেছে, কিন্তু যে কথাটি বলেছে সেটি আমিও বলতে চাইছিলাম। এত তাড়াতাড়ি না হলেও বলতাম। মানে–
নিশীতা বড় বড় চোখে রিয়াজের দিকে তাকিয়ে রইল। রিয়াজ তার অপ্রস্তুত ভাবটা ঝেড়ে ফেলে বলল, তোমার এখনই কিছু বলার প্রয়োজন নেই নিশীতা। তুমি এটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে পার।
নিশীতা কিছুক্ষণ রিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল, আসলে আমি আবার খুব বেশি ভাবনাচিন্তা করতে পারি না।
পার না?
না। নিশীতা মুখ টিপে হেসে বলল, কাজেই আমি কী করব জানেন?
কী?
আপনার এপসিলনকেই আমার জন্য চিন্তাভাবনা করতে দেব!
রিয়াজ উৎফুল্ল মুখে বলল, চমৎকার! উত্তরটা কী হবে আমি কিন্তু সেটা প্রোগ্রাম করে দেব!
আমি জানি। নিশীতা চোখ নামিয়ে বলল, আমার সেটা নিয়ে খুব দুর্ভাবনা নেই।
.
নিশীতাকে ক্যাপ্টেন মারুফ আর তার স্ত্রী বাসায় নামিয়ে দিল রাত এগারটায়। নিশীতা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে নিজের ঘরে যাচ্ছিল, আম্মা তাকে থামালেন, জিজ্ঞেস করলেন, কী হল, আজ তোর মনে খুব আনন্দ মনে হচ্ছে।
নিশীতা থতমত খেয়ে হঠাৎ করে হেসে ফেলল, বলল, হ্যাঁ মা।
কেন?
কারণ ফ্রেন্ড লিস্টার আর তার দলবলকে আচ্ছামতন শিক্ষা দেওয়া গেছে। প্রজেক্ট নেবুলার সব তথ্য বের করার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন হয়েছে। মহাজাগতিক প্রাণীর তৈরি করা মানুষের দেহগুলো সারা পৃথিবীর বড় বড় ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হচ্ছে। রাহেলা ভালো হয়ে যাচ্ছে, তার বাচ্চাটি দুধ খেয়ে পেটটাকে ছোট একটা ঢোলের মতো করে ফেলছে। ক্যাপ্টেন মারুফকে তার কাজের জন্য একটা বড় খেতাব দেবে। আমি শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক হিসেবে পুরস্কার পাব। রিয়াজ–মানে ড. হাসান ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেবে। একদিন এতগুলো ভালো সংবাদ শুনলে মনে আনন্দ হয় না!
হয়। আম্মা হেসে বললেন, কিন্তু তোর মনে তো তার চাইতেও বেশি আনন্দ!
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। আমি তোর মা। তোর আব্বুর সাথে যেদিন আমার প্রথম দেখা হয়েছিল আমি সেদিন এ রকম গুনগুন করে গান গেয়ে ঘরে এসেছিলাম।
নিশীতা কিছুক্ষণ তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে কাছে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল।
.
গভীর রাতে নিশীতার সেলুলার ফোনটি বেজে উঠল। ঘুমের মাঝে হাতড়ে হাতড়ে নিশীতা সেলুলার ফোনটি তুলে নেয়, ঘুম ঘুম গলায় বলল, হ্যালো।
কে, নিশীতা?
নিশীতা চমকে উঠল, এটি এপসিলনের গলার স্বর। কে?
আমি।
তুমি? তুমি কোথায়?
আমি এখানে-ওখানে সব জায়গায়।
আমি ভেবেছিলাম তুমি চলে গেছ।
না যাই নি। আমি এখন যাব তাই তোমার কাছে বিদায় নিতে এসেছি।
তুমি কে, তুমি কেমন কিছুই জানতে পারলাম না।
তার কোনো প্রয়োজন আছে? কেউ কখনো সবকিছু জানতে পারে?
নিশীতা ব্যাকুল গলায় বলল, কিন্তু আমি তোমাকে কখনো ধন্যবাদ জানাতে পারলাম না। আমার কৃতজ্ঞতার কথাটুকুও বলতে পারলাম না।
তার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ ভালবাসাটা কী আমি তোমার কাছেই শিখেছি। আমি সব জানি নিশীতা। কণ্ঠস্বর এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তুমি জানালার কাছে এসে দাঁড়াও।
নিশীতা জানালার কাছে দাঁড়াল।
বিদায়।
বিদায়।
ঠিক সেই মুহূর্তে সমস্ত আকাশ চিরে একটা নীল আলো ঝলসে উঠল। সেই আলো এই পৃথিবী থেকে শুরু করে দূর গ্যালাক্সি পার হয়ে মহাকালের মাঝে হারিয়ে গেল।
.
নিশীতা স্তব্ধ হয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।