- বইয়ের নামঃ প্রজেক্ট নেবুলা
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ জ্ঞানকোষ প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. সন্ধে থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি
প্রজেক্ট নেবুলা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
সন্ধে থেকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল, হঠাৎ করে বৃষ্টিটা চেপে এল। জব্বার নিচু গলায় একটা অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করে উইন্ডশিল্ড ওয়াইপারটা আরেকটু দ্রুত করে দেয়। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে ওয়াইপার দুটো গাড়ির কাচ পরিষ্কার করতে থাকে কিন্তু অন্ধকার দুর্যোগময় রাতে সেটা খুব কাজে আসে না, গাড়ির হেডলাইট মনে হয় সামনের অন্ধকারকে আরো জমাট বাঁধিয়ে দিচ্ছে। রাস্তার অন্যদিক থেকে দৈত্যের মতো একটা ট্রাক চোখ ধাঁধানো। হেডলাইট জ্বালিয়ে প্রচণ্ড গর্জন করে বিপজ্জনকভাবে পাশ কাটিয়ে গেল–পানির ঝাঁপটায় গাড়ির কাচ মুহূর্তের জন্য অন্ধকার হয়ে যায়, প্যাসেঞ্জার সিটে বসে থাকা দবির কব্জির কাছে কাটা হাতটি সামনে এগিয়ে অদৃশ্য কিছু একটা ধরে ফেলার ভঙ্গি করে বিরক্ত হয়ে বলল, আস্তে, জব্বার আস্তে।
জব্বার অন্ধকারে দেখা যায় না এরকম একটা রিকশা ভ্যানকে পাশ কাটিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল, ভয় পাবেন না ওস্তাদ। আমি কালা জব্বার।
দবির শীতল গলায় বলল, সেইটাই ভয়।
কেন ওস্তাদ। এইটা কেন বললেন?
বলছি কারণ তোর কোনো কাণ্ডজ্ঞান নাই।
জব্বার আড়চোখে দবিরের মুখটা দেখার চেষ্টা করে বোঝার চেষ্টা করল দবির এটা ঠাট্টা করে বলেছে কি না। অন্ধকারে দবিরের মুখ দেখা যাচ্ছিল না তাই সে ঠিক বুঝতে পারল না। তবুও সে কথাটাকে একটা হালকা রসিকতা হিসেবে ধরে নিয়ে প্রয়োজন থেকে জোরে শব্দ করে হেসে বলল, ওস্তাদ, আমার হাতে স্টিয়ারিং হুইল কখনো বেইমানি করে নাই।
দবির দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তা হলে কোনটা বেইমানি করেছে?
জব্বার ভিতরে ভিতরে চমকে ওঠে, হঠাৎ করে ভয়ের একটা শীতল স্রোত তার মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যায়। প্যাসেঞ্জার সিটে বসে থাকা ছোটখাটো এই মানুষটি–যার বাম হাতটি কব্জি থেকে কাটা, শহরতলি এলাকায় কব্জি কাটা দবির নামে কুখ্যাত, মানুষটির নিষ্ঠুরতার কথা অপরাধীদের অন্ধকার জগতে সুপরিচিত। অন্ধকার জগতে টিকে থাকার একেবারে আদিম পন্থাটি মাত্র কয়েক বছরে কব্জি কাটা দবিরকে তার সাম্রাজ্যের অলিখিত সম্রাটে পরিণত করে ফেলেছে–দবির তার প্রতিপক্ষকে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ দেয় না। জব্বার দবিরের প্রতিপক্ষ নয়, তার বিশ্বস্ত অনুচর কিন্তু সেই বিশ্বস্ততার হিসাবটুকু দবিরের কাছে যথেষ্ট কি না সে ব্যাপারে জব্বার পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। জব্বার শুকনো গলায় বলল, কী বললেন ওস্তাদ?
কিছু বলি নাই।
জব্বার আর কোনো কথা বলল না, কব্জি কাটা দবিরকে ঘাঁটানোর মতো দুঃসাহস তার নেই। সামনে থেকে ছুটে আসা আরেকটা ভয়ঙ্কর ট্রাককে পাশ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করল, আর কত দূর যাবেন ওস্তাদ?
দবির অনিশ্চিতের মতো হাত নেড়ে তার ভালো হাতটি দিয়ে সিটের নিচে থেকে একটা চ্যাপটা বোতল বের করে দাঁত দিয়ে কামড়ে তার ছিপিটা খুলে ফেলল। প্রায় আধযুগ আগে ঘরে বানানো বোমার বিস্ফোরণে বাম হাতটি উড়ে যাবার পর থেকে সব কাজই তার এক হাতেই করতে হয়। এক হাতে সব কাজ সে এত নৈপুণ্যের সাথে করতে পারে যে কব্জি কাটা দবিরকে দেখলে মনে হতে পারে মানুষের দ্বিতীয় হাতটি একটি বাহুল্য।
দবির বোতল থেকে ঢকঢক করে খানিকটা হুইস্কি গলায় ঢেলে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছে বোতলটা জব্বারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে।
জব্বার নিজের ভিতরে এক ধরনের তৃষ্ণা অনুভব করল কিন্তু সে বোতলটা ধরল না। মাথা নেড়ে বলল, এখন খাব না ওস্তাদ।
দবির ভুরু কুঁচকে জব্বারের দিকে তাকাল, জম্বার তাড়াতাড়ি অনেকটা কৈফিয়ত দেওয়ার মতো বলল, গাড়ির টায়ার স্লিপ কাটছে, এখন মাল খাব না ওস্তাদ। মাল খেলে গাড়ি চালাতে পারব না।
দবির মুখ শক্ত করে বলল, তোকে নেশা করতেকে বলেছে? খা। এক ঢোক খা।
গলায় আপ্যায়নের সুর নেই, এটি রীতিমত আদেশ। কাজেই জব্বার এক হাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে অন্য হাতে বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে গলায় খানিকটা তরল ঢেলে দেয়। বোতলটি ফিরিয়ে দিতে গিয়ে আবিষ্কার করল দবির জানালা দিয়ে চিন্তিত মুখে বাইরে তাকিয়ে আছে। জব্বার আবার এক ধরনের ভীতি অনুভব করে, কারণটি জানা নেই বলে ভীতিটিকে তার কাছে অশুভ বলে মনে হতে থাকে।
আরো মিনিট পনের নিঃশব্দে গাড়ি চালানোর পর হঠাৎ করে বৃষ্টিটা একটু ধরে এল, দবির জানালা পুরোপুরি নামিয়ে দিতেই গাড়ির ভিতরে বাতাসের ঝাঁপটা এসে ঢুকল। অনেক রাত, রাস্তায় গাড়ি খুব বেশি নেই, রাতের ট্রাকগুলো হঠাৎ করে সশব্দে ছুটে যাচ্ছে। রাস্তার দুই পাশে নিচু জমিতে পানি জমেছে, দেখে মনে হয় সুবিশাল হ্রদ। রাতের অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছে না, দিনের বেলা পুরো এলাকাটিকে খুব মনোরম মনে হয়, শহরের অবস্থাপন্ন মানুষেরা গাড়ি করে এখানে বেড়াতে আসে।
দবির গাড়ির ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে বলল, গাড়িটা থামা।
অজানা আশঙ্কায় আবারের বুক কেঁপে ওঠে। সে শুকনো গলায় বলল, থামাব?
হ্যাঁ।
অন্ধকার রাতে এই নির্জন জায়গায় কেন রাস্তার পাশে গাড়ি থামাবে–জব্বার বুঝতে পারল না, কিন্তু তার কারণটি জানার সাহস হল না। সে তবুও দুর্বল গলায় বলল, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।