জিগি হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, কষ্ট খুব আপেক্ষিক ব্যাপার। সন্তান জন্ম দিতে মায়েদের কী রকম কষ্ট হয় জান? সেজন্যে কখনো শুনেছ কোনো মা সন্তান জন্ম দেয় নি?
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে খানিকটা নিয়ন্ত্রণের মাঝে আনার চেষ্টা করে বললাম, আমাকে এখন খানিকটা বিশ্রাম নিতে দাও আমি সোজাসুজি চিন্তাও করতে পারছি না।
জিগি মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ। তোমার এখন বিশ্রাম নেওয়া দরকার।
আমি কোনোমতে বিছানায় এসে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম এবং প্রায় সাথে সাথেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাম।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি জিগি তার যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছে। আমাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে সে চতুষ্কোণ একটা যন্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বলল, এই যে তৈরি করে ফেলেছি।
কী তৈরি করেছ?
নেটওয়ার্ক কেন্দ্রের দরজা খোলার জন্যে পাসওয়ার্ড বের করার ইন্টারফেস।
ব্যাপারটি কীভাবে কাজ করছে সেটা জানার সেই মুহূর্তে আমার কোনো কৌতূহল ছিল কিন্তু জিগি সেটা লক্ষ করল না। গলায় বাড়তি উৎসাহ নিয়ে বলল, আমি পিঠে ব্যাকপেকের মাঝে রাখব পাওয়ার সাপ্লাই আর ডিকোডার। সেখান থেকে একটা কেবল যাবে দরজায়–তুমি থাকবে আমার পাশে তোমার মাথা থেকে সকেট হয়ে আসবে। ডিকোডারে
আমার মাথা থেকে?
হ্যাঁ। তোমার মাথাকে নিউরাল কম্পিউটার হিসেবে ব্যবহার না করলে পাসওয়ার্ড বের করব কেমন করে?
আমি কোনো কথা না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সম্পূর্ণ গোপন একটা পাসওয়ার্ড কয়েক মিনিটের মাঝে খুঁজে বের করতে হলে মানুষের মস্তিষ্কের মতো কিছু একটা প্রয়োজন, সেটাই অস্বীকার করি কী করে?
আমরা আমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে সকালবেলাতেই রওনা দিয়ে দিলাম। একটা বাইভার্বালে করে যেতে পারলে ভালো হত, কিন্তু জিগি বলল পাতাল ট্রেনে করে গেলে মানুষের ভিড়ে সহজে লুকিয়ে থাকা যাবে। আমরা আমাদের ব্যাগ নিয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই মানুষের ভিড়ে মিশে গেলাম। সুপারকন্ডাষ্টিং১৮ রেলের ওপর দিয়ে পাতাল ট্রেনটা কয়েক ঘণ্টার মাঝেই আমাদের নির্দিষ্ট শহরটিতে নিয়ে আসে। এলাকাটিতে এক ধরনের নিরানন্দ ভাব, আমি তার মাঝে খুঁজে খুঁজে পুরাতন দালানটি বের করে ফেললাম। বাইরে অপ্রশস্ত গেট, গেটের উপর জটিল একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা– ঠিক পাসওয়ার্ডটি প্রবেশ করিয়ে গেট খুলে ঢুকে যেতে হবে। বাইরে থেকে মনে হচ্ছে এই দালানটিতে কোনো মানুষজন নেই, একটা পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়ির মতো চেহারা। কে জানে হয়তো আসলেই এখানে এমনিতে মানুষজন থাকে না, প্রয়োজনে কেউ কেউ আসে।
আমি আর জিগি খানিকটা উদাসভাবে এলাকাটা একটু সতর্কভাবে ঘুরে এলাম। তারপর পুরাতন দালানটির সামনে এসে দাঁড়ালাম। ব্যাগ থেকে দুটি পানীয়ের বোতল বের করে হাতে নিয়েছি–আশপাশে মানুষজন খুব বেশি নেই। যদি হঠাৎ করে কেউ চলেও আসে দেখলে ভাববে দুই বন্ধু দেওয়ালে হেলান দিয়ে অলস মধ্যাহ্নে গল্পগুজব করছে। পানীয়ে চুমুক দিতে দিতে জিগি পেছনে দরজার নিরাপত্তা ব্যবস্থাটুকুতে চতুষ্কোণ যন্ত্রটি লাগিয়ে ফেলল। তারপর অন্যমনস্ক একটা ভঙ্গি করে ব্যাকপেক থেকে সকেটটা বের করে আমাকে চাপা গলায় বলল, কাছে এস।
আমি চাপা অস্বস্তি এবং এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে জিগির কাছে এগিয়ে গেলাম। জিগি চোরাচোখে দুই পাশে তাকিয়ে হঠাৎ চোখের পলকে আমার মাথার পেছনে ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেসে সকেটটা লাগিয়ে দিল। আমার সারা শরীরে আবার তীব্র একটা ঝাঁকুনি হয়, চোখের সামনে নানা রঙ খেলা করতে থাকে এবং কানে তীক্ষ্ণ এক ধরনের শব্দ শুনতে পাই। জিগি আমার হাত ধরে রেখে বলে, সাবধান, দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাক, পড়ে যেও না।
আমি কোনোভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম এবং হঠাৎ করে মনে হল চোখের সামনে গোলাকার বৃত্ত আসতে শুরু করেছে। আমার ভয়ংকর এক ধরনের অস্বস্তি হতে থাকে–কী করব বুঝতে পারি না এবং সেই বিচিত্র বৃত্তগুলোকে একটার ওপর আরেকটার বসানোর চেষ্টা করতে থাকি। সত্যি সত্যি সেগুলো সমন্বিত হতেই নিজের ভেতরে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব হয়–কিন্তু সেটা মুহূর্তের জন্যেই, আবার চোখের সামনে বিচিত্র কিছু ছবি ভেসে ওঠে এবং আমি সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে সেগুলোর সমন্বয় করার চেষ্টা করতে থাকি। আমি শুনতে পেলাম আমার কানের কাছে জিগি ফিসফিস করে বলছে, চমৎকার ব্রতুল, চমৎকার! চালিয়ে যাও
কতক্ষণ এভাবে চালিয়ে গিয়েছিলাম আমি বলতে পারব না–আমার মনে হল এক যুগ বা আরো বেশি এবং তখন হঠাৎ করে একসময় জিগি মাথার পেছন থেকে টান দিয়ে সকেটটা খুলে নিল। আমার মনে হল মুহূর্তের জন্যে আমার মাথার ভেতরে বুঝি একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। আমি কোনোমতে পেছনের গেটটা দুই হাতে ধরে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুনতে পেলাম জিগি ফিসফিস করে বলছে, চমৎকার ত্রাতুল, দরজা খুলে গেছে!
আমি কোনোমতে চোখ খুলে বললাম, খুলে গেছে?
হ্যাঁ। এখন কিছুই হয় নি এরকম একটা ভাব করে ভেতরে ঢুকো।
ঢুকব?
হ্যাঁ। এস।
জিগি আমার হাত ধরে ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে গেটটা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। আমি টলতে টলতে কোনোভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, জিগি চারদিকে তাকিয়ে বলল, মনে হচ্ছে আসলেই এখানে কেউ নেই। কিন্তু কোনো রকম ঝুঁকি নেব না। এমনভাবে ভেতরে ঢুকব যেন আমরা এখানেই থাকি।