- বইয়ের নামঃ নায়ীরা
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
১. নীরা ত্রাতিনা
নীরা ত্রাতিনা গোল জানালা থেকে ভেসে ভেসে সরে যাচ্ছিল, সে হাত বাড়িয়ে জানালার কাচটা স্পর্শ করে নিজেকে থামিয়ে নেয়। জানালার শীতল কাঁচে মুখ স্পর্শ করে সে দূর পৃথিবীর দিকে তাকায়, দুই হাজার কিলোমিটার দূরের নীল পৃথিবীটাকে কী সুন্দরই না। দেখাচ্ছে! উপর থেকে মহাদেশগুলোকে স্পষ্ট দেখা যায়, সাদা মেঘে বিষুব অঞ্চলটা ঢেকে আছে। এরকম কোনো একটা মেঘের নিচে এই মুহূর্তে তার প্রিয় শহর টেহলিস আড়াল পড়ে গেছে। কতদিন সে তার শহরে যায় নি, মহাকাশে ভেসে ভেসে সে কী গভীর একটা ভালবাসা নিয়েই না মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শহরটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
ফ্লাইট ক্যাপ্টেন রিশান মহাকাশ স্টেশনের শেষ মাথায় বড় টেলিস্কোপটায় চোখ লাগিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। সে টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে ভেতরে তাকিয়ে নীরা ত্রাতিনাকে দেখতে পায়। ছিপছিপে কম বয়সী তরুণী, ঝকঝকে খাপখোলা তলোয়ারের মতো চেহারা। এই কম বয়সেই নিজেকে একজন সত্যিকার মহাকাশচারী হিসেবে পরিচিত করে ফেলেছে। মেয়েটির জন্য রিশান মাঝে মাঝেই নিজের বুকের গভীরে কোথাও এক ধরনের ভালবাসা অনুভব করে। কখনো সেটা সে প্রকাশ করে নি, কিন্তু সেটা কি এই মেয়েটার কাছে গোপন রয়েছে?
রিশান তার টেলিস্কোপটা ছেড়ে দেয়াল স্পর্শ করে ভাসতে ভাসতে নীরা ত্রাতিনার কাছে এগিয়ে এল। কাছাকাছি এসে জানালা স্পর্শ করে নিজেকে থামিয়ে বলল, নীরা, এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছ তুমি? O।
নীরা ত্রাতিনা রিশানের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসল, বলল, এই মহাকাশ থেকে পৃথিবী ছাড়া দেখার মতো আর কী আছে বলো?
রিশান বলল, তুমি যেভাবে দেখছ, তাতে মনে হচ্ছে পৃথিবীটা আগে কখনো দেখ নি।
নীরা ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, বলল, সেটা তুমি কিন্তু খুব ভুল বলে নি। এখান থেকে আমি যতবার পৃথিবীকে দেখি ততবার মনে হয় আমি যেন প্রথমবার দেখছি।
রিশান বলল, আর দু সপ্তাহের মাঝে পৃথিবীটাকে তুমি আরো অনেক কাছে থেকে দেখতে পাবে!
নীরা ত্রাতিনা বড় বড় চোখে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ। আমি খবর পেয়েছি, নতুন ক্রু আসছে। আমরা পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছি।
নীরা ত্রাতিনা অবিশ্বাসের গলায় বলল, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না!
প্রথমে আমারও বিশ্বাস হয় নি। তখন আমি মহাকাশ কেন্দ্রে যোগাযোগ করেছি, তারা বলেছে এটি সত্যি।
নীরা একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলল, দেখবে একেবারে শেষ মুহূর্তে প্রোগ্রামটা বাতিল করে দেবে।
না, তার সুযোগ নেই। মহাকাশ স্টেশনে টানা ছয় মাসের বেশি কারো থাকার নিয়ম নেই।
নিয়ম নেই তাতে কী হয়েছে? হয়তো আমাদের দিয়েই নিয়ম করবে। টানা ছয়। মাসের বেশি একটা মহাকাশ স্টেশনে থাকলে মহাকাশচারীদের মেজাজ কেমন তিরিক্ষে হয়ে থাকে সেটা নিয়েই হয়তো গবেষণা হবে।
রিশান শব্দ করে হেসে বলল, তোমার ভয় নেই নীরা। সেসব নিয়ে গবেষণা বহুকাল আগে শেষ হয়ে গেছে।
তা হলে তুমি বলছ আমরা সত্যি সত্যি পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছি?
হ্যাঁ নীরা, আমরা দু সপ্তাহের মাঝে পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছি।
চমৎকার! নীরা জানালা থেকে হাতটা সরাতেই ভেসে উপরে উঠে যেতে শুরু করে। মহাকাশ স্টেশনের ছাদ স্পর্শ করে নিজেকে থামিয়ে বলল, এই সুসংবাদটি দেবার জন্য চল একটু স্ফুর্তি করা যাক।
রিশান হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী রকম স্ফুর্তি করার কথা ভাবছ?
উত্তেজক পানীয় খেয়ে সবাইকে নিয়ে খানিকক্ষণ চেঁচামেচি করা যেতে পারে। আমার কাছে খাঁটি প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি একটা কেক আছে, ভালো কোনো ঘটনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। মহাকাশ স্টেশনে এর থেকে ভালো কোনো ঘটনা আর কী হতে পারে।
ঠিকই বলেছ। রিশান বলল, তুমি সবাইকে খবর দিয়ে কেকটা কাটা শুরু কর। আমি আসছি। টেলিস্কোপে একটা গ্রহাণু একটু দেখে আসি।
নীরা ত্রাতিনা ভুরু কুঁচকে বলল, হঠাৎ করে এই গ্রহাণু দেখার জন্য ব্যস্ত হচ্ছ কেন?
মহাকাশ কেন্দ্র থেকে বলেছে। গতিপথটা নাকি সুবিধার নয়। পৃথিবীর কক্ষপথে পড়তে পারে।
নীরা ত্রাতিনা শব্দ করে হাসল, বলল, পৃথিবীর মানুষের ভয় বড় বেশি। মহাকাশে একটা নুড়ি পাথর দেখলেও তাদের ঘুম নষ্ট হয়ে যায়।
রিশান মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ। তবে বেচারাদের খুব বেশি দোষ দেওয়া যায় না, পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগেকার ঘটনা মনে হয় ভুলতে পারছে না। পুরো ডাইনোসর জগৎ উধাও হয়ে গেল-সেই তুলনায় মানুষ তো রীতিমতো অসহায় প্রাণী!
ঠিক আছে তুমি গ্রহাণুটা দেখে আস। আমি সবাইকে ডেকে আনি।
.
আধঘণ্টা পর মহাকাশ স্টেশনের তিরিশ জন ক্রু নিয়ে একটা জমাট পার্টি শুরু হল। নীরা ত্রাতিনার বাচিয়ে রাখা কেক, কিছু বেআইনি উত্তেজক পানীয় এবং নিয়মবহির্ভূত গানবাজনায় ছোট মহাকাশযানটা রীতিমতো উদ্দাম হয়ে ওঠে। মহাকাশ স্টেশনের তরশূন্য পরিবেশে বিচিত্র নাচগানের চেষ্টা করতে গিয়ে ছোট দুর্ঘটনা ঘটিয়ে একটা অবলাল ক্যামেরার মূল্যবান লেন্সটা ভেঙে ফেলার পর সিকিউরিটি অফিসার ফুল হাত তুলে পার্টির সমাপ্তি ঘোষণা করল, গলা উঁচিয়ে বলল, অনেক হয়েছে। সবাই এখন থাম। বাকিটুকু পৃথিবীর জন্য থাকুক।
আমুদে পদার্থবিজ্ঞানী রিশি বলল, পৃথিবীতে কি আমরা এই নাচ নাচতে পারব? কখনো পারব না।
না পারলে নাই। কিন্তু তোমরা যা শুরু করেছ আরেকটু হলে মহাকাশ স্টেশনের দেয়াল ভেঙে বের হয়ে যাবে।
জীববিজ্ঞানী কিরি বলল, আর একটু থুল।
উঁহু। আর না। তোমরা যেভাবে বেআইনি উত্তেজক পানীয় খাচ্ছ যদি পৃথিবীতে সেই খবর পৌঁছায় তা হলে নির্ঘাত আমাকে জেলে পুরে রাখবে।
নীরা ত্রাতিনা খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি সেটা নিয়ে মন খারাপ করো না। কথা দিচ্ছি আমরা প্রতি সপ্তাহে জেলে তোমার সাথে খাবারের প্যাকেট নিয়ে দেখা করতে আসব।
থুল জোর করে মুখ শক্ত করে বলল, তুমি আমাকে দেখতে আসবে না আমি তোমাকে দেখতে আসব সে ব্যাপারে তুমি এত নিশ্চিত হলে কেমন করে?
রিশি ঠাট্টা করে কী একটা বলতে যাচ্ছিল সিকিউরিটি অফিসার থুল তার সুযোগ দিল। হাত নেড়ে বলল, আর ঠাট্টা-তামাশা নয়। পার্টি শেষ। এখন যে যার কাজে যাও।
কাজেই কিছুক্ষণের ভেতরে যে যার কাজে চলে গেল। নীরা ত্রাতিনার এই মুহূর্তে কোনো কাজ নেই, ভেসে ভেসে নিজের কেবিনের দিকে যেতে যেতে তার রিশানের সাথে দেখা হয়ে গেল, হালকা গলায় বলল, খুব মজা হল আজকে তাই না?
রিশান অন্যমনস্ক গলায় বলল, হুঁ।
নীরা ত্রাতিনা রিশানকে ভালো করে লক্ষ করল, মুখটায় এক ধরনের দুশ্চিন্তার ছাপ। সে দেয়ালে হাত দিয়ে নিজেকে থামিয়ে বলল, কী ব্যাপার রিশান, কিছু হয়েছে নাকি?
না। কিছু হয় নি।
তা হলে তোমাকে এত দুশ্চিন্তিত মনে হচ্ছে কেন?
ঐ গ্রহাণুটা-
কী হয়েছে গ্রহাণুটার?
পাজি গ্রহাণুটা একেবারে পৃথিবীর কক্ষপথে।
কত দূরে আছে?
এখনো অনেক দূর, প্রায় সাড়ে চার মিলিয়ন কিলোমিটার।
তা হলে এত দুশ্চিন্তা করছ কেন? এত দূরে থাকতে কখনো নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না।
রিশান চিন্তিত মুখে বলল, না, দুশ্চিন্তা করছি না। তবে
তবে কী?
যদি এটা তার গতিপথ না বদলায় তা হলে আমাদের এটাকে চূর্ণবিচূর্ণ করতে হবে। তার মানে বুঝতে পেরেছ?
নীরা ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। বুঝতে পারছি। সেটা করতে হবে আমাদের।
হ্যাঁ।
নীরা ত্রাতিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তার মানে আমাদের পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া পিছিয়ে যাবে।
হ্যাঁ। রিশান জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, পার্টিটা মনে হয় আমরা একটু আগেই করে ফেলেছি!
নীরা ত্রাতিনা বলল, মোটও আগে করি নি। ঠিক সময়ে করেছি।
কীভাবে ঠিক সময়ে করা হল?
যদি পৃথিবীতে ফিরে যেতে না পারি তা হলে এই গ্রহাণুকে আমাদের চূর্ণবিচূর্ণ করতে হবে। তা হলে ধরে নাও পার্টিটা হয়েছে পাজি গ্রহাণুকে চূর্ণবিচূর্ণ করা উপলক্ষে।
রিশান শব্দ করে হেসে বলল, মহাকাশে ছুটে আসা গ্রহাণুকে ধ্বংস করা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক, সবচেয়ে ভয়ংকর কাজগুলোর একটি। সেটা উপলক্ষে পার্টি করতে হলে বেশ নার্ভের প্রয়োজন!
নীরা ত্রাতিনা বলল, আমার নার্ভ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।
রিশান বলল, জানি।
যদি সত্যি সত্যি নিউক্লিয়ার মিসাইল নিয়ে যেতে হয় আমি কিন্তু যাব।
ঠিক আছে।
এখন কি তুমি টেলিস্কোপে আবার গ্রহাণুটাকে দেখতে যাচ্ছ?
হ্যাঁ।
আমি কি তোমার সাথে দেখতে পারি?
হ্যাঁ। অবশ্যই দেখতে পার।
নীরা ত্রাতিনা আর রিশান ভেসে ভেসে মহাকাশ স্টেশনের বড় টেলিস্কোপটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
.
এই মহাকাশ স্টেশনটি পৃথিবী থেকে দুই হাজার কিলোমিটার উপরে একটা কক্ষপথে বসানো রয়েছে। দুই ঘণ্টার কাছাকাছি সময়ে এটা পৃথিবীকে একবার করে প্রদক্ষিণ করে। এই মহাকাশ স্টেশনে সব সময় বিজ্ঞানীদের একটি দল থাকে, মহাকাশ নিয়ে নানা গবেষণা করার জন্য তাদের পাঠানো হয়। দৈনন্দিন কাজের বাইরেও তাদের আরো নানা ধরনের কাজ করতে হয়-কোনো একটি গ্রহাণু পৃথিবীর দিকে ছুটে এলে সেটাকে মাঝপথে থামিয়ে বিস্ফোরিত করে দেওয়া সেরকম একটা কাজ।
টেলিস্কোপের আইপিসে চোখ লাগিয়ে নীরা ত্রাতিনা বলল, কী বীভৎস দেখতে!
হ্যাঁ, এই গ্রহাণুটা দেখতে ভালো নয়।
কেমন লালচে রং দেখছ? পচা ঘায়ের মতন।
রিশান বলল, হ্যাঁ। এটা এস-টাইপ গ্রহাণু। লোহা আর ম্যাগনেসিয়ামে তৈরি। শতকরা পনের ভাগ গ্রহাণু এরকম।
নীরা ত্রাতিনা জিজ্ঞেস করল, প্রহাণুটা তার কক্ষপথ ছেড়ে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসতে শুরু করল কেন?
ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সম্ভবত অন্য কোনো গ্রহাণুর সাথে ধাক্কা লেগে গতিপথ পাল্টে গেছে।
নীরা ত্রাতিনা খানিকক্ষণ গ্রহাণটা লক্ষ করে বলল, গ্রহাণ হিসেবে এটা বেশ বড়।
হ্যাঁ। প্রায় বারো কিলোমিটার। সত্যি সত্যি পৃথিবীতে আঘাত করলে পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে।
নীরা ত্রাতিনা টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে বলল, শুধু শুধু দুশ্চিন্তা না করে চল এর গতিপথটা বের করে ফেলি।
হ্যাঁ। আমি সেজন্য এসেছি।
আমার এখন সেরকম কোনো কাজ নেই। তোমাকে সাহায্য করতে পারি?
অবশ্যই। তুমি যদি শুধু পাশে বসে থাক তা হলেই আমার অনেক বড় সাহায্য হবে। একা একা এই বিদঘুটে গ্রহাণুটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে না।
তোমার ভয় নেই রিশান, আমি তোমার সাথে আছি।
পরবর্তী ছয় ঘণ্টা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে গ্রহাণুর গতিপথটি ছকে ফেলে নীরা ত্রাতিনা আর রিশান আবিষ্কার করল টোরকা নামের বারো কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটা গ্রহাণু মূর্তিমান বিভীষিকার মতো পৃথিবীর দিকে ছুটে যাচ্ছে। গ্রহাণুটি লালচে, আকৃতি একটু লম্বা এবং পৃষ্ঠদেশ অসমতল। গ্রহাণুটি ঘুরছে এবং সে কারণে গতিপথ অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট। পৃথিবীর ইতিহাসে একচল্লিশ দিনের মাথায় এই গ্রহাণুটির বায়ুমণ্ডলে ঢোকার কথা।
এরপর যে ঘটনাটি ঘটবে সেটি কেউ চিন্তাও করতে সাহস পায় না।
কিছুক্ষণের মাঝেই মহাকাশযানের সব ক্রু গ্রহাণু টোরকার কথা জেনে গেল, মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন জরুরিভাবে সবাইকে তার কেবিনে ডেকে পাঠাল। গ্রহাণুটা পৃথিবীকে আঘাত করলে কী হতে পারে সেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পদার্থবিজ্ঞানী রিশি একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, টোরকা গ্রহাণুটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঘণ্টায় এক শ বিশ হাজার কিলোমিটার বেগে আঘাত করবে।
উপস্থিত বেশ কয়েকজন বিস্ময়ে শিস দেবার মতো একটা শব্দ করল। রিশি মাথা নেড়ে বলল, গ্রহাণুটার আকার বারো কিলোমিটার। এটা বায়ুমণ্ডল ভেদ করে যাবে এবং কিছু বোঝার আগে, প্রায় চোখের পলকে, পৃথিবীতে আঘাত করবে। শেষবার এরকম একটা উল্কা আঘাত করেছিল জনমানবহীন সাইবেরিয়াতে তাই কোনো প্রাণহানি হয় নি। কিন্তু এই গ্রহাণুটা আঘাত করবে এশিয়ার সবচেয়ে জনবহুল এলাকায়। গ্রহাণুটা যখন পৃথিবীতে আঘাত করবে সেটা পৃথিবীর উপরের স্তর কয়েক কিলোমিটার ভেঙে ভেতরে ঢুকে যাবে। সেই ভয়ংকর বিস্ফোরণটি হবে কয়েক হাজার নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণের সমান। মুহূর্তে প্রায় অর্ধবিলিয়ন মানুষ মারা যাবে।
যারা উপস্থিত ছিল তারা আবার শিস দেবার মতো একটা শব্দ করল। রিশি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। সেটা হচ্ছে স্ক। এই বিস্ফোরণে পাথর ধুলাবালি বিদ্যুৎগতিতে উপরে উঠে যাবে। কেন জান?
নীরা ত্রাতিনা জিজ্ঞেস করল, কেন?
কারণ এই গ্রহাণুটা যখন পৃথিবীর দিকে ছুটে যাবে তখন তার পেছনের সব বাতাসকে সরিয়ে নেবে, পেছনে থাকবে একটা শূন্যতা, সেই শূন্য গহ্বর দিয়ে ধুলাবালি পাথর ধোঁয়া আবর্জনা সবকিছু উঠে আসবে। তারপর সেটা ছড়িয়ে পড়বে সারা পৃথিবীর আকাশে। আমাদের কেউ যদি তখন মহাকাশের এই স্টেশনে থাকি তা হলে আমরা দেখব কালো ধোঁয়ায় পৃথিবীটা ঢেকে যাচ্ছে। গ্রহটিকে আর নীল দেখাবে না, এটাকে দেখাবে ধূসর।
রিশি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীতে দিন-রাতের কোনো পার্থক্য থাকবে না, পুরোটাই হবে কালো রাত। কুচকুচে অন্ধকারে সবকিছু ঢাকা থাকবে। হিমশীতল ঠাণ্ডায় পৃথিবী স্থবির হয়ে যাবে। আকাশ থেকে কালো ধুলাবালি পৃথিবীতে পড়তে থাকবে, পুরো পৃথিবী ঢেকে। যাবে কালো ধুলার স্তরে। প্রথমে যারা মারা যায় নি তখন তারা মারা পড়তে শুরু করবে।
রিশি একটা নিশ্বাস ফেলে চুপ করল। জীববিজ্ঞানী কিরি বলল, হ্যাঁ আমার ধারণা পৃথিবীর জীবিত প্রাণীর প্রায় নিরানব্বই শতাংশ মারা যাবে। সমুদ্রের পানি ধুলায় ঢেকে যাবে, জলজ প্রাণীরা নিশ্বাস নিতে পারবে না। গাছপালা কীটপতঙ্গ মারা যাবে প্রচণ্ড শীতে। পশুপাখি মারা যাবে না খেতে পেয়ে। তাদের খেয়ে বেঁচে থাকত যে প্রাণী তখন মারা যাবে সেই। প্রাণী! ফুড চেইন ধরে একটি একটি প্রজাতি ধ্বংস হতে শুরু করবে। পরবর্তী এক বছরে পুরো পৃথিবী প্রায় প্রাণহীন একটা গ্রহে পাল্টে যাবে।
রিশি বলল, হ্যাঁ। এক দুইজন মানুষ নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও বেঁচে থাকবে। তারা আবার একেবারে গোড়া থেকে পৃথিবীর সভ্যতা শুরু করবে!
রিশির কথা শেষ হবার পরও সবাই কেমন যেন হতচকিতের মতো বসে থাকে, পুরো বিষয়টি যেন এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সিকিউরিটি অফিসার থুল কিছু একটা বলার চেষ্টা করে থেমে গেল। ঠিক তখন একটা হাসির শব্দ শোনা যায়-সবাই মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে নীরা ত্রাতিনা খিলখিল করে হাসছে।
থুল একটু ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বলল, কী হল? তুমি হাসছ কেন?
তোমাদের সবাইকে দেখে।
আমাদের মাঝে হাসির ব্যাপারটা কী?
তোমাদের চেহারা দেখেই হাসি পাচ্ছে। তাকিয়ে দেখ সবাইকে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে টোরকা গ্রহাণুটা সত্যি সত্যি পৃথিবীকে আঘাত করে ফেলেছে। সত্যি সত্যি পৃথিবীর সব মানুষ মরে ভূত হয়ে গেছে। মনে রেখ এখনো ব্যাপারটা ঘটে নি এবং আমরা সেটা ঘটতেও দেব না।
কেউ কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে নীরা ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। নীরা ত্রাতিনা বলল, আমরা এখান থেকে একটা মিসাইল দিয়ে গ্রহাণুটাকে আঘাত করব। নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে টোরকাকে টুকরো টুকরো করে দেব।
রিশান মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। আমাদের কাছে পৃথিবী থেকে সেরকম একটা নির্দেশ এসেছে।
কাজেই তোমরা সবাই এরকম প্যাচার মতো মুখ করে থেকো না। তোমাদের দোহাই লাগে-শুধু শুধু কেউ মুখ ভোঁতা করে বসে থাকলে দেখতে খুব খারাপ লাগে!
নীরা ত্রাতিনার কথা শুনে এবারে বেশ কয়েকজন সহজ গলায় হেসে উঠল। রিশি বলল, নীরা ঠিকই বলেছে। এই বিদঘুটে গ্রহাণুটা তো সত্যি সত্যি পৃথিবীকে আঘাত করে নি! আমরা এটাকে তার আগেই ধ্বংস করব।
থুল হাত উঁচু করে বলল, অবশ্যই ধ্বংস করব।
একসাথে এবারে অনেকে হাত তুলে প্রায় স্লোগানের ভঙ্গিতে বলল, অবশ্যই ধ্বংস করব।
.
একটা স্কাউটশিপে করে ফ্লাইট ক্যাপ্টেন রিশান এবং মহাকাশচারী শুরার গ্রহাণু টোরকার কাছে যাবার কথা ছিল, কিন্তু নীরা ত্রাতিনা বলল সেও যেতে চায়। কাজটি বিপজ্জনক তাই কেউ যদি স্বেচ্ছায় যেতে চায় তাকে অগ্রাধিকার দেবার নিয়ম। নীরা ত্রাতিনার বয়স তুলনামূলকভাবে কম হলেও সে প্রথম শ্রেণীর মহাকাশচারী। তাই পৃথিবী থেকে তার অনুমতি পেতে সমস্যা হল না। স্কাউটশিপটি ছোট, সেখানে তিন জন যাওয়া সহজ নয় তাই শেষ পর্যন্ত। রিশান এবং মহাকাশচারী শুরার পরিবর্তে নীরা ত্রাতিনাকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল।
গ্রহাণুটি এখনো অনেকখানি দূরে কিন্তু সেটা কাছে আসার জন্য কেউই অপেক্ষা করতে রাজি নয়। এটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ধ্বংস করা দরকার তাই রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা খুব তাড়াতাড়ি রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মচারীরা স্কাউটশিপে দুটি হালকা নিউক্লিয়ার বোমা তুলে দেয়। স্কাউটশিপে জ্বালানি ভরতে অনেক সময় লেগে গেল। সেখানকার মূল কম্পিউটারে মহাকাশ স্টেশন এবং পৃথিবী থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রবেশ করিয়ে শেষ পর্যন্ত স্কাউটশিপটাকে রওনা দেবার জন্য প্রস্তুত করে নেওয়া হল।
মহাকাশযানের ইঞ্জিনিয়াররা যখন স্কাউটশিপটার যান্ত্রিক ঘুঁটিনাটি শেষবারের মতো পরীক্ষা করছে তখন বায়ু নিরোধক গোলাকার হ্যাঁচ দিয়ে রিশান আর নীরা ত্রাতিনা তাদের স্কাউটশিপে গিয়ে ঢোকে। ধাতব দরজাটি বন্ধ করে দিয়ে দু জনে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে আরামদায়ক চেয়ারে বসে নিজেদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই কাউন্ট ডাউন রু হয়ে যায়। সামনে বড় মনিটরে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের অফিসারদের দেখা যায়, তারা গম্ভীর গলায় কিছু রুটিন চেকআপ করে নেয়। নীরা ত্রাতিনা আর রিশান তাদের অভিজ্ঞ হাতে কন্ট্রোল প্যানেলের সুইচ স্পর্শ করে পুরো স্কাউটশিপটাকে সচল করতে থাকে।
কিছুক্ষণের ভেতরেই একটা চাপা গুম গুম শব্দ করে স্কাউটশিপটা গভীর মহাকাশের দিকে ছুটতে থাকে।
.
পৃথিবীর মহাকর্ষ থেকে বের হবার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি দিয়ে স্কাউটশিপটা তার গতি সঞ্চয় করতে থাকে। মহাকাশযানের ককপিটে বসে রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা তার তৃরণটুকু অনুভব করতে শুরু করে। তাদের মনে হতে থাকে অদৃশ্য কোনো একটা শক্তি তাদেরকে চেয়ারে চেপে ধরেছে। রিশান কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ বুলিয়ে বলল, নীরা, সবকিছু ঠিক আছে তো?
হ্যাঁ, কোনো সমস্যা নেই। সবকিছু ঠিক আছে।
তুমি যদি সহ্য করতে পার তা হলে গতিবেগ আরো দ্রুত বাড়িয়ে ফেলি।
আমি সহ্য করতে পারব।
চমৎকার। রিশান থ্রটল বারটা নিজের কাছে টেনে আনতে আনতে বলল, তোমার মতো মহাকাশচারীকে নিয়ে উড়ে যাওয়ার একটা আনন্দ আছে। আমার সাথে আসার জন্য ধন্যবাদ নীরা।
ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই। এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা মিশনে যেতে পারা আমার জন্য অনেক বড় সৌভাগ্য।
রিশানের খুব ইচ্ছে হল বলে যে, তোমার সাথে পাশাপাশি যেতে পারাও আমার জন্য অনেক বড় সৌভাগ্য! সে সেটি বলতে পারল না। ইঞ্জিনের গর্জনের সাথে সাথে গতিবেগ বাড়তে থাকে, প্রচণ্ড ত্বরণের কারণে তাদের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, মনে হয় বুকের উপর কেউ একটা বিশাল পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। তাদের চোখের সামনে একটা লাল পরদা কাঁপতে থাকে। মনে হতে থাকে আর একটু হলেই তারা অচেতন হয়ে যাবে। দুজন দাঁতে দাঁত চেপে নিঃশব্দে বসে থাকে, রিশান চোখের কোনা দিয়ে নীরা ত্রাতিনাকে দেখার চেষ্টা করে। তাকে বলার ইচ্ছে করে, তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি নীরা। কিন্তু সে সেটাও বলতে পারে না। মহাকাশযানের দুটি ইঞ্জিন প্রচণ্ড গর্জন করছে, পুরো স্কাউটশিপটি থরথর করে কাঁপছে, শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য স্পন্দন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এরকম একটা সময়ে কেউ এ ধরনের একটি কথা বলে না। রিশান তাই সেটি বলার চেষ্টা করল না।
ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই স্কাউটশিপটা তাদের কাঙ্ক্ষিত গতিবেগে পৌঁছে যায়। তৃরণটি বন্ধ করার সাথে সাথে রিশান এবং নীরা ত্রাতিনার নিজেদেরকে ভরশূন্য মনে হতে থাকে। দুজনেই এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করে। মহাকাশের অন্ধকারে এখন তাদের শুধু ছুটে যাওয়া। যতই সময় পার হবে তাদের যাত্রা হবে আরো বিপজ্জনক। ছোটবড় অসংখ্য গ্রহাণুর ভেতর দিয়ে তাদের উড়ে যেতে হবে। টোরকা গ্রহাণুটা এখনো অনেক দূরে, সেখানে পৌঁছাতে এখনো তাদের অনেক দিন বাকি।
পরের কয়েকদিন রিশান আর নীরা ত্রাতিনা ছোট স্কাউটশিপটার মাঝে টোরকা গ্রহাণুটাতে পৌঁছানোর পর তার ওপর নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকগুলো বসানোর ঘুঁটিনাটি পরিকল্পনা করে কাটিয়ে দিল। পৃথিবীর মহাকাশ কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ আছে, মহাকাশ স্টেশনের সাথেও যোগাযোগ আছে। তাদের স্কাউট স্টেশনের গতিপথ আর টোরকা গ্রহাণুর গতিপথ হিসাব করে তাদের স্কাউটশিপের নিয়ন্ত্রণ মডিউলের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে। রিশান আর নীরা ত্রাতিনা এর মাঝে বেশ কয়েকবার পুরো পরিকল্পনাটা পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছে।
দুজন মানুষ খুব কাছাকাছি একটি জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে থাকলে তাদের মাঝে এক ধরনের ঘনিষ্ঠতার জন্ম হয়। এখানেও তার ব্যতিক্রম হল না। দুজন যে শুধুমাত্র গতিপথ আর বিস্ফোরক নিয়ে কথা বলল তা নয়, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, প্রিয়-অপ্রিয়, ভালো লাগা এবং না লাগার বিষয় নিয়েও কথা বলল। টোরকা গ্রহের কাছাকাছি যেদিন পৌঁছে গেছে সেদিন নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকের ডেটনেটরগুলো শেষবারের মতো পরীক্ষা করতে করতে রিশান নীরা ত্রাতিনাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে কী করবে, ঠিক করেছ?
হ্যাঁ।
কী করবে?
হ্রদের তীরে একটা কটেজ ভাড়া করে সেখানে ওক কাঠের শক্ত একটা বিছানায় ঘুমাব। ভরশূন্য অবস্থায় বাতাসে ঝুলে ঝুলে ঘুমাতে ঘুমাতে মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
রিশান হেসে বলল, অনুমান করছি সপ্তাহখানেকের ভেতরেই তোমার যথেষ্ট ঘুম হয়ে যাবে। তখন কী করবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাবার ইচ্ছে আছে। মহাজাগতিক নিউক্লিয়াস নিয়ে একটা জিনিস অনেক দিন থেকে মাথায় কুটকুট করছে। বিষয়টা নিয়ে একটা বড় এক্সপেরিমেন্ট করব ভাবছি।
হুম! রিশান মুখ গম্ভীর করে বলল, শুধু পড়াশোনা এবং গবেষণা! আমি শুনেছিলাম মেয়েরা নাকি ঘর-সংসার করতেও খুব পছন্দ করে।
করি। আমিও করি। ঘর-সংসার বাচ্চাকাচ্চা আমার খুব পছন্দ। নীরা ত্রাতিনা মুচকি হেসে বলল, আমি ঠিক করেছি আমি যখন সংসার শুরু করব তখন আমার উনিশ জন বাচ্চা হবে।
রিশান চোখ কপালে তুলে বলল, কতজন?
উনিশ জন। তার থেকে একজনও কম নয়!
রিশান শব্দ করে হেসে বলল, আমি তোমার সাফল্য কামনা করছি নীরা।
নীরা ত্রাতিনা এবারে রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, পৃথিবীতে ফিরে তুমি কী করবে?
আমি?
হ্যাঁ।
রিশান মাথা চুলকে বলল, এখনো ঠিক করি নি। তুমি কোন হ্রদের তীরে কটেজ ভাড়া করবে যদি বলো তা হলে সেই হ্রদে মাছ ধরতে যেতে পারি।
নীরা ত্রাতিনা খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি বুঝি মাছ খেতে খুব পছন্দ কর?
উঁহু।
তা হলে?
আমি তোমাকে খুব পছন্দ করি!
নীরা ত্রাতিনা আবার খিলখিল করে হাসতে গিয়ে থেমে গেল, রিশানের চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, একটা ছোট স্কাউটশিপে কাউকে নিয়ে দিনের পর দিন মহাকাশে ছুটে যেতে হলে পছন্দ না করে উপায় কী?
রিশান বলল, আসলে বিষয়টা এত সহজ না।
তা হলে বিষয়টা কী?
টোরকা গ্রহাণুটা পৃথিবীর জন্য খুব ভয়ংকর একটা বিপদ। আমাদের যে করেই হোক এটা ধ্বংস করতে হবে। আমরা যদি এখন এটা ধ্বংস করতে না পারি পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তুমি বুঝতে পারছ, কাজটা খুব কঠিন। আমরা যেটা করছি এর আগে সেটা কেউ করে নি। যতই কাছে যাচ্ছি ততই বুঝতে পারছি কাজটা কত বিপজ্জনক। গ্রহাণুটা অত্যন্ত বিচিত্রভাবে ঘুরছে, পুরোটা এবড়োখেবড়ো-বিশাল বিশাল পাথরের চাই উঁচু হয়ে আছে, ডক করার সময় আমাদের স্কাউটশিপ টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণটা ঘটার সময় আমাদের স্কাউটশিপটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে পারে। আমরা নিজেদের কাছে নিজেরা স্বীকার করছি না, কিন্তু দুজনেই খুব ভালো করে জানি এখান থেকে জীবন্ত ফিরে যাবার সম্ভাবনা কম!
নীরা ত্রাতিনা একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, কেন ভয় দেখানোর চেষ্টা করছ?
আমি মোটেই তোমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি না। রিশান একটু হেসে বলল, তোমাকে আমি অনেক দিন থেকে খুব কৌতূহল নিয়ে লক্ষ করছি–তোমার ভিতরে কোনো ভয়ডর নেই। শুধু যে নিজের ভিতরে নেই তা নয়, যারা তোমার আশপাশে থাকে তারাও তোমার সাহসটুকু পেয়ে যায়–তোমাকে ভয় দেখাব কেমন করে? আমি যেটা বলছি সত্যি বলছি। তোমার কিংবা আমার কিংবা আমাদের দুজনেরই কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। তুমি জান?
নীরা ত্রাতিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, জানি।
তাই আমি ভাবছিলাম যখন দুজনই বেঁচে আছি তখন তোমাকে কথাটা জানিয়ে রাখি। তুমি খুব চমৎকার মেয়ে নীরা। তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি। কথাটি এখনই বলছি কারণ এই কথাটি হয়তো আর কখনো বলার সুযোগ পাব না।
নীরা ত্রাতিনা কিছুক্ষণ রিশানের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কোন হ্রদের তীরে কটেজ ভাড়া করব সেটা তোমাকে জানিয়ে রাখব রিশান। তুমি মাছ ধরার ফাঁকে ফাঁকে এই কথাগুলো বলার অনেক সুযোগ পাবে।
সত্যি?
হ্যাঁ। নীরা ত্রাতিনা একটু হেসে বলল, সত্যি।
২. টোরকা গ্রহাণুটা দেখতে অত্যন্ত বীভৎস
টোরকা গ্রহাণুটা দেখতে অত্যন্ত বীভৎস। এটি লালচে, দেখে মনে হয় বিশাল কোনো প্রাণীর চামড়া ছিলে ভেতরের মাংস ক্লেদ বের করে রাখা হয়েছে। গ্রহাণুটি দুটি ভিন্ন ভিন্ন অক্ষে ঘুরপাক খাচ্ছে-মূল অংশ থেকে এবড়োখেবড়োভাবে বের হয়ে থাকা অংশগুলো এত বিপজ্জনকভাবে ঘুরে আসছে যে স্কাউটশিপটা সেখানে মানো খুব বিপজ্জনক হতে পারে। গ্রহাণুটাতে নামার আগে নীরা ত্রাতিনা আর রিশান টোরকাকে ঘিরে একটা স্থির কক্ষপথ তৈরি করে নিল, তারপর একটা সমতল অংশ দেখে খুব সাবধানে সেখানে নেমে আসতে থাকে।
গ্রহাণুটার কয়েকশ মিটার কাছাকাছি এসে তারা মূল ইঞ্জিন বন্ধ করে ছোট ছোট দুটো ইঞ্জিন চালু করে এবং হঠাৎ করে একটি বিপজ্জনক অবস্থার মুখোমুখি হয়ে যায়। কোনো একটা বিচিত্র কারণে গ্রহাণুটা প্রচণ্ড শক্তিতে তাদের স্কাউটশিপটাকে নিচে টেনে নামাতে থাকে। রিশান কন্ট্রোল প্যানেলে বসে চিৎকার করে বলল, মূল ইঞ্জিন বিপরীত থ্রাস্ট।
নীরা ত্রাতিনা দ্রুত আবার মূল ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা করে, সেটি চালু হতে খানিকটা সময় নেয়, কিন্তু ততক্ষণে স্কাউটশিপটা প্রচণ্ড গতিতে নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। গ্রহাণুটার বের হয়ে থাকা একটা অংশ স্কাউটশিপটাকে একটু হলে আঘাত করে ফেলত, শেষ মুহূর্তে রিশান এটাকে সরিয়ে নেয়। গতি কমানোর জন্য মূল ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা করছে, পারছে না-যখন তারা বাঁচার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে তখন একেবারে শেষ মুহূর্তে ইঞ্জিনটা চালু হয়ে যায়। তারপরেও তারা স্কাউটশিপটা পুরোপুরি বাঁচাতে পারল না। প্রচণ্ড গতিতে ভয়ংকর বিস্ফোরণ করে সেটা গ্রহাণুটাতে আছড়ে পড়ে।
স্কাউটশিপটার গুরুতর ক্ষতি হয়েছে, অনেকগুলো এলার্ম একসাথে তারস্বরে বাজতে শুরু করেছে। বৈদ্যুতিক যোগাযোগে বড় ধরনের সমস্যা হয়ে স্কাউটশিপের আলো নিতে গিয়েছে। পোড়া একটা ঝাঁজালো গন্ধে পুরো স্কাউটশিপটা ধীরে ধীরে ভরে যেতে শুরু করে।
যন্ত্রপাতির নিচে চাপা পড়ে থাকা রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা বের হয়ে এল। একজন আরেকজনের দিকে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে থাকে। নীরা ত্রাতিনা বলল, এটা কী হল?
রিশান মাথা নাড়ে, বুঝতে পারছি না।
মনে হচ্ছে গ্রহাণুর মাঝখানে একটা নিউট্রন স্টার হাজির হয়েছে। হঠাৎ করে স্কাউটশিপটাকে এভাবে টেনে নিল কেন?
ম্যাগনেটিক ফিল্ড। আমরা যতটুকু ভেবেছিলাম তার থেকে কয়েক শ গুণ বেশি। গ্রহাণুটা ঘুরছে সেজন্য চৌম্বক আবেশ দিয়ে আশপাশে তীব্র ফিল্ড তৈরি করেছে। আমরা বুঝতে পারি নি।
নীরা ত্রাতিনা চারদিকে তাকিয়ে বলল, স্কাউটশিপটা মনে হয় পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে।
রিশান মাথা নাড়ল, ফাটল দিয়ে সব বাতাস বের হয়ে যাচ্ছে। আমাদের স্পেস সুট পরে নেওয়া দরকার।
একটা স্পেস সুটে বড়জোর দশ-বারো ঘণ্টার মতো অক্সিজেন থাকে। তারপর কী হবে সেটা নিয়ে দুজনের কেউই কোনো কথা বলল না। রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা প্রায় নিঃশব্দে স্পেস সুট পরে নেয়। স্কাউটশিপের ক্ষতির পরিমাণটা একটু অনুমান করার চেষ্টা করল। ফাটলগুলো বন্ধ করা সম্ভব নয় কাজেই সেখানে সময় নষ্ট করল না। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কমিউনিকেশান মডিউলটি কাজ করছে না। পৃথিবী বা স্পেস স্টেশনের সাথেও আর কথা বলা যাচ্ছে না।
নীরা ত্রাতিনা বলল, চল, নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকটি তাড়াতাড়ি গ্রহাণুটার মাঝে বসিয়ে আসি।
হ্যাঁ। দেরি করে লাভ নেই। চল।
দুজন স্কাউটশিপের হ্যাঁচ খুলে সেখান থেকে বিস্ফোরকগুলো বের করে নেয়। ভরশূন্য পরিবেশ, কিন্তু গ্রহাণুটার প্রচণ্ড চৌম্বক ক্ষেত্রের কারণে জুতোর নিচে লাগানো লোহার পাতগুলো তাদের গ্রহাণুটাতে আটকে থাকতে সাহায্য করছিল। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকটি নিয়ে তারা একটা ছোট জেটপ্যাক নিয়ে রওনা দেয়। গ্রহাণুটার মোটামুটি মাঝামাঝি অংশে তারা নেমেছে, এর মূল কেন্দ্রের কাছাকাছি জায়গায় একটা গভীর গর্ত করে সেখানে বিস্ফোরকটা ঢুকিয়ে দিতে হবে। গর্তটা যত গম্ভীর হবে গ্রহটাকে ধ্বংস করার সম্ভাবনা তত বেড়ে যাবে।
রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা একটা ভালো জায়গা বেছে নিয়ে গর্ত করতে শুরু করে। ধারালো ড্রিল মেশিনটি আগুনের ফুলকি ছুটিয়ে গর্ত করতে শুরু করে, থরথর করে কাঁপতে থাকে কুৎসিত গ্রহাণুটির লালচে পাথর।
ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই প্রায় এক কিলোমিটার গভীর একটা গর্ত তৈরি হয়ে যায়। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকের টাইমারটি সেট করে এখন সেটা নামিয়ে উপর থেকে গর্তটা বন্ধ করে দিতে হবে। নীরা ত্রাতিনা প্রশ্ন দৃষ্টিতে বিশানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমরা টাইমারটি কতক্ষণ পরে সেট করব?
রিশান খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, হাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে এটি সেট করতে হবে যেন আমরা এর মাঝে স্কাউটশিপটা ঠিক করে দূরে সরে যেতে পারি।
নীরা ত্রাতিনা বলল, আবার খুব বেশি সময় দেওয়া যাবে না। যদি কোনো কারণে বিস্ফোরকটা কাজ না করে তা হলে যেন দ্বিতীয় একটা দল আসতে পারে তার সময় দিতে হবে।
হ্যাঁ। রিশান মাথা নাড়ল, ঠিকই বলেছ।
টাইমারটিকে বারো ঘণ্টার জন্য সেট করে তারা বিস্ফোরকটার ভেতরে নামিয়ে দিল। ওপর থেকে গর্তটা বুজিয়ে দিয়ে তারা স্কাউটশিপে ফিরে আসতে থাকে। তাদের হাতে এখন বারো ঘণ্টার মতো সময় তার ভেতরে স্কাউটশিপটাকে চালু করে তাদের সরে যেতে হবে। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণে পুরো গ্রহাণটা যখন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে তখন তার টুকরোগুলো চারপাশে যে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের সৃষ্টি করবে তার কয়েক শ কিলোমিটারের ভেতর কোনো জীবন্ত প্রাণীর বেঁচে থাকার কথা নয়।
রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা স্কাউটশিপের ভেতর ঢুকে তার ধাতব দরজা বন্ধ করে, পুরোটা এক ধরনের বিধ্বস্ত অবস্থায় আছে। রিশান চারদিকে তাকিয়ে বলল, আগামী ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতর আমাদের স্কাউটশিপটা চালু করতে হবে, তারপর ছয় থেকে আট ঘন্টায় আমাদের এই গ্রহাণু টোরকা থেকে সরে যেতে হবে। যদি না পারি আমাদের শরীরের একটা পরমাণুও কেউ কখনো খুঁজে পাবে না।
নীরা ত্রাতিনা চারদিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কী ধারণা? স্কাউটশিপটা যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে সেটাকে কি ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতরে ঠিক করা যাবে?
রিশান মাথা নাড়ল, বলল, মনে হয় না।
আমারও তাই ধারণা। তবে-
তবে কী?
যদি আমরা এটাকে ছয় থেকে আট ঘণ্টার মাঝে দাঁড়া করাতে না পারি তা হলে আর কখনোই দাঁড়া করাতে পারব না। কাজেই মন খারাপ করার কিছু নেই!
রিশান হাসার চেষ্টা করে বলল, বিষয়টা নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ নীরা! আমি মোটেও মন খারাপ করছি না।
তা হলে কাজ শুরু করে দেওয়া যাক।
নীরা ত্রাতিনা বলল, আমি অক্সিজেন সাপ্লইটা দেখি। তুমি দেখ ইঞ্জিনগুলো।
রিশান মাথা নাড়ল, বলল, না, আমি অক্সিজেন সাপ্লাইটুকু দেখি তুমি ইঞ্জিনগুলো দেখ। ইঞ্জিনটা দেখার আগে বৈদ্যুতিক যোগাযোগটাও তোমাকে দেখতে হবে। আমি ইমার্জেন্সি পাওয়ার ব্যবহার করে স্কাউটশিপের কম্পিউটারটা চালু করার চেষ্টা করি।
চমৎকার।
দুই ঘণ্টার মাথায় নীরা ত্রাতিনা বৈদ্যুতিক যোগাযোগ ঠিক করে ফেলল। স্কাউটশিপের ফাটলগুলো বুজিয়ে বাতাসের চাপ ঠিক করতে রিশানের লাগল চার ঘণ্টা। নীরা ত্রাতিনা মূল ইঞ্জিনটা চালু করল আরো দুই ঘণ্টায়। রিশান মূল কম্পিউটারটি চালু করতে আরো তিন ঘণ্টা সময় নিল। সবগুলো ইঞ্জিন সমন্বয় করতে এবং জ্বালানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে নীরা ত্রাতিনার আরো দুই ঘণ্টা সময় লেগে গেল। তখন দুইজন মিলে ঘণ্টাখানেক যোগাযোগ মডিউলটা চালু করার চেষ্টা করল, কিন্তু লাভ হল না। তাদের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে তাই যোগাযোগ মডিউলে পৃথিবী কিংবা মহাকাশ স্টেশনের সাথে যোগাযোগ না। করেই গ্রহাণু টোরকা থেকে তারা বিদায় নেবার জন্য প্রস্তুত হল।
নিউক্লিয়ার বিস্ফোরকটি বিস্ফোরিত হবার তিন ঘণ্টা আগে স্কাউটশিপটা গর্জন করে উপরে উঠে যায়, প্রথমে সেটি গ্রহাণুটাকে প্রদক্ষিণ করে কক্ষপথটা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে নেয়, তারপর স্কাউটশিপের শক্তিশালী ইঞ্জিন গর্জন করে পৃথিবীর দিকে ছুটিয়ে নিতে থাকে।
স্কাউটশিপের ভেতরে ককপিটে রিশান এবং নীরা ত্রাতিনা শান্ত হয়ে বসে থাকে, খুব ধীরে ধীরে স্কাউটশিপের গতিবেগ বাড়ছে। তারা ত্বরণটুকু অনুভব করতে ব্রু করেছে, মনে হচ্ছে অদৃশ্য কোনো শক্তি চেয়ারের সাথে তাদের চেপে ধরে রেখেছে। নীরা ত্রাতিনা কন্ট্রোল প্যানেলের নানা ধরনের মিটারগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নীরবে অপেক্ষা করতে থাকে। যতই সময় যাচ্ছে ততই তারা এই গ্রহাণুটি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। নিশ্চিত মৃত্যুর মতো যে গ্রহাণুটি পৃথিবীর দিকে ছুটে যাচ্ছে তারা সেটাকে ধ্বংস করার জন্য নিউক্লিয়ার বিস্ফোরক বসিয়ে এসেছে, আর কিছুক্ষণ তার পরেই মহাকাশে ভয়ংকর একটি বিস্ফোরণে সেটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। পৃথিবীর মানুষ কিংবা মহাকাশ স্টেশনের মহাকাশচারীদের সাথে তাদের যোগাযোগ নেই, সত্যি সত্যি যখন গ্রহাণুটি ধ্বংস হয়ে যাবে তখন তাদের আনন্দধ্বনিটুকু তারা শুনতে পাবে না সত্যি কিন্তু সেটা পুরোপুরি অনুভব করতে পারবে।
গ্রহাণু টোরকা যখন বিস্ফোরিত হল স্কাউটশিপের মনিটরে তারা শুধুমাত্র একটা নীল আলোর ঝলকানি দেখতে পেল। বায়ুহীন মহাশূন্যে সেটি ছিল নিঃশব্দ। পুরো গ্রহাণুটি প্রায় ভস্মীভূত হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে যায়। স্কাউটশিপের রেডিয়েশন মনিটরে কয়েক মিনিট গামা-রে রেডিয়েশনের শব্দ শোনা গেল তারপর সেটি পুরোপুরি নিঃশব্দ হয়ে গেল। নীরা ত্রাতিনা এতক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে বসে ছিল, এবার বুকের ভেতর থেকে আটকে থাকা একটা। নিশ্বাসকে বের করে দিয়ে সে রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমরা তা হলে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পেরেছি।
হ্যাঁ। রিশান মাথা নেড়ে বলল, পৃথিবীর আট বিলিয়ন মানুষ সেজন্য এই মুহূর্তে নিশ্চয়ই তোমাকে এবং আমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে।
হতচ্ছাড়া কমিউনিকেশন মডিউলটি ঠিক থাকলে আমরা এখন তাদের কথা শুনতে পেতাম।
ঠিক বলেছ। রিশান বলল, কথা না শুনলেও কি তাদের আনন্দটুকু অনুভব করতে পারছ না?
পারছি। নীরা আতিনা বলল, সত্যি পারছি।
এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি ধরে রাখার জন্য আমাদের বিশেষ একটা কিছু করা দরকার।
নীরা ত্রাতিনা হেসে বলল, তুমি বিশেষ কী করতে চাও?
অন্ততপক্ষে দুজনের খানিকটা উত্তেজক পানীয় খাওয়া দরকার।
এই স্কাউট স্টেশনে খাবার পানি পরিশোধন করে খেতে হয় তুমি উত্তেজক পানীয় কোথায় পাবে?
রিশান বলল, এসব ব্যাপারে আমি খুব বড় এক্সপার্ট! আমাকে দুই মিনিট সময় দাও!
ঠিক আছে। নীরা খিলখিল করে হেসে বলল, তোমাকে দুই মিনিট সময় দেওয়া গেল।
দুই মিনিট শেষ হবার আগেই রিশান কটকটে লাল রঙের দুই গ্লাস পানীয় নিয়ে আসে। দুজন গ্লাস দুটো উঁচু করে ধরে, রিশান বলল, পৃথিবীর মানুষের নবজীবনের উদ্দেশ্যে।
নীরা ত্রাতিনা প্রতিধ্বনিত করে বলল, নবজীবনের উদ্দেশ্যে।
তারপর দুজন তাদের পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দেয়। রিশান হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে বলল, কেমন হয়েছে আমার এই পানীয়?
খেতে মন্দ নয়। তবে
তবে কী?
কেমন জানি ওষুধ ওষুধ গন্ধ।
রিশান হাসার চেষ্টা করে বলল, ওষুধ দিয়ে তৈরি করেছি, একটু ওষুধ ওষুধ গন্ধ তো হতেই পারে।
দুজন আবার তাদের পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দেয়। নীরা ত্রাতিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা শুধু শুধু যে পৃথিবীর মানুষকে রক্ষা করেছি তা নয়, আমরা নিজেরাও বেঁচে গিয়েছি।
রিশান কিছুক্ষণ নীরা ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, প্রায়।
নীরা ত্রাতিনা একটু চমকে উঠে বলল, প্ৰায়?
হ্যাঁ। নীরা, আমরা এখনো পুরোপুরি বেঁচে যাই নি। তোমাকে যে কথাটা বলা হয় নি সেটি হচ্ছে– রিশান হঠাৎ থেমে যায়।
সেটি কী?
আমাদের স্কাউটশিপে যথেষ্ট অক্সিজেন নেই।
কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। সব মিলিয়ে দুজনের আরো কয়েক ঘণ্টা বেঁচে থাকার মতো অক্সিজেন রয়েছে।
নীরা ত্রাতিনা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রিশানের দিকে তাকিয়ে থাকে, হঠাৎ করে তার মাথাটা একটু ঘুরে ওঠে।
রিশান বলল, কাজেই যদি আমরা বেঁচে থাকতে চাই তা হলে আমাদের কিছু অস্বাভাবিক কাজ করতে হবে।
কী অস্বাভাবিক কাজ?
আমাদের শীতল ঘরে ঘুমিয়ে যেতে হবে। শীতল ঘরে শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রায় থাকলে মানুষকে নিশ্বাস নিতে হয় না।
নীরা ত্রাতিনা প্রায় আর্তনাদের মতো করে বলল, কী বলছ তুমি? আমাদের স্কাউটশিপে কোনো শীতল ঘর নেই! তার হঠাৎ করে মনে হতে থাকে সে যেন পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছে না।
রিশান বলল, আছে।
কোথায় আছে?
এই পুরো স্কাউটশিপটাই হবে শীতল ঘর।
পুরো স্কাউটশিপটা– নীরার হঠাৎ মনে হতে থাকে তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে সে যেন ঠিক করে কথা বলতে পারছে না। মনে হতে থাকে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। রিশান কী বলতে চাইছে সে যেন ঠিক করে বুঝতে পারছে না। চোখের সামনে রিশানকেও মনে হতে থাকে যেন অনেক দূরের কোনো মানুষ।
রিশান হঠাৎ একটু এগিয়ে এসে আস্তে করে নীরার হাত ধরে বলল, নীরা! আমি তোমার পানীয়ের মাঝে খুব কড়া একটা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছি।
নীরা ত্রাতিনা বলতে চাইল, কেন? কিন্তু সে বলতে পারল না, টলে উঠে পড়ে যাচ্ছিল, রিশান তাকে ধরে ফেলল।
রিশান তাকে জড়িয়ে ধরে সাবধানে নিচে শুইয়ে দিয়ে বলল, নীরা, সোনামণি আমার! তোমাকে পরিষ্কার করে কখনো বলি নি, আমি যে শুধু তোমাকে খুব পছন্দ করি তা নয় আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। ভালবাসার মতো সুন্দর জিনিস পৃথিবীতে কিছু নেই, তুমি আমাকে সেটা অনুভব করতে দিয়েছ। সেজন্য তোমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
নীরা ত্রাতিনা কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছু বলতে পারল না। তার ঠোঁট দুটো শুধু একবার নড়ে উঠল।
রিশান নীরা ত্রাতিনার মাথার চুল স্পর্শ করে বলল, আমি জানি তুমি ঘুমিয়ে যাচ্ছ। তুমি আবছা আবছাভাবে আমার কথা শুনতে পাচ্ছ। একটু পরে আর শুনতে পাবে না। তোমাকে আমি অসম্ভব ভালবাসি নীরা, তাই তোমাকে আমি কিছুতেই মারা যেতে দেব না। মনে আছে তুমি আমাকে বলেছিলে যে তুমি উনিশ জন সন্তানের মা হতে চাও? তুমি যদি। বেঁচে না থাক তাহলে কেমন করে উনিশ জন সন্তানের মা হবে? তোমাকে বেঁচে থাকতেই হবে নীরা। তোমাকে আমি বাচিয়ে রাখবই।
আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখব। তারপর খুব ধীরে ধীরে তোমার শরীরের তাপমাত্রা আমি কমিয়ে আনব। কেমন করে সেটা করব বুঝতে পারছ? আমাদের এই স্কাউটশিপের বাইরে হিমশীতল, তাই যখনই স্কাউটশিপের তাপ বন্ধ করে দেব এটা ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকবে। কিন্তু সেটা করতে হবে খুব সাবধানে। মানুষের শরীর অসম্ভব কোমল, তাকে খুব যত্ন করে শীতল করতে হয়।
তোমাকে হিমশীতল করে দেবার পর তোমার আর নিশ্বাস নিতে হবে না। স্কাউটশিপে কোনো অক্সিজেন না থাকলেও তুমি বেঁচে থাকবে। আমি নিশ্চিত মহাকাশ স্টেশনের ক্রুরা এই স্কাউটশিপটা খুঁজে বের করবে। তারপর তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে পৃথিবীতে। পৃথিবীর সেরা ডাক্তাররা তোমাকে বাঁচিয়ে তুলবে। আমি নিশ্চিত তারা তোমাকে বাচিয়ে তুলবে।
রিশান নীরার হাত স্পর্শ করে বলল, তুমি নিশ্চয়ই জানতে চাইছ আমার কী হবে? জান নীরা, আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে যখন লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রকে দেখতাম তখন ভাবতাম আহা, আমি যদি একটা নক্ষত্র হতে পারতাম! আজ আমার সেই স্বপ্ন সত্যি হবে। তোমাকে হিমশীতল করে দেবার পর আমি স্পেস সুট পরে এই স্কাউটশিপের দরজা খুলে মহাকাশে ঝাঁপিয়ে পড়ব! নিঃসীম মহাকাশে যেখানে কেউ নেই, চারপাশে ঘন কালো অন্ধকার সেখানে একা ভেসে থাকতে কী বিচিত্র একটা অনুভূতি হবে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব তোমাকে নিয়ে স্কাউটশিপটা দূরে চলে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ছোট একটা বিল্টুর মতো সেটা অদৃশ্য হয়ে যাবে। আমার স্পেস সুটের অক্সিজেন যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ আমি সেই আশ্চর্য একাকিত্ব উপভোগ করব। তারপর আমি আকাশের নক্ষত্র হয়ে যাব। পৃথিবীতে তুমি যখন তোমার উনিশ জন ছেলেমেয়েকে নিয়ে আকাশের দিকে তাকাবে তখন যদি ক্ষণিকের জন্য কোনো একটা অচেনা নক্ষত্রকে দেখ বুঝবে সেটা আমি।
নীরা ত্রাতিনা কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু সে কিছু বলতে পারল না। রিশান দেখল তার অসহায় কালো দুটি চোখ অশ্রুসজল হয়ে আসছে। রিশান ধীরে ধীরে তার মুখ নামিয়ে এনে নীরা ত্রাতিনার ঠোঁট স্পর্শ করল।
.
নীরা ত্রাতিনার স্কাউটশিপটা মহাকাশ স্টেশনের ক্রুরা উদ্ধার করে ভেতরে তার হিমশীতল দেহটি আবিষ্কার করে। সেটি পৃথিবীতে পাঠানো হয় এবং পৃথিবীর একটি সর্বাধুনিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তাকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। রিশানকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায় নি। সম্ভবত সে সত্যি সত্যি আকাশ নক্ষত্র হয়ে হারিয়ে গেছে।
তারপর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। নীরা ত্রাতিনা টেহলিস শহরের কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে গবেষক হিসেবে যোগ দিয়েছে। তার উনিশটি সন্তানের শখ ছিল তার সেই শখ পূরণ হয়নি। রিশানের প্রতি ভালবাসার কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক সে কখনো বিয়ে করে নি– তার স্বামী বা সন্তান কোনোটাই কখনো ছিল না। উনিশটি দূরে থাকুক– একটিও নয়।
তবে সে জানত না মহাকাশের স্কাউটশিপ থেকে উদ্ধার করার পর তাকে পুনরুজ্জীবিত করা যাবে কি না সে বিষয়ে খানিকটা অনিশ্চয়তা থাকার কারণে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা তার খানিকটা টিস্যু সংরক্ষণ করেছিলেন– ভবিষ্যতে কখনো কোনোভাবে তাকে ক্লোন করার জন্য। নীরা ত্রাতিনা বেঁচে গিয়েছিল বলে তাকে ক্লোন করার প্রয়োজন হয় নি। তবে নীরা ত্রাতিনা কখনো জানতে পারে নি যে সবার অগোচরে টেহলিস শহর থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে একটি বিজ্ঞান কেন্দ্রে খুব গোপনে তাকে ক্লোন করা হয়েছিল। চার দেয়ালে আটকে রাখা একটা গোপন ল্যাবরেটরিতে নীরা ত্রাতিনার ক্লোনেরা ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে থাকে।
নীরা ত্রাতিনা জানলে নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে যেত, তার ক্লোনের সংখ্যা কাকতালীয়ভাবে ছিল ঠিক উনিশ জন।
.
মনিটরটি স্পর্শ করতেই প্রায় নিঃশব্দে চিঠিটি স্বচ্ছ পলিমারে ছাপা হয়ে বের হয়ে এল। উপরে বিজ্ঞান কেন্দ্রের লোগো, বাম পাশে কিছু দুর্বোধ্য সংখ্যা, ডান পাশে মহাপরিচালকের নিশ্চিতকরণ হলোগ্রাম। চিঠির ভাষা ভাবলেশহীন এবং কঠোর–আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পরে বছরের একটি মেয়েকে বিজ্ঞান কেন্দ্রের মূল দপ্তরে পৌঁছে দিতে হবে। কেন পৌঁছে দিতে হবে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই, কখনো থাকে না। অন্য চিঠিগুলো থেকে এটা একটু অন্যরকম। নিচে লেখা আছে মেয়েটাকে সুস্থ, সবল ও নীরোগ হতে হবে যেন টেলিস শহরের দূর্গম যাত্রাপথের ধকল সহ্য করতে পারে।
চিঠিটার দিকে তাকিয়ে তিশিনা নিজের ভেতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করে। পলিমারের একটা পৃষ্ঠায় এই নিরীহ কয়েকটা লাইন একটি মেয়ের জীবনকে কী অবলীলায় সমাপ্ত করে দেবে। চার দেয়ালের ভেতরে আটকে রাখা গোপন ল্যাবরেটরিতে বড় হওয়া এই ক্লোন মেয়েগুলো যদি আর দশটি মেয়ের মতো হত তা হলে কি এই আশ্চর্য নিষ্ঠুরতায় বিজ্ঞান কেন্দ্র তাদের এভাবে ব্যবহার করতে পারত? নিশ্চয়ই পারত না। আর সেটি ভেবেই তিশিনার ভেতরে ক্রোধ পাক খেয়ে উঠতে থাকে। একসময় এখানে উনিশ জন মেয়ে ছিল। একজন একজন করে বিজ্ঞান কেন্দ্র আট জন মেয়ে নিয়ে গেছে। এখন আছে মাত্র এগার জন।
তিশিনা একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল, আমি এই কাজের উপযুক্ত নই। ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা ক্লোনকে মানুষের মর্যাদা দেওয়া হয় নি, তাদের সঙ্গে নিজের একাত্মবোধ করার কথা নয়। ল্যাবরেটরির গিনিপিগ এবং এই মেয়েগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এই মেয়েগুলোর ব্যাপারে তার হওয়ার কথা নির্মোহ এবং পুরোপুরি উদাসীন। কিন্তু তিশিনা খুব ভালো করেই জানে, সেটি সম্ভব নয়। যারা দূরে বসে তথ্যকেন্দ্রের সংখ্যা থেকে এদের হিসাব রাখে তারা নির্মোহ হতে পারে, উদাসীন হতে পারে। কিন্তু তার মতো একজন সুপারভাইজার–যাকে প্রায় প্রতিদিন মেয়েগুলোর সঙ্গে সময় কাটাতে হয়, তারা কেমন করে নির্মোহ হবে? কেমন করে উদাসীন হবে? এরকম হাসিখুশি প্রাণবন্ত মেয়েদের। জন্য গভীর মমতা অনুভব না করাটাই তো বিচিত্র। যারা ক্লোনদের নিয়ে এই গোপন প্রোগ্রামটি শুরু করেছিল তারা কি বিষয়টি ভাবে নি?
তিশিনা চিঠিটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল, একটি মেয়েকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাকে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছে। তার এখনই গিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। মেয়েগুলোর সঙ্গে দেখা করে একজনকে বেছে নিতে হবে। কী নিষ্ঠুর একটা কাজ, অথচ তিশিনা জানে কী সহজেই না সে এই কাজটি শেষ করবে!
ক্লোন হোস্টেলের বড় গেটটি ভোলার জন্য তিশিনাকে গোপন পাসওয়ার্ড ব্যবহার প্রতে হল। ভেতরের দুর্ভেদ্য দরজাগুলো খোলার জন্য পাসওয়ার্ড ছাড়াও তার আইরিস স্ক্যান করিয়ে নিতে হল। লম্বা করিডরের অন্যপাশে একটা বড় হলঘর, সেখানে ক্লোন মেয়েগুলো কিছু একটা করছিল, দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সবাই ছুটে এল। ফুটফুটে চেহারা, একমাথা কালো চুল, মসৃণ ত্বক, ঠোঁটগুলো যেন অভিমানে কোমল হয়ে আছে। সব মিলিয়ে এগার জন, সবাই হুবহু একই চেহারার। শত চেষ্টা করেও কখনো তাদের আলাদা করা সম্ভব নয়। তিশিনা তাই কখনো চেষ্টা করে না। মেয়েগুলো তিশিনাকে গোল হয়ে ঘিরে ধরে। একজন হাত দিয়ে তাকে স্পর্শ করে বলল, ইস! তিশিনা আজকে তোমাকে দেখতে একেবারে স্বর্গের দেবীর মতো সুন্দর লাগছে।
তিশিনা হেসে ফেলল, যৌবনে হয়তো চেহারায় একটু মাধুর্য ছিল, কিন্তু এখন এই মধ্যবয়সে তার কিছু অবশিষ্ট নেই। তার ধূসর চুল, শুষ্ক ত্বক আর ক্লান্ত দেহে এখন আর কোনো সৌন্দর্য নেই। তিশিনা বলল, স্বর্গের দেবীরা তোমাদের কথা শুনলে কিন্তু খুব রাগ করবে, মেয়েরা।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে বলল, কেন রাগ করবে? আমরা কি মিথ্যে কথা বলছি?
পাশের মেয়েটি বলল, এতটুকু মিথ্যে বলি নি। তুমি যখন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আস তখন আমাদের কী আনন্দ হয় তুমি জান?
প্রথম মেয়েটি বলল, সেজন্যই তো তোমাকে আমাদের স্বর্গের দেবী বলে মনে হয়।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি মেয়ে আদুরে গলায় বলল, আজকে তোমার। আমাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ থাকতে হবে।
অন্যরা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেকক্ষণ। অনেকক্ষণ।
আমরা আজকে একসঙ্গে খাব তিশিনা। ঠিক আছে?
তিশিনা একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি আসলে এসেছি একটা কাজে।
কাজে?
একসঙ্গে সবগুলো মেয়ের চোখেমুখে বিষাদের একটা ছায়া পড়ে। তাদের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর কাজ মাত্র একটিই হতে পারে তাদের কাউকে বাইরে যেতে হবে। এই গোপন ল্যাবরেটরি থেকে যারা বাইরে যায় তারা আর কখনো ফিরে আসে না।
হ্যাঁ। তিশিনা মেয়েগুলোর দৃষ্টি এড়িয়ে বলল, একটা জরুরি কাজে এসেছি।
কী কাজ, তিশিনা?
বিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে চিঠি এসেছে। তিশিনা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমাদের একজনকে আমার নিয়ে যেতে হবে।
ফুটফুটে মেয়েগুলো কয়েক মুহূর্ত নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। একজন খুব কষ্ট করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমার কী মনে হয় জান তিশিনা?
কী মনে হয়?
মেয়েটি মুখে হাসিটি ধরে রেখে বলল, আমার মনে হয়, এটি আমাদের খুব বড় সৌভাগ্য।
তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, অনেক বড় সৌভাগ্য।
একজন একজন করে আমরা সবাই বিজ্ঞান কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি।
বিজ্ঞান কেন্দ্রে নিশ্চয়ই খুব মজা হয়। তাই না?
হ্যাঁ। প্রথম মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, নিশ্চয়ই খুব মজা হয়। কত রকম মানুষের সঙ্গে দেখা হয়।
বাইরের মানুষেরা খুব ভালো, তাই না তিশিনা?
তিশিনা কী বলবে বুঝতে না পেরে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। মেয়েটি উজ্জ্বল চোখে বলল, আমাদের এখানেও আমাদের খুব সুন্দর একটা জীবন। সবাই মিলে খুব আনন্দে থাকি। যখন আমরা বাইরে যাই, তখন আমাদের আনন্দের সঙ্গে যোগ হয় উত্তেজনা।
সবগুলো মেয়ে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। উত্তেজনা, সত্যিকারের উত্তেজনা।
তিশিনা এক ধরনের গভীর বেদনা নিয়ে মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েগুলো অসম্ভব বুদ্ধিমতী, সত্যিকার ব্যাপারটি তারা বুঝতে পারে না তা নয়, সেটা তারা প্রকাশ করে না। অনেকটা জোর করে এই নিষ্ঠুর বিষয়টির মধ্যে আনন্দ খুঁজে বের করার ভান করে। একটি মেয়ে তিশিনার হাত ধরে বলল, তিশিনা, তুমি কি জান, বিজ্ঞান কেন্দ্রে আমাদের কী করতে দেবে?
তিশিনা মাথা নাড়ল, বলল, না, জানি না। তবে
তবে কী?
চিঠিতে লেখা আছে আমি যেন সুস্থ, সবল, নীরোগ একজনকে বেছে নিই।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কেন তিশিনা?
কারণ তাকে টেহলিস শহরে যেতে হবে।
মেয়েগুলো এবারে বিস্ময়ের একটি শব্দ করল, বলল, সত্যি? সত্যি টেহলিস শহরে যেতে হবে?
হ্যাঁ। টেহলিস শহর অনেক দূরে। এখন সেখানে যাওয়া খুব কঠিন।
আমাদেরকে এরকম কঠিন একটা অভিযানে নেবে?
হ্যাঁ। তিশিনা মাথা নাড়ল, তোমাদের একজনকে সেখানে যেতে হবে।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল, আমি বলেছিলাম না, পুরো বিষয়টাই উত্তেজনার। মেয়েটা তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই দেখ, চিন্তা করেই আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠছে।
তিশিনা মেয়েটার হাত স্পর্শ করে বলল, বিজ্ঞান কেন্দ্র আমাকে খুব বেশি সময় দেয় নি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমার একজনকে বেছে নিতে হবে।
মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা?
হ্যাঁ তিশিনা এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, তোমাদের মধ্যে কে যেতে চাও?
মেয়েগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। সবাই দেখতে যেমন হুবহ এক, তাদের চিন্তাভাবনাও ঠিক একই রকম। জন্মের পর থেকে তারা পাশাপাশি বড় হয়েছে, এখন তারা এমন একটা পর্যায়ে এসে গেছে যে, একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝে ফেলতে পারে কে কী ভাবছে। একজন নরম গলায় বলল, তিশিনা, তুমি আমাদের জন্য এরকম চমৎকার একটা সুযোগ নিয়ে এসেছ, সেজন্য তোমার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা সবাই টেহলিস শহরে যেতে চাই। কিন্তু বিজ্ঞান কেন্দ্র তো মাত্র একজনকে চেয়েছে।
তিশিনা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। একজনকে চেয়েছে।
মেয়েটি বলল, তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে তা হলে আমরা কি সেটা নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করতে পারি?
হ্যাঁ। পার।
তা হলে খুব ভালো হয়, তিশিনা। আগামীকাল তুমি যখন আমাদের একজনকে নিতে আসবে আমরা একজন তখন তোমার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকব।
চমৎকার। তিশিনা একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, মেয়েরা, আমি কি এখন যেতে পারি? বিজ্ঞান কেন্দ্রে যাওয়ার আগে আমার কিছু আনুষ্ঠানিক কাজ করতে হয়।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল, আমরা ভেবেছিলাম তুমি আজ আমাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ থাকবে তিশিনা?
নিশ্চয়ই থাকব একদিন। আজ নয়। ঠিক আছে?
মেয়েগুলো মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। তিশিনা করিডর ধরে হাঁটতে শুরু করে, মেয়েগুলো আজকে আর অন্যদিনের মতো তার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এল না। তিশিনাও আজ পেছন ফিরে তাকাল না। সেও জানে, আজ পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পাবে ফুটফুটে মেয়েগুলো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, চোখেমুখে কী গভীর বিষাদের ছায়া!
৩. বিজ্ঞান কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি
বিজ্ঞান কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে দীর্ঘ সময় লেগে গেল। এই মেয়েগুলো একটা গোপন প্রজেক্ট, তাদের সম্পর্কে কোথাও কোনো তথ্য নেই। নিরাপত্তাকর্মীরা যেন কোন সমস্যা না করে সেজন্য বিশেষ অনুমতিপত্রের ব্যবস্থা করতে হল। গোপন ল্যাবরেটরির চার দেয়ালের ভেতরে থাকে বলে মেয়েগুলোর বাইরের জীবন সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই জরুরি কাজে লাগতে পারে সেরকম কিছু জিনিসপত্র একটা ব্যাগে গুছিয়ে নিতে হল। পুরো ব্যাপারটি গোপন তাই তার নিজেকেই একটা গাড়ি করে নিয়ে যেতে হবে, গাড়ির জ্বালানি, নির্দিষ্ট পথে যাওয়ার অনুমতি নেটওয়ার্ক থেকে ডাউনলোড করে নিতে হল। ঠিক কী কাজে এই মেয়েটিকে ব্যবহার করবে জানা নেই, তাই তিশিনা মেয়েটির সকল তথ্য একটা ক্রিস্টালে জমা করে নিল।
পরদিন তিশিনা আবার যখন ল্যাবরেটরির ভারী দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছে তখন করিডরে সব কয়টি মেয়ে প্রায় জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েগুলো সুন্দর করে। সেজেছে, চুলগুলো পরিপাটি করে বাধা। তাদের জামাকাপড় খুব বেশি নেই, তার মাঝে সবচেয়ে ভালো পোশাকটি তারা পরেছে। দরজার কাছাকাছি একটা ব্যাগ। সেখানে হয়তো দৈনন্দিন প্রয়োজনের জিনিসগুলো রেখেছে।
তিশিনা কয়েক মুহূর্ত মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে যাবে সেটা কি ঠিক করেছ?
মেয়েগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি নিচু গলায় বলল, আসলে আমাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোনো পার্থক্য নেই। তাই যে কোনো একজন তোমার সঙ্গে যাবে।
কিন্তু সেটি কে?
সেটি আমরা একেবারে শেষ মুহূর্তে ঠিক করব তিশিনা।
এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে বলল, তোমার যেন সময় নষ্ট না হয় সেজন্য আমরা সবাই পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে আছি।
সামনের মেয়েটি বলল, আমাদের ব্যাগটিও প্রস্তুত করে রেখেছি। তুমি ডাকলেই আমাদের একজন এসে ব্যাগটি তুলে নিয়ে তোমার সঙ্গে বের হয়ে যাবে।
তিশিনা কোমল গলায় বলল, আমি বুঝতে পারছি, মেয়েরা। আমি তোমাদের সঙ্গে থাকলে মনে হয় এটাই করতাম।
আমাদের সবাই একরকম, সবাই একসঙ্গে থাকি, একভাবে কথা বলি, একতাবে ভাবি। এত দিন এভাবে আছি যে, এখন মনে হয় আমরা সবাই মিলে বুঝি একজন মানুষ।
তাই আমাদের একজন যখন আমাদের ছেড়ে চলে যায় তখন আমাদের খুব কষ্ট হয়। আমরা কষ্টের মুহূর্তটাকে যতদূর সম্ভব বিলম্বিত করতে চাই।
তিশিনা মাথা নাড়ল, বলল, আমি বুঝতে পারছি।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল, যে তোমার সঙ্গে যাবে তার জীবনটি হবে অন্যরকম।
নিশ্চয়ই তার জীবনটি হবে সুন্দর। সুন্দর এবং উত্তেজনাময়।
একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা তাকে স্পর্শ করে রাখতে চাই তিশিনা।
তিশিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সেই শেষ মুহূর্তটা এসে গেছে। তোমাদের একজন এখন এস আমার সঙ্গে।
মেয়েগুলো তখন হাত তুলে একজন আরেকজনকে শক্ত করে ধরে ধরে চোখ বন্ধ করল, তাদের দেখে মনে হয় তারা বুঝি উপাসনা করছে। ঠিক কীভাবে তারা ঠিক করল তিশিনা বুঝতে পারল না। কিন্তু হঠাৎ মাঝামাঝি জায়গা থেকে একজন এগিয়ে এসে তিশিনার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, চল তিশিনা।
তুমি যাবে?
হ্যাঁ। মেয়েটি ব্যাগটি হাতে তুলে নিয়ে বলল, আমি প্রস্তুত।
তিশিনা ভেবেছিল মেয়েটি হয়তো অন্য মেয়েগুলোর কাছ থেকে বিদায় নেবে, কিন্তু সেরকম কিছু করল না। এরা একজনের সঙ্গে আরেকজন মুখে কোনো কথা না বলেই অনেক কিছু বলে দিতে পারে, নিশ্চয়ই সেরকম কিছু একটা হয়েছে। সম্ভবত সেভাবেই সে বিদায় নিয়েছে।
অন্য দশজন মেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, সামনের মেয়েটি বলল, আমাদের কখনো কোনো নামের প্রয়োজন হয় না, কারণ আমরা সবাই মিলে আসলে একজন মানুষ। কিন্তু যখন কাউকে চলে যেতে হয় তখন তার একটা নামের প্রয়োজন হয়।
অন্য পাশ থেকে আরেকটি মেয়ে বলল, আমরা তাই অনেক ভেবে একটা নাম ঠিক করেছি। নায়ীরা।
নায়ীরা, তোমার সঙ্গে অনেক মানুষের পরিচয় হবে। তারা হবে সুন্দর মনের মানুষ। তাদের ভালবাসা পাবে তুমি।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল তোমার সঙ্গে রাজপুত্রের মতো কোনো এক সুদর্শন তরুণের পরিচয় হবে। সেই রাজপুত্রের মতো সুদর্শন তরুণের হৃদয়ে থাকবে ভালবাসা। তার ভালবাসায় তোমার জীবন পরিপূর্ণ হবে।
পাশের মেয়েটি বলল, নায়ীরা, তোমার সঙ্গে সম্ভবত আমাদের আর যোগাযোগ হবে না। আমরা সবকিছু কল্পনা করে নেব। তোমার জীবনে আনন্দের কী ঘটছে, উত্তেজনার কী ঘটছে, ভালবাসার কী ঘটছে আমরা সেগুলো কল্পনা করে নেব।
তার পাশের মেয়েটি বলল, আমরা বিদায় কথাটি উচ্চারণ করব না। কারণ আমরা তোমাকে বিদায় দিচ্ছি না। তুমি আমাদের সঙ্গেই আছ। তুমি আমাদের মাঝখানেই আহ নায়ীরা।
সামনের মেয়েটি বলল, আমরাও তোমার মাঝেই থাকব। আমাদের সবাইকে তুমি তোমার মাঝে পাবে। সব সময় পাবে।
নায়ীরা ফিসফিস করে বলল, আমি জানি। তার চোখে পানি টলটল করছে, সে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ দুটো মুছে তিশিনার দিকে তাকাল। তিশিনা তার হাত ধরে বলল, চল, নায়ীরা।
ঘড়ঘড় শব্দ করে পেছনের দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতেই নায়ীরা দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তিশিনা নায়ীরার পিঠে হাত রেখে বলল, মন খারাপ করো না নায়ীরা, দেখো, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
আসলে কিছুই ঠিক হবে না, কিন্তু তিশিনার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল যে সত্যিই বুঝি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। নায়ীরা কোনো কথা বলল না, হেঁটে যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে তাকাল। গোপন ল্যাবরেটরির ভারী দরজার ওপাশে যাদের সে ফেলে এসেছে তারা ভিন্ন কোনো মানুষ নয়, তারা সবাই সে নিজে। একজন মানুষকে যখন নিজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হয় সেই কষ্টটার কথা অন্য কেউ জানে না। পৃথিবীর অন্য কেউ কোনো দিন সেটা বুঝতেও পারবে না।
.
বিজ্ঞান কেন্দ্রের ভেতরে ক্লোন গবেষণা বিভাগের দরজায় দাঁড়িয়ে তিশিনা নায়ীরার হাত স্পর্শ করে বলল, আমাকে এখন যেতে হবে নায়ীরা।
নায়ীরা নিচু গলায় বলল, আমি জানি।
তোমার জন্য অনেক শুভকামনা থাকল।
তোমাকে ধন্যবাদ। আমাদের জন্য তুমি যেটুকু করেছ সেজন্য অনেক ধন্যবাদ।
আমি তোমাদের জন্য কিছু করি নি নায়ীরা।
নায়ীরা ম্লান হেসে বলল, করেছ, তিশিনা। আমরা আসলে মানুষ নই, আমরা মানুষের ক্লোন। কিন্তু তুমি কখনো সেটা আমাদের বুঝতে দাও নি। তুমি সব সময় আমাদের মানুষ হিসেবে সম্মান দেখিয়েছ, মানুষ হিসেবে ভালবেসেছ।
তিশিনা ফিসফিস করে বলল, তোমরা ক্লোন হও আর যা-ই হও, আসলে তো তোমরা মানুষ। একটি কথা জান নায়ীরা?
কী কথা?
যে মহিলার ক্রোমোজম ব্যবহার করে তোমাদের ক্লোন করা হয়েছে সেই মহিলাটি ছিলেন অসম্ভব রূপসী, অসম্ভব বুদ্ধিমতী এবং অসম্ভব তেজস্বী। তার ভেতরে এমন একটি সহজাত নেতৃত্ব ছিল যে, প্রয়োজনে তার চারপাশের সবাই সব সময় তার নেতৃত্ব মেনে নিত। তিনি একজন অসাধারণ মহিলা ছিলেন।
নায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, আমি শুনেছি।
তিনি এখন কোথায় আছেন জানি না। তিনি যদি তোমাদের দেখতে পেতেন তা হলে খুব কষ্ট পেতেন। তার মতো একজনের জীবনে অনেক বড় কিছু করার কথা। ক্লোন হয়ে গবেষণা কেন্দ্রে গিনিপিগ হওয়ার কথা নয়।
নায়ীরা মাথা নেড়ে বলল, সেই অসাধারণ মহিলার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ তিশিনা। কারণ তার নিশ্চয়ই অনেক ধৈর্যও ছিল, আমাদেরও অনেক ধৈর্য। আমরা সবকিছু মেনে নিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারি।
তিশিনা খপ করে নায়ীরার হাত ধরে জ্বলজ্বলে চোখে বলল, আমি কী চাই জান?
কী?
আমি চাই তোমাকে যখন টেহলিস শহরে পাঠাবে তখন সেই অভিযানে একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটুক।
নায়ীরা চোখ বড় করে বলল, সে কী!
হ্যাঁ। সেই দুর্ঘটনায় সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাক। তখন তুমি সেখানে নেতৃত্ব দাও, নেতৃত্ব দিয়ে সবকিছু ঠিক করে দাও। বিজ্ঞান কেন্দ্রের সবাই সেটা দেখুক। দেখে হতবাক হয়ে যাক।
নায়ীরা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন ঘরের ভেতর থেকে একজন বের হয়ে এসে বলে, ক্লোন তিন শ নয়, চেকআপ করতে এস।
নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে। এখানে তার পরিচয় ক্লোন তিন শ নয় হিসেবে সে তিশিনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, বিদায় তিশিনা।
তিশিনা ফিসফিস করে বলল, আমি তোমার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব। সব সময় প্রার্থনা করব।
নায়ীরা মাথা ঘুরিয়ে ঘরের ভেতরে তাকাল, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে বলল, আমি প্রস্তুত। কোথায় যেতে হবে?
আমার সঙ্গে এস।
তিশিনা দরজার কাছে পাড়িয়ে থেকে দেখল, নায়ীরা ধীর এবং অনিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে। গোলাকার একটা দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল, বিজ্ঞান কেন্দ্রের মানুষটির পিছু পিছু নায়ীরা এগিয়ে যায়, দরজাটি আবার বন্ধ হয়ে গেল। তিশিনা তার বুকের ভেতর আটকে থাকা নিশ্বাসটি বের করে নিচু গলায় বলল, হে ঈশ্বর, তুমি এই মেয়েটিকে দয়া করো। সে বড় দুঃখী। দোহাই তোমার।
.
স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো বড় টেবিলে নায়ীরা শুয়ে আছে, তার ওপর একজন বয়স্ক মানুষ ঝুঁকে পড়ে তাকে পরীক্ষা করছে। তার কাছাকাছি আরো দুইজন মানুষ। একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। বয়স্ক মানুষটি জিব দিয়ে একটা বিস্ময়ের শব্দ করে বলল, এই মেয়েটির দেহ আশ্চর্য রকম নিখুঁত।
মহিলাটি শব্দ করে হেসে বলল, ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হলে তুমিও এরকম নিখুঁত হতে ড. ইলাক।
ড. ইলাক নামের বয়স্ক মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, সেটা তুমি ঠিকই বলেছ।
মহিলাটি বলল, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ক্লোন হিসেবে এরকম নিখুঁত একজন মানব কিংবা মানবী তৈরি করা এক ধরনের অপচয়।
ড. ইলাক বলল, আমরা যে কাজে একে ব্যবহার করব তার জন্য একটি নিখুঁত দেহ দরকার।
নায়ীরা নিঃশব্দে তাদের কথোপকথন শুনছিল, সে সত্যিকারের মানুষ নয়, তার হয়তো নিজে থেকে কোনো কথা বলার নয়, কিন্তু সে তবুও কথা বলল। জিজ্ঞেস করল, আমাকে তোমরা কী কাজে ব্যবহার করবে?
এক মুহূর্তের জন্য ঘরের তিন জন মানুষ একটু থমকে দাঁড়াল। মনে হল তারা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। ড. ইলাক ইতস্তত করে বলল, তোমার এখন সেটি জানার কথা নয় মেয়ে।
আমার নাম নায়ীরা।
মহিলাটি খনখনে গলায় বলল, তোমার কোনো নামও থাকার কথা নয়।
নায়ীরা একটু চেষ্টা করে তার মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, কিন্তু আমার নাম আছে। আমার মনে হয় নায়ীরা খুব সুন্দর একটি নাম।
ড. ইলাক বলল, নায়ীরা নামটি সুন্দর না অসুন্দর সেটি নিয়ে আলোচনা করার কোনো অর্থ নেই। বিষয়টি তোমাকে নিয়ে। তোমার নিজে থেকে প্রশ্ন করার কথা নয়।
ড. ইলাকের কথা শুনে নায়ীরা শব্দ করে হাসল। ড. ইলাক থতমত খেয়ে বলল, তুমি হাসছ কেন?
তোমার কথা শুনে।
আমার কোন কথাটি হাস্যকর?
নায়ীরা মুখ টিপে হেসে বলল, আমার নিজ থেকে কোনো প্রশ্ন করার কথা নয় সেটি আমার কাছে কৌতুকের মতো মনে হয়।
ড. ইলাক অবাক হয়ে বলল, কেন? কেন কথাটি তোমার কাছে কৌতুকের মতো মনে হয়? তুমি মানুষ নও, তুমি একটি ক্লোন।
কিন্তু আমি এমন একটি মানুষের ক্লোন, যার বুদ্ধিমত্তা সম্ভবত তোমাদের সবার থেকে বেশি। যার প্রতিভা নিশ্চিতভাবে তোমাদের প্রতিভার চেয়ে বেশি।
নায়ীরার কথা শুনে উপস্থিত তিন জন মানুষই কেমন যেন থতমত হয়ে যায়। মহিলাটি খনখনে গলায় বলল, তুমি কেমন করে সেটা জান?
আমি আরো অনেক কিছু জানি। হয়তো সবকিছু আমার জানার কথা নয়, তবু আমি জানি। একজন মানুষ জোর করে নির্বোধ হয়ে থাকতে পারে না।
মহিলাটি খনখনে গলায় আবার কোনো একটা কথা বলতে শুরু করতে চাইছিল কিন্তু ড. ইলাক হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কে বেশি প্রতিভাবান, কে বেশি বুদ্ধিমতী এসব আলোচনা থাকুক। তোমাকে একটা বিশেষ কাজে আনা হয়েছে, সেই কাজের জন্য তোমাকে যেটুকু জানানোর প্রয়োজন হবে তোমাকে যেটুকু জানানো হবে মেয়ে।
আমার নাম নায়ীরা।
ড. ইলাক কোনো কথা না বলে শরীরের অভ্যন্তরে রক্তনালি ও নার্ভন্তু পরীক্ষা করার যন্ত্রটি নিয়ে নায়ীরার ওপরে ঝুঁকে পড়ল। নায়ীরা মনে মনে ফিসফিস করে নিজেকে বলতে থাকে, আমি নায়ীরা। আমি নায়ীরা, ক্লোন প্রক্রিয়ায় আমার সৃষ্টি করা হতে পারে, কিন্তু আমি মানুষ। আমি শতকরা এক শ ভাগ মানুষ। আমি মানুষ নায়ীরা।
.
নায়ীরা তার ঘরের ছোট জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। বিজ্ঞান কেন্দ্রে আসার পর যখন তার শরীরকে নানা যন্ত্রপাতি দিয়ে বিশ্লেষণ করা না হয় তখন তাকে এই ঘরটির ভেতর থাকতে হয়। ঘরটি অপূর্ব, খুব আরামে থাকার জন্য একটা ঘরে যা যা থাকা প্রয়োজন এখানে তার সবকিছু আছে, কিন্তু তবুও সে হাঁপিয়ে ওঠে। তার খুব সৌভাগ্য যে তাকে একটা ভিডিও স্ক্রিন দেওয়া হয়েছে, সেটি এখানকার মূল তথ্যকেন্দ্রের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া আছে। নায়ীরা নিশ্চিত, তথ্যকেন্দ্রের খুব ছোট এবং অপ্রয়োজনীয় একটি অংশ সে। দেখতে পায়। বিজ্ঞান কেন্দ্রের সত্যিকার তথ্য তার কাছ থেকে সযত্নে আড়াল করে রাখা হয়েছে। যেটুকু দেখতে পায় সেটুকুই সে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখে।
দরজায় খুট করে একটি শব্দ হল, নায়ীরা ঘুরে তাকিয়ে দেখে মধ্যবয়স্ক পরিচারিকাটি তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিতে দিতে বলল, তুমি কিন্তু ঠিক করে খাচ্ছ না।
আমি একা একা খেয়ে অভ্যস্ত নই। নায়ীরা একটু হেসে বলল, তুমি আমার সঙ্গে খাবে?
পরিচারিকাটি হাসল, বলল, উঁহু। নিয়ম নেই।
নায়ীরা মাথা নেড়ে বলল, শুধু নিয়ম আর নিয়ম। এত নিয়ম আমার ভালো লাগে না।
ভালো না লাগলেও মানতে হয়। আজকে খাওয়া শেষ কর। ফলের রসটুকুতে একটা অন্যরকম ঝুঁজ দেওয়া হয়েছে, দেখবে খুব মজার।
দেখব। নিশ্চয়ই দেখব।
খাওয়া শেষ করে প্রস্তুত থেকো। তোমার সঙ্গে আজকে দীর্ঘ সেশন হবে।
চমৎকার। নায়ীরা বলল, এই চার দেয়ালের ভেতর আমি হাঁপিয়ে উঠছি।
পরিচারিকাটি চলে যাওয়ার পর নায়ীরা আবার জানালার কাছে এগিয়ে যায়। তার এখন খেয়ে প্রস্তুত হয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু তার কিছু করার ইচ্ছে করছে না। ঘুরেফিরে তার শুধু তার বোনদের কথা মনে পড়ছে। এগার জন মিলে ছিল তাদের অস্তিত্ব। এখন সে একা। এই নিঃসঙ্গতাটুকু যে কী ভয়ানক সেটা কি কেউ কখনো জানতে পারবে? গভীর বিষাদে নায়ীরার বুকের ভেতরটুকু হাহাকার করতে থাকে।
.
একটি কালো গ্রানাইটের টেবিলের একপাশে নায়ীরা বসেছে, তার সামনে চার জন মানুষ। দুজন পুরুষ, দুজন মহিলা। চার জনের ভেতর শুধু ড. ইলাককে সে আগে দেখেছে, অন্যদের এই প্রথমবার দেখছে। চার জন মানুষ পুরোপুরি ভিন্ন মানুষ, কিন্তু তবু তাদের ভেতরে একটি মিল রয়েছে, মিলটি কী সে ঠিক বুঝতে পারছে না।
কঠিন চেহারার একজন মহিলা কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, ক্লোন তিন শ নয়-
নায়ীরা বাধা দিয়ে বলল, আমার নাম নায়ীরা।
মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, আমাকে কথা শেষ করতে দাও। কিছুক্ষণ নায়ীরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মহিলাটি একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমাকে কেন এখানে আনা হয়েছে এবং তোমাকে কী দায়িত্ব দেওয়া হবে সে বিষয়টি তোমাকে জানানোর জন্য এখানে আমরা একত্র হয়েছি। আমরা চার জন ভিন্ন ভিন্ন দপ্তরের। আমি বিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রধান রুবা। এ ছাড়াও এখানে আছেন সামরিক বাহিনীর কমান্ডার গ্রুশান এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মহাপরিচালক জিনা। চিকিৎসা কেন্দ্রের ড. ইলাককে তুমি আগেই দেখেছ। যাই হোক, তুমি নিশ্চয়ই টেহলিস শহঁরের নাম শুনেছ। টেহলিস শহর আমাদের সভ্যতার কেন্দ্রভূমি। আমাদের শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞান বা গবেষণা সব টেলিস শহরকেন্দ্রিক। টেলিস শহর এখান থেকে মাত্র দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে। কিন্তু তবু সেটি আমাদের থেকে অনেক দূরে। কারণ টেহলিস শহর আর আমাদের মাঝখানে রয়েছে অবমানবের বসতি।
বিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রধান কঠিন চেহারার মহিলা রুবা একটি লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই অবমানবের নাম শুনেছ। তারা একসময় চেষ্টা করেছিল পরামানব হতে। মানুষের বিবর্তনকে দ্রুততর করে তারা এমন কিছু ক্ষমতা অর্জন গ্রতে চেয়েছিল, যেটি প্রকৃতি তাদের দিতে রাজি হয় নি। ভয়ংকর সেই পরীক্ষার ফল তারা দিয়েছে নিজেদের পুরো জীবন দিয়ে। তারা বিকলাঙ্গ, অপুষ্ট, অপরিণতবুদ্ধির জটিল একটা প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। তারা অতিমানব বা পরামানব হয় নি। তারা হয়েছে অবমানব। অবমানবের বিভিন্ন রূপ সম্ভবত তোমার একবার দেখা উচিত।
নায়ীরা বলল, আমি দেখেছি।
রুবা একটু অবাক হয়ে বলল, তুমি কোথায় দেখেছ?
আমার ঘরে একটা ভিডিও স্ক্রিন আছে। সেটা মূল তথ্যকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। আমি সেখানে দেখেছি।
হাসিখুশি চেহারার একজন মানুষ, যে সম্ভবত সামরিক বাহিনীর কমান্ডার গ্রুশান, হালকা গলায় বলল, চমৎকার। তা হলে আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে গেল। তুমি নিশ্চয়ই অবমানবের সঙ্গে আমাদের বিরোধের বিষয়টি জান।
হ্যাঁ জানি।
একজন মানুষ যত বড় হয় তত বেশি সে উদারতা দেখাতে পারে। অবমান বড় হতে পারে নি। তাদের ভেতরে উদারতা বা ভালবাসার মতো বড় কোনো গুণ নেই। তাদের সমস্ত শক্তি সমস্ত ক্ষমতা একত্র করেছে আমাদের ধ্বংস করার জন্য। কমান্ডার শান নামের হাসিখুশি মানুষটিকে হঠাৎ কেমন যেন বিষণ্ণ দেখায়, অবমানবরা আমাদের সমান নয়। কোনো দিক দিয়েই আমাদের সমান নয়, কিন্তু তারপরও আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। আমাদের সীমান্তে সব সময় সশস্ত্র সেনাবাহিনী। আমাদের অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হয় এবং সবচেয়ে দুঃখের কথা, আমরা আমাদের প্রিয় শহর টেলিসে যেতে পারি না। অবমানব আমাদের যেতে দেয় না। যদি কখনো যেতে হয় আমাদের আমরা যাই ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়ে।
নায়ীরা একটু সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল, আমাকে সেজন্য টেহলিস শহরে পাঠাতে চাইছ? একজন মূল্যবান মানুষের জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে মূল্যহীন একজন ক্লোনের জীবনের ঝুঁকি নেওয়া?
দ্বিতীয় মহিলাটি যে সম্ভবত নিরাপত্তা বাহিনীর মহাপরিচালক জিনা স্থির চোখে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ইচ্ছে করলে ব্যাপারটাকে এভাবেও দেখতে পার।
নায়ীরা জিজ্ঞেস করল, টেহলিস শহরে আমাকে কী নিয়ে যেতে হবে?
জিনা বলল, একটি অত্যন্ত গোপনীয় তথ্য।
সেটি আমি কীভাবে নেব?
তোমার মস্তিষ্কে করে।
নায়ীরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল আমার মস্তিষ্কে করে?
হ্যাঁ। আমরা তোমার মস্তিষ্কে সেটা প্রবেশ করিয়ে দেব। তুমি সেটা জানবে না।
নায়ীরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। ড. ইলাক মুখে হাসি টেনে বলল, আমরা তোমার দেহ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছি। তোমার দেহ নিখুঁত, নীরোগ এবং সুস্থ। তোমার মস্তিষ্ক এই তথ্য নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। তুমি তোমার মস্তিষ্কে করে এই তথ্য নিয়ে সুদীর্ঘ যাত্রা শেষ করতে পারবে বলে আমার ধারণা।
নায়ীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমাকে কি একা টেহলিস শহরে যেতে হবে?
কঠিন চেহারার ক্রানা শব্দ করে হেসে ফেলল এবং হাসির কারণে হঠাৎ করে তার মুখের কাঠিন্য সরে যায়। সে হাসি হাসি মুখে বলে, না। তোমার পক্ষে একা যাওয়া সম্ভব। হবে না। একজন গাইড তোমাকে নিয়ে যাবে।
এই গাইড মানুষটিও কি আমার মতো ক্লোন?
রুবার মুখ থেকে হাসি হঠাৎ সরে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে আগের কাঠিন্যটুকু ফিরে আসে। সে কঠিন মুখে বলে, আমরা তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে যোগ করে, তোমার কি অন্য কোনো প্রশ্ন আছে?
নায়ীরা মাথা নাড়ল, আছে।
কী প্রশ্ন?
আমি সেই প্রশ্নটি করতে চাইছি না।
কেন?
আমার ধারণা, তোমরা সেই প্রশ্নেরও উত্তর দেবে না।
মহিলাটি কঠিন মুখে বলল, তুমি জিজ্ঞেস করে দেখ।
নায়ীরা একটু হেসে বলল, তোমরা কেন আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছ?
কয়েক মুহূর্ত ঘরের সবাই চুপ করে থাকে। কঠিন চেহারার রুবা সোজা হয়ে বসে কঠিন গলায় বলল, আমরা তোমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছি না, মেয়ে।
নায়ীরাও সোজা হয়ে বসে বলল, আমার নাম নায়ীরা।
.
ড. ইলাক নায়ীরার মাথায় গোলাকার একটা হেলমেট বসিয়ে বলল, এটার নাম নিওরোজিনা। এটা তোমার মস্তিষ্কের নিউরনে সিনান্স কানেকশন তৈরি করবে। আমরা যেটাকে স্মৃতি বলি, তোমার মধ্যে সেরকম স্মৃতি তৈরি হবে।
নায়ীরা কোনো কথা না বলে ড. ইলাকের দিকে তাকিয়ে রইল। ড. ইলাক নিওরোজিনা নামের যন্ত্রটির সঙ্গে কয়েকটা তার জুড়ে দিতে দিতে বলল, সাধারণ স্মৃতির সঙ্গে এর একটা পার্থক্য আছে।
কথা শেষ করে ড. ইলাক নায়ীরার দিকে তাকাল। সে আশা করছে নায়ীরা পার্থক্যটুকু জানতে চাইলে সে উত্তর দেবে। নায়ীরা জানতে চাইল না। তার যে জানার কৌতূহল হচ্ছে না তা নয়। কিন্তু সে ঠিক করেছে, নিজে থেকে কোনো প্রশ্ন করবে না।
ড. ইলাক কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, সাধারণ স্মৃতি আমাদের মনে থাকে। কিন্তু এই স্মৃতি নিওরোজিনা দিয়ে তৈরি কৃত্রিম স্মৃতি, এই স্মৃতি কারো মনে থাকে না।
মুখটা ভাবলেশহীন করে রাখবে ঠিক করার পরও নায়ীরা খুক করে হেসে ফেলল। ড. ইলাক বলল, কী হল, হাসছ কেন?
তোমার কথা শুনে। মানুষ যদি একটা জিনিস মনে রাখতে না পারে তা হলে সেটা আবার স্মৃতি হয় কেমন করে?
ড. ইলাক মুখে একটা আলগা গাম্ভীর্য এনে বলল, এটাই হচ্ছে নিওরোজিনার বিশেষত্ব। পুরো স্মৃতিটা থাকে অবচেতন মনে। আরেকটি নিওরোজিনা দিয়ে এই স্মৃতিটা বের করে নিয়ে আসা যায়।
প্রশ্ন করার জন্য ভেতরে ভেতরে উসখুস করতে থাকলেও নায়ীরা চুপ করে রইল। পুরো ব্যাপারটিতে নায়ীরার উৎসাহের অভাব দেখে ড. ইলাকও মনে হয় একটু উৎসাহহীন হয়ে পড়ল। একটু দায়সারাভাবে বলল, আমরা এখানে তোমার মস্তিষ্কে একটা গোপন তথ্য দিয়ে দেব, টেহলিস শহরে সেই তথ্যটি বের করে আনা হবে।
নায়ীরা শান্তভাবে ড. ইলাকের দিকে তাকিয়ে রইল। ড. ইলাক একটু ইতস্তত করে বলল, তথ্যটি হবে অত্যন্ত গোপন। অত্যন্ত গোপন এবং গুরুত্বপূর্ণ। এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে তোমাকে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা তোমার জন্য খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার।
একেবারে ভাবলেশহীনভাবে চুপচাপ বসে থাকবে ঠিক করে রাখার পরেও নায়ীরা আবার খুকখুক করে হেসে ফেলল। ড. ইলাক একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, তুমি আবার হাসছ। কেন?
তুমি গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলতে পার না।
আমি মিথ্যা কথা বলছি না।
তুমি যদি আসলেই সত্য কথা বলছ, তা হলে বুঝতে হবে মানবসভ্যতার উন্নতি না হয়ে তার বড় ধরনের অবনতি হয়েছে। আমি যতদূর জানি, প্রায় শখানেক বছর আগেই গোপনীয় খবর নিখুঁতভাবে পাঠানোর পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে। এই যুগে কেউ যদি কারো মস্তিষ্কে করে অবচেতনভাবে খবর পাঠায়, তা হলে বুঝতে হবে বিজ্ঞান সম্পর্কে তারা বিশেষ কিছু জানে না।
ড. ইলাক শীতল চোখে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বয়সের তুলনায় তোমার কথাবার্তা বেশ অমার্জিত এবং উদ্ধত।
নায়ীরা বলল, আমি দুঃখিত, ড. ইলাক। আমি একটি ক্লোন। নিজের অন্যান্য ক্লোন ছাড়া আর কাউকে দেখি নি, আর কারো সঙ্গে কথাবার্তা বলি নি। সুন্দর করে, ভদ্রভাবে, মার্জিতভাবে কীভাবে কথা বলতে হয় আমি সেটা কখনো শিখি নি। যখন মনে যেটা আসে সেটাই বলে ফেলি।
সেটাই দেখছি। কিন্তু মেয়ে, তোমাকে বলে রাখি, যখন মনে যেটা আসে সেটা বলার জন্য তুমি বিপদে পড়বে।
ড. ইলাকের কথা শুনে নায়ীরা আবার শব্দ করে হেসে ফেলল। ড. ইলাক ক্রুদ্ধ চোখে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আবার কেন হাসছ?
তোমরা সবাই মিলে নিশ্চয়ই আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে সরাসরি সেটা বলতে পারছ না তাই নিওরোজিনা, অবচেতন স্মৃতি এসব কঠিন কঠিন কথাবার্তা বলছ! তা হলে তুমিই বলো, সত্যিকার বিপদে পড়ার সুযোগটি আমি কখন পাব?
ড. ইলাক নায়ীরার কথার কোনো উত্তর দিল না, নায়ীরাও কোনো কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে রইল। হঠাৎ করে সে মাথায় একটা মৃদু কম্পন অনুভব করতে থাকে। তার মনে হতে থাকে বহুদূর থেকে একটা ঘণ্টার শব্দ ভেসে আসছে। শব্দটি মধুর এবং বিষণ্ণ। তার বুকের ভেতর কেমন এক ধরনের নিঃসঙ্গতার জন্ম দেয়। শব্দটি শুনতে শুনতে তার চোখে ঘুম নেমে আসতে থাকে। কী কারণ জানা নেই, নায়ীরার মনে হতে থাকে ঘুম থেকে জেগে। ওঠার পর তার জীবনটি হবে সম্পূর্ণ অন্যরকম।
.
নায়ীরার যখন ঘুম ভাঙল তখন সে খুব ক্লান্ত। শুনতে পেল কেউ একজন বলল, চোখ খুলে তাকাও মেয়ে।
নায়ীরার মুখের ওপর একজন নার্স ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার এখন কেমন লাগছে?
নার্সটির মুখে একটা মাস্ক লাগানো, সেই মাস্কটির দিকে তাকিয়ে থেকে নারীরা জিজ্ঞেস করল, তুমি মুখে মাস্ক পরে আছ কেন? আমার কি কোনো অসুখ হয়েছে? আমার শরীরে কি কোনো সংক্রামক জীবাণু আছে?
নার্সটি কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল, ইতস্তত করে বলল, আমরা যখনই কাউকে দেখতে আসি মুখে মাস্ক পরে থাকি। এটা আমাদের অভ্যাস।
কথাটি সত্যি নয়, কিন্তু নায়ীরা সেটা নিয়ে কথা বলার উৎসাহ খুঁজে পেল না। নার্সটি তার মুখ থেকে মাস্কটি না খুলেই আবার জিজ্ঞেস করল, তোমার এখন কেমন লাগছে?
নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার খুব দুর্বল লাগছে।
নার্সটি বলল, সেটাই স্বাভাবিক।
নায়ীরার জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হল, মস্তিষ্কে স্মৃতি জন্ম দেওয়া হলে শরীর কেন দুর্বল হবে? শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন না করেই সে চোখ বুজে শুয়ে রইল। নার্সটি বলল, আমি তোমার শরীরে একটা বলকারক ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি শক্তি খুঁজে পাবে।
নার্সটি নায়ীরার ডান হাতের শিরায় একটি সুচ ঢুকিয়ে একটা বলকারক তরলের প্যাকেট ঝুলিয়ে দেয়। ফোঁটা ফোঁটা করে সেটা তার শরীরে প্রবেশ করতে থাকে এবং খুব ধীরে ধীরে এক ধরনের কোমল আরামের অনুভূতি নায়ীরার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
নায়ীরা নিঃশব্দে তার বিছানায় শুয়ে রইল। তাকে ঘিরে লোকজন যাচ্ছে, আসছে, কথা বলছে, যন্ত্রপাতি দিয়ে তাকে পরীক্ষা করছে, কিন্তু কোনো কিছু নিয়েই সে কৌতূহলী হতে পারছে না। কেউ একজন তার হাত স্পর্শ করে তাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করল, চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে ড. ইলাক। নায়ীরা স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়। ড. ইলাক বলল, তোমার এখন কেমন লাগছে মেয়ে?
আমার একটু দুর্বল লাগছে।
সেটা খুবই স্বাভাবিক।
তোমরা কি আমার অবচেতন মনে তথ্যটি প্রবেশ করাতে পেরেছ?
ড. ইলাককে মুহূর্তের জন্য একটু বিব্রত দেখায়, কিন্তু সে দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলে হ্যাঁ, পেরেছি।
আমি কি কোনোভাবে সেই তথ্যটি সচেতনভাবে জানতে পারব?
ড. ইলাক জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, না, পারবে না। কিছুতেই পারবে না।
ড. ইলাক, আমি যতটুকু জানি যে মানুষের মস্তিষ্ক অত্যন্ত রহস্যময়, বিজ্ঞানীরা কখনো সেটা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনি। এমন কি হতে পারে না হঠাৎ করে আমি সেটা জেনে গেলাম। স্বপ্নের ভেতরে কিংবা কোনোভাবে সম্মোহিত হয়ে?
ড. ইলাক জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, না, এটা হতে পারে না। নিওরোজিনা দিয়ে তোমার মাথায় তথ্যটি ঢোকানো হয়েছে। শুধু আরেকটি নিওরোজিনা দিয়েই সেই তথ্য বের করা সম্ভব। অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়।
নায়ীরা কিছুক্ষণ ড. ইলাকের চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে একটু হেসে আবার চোখ বন্ধ করল। একজন মানুষ যখন মিথ্যে কথা বলে নায়ীরা সেটা বুঝতে পারে। এটি কি তার বিশেষ একটি ক্ষমতা, নাকি সবার জন্যই এটি সত্যি-সে জানে না। জীবনের পুরোটাই সে তার অন্য ক্লোনদের সঙ্গে কাটিয়েছে। মাত্র গত কয়েক দিন হল সে প্রথমবার অপরিচিত মানুষদের দেখছে, তাদের সঙ্গে কথা বলছে। এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সে আবিষ্কার করছে যে, অনেকেই তাকে সত্যি কথা বলছে না। হতে পারে সত্যি কথাটি তার জন্য ভালো নয়, কিন্তু সে তো সত্যিকারের মানুষ নয়, সে একটি তুচ্ছ ক্লোন। তার ভালো মন্দে পৃথিবীর কী আসে যায়? ল্যাবরেটরিতে একটা গিনিপিগকে নিয়ে ভয়ংকর একটা এক্সপেরিমেন্ট করার সময় বিজ্ঞানীরা একটুও ইতস্তত করে না, তার বেলায় কেন করবে? এই প্রশ্নের উত্তরটি কি সে খুঁজে পাবে?
চব্বিশ ঘণ্টার ভেতরই নায়ীরা তার শক্তি ফিরে পেল। কতটুকু তার নিজের আর কতটুকু নানা ধরনের ওষুধপত্রের ফল, সেটা সে জানে না। সেটা নিয়ে সে মাথাও ঘামাচ্ছে। তাকে টেলিস শহরে একটি দুর্গম অভিযানে পাঠানো হবে। কত তাড়াতাড়ি সেই অভিযানটুকু শুরু করতে পারবে সেটাই এখন তার একমাত্র ধ্যানধারণা। চার দেয়ালে ঘেরা এই বিজ্ঞান কেন্দ্র, বিজ্ঞান কেন্দ্রের কিছু মিথ্যেবাদী মানুষকে তার আর ভালো লাগছে না। তার সঙ্গে একজন গাইড থাকবে। সেই গাইডটি কেমন মানুষ হবে? দীর্ঘ সময় সেই মানুষটির সঙ্গে সে থাকবে, এই মানুষটি যদি একজন খাঁটি মানুষ না হয় তা হলে সেটা কি খুব দুঃখের একটি ব্যাপার হবে না?
টেহলিস শহরে অভিযানের জন্য তাকে নিশ্চয়ই প্রস্তুত করা হবে। নায়ীরা খানিকটা আগ্রহ নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সেরকম কিছু হল না। যে মহিলাটিকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তার নাম জানা। ক্ৰানা মধ্যবয়স্ক হাসিখুশি মহিলা। নায়ীরার সঙ্গে তার আলাপ-আলোচনা পুরোটাই হল অবমান নিয়ে। বারবার নায়ীরাকে মনে করিয়ে দিল, অবমানব কিন্তু মানুষ নয়। তারা মানুষ থেকে গড়ে ওঠা একটি ভয়ংকর প্রাণী। তাদের ভেতরে স্নেহ-মমতা নেই, ভালবাসা নেই।
নায়ীরা একটু আপত্তি করে বলল, কিন্তু তাদের নিজেদের জন্যও কি স্নেহ-মমতা নেই? একটা পশুও তো তার সন্তানকে বুক আগলে লালন করে?
ক্ৰানা মাথা নেড়ে বলল, সেটা ছিল প্রকৃতির নিয়ম। অবমানবরা প্রকৃতিকে অস্বীকার করেছে। তারা নিজেদের মধ্যে বিবর্তন ঘটিয়েছে, সেই বিবর্তনটি তাদের ভয়ংকর একটা। প্রাণী করে তুলেছে।
কী রকম ভয়ংকর?
তারা দেখতেও ভয়ংকর। আমি শুনেছি, একটা বিশেষ প্রজাতির দেহ থেকে দুটি মাথা গড়ে উঠেছে।
নায়ীরা শিউরে উঠে জিজ্ঞেস করল, দুটি মাথা?
হ্যাঁ। হাতকে আরো কার্যক্ষম করার জন্য সেখানে পাঁচটির বদলে সাতটি করে আঙুল। অনেকের তৃতীয় একটি চোখ রয়েছে।
তৃতীয় চোখ? নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, সেটি কোথায়?
কপালের ওপরে। তৃতীয় চোখটি আমাদের চোখের মতো নয়, সেটি সব সময় খোলা থাকে। সেই চোখের পাতি পড়ে না।
নায়ীরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কী ভয়ংকর!
হ্যাঁ। শারীরিকভাবে ভয়ংকর, কিন্তু সেটা সত্যিকারের ভয় নয়। তারা ভয়ংকর, কারণ তাদের চিন্তাভাবনা ভয়ংকর। মস্তিষ্ককে তারা অন্যভাবে ব্যবহার করতে শিখেছে। কৃত্রিমভাবে নিউরনের সংখ্যা বাড়িয়ে নিয়েছে। তাদের ভেতরে নতুন নতুন অনুভূতির জন্ম নিয়েছে।
নতুন অনুভূতি?
হ্যাঁ, নতুন অনুভূতি, যার কথা আমরা জানি না।
নায়ীরা একটু চিন্তা করে বলল, সেই অনুভূতিগুলো কী ধরনের?
ক্ৰানা গম্ভীর মুখে বলল, আমার মনে হয় না কোনোদিন সেগুলোর কথা আমরা জানতে পারব। যেমন ধর, কষ্ট করে আনন্দ পাওয়া কিংবা যন্ত্রণার ভেতরে সুখের অনুভূতি।
অবমানবদের এ ধরনের অনুভূতি আছে?
হ্যাঁ, আছে। তারা মাঝে মাঝে দল বেঁধে নিজেদের যন্ত্রণা দেয়। তাদের বিকৃত এক ধরনের মানসিকতা রয়েছে।
নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য!
অবমানব সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি নায়ীরাকে সাধারণ কিছু বিষয়ে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়া হল–দৈনন্দিন অসুখবিসুখ হলে কী করতে হবে, কী ওষুধপত্র খেতে হবে এই ধরনের গুরুত্বহীন বিষয়। খুব ঠাণ্ডা বা খুব গরম অবস্থায় পড়ে গেলে নিজেকে রক্ষা করার জন্য নায়ীরাকে কিছু বিশেষ পোশাক দেওয়া হল। নারীরা সবচেয়ে আনন্দ পেল এক জোড়া নাইট ভিশন গগলস দেখে, এটি চোখে দিলে অন্ধকারে পরিষ্কার দেখা যায়। সে ভেবেছিল, তাকে হয়তো আত্মরক্ষার জন্য কোনো একটি অস্ত্রচালনা শেখাবে, কিন্তু বিজ্ঞান কেন্দ্রের সেরকম কোনো পরিকল্পনা আছে বলে মনে হল না।
রাতে ঘুমানোর সময় নায়ীরা নিজের হাতের ওপর হাত বোলাতে গিয়ে হঠাৎ বাম হাতে একটু সুচ ফোঁটানোর মতো ব্যথা অনুভব করে। তার ডান হাতে বলকারক ওষুধের সিরিঞ্জ লাগানো হয়েছিল কিন্তু বাম হাতে কিছু করা হয় নি। বাম হাতে ছোট লাল বিন্দুটির দিকে তাকিয়ে থেকে নায়ীরা ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে। নিওরোজিনা দিয়ে যখন তাকে অচেতন করে রেখেছিল তখন এই ছোট লাল বিন্দুটি দিয়ে তার শরীরে কোনো কিছু ঢোকানো হয়েছে। কী হতে পারে সেটি?
তার কাছে সেটি গোপন করে রাখা হচ্ছে কেন?
৪. গাইড মানুষটিকে নায়ীরার খুব পছন্দ হল
গাইড মানুষটিকে নায়ীরার খুব পছন্দ হল। নীল চোখ এলোমেলো চুল এবং রোদেপোড়া তামাটে চেহারা। নায়ীরাকে দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, আমাকে বলেছে একজন মহিলাকে নিয়ে যেতে! তুমি তো মহিলা নও, তুমি একটা বাচ্চা মেয়ে!
নায়ীরা হেসে বলল, আমাকে বাচ্চা বলা ঠিক হবে না, আমার বয়স পনের।
পনের একটা বয়স হল? আমার বয়স তেতাল্লিশ। তোমার তিন গুণ।
নায়ীরা বলল, আমি আসলে খুব বেশি মানুষ দেখি নি, তাই দেখে মানুষের বয়স অনুমান করতে পারি না। তবে তোমাকে দেখে মোটেও তেতাল্লিশ বছরের মানুষ মনে হচ্ছে না।
কী বলছ তুমি? মানুষের বয়স ঠিক করা উচিত তার অভিজ্ঞতা দিয়ে। যদি সেভাবে ঠিক করা হত তা হলে আমার বয়স হত সাতানব্বই বছর!
সত্যি?
হ্যাঁ। এমন কোনো কাজ নেই যেটা আমি করি নি।
নায়ীরা বলল, তোমার পদ্ধতিতে বয়স ঠিক করা হলে আমি এখনো শিশু। আমার অভিজ্ঞতা বলে কিছু নেই। একেবারে শূন্য।
গাইড মানুষটি বলল, একেবারে শূন্য কেন হবে? নিশ্চয়ই পড়াশোনা করতে স্কুলে গিয়েছ, সেখানে কত রকম বন্ধুবান্ধব, কত রকম শিক্ষক-শিক্ষিকা, কত রকম অভিজ্ঞতা
নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, উঁহু, আমি কখনো স্কুলে যাই নি।
মানুষটি অবাক হয়ে বলল, স্কুলে যাও নি?
না। শুধু স্কুল কেন, কোথাও যাই নি। আমার পুরো জীবন কাটিয়েছি চার দেয়ালঘেরা একটুখানি জায়গার ভেতর।
কেন?
নায়ীরা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, কারণ, আমি একজন ক্লোন।
মানুষটি কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, ক্লোন?
হ্যাঁ।
কিন্তু, কিন্তু মানুষটি বিভ্রান্তের মতো বলল, আমাকে তো সেরকম কিছু বলে নি।
নায়ীরা আহত গলায় বলল, আমি দুঃখিত যে তোমাকে এটা আগে থেকে বলে দেয় নি। আমি সত্যিই দুঃখিত যে, টেহলিস শহরে সত্যিকার একজন মানুষ না নিয়ে তোমার একজন ক্লোনকে নিয়ে যেতে হচ্ছে।
না-না-না, মানুষটি তীব্র গলায় বলল, আমি সে কথা বলছি না। পৃথিবীতে বহু আগে আইন করে ক্লোন তৈরি করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তা হলে তোমাকে কেন তৈরি করা হল?
আসলে আইনের ভেতর ফাঁকফোকর থাকে। সাধারণত ক্লোন তৈরি করা নিষেধ, কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য বিশেষ প্রয়োজনে বিজ্ঞান কেন্দ্রকে অনুমতি দেওয়া হয়।
যদি অনুমতি দেবে, তা হলে তাকে মানুষের মতো বেঁচে থাকতে দেবে না কেন? তাকে চার দেয়ালের মধ্যে আটক রাখবে কেন? স্কুলে যেতে দেবে না কেন-
নায়ীরা আবার জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমি নিশ্চিত, বাইরের মানুষ যদি আমাদের কথা জানে তা হলে তারা ঠিক তোমার মতো কথা বলত। কিন্তু বাইরের মানুষ আমাদের কথা কোনোদিন জানবে না আমরা হচ্ছি অত্যন্ত গোপনীয় একটা প্রজেক্ট! তুমিও নিশ্চয়ই কোনোদিন আমাদের কথা বাইরে জানাতে পারবে না
মানুষটি হতচকিতের মতো মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি ঠিকই বলছ। আমাকে অঙ্গীকার করতে হয়েছে এখানকার কোনো তথ্য কখনো বাইরে জানাতে পারব না। কখনোই না।
নায়ীরা বলল, কাজেই আমাদের কথা বাইরের পৃথিবীর কেউ কখনো জানবে না।
আমি খুব দুঃখিত।
আমার নাম নায়ীরা।
আমি খুব দুঃখিত, নায়ীরা।
নায়ীরা হাসিমুখে বলল, তুমি আমার অনেকখানি দুঃখ দূর করে দিয়েছ।
কীভাবে তোমার দুঃখ দূর করেছি?
আমি এখানে এসেছি প্রায় এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে আমি সবাইকে বলেছি আমার নাম নায়ীরা, কিন্তু কেউ একটিবারও আমাকে আমার নাম ধরে সম্বোধন করে নি।
মানুষটি অবাক হয়ে বলল, কেন?
কারণ একজন ক্লোনের নাম থাকার কথা নয়। একটা ক্লোনের পরিচিতি হয় শুধু একটা সংখ্যা দিয়ে।
কী ভয়ংকর রকমের অমানবিক একটা নিয়ম।
বিচার-অবিচার বিষয়গুলো মানুষের জন্য। আমি মানুষ নই, আমি ক্লোন। একজন ক্লোন আর ল্যাবরেটরির গিনিপিগের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
মানুষটি কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাছে এসে তার পিঠে হাত রেখে বলল, আমি খুব দুঃখিত, নায়ীরা। আমার নিজেকে মনে হচ্ছে একটা দানব-
তোমার দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই- বাক্যটি অসমাপ্ত রেখে নায়ীরা মানুষটির দিকে প্রশ্নভাবে তাকাল।
মানুষটি বলল, আমার নাম রিশি।
তোমার দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই রিশি।
আছে। নিশ্চয়ই আছে।
নায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, না, নেই। তুমি পুরো বিষয়টুকু দেখছ তোমার মতো করে। একজন মানুষের পক্ষ থেকে একজন মানুষ তার জীবনে যা কিছু পায় আমরা তার। কিছু পাই না, তোমাকে সেটা ক্ষুব্ধ করে তুলেছে।
রিশি মাথা নাড়ল, বলল, করবে না?
হয়তো করবে। কিন্তু পুরো বিষয়টা আমাদের পক্ষ থেকে দেখলে করবে না। জন্মের পরমুহূর্ত থেকে আমরা জানি, আমরা ক্লোন, আমাদের তৈরি করা হয়েছে ক্লোন গবেষণায় ব্যবহার করার জন্য। আমরা ধরেই নিয়েছি জন্ম হওয়ার পর একসময় আমাদের কেটেকুটে শেষ করে দেওয়া হবে। এর বাইরে আমরা যেটুকু পাই সেটাই আমাদের বাড়তি লাভ। সেটাই আমাদের জীবন।
রিশি মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু সেটা তো হতে পারে না।
কিন্তু সেটাই তো হচ্ছে। আমরা এটা মেনে নিয়েছি। আমি মনে করি, আমি অসম্ভব সৌভাগ্যবান একজন-একজন- নায়ীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একজন মানুষ। হ্যাঁ, মানুষ। ক্লোন শব্দটা আমি ব্যবহার করছি না।
কেন তুমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মানুষ ভাবছ?
কারণ টেহলিস শহরের দুর্গম অভিযানের সময় তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। তোমার সঙ্গে আমি সময় কাটাতে পারব। মানুষ মানুষের সঙ্গে যেভাবে কথা বলে আমি তোমার সঙ্গে সেভাবে কথা বলতে পারব। তুমি জান আমার জন্য সেটা কত বড় ব্যাপার?
রিশি কোনো কথা না বলে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে রইল। নায়ীরা বলল, আমরা সারা জীবন এরকম একটা কিছুর স্বপ্ন দেখে এসেছি। আমার আরো দশটি বোন আছে, তারা তাদের জীবনে কী পাবে আমি জানি না, কিন্তু আমি অন্তত একজন মানুষের কাছ থেকে। মানুষের সম্মান পেয়েছি।
রিশি নিচু গলায় বলল, তোমাকে প্রথম যখন দেখেছি তখন ভেবেছি তুমি নিশ্চয়ই বাচ্চা একটি মেয়ে। বয়সে তুমি আসলেই বাচ্চা। কিন্তু তুমি একেবারে পরিণত মানুষের মতো কথা বলো।
নায়ীরা শব্দ করে হেসে বলল, চার দেয়ালের ভেতরে আটকা পড়ে থেকে আমরা বইপত্র পড়া ছাড়া আর কিছু করতে পারি না। আমার বয়সী একটা মেয়ের কী নিয়ে কীভাবে কথা বলতে হয় আমি জানি না। সেজন্য আমার কথা হয়তো তোমার কাছে অকালপকের কথার মতো মনে হচ্ছে।
রিশি মাথা নাড়ল, বলল, না। অকালপক্ব একটি জিনিস আর পরিণত মানুষ সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। তুমি অকালপক্কের মতো কথা বলো না, তুমি এই অল্পবয়সেই একেবারে পরিণত একজন মানুষের মতো কথা বলো।
নায়ীরা বলল, তার জন্য আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। যে মানুষটি থেকে আমাদের ক্লোন করা হয়েছে পুরো কৃতিত্ব তার। শুনেছি সে একজন অসাধারণ মহিলা ছিল। আমি যদি তার সম্পর্কে কিছু একটা জানতে পারতাম! আমার এত জানার ইচ্ছে করে।
চেষ্টা করেছ?
নায়ীরা হেসে ফেলল, বলল, তুমি বারবার ভুলে যাচ্ছ যে আমি একজন ক্লোন। আমি আমার পছন্দের একটি গান শোনার চেষ্টাটুকুও করতে পারি না।
রিশি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি দুঃখিত।
নায়ীরা বলল, আমি মোটও দুঃখিত নই। তোমার সঙ্গে খুব বড় একটা অ্যাডভেঞ্চারে যাব চিন্তা করেই আমার মনে হচ্ছে আমার ক্লোন হয়ে থাকার সব দুঃখ মুছে গেছে।
রিশি কোনো কথা না বলে একদৃষ্টে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে রইল।
.
রিশির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর হঠাৎ করে নায়ীরার জীবনটুকু অন্যরকম হয়ে গেল। এত দিন বিজ্ঞান কেন্দ্রে তাকে তুচ্ছ একজন ক্লোন হিসেবে দেখা হয়েছে। হঠাৎ করে রিশি তাকে পুরোপুরি একজন মানুষ হিসেবে দেখছে। রিশির তুলনায় সে একটি বাচ্চা শিশু ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু রিশি তাকে কখনোই ছোট শিশু হিসেবে দেখছে না। প্রত্যেকটা বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছে, পরামর্শ করছে। নারীরা প্রথম প্রথম ভেবেছিল, রিশি বুঝি তাকে। একটু খুশি করানোর জন্য এগুলো করেছে, কিন্তু কয়েক দিনের ভেতরেই বুঝে গেল, সে সত্যি সত্যি তার সাহায্য চাইছে। টেহলিস শহরের ভ্রমণটুকু শুরু হবে একটা পার্বত্য অঞ্চল থেকে। সেই পার্বত্য অঞ্চলের একটা বড় অংশ তাদের পায়ে হেঁটে যেতে হবে। উঁচু একটা পাহাড়ে একটা গ্লাইডার রাখা থাকবে। সেই গ্লাইডারে করে দুজন অবমানবের এলাকার ওপর দিয়ে ভেসে যাবে। সত্যিকারের একটা প্লেনে না গিয়ে গ্লাইডারে কেন যেতে হবে নায়ীরা সেটা বুঝতে পারছিল না। ফ্লাইট কো-অর্ডিনেটরকে জিজ্ঞেস করার পর মানুষটি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, প্লেনে কেমন করে যাবে? নিচে পুরো এলাকাটাতে অবমানবরা থাকে। তারা যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু বোঝে না। ভয়ংকর সব। অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। প্লেন রাডারে ধরা পড়া মাত্রই মিসাইল ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
নায়ীরা জিজ্ঞেস করল, গ্লাইডারকে ফেলবে না?
কীভাবে ফেলবে? গ্লাইডার যেসব হালকা জিনিস দিয়ে তৈরি হয় সেগুলো রাডারে ধরা পড়ে না।
দেখতেও পাবে না?
না। বছরের এই সময়ে এলাকায় মেঘ থাকে। মেঘের ওপর দিয়ে গ্লাইডার উড়ে যাবে, অবমানবরা টের পাবে না।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু গ্লাইডার তো আকাশে বেশি সময় ভেসে থাকতে পারবে না। কখনো না কখনো নিচে নেমে আসবে।
ফ্লাইট কো-অর্ডিনেটর মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। কিন্তু আমরা একটু উষ্ণ বাতাসের প্রবাহের জন্য অপেক্ষা করছি। সেটা এলে বড় একটা এলাকায় বাতাস উপরে উঠে আসবে। তার উপর ভর করে অনেক দূর চলে যাওয়া যাবে।
সেটা কত দূর?
আমরা এখনো জানি না। রিশি একজন প্রথম শ্রেণীর গ্লাইডার পাইলট, আমাদের ধারণা সে অনায়াসে সাত-আট শ কিলোমিটার উড়িয়ে নিতে পারবে।
তারপর?
তারপরের অংশটুকু দুর্গম। দুর্গম বলে অবমানবের বসতিও কম। তোমাদের পায়ে হেঁটে যেতে হবে। কিন্তু সেটা নিয়ে মাথা ঘামিও না, রিশি ব্যাপারটি দেখবে।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু আমিও একটু ধারণা করতে চাই।
হঠাৎ করে ফ্লাইট কো-অর্ডিনেটরের মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে গেল। সে কঠিন গলায় বলল, যেসব বিষয়ে তোমার ধারণা থাকার কথা শুধু সেসব বিষয়ে তোমাকে ধারণা দেওয়া হবে। অহেতুক কৌতূহল দেখিয়ে কোনো লাভ নেই মেয়ে।
নায়ীরা সঙ্গে সঙ্গে চুপ করে গেল।
রিশির কাছে এরকম কোনো সমস্যা নেই। যে কোনো বিষয়ে নারীরা তাকে প্রশ্ন করতে পারে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রিশি এই প্রশ্নের উত্তর দেয়। গ্লাইডারে করে তারা কত দূর যেতে। পারবে নায়ীরা একদিন রিশির কাছে জানতে চাইল। রিশি চিন্তিত মুখে বলল, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। আমাকে বাতাসের প্রবাহের যে ম্যাপ দিয়েছে তার থেকে অনুমান করতে পারি যে, ছয় থেকে সাত শ কিলোমিটার যেতে পারবে।
বাকিটুকু? বাকিটুকু কেমন করে যাব?
রিশি হেসে বলল, হেঁটে!
হেঁটে?
হ্যাঁ। গোপনে যেতে হলে হেঁটে না গিয়ে লাভ নেই।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু পুরোটুকু তো হেঁটে যেতে পারবে না। শেষ অংশটুকুতে জলাভূমি রয়েছে। সেখানে?
রিশি ঠাট্টা করে বলল, কেন, সাঁতরে যাবে? তুমি সাঁতার জান না? না
য়ীরা মাথা নেড়ে বলল, ঠাট্টা করো না। সত্যি করে বলো।
রিশি তখন গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা সেই অংশটুকু কীভাবে যাব সেটি নিয়ে এখন আলাপ করছি। ওপর থেকে নানারকম পরিকল্পনা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু পরিকল্পনাগুলো বেশিরভাগ সময়ে খুব দুর্বল।
দুর্বল?
হ্যাঁ।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, আচ্ছা রিশি, এমন কি হতে পারে যে শেষ অংশটুকুর আসলে কোনো পরিকল্পনা নেই?
রিশি অবাক হয়ে বলল, পরিকল্পনা নেই?
না।
কেন থাকবে না?
কারণ সেখানে পৌঁছানোর আগেই কিছু একটা হবে।
রিশি ভুরু কুঁচকে বলল, কিছু একটা হবে? কী হবে?
আমরা মারা পড়ব। নিশ্চিতভাবে মারা পড়ব।
কেমন করে মারা পড়ব? কেন মারা পড়ব?
নায়ীরা বলল, সেটা আমি জানি না। কিন্তু যারা আমাদের পাঠাচ্ছে তারা সেটা জানে।
রিশি কিছুক্ষণ নায়ীরার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, এরকম অদ্ভুত একটি বিষয় তোমার মাথায় কেমন করে এল?
নায়ীরা একটু লজ্জা পেয়ে যায়, মাথা নিচু করে বলল, আমি দুঃখিত রিশি যে বিজ্ঞান কেন্দ্রের এত বড় বড় মানুষকে নিয়ে আমি সন্দেহ করছি। কিন্তু
কিন্তু কী?
আমি কেন জানি হিসাব মেলাতে পারছি না। তারা বলেছে, আমার মস্তিষ্কে করে একটি গোপন তথ্য পাঠাচ্ছে। কিন্তু সেটি তো সত্যি হতে পারে না। পারে?
রিশি বলল, আমি সেটা জানি না।
নায়ীরা বলল, আমি তাদের সেটা জিজ্ঞেস করেছি, তারা ঠিক উত্তর দিতে পারে নি।
রিশি বলল, হয়তো তারা এর উত্তর জানে না।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু তারা আমার কাছে মিথ্যা কথা বলেছে।
মিথ্যা কথা বলেছে?
হ্যাঁ, নায়ীরা বলল, কেউ মিথ্যা কথা বললে আমি কেমন করে জানি টের পেয়ে যাই।
সেটি কেমন করে হতে পারে?
আমি জানি না। আমি আমাদের ক্লোন করা বোনদের সঙ্গে দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা কাটাতাম। তাদের কথা বলার একটা ধরন আছে, সেটা আমরা জানি। আমাদের কখনোই একজনের সঙ্গে আরেকজনের মিথ্যা বলতে হত না। তাই সত্যি কথা বলার ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুব স্বাভাবিক। মিথ্যে বললেই অস্বাভাবিক মনে হয়।
রিশি ঘুরে ভালো করে নায়ীরার দিকে তাকাল। মনে হল তাকে ভালো করে একবার দেখল। তারপর বলল, আমি কি কখনো তোমার সঙ্গে মিথ্যা বলেছি?
নায়ীরা হেসে ফেলল, বলল, না। সেজন্য তোমার ওপর আমি নির্ভর করি। তা ছাড়া-
তা ছাড়া কী?
তুমি মিথ্যা বলতে পার না। তাই তুমি যখন মিথ্যা বলার চেষ্টা কর, তখন সবাই সেটা বুঝে ফেলে।
রিশি ভুরু কুঁচকে বলল, সত্যি? আমি কি কখনো চেষ্টা করেছি?
হ্যাঁ। নায়ীরা মুখ টিপে হেসে বলল, কদিন আগে একবার চেষ্টা করেছিলে। টেবিল থেকে কী একটা জিনিস তুলে খুব যত্ন করে একটা কাগজে ভাঁজ করে রাখছিলে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী তুলছ? তখন তুমি চমকে উঠে আমতা-আমতা করে বললে, না মানে ইয়ে একটা বিচিত্র পোকা। মনে আছে?
রিশির মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, হ্যাঁ, মনে আছে।
নায়ীরা বলল, সেটা পোকা ছিল না। সেটা অন্য কিছু ছিল। তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছিলে! কিন্তু সেটা অন্যরকম মিথ্যা। তার মধ্যে কোনো অন্যায় ছিল না।
রিশি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ নায়ীরা। তুমি অসাধারণ একটি মেয়ে।
নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি কিন্তু অসাধারণ মেয়ে হতে চাই নি। খুব সহজ সাধারণ একটি মেয়ে হতে চেয়েছিলাম।
যা-ই হোক, তুমি কি জানতে চাও, আমি সেদিন টেবিল থেকে কী তুলেছিলাম?
না। তুমি যেহেতু বলতে চাও নি, আমি সেটা জানতে চাই না।
ঠিক আছে।
তা ছাড়া আমি অনুমান করতে পারি তুমি কী তুলেছিলে এবং কেন তুলেছিলে, তাই জানার প্রয়োজনও নেই।
রিশি চোখ বড় বড় করে নায়ীরার দিকে তাকাল। নায়ীরা বলল, পুরো ব্যাপারটা করেছ আমার জন্য, আমার ভালোর জন্য। তাই আমি এখন না জানলেও কোনো ক্ষতি নেই। একসময় আমি জানব। কারণ তুমি আমাকে জানাবে।
রিশি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, নায়ীরা, তুমি একটি অসাধারণ এবং এবটি বিচিত্র মেয়ে।
নায়ীরা বলল, আমি যদি অন্য দশজন মানুষের মতো বড় হতে পারতাম তা হলে হয়তো বিচিত্র হতাম না।
একটু আগে তুমি যে বিষয়টা বলেছ সেটা অন্য কেউ বললে আমি একেবারেই গুরুত্ব দিতাম না। কিন্তু যেহেতু তুমি বলছ, আমি গুরুত্ব দিচ্ছি। তুমি নিশ্চিত থাক নায়ীরা, আমরা রওনা দেওয়ার পর কীভাবে যাব তার পুরোটুকু আমি ঠিক করে নেব। তোমাকে আমি সুস্থ দেহে টেহলিস শহরে পৌঁছে দেব।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
বিজ্ঞান কেন্দ্র যদি সত্যি সত্যি তোমাকে আর আমাকে মাঝপথে মেরে ফেলার চেষ্টা করে, আমি সেটা হতে দেব না। আমি তোমাকে রক্ষা করব।
আমি জানি, তুমি আমাকে রক্ষা করবে।
সত্যি সত্যি কেউ যদি তোমাকে হত্যা করতে চায়, তুমি জেনে রাখ নায়ীরা, তোমাকে হত্যা করার আগে আমাকে হত্যা করতে হবে।
ঠিক কী কারণ জানা নেই নায়ীরা হঠাৎ মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, বলল, কেউ যদি আমাকে এখন মেরেও ফেলে তবুও আমার কোনো দুঃখ থাকবে না।
রিশি এগিয়ে এসে নায়ীরাকে শক্ত করে বলল, কেউ তোমাকে মেরে ফেলতে পারবে না, নায়ীরা। কেউ না।
.
ইঞ্জিনটা থামার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে রিশি নেমে আসে। বাইরে অন্ধকার, আকাশে বড় একটা চাঁদ। জ্যোৎস্নার আলোয় পুরো এলাকাটাকে একটা অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্যের মতো মনে হচ্ছে। পাহাড়ের শীতল ও সতেজ বাতাসে বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে রিশি নায়ীরাকে ডাকল, নায়ীরা, নেমে এস।
নায়ীরা তার ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিয়ে নিচে নেমে এল। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, কী সুন্দর।
হ্যাঁ। রিশি বলল, দিনের আলোতে জায়গাটা আরো সুন্দর দেখাবে।
গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে একজন বলল, আমি তা হলে যাই?
রিশি বলল, যাও।
মানুষটি বলল, তোমাদের জন্য শুভকামনা।
ধন্যবাদ।
গাড়িটি গর্জন করে উঠে ঘুরে পাহাড়ি পথ দিয়ে নেমে যেতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বহুদূরে হেডলাইটের আলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে একসময় অদৃশ্য হয়ে গেল। রিশি আবছা অন্ধকারে নায়ীরার দিকে তাকাল। বলল, আমাদের দ্রুত এখান থেকে সরে যাওয়া উচিত।
কেন?
গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনে যদি কোনো অবমানব এসে পড়ে!
নায়ীরা ভয় পাওয়া গলায় বলল, এটি কি অবমানবের এলাকা?
না, কিন্তু এরা খুব দুধর্ষ। মাঝে মাঝেই পার্বত্য এলাকায় হানা দেয় বলে শুনেছি।
নায়ীরা বলল, চল, তা হলে সরে যাই।
হ্যাঁ, চল।
দুজন তাদের কাঁধে ব্যাকপ্যাক তুলে নেয়। রিশি একবার আকাশের দিকে তাকায়, তারপর পকেট থেকে জি.পি.এস. বের করে কোনদিকে যেতে হবে ঠিক করে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। তার থেকে কয়েক পা পেছনে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে নায়ীরা বলল, আমাদের কতদূর যেতে হবে?
দূরত্বের হিসাবে খুব বেশি নয়, কিন্তু পাহাড়ি এলাকা। কখনো উপরে উঠতে হবে আবার কখনো নিচে নামতে হবে। রাস্তা নেই-ঝোঁপঝাড়, বনজঙ্গল ভেঙে হাঁটতে হবে, তাই সারা রাত লেগে যেতে পারে।
সারা রাত?
হ্যাঁ। রাতের মধ্যেই পৌঁছে যেতে চাই। পারবে না?
পারব।
চমৎকার।
দুজনই চোখে নাইটভিশন গগলস লাগিয়ে নিয়েছে। সেই গগলসে পুরো এলাকাটাকে অলৌকিক একটা জগতের মতো মনে হয়। চারপাশে ঝোপঝাড়, বড় বড় গাছ। দূরে হঠাৎ হঠাৎ কোনো রাতজাগা প্রাণী দেখা যায়। মানুষের পায়ের শব্দ শুনে ছুটে পালিয়ে গিয়ে দূর থেকে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নায়ীরা জিজ্ঞেস করল, এখানে কি বড় কোনো বন্য প্রাণী আছে?
আছে। পাহাড়ি চিতা আর ভালুক।
তারা আমাদের আক্রমণ করবে না তো?
করার কথা নয়। বনের প্রাণী মানুষকে ভয় পায়। আর যদি কাছাকাছি আসে তুমি অনেক আগেই দেখতে পাবে।
তা ঠিক।
দুজনে আবার নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে। রিশি হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল, নায়ীরা, তোমার সমস্যা হচ্ছে না তো?
না। হচ্ছে না।
হলে বলো।
বলব।
মানুষের শরীর খুব বিচিত্র জিনিস, তাকে দিয়ে যে কত পরিশ্রম করানো যায়, সেটি অবিশ্বাস্য।
ঠিকই বলেছ।
রিশি হালকা কথাবার্তা বলতে বলতে হঠাৎ বলল, নায়ীরা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
কর।
তোমাকে মাঝে মাঝেই খুব আনমনা দেখি। কী ভাব তখন?
আমার ভাবার খুব বেশি কিছু নেই। আমার সঙ্গে যাদের ক্লোন করা হয়েছিল তারা ছাড়া আমার আপনজন কেউ নেই। আমি তাদের কথা ভুলতে পারি না। ঘুরেফিরে আমার শুধু তাদের কথা মনে হয়।
রিশি নরম গলায় বলল, খুবই স্বাভাবিক। আমি তোমার বুকের ভেতরকার যন্ত্রণাটা বুঝতেই পারছি।
পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে নায়ীরা বলল, না, রিশি। তোমরা সেই যন্ত্রণাটুকু বুঝতে পারবে না। প্রথমে আমরা ছিলাম উনিশ জন। একজন একজন করে সরিয়ে নেয়ার পর হয়েছি এগার জন। শেষ কত দিন এই এগার জন মিলে ছিলাম একটা পরিপূর্ণ অস্তিত্ব। তার মধ্যে থেকে একজনকে সরিয়ে নেওয়া হলে তার পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন।
আমি দুঃখিত, নায়ীরা।
নায়ীরা বলল, আমি প্রতি মুহূর্তে অন্যদের কথা ভাবতে থাকি। আমার মনে হয় তাদের সবাইকে একটিবার স্পর্শ করার জন্য আমি আমার পুরো জীবনটুকু দিয়ে দিতে পারব।
রিশি দ্বিতীয়বার বলল, আমি সত্যিই দুঃখিত, নায়ীরা।
.
রিশি এবং নায়ীরা যখন তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছায় তখন পুব আকাশ আলো হতে শুরু করেছে। পাহাড়ের চূড়ায় বিশাল পাখির মতো ডানা মেলে একটা গ্লাইডার শুয়ে আছে। তার পাশে বসে দুজন তাদের পিঠ থেকে বোঝা নামিয়ে নেয়। দুজনে ক্লান্ত দেহে বড় পাথরে হেলান দিয়ে বসে লম্বা লম্বা নিশ্বাস নিতে থাকে। রিশি নায়ীরার দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন লাগছে তোমার?
ভালো। চারদিকে তাকাতে তাকাতে নায়ীরা বলল, আমি প্রকৃতির এত সুন্দর রূপ আগে কখনো দেখি নি। শুধু মনে হচ্ছে
কী মনে হচ্ছে?
মনে হচ্ছে আমার অন্য বোনগুলোকেও যদি কোনোভাবে এখানে আনতে পারতাম তা হলে কী মজাটাই না হত।
রিশি একটা নিশ্বাস ফেলে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। নায়ীরা তার ব্যাকপ্যাকে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ে বলল, আমরা কখন রওনা দেব রিশি?
রিশি পাহাড়ের পাদদেশে ঘন জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা অবমানবদের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। দিনের আলোয় বের হতে চাইছি না। অন্ধকার হওয়ার পর গ্লাইডারটি ভাসিয়ে দেব।
তা হলে আমি এখন একটু বিশ্রাম নিতে পারি?
হ্যাঁ নায়ীরা, পার।
ঠিক আছে, আমি তা হলে একটু ঘুমিয়ে নিই।
ঘুমাও। আমি পাহারায় থাকব।
নায়ীরা গুটিসুটি মেরে শুয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। এই দীর্ঘ পথ বিশাল বোঝ টেনে এনে মেয়েটি সত্যি সত্যি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। রিশি একটা পাথরে হেলান দিয়ে নিঃশব্দে বসে থাকে। খুব ধীরে ধীরে চারদিক আলোকিত হয়ে উঠছে। ভোরের প্রথম আলোতে একটা পাহাড়ের চূড়ায় বিশাল একটা গ্লাইডারের পাখার নিচে গুটিসুটি মেরে একটি কিশোরী ঘুমিয়ে আছে। দৃশ্যটি অন্যরকম। রিশি তাকিয়ে থাকে, তার মনে হতে থাকে এটি আসলে ঘটছে না, এটি কল্পনার একটি দৃশ্য। ভালো করে তাকালেই দেখবে আসলে এটি এখানে নেই।
.
নায়ীরা যখন ঘুম থেকে উঠেছে তখন সূর্য অনেক ওপরে উঠে গেছে। পাহাড়ের চূড়ায় এক ধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা।
কাছাকাছি রিশি যেখানে বসেছিল সেখানেই চুপচাপ বসে আছে। নায়ীরাকে জেগে উঠতে দেখে জিজ্ঞেস করল, ঘুম হল?
হ্যাঁ, এভাবে আগে কখনো ঘুমাই নি।
এভাবে নিশ্চয়ই আগে কখনো ক্লান্তও হও নি।
তুমি একটু বিশ্রাম নেবে না?
নিয়েছি। নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, কখন নিয়েছ? তুমি তো এখানেই সারাক্ষণ বসে আছ।
রিশি হেসে বলল, এটাই আমার বিশ্রাম। আমার অভ্যাস আছে। যাও, হাত-মুখ ধুয়ে এস, কিছু একটা খাই।
হ্যাঁ, খিদে পেয়েছে।
পাহাড়ের বাতাস খুব সতেজ। এই বাতাসে নিশ্বাস নিলে এমনিতেই খিদে পায়। যাও, দেরি করো না।
খাবারের আয়োজনটুকু ছিল সহজ। এলুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়ানো যবের রুটি, কিছু প্রোটিন আর গরম কফি। খাওয়া শেষ করে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে রিশি বলল, জীবনটা যদি এখানে থেমে যেত, মন্দ হত না। কী বলো?
নায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল হ্যাঁ। চারপাশে এত সুন্দর যে চোখ জুড়িয়ে যায়। আমার কী মনে হচ্ছে জান?
কী?
আমরা যেটাকে সভ্যতা বলছি, সেটা ঠিকভাবে অগ্রসর হয় নি।
কেন? রিশি চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল, এরকম একটা কথা মনে হওয়ার কী কারণ?
মানুষ নিশ্চয়ই একসময় প্রকৃতির কাছাকাছি থাকত। এখন প্রকৃতিকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঘোট ঘোট ঘুপচির ভেতরে থাকে। চার দেয়ালের ভেতরে থাকে। সূর্যের আলো বন্ধ করে নিজেরা আলো তৈরি করে। যখন অন্ধকার থাকার কথা, তখনো আলো জ্বেলে রাখে।
রিশি হেসে ফেলল, বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। আমার কী মনে হয় জান?
কী?
মানুষ নিশ্চয়ই আবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যাবে।
নায়ীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি একটা জিনিস কখনো বুঝতে পারি নি।
সেটা কী?
মানুষে মানুষে যুদ্ধ করে কেন?
সেটা শুধু তুমি নও, কেউ বুঝতে পারে না।
নায়ীরা একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, আগে পৃথিবীতে ছিল শুধু মানুষ। এখন নিজেরা নিজেরা দুই ভাগ হয়ে গেছে, মানব আর অবমানব! একজন আরেকজনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। ভবিষ্যতে কি আরো ভাগ হবে, আরো বেশি যুদ্ধ করবে?
রিশি মাথা নাড়ল, বলল, তোমার এ প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না নায়ীরা। আমার ধারণা, কেউই জানে না।
দুজনে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে কফির মগে চুমুক দেয়। পাথরে হেলান দিয়ে দূরে তাকায়। ঘন সবুজ বনে দূর প্রান্তর ঢেকে আছে। সেখানে ভয়ংকর অবমানবরা ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
রিশি কফির মগটি নিচে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়াল। বলল, এস নায়ীরা, আমরা গ্লাইডারটা প্রস্তুত করি।
নায়ীরা উঠে দাঁড়াল। গ্লাইডারটা বিশাল একটা সাদা পাখির মতো দুটো পাখা ছড়িয়ে রেখেছে। হালকা ফাইবার গ্লাসের কাঠামোর ওপর পাতলা পলিমারের আবরণ। পাহাড়ের চূড়ার দমকা হাওয়ায় যেন উঠে চলে না যায় সেজন্য পাথরের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। রিশি পুরো গ্লাইডারটা ভালো করে পরীক্ষা করে সন্তুষ্টির মতো শব্দ করে বলল, চমৎকার জিনিস। এর মধ্যে কোনো ফঁকিঝুঁকি নেই। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, পৃথিবীর একেবারে সেরা ইঞ্জিনিয়াররা তৈরি করেছে।
নায়ীরা গ্লাইডারটার ওপরে হাত বুলিয়ে বলল, এত হালকা একটা জিনিস আমাদের দুজনকে নিতে পারবে?
শুধু আমাদের দুজনকে নয়, আমাদের জিনিসপত্র, খাবারদাবার সবকিছু নিতে পারবে। রিশি গ্লাইডারের সামনে ছোট ককপিটটা দেখিয়ে বলল, এখানে বসব আমি, আমার সামনে কন্ট্রোল প্যানেল। আর তুমি বসবে পেছনে।
নায়ীরা পেছনের ছোট ককপিটটা ভালো করে দেখল। ছোট হলেও সে বেশ আরাম করেই বসতে পারবে। দুজনের মাঝখানের অংশটুকু তাদের খাবারদাবার, জিনিসপত্র রাখার জন্য।
রিশি তার ব্যাগ খুলে জিনিসপত্র বের করে গ্লাইডারে তুলতে থাকে। নায়ীরাও তার ব্যাগ খুলে নেয়। শুকনো খাবার, পানি, কিছু জ্বালানি, গরম কাপড়, স্লিপিং ব্যাগ বের করে সাজিয়ে রাখতে থাকে। সবকিছু রাখার পর রিশি ঢাকনাটা বন্ধ করে আবার সন্তুষ্টির মতো শব্দ করল। বলল, আমাদের কাজ শেষ। এখন শুধু অন্ধকার হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা। অন্ধকার হলেই রওনা দিতে পারব।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, আমাকে বলেছিলে একটা উষ্ণ বাতাসের প্রবাহ শুরু হবে, সেটা কি শুরু হয়েছে?
গোপনীয়তার জন্য আমাদের কাছে কোনো যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। শর্টওয়েভ রেডিওতে আবহাওয়ার খবর শুনে অনুমান করতে হবে।
সেটা শুনবে না?
শুনব। গ্লাইডার ভাসিয়ে দেওয়ার পর শুনব। রেডিওটা আছে ককপিটে। রিশি দূর দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের এখন আর কিছু করার নেই। চল জায়গাটা একটু ঘুরে দেখি।
চল। নায়ীরা উঠে দাঁড়াল। বলল, এরকম একটা সুযোগ পাব, আমি কখনো ভাবি নি।
একটা ঝরনাধারার মতো শব্দ শুনছি। চল দেখি, জায়গাটা খুঁজে পাই কি না।
আবার হারিয়ে যাব না তো?
না। হারাব না। জি.পি.এস. আবিষ্কারের পর পৃথিবী থেকে কেউ কখনো হারিয়ে যায় নি।
ঝরনাটি খুঁজে বের করতে তাদের ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। পাহাড়ের ওপর থেকে বিশাল একটি জলধারা নিচে পাথরের ওপর আছড়ে পড়ছে। চারপাশে ভেজা কুয়াশার মতো পানির কণা, নিচে ঘন বৃক্ষরাজি। বড় একটা গ্রানাইট পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে দুজন ঝরনাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। রিশি বলল, কী সুন্দর!
একটি সুন্দর দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে নায়ীরা প্রতিবারই উচ্ছাস প্রকাশ করেছে। এবারে এত সুন্দর একটি দৃশ্য দেখেও রিশির কথার প্রতিধ্বনি তুলে নায়ীরা কিছু বলল না দেখে রিশি একটু অবাক হয়ে ঘুরে নায়ীরার দিকে তাকাল। নায়ীরা এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ-মুখ লালচে এবং মনে হল সে অল্প অল্প কাঁপছে। রিশি অবাক হয়ে বলল, নায়ীরা, তোমার কী হয়েছে?
নায়ীরা বলল, বুঝতে পারছি না। কেমন যেন শীত করছে। রিশি নায়ীরাকে স্পর্শ করে চমকে উঠল, শরীর উত্তপ্ত, যেন পুড়ে যাচ্ছে। বলল, সে কী? তোমার তো দেখি অনেক জ্বর। কখন জ্বর উঠেছে?
আমি জানি না। এই একটু আগে থেকে শরীর খারাপ লাগতে শুরু করেছে।
রিশি নায়ীরাকে একটা পাথরের ওপর হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। বলল, তুমি এখানে বস। দেখি, কী করা যায়।
ছোটখাটো অসুখের জন্য তাদের কাছে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র আছে, কিন্তু সঙ্গে করে কিছু নিয়ে আসে নি। রিশি নায়ীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, দেখা যাক, জ্বরটা কতটুকু ওঠে। যদি বেশি ওঠে আমি তোমার জন্য ওপর থেকে ওষুধ নিয়ে আসব।
না, না-, নায়ীরা কাতর গলায় বলল, আমাকে একা ফেলে রেখে যেও না।
রিশি নায়ীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ঠিক আছে, আমি যাব না। যদি দেখি তোমার খুব বেশি জ্বর উঠে গেছে তা হলে তোমাকে পাঁজাকোলা করে ওপরে নিয়ে যাব।
নায়ীরা রিশির কথা ঠিক বুঝতে পারল বলে মনে হল না। সে শূন্যদৃষ্টিতে রিশির দিকে। তাকিয়ে রইল। তার চোখ ধীরে ধীরে রক্তবর্ণ হয়ে উঠছে, ঠোঁটগুলো শুকনো এবং কেমন যেন নীল হয়ে আসছে। নায়ীরা থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। রিশি নিজের জ্যাকেটটা খুলে নায়ীরার শরীরকে ঢেকে দিয়ে তাকে শক্ত করে ধরে রাখে। নায়ীরা চাপা গলায় বিড়বিড় করে কিছু বলল, রিশি ঠিক বুঝতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, কী বলছ নায়ীরা?
নায়ীরা ফিসফিস করে বলল, আমাকে মেরে ফেলবে।
কে তোমাকে মেরে ফেলবে?
সবাই মিলে। নায়ীরা শূন্যদৃষ্টিতে রিশির দিকে তাকিয়ে বলল, আমার শরীরে ওরা বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে।
নায়ীরা জ্বরের ঘোরে কথা বলছে, তবুও রিশি কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করল। বলল, কেমন করে বিষ ঢুকিয়েছে?
আমাকে অচেতন করে আমার বাম হাতের শিরার ভেতরে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি জানি।
তুমি সেটা নিয়ে চিন্তা করো না নায়ীরা। আমি তোমাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করব।
নায়ীরা বিড়বিড় করে বলল, গত পনের বছরে আমার কখনো অসুখ করে নি। আমার কেন এখন অসুখ হল? কেন?
রিশি নায়ীরাকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল, এটা হয় নায়ীরা। সব মানুষের ছোট বড় অসুখ হয়। হতে হয়।
নায়ীরা বিড়বিড় করে বলল, আমাকে মেরে ফেলবে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। তারপর হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে রিশির ঘাড়ে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল।
রিশি সাবধানে নায়ীরাকে পাথরের ওপর শুইয়ে দিয়ে ঝরনা থেকে আঁজলা করে পানি নিয়ে এসে ভেজা কাপড় দিয়ে তার মুখ, হাত-পা মুছে দেয়। তার নাড়ি, নিশ্বাস স্বাভাবিক। জ্বরটুকু কমিয়ে দিতে পারলেই কোনো বিপদের ঝুঁকি থাকে না। কিন্তু রিশি কিছুই করতে পারছে না। সে নায়ীরার হাত ধরে বসে রইল।
ধীরে ধীরে নায়ীরার জ্বর আরো বাড়তে থাকে। ছটফট করতে করতে কাতর গলায় তার বোনদের ডাকতে থাকে সে। আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করে। তার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। একসময় শরীরে অপ্রতিরোধ্য এক ধনের খিঁচুনি শুরু হয়ে যায়। রিশি নায়ীরাকে শক্ত করে ধরে রেখে তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, নায়ীরা একটু সহ্য কর। একটু সহ্য কর, সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখো, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে-সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
সমস্ত শরীরে খিচুনি দিতে দিতে একসময় হঠাৎ নায়ীরার শরীর অবশ হয়ে এলিয়ে পড়ে। রিশি তার হৃৎস্পন্দন, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের গতি পরীক্ষা করে দেখে, তার সারা শরীর ঘামতে শুরু করেছে। নায়ীরার ওপর থেকে রিশি নিজের জ্যাকেটটি সরিয়ে নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জ্বর নামতে শুরু করে। রিশি নায়ীরার মাথার কাছে বসে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে।
ঘণ্টাখানেক পর নায়ীরা চোখ মেলে তাকাল। রিশি তার ওপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন লাগছে নায়ীরা?
নায়ীরা ফিসফিস করে বলল, ভালো।
চমৎকার। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। রিশি জিজ্ঞেস করল, তোমার কি আগে কখনো এরকম জ্বর উঠেছিল?
না।
জ্বরের ঘোরে তুমি তোমার শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়ার কথা বলছিলে। কথাটা কি তোমার মনে আছে?
নায়ীরা মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ, মনে আছে।
কেন বলছিলে সেটা?
নায়ীরা তার বাম হাত বের করে একটা লাল বিল্টুকে দেখিয়ে বলল, এই যে এখানে দেখ। এখান দিয়ে তারা আমার শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে।
রিশি বিন্দুটা ভালো করে পরীক্ষা করল। সেখানে একটা সুচ ঢুকানো হয়েছিল, এত দিন পরেও সেটা বোঝা যাচ্ছে।
রিশি বলল, তোমার শরীরে কেন বিষ ঢোকাবে?
আমি জানি না।
রিশি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি অসুস্থ। তুমি কি টেহলিস শহরের যাত্রা শুরু করতে চাও? নাকি আমরা ফিরে যাব?
না। নায়ীরা মাথা নাড়ল, আমি ফিরে যেতে চাই না। তা ছাড়া-
তা ছাড়া কী?
আমার এখন নিজেকে অসুস্থ মনে হচ্ছে না।
নায়ীরা উঠে দাঁড়াল। ঝরনার জলধারার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ইস! কী। সুন্দর।
রিশি বলল, আমাদের এখন যেতে হবে নায়ীরা।
চল যাই।
দুজন পাথরে পা রেখে হাঁটতে হাঁটতে ওপরে উঠতে থাকে। রিশি পকেট থেকে তার ঘোট ইলেকট্রনিক ডায়েরিটা বের করল। তাকে কখন কী করতে হবে সেখানে লেখা আছে। বিকেল পঁচটা তিরিশ মিনিট : গ্লাইডারে উড্ডয়ন। তার নিচে ছোট ছোট করে লেখা : গোপনীয়; অপরায়ু বা বিকেলে নায়ীরার সমস্ত শরীরে খিচুনি দিয়ে প্রচণ্ড জ্বর উঠতে পারে। এতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। কোনোভাবেই টেহলিস শহরের অভিযান বন্ধ করা যাবে না।
রিশি নিঃশব্দে তার ইলেকট্রনিক ডায়েরিটা বন্ধ করে পকেটে রেখে দেয়। নায়ীরার সন্দেহটি তা হলে আসলেই সত্যি?
৫. পাহাড়ের চূড়ার দমকা বাতাসে
পাহাড়ের চূড়ার দমকা বাতাসে দেখতে দেখতে গ্লাইডারটি ওপরে উঠে গেল। নায়ীরা তার ককপিটে বসে আছে, বেল্ট দিয়ে সিটের সঙ্গে বাঁধা, তারপরেও সে শক্ত করে ককপিটের দেয়াল ধরে রেখেছে। সামনের ককপিটে বসে থাকা রিশি গলা উঁচিয়ে বলল, ভয় পেও না। নায়ীরা, রুটাই একটু ঝামেলার। একবার ভেসে গেলে আর কোনো সমস্যা নেই।
নায়ীরার বুক ধুকধুক করছিল, কিন্তু সে বলল, আমি ভয় পাচ্ছি না রিশি।
চমৎকার। আরেকটু ওপরে উঠে নিই, তখন ছেড়ে দেব।
গ্লাইডারটি শক্ত নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধা রয়েছে। রিশি আস্তে আস্তে দড়িটি ছাড়ছে আর গ্লাইডারটি ওপরে উঠছে, অনেকটা ঘুড়ি ওড়ানোর মতো। যখন অনেক ওপরে যাবে তখন দড়ির বাধন খুলে গ্লাইডারটি মুক্ত হয়ে উড়ে যেতে শুরু করবে।
নায়ীরা তার ককপিট থেকে মাথা বের করে সাবধানে নিচে তাকাল। তারা পাহাড়ের চূড়া থেকে অনেক ওপরে উঠে গেছে। এখান থেকে ঝরনাধারাটিকে বেশ স্পষ্ট দেখা যায়, মনে হচ্ছে সরু সাদা একটি সুতো ঝুলছে। নিচের বনাঞ্চল সবুজ গাছে ঢাকা। সামনে বহুদূরে সবুজ প্রান্তর, যেখানে অবমানবেরা তাদের ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। নায়ীরা বুকের ভেতর এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে। তারা কি এই ভয়াল উপত্যকা পার হয়ে সত্যিই টেহলিস শহরে যেতে পারবে?
রিশি তার কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ রেখে খুব সাবধানে ওপরে উঠে যাচ্ছে। দুই পাশে গ্লাইডারের ডানা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, বাতাসে মাঝে মাঝে থরথর করে কাঁপছে। আকাশে সাদা মেঘ, একটু পরেই গ্লাইডারটা ওই সাদা মেঘের ওপর দিয়ে ভেসে যাবে। নারীরা নিচে তাকাল। তারা এত ওপরে উঠে এসেছে যে পাহাড়ের চূড়াটুকুও আর আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে পুরো এলাকাটাই বুঝি একই সমতলের অংশ।
ককপিট থেকে রিশির গলা শোনা গেল, নায়ীরা, যেটুকু ওঠার কথা উঠে গেছি।
এখন তা হলে আমরা রওনা দেব?
হ্যাঁ। দড়িটুকু কেটে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্লাইডারটা কিন্তু খানিকটা নিচে নেমে আসবে। ভরশূন্য মনে হবে নিজেকে, ভয় পেও না।
নায়ীরা হাসার চেষ্টা করল। বলল, পেলেও তোমাকে বুঝতে দেব না!
তোমার যেরকম ইচ্ছে। দেখতে দেখতে গ্লাইডারের বেগ বেড়ে যাবে, ইচ্ছে করলে ককপিটের ঢাকনাটা টেনে দিতে পার।
এমনিতেই ভালো লাগছে।
বেশ। তুমি কি প্রস্তুত?
হ্যাঁ রিশি। আমি প্রস্তুত।
ককপিটটা শক্ত করে ধরে রাখ, আমরা যাচ্ছি।
পরমুহূর্তে নায়ীরা একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে। তারপর হঠাৎ করে তার মনে হতে থাকে সে নিচে পড়ে যেতে শুরু করেছে। নিজেকে তার রশূন্য মনে হতে থাকে, মনে হয় সে বুঝি খোলা ককপিট থেকে উড়ে বের হয়ে যাবে। গ্লাইডারটি গতি সঞ্চয় করছে। তার মুখের ওপর সে বাতাসের তীব্র বেগ অনুভব করতে থাকে।
রিশি চিৎকার করে বলল, তুমি ঠিক আছ নায়ীরা?
আছি।
চমৎকার।
গ্লাইডারটি মাথা নিচু করে খানিকটা নিচে নেমে গতি সঞ্চয় করেছে। রিশি এখন এটাকে সোজা করে নেয়। মেঘের ওপর দিয়ে তখন এটা ভেসে যেতে শুরু করে। একটু আগের সেই ভরশূন্য হয়ে উড়ে যাওয়ার অনুভূতিটা নেই। নায়ীরা মুখের ওপর প্রবল বাতাসের ঝাঁপটা অনুভব করে। সে সামনের ড্রয়ার খুলে এক জোড়া গগলস বের করে চোখে পরে নেয়।
বিকেলের পড়ন্ত আলোতে চারপাশে এক ধরনের মায়াময় পরিবেশ, তার ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে তারা গ্লাইডারে করে আকাশের মেঘের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। অত্যন্ত বিস্ময়কর একটা অনুভূতি। নায়ীরা ককপিট থেকে মাথা বের করে সাবধানে নিচে তাকাল। অনেক নিচে গাছপালা, বনবাদাড়, সরু সুতার মতো নদী। নায়ীরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রিশি ককপিটে তার রেডিওটি চালু করে কিছু একটা শুনছে। একটু পর রেডিও বন্ধু করে দিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, উষ্ণ প্রবাহটি চলে এসেছে। চোখ বন্ধ করে আট শ কিলোমিটার চলে যাব।
কতক্ষণ লাগবে?
ধরে নাও, সারা রাত।
সারা রাত চুপচাপ করে বসে থাকব?
বসে থাকতে হবে। কিন্তু চুপচাপ বসে থাকবে, নাকি কথা বলতে থাকবে সেটা তোমার ইচ্ছে।
বাতাসের জন্য কথা বলা যায় না। চিৎকার করে আর কতক্ষণ কথা বলা যায়?
রিশি হাসল। বলল, ঠিকই বলেছ?
নায়ীরা তার জ্যাকেটের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, তুমি উষ্ণ প্রবাহের কথা বলছ, কিন্তু এখানে তো দেখছি বেশ ঠাণ্ডা।
অন্ধকারটা নামুক তখন দেখবে ঠাণ্ডা কাকে বলে। ককপিটের ঢাকনা ফেলে তখন ভেতরে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে হবে।
নায়ীরা দুই হাত ঘষে একটু গরম হওয়ার চেষ্টা করতে করতে ককপিটে আরাম করে বসে থাকার চেষ্টা করল। মাত্র কয়েক দিন আগেই তার এক ধরনের নিস্তরঙ্গ একঘেয়ে জীবন ছিল, এখন হঠাৎ করে পুরো জীবনটি পাল্টে গেছে। মাথায় করে সে একটা তথ্য নিয়ে যাচ্ছে টেহলিস শহরে, কথাটা যদিও সে বিশ্বাস করে না। তবে সে যে কিছু একটা নিয়ে যাচ্ছে, সে কথাটি সত্যি। কী নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে কে জানে! নায়ীরা দূরে। অস্তায়মান সূর্যের দিকে তাকাল। নিচে বিস্তীর্ণ বনভূমিতে এখন নিশ্চয়ই অন্ধকার নেমে এসেছে। আকাশের কাছাকাছি সূর্যটা যাই যাই করেও যেতে পারছে না। চারপাশে সাদা মেঘে সূর্যের রশ্মিটুকুকে কী অপূর্বই না দেখায়! সে কি কখনো ভেবেছিল, তার ধরাবাঁধা ক্লোন-জীবনে কখনো এরকম একটি দৃশ্য দেখার সুযোগ পাবে?
হঠাৎ বহুদূর থেকে গুম গুম শব্দ ভেসে আসে। নায়ীরা চমকে উঠে বলল, কিসের শব্দ?
রিশি দূরে তাকানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, জানি না, মনে হয় অবমানব গোলাগুলি শুরু করেছে।
আমাদের গুলি করেছে?
না। অনেক দূর থেকে শব্দ আসছে। আমাদের দিকে নয়।
আমাদের কি ওরা গুলি করতে পারে?
সম্ভাবনা খুব কম। অন্ধকার নেমে আসছে, আমাদের আর দেখা পাবে না। নিরাপত্তার। জন্য আমরা ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন পর্যন্ত ব্যবহার করছি না।
নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মানুষ আর মানুষ যদি যুদ্ধ না করত তা হলে পৃথিবীটা কী সুন্দর হত, তাই না রিশি।
হ্যাঁ। ঠিকই বলেছ।
রিশি, তোমার কি মনে হয় যে, একদিন মানুষ এত উন্নত হবে যে তারা বুঝতে পারবে যুদ্ধবিগ্রহ করার কোনো অর্থ নেই। তারা একজনের সঙ্গে আরেকজন যুদ্ধ করবে না?
আমার মনে হয় হবে। নিশ্চয়ই হবে।
.
দেখতে দেখতে অন্ধকার নেমে এল। আকাশে আধখানা চাঁদ এবং অসংখ্য নক্ষত্র। নায়ীরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে নক্ষত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। পৃথিবী থেকে কত লক্ষ কোটি মাইল দূরে ওই নক্ষত্রগুলো, সেখানে কি পৃথিবীর মতো কোনো গ্রহ আছে? সেই গ্রহে কি মানুষের মতো কোনো প্রাণী আছে? সেই প্রাণী কি এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে একই কথা ভাবছে? নায়ীরা অকারণে নিজের ভেতরে এক ধরনের শিহরন অনুভব করে।
গ্লাইডারটি হঠাৎ মৃদু একটা ঝাঁকুনি দিয়ে কাঁপতে শুরু করে। নায়ীরা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হল?
কিছু না। আমি গতিপথটা একটু পরিবর্তন করছি।
রিশি।
বলো।
গ্লাইডার চালানো কি খুব কঠিন?
একেবারেই কঠিন না। এটা নিজে ভেসে থাকে। পাখাগুলো নাড়াচাড়া করে গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
বিজ্ঞান কেন্দ্রের একজন বলেছিল, তুমি নাকি পৃথিবীর সেরা গ্লাইডার পাইলট!
রিশি শব্দ করে হেসে বলল, ঠাট্টা করে বলেছে। কারণ কাজটা এত সোজা যে, এর মধ্যে সেরা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রিশি হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে বলল, তুমি গ্লাইডার চালানো শিখতে চাও?
নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, কে? আমি?
হ্যাঁ।
আমি কেমন করে শিখব?
তুমি যদি সাহস করে ফিউজলেজের ওপর দিয়ে আমার ককপিটে চলে আস আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব।
আমি ফিউজলেজের ওপর দিয়ে চলে আসব?
হ্যাঁ। ককপিটে যথেষ্ট জায়গা আছে। একটু চাপাচাপি হবে কিন্তু দুজন বসতে পারব।
নায়ীরা উত্তেজিত গলায় বলল, তুমি সত্যি বলছ?
হ্যাঁ। আমি সত্যি বলছি। তবে খুব সাবধান, পড়ে যেও না যেন। তা হলে বিজ্ঞান কেন্দ্রের লোকজন আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে।
নায়ীরা সিটবেল্ট খুলে নিজেকে মুক্ত করতে করতে বলল, আমি পড়ব না।
ককপিট থেকে শরীরটা বের করে ফিউজলেজটা আঁকড়ে ধরে নায়ীরা সাবধানে সামনে অগ্রসর হতে থাকে, বাতাসে তার চুল উড়ছে, ভয়ে সে নিচে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না। মনে হতে থাকে একটু অসাবধান হলেই বুঝি বাতাস তাকে উড়িয়ে নেবে।
কিন্তু সেরকম কিছু হল না, রিশির কাছাকাছি আসতেই সে হাত বাড়িয়ে খপ করে নায়ীরাকে ধরে ফেলে তারপর শক্ত হাতে তাকে টেনে ককপিটে ঢুকিয়ে নেয়। নায়ীরা ছেলেমানুষের মতো খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, কী মজা হল, তাই না?
পড়ে গেলে মজাটা বের হত! অবমানবেরা যখন দেখত আকাশ থেকে পরী নেমে আসছে, কী অবাক হত বলো দেখি?
কিন্তু সেই পরী তো উড়তে উড়তে নামত না, ঢেলার মতো পড়েই থেঁতলে যেত!
এগুলো হচ্ছে ছোটখাটো ঘুঁটিনাটি। উড়ে উড়ে নামলেও পরী, ঢেলার মতো নামলেও পরী। আকাশ থেকে ফুটফুটে একটা মেয়ে নামছে, সেটাই হচ্ছে বড় কথা।
নায়ীরা কৌতূহল নিয়ে ককপিটের দিকে তাকাল। ভেতরে অনেকগুলো মিটার জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। রিশি তার একটা দেখিয়ে বলল, এই যে এটা দেখাচ্ছে আমরা কত উঁচুতে আছি, আর এটা দেখাচ্ছে আমাদের গতিবেগ। এই এটা দেখাচ্ছে আমরা কোনদিকে যাচ্ছি। আমরা কোনদিকে যেতে চাই সেটা সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছি। যখন সেটা থেকে একটু সরে যায় আমাকে আবার নিজের হাতে আবার ঠিক করে নিতে হয়।
রিশি একটা একটা করে নায়ীরাকে দেখিয়ে দেয়। নারীরা কৌতূহল নিয়ে দেখে, রিশির অনুমতি নিয়ে হাত দিয়ে স্পর্শ করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্লাইডারটা উড়িয়ে নেওয়ার ছোটখাটো বিষয়গুলো সে শিখে যায়। রিশি তাকে উড়িয়ে নিতে দেয় এবং নায়ীরা ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে গ্লাইডারটি উড়িয়ে নিয়ে যায়।
ছোট ককপিটে দুজন পাশাপাশি বসেছে। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। রিশি তাই ককপিটের ঢাকনাটা টেনে দেয়। কিছুক্ষণের ভেতরই ভেতরে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে। রিশি সামনের ড্রয়ার খুলে তাদের শুকনো খাবারের প্যাকেট বের করে, দুজনে খেতে খেতে হালকা গলায় গল্প করে।
নায়ীরা তার কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে ডান দিকের একটা স্ক্রিন দেখিয়ে বলল, এটা কী?
একটা ভিডিওস্ক্রিন। কেন রেখেছে বুঝতে পারছি না। চালু করার চেষ্টা করেছি, কোনো লাভ হয় নি।
নায়ীরা উচ্চতার মিটারটির দিকে তাকিয়ে বলল, খুব ধীরে ধীরে আমাদের উচ্চতা কমে আসছে রিশি।
তুমি ঠিক করে নাও।
নায়ীরা উচ্চতা বাড়ানোর জন্য গ্লাইডারের পাখাগুলো ঠিক করার চেষ্টা করে বলল, এখন আগের উচ্চতায় ফিরে এসেছি, কিন্তু আমাদের গতিবেগ কমে এসেছে।
যেটুকু কমেছে সেটা এমন কিছু নয়।
কিন্তু কেন এরকম হচ্ছে?
রিশি একটু হেসে বলল, এটা অসম্ভব হালকা গ্লাইডার। এর কোথায় কতটুকু ওজন হবে সেটা একেবারে গ্রাম পর্যন্ত হিসাব করা আছে। তোমাকে সামনে নিয়ে আসায় ককপিটটায় ওজন বেশি হয়ে গেছে। তাই গ্লাইডারের ওজনের ব্যালেন্স ঠিক নেই, আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসছে।
নায়ীরা চিন্তিত মুখে বলল, তা হলে আমি পেছনে আমার ককপিটে চলে যাই।
কোনো তাড়াহুড়ো নেই। ধীরেসুস্থে যেও। রিশি হঠাৎ কী মনে করে বলল, তার চেয়ে আরেকটা কাজ করা যাক।
কী কাজ?
তুমি এই ককপিটে বস। আমি পেছনে তোমার ককপিটে বসি।
কিন্তু যদি হঠাৎ করে কিছু হয়?
কী আর হবে? রিশি শব্দ করে হেসে বলল, এটা একটা গ্লাইডার, গাছের পাতা যেরকম বাতাসে ভাসতে ভাসতে নামে, এটাও সেরকম ভাসতে ভাসতে নেমে যাচ্ছে। এর মধ্যে হঠাৎ করে কিছু হওয়ার নেই।
ঠিক আছে, নায়ীরা খুশি হয়ে বলল, আমি হলে তোমার ককপিটে বসছি। তুমি আমার ককপিটে যাও।
রিশি ককপিট থেকে বের হয়ে ফিউজলেজের ওপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে নায়ীরার ককপিটে গিয়ে বসে যায়।
.
ককপিটে বসে নায়ীরা গ্লাইডারটিকে কখনো ওপরে কখনো নিচে নামিয়ে পরীক্ষা করে দেখল। বাতাসের প্রবাহের কারণে কখনো কখনো গতিবেগের পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল, নায়ীরা সেটাও ঠিক করে নিতে শিখেছে। ককপিটে বসে সে দেখতে দেখতে প্রায় দুই শ কিলোমিটার উড়িয়ে নিয়ে এসেছে। বাইরে নিশুতি রাত। চাঁদটি পশ্চিম দিকে খানিকটা ঢলে পড়েছে। জ্যোৎস্নার নরম আলোয় গ্লাইডারটিকে একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো দেখায়। নিচে, বহু নিচে অবমানবেরা হিংস্র চোখে হয়তো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। নায়ীরা। একবার পেছনে ফিরে রিশিকে দেখার চেষ্টা করল। রিশি ককপিটে শান্তভাবে বসে আছে, এই কনকনে শীতেও তার ককপিটের ঢাকনা খোলা, বাতাসে তার চুল উড়ছে। নায়ীরা রিশিকে উদ্দেশ করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ ছোট একটা বিস্ফোরণের মতো শব্দ হল-সঙ্গে সঙ্গে রিশি ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে ওঠে। নায়ীরা শুনতে পেল রিশি একটা কাতর আর্তনাদের মতো শব্দ করেছে। নায়ীরা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, রিশি, কী হয়েছে রিশি?
রিশি তার কথার উত্তর দিল না। নায়ীরা আবার ডাকল, রিশি। রিশি-
রিশি এবারেও তার কথার উত্তর দিল না, শুধু একটা চাপা আর্তনাদের মতো শব্দ করল। এক মুহূর্তের জন্য ভয়ে আতঙ্কে নায়ীরার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল, অনেক কষ্টে সে নিজেকে শান্ত করল। ফিউজলেজের ওপর উঠে সে রিশির ককপিটে এগোতে এগোতে বলল, আমি আসছি বিশি।
গ্লাইডারটি দুলছে, সামনের ককপিটটি সম্ভবত কখনো খালি রাখার কথা নয়, কিন্তু এখন সেটি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। পেছনের ককপিটের কাছাকাছি গিয়ে নায়ীরা আবার ডাকল, রিশি।
ককপিটের ভেতর থেকে রিশি গোঙানোর মতো শব্দ করে বলল, কাছে এস না নায়ীরা।
কেন?
এই ককপিটটাতে বুবি ট্র্যাপ বসানো।
কী বসানো?
বুবি ট্র্যাপ। আমি মারা যাচ্ছি নায়ীরা।
নায়ীরা আর্তনাদ করে বলল, কী বলছ তুমি?
গ্লাইডারটি খুব খারাপভাবে দুলছে, তার মধ্যেই নায়ীরা আরো একটু অগ্রসর হয়ে গেল। রিশি চাপা স্বরে বলল, খবরদার নায়ীরা, কাছে এস না খবরদার।
জ্যোৎস্নার আলোয় নারীরা অস্পষ্টভাবে রিশিকে দেখতে পায়। তার শরীরে ছোপ ছোপ কালো রঙ। আসলে রঙটি কালো নয়, সেটা যে রক্তের ছোপ সেটা বুঝতে নায়ীরার একটুও দেরি হয় না।
তোমার এখানে থাকার কথা ছিল। রিশি ফিসফিস করে বলল, এখানে তোমাকে হত্যা করার কথা ছিল। তুমি বেঁচে গেছ নায়ীরা-।
নায়ীরা আর্তনাদ করে বলল, না। আমি বাঁচতে চাই না –
নায়ীরা, তোমাকে বাঁচতে হবে। তোমাকে টেহলিস শহরে যেতে হবে। আমার জ্যাকেটের পকেটে-
রিশি তার কথা শেষ করতে পারল না, জ্যোত্সর আবছা আলোতে হঠাৎ বিদ্যুঝলকের মতো কিছু একটা রিশির দিকে ছুটে যায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে, সঙ্গে সঙ্গে একটা চাপা আর্তনাদ করে হঠাৎ রিশি নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
নায়ীরা ফিউজলেজে শুয়ে আকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে ডাকল, রিশি, রিশি। আমার রিশি!
মাটি থেকে পাঁচ হাজার মিটার ওপরে গ্লাইডারটি বিপজ্জনকভাবে দুলতে দুলতে নিচে নেমে আসতে থাকে। তার ফিউজলেজে শুয়ে পনের বছরের কিশোরী একটা মেয়ে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে। পৃথিবীর কোনো মানুষ সেই মেয়েটির অসহায় কান্নার শব্দ শুনতে পায় না।
.
নায়ীরা ককপিটে পাথরের মতো বসে আছে। গ্লাইডারটি খুব ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসছে, সেটাকে ওপরে নেওয়া দরকার, কিন্তু নায়ীরা তার চেষ্টা করে না। দক্ষিণ দিক থেকে একটা বাতাস এসে গ্লাইডারটাকে তার গতিপথ থেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেছে, নায়ীরা সেটাও ঠিক করার চেষ্টা করল না-এখন কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। ঠিক তখন খুট করে ককপিটে একটা শব্দ হল, সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোল প্যানেলের ভিডিও মনিটরটি জ্বলে ওঠে। রিশি বলেছিল সে এটা চালু করার চেষ্টা করেছিল লাভ হয় নি। এখন নিজে নিজেই এটা চালু হয়েছে। সেখানে প্রথমে কয়েকটি সংখ্যা ভেসে আসে, তারপর সংখ্যাগুলো সরে গিয়ে একটা নীল আলো দেখা দেয়। প্রথমে এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ এবং তারপর হঠাৎ একজন মানুষের। ছবি ভেসে আসে। নায়ীরা মানুষটিকে চিনতে পারে, বিজ্ঞান কেন্দ্রের পরিচালক রুবা।
রুবা তার কঠিন মুখে জোর করে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, যদি সবকিছু আমাদের পরিকল্পনা মতো ঘটে থাকে, তা হলে রিশি তুমি সামনের ককপিটে বসে আছ এবং খানিকটা বিস্ময় নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছ পেছনের ককপিটে এইমাত্র কী ঘটে গেল। যদি তোমাকে আমরা ঠিকমতো বুঝে থাকি তা হলে তুমি সম্ভবত খানিকটা ক্ষুব্ধ। তিন শ নয় নম্বর ক্লোন মেয়েটি-যে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে নায়ীরা বলে ঘোষণা করে আসছে, তাকে কেন আকাশের এত ওপরে রক্তক্ষরণে নিঃশেষিত করা হল, তুমি নিশ্চয়ই সেটি বোঝার চেষ্টা করছ। ক্লোন তিন শ নয় নিজেকে একটি নাম দিয়ে পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করলেও তার কোনো নাম পাওয়ার অধিকার নেই। সে একটি ক্লোন এবং যেখান থেকে আমরা তাকে এনেছি সেখানে হুবহু তার মতো আরো দশটি ক্লোন রয়েছে। প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রয়োজনে এই ক্লোনদের প্রস্তুত করা হয় এবং প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রয়োজনে তাদের খরচ করা হয়।
বিজ্ঞান কেন্দ্রে আমরা লক্ষ করেছি তিন শ নয় নম্বর ক্লোনের জন্য তোমার খানিকটা মমতার জন্ম হয়েছিল। আমরা সেটাকে অস্বাভাবিক মনে করি না। বাড়ির পোষা কুকুরের জন্য যদি মমতা জন্ম নিতে পারে, তা হলে একটি ক্লোনের জন্য মমতার জন্ম হবে না কেন? তবে আমরা নিশ্চিত, তুমি আমাদের সকল মানুষের অস্তিত্বের প্রয়োজনে একটি ক্লোনকে ব্যবহার করার বিষয়টিকে নিশ্চয়ই খোলামন দিয়ে গ্রহণ করবে।
আমরা কিছুদিন আগে জানতে পেরেছি আমাদের ওপর ব্যবহার করার জন্য অবমানবরা একটি মানববিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করতে শুরু করেছে। তাদের যে কোনো মূল্যে নিবৃত্ত করতে হবে। সেজন্য তারা আঘাত করার আগেই আমরা তাদের আঘাত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের ল্যাবরেটরিতে আমরা একটি ভাইরাস তৈরি করেছি, যেটি তাদের পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে। এই ভাইরাসটির বিশেষত্ব এই যে, সেটি আমাদের আক্রান্ত করতে পারবে না। এই ভাইরাস শুধু অবমানবদের আক্রান্ত করবে। এই ভাইরাসের সংক্রমণের পর অবমানবরা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে ব্যাকটেরিয়ার মতো অত্যন্ত দ্রুত মৃত্যুবরণ করবে। ভাইরাসটি দিয়ে সঠিকভাবে তাদের আক্রমণ করতে পারলে আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতরে অবমানব প্রজাতির পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার কথা। আমরা অবমানবদের নিশ্চিহ্ন করে পৃথিবীকে একটি নিরাপদ বাসস্থান হিসেবে রেখে যেতে চাই।
পৃথিবীকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বাসস্থান হিসেবে রাখার জন্য আমরা ক্লোন তিন শ নয়কে ব্যবহার করছি। আমরা তার শরীরের ভেতরে ভাইরাস জন্মানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। তার শরীরটিকে ব্যবহার করে কোটি কোটি ভাইরাসের জন্ম দেওয়া হয়েছে। আজ দুপুরে শরীরের কোষ ভেঙে সেগুলো তার রক্তস্রোতে মিশে গেছে। সেই সময়টিতে খিচুনি দিয়ে তার সমস্ত শরীরে প্রচণ্ড তাপমাত্রার জন্ম হয়েছিল। ক্লোন তিন শ নয় সেই মুহূর্ত থেকে অবমানবদের জন্য একটি ভয়াবহ মারণাস্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়।
কিছুক্ষণ আগে সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী মারণাস্ত্রটি অতিমানবদের ওপর নিক্ষেপ করা হয়েছে। পদ্ধতিটি খুব সহজ-গ্লাইডারের ককপিটে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার শরীরের গুরুত্বপূর্ণ ধমনিগুলো কেটে দেওয়া। তার শরীরের রক্ত গ্লাইডারের বিশেষ টিউব দিয়ে নিচের বায়ুমণ্ডলে মিশে গেছে। উষ্ণ বায়ুপ্রবাহে সেটি অবমানবদের এলাকায় পৌঁছে যাবে। আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতরে প্রকৃতির সবচেয়ে ভয়ংকর এবং বিপজ্জনক পরীক্ষা অবমানব প্রজন্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
রিশি, আমি নিশ্চিত তুমি বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছ। তোমার প্রতি আমাদের জরুরি নির্দেশ, তুমি ক্লোন তিন শ নয়ের মৃতদেহ নিয়ে গ্লাইডারটিকে নির্দিষ্ট স্থানে অবতরণ করাও। গ্লাইডারে রাখা বিকনটি চালু করা হলে তোমাকে উদ্ধার করা হবে।
আমরা আশা করছি ক্লোন তিন শ নয়ের মৃত্যুর বিষয়টিকে তুমি সহজভাবে নেবে। ভাইরাসে ভরা তার রক্ত অবমানবদের এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এ ছাড়া অন্য কোনো সহজ উপায় ছিল না। শুধু মানবদেহেই এই ভাইরাসটি সজীব থাকে এবং বংশবৃদ্ধি করে। তাকে এই প্রক্রিয়ায় হত্যা করা না হলেও আগামী দুই সপ্তাহে তার মৃত্যু ঘটত। এই ভাইরাস আমাদের আক্রান্ত করে না, কিন্তু ক্লোন তিন শ নয়ের দেহের প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি অঙ্গ ভাইরাসের জন্মের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। যে তিন শ নয় নম্বর ক্লোনটি আগামী দু সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যুবরণ করত, সেটি এখন মৃত্যুবরণ করেছে। এটাই পার্থক্য।
বিদায় রিশি। তোমাকে উদ্ধার করার জন্য আমরা তোমার সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করব।
খুট করে ভিডিও মনিটরটি বন্ধ হয়ে গেল। নায়ীরা তখনো নিস্পলক দৃষ্টিতে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকে দেখে মনে হয়, তার আশপাশে কী ঘটছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
খুব ধীরে ধীরে নায়ীরা পুরো ব্যাপারটি বুঝতে পারে। ভয়ংকর অবমানবদের ভাইরাস দিয়ে হত্যা করার জন্য তাকে পাঠানো হয়েছে, তার রক্তের মধ্যে রয়েছে সেই ভাইরাস। ঘটনাক্রমে সেই ভাইরাস এখনো মুক্ত হয় নি। রিশির প্রাণের বিনিময়ে অবমানবেরা বেঁচে গেছে, কিন্তু সেটি নিশ্চয়ই সাময়িক। বিজ্ঞান কেন্দ্র যখন জানতে পারবে তারা আবার চেষ্টা করবে, সফল না হলে আবার। আজ হোক কাল হোক পৃথিবী থেকে অবমানবদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে। পৃথিবী হবে একটি নিরাপদ স্থান।
সেটি এখনো নিরাপদ হয় নি, তা হলে কি তার নিজের প্রাণ দিয়ে পৃথিবীকে নিরাপদ করা উচিত? ধারালো একটা চাকু দিয়ে তার হাতের ধমনি কেটে দেওয়া উচিত, যেন তার শরীরের ভেতরে বাস করা কোটি কোটি ভাইরাস কিলবিল করে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে? নায়ীরা তার হাতের দিকে তাকাল, না, সে নিজের হাতের ধমনি কাটতে পারবে না। দু সপ্তাহ পর সে এমনিতেই মারা যাবে জেনেও সে এখন নিজেকে হত্যা করতে পারবে না। যত ভয়ংকরই হোক, মানবপ্রজাতির একটি অপভ্রংশকে সে এভাবে নিঃশেষ করতে পারবে না। সে খুব সাধারণ একটি মেয়ে। একটি প্রজাতিকে পৃথিবী থেকে পুরোপুরি অপসারণ করার মতো এত বড় একটি সিদ্ধান্ত সে নিতে পারবে না। কিছুতেই সে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।
নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে ঠিক করল, সে বেঁচে থাকবে। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে রিশি তাকে বলেছে, তাকে বেঁচে থাকতে হবে। তার জ্যাকেটের পকেটে কিছু একটা আছে, সেটা তাকে দেখতে হবে। সেটা না দেখে সে মারা যাবে না। কিছুতেই মারা যাবে না।
নায়ীরা একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে বসে। এই গ্লাইডারটাকে এখন সে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, ঠিক যেভাবে ভাসিয়ে নেওয়ার কথা। তারপর এটাকে ঠিক জায়গায় সে নিচে নামিয়ে আনবে, ঠিক যেভাবে নামিয়ে আনার কথা। তারপর সে যাবে টেহলিস শহরের দিকে, ঠিক যেভাবে তার যাওয়ার কথা। হতে পারে সেটি অসম্ভব, কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। তার শরীরে মৃত্যু বাসা বেঁধেছে, তার আর কোনো কিছুতে ভয় পাওয়ার নেই। সে আর কোনো কিছুতে ভয় পাবে না।
.
দীর্ঘ একটি রাত শেষ হয়ে যখন পূর্ব আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে, উঁচু গাছের কচি পাতায় যখন ভোরের সূর্যের সোনালি রোদ স্পর্শ করেছে, তখন অতিকায় একটি ফিনিক্স পাখির মতো ধবধবে সাদা গ্লাইডারটি নিঃশব্দে নিচে নেমে এল। চাকার ওপর ভর করে। সোজা সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটে গিয়ে একসময় সেটি থেমে যায়।
নায়ীরা তার ককপিট থেকে নিচে নেমে আসে। সে এখন অবমানবের এলাকায়। হয়তো এই মুহূর্তে কোনো একজন অবমানব তার ভয়ংকর বিকৃত চেহারা নিয়ে, তার তিনটি চোখ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো হাতের সাত আঙুল দিয়ে ধরে রাখা কোনো ভয়ংকর অস্ত্র তার দিকে তাক করে রেখেছে, অদৃশ্য কোনো বুলেট তার মস্তিষ্ককে বিদীর্ণ করে দেবে, নিজের অজান্তে তার শরীরের লক্ষ-কোটি ভাইরাস কিলবিল করে তাদের ধ্বংস করার জন্য ছড়িয়ে পড়বে। নায়ীরা কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, কোনো বুলেট তার মস্তিষ্ককে বিদীর্ণ করে দিল না, ভয়ংকর অস্ত্র হাতে দুই মাথার কোনো দানবও ছুটে এল না। নায়ীরা তখন পেছনের ককপিটে গিয়ে ভেতরে তাকাল। সিটবেল্টে বাঁধা রিশির মৃতদেহ রক্তশূন্য এবং বিবর্ণ। ঠোঁট দুটো নীল, চোখ আধখোলা। রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। নায়ীরা ফিসফিস করে বলল, আমি দুঃখিত রিশি। আমি খুব দুঃখিত।
রিশি বলেছিল তার জ্যাকেটের পকেটে কিছু একটা আছে, সে যেন সেটা দেখে। নায়ীরা সাবধানে জ্যাকেটের পকেটে হাত দেয়, সেখানে দুমড়ানো একটা খাম। নায়ীরা খামটি খুলে দেখে ভেতরে খবরের কাগজের এক টুকরো কাগজ। সেখানে ছোট একটা খবর, নায়ীরা ফিসফিস করে সেটা পড়ল।
মহাকাশবিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনা রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে সম্মানিত
কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনাকে (৪২) সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, নীরা ত্রাতিনা একাধিকবার দুঃসাহসিক মহাকাশ অভিযানে অংশ নিয়েছেন এবং মহাকাশে নিউক্লিয়াসের বিশ্লেষণ সম্পর্কে তার মৌলিক গবেষণা কাজ রয়েছে। যৌবনে মহাকাশে এক দুর্ঘটনায় তার প্রিয় সহকর্মীর মৃত্যুর পর তিনি তার একাকী নিঃসঙ্গ জীবন মহাকাশ গবেষণায় অতিবাহিত করেন।
ছোট খবরটির ওপরে বিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনার একটি ছবি। নায়ীরা নিশ্বাস বন্ধ করে বিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনার ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। ছবিটি তার নিজের। তার থেকে একটু বয়স বেশি, কিন্তু মানুষটি যে সে নিজে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তার কালো চুল, তার চোখ, ঠোঁটের কোনায় তার হাসি। রিশি টেবিলের ওপর থেকে একবার তার একটি চুল তুলে নিয়েছিল, সেখান থেকে তার ডিএনএ প্রোফাইল বের করে নিশ্চয়ই নীরা ত্রাতিনাকে খুঁজে বের করেছে।
কী আশ্চর্য! মহাকাশবিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনা কি জানে তার ক্লোন করা হয়েছে? সে কি জানে তার দুঃসাহসী অস্তিত্বকে এখন ল্যাবরেটরিতে গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করা হয়? যদি জানত তা হলে সে কী করত?
নায়ীরা কাগজের টুকরোটি পকেটে রেখে সাবধানে রিশির দেহটি মুক্ত করে নিচে নামিয়ে আনে। এই মানুষটির মৃতদেহ একটি সম্মানজনক শেষকৃত্য দাবি রাখে। একজন মানুষের মৃতদেহকে কেমন করে সমাহিত করতে হয় সে জানে না। তবু সে চেষ্টা করবে। মাটিতে গর্ত করে সে রিশিকে সেখানে শুইয়ে দেবে। সমাধির ওপরে একটি পাথর রেখে। সেখানে লিখে দেবে, রিশি : পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ।
নায়ীরা গ্লাইডার থেকে একটা শাবল নিয়ে ছায়াঢাকা একটি সুন্দর জায়গায় মাটি কাটতে থাকে। সে আগে কখনো মাটি কাটে নি, মাটি কাটতে এত কষ্ট সে জানত না। নিঃশব্দে সে শাবল দিয়ে গর্ত করতে থাকে, তাকে খুব সাবধান থাকতে হবে যেন কোনোভাবে শরীরের কোথাও কেটে না যায়। শরীর থেকে যেন এক ফোঁটা রক্তও বের হয়ে না আসে একটি প্রজাতিকে সে ধ্বংস করতে চায় না। সে প্রজাতি যত ভয়ংকর প্রজাতিই হোক।
রিশির দেহটিকে মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়ার আগে নায়ীরা তাকে শেষবারের মতো স্পর্শ করে ফিসফিস করে বলল, রিশি। বিদায়। তুমি কোথায় গিয়েছ আমি জানি না। তবে সেখানে আমি আসছি। দু সপ্তাহের মধ্যেই আছি।
পুরো দেহটি মাটি দিয়ে ঢেকে সে যখন উঠে দাঁড়াচ্ছে ঠিক তখন তার নজরে পড়ল গাছের নিচে এক জোড়া পা। কোনো একজন মানুষ নিঃশব্দে তাকে দেখছে। নায়ীরা খুব ধীরে ধীরে চোখ তুলতে থাকে—পা, দেহ এবং সবশেষে মাথা। নায়ীরা এর আগে অনেকবার অবমানবের বর্ণনা শুনেছে, কিন্তু নিজের চোখে প্রথমবার একজন অবমানব দেখে নায়ীরা আতঙ্কে শিউরে ওঠে। বিকৃত কুঞ্চিত ভয়ংকর একটি মুখমণ্ডল, দুটি চোখ ঠেলে বের হয়ে এসেছে। নাক নেই, সেখানে গলিত একটি গর্ত। ঠোঁটহীন একটি মুখ, ধারালো দাঁতের পেছনে লকলকে লাল জিব। মুখ থেকে আঠালো লালা ঝরছে। তীব্র ক্রুর দৃষ্টিতে কুৎসিত অবমানবটি তার দিকে তাকিয়ে আছে।
নায়ীরা আতঙ্কে চোখ বন্ধ করল। এই ভয়ংকর প্রাণীটির দিকে সে তাকাতে পারবে না। কিছুতেই পারবে না। নারীরা চোখ বন্ধ করে হাঁটু গেড়ে বসে রইল। প্রাণীটি তাকে আঘাত করুক, তাকে হত্যা করুক। সে রিশির পাশে প্রাণ হারিয়ে শুয়ে থাকবে। কিন্তু সে আর চোখ খুলবে না। কিছুতেই চোখ খুলবে না।
তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?
অবমানবটির কথা শুনে নায়ীরা চমকে ওঠে। ভয়ংকর চেহারার এই প্রাণীটির গলার স্বর ভরাট এবং স্পষ্ট। উচ্চারণ একটু অন্যরকম, কিন্তু কথা বুঝতে কষ্ট হয় না। নায়ীরা দু হাতে মুখ ঢেকে রইল, তার কথা বলার শক্তি নেই।
চোখ তুলে তাকাও মেয়ে।
নায়ীরা ভয়ে ভয়ে চোখ তুলে তাকায়। ভয়ংকর প্রাণীটি তার দিকে এগিয়ে আসে, তারপর গলার কাছে হাত দিয়ে নিজের মুখোশটি খুলে নেয়। মুখোশের নিচে অনিন্দ্যসুন্দর একজন তরুণের মুখ, নীল চোখ, খাড়া নাক, কুচকুচে কালো চুল। তরুণটি একটু এগিয়ে এসে বলল, তুমি কি আমার মুখোশ দেখে ভয় পেয়েছ? আমি দুঃখিত। খুব দুঃখিত।
নায়ীরা কিছুক্ষণ বিস্ফারিত চোখে এই অনিন্দ্যসুন্দর তরুণের দিকে তাকিয়ে রইল। সে ধাতস্থ হতে একটু সময় নেয়। বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি মুখে এই মুখোশটি পরেছিলে কেন?
তরুণটি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে একটু হেসে বলল, এখানে কেউ নেই। আমি একা। মানুষ একা থাকলে অদ্ভুত অনেক কিছু করে। তা ছাড়া
তা ছাড়া কী?
আমি হরিণ কিংবা একটা পাহাড়ি ছাগল শিকার করতে এসেছি।
শিকার? নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, আমি জানতাম মানুষ প্রাচীনকালে শিকার করত। এখনো করে?
সুদর্শন তরুণটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, আমাদের মাঝে মাঝে করতে হয়। তখন আমি এখানে আসি।
ও। আচ্ছা।
শিকার করার সময় আমি এই মুখোশটা মুখে পরে নিই।
কেন?
হরিণ কিংবা পাহাড়ি ছাগলের মতো সুন্দর এক প্রাণীকে হত্যা করতে আমার খুব খারাপ লাগে। তখন আমি মুখে এই মুখোশটা পরে নিয়ে ভান করি যে আমি আমি না। আমি অন্য কেউ। একটা দানব।
নায়ীরা একটু অবাক হয়ে এই বিচিত্র তরুণটির দিকে তাকিয়ে রইল। এই তরুণটি কি অবমানব? অবমানব সম্পর্কে কত ভয়ংকর কথা শুনেছে কিন্তু তরুণটিকে তো মোটেও ভয়ংকর মনে হচ্ছে না। একটু বিচিত্র কিন্তু মোটেও ভয়ংকর নয়।
তরুণটি এক পা থেকে অন্য পায়ে ভর সরিয়ে নিয়ে বলল, তুমি কে? তুমি কোথা থেকে এসেছ?
নায়ীরা একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি তোমার এ প্রশ্নের উত্তর কেমন করে দেব জানি না। কারণ এর কোনো উত্তর নেই। আমি কেউ না। আমার কোনো নাম পর্যন্ত নেই। আমি নিজের জন্য একটা নাম ঠিক করেছি, সেই নামে আমাকে কেউ ডাকে না। একজন ডাকত, তাকে আমি এখানে কবর দিয়েছি।
তরুণটি বিস্মিত হয়ে বলল, এখানে কবর দিয়েছ?
হ্যাঁ।
তরুণটি শিস দেওয়ার মতো এক ধরনের শব্দ করে বলল, আমি দুঃখিত যে তোমার একজন সঙ্গী মারা গেছে। সে কেমন করে মারা গেল?।
নায়ীরা একটু ইতস্তত করে বলল, পুরো বিষয়টি আমি যদি তোমাকে খুলেও বলি তুমি সেটা বিশ্বাস করবে না। আমার কথা থাকুক। তুমি কে?
আমার নাম তিহান।
তিহান?
হ্যাঁ।
আমার নাম নায়ীরা।
তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম নায়ীরা। তরুণটি একটু এগিয়ে এসে হাত মেলানোর জন্য তার হাতটি বাড়িয়ে দেয়।
নায়ীরা কিছুক্ষণ বাড়িয়ে দেওয়া হাতটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার সঙ্গে হাত মেলানো ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না।
কেন?
কারণ আমার শরীরে ভয়ংকর একটা ভাইরাস আছে। এই ভাইরাস দিয়ে তোমাদের সবাইকে হত্যা করার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছে। তোমাকে স্পর্শ করলে যদি তোমার শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ হয়?
নায়ীরা ভেবেছিল, তার এ কথা শুনে তিহান নামের এই তরুণটি খুব বিস্মিত হবে।
কিন্তু তরুণটি বিস্মিত হল না। এগিয়ে দেওয়া হাত সরিয়ে নিয়ে শান্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
নায়ীরা জিজ্ঞেস করল, আমার কথা শুনে তুমি অবাক হও নি?
তিহান মাথা নাড়ল, না।
কেন নয়?
কারণ আমরা জানি, এরকম একটা কিছু হবে।
তোমরা জান? নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, তোমরা কেমন করে জান?
আমরা জানি পৃথিবীর মানুষ আমাদের অবমানব বলে। তারা আমাদের নিয়ে অনেক রকম পরীক্ষা করে।
তোমাদের নিয়ে অনেক পরীক্ষা করে?
হ্যাঁ। আমার মায়ের কাছে আমরা শুনেছি পৃথিবীর মানুষেরা একসময় আমাদের নিয়ে জেনেটিক এক্সপেরিমেন্ট করেছে। তখন এখানে অনেক বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিয়েছে। তাদের হাতে সাতটি আঙুল। কপালে বাড়তি চোখ। উত্তরের একটা গ্রামে একটা শিশুর দুটি মাথা ছিল।
এখন সেরকম শিশুর জন্ম হয় না?
না।
কেন?
মনে হয় তারা সেই এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করেছে। এখন আমাদের নিয়ে অন্য এক্সপেরিমেন্ট করে।
কী এক্সপেরিমেন্ট?
আমাদের সব পাওয়ার স্টেশন বন্ধ করে দিয়েছে। আমাদের সবকিছু তখন বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা এখন প্রাচীন মানুষের মতো থাকি। চাষ করি। শিকার করি। গাছের বাকলের পোশাক পরি।
নায়ীরা অবাক হয়ে বলল, ও।
আমার মা বলেন, আমরা আসলে একটা ল্যাবরেটরিতে আছি। আমাদের ওপর এক্সপেরিমেন্ট করে পৃথিবীর মানুষ গবেষণা করে। মানুষের ওপর গবেষণা। সমাজের ওপর গবেষণা।
নায়ীরা কী বলবে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। তিহান একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মাঝে মাঝে হঠাৎ করে ভয়ংকর কোনো রোগ এসে আমাদের ওপর ভর করে। আমাদের অনেক মানুষ তখন মারা যায়। আমার মা বলেছে, পৃথিবীর মানুষ একটা রোগ বের করার জন্য গবেষণা করছে, যে রোগে আমাদের সব মানুষ একসাথে মরে যাবে।
নায়ীরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তিহানের দিকে তাকিয়ে রইল। তিহান বলল, আমি যাই।
তুমি কোথায় যাবে?
আমি আমার গ্রামে যাব। গিয়ে সবাইকে বলব আমরা যে শেষ সময়টার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, সেই সময়টা চলে এসেছে।
তোমার কি ভয় করছে তিহান?
না। আমার ভয় করছে না। একটু দুঃখ লাগছে, কিন্তু ভয় করছে না। তিহান কয়েক মুহূর্ত নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, বিদায়। তারপর হাতের মুখোশটা সে মাথায়। পরে নিল। মুহূর্তে তাকে দেখাতে লাগল একটা ভয়ংকর দানবের মতো। তিহান ঘুরে দাঁড়াল, তারপর পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটতে ব্রু করল। নায়ীরা হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলল, তিহান দাঁড়াও। শোন।
তিহান তার ভয়ংকর মুখ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়, কী হল?
আমি কি তোমার সঙ্গে যেতে পারি?
কোথায়?
তোমাদের গ্রামে।
কেন?
তোমার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে।
তিহান কয়েক সেকেন্ড কিছু একটা চিন্তা করল। তারপর মুখ থেকে ভয়ংকর মুখোশটা খুলে বলল, এস।
তুমি এক সেকেন্ড অপেক্ষা কর। আমি একটা জিনিস নিয়ে নিই।
কী জিনিস?
একটা বিকন। এটা চালু করলে বিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে উদ্ধার করতে আসবে।
কাকে উদ্ধার করতে আসবে?
আমাকে না। রিশিকে। যাকে আমি এখানে কবর দিয়েছি।
তিহান কোনো কথা বলল না। নিঃশব্দে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে রইল। নায়ীরা গ্লাইডারের ড্রয়ার খুলে ঘোট ইলেকট্রনিক বিকনটা খুঁজে বের করে নিজের পকেটে নিয়ে নেয়। তারপর তিহানের কাছে এসে বলল, চল যাই।
চল।
তিহান, শুধু একটা বিষয়ে খুব সাবধান।
সেটা কী?
আমার রক্তে কিলবিল করছে এমন একটা ভাইরাস যেটা আমাকে এত সহজে হত্যা। করতে পারবে না, কিন্তু তোমাদের আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতরে শেষ করে দেবে। কাজেই খুব সাবধান, যেন কোনোভাবে আমার শরীর কেটে রক্ত বের হয়ে না যায়। তা হলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে।
তিহান কোনো কথা না বলে একটু হাসার চেষ্টা করল। নায়ীরা জিজ্ঞেস করল, তুমি হাসছ কেন?
কারণ কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। পৃথিবীর মানুষ তোমাকে দিয়ে যদি আমাদের শেষ করতে না পারে, তা হলে আরেকজনকে পাঠাবে। তাকে দিয়ে সম্ভব না হলে আরেকজনকে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে, কাজেই এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। আজ হোক কাল হোক, আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব নায়ীরা।
নায়ীরা কিছুক্ষণ তিহানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি দুঃখিত তিহান।
তোমার দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই।
আমি জানি না, এটা থেকে সান্ত্বনা পাওয়ার কোনো যুক্তি আছে কিনা আমার শরীরকে ভাইরাস তৈরির জন্য ব্যবহার করেছে বলে আমার আয়ু আর মাত্র দুই সপ্তাহ।
আমি দুঃখিত নায়ীরা।
তোমারও দুঃখিত হওয়ার কিছু নেই তিহান।
কথাটি হাসির কথা নয় কিন্তু কেন জানি দুজনেই একসাথে একটু হেসে ফেলল।
বনের ভেতর দিয়ে নায়ীরা তিহানের সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে যেতে থাকে। দুই পাশে গাছে বুনো ফুল, বাতাসে ফুলের গন্ধ। পাখি ডাকছে, কাঠবিড়ালী গাছে ছুটোছুটি করছে। নায়ীরা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তার এখনো বিশ্বাস হয় না প্রকৃতির এত কাছাকাছি যে মানুষগুলো বেঁচে আছে, কী আশ্চর্য নিষ্ঠুরতায় তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে।
বুনো পথ শেষ হয়ে হঠাৎ একটা খোলা প্রান্তর শুরু হয়ে গেল। লম্বা ঘাসের ভেতর দিয়ে দুজন হেঁটে যায়। প্রান্তরের শেষে একটা নদী। একটা গাছের নিচে ছোট একটা নৌকা বাঁধা। একটা গাছের ভেতরটুকু খোদাই করে নৌকাটি তৈরি করা হয়েছে। দুজন কষ্ট করে বসতে পারে। তিহান নৌকাটা খুলে নায়ীরাকে বলল, ওঠ।
নায়ীরা নদীর স্বচ্ছ পানিতে পা ভিজিয়ে নৌকায় উঠে বসে। তিহান নৌকাটাকে মাঝনদীর দিকে ধাক্কা দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসল। নদীর স্রোতে নৌকাটা তরতর করে। এগোতে থাকে, তিহান বৈঠাটাকে হালের মতো ধরে রেখেছে। তিহান হাত দিয়ে নদীর পানি তুলে এক চুমুক খেয়ে বলল, সোতের টানে যাচ্ছি, দেখতে দেখতে পৌঁছে যাব।
তোমার গ্রাম এখান থেকে কত দূর?
তিহান মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, এখন আমাদের কাছে এই প্রশ্নগুলোর কোনো অর্থ নেই। একসময় আমরা মিটার-কিলোমিটার ব্যবহার করেছি। এখন আর প্রয়োজন হয় না। দূরত্ব হচ্ছে কাছে কিংবা দূরে। ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ড বলেও আমাদের কিছু নেই। সময় এখন হচ্ছে সকাল-দুপুর আর সন্ধ্যা!
নায়ীরা আর কোনো কথা বলে না। দেখতে দেখতে নৌকাটা বুনো অঞ্চল পার হয়ে লোকালয়ের কাছাকাছি আসতে থাকে। নদীর পাশে হঠাৎ করে একটা-দুটো গ্রাম দেখা যায়। মাটির ঘর, ঘাসের ছাদ। নদীর তীরে উদোম গায়ে শিশুরা খেলছে। শক্ত-সমর্থ নারীরা শস্য বাছাই করছে। পুরুষ মানুষেরা মাঠে কাজ করছে। দেখে মনে হয় কয়েক হাজার বছর আগের একটা দৃশ্য। আধুনিক সভ্যতার কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু পুরো দৃশ্যটাতে এক ধরনের আশ্চর্য কোমল শান্তির ছাপ খুব স্পষ্ট। নায়ীরা সেদিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ একটু বিভ্রান্ত হয়ে যায়, পৃথিবীর সভ্যতা সত্যিই কি ঠিকভাবে অগ্রসর হচ্ছে?
তিহান যখন তার গ্রামে পৌঁছল, তখন সূর্য ঢলে পড়ে বিকেল হয়ে এসেছে। নদীর ঘাটে নৌকাটা বেঁধে তিহান নদীর তীরে নেমে এল। স্বচ্ছ নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে নায়ীরাও নেমে আসে। গ্রামের ছোট ছোট শিশুরা নদীর ঘাটে ভিড় করেছে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে আরো কিছু নারী-পুরুষ এগিয়ে এসেছে। এখানকার মানুষের সঙ্গে নায়ীরার চেহারা আর পোশাকের পার্থক্যটুকু খুব স্পষ্ট।
নৌকা থেকে নেমে তিহান সোজা হেঁটে যেতে থাকে। আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন তাকে নিচু স্বরে কিছু একটা জিজ্ঞেস করল, তিহান তাদের কারো প্রশ্নের উত্তর দিল না। নায়ীরা চারপাশে তাকায়, ঘোট ঘোট শিশু, কিশোর-কিশোরী আর নানা বয়সের পুরুষ ও রমণী তাকে ঘিরে রেখেছে। তার শরীরের এক ফোঁটা রক্ত এদের সবাইকে হত্যা করে ফেলতে পারে! এর চেয়ে বড় নিষ্ঠুরতা, এর চেয়ে বড় পরিহাস আর কী হতে পারে?
একটা বড় খালি উঠোনের চারপাশে ছোট ছোট কয়েকটা মাটির ঘর। তিহান তার একটার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকল, মা।।
কয়েক মুহূর্ত পর ভেতর থেকে মধ্যবয়সী একজন মহিলা বের হয়ে আসে। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, মুখে বয়সের বলিরেখা, রোদে পোড়া বাদামি চেহারা, শরীরে হাতে বোনা মোটা ধূসর কাপড়ের পোশাক। মহিলাটি ঘর থেকে বের হয়ে নায়ীরাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। একবার তিহানের দিকে, আরেকবার নায়ীরার দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, তুমি কে, মেয়ে?
নায়ীরা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ধূসর বিবর্ণ কাপড়ে ঢাকা মধ্যবয়স্ক এই মহিলাটির চোখ দুটোর দৃষ্টি কী তীব্র। মনে হয় তার শরীর ভেদ করে চলে যাচ্ছে। মহিলাটি আবার জিজ্ঞেস করল, কে তুমি?
নায়ীরা কী বলবে বুঝতে পারল না। তিহান বলল, মা, তুমি যার কথা সব সময় বলল, এই মেয়েটি সেই মেয়ে।
মহিলাটি কেমন যেন চমকে উঠে ঘুরে নায়ীরার দিকে তাকায়। তীব্র স্বরে বলল, তুমি কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ?
নায়ীরা ভাঙা গলায় বলল, আমি একা আর পারছি না। আমার কারো সঙ্গে কথা বলতে হবে। আমাকে তুমি ফিরিয়ে দিও না।
তুমি কী বলতে চাও?
নায়ীরা ক্লান্ত গলায় বলল, আমি কি তোমার সঙ্গে একা একা কথা বলতে পারি?
মহিলাটি কিছুক্ষণ নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তুমি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত। তুমি বস, তোমাকে আগে আমি কিছু খেতে দিই।
মহিলাটি ঘরের ভেতর থেকে ঘাসে বোনা একটি কার্পেট এনে বিছিয়ে দিয়ে বলল, বস।
নায়ীরা মাটির ঘরে দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে। সত্যিই সে ক্লান্ত। সত্যিই সে ক্ষুধার্ত। শুধু একজন মা হয়তো সন্তানের মতো কাউকে দেখে সেটা বুঝতে পারে। অন্যেরা পারে না। তার মা নেই। তার কখনো মা ছিল না। নীরা ত্রাতিনা নামে বিখ্যাত একজন বিজ্ঞানীর শরীরের একটি কোষ নিয়ে ল্যাবরেটরিতে তাকে ক্লোন করা হয়েছিল। একজন মানুষের শরীরের একটা কোষ নিয়ে যদি কাউকে ক্লোন করা হয় তা হলে কি তাকে মা বলা যায়? একজন মানুষের মা থাকা নিশ্চয়ই খুব বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। নিশ্চয়ই খুব মধুর অভিজ্ঞতা।
তিহানের মা মাটির একটা বাটিতে করে গরম সুপ নিয়ে আসে। সেই গরম সুপে চুমুক দিয়ে নায়ীরা মধ্যবয়স্ক মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, আমি তোমাকে কী বলে সম্বোধন করব?
এই গ্রামে সবাই আমাকে ফুলী-মা বলে ডাকে। এই গ্রামে সবাই আমার সন্তানের মতো।
আমিও তোমাকে ফুলী-মা বলে ডাকব?
ডাক।
আমি একজন ক্লোন। আমার কোনো মা ছিল না। আমি যদি কখনো কাউকে মা ডাকি সেটা হবে একটা মিথ্যাচার।
এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। এটি শুধু একটি সম্বোধন। ফুলী-মা একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুমি বলো, তুমি কেন আমার কাছে এসেছ।
আমি তোমাদের সবার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।
তুমি কেন আমাদের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছ?
তিহানের কথা থেকে তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ আমার রক্তের ভেতরে রয়েছে তোমাদের সবাইকে হত্যা করার জন্য এক ভয়ংকর ভাইরাস।
ফুলী-মা কোনো কথা না বলে স্থিরদৃষ্টিতে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে রইল। নায়ীরা বলল, গত রাতে আকাশে আমার হাতের ধমনি কেটে তোমাদের ওপর এই ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিল। ঘটনাক্রমে সেটি ঘটে নি।
ফুলী-মা বলল, আজ হোক, কাল হোক সেটা ঘটবে। পৃথিবীর মানুষ সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তোমাকে দিয়ে যদি না পারে তা হলে তারা অন্য কাউকে দিয়ে আমাদের সবাইকে হত্যা করবে।
নায়ীরা বলল, আমাকে তুমি সেটা বুঝিয়ে দেবে?
তুমি কী বুঝতে চাও মেয়ে?
কেমন করে এটা হতে পারে?
আমি ছোট থাকতে যখন ইতিহাস পড়েছি তখন দেখেছি, অসংখ্যবার পৃথিবীতে এ ঘটনা ঘটেছে। মানুষ নিজেদের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়েছে, তারপর শক্তিমান মানুষ দুর্বল মানুষকে হত্যা করেছে।
নায়ীরা বলল, কিন্তু কেন মানুষের বিভাজন হবে? আমি কেন ক্লোন, অন্যেরা কেন মানুষ? আমরা সবাই কেন মানুষ না? তোমরা কেন অবমানব, অন্যেরা কেন মানব? সবাই কেন মানব না?
মহিলা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, এই আলোচনা থাক মেয়ে। আমরা জানতাম, মৃত্যু আসছে। চারপাশে পাহাড়, এক পাশে নদী, বিশাল এই এলাকায় আমরা আটকা পড়া কিছু মানব। পৃথিবীর মানুষের ভাষায় অবমানব! ভালোই হল, তুমি সঙ্গে করে মৃত্যুকে নিয়ে এসেছ। কখন সেই ভয়ংকর সময় আসবে এখন আমাদের সেটা নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমরা ভেবেচিন্তে আমাদের সময় ঠিক করে নেব।
না। নায়ীরা মাথা নাড়ল, না, ফুলী-মা, সেটা হতে পারে না।
কী হতে পারে না?
এভাবে তোমাদের সবার মৃত্যু হতে পারে না।
নায়ীরা, তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।
শোন ফুলী-মা, পৃথিবীর মানুষ তোমাদের কথা জানে না। যেটুকু জানে ভুলভাবে জানে, বিকৃতভাবে জানে। আমি তাদের ভুল ভাঙাতে চাই, সত্যি কথা জানাতে চাই।
নায়ীরার কথা শুনে ফুলী-মা শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, তুমি কি ভেবেছ আমরা তার চেষ্টা করি নি? কতবার চেষ্টা করেছি। আমাদের কত তরুণ-তরুণী টেহলিস শহরে যেতে চেষ্টা করেছে। কতবার সেই পাহাড় অতিক্রম করতে চেয়েছে। প্রতিবার তাদের ধরে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। কেউ যেতে পারে নি। পৃথিবীর মানুষকে বোঝানো হয়েছে। আমরা অবমানব। আমরা ভয়ংকর প্রাণী। আমরা নিষ্ঠুর, আমরা হিংস্র, আমরা খুনি!
আমরা কি তাই বলে হাল ছেড়ে দেব? পৃথিবীর মানুষকে আমরা আর সত্যি কথা জানাতে চেষ্টা করব না?
কীভাবে চেষ্টা করবে?
নায়ীরা পকেট থেকে ছোট ইলেকট্রনিক বিকনটা বের করে দেখাল, এই যে দেখছ, এটা একটা ইলেকট্রনিক বিকন। এর সুইচটা অন করলে বিজ্ঞান কেন্দ্র থেকে কেউ আসবে উদ্ধার করতে। নিশ্চয়ই একটা হেলিকপ্টারে আসবে। তুমি এই গ্রামে তোমার সন্তানদের দিয়ে সেই হেলিকপ্টারটি দখল করিয়ে দিতে পারবে?
যদি দিই, তখন তুমি কী করবে?
আমি সেটা নিয়ে টেহলিস শহরে উড়ে যাব।
গিয়ে তুমি কী করবে?
আমি সবকিছু বলব।
ফুলী-মা আবার শব্দ করে হাসল। বলল, তুমি টেহলিস শহরে উড়ে যেতে পারবে কিনা আমি জানি না। যদি যেতেও পার, সেখানে কেউ তোমার কথা বিশ্বাস করবে না। সত্যি কথা বলতে কি, কেউ তোমার কথা শুনতেও রাজি হবে না।
হবে।
না, নায়ীরা। পৃথিবী খুব চমৎকার একটা জায়গা। কিন্তু তুমি যদি পৃথিবীতে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাক, তা হলে এই পৃথিবীর থেকে কঠিন জায়গা আর কিছু হতে পারে না। ফুলী-মা একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা এখন ভুল সময়ে ভুল জায়গায় আছি। এখন তুমি একজন মানুষকেও তোমার কথা বিশ্বাস করাতে পারবে না।
পারব। পৃথিবীর সব মানুষ আমাকে অবিশ্বাস করলেও একজন কখনো আমাকে অবিশ্বাস করবে না।
সে কে?
তার নাম নীরা ত্রাতিনা।
কেন সে তোমার কথা অবিশ্বাস করবে না?
কারণ আমি তার ক্লোন।
নায়ীরা ব্যাকুল চোখে ফুলী-মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমাকে সাহায্য করবে? আমার জন্য নয়, তোমার সন্তানদের জন্য। করবে?
ফুলী-মা আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে, নায়ীরা। আমি তোমাকে সাহায্য করব।
.
নায়ীরা একটা উঁচু বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তার সামনে প্রায় জনপঞ্চাশেক নারী-পুরুষ। তিহানের মা-যাকে গ্রামের সবাই ফুলী-মা ডাকে, সবাইকে এখানে একত্র হতে বলেছে। তিহানের মা এই গ্রামের সবারই মা, তার কথা কেউ কখনো ফেলতে পারে না। গ্রামের সবাই দেখেছে বিচিত্র পোশাকের কমবয়সী একটা মেয়ে এখানে এসেছে। কেন এসেছে তারা কেউ জানে না। পৃথিবী থেকে আগেও কখনো কখনো কোনো মানুষ এখানে এসেছে, কিন্তু সেটি কখনো তাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে নি। রূপসী এই মেয়েটিও নিশ্চয়ই তাদের জন্য কোনো সৌভাগ্য বয়ে আনে নি, তাদের জন্য নিশ্চয়ই এক ভয়াবহ বিপদ বয়ে এনেছে। সেটি কত বড় বিপদ সেটাই তারা এখন জানতে চায়। যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা চাপা গলায় নিজেদের ভেতর কথা বলছে, নায়ীরা হাত তুলতেই সবাই থেমে গেল।
নায়ীরা বলল, আমার নাম নায়ীরা। আসলে এটি আমার সত্যিকারের নাম না। আমার সত্যিকারের নাম নেই। আমি একটি ক্লোন। কোনো ক্লোনকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, তাই ক্লোনদের কোনো নাম থাকে না। পৃথিবীর মানুষ আমাকে কোনো নাম ধরে ডাকে না। আমাকে একটা নম্বর দিয়ে ডাকে। আমার নম্বর তিন শ নয়।
নায়ীরা সবার দিকে একনজর তাকিয়ে বলল, পৃথিবীর মানুষ যেরকম আমাকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে না, ঠিক সেরকম তোমাদেরও মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে না। তোমাদের তারা বলে অবমানব। পৃথিবীর সাধারণ মানুষকে তারা বুঝিয়েছে তোমরা সত্যিকারের মানুষ নও। তোমরা হিংস্র, তোমরা খুনি, তোমরা অপরিণত বুদ্ধির মানুষ। তারা বলে, তোমরা তাদের ধ্বংস করার জন্য মানববিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করেছ। তাই তোমাদের হত্যা। করতে হবে। তোমরা পৃথিবীর মানুষকে হত্যা করার আগে তারা তোমাদের হত্যা করবে।
তোমাদের হত্যা করার জন্য তারা আমাকে পাঠিয়েছে। আমার শরীরের ভেতরে আছে। একটি ভয়ংকর ভাইরাস। আমার রক্তে সেই ভাইরাস কিলবিল করছে। তারা আমাকে কেটে সেই রক্ত তোমাদের ওপর ছিটিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু সেটা ঘটে নি। আমি এখনো বেঁচে আছি এবং তোমরাও এখনো বেঁচে আছ। পৃথিবীর সেই অল্প কয়জন খারাপ মানুষ যখন সেটি জানবে, তারা আবার কাউকে পাঠাবে। সে যদি ব্যর্থ হয় তখন আবার কাউকে পাঠাবে। এখন তোমাদের বেঁচে থাকার একটিমাত্র উপায়।
কাঁপা গলায় একটি কিশোরী জানতে চাইল, কী উপায়?
নায়ীরা পকেট থেকে ছোট ইলেকট্রনিক বিকনটি বের করে সবাইকে দেখিয়ে বলল, এই যে আমার কাছে একটা ইলেকট্রনিক বিকন। অন করা মাত্রই এটা থেকে একটা সিগন্যাল বের হবে, তখন একটা হেলিকপ্টার আসবে উদ্ধার কাজে। সেই হেলিকপ্টারটি তোমাদের দখল করে দিতে হবে।
উপস্থিত নারী-পুরুষ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ একটি কথাও বলল না। নায়ীরা বলল, সেই হেলিকপ্টার নিয়ে আমি যাব টেহলিস শহরে, পৃথিবীর মানুষকে সত্য কথাটি বলতে। আমি যদি তাদের বলতে পারি, তা হলে তোমরা বাচবে। যদি না পারি, তোমরা পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তোমরা বলো, তোমরা কি একটিবার শেষ চেষ্টা না করে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে চাও?
উপস্থিত সবাই মাথা নাড়ল, না, চাই না।
তা হলে আমাকে সবাই সাহায্য কর। এস, সবাই মিলে একটা পরিকল্পনা করি।
নায়ীরাকে ঘিরে সবাই কাছাকাছি এগিয়ে এল।
৬. মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসার
দীর্ঘ সময় কথা বলে তারা সবাই মিলে একটা পরিকল্পনা করল। পরিকল্পনা শেষে বিকনের সুইচটি অন করে নায়ীরা সেটি তিহানের হাতে দিয়ে বলল, এটা এখন তোমার কাছে রাখ।
তিহান সেটা হাতে নিয়ে বলল, ঠিক আছে।
বিজ্ঞান কেন্দ্রের মানুষগুলো এই বিকনের সিগন্যাল অনুসরণ করে আসবে। কাজেই তোমার ওপর এখন অনেক দায়িত্ব।
তিহান বলল, আমি আমার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করব, তুমি নিশ্চিন্ত থাক।
নায়ীরা বলল, আমার হিসাবে দুই ঘণ্টার ভেতর উদ্ধারকারী দল চলে আসবে।
আমরা সবাই প্রস্তুত।
উদ্ধারকারী দল আশা করবে একটি মৃত্যু উপত্যকা। তারা ধরে নেবে তোমরা সবাই মারা গেছ।
তুমি চিন্তা করো না, নায়ীরা। তারা যা আশা করছে ঠিক সেটাই দেখতে পাবে। আমরা সব জায়গায় খবর পাঠিয়ে দিয়েছি। আজ কেউ ঘর থেকে বের হবে না। এখানে কোথাও কোনো প্রাণের চিহ্ন দেখতে পাবে না। যারা বের হবে তারা মৃত সেজে পথেঘাটে পড়ে থাকবে।
চমৎকার! যাদের মৃতের ভূমিকায় অভিনয় করার কথা তারা সবাই কি বের হয়েছে?
হ্যাঁ, বের হয়েছে। মাঠে-ঘাটে, ঘরে-বাইরে তারা আগামী কয়েক ঘণ্টা মৃত মানুষের মতো পড়ে থাকবে। হেলিকপ্টার থেকে দেখে পৃথিবীর মানুষেরা এতটুকু সন্দেহ করবে না।
চমৎকার! মনে থাকে যেন, এটা আমাদের শেষ সুযোগ।
আমরা এ সুযোগ নষ্ট করব না।
নায়ীরা একটা মাটির ঘরের ভেতর আশ্রয় নিয়েছে। হেলিকপ্টার দখল করার সময় একটা সংঘর্ষ হতে পারে, গোলাগুলি হতে পারে, সে তার মধ্যে থাকতে চায় না। কোনোভাবে তার শরীরের এতটুকু কেটে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এখানে যত বড় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হোক না কেন, তার শরীর থেকে কোনো রক্ত বের হতে পারবে না। এক ফোঁটাও না।
নায়ীরা ছোট ঘরটির ভেতর অস্থির হয়ে অপেক্ষা করতে করতে যখন ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেল, ঠিক তখন অনেক দূরে একটা হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেল। বিকনের সিগন্যাল অনুসরণ করে এটা এগিয়ে আসছে। নায়ীরা মাটির ঘরের ছোট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হেলিকপ্টারটা দেখতে পায়, খামের ওপর দুবার ঘুরে সেটা কাছাকাছি একটা মাঠে নেমে এল। ইঞ্জিনটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দরজা খুলে ডজনখানেক মানুষ নেমে আসে। মানুষগুলোর হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। তারা হেলিকপ্টারটি ঘিরে দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক তাকায়। চারপাশে অসংখ্য মৃতদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, অবমানবের মৃতদেহ, ঠিক যেরকম হওয়ার কথা।
সশস্ত্র চার জন মানুষ তাদের যোগাযোগ মডিউল হাতে নিয়ে বিকনটির অবস্থান নির্দিষ্ট করে নেয়। দলপতি মাইক্রোফোনে কথা বলে সাবধানে অগ্রসর হতে থাকে। সশস্ত্র মানুষগুলো একটা বড় পাথরের আড়ালে হেঁটে যেতে থাকে। তারা তখনো জানে না যে সেখানে তাদের জন্য তিহান আট জন সুঠাম তরুণকে নিয়ে অপেক্ষা করছে। নায়ীরা নিঃশব্দে তাদের লক্ষ করে, এখনো সবকিছু তাদের পরিকল্পনামতো ঘটছে। আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই চূড়ান্ত আক্রমণটি ঘটে যাওয়ার কথা।
বড় একটা পাথরের আড়ালে ছোট একটা মাটির ঘরের সামনে গিয়ে সশস্ত্র মানুষগুলো থমকে দাঁড়াল, এই মাটির ঘরের ভেতর থেকে বিকনের সিগন্যাল আসছে। সশস্ত্র মানুষদের একজন হাতে অস্ত্র নিয়ে ডাকল, রিশি, তুমি বের হতে পার। তোমার কোনো ভয় নেই, আমরা তোমাকে উদ্ধার করতে এসেছি।
ঠিক সেই মুহূর্তে আট জন সুঠাম তরুণ সশস্ত্র মানুষগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কী হচ্ছে বোঝার আগেই তারা নিচে পড়ে গেছে এবং বিদ্যুগ্মতিতে তাদের অস্ত্রগুলো কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
একই সময় দ্বিতীয় দলটি হেলিকপ্টারের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা অন্যদের আক্রমণ করেছে। কিছু বোঝার আগেই তারাও বন্দি হয়ে গেল। হেলিকপ্টারের ভেতরে যারা ছিল তারা গোলাগুলি করার চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো লাভ হল না। এই গ্রামের কিছু তরুণ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে গুলি করতে করতে হেলিকপ্টারটি দখল করে নিয়েছে। নায়ীরাকে সেই খবরটি দেওয়ার জন্য কিছুক্ষণের মাঝেই তিহান নিজে এসে উপস্থিত হল। নায়ীরা নিশ্বাস বন্ধ করে জিজ্ঞেস করল, হেলিকপ্টারটি দখল হয়েছে?
হ্যাঁ, নায়ীরা, দখল হয়েছে।
গোলাগুলির শব্দ শুনলাম, কারো গায়ে কি গুলি লেগেছে?
আমাদের কারো গায়ে গুলি লাগে নি। তাদের দুজন গুলি খেয়েছে।
তাদের কী অবস্থা?
অবস্থা খারাপ নয়। চামড়া স্পর্শ করে গেছে। একেবারেই গুরুতর কিছু নয়।
সবাইকে বেঁধেছ?
হ্যাঁ। সবাইকে বেঁধেছি।
চমৎকার! যারা হেলিকপ্টারে তাদের কী করেছ?
তাদেরকেও শক্ত করে বাঁধা হয়েছে। আমার ধারণা, তাদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষও আছে।
চমৎকার! হেলিকপ্টারে যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ থাকবে আমাদের জন্য তত ভালো।
তুমি এখন হেলিকপ্টারটিতে যেতে চাও?
হ্যাঁ, যেতে চাই। কিন্তু আমি খালি হাতে যেতে চাই না। আমাকে একটা ছোট অস্ত্র দাও। কেমন করে সেটা ব্যবহার করতে হয় সেটাও শিখিয়ে দিতে হবে।
তিহান একটু হাসল। বলল, অস্ত্র কেমন করে ব্যবহার করতে হয় আমরাও খুব ভালো জানতাম না। একটু আগে চেষ্টা চরিত্র করে শিখে নিয়েছি। এস তোমাকেও শিখিয়ে দেব।
.
নায়ীরা হেলিকপ্টারে ঢুকে দেখল ভেতরে চার জন মানুষকে তাদের সিটের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। চার জনই খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। বিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রধান রুবা, সামরিক বাহিনীর কমান্ডার গ্রুশান, নিরাপত্তা বাহিনীর মহাপরিচালক জিনা এবং চিকিৎসা কেন্দ্রের ড. ইলাক। পাইলটকে বাঁধা হয় নি, কিন্তু তার মাথায় একজন তরুণ একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ধরে রেখেছে। নায়ীরাকে হেলিকপ্টারে উঠতে দেখে বেঁধে রাখা চার জন মানুষ ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। রুবা বলল, তু-তুমি?
নায়ীরা হাসার চেষ্টা করে বলল, হ্যাঁ। আমি। বিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রধান রুবা, আমি।
তুমি কেমন করে?
সেটা নিয়ে আলাপ করার অনেক সময় পাওয়া যাবে। নায়ীরা পাইলটের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এই হেলিকপ্টারটি নিয়ে টেলিস শহরে যেতে চাই। তোমার কোনো আপত্তি আছে?
পাইলট মাথা নাড়ল। বলল, না! নেই।
চমৎকার! তোমাকে শুধু একটা জিনিস মনে করিয়ে দিতে চাই, আমি দু সপ্তাহের ভেতর মারা যাচ্ছি। যে দু সপ্তাহের ভেতর মারা যাবে সে দু সপ্তাহ আগেও মরতে খুব একটা ভয় পায় না, তাকে কোনো রকম ভয়ভীতি দেখানো যায় না। তাই আমি আশা করব তুমি অন্য কিছু করার চেষ্টা করবে না।
পাইলট মাথা নাড়ল। বলল, করব না।
তুমি যদি তোমার কথা রাখ, তা হলে তুমি তোমার সন্তানদের কাছে বলতে পারবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অবিচারটি দূর করতে তুমি সাহায্য করেছ।
আমি বুঝতে পারছি।
সেইসঙ্গে এ কথাও বলতে পারবে যে, পৃথিবীর জঘন্যতম চার জন অপরাধীকে তুমি আইনের হাতে তুলে দিয়েছিলে।
ড. ইলাক দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তুমি বোকার স্বর্গে বাস করছ। টেহলিস শহরের একটি মানুষও তোমার কথা বিশ্বাস করা দূরে থাকুক, তোমার কথা শুনতেও রাজি হবে না। হেলিকপ্টারটি মাটিতে নামার তিন মিনিটের মধ্যে কমান্ডো বাহিনী তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। পৃথিবীর কোনো মানুষ তোমাকে খুঁজে পাবে না মেয়ে।
আমার নাম নায়ীরা।
ক্লোনদের কোনো নাম হয় না।
নায়ীরা একটু এগিয়ে তার রিভলবারটি ড. ইলাকের মাথায় ধরল। সেফটি ক্যাচ টেনে বলল, আমার নাম নায়ীরা।
ড. ইলাক হঠাৎ দরদর করে ঘামতে থাকে। নায়ীরা হিংস্র গলায় বলল, আমি ট্রিগার টেনে তোমার মতো নরকের কীটকে হত্যা করে এই মুহূর্তে পৃথিবীটাকে আগের চাইতে একটু ভালো একটা গ্রহে পাল্টে দিতে পারি। আমি কখনো একটি পোকাও মারি নি। কিন্তু তোমাকে হত্যা করতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা হবে না। তুমি দেখতে চাও?
ড. ইলাক ফ্যাকাসে মুখে বলল না, আমি দেখতে চাই না। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি দেখতে চাই না, নায়ীরা।
নায়ীরা রিভলবারটি সরিয়ে এনে বলল, এটি বিচিত্র কিছু নয় যে পৃথিবীর সব অপরাধীই আসলে কাপুরুষ। সে হেলিকপ্টারের ভেতর অস্ত্র হাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তরুণদের বলল, তোমরা এখন নেমে যাও। আমি এখন রওনা দিতে চাই।
তিহান এগিয়ে এসে বলল, আমি কি তোমার সঙ্গে আসব?
না, তিহান। আমি একা যেতে চাই।
যদি তোমার কোনো বিপদ হয়?
সেজন্যই আমি একা যেতে চাই।
ঠিক আছে। বিদায় নায়ীরা।
বিদায়।
অস্ত্র হাতে তরুণগুলো নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনটি গর্জন করে ওঠে। গ্রামটির ওপরে একবার পাক খেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা দক্ষিণ দিকে টেহলিস শহরের দিকে ছুটে যেতে থাকে। নদীতীরের একটি গ্রামে হাতবাধা মোল জন সেনাসদস্য এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তাদেরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা কৌতূহলী শিশু-কিশোর, তরুণ তরুণীদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা শুনে এসেছে অবমানবরা বিকলাঙ্গ এবং হিংস্র। খুনি এবং রক্তপিপাসু। বিকৃত এবং ভয়ংকর। কিন্তু সেটি সত্য নয়, তারা একেবারেই সাধারণ। তারা সহজ এবং সরল। তারা সুদর্শন এবং সুঠাম। তারা বুদ্ধিমান এবং কৌতূহলী। একজন বৃদ্ধা তাদের পানীয় দিয়ে গেছে, তাদের ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। তাদের সাময়িক অসুবিধার জন্য ক্ষমা চেয়ে গেছে। কোথাও কিছু একটা গোলমাল আছে, সেটি কী সেনাসদস্যরা তা বুঝতে পারছে না।
.
হেলিকপ্টারের ভেতর পাইলট নায়ীরাকে জিজ্ঞেস করল, টেহলিস শহরে তুমি কোথায় যেতে চাও?
কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পাইলট অবাক হয়ে বলল, কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে?
হ্যাঁ, তুমি কি সেখানে একটি খবর পাঠাতে পারবে?
পারব। প্রতিরক্ষা দপ্তরের কমপক্ষে এক ডজন রাডার এই মুহূর্তে আমাদের হেলিকপ্টারটিকে লক্ষ করছে। আমাদের প্রত্যেকটি কথা শুনছে।
চমৎকার! তুমি তাদের বলো আমি কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাকাশবিজ্ঞান বিভাগের বিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
হেলিকপ্টারের পেছনে বসে থাকা চার জন ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল। পাইলট ইতস্তত করে বলল, তুমি যদি কিছু মনে না কর নায়ীরা, আমাকে বলবে, কেন তুমি একজন মহাকাশবিজ্ঞানীর সঙ্গে দেখা করতে চাও?
আমি মহাকাশবিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনার সঙ্গে দেখা করতে চাই না। আমি আসলে মানুষ নীরা ত্রাতিনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। তার কারণ আমাকে এই মানুষটি থেকে ক্লোন করা হয়েছে। আমার ধারণা, আমি কী বলতে চাই সেটি তার থেকে ভালো করে কেউ বুঝবে না। কারণ আমি আর সে আসলে একই মানুষ।
পাইলট কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে ছিল বলে জানতে পারল না হেলিকপ্টারে সিটে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা বিজ্ঞান কেন্দ্র এবং প্রতিরক্ষা দপ্তরের চার জন সর্বোচ্চ কর্মকর্তার মুখ হঠাৎ করে রক্তহীন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
.
নীরা ত্রাতিনা স্টেইনলেস স্টিলের বায়ুশূন্য চেম্বারে ভাসমান ক্রোমিয়াম গোলকটির দিকে তাকিয়ে থেকে অতিবেগুনি রশ্মির একটি পালস পাঠাল। সিলিকন ডিটেক্টরটি পালসটিকে একটি বৈদ্যুতিক পালস্ হিসেবে তথ্য সংব্রক্ষণকারী কম্পিউটারে সংরক্ষণ করছে। সেদিকে তাকিয়ে থেকে নীরা ত্রাতিনা সন্তুষ্টির শব্দ করে বলল, চমৎকার! নিখুঁত ডিজাইন।
পাশে দাঁড়িয়ে টেকনিশিয়ান বলল, তোমার ডিজাইন সব সময় নিখুঁত।
উঁহু। তিরিশ সালে স্পেসশিপে একটা বায়ুনিরোধক যন্ত্র তৈরি করেছিলাম, ল্যান্ডিংয়ের সময় ভেঙেচুরে ভয়ংকর অবস্থা।
নীরা ত্রাতিনা ঘটনাটার একটা বর্ণনা দিতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক তখনই তার টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোনের স্ক্রিনে মানুষটির চেহারা অপরিচিত। শুধু যে অপরিচিত তা নয়, দেখে মনে হয় মানুষটি সামরিক বাহিনীর। একটু বিস্ময় নিয়ে সে বলল, নীরা ত্রাতিনা কথা বলছি।
প্রফেসর ত্রাতিনা। তোমাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি? কথা দিচ্ছি এক মিনিট থেকে এক সেকেন্ড বেশি সময় নেব না।
ঠিক আছে। বলো।
তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসীদের হাইজ্যাক করা একটা হেলিকপ্টার নেমেছে। আমাদের কমান্ডো দল ভেতরে ঢোকার জন্য রেডি। তাদের অর্ডার দেওয়ার আগে তোমার সঙ্গে কথা বলে নিতে চাইছি।
নীরা ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসীরা কেন হেলিকপ্টার হাইজ্যাক করে নামাবে?
সেটা আমাদের জন্যও একটা রহস্য।
আর যদি নামিয়েই থাকে আইন রক্ষাকারী তাদের নিয়মমতো সিদ্ধান্ত নেবে। আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ?
সেনা কর্মকর্তা একটু ইতস্তত করে বলল, তার কারণ হেলিকপ্টারের হাইজ্যাকার বলেছে সে তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়!
আমার সঙ্গে? নীরা ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, আমার সঙ্গে কেন?
সেটাও একটা রহস্য। যাই হোক, আমরা আইন রক্ষাকারী দপ্তর আগেও কখনো সন্ত্রাসী বা হাইজ্যাকারদের দাবিদাওয়া মানি নি, এখনো মানব না। আমরা এখনই আক্রমণ করতে যাচ্ছি।
ঠিক আছে কর।
ধন্যবাদ প্রফেসর।
ধন্যবাদ। নীরা ত্রাতিনা টেলিফোনটা বন্ধ করতে গিয়ে থেমে গেল। বলল, অফিসার।
বলো।
হাইজ্যাকারদের পরিচয় কী?
সেনা কর্মকর্তা একটু ইতস্তত করে বলল, সেটা আরেকটা রহস্য।
নীরা ভুরু কুঁচকে বলল, কী রকম রহস্য?
আমরা তার পরিচয় বের করতে পারি নি।
নীরা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, পরিচয় বের করতে পার নি? ডাটাবেসে তার সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই?
ডাটাবেসে দেখতেই পাচ্ছি না। তার শরীরে ট্রাকিওশান সিগন্যাল নেই।
মানে?
মানে সেটাই। এই হাইজ্যাকারের কোনো পরিচয় পৃথিবীতে নেই।
সেটা কেমন করে হয়?
তা আমরা জানি না। কিন্তু তাই হয়েছে। তবে তুমি এটা নিয়ে চিন্তা করো না। আর দশ মিনিটের ভেতর আমরা এই রহস্যের সমাধান করে ফেলব। জীবিত কিংবা মৃত এই হাইজ্যাকারকে ধরে আনব।
হাইজ্যাকারের বয়স কত?
গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে পনের-ষোল বছরের বেশি নয়।
নীরা ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, এত ছোট?
আরো বেশি হতে পারে। মেয়েদের গলার স্বর শুনে সব সময় বয়স অনুমান করা যায়।
নীরা চমকে উঠে বলল, মেয়ে?
ও আচ্ছা! তোমাকে বলা হয় নি? হ্যাঁ, হাইজ্যাকার একটা মেয়ে।
নীরা শীতল গলায় বলল, তোমার কমান্ডোদের অপেক্ষা করতে বলে। আমি আসছি।
সেনা কর্মকর্তা ব্যস্ত হয়ে বলল, তুমি এসে কী করবে? এটা আইন রক্ষাকারীদের ব্যাপার। আমাদের দায়িত্ব আমাদের পালন করতে দাও।
পনের-ষোল বছরের একটি মেয়ে সেনাদপ্তরের একটা হেলিকপ্টার হাইজ্যাক করে ফেলেছে, তার অর্থ, তোমরা নিশ্চয়ই তোমাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন কর নি। যাই হোক, কেউ যেন হেলিকপ্টারে না ঢোকে। আমি আসছি।
সেনা কর্মকর্তা বিরস মুখে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, নীরা ত্রাতিনা তাকে সে সুযোগ দিল না। টেলিফোনের লাইন কেটে উঠে দাঁড়াল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা টেকনিশিয়ানকে তার যন্ত্রটা দেখিয়ে বলল, তুমি এটাকে ক্যালিব্রেট কর। আমি আসছি।
কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে একটা বিশাল হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে আছে। হেলিকপ্টারটি ঘিরে নিরাপত্তা বাহিনীর অসংখ্য গাড়ি। নীরা ত্রাতিনা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা অসহিষ্ণু কমান্ডো দলটিকে দেখতে পেল, সে অনুমতি দেয় নি বলে তারা ভেতরে ঢুকতে পারছে না।
খেলার মাঠটি সেনাবাহিনীর লোকেরা কর্ডন করে রেখেছে, কর্ডনের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কৌতূহলী চোখে দাঁড়িয়ে আছে। নীরা ত্রাতিনা সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তার কাছে নিজের পরিচয় দিতেই তাঁকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। হেলিকপ্টারের কাছাকাছি দ্বিতীয় একজন কর্মকর্তার দিকে তার দিকে এগিয়ে আসে। নীরা ত্রাতিনা মানুষটিকে চিনতে পারল। একটু আগে এই মানুষটি টেলিফোনে তার সঙ্গে কথা বলেছে। মানুষটি কাছে এসে নিচু গলায় বলল, প্রফেসর, আমি মনে করি তোমার কিছুতেই ভেতরে যাওয়া উচিত নয়। এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তা ছাড়া—
মানুষটিকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে নীরা ত্রাতিনা বলল, তুমি ভেতরে বাচ্চা মেয়েটিকে জানাও যে, আমি তার সঁঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
মানুষটি বিরস মুখে টেলিফোনে কার সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলল। তারপর তাকে হেলিকপ্টারের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে বলল, এই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাও। দরজায় টোকা দিলে খুলে দেবে। তবে আমি শেষবারের মতো বলছি–
নীরা ত্রাতিনা তার কথা শেষ হওয়ার আগেই সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরজায় টোকা দিল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুট করে খুলে গেল। নীরা ভেতরে ঢুকে চারদিকে তাকাল। বড় একটা হেলিকপ্টারের সামনের চারটা সিটে চার জন মানুষকে বেঁধে রাখা হয়েছে। দুজন পুরুষ ও দুজন মহিলা। হেলিকপ্টারের দরজা যে খুলেছে সে সম্ভবত হেলিকপ্টারের পাইলট। অন্য পাশে একটা মেয়ে হাতে একটা বেঢপ রিভলবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীরা ত্রাতিনা মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়েই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল। মুহূর্তে নীরার। মুখ থেকে রক্ত সরে যায়। সে হেলিকপ্টারের দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে কোনোভাবে বলল, তুমি?
হ্যাঁ, আমি। তুমি আমাকে দেখে নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছ। তুমি আরো অবাক হবে, যদি শোন আমি একা নই। আমি যেখান থেকে এসেছি সেখানে আমার মতো আরো দশ জন আছে। আমরা ক্লোন তাই আমাদের কোনো নাম থাকতে হয় না। কিন্তু আমরা সবাই মিলে আমার নাম দিয়েছি নায়ীরা।
নীরা ত্রাতিনা কোনো কথা না বলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নায়ীরা নামের মেয়েটি আসলে সে নিজে।
নায়ীরা একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি জানতে যে তোমাকে ক্লোন করা হয়েছে?
না। নীরা ত্রাতিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীর আইনে কাউকে ক্লোন করা যায় না।
কিন্তু এরা করেছে। নায়ীরা হাত দিয়ে বেঁধে রাখা চার জনকে দেখিয়ে বলল, এরা বলেছে, তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে না। এরা বলেছে কালো পোশাক পরা কমান্ডোরা এসে আমাকে কোনো কথা না বলার সুযোগ দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলবে।
নীরা ত্রাতিনা কোনো কথা না বলে বিস্ফারিত চোখে নায়ীরার দিকে তাকিয়ে থাকে। নায়ীরা বলল, কিন্তু আমি তাদের বলেছি যে, তুমি আসবে। তুমি নিশ্চয়ই আসবে। আমাকে কেউ ডাকলে আমি যেতাম। তুমি নিশ্চয়ই আমার মতন, তাই না?
নীরা ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, বলল, আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি এখনো
নায়ীরা বাধা দিয়ে বলল, আমি কেন তোমার কাছে এসেছি সেটা তুমি এখনো শোন নি। সেটা শুনলে তুমি সেটাও বিশ্বাস করবে না।
তুমি কেন আমার কাছে এসেছ?
তুমি কি অবমানবদের কথা জান?
হ্যাঁ, জানি।
তারা ভুলভাবে নিজেদের বিবর্তন ঘটিয়েছে। হিংস্র বিকৃত বিকলাঙ্গ হয়ে গড়ে উঠেছে। মানুষকে ধ্বংস করার জন্য মানববিধ্বংসী অস্ত্র গড়ে তুলেছে। এখন আমাদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। তাই না?
হ্যাঁ।
নায়ীরা জোর করে হেসে বলল, তুমি কি জান এটা মিথ্যা? তুমি কি জান অবমানব বলে কিছু নেই? তারা সাধারণ মানুষ। নিরীহ মানুষ। অসহায় মানুষ। তুমি সেটা জান?
নীরা ত্রাতিনা চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। আমি সত্যি বলছি। আমি নিজের চোখে দেখেছি।
কিন্তু এটা তো হতে পারে না, এটা অসম্ভব।
নায়ীরা নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, এটা অসম্ভব।
কিন্তু এই মানুষগুলো সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর। তুমিও নিশ্চয়ই জান, আমি কখনো মিথ্যা বলব না। আমি তো আসলে তুমি।
হ্যাঁ, আমি জানি নায়ীরা। আমি জানি।
নায়ীরা একটু এগিয়ে এসে হঠাৎ করে কেমন জানি টলে উঠে কাছাকাছি একটা চেয়ার ধরে নিজেকে সামলে নেয়। নীরা ত্রাতিনা জিজ্ঞেস করল, তোমার কী হয়েছে?
আমি আসলে খুব অসুস্থ।
অসুস্থ! কী হয়েছে তোমার?
এরা বলেছে, আমি দুই সপ্তাহ পরে মারা যাব। কিন্তু আমি জানি, আমি দুই সপ্তাহ টিকে থাকব না। আমি টের পাচ্ছি, আমি তার অনেক আগেই মারা যাব। কিন্তু এখন আমার সেটা নিয়ে কোনো দুঃখ নেই। কারণ আমি জানি, তুমি নিশ্চয়ই অবমানবদের রক্ষা করবে। করবে না?
আমার পক্ষে যেটুকু করার সেটা করব। নিশ্চয়ই করব।
আমি জানি, তুমি করবে। আমি হলে করতাম। তুমি আর আমি তো একই মানুষ, তাই না?
নায়ীরা চেয়ারটা ধরে খুব ধীরে ধীরে বসে। ফিসফিস করে বলে, আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে দাঁড়া করে রেখেছিলাম। আর পারছি না। আমি খুব ক্লান্ত। খুব অসুস্থ।
নীরা নায়ীরার কাছে গিয়ে তাকে স্পর্শ করে, তোমার কী হয়েছে নায়ীরা?
অবমানদের হত্যা করার জন্য এরা আমার শরীরে লাখ লাখ কোটি কোটি ভাইরাসের জন্ম দিয়েছে। সেই ভাইরাসগুলো আমার শরীরকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কিন্তু তাতে এখন আর কিছু আসে যায় না। নায়ীরা দুর্বলভাবে হেসে হঠাৎ হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল।
নীরা ত্রাতিনা ছুটে গিয়ে তাকে ধরে মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল। এই মেয়েটি সে নিজে। কৈশোরে সে ঠিক এরকম ছিল, সাহসী এবং তেজস্বী। মায়াময় এবং কোমল। গভীর আবেগে তার হৃদয় ছিল ভরপুর। কী আশ্চর্য! কৈশোরের সেই মেয়েটি আবার তার কাছে ফিরে এসেছে?
নায়ীরা নীরা ত্রাতিনার হাত ধরে বলল, আমাকে কোনো মা জন্ম দেয় নি। আমার কোনো মা নেই। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, মা থাকলে কেমন লাগে।
নীরা ত্রাতিনা নায়ীরাকে শক্ত করে ধরে বলল, আমি তোমাকে জন্ম দিই নি, কিন্তু তুমি আমার মেয়ে। নায়ীরা, মা আমার, তুমি এতদিন পর কেন এসেছ?
নায়ীরা ফিসফিস করে বলল, মা, তোমার ঠিক আমার মতো আরো দশটি মেয়ে এখনো বেঁচে আছে। তারা খুব দুঃখী মেয়ে। তুমি তাদের দেখবে না?
দেখব, নিশ্চয়ই দেখব।
নায়ীরার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে, সে নীরা ত্রাতিনার হাত ধরে চোখ বুজল।
নীরা ত্রাতিনা নায়ীরার মাথাটা নিজের কোলে রেখে তার পকেট থেকে ফোন বের করে একটি নম্বর ডায়াল করল। কানেকশন হওয়ার পর স্ক্রিনে কঠোর চেহারার একজন মানুষকে দেখা যায়। নীরা ত্রাতিনা নিচু গলায় বলল, আমি প্রফেসর নীরা ত্রাতিনা। আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলতে চাই।
রাষ্ট্রপতি এই মুহূর্তে একটি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত রয়েছেন-
নীরা তাকে বাধা দিয়ে বলল, তাতে কিছু আসে যায় না। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা আছে। তাকে তুমি বলো, তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি আমি তাকে জানাতে চাই।
ঠিক আছে, বলছি।
নীরা ত্রাতিনা হেলিকপ্টারের মেঝেতে নায়ীরার মাথাটি কোলে নিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে। হেলিকপ্টারের সিটে শক্ত করে বেঁধে রাখা চার জন বিজ্ঞান এবং সেনা কর্মকর্তার হাত-পা শক্ত করে বেঁধে রাখার কারণে সেখানে ঠিকভাবে রক্ত সঞ্চালন না হয়ে সেগুলো অবশ হয়ে আসছিল, কিন্তু কর্মকর্তাদের কেউই সেই বিষয়টি নিয়ে বিচলিত ছিল না। তাদের বিচলিত হওয়ার জন্য অনেক বড় বিষয় অপেক্ষা করছে, সেটি সম্পর্কে তাদের তখন আর কোনো সন্দেহ নেই।
.
নায়ীরা যখন চোখ খুলে তাকাল সে তখন হাসপাতালের একটি বিছানায় শুয়ে আছে। তার মাথার কাছে অসংখ্য মনিটর। শরীরের নানা জায়গা থেকে অনেকগুলো সেন্সর সেই মনিটরগুলোতে এসেছে। শরীরের রক্ত বিশুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া দিয়ে তার দেহটি ভাইরাসমুক্ত করা চলছে। পদ্ধতিটি কার্যকর, তবে সময়সাপেক্ষ। নায়ীরা মাথা ঘুরিয়ে দেখল, তার মাথার কাছে নীরা ত্রাতিনা দাঁড়িয়ে আছে। নায়ীরাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে সে তার কাছে এগিয়ে এসে তার হাত স্পর্শ করল, জিজ্ঞেস করল, তুমি এখন কেমন আছ?
মনে হয় ভালোই আছি। একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, এখন কয়টা বাজে?
রাত একটা।
এত রাত?
হ্যাঁ, অনেক রাত।
মা, তুমি কি অবমানবদের রক্ষা করেছ?
হ্যাঁ, তাদের রক্ষা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তে কয়েক শ হেলিকপ্টার অবমানবদের এলাকায় উড়ে যাচ্ছে তাদের সাহায্য করার জন্য।
সেখানে একটা গ্রামে তিহান নামে একটা ছেলে থাকে।
কী করে তিহান?
হরিণ শিকার করে। কিন্তু সে হরিণকে মারতে চায় না, তাই হরিণ শিকার করার সময় মুখে একটা দানবের মুখোশ পরে থাকে।
ভারি মজার ছেলে তো?
হ্যাঁ মা, সে খুব মজার ছেলে। নায়ীরা একটু অপেক্ষা করে বলল, কিন্তু শুধু মজার ছেলে নয়, সে খুব কাজের ছেলে। আমরা যখন হেলিকপ্টারটা দখল করেছি তখন সে খুব সাহায্য করেছে। তার সঙ্গে যদি তোমার কখনো লেখা হয়, তুমি আমার পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ দিয়ে দিও।
দেব, নিশ্চয়ই দেব।
নায়ীরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মা।
বলো, মা।
আমার যে আরো দশটি বোন আছে তাদের কী হবে মা?
তাদের উদ্ধার করার জন্য বিশেষ কমান্ডো বাহিনী পাঠানো হয়েছে।
তুমি তাদের দেখলে অবাক হয়ে যাবে। তাদের কথা আমি এক মুহূর্ত ভুলতে পারি না।
আমি সেটা বুঝতে পারি।
তারা কি এখানে আসবে?
হ্যাঁ। আসবে, অবশ্যই আসবে।
নায়ীরা উত্তেজনায় উঠে বসার চেষ্টা করল, নীরা ত্রাতিনা তাকে শান্ত করে শুইয়ে রাখে। নায়ীরা জ্বলজ্বলে চোখে জিজ্ঞেস করল, কবে আসবে?
সবকিছু শেষ করে আসতে আসতে তাদের বেশ কয়েক দিন লেগে যাবে।
ও! হঠাৎ করে নায়ীরার উত্তেজনা দপ করে নিভে গেল। ফিসফিস করে বলল, কয়েক দিন পর তো আমি বেঁচে থাকব না।
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। এই রাতটি আমার শেষ রাত। আমি জানি।
নীরা ত্রাতিনা কোনো কথা না বলে নায়ীরার হাতটি নিজের হাতে তুলে নেয়। নায়ীরা একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি যদি নাও থাকি তুমি তো থাকবে। তারা একটা বোনকে হারিয়ে একটা মা পাবে। তাই না মা?
ত্রাতিনা কোনো কথা না বলে নায়ীরার হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পর নায়ীরা আবার ডাকল, মা।
বলো নায়ীরা।
পৃথিবীর মানুষ কি সবকিছু জেনে গেছে?
হ্যাঁ, তারা সবকিছু জেনেছে।
তারা কী বলছে, মা?
তারা প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর ভীষণ রেগেছে। তাদের সদর দপ্তর পুড়িয়ে দিয়েছে।
সত্যি?
হ্যাঁ, সারা পৃথিবী থেকে হাজার হাজার মানুষ অবমানবের দেশে যাচ্ছে তাদের দেখতে, তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে।
সত্যি?
সত্যি মা। সারা পৃথিবীতে সবার কাছে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে, তুমি জান?
কে?
তুমি।
আমি?
হ্যাঁ।
নীরা আতিনা মিষ্টি করে হাসল, বলল, তুমি কেমন করে অবমানবের দেশে গিয়ে তাদের রক্ষা করেছ পৃথিবীর সব মানুষ সে কাহিনী জানে। টেলিভিশনে এখন তোমার ওপর একটু পরপর বুলেটিন প্রকাশ করছে। পৃথিবীর সকল মানুষ তোমার জন্য প্রার্থনা করছে।
নায়ীরা জ্বলজ্বলে চোখে বলল, সত্যি মা? সত্যি?
হ্যাঁ। এই হাসপাতালের বাইরে হাজার হাজার স্কুলের ছেলেমেয়েরা তোমার জন্য ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তাদের ভেতরে আসতে দেবে না?
না। তুমি সুস্থ না হলে কাউকে ভেতরে আসতে দেবে না।
নায়ীরার চোখ-মুখের ঔজ্জ্বল্য আবার দপ করে নিভে গেল। সে নিচু গলায় বলল, কিন্তু আমি তো আর সুস্থ হব না মা।
ত্রাতিনা নায়ীরার হাত ধরে বলল, তুমি এখন একটু বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা কর।
নায়ীরা নীরা ত্রাতিনার হাত ধরে চোখ বন্ধ করল।
.
ড. নিশিরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি দুঃখিত প্রফেসর ত্রাতিনা। আমি খুব দুঃখিত।
নীরা ত্রাতিনা হাসপাতালের ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে থাকা নায়ীরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী নিষ্পাপ একটি মুখমণ্ডল! সে যখন পনের বছরের একটা কিশোরী ছিল তখন কি তার মুখমণ্ডল এত নিষ্পাপ ছিল? এইটুকুন মেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অবিচারটির মুখোশ খুলে দিয়েছে, এখনো সেটি নীরা ত্রাতিনা বিশ্বাস করতে পারছে না। অথচ এই মেয়েটিকে বাঁচানো যাবে না?
নীরা ত্রাতিনা ড. নিশিরার দিকে তাকিয়ে বলল, সারা পৃথিবীর মানুষ এই মেয়েটির জন্য প্রার্থনা করছে।
আমি জানি।
হাসপাতালের বাইরে হাজার হাজার স্কুলের ছেলেমেয়ে ফুল নিয়ে এসেছে, তুমি দেখেছ?
দেখেছি।
কিন্তু এই মেয়েটিকে বাঁচানো যাবে না?
না প্রফেসর ত্রাতিনা। প্রতিরক্ষা দপ্তরের ভয়ানক মানুষগুলো তার শরীরকে ভাইরাস জন্মানোর জন্য ব্যবহার করেছে। সেই ভাইরাসগুলো মস্তিষ্ক ছাড়া তার প্রত্যেকটি অঙ্গ কুরে কুরে খেয়েছে। তার হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ, কিডনি, ফুসফুস কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই মেয়েটি কেমন করে এখনো বেঁচে আছে সেটিই একটি রহস্য।
তাকে কোনোভাবে বাঁচানো যাবে না?
না।
কোনোভাবেই না?
না, প্রফেসর লাতিনা, কোনোভাবেই না। এই মেয়েটিকে বাঁচাতে হলে তার শরীরের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বদলে দিতে হবে। তার দরকার নতুন একটি হৃৎপিণ্ড, নতুন যকৃত, নতুন কিডনি, নতুন ফুসফুস-এক কথায় একটা নতুন দেহ। কোথা থেকে সেটা পাবে?
যদি কেউ দিতে রাজি হয়?
কে রাজি হবে? তা ছাড়া রাজি হলেই তো হবে না। তার শরীরের সঙ্গে সেগুলো মিলতে হবে। সেটি তো সম্ভব নয়। একটি-দুটি অঙ্গ মেলানো যায়, কিন্তু প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ?
ত্রাতিনা ফিসফিস করে বলল, তুমি জান নায়ীরা আমার ক্লোন?
হ্যাঁ, জানি।
তার মানে জান?
ড. নিশিরা ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ভয়ানক চমকে উঠে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ প্রফেসর ত্রাতিনা?
আমি বলতে চাইছি যে, আমার প্রত্যেকটি অঙ্গ নায়ীরা ব্যবহার করতে পারবে। আমি আর নায়ীরা আসলে একই মানুষ। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে আমি চেকআপ করিয়েছি, আমি সুস্থ সবল আর নীরোগ।
ড. নিশিরা খপ করে ত্রাতিনার হাত ধরে বলল, না, প্রফেসর ত্রাতিনা, এটা হতে পারে না! অসম্ভব
নীরা ত্রাতিনা ড. নিশিরার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে বলল, তোমার ছেলেমেয়ে আছে?
হ্যাঁ আছে।
কত জন?
দুজন। কিন্তু তার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?
যদি কখনো এরকম হয়, তাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য তোমার প্রাণ দিতে হয়, তুমি কি তোমার প্রাণ দেবে?
কাল্পনিক প্রশ্ন করো না প্রফেসর ত্রাতিনা।
এটা কাল্পনিক প্রশ্ন না। আমি জানি তুমি দেবে। একজন মায়ের কাছে তার নিজের জীবন থেকে সন্তানের জীবন অনেক বড়। নায়ীরা আমার সন্তান। তুমি যদি তোমার সন্তানের জন্য প্রাণ দিতে পার, আমি কেন পারব না? ত্রাতিনা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ড. নিশিরা তুমি অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুত হও।
না, প্রফেসর ত্রাতিনা, এটা হতে পারে না। তুমি পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী-
একজন মানুষ তার জীবনে যা পেতে পারে আমি তার সব পেয়েছি। নায়ীরা কিছু পায়নি, সে শুধু দিয়েছে। তাকে আমি ছোট একটা জীবন উপহার দিতে চাই।
না, ত্রাতিনা, না
আমি আর নায়ীরা আসলে একই মানুষ। আমার নিজের মধ্যে বেঁচে থাকা আর নায়ীরার মধ্যে বেঁচে থাকা আমার জন্য একই ব্যাপার।
না, না, প্রফেসর ত্রাতিনা। ড. নিশিরা কঠিন গলায় বলল, তুমি এটা করতে পার না।
আমাকে তুমি বাধা দিও না। নীরা ত্রাতিনা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আর বাধা দিয়েও লাভ নেই, নায়ীরাকে পৃথিবীর সবাই মিলে থামাতে পারে নি। আমাকেও পারবে না। আমি আর নায়ীরা আসলে একই মানুষ, তুমি তো জান।
ড. নিশিরা হতচকিত চোখে নীরা ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। নীরা ত্রাতিনা মৃদুস্বরে বলল, বিদায়।
ড. নিশিরা কিছু বলল না, কিন্তু সে জানে কথাটি মুখে উচ্চারণ করা না হলেও এ যুগের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী নীরা ত্রাতিনাকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। চিরদিনের জন্যই।
.
প্রফেসর নীরা ত্রাতিনার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে এক রকম চেহারার এগার জন কিশোরী তার কফিনটি বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। নায়ীরা তখনো পুরোপুরি সুস্থ হয় নি। হুইল চেয়ারে করে তাকে পিছু পিছু ঠেলে নিয়ে গেছে তিহান নামের একজন সুদর্শন তরুণ।
পৃথিবীর অন্য সব মানুষের সঙ্গে একসময় যাদের অবমানব বলা হত তারাও সেই অনুষ্ঠানটি দেখেছিল। নায়ীরাকে তার চোখের পানি মুছে নিতে দেখে পৃথিবীর অনেক মানুষও তাদের চোখের পানি মুছে নিয়েছিল।
সেই চোখের পানি ছিল একই সঙ্গে দুঃখের এবং ভালবাসার।
মানুষের জন্য মানুষের ভালবাসার।