- বইয়ের নামঃ নায়ীরা
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
১. নীরা ত্রাতিনা
নীরা ত্রাতিনা গোল জানালা থেকে ভেসে ভেসে সরে যাচ্ছিল, সে হাত বাড়িয়ে জানালার কাচটা স্পর্শ করে নিজেকে থামিয়ে নেয়। জানালার শীতল কাঁচে মুখ স্পর্শ করে সে দূর পৃথিবীর দিকে তাকায়, দুই হাজার কিলোমিটার দূরের নীল পৃথিবীটাকে কী সুন্দরই না। দেখাচ্ছে! উপর থেকে মহাদেশগুলোকে স্পষ্ট দেখা যায়, সাদা মেঘে বিষুব অঞ্চলটা ঢেকে আছে। এরকম কোনো একটা মেঘের নিচে এই মুহূর্তে তার প্রিয় শহর টেহলিস আড়াল পড়ে গেছে। কতদিন সে তার শহরে যায় নি, মহাকাশে ভেসে ভেসে সে কী গভীর একটা ভালবাসা নিয়েই না মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শহরটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
ফ্লাইট ক্যাপ্টেন রিশান মহাকাশ স্টেশনের শেষ মাথায় বড় টেলিস্কোপটায় চোখ লাগিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। সে টেলিস্কোপ থেকে চোখ সরিয়ে ভেতরে তাকিয়ে নীরা ত্রাতিনাকে দেখতে পায়। ছিপছিপে কম বয়সী তরুণী, ঝকঝকে খাপখোলা তলোয়ারের মতো চেহারা। এই কম বয়সেই নিজেকে একজন সত্যিকার মহাকাশচারী হিসেবে পরিচিত করে ফেলেছে। মেয়েটির জন্য রিশান মাঝে মাঝেই নিজের বুকের গভীরে কোথাও এক ধরনের ভালবাসা অনুভব করে। কখনো সেটা সে প্রকাশ করে নি, কিন্তু সেটা কি এই মেয়েটার কাছে গোপন রয়েছে?
রিশান তার টেলিস্কোপটা ছেড়ে দেয়াল স্পর্শ করে ভাসতে ভাসতে নীরা ত্রাতিনার কাছে এগিয়ে এল। কাছাকাছি এসে জানালা স্পর্শ করে নিজেকে থামিয়ে বলল, নীরা, এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছ তুমি? O।
নীরা ত্রাতিনা রিশানের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসল, বলল, এই মহাকাশ থেকে পৃথিবী ছাড়া দেখার মতো আর কী আছে বলো?
রিশান বলল, তুমি যেভাবে দেখছ, তাতে মনে হচ্ছে পৃথিবীটা আগে কখনো দেখ নি।
নীরা ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, বলল, সেটা তুমি কিন্তু খুব ভুল বলে নি। এখান থেকে আমি যতবার পৃথিবীকে দেখি ততবার মনে হয় আমি যেন প্রথমবার দেখছি।
রিশান বলল, আর দু সপ্তাহের মাঝে পৃথিবীটাকে তুমি আরো অনেক কাছে থেকে দেখতে পাবে!
নীরা ত্রাতিনা বড় বড় চোখে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ। আমি খবর পেয়েছি, নতুন ক্রু আসছে। আমরা পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছি।
নীরা ত্রাতিনা অবিশ্বাসের গলায় বলল, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না!
প্রথমে আমারও বিশ্বাস হয় নি। তখন আমি মহাকাশ কেন্দ্রে যোগাযোগ করেছি, তারা বলেছে এটি সত্যি।
নীরা একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলল, দেখবে একেবারে শেষ মুহূর্তে প্রোগ্রামটা বাতিল করে দেবে।
না, তার সুযোগ নেই। মহাকাশ স্টেশনে টানা ছয় মাসের বেশি কারো থাকার নিয়ম নেই।
নিয়ম নেই তাতে কী হয়েছে? হয়তো আমাদের দিয়েই নিয়ম করবে। টানা ছয়। মাসের বেশি একটা মহাকাশ স্টেশনে থাকলে মহাকাশচারীদের মেজাজ কেমন তিরিক্ষে হয়ে থাকে সেটা নিয়েই হয়তো গবেষণা হবে।
রিশান শব্দ করে হেসে বলল, তোমার ভয় নেই নীরা। সেসব নিয়ে গবেষণা বহুকাল আগে শেষ হয়ে গেছে।
তা হলে তুমি বলছ আমরা সত্যি সত্যি পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছি?
হ্যাঁ নীরা, আমরা দু সপ্তাহের মাঝে পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছি।
চমৎকার! নীরা জানালা থেকে হাতটা সরাতেই ভেসে উপরে উঠে যেতে শুরু করে। মহাকাশ স্টেশনের ছাদ স্পর্শ করে নিজেকে থামিয়ে বলল, এই সুসংবাদটি দেবার জন্য চল একটু স্ফুর্তি করা যাক।
রিশান হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী রকম স্ফুর্তি করার কথা ভাবছ?
উত্তেজক পানীয় খেয়ে সবাইকে নিয়ে খানিকক্ষণ চেঁচামেচি করা যেতে পারে। আমার কাছে খাঁটি প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি একটা কেক আছে, ভালো কোনো ঘটনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। মহাকাশ স্টেশনে এর থেকে ভালো কোনো ঘটনা আর কী হতে পারে।
ঠিকই বলেছ। রিশান বলল, তুমি সবাইকে খবর দিয়ে কেকটা কাটা শুরু কর। আমি আসছি। টেলিস্কোপে একটা গ্রহাণু একটু দেখে আসি।
নীরা ত্রাতিনা ভুরু কুঁচকে বলল, হঠাৎ করে এই গ্রহাণু দেখার জন্য ব্যস্ত হচ্ছ কেন?
মহাকাশ কেন্দ্র থেকে বলেছে। গতিপথটা নাকি সুবিধার নয়। পৃথিবীর কক্ষপথে পড়তে পারে।
নীরা ত্রাতিনা শব্দ করে হাসল, বলল, পৃথিবীর মানুষের ভয় বড় বেশি। মহাকাশে একটা নুড়ি পাথর দেখলেও তাদের ঘুম নষ্ট হয়ে যায়।
রিশান মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ। তবে বেচারাদের খুব বেশি দোষ দেওয়া যায় না, পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগেকার ঘটনা মনে হয় ভুলতে পারছে না। পুরো ডাইনোসর জগৎ উধাও হয়ে গেল-সেই তুলনায় মানুষ তো রীতিমতো অসহায় প্রাণী!
ঠিক আছে তুমি গ্রহাণুটা দেখে আস। আমি সবাইকে ডেকে আনি।
.
আধঘণ্টা পর মহাকাশ স্টেশনের তিরিশ জন ক্রু নিয়ে একটা জমাট পার্টি শুরু হল। নীরা ত্রাতিনার বাচিয়ে রাখা কেক, কিছু বেআইনি উত্তেজক পানীয় এবং নিয়মবহির্ভূত গানবাজনায় ছোট মহাকাশযানটা রীতিমতো উদ্দাম হয়ে ওঠে। মহাকাশ স্টেশনের তরশূন্য পরিবেশে বিচিত্র নাচগানের চেষ্টা করতে গিয়ে ছোট দুর্ঘটনা ঘটিয়ে একটা অবলাল ক্যামেরার মূল্যবান লেন্সটা ভেঙে ফেলার পর সিকিউরিটি অফিসার ফুল হাত তুলে পার্টির সমাপ্তি ঘোষণা করল, গলা উঁচিয়ে বলল, অনেক হয়েছে। সবাই এখন থাম। বাকিটুকু পৃথিবীর জন্য থাকুক।