- বইয়ের নামঃ ত্রিনিত্রি রাশিমালা
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে
আমি দীর্ঘ সময় খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাইরে আবছা অন্ধকার, আকাশে সম্ভবত মেঘ করেছে, দক্ষিণের একটা নিম্নচাপ এই এলাকার উপর দিয়ে যাবার কথা। মেঘ আমার বড় ভালো লাগে, কিন্তু আজ আমি মেঘের জন্যে অপেক্ষা করছি না। দিনের আলো নিভে যখন অন্ধকার নেমে আসে, নিচের আদিগন্ত বিস্তৃত শহরে যখন একটি একটি করে নক্ষত্রের মতো আলো ফুটতে থাকে তখন সেটি দেখতেও আমার খুব ভালো লাগে, কিন্তু আজ আমি সেটাও দেখছি না। আমার মন আজ বড় বিক্ষিপ্ত, আমার ভালবাসার মেয়েটি আজ আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
আমার হঠাৎ ত্রিশার কথা মনে পড়ল, সাথে সাথে বুকের ভিতর কোথায় জানি যন্ত্রণা করে ওঠে। কিছুক্ষণ আগেও ত্রিশা এই ঘরে ছিল। আমি আর ত্রিশা মুখোমুখি বসেছিলাম। ত্রিশা বসেছিল আমার খুব কাছে, এত কাছে যে আমি তার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। জানালা দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস আসছিল সেই বাতাসে তার মাথার চুল উড়ে উড়ে যাচ্ছিল, আমার খুব ইচ্ছে করছিল হাত দিয়ে আমি তার চুল স্পর্শ করি। কিন্তু আমি চুপ করে বসে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম, আমি বুঝতে পেরেছিলমি সে আজ আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।
ত্রিশা অনেকক্ষণ বিষণ্ণ মুখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে আমার কপাল থেকে কয়েকটা চুল সরিয়ে নরম গলায় ডেকে বলেছিল, রিকি—
আমি কোনো কথা না বলে তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিলাম। তখন সে কেমন যেন চেষ্টা করে নিজেকে একটু শক্ত করে বলেছিল, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই রিকি।
আমি খুব সাবধানে একটা নিশ্বাস গোপন করে বলেছিলাম, তুমি কী বলবে আমি জানি ত্রিশা।
ত্রিশা তখন খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, তুমি জান?
হ্যা আমি জানি। আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নরম গলায় বলেছিলাম, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, ত্রিশা।
আমার কথা শুনে ত্রিশা চমকে উঠেছিল, তার মুখ হঠাৎ রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ চেষ্টা করে সে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কেমন করে এটা জানলে?
আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম, আমি জানি না।
তখন ত্রিশা আমার দিকে অনেকক্ষণ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। তার দুই চোখে পানি জমে উঠেছিল, হাত দিয়ে পানি মুছে সে গলার স্বর খুব স্বাভাবিক করে বলেছিল, আমি খুব দুঃখিত রিকি। তুমি খুব চমৎকার একটি মানুষ, আমি কখনো তোমার কথা ভুলব না। কিন্তু আমরা দুজন একজন আরেকজনের জন্যে নই। আমরা যদি কাছাকাছি থাকি একজন থেকে আরেকজন শুধু কষ্টই পাব–
ত্রিশা নরম গলায় আরো অনেক কথা বলেছিল, আমি সেগুলো ভালো করে শুনি নি। সেসব কথায় কিছু আসে যায় না। আমার খুব ইচ্ছে করছিল তার দুই হাত জাপটে ধরে অনুনয় করে বলি, ত্রিশা তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। আমি জানি তুমি কী চাও, আমি তোমার সব স্বপ্ন সত্য করে দেব। বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছা করলে পারি।
কিন্তু আমি ত্রিশাকে কিছু বলি নি। আমি তাকে উঠে যেতে দেখেছি, টেবিল থেকে তার ছোট ব্যাগটা তুলে নিতে দেখেছি, তারপর আমাকে গভীর ভালবাসায় একবার আলিঙ্গন করে দরজা খুলে চলে যেতে দেখেছি। আমি তাকে ডেকে ফেরাতে চেয়েছিলাম কিন্তু ফেরাই নি। কেন ফেরাই নি কে জানে? আমি অন্য মানুষের মনের কথা বুঝে ফেলি অনায়াসে কিন্তু কখনো নিজেকে বুঝতে পারি নি। কেন ঈশ্বর আমাকে সাধারণ একজন মানুষ করে জন্ম দিল না? কেন?
আমি জানালা খুলে নিচে তাকালাম এবং ঠিক তখন আমার খুব একটা বিচিত্র জিনিস মনে হল। আমি যদি এখন তিন শ এগার তালার উপর থেকে নিচের চকচকে রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়ি তাহলে কেমন হয়? তিন শ এগার তালা অনেক উঁচু, নিচে পড়তে কম করে হলেও চৌদ্দ সেকেন্ড সময় লাগবে। এই চৌদ্দ সেকেন্ড সময় যখন নিজেকে ভরশূন্য মনে হতে থাকবে এবং যখন নিশ্চিত মৃত্যুকে দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখব তখন কি জীবনকে একটি সম্পূর্ণ নূতন দৃষ্টি থেকে দেখা যাবে? যে দৃষ্টিতে আমি জীবনকে কখনো দেখি নি? আমি এক ধরনের লোভাতুর দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম এবং ঠিক তখন আমার কানের কাছে কিটি ফিসফিস করে বলল, লাফ দিতে চাও?
আমি ঘুরে কিটির দিকে তাকালাম, কিটি আমার ঘরের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করার রবোট। সে দীর্ঘদিন থেকে আমার সাথে আছে। বুদ্ধিমত্তা নিনিষ স্কেলে চার মাত্রা থেকে বেশি হওয়ার কথা নয়। শুধুমাত্র দীর্ঘদিনের সাহচর্যের কারণে তার সাথে আমার এক ধরনের বিচিত্র বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। ইদানীং সে আমাকে খানিকটা বুঝতে শিখেছে বলে মনে হয়। আমি একটু অবাক হয়ে কিটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী বললে?
জানালা দিয়ে লাফ দিতে চাও?
লাফ দেব? কেন?
কোনো মানুষকে যখন তাদের ভালবাসার মেয়েরা ছেড়ে চলে যায় তখন তারা এ রকম করে। কেউ মাথায় গুলি করে, কেউ জানালা দিয়ে লাফ দেয়। আমি খবরের কাগজে পড়েছি। এটাকে মানসিক ভারসাম্যহীনতা বলে।
তোমার তাই মনে হচ্ছে? আমি মানসিক ভারসাম্যহীন?
হ্যাঁ। কিটি তার সবুজ চোখে এক ধরনের একাগ্রতা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকে, মাথা নেড়ে বলে, তুমি আজ অবশ্যি মানসিক ভারসাম্যহীন। কফিতে দুই চামচ চিনি না দিয়ে এক চামচ চিনি দিয়েছ।