- বইয়ের নামঃ ত্রাতিনা
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
১. ত্রাতিনা – প্রথম পর্ব
ত্রাতিনা – বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
উৎসর্গ
প্রিয়
মেহেদী হক এবং নাসরীন সুলতানা মিতু
একটি অসাধারণ জুটি!
(সবাই যদি তোমাদের মত হতো, তাহলে আমি আর
কোনোকিছু নিয়ে কখনো দুর্ভাবনা করতাম না!)
.
০১. প্রথম পর্ব
বিজ্ঞান একাডেমির মহাপরিচালক মহামান্য রিহা দুই হাতে তার মাথার ধবধবে সাদা চুল এক মুহূর্তের জন্যে খামচে ধরলেন। তারপর মাথা তুলে কমান্ডার লীয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী বলছ তুমি?”
এটি একটি প্রশ্ন। কিন্তু তার কথাটি প্রশ্নের মতো না শুনিয়ে অনেকটা হাহাকারের মতো শোনালো। কমান্ডার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মাথা তুলে নিচু গলায় বলল, “আমি দুঃখিত মহামান্য রিহা।”
মহামান্য রিহা শূন্য দৃষ্টিতে কমান্ডারের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বললেন, “সারা পৃথিবীর মানুষ আমাকে তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়েছে, আর আমি তাদের রক্ষা করতে পারছি না?”
কমান্ডার লী নরম গলায় বলল, “এখনো আমাদের হাতে আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় আছে। ঠিক করে বললে বলা যায় আটচল্লিশ ঘন্টা সতেরো মিনিট।”
“আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় থাকা আর সময় না থাকার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই কমান্ডার। শেষবার যখন এরকম ঘটনা ঘটেছিল, তখন আমরা ছয়মাস সময় পেয়েছিলাম। তারপরও সেটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন। প্রথম দুটো মিসাইল টার্গেট মিস করল। তিন নম্বরটা আঘাত করতে পারল, সেটাও আংশিক—”
কমান্ডার লী মাথা নিচু করে বলল, “আমি আমার পুরো বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত, আমাদের কী করতে হবে আদেশ করেন মহামান্য রিহা। আমরা আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করব।”
মহামান্য রিহা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “তুমি কমান্ড কাউন্সিলের সবাইকে ডেকে আনে। আধা ঘন্টার মাঝে আমি সবাইকে নিয়ে বসতে চাই। আর তুমি এর মাঝে তোমার পুরো বাহিনীকে নিয়ে টার্গেট লক করো। প্রয়োজন হলে বৃষ্টির মতো মিসাইল পাঠাও-”
“মহাকাশে অনেক উপগ্রহ মহামান্য রিহা, বৃষ্টির মতো পাঠালে অনেক প্রাণহানি হবে।”
মহামান্য রিহা মাথা ঝাঁকালেন। বললেন, “না, না, একটাও প্রাণহানি হতে পারবে না। পৃথিবীর মানুষ আমাকে তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়েছে, তাদের একজনের প্রাণও নেয়ার অধিকার দেয়নি।”
কমান্ডার লী ইতস্তত করে বলল, “কয়েক বিলিয়ন প্রাণ বাঁচানোর জন্যে যদি কিছু প্রাণ দিতে হয়, সেটি খুব বড় একটি অন্যায় নয় মহামান্য রিহা।”
মহামান্য রিহা হেঁটে জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন। মাথা নেড়ে বললেন, “না। না কমান্ডার, একজন মানুষের প্রাণও আমি নিতে পারব না। তুমি যাও, যত দ্রুত সম্ভব সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিলের সভার আয়োজন করো।”
কমান্ডার লী মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মহামান্য রিহা তার ছোট দোতালা কাঠের ঘরের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশ ভরা নক্ষত্র তার মাঝে একটি দুটি বাই ভার্বোল মাঝে মাঝে চাপা গুঞ্জনের মতো শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে। তার বাড়ির চারপাশে গাছ, সেখানে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। ঝিঁঝি পোকার চোখে ঘুম নেই, কিন্তু এখন মধ্যরাত, শহরের সব মানুষ তাদের ঘরে নিশ্চিন্ত নিরাপদে ঘুমাচ্ছে। কেউ জানে না, মহাকাশ থেকে একটি গ্রহকণা সরাসরি পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে। যদি সেটাকে থামানো না যায়, সেটি আটচল্লিশ ঘন্টা পর আফ্রিকার সাহারাতে আঘাত করবে। পঁয়ষটি মিলিয়ন বছর আগে এরকম একটি গ্রহকণা পৃথিবীকে আঘাত করেছিল। পৃথিবীর বুক থেকে তখন ডাইনোসর নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। যদি এই গ্রহকণাটি পৃথিবীকে আঘাত করে, তাহলে মানব প্রজাতি ডাইনোসরের মতো পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
.
আধাঘণ্টার আগেই কমান্ড কাউন্সিলের সবাই শহর কেন্দ্রের বড় হলঘরটাতে। হাজির হলো। গভীর রাতে সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে আনা হয়েছে। কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যদের চেহারায় তার একটা ছাপ পড়েছে। উশকু খুশকু চুল, চোখে এক ধরনের উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, শুকনো মুখ। নিজেদের আসনে সবাই নিঃশব্দে বসে আছে। কোনো একটা কারণে আজ কেউ নিজেদের ভেতরেও কথা বলছে না।
মহামান্য রিহা হলঘরে ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তার প্রতি সম্মান দেখালো। মহামান্য রিহা সেটা লক্ষ্য করলেন বলে মনে হল না। নিজের বড় চেয়ারটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, “তোমাদের সবাইকে এই গভীর রাতে ডেকে আনতে হলো, পৃথিবীর ইতিহাসে পৃথিবী এর আগে এতো বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বলে মনে হয় না।”
কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যরা কেউ কোনো কথা বলল না। মহামান্য রিহা বললেন, “তোমরা সবাই জান, কী জন্যে আমি তোমাদের ডেকেছি। প্রায় সতুর কিলোমিটার চওড়া একটা গ্রহকণা আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতর পৃথিবীতে আঘাত করবে। কক্ষপথ নির্ভুলভাবে বের করা হয়েছে, আফ্রিকার সাহারা মরুভূমিতে সেটি ঘন্টায় প্রায় ষাট হাজার কিলোমিটার বেগে আঘাত করবে। আঘাতটি হবে তিন লক্ষ মাঝারি সাইজের হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণের কাছাকাছি। আফ্রিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড আঘাতের সাথে সাথে ভস্মীভূত হয়ে যাবে। গ্রহকণাটি যখন আঘাত করবে, তখন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে তার কক্ষপথে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হবে। সেই শূন্যতার ভেতর দিয়ে ধুলোবালি পাথর ধোঁয়া কয়েক সেকেন্ডের ভেতর বায়ুমণ্ডলের ওপরের অংশে ঢুকে যাবে। কয়েক মিনিটের ভেতর পুরো আফ্রিকা, ইউরোপ এবং এশিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে।