- বইয়ের নামঃ ত্রাতিনা
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
১. ত্রাতিনা – প্রথম পর্ব
ত্রাতিনা – বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
উৎসর্গ
প্রিয়
মেহেদী হক এবং নাসরীন সুলতানা মিতু
একটি অসাধারণ জুটি!
(সবাই যদি তোমাদের মত হতো, তাহলে আমি আর
কোনোকিছু নিয়ে কখনো দুর্ভাবনা করতাম না!)
.
০১. প্রথম পর্ব
বিজ্ঞান একাডেমির মহাপরিচালক মহামান্য রিহা দুই হাতে তার মাথার ধবধবে সাদা চুল এক মুহূর্তের জন্যে খামচে ধরলেন। তারপর মাথা তুলে কমান্ডার লীয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী বলছ তুমি?”
এটি একটি প্রশ্ন। কিন্তু তার কথাটি প্রশ্নের মতো না শুনিয়ে অনেকটা হাহাকারের মতো শোনালো। কমান্ডার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর মাথা তুলে নিচু গলায় বলল, “আমি দুঃখিত মহামান্য রিহা।”
মহামান্য রিহা শূন্য দৃষ্টিতে কমান্ডারের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বললেন, “সারা পৃথিবীর মানুষ আমাকে তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়েছে, আর আমি তাদের রক্ষা করতে পারছি না?”
কমান্ডার লী নরম গলায় বলল, “এখনো আমাদের হাতে আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় আছে। ঠিক করে বললে বলা যায় আটচল্লিশ ঘন্টা সতেরো মিনিট।”
“আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় থাকা আর সময় না থাকার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই কমান্ডার। শেষবার যখন এরকম ঘটনা ঘটেছিল, তখন আমরা ছয়মাস সময় পেয়েছিলাম। তারপরও সেটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন। প্রথম দুটো মিসাইল টার্গেট মিস করল। তিন নম্বরটা আঘাত করতে পারল, সেটাও আংশিক—”
কমান্ডার লী মাথা নিচু করে বলল, “আমি আমার পুরো বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত, আমাদের কী করতে হবে আদেশ করেন মহামান্য রিহা। আমরা আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করব।”
মহামান্য রিহা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “তুমি কমান্ড কাউন্সিলের সবাইকে ডেকে আনে। আধা ঘন্টার মাঝে আমি সবাইকে নিয়ে বসতে চাই। আর তুমি এর মাঝে তোমার পুরো বাহিনীকে নিয়ে টার্গেট লক করো। প্রয়োজন হলে বৃষ্টির মতো মিসাইল পাঠাও-”
“মহাকাশে অনেক উপগ্রহ মহামান্য রিহা, বৃষ্টির মতো পাঠালে অনেক প্রাণহানি হবে।”
মহামান্য রিহা মাথা ঝাঁকালেন। বললেন, “না, না, একটাও প্রাণহানি হতে পারবে না। পৃথিবীর মানুষ আমাকে তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব দিয়েছে, তাদের একজনের প্রাণও নেয়ার অধিকার দেয়নি।”
কমান্ডার লী ইতস্তত করে বলল, “কয়েক বিলিয়ন প্রাণ বাঁচানোর জন্যে যদি কিছু প্রাণ দিতে হয়, সেটি খুব বড় একটি অন্যায় নয় মহামান্য রিহা।”
মহামান্য রিহা হেঁটে জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন। মাথা নেড়ে বললেন, “না। না কমান্ডার, একজন মানুষের প্রাণও আমি নিতে পারব না। তুমি যাও, যত দ্রুত সম্ভব সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিলের সভার আয়োজন করো।”
কমান্ডার লী মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান প্রদর্শন করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। মহামান্য রিহা তার ছোট দোতালা কাঠের ঘরের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশ ভরা নক্ষত্র তার মাঝে একটি দুটি বাই ভার্বোল মাঝে মাঝে চাপা গুঞ্জনের মতো শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে। তার বাড়ির চারপাশে গাছ, সেখানে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। ঝিঁঝি পোকার চোখে ঘুম নেই, কিন্তু এখন মধ্যরাত, শহরের সব মানুষ তাদের ঘরে নিশ্চিন্ত নিরাপদে ঘুমাচ্ছে। কেউ জানে না, মহাকাশ থেকে একটি গ্রহকণা সরাসরি পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে। যদি সেটাকে থামানো না যায়, সেটি আটচল্লিশ ঘন্টা পর আফ্রিকার সাহারাতে আঘাত করবে। পঁয়ষটি মিলিয়ন বছর আগে এরকম একটি গ্রহকণা পৃথিবীকে আঘাত করেছিল। পৃথিবীর বুক থেকে তখন ডাইনোসর নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। যদি এই গ্রহকণাটি পৃথিবীকে আঘাত করে, তাহলে মানব প্রজাতি ডাইনোসরের মতো পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
.
আধাঘণ্টার আগেই কমান্ড কাউন্সিলের সবাই শহর কেন্দ্রের বড় হলঘরটাতে। হাজির হলো। গভীর রাতে সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে আনা হয়েছে। কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যদের চেহারায় তার একটা ছাপ পড়েছে। উশকু খুশকু চুল, চোখে এক ধরনের উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, শুকনো মুখ। নিজেদের আসনে সবাই নিঃশব্দে বসে আছে। কোনো একটা কারণে আজ কেউ নিজেদের ভেতরেও কথা বলছে না।
মহামান্য রিহা হলঘরে ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তার প্রতি সম্মান দেখালো। মহামান্য রিহা সেটা লক্ষ্য করলেন বলে মনে হল না। নিজের বড় চেয়ারটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, “তোমাদের সবাইকে এই গভীর রাতে ডেকে আনতে হলো, পৃথিবীর ইতিহাসে পৃথিবী এর আগে এতো বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে বলে মনে হয় না।”
কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যরা কেউ কোনো কথা বলল না। মহামান্য রিহা বললেন, “তোমরা সবাই জান, কী জন্যে আমি তোমাদের ডেকেছি। প্রায় সতুর কিলোমিটার চওড়া একটা গ্রহকণা আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতর পৃথিবীতে আঘাত করবে। কক্ষপথ নির্ভুলভাবে বের করা হয়েছে, আফ্রিকার সাহারা মরুভূমিতে সেটি ঘন্টায় প্রায় ষাট হাজার কিলোমিটার বেগে আঘাত করবে। আঘাতটি হবে তিন লক্ষ মাঝারি সাইজের হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণের কাছাকাছি। আফ্রিকা, ইউরোপ এবং এশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড আঘাতের সাথে সাথে ভস্মীভূত হয়ে যাবে। গ্রহকণাটি যখন আঘাত করবে, তখন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে তার কক্ষপথে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হবে। সেই শূন্যতার ভেতর দিয়ে ধুলোবালি পাথর ধোঁয়া কয়েক সেকেন্ডের ভেতর বায়ুমণ্ডলের ওপরের অংশে ঢুকে যাবে। কয়েক মিনিটের ভেতর পুরো আফ্রিকা, ইউরোপ এবং এশিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে।
কয়েক ঘণ্টার ভেতর সারা পৃথিবীর আকাশ কুচকুচে কালো হয়ে যাবে। পৃথিবী হবে একটি ঘন অন্ধকার গ্রহ। দুই থেকে তিন বছর আকাশ এভাবে অন্ধকার থাকবে। ধুলোবালি পৃথিবীতে ঝরে পড়তে আরো সময় নেবে। সূর্যের আলো ঢুকতে পারবে না বলে সমস্ত পৃথিবী হিমশীতল হয়ে যাবে। পৃথিবীর যত জীবিত প্রাণী, তার শতকরা নিরানব্বই দশমিক নিরানব্বই অংশ মারা যাবে। পৃথিবী হবে একটা প্রাণহীন গ্রহ।”
মহামান্য রিহা একটু থেমে টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে এক সেঁক পানি খেয়ে বললেন, “আমরা পৃথিবীতে এটা হতে দিতে পারি না। সেজন্যে তোমাদের ডেকে এনেছি। তোমরা বল আমরা কীভাবে পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারি?”
কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যরা একে অপরের দিকে তাকালো। জীব বিজ্ঞানী লিয়া সোজা হয়ে বসে বলল, “আমাদের হাতে সময় নেই। তাই আমি একেবারে সময় নেব না। যেটা বলতে চাই, সোজাসুজি সেটা বলছি। আমি সব সময় প্ল্যান বি প্রস্তুত রাখার পক্ষপাতী। প্ল্যান এ বা মূল প্ল্যানটি কাউন্সিলের সদস্যরা বের করে নিয়ে আসুক, সেই পরিকল্পনাটি যদি কাজ না করে, তাহলে কী করতে হবে আমি সেটি বলি।”
জীববিজ্ঞানী লিয়া একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “যদি আমাদের পরিকল্পনা কাজ না করে, তাহলে পৃথিবীটা অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাবে। শেষবার যখন এটা হয়েছিল, তখন ডাইনোসর ধ্বংস হয়ে স্তন্যপায়ী প্রাণী পৃথিবীতে বংশ বিস্তার শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্ম নিতে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর সময় লেগেছিল। আমি মনে করি, এবারে সেটা হতে দেয়ার প্রয়োজন নেই। আমি কয়েক হাজার নারী-পুরুষ এবং কয়েক লক্ষ মানব ভ্রুণ সংরক্ষণের পক্ষপাতী। পাহাড়ের গভীরে টানেল খুঁড়ে সেখানে হিমঘরে আমরা এভাবে মানব প্রজাতিকে রক্ষা করব। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার কয়েক বছর পর যখন আবার সেটা মানুষের বসবাসের উপযুক্ত হবে, পৃথিবীর মানুষ তখন আবার পৃথিবীতে ফিরে আসবে। নতুন করে মানব সভ্যতার জন্ম হবে।”
ত্রাতিনা জীববিজ্ঞানী লিয়া তার কথা শেষ করে অন্যদের মুখের দিকে তাকালো, কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। লিয়া একটু ইতস্তত করে বলল, “আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলে মানবপ্রজাতি সংরক্ষণের এই দায়িত্বটুকু আমি নিতে পারি।”
মহামান্য রিহা তার চেয়ারে হেলান দিয়ে ক্লান্ত গলায় বললেন, “লিয়া, তোমাকে ধন্যবাদ। মূল পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে কী করতে হবে, সেটা তুমি যথেষ্ট স্পষ্ট করে বলেছ এবং তোমাকে সেই দায়িত্ব দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমি ধারাবাহিকভাবে কাজ করতে পছন্দ করি। মূল পরিকল্পনা কী হবে, সেটি ঠিক করার পর আমি তোমার প্ল্যান বি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেব।”
মহামান্য রিহা চুপ করা মাত্রই পদার্থবিজ্ঞানী রিশি বললেন, “গ্রহকণার খবরটি শোনার পর থেকে আমার পক্ষে যেটুকু সম্ভব, আমি সেই তথ্য বিশ্লেষণ করেছি। আমার বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু আমি খোলাখুলি বলে ফেলি। আমার ধারণা, আমরা এইবার পৃথিবী রক্ষা করতে পারব না।”
সবাই ঘুরে পদার্থবিজ্ঞানী রিশির দিকে তাকালো। পরিবেশ বিজ্ঞানী নিহি জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেন এটা মনে করছ?”
“গ্রহকণাটি কীভাবে পৃথিবীর দিকে রওনা দিয়েছে, আমি সেটা বিশ্লেষণ করেছি। এটা শুরু হয়েছে প্রায় এক বছর আগে। সৌরজগতের বাইরে থেকে একটা অখ্যাত ধূমকেতু প্রথম এই গ্রহকণাটুকুকে তার কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত করেছে। বৃহস্পতি গ্রহের আকর্ষণে প্রথম এটি কক্ষপথের বাইরে যাবার শক্তি পেয়েছে। মঙ্গল গ্রহ এটিকে স্লিং শট প্রক্রিয়ায় পৃথিবীর দিকে পাঠিয়েছে। এই গ্রহকণাটির পৃথিবী থেকে কমপক্ষে এগারো মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে দিয়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু খুবই বিচিত্র কারণে এটি আরেকটা খুবই বৃহৎ গ্রহকণার সাথে সংঘর্ষে তার কক্ষপথ পরিবর্তন করেছে। ঠিক এই সময় সূর্যের বিশাল একটা করোনা ডিসচার্জ হয়েছে। সূর্য থেকে বের হওয়া চার্জড পার্টিকেলে এটা আটকা পড়ে পৃথিবীর কাছে এসেছে। আমরা মাত্র আটচল্লিশটা ঘন্টা আগে এটি সম্পর্কে জেনেছি। কারণ এর আগে এটি ছিল নিরীহ একটি গ্রহকণা, অনেক দূর দিয়ে এর চলে যাবার কথা ছিল। গতিপথ পাল্টে সরাসরি পৃথিবীর দিকে আসার জন্যে অনেকগুলো বিচিত্র ঘটনা ঘটতে হয়েছে এবং সবগুলো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা খুব কম, সোজা কথায় এগুলো ঘটার কথা না। কিন্তু আমরা জানি, এটা ঘটেছে, কাজেই আমার ধারণা–”
পদার্থবিজ্ঞানী রিশি কথা থামিয়ে মহামান্য রিহার দিকে তাকালো। মহামান্য রিহা বললেন, “তোমার কথা শেষ করো রিশি।”
রিশি বলল, “আমার ধারণা, এটি নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি কাকতালীয় ঘটনা নয়।”
“তাহলে এটি কী?”
“কোনো একটি বুদ্ধিমান প্রাণী পৃথিবীকে নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে যেভাবে এর একটা পরিবর্তন এনেছিল, এখন আবার সেই পরিবর্তন আনতে চাইছে। কাজেই আমার ধারণা, আমরা এটি থামাতে পারব না।”
মহামান্য রিহা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর ক্লান্ত গলায় বললেন, “সম্ভবত তোমার সন্দেহ সত্যি। সম্ভবত কোনো একটি বুদ্ধিমান প্রাণী পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলার প্রস্তুতি হিসেবে এই গ্রহকণাটিকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। কিন্তু আমি সেজন্যে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব না। আমি পৃথিবীকে রক্ষা করার চেষ্টা করব। সেটি কীভাবে করা যায়, আমি তার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব শুনতে চাই।”
পরিবেশ বিজ্ঞানী নীহা বলল, “আসলে কী করতে হবে, আমরা সেটা সবাই জানি। গ্রহকণাটির কক্ষপথে পরিবর্তন আনতে হবে যেন সেটি পৃথিবীতে আছড়ে না পড়ে। এটি যেন পৃথিবীকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।”
পদার্থবিজ্ঞানী রিশি মাথা নেড়ে বলল, “কাজটি এতো সহজ নয় নীহা। যদি কক্ষপথে যথেষ্ট পরিবর্তন আনতে না পার, তাহলে এটা হয়তো আফ্রিকাতে আঘাত না করে সাইবেরিয়াতে আঘাত করবে। আমাদের কোনো লাভ হবে না।”
নীহা বলল, “সেই হিসেবটুকু নিশ্চয়ই করা হবে। আমরা নিশ্চয়ই শুধু অনুমানের উপর নির্ভর করে গ্রহকণাটির কক্ষপথ পাল্টানোর চেষ্টা করব না। কাজটা নিখুঁতভাবেই করব। কিন্তু সেই কাজটুকু নিখুঁতভাবে করার জন্যে আমাদের যে প্রযুক্তির প্রয়োজন, সেটি কী আছে? এই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?”
প্রযুক্তিবিদ কিরি বলল, “আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি।”
মহামান্য রিহা বললেন, “চমৎকার। উত্তর দাও কিরি।”
কিরি এক মুহূর্তে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। তাকে দেখে মনে হল, তার হাতের মাঝে কোথাও যেন প্রশ্নের উত্তরটি লেখা রয়েছে। এক মুহূর্ত পর সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের কাছে এক সময় এই প্রযুক্তি খুব ভালোভাবে ছিল। পৃথিবী যখন নানা দেশে বিভক্ত ছিল, নিজেদের ভেতর যুদ্ধ বিগ্রহ ছিল, তখন সব দেশই একে অপরকে আক্রমণ করার জন্যে এই প্রযুক্তি তৈরি করে রেখেছিল। কিন্তু পুরো পৃথিবীটা শান্তির দিকে এগিয়েছে। এখন পৃথিবীতে আলাদা আলাদা দেশ নেই, পুরো পৃথিবী মিলে একটি দেশ। শুধু তাই না, পৃথিবী পরিচালনার জন্যে পৃথিবীর মানুষ রাজনৈতিক নেতাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আমাদের মতো বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা এখন পৃথিবীকে পরিচালনা করি। আমরা অস্ত্রগুলো অকেজো করেছি। এখন যখন প্রয়োজন হয়েছে, আমাদের হাতে সেই প্রযুক্তি নেই। যেটি আগে নিশ্চিতভাবে করা যেতো, এখন সেটি করার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। আমরা গ্রহকণাটিকে আঘাত করতেও পারি, আবার নাও করতে পারি।”
মহামান্য রিহা বললেন, “তাহলে আমরা এখন কী করতে পারি?”
“আমাদের হাতে দুটি ভিন্ন পথ খোলা আছে। আমার মনে হয়, আমাদের একই সাথে দুটি পথেই চেষ্টা করতে হবে। একটি হচ্ছে, পৃথিবী থেকে মিসাইল দিয়ে গ্রহকণাটিকে আঘাত করার চেষ্টা করা। যদি আঘাত করে ধ্বংস করে দিতে পারি, আমাদের বিপদ কেটে যাবে। কিন্তু আমি শুধু এটুকুর উপর ভরসা করতে চাই না। গ্রহকণাটির আকার বিদঘুঁটে এবং সেটি
খুবই বিচিত্রভাবে ঘুরপাক খেতে খেতে আসছে। মিসাইলটি গ্রহকণাটিকে ঠিকভাবে আঘাত করতে পারবে কী না, আমি সে বিষয়ে তত নিশ্চিত নই। আমার মনে হয়, আমাদের দ্বিতীয় আরেকটা পথে কাজ করতে হবে।”
“সেটি কী?”
“একটা টিমকে নিউক্লিয়ার বোমাসহ মহাকাশযানে করে পাঠাতে হবে। তারা এই গ্রহকণার উপর নামবে। সেখানে বোমাটি বসাবে এবং বিস্ফোরণ ঘটাবে। এই কাজটি অসম্ভব কঠিন, কিন্তু এটি নিশ্চিতভাবে কাজ করবে।”
মহামান্য রিহা কিছুক্ষণ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “টিমের সদস্যরা কেউ বেঁচে ফিরে আসবে না?”
“না। যেটুকু সময় আছে, সেই সময়ে তারা নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারবে না। যারা যাবে, তারা পৃথিবীর মানুষের কাছ থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে যাবে।”
মহামান্য রিহা আবার কিছুক্ষণ নিঃশব্দে মাথা নিচু করে বসে রইলেন। তারপর মাথা তুলে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে, যদি এটাই একমাত্র উপায় হয়ে থাকে, তাহলে এটাই আমাদের করতে হবে। এসো তোমাদের নিয়ে পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করে ফেলি।”
পনেরো মিনিটের ভেতর কমান্ড কাউন্সিল পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করে নিল। সাথে আরো একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, পৃথিবীর মানুষকে এই ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে কিছু জানানো হবে না। সত্যিই যদি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায়, সেটি ঘটুক সবার অগোচরে।
.
১.০২
কমান্ডার লী তার সামনে বসে থাকা কুড়িজন মহাকাশচারীর উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, “আমাদের এখন কী করতে হবে, তোমরা সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।”
মহাকাশচারীরা মাথা নাড়ল। কেউ মুখে কোনো কথা বলল না। কমান্ডার লী গলার স্বরকে একটুখানি উঁচু করে বলল, “সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিল আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে তোমাদের ভেতর থেকে একটি টিম তৈরি করার জন্যে। যে টিমটি গ্রহাণুটিকে ধ্বংস করতে যাবে।”
মহাকাশচারীরা এবারেও কোনো কথা বলল না। পাথরের মতো মুখ করে বসে রইল। কমান্ডার লী বলল, “আমি ইচ্ছে করলে তোমাদের কয়েকজনকে নিয়ে সেই টিম তৈরি করে দিতে পারি। কিংবা তোমরা চাইলে নিজেদের ভেতরে আলোচনা করে আমাকে একটা টিম তৈরি করে দিতে পার। এখন তোমাদের কী ইচ্ছা, বল।”
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বলল, “আমাদের পাঁচ থেকে দশ মিনিট সময় দেয়া হলে আমরা নিজেদের ভেতর কথা বলে তোমাকে টিমের সদস্যদের তালিকা তৈরি করে দিতে পারব।”
পিছন থেকে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “তার প্রয়োজন নেই কমান্ডার। আমি এই মিশনের দায়িত্ব নিতে চাই।”
সবাই মাথা ঘুরিয়ে মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটির নাম রায়ীনা। মহাকাশচারীদের এই দলটির মাঝে সবচেয়ে অভিজ্ঞ কয়েকজনের একজন।
কমান্ডার একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “রায়ীনা, তুমি জান এটা হচ্ছে একটা সুইসাইড মিশন।”
রায়ীনা শান্তভাবে বলল, “হ্যাঁ আমি জানি। কিন্তু আমার কাছে এই কারণটি এতোটুকু গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার কাছে এই মিশনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সঠিকভাবে করা না হলে পৃথিবীর সাত বিলিয়ন মানুষকে বাঁচানো যাবে না। আমি এই দায়িত্বটি নিতে চাই।”
মধ্যবয়স্ক মহাকাশচারী রায়ীনার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “রায়ীনা, তুমি বিষয়টাকে যেভাবে দেখছ, আমরা সবাই ঠিক একইভাবে দেখছি। কাজেই আমরা কি সবাই মিলে এটা নিয়ে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না?”
রায়ীনা বলল, “অবশ্যই পারি। কিন্তু আমাদের হাতে সময় খুব কম, প্রত্যেকটা সেকেন্ড মূল্যবান। তাই আমি একটু সময় বাঁচানোর চেষ্টা করছি, আর কিছু নয়। তা ছাড়া আমার ধারণা, আমরা সবাই মিলে আলোচনা করলে তোমরা আমাকেই দায়িত্বটা দেবে। এ ধরনের মিশনে আমার অভিজ্ঞতা সবচাইতে বেশি।”
মধ্যবয়স্ক মহাকাশচারী বলল, “মহাকাশে একটা গ্রহাণুতে মহাকাশযান নামানোতে আমাদের কারো অভিজ্ঞতা নেই। আমরা কেউ আগে এটা করিনি।”
“কিন্তু আমি নিয়মিতভাবে মহাকাশ স্টেশনে রসদ নিয়ে যাই। আমি চোখ বন্ধ করে মহাকাশ স্টেশনে মহাকাশযান ডক করতে পারি। একটা জটিল মহাকাশ স্টেশন আর গ্রহাণুর মাঝে বড় কোনো পার্থক্য নেই।”
মধ্যবয়স্ক মহাকাশচারী বলল, “আছে। এই গ্রহকণার বেলায় পার্থক্য আছে। মহাকাশ স্টেশন বিচিত্রভাবে তার তিন অক্ষে ঘুরপাক খায় না। এই গ্রহাণুটি বিচিত্রভাবে তার তিন অক্ষে ঘুরপাক খাচ্ছে।”
রায়ীনা একটু হাসির মতো ভঙ্গি করে বলল, “আমি জানি। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, একটি মহাকাশ স্টেশন একবার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সবাই সেটির আশা ছেড়ে দিয়েছিল। আমি তখন নিজ দায়িত্বে সেই মহাকাশ স্টেশনে ডক করে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম!”
মধ্যবয়স্ক মহাকাশচারী হাসল। বলল, “হ্যাঁ। অবশ্যই মনে আছে। তোমার সেই কাজটুকু এখন মহাকাশ অভিযানের টেক্সট বইয়ে ঢোকানো আছে। মহাকাশ ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রীদের সেটা পড়ানো হয়।”
“কাজেই তোমরা আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পার। আমি তোমাদের নিরাশ করব না। মূল কাজটি করবে মহাকাশযানের অন বোর্ড কোয়াকম্প। গ্রহাণুটির গতি বিশ্লেষণ করে মহাকাশযানটিকে তার সাপেক্ষে স্থির করে আনতে হবে। আমি শুধু ম্যানুয়েল কন্ট্রোলে থাকব।”
কমান্ডার লী এতোক্ষণ কোনো কথা বলেনি। রায়ীনার কথা শেষ হবার পর তার দিকে তাকিয়ে বলল, “শুধু ডক করা নয়, ডক করার পর একটি থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা ডেটনেট করার ব্যাপার আছে।”
রায়ীনা হেসে বলল, “সেটি হচ্ছে একটা লাল বোতাম টিপে ধরা। দেখিয়ে দেয়া হলে একটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও এটা করতে পারে। সেটি করার আগে রেটিনা স্ক্যান করিয়ে সিকিউরিটি কোড ঢোকাতে হবে। আমি সেটা ঢোকাতে পারব। কোনো সাহায্য ছাড়াই আমি সিকিউরিটি কোড মনে রাখতে পারব। পাইয়ের মান দশমিকের পর তেতাল্লিশ ঘর পর্যন্ত আমার এমনিতেই মনে থাকে।”
মধ্যবয়স্ক মহাকাশচারী বলল, “রায়ীনা। আমার মনে হয়, তোমাকে দায়িত্বটি দেবার আগে আমরা সবাই মিলে বিষয়টা একটুখানি আলোচনা করি।”
রায়ীনা মাথা নাড়ল। বলল, “যদি তোমাদের কারো মনে হয়, আমি এই কাজটি করার উপযুক্ত নই, তোমরা সেটি প্রকাশ্যে সবার সামনে বলতে পার। আমি মেনে নেব। কিন্তু যদি আমার কর্মক্ষমতা নিয়ে তোমাদের কোনো সন্দেহ না থাকে, তাহলে আমি এই দায়িত্ব পালন করতে চাই। পৃথিবীতে খুব কম মানুষের জীবনে এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করার সুযোগ আসে। আমি নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করব, যদি আমাকে এই সুযোগটি দেয়া হয়।”
মহাকাশচারীরা কোনো কথা বলল না। কমবয়সী একজন বলল, “রায়ীনা, তোমার কর্মদক্ষতা নিয়ে আমাদের কারো মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আমরা, তরুণেরা সব সময় তোমার মতো একজন হওয়ার চেষ্টা করি–”
তরুণ মহাকাশচারীর কথা শেষ হওয়ার আগেই রায়ীনা বলল, “তোমরা সত্যিই যদি এটি বিশ্বাস করো, তাহলে আমাকে দায়িত্ব দেয়া নিয়ে তোমাদের কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। আমি দায়িত্বটি নিতে চাই।” রায়ীনা কমান্ডার লীয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “কমান্ডার, আমাকে দায়িত্বটুকু দিন।”
কমান্ডার কয়েক সেকেন্ড নিঃশব্দে রায়ীনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে রায়ীনা। আমি তোমাকে দায়িত্ব দিচ্ছি। এই দায়িত্ব নেবার জন্য পৃথিবীর মানুষের পক্ষ থেকে আমি তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
রায়ীনা বলল, “ধন্যবাদ কমান্ডার।” তারপর যেভাবে হঠাৎ উঠে
দাঁড়িয়েছিল, ঠিক সেভাবে তার জায়গায় বসে পড়ল।
কমান্ডার বলল, “আমরা টিম লিডার পেয়েছি। এখন আমাদের আরো দু’জন সদস্য দরকার। যারা রায়ীনার সাথে যাবে।”
একজন তরুণ মহাকাশচারী প্রায় লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি যাব।”
সাথে সাথে অন্য সবাই উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল, “আমি। আমি। আমি যাব।”
যে তরুণ মহাকাশচারী সবার আগে উঠে দাঁড়িয়েছিল, সে গলা উঁচিয়ে বলল, “আমি রায়ীনার সাথে অনেকবার রসদ নিয়ে মহাকাশ স্টেশনে গিয়েছি। রায়ীনার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা আমার সবচেয়ে বেশি। আমি রায়ীনার মিশনে চমৎকার একজন সহকর্মী হব।”
সাথে সাথে অন্যেরাও কথা বলতে শুরু করল এবং ঘরের ভেতর একধরনের হট্টগোলের মতো অবস্থা হল। তখন রায়ীনা আবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমরা আমাকে আরেকবার কথা বলার সুযোগ দাও।”
কমান্ডার মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। আমার মনে হয়, রায়ীনাকে আমরা তার টিমের অন্য দু’জন সদস্যকে বেছে নিতে দিই।”
রায়ীনা বলল, “আমার আর কাউকে প্রয়োজন নেই। এই মিশনটি সবচেয়ে ভালোভাবে শেষ করার জন্যে আমি একাই যথেষ্ট। আমার প্রয়োজন একটি ইলন শাটল, সেখানে থাকবে একটি অনবোর্ড কোয়াকম্প। পৃথিবীর মূল ডাটা সেন্টারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ থাকবে প্লিক্সি নেটওয়ার্ক দিয়ে। ইলন শাটলকে উৎক্ষেপণ করে ট্রিটন রকেট দিয়ে, তাহলেই আর কোনো কিছুর প্রয়োজন হবে না।”
কমান্ডার লী একটু অবাক হয়ে বলল, “তুমি একা যেতে চাও?”
“হ্যাঁ কমান্ডার। আমি একা গেলে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে পারব। আমাকে তাহলে অন্যের কাজকর্ম নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। অন্যের কাজকর্মের উপর নির্ভর করতে হবে না। অন বোর্ড একটা কোয়াকম্প থাকলে আমার কোনো মানুষের সাহায্যের দরকার হবে না।”
“কিন্তু এতো বড় একটা মিশনে শুধু একজনের উপর নির্ভর করা ঠিক হবে না।”
রায়ীনা মাথা নাড়ল। বলল, “সেটি সত্যি। আমার মনে হয়, আমি রওনা দেয়ার পর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় এমনকি দরকার হলে চতুর্থ এবং পঞ্চম মিশনও প্রস্তুত থাকা দরকার। কোনো কারণে আমি যদি ব্যর্থ হই, একটির পর আরেকটি মিশন পাঠানোর প্রস্তুতি থাকতে হবে।”
কমান্ডার লী মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ। সেটি আমাদের পরিকল্পনার মাঝে আছে।”
রায়ীনা এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, “আমার মিশনটি প্রস্তুত করতে মিশন কন্ট্রোলের খুব কম করে হলেও এক থেকে দুই ঘণ্টা সময় দরকার হবে। আমি কী এই সময়টুকু নিজের জন্যে পেতে পারি?”
কমান্ডার লী বলল, “অবশ্যই পেতে পারো। মিশন শুরু করার আগে তোমার সাথে দশ থেকে পনেরো মিনিট সময় পেলেই চলবে।”
“ধন্যবাদ কমান্ডার। আমি কী এখনই বিদায় নিতে পারি?”
“অবশ্যই।”
রায়ীনা ঘরের ভেতর চুপচাপ বসে থাকা মহাকাশচারীদের দিকে এক নজর তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, “তোমাদের সাথে সম্ভবত আমার আর দেখা হবে না। তোমাদেরকে বলছি তোমরা হচ্ছ আমার সত্যিকারের পরিবার। আমাকে চমঙ্কার একটা আনন্দময় জীবন দেওয়ার জন্যে তোমাদের ধন্যবাদ।”
মহাকাশচারীরা মাথা নাড়ল। একজন বলল, “আমাদের বেঁচে থাকার অর্থ শেখানোর জন্যে তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা রায়ীনা। আমাদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি যাও রায়ীনা। যার কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে, তুমি তার কাছে যাও।”
রায়ীনা ঘর থেকে বের হয়ে গেল। পিছনের সারিতে বসে থাকা একজন তরুণ তার পাশের তরুণীকে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, “রায়ীনা কার কাছ থেকে বিদায় নেবে?”
“তার দুই বছরের মেয়েটির কাছ থেকে।”
.
অনাথ আশ্রমের গেটে বাইভার্বালটি থামিয়ে দরজা খুলে রায়ীনা নেমে এল। সে তার বাম হাত দিয়ে তার দুই বছরের মেয়েটিকে আলগোছে ঝুলিয়ে রেখেছে। মেয়েটিকে দেখে মনে হতে পারে, তাকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখার কারণে সে বুঝি খুব অস্বস্তি বোধ করছে। কিন্তু তার মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, সে মোটেও অস্বস্তিতে নেই এবং এভাবে ঝুলে থাকায় সে খুবই অভ্যস্ত। মেয়েটি ঝুলন্ত অবস্থায় অনেকটা আপন মনে নিজের হাত দুটি নিয়ে খেলছে।
রায়ীনা কয়েক পা অগ্রসর হতেই অনাথ আশ্রমের দরজা খুলে এর ডিরেক্টর ক্লারা–হাসিখুশি মধ্যবয়স্ক একজন মহিলা বের হয়ে এল। দুই হাত ওপরে তুলে আনন্দের একটা ভঙ্গি করে ক্লারা বলল, “আমাদের কী সৌভাগ্য, একজন সত্যিকারের মহাকাশচারী আমাদের দেখতে এসেছে। আমার বাচ্চারা আনন্দে পাগল হয়ে যাবে!”
রায়ীনা হাসিমুখে বলল, “তারা যদি মহাকাশচারী দেখতে চায়, আমাদের সেন্টার থেকে ডজন ডজন মহাকাশচারী পাঠাতে পারব। আজকে আমি একটা কাজে এসেছি। সেই কাজটুকু আগে সেরে নেই।”
“অবশ্যই। অবশ্যই। চলে এসো।”
আশ্রমের ডিরেক্টর ক্লারার অফিসটা খোলামেলা। এখানে নিশ্চয়ই অনেক শিশু আসে। অফিসটিকে শিশুদের জন্যে আনন্দময় করে রাখা আছে। রায়ীনা তার বাম হাতে ঝুলিয়ে রাখা মেয়েটিকে মেঝেতে নামিয়ে দিল। মেয়েটি সাথে সাথে ঘরের কোনায় স্কুপ করে রাখা খেলনাগুলোর দিকে ছুটে গেল। রায়ীনা এক নজর সেদিকে তাকিয়ে থেকে একটা চেয়ার টেনে বসে ডিরেক্টর ক্লারার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার হাতে একেবারে সময় নেই। যে কথাটি বলতে এসেছি, আগে বলে নিই?”
রায়ীনার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। আশ্রমের ডিরেক্টর ক্লারার হাসি হাসি মুখে এক ধরনের গাম্ভীর্য নেমে এলো। সে মাথা নেড়ে বলল, “অবশ্যই রায়ীনা।”
রায়ীনা কোনোরকম ভূমিকা না করে বলল, “আমি আমার মেয়ে ত্রাতিনাকে তোমার হাতে দিতে এসেছি। আমার ইচ্ছা, সে এই আশ্রমে তার মতো আরো অনেকের সাথে বড় হোক।”
ডিরেক্টর ক্লারার চোখে এক ধরনের বিস্ময়ের ছায়া পড়ল। কিন্তু সে কোনো কথা বলল না। রায়ীনা শান্ত গলায় বলল, “তুমি আমাকে কোনো প্রশ্ন করো না। কারণ প্রশ্ন করলেও আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না।”
ডিরেক্টর ক্লারা কোনো প্রশ্ন করলো না। একদৃষ্টে রায়ীনার দিকে তাকিয়ে রইল। রায়ীনা শান্ত গলায় বলল, “আমি মায়ের দায়িত্ব পালনে কোনো অবহেলা করিনি। পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে আনন্দময় সময় ছিল ত্রাতিনার সাথে কাটানো সময়টুকু।” রায়ীনা হঠাৎ করে থেমে গেল। রায়ীনার ইস্পাতের মতো শক্ত নার্ভ, কিন্তু সে আবিষ্কার করল, সে আর কথা বলতে পারছে না। তার চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে পড়ছে।
ডিরেক্টর ক্লারা বলল, “রায়ীনা, তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না। অমি কিছু জানতেও চাই না। একজন মা নিজে এসে তার সন্তানকে এই আশ্রমে দিয়ে গেলে আর কিছু করতে হয় না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, তোমার মেয়ে ত্রাতিনা এখানে অন্য সব শিশুদের নিয়ে গভীর এক ধরনের ভালোবাসা নিয়ে একটা বিশাল পরিবারে বড় হবে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। রায়ীনা।”
রায়ীনা খুব সাবধানে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তার চোখের কোনা মুছে নিয়ে ত্রাতিনার দিকে তাকালো। ত্রাতিনা তখন গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা খেলনা ভালুকের মাথাটি ধড় থেকে টেনে আলাদা করার চেষ্টা করছিল।
রায়ীনা আবার ডিরেক্টর ক্লারার দিকে তাকালো। তারপর পকেট থেকে ছোট একটা ক্রিস্টাল তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমি জানি প্রথম প্রথম ত্রাতিনা আমাকে খুঁজবে, আমার জন্যে কাঁদবে। তারপর সে আস্তে আস্তে আমাকে ভুলে যাবে। বহুদিন পর সে যখন বড় হবে, তখন হঠাৎ একসময় হয়তো তার কৌতূহল হবে, সে জানতে চাইবে সে কোথা থেকে এসেছে। তার মা কে, বাবা কে, তার পরিচয় কী। তখন তুমি এই ক্রিস্টালটি ত্রাতিনার হাতে দিও। এখানে আমি তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বলেছি। আমার ধারণা, সে যদি এটা শোনে, তাহলে হয়তো তার মাকে সে ক্ষমা করে দেবে।”
ডিরেক্টর মহিলাটি হাত বাড়িয়ে ক্রিস্টালটি নিয়ে বলল, “আমি এটা এখনই আমাদের সেফ ডিপোজিটে রেখে দিচ্ছি। ত্রাতিনা যখন পূর্ণ বয়সে পৌঁছাবে, তখন সেটি তার হাতে দেয়া হবে।”
“ধন্যবাদ তোমাকে।” রায়ীনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার হাতে সময় খুব কম। আমি কী ত্রাতিনাকে তোমাদের অন্য শিশুদের মাঝে রেখে আসতে পারি? তাহলে আমার বিদায় নেওয়া সহজ হবে।”
ডিরেক্টর মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “অবশ্যই সেটি করতে পারবে। এসো আমার সাথে।”
রায়ীনা তখন হেঁটে ত্রাতিনার কাছে গিয়ে বলল, “এসো ত্রাতিনা, আমরা তোমার আপনজনের কাছে যাই।”
ত্রাতিনা কী বুঝল কে জানে, আপনজনের কাছে যাওয়ার জন্যে প্রায় লাফিয়ে রায়ীনার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। রায়ীনা তাকে বুকে চেপে উঠে দাঁড়াল। ডিরেক্টর মহিলার পিছনে পিছনে সে করিডোর ধরে হাঁটতে থাকে। করিডোরের শেষ মাথায় একটা বড় হলঘর। হলঘরের দরজা খুললেই দেখা গেল, ভেতরে অনেকগুলো নানা বয়সী শিশু হুটোপুটি করে খেলছে। তাদের ভেতর থেকে বেশ কয়েকজন মাথা ঘুরিয়ে ডিরেক্টর মহিলা এবং রায়ীনার দিকে তাকাল। তাদের চোখ মুখ হঠাৎ আনন্দে জ্বলজ্বল করে ওঠে এবং এক সাথে সবাই তাদের দিকে ছুটে আসে।
শিশুগুলো তাদের ঘিরে দাঁড়াল এবং অকারণে খিলখিল করে হাসতে শুরু করল। রায়ীনা মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে ত্রাতিনাকে নামিয়ে দিয়ে ফিস ফিস করে বলল, “ত্রাতিনা, এই যে, এরা তোমার ভাই বোন! তুমি যাবে তাদের কাছে?”
ত্রাতিনা একবার খানিকটা সন্দেহের চোখে মায়ের দিকে তাকালো, তারপর তাদের ঘিরে থাকা শিশুগুলোর দিকে তাকালো। তার চোখে মুখে দুর্ভাবনার একটা ছাপ পড়ল। সে বুঝতে পারছে না, হঠাৎ করে তার চারপাশে তার সমবয়সী এতোগুলো শিশু কোথা থেকে এসেছে।
একটি সোনালী চুলের মেয়ে ত্রাতিনার কাছে এসে সাবধানে তার হাতটি ধরে নিজের দিকে টেনে আনতে চেষ্টা করল। ত্রাতিনা প্রথমে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে। তারপর হঠাৎ কী মনে করে অন্য হাত দিয়ে মেয়েটির সোনালী চুলগুলো স্পর্শ করে দেখল। কী কারণ কে জানে কেন, হঠাৎ করে ত্রাতিনার মুখ থেকে দুর্ভাবনার চিহ্নটি সরে গিয়ে মুখটি হাসি হাসি হয়ে যায়। রায়ীনা নিচু গলায় বলল, “যাও ত্রাতিনা, যাও। তোমার ভাই বোনের কাছে যাও।”
ত্রাতিনা তখন খুব সাবধানে শিশুদের সাথে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে যেতে থাকে।
রায়ীনা কিছুক্ষণ তার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ডিরেক্টর ক্লারার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কি কিছুক্ষণ এই ঘরটিতে থাকতে পারি?”
“অবশ্যই। তোমার বসার জন্যে একটা চেয়ার এনে দিই।”
“তার কোনো প্রয়োজন নেই।” রায়ীনা একটু পিছিয়ে গিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। তারপর ক্লারার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার হাতে একেবারে সময় নেই। দশ কী পনেরো মিনিটের ভেতর আমার ডাক পড়বে। তখন আমাকে যেতে হবে। যতক্ষণ আমাকে না ডাকছে, আমি ততক্ষণ এখানে বসে থাকতে চাই।”
ডিরেক্টর ক্লারা বলল, “ছোট বাচ্চাদের চেঁচামেচি যদি তোমার নার্ভের উপর উঠে না যায়, তুমি যতক্ষণ ইচ্ছা এখানে বসে থাকতে পার। তুমি সম্ভবত নিরিবিলি একা বসে থাকতে চাও। আমি তোমাকে একা থাকতে দিই?”
রায়ীনা একটু হাসার চেষ্টা করল। বলল, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আসলেই আমি একটু সময় একা বসে থাকতে চাইছিলাম।”
রায়ীনা দেওয়ালে হেলান দিয়ে একা একা বসে রইল। বড় হলঘরের এক পাশে ত্রাতিনা অন্য শিশুদের সাথে খেলতে শুরু করেছে। রায়ীনা বিচিত্র এক ধরনের লোভাতুর দৃষ্টিতে তার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইল। আর কোনোদিন সে তার এই সন্তানটিকে বুকে চেপে ধরতে পারবে না। এই শিশুগুলো যেন পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারে, সে জন্যে সে তার প্রাণটি দিতে যাবে। সেটি নিয়ে তার ভেতরে কোনো হতাশা নেই। কোনো জ্বালা কিংবা ক্ষোভ নেই। একটুখানি দুঃখ হয়তো আছে, কিন্তু সেরকম দুঃখ কার জীবনে নেই?
ঠিক দশ মিনিটের মাথায় রায়ীনার ট্রাকিওশানটি তাকে সংকেত দিল, তার যাবার সময় হয়েছে। রায়ীনা উঠে দাঁড়াল, তার দুই বছরের মেয়েটির কাছ থেকে এখন তাকে বিদায় নিতে হবে। সে কী পারবে বিদায় নিতে?
রায়ীনা নরম গলায় ডাকল, “ত্রাতিনা, মা আমার।”
ত্রাতিনা ঘুরে তাকাল। তারপর তার দিকে ছুটে এলো। রায়ীনা দুই হাত বাড়িয়ে ত্রাতিনাকে জড়িয়ে ধরল। তাকে বুকে চেপে রেখে ফিসফিস করে বলল, “ত্রাতিনা, মা আমার। তুই ভালো থাকিস মা। তোর এই মায়ের ওপর কোনো রাগ পুষে রাখিস না মা। এই পৃথিবীতে তোরা যেন বেঁচে থাকিস, সে জন্যে আমাকে চলে যেতে হচ্ছে সোনামনি।”
ত্রাতিনা তার মায়ের কথাগুলো বুঝতে পারল না। কিন্তু গলার স্বরের আকুতিটুকু বুঝতে পারল। সে অবাক হয়ে তার মায়ের দিকে তাকাল। রায়ীনার চোখে পানি টলটল করছে, সে খুব সাবধানে তার চোখ মুছে এবার ত্রাতিনাকে স্পষ্ট গলায় বলল, “যাও মা। তোমার ভাইবোনের কাছে যাও।”
ত্রাতিনা চলে গেল না। মায়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রায়ীনা আবার বলল, “যাও ত্রাতিনা। ওই দেখো, সবাই তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
ত্রাতিনা খপ করে রায়ীনাকে ধরে বলল, “না। না।”
রায়ীনা হতাশভাবে ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে দেখল কাছাকাছি ডিরেক্টর ক্লারা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। রায়ীনা নিচু গলায় তাকে বলল, “তুমি কী আমার মেয়েটিকে ধরে রাখবে? আমার এখন যেতে হবে।”
ডিরেক্টর ক্লারা ত্রাতিনার কাছে এসে তার হাত ধরে বলল, “মাকে ছেড়ে দাও ত্রাতিনা, তোমার মায়ের এখন যেতে হবে।”
ত্রাতিনা তার মাকে ছেড়ে দিল। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
.
১.০৩
রায়ীনা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। মহাকাশযানের চেয়ারটিতে বেল্ট দিয়ে তাকে এমনভাবে বেঁধে রাখা আছে যে, সে নিচের দিকে দেখতে পাচ্ছে না। তার সামনে নীল আকাশ, সেখানে সাদা মেঘ। সে পৃথিবীটিকে আর কখনো দেখতে পাবে না, এই নীল আকাশ আর সাদা মেঘও কখনো দেখতে পাবে না। কিন্তু সে এই ধরনের ভাবালুতাকে তার চিন্তার মাঝে স্থান দিল না। মাথার ভেতর থেকে সব ধরনের চিন্তা সরিয়ে দিয়ে সে তার মিশনের জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।
রায়ীনা সামনের প্যানেলটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। কোয়াকম্পের সুইচ অন করল। জ্বালানি পরীক্ষা করল। কারগো বে’তে রাখা নিউক্লিয়ার বোমাটির নিয়ন্ত্রণ শেষবারের মতো দেখে নিল। মহাকাশযানের বাতাসের চাপ পরীক্ষা করল, বায়ু নিরোধক সিল পরীক্ষা করল। যোগাযোগ মডিউল চালু করল। তারপর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে কথা বলল, “আমি প্রস্তুত।”
রায়ীনা কমান্ডার লীয়ের গলার স্বর শুনতে পায়, “চমৎকার রায়ীনা। তোমার মিশন সফল হোক। আমরা কাউন্ট ডাউন শুরু করছি।”
“করো।”
প্রায় সাথে সাথেই আলোর ঝলকানির সাথে সাথে সে কাউন্ট ডাউন শুনতে পায়। ভরাট পুরুষ কণ্ঠে কোনো একজন গুনতে শুরু করেছে, “দশ, নয়, আট…।”
রায়ীনা একটা ঝাঁকুনি এবং তারপর একটা কম্পন অনুভব করে। তার মহাকাশযানটিকে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। বিশাল ক্ল্যাম্পগুলো ধীরে ধীরে দুই পাশে সরে যাচ্ছে। রায়ীনা টের পেলো, তার ইঞ্জিনটি চালু হতে শুরু
ত্রাতিনা করেছে। এক ধরনের ধাতব গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
“সাত…ছয়…পাঁচ…চার…”
পানি দিয়ে সিক্ত করে রাখা কংক্রিটের বেস থেকে ইঞ্জিনের উত্তাপে সাদা জলীয় বাষ্প চারদিক ঢেকে ফেলছে।
“তিন….দুই….এক…”
রায়ীনা একটা ঝাঁকুনি অনুভব করল এবং হঠাৎ পুরো মহাকাশযানটা থরথর করে কেঁপে ওঠে। রায়ীনা বাইরে তাকালো, মহাকাশযানটা ওপরে উঠতে শুরু করেছে। রায়ীনা তার সিটে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল। কিছুক্ষণের ভেতরেই অদৃশ্য একটা শক্তি তাকে তার সিটের সাথে চেপে ধরবে। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ থেকে বের হওয়ার সময় সব মহাকাশচারীদের এই অদৃশ্য শক্তির মুখোমুখি হতে হয়। ট্রিটন রকেটের শক্তিশালী ইঞ্জিন প্রচণ্ড গর্জন করে তার ইলন শাটলকে মহাকাশে নিয়ে যেতে শুরু করেছে। গতি বাড়তে শুরু করার সাথে সাথে রায়ীনা অনুভব করল, অদৃশ্য একটা শক্তি তার বুকের উপর চেপে বসেছে। তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়, মনে হয় চোখের সামনে একটা লাল পদা থরথর করে কাঁপছে। রায়ীনা নিঃশ্বাস বন্ধ করে সমস্ত শরীরকে টান টান করে রাখে। সে বুঝতে পারছে, তার মুখ থেকে রক্ত সরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সে বুঝি কিছু চিন্তা করতে পারছে না। রায়ীনা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। প্রতিবার মহাকাশ অভিযানে তাকে এই অদৃশ্য শক্তির ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সে জানে, কিছুক্ষণের মাঝেই সে পৃথিবীকে ঘিরে একটা কক্ষপথে ঢুকে যাবে। তখন হঠাৎ করে তার বুকের ওপর ভেসে থাকা জগদ্দল পাথরটি সরে যাবে। ইলন শাটলের ভেতর পুরোপুরি ভরশূন্য হয়ে সে ভেসে বেড়াবে।
রায়ীনা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে এবং প্রায় হঠাৎ করেই তার মনে হয় তার বুকের ওপর চেপে বসে থাকা অদৃশ্য শক্তিটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। নিজেকে মনে হয় হালকা এবং ভরশূন্য। রায়ীনা তার সিট বেল্ট খুলে নিজেকে মুক্ত করে নিল। তারপর ভেসে ভেসে জানালার কাছে এসে বাইরে তাকালো, নিচে নীল পৃথিবী। পৃথিবীটি কী সুন্দর, এটি মনে হয় শুধু মহাকাশে এলেই সত্যিকার অর্থে অনুভব করা যায়।
রায়ীনা জানালাটিতে ধাক্কা দিয়ে কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে এসে ভিডিও স্ক্রীনটা চালু করল। সাথে সাথেই প্লিক্সি নেটওয়ার্কে সে পৃথিবীর কন্ট্রোল সেন্টার দেখতে পায়। কমান্ডার লী বড় একটা স্ক্রীনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রায়ীনাকে দেখতে পেয়ে মুখে একটা হাসি টেনে এনে বলল, “চমৎকার ট্র্যাজেক্টরি। তুমি কক্ষপথে পৌঁছে গেছ।”
রায়ীনা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ।”
কমান্ডার লী বলল, “গ্রহকণাটা এখনো এগারো ঘন্টার পথ।”
রায়ীনা বলল, “বুঝতে পারছি।”
“প্রোগ্রাম লোড করা আছে। পৃথিবীটা একবার ঘুরে এসে ঠিক জায়গায় এলে তোমার রকেট চালু হবে।”
রায়ীনা একটু হাসল। বলল, “মহাকাশে ওপরে নিচে অনেকবার গিয়েছি, কিন্তু এই মিশনটা অন্যরকম।”
“হ্যাঁ, অন্যরকম।”
“প্রতিটা সেকেন্ড মূল্যবান।”
“যদি সময় থাকতো, তাহলে তোমাকে পৃথিবী কয়েকবার ঘুরিয়ে এনে ছেড়ে দিতাম। এখন একবারে এক্সেলেরেট করতে হবে-কষ্ট বেশি হবে।”
রায়ীনা হাসল। বলল, “আমার কষ্ট নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমি জড় পদার্থের মতন, আমার কষ্ট হয় না।”
রায়ীনা কন্ট্রোল প্যানেলটাতে ধাক্কা দিয়ে আবার নিজেকে ভাসিয়ে জানালার কাছে নিয়ে আসে। জানালার হ্যাঁন্ডেলটা ধরে সে আবার নিচে পৃথিবীর দিকে তাকালো। নীল পৃথিবীটা ঘিরে সাদা মেঘ, অর্ধেক পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে এসেছে। আর কিছুক্ষণের মাঝে সেও পৃথিবীর অন্ধকার ছায়ার মাঝে ঢুকে যাবে। তখন পৃথিবীর অন্য একটা রূপ দেখা যাবে। বড় বড় শহরগুলোতে স্ফটিকের মতো আলো জ্বলজ্বল করছে, মহাকাশ থেকে কী অপূর্ব দেখায়।
রায়ীনা ঘড়ির দিকে তাকালো। পুরো পৃথিবীটা ঘুরে আসতে নব্বই মিনিটের মতো সময় নেয়। যার অর্থ, আর দশ মিনিটের মাঝেই সে পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে গ্রহকণার দিকে ছুটে যাবে। তার এখন মহাকাশচারীর সিটে বসা দরকার। তা না হলে একটু পরেই কর্কশ এলার্ম বাজতে শুরু করবে।
রায়ীনা ভেসে ভেসে তার সিটে গিয়ে বসল। দুই পাশ থেকে স্ট্র্যাপ এসে তাকে সিটের সাথে বেঁধে নেয়। সে হাত বাড়িয়ে কোয়াকম্পের সুইচটি অন করে দিল। এখন থেকে সে সরাসরি কোয়াকম্পের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায়।
রায়ীনা আবার কমান্ডার লীয়ের গলার স্বর শুনতে পেল। কমান্ডার নিচু গলায় ডাকল, “রায়ীনা।”
“বল।”
“তুমি প্রস্তুত?”
“হ্যাঁ। আমি প্রস্তুত।”
“তোমার সাথে আমরা যোগাযোগ রাখব, কিন্তু এখন থেকে তোমার মহাকাশযানের দায়িত্ব তোমার।”
“আমি জানি।”
“আমরা অপেক্ষা করব। শুধু তুমি ডাকলে আমরা সাড়া দেব। আমরা নিজে থেকে তোমার সাথে আর কথা বলব না।”
“ঠিক আছে কমান্ডার। মিশনের এই পর্যায়ে এটাই হচ্ছে প্রোটোকল।”
“তাহলে বিদায় রায়ীনা।”
“বিদায়।” অভ্যাস মতো আবার দেখা হবে” বলতে গিয়ে রায়ীনা থেমে গেল। আবার দেখা হবে না। পৃথিবীর কারো সাথে আর দেখা হবে না।
.
রায়ীনা প্রথমে একটা গর্জন শুনতে পেলো। তারপর তীব্র একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে। প্রায় সাথে সাথেই রায়ীনার মনে হলো, একটা ভারী পাথর বুঝি তার বুকের ওপর চেপে বসেছে। সে দাঁত দাঁত চেপে নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই এই অদৃশ্য চাপটা সহনীয় হয়ে যাবে। হলোও তাই, রায়ীনা তখন সিট বেল্ট খুলে বের হয়ে এলো। জানালার কাছে এসে সে নিচের দিকে তাকালো। দূরে পৃথিবীটা দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসবে। এই প্রথমবার পৃথিবীর জন্যে সে এক ধরনের বেদনা অনুভব করে। হঠাৎ করে তার ত্রাতিনার কথা মনে পড়ে যায়। এই মুহূর্তে সে কী করছে? যে শহরটি থেকে সে এসেছে, সেটি এখন পৃথিবীর উল্টোপিঠে। সেখানে এখন গভীর রাত। ত্রাতিনা কী তার জন্যে কাঁদছে? কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে? নাকি এখনো জেগে আছে? নূতন জায়গায় নূতন পরিবেশে সে কী ভয় পাচ্ছে? রায়ীনা জোর করে তার মাথা থেকে ভাবনাটা সরিয়ে দিল। তার এখন আবেগপ্রবণ হলে চলবে না। সে পৃথিবীকে রক্ষা করার মিশনে এসেছে। তার এখন অন্য কিছু নিয়ে ব্যাকুল হবার সময় নেই।
ঘণ্টা দুয়েক পর হঠাৎ এলার্ম বেজে উঠল। রায়ীনা মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। কোয়াকম্প জানাচ্ছে, তার ইলন শাটলের জ্বালানি বিপজ্জনক মাত্রায় কমে আসছে। পৃথিবীতে নিরাপদে ফিরে যেতে হলে তার জ্বালানি হিসেব করে খরচ করতে হবে। রায়ীনাকে আর পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে না। তাকে তার জ্বালানি বাঁচিয়ে রাখতেও হবে না। কোয়াকম্প সেটি জানে না!
রায়ীনা এলার্মটি স্পর্শ করে বন্ধ করে মনিটরের দিকে তাকালো। সে গ্রহকণাটির কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। এখন তাকে খুব সাবধানে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। গ্রহকণাটির পাশাপাশি তাকে যেতে হবে এবং খুব সাবধানে গ্রহকণাটির ওপর নামতে হবে। কাজটি সহজ হবে না। কারণ গ্রহকণাটির আকার খুবই বিচিত্র এবং সেটি আরো বিচিত্রভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। রায়ীনাকে এখন আর পৃথিবীর তথ্য ব্যবহার করতে হবে না, সে নিজেই তার ইলন শাটল থেকে গ্রহকণাটির বিচিত্র গতিটাকে বিশ্লেষণ করতে পারবে। কোয়াকম্প তাকে সাহায্য করবে।
রায়ীনা আবার মহাকাশচারীর সিটে গিয়ে বসল। সাথে সাথে দুই পাশ থেকে নিরাপত্তা বন্ধনী আবার তাকে সিটের সাথে আটকে ফেলল। রায়ীনা তখন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে, কন্ট্রোল প্যানেলটি নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসে।
গ্রহকণাটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। কী বিচিত্র এই গ্রহকণাটি! একটি গ্রহকণার আকার যদি কুৎসিত হওয়া সম্ভব হতো, তাহলে নিশ্চিতভাবে এটাকে কুৎসিত বলা যেতো। শুধু কুৎসিত নয়, অশুভ এবং বিপজ্জনক।
রায়ীনাকে তার ইলন শাটলের বেগ কমাতে কমাতে গ্রহকণাটির দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ঠিক যখন গ্ৰহকণাটির পাশে পৌঁছাবে, তখন গ্রহকণাটির তুলনায় তাকে স্থির হয়ে যেতে হবে। কোয়াকম্প তার অনেকখানিই করে ফেলতে পারবে, কিন্তু শেষ কাজটি তার নিজের হাতে করতে হবে।
দেখতে দেখতে সে গ্রহকণাটির কাছাকাছি চলে এলো। ইলন শাটলটির থেকে দূরত্ব এখন পাঁচ শ’ মিটার থেকে কম। এখান থেকে জানালা দিয়ে খালি চোখেই রায়ীনা দেখতে পেল গ্রহকণাটি ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখে মনে হয়, সেটি বুঝি মহাকাশে স্থির হয়ে আছে। আসলে সেটি স্থির নয়, সেটি অচিন্ত্যনীয় বেগে পৃথিবীর দিকে ছুটে যাচ্ছে। সে যদি গ্রহকণাটিকে ধ্বংস করতে না পারে, তাহলে এই গ্রহকণাটি পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলবে।
রায়ীনা কোয়াকম্পকে গ্রহকণাটির বিচিত্রভাবে ঘুরপাক খেতে থাকার গতিটি বিশ্লেষণ করতে দিয়ে ধীরে ধীরে ইলন শাটলটিকে সেটির কাছাকাছি নিতে থাকে। একশ মিটারের কাছাকাছি এসে সে থেমে গেল। কোয়াকম্প গতিপথটি বিশ্লেষণ করে মনিটরে দেখাচ্ছে এবং সেদিকে তাকিয়ে রায়ীনা চমকে উঠল। একটা গ্রহকণার গতিপথ এরকম হতে পারে না। গ্রহকণার সেন্টার অফ এ্যাভেটি ইলন শাটলের তুলনায় স্থির থাকতে হবে। কিন্তু এটি স্থির নয়, এটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নড়ছে। এটি কোনোভাবেই হওয়া সম্ভব নয়।
রায়ীনা ভুরু কুঁচকে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের চোখকে সে কীভাবে অবিশ্বাস করবে? কোয়াকম্পের বিশ্লেষণ যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এই গ্রহকণার ওপর নামা প্রায় অসম্ভব। শেষ মুহূর্তে গ্রহকণাটির একটা অংশ ঘুরপাক খেতে খেতে ইলন শাটলকে আঘাত করে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলতে পারে। থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটি বিস্ফোরিত না হয়ে উড়ে যাবে!
রায়ীনা আবার মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মনিটরটির বিশ্লেষণ যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এই গ্রহকণাটি একটি নিরীহ গ্রহকণা নয়। হয়তো এর ভেতরে অবরুদ্ধ গ্যাস আছে। সেই গ্যাস হয়তো এর ফাঁক ফোকর দিয়ে বের হয়ে এসে গ্রহকণাটাকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে। কিংবা এটি–
রায়ীনা তার মাথা থেকে চিন্তাটাকে সরিয়ে দিল। এরকম নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে একটা গ্রহকণা যদি ঘুরপাক খেতে থাকে, তাহলে এটি যা হতে পারে সেটি হওয়া সম্ভব নয়। কিছুতেই সম্ভব নয়। সেই সম্ভাবনার কথা রায়ীনা তার মাথায় আনতে চায় না। রায়ীনা এখন কোয়াকম্পের ওপর নির্ভর না করে পুরোপুরি নিজের নিয়ন্ত্রণে ইলন শাটলকে গ্রহকণাটির ওপর নামিয়ে আনবে। তারপর ইলন শাটলে রাখা নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণে গ্রহকণাটিকে ভস্মীভূত করে দেবে।
ইলন শাটলকে নামানোর জন্যে রায়ীনা গ্রহকণার ওপর একটা জায়গা বেছে নেয়। জায়গাটি মসৃণ নয়। খানিকটা এবড়োথেবড়ো, কিন্তু আশেপাশে বড় কোনো উঁচুনিচু জায়গা নেই। রায়ীনা খুব সাবধানে ইলন শাটলকে নামাতে থাকে। গ্রহকণাটি যখন হঠাৎ ঘুরে যায় কিংবা নড়ে যায়, রায়ীনাও তখন ইলন শাটলকে ঘুরিয়ে নেয়, নড়িয়ে নেয়। উঁচু হয়ে বের হয়ে থাকা কোনো অংশ হঠাৎ করে ঘুরে ইলন শাটলের দিকে ছুটে এলে রায়ীনাকেও দ্রুত সরে যেতে হয়। এর আগে ইলন শাটলকে কেউ এইভাবে ব্যবহার করেনি, করার প্রয়োজন হয়নি।
রায়ীনা এক সময়ে তার ইলন শাটলের শক্তিশালী ইঞ্জিনের ধোঁয়া দেখতে পায়। ইঞ্জিনের উত্তপ্ত গ্যাস গ্রহকণায় আঘাত করে ধুলোবালি উড়িয়ে নিতে শুরু করেছে। হঠাৎ গ্রহকণাটি জীবন্ত প্রাণীর মতো নড়ে ওঠে। উঁচু হয়ে থাকা একটা অংশের আঘাতে গুঁড়িয়ে যাবার আগেই রায়ীনা প্রচণ্ড গতিতে নিচে নেমে গ্রহকণাটির ওপর আক্ষরিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল। রায়ীনা একটা প্রচণ্ড সংঘর্ষ অনুভব করে, পুরো শাটলটি কেঁপে ওঠে, যন্ত্রপাতি ভেঙেচুরে যায়। ইলন শাটলের ভেতর বিপদ সংকেতের তীব্র এলার্ম বাজতে থাকে।
প্রচণ্ড সংঘর্ষে রায়ীনা সিট ভেঙে বের হয়ে নিচে ছিটকে পড়েছিল। সে উঠে দাঁড়ালো, তারপর ভাসতে ভাসতে জানালার পাশে দাঁড়াল। সে গ্রহকণাটির ওপর নামতে পেরেছে। সংঘর্ষে ইলন শাটলের কতোটুকু ক্ষতি হয়েছে, সে জানে না। সেটি নিয়ে তার মাথা ঘামাতে হবে না। তার আগে। ইলন শাটলটিকে এই গ্রহকণার সাথে যুক্ত করে নিতে হবে। রায়ীনা কাঁপা হাতে একটা সুইচ স্পর্শ করে। সাথে সাথে যেন এক ধরনের গুঞ্জন শুনতে পায়। ইলন শাটলের নিচ থেকে অতিকায় স্কু বের হয়ে গ্রহকণার মাঝে গেঁথে যেতে শুরু করেছে। এখন শুধু তার নিউক্লিয়ার বোমাটিকে বিস্ফোরণের জন্যে চালু করে দিতে হবে।
রায়ীনা মেঝেতে ধাক্কা দিয়ে ভেসে ভেসে ইলন শাটলের পিছনে যায়। সুইচ টিপে পিছনের গোল দরজাটি খুলতেই থামো নিউক্লিয়ার বোমাটি চোখে পড়ল। একশ কিলোটনের একটি বোমার আকার এতো ছোট হতে পারে, নিজের চোখে দেখেও রায়ীনার বিশ্বাস হয় না।
রায়ীনা বোমাটার পিছনে সুইচ প্যানেল খুলে সেখানে বোতামটি স্পর্শ করে। সাথে সাথে একটা নীল আলো ঝলসে ওঠে। ছোট চতুষ্কোণ একটা জায়গায় রায়ীনা তার চোখ রাখল। সেখানে তার রেটিনা স্ক্যান করা হলো এবং সাথে সাথে স্ক্রীনে একটা ছোট কী বোর্ড স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রায়ীনা কাঁপা হাতে ষোলটি সংখ্যা প্রবেশ করানোর সাথে সাথে কর্কশ স্বরে এলার্ম বাজতে থাকে। মনিটরে একটা লেখা ভেসে ওঠে, “এই বোমাটি বিস্ফোরণের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। দশ মিনিটের ভেতর এটি বিস্ফোরিত হবে।”
রায়ীনা তার বুকের ভেতর আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিল। সে পৃথিবীটাকে রক্ষা করতে পেরেছে। পৃথিবীর সাত বিলিয়ন মানুষকে রক্ষা করতে পেরেছে। তার আদরের ত্রাতিনাকে রক্ষা করতে পেরেছে। রায়ীনা ভেসে ভেসে কন্ট্রোল ঘরে ফিরে আসে। তাকে এখন দশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। দশ মিনিট অনেক সময়। এই দশ মিনিট সময় সে কেমন করে কাটাবে?
রায়ীনা তার সিটে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইল। তারপর প্রায় হঠাৎ করেই ঠিক করল, সে গ্রহকণাটিতে নামবে। যে কোনো হিসেবে কাজটি অনেক বিপজ্জনক। কিন্তু যখন দশ মিনিটেরও কম সময়ে একশ কিলোটনের একটা থামো নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণে সবকিছু ভস্মীভূত হয়ে যাবে, তখন বিপজ্জনক আর নিরাপদ অবস্থার কোনো অর্থ নেই।
রায়ীনা ইলন শাটলের দরজা খুলে একটা লাফ দিয়ে নিচে নেমে এলো। গ্রহকণার সাথে ধাক্কা খেয়ে সে প্রায় উড়ে যাচ্ছিল। কোনোভাবে একটা সুচালো পাথরকে ধরে সে নিজেকে থামাল এবং কোনোভাবে নিজের পায়ের উপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। শেষ পর্যন্ত সে যখন নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে পারল, তখন হঠাৎ করে সে অত্যন্ত বিচিত্র একটা জিনিস লক্ষ্য করল। গ্রহকণাটি থরথর করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে, এর ভেতরে একটা শক্তিশালী ইঞ্জিন কাজ করছে। কী আশ্চর্য! সে যে চিন্তাটি জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল, সেই চিন্তাটিই সঠিক। এটি একটি গ্রহকণা নয়। এটি পৃথিবীর দিকে ছুটে যাওয়া বিশাল একটি মহাকাশযান।
রায়ীনা কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে ঠিক ভাবে চিন্তা করতে পারছিল না, কষ্ট করে সে নিজেকে শান্ত করল। তারপর নিচু গলায় ডাকল, “কমান্ডার।”
প্রায় সাথে সাথে রায়ীনা কমান্ডার লীয়ের গলার স্বর শুনতে পেলো।”বল রায়ীনা।”
“থামো নিউক্লিয়ার বোমাটি বিস্ফোরণের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি আর সাত মিনিট তেতাল্লিশ সেকেন্ডের মাঝে বিস্ফোরিত হবে।”
কমান্ডার লী বলল, “আমরা জানি। তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা রায়ীনা। পৃথিবীর মানুষ হয়তো কখনোই জানতে পারবে না তুমি কেমন করে তাদের রক্ষা করেছ।”
“তার প্রয়োজনও নেই কমান্ডার।” রায়ীনা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, “আমি অন্য একটি কারণে তোমার সাথে কথা বলতে চাই।”
“বল রায়ীনা।”
“আমি শুধুমাত্র তোমার সাথে কথা বলতে চাই। সর্বোচ্চ গোপন চ্যানেলে।”
কমান্ডার লী এক মুহূর্তের জন্যে ইতস্তত করল। তারপর বলল, “ঠিক আছে রায়ীনা। আমি গোপন চ্যানেল চালু করেছি। তোমার কথা আমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পারবে না। বল তুমি কী বলতে চাও।”
“কমান্ডার লী, আমরা সবাই যেটাকে একটি গ্রহকণা ভেবে আসছি, সেটি আসলে গ্রহকণা নয়।”
কমান্ডার লী কাঁপা গলায় বলল, “তাহলে এটা কী?”
“এটা একটা মহাকাশযান। আমি এর উপর দাঁড়িয়ে আছি এবং এর ইঞ্জিনের কম্পন অনুভব করছি।”
“কী বলছ তুমি?”
“আমি কোনো প্রস্তুতি ছাড়া নেমে এসেছি। তাই ভিডিও চ্যানেলটি চালু করতে পারিনি, তাই তোমাকে দেখাতে পারছি না।”
“তুমি বল, তোমার কথা শুনেই আমি বুঝে নেবার চেষ্টা করছি।”
রায়ীনা অনেকটা ধারাবর্ণনা দেওয়ার মতো করে বলল, “আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেই জায়গাটা মোটামুটি সমতল, একটু সামনে অনেকগুলো উঁচু নিচু পাথর। আমি সেদিকে এগিয়ে যাই। কারণ—
“কারণ কী?”
“কারণ আমার মনে হচ্ছে ওদিক দিয়ে একটু আলো বের হয়ে আসছে।”
“আলো?”
“হ্যাঁ। নীলাভ আলো। সম্ভবত ওটা এই মহাকাশযানের কন্ট্রোল রুম।”
কমান্ডার লী কাঁপা গলায় বলল, “কন্ট্রোল রুম?”
রায়ীনা একটা বড় পাথর ধরে সামনে এগিয়ে যায়। সাবধানে নিচে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার অনুমান সঠিক। একটা চতুষ্কোণ গর্ত থেকে আলো বের হচ্ছে। এটা সম্ভবত ভেতরে ঢোকার দরজা।”
কমান্ডার লী কোনো কথা বলল না। রায়ীনা বলল, “আমি নিচে নামছি।”
“নামো। কী দেখো আমাকে জানাও।”
“জানাব।”
রায়ীনা চতুষ্কোণ ফুটো দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। একটা সুড়ঙ্গের মতো জায়গা। রায়ীনা হেঁটে যেতেই জায়গাটা আলোকিত হয়ে গেল। সে বড় একটা হলঘরে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশের দেওয়ালে বিচিত্র এক ধরনের কারুকার্য। সেগুলো নড়ছে এবং আকার পরিবর্তন করছে। মাঝে মাঝে কোনো কোনো অংশ আলোকিত হয়ে উঠছে।
হঠাৎ রায়ীনার মাথাটা ঘুরে উঠল। শুনতে পেল কমান্ডার লী তাকে ডাকছে, “রায়ীনা। রায়ীনা, তুমি কোথায়?”
রায়ীনা কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল। বলল, “আমি সম্ভবত কন্ট্রোল রুমে। চারপাশে যেগুলো দেখছি সেগুলো সম্ভবত যন্ত্রপাতি, যদিও দেখতে একেবারে অন্যরকম।”
“কোনো এলিয়েন? কোনো প্রাণী?”
রায়ীনা হঠাৎ অনুভব করলো তার পিছনে কিছু একটা এসে দাঁড়িয়েছে। রায়ীনা ঘুরে দাঁড়ালো, এবং সাথে সাথে একটা আর্ত শব্দ করল। রায়ীনা হতবাক হয়ে দেখল, ঘরটার মাঝামাঝি ত্রাতিনা দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ত্রাতিনা! তার মেয়ে ত্রাতিনা।
কমান্ডার লী জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে রায়ীনা? তুমি কী দেখছ?”
“হ্যালুসিনেশান। এই মহাকাশযানের প্রাণী আমাকে নিয়ে খেলছে।”
“কেন? তুমি কী দেখছ?”
“আমার মেয়ে ত্রাতিনা।”
কমান্ডার লী চিৎকার করে বলল, “তোমার মেয়ে ত্রাতিনা?”
“হ্যাঁ। একটু আগে আমার মাথা ঘুরে উঠেছিল। তখন নিশ্চয়ই আমার মস্তিষ্ক থেকে তথ্য নিয়েছে। সেই তথ্য ব্যবহার করে ত্রাতিনাকে তৈরি করেছে। অবিকল ত্রাতিনা।”
“কী বলছ তুমি?”
“হ্যাঁ কমান্ডার লী। আমি ত্রাতিনাকে একটু আদর করি? আমি জানি এটা হ্যলুসিনেশান। আমি জানি এটি সত্যি নয়, কিন্তু তবু আমি একটু আদর করি ত্রাতিনাকে?”
কমান্ডার লী কিছু একটা বলতে চাইছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে একশ কিলোটন থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটির প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মুহূর্তে সবকিছু ভস্মীভূত হয়ে গেল।
২. দ্বিতীয় পর্ব (ষোল বছর পর)
দ্বিতীয় পর্ব (ষোল বছর পর)
২.০১
অনাথ আশ্রমের ডাইনিংরুমে ছেলে মেয়েরা হই চই করে রাতের খাবার খাচ্ছে। আশ্রমের ডিরেক্টর ক্লারা নিঃশব্দে ডাইনিং রুমের এক কোণায় দাঁড়িয়ে মুখে এক ধরনের কৌতুকের হাসি নিয়ে ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকিয়েছিল। এই প্রাণোচ্ছল ছেলেমেয়েগুলোকে দেখে ডিরেক্টর ক্লারা মাঝে মাঝে এক ধরনের হিংসা অনুভব করে। এই কমবয়সী ছেলে মেয়েগুলোর কেমন করে এতো প্রাণশক্তি থাকতে পারে? কেমন করে এতো সহজে তারা জীবনটিকে এতো আনন্দময় করে ফেলতে পারে?
ডিরেক্টর ক্লারার মাঝে মাঝেই মনে হয়, অনাথ আশ্রমের দায়িত্ব পাওয়াটি মনে হয় তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। শুধুমাত্র এজন্যেই বুঝি সারাটি জীবন ছোট ছোট শিশুদের সাথে কাটাতে পেরেছে। তাদেরকে কিশোর-কিশোরী হয়ে উঠতে দেখেছে। তারপর এক সময় তরুণ তরুণী হওয়ার পর বাইরের পৃথিবীতে যাওয়ার জন্যে অশ্রুসজল চোখে তাদের বিদায় দিয়ে এসেছে।
এবারে আরো একটি মেয়েকে বিদায় দেবে। মেয়েটির নাম ত্রাতিনা। ষোল বছর আগে তার মহাকাশচারী মা ক্লারার হাতে এই মেয়েটিকে তুলে দিয়েছিল। এতো বছর পরেও ডিরেক্টর ক্লারা সেই দিনটির কথা ভুলতে পারে না। মহাকাশচারী রায়ীনা তার মেয়েকে রেখে চলে যাচ্ছে, ছোট মেয়েটি কী বুঝেছে কে জানে, সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। ডিরেক্টর ক্লারা তাকে বুকে চেপে ধরে রেখেছিল। মহাকাশচারী রায়ীনার কী হয়েছিল কে জানে, সে আর কোনোদিন ফিরে আসেনি। ত্রাতিনা অনাথ আশ্রমের অন্য দশজন ছেলেমেয়ের সাথে বড় হয়েছে। মেয়েটি কখনো তার বাবা মায়ের কথা জানতে চায়নি। হয়তো ধরেই নিয়েছে তার মা-বাবার কথা কেউ জানে না। তা না হলে কেন সে অনাথ আশ্রমে থাকবে?
ডিরেক্টর ক্লারা ডাইনিং হলে ত্রাতিনাকে খুঁজে বের করল। মাঝামাঝি একটা টেবিলে আরও কয়েকজন ছেলেমেয়েকে নিয়ে খেতে বসেছে। মেয়েটি মায়ের মতো কালো চুল আর কালো চোখ নিয়ে বড় হয়েছে। হাসিখুশি প্রাণশক্তিতে ভরপুর একটি মেয়ে। ক্লারা লক্ষ্য করল, ড্রিংকিং স্ট্রয়ের ভেতর একটা মটরশুটি ঢুকিয়ে ত্রাতিনা ফুঁ দিয়ে সেই মটরশুটিটি পাশের টেবিলের একজন ছেলের ঘাড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে। ছেলেটি চমকে উঠে তার ঘাড়ে হাত দিয়ে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। তার ঘাড়ে কী এসে আঘাত করছে বুঝতে না পেরে ছেলেটি ঘাড়ে হাত বুলাচ্ছে এবং পাশের টেবিলে অন্য বন্ধুদের নিয়ে ত্রাতিনা হেসে কুটি কুটি হচ্ছে।
ডিরেক্টর ক্লারা আরো একটু এগিয়ে টেবিল থেকে একটা গ্লাস আর একটা চামুচ তুলে নেয়। তারপর চামুচ দিয়ে গ্লাসটাকে টোকা দিয়ে টুং টুং শব্দ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ছেলেমেয়েরা ক্লারার এই শব্দটির সাথে পরিচিত। সবাই প্রথমে থেমে গেল, তারপর ক্লারার দিকে তাকিয়ে আনন্দের মতো একটি শব্দ করল।
ডিরেক্টর ক্লারা বলল, “ছেলেমেয়েরা, আমি তোমাদের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”
সবাই তখন চুপ করে উৎসুক চোখে তার দিকে তাকায়। ক্লারা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমি তোমাদের একটা সুসংবাদ দিতে এসেছি।”
সুসংবাদটি কী না শুনেই ছেলেমেয়েগুলো আনন্দে চিৎকার করতে থাকে। ডিরেক্টর ক্লারা হেসে বলল, “সুসংবাদটি না শুনেই তোমরা আনন্দে চিৎকার করছ, ব্যাপার কী?”
একজন বলল, “সুসংবাদটি শুনে আমরা কীভাবে চিৎকার করব, সেটি একটু প্র্যাকটিস করে নিলাম।”
অন্যেরা বলল, “বল, বল সুসংবাদটি বল। শুনতে চাই, আমরা শুনতে চাই।”
ডিরেক্টর ক্লারা বলল, “কিন্তু তোমরা শান্ত না হলে আমি কীভাবে বলব?”
সবাই তখন শান্ত হয়ে ক্লারার দিকে তাকিয়ে রইল। ক্লারা সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, “তোমাদের ত্রাতিনা কেন্দ্রীয় মহাকাশ ইনস্টিটিউটে পুরো স্কলারশীপ পেয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। এই মাত্র আমি তার খবর পেয়েছি।”
ক্লারা কথা শেষ করার আগেই ডাইনিং হলের ছেলেগুলো শুধু চিৎকার করে শান্ত হলো না। তারা ছুটে এসে ত্রাতিনাকে ধরে হুটোপুটি করতে লাগল। সবাই মিলে তাকে মাথার ওপরে তুলে নিয়ে নাচানাচি করতে থাকে।
ক্লারা আনন্দোৎসবে বাধা দিল না। একটু শান্ত হওয়ার পর সে এগিয়ে গিয়ে ত্রাতিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ত্রাতিনা মা, তোমাকে দুই সপ্তাহের মাঝে ইনস্টিটিউটে যোগ দিতে হবে।”
ত্রাতিনা নিঃশব্দে ক্লারার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর নিচু গলায় বলল, “দুই সপ্তাহ?”
“হ্যাঁ মা। তোমাকে আমাদের বিদায় দিতে হবে। আমরা সবাই তোমার অভাবটুকু অনুভব করব।”
হঠাৎ করে ডাইনিং হলের সব ছেলেমেয়ে চুপ করে যায়। একটি আনন্দ সংবাদের সাথে সাথে যে এরকম একটি বেদনার সম্পর্ক থাকতে পারে সেটি আগে তারা কখনো অনুমান করেনি।
দুই সপ্তাহ পর একটি শীতল, কুয়াশাচ্ছন্ন, বৃষ্টিভেজা দিনে ত্রাতিনা ডিরেক্টর ক্লারার কাছ থেকে বিদায় নিতে গেল। তার হাতে একটা ছোট ব্যাগ, অনাথ আশ্রমের গেটে একটা বাইভার্বাল তাকে পাতাল ট্রেন স্টেশনে নেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে। সেই বাইভার্বালকে ঘিরে অনাথ আশ্রমের অন্যান্য ছেলেমেয়েরা ত্রাতিনাকে বিদায় দেওয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে।
ক্লারা ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, “বস ত্রাতিনা।”
ত্রাতিনা ক্লারার সামনে চেয়ারটিতে বসল। ডিরেক্টর ক্লারা বলল, “তোমার জন্যে আমার খুব অহংকার হচ্ছে ত্রাতিনা। কেন্দ্রীয় মহাকাশ ইনস্টিটিউট এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ইনস্টিটিউট। এখানে পড়তে সুযোগ পাওয়া খুব ভাগ্যের কথা।”
ত্রাতিনা কিছু না বলে হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়ল।
ক্লারা বলল, “তুমি অবশ্য ভাগ্যের জোরে এই সুযোগ পাওনি। তুমি সুযোগ পেয়েছ নিজের যোগ্যতায়।”
ত্রাতিনা বলল, “তুমি আমাদের লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছ, আমাদের উৎসাহ দিয়েছ, আমরা সবাই তাই তোমার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ।”
“ধন্যবাদ ত্রাতিনা। আমি আমার দায়িত্বটুকু শুধু পালন করেছি। তার বেশি কিছু করিনি।” ক্লারা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, “তুমি ইনস্টিটিউটে কী নিয়ে পড়াশোনা করবে ঠিক করেছ?”
ত্রাতিনা একটু লাজুক মুখে বলল, “আমি মহাকাশচারী হতে চাই। মহাকাশযানে করে মহাকাশে অভিযান করার আমার খুব ইচ্ছা।”
ক্লারা এক মুহূর্ত ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, “কী আশ্চর্য!”
ত্রাতিনা একটু অবাক হয়ে বলল, “আশ্চর্য! কেন এটি তোমার কাছে আশ্চর্য মনে হচ্ছে? আমি কী মহাকাশচারী হতে পারি না?”
ক্লারা বলল, “অবশ্যই হতে পার। তুমি যেটা চাইবে, সেটাই হতে পারবে। আমি সেজন্যে আশ্চর্য হইনি। আমি আশ্চর্য হয়েছি অন্য কারণে।”
ত্রাতিনা জিজ্ঞেস করল, “কী কারণে?”।
ক্লারা তার চেয়ার থেকে উঠে ত্রাতিনার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, একটু নিচু হয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল, “বাইরে এই অনাথ আশ্রমের ভাই বোনেরা তোমাকে বিদায় দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি তার মাঝে তোমাকে বলেছি আমার সাথে দেখা করে যাওয়ার জন্যে। সেটি শুধু আনুষ্ঠানিক বিদায় দেওয়ার জন্যে নয়। তার একটি কারণ আছে ত্রাতিনা।”
”কী কারণ?”
“আমি তোমাকে একটি জিনিস দিতে চাই।”
“কী জিনিস?”
“তোমার মা যেদিন তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল, সেদিন আমাকে একটা ছোট ক্রিস্টাল দিয়ে বলেছিল, তুমি যখন বড় হবে তখন আমি যেন সেটা তোমার হাতে দিই।”
ত্রাতিনা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, বলল, “মা? আমার মা? তুমি আমার মাকে দেখেছ?”
“হ্যাঁ, দেখেছি।”
“তুমি কখনো সেটি আমাকে বলনি–”
“না, বলিনি। আমার বলার কথা না সেজন্য বলিনি। আমি অপেক্ষা করছিলাম, কখন তুমি বড় হবে-এখন বড় হয়েছ, তাই তোমাকে বলছি।”
“আমার মা দেখতে কেমন ছিল? কী করতো আমার মা? আমাকে নিজের কাছে না রেখে কেন অনাথ আশ্রমে রেখে গেল?”
ক্লারা দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করল। বলল, “আমার মনে হয় তুমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর এই ক্রিস্টালটিতে পেয়ে যাবে। তুমি এক সেকেন্ড অপেক্ষা কর।”
ডিরেক্টর ক্লারা উঠে গেল। দেওয়ালে লাগানো সেফটি ভল্টে রেটিনা স্ক্যান করিয়ে খুলে নেয়। তারপর ওপরের তাক থেকে ভেলভেটে মোড়ানো ছোট একটা ধাতব বাক্স নিয়ে আসে। সেটি ত্রাতিনার হাতে তুলে দিয়ে বলল, “এই নাও। এর ভেতরে আমি ষোল বছর ধরে তোমার ক্রিস্টালটি বাঁচিয়ে রাখছি। আজকে আমার দায়িত্ব শেষ হল।”
ত্রাতিনা বাক্সটি প্রথমে কিছুক্ষণ নিজের বুকে চেপে ধরে রাখে। তারপর খুব সাবধানে সেটি খোলে, বাক্সের মাঝখানে নিও পলিমারের ফ্রেমে ছোট একটা ক্রিস্টাল চকচক করছে। এই ক্রিস্টালটি ত্রাতিনার মা ত্রাতিনার জন্যে তৈরি করে রেখেছে। ঠিক কী কারণ জানা নেই, হঠাৎ করে ত্রাতিনার চোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো।
ডিরেক্টর ক্লারা ত্রাতিনার পাশে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল, “তুমি যখন বলেছ যে তুমি মহাকাশ ইনস্টিটিউটে মহাকাশচারী হবে, তখন আমি বলেছিলাম কী আশ্চর্য! কেন বলেছিলাম, জান?”
“কেন?”
“তার কারণ, তোমার মাও ছিলেন একজন মহাকাশচারী। মহাকাশচারী রায়ীনা। তোমার মা যেদিন তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল, সেদিন খুব জরুরি একটা কাজে তাকে চলে যেতে হয়েছিল। কী কাজ, সেটি আমি জানি না। আর কোনোদিন ফিরে আসেনি, তোমার মা নিশ্চয়ই জানতো আর ফিরে আসবে না।”
ত্রাতিনা ফিসফিস করে বলল, “মা। আমার মা।”
ডিরেক্টর ক্লারা ত্রাতিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ত্রাতিনা সোনা তোমার যাবার সময় হয়েছে। বাইরে সবাই তোমাকে বিদায় দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
ত্রাতিনা তার ব্যাগটি খুলে সেখানে ভেলভেট দিয়ে মোড়ানো ধাতব বাক্সটি রেখে উঠে দাঁড়াল। ক্লারা ত্রাতিনাকে আলিঙ্গন করে বলল, “যাও মা। প্রার্থনা করি তোমার অপূর্ব একটি জীবন হোক।”
ত্রাতিনা চোখ মুছে বলল, “আমার মায়ের কথা মনে নেই। মায়েরা কেমন করে সন্তানকে ভালোবাসে, সেটি আমি জানি না। কিন্তু তুমি আমাদের সবাইকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবেসেছ। আমরা সবাই তোমার কাছ থেকে সেই ভালোবাসাটা পেয়েছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ক্লারা।”
ত্রাতিনা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ডিরেক্টর ক্লারা হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। গেটের সামনে একটা বাইভার্বাল দাঁড়িয়ে আছে। সেটি ঘিরে অনাথ আশ্রমের সব ছেলেমেয়ে নিঃশব্দে ত্রাতিনাকে বিদায় দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে।
.
পাতাল ট্রেনটি ম্যাগনেটিক লেভিটেশন ব্যবহার করে ঘণ্টায় দুই হাজার ত্রাতিনা কিলোমিটার বেগে ছুটে যাচ্ছে। যদিও ট্রেনের ভেতরে বসে থেকে সেটি বোঝার কোনো উপায় নেই। ত্রাতিনা তার সিটে হেলান দিয়ে নিঃশব্দে বসে আছে। ইনস্টিটিউট থেকে তাকে ট্রেনের টিকিট পাঠিয়েছে ছোট একটা ঘরে সামনাসামনি দু’টি সিট। সামনের সিটে একজন বয়সী মহিলা কানে হেড ফোন লাগিয়ে বসে কিনিস্কির নবম সিম্ফোনি শুনছে। সিম্ফোনির তালে তালে খুব ধীরে ধীরে তার মাথা নড়ছে। এ ছাড়া বোঝার আর কোনো উপায় নেই। ট্রেনের ছোট কামরাটি পুরোপুরি নিঃশব্দ।
ত্রাতিনা ক্রিস্টালটি হাতে নিয়ে বসে আছে। তার হাতে ভিডি গগলস। ক্রিস্টালটি ঢুকিয়ে গগলসটি চোখে লাগালেই সে তার মাকে দেখতে পাবে। মাকে দেখার জন্যে একই সাথে সে নিজের ভেতরে এক ধরনের ব্যাকুলতা এবং পাশাপাশি বিচিত্র এক ধরনের ভীতি অনুভব করছে। কী দেখবে সে? সে কী সহ্য করতে পারবে? নাকি ভেঙে পড়বে?
শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে সে কাঁপা হাতে ক্রিস্টালটি ভিডি গগলসের ছোট স্লটটিতে ঢুকিয়ে ক্লিপটা টেনে দিল। তারপর গগলসটি চোখের উপর লাগিয়ে ত্রাতিনা ট্রেনের সিটে মাথা রাখল। প্রথমে একটা নীল আলোর ঝলকানি দেখতে পেল। মৃদু একটা যান্ত্রিক শব্দ শুনতে পেলো। তারপর হঠাৎ করে সে তার মাকে দেখতে পেলো।
ছোট করে কাটা কুচকুচে কালো চুল। গভীর কালো চোখ, সেই চোখে তীব্র একটা দৃষ্টি। মনে হয়, সেই দৃষ্টি দিয়ে তার মা সবকিছু ঝলসে দেবে। ত্রাতিনা কেঁপে উঠল। দেখলো, তার মা সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে। এটি তার সত্যিকারের মা নয়, এটি তার মায়ের ত্রিমাত্রিক প্রতিচ্ছবি। তবু ত্রাতিনার মনে হলো সত্যিকারের মা তার দিকে তাকিয়ে আছে। ত্রাতিনা দেখলো তার মায়ের ঠোঁট নড়ে উঠেছে। সে তখন তার মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো, স্পষ্ট গলায় তার মা বলল, “ত্রাতিনা, মা আমার। তুই এখন আমার কথা শুনছিস, তার মানে তুই আর আমার ছোট শিশুটি নেই। তুই বড় হয়েছিস। ভালো আছিস মা?”
ত্রাতিনা জানে, এটি তার সত্যিকারের মা নয়। শুধুমাত্র তার মায়ের প্রতিচ্ছবি। তারপরও সে ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ মা। ভালো আছি। খুব ভালো আছি।”
“ত্রাতিনা মা, তুই নিশ্চয়ই আমার উপর অনেক অভিমান করে আছিস! তুই নিশ্চয়ই ভাবছিস, আমি কেমন করে তোকে একটা অনাথ আশ্রমে রেখে চলে গেলাম। মা হয়ে কেমন করে সন্তানকে ছেড়ে গেলাম! তাই না?”
“কিন্তু মা আমার, সোনা আমার! বিশ্বাস কর, তোকে এই পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে আমি গিয়েছি। পৃথিবীটা কতো সুন্দর, তুই এখনো দেখিসনি মা, আমি দেখেছি। মহাকাশে আমি রাতের পর রাত মুগ্ধ হয়ে নীল পৃথিবীটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। সেই পৃথিবীটাতে তুই যেন বেঁচে থাকতে পারিস, তোর মতো আরো লক্ষ কোটি মানুষ যেন বেঁচে থাকতে পারে সে জন্যে আমি গিয়েছি। আমার উপর রাগ করে থাকিস না মা! দোহাই তোর।”
ত্রাতিনা ফিসফিস করে বলল, “না, মা। আমি তোমার উপর রাগ করে নাই!”
“ত্রাতিনা মা আমার, আমার হাতে সময় নেই। একেবারে সময় নেই। আমার এখনই তোকে নিয়ে অনাথ আশ্রমে যেতে হবে। আমি নিজে অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। আমি জানি, সেখানে অনেক ভাইবোনকে নিয়ে বড় হওয়া যায়। সবাই মিলে বিশাল একটা পরিবার হয়, সেখানে সবাই সবার আপনজন। তুই নিশ্চয়ই আপনজনদের নিয়ে বড় হয়েছিস, তাই না মা?”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ, মা। আমি আপনজনদের মাঝে বড় হয়েছি।”
“তুই এখন বড় হয়েছিস-কতোটুকু বড় হয়েছিস, সেটা তো জানি না। তোর মাথায় কী ঘন কালো চুল। তোর চোখগুলো কী গভীর কালো? তোর কোন বিষয় পড়তে ভালো লাগে? বিজ্ঞান? গণিত? সাহিত্য? গান শুনিস তুই? কার গান শুনতে ভালো লাগে তোর?”
ত্রাতিনা দেখলো, তার মা হঠাৎ থেমে গেল। তারপর ফিসফিস করে বলল, “আমার এখন যেতে হবে মা। আমি যাই? তোকে কী একটিবার আমার বুকে চেপে ধরতে পারব? শক্ত করে চেপে ধরে রাখব, যেন তুই চলে যেতে না পারিস…”
ত্রাতিনা দেখলো, তার মা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। সে থরথর করে কাঁপতে থাকে, কোনোভাবে সে নিজেকে সামলাতে পারে না।
হঠাৎ সে অনুভব করল, কেউ তার মাথায় হাত রেখেছে। ত্রাতিনা চোখ থেকে গগলস খুলে তাকাল। সামনের সিটে বসে থাকা বয়স্ক মহিলাটি তার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, “সোনামনি মনে হচ্ছে কোনো কিছু দেখে তুমি খুব বিচলিত হয়েছ। আমি কী কোনোভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি?”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারবে না। কেউ না।”
বয়স্ক মহিলা গভীর স্নেহে ত্রাতিনার হাতটি ধরে তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
.
২.২
মহাকাশ ইনস্টিটিউটের এক পাশে বিশাল একটি কমপ্লেক্স। উঁচু ছাদ, বড় হলঘর। তার মাঝখানে একটি বড় সেন্ট্রিফিউজ। সেন্ট্রিফিউজের দুই পাশে দুটো ছোট কুঠুরি—যার ভেতরে একজন মানুষকে কোনোভাবে রাখা যায়। মানুষটিকে শক্ত একটা সিট বেল্ট দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। সেন্ট্রিফিউজটিকে তখন ধীরে ঘোরানো শুরু হয়। প্রথমে আস্তে তারপর গতিবেগ বাড়তে থাকে। কুঠুরির ভেতরে সিট বেল্ট দিয়ে বেঁধে রাখা মানুষটি তখন ঘূর্ণনের চাপটি অনুভব করতে থাকে। ধীরে ধীরে সেই চাপ বাড়তে থাকে। মহাকাশচারী হওয়ার ট্রেনিংয়ের এটি হচ্ছে একেবারে প্রথম ধাপ। আজকে এই সেন্ট্রিফিউজের এক পাশে ত্রাতিনা, অন্য পাশে ইনস্টিটিউটের অন্য একটি ছাত্র।
ঘূর্ণনের পূর্ণ মাত্রা পৌঁছানোর পর সেন্ট্রিফিউজের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়া হল। তখন ধীরে ধীরে সেন্ট্রিফিউজের গতি কমে আসতে থাকে। সেন্ট্রিফিউজ পুরোপুরি থেমে যাবার পর দু’জন টেকনিশিয়ান দুই পাশের দুটো কুঠুরি খুলে দিল এবং তার ভেতর থেকে ত্রাতিনা আর অন্য ছাত্রটি বের হয়ে এলো। ত্রাতিনা বেশ স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে তার সহপাঠী ছাত্রটির দিকে এগিয়ে যায়। অন্য ছাত্রটির চেহারা যথেষ্ট বিধ্বস্ত। সে টলতে টলতে কোনোভাবে এগিয়ে একটা পিলার ধরে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকে।
ত্রাতিনা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল”কী খবর কিহি, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার উপর দিয়ে একটা সাইক্লোন বয়ে গেছে।”
কিহি মাথা তুলে বলল, “শুধু সাইক্লোন না ত্রাতিনা, আমার উপর দিয়ে টাইফুন টর্নেডো সুনামি সবকিছু বয়ে গেছে। এই সেন্ট্রিফিউজটা হচ্ছে মানুষের উপর নির্যাতন করার একটা যন্ত্র!”
ত্রাতিনা শব্দ করে হাসল। বলল, “মহাকাশচারীদের ট্রেনিংয়ের প্রথম অংশই হচ্ছে ত্বরণের শক্তিতে অভ্যস্ত হওয়া। এটাকে সকালের ব্রেক ফাস্টের মতো ধরে নাও, প্রতিদিন নিয়ম করে ভোরবেলা এর ভেতর দিয়ে যেতে হবে।”
কিহি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “কিন্তু তুমি এতো সহজে এটা সহ্য করো কেমন করে?”
ত্রাতিনা বলল, “জানি না!” সে ইচ্ছে করলেই বলতে পারতো আমার মা ছিলেন একজন মহাকাশচারী–হয়তো আমার রক্তের মাঝে মহাকাশচারী হওয়ার রক্ত আছে! কিন্তু সে সেটি বলল না। তার মায়ের ব্যাপারটি একান্ত ভাবেই তার নিজের, কাউকে সে তার কথা বলবে না।
কিহি খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করে বলল, “চল যাই।”
“চল।”
দু’জনে সেন্ট্রিফিউজ কমপ্লেক্স থেকে বের হয়ে এলো। বাইরে শরতের শীতল হাওয়া। ক্যাম্পাসের বড় বড় গাছগুলোর পাতার রং বদলাতে শুরু করেছে।
কিহি বলল, “খুব খিদে লেগেছে। কিছু একটা খেতে হবে।”
ত্রাতিনা বলল, “যাও। ক্যাফেটেরিয়া থেকে কিছু একটা খেয়ে এসো।”
“তুমি যাবে না?”
“না। আমার খিদে লাগেনি। খাওয়ার সময় ছাড়া আমার খিদে লাগে।”
“ঠিক আছে, কিছু খেতে না চাইলে নাই–একটু কফি খেতে পার আমার সাথে।”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “না কিহি। আমার একটু লাইব্রেরিতে যেতে হবে।”
কিহি একটু অবাক হয়ে বলল, “আমাদের লেখাপড়া এখনো শুরু হয়নি। তুমি দিন রাত লাইব্রেরিতে বসে কী কর?”।
ত্রাতিনা হাসল। বলল, “লেখাপড়া শুরু হয়নি বলেই তো এখন লাইব্রেরিতে সময় কাটাতে পারছি। একবার শুরু হলে কী আর নিঃশ্বাস নিতে পারব?”
কিহি একটু অবাক হয়ে ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “কী করো তুমি লাইব্রেরিতে?”
“পড়ি। নিরিবিলিতে পড়ার জন্য লাইব্রেরি থেকে ভালো কোনো জায়গা নেই।”
“কী পড়!”
“এইতো, যা ভালো লাগে। ইতিহাস, পৃথিবীর ইতিহাস।” কিহি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ত্রাতিনা কিহির দিকে হাত নেড়ে লাইব্রেরির দিকে হেঁটে যেতে থাকে।
ত্রাতিনা স্পষ্ট করে কিহিকে বলেনি যে লাইব্রেরিতে কী করে। তার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। ত্রাতিনা তার মায়ের ক্রিস্টালটি থেকে জেনেছে যে, খুব রহস্যময়ভাবে তার মাকে চলে যেতে হয়েছিল। তার মা একজন মহাকাশচারী, কাজেই কোথাও যদি যেতে হয় তাহলে নিশ্চয়ই মহাকাশে গিয়েছে। কেন গিয়েছে? কী করেছে তার মা? কেন করতে হয়েছে? ত্রাতিনা সেটি বের করতে চায়। ষোল বছর আগের তথ্যগুলো সে খুঁজে খুঁজে বের করছে। সবগুলো একটা পাজলের মতো। টুকরো টুকরো তথ্যগুলো সেই পাজলের একেকটা অংশ। খুব ধীরে ধীরে সেই রহস্যময় সময়টিতে কী হয়েছিল, সেই বিষয়টি ত্রাতিনার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
জাতীয় তথ্য ভাণ্ডারে তার মায়ের অনেক তথ্য আছে। ত্রাতিনা বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করেছে চতুর্থ বর্ষে ঘূর্ণায়মান মহাকাশ স্টেশনে অবতরণের একটা পদ্ধতি তাদের শেখানো হবে, এই পদ্ধতিটির নাম রায়ীনা পদ্ধতি–তার মায়ের নামানুসারে। কী আশ্চর্য। তার বাবা সম্পর্কে বিশেষ তথ্য নেই। খুব অল্প সময়ের জন্যে তার বাবার সাথে পরিচয় হয়েছিল, ত্রাতিনার জন্ম হওয়ার আগেই তার বাবা হারিয়ে গিয়েছে। কেন হারিয়ে গিয়েছে, কোথায় হারিয়ে গেছে সে সম্পর্ক কোনো তথ্য নেই।
তার নিজের সম্পর্কেও একটা লাইন লেখা আছে, লাইনটা এরকম–রায়ীনার শিশুকন্যার নাম ত্রাতিনা। রায়ীনার ইচ্ছানুসারে সে কোনো একটি অনাথ আশ্রমে বড় হচ্ছে।
তথ্য ভাণ্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, তার মায়ের মৃত্যুর দিনটি, অনাথ আশ্রমে তাকে রেখে আসার পরদিন তার মা মারা গিয়েছে। ত্রাতিনা অনুমান করতে পারে, খুব একটা জরুরি কাজে তার মা মহাকাশে অভিযান করেছিল। কাজটি করতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনায় মা মারা গিয়েছে, ব্যাপারটা সেরকম নয়। তার মা নিশ্চিতভাবে জানতো যে সে মারা যাবে। সেজন্যে তার মা ত্রাতিনাকে অনাথ আশ্রমে রেখে গেছে।
ত্রাতিনা তার মায়ের মৃত্যুর দিনটিতে মহাকাশে কী ঘটেছিল, সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। বিষয়টি রহস্যময়। তথ্য ভাণ্ডারে ইচ্ছা করে কিছু তথ্য গোপন রাখা হয়েছে। মনে হয়, অনেক তথ্য সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেদিন উত্তরের কয়েকটা শহরে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। কিছু কিছু এলাকায় যোগাযোগ বন্ধ ছিল, এরকম কিছু তথ্য আছে। কিন্তু সেখান থেকে কী ঘটেছিল, অনুমান করা কঠিন। ত্রাতিনা তবু বের করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
লাইব্রেরিতে বসে বসে সে ষোল বছর আগের সেই রহস্যময় সময়টির খুঁটিনাটি তথ্য খুঁজে বের করে। কোনো তথ্য গোপন করা হলে সেটিও বের হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছে বিজ্ঞানীরা। তারা মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে না। তার মা কীভাবে মারা গিয়েছিল, সেই তথ্যটি গোপন করার নিশ্চয়ই একটা কারণ ছিল। কারণটা কী হতে পারে, ত্রাতিনা বুঝতে পারছে না।
.
ত্রাতিনা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর পেয়ে গেল একেবারে হঠাৎ করে। তাদের মহাকাশের ইতিহাসের উপর লেকচার দেওয়ার জন্যে একজন বয়স্ক মহাকাশচারী এসেছেন। দুই ঘণ্টার টানা লেকচার দিয়ে মহাকাশচারী ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করল, তাদের কোনো প্রশ্ন আছে কি না। সবারই কোনো না কোনো প্রশ্ন, বয়স্ক মহাকাশচারী ধৈর্য ধরে সবার প্রশ্নের উত্তর দিল। তখন একজন জিজ্ঞেস করল, “তুমি তো অনেক অভিযান করেছ। কখনো কী খুব বিপজ্জনক মিশন করেছ?”
বয়স্ক মহাকাশচারী মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ। আমি আমার ক্রুদের নিয়ে একবার খুব বিপদে পড়েছিলাম। মহাকাশে হঠাৎ করে আমাদের মহাকাশযানের সমস্ত কমিউনিকেশন্স বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পুরো মহাকাশযানটি হয়ে গেল একটা জড় পদার্থ! অনবোর্ড কোয়াকম্প পর্যন্ত কাজ করছে না। শুধুমাত্র ইঞ্জিন অন অফ করে পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলাম কোনো যোগাযোগ ছাড়া।”
আরেকজন জানতে চাইল, “কীভাবে কমিউনিকেশন্স বন্ধ হল?”
“রেডিয়েশান। হঠাৎ করে একটা তীব্র গামা রে বার্স্ট এসে ইলেকট্রনিক্স নষ্ট করে দিল।”
“রেডিয়েশান কোথা থেকে এলো?”
“মহাকাশে মাঝে মাঝে রেডিয়েশান বাস্ট আসে। সূর্য থেকেই অনেক ধরনের বাস্ট আসে।”
আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “তখন তোমার বয়স কতো ছিল?”
মহাকাশচারী হাসার চেষ্টা করল। বলল, “বয়স কম ছিল। ষোল বছর আগে–আমার বয়স তখন মাত্র ষাট!”
ত্রাতিনা ভিতরে ভিতরে চমকে উঠল। ষোল বছর আগে রেডিয়েশান বাচেঁ মহাকাশযানের ইলেকট্রনিক্স নষ্ট হয়ে গিয়েছিল? সে হাত তুলে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী তারিখটি মনে আছে?”
“মনে থাকার কথা নয়, আমার দিন তারিখ মনে থাকে না। তবে ঘটনাক্রমে আমার তারিখটা মনে আছে। সেদিন ছিল আমাদের বিবাহ বার্ষিকী, সেপ্টেম্বরের বারো তারিখ।”
ত্রাতিনা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল। তার মায়ের রহস্যজনক মৃত্যুর দিনটিও সেপ্টেম্বরের বারো তারিখ, ঠিক ষোল বছর আগে।
.
এতোদিন ত্রাতিনা বিচ্ছিনভাবে খোঁজখবর নিচ্ছিল। হঠাৎ করে সে খোঁজ খবর নেওয়ার একটি সুনির্দিষ্ট দিক খুঁজে পেলো। ষোল বছর আগে সেপ্টেম্বরের বারো তারিখ আরো অন্য মহাকাশযান কী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল? হয়ে থাকলে কোথায়? কীভাবে?
পরের কয়েক সপ্তাহে সে ক্ষতিগ্রস্ত মহাকাশযানের খোঁজ নিতে থাকে। বিভিন্ন মহাকাশচারীর সাথে কথা বলে, তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চায়। পৃথিবীর বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে লগ ঘাঁটাঘাঁটি করে সে অনুমান করতে পারে সেই দিনটিতে মহাকাশে একটা নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ঘটেছিল। তার মা নিশ্চয়ই সেই বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিল। তার মা জানতো সে মারা যাবে, কারণ নিশ্চয়ই বিস্ফোরণটি ঘটিয়েছিল তার মা। মহাকাশ থেকে একটা গ্রহকণা ছুটে এলে সেগুলোকে ধ্বংস করার জন্যে নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ ঘটননা হতে পারে। কিন্তু সেটি করার জন্যে কাউকে নিউক্লিয়ার বোমা নিয়ে যেতে হয় না। নিচ থেকে সেটি উড়িয়ে দেয়া যায়। তার মা বোমাটি নিয়ে গিয়েছিল। কেন?
ত্রাতিনা হঠাৎ করে ঠিক করল, সে ব্যাপারটি জানতে চেয়ে সামরিক বাহিনীর সর্ব প্রধানকে একটি চিঠি লিখবে।
ত্রাতিনা লিখল:
কমান্ডার লী,
আমার নাম ত্রাতিনা। আমার মায়ের নাম রায়ীনা। আমার মা ষোল বছর আগে সেপ্টেম্বরের বারো তারিখে মহাকাশে একটি নিউক্লিয়ার বোমা বিস্ফোরণ করার জন্যে নিজের প্রাণ দিয়েছিলেন।
কারণটি জানার আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে।
বিনীত
ত্রাতিনা
ত্রাতিনা চিঠিটাকে যোগাযোগ মডিউলে প্রবেশ করালো, নিরাপত্তা সূচক মাত্রা দিল, এনক্রিপ্ট করলো। তারপর পাঠিয়ে দিল।
ষোল বছরের একটি মেয়ে হয়ে পৃথিবীর সামরিক বাহিনীর প্রধানের কাছে একটা চিঠি পাঠানোর বিষয়টা ঠিক হল কিনা, সে বুঝতে পারল না। সে অবশ্যি বোঝার খুব বেশি চেষ্টাও করল না।
.
২.৩
ক্যাম্পাসে দুপুর বেলা ট্রলিতে করে নানা ধরনের খাবার নিয়ে আসা হয়। ছাত্রছাত্রীরা সেই খাবার নিয়ে ক্যাম্পাসের খোলা জায়গায় বসে গল্পগুজব করতে করতে খায়। আজকেও ত্রাতিনা খাবারের প্যাকেট নিয়ে কিহি এবং আরো কয়েকজনের সাথে খেতে বসেছে। দক্ষিণ অঞ্চলের খাবার, তুলনামূলকভাবে ঝাল বেশি, খেতে খেতে ত্রাতিনা আহা উঁহু করছে তখন অনেক দূর থেকে সে চাপা এক ধরনের গুম গুম শব্দ শুনতে পেলো। একটু অবাক হয়ে ত্রাতিনা বলল, “কিসের শব্দ?”
কিহি বলল, “আকাশ তো পরিষ্কার। মেঘের ডাক তো হতে পারে না।”
তখন ত্রাতিনা বহু দূরে এক সাথে অনেকগুলো বাইভার্বালকে আসতে দেখলো। এর আগে সে কখনো একসাথে এতোগুলো বাইভার্বালকে উড়তে দেখেনি। ত্রাতিনা বলল, “দেখেছো কতগুলো বাইভার্বাল একসাথে?”
সবাই দেখলো। কিহি বলল, “কোথায় যাচ্ছে কে জানে।”
খেতে খেতে সবাই তাকিয়ে থাকে এবং একটু অবাক হয়ে দেখলো বাইভার্বালগুলো শক্তিশালী ইঞ্জিনের গর্জন করে ঠিক তাদের ক্যাম্পাসের উপর এসে থেমে গেল। একটা বড় বাইভার্বাল মাটি থেকে এক মিটারের কাছাকাছি নেমে এলো। সেটার দরজা খুলে সেনাবাহিনীর পোশাক পরে থাকা অনেকগুলো সশস্ত্র মানুষ লাফিয়ে নেমে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়ল। ত্রাতিনা ফিসফিস করে বলল, “সর্বনাশ! মনে হচ্ছে, আমাদের আক্রমণ করবে।”
কিহি বলল, “না, আক্রমণ করবে না। মনে হয়, সামরিক বাহিনীর বড় কোনো অফিসার এসেছে। এরা তার বডিগার্ড।”
কিহির ধারণা সত্যি। কয়েকটা বাইভার্বাল থেকে সামরিক পোশাক পরে থাকা মানুষগুলো নেমে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর বিশাল একটা বাইভার্বাল তাদের কাছাকাছি এসে থামল। নিচে একটা অংশ খুলে যাবার পর সেখান থেকে একটা সিঁড়ি বের হয়ে আসে এবং সিঁড়ি দিয়ে সামরিক পোশাক পরে থাকা একজন ছোটখাটো মানুষ নেমে এলো! কিহি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “এটি কে?”
একজন ফিসফিস করে বলল, “সামরিক বাহিনীর প্রধান। কমান্ডার লী।”
ত্রাতিনা চমকে উঠল এবং সাথে সাথে সে বুঝে গেল, তার চিঠি পেয়ে কমান্ডার লী সরাসরি তার সাথে দেখা করতে চলে এসেছে। কী আশ্চর্য!
কিহি চাপা গলায় বলল, “কমান্ডার লী আমাদের ক্যাম্পাসে কেন এসেছে?”
ত্রাতিনা বলল, “মনে হয় আমার সাথে দেখা করতে।” কথাটাকে একটা কৌতুক মনে করে কিহি হেসে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু সে হাসি থামিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কারণ দেখতে পেল, কমান্ডার লী সরাসরি তাদের দিকে হেঁটে আসছে।
ত্রাতিনার সামনে এসে কমান্ডার লী থেমে গেল। তার দিকে তাকিয়ে বলল, “ত্রাতিনা?”
ত্রাতিনা খাবারের প্যাকেটটা নিচে রেখে দাঁড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি ত্রাতিনা।”
কমান্ডার লী তার হাত দুটো দুই পাশে ছড়িয়ে বলল, “মা, আমি কি তোমাকে একবার আলিঙ্গন করতে পারি?”
ত্রাতিনা কোনো কথা না বলে দুই পা এগিয়ে যায়। কমান্ডার লী গভীর ভালোবাসায় তাকে আলিঙ্গন করে। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, “তুমি কি জান তোমার মা পৃথিবীর সাত বিলিয়ন মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে?”
ত্রাতিনা বলল, “না জানি না।” কী কারণ কে জানে, ত্রাতিনার চোখ পানিতে ভিজে এলো।
কমান্ডার লী ত্রাতিনাকে শক্ত করে ধরে রেখে ফিসফিস করে বলল, “পৃথিবীর মানুষের কাছে তোমার মায়ের কথা বলার সময় এখনো আসেনি। সারা পৃথিবীতে এখন আমরা মাত্র অল্প কয়জন সেটি জানি।”
ত্রাতিনা ফিসফিস করে বলল, “কখনো কী সেই সময় আসবে?”
কমান্ডার লী বলল, “আমরা আশা করছি আসবে। বিষয়টি অনেক জটিল। আমি তোমাকে একদিন সবকিছু বলব।”
“ধন্যবাদ কমান্ডার লী।”
কমান্ডার লী ত্রাতিনাকে ছেড়ে দিয়ে ঘুরে যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবে তার বিশাল বাইভার্বালের দিকে হাঁটতে শুরু করে। বিশাল বাইভার্বালটি থেকে একটা সিঁড়ি নেমে এলো, কমান্ডার লী সেই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। গোলাকার দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল এবং দেখতে দেখতে সবগুলো বাইভার্বাল গর্জন করে উপরে উঠে যায়। তারপর ঘুরে যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকে উড়ে যেতে থাকে।
বাইভার্বালগুলো চোখের আড়াল হয়ে যাবার পর সবাই ত্রাতিনার দিকে ঘুরে তাকালো। তারা তাদের চোখের সামনে যেটা দেখেছে, সেটা বিশ্বাস করতে পারছে না। কেউ সাহস করে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারছে না। ত্রাতিনা তার খাবারের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে যেন কিছুই হয়নি সেরকম ভঙ্গি করে খেতে শুরু করে।
কিহি সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “কমান্ডার লী তোমার কাছে কেন এসেছিল?”
“আমি তাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। চিঠিটা পড়ে উত্তর না দিয়ে সরাসরি চলে এসেছে।”
“কী লিখেছিলে চিঠিতে?”
“এই তো-ব্যক্তিগত কথা।”
“কমান্ডার লী তোমার কানে ফিসফিস করে কিছু বলেছে। কী বলেছে?”
ত্রাতিনা খুবই শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “বলেছে আমার চিঠিতে কয়েকটা বানান ভুল ছিল। শুদ্ধ বানানগুলো কী হবে সেটা বলে দিয়েছে।”
কিহি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আমার সাথে ঠাট্টা করছ, তাই না?”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। হাসি হাসি মুখে বলল, “তুমি সঠিক অনুমান করেছ কিহি।”
“কেন তুমি ঠাট্টা করছ?”
“কারণ আসলে যে কথাটি বলেছে, সেটা অনেক কম বিশ্বাসযোগ্য! তোমাদেরকে বলা হলে তোমরা কেউ বিশ্বাস করবে না।”
পাশে বসে থাকা একটি মেয়ে কাছে এসে বলল, “আমি কী তোমার সাথে একটা ছবি তুলতে পারি?”
ত্রাতিনা হেসে বলল, “কেন পারবে না! শুধু সেই মেয়েটি নয়, আরো অনেকেই তখন তার সাথে ছবি তুললো।
.
কমান্ডার লী ত্রাতিনাকে কথা দিয়েছিল যে, তার মায়ের পুরো ব্যাপারটি অনেক জটিল। কোনো একদিন তাকে সবকিছু বলবে। কখন বলবে, সে অনুমান করতে পারছিল না। কিন্তু সপ্তাহ শেষ হবার আগেই তার সাথে কমান্ডার লীয়ের দেখা হলো। এবারে দেখা হলো সবার অগোচরে।।
ছুটির দিনগুলোতে ত্রাতিনা মিউজিয়ামগুলোতে ঘুরে বেড়ায়। তার বয়সী ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগই কখনো মিউজিয়ামে সময় কাটাতে চায় না। তাই প্রায় সময়েই সে একা একা ঘোরে। সে যখন একটি প্রাচীন ছবির সামনে খানিকটা বিস্ময় এবং অনেকখানি অবিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তখন হঠাৎ শুনতে পেলো একজন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “ত্রাতিনা?”
ত্রাতিনা ঘুরে তাকালো। মধ্যবয়স্ক সাদাসিধে চেহারার একজন মানুষ।। তাকে আগে কখনো দেখেছে বলে তার মনে পড়ল না। মানুষটি মাথাটা আরেকটু নিচু করে বলল, “কমান্ডার লী আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে। তোমার যদি সেরকম ব্যস্ততা না থাকে, তাহলে তোমাকে তার কাছে নিয়ে যেতে বলেছে।”
ত্রাতিনা একটু চমকে উঠল। বলল, “না, মিউজিয়ামে ছবি দেখার মাঝে কোনো ব্যস্ততা নেই।”
“চমৎকার। চল তাহলে।”
ত্রাতিনা মানুষটির সাথে বের হলো। মিউজিয়ামের গেটে দাঁড়ানোর সাথে সাথে উপর থেকে একটা সাদামাটা বাইভার্বাল নিচে নেমে এলো। মানুষটির সাথে বাইভার্বালটিতে উঠে ত্রাতিনা অবাক হয়ে যায়। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু ভেতরে বাইভার্বালটি চমকপ্রদ। এক কথায় অসাধারণ। ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “কী সুন্দর।”
“হ্যাঁ। তোমাকে নেয়ার জন্যে কমান্ডার লী এই বাইভার্বালটি পাঠিয়েছে। তুমি কে আমি জানি না, কিন্তু কমান্ডার লী তোমাকে খুব স্নেহ করে। তার কাছে তুমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
ত্রাতিনা কী বলবে বুঝতে পারল না। ইতস্তত করে বলল, “কমান্ডার লীয়ের মতো একজন মানুষের স্নেহ পাওয়া খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমি নিশ্চয়ই খুব সৌভাগ্যবান।”
মানুষটি একটুখানি হাসার ভঙ্গি করে বলল, “আসলে সৌভাগ্যের ব্যাপারটি কিন্তু কখনো বিনা কারণে ঘটে না। সৌভাগ্যের কারণ থাকে!”
মানুষটি তখন ত্রাতিনার ইনস্টিটিউট নিয়ে হালকা ভদ্রতার কথা বলতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা সেনাবাহিনীর বড় কমপ্লেক্সে ঢুকে যায়। ত্রাতিনা জীবনেও কল্পনা করেনি সে কখনো এখানে আসতে পারবে।
বাইভার্বাল থেকে নেমে চওড়া সিঁড়ি দিয়ে ত্রাতিনা মানুষটির পিছু পিছু বড় একটা দালানে ঢুকে যায়। কয়েকটা করিডোর পার হয়ে তারা বড় একটা হলঘরে পৌঁছাল। হলঘরের ঠিক মাঝখানে একটি বড় টেবিলে সোনালী চুলের হাসিখুশি একজন মহিলা বসেছিল। ত্রাতিনাকে দেখে খুশি হওয়ার ভঙ্গি করে বলল, “তুমি নিশ্চয়ই ত্রাতিনা। এসো আমার সাথে। কমান্ডার লী তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
সাদাসিধে চেহারার মানুষটি ত্রাতিনার দিকে হাত নেড়ে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেল। ত্রাতিনা সোনালী চুলের হাসিখুশি মহিলার পিছু পিছু হলঘরের শেষ মাথায় একটা বড় দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খুলে মাথা ঢুকিয়ে বলল, “কমান্ডার লী, তোমার অতিথি চলে এসেছে।”
কমান্ডার লী জানালার কাছে দাঁড়িয়েছিল। মহিলার গলায় স্বর শুনে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। ত্রাতিনাকে দেখে আনন্দের ভঙ্গি করে দুই হাত তুলে এগিয়ে এলো। বলল, “এসো ত্রাতিনা। এসো। আসতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?”
ত্রাতিনা বলল, “না কোনো অসুবিধে হয়নি। বাইভার্বালটি খুবই সুন্দর ছিল।”
কমান্ডার লী বলল, “এর থেকেও সুন্দর বাইভার্বাল আছে। কোনো এক জোছনা রাতে তোমাকে নিয়ে বের হবো। দেখবে তোমার ভালো লাগবে।”
“ধন্যবাদ কমান্ডার লী।”
“তুমি কী খাবে বল।”
“আমি খেয়ে এসেছি। কিছু খাব না।”
“কিছু একটা খাও। আমাদের এখানে খুব ভালো উত্তেজক পানীয় তৈরি করে। খেলে মনে হবে বয়স দশ বছর কমে গেছে।”
ত্রাতিনা বলল, “আমার বয়স ষোলো, দশ বছর কমে গেলে একেবারে নাবালক হয়ে যাব।”
কমান্ডার লী হা হা করে হাসল। বলল, “এটা একটা কথার কথা। আক্ষরিকভাবে নিও না।”
কমান্ডার লী কোনো একটা বোতামে চাপ দিয়ে পানীয়ের কথা বলে দিল এবং প্রায় সাথে সাথেই সোনালী চুলের মহিলাটি দু’টি সুন্দর গ্লাসে করে হালকা সবুজ রংয়ের এক ধরনের পানীয় নিয়ে এল। টেবিলে গ্লাস দুটো রেখে বলল, “আর কিছু লাগবে কমান্ডার লী?”
“না আর কিছু লাগবে না।”
“উত্তর অঞ্চলের বাদামী বাদাম আছে।”
”ধন্যবাদ কিকি। লাগবে না।”
“তাহলে মিষ্টি জাতীয় কিছু? দক্ষিণের ফার্মেন্ট করা মিষ্টি।”
কমান্ডার লী ধৈর্য ধরে বলল, “লাগবে না। তুমি এবারে যেতে পার। কিকি।”
“আমি ভেবেছিলাম তোমার কমবয়সী অতিথিকে তুমি আরো একটু বেশি আপ্যায়ন করবে।”
কমান্ডার লী বলল, “আমার মনে হয় যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকু আপ্যায়ন করা হয়েছে। তাছাড়া শুধু মাত্র খাবার দিয়ে আপ্যায়ন হয় না। আপ্যায়নের আরো অনেক পদ্ধতি আছে। তুমি আস্তে আস্তে শিখবে।”
সোনালী চুলের মহিলাটি বলল, “আমি আস্তে আস্তে নয়, আমি দ্রুত শিখতে চাই।”
“ঠিক আছে, আমি তোমার কোম্পানীকে সেভাবে রিপোর্ট করব।”
সোনালী চুলের মহিলাটি ঘর থেকে বের হওয়ায় পর কমান্ডার লী হতাশভাবে মাথা নাড়ল। বলল, “তুমি দেখেছ, এর সবকিছু ঠিক আছে, কিন্তু তারপরও কী যেন ঠিক নেই।
“একটু বেশি আগ্রহী–”
“মানুষ আগ্রহী হলে সমস্যা নেই। রবোট বেশি আগ্রহী হলে সমস্যা।”
ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “এই মহিলাটি রবোট?”
“হ্যাঁ। পরীক্ষামূলক রবোট। আমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্যে দিয়েছে।”
ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “কী আশ্চর্য! আমি শুনেছিলাম মানুষের চেহারার রবোট তৈরি করা বেআইনী।”
“তুমি ঠিকই শুনেছ। কিন্তু আমাদের কিছু দীর্ঘমেয়াদী মহাকাশ অভিযান করতে হবে। সেখানে মহাকাশচারীদের সঙ্গী হিসেবে মানুষের মতো রবোট দেয়া যায় কি না, সেটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা হচ্ছে। সেজন্য এই রবোটগুলো তৈরি হয়েছে।”
ত্রাতিনা বলল, “কী আশ্চর্য! আমি দেখে একেবারেই বুঝতে পারিনি।” হি হি করে হেসে বলল, “ভেবেছি মহিলাটি একটু বেশি কথা বলে!”
কমান্ডার লী পানীয়ের গ্লাসটি হাতে তুলে নিয়ে বলল, “নাও, পানীয়টি এক চুমুক খেয়ে দেখো।”
ত্রাতিনা পানীয়টিতে চুমুক দিয়েই বুঝতে পারে, কমান্ডার লী আসলেই ভুল বলেনি। সত্যি সত্যি পানীয়টি এক চুমুক খেতেই তার মনে হলো সারা শরীরে বুঝি এক ধরনের প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে।
ত্রাতিনা হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঠোঁট দুটো মুছে বলল, “কমান্ডার লী, তুমি বলেছিলে আমাকে তুমি আমার মায়ের কথা বলবে।”
“হ্যাঁ। বলব। সে জন্যে আজ তোমাকে আমি ডেকে এনেছি। কিন্তু তার আগে আমাকে একটা ছোট আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হবে। আমাকে একজনের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।”
“তুমি সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তুমি কার কাছ থেকে অনুমতি নেবে?”
“বিজ্ঞান একাডেমির মহাপরিচালক রিহার কাছ থেকে।”
ত্রাতিনা চমকে উঠল, “মহামান্য রিহা?”
“হ্যাঁ।”
“তুমি তাকে দেখেছ?”
কমান্ডার লী হাসল। বলল, “দেখেছি। অনেকবার দেখেছি। তুমিও দেখবে। মহামান্য রিহা তোমার সাথে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।”
ত্রাতিনা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, “আমার সাথে?”
“হ্যাঁ। তোমার সাথে। চল, আমরা যাই।”
হলঘরের ভেতর দিয়ে যাবার সময় রবোট মহিলাটি বলল, “কমান্ডার লী, আমার মনে হয় এই মেয়েটিকে প্রয়োজনের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়ে যাচ্ছে। সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে তোমার বেসামরিক কিশোর কিশোরীকে এতো গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই। অন্য কেউ সেই দায়িত্বটি পালন করতে পারবে।”
কমান্ডার লী বলল, “কিকি, তুমি এখন একটু বিশ্রাম নাও। মনে হয়, তোমার কপোট্রন উত্তপ্ত হয়ে আছে।”
.
২.৪
ত্রাতিনা ভেবেছিল মহামান্য রিহার বাসভনটি হবে বিশাল। তার ঘরের মেঝে হবে মার্বেল পাথরের। দেওয়াল হবে গ্রানাইটের। ঘরের দরজা হবে মূল্যবান ক্রোমিয়াম এলয়ের। ঘরের ভেতর থাকবে আধুনিক যন্ত্রপাতি। কিন্তু ত্রাতিনা খুবই অবাক হয়ে দেখলো, তার বাসভবনটি আসলে ছোট একটি দোতলা কাঠের বাসা। বাসার চারপাশে বড় বড় গাছ এবং সেই গাছগুলোতে অসংখ্য পাখি কিচিরমিচির করে ডাকছে।
ঘরের সামনে কোনো গার্ড নেই। কমান্ডার লী ত্রাতিনাকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল। ত্রাতিনা কখনো কাঠের সিঁড়ি ব্যবহার করেনি। সে এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে লক্ষ্য করল, সিঁড়িটা তাদের পায়ের নিচে রীতিমত কাঁচক্যাচ শব্দ করে জানান দিচ্ছে।
দোতলায় একটা বড় ঘর। তার পাশে একটা দরজা। সেই দরজাটির অপর পাশে বারান্দা। ত্রাতিনা লক্ষ্য করল, কমান্ডার লী এই বাসাটার সাথে বেশ পরিচিত। দরজাটি অল্প একটু খুলে বলল, “আসতে পারি মহামান্য রিহা?”
বারান্দা থেকে মহামান্য রিহা বললেন, “এসো এসো।”
কমান্ডার লী বলল, “আমি রায়ীনার মেয়েটিকে নিয়ে এসেছি। আপনি তাকে দেখতে চেয়েছিলেন।”
“নিয়ে এসো।”
কমান্ডার লী ত্রাতিনার হাত ধরে বারান্দায় গেল। ত্রাতিনা তখন অল্প অল্প কাঁপছে। এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না। সারা পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষটির সাথে তার দেখা হবে। তার হৃৎপিণ্ড ধ্বক ধ্বক করছে, মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডের শব্দে সে আর কিছু শুনতে পাবে না।
মহামান্য রিহা বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। শরীরে সাদা একটি ঢিলেঢালা পোশাক। মাথার চুল এলোমেলো, মুখমণ্ডলে বয়সের ছাপ। ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, “এসো মা। কাছে এসো।”
ত্রাতিনা এগিয়ে গেল। মহামান্য রিহার কাছাকাছি আসতেই হাত বাড়িয়ে ত্রাতিনার কনুইটি ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বললেন, “তুমি রায়ীনার মেয়ে ত্রাতিনা?”
ত্রাতিনার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না। সে কোনোভাবে তার মাথা নাড়ল।
“তোমার মাকে আমি দেখিনি। আমি শেষবারের মতো তাকে দেখতে চেয়েছিলাম। কমান্ডার বলল, সময় নেই। তাই আর দেখা হল না।” মহামান্য রিহা কথা শেষ করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। নিঃশ্বাসটাকে কেমন জানি দীর্ঘশ্বাসের মতো শোনালো।
মহামান্য রিহা ত্রাতিনার কনুইটা ছেড়ে দিয়ে তার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “তোমার মা পৃথিবীর সব মানুষকে রক্ষা করেছে, সেটি তুমি জান?”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল।
কমান্ডার লী বলল, “বিস্তারিত কিছু জানে না। সত্যি কথা বলতে কী, কেউ তাকে কিছু বলেনি। ত্রাতিনা নিজেই চিন্তা করে করে অনেক কিছু বের করেছে। সে নিজে আমার সাথে যোগাযোগ করেছে, তা না হলে আমি কিছুতেই তাকে খুঁজে পেতাম না। অনাথ আশ্রমগুলোর নিয়ম খুব কঠিন। তারা কারো তথ্য কাউকে দেয় না।”
মহামান্য রিহা মাথা নাড়লেন। বললেন, “কেন দেবে? একজন মানুষের ব্যক্তি স্বাতন্ত্রকে সম্মান করতে হয়।”
কমান্ডার লী বলল, “আমার মনে হয় রায়ীনার মেয়ের তার মা সম্পর্কে জানার অধিকার আছে। আপনি অনুমতি দিলে আমি তাকে তার মা সম্পর্কে বলতে পারি!”
মহামান্য রিহা কিছুক্ষণ ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কমান্ডার লীকে বললেন, “মেয়েটি একেবারে বাচ্চা মেয়ে! তাকে কী বলবে? কতোটুকু বলবে?”
কমান্ডার লী বলল, “আমার মনে হয়, সেটি নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা করতে হবে না। মহাকাশ ইনস্টিটিউটে রাখা ত্রাতিনার প্রোফাইলটা আমি দেখেছি। ত্রাতিনার বয়স মাত্র ষোল, কিন্তু সে এর মাঝে পুরোপুরি দায়িত্বশীল একজন মানুষ। নিনিষ স্কেলে তার বুদ্ধিমত্তা আট পর্যায়ের।”
মহামান্য রিহা হা হা করে হাসলেন। বললেন, “নিনিষ স্কেলে আমার বুদ্ধিমত্তা কখনো মাপা হয়নি। মাপা হলে এটা টেনে টুনে ছয়ের বেশি হবে। বলে মনে হয় না!”
কমান্ডার লী বলল, “আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে আমরা বিদায় নিই। আপনি আমাদের সময় দিয়েছেন, সে জন্যে কৃতজ্ঞতা।”
মহামান্য রিহা ত্রাতিনার দিকে তাকালেন। একটুখানি হেসে বললেন, “কিন্তু আমি তো এই মেয়েটির গলার স্বরটুকু শুনতে পেলাম না!”
ত্রাতিনা মাথা নিচু করে বলল, “মহামান্য রিহা, আপনার সামনে কথা বলার সাহস আমার নেই।”
“আমি কোনো বাঘ ভালুক নই। আমাকে এতো ভয় পাবার কিছু নেই। তুমি কিছু বলতে চাইলে বল।”
ত্রাতিনা বলল, “আমার কিছু বলার নেই মহামান্য রিহা।”
“যে মানুষটি এই পৃথিবীটা রক্ষা করেছে, তুমি তার মেয়ে। তোমার মায়ের কাছে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাতে পারিনি। তোমার কাছে জানাই।”
ত্রাতিনা বলল, “আমাকে লজ্জা দেবেন না মহামান্য রিহা। আমার মা শুধুমাত্র তার দায়িত্ব পালন করেছে। আপনি আমার মায়ের কৃতজ্ঞতাটুকু আমাকে জানিয়েছেন, সেটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।”
মহামান্য রিহা বললেন, “তুমি আমার কাছে এসেছ, তোমাকে আমার একটা উপহার দেয়া উচিত। বল তুমি কী উপহার চাও।”
ত্রাতিনার গলা কেঁপে উঠল, বলল, “আমি কোনো উপহার চাই না মহামান্য রিহা। আপনি আমার মাথায় হাত রেখেছেন, সেটি আমার সবচেয়ে বড় উপহার।”
কমান্ডার লী বলল, “ত্রাতিনা, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না তুমি কতো বড় সুযোগ পেয়েছ। সারা পৃথিবীতে এর আগে অন্য কেউ এ সুযোগ পেয়েছে বলে মনে হয় না। তুমি যা ইচ্ছা তাই চাইতে পার।”
ত্রাতিনা বলল, “মহামান্য রিহা, আমি শুধু একবার আপনাকে স্পর্শ করতে চাই।”
মহামান্য রিহা হাসলেন। হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “নাও স্পর্শ করো। একজন বৃদ্ধ মানুষের কুঞ্চিত চামড়া স্পর্শ করে তুমি কী পাবে আমি জানি না। জীন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের আয়ু বাড়িয়ে দেওয়ার কাজটি ঠিক হয়েছে কি না, বুঝতে পারছি না! আমার অর্ধশতক বছর আগে মারা যাওয়ার কথা ছিল।”
ত্রাতিনা মহামান্য রিহার হাতটা স্পর্শ করে এক ধরনের শিহরণ অনুভব করে। এই মানুষটি পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষ, সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ। সে তার হাত স্পর্শ করছে। কী আশ্চর্য!
মহামান্য রিহা বললেন, “তুমি এখনো ইচ্ছা করলে আরো কিছু চাইতে পার। বল কী চাও।”
ত্রাতিনা মাথা নিচু করে বলল, “সত্যি চাইব?”
“হ্যাঁ চাও।”
ত্রাতিনা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল। তারপর সাহস সঞ্চয় করে এক নিঃশ্বাসে বলল, “মহাজাগতিক প্রাণীর মুখোমুখি হওয়ার জন্যে মহাকাশে যে অভিযান চালানো হবে, আমি সেই অভিযানটি করতে চাই।”
কমান্ডার লী এবং মহামান্য রিহা একই সাথে একইভাবে চমকে উঠলেন। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। কিছুক্ষণ পর কমান্ডার লী বলল, “ত্রাতিনা, তুমি কেমন করে জান মহাজাগতিক প্রাণীর মুখোমুখি হওয়ার জন্য একটি অভিযান হবে?”
ত্রাতিনা বলল, “বিষয়টা অনুমান করা কঠিন নয়। একটি গ্রহকণাকে
ত্রাতিনা ধ্বংস করার জন্যে কাউকে নিউক্লিয়ার বোমা নিয়ে মহাকাশে যেতে হয় না। সেটা খুব সহজে পৃথিবী থেকে ধবংস করা যায়। কিন্তু আমার মা নিজে গিয়েছিল, কারণ যেটি ধ্বংস করতে গিয়েছিল, সেটি গ্রহকণা ছিল না। সেটি নিশ্চয়ই ছিল কোনো মহাজাগতিক প্রাণীর মহাকাশযান। পৃথিবীর মানুষ আগে হোক পরে হোক, সেই প্রাণীর মুখোমুখি হবে।”
মহামান্য রিহা মৃদু গলায় বললেন, “যুক্তিতে কোনো ভুল নেই।”
কমান্ডার লী বলল, “কিন্তু তুমি কেমন করে অনুমান করলে সে জন্যে মহাকাশ অভিযান হবে?”
“তোমার অফিসে মানুষের মতো দেখতে রবোর্ট দেখে এসেছি। তুমি বলেছ দীর্ঘ মহাকাশ অভিযানের জন্যে সেগুলো তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘ মহাকাশ অভিযানের কারণ আর কী হতে পারে?”
মহামান্য রিহা হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, “কমান্ডার লী, “বুদ্ধির খেলায় তুমি এই মেয়েটির কাছে হেরে গেছ। এই মেয়েটি তোমার গোপন থেকে গোপনতম প্রজেক্টের কথা জেনে গেছে!”
কমান্ডার লী মাথা চুলকে বলল, “ত্রাতিনা জেনে গেলে আমি দুর্ভাবনা করব না, ত্রাতিনা আমাদের নিজেদের মানুষ।”
ত্রাতিনা মহামান্য রিহার দিকে তাকিয়ে বলল, “মহামান্য রিহা, আপনি কী অনুমতি দেবেন? আমার মা মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে সংঘর্ষের একটি অংশের জন্যে দায়িত্ব নিয়েছে। আমি, তার মেয়ে অন্য অংশটির দায়িত্ব নিতে চাই। আমার মায়ের প্রতি সেটিই হবে আমার ভালোবাসা, আমার কৃতজ্ঞতা।”
এই প্রথম মহামান্য রিহার চেহারায় এক ধরনের গাম্ভীর্য নেমে এল। তিনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “মহাজাগতিক প্রাণীর বিরুদ্ধে সেই অভিযানটি হবে একেবারে অন্যরকম। তুমি শত চেষ্টা করেও তার প্রকৃতিটি অনুমান করতে পারবে না। সেই অভিযানটি হবে সময়সাপেক্ষ, একটি মহাকাশযানে টানা বারো বছর থাকা সোজা কথা নয়। যদিও বেশিরভাগ সময় হিমঘরে ঘুমিয়ে কাটাতে হবে। মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে সংঘর্ষ শেষে ফিরে আসতে পারবে কি না, সেটি কেউ জানে না। যে যাবে, সে
আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে যাবে।”
ত্রাতিনা বলল, “আমি জানি মহামান্য রিহা। বেঁচে থাকার সময় দিয়ে আমি জীবনের পরিমাপ করি না। কী করেছি, সেটা দিয়ে জীবনের পরিমাপ করি।”
মহামান্য রিহা বললেন, “ঠিক আছে। আজ থেকে চার বছর পর তুমি যদি প্রমাণ করতে পারো তুমি একজন প্রথম শ্রেণীর মহাকাশচারী হতে পেরেছ, আমরা তোমাকে সেই অভিযানে পাঠাব।”
ত্রাতিনার প্রবল একটি ইচ্ছে হল সে ছুটে গিয়ে মহামান্য রিহাকে আলিঙ্গন করে। কিন্তু সে কিছু না করে নিচু গলায় বলল, “আপনাকে ধন্যবাদ রিহা। অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
৩. তৃতীয় পর্ব (চার বছর পর)
কমান্ড কাউন্সিলের বড় হলঘরটাতে সবাই নিঃশব্দে বসে আছে। মহামান্য রিহা এখনো এসে পৌঁছাননি। তাই তার চেয়ারটা খালি। টেবিলের উল্টোদিকে আরো তিনটি চেয়ার খালি। এই তিনটি চেয়ারে কে বসবে, কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যদের জানানো হয়নি।
বিকেল তিনটার সময় সভা ডাকা হয়েছিল এবং একেবারে কাঁটায় কাঁটায় তিনটার সময় মহামান্য রিহা হলঘরটিতে ঢুকলেন। সবাই দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান দেখালো। মহামান্য রিহার চেহারায় বয়সের ছাপ ফুটে উঠেছে। এবং তিনি শেষ পর্যন্ত বয়সের ভারে একটু কুঁজো হয়ে হাঁটছেন। নিজের চেয়ারে বসে বললেন, “বস। তোমরা সবাই বস।”
সবাই তাদের চেয়ারে বসল। মহামান্য রিহা সবার দিকে এক নজর তাকালেন। তারপর মৃদু গলায় বললেন, “আমি তোমাদের সাথে এই ঘরে অসংখ্যবার বসেছি। অসংখ্য বিষয় নিয়ে কথা বলেছি এবং অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু আজকের এই সভাটিতে এসে আমার কুড়ি বছর আগের একটা সভার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।”
মহামান্য রিহার কথা শুনে বেশ কয়েকজন মাথা নাড়ল। তারা বুঝতে পেরেছে, মহামান্য রিহা কোন সভাটির কথা বলেছেন।
মহামান্য রিহা বললেন, “তোমরা যারা সেই সভাটিতে ছিলে তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, সেদিন আমরা ভয়ঙ্কর একটি বিপদের মুখে ছিলাম। সারা পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মুখোমুখি হয়েছিল। পৃথিবীর সাধারণ মানুষকে কখনো জানানো হয়নি, কিন্তু তোমরা জানো, তখন পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যে একজন মহাকাশচারী আত্মাহুতি দিয়েছিল। একটি থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা নিয়ে মহাকাশে সেই গ্রহকণাটিকে ধ্বংস করেছিল। সেই মহাকাশচারীর নাম ছিল রায়ীনা।
“পৃথিবীর মানুষ জানে না, কিন্তু সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে তোমরা জানো, সেই গ্রহকণাটি আসলে ছিল মহাজাগতিক কোনো একটি প্রাণীর মহাকাশযান। এরপর এক যুগ থেকে বেশি সময় আমরা সেই মহাজাগতিক প্রাণীর অস্তিত্ব নিয়ে অনুসন্ধান করেছি। তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রচেষ্টা থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা সেই মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে মুখোমুখি হতে যাচ্ছি। এটি সাধারণ যোগাযোগ হতে পারে, এটি একটি সংঘর্ষও হতে পারে, শেষ পর্যন্ত এটি কী হবে, আমরা জানি না। শুধু জানি, আমরা প্রথমবারের মতো মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগ করার জন্যে একটি অভিযান করতে যাচ্ছি।
“আমি সেই অভিযানের সদস্যদের সাথে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে তোমাদের ডেকেছি। তোমাদের কারো কিছু বলার থাকলে বল, তারপর আমি অভিযানের সদস্যদের ডাকব।”
জীববিজ্ঞানী লিয়া সবার আগে কথা বলল, “মহামান্য রিহা, বুদ্ধিমত্তা খুবই বিচিত্র একটা বিষয়। যদি শুধুমাত্র বেঁচে থাকার কৌশলটি লক্ষ্য করি, তাহলে একটা ভাইরাস যথেষ্ট বুদ্ধিমান, কিন্তু আমরা কখনোই ভাইরাসের সাথে তথ্য বিনিময় করতে পারব না। কাজেই মহাজাগতিক প্রাণীটির বুদ্ধিমত্তা যদি আমাদের বুদ্ধিমত্তা থেকে অনেক বেশি হয় এবং অন্যরকম হয়, তাহলে আমরা কখনোই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারব না!”
মহামান্য রিহা শব্দ করে হাসলেন। বললেন, “লিয়া, ভাইরাসের সাথে তুলনা করার উপমাটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ভাইরাস আমাদের সাথে তথ্য বিনিময় করতে পারে না, কিন্তু আমাদের অসুস্থ করে তাদের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দেয়। প্রয়োজন হলে আমরাও সেটা করব।”
পদার্থবিজ্ঞানী রিশি বলল, “এই অভিযানের কিছু বিষয়ে আমি কাজ করেছি। যোগাযোগটি করা হবে নিউট্রিনো বীম দিয়ে। আশা করছি, নতুন এই প্রযুক্তিটি আমাদের হতাশ করবে না।”
মহামান্য রিহা বললেন, “রিশি তুমি কখনোই পৃথিবীর মানুষকে কিংবা আমাকে হতাশ করোনি। আমি নিশ্চিত, এবারেও তুমি হতাশ করবে না। তোমার প্রযুক্তিটি নিশ্চয়ই কাজ করবে।”
পরিবেশ বিজ্ঞানী নীহা বলল, “সৌরজগতের বাইরে যাওয়া অনেক সময়সাপেক্ষ একটি অভিযান। আশা করি, আমাদের অভিযাত্রীরা এই দীর্ঘযাত্রায় সুস্থ থাকবে।”
মহামান্য রিহা বললেন, “আমি আমাদের অভিযাত্রী দল সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। তোমরা নিজেরাই দেখবে এবং আমি নিশ্চিত, একটুখানি বিস্মিত এবং অনেকখানি অনুপ্রাণিত হবে।”
পদার্থবিজ্ঞানী রিশি বলল, “আমার মনে হয়, তাদেরকে এখন ডাকা যেতে পারে।”
মহামান্য রিহা তখন তার সামনে রাখা ঘণ্টাটিতে টোকা দিয়ে অভিযাত্রীদের ডাকার জন্যে সংকেত দিলেন। প্রায় সাথে সাথেই ত্রাতিনা এবং তার সাথে আরো দু’জন অভিযাত্রী হলঘরে এসে ঢুকল। গত চার বছরে ত্রাতিনার চেহারা থেকে কিশোরীসুলভ ভাবটি সরে গিয়েছে। এ ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন নেই। অন্য দু’জনের একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। তাদের বয়স কুড়ি থেকে চল্লিশের ভেতর যা কিছু হতে পারে।
মহামান্য রিহা তাদের বসতে বললেন এবং তারা তাদের জন্যে আলাদা করে রাখা চেয়ারে বসল।
মহামান্য রিহা বললেন, “প্রিয় সুপ্রিম কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দ, আমি তোমাদের সাথে এই তিনজন অভিযাত্রীর পরিচয় করিয়ে দিই। দলপতি হচ্ছে ত্রাতিনা, তোমরা ত্রাতিনাকে কখনোই না দেখে থাকলেও তার মায়ের পরিচয় সবাই জান। সে মহাকাশচারী রায়ীনার মেয়ে।”
কমান্ড কাউন্সিলের সদস্য সবাই এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকালো। পদার্থবিজ্ঞানী রিশি বলল, “ত্রাতিনা, তোমাকে অভিনন্দন। এরকম একটি অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া অনেক বড় দায়িত্ব।”
ত্রাতিনা বলল, “আমি আমার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করব। আমাদের উপর এই দায়িত্ব দেয়ার জন্য আমরা আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, আমার সাথে রুখ এবং গিসাকে দেয়া হয়েছে।”
জীববিজ্ঞানী লিয়া বলল, “এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিযান, কিন্তু তোমার সাথে দু’জন মানুষ না দিয়ে দু’জন এনড্রয়েড দেয়া হয়েছে কেন, সেটা বুঝতে পারলাম না।”
ত্রাতিনা বলল, “সিদ্ধান্তটি আমার নয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই আনন্দিত যে আমার সাথে রুখ এবং গিসা রয়েছে। মানুষ হিসেবে আমি খুবই কোমল একটি প্রজাতি। তাপ, চাপ, রেডিয়েশান কিংবা পরিবেশের একটুখানি তারতম্য হলেই আমি ধ্বংস হয়ে যাব। সে তুলনায় রুখ এবং গিসা অত্যন্ত কঠোর পরিবেশেও টিকে থাকতে পারবে। আমাদের অভিযানের জন্যে এটি খুবই জরুরি একটি ব্যাপার।”
জীববিজ্ঞানী লিয়া হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বলল, “আমি জানি। আমি আগের যুগের মানুষ, যন্ত্রকে কখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করি না। সেটা রবোট হোক, আর এনড্রয়েড কিংবা সাইবর্গই হোক।”
রুখ হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, “আপনারা আমাদের বিশ্বাস। করতে পারেন।”
গিসা বলল, “যদি আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি তাহলে বলা যায় মানুষও একটি যন্ত্র। জৈবরাসায়নিক যন্ত্র। সত্যি কথা বলতে কী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে জৈব রাসায়নিক যন্ত্র থেকে সাধারণ যন্ত্র বেশি কার্যকর।”
মহামান্য রিহা হাত তুলে বিতর্কটি থামিয়ে দিয়ে বললেন, “ত্রাতিনা, রুখ এবং গিসা আমরা তোমাদের সফল একটি অভিযান কামনা করি।”
ত্রাতিনা বলল, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মহামান্য রিহা।”
মহামান্য রিহা বললেন, “আমি শেষ পর্যন্ত বয়সের ভারে ক্লান্ত হতে শুরু করেছি। তুমি যখন তোমার অভিযান শেষে ফিরে আসবে, আমি তখন আর বেঁচে থাকব না। ত্রাতিনা, তোমার সাথে আজকেই হয়তো আমার শেষ দেখা।”
.
সেদিন রাত্রিবেলা মহামান্য রিহা ঘুমের মাঝে মারা গেলেন। মনে হয়, ত্রাতিনার সাথে শেষ দেখা করার জন্যেই বুঝি তিনি এতোদিন বেঁচে ছিলেন।
.
৩.২
ছোট মহাকাশযানটিতে ত্রাতিনা তার সিটে বসে আছে। তার দুইপাশে রুখ এবং গিসা। এই ছোট মহাকাশযানটি তাকে মূল মহাকাশযান পেপিরাতে পৌঁছে দেবে। এই মুহূর্তে পেপিরা চাঁদের একটি উপগ্রহ হয়ে ঘুরছে। প্রায় এক যুগ থেকে ধীরে ধীরে এটিকে প্রস্তুত করা হয়েছে। ত্রাতিনা তার দু’জন এনড্রয়েড ক্রু নিয়ে সেটাতে ওঠার পর তাদের সবকিছু বুঝিয়ে দেয়া হবে। তারপর মহাকাশযান পেপিরা তার যাত্রা শুরু করবে। মহাকাশযানটির নাম পেপিরা প্রাচীন ভাষায় যার অর্থ যোগাযোগ। ত্রাতিনা কিংবা তার কু দু’জন এখনো পেপিরাকে দেখেনি। কিন্তু গত কয়েকমাস তারা পেপিরার একটি মডেলের ভেতর কাজ করেছে। কাজেই অনুমান করছে, তারা যখন সত্যিকারের পেপিরাতে পা দেবে, তখন সেটাকে খুব অপরিচিত একটা আবাসস্থল মনে হবে না।
ত্রাতিনা তার পাশে বসে থাকা রুখ এবং গিসার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা প্রস্তুত?”
গিসা বলল, “আমরা অনেকদিন থেকে প্রস্তুত!”
ত্রাতিনা বলল, “এক্ষুনি কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে যাবে।”
গিসা বলল, “হ্যাঁ। আর মাত্র এক মিনিট।”
ঠিক তখন ত্রাতিনা কমান্ডার লীয়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো, “ত্রাতিনা আমি তোমাকে এই অভিযানের জন্যে বিদায় জানাচ্ছি। প্রায় বিশ বছর আগে আমি তোমার মাকে বিদায় জানিয়েছিলাম। সেটি ছিল সত্যিকারের বিদায়। কারণ আমরা সবাই জানতাম, তার সাথে আর দেখা হবে না। তবে তোমার বিদায়টি মোটেও সে রকম নয়। তোমার সাথে আবার দেখা হবে। আমাদের এই অভিযানটি শুরু করার জন্যে আমরা কয়েক বছর বেশি সময় নিয়েছি, শুধুমাত্র তোমাদের আবার নিরাপদে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যে।”
ত্রাতিনা বলল, “অনেক ধন্যবাদ, কমান্ডার লী।”
“তোমার সাথে আমাদের দেখা হবে আজ থেকে চব্বিশ বছর পর। চব্বিশ বছর দীর্ঘ সময়, এই দীর্ঘসময়ে পৃথিবীর অনেক পরিবর্তন হবে। আমি বেঁচে থাকব কি না, আমি জানি না। কিন্তু আমরা নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করেছি, যেন এই দীর্ঘ সময়টি তোমার কাছে দীর্ঘ মনে না হয়। দিন শেষে তুমি যখন তোমার স্লিপিং ব্যাগে ঘুমুতে যাবে, তুমি জানতেও পারবে না যে তোমার ঘুমটি হবে দীর্ঘ। তুমি ঘুম থেকে উঠবে এক বছর পর! কাজেই বারো বছর তোমার কাছে মনে হবে মাত্র বারো দিন। কাজেই তোমার হিসেবে তুমি পৃথিবীতে ফিরে আসবে তিন থেকে চার সপ্তাহের ভেতর!”
ত্রাতিনা বলল, “আমি জানি কমান্ডার লী। আমার যাত্রাকে সহনশীল করার জন্যে তোমরা অনেক কিছু চিন্তা করেছ।”
কমান্ডার লী বলল, “তোমাকে অভিযানের অভিনন্দন!”
কমান্ডার লীয়ের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ইঞ্জিনের চাপা গুঞ্জন শোনা গেল এবং সাথে সাথে একটি সুরেলা নারী কণ্ঠে কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেল। সাদা জলীয় বাষ্পে চারপাশ ঢেকে যায় এবং ইঞ্জিনের কম্পন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে।
“নয়–আট–সাত–ছয়-”
ত্রাতিনা শেষ বার তার পরিচিত কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ বুলিয়ে নেয়।
”চার–তিন–দুই–এক-”
ত্রাতিনা একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে এবং মহাকাশযানটি ওপরে উঠতে শুরু করে। কয়েক মুহূর্ত পরে সে তীব্র ত্বরণের জন্যে নিজের বুকের ওপর একটা চাপ অনুভব করে। ত্রাতিনা শরীরটিকে এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। চোখ বন্ধ করে সে শুনতে পেলো রুখ এবং গিসা সম্প্রতি প্রকাশিত একটি উপন্যাসের চরিত্র নিয়ে কথা বলছে। তাদের শরীর জৈবিক শরীর নয়, তাদের যান্ত্রিক দেহ তীব্র ত্বরণের চাপ অনুভব করে না! এনড্রয়েড সম্ভবত কোনো ধরনের শারীরিক কষ্ট অনুভব করে না।
.
ত্রাতিনাদের ছোট মহাকাশযানটি পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছানোর পর দুইবার সেটি পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করলো। মহাকাশ থেকে সে এক ধরনের মুগ্ধ দৃষ্টিতে পৃথিবী নামের নীল গ্রহটির দিকে তাকিয়ে থাকে। নিচের গ্রহটি জীবন্ত, ওপর থেকে সেটি বোঝা যায় না। পৃথিবীর প্রতিটি ধূলিকণা অসংখ্য প্রাণকে বাঁচিয়ে রেখেছে। সে সৌর জগতের দ্বিতীয় জীবন্ত প্রাণের সাথে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। কেমন হবে তার অভিজ্ঞতাটি? সে কী তার অভিজ্ঞতাটি পৃথিবীতে জানানোর জন্যে জীবন্ত ফিরে আসতে পারবে?
।ত্রাতিনা জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটি সরিয়ে, চাঁদের দিকে তার অভিযানটিকে নির্দিষ্ট করে নিল। তারপর আবার তার সিটে নিজেকে নিরাপত্তা বন্ধনী দিয়ে বেঁধে নিল। ত্রাতিনা চোখ বন্ধ করে শুনতে পেলো রুখ এবং গিসা তর্ক করছে, কিনিস্কীয় নবম নাকি সপ্তম সিম্ফোনিটির মাঝে কোনটি বেশি কালোত্তীর্ণ হয়েছে!
আঠারো ঘণ্টা পর ত্রাতিনাদের ছোট মহাকাশযানটি পেপিরার সাথে ডক করল। বাতাসের চাপ সমম্বিত হওয়ার পর বায়ু নিরোধক হ্যাঁচ খুলে ত্রাতিনা ভাসতে ভাসতে পেপিরার ভেতরে ঢোকে। ভেতরে একজন লাল তারকা কমান্ডার তার জন্যে অপেক্ষা করছিল। ত্রাতিনাকে দেখে সে এগিয়ে এসে বলল, “এসো ত্রাতিনা, আমরা তোমাদের জন্যে অপেক্ষা করছি।” কমান্ডার ত্রাতিনাকে আলিঙ্গন করে বলল, “আমাকে অনেকবার সতর্ক করে বলা হয়েছে তোমার বয়স খুব কম; কিন্তু এতো কম আমি বুঝতে পারিনি।”
ত্রাতিনা বলল, “চেহারায় বয়সের ছাপটি পড়েনি বলে বয়স কম মনে হচ্ছে, কিন্তু আসলে আমার বয়স এমন কিছু কম নয়। আমার থেকে কমবয়সী মহাকাশচারী এর আগে আমার থেকে বড় অভিযান করেছে।”
ত্রাতিনা রুখ এবং গিসার সাথে কমান্ডারের পরিচয় করিয়ে দিল। কিন্তু এনড্রয়েড বলেই হয়তো কমান্ডার তাদের নিয়ে উচ্ছ্বসিত হলো না।
ত্রাতিনা ঘুরে ঘুরে মহাকাশযান পেপিরাটি দেখলো। পৃথিবীতে সে এর মডেলের ভেতর কাজ করেছে, কিন্তু আসল মহাকাশযানটি যে এতো বড়, সে কখনো কল্পনা করেনি।
বারোজনের একটা টিম ত্রাতিনাকে পুরো মহাকাশযানটি ঘুরিয়ে দেখালো। তার যন্ত্রপাতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। সুযোগ সুবিধাগুলোর কথা মনে করিয়ে দিল। তথ্যভাণ্ডারের সাথে যুক্ত করে দিল। বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ব্যবহার করার জন্যে অস্ত্রগুলো দেখিয়ে দিল। এই পুরো সময়টুকু রুখ এবং গিসা একটি প্রাচীন কালোত্তীর্ণ সাহিত্য নিয়ে নিজেদের ভেতর আলোচনা করে সময় কাটাচ্ছিল। তাদের আলাদাভাবে এই তথ্যগুলো জানতে হবে না। সব তথ্য সরাসরি তাদের কপোট্রনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
পেপিরাটির দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার পর ত্রাতিনার শেষবারের মতো পুরো মেডিকেল চেক করে বারোজনের টিমটি বিদায় নিল। বায়ু নিরোধক হ্যাঁচটি বন্ধ করে দেবার পর সে দেখলো স্কাউটশীপটা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। নিচে চাঁদে বেস স্টেশনটি দেখা যাচ্ছে, এই মানুষগুলো এখানে কিছুদিন কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরে যাবে।
ত্রাতিনা কিছুক্ষণ নিজের মতো করে এই মহাকাশযানটিতে ঘুরে বেড়ালো। মূল ইঞ্জিন চালু করার আগে সে কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ তৈরি করার জন্যে পেপিরাকে মূল অক্ষের সাপেক্ষে ধীরে ধীরে ঘোরাতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা আবার নিজের দেহের ওজন অনুভব করতে শুরু করে। ত্রাতিনা তখন মহাকাশযানের একাধিক কন্ট্রোল সেন্টারের একটিতে বসে কন্ট্রোল প্যানেলের তথ্যগুলো যাচাই করে নিল। কোয়াকম্পটির সুইচ অন করে সে রুখ এবং গিসার দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কী প্রস্তুত?”
গিসা হেসে বলল, “হ্যাঁ আমরা তো আগেই তোমাকে বলেছি আমরা অনেকদিন থেকে প্রস্তুত।”
“তাহলে আমরা মূল ইঞ্জিন চালু করি?”
“করো।”
ত্রাতিনা নিজের চোখের স্ক্যানিং করে ইঞ্জিনের নিয়ন্ত্রণটি নিয়ে নেয়, তারপর সুইচ টিপে একটি একটি করে ছয়টি ইঞ্জিন চালু করে দিল। ছয় ছয়টি শক্তিশালী ইঞ্জিন, তারপরও মহাকাশযানটিতে খুব সূক্ষ্ম একট কম্পন ছাড়া সে আর কিছুই অনুভব করল না।
দেখতে দেখতে প্রথমে চাঁদের মহাকর্ষণ থেকে এবং কিছুক্ষণের ভেতর পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে পেপিরা সৌরজগতের শেষ প্রান্তের দিকে রওনা দেয়। ত্রাতিনা এক ধরনের অবিশ্বাস নিয়ে তখনো কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে ছিল, তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না একুশ বছরের একটি মেয়ে হয়ে সে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মহাকাশ অভিযানটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
ত্রাতিনা মহাকাশযানটির ভেতরে কিছুক্ষণ ইতস্তত ঘুরে বেড়ালো। একদিন নয় দুইদিন নয়, বারো বছর সে এই মহাকাশযানটিতে কাটাবে। তার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। সে যন্ত্রপাতিগুলো দেখলো, ইঞ্জিন ঘরে উঁকি দিল। কোয়াকম্পের হিমশীতল চৌকোণা বাক্সটি হাত দিয়ে স্পর্শ করল। অস্ত্রপাতির ঘরে ভয়াবহ অস্ত্রগুলো দেখে সে ছোট লাউঞ্জ থেকে এক কাপ কফি নিয়ে কন্ট্রোল রুমে ফিরে এলো।
রুখ এবং গিসা খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা আলোচনা করছিল। ত্রাতিনাকে দেখে তারা মুখ তুলে তাকালো। রুখ খুব গম্ভীর মুখে ত্রাতিনাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ত্রাতিনা তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
ত্রাতিনা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “করো।”
“আমরা আমাদের দুজনের প্রোফাইল দেখছিলাম। আমাদের দু’জনের প্রোফাইল অনুযায়ী আমাদের মানবিক সত্তা হচ্ছে আটানব্বই পার্সেন্ট। যার অর্থ, আমাদের দুই পার্সেন্ট ঘাটতি আছে।”
ত্রাতিনা হাসার চেষ্টা করে বলল, “ওটা নিয়ে দুর্ভাবনা করো না। আমি নিশ্চিত, আমার প্রোফাইল পরীক্ষা করলে দেখবে আমার মানবিক সত্তা টেনে টুনে আশি পার্সেন্ট!”
“তুমি যেহেতু নিজেই মানুষ, তোমার মানবিক সত্তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কখনো মাপার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমরা যেহেতু মানুষ নই, আমাদের মাপটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তুমি কী বলতে পারবে, ঠিক কোন কারণে আমাদের দুই পার্সেন্ট ঘাটতি?”
ত্রাতিনা কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “আমি ঠিক অনুমান করতে পারছি না। হতে পারে যেমন আমি এখন কফি খাচ্ছি সেটা দেখেও তোমাদের কফি খেতে ইচ্ছে করছে না! তোমরা মানুষ হলে এখন নিশ্চয়ই লাউঞ্জ থেকে কফি নিয়ে আসতে।”
গিসা মাথা নাড়ল, বলল, “না। খাওয়ার ব্যাপারটি এর মাঝে নেই, আমাদের যেহেতু খেতে হয় না, তাই ওটা হিসেবে ধরা হয় না।”
ত্রাতিনা খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, “তোমাদের দুজনের সাথে আমি গত কয়েকমাস সময় কাটিয়েছি। তোমাদের কখনো কোনো কিছু নিয়ে রাগ হতে দেখিনি! রাগ খুবই বড় একটা মানবিক সত্তা। মানুষ কথায় কথায় রাগ হয়।”
“রাগ?” রুখ এবং গিসা একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। তারপর বলল, “তুমি হয়তো ঠিকই বলেছ। কিন্তু রাগ তো একটি নেতিবাচক অনুভূতি।”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। রাগ একটি নেতিবাচক অনুভূতি, কিন্তু তোমাকে কে বলেছে মানুষের সব অনুভূতি ইতিবাচক? মানুষের ভেতর ইতিবাচক আর নেতিবাচক দুই অনুভূতিই আছে। যে মানুষ তার নেতিবাচক অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে ইতিবাচক অনুভূতিটি দেখাতে পারে, আমরা তাদের ভালো মানুষ বলি।”
গিসা বুঝে ফেলার ভঙ্গি করল। তারপর বলল, “তার মানে আমাদের রাগ থাকতে হবে, কিন্তু সেটা প্রকাশ করা যাবে না?”
ত্রাতিনা বলল, “প্রকাশ করা যাবে না তা নয়, প্রয়োজনে রাগ প্রকাশ করা যায়। অনেক সময় রাগ প্রকাশ করতে হয়।”
রুখ এবং গিসাকে খুবই চিন্তিত দেখালো। ত্রাতিনা মনে মনে একটু কৌতুক অনুভব করে। এই দু’টি এনড্রয়েড এই মহাকাশযানের সকল খুঁটিনাটি জানে, মহাকাশযানটিকে নিখুঁতভাবে পরিচালনা করে সৌরজগতের শেষ প্রান্তে তারা নিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু তাদের আচরণ অনেকটা শিশুর মতো!
ত্রাতিনা মহাকাশযানের কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। মহাকাশটি কুচকুচে কালো, শুধু বাইরে বহু দূরে পৃথিবীটা দেখা যাচ্ছে, এর মাঝে অনেক ছোট হয়ে এসেছে। শুধু পৃথিবী নয়, সূর্যটাকেও বেশ ছোট দেখাচ্ছে।
মহাকাশযানের এই ইঞ্জিনগুলো অসাধারণ শক্তিশালী। সে যেহেতু জেগে আছে, ত্বরণটি একটা সহ্যসীমার মাঝে রাখা হয়েছে। সে ঘুমিয়ে যাবার পর যখন তাকে হিমশীতল করে ফেলা হবে, তখন ত্বরণ আরো বাড়িয়ে দেয়া হবে।
ত্রাতিনা মহাকাশযানের তথ্যভাণ্ডার থেকে মহাজাগতিক প্রাণীর সম্ভাব্য আচরণ নিয়ে গবেষণাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল। তার হয়তো সৌরজগতের শেষপ্রান্তে পৌঁছাতে বারো বছর লেগে যাবে, কিন্তু প্রায় বেশিরভাগ সময়টুকুই তার হিমঘরেই কাটাতে হবে।
ত্রাতিনা দীর্ঘ চব্বিশ ঘণ্টা একটানা কাজ করে ঘুমুতে গেল। এখনো সে পৃথিবীর কাছাকাছি আছে, তাই পৃথিবীর ভিডি মডিউলের অনুষ্ঠান সে দেখতে পাচ্ছে। পৃথিবীতে কখনোই ছেলেমানুষি এই অনুষ্ঠানগুলো দেখার আগ্রহ অনুভব করেনি। কিন্তু পৃথিবী থেকে লক্ষ মাইল দূরে থেকে হঠাৎ সে এই ছেলেমানুষি অনুষ্ঠানগুলো গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখল।
দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে, নিজেই জানে না।
ত্রাতিনার ঘুম ভাঙল ঠিক এক বছর পর। ঘুমটি যেহেতু দৈনন্দিন ঘুম ছিল না, তাই তাকে বেশ কিছু নিয়ম মেনে তারপর উঠতে হলো। তাকে প্রথমে হাত, তারপর পা নাড়াতে হলো, মাথা ঘোরাতে হলো, বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে হলো। চোখ খুলতে হলো, বন্ধ করতে হলো মাথার ভেতরে ছোট একটা গাণিতিক হিসেব করে উত্তরটা বলতে হলো তারপর ক্যাপসুলের ঢাকনা খুলে বের হতে পারল।
ক্যাপসুলের ঢাকনার দুই পাশে রুখ এবং গিসা দাঁড়িয়েছিল। তারা উল্লসিত গলায় বলল, “পেপিরাতে শুভাগমনের শুভেচ্ছা ত্রাতিনা।”
ত্রাতিনা হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আমার কাছে মনে হচ্ছে গতরাতে ঘুমিয়ে আজ ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি! তোমাদের শুভকামনা একটু বেশি মনে হচ্ছে।”
“মোটেও বেশি নয়। গত এক বছরে অনেক কিছু ঘটেছে তাই আমরা আগ্রহ নিয়ে তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।”
ত্রাতিনা ভুরু কুঁচকে বলল, “অনেক কিছু ঘটেছে?”
“হ্যাঁ।”
“কোনো সমস্যা?”
“না, কোনো সমস্যা হয়নি। পেপিরার যন্ত্রপাতি নিখুঁত, এখানে সমস্যা হবার কিছু নেই।”
“গ্রহকণাদের বেল্টের ভেতর ঢোকার সময় নাটকীয় কিছু ঘটেনি?”
“না, ঘটেনি। আমরা এখনো গ্রহকণা বেল্টের ভেতর আছি, তুমি ইচ্ছে করলে দেখতে পারো নাটকীয় কিছু ঘটানো যায় কি না।”
ত্রাতিনা বলল, “আমরা অনেক বড় অভিযানে যাচ্ছি। যদি তা না হতো, তাহলে নিশ্চিতভাবে আমি একটি গ্রহকণায় নেমে তার ওপরে লিখে আসতাম, ত্রাতিনা এই গ্রহকণায় এসেছিল!”
ত্রাতিনার কথা শুনে রুখ এবং গিসা শব্দ করে হাসল। ঠিক কী কারণে জানা নেই ত্রাতিনার কাছে তাদের হাসিটি সবসময়েই খানিকটা কৃত্রিম শোনায়। এই দুইটি এনড্রয়েড মানুষ হওয়ার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, দেখে মাঝে মাঝেই ত্রাতিনার এক ধরনের মায়া হয়।
ত্রাতিনা মহাকাশযানের কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। গ্রহকণা বেল্টটি আলাদাভাবে দেখতে পেলো না। কিন্তু বৃহস্পতি গ্রহটিকে বেশ স্পষ্ট দেখাতে পেলো। কয়েকদিন কাজ করে সে আবার ঘুমিয়ে যাবে। পরের বার যখন উঠবে, তখন বৃহস্পতি গ্রহটার খুব কাছে চলে আসবে। সত্যি কথা বলতে কী, বৃহস্পতি গ্রহের মহাকর্ষণ বল ব্যবহার করে পেপিরার গতিকে বাড়ানো হবে। মহাকাশচারীদের উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্যে মঙ্গল গ্রহ পর্যন্ত অনেককেই আসতে হয়, কিন্তু এর পর বড় অভিযান ছাড়া আর কেউ আসার সুযোগ পায় না। বছর দুয়েক আগে বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপাতে একটা অভিযানে এসে একটা মহাকাশযান বিধ্বস্ত হয়ে সব মহাকাশচারী মারা গিয়েছিল। কারণটি কখনো জানা যায়নি।
ত্রাতিনা রুখ আর গিসার দিকে তাকিয়ে বলল, “গত এক বছরে কী ঘটেছে বল।”
“এতো ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। তুমি প্রস্তুত হয়ে এসো। নাস্তা করো। কফি খাও, তখন তোমার সাথে কথা বলব।”
“নিউট্রিনো ফ্লাক্স মেপেছ?”
“এটা প্রতিদিন একবার করে মাপছি।”
“পৃথিবী থেকে কোনো তথ্য? কোনো নির্দেশ?”
“না। কোনো তথ্য নেই। কোনো নির্দেশ নেই। জন্মদিনের শুভেচ্ছা আছে।”
“পৃথিবী ঠিক আছে? কোনো ঘূর্ণিঝড় ভূমিকম্প?”
“ওসব কিছু আছে। কিন্তু যেহেতু আগে থেকে ভবিষ্যৎবাণী করা যাচ্ছে, তাই ক্ষয়ক্ষতি বলতে গেলে নেই। বরং প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন পৃথিবীতে উৎসবের মতো!”
“নূতন কোনো আবিষ্কার?”
“নূতন কিছু প্রাণী তৈরি হয়েছে। নিরীহ গোবেচারা ধরনের, কিন্তু সাইজ অনেক বড়। চিড়িয়াখানায় বাচ্চাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য!”
ত্রাতিনা হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে নিজের ঘরে গেল। বরফের মতো কনকনে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে ঢিলেঢালা কাপড় পরে লাউঞ্জে এলো। খাওয়ার ট্রেতে গরম খাবার, তরল পানীয় আর গরম কফি নিয়ে সে কন্ট্রোল সেন্টারে এসে বসল। রুখ আর গিসা তার দুই পাশে বসে ত্রাতিনার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। ত্রাতিনা মাথা নেড়ে বলল, “তোমরা ঠিকই অনুমান করেছ, কন্ট্রোল টেবিলে গরম খাবার নিয়ে বসা সপ্তম মাত্রায় অপরাধ।”
“তাহলে?”
“জোরে হাঁচি দেওয়াও সপ্তম মাত্রার অপরাধ। তাছাড়া এখানে আমাকে শাস্তি দেওয়ার কেউ নেই। তোমরা এনড্রয়েড–এনড্রয়েড মানুষকে শাস্তি দিতে পারে না। কাজেই আমি এই ছোট বেআইনী কাজটি করছি”–বলে ত্রাতিনা তার প্লেট থেকে এক টুকরো ছোট কিন্তু সুস্বাদু প্রোটিন কেটে নিয়ে মুখে ঢুকিয়ে বলল, “এবারে বল গত এক বছরে অনেক কিছু কী কী ঘটেছে?”
রুখ বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল, “মনে আছে তোমাকে বলেছিলাম আমাদের প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে আমাদের মানবিক সত্তা আটানব্বই পার্সেন্ট, অর্থাৎ দুই পার্সেন্ট ঘাটতি আছে?”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “মনে আছে।”
“তুমি বলেছিলে আমাদের ভেতরে রাগ নেই। রাগ হচ্ছে খুব জরুরি একটি মানবিক সত্তা।”
ব্রাতিনা বলল, “হ্যাঁ মনে আছে।”
“তোমার কথা সত্যি। আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি শুধু রাগ নয়, হিংসা, ঘৃণা এবং লোভ এগুলোও মানবিক সত্তা। তাই গত এক বছর আমরা নিজেদের ভেতরে এই মানবিক সত্তাগুলো তৈরি করেছি।”
ত্রাতিনা চোখ কপালে তুলে বলল, “কী করেছ?”
গিসা বলল, “আমরা এখন রাগ হতে পারি, হিংসা করতে পারি, ঘৃণা করতে পারি এবং লোভ করতে পারি।”
ত্রাতিনা হতাশার ভঙ্গি করে বলল, “তোমরা জান তোমরা কী করেছ?”
“কী করেছি?”
“তোমরা ছিলে উচ্চ শ্রেণীর মানুষের মতো। সাধারণ মানুষের নিচতা হীনতা তোমাদের মাঝে ছিল না। এখন তোমরা হওয়ার চেষ্টা করছ নিচু শ্রেণীর মানুষ-”
গিসা বলল, “আমরা উঁচু নিচু বুঝি না। আমরা পুরোপুরি মানুষের মতো হতে চাই।”
“সেটা কখনো হতে পারবে কি না, আমি জানি না। মানুষ খুবই জটিল একটা প্রাণী। শুধু জটিল না, বলতে পার পুরোপুরি জগাখিচুড়ি একটা প্রাণী। বিবর্তনের কারণে কোনো একটা দিকে পরিবর্তিত হয়েছে। তারপর অন্য একটা প্রয়োজনে আবার অন্য একদিকে পরিবর্তন হয়েছে। একটা স্তরের উপর আরেকটা স্তর, পুরোপুরি এলোমেলো। খুব ঠাণ্ডা মাথায় যদি মানুষকে নূতন করে ডিজাইন করা যেতো, তাহলে মানুষ হতো খুব সহজ সরল দক্ষ একটা প্রাণী! কিন্তু সেটা তো হতে পারবে না।”
রুখ বলল, “কেন হতে পারবে না?”
ত্রাতিনা তার কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “কীভাবে হবে?”
“মানুষ বলতে তুমি নিশ্চয়ই মানুষের পাকস্থলী, কিডনি কিংবা হৃৎপিণ্ড বোঝাও না। মানুষ হচ্ছে তার মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ককে সুরক্ষা দেওয়ার জন্যে
অন্য সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তৈরি হয়েছে। ঠিক কি না?”
ত্রাতিনা বলল, “ঠিক আছে। তর্কের খাতিরে মেনে নিই।”
“তাহলে আমরা যদি মানুষের মস্তিষ্কের মতো জটিল একটা সিস্টেম দাঁড়া করি এবং সেটাকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে সহজ সরল কিছু যন্ত্রপাতি দাঁড়া করি, তাহলে সেটা কী মানুষ থেকে ভালো হল না?”
“কিন্তু সেটা কীভাবে হবে?” রুখ গলা উঁচিয়ে বলল, “কীভাবে হবে মানে? হয়ে গেছে!”
ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ। এই যে আমরা দুইজন তোমার সামনে বসে আছি। আমরা হচ্ছি ভবিষ্যতের মানুষ। আমাদের ভেতর মানুষের মানবিক সত্তা আছে, বুদ্ধিমত্তা আছে। কিন্তু আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্যে স্নায়ুতন্ত্র, রক্ত সঞ্চালন, কিডনি পরিবহন, পুষ্টিতন্ত্র, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কোনো কিছু লাগে না। আমরা হচ্ছি ভবিষ্যতের মানুষ।”
ত্রাতিনা হাসি হাসি মুখে বলল, “আর আমরা?”
“তোমরা হবে অতীতের মানুষ।”
ত্রাতিনা তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে। অতীতের মানুষ ভবিষ্যতের মানুষকে স্বাগত জানাচ্ছে। যদি মহাজাগতিক প্রাণী সত্যি সত্যি পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলতে চায়, তাহলে ভবিষ্যতের মানুষ এই পৃথিবীর ইতিহাস, কালচার ঐতিহ্য জ্ঞান বিজ্ঞানকে বাঁচিয়ে রাখবে।”
গিসা বলল, “তুমি আমাদের নিয়ে কৌতুক করছ। কিন্তু এক সময় নিশ্চয়ই আমাদের গুরুত্বটা বুঝতে পারবে। পারবেই পারবে।”
.
ত্রাতিনা কয়েকদিন মহাকাশযানটিতে কাটিয়ে আবার ঘুমুতে চলে গেল।
এবারে তার ঘুম ভাঙলো এক বছরের আগেই, কারণ তাকে জাগিয়ে তোলা হলো। ক্যাপসুলের ভেতর চোখ খুলেই সে বুঝতে পারলো, সময়ের আগেই তাকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে, কারণ মাথার কাছে ছোট একটা লাল বাতি জ্বলছে এবং নিভছে। ত্রাতিনা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে, নিয়ম মাফিক হাত পা এবং মাথা নাড়িয়ে, চোখ খুলে এবং বন্ধ করে শেষে মাথার ভিতরে ছোট একটা হিসেব করে ক্যাপসুল থেকে বের হয়ে এলো। ক্যাপসুলের বাইরে রুখ এবং গিসা দাঁড়িয়ে আছে, এর আগেরবার তাদের চেহারায় একটা উৎফুল্ল ভাব ছিল, এবারে সেটি নেই। দুজনেই একটু গম্ভীর।
ত্রাতিনা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “কোনো সমস্যা?”
রুখ মাথা নাড়ল, “না, সমস্যা না। তবে–”
“তবে কী?”
“একটা স্কাউটশীপ আমাদের মহাকাশযান পেপিরাকে ধরার চেষ্টা করছে।”
ত্রাতিনা চোখ বড় করে তাকালো, “কী বললে? একটা স্কাউটশীপ?”
“হ্যাঁ।”
“যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছ?”
”করেছি। মনে হয় চ্যানেল খোলা নেই। কোনো উত্তর নেই।”
“পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করেছ?”
“চেষ্টা করেছি। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা বৃহস্পতি গ্রহের ছায়ার মাঝে আছি, এখান থেকে বের হবার আগে যোগাযোগ হচ্ছে না।”
“কী আশ্চর্য! বৃহস্পতি গ্রহের কাছে একটা স্কাউটশীপ?”
গিসা বলল, “আমি জানি না এটাকে স্কাউটশীপ বলা ঠিক হবে কি না। এটা খুব ছোট অত্যন্ত বিচিত্র একটা মহাকাশযান।”
ত্রাতিনা কন্ট্রোল প্যানেলে গিয়ে মহাকাশযানটাকে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। গিসা ঠিকই বলেছে, এটাকে স্কাউটশীপ কিংবা মহাকাশযান বলা যায় কিনা সন্দেহ আছে। মনে হচ্ছে অত্যন্ত বিচিত্র কিছু যন্ত্রপাতি জুড়ে দিয়ে কিছু একটা দাঁড় করানো হয়েছে। শুধু তাই না, এই মহাকাশযানটার যাত্রাপথ একটি সুইসাইড মিশন। এটি সরাসরি মহাকাশযান পেপিরার সাথে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে, পেপিরার যেটুকু ক্ষতি হবে, সেটা সারিয়ে নেয়ার উপায় আছে, কিন্তু এই মহাকাশযানটার রক্ষা পাবার কোনো উপায় নেই।
ত্রাতিনা কোয়াকম্প দিয়ে হিসেব করে পেপিরার সাপেক্ষে এই বিচিত্র মহাকাশযানটার যাত্রাপথ বের করলো। তাদের মহাকাশযানে আঘাত করার আগে এখনো হাতে কয়েক ঘণ্টা সময় আছে।
রুখ বলল, “এটি একটি বিপজ্জনক বস্তু। যেহেতু এটি কোনো রকমভাবে যোগাযোগ করছে না, কাজেই ধরে নেয়া যায় এটি একটি মহাজাগতিক জঞ্জাল। আমাদের নিরাপত্তার জন্যে এটা ধ্বংস করে দেয়া সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত কাজ।”
গিসা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ ধ্বংস করে দিই।”
রুখ বলল, “আমরা যেখানে আছি তার আশেপাশে কয়েক লক্ষ কিলোমিটারের ভেতর কোনো মানুষের বসতি নেই। এর ভেতরে কোনো মানুষ নেই।”
ত্রাতিনা কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়েছিল, দেখতে পেলো মহাকাশযানটির একটি অংশ হঠাৎ করে ভেঙে উড়ে গেল। রুখ সেটা দেখে মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের হয়তো এটা ধ্বংস করতে হবে না; এটি নিজে থেকেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একটা অংশ ভেঙে উড়ে গেছে।”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “না। তোমরা বিষয়টি ধরতে পারনি।”
“কেন? কী হয়েছে?”
“মহাকাশযানের একটা অংশ এমনি এমনি ভেঙে উড়ে যায়নি। এটি ইচ্ছে করে করা হয়েছে।”
“কেন?”
“যাত্রাপথটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে। দেখেছ এর যাত্রাপথ এখন আর সাংঘর্ষিক না। এটি এখন আমাদের সমান্তরালভাবে আসছে।”
গিসা বলল, “এটি কাকতালীয় ব্যাপার। মহাকাশযানের অংশ ভেঙে কেউ মহাকাশযানের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে না। মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ করে মহাকাশের ইঞ্জিন দিয়ে।”
“যদি মহাকাশযানে ইঞ্জিন না থাকে?”
গিসা একটু হাসল। বলল, “যদি ইঞ্জিন না থাকে, সেটাকে কেউ মহাকাশযান বলে না।”
ত্রাতিনা মনিটরটির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। বলল, “দেখেছ কী হয়েছে?”
“কী হয়েছে?”
“মহাকাশযানের আরেক টুকরো বের হয়ে গেছে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। গতি একটু বাড়িয়েছে, যেন আমাদের স্পর্শ করতে পারে।”
“তুমি কী বলতে চাইছ?”
“আমি বলতে চাইছি, এই বিচিত্র মহাকাশযানটিকে আমাদের মহাকাশযানে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য প্রস্তুত হও।”
রুখ বলল, “তুমি এটাকে ডক করতে দেবে? এর ভেতরে কী আছে তুমি জানো না। হতে পারে এই কোনো দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত কোনো মহাকাশযানের অংশ।”
“যেটাই হোক, আমি সেটা দেখতে চাই।”
মহাকাশযানটি অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। এখন এটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রুখ ভালো করে দেখে বলল, “ত্রাতিনা।”
“বল। এটি কোনোভাবে আমাদের মহাকাশযানে ডক করতে পারবে।। এটির বায়ু নিরোধক কোনো হ্যাঁচ নেই।”
ত্রাতিনাকে খুব বিচলিত হতে দেখা গেল না। বলল, “আমি অনুমান করেছিলাম।”
“তাহলে?”
“মহাকাশযানটাকে সরাসরি পেপিরার ভেতরে নিয়ে আসব।”
“কী বলছ তুমি?”
“হ্যাঁ। একটা অংশ সিল করে সেটা খুলে দেব। মহাকাশযানটা ভেতরে ঢুকবে। তারপর মহাকাশযান বন্ধ করে বাতাসের চাপ সমন্বয় করব।”
“কী বলছ তুমি? এটা দ্বিতীয় মাত্রার বিপজ্জনক পরিস্থিতি।”
“না। এটা একেবারে প্রথম মাত্রার বিপজ্জনক পরিস্থিতি। এই বিচিত্র মহাকাশযানটার ভেতরে একজন মানুষ রয়েছে। আমাদের তাকে উদ্ধার করতে হবে। যে কোনো মূল্যে–”
“কিন্তু।”
ত্রাতিনা হাসল। বলল, “তোমরা পুরোপুরি মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছ। পুরোপুরি মানুষ হওয়ার এটা প্রথম শর্ত অন্য একজন মানুষকে বাঁচাতে হয়। যে কোনো মূল্যে। যাও, তোমরা পেপিরার লোডিং ডক খুলে দাও। আমি কন্ট্রোল প্যানেলে আছি।”
ত্রাতিনা তার মহাকাশচারী জীবনের পুরো অভিজ্ঞতাটুকু ব্যবহার করে বিচিত্র মহাকাশযানটিকে পেপিরার ভেতরে নিয়ে এলো। প্রাণপণ চেষ্টা করেও মহাকাশযানটিকে ঠিকভাবে নামাতে পারলো না। একেবারে শেষ মুহূর্তে মহাকাশযানটি পেপিরার দেয়ালে আঘাত করল। বিচিত্র মহাকাশযানটি স্থির হবার পর পেপিরার লোডিং ডকের বিশাল ঢাকনাটি ধীরে ধীরে নেমে এলো। বাতাসের চাপ সমান করার সাথে সাথে গিসাকে কন্ট্রোল প্যানেলে রেখে ত্রাতিনা রুখকে নিয়ে ভিতরে ছুটে গেল।
বিচিত্র মহাকাশযানটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এর কোনো দরজা নেই। ভেতর থেকে বের হওয়ার কোনো জায়গা নেই। ত্রাতিনা লেজার দিয়ে সাবধানে একপাশে কেটে একটা গর্ত করে ভেতরে মাথা ঢোকালো। দেখলো মহাকাশযানটির সামনে ছিন্নভিন্ন পোশাকে একজন মানুষ যন্ত্রপাতির নিচে চাপা পড়ে আছে। তার লম্বা মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। ত্রাতিনাকে দেখে মানুষটি হাত নেড়ে বলল, “এটা কী সত্যি ঘটেছে, নাকি এটা কোনো হ্যাঁলুসিনেশন?”
ত্রাতিনা বলল, “আমিও এটা কাউকে জিজ্ঞেস করতে চাই। এটা কি সত্যি ঘটেছে?”
যন্ত্রপাতির ভেতর থেকে মানুষটা নিজেকে টেনে বের করে আনতে আনতে বলল, “একসাথে দুইজনের একই হ্যাঁলুসিনেশান হতে পারে না। মনে হয়, সত্যিই এটা হচ্ছে।”
ত্রাতিনা বলল, “হ্যাঁ সত্যি এটা হচ্ছে। তোমার নাম কী?”
“নাম?”
“হ্যাঁ।”
মানুষটি হাসল, দাড়ি গোঁফের জঙ্গলের ভেতর থেকে তার ঝকঝকে দাঁত বের হয়ে আসে।”অনেকদিন নামটা ব্যবহার হয়নি তো, তাই মনে করতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হয় আমার নাম গ্রাহা।”
“তুমি কী জান, একসময়ে টেক্সট বইয়ে একটা চ্যাপ্টার লেখা হবে যার শিরোনাম হবে গ্রাহা উদ্ধার প্রক্রিয়া?”
গ্রাহা নামের মানুষটা এবারে শব্দ করে হাসল। বলল”আসলে একটা চ্যাপ্টার নয় মনে হয় পুরো একটা বই লেখা সম্ভব। সেটার নাম হতে পারে, ‘হতভাগা গ্রাহার জীবন কাহিনী’।”
রুখ নিচু গলায় বলল, “ত্রাতিনা, আমার মনে হয় তোমরা মহাকাশযানের ভেতরে গিয়ে এই কথাবার্তা বলতে পারবে। তার অনেক সময় আছে।”
.
৩.৩
মহাকাশযান পেপিরার ভেতরে ঢুকে গ্রাহা এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকালো। তারপর নিচু গলায় বলল, “এ রকম একটি মহাকাশযান হতে পারে আমি সেটা স্বপ্নেও কল্পনা করিনি।”
ত্রাতিনা বলল, “আমিও করিনি।”
“তোমাদের কমান্ডারের সাথে দেখা করার আগে আমার মনে হয় একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া দরকার।”
ত্রাতিনা বলল, “তার প্রয়োজন হবে না। তোমার এর মাঝে কমান্ডারের সাথে দেখা হয়েছে।”
গ্রাহা অবাক হয়ে বলল, “দেখা হয়েছে?”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। আমি এই মহাকাশযানের কমান্ডার। এবং ঝাড়দার এবং নিরাপত্তাকর্মী। এবং বাবুর্চি। এক কথায় সবকিছু।”
গ্রাহা বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “কী আশ্চর্য! এতো বড় মহাকাশযানের দায়িত্বে এতো কমবয়সী একজন? অন্য মহাকাশচারীরা কোথায়?”
ত্রাতিনা বলল, “আর কেউ নেই। আমরা তিনজন এর দায়িত্বে।”
“কী আশ্চর্য! মাত্র তিনজন মানুষ এর দায়িত্বে?”
গিসা বলল, “আসলে তিনজন মানুষ নয়। একজন মানুষ। ত্রাতিনা। আমরা মানুষ নই। আমরা এনড্রয়েড।”
গ্রাহা রীতিমত চমকে উঠল এবং অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে গিসার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “আমি নিজের চোখে দেখে এবং নিজের কানে শুনেও বিশ্বাস করছি না।”
রুখ বলল, “এই অভিযানের জন্যে আমাদের বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। আমরা মূলত ত্রাতিনাকে নিরাপত্তা দেই, কিন্তু এই দীর্ঘ যাত্রায় ত্রাতিনা যেন নিঃসঙ্গ অনুভব না করে সেজন্যে আমাদের রয়েছে প্রায় পূর্ণাঙ্গ মানবসত্তা।”
গিসা বলল, “এছাড়াও আমাদের আরো একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে। যেটি এই মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না।”
গ্রাহা মাথা নাড়ল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। সে সম্ভবত এর আগে কখনোই একটা এনড্রয়েডের সাথে কথা বলেনি। তাদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হবে, সে জানে না।
ত্রাতিনা ব্যাপারটা খানিকটা বুঝতে পারল। সে গ্রাহাকে বলল, “গ্রাহা, তুমি কীভাবে কোথা থেকে কীভাবে এখানে এসে হাজির হয়েছ, সেটা জানার জন্যে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করব। তোমার সম্ভবত একটা মেডিকেল চেকআপ করা উচিত। তারপর গরম পানিতে একটা দীর্ঘ গোসল, নূতন কাপড়, ভালো ডিনার, উত্তেজক পানীয় ইত্যাদি। যারা এই মহাকাশযানটি ডিজাইন করেছে, তারা সবকিছু চিন্তা করেছে, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেনি এখানে আরো একজন মানুষ এসে হাজির হবে। কাজেই এখানে দ্বিতীয় মানুষের কোনো ব্যবস্থা নেই। তোমাকে সবকিছু আমার সাথে ভাগাভাগি করতে হবে।”
গ্রাহা বলল, “আমি তুলনামূলকভাবে বেশি খাই। এখন হয়তো আমি আরো বেশি খাব। তোমার খাবার সরবরাহে সমস্যা হতে পারে।”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “সেটা নিয়ে তোমার দুর্ভাবনা করতে হবে না। এই অভিযানে আমি বেশিরভাগ সময়ে ঘুমিয়ে থাকি। সময় কাটানোর এটা সবচেয়ে সহজ উপায়।”
গ্রাহা বলল, “তোমার অভিযান সম্পর্কে আমি কিছু জানি না। আমি হাজির হয়ে তোমার অভিযানের কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেছি কি না, সেটাও বুঝতে পারছি না।”
ব্রাতিনা বলল, “আমরা সেটা নিয়ে আলোচনা করব। আমার ধারণা, আমার অভিযানটি সম্পর্কে জানার পর তুমি তোমার বিদঘুঁটে মহাকাশযানে করে যেখান থেকে এসেছ আবার সেখানে ফিরে চলে যাবে।”
.
মেডিকেল চেক আপে গ্রাহার শরীরে রক্তশূন্যতা, অপুষ্টি, হৃৎপিণ্ডের প্রদাহ, স্নায়ু বৈকল্য এরকম গুরুতর অনেকগুলো সমস্যা ধরা পড়ল। কিন্তু সেগুলো দেখে কেউই বিচলিত হলো না। এই মানুষটি বেঁচে আছে সেটি পুরোপুরি একটি অলৌকিক বিষয়। সে তুলনায় কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যাকে বিবেচনায় আনার কোনো প্রয়োজন নেই।
পেপিরার মেডিকেল সেবা নিয়ে গ্রাহা ত্রাতিনার সাথে ডিনার করার সময় তার ইতিহাসটুকু বলল। গ্রাহা একজন প্রথম শ্রেণির মহাকাশচারী। তিন বছর আগে সে বৃহস্পতি গ্রহের চাঁদ ইউরোপাতে একটি অভিযানে এসেছিল। একেবারেই দুর্ঘটনাক্রমে একটা উল্কার আঘাতে তাদের মহাকাশযানের মূল ইঞ্জিনটি বিকল হয়ে যায়। কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই তাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে ইউরোপাতে নামতে হয়। মূল ইঞ্জিন ছাড়া সেটি ছিল অসম্ভব একটি ব্যাপার। মহাকাশযানের কেউই বাঁচেনি। গ্রাহা কীভাবে বেঁচে গিয়েছে, সেটি সব সময়েই রহস্য হিসেবে থেকে যাবে।
তাদের অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউরোপা উপগ্রহটি মানুষের বসবাসের কতোটুকু উপযোগী, সেটা সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়া–গ্রাহা এখন সেই ধারণাটি নিজের জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই উপগ্রহে জীবন ধারণের মূল উপাদান পানি এবং অক্সিজেন দু’টিই আছে। এর সাথে অল্পকিছু সাহায্য পেলে একজন মানুষ অনির্দিষ্টকাল ইউরোপাতে বেঁচে থাকতে পারবে।
গ্রাহার দুর্ভাগ্য, তাদের মহাকাশযানের মূল যোগাযোগ মডিউলটি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাই পৃথিবীর সাথে আর কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারেনি। অনেক কষ্ট করে সে তার আংশিক চালু করেছিল, যে কারণে মহাকাশের কিছু সিগন্যাল সে পেতো, কিন্তু কিছুই পাঠাতে পারত না।
সময় কাটানোর জন্যে সে বিধ্বস্ত মহাকাশযানের অংশগুলো জোড়াতালি দিয়ে এই মহাকাশযানটি তৈরি করেছিল। সেটি দিয়ে কখনোই কোনো মহাকাশযানে নামতে পারবে আশা করেনি। কিন্তু বিশাল একটা উপগ্রহে পুরোপুরি একাকী বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেয়ার থেকে প্রায় অসম্ভব কিছু একটা চেষ্টা করতে গিয়ে মারা যাওয়াটাই তার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। তাই যখন তার যোগাযোগ মডিউলে পেপিরার সংকেত ধরা পড়েছে, সে সেটাকে ধরার চেষ্টা করেছে। বৃহস্পতি গ্রহের এতো কাছে দিয়ে সত্যিকারের মহাকাশচারী নিয়ে একটি মহাকাশযান উড়ে যাবে, সেটি সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। সে যে সত্যি সত্যি এই মহাকাশযানের ভেতরে নিরাপদে আশ্রয় পেয়েছে, সেটি সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না।
গ্রাহা তখন ত্রাতিনার কাছে তার অভিযানের উদ্দেশ্যটি জানতে চাইল। ত্রাতিনা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “তোমাকে এক কথায় যদি বলতে হয় তাহলে বলব যে আমরা একটা মহাজাগতিক প্রাণীর কাছে একটা মেসেজ নিয়ে যাচ্ছি।”
গ্রাহা কিছুক্ষণ বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “মহাজাগতিক প্রাণী?”
ত্রাতিনা বলল, “মহাজাগতিক প্রাণী শব্দটা হয়তো ঠিক হলো না, প্রাণী বললেই আমাদের মনে হাত পা চোখ মুখ আছে এরকম একটা জীবন্ত কিছুর ছবি ভেসে ওঠে! আমার শুদ্ধ করে বলা উচিত মহাজাগতিক অস্তিত্ব।”
“অস্তিত্ব? মহাজাগতিক অস্তিত্ব?” এবারে গ্রাহাকে আরো বেশি বিভ্রান্ত দেখালো।
ত্রাতিনা বলল, “আরো শুদ্ধ করে বলা যাক, একটি বুদ্ধিমান মহাজাগতিক অস্তিত্ব!”
গ্রাহা হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনো একটা জায়গায় একটা বুদ্ধিমান মহাজাগতিক অস্তিত্ব ঘাপটি মেরে বসে আছে? তুমি তার কাছে একটা চিঠি নিয়ে যাচ্ছ?”
ত্রাতিনা হাসল, বলল, “ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম।”
”তুমি কেমন করে জান এই মহাবিশ্বে একটা বুদ্ধিমান মহাজাগতিক অস্তিত্ব আছে?”
ত্রাতিনা বুকে হাত দিয়ে বলল, “আমি ত্রাতিনা সেটা জানি না পৃথিবীর বড় বড় বিজ্ঞানী গবেষকরা সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। কারণ আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগে একটা মহাজাগতিক কণা পৃথিবীটাকে ধ্বংস করার জন্যে ছুটে গিয়েছিল, যেটাকে শেষ মুহূর্তে একটা থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে ধ্বংস করে পৃথিবীকে রক্ষা করা হয়েছে।”
গ্রাহা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, বিষয়টা পৃথিবীর সাধারণ মানুষের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমরা মহাকাশচারীদের অনেকে সেটা শুনেছি। রায়ীনা নামে একজন মহাকাশচারী–”
ত্রাতিনা হঠাৎ শব্দ করে হাসল। গ্রাহা থেমে গেল, ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি হাসলে কেন?”
“তোমার মুখে আমার মায়ের নাম শুনে!”
গ্রাহা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, তারপর খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, “তুমি রায়ীনার মেয়ে?”
“হ্যাঁ। আমার ক্রোমোজমের তেইশটি রায়ীনার কাছ থেকে এসেছে!”
গ্রাহা উঠে দাঁড়িয়ে ত্রাতিনার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “ত্রাতিনা, আমি তোমাকে একটু আলিঙ্গন করি?”
ত্রাতিনা কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল এবং গ্রাহা তাকে গভীর ভালোবাসায় আলিঙ্গন করল। রুখ এবং গিসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দু’জনের দিকে তাকিয়েছিল। তারা এবারে একজন আরেকজনের দিকে তাকালো। রুখ গলা নামিয়ে গিসাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী অনুমান করেছিলে গ্রাহা হঠাৎ করে এতো আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বে?”
“না।” গিসা মাথা নাড়ল, বলল, “না আমি অনুমান করিনি। সত্যি কথা বলতে কী আমার কাছে আবেগের এ ধরনের বহিঃপ্রকাশকে খানিকটা বাহুল্য মনে হয়।”
রুখ বলল, “সেটাই হচ্ছে আমাদের সমস্যা। এ কারণেই আমাদের প্রোফাইলের মানবিক সত্তা পুরো একশ ভাগ হতে পারছে না!”
গ্রাহা আবার নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার পর ত্রাতিনা বলল, “যাই হোক যেটা বলছিলাম, পৃথিবীর বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা যখন নিশ্চিত হলেন যে, কোনো একটা মহাজাগতিক প্রাণী পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য এই গ্রহকণারূপী মহাকাশযানটি পাঠিয়েছে, তখন তারা বিষয়টা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা শুরু করলেন। তারা যেটা খুঁজে বের করলেন, সেটা খুবই বিচিত্র।”
গ্রাহা একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল, “সেটা কী?”
“সেটা হচ্ছে মহাজাগতিক বুদ্ধিমত্তার এই অস্তিত্ব পৃথিবীকে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার কারণে ধ্বংস করছে না। তারা এটা করছে নিছক একটা কৌতূহল থেকে। বুদ্ধিমান হওয়ার প্রথম শর্ত কৌতূহল।”
“কৌতূহল?”
“হ্যাঁ, যেহেতু কাছে আসতে পারছে না, তাই দূর থেকে এটা পর্যবেক্ষণ করার সবচেয়ে সোজা উপায় হচ্ছে সেখানে কিছু একটা ছুঁড়ে দেয়া। বিজ্ঞানীরা যেভাবে প্রোটন প্রোটন সংঘর্ষ করে ভেতরে কোয়ার্কেরা কী রকম আছে সেটা বের করে নেয়!”
গ্রাহা মাথা নাড়ল। বলল, “আমি একটা বিষয় বুঝতে পারছি না। তুমি বলছ তারা কাছে আসতে পারছে না। যদি আসলেই বুদ্ধিমান হয়ে থাকে, কাছে আসতে সমস্যা কী?”
“সূর্যের জন্য কাছে আসতে পারে না।”
“সূর্য?”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ সূর্য। আমাদের সূর্যের প্রধান বিক্রিয়া হচ্ছে প্রোটন প্রোটন বিক্রিয়া, সেখান থেকে নিউট্রিনো বের হয়, পৃথিবীতে তার ফ্লাক্স বিশাল। পৃথিবীর পৃষ্ঠে যদি আমরা দাঁড়িয়ে থাকি, প্রতি সেকেন্ডে শুধু আমাদের চোখের মণি দিয়ে এক বিলিয়ন নিউট্রিনো যায়। আমরা সেটা টের পাই না, কারণ নিউট্রিনোর বিক্রিয়া বলতে গেলে কিছু নেই।”
গ্রাহা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ আমরা হাইস্কুলে এগুলো পড়েছি।”
”আমাদের শরীর নিউট্রিনোর সাথে বিক্রিয়া করে না, কিন্তু আমি যে মহাজাগতিক অস্তিত্বের কথা বলছি, সেটা করে। তাই সেটা সূর্যের কাছে আসতে পারে না। আমরা সূর্য থেকে যত দূরে যাব, নিউট্রিনো ফ্লাক্স তত কমতে থাকবে। শনি গ্রহের কাছাকাছি নিউট্রিনো ফ্লাক্স হবে পৃথিবীর এক শত ভাগের এক ভাগ। সৌর জগতের শেষ মাথায় যদি যাই, নিউট্রিনো ফ্লাক্স পৃথিবীর এক হাজার ভাগের এক ভাগ। কাজেই পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা বের করেছেন, মহাজাগতিক অস্তিত্ব শুরু হয়েছে সৌরজগতের বাইরে থেকে। বুঝেছ?”
গ্রাহা মাথা নাড়ল। বলল, “তুমি যেটা বলেছ, সেটা বুঝেছি। কিন্তু কী বলতে চাইছ সেটা এখনো বুঝিনি।”
ত্রাতিনা বলল, “আপাতত এটুকু বুঝলেই চলবে। যেহেতু মহাজাগতিক অস্তিত্বটুকু সৌরজগতের শেষ প্রান্ত থেকে শুরু, তাই আমি সেখানে যাচ্ছি।”
গ্রাহা মাথা চুলকে বলল, “সেই হাইস্কুলে যেটুকু পদার্থবিজ্ঞান পড়েছিলাম এবং যতটুকু মনে আছে, সেটা থেকে বলতে পারি এই মহাজাগতিক অস্তিত্ব যেহেতু নিউট্রিনোর সাথে বিক্রিয়া করে, অর্থাৎ সেটা তৈরি উইম্পস দিয়ে। কাজেই সে তোমাকে দেখবে না!”
ত্রাতিনা আনন্দে হাততালি দিয়ে বলল, “এই তো তুমি পুরোটাই বুঝে গেছ! এই মহাজাগতিক অস্তিত্ব আমাকে দেখতেই পাবে না! কাজেই সেখানে পৌঁছে গিয়ে আমার নিজেকে জানাতে হবে, বলতে হবে, আমি এসেছি।”
“কীভাবে বলবে?”
“একটা দশ মেগাটন থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা পাঠাব! সেটা যখন বিস্ফোরিত হবে সেখান থেকে বিশাল নিউট্রিনো ফ্লাক্স বের হবে–এই মহাজাগতিক অস্তিত্ব জানবে আমি এসেছি!”
গ্রাহা কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কী যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, “এই মহাজাগতিক অস্তিত্ব নিশ্চয়ই একটা প্রাণীর মতো না, তার নিশ্চয়ই হাত পা নেই, মাথা নেই, চোখ নেই।”
ত্রাতিনা বলল, “না, নেই।”
“শুধু মস্তিষ্কের মতো কিছু?”
“হ্যাঁ। আমাদের যে রকম অসংখ্য নিউরন, একটার সাথে আরেকটা, সংযোগ, এটাও তাই। বিশাল মহাবিশ্ব জুড়ে ওই রূপ ছড়িয়ে আছে, একটার সাথে আরেকটা যোগাযোগ রাখছে। বলতে পারো বিশাল এলাকায় যেন বুদ্ধিমত্তা ছড়িয়ে পড়ছে!”
“তার মানে তুমি যখন থার্মোনিউক্লিয়ার বোমাটা ফাটাবে, সেটা অনেকটা এই মহাজাগতিক প্রাণীর মস্তিষ্কের ভেতর গুলি করার মতো?”
ত্রাতিনা শব্দ করে হাসল। বলল, “তোমার উপমাটা ভালো, আমার পছন্দ হয়েছে। আমরা এই মহাজাগতিক প্রাণীর মস্তিষ্ক বল, বুদ্ধিমত্তার আস্তরণ বল সেখানে গুলি করতে যাচ্ছি!”
গ্রাহা বলল, “কেউ আমার মাথায় গুলি করলে আমি যথেষ্ট বিরক্ত হব।”।
“ভয় নেই, এই প্রাণী বিরক্ত হবে না।”
“কেন?”
“কারণ, বিরক্তি, ক্রোধ, আনন্দ, হতাশা এগুলো মানুষের অনুভূতি। মানুষের বুদ্ধিমত্তা থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমত্তা হলে তারা মানবিক এই বুদ্ধিমত্তার অনেক ঊর্ধ্বে চলে যায়।”
গ্রাহা ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি নিশ্চিত?”
“আমি এসব জানি না, তাই আমার নিশ্চিত হওয়া না হওয়ায় কিছু আসে যায় না। যারা বিশেষজ্ঞ, তারা অনেক গবেষণা করে এই বিষয়টা বের করেছেন।”
“তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো, তুমি এই মহাজাগতিক প্রাণী বা অস্তিত্বের মস্তিষ্কের ভেতর বোমা ফাটিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে। তারপর কী করবে?”
“পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা তখন তাদের সাথে যোগাযোগ করার জন্যে একটা যন্ত্র তৈরি করে দিয়েছেন, তখন সেই যন্ত্র দিয়ে যোগাযোগ করব।”
গ্রাহা বলল, “তাদের সাথে যোগাযোগ করবে? তাদের ভাষায় কথা বলবে?”
“অনেকটা সে রকম। তখন কী হবে, কেমন করে হবে সেটা আমি জানি না। তখন দেখা যাবে। মোটামুটি বলা যায়, আমি বলব তোমাদের জন্যে পৃথিবীর বুদ্ধিমত্তার নিদর্শন একটা উপহার দিতে এসেছি।”
“পৃথিবী থেকে উপহার? কী রকম উপহার? এদের জন্যে নিশ্চয়ই সোনার আংটি কিংবা হীরার নেকলেসের কোনো গুরুত্ব নেই।”
“না নেই।”
“তাহলে, তাদের কী উপহার দেবে?”
ত্রাতিনা হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, “এই যে তোমাদের সামনে বসে আছে, রুখ এবং গিসা। তাদেরকে ঠিক এই উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে।”
রুখ এবং গিসা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। রুখ বলল, “সে জন্যে আমাদের ভেতরের মানবিক সত্তাকে যতদূর সম্ভব মানুষের মানবিক সত্তার কাছাকাছি আনা হয়েছে। আর আমাদের শরীরটা তৈরি হয়েছে এমনভাবে যেন এখান থেকে বেটা ডিকে হয়, নিউট্রিনো বের হয়। যেন সহজে বিশ্লেষণ করতে পারে।”
গ্রাহা কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তোমাদের দু’জনকে দিয়ে দেয়া হবে?”
“হ্যাঁ।”
“তোমাদের ভেতরে যদি সত্যিকারের মানবিক সত্তা থাকতো, তাহলে তোমরা নিশ্চয়ই আপত্তি করতে।”
“আপত্তি? আপত্তি কেন করব? আমাদের কপোট্রন স্ক্যান করে রাখা হবে, কাজেই আবার আমাদের সৃষ্টি করা হবে।”
গ্রাহা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। বলল, “কিন্তু তোমরা তো সত্যিকারের মানুষ নও। মানুষের ডিকয়।”
ত্রাতিনা বলল, “আমাদের কিছু করার নেই। রুখ এবং গিসা শুধু যে মানুষের কাছাকাছি একটা সহজ যান্ত্রিক রূপ তা নয়, তাদের ভেতর পৃথিবীর সব তথ্য দিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে তথ্য আর অন্য কোনোভাবে দেয়া সম্ভব নয়।।
গ্রাহা মাথা নেড়ে বলল, “কেউ যদি আমাকে বলতো যে তোমাকে মহাজাগতিক প্রাণীর হাতে তুলে দেব, আমি কিন্তু কিছুতেই রাজি হতাম না!”
গিসা বলল, “আমরা আনন্দের সাথে রাজি হয়েছি। পৃথিবীর মানুষের জন্যে আমরা কিছু একটা করতে পেরেছি, সেজন্যে আমরা গর্বিত।”
গ্রাহা বেশ খানিকটা বিস্ময়ের সাথে এই পরিতৃপ্ত এবং গর্বিত এনড্রয়েড দুটির দিকে তাকিয়ে রইল।
.
৩.৪
দু’দিন পর ত্রাতিনা গ্রাহাকে বলল, “গ্রাহা আমাদের দু’জনের একটু কথা বলা দরকার।”
গ্রাহা বলল, “কী বিষয় নিয়ে কথা বলবে?”
“তোমার বিষয়ে।”
গ্রাহা বলল, “আমার বিষয়ে? আমি কী বেশি খেয়ে তোমার রসদ ফুরিয়ে ফেলছি?”
ত্রাতিনা হাসল। বলল, “না, সেরকম কোনো আশংকা নেই।”
“তাহলে তুমি কী নিয়ে কথা বলতে চাও?”
“তোমার নিশ্চয়ই পৃথিবীতে ফিরে যাওয়া দরকার। তুমি প্রাণে রক্ষা পেয়েছ, এখন সেই প্রাণটুকু নিয়ে যদি পৃথিবীতে ফিরে না যাও, তাহলে কেমন হবে? পৃথিবীতে নিশ্চয়ই তোমার পরিবার আছে, আপনজন আছে।”
গ্রাহার মুখটা হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেল। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “কয়দিন থেকে আমারও আমার পরিবারের কথা মনে হচ্ছিল। পৃথিবীতে আমার স্ত্রী আছে, আমার ছোট একটি মেয়ে আছে। আমি যখন এই অভিযানে রওনা দিয়েছি, তখন আমার মেয়ের বয়স ছিল এক বছর। এখন নিশ্চয়ই সে একটু বড় হয়েছে।”
ত্রাতিনা বলল, “বৃহস্পতির ছায়া থেকে সরে গেলেই আমরা পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে পারবো। তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে পারবে। তোমার মেয়েকে দেখতে পাবে।”
গ্রাহা বলল, “আমি জানি না আমি সেটা আসলেই করতে চাই কি না, তিন মিলিয়ন কিলোমিটার দূর থেকে কথা বলার ব্যাপারটি আমার কাছে কৃত্রিম মনে হয়।”
“কিন্তু তোমার স্ত্রী যখন জানতে পারবে তুমি বেঁচে আছ, সে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে।”
গ্রাহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “সেটা নাও হতে পারে।”
ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “নাও হতে পারে?”
“হ্যাঁ। আমার স্ত্রী জানে, আমি মারা গেছি। ছোট একটি সন্তান নিয়ে সে কি একাকী নিঃসঙ্গ বেঁচে থাকবে? থাকবে না। সে নিশ্চয়ই এতোদিনে নতন একজন সঙ্গী খুঁজে নিয়েছে। এখন হঠাৎ করে যদি জানতে পারে আমি বেঁচে আছি, সেটি তার জীবনে আনন্দের বদলে জটিলতা তৈরি করবে।”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল, গ্রাহার কথায় যুক্তি আছে। গ্রাহাকে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে তুমি কী করতে চাও?”
“আমি পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার পর তাদের সাথে যোগাযোগ করব। তার আগে নয়।”
ত্রাতিনা বলল, “ঠিক আছে, তাহলে তোমাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কথা বলি।”।
“বল।”
“আমাদের এই মহাকাশযান পেপির ভবিষ্যৎ কী, কেউ জানে না। আমি পৃথিবীতে প্রাণে বেঁচে ফিরে যেতে পারব কিনা সেটিও জানি না। যদি প্রাণে বেঁচে ফিরে যেতেও পারি, তাহলে সেটি হবে আজ থেকে প্রায় বাইশ বছর পর। বাইশ বছর অনেক দীর্ঘ একটি সময়। কাজেই তোমাকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠানোর জন্যে এখনই আমাদের কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে।”
“কী ব্যবস্থা?”
ত্রাতিনা বলল, “আমি ঠিক জানি না। তুমি একজন অভিজ্ঞ মহাকাশচারী। তুমি বল।”
গ্রাহা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “একটা মাত্র উপায়। সেটি হচ্ছে প্রথমে পৃথিবীতে খবর পাঠাই যে আমি বেঁচে আছি। তারপর তোমার মহাকাশযান থেকে প্রয়োজনীয় রসদ নিয়ে একটা স্কাউটশীপে ইউরোপাতে আমার ঘাঁটিতে ফিরে যাই। সেখানে দুই বছর অপেক্ষা করি, এর মাঝে পৃথিবী থেকে উদ্ধারকারী দল চলে আসবে। আরো দুই বছর পর আমি পৃথিবীতে ফিরে যাব। যার অর্থ আজ থেকে চার বৎসর পর আমি পৃথিবীর মাটিতে পা দেব। আমার মেয়ে ততদিনে একটি কিশোরী বালিকা হয়ে যাবে।”
ত্রাতিনা হাত বাড়িয়ে বলল, “চমৎকার পরিকল্পনা। আমিও ঠিক এই সমাধানটির কথা ভাবছিলাম।”
গ্রাহা বলল, “যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাইলে এটি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
ত্রাতিনা বলল, “তাহলে আমরা ব্যবস্থা করি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার যাওয়া উচিত। কারণ প্রতি ঘণ্টায় আমরা পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটার দূরে চলে যাচ্ছি!”
গ্রাহা বলল, “তোমার ব্যস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই।”
“কেন?”
“আমি এটি করতে রাজি নই।”
ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “রাজি নও? কেন?”
“আমার এক বছরের নিঃসঙ্গ জীবনটি ছিল ভয়ঙ্কর। আমি আসলে মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গিয়েছিলাম। আমি কোনোভাবেই সেই জীবনে ফিরে যেতে চাই না। একদিন নয় দুইদিন নয়, টানা দুই বছর নিঃসঙ্গ পরিবেশে একটি গ্রহে একাকী দিন কাটানো থেকে মরে যাওয়া ভালো।”
ত্রাতিনা কিছুক্ষণ ভাবল, তারপর বলল, “ঠিক আছে। তাহলে আমি একটুখানি জটিল কিন্তু তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা পরিকল্পনা দিই।”
গ্রাহা মাথা নাড়ল, বলল, “না রাজি না।”
ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “আমি আমার পরিকল্পনাটি এখনো বলিনি।”
“কিন্তু আমি জানি, তুমি কী বলবে?”
“আমি কী বলব?”
“তুমি বলবে আমাকে একটা ক্যাপসুলে ঢুকিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। তারপর ইউরোপার কক্ষপথে আমাকে ছেড়ে দেবে। পৃথিবীর উদ্ধারকারী দল এসে আমার ক্যাপসুলটি উদ্ধার করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। সেখানে আমার ঘুম ভাঙানো হবে। আমার কাছে মনে হবে আমি আজ ঘুমিয়ে গেছি এবং কাল ভোরে পৃথিবীতে জেগে উঠেছি।”
ত্রাতিনা হাসল। বলল, “তুমি ঠিকই অনুমান করেছ।”
“এর মাঝে কোনো কৃতিত্ব নেই। আমাদের মহাকাশ অভিযানের কোর্সে এগুলো শেখানো হয়। তুমি আমি সবাই এক জায়গা থেকে এগুলো শিখেছি।”
“কিন্তু এগুলো কার্যকর পদ্ধতি।”
“কিন্তু গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি না। আমি একটা ক্যাপসুলের ভেতর জড় পদার্থ হয়ে বছরের পর বছর একটা উপগ্রহকে ঘিরে ঘুরতে চাই না।”
“কিন্তু তুমি সেটা জানবে না।”
“তাতে কিছু আসে যায় না।” তাহলে তুমি কী করবে?”
“আমি তোমার সাথে পেপিরাতে থাকব।”
“পেপিরাতে থাকবে? পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে কি না, সেটা তুমি জান না।”
“তুমি যদি ফিরে যেতে পার, তাহলে আমিও ফিরে যাব।”
“তুমি যখন পৃথিবীতে ফিরে যাবে, তখন তোমার মেয়ে আর শিশু থাকবে না। বড় হয়ে যাবে।”
“আমি জানি। বড় হয়ে তোমার বয়সী একটা মেয়ে হবে।”
“হ্যাঁ। আমার বয়সী।”
গ্রাহা একটু ইতস্তত করে বলল, “তোমাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে তোমার বয়সী একটা মেয়ে খুব চমৎকার একটি অভিজ্ঞতা। একটি শিশু বা কিশোরীর সাথে হঠাৎ করে দেখা করার থেকে তোমার বয়সী মেয়ের সাথে দেখা করা সহজ। সে তার বাবাকে অনেক সহজে গ্রহণ করতে পারবে।”
ত্রাতিনা চুপ করে বসে রইল। গ্রাহা খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, “শুধু তাই নয়, আরো একটি ব্যাপার আছে।”
“কী ব্যাপার?”
“মহাজাগতিক এই প্রাণী কিংবা অস্তিত্বের সাথে তুমি মুখোমুখি হবে, কী হবে কেউ জানে না। অভিজ্ঞতাটা অনেক ভয়ঙ্কর হতে পারে।”
“হ্যাঁ হতে পারে।”
“তখন আমি তোমার পাশে থাকতে চাই।”
“আমি একা নই। আমার সাথে রুখ এবং গিসা আছে।”
গ্রাহা কাঠ কাঠ স্বরে হেসে উঠল। তারপর বলল, “রুখ আর গিসার কথা বলো না। মানুষ চমৎকার একটি বিষয়। যন্ত্রও চমৎকার বিষয়। কিন্তু মানুষের মতো যন্ত্র কিংবা যন্ত্রের মতো মানুষ চরম নির্বুদ্ধিতা। তোমাকে একা পাঠানোর সিদ্ধান্তটি ঠিক হয়নি। সাথে আরো মানুষ দেয়া উচিত ছিল।
“এটি আমার সিদ্ধান্ত। আমি অন্য কোনো মানুষ আনতে রাজি হইনি। আমার মা একা গিয়েছিল, অন্য কারো জীবন বিপন্ন করেনি। আমিও কারো জীবন বিপন্ন করতে চাই না।”
“সেটি ঠিক আছে। তুমি সেভাবে চেয়েছিলে। কিন্তু আমি যেহেতু ঘটনাক্রমে এখানে চলে এসেছি, এখন তোমার আর কিছু করার নেই। আমি তোমার পাশে থাকতে চাই।”
ত্রাতিনা কিছু না বলে গ্রাহার দিকে তাকিয়ে রইল। গ্রাহা একটু পর বলল, “আমি জানি তুমি এই মহাকাশযানের কমান্ডার। তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমাকে সেটাই মেনে নিতে হবে। আমি সেটাই মেনে নেব। কিন্তু আমি তোমার কাছে অনুরোধ করছি, আমাকে তোমার সাথে থাকতে দাও।”
ত্রাতিনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে।” গ্রাহা বলল, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ কমান্ডার!” ত্রাতিনা গ্রাহার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। গ্রাহা বলল, “কমান্ডার ত্রাতিনা, এবারে আমার মেয়ের বয়সী মানুষ ত্রাতিনার কাছে একটি অনুরোধ করতে পারি?”
“করো।”
“আমি জানি তোমার এখন শীতল গ্রহে গিয়ে ঘুমানোর কথা। আমি অনুরোধ করছি, তুমি কয়েকদিন পরে ঘুমুতে যাও। আমি বহুদিন মানুষের সাথে কথা বলিনি। কয়েকটা দিন তুমি আমাকে তোমার সাথে কথা বলতে দাও।”
ত্রাতিনা বলল, “কথা বলার ব্যাপারে আমার দক্ষতা খুব কম। তবে আমি খুব ভালো শ্রোতা। বিশেষ কোনো কথা বলতে না পারলেও আমি তোমার সব কথা শুনতে রাজি আছি।”
“মাঝে মাঝে হু হা করবে, তাহলেই হবে। আমি একটানা কথা বলে যাব।”
ত্রাতিনা হাসল। বলল, “ঠিক আছে।”
.
মহাকাশযান বৃহস্পতি গ্রহের মহাকর্ষ ব্যবহার করে স্লিং শট প্রক্রিয়ায় তার গতিবেগ বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বৃহস্পতি গ্রহের ছায়া থেকে বের হয়েছে। ত্রাতিনা পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করেছে এবং নিয়মিত তথ্য বিনিময় শুরু করেছে।
কয়েকদিন পর ত্রাতিনা গ্রাহাকে বলল, “গ্রাহা, তোমার জন্যে আমি একটি উপহার সংগ্রহ করেছি।”
গ্রাহা একটু অবাক হয়ে বলল, “উপহার? আমার জন্যে?”
“হ্যাঁ।”
“কোথা থেকে সংগ্রহ করেছ?”
“পৃথিবী থেকে।”
“পৃথিবী থেকে?” গ্রাহা কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “দেখি আমার উপহার।”
ত্রাতিনা হাতে ধরে রাখা ছোট মডিউলটি স্পর্শ করতেই তাদের সামনে ছোট একটা জায়গা আলোকিত হয়ে উঠল। সেই আলোকিত জায়গাটিতে ছোট একটা শিশুর ত্রিমাত্রিক ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ত্রাতিনা বলল, “গ্রাহা এটি তোমার মেয়ে।”
গ্রাহা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। ত্রাতিনা নরম গলায় বলল, “মহাকাশযান পেপিরার কমান্ডার হিসেবে আমার অনেক ক্ষমতা। আমি আমার সেই ক্ষমতা ব্যবহার করে তোমার মেয়ে রিয়ার এই হলোগ্রাফিক ছবিটি নিয়ে এসেছি।”
“আমার মেয়ে? রিয়া?”
“হ্যাঁ। আমরা প্রায় ছয় মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে, তাই সিগন্যাল আসতে প্রায় তিরিশ মিনিট সময় লাগছে।
রিয়ার হলোগ্রাফিক ছবিটি ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে। সে নড়তে থাকে, কথা বলতে থাকে, খিলখিল করে হাসতে থাকে।
গ্রাহা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, হলোগ্রাফিক ছবি স্পর্শ করা যায় না জেনেও সে ধীরে ধীরে তার হাতটি দিয়ে হলোগ্রাফিক ছবিটি স্পর্শ করার চেষ্টা করল। কিন্তু ছবিটির ভেতর দিয়ে তার হাতটি বের হয়ে এলো। ত্রাতিনা দেখলো গ্রাহার চোখ প্রথমে অশ্রু সজল হয়ে উঠল, তারপর ফোঁটা ফোঁটা পানি বের হয়ে এলো। সে নরম গলায় বলল, “গ্রাহা! আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমাকে আমি তোমার মেয়ের কাছে পৌঁছে দেব। হলোগ্রাফিক ছবি নয়, তুমি তোমার রক্ত মাংসের মেয়ের মাথায় হাত বুলাবে।”
গ্রাহা বলল, “আমি জানি, তুমি সেটি করবে। আমি জানি।”
৪. চতুর্থ পর্ব (দশ বছর পর)
ত্রাতিনা চোখ খুলে তাকালো। ক্যাপসুলের পরিচিত স্ক্রীনটার দিকে তাকিয়ে সে আবার চোখ বন্ধ করল। নেপচুনের কক্ষপথ পার হয়ে সে সৌরজগতের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। পৃথিবী থেকে এখানে একটি সিগন্যাল পৌঁছাতে সময় নেয় চার ঘণ্টা। গত দশ বছরে সে দশ বার ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। প্রতিবারই গ্রাহাকে ঘুম থেকে তুলেছে, তারপর দুজন মিলে মহাকাশযান পেপিরার খুঁটিনাটি পরীক্ষা করেছে। পৃথিবীর সাথে তথ্য বিনিময় করেছে। রুখ এবং গিসার সাথে কথা বলেছে। এই দুটি এনড্রয়েড গত বারো বছর কোনো অভিযোগ না করে কন্ট্রোল রুমে বসে পেপিরার যন্ত্রপাতি লক্ষ্য করেছে, তারা না থাকলে সে প্রতিবার এতো দীর্ঘ সময়ের জন্যে ক্যাপসুলের ভেতর ঘুমিয়ে কাটাতে পারত না।
ত্রাতিনা আবার চোখ খুলে তাকালো। পরিচিত স্ক্রীনটিতে সবুজ একটি বাতি জ্বলছে এবং নিভছে। স্ক্রীনটি থেকে তাকে জাগিয়ে তোলার জন্যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ত্রাতিনা শরীরে শক্তি অনুভব করতে শুরু করেছে। তাকে হাত এবং পা নাড়াতে বলা হলো। তারপর মাথা ঘোরাতে বলা হলো, চোখ খুলতে এবং বন্ধ করতে বলা হলো। তারপর ছোট একটা গুণ অংক করতে দেয়া হলো। মাথার ভেতরে গুণ অংকটি শেষ করে সে ফিসফিস করে উত্তরটি বলার সাথে সাথে ক্যাপসুলের ঢাকনাটি খুলে যেতে শুরু করে। ক্যাপসুলের দুই পাশে রুখ এবং গিসা দাঁড়িয়ে আছে। তারা হাসিমুখে ত্রাতিনাকে অভিবাদন জানাল। রুখ বলল, “পেপিরাতে তোমাকে স্বাগতম ত্রাতিনা।”
ত্রাতিনা বলল, “তোমাদের ধন্যবাদ। শেষ বছরটি কেমন কেটেছে তোমাদের দু’জনের?
গিসা বলল, “একেবারেই উত্তেজনাহীন। তোমাকে বলার মতো কিছুই ঘটেনি। পেপিরার যন্ত্রপাতি নিখুঁত–আমার মনে হয় এতো নিখুঁত না হলেই ভালো হতো। তাহলে আমাদের জীবনে একটুখানি বৈচিত্র্য থাকতো।”
”ঠিক আছে। আমরা যখন পৃথিবীতে ফিরে যাব, তখন আমাদের রিপোর্টে আমি এই কথাটি লিখে দেব।”
ত্রাতিনা তার ক্যাপসুল থেকে বের হলো। রুখ এবং গিসা তাকে দুই পাশ থেকে ধরে বের হতে সাহায্য করল। ত্রাতিনা একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এতোদিন আমরা যা জেনে এসেছি আর যা শিখে এসেছি, এখন তার পরীক্ষা হবে। তোমাদের কী মনে হয় রুখ এবং গিসা, আমাদের মিশন কী : কাজ করবে?”
রুখ মুখ শক্ত করে বলল, “অবশ্যই করবে।”
গিসা বলল, “এই মিশনের প্রতিটি খুঁটিনাটি অনেকবার করে দেখা হয়েছে। নিশ্চয়ই কাজ করবে।”
ত্রাতিনা তার লাউঞ্জের দিকে যেতে যেতে বলল, “যাও গ্রাহাকে তুলে নিয়ে আস। মিশনের খুঁটিনাটিতে গ্রাহা ছিল না, তাকে আমাদের সাথে নিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটি ভালো হল না খারাপ হল, বুঝতে পারছি না!”
.
কিছুক্ষণ পর লাউঞ্জে বসে খেতে খেতে ত্রাতিনা গ্রাহাকে বলল, “গ্রাহা, তুমি কী প্রস্তুত?”
“আমি সব সময়েই প্রস্তুত।”
“চমৎকার।”
গ্রাহা কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরের কুচকুচে অন্ধকার মহাকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি দাবি করছ আমরা এই মুহূর্তে মহাজাগতিক প্রাণী কিংবা মহাজাগতিক অস্তিত্বের মস্তিষ্কের ভেতর ঢুকে গেছি?”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল।
গ্রাহা বলল, “ব্যাপারটা চিন্তা করলেই আমার কেমন জানি গা গুলিয়ে আসে।”
“চিন্তা করো না।”
“হ্যাঁ। চিন্তা করছি না।”
ত্রাতিনা রুখ এবং গিসার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা কী প্রস্তুত?”
দু’জনেই মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। প্রস্তুত।”
“চল তাহলে কাজ শুরু করে দিই।”
.
চারজন তখন পেপিরার শেষ মাথায় গিয়ে লোডিং ডকের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। সেখানে থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটি রাখা আছে। বোমাটির তিন পাশে তিনটি ছোট ট্রিটন রকেট লাগানো। গ্রাহা একটু বিস্ময়ের সাথে বলল, “আমি আগে কখনো হাইড্রোজেন বোমা দেখিনি।”
ত্রাতিনা বলল, “দেখার কথা না! এটা রেফ্রিজিরেটর কিংবা এয়ার কুলারের মতো একটা জিনিস না।”
গ্রাহা বিস্ময়ে মাথা নেড়ে বলল, “একটি থার্মো নিউক্লিয়ার বোমা এতো ছোট হয়, আমি জানতাম না।”
ত্রাতিনা বলল, “আমার মনে হয় পৃথিবী যদি রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে শাসন করা হতো, তাহলে বোমার ওপর আরো গবেষণা হতো, বোমাগুলো আরো ছোট হতো। কিন্তু এখন যেহেতু পৃথিবী পরিচালনা করছে। বিজ্ঞানীরা, তাই যুদ্ধ বিগ্রহ নেই। বোমা নিয়েও গবেষণা নেই।”
“ঠিকই বলেছ।”
“আমাদের এই থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটির অবস্থান ঠিক করতে হবে।”
ত্রাতিনা কন্ট্রোল প্যানেলের কিছু বোতাম টিপে কাজ শুরু করে দেয়। একটা যান্ত্রিক শব্দ হয় এবং তিনটি রকেট লাগানো থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটির সামনের অংশ ধীরে ধীরে উঁচু হতে থাকে। ঠিক পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোণে আসতেই সেটি থেমে গেল। ত্রাতিনা মুখে সন্তুষ্টির শব্দ করে বলল, “এখন বায়ু নিরোধক হ্যাঁচটি খুলে দিতে হবে। তাহলে রকেট তিনটি বোমাটি নিয়ে বের হয়ে যেতে পারবে।”
রুখ এবং গিসা ঘুরে ঘুরে সবকিছু পরীক্ষা করে বলল, “সব ঠিক আছে। রকেট লাগানো বোমাটি পেপিরার মাউন্ট থেকে খুলে দেয়া হয়েছে।”
“চল তাহলে ভেতরে যাই।”
“চল।”
চারজনের ছোট দলটি গোল হ্যাঁচের ভেতর দিয়ে পেপিরার ভেতরে ফিরে এলো। বায়ু নিরোধক ঢাকনা দিয়ে হ্যাঁচ বন্ধ করল। তারপর ওপরের বায়ু নিরোধক ঢাকনাটি খুলে দিল। বোমাটি এখন মহাকাশে বের হওয়ার জন্যে প্রস্তুত। শেষ মুহূর্তে ত্রাতিনা গোপন পাসওয়ার্ড দিয়ে বোমাটিকে বিস্ফোরণের জন্যে প্রস্তুত করে নিল। ঠিক তিরিশ মিনিট পরে এটি বিস্ফোরিত হবে।
ত্রাতিনা সবাইকে নিয়ে কন্ট্রোল রুমে ফিরে আসে। নিজেদের সিটে বসে নিরাপত্তা বন্ধনী দিয়ে নিজেদের আটকে নেয়। তারপর সুইচ টিপে থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটি উন্মুক্ত করে দেয়। তিনটি ট্রিটন রকেট এক সাথে গর্জন করে চালু হয়ে যায়। পুরো মহাকাশযান একটা প্রবল ঝাঁকুনি অনুভব করল এবং সাথে সাথেই তারা মনিটরে থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটিকে উড়ে যেতে দেখল। রকেট তিনটির পিছন থেকে জ্বলন্ত গ্যাস বের হতে থাকে। এবং দেখতে দেখতে সেটি চোখের আড়াল হয়ে যায়।।
ত্রাতিনা নিজেকে সিট থেকে মুক্ত করে বলল, “বোমাটি বিস্ফোরণের পর রেডিয়েশন মাপার জন্যে সবকিছু ঠিক আছে?”
রুখ মাথা নাড়ল। বলল, “ঠিক আছে।”
“চমৎকার। বোমা বিস্ফোরণের সিগন্যাল পাওয়ার সাথে সাথে আমাদের যোগাযোগ মডিউলটি চালু করতে হবে।”
“আমরা প্রস্তুত।”
“পরবর্তী তিরিশ মিনিট আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।”
গ্রাহা বলল, “আমি সবসময়েই শুনে এসছি, অপেক্ষা করা মৃত্যু থেকেও ভয়ংকর!”
ত্রাতিনা হাসল। বলল, “মৃত্যু মোটেও ভয়ংকর নয়।”
ঠিক তিরিশ মিনিট পর পেপিরার ভেতরে থাকা সবগুলো তেজস্ক্রিয় মনিটর এক সাথে শব্দ করে উঠল। তখন রুখ এবং গিসা গিয়ে নিউট্রিনো বীম দিয়ে তৈরি যোগাযোগ মডিউলটি চালু করে দিল। মডিউলে মনিটরের এক কোনায় তখন একটা ছোট লাল আলো জ্বলতে এবং নিভতে থাকে।
ত্রাতিনা গ্রাহার দিকে তাকিয়ে বলল, “যোগাযোগ মডিউল চালু হয়েছে। আমরা সিগন্যাল পাঠাতে শুরু করেছি।”
“কী সিগন্যাল?”
“আপাতত শুধু প্রাইম সংখ্যা। যে কোনো প্রাণী বা বুদ্ধিমান অস্তিত্ব আর কিছু জানুক বা না জানুক, প্রাইম সংখ্যার অস্তিত্ব জানে। তারা যদি আমাদের এই মহাকাশযান থেকে প্রাইম সংখ্যার সিগন্যাল পেতে থাকে, তারা জানবে আমাদেরও কোনো এক ধরনের বুদ্ধিমত্তা আছে।”
গ্রাহা জিজ্ঞেস করল, “এখন আমরা কী করব?”
“অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
গ্রাহা মৃদু স্বরে বলল, “আমি তোমাকে আগেই বলেছি, অপেক্ষা করা মৃত্যু থেকেও ভয়ঙ্কর।”
.
সবাই মিলে ছত্রিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করল। কিন্তু কিছুই হলো না। গ্রাহা বলল, “ত্রাতিনা, আমরা কতোক্ষণ অপেক্ষা করব?”
“কেমন করে বলি।”
“আমাদের কাছে সময়ের এক ধরনের পরিমাপ আছে। আমাদের শারীরিক ব্যাপারগুলো সেকেন্ড কিংবা মিলি সেকেন্ডে হয়। এই মহাজাগতিক প্রাণীর সময়ের পরিমাপ কী রকম? আমাদের এক সেকেন্ডের গুরুত্ব যদি তাদের একশ বছরের সমান হয়? তাহলে কী হবে?”
ত্রাতিনা বলল, “সেটি হওয়ার কথা নয়। এটি পৃথিবীর দিকে যখন গ্রহকণাটি পাঠিয়েছিল, সেটি আমাদের সময়ের হিসেবেই পাঠিয়েছিল।”
গ্রাহা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “এই মহাজাগতিক অস্তিত্ব আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে কি না, সেটি আমরা কেমন করে বুঝব?”
“যদি ধরে নিই তাদের বুদ্ধিমত্তা আমাদের থেকে বেশি, তাহলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। একটা পিঁপড়া আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে না, আমরা ইচ্ছে করলেই একটা পিঁপড়াকে জ্বালাতন করতে পারি।”
এভাবে আরো বারো ঘন্টা কেটে গেল। যখন ত্রাতিনা আর গ্রাহা ক্লান্তিতে প্রায় ভেঙে পড়ছে, ঠিক তখন হঠাৎ করে পুরো মহাকাশযান অন্ধকার হয়ে গেল। মহাকাশযানের ইঞ্জিনগুলো থেমে গেল এবং মনে হলো পুরো মহাকাশযানটিতে বুঝি কবরের নীরবতা নেমে এসেছে।
কুচকুচে অন্ধকারে গ্রাহার গলার স্বর শোনা গেল। কাঁপা গলায় সে বলল, “কী হয়েছে?”
ত্রাতিনা শান্ত গলায় বলল, “মনে হয় মহাজাগতিক প্রাণী আমাদের সাথে যোগাযোগ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে।”
“প্রক্রিয়াটি আমার পছন্দ হচ্ছে না।”
“পছন্দ হওয়ার কথা নয়।”
গ্রাহা কাঁপা গলায় ডাকল, “রুখ? গিসা-”
ত্রাতিনা বলল, “তাদের ডেকে লাভ নেই।”
“কেন?”
“মহাজাগতিক প্রাণী এই মহাকাশযানের প্রতিটি যন্ত্র অচল করে দিয়েছে। রুখ আর গিসা যন্ত্র।”
“আমাদের অচল করেনি কেন? আমরাও তো আসলে এক ধরনের যন্ত্র।”
“মনে হয় জটিলতার জন্য। সহজ যন্ত্র অচল করেছে, জটিল যন্ত্র অচল করেনি। কিংবা করতে পারেনি।”
খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ত্রাতিনা বলল, “এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকার আমার কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে।”
গ্রাহা বলল, “আমি দীর্ঘসময় ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কাটিয়েছি। ইউরোপাতে আমার সময়টি ছিল অন্ধকার এবং নিঃশব্দ। অন্ধকার নিঃশব্দ এবং শীতল।”
ত্রাতিনা বলল, “এই মহাজাগতিক প্রাণী যদি আমাদের অচল যন্ত্রগুলো সচল না করে, তাহলে আমাদের মহাকাশযানটিও হয়ে যাবে অন্ধকার নিঃশব্দ এবং শীতল।”
অন্ধকারে আরো কিছুক্ষণ দুইজন নিঃশব্দে বসে থাকে। হঠাৎ গ্রাহা ডাকলো, “ত্রাতিনা।”
“বল।”
“আমার এক ধরনের বিচিত্র অনুভূতি হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে কেউ একজন আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।”
ত্রাতিনা বলল, “হ্যাঁ। আমারও বেশ কিছুক্ষণ থেকে সে রকম একটা অনুভূতি হচ্ছে।”
“তার মানে প্রাণীটি আমাদের দেখছে।”
“হ্যাঁ শুধু দেখছে না, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।”
ত্রাতিনার মনে হতে থাকে তার শরীরের ভেতর কিছু একটা ঢুকে গেছে এবং সেটি নড়ছে। হঠাৎ করে শরীরের একটা অংশ কেমন যেন অবশ হয়ে যায়, তারপর হঠাৎ করে জীবন্ত হয়ে ওঠে। অনুভূতিটি নিচ থেকে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে। ত্রাতিনার হঠাৎ করে মাথাটা ঘুরে ওঠে, হঠাৎ করে অসংখ্য স্মৃতি মাথার ভেতর খেলা করে যায়। মুহূর্তের জন্যে সে এক ধরনের আতংক অনুভব করে আবার পর মুহূর্তে এক ধরনের বিষাদ এসে তার উপর ভর করে।
“আমার মস্তিষ্ক নিয়ে খেলছে।” ত্রাতিনা মনে মনে ভাবল, “আমাকে ভয় পেলে চলবে না। আমাকে শান্ত থাকতে হবে। শান্ত থাকতে হবে…”
কিন্তু ত্রাতিনা শান্ত থাকতে পারল না, হঠাৎ অবর্ণনীয় এক ধরনের আতংকে তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে সে এক বিন্দু আলোর জন্যে হাহাকার করতে করতে জ্ঞান হারালো।
.
৪.২
ত্রাতিনা সামনে তাকালো। যতদূর চোখ যায় শুধু শূন্যতা। ত্রাতিনা মাথা ঘুরিয়ে তার চারপাশে তাকালো। কোথাও কিছু নেই। এখানেও যতদূর চোখ যায়, শুধু শূন্যতা। সেই শূন্যতার কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই। ত্রাতিনার মনে হয়, সেই শূন্যতায় সে অতলে ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু সেই অতলেরও কোনো শেষ নেই। সে নিচে পড়তেই থাকবে, পড়তেই থাকবে। ত্রাতিনা দুই হাত দিয়ে কিছু একটা ধরতে চেষ্টা করল। ধরার কিছু নেই, শূন্যতা ধরা যায় না, দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না। ত্রাতিনার মনে হতে থাকে, এক অসীম শূন্যতায় সে আটকা পড়ে আছে, এই শূন্যতা থেকে তার মুক্তি নেই।
ত্রাতিনা চিষ্কার করে জিজ্ঞেস করল, “আমি কোথায়?” তার কণ্ঠস্বর দূরে মিলিয়ে গেল, তারপর প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার ফিরে এল, আমি কোথায় … আমি কোথায় . . . আমি কোথায় ….
খুব ধীরে ধীরে প্রতিধ্বনিগুলো মিলিয়ে যেতে থাকে। তারপর এক সময় আবার সেই নৈঃশব্দ্যের শূন্যতায় ডুবে যায়।
ত্রাতিনা আবার চিৎকার করল, “আমি কোথায়?” তার চিৎকার বহু দূর থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে, প্রতিধ্বনিত শব্দগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে। শব্দগুলো মিলিয়ে যেতে যেতে আবার নূতন করে অনুরণিত হয়, ত্রাতিনার মনে হয় সে বুঝি কারো কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যায় না, কিন্তু কোনো এক ধরনের কণ্ঠস্বর। মনে হয় কেউ কিছু একটা বলছে।
“কে?” ত্রাতিনা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “কে? কথা বলে?”
ত্রাতিনা স্পষ্ট শুনল, কেউ একজন বলল, “আমি।”
“আমি কে?”
“যার কাছে এসেছ।”
ত্রাতিনার চিন্তা এলোমেলো হতে থাকে, সে প্রাণপণ চেষ্টা করে চিন্তাকে সুনির্দিষ্ট রাখতে। অনেক কষ্ট করে সে জিজ্ঞেস করল, “এটা কী সত্যি?”
কোনো উত্তর নেই।
ত্রাতিনা আবার জিজ্ঞেস করল, “এটা কী সত্যি?”
“সত্যি বলে কিছু নেই।”
“আমি কী স্বপ্ন দেখছি?”
“সব স্বপ্ন।”
“আমি পৃথিবী থেকে এসেছি। তৃতীয় গ্রহ। নীল গ্রহ। পৃথিবী।”
“জানি।”
“পৃথিবীর মানুষ তোমার সাথে যোগাযোগ করতে চায়।”
“জানি।”
“পৃথিবীর মানুষ আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে।”
“জানি।”
ত্রাতিনা ক্লান্ত গলায় বলে, “তুমি সব জানো?”
“হ্যাঁ।”
“কেমন করে জানো?”
কোনো উত্তর নেই। ত্রাতিনা আবার জিজ্ঞেস করল, “তুমি সব কিছু জানো?”
“তুমি যা জানো, আমি তা জানি।”
“তুমি আমার মস্তিষ্কে ঢুকেছ?”
“ঢুকেছি।”
“আমাদের মহাকাশযানে ঢুকেছ?”
“ঢুকেছি।”
“পৃথিবী থেকে আমরা যে তথ্য নিয়ে এসেছি, তুমি সব পেয়েছ?”
“পেয়েছি।”
“তাহলে আমরা পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারি?”
কোনো উত্তর নেই। ত্রাতিনা চিৎকার করে বলল, “তাহলে আমরা কী পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারি?”
এবারও কোনো উত্তর নেই। ত্রাতিনা চিৎকার করে বলল, “কথা বল। ফিরে যেতে পারি?”
“যখন সময় হবে।”
“কখন সময় হবে?”
কোনো উত্তর নেই। ত্রাতিনা আবার জিজ্ঞেস করল, “কখন সময় হবে?” এবারও কোনো উত্তর নেই।
ত্রাতিনা আবার গভীর শূন্যতায় ডুবে যেতে থাকে। হাত দিয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু ধরা ছোঁয়ার কিছু নেই। স্পর্শ করার কিছু নেই।
ত্রাতিনার মনে হল, অনেক দূর থেকে তাকে কেউ ডাকছে। সত্যি কেউ ডাকছে, নাকি এটি মনের ভুল, সে বুঝতে পারল না। ত্রাতিনার মনে হল, ভয়ংকর কিছু একটা ঘটেছিল, কিন্তু সেটি কী, সে মনে করতে পারল না।
আবার কেউ একজন তাকে ডাকল। ত্রাতিনা চোখ খুলে তাকায়। সে দেখল তার মুখের উপর গিসা ঝুঁকে পড়েছে। গিসা তাকে ডাকছে, এটি তাহলে স্বপ্ন নয়। এটি সত্যি। খুব ধীরে ধীরে ত্রাতিনার সবকিছু মনে পড়ে যায়। মহাজাগতিক প্রাণী তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল। পুরো মহাকাশযানের প্রতিটি যন্ত্রপাতি অচল করে দিয়েছিল। এক সময় মনে হয়েছিল, তার মাথার ভেতর কিছু ঢুকে গেছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আর আতংকে সে জ্ঞান হারিয়েছে। জ্ঞান হারিয়ে সে খুব বিচিত্র একটা স্বপ্ন দেখছিল। সেটি কী শুধু স্বপ্ন, নাকি তার মাঝে সত্যি আছে?
ত্রাতিনা চারপাশে তাকালো। মহাকাশযানে আলো জ্বলছে। সে ইঞ্জিনের গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছে। অচল হয়ে যাওয়া মহাকাশযানটি আবার সচল করে দিয়েছে। ত্রাতিনা উঠে বসল। তার মাথার ভেতর এখনও দপ দপ করছে। মহাজাগতিক প্রাণী কী তাহলে তাদের মুক্তি দিয়েছে? তাহলে এখন কী তারা পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে?
ত্রাতিনা রুখকে জিজ্ঞেস করল, “সব কিছু ঠিক আছে?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছে।”
“ইঞ্জিন সবগুলো চালু আছে?”
“চালু আছে।”
“কোয়াকম্প?”
“কোয়াকম্প নিয়ে একটু সমস্যা। শীতল প্রবাহ ছিল না বলে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাপমাত্রা কমে গেলে আবার চালু হবে। গিসা সেটা দেখছে।”
“যোগাযোগ মডিউল?”
“চালু করা হয়েছে।”
“গ্রাহা কোথায়?”
“দেখলাম হেঁটে হেঁটে লাউঞ্জের দিকে গেল।”
“সে ঠিক আছে?”
“এখন ঠিক আছে। তোমার মতো অবস্থা। অচেতন হয়ে ছিল।”
“তোমরা কেমন ছিলে?”
“তিরিশ মিনিটের মতো পুরোপুরি ব্ল্যাক আউট হয়ে গিয়েছিল। কী হয়েছে কিছু জানি না।”
ত্রাতিনা উঠে দাঁড়াল। এখনো মাথার ভেতর দপ দপ করছে। সে খানিকটা টলতে টলতে হেঁটে যেতে থাকে। লাউঞ্জের সামনে তার গ্রাহার সাথে দেখা হলো। গ্রাহা লাউঞ্জের দরজার পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ রক্তশূন্য।
ত্রাতিনা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে গ্রাহা?”
গ্রাহা কোনো কথা বলল না। শূন্য দৃষ্টিতে ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। ত্রাতিনা আবার জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“লাউঞ্জের ভেতর-”
“লাউঞ্জের ভেতরে কী?”
“যেও না।”
ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “যাব না?”
“না।”
“কেন?”
“বলতে পারব না।”
“বলতে পারবে না?”
“না।”
ত্রাতিনা অবাক হয়ে বলল, “আমাকে তাহলে যেতে হবে। দেখতে হবে।”
গ্রাহা হঠাৎ করে কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, “না, আমি তোমাকে যেতে দেব না।” সে দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে ত্রাতিনার পথ আটকে দাঁড়াল।
ত্রাতিনা বলল, “সরে যাও গ্রাহা। আমাকে ঢুকতে দাও। আমি পেপিরার কমান্ডার হিসেবে তোমাকে আদেশ করছি।”
গ্রাহা এক ধরনের আহত দৃষ্টিতে ত্রাতিনার দিকে তাকালো। তারপর দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, “কাজটি ভালো হলো না ত্রাতিনা।”
ত্রাতিনা গ্রাহাকে পাশ কাটিয়ে লাউঞ্জের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো এবং একটা আর্ত চিৎকার করে দরজাটি ধরে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল।
লাউঞ্জের মেঝেতে দুটি দেহ। একটি তার নিজের, অন্যটি গ্রাহার। দেহ দু’টি স্থির, দেখে মনে হয় মৃতদেহ। ত্রাতিনা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেহ দুটোর দিকে তাকায়। মেঝেতে শুয়ে থাকা ত্রাতিনার দেহটি হঠাৎ চোখ খুলে ত্রাতিনার দিকে তাকালো, চোখের দৃষ্টি শূন্য এবং অর্থহীন। তারপর হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। কী ভয়ংকর সেই হাসি, কী অবিশ্বাস্য সেই চোখের দৃষ্টি।
ত্রাতিনা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কী জীবিত, না মৃত?”
“জানি না কী বলব? দেহগুলো নিখুঁতভাবে তৈরি। শুধু মাথায় কোনো মস্তিষ্ক নেই। ফাঁকা।”
ত্রাতিনার হঠাৎ সারা শরীর গুলিয়ে এলো। সে দরজা বন্ধ করে পিছিয়ে আসে। তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।
গ্রাহা নরম গলায় বলল, “আমি তোমাকে ঢুকতে নিষেধ করেছিলাম। তুমি আমার কথা শুনলে না।”
ত্রাতিনা গ্রাহার দিকে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলল, “আমি পেপিরার কমান্ডার। আমার সবকিছু জানতে হবে গ্রাহা।”
.
৪.৩
ত্রাতিনা তার গ্লাসের পানীয়টিতে চুমুক দিয়ে বলল, “আমি বুঝতে পারছি না আমি যেটা স্বপ্নে দেখেছি, সেটি কী শুধুই স্বপ্ন, নাকি তার মাঝে সত্যতা আছে?”
গ্রাহা বলল, “না ত্রাতিনা, সেটি স্বপ্ন ছিল না। কারণ অবচেতন অবস্থায় আমারও ঠিক একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমিও দেখেছি, আমি অসীম শূন্যতায় ভাসছি। অদৃশ্য কারো কথা শুনছি, যে বলছে আমাদের তার দরকার।”
“কী দরকার হতে পারে আমি একটি অনুমান করতে পারি।”
গ্রাহা বলল, “অনুমান করা খুব কঠিন না। যে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী হচ্ছে কৌতূহলী। বুদ্ধিমান প্রাণী সবকিছু জানতে চায়। এই মহাজাগতিক প্রাণী এই মহাকাশযানের সবকিছু জেনে গেছে, তার কাছে সব যন্ত্রপাতি তুচ্ছ! এটাকে সে পুরোপুরি অচল করেছে। তারপর আবার সচল করেছে। রুখ গিসাকে ব্ল্যাক আউট করিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে দিয়েছে। কোয়াকম্পের মতো কম্পিউটারকে অচল করেছে, আবার সচল করেছে। কাজেই যান্ত্রিক বিষয় নিয়ে তার কৌতূহল নেই।”
ত্রাতিনা বলল, “তার কৌতূহল শুধু মানুষকে নিয়ে। আমাদের দু’জনকে নিয়ে।”
“হ্যাঁ।”
“আমাদের দুজনকে তৈরি করতে চেষ্টা করেছে। দেহের খুঁটিনাটি সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি করেছে, শুধু মস্তিষ্কটি পারেনি।”
গ্রাহা বলল, “কীভাবে পারবে? আমাদের মস্তিষ্ক সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে জটিল যন্ত্র, এখানে একশ বিলিয়ন নিউরন, একটি নিউরন অন্য দশ হাজার নিউরনের সাথে যুক্ত, প্রতি মুহূর্তে সিনান্স সংযোগ হচ্ছে-”
ত্রাতিনা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ, আমাদের মস্তিষ্কের সম্ভাব্য সবগুলো স্টেট বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবগুলো পরমাণুর সংখ্যা থেকে বেশি।”
“এই মহাজাগতিক প্রাণী আমাদের সেই মস্তিষ্কটি চায়। এটি দেখতে চায়। বিশ্লেষণ করতে চায়।”
ত্রাতিনা আর গ্রাহা যখন কথা বলছিল পাশে দাঁড়িয়ে তখন রুখ আর গিসা নিঃশব্দে তাঁদের কথা শুনছিল। এবার রুখ বলল, “তোমরা দুইজন সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছেছ। আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি পেপিরার কক্ষপথ আটকে দেওয়া হয়েছে। এটি পরিবর্তন করা যাচ্ছে না।”
গিসা বলল, “শুধু তাই না। পৃথিবীর সাথেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।”
ত্রাতিনা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “এই মহাজাগতিক প্রাণী হুবহু মানুষের মস্তিষ্ক তৈরি করতে পারবে না। এটি বিশ্লেষণ করতে পারবে না। যার অর্থ বুঝতে পারছ?”
গ্রাহা বলল, “হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।”
“যার অর্থ আমরা অনন্তকালের জন্যে এখানে আটকা পড়েছি।”
“হ্যাঁ। আমরা অনন্তকালের জন্যে আটকা পড়েছি।”
ত্রাতিনা তার পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “কিন্তু আমরা এখানে দুইজন মানুষ। তুমি আর আমি। আমাদের দুজনেরইতো অনন্তকালের জন্যে আটকা থাকার কোনো প্রয়োজন নেই।”
গ্রাহা একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, “তুমি কী বলতে চাইছ?”
“আমি বলতে চাইছি যে, একজন মানুষকেই এই মহাজাগতিক প্রাণী গিনিপিগ হিসেবে বিশ্লেষণ করুক। অন্যজন পৃথিবীতে ফিরে যেতে সমস্যা কোথায়?”
গ্রাহা মাথা নাড়ল। বলল, “না সমস্যা নেই। একজন অবশ্যই ফিরে যেতে পারে।”
কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে বসে থাকে। গ্রাহা জিজ্ঞেস করে, “কে থাকবে, আর কে ফিরে যাবে?”
ত্রাতিনা একটু অবাক হয়ে গ্রাহার দিকে তাকিয়ে বলে, “এটি কী রকম প্রশ্ন? অবশ্যই আমি থাকব এবং তুমি ফিরে যাবে। আমি পেপিরার কমান্ডার, পেপিরার সবার ভালোমন্দ্রের দায়িত্ব আমার। তুমি পেপিরার অতিথি, তোমাকে বাঁচিয়ে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে তোমার মেয়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।”
গ্রাহা কোনো কথা বলল না। ত্রাতিনা বলল, “একটা ক্যাপসুলে ঢুকিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে মহাকাশযান থেকে বাইরে ছুঁড়ে দিও। আমি নিশ্চিত, তাহলে মহাজাগতিক প্রাণী পেপিরাকে পৃথিবীতে ফিরে যেতে দেবে।”
গ্রাহা এবারও কোনো কথা বলল না। ত্রাতিনা বলল, “আমার জন্যে তোমার বিচলিত হবার কোনো কারণ নেই গ্রাহা। পৃথিবীতে কোনো আপনজন আমার জন্যে অপেক্ষা করছে না। আমি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। তোমার কথা ভিন্ন। পৃথিবীতে তোমার স্ত্রী আছে। তোমার মেয়েটি তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
গ্রাহা এবারও কোনো কথা বলল না। কিন্তু তার মুখে খুব সূক্ষ্ম একটু হাসি ফুটে উঠল। ত্রাতিনা সেটা না দেখার ভান করে বলল, “আমার মা পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্যে প্রাণ দিয়েছে। এবারে আমার পালা। আমার মা যে কাজটি শুরু করেছিল, আমি সেটি শেষ করব।”
গ্রাহার মুখে এবারে খুব বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠল। সেদিকে তাকিয়ে ত্রাতিনা অধৈর্য হয়ে বলল, “তুমি কোনো কথা বলছ না কেন?”
গ্রাহা এবারে মুখ খুলল, বলল, “আমি একটুখানি অপেক্ষা করছি।”
“কিসের জন্যে অপেক্ষা করছ?”
“তোমার রক্তে রিটিলিনটুকু মিশে যাবার জন্যে।”
ত্রাতিনা চমকে উঠে বলল, “রিটিলিন?”
“হ্যাঁ। তোমার জন্যে যে পানীয়টুকু এনেছি, আমি সেখানে দুই ফোঁটা রিটিলিন দিয়ে এনেছি। কিছুক্ষণের মাঝে তুমি পুরোপুরি অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। আমি লক্ষ করেছি তোমার চোখের পিউপিল বিস্তৃত হচ্ছে, তোমার কণ্ঠস্বর একটুখানি ধীর হয়ে এসেছে।”
ত্রাতিনা লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবিষ্কার করল, সে উঠতে পারছে না। কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করল, তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।
গ্রাহা একটুখানি এগিয়ে এসে ত্রাতিনার হাত স্পর্শ করে বলল, “ত্রাতিনা, তুমি এখন শুধু শুধু দাঁড়ানোর চেষ্টা করো না। কথা বলারও চেষ্টা করো না। তোমার শরীরে বিটিলিন কাজ করতে শুরু করেছে। আরো মাত্র কয়েক মিনিটি তুমি দেখতে পাবে, কথা শুনতে পাবে। তারপর তুমি ঘুমিয়ে পড়বে।”
গ্রাহা নরম গলায় বলল, “আমি জানি তুমি পেপিরার কমান্ডার হিসেবে নিজেকে মহাজাগতিক প্রাণীর হাতে তুলে দিয়ে আমাকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠাবে। তাই আমাকে এইটুকু অপরাধ করতে হলো। মহাকাশযানের কমান্ডারকে গোপনে রিটিলিন খাইয়ে অবচেতন করা অনেক বড় অপরাধ, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। আমি সেই অপরাধটুকু করেছি। জেনে শুনে করেছি। এটি না করে তোমাকে আমি পৃথিবীতে ফেরত পাঠাতে পারতাম না। তুমি কিছুতেই এটা করতে দিবে না। তুমি তোমার মায়ের মতোই একজন আপাদমস্তক মহাকাশচারী।
“আমি জানি, তুমি চাইছ আমি যেন পৃথিবীতে গিয়ে আমার মেয়ের সাথে মিলিত হই। তাকে দেখি, তার সাথে কথা বলে সময় কাটাই। ত্রাতিনা, আমি আমার মেয়ের সাথে মিলিত হয়েছি। দেখা করেছি, তার সাথে কথা বলেছি, কারণ তুমি হচ্ছ আমার সেই মেয়ে। পৃথিবীতে আমার আরও একটি মেয়ে আছে। ক্লিয়া। সম্ভব হলে তুমি ক্লিয়ার সাথে দেখা করো। সেই মেয়েটিকে আমার হয়ে একবার আলিঙ্গন করো। তাকে বলো, আমি তাকে অনেক ভালোবাসি। সৌর জগতের শেষ প্রান্তে একটি ক্রোমিয়াম ক্যাপসুলের ভেতর থেকে আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। তাকিয়ে থাকব।”
গ্রাহা উঠে দাঁড়ালো। ত্রাতিনার দিকে অগ্রসর হয়ে বলল, “মা ত্রাতিনা, তুমি অচেতন হওয়ার আগে আমি তোমাকে একটি অনুরোধ করতে পারি? তুমি এখন আর কথা বলতে পারবে না। শুধু একবার একটুখানি হাসো, একটুখানি।”
ত্রাতিনার মুখে খুব ধীরে ধীরে একটুখানি হাসি ফুটে উঠল। গ্রাহা ত্রাতিনার মাথায় হাত বুলিয়ে গভীর মমতায় ফিসফিস করে বলল, “পৃথিবীতে ফিরে যাও মা। মহাকাশের জগতে তোমার প্রয়োজন নেই। ত্রাতিনা মা আমার, তোমার প্রয়োজন পৃথিবীতে।”
রুখ এবং গিসা নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল। গ্রাহা তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “ত্রাতিনাকে একটা ক্যাপসুলে নিরাপদে ঢুকিয়ে দাও। তাকে শীতল করে রাখো, বারো বছর পর পৃথিবীতে ফিরে যাবার পর জাগিয়ে তুলতে হবে।”
রুখ মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”
“আর আমার জন্যে একটা ক্যাপসুল রেডি করো। আমাকে যখন মহাকাশে ছুঁড়ে দেবে, লাউঞ্জ থেকে ওই দেহ দুটোও বাইরে ছুঁড়ে দিও। এগুলো পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”
রুখ আবার মাথা নাড়ল। বলল, “ঠিক আছে।”
“আমাকে ছুঁড়ে দেবার পর পেপিরার যাত্রাপথ পৃথিবীর দিকে করে নিও। আমি নিশ্চিত, মহাজাগতিক প্রাণী তখন তোমাদের ফিরে যেতে দেবে।”
রুখ বলল, “আমরা তাই আশা করছি।”
গ্রাহা এবার গিসার দিকে তাকিয়ে বলল, “খুব খিদে পেয়েছে। তুমি কি আমার জন্যে চমৎকার একটা ডিনার রেডি করতে পারবে? তিতির পাখির মাংস, যবের রুটি আর আঙুরের রস?”
গিসা মাথা নাড়ল বলল, “পারব।”।
“আমি যখন খাব, তখন তুমি কী আমার প্লেটে খাবারগুলো তুলে দেবে? আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, তখন আমার মা যেভাবে তুলে দিতো?”
গিসা বলল, “অবশ্যই তুলে দেব গ্রাহা, অবশ্যই তুলে দেব।”
৫. শেষ পর্ব (বারো বছর পর)
বাইভার্বাল থেকে নেমে ত্রাতিনা মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে ছোট বাসাটার দিকে এগিয়ে যায়। গাছপালা ঢাকা মেঠো পথ, গাছগুলোতে পাখি কিচির মিচির করছে।
ত্রাতিনা সিঁড়ি বেয়ে উঠে বাসার দরজায় শব্দ করল। কয়েক মুহূর্ত পরে দরজাটি খুলে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের একটি মেয়ে বের হয়ে এলো। মেয়েটি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে ত্রাতিনার দিকে তাকায়। ত্রাতিনা নরম গলায় বলে, “আমার নাম ত্রাতিনা। তুমি নিশ্চয়ই ক্লিয়া?”।
মেয়েটি মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ।”
ত্রাতিনা বলল, “তোমার বাবা গ্রাহা একজন খুব দুঃসাহসী মহাকাশচারী ছিল।”
ক্লিয়া একটু অবাক হয়ে বলল, “তুমি কেমন করে জান?”
“আমি জানি, কারণ আমিও একজন মহাকাশচারী। তোমার বাবার সাথে আমার একটি মহাকাশযানে সময় কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল।”
ক্লিয়া ত্রাতিনার হাত ধরে বলল, “তুমি কী একটু ভেতরে আসবে? আমার বাবার কথা একটু বলবে?”
“হ্যাঁ বলব। আমি সেজন্যেই এসেছি। তার আগে আমি কী তোমাকে একবার আলিঙ্গন করতে পারি? তোমার বাবা তার জীবনের শেষ মুহূর্তটিতে আমাকে বলেছিল, আমি যেন তোমাকে তার হয়ে একবার আলিঙ্গন করি।”
ক্লিয়া কোনো কথা না বলে ত্রাতিনাকে জড়িয়ে ধরল। ত্রাতিনা ফিসফিস করে বলল, “আমি যেন পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারি, সেজন্যে তোমার বাবা তার জীবন দিয়েছিল। তুমি যেরকম তোমার বাবার সন্তান, আমিও ঠিক সেরকম তার আরেকজন সন্তান।”
ঘরের দরজায় দুইটি তরুণী একে অপরকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে থাকে। দুইজন এর আগে কখনো একজন আরেকজনকে দেখেনি। কিন্তু দুইজনই হঠাৎ করে বুঝতে পারে, তারা একজন আরেকজনের খুব আপনজন।