- বইয়ের নামঃ ত্রাতুলের জগৎ
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. ট্রাকিওশানহীন একজন যুবক
দুপুরবেলা এই এলাকাটিতে মানুষ, সাইবর্গ, এন্ড্রয়েড আর রোবটের একটা ছোটখাটো ভিড় জমে যায়। বেশিরভাগ মানুষের চেহারায় ব্যস্ততা আর উদ্বেগের ছাপ থাকে। কারো কারো চেহারায় থাকে ক্লান্তি, অবসাদ, এমনকি হতাশা। ক্বচিৎ এক-দুজনকে তারুণ্য বা ভালবাসার কারণে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে থাকতে দেখি, তাদের দেখতে আমার বড় ভালো। লাগে–আমি এক ধরনের লোভাতুর দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। সাইবর্গগুলোর চেহারায় সব সময় এক ধরনের বিভ্রান্তির ছাপ থাকে। তাদের মানুষ অংশটি প্রতিনিয়ত যন্ত্র অংশটির সাথে এক ধরনের অদৃশ্য সংঘাতের মাঝে আটকা পড়ে আছে, সেই সংঘাতের। ছাপটি তাদের চোখে–মুখে ফুটে থাকে। তাদের ভুরু হয় কুঞ্চিত, চোখে থাকে ক্রোধের ছায়া। তাদের পদক্ষেপ হয় দ্রুত এবং অবিন্যস্ত। আমার কাছে সবচেয়ে হাস্যকর মনে হয় এন্ড্রয়েডগুলোকে, তাদের চেহারা মানুষের মতো, সেই কথাটি মনে হয় তারা এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারে না। সব সময়ই তারা মুখে একটা মানবিক অনুভূতির চিহ্ন ফুটিয়ে রাখতে চায়–সেই অনুভূতিটি হয় চড়া সুরে বাধা। যখন ক্লান্তির ছাপ থাকার কথা তখন তাদের মুখে আসে গভীর অবসাদের চিহ্ন, যখন হালকা আনন্দ থাকার কথা তখন তাদের চোখে–মুখে আসে মাদকাসক্ত মানুষের বেপরোয়া উত্তেজনা, যখন বিরক্তির চিহ্ন থাকার কথা তখন তাদের মুখে থাকে দুর্দমনীয় ক্রোধের ছাপ! সেই তুলনায় রোবটগুলোকে দেখে অনেক। বেশি স্বস্তি অনুভব করি। তাদের চেহারা যান্ত্রিক এবং ভাবলেশহীন, তাদের কাজকর্ম বা ভাবভঙ্গিতে কোনো জটিলতা নেই, তাদের আচার-আচরণে কোথায় যেন একটি শিশু বা। পোষা কুকুরের সারল্য রয়েছে। আমি তাদের সাহচর্যকে পছন্দ করি না কিন্তু দূর থেকে দেখে এক ধরনের ছেলেমানুষি কৌতুক অনুভব করি।
আমার মনে হয় আমাকে দেখেও এই রোবট, এন্ড্রয়েড, সাইবর্গ বা মানুষগুলোর কপোট্রনে বা মনে বিচিত্র ভাবনার উদয় হয়। আমি সুউচ্চ সহস্রতল অট্টালিকার দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকি। এই রাস্তায় দুটো ইঁদুর, একটি কবুতর এবং কয়েকটি চড়ুই পাখির সাথে আমার ভাব হয়েছে। দুপুরে খাবার সময় আমি কিছু রুটির টুকরো ছড়িয়ে দিই এবং এই প্রাণীগুলো এক ধরনের আগ্রহ নিয়ে সেগুলো খায়। তাদের একেবারে সোজাসাপ্টা কাড়াকাড়ি করে খাওয়া দেখতে আমার এক ধরনের আনন্দ হয়। প্রাণীগুলো আজকাল আমাকে ভয় পায় না, আমার আস্তিনের নিচে নির্বিবাদে লুকিয়ে থাকে কিংবা আমার কাঁধে বসে কিচিরমিচির করে ডাকাডাকি করে। এই এলাকার রোবটগুলো ভাবলেশহীন মুখে আমাকে লক্ষ করে, কিন্তু তাদের সবুজ ফাটাসেলের চোখে আলোর তারতম্য দেখে আমি বুঝতে পারি তাদের কপোট্রনে খানিকটা হলেও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় এবং তারা নিজেদের ভেতরে কোনো একটা হিসাব মেলাতে পারে না। একজন অল্পবয়সী মানুষের সুউচ্চ অট্টালিকার দেওয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে থাকার কথা নয়, তার শরীরের ওপর দিয়ে পশুপাখির ছোটাছুটি করার কথা নয়। রোবটগুলো কখনোই আমাকে বিরক্ত করে নি কিন্তু সাইবর্গ এবং এন্ড্রয়েডগুলো মাঝে মাঝেই থমকে দাঁড়িয়ে কৌতূহল প্রকাশ করেছে, কখনো কখনো অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য কিংবা ক্রোধ প্রকাশ করেছে। আমাকে দেখে মানুষেরা অবিশ্যি সব সময়ই সহজাত সৌজন্যের কারণে নিজেদের অনুভূতি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেটি কখনো গোপন থাকে নি। আমি বুঝতে পারি তারা আমার জন্যে এক ধরনের কণা এবং অনুকম্পা অনুভব করছে। প্রাচীনকালে মানুষ মানসিক রোগাক্রান্ত হয়ে জীবনবিমুখ হয়ে যেত–গত কয়েক শতাব্দীতে তার কোনো উদাহরণ নেই। এখন যারা সমাজের প্রচলিত নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাস্তার পাশে পা ছড়িয়ে বসে পাখির সাথে কিংবা ইঁদুরের সাথে বসবাস করে তারা পুরোপুরি নিজের ইচ্ছেতেই করে। এটি এক ধরনের বিদ্রোহ, যে বিদ্রোহের কারণ জানা নেই। মানুষ সেই বিদ্রোহকে ভয় পায়, সেই বিদ্রোহীর জন্যে করুণা অনুভব করে।
আমি মানুষের করুণামিশ্রিত অনুকম্পার দৃষ্টি দেখে কিছু মনে করি না। কারণ আমি জানি আমি আমার চারপাশের এই অসংখ্য মানুষ, সাইবর্গ, এন্ড্রয়েড বা রোবট থেকে অনেক ভালো জীবন পেতে পারতাম, কিন্তু সেই জীবনে আমার কোনো আকর্ষণ নেই। আমি দেখেছি সেই জীবন প্রকৃতপক্ষে অর্থহীন– প্রতিটি মানুষের জীবন এত সুনির্দিষ্ট, এত গতানুগতিক যে সেটি একটি সাজানো নাটকের মতো। আমি সেই সাজানো রঙ্গমঞ্চের অভিনেতা হতে চাই নি। তাই একদিন শহরের কমিউনিটি কেন্দ্রে গিয়ে অভ্যর্থনা ডেস্কের মেয়েটিকে বলেছিলাম, আমি আমার ট্রাকিওশানটি ফিরিয়ে দিতে চাই।
মেয়েটি আমার কথা বুঝতে পারল বলে মনে হল না, খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, ট্রাকিওশান! ফিরিয়ে দেবে?
মেয়েটির মুখ দেখে আমি এক ধরনের কৌতুক অনুভব করলাম, মনে হল আমার কথা শুনে সে আকাশ থেকে পড়েছে। আমি মুখে হাসি টেনে এনে বললাম, তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি মনে করছ ট্রাকিওশান নয়, আমি বুঝি আমার মস্তিষ্ক ফিরিয়ে দিতে এসেছি।
মেয়েটি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, সেটা বরং আমি বুঝতে পারতাম। আজকাল জীবন এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে মাঝে মাঝে মনে হয় মস্তিষ্ক ছাড়াই দিন বেশ কেটে যাবে! কিন্তু ট্রাকিওশান–ট্রাকিওশান ছাড়া তুমি কেমন করে থাকবে?
আমার ধারণা খুব আনন্দে থাকব।।
মেয়েটি ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কি মাদকাসক্ত?
না। আমি এই মুহূর্তে মাদকাসক্ত নই। আমি পুরোপুরি সুস্থ মানুষ। আমার ট্রাকিওশানটি পরীক্ষা করলে তুমি দেখবে আমি মানুষটি খুব গবেট নই।
তা হলে কেন ট্রাকিওশান ফেরত দিতে চাইছ? তখন তোমাকে খুঁজে পাবার কোনো উপায় থাকবে না। তোমার যদি কোনো জরুরি প্রয়োজন হয় যদি কোনো বিপদ হয়
ঠিক সেজন্যেই ফেরত দিতে চাইছি। আমি মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বললাম, সব সময়ই কেউ না কেউ আমার ওপর নজর রাখছে, সেটা চিন্তা করলেই আমার রক্তচাপ বেড়ে যায়। আমি স্বাধীনভাবে থাকতে চাই।
মেয়েটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, স্বাধীনভাবে?
হ্যাঁ! প্রাচীনকালের মানুষের শরীরে ট্রাকিওশান ঢুকিয়ে দেওয়া হত না। তারা দিব্যি বেঁচে ছিল।
কিন্তু প্রাচীনকালের মানুষেরা নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে ফেলত। অদ্ভুত সব ভাইরাস আবিষ্কার করে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ মেরে ফেলেছিল। মানুষকে ক্লোন করতে গিয়ে
মেয়েটিকে আমি যতটুকু বুদ্ধিমতী ভেবেছিলাম সে তার থেকে বেশি বুদ্ধিমতী– ইতিহাসের অনেক খবর রাখে। তাই আমি যুক্তিতর্কের দিকে অগ্রসর না হয়ে বললাম, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু প্রাচীনকালের মানুষেরা সবাই সেরকম নির্বোধ ছিল না। তাদের মাঝেও অনেক ধাটি মানুষ ছিল। প্রথম আন্তঃনক্ষত্র অভিযানের ইতিহাসটুকু পড় নি? মানুষ সেখানে কী রকম বিপদের ঝুঁকি নিয়েছিল তুমি জান?
মেয়েটা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি বিপদের ঝুঁকি নিতে চাও?
ইচ্ছে করে নিতে চাই না। কিন্তু একটা ট্রাকিওশান আমাকে সব সময় চোখে চোখে রাখছে, একটা হাঁচি দিলেও দুটি বাইভার্বালে করে তিনটি চিকিৎসক রোবট পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমি সেরকম অবস্থা থেকে মুক্তি চাই।
মেয়েটা একটা ছোট যোগাযোগ মডিউল অন্যমনস্কভাবে হাত বদল করে বলল, এটা নিশ্চয়ই বেআইনি?
আমি মাথা নাড়লাম, না, বেআইনি না। যারা চার মাত্রার অপরাধী তাদের জন্যে বেআইনি। আমার রেকর্ড একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার। ক্রিস্টালের মতো স্বচ্ছ।
মেয়েটা হাল ছাড়ল না, বলল, কিন্তু এটা শরীরের ভেতর থেকে বের করতে হলে নিশ্চয়ই চিকিৎসা কেন্দ্রে যেতে হবে। চিকিত্সক রোবট লাগবে
তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি মধুরভাবে হেসে বললাম, তোমার চোখের সামনে আমি আমার হাতের চামড়া কেটে ট্রাকিওশানটা বের করে দেব।
মেয়েটা এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল এবং আমি কিছু বলার আগেই সামনে রাখা একটা বোম স্পর্শ করে বলল, তুমি একটু দাঁড়াও, আমি দুজন প্রতিরক্ষা রোবটকে ডাকি।
আমি রোবটের সাহচর্য একেবারেই পছন্দ করি না। মানুষ–বড়জোর সাইবর্গকে আমি সহ্য করতে পারি কিন্তু ঠিক কী কারণ জানি না, আমি রোবটকে একেবারেই সহ্য করতে পারি না। আমি একটু ক্ষুব্ধ হয়ে বললাম, তুমি শুধু শুধু রোবটকে ডেকে পাঠালে। শুধু খানিকটা যন্ত্রণা বাড়ালে।
যন্ত্রণা বাড়ালাম? মেয়েটি একটু উষ্ণ হয়ে বলল, তোমার যদি কিছু একটা হয়?
আমি চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেলাম দুটি কদাকার রোবট দ্রুত পায়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। কপালের পাশে কোম্পানির ছাপ এবং নম্বর, এগুলো চতুর্থ প্রজন্মের হাইব্রিড। কপোট্রনের নিউরাল নেটওয়ার্কে এদের তিন মাত্রার নিরাপত্তা বন্ধনী। রোবট দুটি নিঃশব্দে আমার দুপাশে এসে দাঁড়াল। আমি না তাকিয়েই বুঝতে পারি তাদের ফটোসেলের। চোখ তেইশ থেকে সাতচল্লিশ হার্টজে কাঁপতে শুরু করেছে। আমাকে রক্ষা করার জন্যে। এসেছে কিন্তু ব্যাপারটি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হয় নি আমাকে বিপদে ফেলে দেওয়া এদের জন্যে বিচিত্র কিছু নয়। ঝুঁকি নেওয়া আমার কাছে নিরাপদ মনে হল না। আমি মেয়েটির দিকে ঝুঁকে বললাম, গুগোলপ্লেক্স।
গুগোলপ্লেক্স? মেয়েটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি মাথা নাড়লাম, কিংবা স্কুয়ের সংখ্যা। সেটিও হতে পারে।
কী হতে পারে?
স্মৃতির বিভেদ। ট্রানসেন্ডেন্টাল সংখ্যার উদাহরণ হতে পারে। এক চার এক পাঁচ নয় দুই ছয় পাঁচ তিন পাঁচ…
আমি প্রথম ত্রিশটা সংখ্যা বলা মাত্রই রোবট দুটি চাপা স্বরে গর্জন করে উঠল। বলল, খবরদার। তুমি থামো।
আমি থামলাম না, দ্রুত পরের দশটি সংখ্যা উচ্চারণ করলাম এবং প্রায় সাথে সাথে ম্যাজিকের মতো কাজ হল। রোবট দুটি একেবারে মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল। আমি ঝুঁকি নিয়ে সহস্রতম অংশ থেকে আরো দশটি সংখ্যা উচ্চারণ করে রাখলাম। মেয়েটি বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?
বিশেষ কিছু না। আমি রোবট দুটোকে অচল করে রাখলাম।
মেয়েটি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বলল, অচল করে রাখলে? কীভাবে?
তুমি যদি এই লাইনের লোক না হও তা হলে বুঝবে না। সব কপোট্রনেরই কিছু না কিছু সমস্যা থাকে। টেস্ট করার জন্যে রোবট কোম্পানিরা কিছু ফাঁকফোকর রেখে দেয়। সেগুলো গোপন থাকে না–বের হয়ে যায়। সেটা জানতে হয়–হিসাব করে সেটা ব্যবহার করা যায়।
কিন্তু–কিন্তু–।
আমি মেয়েটাকে বাধা দিয়ে বললাম, এই রোবট দুটি বেশিক্ষণ অচল থাকবে না। এক্ষুনি আবার সিস্টেম লোড করে নেবে। কাজেই আমার বেশি সময় নেই। আমি পকেট থেকে ছোট এবং ধারালো একটা চাকু বের করে হাতের ভেতরের দিকে নরম চামড়াটা একটু চিরে ফেলতেই সেখানে এক বিন্দু রক্ত বের হয়ে এল। রক্তের ওপর ছোট ট্রাকিওশানটি ভাসছে, খুব ভালো করে না তাকালে সেটি দেখা যায় না। আমি চাকুর মাথায় সাবধানে সেটি তুলে নিয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিলাম। বললাম, এই যে আমার ট্রাকিওশান।
মেয়েটি কী করবে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ট্রাকিওশানটি খুব সাবধানে তার কোয়ার্টজের ডেস্কের ওপর রেখে বললাম, সাবধানে দেখে রেখো–হারিয়ে গেলে বিপদে পড়বে।
মেয়েটি ঠিক তখনো বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। আমার দু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোবট দুটির দিকে তাকিয়ে আমার দিকে ঘুরে তাকাল, বলল, তুমি যে কোনো রোবটকে অচল করে দিতে পার?
না। যে কোনো রোবটকে পারি না। নতুন সিস্টেম বের হলে একটু সময় লাগে।
কীভাবে কর?
চেষ্টাচরিত্র করে। কপোট্রনের গঠন জানা থাকলে পারা যায়। আমি মুখে হাসি টেনে বললাম, তুমি চাইলে তোমাকেও শিখিয়ে দিতে পারি! তৃতীয় প্রজন্মের যোগাযোগ রোবট খুব সোজা। একটা লাল কার্ড নেবে আরেকটা সবুজ। লাল কার্ডটা চোখের সামনে দুবার নাড়াবে তারপর সবুজ কার্ড একবার। তারপর বলবে দোহাই দোহাই এন্ড্রোমিডার দোহাই–নয়ের পর সাত চাই।
নয়ের পর সাত?
হ্যাঁ। দেখবে রোবট ফেঁসে গেছে। পুরো আড়াই মিনিট। আমি মুখে হালকা গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললাম, তবে সাবধান। আমি যতদূর জানি ব্যাপারটা হালকাভাবে বেআইনি। রোবটগুলোর মেমোরিতে থাকে না তাই ধরতে পারে না।
আমি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোবটটার সবুজ ফাটাসেলের চোখে হালকা আলোর বিচ্ছুরণ দেখতে পেলাম, যার অর্থ সেগুলো তাদের সিস্টেম লোড করতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই সেগুলো জেগে উঠবে আমাকে তার আগেই চলে যেতে হবে। আমি ডেস্কের ওপর পাশে বসে থাকা মেয়েটির দিকে চোখ মটকে বললাম, বিদায়!
কিন্তু কিন্তু
মেয়েটি আরো কিছু একটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু তার আগেই আমি বড় হলঘর পার হয়ে বাইরে চলে এসেছি। আমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই–আমার সাথে এই মেয়েটি আর কোনোদিন যোগাযোগ করতে পারবে না। শুধু এই মেয়েটি নয়, পৃথিবীর আর কেউই যোগাযোগ করতে পারবে না।
.
চড়ুই পাখিটি আমার কাঁধ থেকে নেমে আমার হাতের তালুতে আশ্রয় নিয়ে হাত থেকে খুঁটে খুঁটে কয়েকটি শস্যদানা খাচ্ছিল, ঠিক এরকম সময়ে আমার সামনে ক্রুদ্ধ চেহারার একটি সাইবর্গ দাঁড়িয়ে গেল। তার মাথার ডানপাশে মস্তিষ্কের ভেতর থেকে কিছু। টিউব বের হয়ে এসেছে। বাম চোখটি কৃত্রিম, সেখানে ঘোলা লাল রঙের একটা আলো। সাইবর্গের দাঁতগুলো ধাতব। সে এক ধরনের যান্ত্রিক গলায় বলল, তুমি কে? তুমি এখানে কী করছ?
আমি তার দিকে না তাকিয়ে বললাম, তুমি কে? তুমি এখানে কী করছ–আমি কি সেটা জানতে চেয়েছি?
সাইবর্গটি ধাতব গলায় বলল, না।
তা হলে তুমি কেন জানতে চাইছ?
এটি স্বাভাবিক নয়। পৃথিবীর সব মানুষকে তার দায়িত্ব পালন করতে হয়। তুমি তোমার দায়ি
আমি একটু কৌতূহল নিয়ে সাইবর্গটির দিকে তাকালাম, মস্তিষ্ক থেকে বের হওয়া টিউবগুলোতে কোম্পানির ছাপ দেওয়া রয়েছে। এটি সপ্তম প্রজন্মের ইন্টারফেস, এই সাইবর্গটির সিস্টেম অত্যন্ত ক্রটিপূর্ণ। আমি ইচ্ছে করলে চোখের পলকে এটিকে বিকল করে দিতে পারি। যন্ত্র অংশটি বিকল করে দেওয়া হলে তার মানব অংশটি কী করে আমার খুব জানার ইচ্ছে হল, কিন্তু আমি জোর করে আমার কৌতূহলকে নিবৃত্ত করলাম। শহরের মাঝামাঝি এলাকায় ভর দুপুরবেলা আমি একটা হট্টগোল শুরু করতে চাই না। কিন্তু সাইবর্গটি নাছোড়বান্দার মতো লেগে রইল, কণ্ঠস্বর এক ধাপ উঁচু করে বলল, তুমি এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি।
না দিই নি।
কেন?
কারণ প্রথমত আমার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়ত, আমি যদি উত্তর দিই তুমি সেটা বুঝবে না।
কেন বুঝব না?
কারণ তুমি একটা সাইবর্গ। সাইবর্গের বুদ্ধিমত্তার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। একটা বিশেষ ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে সাইবর্গ তৈরি করা হয়েছিল এবং আমার ধারণা সেই উদ্দেশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
সাইবর্গটি তার গলার স্বর আরো এক ধাপ উঁচু করে আরো উষ্ণ হয়ে বলল, তুমি কেন এই কথা বলছ?
কারণ তুমি সম্পূর্ণ বিনা প্রয়োজনে আমার সময় নষ্ট করছ। তোমার চেঁচামেচির কারণে আমার পোষা ইঁদুরটি লুকিয়ে গেছে। চড়ুই পাখিটি উড়ে ঐ বিল্ডিঙের কারনিসে বসে আছে। তুমি দূর হও।
সাইবর্গটি প্রায় মারমুখী হয়ে বলল, তুমি কেন আমার সাথে অপমানসূচক কথা বলছ? আমি তোমার সম্পর্কে মূল তথ্যকেন্দ্রে রিপোর্ট করে দেব।
আমার এবারে একটু ধৈর্যচ্যুতি হল–কাজেই আমি সাইবর্গটির চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ধু–ধু একটা প্রান্তর তার ঠিক মাঝখান দিয়ে একটা পাথর গড়িয়ে যাচ্ছে।
সাইবর্গটির ভালো চোখটিতে হঠাৎ একটি আতঙ্ক ফুটে উঠল। কাঁপা গলায় বলল, কেন তুমি এ কথা বলছ?
পাথরটা ছয় টুকরো হয়ে গেছে। এখন ছয়টি ধু–ধু প্রান্তর। তার মাঝে ছয়টা পাথর গড়িয়ে যাচ্ছে।
সাইবর্গটা চিৎকার করে বলল, না, না–তুমি চুপ কর।
আকাশে তখন বিদ্যুৎ। বিদ্যুতের রঙ নীল।
আমার কথা শেষ হবার আগেই সাইবর্গটি হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল এবং আমি তখন কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। যন্ত্রের অংশটি অচল হবার পর নিশ্চয়ই তার ভেতরের মানুষটি কাঁদছে। একটি সাইবর্গের ভেতরের মানুষটি কি সব সময়ই এরকম বিষণ্ণ এবং হতাশাগ্রস্ত? আমি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললাম তুমি কেন কাঁদছ?
আমাকে মুক্তি দাও। দোহাই তোমার
আমি তোমাকে কেমন করে মুক্তি দেব?
আমি কিছু একটা কথা বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। আমাকে ঘিরে ছোট একটা ভিড় জমে উঠেছে। বেশ কয়েকটি রোবট, সাইবর্গ এবং এন্ড্রয়েড দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে কিছু মানুষও রয়েছে।
কঠোর চেহারার একটি এন্ড্রয়েড বলল, এই মানুষটি মেটাকোড ব্যবহার করেছে।
আরো একটি এন্ড্রয়েড তাদের অভ্যাসমতো বাড়াবাড়ি বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ। আমি নিজে শুনেছি।
নিরাপত্তা কেন্দ্রে খবর দিতে হবে।
কীভাবে খবর দেবে? তুমি দেখছ না এর শরীর থেকে কোনো সিগন্যাল আসছে না। এর শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই।
উপস্থিত সকল রোবট, সাইবর্গ, এন্ড্রয়েড এবং মানুষেরা বিস্ময়ের এক ধরনের শব্দ করল, আমি তখন বুঝতে পারলাম আমার এখান থেকে সরে পড়ার সময় হয়েছে। যদি। এভাবে বসে থাকি তা হলে কিছুক্ষণের মাঝেই আবার কিছু প্রতিরক্ষা রোবট নিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী চলে আসবে। আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং ঠিক তখন শুনতে পেলাম কাছাকাছি একটা বাইভার্বাল এসে দাঁড়িয়েছে এবং তার ভেতর থেকে দুজন প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষ নেমে এসেছে। একজন গলা উঁচু করে বলল, এখানে এত ভিড় কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?
অন্য কেউ কিছু বলার আগেই আমি বললাম, না বিশেষ কিছু হয় নি। একটা সাইবর্গের সিস্টেম ফেল করেছিল, সেটি আবার তার সিস্টেম লোড করে নিচ্ছে।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষটি দাঁতের নিচে দিয়ে অস্পষ্ট গলায় সাইবর্গ প্রজাতির উদ্দেশে একটা কুৎসিত গালি উচ্চারণ করে বলল, সেজন্যে এত ভিড় করার কী আছে? সবাই নিজের কাজে যাও।
রোবট, সাইবর্গ আর এন্ড্রয়েডগুলো কোনো কথা না বলে সাথে সাথে বাধ্য মানুষের মতো সরে যেতে শুরু করল। মানুষদের একজন নিচু গলায় বলল, সাইবর্গটার সিস্টেম এমনি এমনি ফেল করে নি। এই মানুষটি মেটাকোড ব্যবহার করে ফেল করিয়েছে।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষ দুজন শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে আমার দিকে তাকাল, হঠাৎ করে তাদের ভুরু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে এবং চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। একজন মানুষ অনাবশ্যক রকম কঠিন গলায় বলল, সত্যি?
আমি মাথা নাড়লাম। কাজটি হালকাভাবে বেআইনি, বাড়াবাড়ি কিছু হওয়ার কথা নয়। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষটি তবুও তার মুখে মোটামুটি একটা ভয়ংকর ভাব ফুটিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন মেটাকোড ব্যবহার করেছ?
আমি মুখে একটা নির্দোষ সারল্যের ভাব ফুটিয়ে বললাম, সাইবর্গটা আমাকে বড় বিরক্ত করছিল।
বিরক্ত করলেই তুমি মেটাকোড ব্যবহার করবে? কোথা থেকে তুমি এই মেটাকোড পেয়েছ?
আমি হাসার ভঙ্গি করে বললাম, পাবলিক টয়লেটে লেখা থাকে। নেটওয়ার্কের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর লোকগুলো আরো কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই সাইবর্গটা নিজের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, এই মানুষটার ট্রাকিওশান নেই।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষগুলো চমকে উঠে বলল, কী বললে?
বলেছি যে ট্রাকিওশান নেই।
মানুষ দুজন নিজেদের রনোগান বের করে আমার দিকে উঁচু করে কিছু একটা দেখে আবার শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বলল, সত্যিই নেই।
আমি একটা নিশ্বাস ফেললাম, বড় ধরনের অপরাধীরা শরীর থেকে ট্রাকিওশান সরিয়ে ফেলে, আমি বড় ধরনের দূরে থাকুক, ছোট অপরাধীও নই। কিন্তু এখন সেটা প্রমাণ করা যাবে না। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষ দুটো এখন আমাকে ধরে নিয়ে যাবে, আমার জিনেটিক কোড দিয়ে আমার তথ্য বের করে তথ্যকেন্দ্র থেকে নিঃসন্দেহ হবে। যতক্ষণ আমার পরিচয় নিয়ে নিঃসন্দেহ না হচ্ছে ততক্ষণ আমার সাথে দুর্ব্যবহার করতে থাকবে। আমি একটি নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম–যেদিন নিজের ট্রাকিওশান ফিরিয়ে দিয়ে এসেছি সেদিন থেকে এই বাড়তি ঝামেলার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত হয়ে আছি।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষ দুজন কিন্তু হঠাৎ করে তাদের মুখের কঠোর ভাবটুকু ঝেড়ে ফেলে কেমন যেন সদয় চোখে তাকাল, তারপর সহজ গলায় বলল, ট্রাকিওশান খসিয়ে দিয়েছ?
আমি মাথা নাড়লাম। একজন চোখ মটকে বলল, ভালোই করেছ, এখন কোনো দায়দায়িত্ব নেই। ঝাড়া হাত–পা।
আমি মানুষটার চোখের দিকে তাকালাম, মনে হল সেখানে এক মুহূর্তের জন্যে একটা ধূর্ত দৃষ্টি উঁকি দিয়ে গেল। মানুষটি তখন উপস্থিত মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে জটলা না করে সবাই যে যার কাজে যাও। মানুষটা নিজের জীবনকে সহজ করার জন্যে ট্রাকিওশান পর্যন্ত খসিয়ে এসেছে অথচ তোমরা তাকে শুধু যন্ত্রণাই দিয়ে যাচ্ছ!
উপস্থিত মানুষগুলো এবং তার পিছু পিছু সাইবর্গটি সরে গেল, এখন এখানে আমি একা। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষগুলো কী করে দেখার জন্যে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম কিন্তু তারা কিছুই করল না। সহৃদয় ভঙ্গিতে একটু হেসে বলল, তোমার জীবন স্বাধীন হোক। শুভ হোক।
আমি জোর করে মুখে ভদ্রতার হাসি টেনে বললাম, ধন্যবাদ।
মানুষ দুজন বাইভার্বালে করে সরে যাবার পর আমি আবার হাঁটতে শুরু করি। পাতাল নগরীর কাছাকাছি একটি কৃত্রিম হ্রদ রয়েছে, তার তীরে একটা বিস্তৃত অংশে বনভূমি তৈরি করা হয়েছে। আমি সময় পেলে সেখানে গিয়ে হ্রদের বালুবেলায় ঘুরে বেড়াই–শহরের ঠিক মাঝখানে যেরকম উটকো বিপত্তির জন্ম হয় সেখানে সেরকম কিছু হওয়ার কথা নয়।
আমি অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে বড় বিল্ডিংটার অন্য পাশে চলে এসে পেছন দিকে তাকালাম। মাটি থেকে কয়েক মিটার উঁচুতে একটা বাইভার্বাল স্থির হয়ে আছে। আমি বড় রাস্তাটার অন্যপাশে এসে আবার পেছন দিকে তাকালাম, বাইভার্বালটি নিঃসন্দেহে আমাকে অনুসরণ করছে।
আমি একটা নিশ্বাস ফেললাম। শরীরের ভেতর রক্তস্রোতে ঢুকিয়ে দেওয়া একটা ট্রাকিওশান দিয়ে একজন মানুষকে বহু দূর থেকে চোখে চোখে রাখা যায়–সেটি নেই বলে একটি আস্ত বাইভার্বাল এবং কয়েকজন মানুষ মিলে আমাকে চোখে চোখে রাখছে।
কারণটা কী বুঝতে পারছিলাম না বলে আমি নিজের ভেতর এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করতে থাকি।
০২. কিডন্যাপ
শহরতলিতে ছোট একটা রেস্টুরেন্টে আমি কিছু খেয়ে নিলাম–এখানে ভদ্র কিংবা সচ্ছল মানুষরা আসে না। যারা আসে তাদের সবাই সমাজের বাইরের মানুষ অনেকেই মাদকাসক্ত। একটা বড় অংশ আছে যারা ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্কে বড় ক্ষতি করে বসে আছে। অনেকেই চোখ ভালো করে খুলতে পারে না, হাত কিংবা পা নিয়ন্ত্রণের বাইরে কাঁপতে থাকে। কথা জড়িয়ে আসে। ভালো একটা চিকিৎসা কেন্দ্রে কিছু দক্ষ চিকিৎসক রোবট দিয়ে এদের অনেককেই সারিয়ে তোলা সম্ভব কিন্তু এই মানুষগুলোর সে ব্যাপারে উৎসাহ নেই। অনেকের ধারণা তা হলে জোর করে তাদেরকে সাইবর্গে পাল্টে দেওয়া হবে। কোনো মানুষ–তার যত সমস্যাই থাকুক কিছুতেই সাইবর্গ হতে চায় না।
রেস্টুরেন্টে নিরিবিলি খেয়ে আমি আমার শেষ সম্বলের কয়েকটি ইউনিট দিয়ে মূল্য পরিশোধ করে বের হয়ে এলাম। এই এলাকাটি সমাজবহির্ভূতদের এলাকা, চারদিকে আবছা অন্ধকার, আলোগুলো ভেঙে রাখা হয়েছে। আকাশের কাছাকাছি উত্তেজক পানীয়ের একটা বিজ্ঞাপন জ্বলছে এবং নিবছে, তার কিছু আলো এখানে ছড়িয়ে পড়েছে। দিনের বেলায় এই এলাকাটিকে অত্যন্ত নিরানন্দ এবং হতচ্ছাড়া দেখায় কিন্তু রাত্রিবেলায় আধো আলো এবং আধো অন্ধকারে এর মাঝে কেমন জানি এক ধরনের রহস্যের ছোঁয়া লেগেছে।
আমি রাস্তার পাশে উবু হয়ে বসে থাকা একজন মাদকাসক্ত মানুষকে পাশ কাটিয়ে কয়েক পা সামনে গিয়েছি, ঠিক তখন হঠাৎ করে একটি বাইভার্বাল নিঃশব্দে আমার পাশে নেমে এল। আমি কিছু বোঝার আগে তার গোলাকার দরজা খুলে যায় এবং এক জোড়া হাত আমাকে ধরে প্রায় হ্যাঁচকা টানে বাইভার্বালের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। প্রায় সাথে সাথে বাইভার্বালটি শূন্যে উঠে যেতে থাকে, আমি তুরণের প্রকৃতি দেখে বুঝতে পারি এটি খুব দ্রুত সরে যেতে শুরু করেছে।
আমি নিজের জীর্ণ পোশাকটিকে সমান করার চেষ্টা করতে করতে বললাম, এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমাকে ডাকলে আমি স্বেচ্ছায় তোমাদের কাছে যেতাম।
বাইভার্বালের কন্ট্রোল প্যানেলে একটি নিরানন্দ সাইবর্গ বসে আছে, ভেতরে দুজন মানুষ। ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায় দুজনের একজন পুরুষ অন্যজন মহিলা। এক সময় পুরুষ এবং মহিলার শারীরিক পার্থক্যটুকু খুব চড়া সুরে প্রকাশ করা হত–আজকাল খুব তীক্ষ্ণ চোখে পরীক্ষা না করলে সেটি ধরা যায় তার কারণ কী কে জানে। আজ থেকে এক শ বছর বা এক হাজার বছর পরে কীহলে পুরুষ এবং নারীর পার্থক্য কি ঘুচে যাবে, নাকি পুরুষ এবং নারী ছাড়াও অন্য ধরুন প্রজন্মের সৃষ্টি হবে?
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বাইভার্বালের জানালা দিয়ে নিচে তাকালাম, আলোকোজ্জ্বল একটা বড় শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের যে সহজ সৌজন্যতা থাকা উচিত এদের মাঝে তা নেই। আমার সাথে কেউ একটি কথাও বলে নি, কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেবে কি কে জানে। তবুও আমি ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাবে?
মানুষ দুজন চুপ করে রইল, ভেবেছিলাম হয়তো উত্তরই দেবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী। ভেবে মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, সেটা তুমি নিজেই দেখবে।
আমার বিনা অনুমতিতে আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে আসা বেআইনি কাজ।
পুরুষ মানুষটি এবার কাঠকাঠ গলায় হেসে বলল, তোমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই। ইচ্ছে করলে তোমাকে আমি দরজা খুলে নিচে ফেলে দিতে পারি। কেউ কিছু জানবে না।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি নিশ্চয়ই একটা এন্ড্রয়েড। কারণ একজন মানুষ কেউ জানবে না বলেই কখনোই আরেকজনকে খুন করে ফেলার কথা বলে না।
পুরুষ মানুষটি আমার কথা শুনে খুব ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল, আমার দিকে তার মাথাটা এগিয়ে এনে দাতে দাঁত ঘষে বলল, তুমি যদি একটা মানুষ হতে তা হলে এই কথা বলতাম না। তুমি হচ্ছ অকর্মণ্য, অপদার্থ, মাদকাসক্ত একজন ফালতু মানুষ। তুমি এই সমাজের কোনো কাজে আস না। তুমি দুপুরবেলায় নোংরা একটা ইঁদুরকে কোলে নিয়ে রাস্তায় পা ছাড়িয়ে বসে থাক।
আমি মুখে হাসি টেনে বললাম, সেটাই হয়তো সমাজের প্রতি আমার দায়িত্ব। অকর্মণ্য, অপদার্থ, মাদকাসক্ত, ফালতু হয়ে বেঁচে থাকা–যেন আমাকে দেখে সমাজের অন্যরা সতর্ক হতে পারে। এই সৃষ্টি জগতে তেলাপোকারও একটা ভূমিকা আছে, তুমি জান?
পুরুষ মানুষটি ক্রুদ্ধ গলায় কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু মহিলাটি তাকে নিবৃত্ত করল। বলল, আহ্! কেন খামকা ঝামেলা বাড়াচ্ছ?
নিরাপত্তা বাহিনীর দুজন আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।
বাইভার্বালটি একটা ছোট শহরের ওপর একবার পাক খেয়ে নিচে নেমে এল। একটা হ্রদ পার হয়ে ছোট একটা পাহাড়ের পাদদেশে পুরোনো একটা অট্টালিকার পাশে এসে এটি স্থির হয়ে দাঁড়াল। দরজা খোলা মাত্রই আমাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে নামানোর আগেই আমি নিচে নেমে এলাম। আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করে প্রতিরক্ষা বাহিনীর দুজন সদস্য আমার পিছু পিছু হটতে থাকে। বাইরের একটা বড় দরজায় কিছু গোপন কোড এবং রেটিনা স্ক্যান করিয়ে আমাদের ভেতরে ঢোকানো হল। একটা ছোট করিডর ধরে হেঁটে বড় একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সুইচ টিপে ভারী দরজা খোলা হল–ভেতরে নানা বয়সী কিছু মানুষ, চোখের দৃষ্টি দেখেই বোঝা যায় এদের সবাইকে ঠিক আমার মতো করে ধরে আনা হয়েছে। মানুষগুলো কৌতূহলী চোখে আমাদের দিকে তাকাল। আমি কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কিন্তু তার দরকার হল না।অত্যন্ত রূঢ়ভাবে ধাক্কা দিয়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষটি আমাকে ঘরের ভেতরে ঠেলে দিপ্রায় সাথে সাথেই ঘরঘর করে ভারী দরজাটি বন্ধ হয়ে যায়।
ভেতরের মানুষগুলো আমাকে এবং আমি ভেতরের মানুষগুলো যাচাই করে দেখতে শুরু করলাম। ঘরের ভেতর সব মিলিয়ে সাতজন মানুষ–দুজন মেয়ে এবং পাঁচজন পুরুষ। দুটি মেয়েরই চোখের দৃষ্টি অপ্রকৃতিস্থ, দেখে বোঝা যায় ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে মস্তিষ্কের সর্বনাশ করে বসে আছে। দুজন পুরুষকে মনে হল পেশাজীবী অপরাধী, চোখে–মুখে একটু বেপরোয়া ভাব এবং হাতের আঙুলগুলো অদৃশ্য একটি লেজার রাস্টার১২ ধরে রাখার ভঙ্গি করে নড়ছে। অন্য মানুষগুলোকে মনে হল জীবন সম্পর্কে উদাসীন, একজনের মুখে একটু মৃদু হাসি এবং তাকে দেখে মনে হল পুরো ব্যাপারটি দেখে সে ভারি মজা পাচ্ছে। ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে থাকা একটি মেয়ে ঘাড় বাকা করে একটা চোখ ঈষৎ খুলে বলল, তোমার কাছে কি বিভিচুরাস১৩ আছে?
বিডিচুরাসের মতো ভয়ংকর একটি মাদকদ্রব্য পকেটে নিয়ে কারো ঘোরার কথা নয়, কিন্তু মেয়েটি এই ধরনের সহজ যুক্তিতর্কের উপরে চলে গিয়েছে। ঈষৎ খুলে রাখা চোখটি বন্ধ করে অভিযোগ করার ভঙ্গি করে বলল, আমার স্টিমুলেটরটি নিয়ে গেছে।
পেশাজীবী অপরাধীদের একজন জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করে টিটকারি দিয়ে বলল, বড় অন্যায় করেছে!
মেয়েটি তার কথায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে বিড়বিড় করে অনেকটা নিজের সাথে কথা বলতে থাকে। মুখে মৃদু হাসি লেগে থাকা মানুষটি তার মুখের মৃদু হাসিকে একটু বিস্তৃত করে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে কেন এনেছে?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, জানি না।
তুমি কি কোনো অপরাধ করেছ?
এভাবে ধরে নিয়ে আসার মতো কোনো অপরাধ করি নি।
মানুষটি সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, তার মানে ছোটখাটো কিছু একটা করেছ।
তা করেছি। ট্রাকিওশানটা বের করে ফেলেছি।
উপস্থিত যারা ছিল তাদের প্রায় সবাই আমার দিকে ঘুরে তাকাল। পেশাদার অপরাধীর মতো মানুষটি অদৃশ্য লেজার ব্লাস্টারের ট্রিগার ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, তার মানে তুমি ওস্তাদ মানুষ!
আমি তার কথায় কোনো উত্তর দিলাম না। মানুষটি তার ডান হাত দিয়ে গলায় পোচ দেবার ভঙ্গি করে বলল, কিন্তু ধরা পড়ে গেছ ওস্তাদ, এখন তুমি শেষ।
দ্বিতীয় পেশাদার অপরাধীটি বলল, তোমার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটেকুটে নিয়ে নেবে।
কিংবা একটা বেকুব সাইবর্গ বানিয়ে ফেলবে।
কিংবা তোমাকে শীতল ঘরে নিয়ে রেখে দেবে। দ্বিতীয় পেশাদার অপরাধীটি দুলে দুলে হাসতে হাসতে বলল, হয়তো তোমাকে ভিনজগতের মহাকাশের প্রাণীর কাছে বিক্রি করে দেবে।
আমি এই অর্থহীন কথোপকথনে যোগ দিলাম না আমি নিশ্চিত বাইরে থেকে আমাদের প্রত্যেকটি কাজকর্ম, অঙ্গভঙ্গি খুব যত্ন করে লক্ষ করা হচ্ছে, ঠিক কী কারণ জানি না, আমার মনে হল এই দলটির মাঝে নিজেকে আলাদা করে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলায় বিপদের ঝুঁকি আছে। আমি নীরবে এক কোনায় গিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। মুখে মৃদু হাসি লেগে থাকা দার্শনিকের মতো মানুষষ্টি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মন খারাপ করার কিছু নেই, এরা বেশ ভালো যত্ন করে। এখানকার খাবার খুব ভালো।
ভেতরে কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। একটা নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাবার পর যখন হাল ছেড়ে দেওয়া হয় তখন হঠাৎ করে সময়ের আর কোনো গুরুত্ব থাকে না। আমাকে যখন ডেকে নেওয়া হল তখন আমি অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছি–ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি যে আমি একটা বিশাল অরণ্যে হারিয়ে গেছি, যেদিকেই যাই সেদিকেই একটা বিশাল বৃক্ষ আমার পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার পোশাক ধরে খুব রূঢ়ভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে আমাকে ঘুম থেকে তোলা হল, আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন মানুষ বলল, চলো।
কোথায় জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ হবে না বলে আমি কিছু জিজ্ঞেস করলাম না, নীরবে উঠে দাঁড়ালাম। আমি যখন ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম তখন অন্য মানুষগুলো এক ধরনের নিরুত্তাপ নিস্পৃহ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমাকে একটি লম্বা করিডর ধরে হটিয়ে ছোট একটি কিউবিকেলে নেওয়া হল। সেখানে আমাকে নগ্ন হতে হল এবং আমি বুঝতে পারলাম এক ধরনের আঁজালো জীবাণুনাশক দিয়ে আমাকে পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে। আমার সমস্ত শরীরকে স্ক্যান। করা হল, নানা ধরনের যন্ত্রপাতি দিয়ে আমার শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ঘুঁটিনাটি পরীক্ষা করা হল, জিনেটিকে কোডিং করে নেওয়া হল, মেটাবলিজমের হার নির্ধারণ করা হল এবং সবশেষে নিওপলিমারের একটি পোশাক পরিয়ে একটি বড় হলঘরে পৌঁছে দেওয়া। হল, সেখানে আমি প্রথমবার একজন সত্যিকারের মানুষ দেখতে পেলাম। মানুষটি একজন। কমবয়সী মেয়ে। তার সোনালি চুল এবং আকাশের মতো নীল চোখ। মেয়েটি সুন্দর করে হেসে বলল, আশা করছি তোমার কোনো অসুবিধে হয় নি।
আমি নিচু গলায় বললাম, হলেই সেটি নিয়ে কে মাথা ঘামাচ্ছে!
তোমাকে কী বলে ডাকব? তোমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই–তোমার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
আমি জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, কিছু জান না বলেই তো আমাকে এনেছ। কী করবে করে ফেল–শুধু শুধু নামপরিচয় জেনে কী হবে?
মেয়েটির চোখে–মুখে এক ধরনের বিস্ময়ের ছায়া পড়ল, এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, আমার নাম জানা। আমি এখানকার চিকিৎসা কেন্দ্রের দায়িত্বে আছি।
আমার নাম ভ্রাতুল। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, এটা আমার সত্যিকারের নাম।
মেয়েটি সুন্দর করে হেসে বলল, সত্যিকারের নাম না হলেও আমি কখনো জানব না।
মেয়েটির কথাবার্তায় এক ধরনের সহৃদয়তার ছোঁয়া পেয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে তোমরা কেন এনেছ?
মেয়েটি একটু বিব্রত হয়ে বলল, আমি সত্যিই জানি না। মাঝে মাঝেই আমাকে কিছু মানুষকে পরীক্ষা করে তার শারীরিক অবস্থার একটা রিপোর্ট দিতে হয়। এর বেশি আমি কিছু জানি না। ক্রানা নামের মেয়েটি ইতস্তত করে থেমে গেল–মেয়েটি নিশ্চয়ই আরো কিছু জানে কিন্তু আমাকে বলতে চাইছে না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমার সম্পর্কে কী রিপোর্ট দিয়েছ?
তুমি নীরোগ স্বাস্থ্যবান হাট্টাকাট্টা একজন যুবক।
এবং—
এবং কী?
এবং মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করে একটি ট্রাইকিনিওয়াল বসানো সম্ভব।
মেয়েটি আমার কথা শুনে ভয়ানকভাবে চমকে উঠল, অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তু–তু–তুমি কীভাবে জান?
জানি না। অনুমান করছি। আমাকে যেভাবে জীবাণুমুক্ত করা হল তাতে মনে হচ্ছে। সম্ভবত শরীরে কোনো অস্ত্রোপচার করা হবে। মাথার পেছনে মনে হচ্ছে খানিকটা জায়গায় একটু বেশি করে চুল কেটেছে। এরকম জায়গায় ট্রাইকিনিওয়াল বসায়। তাই অনুমান করছি।
মেয়েটি কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমি জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, আমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই–কাজেই আমাকে নিয়ে তোমরা যা। খুশি করতে পার। ভয়ংকর কোনো এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে আমার থেকে ভালো একজন মানুষ কোথায় পাবে? কারো কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই–একেবারে নিখুঁত একটি গিনিপিগ।
মেয়েটি নিচু গলায় বলল, শরীর থেকে ট্রাকিওশান সরিয়ে তুমি খুব ভুল করেছ ভ্রাতুল।
আমি মাথা নাড়লাম, তুমি ঠিকই বলেছ জানা। কিন্তু সেজন্যে আমার কোনো দুঃখ নেই–আমি জেনেশুনেই এই ভুলটা করেছি।
ক্রানা আমাকে যে কয়েকজন মানুষের কাছে পৌঁছে দিল তাদের চেহারা কঠোর এবং আনন্দহীন। অপারেশন থিয়েটারের মতো নানা ধরনের যন্ত্রপাতি বোঝাই একটা ঘরের মাঝামাঝি একটি স্বচ্ছ ধাতব টেবিলে শুইয়ে আমার দুটি হাত এবং পা স্ক্র্যাপ দিয়ে বেঁধে ফেলল। এখানে আপত্তি বা প্রশ্ন করার মতো কোনো সুযোগ বা পরিবেশ নেই। একটা চিকিৎসক বরাবট আমার মাথাকে গোলাকার একটা টিউবে আটকে দেওয়ার সময় আমি মরিয়া হলে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কী করছ?
আনন্দহীন চেহারার মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বলল, একটু পরেই জানতে পারবে।
আমি মানুষটির চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করে বললাম তোমার নাম কী?।
আমার প্রশ্ন শুনে মানুষটি খুব অবাক হল। ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, নাম? নাম দিয়ে তুমি কী করবে?
কৌতূহল।
কৌতূহল সংবরণ কর যুবক।
আমার নাম ত্রাতুল।
তোমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই–কাজেই তোমার নাম ত্ৰাতুল না হয়ে কোলি ব্যাক্টেরিয়া হলেও কিছু আসে যায় না।
আমি নিচু গলায় বললাম, কিন্তু আমি একজন মানুষ।
মানুষ? হঠাৎ করে নিরানন্দ চেহারার মানুষটি আনন্দহীন গলায় হাসতে শুরু করল।
মানুষটির ভব্যতাবিবর্জিত পুরোপুরি হৃদয়হীন আচরণটিতে আমি হঠাৎ করে এক ধরনের আকর্ষণ খুঁজে পেতে শুরু করলাম। চিকিৎসক রোবটটি যখন আমার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করার জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করছিল আমি তখন ভেতরের মানুষগুলোকে তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে পরীক্ষা করতে থাকি। হৃদয়হীন নিরানন্দ মানুষটির চেহারায় কোথায় যেন সরীসৃপের সাথে একটু মিল রয়েছে, হয়তো তার শীতল ভাবলেশহীন মুখ হয়তো উঁচু কণ্ঠার হাড় বা ফ্যাকাসে এবং বিবর্ণ মুখাবয়ব।
দ্বিতীয় মানুষটির অগোছালো চেহারা এবং চেহারার মাঝে এক ধরনের বিরক্তির ভাব পাকাপাকিভাবে লেগে আছে। মানুষুটির চুল লালচে এবং মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তৃতীয় মানুষটি সম্ভবত মহিলা কিন্তু তাকে দেখে সেটি নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই। চিকিৎসক রোবটটি যখন আমার মাথাটিকে বিশেষ গোলাকৃতি একটি হেলমেটের মতো যন্ত্রের মাঝে শক্ত করে আটকে ফেলার চেষ্টা করছিল তখন এই তিনজন মানুষ কয়েকটি ভিন্ন। ভিন্ন যন্ত্রের সামনে বসে কোনো একটি কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
একসময় সরীসৃপের মতো দেখতে নিরানন্দ চেহারার মানুষটি বলল, আমার সিস্টেম প্রস্তুত। পুরোটি চার্জ করা হয়েছে।
লালচে চুলের অগোছালো চেহারার মানুষটি এক ধরনের বিরক্তির ভাব নিয়ে বলল, আমিও প্রস্তুত। ডাটা সারিবদ্ধ করা হয়েছে।
মহিলা বলে যাকে সন্দেহ করছিলাম সে প্রথমবার মুখ খুলল, চিকিৎসক রোবটটিকে বলল, কাজ রু কর, ইলেনা। তার কণ্ঠস্বর শুনে আমি এবারে নিঃসন্দেহ হলাম, মানুষটি আসলেই মহিলা।
আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু বুঝতে পারলাম রোবটটি আমার মাথার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার মাথার পেছনে শীতল কিছু একটা স্পর্শ করল এবং হঠাৎ করে সেখানে প্রচণ্ড শক্তিতে কিছু আঘাত করল, আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম। হঠাৎ করে মনে হল আমার সমস্ত চেতনা বুঝি লোপ পেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি চেতনা হারালাম না, মাথার পেছন দিয়ে কিছু একটা আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করানো শুরু করেছে। আমার দুটি হাত হঠাৎ করে আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। সমস্ত শরীরে আমি অপ্রতিরোধ্য এক ধরনের খিচুনি অনুভব করতে শুরু করলাম। আমার চোখের সামনে পরিচিত জগৎ হঠাৎ করে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। বিচিত্র কিছু নকশা, আশ্চর্য উজ্জ্বল কিছু রঙ চোখের সামনে খেলা করতে থাকে, সেগুলো নড়তে থাকে এবং মিলিয়ে যেতে থাকে, আমি উচ্চ কম্পনের কিছু শব্দ শুনতে থাকি এবং তার তীক্ষ্ণ ধ্বনি আমাকে অস্থির করে তোলে। হঠাৎ করে চারদিক নীরব হয়ে আসে, সেই ভয়ংকর নীরবতায় আমার সারা শরীর শিউরে ওঠে। আমি চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করি কিন্তু কিছুই দেখতে পাই না, মনে হয় চারদিকে কুচকুচে কালো অন্ধকার। আমি নিজের ভেতরে এক ধরনের গভীর বিষণ্ণতা অনুভব করতে থাকি, এক গভীর বিচিত্র হতাশা সমস্ত পৃথিবী, জগৎসংসার সৃষ্টি জগতের সবকিছুর প্রতি এক অতিমান এক ধরনের তীব্র দুঃখবোধে আমার বুকের ভেতর হাহাকার করতে থাকে। হঠাৎ করে আমার মনে হতে থাকে কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি। তাতেও কিছু আসে যায় না। এই জগৎসংসার, এই পৃথিবী, এই সৃষ্টি জগৎ বেঁচে আছে ধ্বংস হয়ে গেছে তাতেও কিছু আসে যায় না। আমি আমার সমস্ত চেতনাকে অদৃশ্য কোনো একটি অস্তিত্বের কাছে সমর্পণ করে গভীর এক ধরনের শূন্যতায় নিমজ্জিত হয়ে গেলাম।
০৩. রাজকুমারী রিয়া
আমি চোখ খুলে দেখতে পেলাম আমাকে ঘিরে তিনজন মানুষই দাঁড়িয়ে আছে। নিরানন্দ সরীসৃপের মতো মানুষটিকে হঠাৎ করে প্রাণবন্ত মানুষের মতো দেখাচ্ছে। লালচে চুলের বিরক্ত মানুষটিকেও কেমন জানি সহৃদয় মানুষ মনে হচ্ছে। যে মানুষটিকে পুরুষ না মহিলা বলে নিঃসন্দেহ হতে পারছিলাম না এখন হঠাৎ করে তাকে বেশ সুন্দরী একজন মহিলা মনে হল। নিশ্চয়ই আমার মস্তিষ্কে কিছু একটা করা হয়েছে যে কারণে গোমড়ামুখী নিরানন্দ তিনজন মানুষকেই হঠাৎ করে মোটামুটি সহৃদয় মানুষ বলে মনে হচ্ছে।
মহিলাটি আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, তোমার এখন কেমন লাগছে?
আমি মহিলাটির চোখের দিকে তাকালাম। মহিলাটির চোখে সত্যিকারের এক ধরনের উদ্বেগ। আমার জন্যে হঠাৎ করে এই মমত্ববোধ কেমন করে এল? আমি বললাম, জানি না।
নিরানন্দ মানুষটি বলল, জানার কথা নয়। বুঝতে একটু সময় লাগবে।
আমি মহিলাটির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী?
আমার নাম রিকি।
তোমাকে আগে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি তোমার নাম বলতে চাও নি।
রিকি অন্য দুজনের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসল, হেসে বলল, আগে আর এখনের মাঝে একটা বড় পার্থক্য আছে।
কী পার্থক্য?
আগে তুমি ছিলে ট্রাকিওশান সরানো একজন ফালতু মানুষ শব্দটার জন্যে কিছু মনে করো না।
এখন?
এখন তোমার মস্তিষ্কে একটা ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস বসিয়ে তোমার পুরো নিউরাল কানেকশান ম্যাপ করে নিয়েছি–তুমি এখন ফালতু মানুষ নও। রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
তার মানে আমার আর একটা অস্তিত্ব তৈরি করে নিয়েছ।
বলতে পার।
এটা বেআইনি। এটা তোমরা করতে পার না।
অন্য কারো বেলায় সেটা সত্যি তোমার জন্যে নয়। তুমি ভুলে যাচ্ছ শরীর থেকে ট্রাকিওশান সরিয়ে তুমি মানুষ হিসেবে তোমার সমস্ত অধিকার নিজে থেকে ছেড়ে দিয়েছ।
লাল চুলের মানুষটা সহৃদয় ভাবে হেসে বলল, তুমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। ট্রাইকিনিওয়াল বসিয়ে মস্তিষ্ক ম্যাপ করা হলে শরীরের ওপর খুব বড় অত্যাচার হয়।
আমি কিছু বললাম না।
তোমার শরীর এখন কেমন লাগছে?
আমি উঠে বসার চেষ্টা করে বললাম, একটু দুর্বল লাগছে।
মহিলাটি আমাকে ধরে সোজা করে বসিয়ে দিয়ে বলল, হঠাৎ করে উঠে বোসো না। ধীরে ধীরে ওঠ।
আমি চারদিকে তাকালাম, সবকিছুই আগের মতো আছে তবুও কোথায় যেন সবকিছুকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। আমার মস্তিষ্কের মাঝে নিশ্চয়ই কিছু একটা পরিবর্তন করে দিয়েছে। আমি মাথার পেছনে হাত দিয়ে সেখানে ছোট একটা ধাতব টিউব অনুভব করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী?
ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস। ভেতরে ছোট ক্ষতটুকু শুকিয়ে গেলে খুলে নিতে পারবে।
আমার শরীর শিরশির করে ওঠে, মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি সংযোগ করার জন্যে সেখানে একটি পোর্ট খুলে রেখেছে ব্যাপারটি চিন্তা করে আমার সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে।
মহিলাটি উদ্বিগ্ন গলায় বলল, তুমি নিজে থেকে ইন্টারফেসটা খোলার চেষ্টা করো না কিন্তু মস্তিষ্কের সাথে লাগানো আছে–চিকিৎসক রোবট ছাড়া আর কেউ খুলতে পারবে না।
আমার রেগে ওঠার কথা ছিল কিন্তু কোনো একটা বিচিত্র কারণে আমি কেন জানি রেগে উঠতে পারলাম না। ভেতরে ভেতরে আমি কেমন জানি অবসন্ন এবং উদাসীন অনুভব করতে থাকি।
মহিলাটি লাল চুলের মানুষটিকে বলল, শিরান, তুমি ত্রাতুলকে দাঁড় করিয়ে দাও।
ঠিক আছে, ক্লিশা। শিরান নামের লাল চুলের মানুষটি আমাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল। আমার প্রথমে মনে হল হাঁটুতে কোনো জোর নেই, আমি পা ভেঙে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু দুই পাশ থেকে দুজন আমাকে সময়মতো ধরে ফেলল। খানিকক্ষণ চেষ্টা করার পর আমি নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে পারলাম। দেয়াল ধরে ঘরের ভেতরে একটু ঘুরে এসে আমি তিনজন মানুষের দিকে তাকালাম, বললাম, রিকি, শিরান এবং ক্লিশা–তোমরা আমাকে একটা সত্যি কথা বলবে?
ক্লিশা একটু ব্যাকুল চোখে বলল, অবশ্যই বলব।
তোমরা আমাকে কেন এনেছ? আমাকে কী করেছ? এখন আমাকে দিয়ে কী করবে?
ক্লিশা অন্য দুজনের দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, দেখো ত্রাতুল, একটি খুব বড় প্রজেক্টে মানুষের কিছু অস্তিত্বের প্রয়োজন। আইন খুব কঠিন তাই আমরা সবার মস্তিষ্ক ম্যাপ করতে পারি না। তোমার ট্রাকিওশান নেই বলে তোমারটা করেছি। এর বেশি কিছু নয়।
আমার মস্তিষ্কের ম্যাপ মানে আমি। যার অর্থ এখন আমার দুটো অস্তিত্ব।
বলতে পার।
আমার অন্য অস্তিত্ব এখন কোথায়?
একটি বিশাল তথ্য কেন্দ্রে আছে।
কীভাবে আছে? সে কি কষ্টে আছে?
ক্লিশা হাসল, বলল, না সে কষ্টে নেই। তাকে কোনো ক্ষেত্র দেওয়া হয় নি। তার শরীর নেই, ইন্দ্রিয় নেই, কোনো কিছু অনুভব করার ক্ষমতা নেই।
আমি একটু উত্তেজিত হয়ে বললাম, কিন্তু সেটি নিশ্চয়ই ভয়ংকর একটি অনুভূতি। একজন মানুষের কোনো কিছু অনুভব করার ক্ষমতা নেই আমি তো চিন্তাও করতে পারি না।
শিরান নামের লাল চুলের মানুষটি আমার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, এখন এসব চিন্তা করে লাভ নেই। দেখো কত তাড়াতাড়ি নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে পার। যত তাড়াতাড়ি তুমি দাঁড়াতে পারবে তত তাড়াতাড়ি তুমি তোমার নিজের জগতে যেতে পারবে।
সবকিছু এখনো আমার কাছে খানিকটা দুর্বোধ্য মনে হতে থাকে। আমি অবিশ্যি সেটি নিয়ে মাথা ঘামালাম না। শিরান নামের মানুষটি সত্যি কথাই বলেছে, আমার মস্তিষ্কের আরেকটা কপি কোথাও থাকলেই কী আর না থাকলেই কী? আমি এখান থেকে বের হয়ে যাব–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
কিছুক্ষণের মাঝেই আমি মোটামুটিভাবে হাঁটতে শুরু করলাম। নিজের শরীরের ওপর খানিকটা নিয়ন্ত্রণ ফিরে এল। হঠাৎ করে মাথা ঘুরিয়ে তাকালে মাথাটা একটু ঘুরে ওঠে। এ ছাড়া অন্য কোনো উপসর্গ নেই। ক্লিশা বলেছে কিছুক্ষণের মাঝে এ সমস্যাটিও থাকবে না।
ঘণ্টাখানেকের মাঝে আমি আমার নিজের পোশাক পরে বের হয়ে এলাম। রাত্রিবেলা আমাকে যখন এখানে এনেছে তখন বুঝতে পারি নি, দিনের বেলা দেখতে পেলাম পুরো এলাকাটি খুব সুন্দর। পাহাড়ের পাদদেশে চমৎকার একটি হ্রদ, হ্রদের পানি আশ্চর্য রকম নীল–দেখে ছবির মতো মনে হয়। পুরো এলাকাটি গাছপালা দিয়ে ঘেরা, রাস্তাগুলো জনশূন্য। মাঝে মাঝে নিচু হয়ে একটি–দুটি বাইভার্বাল উড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া কোনো যানবাহন নেই। সূর্যের নরম একটা উত্তাপ, হ্রদ থেকে হালকা শীতল বাতাস বইছে, বাতাসে এক ধরনের জলে ভেজা গন্ধ। আমি রাস্তা দিয়ে অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকি, এলাকাটিতে এক ধরনের শান্তি শান্তি ভাব ছড়িয়ে আছে। এখানে কয়েকদিন থেকে গেলে মন্দ হয় না।
আমি বড় রাস্তা থেকে সরে গিয়ে গাছপালায় ঢাকা ছোট একটি রাস্তা ধরে খানিকটা উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকি। রাস্তাটি সম্ভবত হ্রদের তীরে গিয়েছে, গাছের পাতা বাতাসে শিরশির করে নড়ছে–শব্দটি শুনতে বড় মধুর লাগতে থাকে। বড় বড় শহরগুলো থেকে গাছপালা পুরোপুরি উঠে গিয়েছে–এখানে এসে হঠাৎ করে এর গুরুত্বটুকু নতুন করে মনে পড়ল। রাস্তাটি সরু হয়ে আর ঘন গাছপালার ভেতরে চলে এসেছে, গাছের ওপর পাখি কিচিরমিচির করে ঝগড়া করছে, আরো উপরে নীল আকাশে সাদা মেঘ। সব মিলিয়ে পরিবেশটি ভারি মধুর।
অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে আমি হঠাৎ করে গাছপালার ভেতর থেকে বের হয়ে হ্রদের সামনে চলে এলাম। সামনে বিস্তৃত বালুবেলা সকালের নরম রোদে চিকচিক করছে। দূরে হ্রদের টলটলে পানি, পাহাড়ের ছায়া পড়ে পানিতে গাঢ় একটি নীল রঙ, দেখে মনে হয় বুঝি অতিপ্রাকৃত একটি দৃশ্য। এই অস্বাভাবিক সুন্দর দৃশ্যটি দেখে আমি কয়েক মুহূর্ত প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। যখন বুকের ভেতর থেকে আটকে থাকা নিশ্বাসটি বের করে দিচ্ছি ঠিক তখন মনে হল একটি মেয়ের আর্তচিৎকার শুনতে পেলাম। এই অপূর্ব প্রায় অলৌকিক সুন্দর একটি জায়গায় মেয়ে কণ্ঠের আর্তচিৎকার এত অস্বাভাবিক মনে হল যে আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম। মনে হল নিশ্চয়ই ভুল শুনেছি–কিন্তু ঠিক তখন আমি দ্বিতীয়বার একটি মেয়ের চিৎকার শুনতে পেলাম। এটি মনের ভুল নয়, সত্যি সত্যি কোনো একটি মেয়ে চিৎকার করেছে।
আমি মেয়েটির গলার আওয়াজ লক্ষ্য করে ছুটতে থাকি। হ্রদের তীরের টানা বাতাসে ছোটবড়া বালিয়াড়ি তৈরি হয়েছে। তার দুটি অতিক্রম করে তৃতীয়টির উপরে উঠতেই দেখতে পেলাম, বালিয়াড়ির অন্য পাশে কয়েকজন মানুষ মিলে একটি মেয়েকে টানাহ্যাঁচড়া করছে। আমি বালিয়াড়ির উপরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম, কী হচ্ছে? কী হচ্ছে ওখানে?
মানুষগুলো ঘুরে আমার দিকে তাকাল এবং আমি দেখতে পেলাম এরা সত্যিকারের মানুষ নয়–এগুলো সাইবর্গ। মাথার পাশে যান্ত্রিক করোটি, সেখানে নানা ধরনের টিউবে কপোট্রন শীতল করার তরল প্রবাহিত হচ্ছে। কারো কারো একটি চোখ কৃত্রিম, সেখানে লাল আলো জ্বলছে। সাইবর্গগুলো একবার আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আবার মেয়েটিকে টানাহ্যাঁচড়া করতে থাকে। একটি সাইবর্গ তার শক্তিশালী হাত দিয়ে মেয়েটিকে প্রায় শূন্যে তুলে নিয়ে ফেলে দিল। আমি সাইবর্গগুলোর এক ধরনের কুৎসিত যান্ত্রিক হাসি শুনতে পেলাম।
কী করছ? কী করছ তোমরা? বলে চিৎকার করতে করতে আমি বালিয়াড়ি থেকে ছুটতে ছুটতে সাইবর্গগুলোর দিকে যেতে থাকি। একটা শক্তিশালী সাইবর্গ তার বাম পা দিয়ে মেয়েটিকে বালুতে চেপে ধরে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে খসখসে গলায় বলল, তুমি কে? এখানে কেন এসেছ?
আমি কাছাকাছি একটা বালিয়াড়ির উপর দাঁড়িয়ে থেকে চিৎকার করে বললাম, আমি যেই হই না কেন, তুমি মেয়েটিকে ছেড়ে দাও।
মেয়েটিকে যদি ছেড়েই দেব তা হলে ধরে আনলাম কেন?
আমিও সেটা জানতে চাই। কেন ধরে এনেছ?
দেখার জন্যে। অনেক দিন মেয়ে দেখি না।
দেখার জন্যে পা দিয়ে মাটিতে চেপে ধরে রাখতে হয় না। তোমার গোবদা পা সরাও–মেয়েটিকে ছাড়।
সাইবর্গটি একটা নোংরা মুখভঙ্গি করে বলল, অন্যরকম করে দেখতে চাই।
আমি ক্রুদ্ধ গলায় বললাম, বাজে কথা বলো না। সাইবর্গ মাত্রই নপুংসক। মিছিমিছি অন্যরকম ভান করো না।
সব সময় তো নপুংসক ছিলাম না এখন না হয় হয়েছি।
অনেক বাজে কথা হয়েছে। এখন মেয়েটিকে ছেড়ে দাও।
সাইবর্গটি আমার কথায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে অন্য সাইবর্গগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, এই মানুষটি খুব দুর্ব্যবহার করছে।
সাইবর্গগুলো সম্মতির ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। মেয়েটিকে মাটিতে চেপে রাখা সাইবর্গটি বলল, সাইবর্গের সাথে দুর্ব্যবহার করলে তার শাস্তি পেতে হবে। এটাকেও ধরে আন।
আমি তীক্ষ্ণ চোখে সাইবর্গগুলোকে লক্ষ করলাম, দেখতে ভিন্ন মনে হলেও এগুলো আসলে হাইব্রিড তিন মডেলের। এই মডেলগুলোর বড় ধরনের সমস্যা আছে। তা ছাড়াও এদের মেটাকোড এত সহজ যে ইচ্ছে করলেই এগুলোকে আমি চোখের পলকে বিকল করে দিতে পারি। কিন্তু এরা কী করে আমার দেখার ইচ্ছে করল, আমি কয়েক পা এগিয়ে দুই হাত কোমরে রেখে দাঁড়িয়ে বললাম, আমি দশ সেকেন্ড সময় দিচ্ছি নোংরা আবর্জনা কোথাকার! এর মাঝে যদি এখান থেকে বিদায় না হও তোমাদের কপোট্রনের বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেব।
দুটি সাইবর্গ মুখে অশ্লীল কথার তুবড়ি ছুটিয়ে বালিয়াড়ি ভেঙে আমার কাছে ছুটে আসতে থাকে, আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পূর্বমুহূর্তে ফিসফিস করে বললাম, কালো গহ্বরে এনিফর্মের নৃত্য।
সাইবর্গ দুটি থমকে দাঁড়িয়ে গেল, একজন ফিসফিস করে বলল, কী বললে? কী। বললে তুমি?
আমি বলেছি কালো গহ্বর অর্থাৎ ব্ল্যাকহোলে এনিফর্মের নৃত্য।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সাইবর্গ দুটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল এবং স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই রইল। আমি পা দিয়ে ধাক্কা দিতেই একটি সাইবর্গ বালিয়াড়ি দিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। আমি দ্বিতীয় সাইবর্গটিকে গুঁড়িয়ে দেবার আগে কৌতূহলী হয়ে তার ব্যাগটিতে উঁকি দিলাম, সেখানে একটি মাঝারি আকারের অস্ত্র লুকানো আছে। কাজটি ঘোরতর বেআইনি, সাইবর্গকে এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের মাঝে আনা যায় নি, তাদের কাছে কখনোই অস্ত্র থাকার কথা নয়। আমি ব্যাগটি থেকে অস্ত্রটি বের করে তাকে ধাক্কা দিতেই এই সাইবর্গটিও বালিয়াড়ি থেকে নিচে গড়িয়ে পড়ল।
অন্য দুটি সাইবর্গ এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, আমি অস্ত্রটি তাদের দিকে তাক করে বললাম, দশ সেকেন্ডের আর দুই সেকেন্ড বাকি আছে আবর্জনার পিণ্ড। এই মুহূর্তে দূর হও।
আমার কথায় এবারে ম্যাজিকের মতো কাজ হল। সাইবর্গ দুটি মেয়েটিকে ছেড়ে দিয়ে ছুটতে ছুটতে পালিয়ে গেল, এরা দৌড়ে অভ্যস্ত নয়, বিশেষ করে বালুর উপরে দৌড়ানো খুব কঠিন, সাইবর্গ দুটি কয়েকবার পা হড়কে নিচে পড়ে গিয়েও থামল না।
আমি বালিয়াড়ির ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এলাম। মেয়েটি ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে শরীর থেকে বালু ঝাড়ছে। আমি কাছে যেতেই বড় বড় চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিশ্বাস ফেলে বলল, ধন্যবাদ। তুমি না এলে যে কী সর্বনাশ হত!
কিছু হত না। আমি হাসার ভঙ্গি করে বললাম, আধুনিক প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় ব্যর্থ আবিষ্কার হচ্ছে সাইবর্গ। মানুষ আর যন্ত্র মিলিয়ে তৈরি করা হয়েছে লাভের মাঝে লাভ হয়েছে এটা মানুষও হয় নি যন্ত্রও হয় নি।
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। এই ব্যাপার নিয়ে আমার অনেক দিনের কৌতূহল। কিছু কিছু জিনিস আমি জানি।
মেয়েটি মাথার এলোমেলো চুলকে হাত দিয়ে খানিকটা বিন্যস্ত করার চেষ্টা করে বলল, সেটি অবিশ্যি দেখতে পেলাম। এই দুটি সাইবর্গকে কী সহজে কাবু করে ফেললে।
মেটাকোড জানলে তুমিও পারবে। আমি হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম, আমার নাম শ্রাতুল। কিন্তু আমি সেটা প্রমাণ করতে পারব না। আমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই।
মেয়েটি এবার মনে হল প্রথমবার সত্যিকার কৌতূহল নিয়ে আমার দিকে তাকাল, তার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল এবং শুধুমাত্র এই হাসিটির কারণে আমার হঠাৎ করে মনে হল মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী। আমি বললাম, কী হল? তুমি হাসছ কেন?
আমি শুধু নেটওয়ার্কে শুনেছি কোনো কোনো মানুষ নাকি শরীর থেকে ট্রাকিওশান সরিয়ে ফেলে। কখনো কাউকে দেখি নি।
জেলখানায় গেলেই দেখবে। বড় বড় অপরাধীরা শরীরে ট্রাকিওশান রাখে না। রাখলেও ভুল ট্রাকিওশান রাখে।
কিন্তু সেটা তো অন্য ব্যাপার। অপরাধ করার জন্যে ট্রাকিওশান সরানো–।
আমি হেসে বললাম, তুমি কেন ধরে দিলে আমি একজন অপরাধী না। আমি তো অপরাধী হতেও পারি।
মেয়েটি একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, বলল, আমার একবারও মনে হয় নি যে তুমি অপরাধী হতে পার। তাকে কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখাল, ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি অপরাধী?
আমি হেসে ফেললাম, প্রথমবার বুঝতে পারলাম মেয়েটির মাঝে এক ধরনের সারল্য রয়েছে যেটি আমি বহুদিন কারো মাঝে দেখি নি। বললাম, তুমি কি মনে কর আমি অপরাধী হলে সেটি তোমার কাছে স্বীকার করব?
করবে না, তাই না?
না। অপরাধী হওয়ার পর প্রথম কাজই হচ্ছে মিথ্যা কথা বলা।
মেয়েটি খুব একটি নতুন জিনিস আবিষ্কার করেছে সেরকম ভঙ্গি করে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই আমি অপরাধী না। ঠিক করে বলতে হলে বলতে হয় যে বড় ধরনের অপরাধী না।
তার মানে ছোট ছোট অপরাধ করেছ?
হ্যাঁ, এই যে দুটি সাইবর্গকে অচল করেছি সেটাও ছোট একটা অপরাধ।
কিন্তু সেটা তো করেছ আমাকে বাঁচানোর জন্যে।
তবুও। আমি মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, কিন্তু তোমাকে সাহায্য করার জন্যে কেউ এল না কেন?
আমি বুঝতে পারছি না। গত কয়েকদিন থেকে আমার শুধু অঘটন ঘটছে। নিউরাল কানেকশান ম্যাপ করার পর থেকে
আমি চমকে উঠে বললাম, তোমার নিউরাল কানেকশান ম্যাপ করা হয়েছে?
হ্যাঁ।
তার মানে তোমার মাথাতেও ট্রাইকিনিওয়াল বসানো হয়েছে?
হ্যাঁ, এই দেখ। মেয়েটি আমার সামনে তার মাথাটি এগিয়ে নিয়ে আসে, আমি তার ঘন কালো রেশমের মতো চুল সরিয়ে দেখতে পেলাম মাথার পেছনে ছোট একটা ধাতব সকেট লাগানো–এটা নিশ্চয়ই ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস আমার মাথাতেও আছে।
আমি একটু অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই কিছু একটা ছিল, মেয়েটা কেমন যেন ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? তুমি এরকমভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
না, আমি একটু বোঝার চেষ্টা করছি। আমার নিউরাল কানেকশান ম্যাপ করেছে কারণ আমার মানুষ হিসেবে কোনো অধিকার নেই। কিন্তু তোমাকে কেন করল?
ও! মেয়েটার মুখে নির্দোষ সারল্যের একটা হাসি ফুটে উঠল, বলল, তার কারণ আমি হচ্ছি রাজকুমারী রিয়া!
রাজকুমারী রিয়া?
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল, সত্যিকারের রাজকুমারী নই–কিন্তু তবু নাকি আমি রাজকুমারী।
কেমন করে শুনি?
জিনেটিক কোডিং করে একেবারে নিখুঁত একজন মানুষ তৈরি করা হয়েছে তুমি জান?
হ্যাঁ, জানি। একটি মেয়েকে তৈরি করা হয়েছে। সেটা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে, নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে–
আমি সেই মেয়ে।
আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলাম–খানিকক্ষণ আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। মেয়েটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, আমি নেটওয়ার্কে এই মেয়েটির ছবি দেখেছি, কালো চুল, কালো গভীর চোখ, মসৃণ ত্বক। ছবিতে শুধুমাত্র চেহারার সৌন্দর্যটুকু ধরা পড়ে–ভেতরের সৌন্দর্য ধরা পড়ে না। সামনাসামনি কথা বলে বোঝা যায়। এই মেয়েটির ভেতরে একটি আশ্চর্য সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। আমি খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বললাম, তুমি সেই রিয়া?
হ্যাঁ।
তুমি এখানে কেন?
আমি জানি না। আমার নিউরাল ম্যাপিং করে এখানে নিয়ে এসেছে। বলেছে এখানে এক সপ্তাহ থাকতে হবে। আমি কাউকে চিনি না, জানি না, যেখানেই যাই সেখানেই একটা অঘটন ঘটে।
অঘটন?
হ্যাঁ। আমি একটা ছোট গেষ্ট হাউজে আছি সেখানে দুই দল মারামারি করল একটা বিস্ফোরক আমার এই কনুই ঘেঁষে গিয়েছে, পেছনে একটা দেওয়াল ধসে গিয়েছে। গত রাতে গেস্ট হাউজের একটা বিম খুলে পড়েছে–একটুর জন্যে বেঁচে গেছি। দুপুরে খাবার গলায় আটকে গেল–নিশ্বাস বন্ধ করে মারাই গিয়েছিলাম, একজন এসে হেইমলিক। ম্যানুভার১৬ করে আমাকে বাচাঁলো। এখানে কী হয়েছে তা দেখতেই পেলে!
আমি ভুরু কুঁচকে রিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। রিয়া একটু হেসে বলল, আমার কী মনে হচ্ছে জান?
কী?
আমাকে এরা তৈরি করেছে একেবারে নিখুঁত মানুষ হিসেবে।
হ্যাঁ।
মানুষের যেসব গুণ থাকার কথা সব নাকি আমার মাঝে দিয়েছে আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না!
কেন?
মাঝে মাঝে এমন সব চিন্তা আমার মাথার মাঝে আসে যেগুলো নিখুঁত ভালোমানুষের মাঝে আসার কথা নয়। যাই হোক–যা বলছিলাম, আমার কী মনে হয় জান?
কী?
এরা আমাকে পরীক্ষা করছে। এতদিন আমাকে আর আমার মাকে খুব ভালো করে রেখেছে, যত্ন করে রেখেছে। ভালো স্কুলে গিয়েছি ভালো মানুষের সাথে মিশেছি সব সময় আমাকে চোখে চোখে রেখেছে। এখন আমার ওপর একটা পরীক্ষা করছে। বিপদ–আপদ অঘটন হলে আমি কী রকমভাবে ব্যবহার করি সেটা দেখতে চাইছে।
রিয়া মেয়েটি নিশ্চয়ই বুদ্ধিমতী, পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষের তো বুদ্ধিমত্তা থাকারই কথা–তার কথায় একটি যুক্তিও আছে। আমি নিশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি ঠিকই বলেছ। মনে হয় তোমাকে একটা পরীক্ষা করছে। তোমার ট্রাকিওশান নিশ্চয়ই সব তথ্য কোনো একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডারে পাঠিয়ে যাচ্ছে
রিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু ত্রাতুল তুমি জান একটা জিনিস?
কী?
আমার কখনো যেটা হয় নি সেটা হচ্ছে।
কী হচ্ছে?
আমার কেন জানি ভয় করছে।
ভয়?
হ্যাঁ, রিয়ার বড় বড় কালো দুটি চোখে ভয়ের একটি আশ্চর্য ছায়া পড়ল। মেয়েটি পৃথিবীর নিখুঁত মানুষ, তার চেহারায় মানুষের অনুভূতির কী চমৎকার একটি প্রতিফলন হয়– আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকি। আমি একটা নিশ্বাস নিয়ে বললাম, কী নিয়ে ভয় রিয়া?
আমি সেটা জানি না। সেজন্যেই ভয়।
আমার হঠাৎ খুব ইচ্ছে করল এই কোমল চেহারার মেয়েটিকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে বলি, তোমার কোনো ভয় নেই রিয়া–আমি তোমার পাশে আছি। কিন্তু আমি সেটা মুখ ফুটে বলতে পারলাম না।
বালিয়াড়ির নিচে খচমচ করে এক ধরনের শব্দ হল–আমি তাকিয়ে দেখলাম সাইবর্গ দুটো ওঠার চেষ্টা করছে। রিয়া আমার কাছে এসে হাত ধরে বলল, ঐ যে ওগুলো উঠে দাঁড়াচ্ছে।
পারবে না। আমি বললাম, আমার হিসেবে এখনো পনের মিনিট কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। তা ছাড়া ওপর থেকে গড়িয়ে এসেছে, আমি নিশ্চিত কপোট্রনের কিছু যোগাযোগ নষ্ট হয়েছে। ভেতরে কিছু ভেঙেচুরে গেছে।
নষ্ট হয়ে তো ক্ষতিও হতে পারে, হয়তো আমাদের আক্রমণ করে বসল।
তার আশঙ্কা নেই কিন্তু খামকা ঝুঁকি নেব না। চলো, আমরা যাই।
রিয়া আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আমার সাথে কিছুক্ষণ থাকবে?
অবশ্যই থাকব। আমি নরম গলায় বললাম, তুমি হচ্ছ পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ—-তোমার সাথে কিছুক্ষণ থাকা তো আমার জন্যে অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। রিয়া কিছু না বলে বালিয়াড়ি ভেঙে হাঁটতে শুরু করল–আমি হাতের অস্ত্রটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রিয়ার পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করলাম।
০৪. শূন্য দিয়ে ঘেরা
আমরা একটা প্রাচীন বাইভার্বালে করে শহরের মাঝামাঝি ফিরে এলাম। রিয়া যে গেস্ট হাউজে আছে সেটি ভারি সুন্দর, হ্রদের তীরে ছোট একটা কুটিরের মতো, চারপাশে গাছ দিয়ে ঘেরা। সামনে চমৎকার একটি ফুলের বাগান, বখানে নানা রঙের ফুল। আমাদের রেটিনা যদি পতঙ্গের চোখের মতো আরো স্বল্প তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে সংবেদনশীল হত তা হলে না জানি কী বিচিত্র রঙ দেখতে পেতাম।
রিয়া তার ঘরে গিয়ে যোগাযোগ মডিউলে তার মায়ের সাথে যোগাযোগ করল। খানিকক্ষণ কথা বলে আমার কাছে ফিরে এসে বলল, কিছু একটা গোলমাল আছে।
গোলমাল?
হ্যাঁ।
কী গোলমাল?
জানি না।
আমি রিয়ার দিকে তাকালাম, কিন্তু রিয়ার চোখে–মুখে কৌতুকের কোনো চিহ্ন নেই। সে বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কখনো এরকম হয় নি, যে তুমি জান কোথাও কিছু একটা সমস্যা আছে কিন্তু সমস্যাটি কী ঠিক ধরতে পারছ না?
হয়। অবিশ্যি হয়।
এখানেও সেই একই ব্যাপার। যেমন মনে কর মায়ের সাথে যোগাযোগের ব্যাপারটা, আমি ইচ্ছেমতো করতে পারি না। এখানে এসে কথা বলতে হয়। যখন মায়ের সাথে কথা বলি তখন–
তখন কী?
না, কিছু না।
বলো কী বলতে চাইছ।
মনে হচ্ছে মা কিছু একটা গোপন করতে চাইছে, বলতে চাইছে না।
তোমার মা তোমার কাছে কিছু একটা গোপন করছেন?
রিয়া দুর্বলতাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, আমি ঠিক তা বলি নি। বলেছি যে মনে হচ্ছে কিছু একটা গোপন করার চেষ্টা করছেন।
সেটাই তোমার মনে হবে কেন?
যাই হোক–ছেড়ে দাও। আমাকে এখানে এক সপ্তাহ থাকতে হবে, দুদিন এর মাঝে পার হয়ে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে আর পাঁচদিন কাটিয়ে দেব। তোমার সাথে পরিচয় হয়েছে, এখন এত কষ্ট হবে না। তুমি মানুষটা চমৎকার।
আমি রিয়ার দিকে তাকালাম–মেয়েটি খুব সরাসরি স্পষ্ট কথা বলে–ভদ্রতার নামে নিজেকে আড়াল করে রাখার যে পদ্ধতি আছে সেটি সে জানে না। আমি হেসে বললাম, তুমি আমার সম্পর্কে কিছুই জান না। আমাকে দেখেছ বড়জোর দুই ঘণ্টা, আর বলে ফেললে আমি মানুষটা চমৎকার?
তুমি ভুলে যাচ্ছ যে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ। আমি মানুষকে খুব ভালো বুঝতে পারি।
আমি একেবারেই পারি না। আমার ধারণা ছিল আমি মানুষটা অলস, অকর্মণ্য, কঁকিবাজ, বোকা–এক কথায় একেবারে ফালতু।।
রিয়া খিলখিল করে হেসে বলল, অলস, অকর্মণ্য, ফাঁকিবাজ, বোকা আর ফালতু মানুষেরা চমৎকার হতে পারে না তোমাকে কে বলেছে?
আমিও হেসে ফেললাম, বললাম, তা ঠিক।
চলো কোথাও থেকে খেয়ে আসি। খোজাখুঁজি করলে নিশ্চয়ই ভালো একটা খাওয়ার জায়গা পাওয়া যাবে। রিয়া চোখ নাচিয়ে বলল, আমার কাছে অনেকগুলো ইউনিট, খরচ করতে হবে না?
রিয়া খাবার জন্যে যে জায়গাটি খুঁজে বের করল আমি একা হলে কখনোই সেরকম জায়গায় যেতে সাহস পেতাম না। জায়গাটি হ্রদের উপরে ভাসছে, বিশেষ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো ব্যবহার করে এক ধরনের আলো-আঁধারি রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। টেবিলের উপর খাবারের তালিকা দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম আমরা সচরাচর যেসব কৃত্রিম খাবার খাই এখানে তার কিছু নেই, সব খাবার প্রাকৃতিক! আমি ভয়ে ভয়ে রিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, এরকম খাবার খাওয়ার মতো ইউনিট আছে তো?
রিয়া খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি সেটা নিয়ে চিন্তা করো না। আমি হচ্ছি রাজকুমারী রিয়া–সারা পৃথিবীর মাঝে একমাত্র নিখুঁত মানুষ ইউনিটের অভাব বলে আমরা এক বেলা ভালো খাবার খেতে পারব না এটা তো হতে পারে না। তবে রিয়া একমুহূর্ত থেমে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার চিন্তা এখন কোনো না অঘটন ঘটে যায়।
কেন? অঘটন কেন ঘটবে?
তাই তো ঘটছে। সারা জীবনে আমার যতগুলো অঘটন ঘটেছে গত দুই দিনে তার থেকে বেশি ঘটে গেছে।
আমি হেসে ব্যাপারটি উড়িয়ে দিলাম।
আমরা যখন খাবারের মাঝামাঝি পর্যায়ে আছি–একটি সুস্বাদু সত্যিকার তিতির পাখির মাংস সত্যিকারের জলপাই তেল এবং মশলায় হালকা করে রান্না করা হয়েছে, সেটি যবের রুটি দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছি ঠিক তখন রিয়ার কথা সত্যি প্রমাণিত হয়ে গেল। প্রথমে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম, তারপর হঠাৎ করে ইতস্তত কিছু মানুষ ছোটাছুটি করতে লাগল। রাগী চেহারার একজন ভয়ংকর দর্শন একটা অস্ত্র নিয়ে একবার ছুটে গেল, কিছুক্ষণ পর আবার সে ফিরে এল এবং আমরা তখন নিরাপত্তাকর্মীদের দেখতে পেলাম। ভয়ংকর দর্শন অস্ত্র হাতে রাগী চেহারার মানুষটি হঠাৎ একটি বিচিত্র জিনিস করে বসল, ঝটকা মেরে রিয়াকে আঁকড়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নেয় এবং তার মাথায় ভয়ংকর দর্শন অস্ত্রটি চেপে ধরে চিৎকার করে বলল, খবরদার। কাছে এলে এই মেয়ের মাথাটাকে উড়িয়ে দেব।
আমি দেখতে পেলাম নিরাপত্তাকর্মীরা যে যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে গেছে। রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম, সেখানে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই–বরং মনে হল একটু কৌতুক ফুটে উঠেছে। আমি নিশ্চিত নই কিন্তু মনে হল সে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে একটু হাসারও চেষ্টা করল। হয়তো বলার চেষ্টা করল, বলেছিলাম না?
নিরাপত্তাকর্মীরা অস্ত্র উদ্যত করে রেখে বলল, তুমি কী চাও?
মানুষটি ধমক দিয়ে বলল, তুমি খুব ভালো করে জান আমি কী চাই। একটা চতুর্থ মাত্রার বাইভার্বাল নিয়ে এস এক্ষুনি।
কেন, বাইভার্বাল দিয়ে কী করবে?
আমি এই দ্বীপ থেকে পালাব। এখানে মানুষ থাকে? রিয়া হঠাৎ খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মানুষটির ভয়ংকর দর্শন অস্ত্রটাকে প্রায় অবহেলায় সরিয়ে দিয়ে বলল, কী হয়েছে এই দ্বীপটায়?
বের হওয়া যায় না এটার শেষ নাই মানুষটার কথা শেষ হবার আগেই নিরাপত্তাকর্মীরা তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল– মানুষটি মরিয়া হয়ে গুলি করে বসল–আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম রিয়ার শরীরে গুলি লেগেছে, কিন্তু হুটোপুটি শেষ হবার পর দেখলাম রিয়া গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে।
রাগী চেহারার মানুষটি চিৎকার করতে লাগল এটা নরক, জাহান্নাম, এটা ভূতের বাড়ি–কবরখানা কিন্তু কেউ তার কথার বিশেষ গুরুত্ব দিল না, সম্ভবত ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে মস্তিষ্কের বারোটা বাজিয়ে রেখেছে। মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত জায়গা সরিয়ে একটা কপোট্রনিক ইন্টারফেস বসিয়ে এখন তাকে একটা সাইবর্গ বানিয়ে ফেলতে হবে।
আমাদের খাবার পর্বটি সেখানেই শেষ করতে হল–দুজনের কারোরই আর সেখানে থাকার ইচ্ছে করল না। বের হয়ে আমি রিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, এত বড় একটা ব্যাপার তুমি একটুও ঘাবড়ে যাও নি।
বড় ব্যাপার কে বলেছে? পুরোটা সাজানো নাটক।
সাজানো নাটক?
হ্যাঁ, তোমাকে বলেছিলাম না। আমি যেখানেই যাই সেখানেই অঘটন। রিয়া হাসার চেষ্টা করে বলল, এটাও তাই।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না–এটা তাই না। লোকটার হাতের অস্ত্রটি সত্যি। গুলিতে কতটুকু জায়গা ধসে গিয়েছিল দেখেছ? আমি ভেবেছিলাম তোমার গায়ে গুলি লেগেছে।
কিন্তু কখনো লাগে না। আমি তাই দেখছি–শেষ মুহূর্তে আমি রক্ষা পেয়ে যাই। যেন একটা নাটক হচ্ছে। আমি তার নায়িকা। শেষ দৃশ্য পর্যন্ত বাচিয়ে রাখতে হবে।
আমি কোনো কথা না বলে রিয়ার পাশাপাশি হাঁটতে থাকি। রাত সেরকম গম্ভীর হয় নি কিন্তু এর মাঝে চারপাশে নির্জনতা নেমে এসেছে। ঠিক কী কারণ জানি না, আমি হঠাৎ এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করতে থাকি। অস্বস্তির কারণটুকু বুঝতে পারছি না বলে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করতে থাকি। কথা না বলে দুজনে অনেকটুকু হেঁটে গেলাম। একসময় রিয়া মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, কী হল, কথা বলছ না কেন?
ভাবছি?
কী ভাবছ?
মানুষটা কী বলছিল মনে আছে? এই জায়গাটা নরক, এটা ভৌতিক দ্বীপ–সেটা?
হ্যাঁ! আমি মাথা নাড়লাম, মানুষটা বলছিল এখান থেকে বের হওয়া যায় না। মনে আছে?
হ্যাঁ।
কেন বলছিল? আমাদের কি এখানে আটকে রাখা হয়েছে? এটা কি বিশেষ একটা এলাকা? কেন এখান থেকে বের হওয়া যায় না?
রিয়া ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী বলছ তুমি?
আমি কিছুই বলছি না, কিন্তু মানুষটার কথা আমাকে খুব ভাবনায় ফেলে দিয়েছে।
চলো তা হলে নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে গিয়ে জিজ্ঞেস করি।
না, ওখানে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, ওরা বলবে না।
তা হলে?
আমাদের নিজেদের বের করতে হবে।
রিয়া আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী বের করতে হবে?
আসলেই কি আমাদের আটকে রেখেছে নাকি।
কীভাবে বের করবে?
সোজা। একটা বাইভার্বাল নেব সাইবর্গটাকে অচল করে সোজা এখান থেকে বের হয়ে যাব–দেখি কেউ আটকায় নাকি।
আমি ভেবেছিলাম রিয়া এরকম একটা ব্যাপারে রাজি হবে না–কিন্তু দেখলাম সে সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল। আমরা তখন রাস্তার মোড়ে একটা বাইভার্বালের জন্যে পঁড়িয়ে রইলাম।
প্রথম দুটি বাইভার্বালকে ছেড়ে দিতে হল–তার চালক একেবারে নতুন মডেলের সাইবর্গ, তাদের মেটাকোড এখনো আমার জানা নেই, এটাকে আমি অচল করতে পারব না। তৃতীয়টি পুরোনো বাইভার্বাল, চালকটিও তৃতীয় প্রজন্মের। আজ সকালেই এদের দুটিকে বালুবেলায় অচল করে এসেছি।
বাইভার্বালটি উপরে ওঠার তিরিশ সেকেন্ডের ভেতরে আমি সাইবর্গটি অচল করে দিয়ে তার নিয়ন্ত্রণটি হাতে নিয়ে নিলাম। শহরের উপরে একবার পাক খেয়ে আমি সেটিকে উড়িয়ে নিতে থাকি। রিয়া আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি বাইভার্বাল চালাতে পার?
না।
তা হলে কেমন করে চালাচ্ছ?
নিজেই চলছে–আমি শুধু বলছি কোন দিকে চলতে হবে!
আমি রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, যে জিনিস সাইবর্গ চালাতে পারে সেটা যে কোন মানুষ চালাতে পারে। তুমি নিশ্চয়ই জান সাইবর্গের বুদ্ধিমত্তা একটা শিশুর সমান।
আমি নিশ্চিত এরকম একটা পরিবেশে অন্য যে কেউ হলে ঘাবড়ে যেত কিন্তু রিয়ার ভয়ভীতি কম–কে জানে একজন নিখুঁত মানুষ, সম্ভবত সাহসী মানুষ।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক উড়িয়ে নেবার পর আমরা এই শহরটির শেষ মাথায় এসে উপস্থিত হলাম। নিচে রাস্তার আলো কমে এসেছে। আরো কিছুক্ষণ চালিয়ে নেবার পর হঠাৎ করে অন্ধকার কেটে এক ধরনের আলো ফুটে উঠল। আমরা সোজাসুজি এগিয়ে যেতে থাকি এবং হঠাৎ করে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি। যে জিনিসটিকে আমরা আলো হিসেবে ভাবছি সেটি সত্যিকার অর্থে আলো নয়–সেটি হচ্ছে অন্ধকারের অনুপস্থিতি। আমরা ভালো করে তাকিয়ে দেখতে পেলাম শহরটি হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেছে এবং তাকে ঘিরে এক ধরনের শূন্যতা। কোথাও কিছু নেই–ব্যাপারটি এত অস্বাভাবিক যে তাকে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এটি কুয়াশার মতো নয় যে সবকিছু ঢাকা পড়ে আছে। এটি স্পষ্ট এবং এর মাঝে কোনো বিভ্রান্তি নেই। মনে হচ্ছে হঠাৎ করে সমস্ত সৃষ্টি জগৎ শেষ হয়ে গেছে। সেই ভয়ংকর শূন্যতা দেখে আমার সমস্ত চেতনা হঠাৎ করে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল, আমি চিৎকার করে বললাম, রিয়া–চোখ বন্ধ কর।
কেন?
এটা দেখলে তুমি পাগল হয়ে যাবে।
রিয়া দুই হাতে আমাকে শক্ত করে ধরে বলল, এটা কী?
এটা হচ্ছে শূন্যতা। এটা হচ্ছে সত্যিকারের শুন্যতা।
এখানে কেন?
আমার একটা জিনিস মনে হচ্ছে, কিন্তু কিন্তু
কিন্তু কী? রিয়া ভয় পাওয়া গলায় বলল, বলো এটি এখানে কেন?
আমি বাইভার্বালটিকে ঘুরিয়ে শহরের ভেতরে নিয়ে এলাম–কিছুক্ষণের মাঝে অন্ধকার নেমে এল, নিচে রাস্তাঘাট, আলো, জনবসতি দেখা যেতে লাগল। রিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, রেস্টুরেন্টে যে মানুষটি আমাকে ধরেছিল সে নিশ্চয়ই এই শূন্যতা দেখে এসেছে।
হ্যাঁ, দেখে পাগল হয়ে গেছে।
আমরা কি পাগল হয়ে গেছি?
আমি একটি নিশ্বাস ফেলে বললাম, হয়ে গেলে মনে হয় ভালো হত।
কেন? রিয়া ভয় পেয়ে বলল, কেন তুমি এ কথা বলছ?
আমি সাবধানে বাইভার্বালটিকে হ্রদের তীরে বালুবেলায় নামিয়ে এনে তার ইঞ্জিন বন্ধ করে দরজা খুলে দিলাম। প্রথমে রিয়া এবং তার পিছু পিছু আমি নেমে এলাম। আকাশে বড় একটা চাঁদ উঠেছে, হ্রদের পানিতে সেই বড় চাঁদের প্রতিফলন ঘটে পানি চিকচিক করছে। বিশাল বালুবেলা ধূসর একটি সুবিস্তৃত প্রান্তরের মতো–পুরো দৃশ্যটিকে খানিকটা অতিপ্রাকৃতিক বলে মনে হতে থাকে।
রিয়া আমার পাশে প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, কী হয়েছে ত্রাতুল, তুমি কেন বলছ আমাদের পাগল হয়ে যাওয়া উচিত ছিল?
তুমি বুঝতে পারছ না? কথা বলতে গিয়ে আমার গলা কেঁপে গেল, তুমি এখনো বুঝতে পার নি?
না।
তোমার মনে আছে আমার এবং তোমার মাথায় ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস লাগানো আছে?
হ্যাঁ।
ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস লাগিয়ে আমাদের মস্তিষ্কের ম্যাপিং করা হয়েছে?
রিয়া মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, আমি জানি।
যার অর্থ আমাদের একটা অস্তিত্ব তৈরি করে একটা তথ্যকেন্দ্রে জমা করে রেখেছে।
হ্যাঁ। তাতে কী হয়েছে?
আমরা সেই অস্তিত্ব। আমরা সত্যিকারের ত্রাতুল নই, সত্যিকারের রিয়া নই।
রিয়া একটা আর্তচিৎকার করে আমাকে ধরে ফেলল, তারপর থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। আমি গভীর মমতায় তাকে ধরে রেখে খুব সাবধানে বালুবেলায় বসিয়ে দিলাম। সে অপ্রকৃতিস্থের মতো আমার কাঁধে মাথা রেখে আকুল হয়ে কেঁদে উঠল। আমি রিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, আমি খুব দুঃখিত রিয়া। আমি খুব দুঃখিত।
আমি আকাশে পূর্ণ একটি চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই চাঁদ, চাঁদের আলো, হ্রদ, হ্রদের পানি, বালুবেলা সব কৃত্রিম, সব একটি বিশাল তথ্যভাণ্ডারের তথ্য। আমি এবং রিয়াও কৃত্রিম—আমাদের ভাবনা–চিন্তা, দুঃখ–কষ্ট আসলে বিশাল কোনো এক যন্ত্রের ভেতরের হিসাব, আলো এবং ইলেকট্রনের বিচ্ছুরণ, কিছু যান্ত্রিক পদ্ধতি।
গম্ভীর হতাশায় আমার বুকের ভেতরে কিছু একটা গুঁড়িয়ে যেতে থাকে। আমি আমার হাতের দিকে তাকালাম, কী আশ্চর্য–আমি আসলে সত্যিকারের আমি নই? কৃত্রিম একটা ছোট শহরের জগতে আটকে পড়ে থাকা কিছু তথ্য? ভ্রাতুল এখন কোথায় আছে? সত্যিকারের ত্রাতুল?
০৫. সত্যিকারের ত্রাতুল
আমি চোখ খুলে তাকালাম, দেখতে পেলাম আমাকে ঘিরে তিনজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, নিরানন্দ চেহারার সরীসৃপের মতো মানুষ, লালচে চুলের বিরক্ত চেহারার মানুষ এবং পুরুষ না নারী বোঝার উপায় নেই সেই মহিলা। চিকিৎসক রোবটটিকে দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু আমার মাথার পেছনে খুটখাট শব্দ শুনে বুঝতে পারছি সে কাছেই আছে।
নিরানন্দ চেহারার মানুষটি বলল, তুমি এখন উঠে বসতে পার।
আমি উঠে বসার চেষ্টা করতেই মাথার পেছনে কোথায় জানি যন্ত্রণা করে উঠল। সেখানে হাত দিতেই অনুভব করলাম, একটা ধাতব টিউব লাগানো। আমি দাঁতে দাঁত ঘষে বললাম, জানোয়ারের বাচ্চা।
নিরানন্দ চেহারার মানুষটি ক্রুদ্ধ গলায় বলল, কী বললে? কী বললে তুমি?
আমি সাবধানে উঠে বসতে বসতে বললাম, বলেছি জানোয়ারের বাচ্চা। এটা একটা গালি। তবে যদি ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা কর তা হলে বুঝবে আসলে এটা ভুল গালি।
তুমি কী বলতে চাইছ!
আমি কী বলতে চাইছি সেটা তুমি বুঝবে বলে মনে হয় না। তবু যদি শুনতে চাও তা হলে শোন–পৃথিবীতে শুধু মানুষই অন্য মানুষকে অপ্রয়োজনে কষ্ট দেয়। অন্য কোনো পশুপাখি অপ্রয়োজনে নিজের প্রজাতিকে কষ্ট দেয় না। কাজেই তোমাদের জানোয়ারের বাচ্চা গালি দেওয়া হলে জানোয়ারকে অপমান করা হয়।
মানুষটি আমার কথা শুনে এত অবাক হল যে বলার মতো নয়–আরেকটু হলে হয়তো তেড়ে এসে আমাকে আঘাত করে বসত কিন্তু অন্য দুজন তাকে থামাল। মহিলাটি খনখনে গলায় বলল, ছেড়ে দাও। মাত্র নিউরাল কানেকশান ম্যাপিং হয়েছে, এখনো সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আসে নি। কী বলছে নিজেও জানে না।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, কী বলছি, আমি খুব ভালো করে জানি। আমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করার তোমাদের কোনো অধিকার নেই।
লাল চুলের বিরক্ত চেহারার মানুষটি বলল, অধিকার, দায়িত্ব, ন্যায়–অন্যায় এসব বড় বড় ব্যাপার নিয়ে কথাবার্তা তোমার মুখে মানায় না। তুমি একজন ফালতু মানুষ–তোমার। মস্তিষ্ক ম্যাপিং করে তবুও তোমাকে কোনোভাবে কাজে লাগানো গেছে।
আমার অস্তিত্বটিকে তোমরা কী করেছ?
সেই উত্তর আমরা তোমাকে দেব কেন? নেটওয়ার্কে করে তাকে তার জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কোথায় পাঠিয়েছ? কোথায় রেখেছ? তাকে কি কষ্ট দিচ্ছ?
দিলেই কী আর না দিলেই কী? সেটা আর তুমি নও।
আমি চিৎকার করে বললাম, সে আমি। তাকে তোমরা কষ্ট দিতে পারবে না।
মহিলাটি এতক্ষণ কোনো কথা বলছিল না, এবারে কঠোর গলায় বলল, দেখ যুবক, তুমি বাড়াবাড়ি করছ। আমরা তোমার প্রতি অনুকম্পা করে তোমাকে মানুষ হিসেবে বাচিয়ে রেখেছি। ইচ্ছে করলেই তোমার মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সরিয়ে সেখানে কপোট্রন বসিয়ে একটা সাইবর্গে পাল্টে দিতে পারতাম। সেটা করি নি–তার অর্থ এই নয় যে, ভবিষ্যতে করব না।
তোমরা আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?
হ্যাঁ! আমরা তোমাকে ভয় দেখাচ্ছি। তোমাকে ভয় দেখাতে কোনো সমস্যা নেই। একটা পোষা কুকুরের অধিকার তোমার থেকে বেশি।
আমি মহিলাটির শীতল চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে রইলাম–একটি ভালো সঙ্গীত শুনলে বা চমৎকার একটা শিল্পকর্ম দেখলে যেরকম আনন্দ হয় মহিলাটির হৃদয়হীনতা দেখে আমার হঠাৎ সেরকম এক ধরনের আনন্দ হল–নিজের অজান্তেই হঠাৎ করে আমার মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল। মহিলাটি জিজ্ঞেস করল, তুমি হাসছ কেন?
আনন্দে।
আনন্দে? কীসের আনন্দে?
আমি তোমাকে সেটা বলব না। এটা আমার ব্যক্তিগত আনন্দ। তুমি সেটা বুঝতে পারবে না।
অনেক হয়েছে। এখন তুমি যাও।
ঠিক আছে যাচ্ছি। আবার দেখা হবে।
মহিলাটি মাথা নাড়ল, বলল, না দেখা হবে না।
আমি মনে মনে বললাম, নিশ্চয়ই দেখা হবে। আমার সাথে দেখা না হলেও আমার অন্য অস্তিত্বের সাথে দেখা হবে। আমি আবার আমার মাথার পেছনে হাত দিলাম, সেখানে ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেসটিতে এক ধরনের ভোঁতা যন্ত্রণা। আমি ঘর থেকে বের হওয়ার সময় লাল চুলের মানুষটি বলল, নিজে থেকে ইন্টারফেসটি খোলার চেষ্টা করো না আহাম্মক কোথাকার। মস্তিষ্কের সাথে লাগানো আছে–কিছু একটা গোলমাল হলে একেবারে পাকাপাকি অচল হয়ে যাবে। লোকটি মুখ বাঁকা করে হেসে বলল, কে জানে সেটাই মনে হয় তোমার জন্যে ভালো?
আমি কোনো কথা না বলে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। লম্বা করিডর ধরে হেঁটে বড় একটা দরজার সামনে দাঁড়াতেই দরজাটি খুলে গেল। বাইরে পাথর ছড়ানো ছোট রাস্তা। রাস্তা শেষ হয়েছে একটি গেটের সামনে। গেটটি ঠেলে খুলে আমি বের হয়ে এলাম। বাইরে দাঁড়িয়ে আবার আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, পুরাতন একটি বিশেষত্বহীন দালান, দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে অসহায় মানুষকে ধরে এনে তাদের মস্তিষ্কের নিউরাল কানেকশান ম্যাপিং করে রাখা হয়। আমার একটি অস্তিত্বকে ওরা তৈরি করে রেখেছে–সে কোথায় আছে কেমন আছে কে জানে। আমার না দেখা সেই অস্তিত্বটির জন্যে আমি আমার বুকের ভেতরে এক ধরনের গভীর বেদনা অনুভব করতে থাকি।
আমি পুরাতন সেই দালানটাকে পেছনে ফেলে হাঁটতে শুরু করলাম। পাশাপাশি উঁচু ঘিঞ্জি দালান–পুরো এলাকাটিতে এক ধরনের মন খারাপ করা ভাব। মাথার উপর দিয়ে তীক্ষ্ণ শব্দ করে বাইভার্বাল উড়ে যাচ্ছে। রাস্তায় মানুষ, সাইবর্গ এবং এন্ড্রয়েড। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম কোথাও একটি গাছ নেই, একটু মাটি নেই, সভ্যতার নামে সবাই মিলে পৃথিবীটাকে কী নিষ্ঠুরভাবেই না পরিবর্তিত করে ফেলেছে। হেঁটে হেঁটে আমি নিজেকে ক্লান্ত করে ফেললাম আমার পকেটে হাত খুলে খরচ করার মতো ইউনিট নেই। তাই খুঁজে খুঁজে একটা পাতাল ট্রেন বের করতে হল। টিকিট কিনে আমি ছোট একটা ঘুপচি বগিতে চেয়ারে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে বসে থাকি। মাটির নিচে অন্ধকার গহ্বরের ভেতর দিয়ে ট্রেনটি সুপার কন্ডাক্টিং রেলের ওপর দিয়ে ভয়ংকর গতিতে ছুটে চলতে শুরু করে। বসে থাকতে থাকতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম আমার অস্তিত্বটি একটি ছোট ঘরের ভেতর আটকা পড়ে আছে, ঘরের ভেতর কয়েকটি বুনো কুকুর–তাদের মুখ দিয়ে সাদা ফেনা ঝরছে। আমার অস্তিত্বটি ঘরটির জানালার লোহার রড ধরে ঝুলে আছে, কুকুরগুলো হিংস্র চিৎকার করে আমার অস্তিত্বটিকে ধরার চেষ্টা করছে–পারছে না। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আমার অস্তিত্বটি কাতর গলায় আমার কাছে সাহায্য চাইছে কিন্তু আমি কিছু করতে পারছি না। এরকম সময়ে ট্রেনটি একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল, আমি আমার নিজের শহরে পৌঁছে গেছি। আমি সিট বেল্ট খুলে বের হয়ে এলাম। আমার চারপাশে অসংখ্য মানুষ, সাইবর্গ আর এন্ড্রয়েড ব্যস্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছে–শুধু আমার কোনো ব্যস্ততা নেই।
মাটির নিচ থেকে উপরে উঠে দেখতে পেলাম চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। আমি এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করতে থাকি হঠাৎ করে নরম একটি বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমে অচেতন হয়ে যাবার ইচ্ছে করতে থাকে। আমি শহরের উপকণ্ঠে আমার দুই হাজার তলা অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিঙে আমার ছোট খুপরির মতো ঘরটিতে এসে শরীরের কাপড় না খুলেই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে কিন্তু আমার বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতা নেই।
এভাবে কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম আমি জানি না। যখন আমার ঘুম ভেঙেছে তখন বাইরে রাত না দিন তাও আমি জানি না। আমি কোনোমতে বিছানা থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে চোখে–মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে আমার শোবার ঘরে ফিরে এলাম। ভিডি মডিউলে১৭ একটা লাল বাতি জ্বলছে এবং নিবছে যার অর্থ এখানে আমার জন্য অসংখ্য তথ্য জমা হয়েছে। আমার পরিচিত মানুষ বলতে গেলে নেই এই তথ্যগুলোর বেশিরভাগ নানা ধরনের যন্ত্রপাতি থেকে এসেছে এর মাঝে কখনোই প্রয়োজনীয় কোনো তথ্য থাকে না। আমি একটি বোতাম স্পর্শ করে সেগুলো মুছে দিতে গিয়ে কেন জানি থেমে গেলাম–ঠিক কী কারণ জানি না, আমি তথ্যগুলো দেখতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এবং অর্থহীন কাজের মাঝে এক ধরনের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়।
ভিডি মডিউলের বেশিরভাগ তথ্য সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়–পৃথিবীর যাবতীয় অর্থহীন দ্রব্য মানুষকে গছিয়ে দেওয়ার এক ধরনের অসহনীয় প্রতিযোগিতা ছাড়া সেগুলো আর কিছু নয়। তথ্যগুলোর মাঝে হঠাৎ করে অবশ্য একটি পরিচিত মানুষের একটি ভিডিও ক্লিপ পেলাম, জিগি নামের একজন বাতিকগ্রস্ত মানুষ হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে আমার প্রায় বুকের ওপর চেপে বসে চিৎকার করে বলল, কী খবর তোমার ত্রাতুল? তোমার কোনো দেখা নাই?
জিগি আবার অদৃশ্য হয়ে গেল, বাতিকগ্রস্ত এই মানুষটির যে আমার সাথে খুব ঘনিষ্ঠতা আছে তা নয়–আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধব বলতে গেলে একেবারেই নেই। জিগির সাথে আমার বন্ধুত্ব হওয়ার কথা নয়, তবুও একটি বিচিত্র কারণে তাকে আমার বন্ধু বলে মনে হয়। জিগির ভেতর যদি বিন্দু পরিমাণও শৃঙ্খলাবোধ থাকত তা হলেই তার প্রায় অস্বাভাবিক মেধাবী মস্তিষ্ক ব্যবহার করে একজন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের গণিতবিদ কিংবা বিজ্ঞানী হতে পারত। কিন্তু তার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যাপারে এতটুকু কৌতূহল নেই–তার প্রতিভাবান মস্তিষ্ককে প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের কাজে না লাগিয়ে এন্ড্রয়েড আর সাইবর্গের মেটাফাইল খুঁজে বের করার কাজে ব্যস্ত রেখেছে। আমি আরো কিছুক্ষণ ভিডি মডিউলের একঘেয়ে এবং অর্থহীন তথ্যগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম–ঠিক যখন ভিডি মডিউলটি বন্ধ করে দিচ্ছি তখন হঠাৎ করে একটি ভিডিও ক্লিপে আমার দৃষ্টি আটকে গেল। এলোমেলো চুল, বিষণ্ণ চেহারার একজন যুবকের ত্রিমাত্রিক ছবি ভেসে এসেছে, যুবকটি কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তারপর একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ত্রাতুল, আমি ভ্রাতুল।
আমি ভয়ানক চমকে উঠে তাকালাম, এলোমলো চুলের বিষণ্ণ চেহারার যুবকটিকে আমি চিনতে পারি নি–সে আসলে আমি। আমি বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখতে পেলাম সে একবার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আবার ঘুরে তাকাল, কী ভয়ংকর শূন্য একটি দৃষ্টি–সেই দৃষ্টিতে আমার বুকের ভেতরে কী যেন হাহাকার করে ওঠে। সে ক্লান্ত গলায় বলল, আমাদের খুব বিপদ ত্রাতুল। আমার আর রিয়ার। সে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা কী করব বলবে তুমি?
আমি দেখতে পেলাম এলোমেলো চুলের বিষণ্ণ চেহারার যুবকটি–যে আসলে আমি, হলোগ্রাফিক স্ক্রিন থেকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
আমি স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম, দেখতে পেলাম আমার হাত থরথর করে কাঁপছে।
০৬. জিগি
জিগির বাসাটি খুঁজে পেতে আমার খুব কষ্ট হল। সে নানা ধরনের বেআইনি এবং অবৈধ কাজে লেগে থাকে বলে নিজের থাকার জায়গাটি কখনো কাউকে জানাতে চায় না। দরজায় শব্দ করার পরও সে দরজা খোলার আগে নানাভাবে নিশ্চিত হয়ে নিল মানুষটি সত্যিই আমি।
আমাকে দেখে সে প্রয়োজন থেকে জোরে চিৎকার করে বলল, আরে ত্রাতুল–সত্যিই দেখি তুমি! আমি ভেবেছি একটা নিরাপত্তা বাহিনীর এন্ড্রয়েড।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না, আমি এন্ড্রয়েড না।
তোমাকে দেখতে এরকম লাগছে কেন? জিগি ভুরু কুঁচকে বলল, দেখে মনে হচ্ছে অনেক দিন তোমাকে কেউ কিছু খেতে দেয় নি?
আমাকে কেন এরকম দেখাচ্ছে তার একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু মুখ খোলার আগেই জিগি চোখ বড় বড় করে বলল, কী মজা হয়েছে জান?
আমি জিজ্ঞেস করার আগেই জিগি বলতে শুরু করল, চতুর্থ মাত্রার হাইব্রিড সাইবর্গের কপোট্রনের বাইরের শেলে দুইটা মডিউলে ক্রস কানেক্ট!
জিগি হা–হা করে আনন্দে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে শুরু করল। সাইবর্গের কপোট্রনের ক্রটিতে জিগি যেরকম আনন্দ পেতে পারে আমি সেরকম পেতে পারি না–কিন্তু জিগি সেটা লক্ষ করল বলে মনে হল না। হঠাৎ করে আমাকে ঘরের কোনায় টেনে নিয়ে একটা মাঝারি এন্টেনাকে অনুরণিত করতে শুরু করে বলল, দেখো কী মজা হয়?
সবুজ স্ক্রিনে কিছু সংখ্যা ছোটাছুটি করতে থাকে, আমি সেদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী মজা হবে?
নেটওয়ার্কে একটা ফাঁক খুঁজে পেয়েছি। আমি এখন মূল নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়তে পারি।
সে তো সবাই পারে।
জিগি হাত নেড়ে বলল, কিন্তু সেটা তো আইনসম্মতভাবে আমি পুরোপুরি বেআইনিভাবে ঢুকছি! জিগি আবার আনন্দে হা–হা করে হাসতে থাকে।
জিগি নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে একটা গোপন তথ্য ভাণ্ডারের কিছু মূল্যবান তথ্য নষ্ট করে দিয়ে বলল, দেখেছ? আমি কী করেছি? আমাকে ধরতে পারল?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না পারে নি।
কখনো পারবে না। জিগি বুকে থাবা দিয়ে বলল, কখনো না!
কেন?
আমার ট্রাকিওশান ভুয়া! জিগি আবার আনন্দে হা–হা করে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে বলল, নতুন এন্ড্রয়েডগুলোর মেটা ফাইলগুলো বের করেছি। তুমি নেবে?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, নেব।
আসো–তোমাকে একটা ক্রিস্টালে লোড করে দেই।
আমি জিগিকে থামিয়ে বললাম, জিগি। আমি তোমার কাছে একটা বিশেষ কাজে এসেছি।
আমার কাছে? বিশেষ কাজে? জিগি খুব অবাক হল। তার কাছে কেউ কখনো বিশেষ কাজে আসে না। সে ভুরু কুঁচকে বলল, কী কাজ?
আমি পকেট থেকে একটা ছোট ক্রিস্টাল বের করে জিগির হাতে দিয়ে বললাম, এটা দেখ।
জিগি ক্রিস্টালটি তার ঘরের অসংখ্য যন্ত্রপাতির কোনো একটিতে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে কোথায় কোথায় সুইচ টিপে দিতেই ঘরের মাঝামাঝি একটা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে আমাকে দেখতে পেলাম। এলোমেলো চুল, দিশেহারা শূন্য দৃষ্টি, কাতর কণ্ঠস্বর। গম্ভীর হতাশায় ডুবে গিয়ে সে বলল, ভ্রাতুল, আমি ত্রাতুল।
জিগি খুব কৌতূহল নিয়ে পরপর তিনবার ভিডিও ক্লিপটি দেখল। সুইচ টিপে ভিডি মডিউল বন্ধ করে সে আমার দিকে তাকাল, তার চোখ অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো জ্বলজ্বল করছে। খানিকক্ষণ সে কোনো কথা বলল না, হঠাৎ করে সে উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে এসে আমার চুল খামচে ধরে ঘুরিয়ে মাথার পেছনে তাকাল, তারপর শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বলল, এন্ড্রোমিডার দোহাই! তোমার মাথায় ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস লাগিয়েছে?
হ্যাঁ।
তোমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করে নিয়েছে?
হ্যাঁ।
তার মানে তোমার আরেকটা অস্তিত্ব তৈরি করে পরাবাস্তব জগতে আটকে রেখেছে?
হ্যাঁ।
কত বড় সাহস! জিগি টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, জানোয়ারের বাচ্চাদের মিউটেশান হোক। ক্লচ ভাইরাস রক্তনালিকে ছিন্ন করে দিক। গামা রেডিয়েশনে হিমোগ্লাবিন ফেটে যাক।
আমি জোর করে হাসার চেষ্টা করলাম। জিগি মুখ পাথরের মতো শক্ত করে বলল, রিয়া নামে আরেকজনকে ম্যাপিং করেছে?
হ্যাঁ।
সেটা কে?
আমি জানি না।
নামটা আমার কাছে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে–আগে কোথাও শুনেছি।
এটি একটি সাধারণ নাম, না শোনার কোনো কারণ নেই।
না–না তা নয়। জিগি মাথা নাড়ল, বলল, এই নামের একজন বিশেষ মানুষ আছে। জিগি ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল, তারপর তার অসংখ্য যন্ত্রপাতির মাঝে কোনো একটিতে মাথা ঢুকিয়ে কিছু তথ্য প্রবেশ করিয়ে ফিরে এসে বলল, পৃথিবীতে রিয়া নামে দুই লক্ষ তিরানব্বই হাজার সাত শ বিয়াল্লিশটি মেয়ে আছে। তার মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত মেয়েটিকে আদর করে ডাকা হয় রাজকুমারী রিয়া।
রাজকুমারী রিয়া?
হ্যাঁ। তার বয়স বাইশ। উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে তার মায়ের সঙ্গে থাকে।
আমি মাথা চুলকে বললাম, কেন সে বিখ্যাত? কেন তাকে রাজকুমারী রিয়া ডাকা হয়?
কারণ রিয়া হচ্ছে পৃথিবীর নিখুঁততম মানবী। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে তার শরীরের প্রত্যেকটা জিন আলাদা আলাদাভাবে তৈরি করা হয়েছে।
ও হ্যাঁ। মনে পড়েছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি ভাবছ এই রিয়াকেই আটকে রেখেছে!
জিগি মাথা নাড়ল, বলল, সম্ভবত।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে। আমি কী বলেছি লক্ষ করেছ? আমি বলেছি, আমাদের খুব বিপদ, আমার আর রিয়ার। আমি বলি নি আমার আর রিয়া নামের একটি মেয়ের খুব বিপদ–আমি ধরেই নিয়েছি রিয়াকে সবাই চেনে।
হ্যাঁ।
এভাবে বলার একটা অর্থ আছে। এর মাঝে একটা বড় তথ্য লুকিয়ে আছে।
জিগি ঘরে কয়েকবার পায়চারি করে এক বোতল উত্তেজক পানীয় ঢকঢক করে খানিকটা খেয়ে বলল, এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। কিছুতেই না!
আমি বললাম, আমি সেজন্যে তোমার কাছে এসেছি। তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবে না।
জিগি মাথা নাড়ল, তা ঠিক। নেটওয়ার্কে ঢোকা যার–তার কাজ নয়।
জিগির চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, মুখের মাংসপেশি টানটান হয়ে থাকে, চোখ জ্বলজ্বল করতে শুরু করে অনেক দিন পর সে তার মনের মতো একটা কাজ পেয়েছে। তখন তখনই সে মাথায় হেলমেটের মতো একটা নিউরাল ইন্টারফেস পরে কাজে লেগে যায়।
জিগি ঘণ্টাখানেক নেটওয়ার্কের সাথে ধস্তাধস্তি করল তারপর কেমন যেন বিধ্বস্তভাবে মাথা থেকে হেলমেটটা খুলে ঘরের এক কোনায় ছুঁড়ে দিয়ে কয়েকবার মেঝেতে পা দিয়ে লাথি দিল। আমি বললাম, কী হয়েছে?
পারছি না। নেটওয়ার্কের যোগাযোগটা পাচ্ছি না।
পাচ্ছ না?
না। আমার মনে হয় মূল কেন্দ্রে আলাদা করে রেখেছে। এখান থেকে ভেতরে ঢোকা যাবে না।
ত্তা হলে?
জিগির মুখে ক্রুদ্ধ অস্থির এক ধরনের ভাব ফুটে ওঠে–ঢকঢক করে আবার কয়েক ঢোক উত্তেজক পানীয় খেয়ে মাথা নেড়ে বলল, নিশ্চয়ই কোনো উপায় আছে।
আমি বললাম, যে বাসাটিতে আমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করছে সেখানে গেলে–
জিগি কাছাকাছি একটা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, ঠিক বলেছ! সেই বাসাটি নিশ্চিতভাবে নেটওয়ার্কের সাথে জুড়ে দেওয়া আছে।
কিন্তু সেখানে ঢুকব কেমন করে? কত রকম নিরাপত্তার ব্যবস্থা!
জিগি হাত নেড়ে উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, সেটা দেখা যাবে। চল যাই।
আমি বললাম, রাজকুমারী রিয়ার সাথে যোগাযোগ করলে কেমন হয়?
জিগি খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, পাবে না।
কী পাব না?
রিয়াকে।
চেষ্টা করতে ক্ষতি কি?
ঠিক আছে চেষ্টা কর।
আমি ভিডি মডিউলে চেষ্টা করতে থাকি। প্রথম দুবার যোগাযোগ করা গেল না– তৃতীয়বার আমাকে অবাক করে দিয়ে ভিডি স্ক্রিনে অপরূপ রূপসী একটি মেয়ের ছবি ভেসে উঠল, মেয়েটি কৌতূহলী চোখে বলল, কে? কে তুমি?
আমি থতমত খেয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, তুমি কি রাজকুমারী রিয়া?
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল, কেউ যখন খুব গম্ভীর হয়ে আমাকে রাজকুমারী রিয়া বলে ডাকে তখন আমার খুব হাসি পায়।
আমি–আমি–আসলে বুঝতে পারছি না তোমাকে কী বলে ডাকব।
ছেড়ে দাও ওসব। বলো তুমি কে?
তুমি আমাকে চিনবে না। আমি একটা বিশেষ প্রয়োজনে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছি!
রিয়া মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, প্রয়োজনটা সত্যি না হলে কিন্তু ভালো হবে না আগেই সাবধান করে রাখছি। প্রতিদিন কতশত মানুষ আমার সাথে যোগাযোগ করে তুমি জান?
আমি অনুমান করতে পারি। তুমি নিশ্চিত থাক। প্রয়োজনটা খুব জরুরি।
বলো।
তোমার মাথার পেছনে কি একটা ধাতব টিউব লাগানো?
রিয়া হতচকিত হয়ে বলল, কী বললে? কী বললে তুমি?
তোমার মাথায় কি গত এক-দুইদিনের মাঝে কোনো ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস লাগানো হয়েছে?
রিয়া নিজের মাথার পেছনে হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলল, হ্যাঁ। লাগিয়েছে। তুমি কেমন করে জান? এটি কারো জানার কথা না।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, আমারও লাগিয়েছে। আমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করে আমার একটি অস্তিত্ব তৈরি করা হয়েছে। সেই অস্তিত্ব আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। করে বলেছে সে খুব কষ্টে আছে। তার সাথে কে আছে জান?
কে?
তুমি।
রিয়া এক ধরনের হতচকিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, কিন্তু তারা যে বলল আমার অস্তিত্বটি সুপ্ত থাকবে, কখনো জাগাবে না–শুধু নিরাপত্তার জন্যে তৈরি করেছে।
মিথ্যা কথা বলেছে। আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ। তোমার ভেতরে সম্ভবত কোনো খারাপ প্রবৃত্তি নেই–তুমি মনে হয় খারাপ কিছু দেখতে শেখ নি। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি–পৃথিবীতে অনেক খারাপ মানুষ আছে। তারা তোমার সাথে মিথ্যা কথা বলছে।
রিয়া অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল–তার মুখ দেখে মনে হল, সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে, কেউ তার সাথে মিথ্যা কথা বলতে পারে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, কেন?
আমি জানি না। তু
মি তুমি তুমি কি নিশ্চিত?
হ্যাঁ। আমি নিশ্চিত।
তুমি কে? তোমার পরিচয় তো আমি জানি না।
আমার নাম ব্রাতুল। আমার কোনো ট্রাকিওশান নেই তাই আমার আর কোনো পরিচয় নেই।
রিয়া আরো কী একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করে জিগি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ভিডি মডিউলটি বন্ধ করে চিৎকার করে বলল, সাবধান ব্রতুল।
কী হয়েছে?
ধরতে আসছে।
ধরতে আসছে? কাকে?
তোমাকে আর আমাকে।
কে ধরতে আসছে?
জিগি শুষ্ক মুখে বলল, নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ স্কোয়াড। ঐ দেখ–
আমি ঘরের এক কোনায় স্ক্রিনে দেখতে পেলাম রাস্তার পাশে বড় বড় বাইভার্বাল থামছে আর সেখান থেকে পিলপিল করে কালো পোশাক পরা নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ স্কোয়াড নেমে আসছে। মানুষগুলোর পোশাক কালো, চোখে কালো চশমা এবং কোমরে বীভৎস স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝুলছে। যন্ত্রের মতো তারা সারিবদ্ধভাবে ছুটে আসছে। আমি জিগির দিকে তাকালাম, এরা কেন আসছে?
আমাদের ধরতে।
কেন?
একটু আগে নেটওয়ার্কে ঢোকার চেষ্টা করলাম মনে নেই?
কিন্তু তুমি বলেছিলে কেউ তোমাকে ধরতে পারবে না। তোমার ট্রাকিওশান তুমি পাল্টে ফেলেছ। তুমি
জিগি মুখ খিঁচিয়ে বলল, এখন থামো–আগে পালাই।
কেমন করে পালাবে? সব ঘেরাও করে ফেলেছে না?
আমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম কয়েকটা কালো বাইভার্বাল এই দুই হাজার তলা বিল্ডিংটিকে ঘিরে উড়ছে। ভালো করে লক্ষ করলে ভেতরে বসে থাকা মানুষগুলোকেও দেখা যায়। জিগি আমার কথার উত্তর না দিয়ে ছোট একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে তার যন্ত্রপাতির মাঝে ছোটাছুটি করে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ব্যাগ ভর্তি করে নিয়ে বলল, চলো।
আমি দরজার দিকে এগুতেই জিগি ধমক দিয়ে বলল, ওদিকে কোথায় যাচ্ছ?
বাইরে যাবে না?
দরজা দিয়ে? তুমি কি ভেবেছ সিঁড়ি, লিফট আর বের হবার পোর্ট তোমার জন্যে রেডি করে রেখেছে? সব জায়গায় বিশেষ স্কোয়াড এখন কিলবিল করছে।
তা হলে?
এই যে, এদিক দিয়ে।
আমি জিগির পেছনে পেছনে গেলাম, তার বিছানাটা টেনে তুলতেই নিচে একটা ছোট চৌকোনা দরজা বের হল। সেটা খুলতেই একটা গোলাকার ডাক্ট দেখা গেল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এদিক দিয়ে?
হ্যাঁ। ডানদিকে দশ মিটার মতো গেলে মূল তথ্য সরবরাহের লাইনটা পাবে, ঝুলে নেমে যেতে হবে। তোমার উচ্চতাভীতি নেই তো?
আমি শুষ্ক গলায় বললাম, আছে কি না কখনো পরীক্ষা করে দেখি নি।
বেশ! আজকে পরীক্ষা হয়ে যাবে। নামো।
তুমি?
আমি হলোগ্রাফিক ভিডিওটা চালিয়ে দিয়ে আসি।
জিগি ভেতরে গিয়ে কিছু যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করে কয়েকটা সুইচ টিপে দিতেই ঘরের ভেতরে একটা হলোগ্রাফিক প্রতিচ্ছবি ভেসে এল–সেখানে দেখা যাচ্ছে ভয়ংকর কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে জিগি দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরপর দরজার দিকে তাক করে গুলি করে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে বলে ভয় দেখাচ্ছে। জিগি নিজের হলোগ্রাফিক ছবিটার দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে আমার কাছে ফিরে এসে বলল, নিরাপত্তার লোকজন যখন দেখবে আমাকে পাওয়া গেছে খানিকটা নিশ্চিন্ত হবে। এত সব অস্ত্র দেখে সহজে ঢুকবে না– ততক্ষণে আমরা হাওয়া হয়ে যাব।
ছোট খোপটার ভেতরে ঢুকে জিগি উপরের অংশটুকু ঢেকে দিল, এই দিক দিয়ে যে বের হয়ে এসেছি সেটা আর কেউ বুঝতে পারবে না।
জিগির পিছু পিছু আমি সরু একটা টানেলের মতো স্থায়গা দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে থাকি। খানিক দূর যাওয়ার পর একটা বড় শ্যাফট পাওয়া গেল। নানা আকারের অসংখ্য তার বহু নিচে নেমে গেছে। জিগি মোটা একটা তার ধরে ঝুলে ঝুলে নিচে নামতে নামতে বলল, সাবধান ত্রাতুল। লাল রঙের তারগুলো ধরো না–ভেতরে ইনফ্রারেড আলো যাচ্ছে, কয়েক মেগাওয়াট–কোনোমতে ভেঙে গেলে মুহূর্তের মাঝে ভাজা কাবাব হয়ে যাবে।
আমি লাল রঙের তারগুলো স্পর্শ না করে সাবধানে কালো রঙের মোটা একটা তার ধরে ঝুলতে ঝুলতে নিচে নামতে শুরু করলাম–হাত ফসকে গেলে প্রায় দুই কিলোমিটার নিচে পড়ে থেঁতলে যাব– পৃথিবীর কেউ কোনোদিন জানতেও পারবে না! মাথা থেকে জোর করে সেই চিন্তা দূর করে দিলাম–যা হয় হবে, কোনো কিছুতেই আর পায়রায়া করি না এই ধরনের একটা ভাব নিজের ভেতরে নিয়ে এসে সরসর করে একটা সরীসৃপের মতো জিগির সাথে সাথে নিচে নামতে থাকি। জিগির মুখে দুশ্চিন্তার কোনো চিহ্ন নেই, তাকে দেখে মনে হয় এই ধরনের কাজ সে আগে অনেকবার করেছে এবং এই মুহূর্তে সে ব্যাপারটা খানিকটা উপভোগ করতে শুরু করেছে।
শ্যাফটের নিচে পৌঁছে জিগি দরজার দিকে এগিয়ে গেল, পকেট থেকে একটা চাবি বের করে দরজার তালাটা খুলে প্রথমে এলার্ম সিস্টেমটা অচল করে দিল, তারপর দরজাটা একটু ফাঁক করে প্রথমে নিজের মাথাটা একটু বের করে বাইরে পুরোপুরি নিরাপদ নিশ্চিত হওয়ার পর সে সাবধানে বের হয়ে আমাকেও বেরিয়ে আসতে ইঙ্গিত করল। আমি বের হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আগেও এদিক দিয়ে বের হয়েছ!
অবিশ্যি। এসব ব্যাপারে কোনো ঝুঁকি নেওয়া যায় নাকি? শিখে রাখো আমার কাছ থেকে কোনো জায়গায় থাকতে চাইলে প্রথমেই পালিয়ে যাবার রাস্তাটি ঠিক করে রাখবে।
আমি কোনো কথা বললাম না। দুজনে রাস্তার পাশ দিয়ে সাবধানে হেঁটে যেতে থাকি। দ্বিতীয় এপার্টমেন্ট বিন্ডিংটার পাশে আসার পর হঠাৎ একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম, কিছুক্ষণ টানা গুলির শব্দ হল এবং অনেক উপর থেকে কিছু আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হয়ে আসতে দেখা গেল। জিগি আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল, বেকুবগুলো আমার হলোগ্রাফিক মূর্তিটাকে গুলি করছে। হা–হা–হা–
আমি পুরো ব্যাপারটা চিন্তা করে একটু শিউরে উঠি–এর মাঝে হাসার মতো কোনো বিষয় খুঁজে পাই না।
০৭. নিরানন্দ দালান
জিগিকে নিয়ে আমি আমার এপার্টমেন্টে যেতে চাইলাম কিন্তু সে রাজি হল না। যে জায়গা থেকে পালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে রাখা নেই সেখানে জিগি যায় না। বাধ্য হয়ে আমাকে তার সাথে নতুন এক জায়গায় যেতে হল। জায়গাটি বেআইনি–এখানে কখনো নিরাপত্তাকর্মীরা আসে না। সে কারণে পুরো এলাকাটির মাঝে এক ধরনের থমথমে নিরানন্দ ভাব, এখানকার মানুষজন বেপরোয়া এবং নিষ্ঠুর। বেশিরভাগই মাদকাসক্ত না হয়। ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহারকারী। আমরা আকাশের কাছাকাছি একটা ছোট ঘরে রাত কাটাবার আয়োজন করলাম। রাতের খাবার খেয়ে জিগি কোথায় কোথায় যেন যোগাযোগ করল, বিচিত্র রকমের মানুষেরা এসে তাকে কিছু যন্ত্রপাতিও দিয়ে গেল, সেগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করে সে একটা নিউরাল কম্পিউটার দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে থাকে। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তুমি নিউরাল কম্পিউটার তৈরি করছ?
জটিল একটা যন্ত্রের মাঝখানে আঙুল দিয়ে কিছু অবলাল রশ্মি আটকে দিয়ে বলল, হুম।
কিন্তু
কিন্তু কী?
এটা তো দেখছি ইন্টারফেস। মূল প্রসেসর আর মেমোরি কোথায়?
জিগি দাঁত বের করে হেসে আমার মাথায় আঙুল দিয়ে দুইবার টোকা দিল। আমি অবাক হয়ে বললাম, মস্তিষ্ক? মানুষের মস্তিষ্ক?
জিগি মাথা নাড়ল, বলল, নিখুঁতভাবে বলতে চাইলে বলা যেতে পারে তোমার মস্তিষ্ক! আমার বহুদিনের শখ ছিল একটা নিউরাল কম্পিউটারের, কিন্তু কে তার মস্তিষ্ক আমাকে ব্যবহার করতে দেবে? আর দিলেও আমি ইন্টারফেস করব কেমন করে? এখন একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম।
আমি আতঙ্কিত হয়ে জিগির দিকে তাকালাম, তুমি আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করবে?
তা না হলে কার? ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস আমি কেমন করে পাব? অকাট্য যুক্তি কিন্তু শুনে আমি আতঙ্কে শিউরে উঠি। মাথা নেড়ে বললাম, না–না। মস্তিষ্ক নিয়ে কোনো ছেলেখেলা না।
জিগি মুখ শক্ত করে বলল, ছেলেখেলা? তোমার ধারণা আমি ছেলেখেলা করি?
সত্যি কথা বলতে কী আমার তাই ধারণা। কিন্তু তাই বলে মনে করো না যে তোমার ওপরে আমার বিশ্বাস নেই।
জিগি টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, তা হলে?
তা হলে কী?
তা হলে তোমার মস্তিষ্ক আমাকে ব্যবহার করতে দিচ্ছ না কেন? আমি কি নিজের জন্যে চাইছি? তোমার জন্যেই চাইছি!
আমার জন্যে?
জিগি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। তোমার জন্যে। তোমার অস্তিত্বকে রক্ষা করার জন্যে যদি নেটওয়ার্কে ঢুকতে হয় তা হলে একটা নিউরাল কম্পিউটার দরকার। তোমার সেই নেটওয়ার্কিং কেন্দ্রে কি আমাদের এমনিতে ঢুকতে দেবে? দেবে না–দরজার গোপন পাসওয়ার্ড বের করতে হবে। একটা ভালো নিউরাল কম্পিউটার ছাড়া কি গোপন পাসওয়ার্ড বের করতে পারব? পারব না।
আমি তবু অস্বস্তি বোধ করতে থাকি। জিগি আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, আমার ওপর বিশ্বাস রাখ লাতুল, আমি তোমার এক বিলিয়ন নিউরন শুধু ব্যবহার করব, একটা নিউরনেরও ক্ষতি করব না। এস–এই টেবিলটার ওপর শুয়ে পড়।
আমি খুব অনিচ্ছার সাথে টেবিলের ওপর শুয়ে পড়লাম। জিগি তার বিচিত্র জোড়াতালি দেওয়া যন্ত্রটি আমার মাথার কাছে নিয়ে এল। সেখান থেকে একটা মান্টিকোর কো–এক্সিয়াল তার বের হয়ে এসেছে, তার এক পাশে একটা বিদঘুঁটে সকেট। সকেটটি সে চাপ দিয়ে আমার মাথার পেছনে ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেসে লাগিয়ে দিল। সাথে সাথে আমার পুরো শরীরে আমি একটি প্রচণ্ড ঝাঁকুনি অনুভব করি। মাথার ভেতরে হঠাৎ করে প্রচণ্ড যন্ত্রণা করে ওঠে অনেকগুলো আলোর ঝলকানি, উচ্চ কম্পনের একটা শব্দ এবং ঝুঁজালো এক ধরনের গন্ধের সাথে সাথে মুখে তীব্র এক ধরনের বিস্বাদ অনুভব করতে লাগলাম। আমি ছটফট করে উঠলাম, জিগি শক্ত করে আমাকে টেবিলে চেপে ধরে বলল, নড়বে না, খবরদার নড়বে না। এক্ষুনি সব ঠিক হয়ে যাবে।
জিগির কথা সত্যি প্রমাণিত হল, সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মাঝে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এল, শুধুমাত্র কোথায় যেন একটা ভোঁতা শব্দ শুনতে থাকলাম। জিগি আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, চমৎকার! নিউরাল কম্পিউটারের সাথে আমার প্রথম সফল যোগাযোগ। এখন। তোমাকে দিয়ে আমি কিছু জটিল সমস্যার সমাধান করাব।
কী ধরনের সমস্যা?
বায়োমেটেরিয়ালে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশানে নন লিনিয়ার উপঘাত
আমি এসব কিছুই জানি না।
জিগি আনন্দে হা–হা করে হাসল, বলল, এটাই তো মজা, তুমি এর কিছুই জান না কিন্তু তুমি এর সমাধান বলে দেবে। আমি সমস্যাটি সমান্তরাল করে দেব–তোমার মস্তিষ্কে যখন সেটি যাবে তুমি সমাধান করতে পার সেভাবে
আমি বুঝতে পারছি না।
এক্ষুনি বুঝতে পারবে। হঠাৎ হঠাৎ করে তুমি এখন বিচিত্র জিনিস দেখবে, তোমার সেই বিচিত্র জিনিস থেকে কোনো কিছু করার ইচ্ছে করবে তুমি সেটা করবে এবং আমি আমার সমাধান পেয়ে যাব।
যদি কিছু না করি?
করবে। জিগি অর্থবহভাবে চোখ টিপে বলল, করবে নিশ্চয়ই করবে!
জিগির কথা শেষ হবার আগেই আমি চোখের সামনে দেখতে পেলাম ছোট ছোট
অনেকগুলো বৃত্তাকার বস্তু। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম, তবুও সেগুলো দেখা যেতে লাগল। সেগুলো ক্রমাগত বড় হচ্ছে, বড় হতে হতে সেগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার নতুন করে কিছু বৃত্ত তৈরি হচ্ছে যেগুলো আকার পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। আমার মনে হতে থাকে এই বৃত্তগুলোর একটার সাথে আরেকটার সমন্বয় করতে হবে–না করা পর্যন্ত আমি বুঝি শান্তি পাব না। আমার বিচিত্র এক ধরনের কষ্ট হতে থাকে। শারীরিক কোনো কষ্ট নয়, অন্য কোনো এক ধরনের কষ্ট। আমি প্রাণপণে সেই বিচিত্র বৃত্তাকার বস্তুগুলোকে আমার মাথার ভেতরে সাজাতে থাকি, হঠাৎ হঠাৎ সেগুলো সাজানো হয়ে যায় এবং আমি তখন নিজের ভেতরে এক আশ্চর্য প্রশান্তি অনুভব করি কিন্তু সেটি মুহূর্তের জন্যে; আবার সেগুলো পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যায় এবং আমি বিচিত্র এক ধরনের কষ্ট অনুভব করতে থাকি। আমি প্রাণপণে নিজের সেই কষ্ট কমানোর চেষ্টা করে ভাসমান প্রতিচ্ছবির সাথে যুদ্ধ করতে থাকলাম।
কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানি না হঠাৎ করে সবকিছু মিলিয়ে গেল এবং আমি তখন নিজের ভেতরে আশ্চর্য এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করতে থাকলাম। আমি জিগির গলা শুনতে পেলাম, চমৎকার ত্রাতুল! তোমার কাজ শেষ।
আমি ওঠার চেষ্টা করতেই জিগি টেবিলে চেপে ধরে রেখে বলল, এক সেকেন্ড দাঁড়াও, তোমার মাথা থেকে সকেটটা খুলে নিই।
আমি কিছু বলার আগেই সে হ্যাঁচকা টান দিয়ে মাথার পেছন থেকে সকেটটা খুলে নেয়, মুহূর্তের জন্যে আমার শরীর ভয়ংকর রকম অনিয়ন্ত্রিতভাবে খিচুনি দিয়ে ওঠে। আমার মনে হল কানের কাছে একটা ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটেছে, চোখের সামনে উজ্জ্বল চোখ ধাঁধানো আলো ঝলসে উঠল এবং মুখে তিক্ত এক ধরনের স্বাদ অনুভব করলাম। জিগি আমাকে টেনে। বসিয়ে দিয়ে আমার সামনে একটা মনিটর ধরে রাখল, বলল, এই দেখ।
আমি তখনো অল্পসল্প কাঁপছি, কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী দেখব?
তোমার সমাধান এবং আসন সমাধান। হুবহু মিলে গেছে। জিগি আনন্দে হা–হা করে হেসে বলল, আমি এখন একটি ব্যক্তিগত নিউরাল কম্পিউটারের মালিক।
না। আমি মাথা নাড়লাম, তুমি এখনো নিজেকে মালিক বলে দাবি করো না। আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা আনন্দের না–তোমার নিউরাল হিসেব করতে হলে আমার যদি এরকম কষ্ট হয় তা হলে আমি তোমাকে কখনো আমার মাথায় সকেট বসাতে দেব না।
জিগি হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, কষ্ট খুব আপেক্ষিক ব্যাপার। সন্তান জন্ম দিতে মায়েদের কী রকম কষ্ট হয় জান? সেজন্যে কখনো শুনেছ কোনো মা সন্তান জন্ম দেয় নি?
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে খানিকটা নিয়ন্ত্রণের মাঝে আনার চেষ্টা করে বললাম, আমাকে এখন খানিকটা বিশ্রাম নিতে দাও আমি সোজাসুজি চিন্তাও করতে পারছি না।
জিগি মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ। তোমার এখন বিশ্রাম নেওয়া দরকার।
আমি কোনোমতে বিছানায় এসে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম এবং প্রায় সাথে সাথেই গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়লাম।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি জিগি তার যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছে। আমাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখে সে চতুষ্কোণ একটা যন্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বলল, এই যে তৈরি করে ফেলেছি।
কী তৈরি করেছ?
নেটওয়ার্ক কেন্দ্রের দরজা খোলার জন্যে পাসওয়ার্ড বের করার ইন্টারফেস।
ব্যাপারটি কীভাবে কাজ করছে সেটা জানার সেই মুহূর্তে আমার কোনো কৌতূহল ছিল কিন্তু জিগি সেটা লক্ষ করল না। গলায় বাড়তি উৎসাহ নিয়ে বলল, আমি পিঠে ব্যাকপেকের মাঝে রাখব পাওয়ার সাপ্লাই আর ডিকোডার। সেখান থেকে একটা কেবল যাবে দরজায়–তুমি থাকবে আমার পাশে তোমার মাথা থেকে সকেট হয়ে আসবে। ডিকোডারে
আমার মাথা থেকে?
হ্যাঁ। তোমার মাথাকে নিউরাল কম্পিউটার হিসেবে ব্যবহার না করলে পাসওয়ার্ড বের করব কেমন করে?
আমি কোনো কথা না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সম্পূর্ণ গোপন একটা পাসওয়ার্ড কয়েক মিনিটের মাঝে খুঁজে বের করতে হলে মানুষের মস্তিষ্কের মতো কিছু একটা প্রয়োজন, সেটাই অস্বীকার করি কী করে?
আমরা আমাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে সকালবেলাতেই রওনা দিয়ে দিলাম। একটা বাইভার্বালে করে যেতে পারলে ভালো হত, কিন্তু জিগি বলল পাতাল ট্রেনে করে গেলে মানুষের ভিড়ে সহজে লুকিয়ে থাকা যাবে। আমরা আমাদের ব্যাগ নিয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই মানুষের ভিড়ে মিশে গেলাম। সুপারকন্ডাষ্টিং১৮ রেলের ওপর দিয়ে পাতাল ট্রেনটা কয়েক ঘণ্টার মাঝেই আমাদের নির্দিষ্ট শহরটিতে নিয়ে আসে। এলাকাটিতে এক ধরনের নিরানন্দ ভাব, আমি তার মাঝে খুঁজে খুঁজে পুরাতন দালানটি বের করে ফেললাম। বাইরে অপ্রশস্ত গেট, গেটের উপর জটিল একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা– ঠিক পাসওয়ার্ডটি প্রবেশ করিয়ে গেট খুলে ঢুকে যেতে হবে। বাইরে থেকে মনে হচ্ছে এই দালানটিতে কোনো মানুষজন নেই, একটা পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়ির মতো চেহারা। কে জানে হয়তো আসলেই এখানে এমনিতে মানুষজন থাকে না, প্রয়োজনে কেউ কেউ আসে।
আমি আর জিগি খানিকটা উদাসভাবে এলাকাটা একটু সতর্কভাবে ঘুরে এলাম। তারপর পুরাতন দালানটির সামনে এসে দাঁড়ালাম। ব্যাগ থেকে দুটি পানীয়ের বোতল বের করে হাতে নিয়েছি–আশপাশে মানুষজন খুব বেশি নেই। যদি হঠাৎ করে কেউ চলেও আসে দেখলে ভাববে দুই বন্ধু দেওয়ালে হেলান দিয়ে অলস মধ্যাহ্নে গল্পগুজব করছে। পানীয়ে চুমুক দিতে দিতে জিগি পেছনে দরজার নিরাপত্তা ব্যবস্থাটুকুতে চতুষ্কোণ যন্ত্রটি লাগিয়ে ফেলল। তারপর অন্যমনস্ক একটা ভঙ্গি করে ব্যাকপেক থেকে সকেটটা বের করে আমাকে চাপা গলায় বলল, কাছে এস।
আমি চাপা অস্বস্তি এবং এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে জিগির কাছে এগিয়ে গেলাম। জিগি চোরাচোখে দুই পাশে তাকিয়ে হঠাৎ চোখের পলকে আমার মাথার পেছনে ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেসে সকেটটা লাগিয়ে দিল। আমার সারা শরীরে আবার তীব্র একটা ঝাঁকুনি হয়, চোখের সামনে নানা রঙ খেলা করতে থাকে এবং কানে তীক্ষ্ণ এক ধরনের শব্দ শুনতে পাই। জিগি আমার হাত ধরে রেখে বলে, সাবধান, দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাক, পড়ে যেও না।
আমি কোনোভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম এবং হঠাৎ করে মনে হল চোখের সামনে গোলাকার বৃত্ত আসতে শুরু করেছে। আমার ভয়ংকর এক ধরনের অস্বস্তি হতে থাকে–কী করব বুঝতে পারি না এবং সেই বিচিত্র বৃত্তগুলোকে একটার ওপর আরেকটার বসানোর চেষ্টা করতে থাকি। সত্যি সত্যি সেগুলো সমন্বিত হতেই নিজের ভেতরে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব হয়–কিন্তু সেটা মুহূর্তের জন্যেই, আবার চোখের সামনে বিচিত্র কিছু ছবি ভেসে ওঠে এবং আমি সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে সেগুলোর সমন্বয় করার চেষ্টা করতে থাকি। আমি শুনতে পেলাম আমার কানের কাছে জিগি ফিসফিস করে বলছে, চমৎকার ব্রতুল, চমৎকার! চালিয়ে যাও
কতক্ষণ এভাবে চালিয়ে গিয়েছিলাম আমি বলতে পারব না–আমার মনে হল এক যুগ বা আরো বেশি এবং তখন হঠাৎ করে একসময় জিগি মাথার পেছন থেকে টান দিয়ে সকেটটা খুলে নিল। আমার মনে হল মুহূর্তের জন্যে আমার মাথার ভেতরে বুঝি একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। আমি কোনোমতে পেছনের গেটটা দুই হাতে ধরে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুনতে পেলাম জিগি ফিসফিস করে বলছে, চমৎকার ত্রাতুল, দরজা খুলে গেছে!
আমি কোনোমতে চোখ খুলে বললাম, খুলে গেছে?
হ্যাঁ। এখন কিছুই হয় নি এরকম একটা ভাব করে ভেতরে ঢুকো।
ঢুকব?
হ্যাঁ। এস।
জিগি আমার হাত ধরে ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে গেটটা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। আমি টলতে টলতে কোনোভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম, জিগি চারদিকে তাকিয়ে বলল, মনে হচ্ছে আসলেই এখানে কেউ নেই। কিন্তু কোনো রকম ঝুঁকি নেব না। এমনভাবে ভেতরে ঢুকব যেন আমরা এখানেই থাকি।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, ঠিক আছে।
কেউ যদি আমাদের লক্ষ করছে সে যেন কোনো সন্দেহ না করে।
ঠিক আছে।
যদি কিছু জিজ্ঞেস করে আমরা বলব যে ট্রাইকিনিওয়াল যোগাযোগ পরীক্ষা করার জন্যে এসেছি।
ঠিক আছে।
ভান করব যে তুমি হচ্ছ আমাদের পরীক্ষার বিষয়। তোমাকে দিয়ে আমরা সিস্টেম পরীক্ষা করি।
ঠিক আছে।
জিগি বিরক্ত হয়ে বলল, কী হয়েছে তোমার? যেটাই জিজ্ঞেস করি তার উত্তর দেও ঠিক আছে? কথা বলতে কি তোমার ইউনিট খরচ হয়?
আমি কষ্ট করে চোখ খোলা রেখে বললাম, ইউনিট খরচ হলে সহজ হত। তোমার মস্তিষ্কের নিউরনে কখনো কেউ স্টিমুলেশন দেয় নি বলে তুমি জান না।
ও! জিগি হঠাৎ করে খানিকটা ব্যস্ত হয়ে বলল, আমি বুঝতে পারি নি ব্যাপারটি এত কষ্টের। তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?
খানিকটা। একটু সময় দাও, ঠিক হয়ে যাবে।
জিগি আর কথা বলল না, আমরা পাশাপাশি হেঁটে বড় পুরাতন দালানটির ভেতরে ঢুকলাম। বাইরের গেটের পাসওয়ার্ড জানার কারণে খুব সহজেই দালানের দরজা খুলে ফেলা গেল। ভেতরে পা দিতেই অনেকগুলো বাতি জ্বলে উঠল এবং পরিশোধিত বাতাস সঞ্চালনের জন্যে কিছু পাম্প চালু হয়ে গেল—-আমরা তার চাপা গুঞ্জন শুনতে পেলাম। জিগি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, চমৎকার! তার মানে এখানে কেউ নেই।
আমি এতক্ষণে মোটামুটি নিজের পায়ের ওপর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি। করিডরটার দিকে তাকিয়ে বললাম, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে চলে কোনো একটা ঘরে ঢুকে যাই।
হ্যাঁ। জিগি উৎফুল্ল গলায় বলল, মূল পাসওয়ার্ড জেনে গেছি, এখন আর কেউ আমাদের আটকাতে পারবে না।
মাত্র দুদিন আগেই আমি এখানে ছিলাম, তাই করিডর ঘর দরজা খানিকটা পরিচিত মনে হচ্ছে। জিগিকে নিয়ে আমি নির্দিষ্ট ঘরটিতে উপস্থিত হলাম, ভেতরে কমিউনিকেশানের যন্ত্রপাতি, মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা, নেটওয়ার্ক এবং নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ সাজানো। ঘরটিতে ঢুকে জিব দিয়ে শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে জিগি এক ধরনের আনন্দধ্বনি করে বলল, এন্ড্রোমিডার কসম! এই রকম একটা জায়গা যদি আমার থাকত।
আমি অস্ত্রোপচার করার বিছানাটিতে পা ঝুলিয়ে বসে বললাম, এই তো পেয়ে গেলে! কী করবে কর।
কিন্তু পাকাপাকিভাবে তো পাই নি। অল্পক্ষণের জন্যে পেয়েছি। যাই হোক জিগি ঘাড় থেকে ব্যাগ নামিয়ে সাথে সাথে কাজে লেগে গেল। আমি যন্ত্রপাতির ঘুঁটিনাটি তার মতো এত ভালো করে জানি না বলে আপাতত বিছানায় বসে বসে তার কাজ দেখতে লাগলাম।
কিছুক্ষণের মাঝেই বোঝা গেল এটি নেটওয়ার্কের একটা বড় নোড। মানুষের নতুন অস্তিত্ব সৃষ্টি করে এখান থেকেই সেটা এই নেটওয়ার্কে প্রবেশ করানো হয়। এখান থেকে নানা ধরনের ফাইবারের অসংখ্য ক্যাবল ভূগর্ভে চলে গেছে। মূল তথ্যকেন্দ্রগুলো কোথায় কে জানে কিন্তু সবগুলোয়ই এখান থেকে যোগায়োগ করা সম্ভব। জিগি মাথায় একটা হেলমেট পরে উবু হয়ে বসে কাজ শুরু করে দেয়।
ঘণ্টাখানেক পরে উত্তেজিত গলায় জিগি বলল, পেয়েছি।
কী পেয়েছ?
মূল তথ্যকেন্দ্র।
সত্যি? আমি কাছে এগিয়ে গেলাম, জিজ্ঞেস করলাম, কোথায়?
এই দেখ বলে জিগি তার মনিটরে কিছু পরিবর্তনশীল সংখ্যা দেখাতে থাকে। টেবিলে হাত দিয়ে থাবা দিয়ে বলে, এখন শুধু ভেতরে ঢুকে যাওয়া। ঢুকে গিয়ে ইচ্ছে করলেই সব তথ্য পাল্টে দিতে পারি!
হ্যাঁ। কিন্তু আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, আমাদের অস্তিত্বগুলো কি পেয়েছ? কোথায় আছে? কেমন আছে?
আছে, আছে এখানেই আছে। জিগি সংখ্যাগুলো দেখিয়ে বলল, এর মাঝে কোনো একটা তোমাদের অস্তিত্ব। আমি ইচ্ছে করলেই এখন সব শেষ করিয়ে দিতে পারি, ধ্বংস করে দিতে পারি, উড়িয়ে দিতে পারি! জিগি আনন্দে হা–হা করে হেসে বলল, আমি এখন একটা ছোটখাটো ঈশ্বরের মতো।
থামো। আমি জিগিকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে বললাম, ঈশ্বর শুধু ধ্বংস করতে পারে না, তৈরিও করতে পারে। তুমি তো শুধু শেষ করে দেওয়ার কথা বলছ। আমরা তো শেষ করতে চাইছি না–যোগাযোগ করতে চাইছি। আমার অস্তিত্ব কিংবা রিয়ার অস্তিত্বের সাথে কথা বলতে চাইছি। তারা কেমন আছে কোথায় আছে জানতে চাইছি।
হ্যাঁ। জিগি মাথা নাড়ল, মনিটরের সংখ্যাগুলো আরো কিছুক্ষণ মনোযাগ দিয়ে লক্ষ করে বলল, সবচেয়ে ভালো হয় তুমি যদি এখানে ঢুকে যাও।
ঢুকে যাব?
হ্যাঁ। এই যে দেখ এখানে ছয়টা পরাবাস্তব জগৎ রয়েছে, এর মাঝে কোনো একটা তোমার। অন্যগুলো
অন্যগুলো কী?
জিগি মাথা চুলকে বলল, বুঝতে পারছি না। নিজে না দেখে বলা মুশকিল। তুমি ঢুকে দেখে আস। তোমার মাথায় ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস আছে–তোমার জন্যে একেবারে পানির মতো সোজা।
আমি জিগির দিকে কাতর চোখে তাকালাম, ভেতরে কী আছে কে জানে কিন্তু আমি সেখানে ঢোকার মতো সাহস পাচ্ছি না। জিগি বলল, কী হল, ঢুকবে না?
আমি একটা নিশ্বাস ফেললাম, বললাম, ঠিক আছে। ঢুকে দেখে আসি।
জিগি চকচকে চোখে বলল, তোমার কোনো ভয় নেই। এখানে অনেক যন্ত্রপাতি আছে, আমি তোমাকে খুব ভালোভাবে দেখেশুনে রাখব। বাইরের কিছু তোমার মাথায় ঢুকতে দেব না। যদি দেখি তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে।
আমি চমকে উঠে জিগির দিকে তাকালাম, বললাম, সমস্যা কী হতে পারে? কিছু একটা কি মাথায় ঢুকে যেতে পারে?
সেটা তো পারেই। ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস হচ্ছে দ্বিমুখী। তোমার মস্তিষ্ক থেকে যেতে পারে আসতেও পারে। আমি লক্ষ রাখব কিছু যেন না আসে। তুমি ভয় পেয়ো না।
আমি তবুও ভয় পেলাম, কিন্তু পেলেও আর কিছু করার নেই। অস্ত্রোপচারের উঁচু টেবিলটাতে লম্বা হয়ে শুয়ে বললাম, নাও, কী করবে কর।
আমি আমার সমস্ত স্নায়ু শক্ত করে ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবার জন্যে নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকি।
» ০৮. পরাবাস্তব জগৎ
আমি চোখ বন্ধ করে মনে মনে নিজেকে বললাম এটি একটি পরাবাস্তব জগৎ এটি আসলে কিছু বিচিত্র তথ্যের কৌশলী উপস্থাপনা, এখানে যা আছে তার কোনোটিই সত্যি নয় তাই আমি এর কিছুই দেখে অবাক হব না। তারপরও আমি চোখ খুলে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। আমার চারপাশে একটি বিচিত্র কুয়াশা ঢাকা আবছা জগৎ। কোথাও কোনো শব্দ নেই, মনে হয় নিজের নিশ্বাসের শব্দ আর হৃৎস্পন্দনও শুনতে পাব। জিগি বলেছিল এখানে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন পরাবাস্তব জগৎ রয়েছে কিন্তু এখানে একটি সুবিস্তৃত প্রান্তর ছাড়া আর কিছু নেই।
আমি খুব সাবধানে হাঁটতে থাকি, তখন মনে হল অনেক দূরে কোথাও একটি ঘণ্টা বাজছে শোনা যায় না এরকম একটি শব্দ। ঘণ্টাটি খুব গুরুগম্ভীর, মনে হয় কোনো একটি প্রাচীন মন্দিরের উপাসনার ঘণ্টা। আমি হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগুতে থাকি, ঠিক তখন দূরে কিছু জিনিস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনে হয় একটি অতি প্রাচীন উপাসনালয়, আরো কাছে যাবার পর দেখলাম সেখানে মিটমিট করে বাতি জ্বলছে। আমি আরো কাছে এগিয়ে এলাম এবং তখন এই উপাসনালয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠল। অত্যন্ত বিচিত্র কারুকাজ করা দেওয়াল, পুরো স্থাপত্যটি একেবারেই অচেনা। আমি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, ভেতরে ঢোকার কোনো দরজা নেই। আমি একটু কাছে এসে দেওয়ালটা স্পর্শ করতেই সেটা পেছনে সরে গেল, ভালো করে তাকিয়ে দেখি ভেতরে ঢোকার মতো ছোট একটা জায়গা উন্মুক্ত হয়েছে। আমি সাবধানে ভেতরে ঢুকেছি তখন হঠাৎ করে মনে হল সরসর শব্দ করে কিছু একটা পেছনে সরে যাচ্ছে। ভেতরে বিশাল একটি কক্ষ, তার কারুকাজ করা দেওয়াল। আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম এবং আমার মনে হল কারুকাজ করা দেওয়ালটি আস্তে আস্তে নড়ছে। আমার হঠাৎ করে মনে হল আমি জীবন্ত কোনো প্রাণীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার স্পষ্ট মনে হল আমি একটা প্রাণীর নিশ্বাস নেবার শব্দও শুনছি। নিশ্বাসের সাথে সাথে তার হৃৎস্পন্দন, দেহের সংকোচন, শরীরের কম্পনের শব্দ শোনা যেতে থাকে। জীবন্ত প্রাণীর এক ধরনের জৈবিক ঘ্রাণ আমার নাকে আসে, মনে হয় অশরীরী কোনো প্রাণী আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে।
আমি চোখ বন্ধ করে নিজেকে বললাম, এটি একটি পরাবাস্তব জগৎ এটি সত্যি নয়। জিগি আমার শরীরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে, ভয়ংকর কিছু ঘটলেই সে আমার ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস টেনে খুলে দেবে, তখন আমি আবার সত্যিকারের জগতে ফিরে যাব। আমি চোখ বন্ধ করেই পায়ে পায়ে পিছিয়ে এসে দেওয়াল স্পর্শ করলাম। হাতের নিচে শীতল পিচ্ছিল জীবন্ত এক ধরনের অনুভূতি– আমি নিশ্বাস বন্ধ করে ধাক্কা দিতেই সেটি উন্মুক্ত হয়ে গেল এবং আমি নিশ্বাস বন্ধ করে প্রায় ছুটে বের হয়ে এলাম। আমার অস্তিত্বকে কি এরকম কোনো একটি জায়গায় বন্দি করে রেখেছে? আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর কুলকুল করে ঘামতে থাকে।
সে আমি চোখ খুলে তাকালাম, নিজের অজান্তেই ছুটে অনেক দূরে চলে এসেছি। উপাসনালয়ের মতো দেখতে প্রাচীন স্থাপত্যটিকে আর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, শুধু বহুদূর থেকে এক ধরনের অস্পষ্ট রহস্যময় ঘণ্টার আওয়াজটি শোনা যাচ্ছে। আমি বুকভরে একবার নিশ্বাস নিলাম, কোথায় যেতে হবে কী করতে হবে কিছু বুঝতে পারছি না। এই পরাবাস্তব জগৎটি সত্যিকার জগতের মতো–এর থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই।
ঠিক এরকম সময় বহু দূরে কোথাও একটি আলো জ্বলে আবার নিবে গেল। হয়তো এটি আমার জন্যে কোনো সংকেত, হয়তো আমার ওদিকে যাবার কথা। আমি বুকের মাঝে সাহস সঞ্চয় করে সেদিকে হাঁটতে থাকি।
আলোটি জ্বলে এবং নিবে আমাকে খানিকটা বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করল। হয়তো আলোটার দিকে সোজাসুজি যাচ্ছি হঠাৎ করে দেখতে পেলাম আলোটা ডানদিকে সরে গিয়ে জ্বলে উঠেছে। ডানদিকে হাঁটছি, তখন আলোটা আবার বামদিকে সরে গিয়ে জ্বলে উঠল।
হেঁটে হেঁটে শেষ পর্যন্ত আমি আলোটা খুঁজে পেলাম। খুব আধুনিক ধরনের একটা ছোট বাসা, সেই বাসার ওপর একটি এন্টেনা এবং এন্টেনার ওপর একটি আলো–যেটি জ্বলছে এবং নিবছে, যে আলোটা দেখে আমি এখানে এসেছি। বাসাটির বাইরে একটি সাজানো লন, তার ভেতর দিয়ে নুড়ি বসানো রাস্তা চলে গেছে। আমি সাবধানে সেই রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে বাসাটির কাছে চলে এলাম। বাসার ভেতর আলো জ্বলছে, মনে হয় সেখানে কেউ আছে। আমি দরজা স্পর্শ করতেই ভেতরে কোথাও শব্দ হল। আমি একজনের পদশব্দ শুনতে পেলাম, কেউ একজন এসে দরজা খুলে দিল, আমার দিকে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, কে?
আমি মানুষটিকে ভালো করে লক্ষ করলাম, এটি পরাবাস্তব জগতের পরাবাস্তব মানুষ, কিন্তু তার সাথে সত্যিকার মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। মানুষটি মধ্যবয়স্ক, মাথার চুল সোনালি এবং চোখ নীল। গায়ের রঙ রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে, মুখে বয়স এবং অভিজ্ঞতার চিহ্ন। মানুষটি আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?
আমি বললাম, তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে আমি কি ভেতরে আসতে পারি?
মানুষটার মুখে বিচিত্র এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে। সে দরজা থেকে সরে গিয়ে বলল, এস।
আমি ভেতরে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেলাম, কী চমৎকার করে সাজানো ঘরটি, কোথাও এতটুকু বাহুল্য নেই, এতটুকু অসামঞ্জস্য নেই, শুধুমাত্র পরাবাস্তব জগতেই বুঝি এরকম চমৎকার একটি ঘর খুঁজে পাওয়া যায় আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। সোনালি চুল, নীল চোখের মধ্যবয়স্ক মানুষটি এক ধরনের অবিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, মুখে হতচকিত এক ধরনের বিস্ময় ধরে রেখে বলল, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ? এখানে কারো আসার কথা নয়।
আমি জানি।
তা হলে তুমি কোথা থেকে এসেছ? কে তুমি?
আমার পরিচয় দিয়ে কোনো লাভ নেই। আমার নাম ত্রাতুল–কিন্তু সেটাও প্রমাণ করতে পারব না। তার চাইতে বলো তুমি কে? তোমার নিশ্চয়ই একটা পরিচয় আছে, তুমি নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ।
হ্যাঁ। আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। আমি এত গুরুত্বপূর্ণ যে আমার একটা অস্তিত্বকে আলাদা সরিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে বেঁচে থাকার আনন্দের সবরকম উপকরণ আছে–তার মাঝে বাইরের কারো আসার কথা নয়। তুমি কেমন করে চলে এসেছ?
সম্ভবত ভুল করে। আমি মাথা নেড়ে বললাম, কিন্তু এসে যখন পড়েছি তোমার কাছ থেকে কিছু তথ্য নিয়ে যাই।
মানুষটার মুখে এক ধরনের উপহাসের হাসি ফুটে উঠল, বলল, কী তথ্য?
তুমি কে? তুমি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
মানুষটি মনে হল ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না যে তাকে এই প্রশ্নটি করা হয়েছে। সম্ভবত কেউ তাকে এভাবে প্রশ্ন করে না। সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি আবার বললাম, কে তুমি?
আমার নাম খ্রাউস। আমি এই পরাবাস্তব জগতের সৃষ্টিকর্তা।
আমি কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে জিজ্ঞেস করলাম, কেন তুমি এই পরাবাস্তব জগৎ সৃষ্টি করেছ?
আমি কাউকে এই প্রশ্নের জবাব দিই নি। কিন্তু তোমাকে দেব। কারণ তুমি সত্যিকারের মানুষ নও, তুমি পরাবাস্তব মানুষ। তোমাকে বললে কিছু আসে–যায় না।
কেন কিছু আসে–যায় না?
খ্রাউস হঠাৎ করে হেসে উঠল। হাসি অত্যন্ত বিচিত্র একটি প্রক্রিয়া, মানুষের ভেতরের রূপটি হাসির সাথে কেমন করে জানি প্রকাশিত হয়ে যায়। স্বাউসের হাসি দেখে আমি তাই শিউরে উঠলাম। হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম মানুষটি অসম্ভব নিষ্ঠুর। আমার মনে হল মানুষ নয়, আমি বুঝি একটি দানবের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। খ্রাউস যেরকম হঠাৎ করে হেসে উঠেছিল সেরকম হঠাৎ করে থেমে গিয়ে বলল, কারণ তুমি কিছু বোঝার আগেই তোমাকে নিশ্চিহ্ন করা হবে! এই অস্তিত্বকে এবং তোমার সত্যিকার অস্তিত্বকে।
আমার ভয় পাওয়া উচিত ছিল কিন্তু কেন জানি ভয় না পেয়ে আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলাম, বললাম, কে আমাকে নিশ্চিহ্ন করবে? তুমি?
না যুবক, তুমি বুঝতে পারছ না। তুমি কেমন করে এখানে ঢুকেছ আমি এখনো জানি, কিন্তু সেজন্য তোমাকে খুঁজে বের করে হত্যা করা হবে।
বেশ! তা হলে আমাকে হত্যা করে ফেলার আগেই আমি জেনে নেই–তুমি তা হলে বলো, কেন তুমি একটা পরাবাস্তব জগৎ তৈরি করেছ?
আমাদের গ্যালাক্সিতে প্রায় এক মিলিয়ন বুদ্ধিমান প্রাণী থাকার কথা। এতদিন তাদের কারো সাথে আমাদের যোগাযোগ হয় নি কারণ আমরা যোগাযোগ করার মতো স্তরে পৌঁছাই নি। পিঁপড়ার সাথে মানুষ যেরকম যোগাযোগ করতে পারে না, অনেকটা সেরকম। শেষ পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ হয়েছে, বছর দুয়েক আগে।
পিঁপড়া থেকে উন্নত হয়েছে? পিঁপড়ার পাখা উঠেছে?
আমার টিটকারিটা উপেক্ষা করে খ্রাউস বলল, সেই উন্নত প্রাণীর সাথে আমাদের এক ধরনের শুভেচ্ছা বিনিময়ও হয়েছে। তারা আমাদের পরাবাস্তব জগৎ তৈরি করার মতো প্রযুক্তি দিয়েছে, তার বদলে আমরা তাদেরকে–
পৃথিবীর মানুষ দিচ্ছ?
খ্রাউস খানিকক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ঠিকই অনুমান করেছ।
সেই মানুষটি হতে হবে পৃর্থিবীর নিখুঁততম মানুষ? সেজন্যে পৃথিবীর নিখুঁত মানবী তৈরি করছ?
খ্রাউস আবার চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল, তারপর বলল, তুমি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তুমি যে এই পরাবাস্তব জগতে ঢুকে পড়েছ সেটা দেখে আমি এখন আর খুব অবাক হচ্ছি না।
এই পরাবাস্তব জগৎ সেই বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে যোগাযোগের ইন্টারফেসঃ প্রাচীন উপাসনালয়ের মতো দেখতে জায়গাটির ভেতর থেকে মহাকাশের প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করা হয়?
খ্রাউস এবারে হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, তোমাকে আমি নতুন কিছুই বলতে পারলাম না। তুমি দেখছি সবই জান।
আমি শুধু একটি জিনিস জানি না।
কী জিনিস?
মানুষকে কোনো এক বুদ্ধিমান মহাজাগতিক প্রাণীর হাতে তুলে দেওয়ার সাথে তাদেরকে পরাবাস্তব জগতে সৃষ্টি করার সম্পর্ক কী?
তুমি কখনো চিড়িয়াখানায় গিয়েছ?
হ্যাঁ গিয়েছি।
চিড়িয়াখানায় বন্যপশু নিয়ে আসার আগে বনে–জঙ্গলে সেই পশুদের জীবনযাত্রা দেখে আসতে হয়। এখানেও তাই। যেসব মানুষকে পাঠানো হবে তাদের জীবনযাত্রা দেখা হচ্ছে। তাদেরকে নিয়ে খানিকটা গবেষণা করা হচ্ছে। তাদেরকে বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আমি কিছুক্ষণ খ্রাউসের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, খ্রাউস।
পৃথিবীতে আমাকে মহামান্য খ্রাউস ডাকা হয়।
এটা পৃথিবী না। তা ছাড়া আমি কখনো কাউকে মহামান্য ডাকি না। আমি মুখের মাংসপেশি শক্ত করে বললাম, খ্রাউস, তোমার কি কখনো মনে হয়েছে যে এই কাজটি পৃথিবীর মানুষের কাছে অন্যায় এবং অমানবিক বলে মনে হতে পারে?
খ্রাউস আবার শব্দ করে হেসে উঠল, নিষ্ঠুর নীল দুটি চোখ দেখে আবার আমি আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। খ্রাউস হাসতে হাসতে বলল, পৃথিবীর সাধারণ মানুষের কথা ভাবলে পৃথিবীতে কখনো সভ্যতা গড়ে উঠত না! মানুষ এখনো গুহায় বসে পাথরে পাথর ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে বুনো শূকর পুড়িয়ে পুড়িয়ে খেত। কিন্তু তা হয় নি। কেন হয় নি জান?
কেন?
কারণ পৃথিবীতে স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষের জন্ম হয়েছে। তারা সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করে, প্রয়োজনে ধ্বংস করে বড় বড় সভ্যতা গড়ে তুলেছে। পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাস হচ্ছে যুদ্ধের ইতিহাস–একটি সভ্যতা ধ্বংস করে সব সময় আরেকটি সভ্যতা গড়ে উঠেছে। আমরা এখন ঠিক সেরকম একটা মুহূর্তের কাছাকাছি আছি। পৃথিবীর এই সভ্যতা ধ্বংস করে আমরা নতুন একটা সভ্যতা গড়ে তুলব। সে
ও! আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, বুঝতে পেরেছি।
কী বুঝতে পেরেছ?
তুমি হচ্ছ ইতিহাসের সেই বিশ্বাসঘাতক। যে সব সময় নিজের জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
তোমার এসব কথা হচ্ছে অসভ্য মানুষের অশালীন ভাষা। অশালীন ভাষা ব্যবহার। করে তুমি আমাকে বিচলিত করতে পারবে না।
আমি জানি। কিন্তু তবু চেষ্টা করতে চাই।
নির্বোধ যুবক। তুমি জান তোমার জীবন শেষ হয়ে এসেছে।
সম্ভবত। আমি চোখ ঘুরিয়ে ঘরের চারপাশে তাকালাম। দেওয়ালে চমৎকার একটি শেলফ তৈরি করে তার ওপর কিছু প্রাচীন পুরাকীর্তি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কিছু মূর্তি, কিছু অলংকার। তৈজসপত্রের সাথে একটি লম্বা ধাতব দও সম্ভবত কখনো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হত। আমি এগিয়ে সেটি হাতে তুলে নিলাম।
খ্রাউস প্রচণ্ড ক্রোধে চিৎকার করে বলল, তুমি কী করছ?
আমার এটা কৌতূহল। অশালীন ভাষা ব্যবহার করে তোমাকে বিচলিত করা যায় না, কিন্তু এই ভোঁতা দণ্ডটি দিয়ে তোমাকে ঠিকমতো আঘাত করে বিচলিত করা যায় কি না দেখতে চাই!
খ্রাউস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, প্রথমে তার চোখে বিস্ময় এবং একটু পরে সেখানে এক ধরনের আতঙ্ক ফুটে ওঠে। আমি দুই হাতে ভোঁতা ধাতব দণ্ডটি শক্ত করে ধরে তার দিকে এগিয়ে গেলাম, খ্রাউস পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই আমি সমস্ত শরীরের জোর দিয়ে তাকে আঘাত করলাম। সে মাথা সরিয়ে নেবার চেষ্টা করল, কিন্তু তার পরও দণ্ডটি তার মুখে এসে আঘাত করল। সাথে সাথে চোখের নিচে খানিকটা জায়গা ফেটে রক্ত বের হয়ে আসে।
খ্রাউস কাতর আর্তনাদ করে বলল, কী করছ? কী করছ তুমি?
আমি হিংস্র গলায় বললাম, দেখছি। পরাবাস্তব জগতে কাউকে খুন করা যায় কি না দেখছি।
আমি সত্যি সত্যি উন্মত্তের মতো আবার ধাতব দণ্ডটি তুলে তাকে আঘাত করার চেষ্টা করলাম, ঠিক তখন মনে হল আমার মাথার ভেতরে একটা বিস্ফোরণ ঘটল। হঠাৎ করে সবকিছু অদৃশ্য হয়ে যায় এবং আমি জিগির ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম–কী হয়েছে ত্রাতুল? কী হয়েছে তোমার?
আমি মাথা চেপে ধরে কোনোমতে উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বললাম, কিছু হয় নাই। একজনকে খুন করার চেষ্টা করছিলাম।
কাকে?
আমি উত্তর দেবার আগেই খুট করে দরজা খুলে গেল। দেখলাম সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক মানুষ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
পেছন থেকে একজন মানুষ হেঁটে আসছে। মানুষটির সোনালি চুল এবং নীল চোখ। মানুষটি মধ্যবয়স্ক এবং সুদর্শন।
মানুষটি খ্রাউস এবং আমি কয়েক মুহূর্ত আগে তাকে পরাবাস্তব জগতে খুন করার চেষ্টা করেছি।
০৯. খ্রাউস
নিরাপত্তা বাহিনীর কালো পোশাক পরা মানুষগুলো হেঁটে আমাদের খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো আমাদের দিকে তাক করে ধরল। যে কোনো একটি অস্ত্র দিয়েই তারা আমাকে ভস্মীভূত করে দিতে পারে, তার পরও কেন এতগুলো অস্ত্র আমাদের দিকে তাক করে রেখেছে সেটি একটি রহস্য!
নিরাপত্তা বাহিনীর লোকগুলোর পেছন থেকে খ্রাউস হেঁটে হেঁটে সামনে এসে দাঁড়ায়, আমি দেখতে পেলাম তার পেছনে আরো কয়েকজন মানুষ। তিনজনকে আমি বেশ ভালো করে চিনি–অত্যন্ত হৃদয়হীন এই তিনজন মানুষ আমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করেছিল, তারা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্যদের আমি চিনি না–ক্রানা নামের সেই ডাক্তার মেয়েটিকে খুঁজলাম কিন্তু তাকে দেখতে পেলাম না।
খ্রাউস খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে এবং জিগিকে খানিকক্ষণ লক্ষ করল, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, যখন শুনতে পেলাম পরাবাস্তব নেটওয়ার্কে কেউ ঢুকে গেছে তখন তাদের নিজের চোখে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।
জিগি কোনো কথা বলল না, যে কোনো জায়গাতে পৌঁছেই সে প্রথমেই পালিয়ে যাবার একটা ব্যবস্থা করে রাখে। এখানে সেটা করতে পারে নি বলে অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে আছে। আমি খ্রাউসের দিকে তাকিয়ে বললাম, দেখে কি তোমার আশাভঙ্গ হয়েছে?
নিশ্চয়ই হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম দেখব খুব বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ, তার বদলে দেখছি একেবারে আজেবাজে অপদার্থ ফালতু মানুষ।
তোমার আশাভঙ্গের কারণ হবার জন্যে খুব দুঃখিত। তবে আমি ইচ্ছে করে। বাক্যটা অসমাপ্ত রেখে থেমে গেলাম।
খ্রাউস তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তবে?
তবে পরাবাস্তব জগতে তোমার অস্তিত্বটির কিন্তু আশাভঙ্গ হয় নি। সে অত্যন্ত চমৎকৃত হয়েছে।
আমার কথা শুনে খ্রাউস বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, আমি দেখলাম তার সমস্ত মুখমণ্ডল মুহূর্তে রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে যায়, অনেক কষ্ট করে সে নিজেকে সংবরণ করে এবং জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলে, তাই নাকি?
হ্যাঁ। আমিও মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, তোমার সাথে আমার পরিচয় হয় নি কিন্তু পরাবাস্তব খ্রাউসের সাথে আমার চমৎকার একটা পরিচয় হয়েছে। অত্যন্ত চমৎকার।
খ্রাউস অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলল, আমি দেখতে পেলাম তার চোখ দুটো মুহূর্তের জন্যে হিংস্র শ্বাপদের মতো জ্বলে উঠল। এই মানুষটি তার পরাবাস্তব অস্তিত্বের মতোই নিষ্ঠুর।
খ্রাউস মাথা ঘুরিয়ে পুরুষের মতো দেখতে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্লিশা তুমি নেটওয়ার্কটি দেখ–এর ভেতরের তথ্য বিকৃত হয়েছে কি না জানা দরকার।
আমি ক্লিশার দিকে তাকিয়ে বললাম, শুভ অপরাহ্ন ক্লিশা! আমি তোমাকে বলেছিলাম আবার আমাদের দেখা হবে–তুমি তখন আমার কথা বিশ্বাস কর নি। দেখা হল কি না?
ক্লিশা আমার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকাল, কোনো কথা বলল না। তার সাথে সাথে লাল চুলের মানুষটি এবং সরীসৃপের মতো মানুষটি যন্ত্রপাতির দিকে এগিয়ে গেল। জিগি তাদের কাছে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষগুলো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র উঁচু করে তাকে থামাতে চেষ্টা করে। জিগি খানিকটা অবহেলায় অস্ত্রগুলো সরিয়ে বলল, শুধু শুধু বিরক্ত করো না–তোমরা খুব ভালো করে জান এই ঘরে তোমরা এই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না–তোমাদের শখের নেটওয়ার্ক নোড় তা হলে ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাবে।
কথাটি সত্যি এবং তাই নিরাপত্তা বাহিনীর খুব অপমান বোধ হল, তারা তখন অস্ত্রের বাট দিয়ে জিগির মাথায় আঘাত করে তাকে নিচে ফেলে দিল। খ্রাউস হাত তুলে বলল, ওদের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত জানে মেরো না।
নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা খ্রাউসের কথামতো তাকে জানে না মেরে শারীরিকভাবে অমানুষিক নিষ্ঠুরতায় কয়েকবার আঘাত করল। আমি দেখতে পেলাম জিগির ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে এসেছে কিন্তু সেটি উপস্থিত কাউকেই এতটুকু বিচলিত করল না।
ক্লিশা এবং তার দুজন সঙ্গী তাদের যন্ত্রপাতির ওপর ঝুঁকে পড়ে এবং কিছুক্ষণের মাঝেই তাদেরকে অত্যন্ত বিভ্রান্ত দেখাতে থাকে। খ্রাউস ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
বুঝতে পারছি না। ক্লিশা আমতা–আমতা করে বলল, মনে হচ্ছে ভেতরে সব ওলটপালট হয়ে গেছে–সিকিউরিটির অংশটুকু ওভারলোড হয়েছে। ছয়টা স্তর আছে। সেগুলো এমনভাবে জট পাকিয়েছে যে–
যে?
আলাদা করাই মুশকিল।
খ্রাউসের মুখ ধীরে ধীরে রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে। সে হিংস্র দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে আরেকবার জিগির দিকে তাকিয়ে দাতে দাঁত ঘষে বলল, কী করেছ তোমরা?
জিগি হাতের উল্টোপৃষ্ঠা দিয়ে ঠোঁটের রক্ত মুছে বলল, সেটাই তোমাদের বলতে চাইছিলাম, তোমার নির্বোধ বোম্বেটে বাহিনী বলতে দেয় নি। আমাকে আচ্ছামতো পিটিয়েছে।
ঠিক আছে, এখন বলো।
এখন একটু দেরি হয়ে গেছে। আমার আর বলার ইচ্ছে করছে না।
জিগি জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, পারলে তোমরা নিজেরা বের করে নাও।
ক্লিশা তাড়াতাড়ি করে বলল, মহামান্য খ্রাউস, আমরা এক্ষুনি বের করে ফেলছি। এই সব তুচ্ছ মানুষের কথায় কোনো গুরুত্ব দেবেন না।
খ্রাউস একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুচ্ছ মানুষের কথায় যেটুকু গুরুত্ব দেবার কথা তার থেকে বেশি গুরুত্ব আমি দিই না। তবে যেটুকু না দিলেই নয় সেটুকু গুরুত্ব আমি দিই।
খ্রাউসের কথায় কী ছিল আমি জানি না কিন্তু দেখতে পেলাম ক্লিশা আতঙ্কে কেমন যেন শিউরে উঠল।
খ্রাউস খানিকক্ষণ অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে থাকে তারপর কেমন যেন ক্লান্তভাবে একটা নিশ্বাস ফেলে নিরাপত্তা বাহিনীর একজন অফিসারকে বলল, এই দুজনকে কোনো একটি জায়গায় আটকে রেখো–আমার এদের সাথে কথা বলতে হবে।
নিরাপত্তা বাহিনীর অফিসারটি মাথা নেড়ে সাথে সাথেই আমাদের দুজনকে দু পাশ থেকে ধরে নিয়ে যেতে থাকে।
.
আমাদের দুজনকে যে ঘরটিতে আটকে রাখল সেখানে আরো একজন মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে। মানুষটির নিশ্চয়ই কোনো একটা বিশেষত্ব রয়েছে, কারণ তাকে একটা খাঁচার ভেতরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে এবং তার হাত ও পা শিকল দিয়ে বাঁধা। মানুষটির মুখে এক ধরনের উদাস ভাব এবং আমাদের দুজনকে দেখে নিস্পৃহভাবে তাকাল। আমি এবং জিগি মানুষটির কাছে এগিয়ে গেলাম, কাছাকাছি যেতেই মানুষটি বলল–বেশি কাছে এস না, খাঁচার দেওয়ালে হাই ভোল্টেজ দিয়ে রেখেছে। শক খাবে।
আমরা থেমে গেলাম, খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
আমাকে ভয় পায়।
কেন?
কারণ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ।
সবচেয়ে খারাপ মানুষ?
হ্যাঁ। মানুষটি মুখে এক ধরনের হাসি ফুটিয়ে আমার দিকে তাকাল, আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করি। সেখানে ভয়ংকর একটি অমানবিক দৃষ্টি দেখে বুকের ভেতরে এক ধরনের কাঁপুনি হতে থাকে। আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, মানুষ সবচেয়ে খারাপ কেমন করে হয়?
হয় না। তৈরি করতে হয়। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরি করতে হয়।
তোমাকে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরি করেছে?
হ্যাঁ। মানুষটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসার মতো ভঙ্গি করল এবং সেটি দেখে আমি আবার শিউরে উঠলাম। মানুষটির সোনালি চুল এবং সবুজ চোখ, অত্যন্ত সুগঠিত দেহ, উঁচু চোয়াল এবং খাড়া নাক। মানুষটির চেহারায় একটি অত্যন্ত বিচিত্র পাশবিক ভাব রয়েছে, দেখে এক ধরনের আতঙ্ক হয়। মানুষটি একটি নিশ্বাস ফেলে বলল, অনেক গবেষণা করে আমাকে তৈরি করেছে। আমার মনে হয় মোটামুটি নিখুঁতভাবেই তৈরি করেছে।
জিগি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কৌতূহল নিয়ে মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, কেন একথা বলছ?
কারণ আছে বলেই বলছি। যেমন মনে কর
কী?
তোমরা দুজন ঘরে আসতেই আমি প্রথমেই ভাবলাম কীভাবে তোমাদের খুন করা যায়।
খুন করা যায়?
হ্যাঁ। ভেবে বের করেছি।
তুমি বলতে চাও তুমি এই খাঁচার ভেতর থেকে আমাদের দুজনকে খুন করতে পারবে?
হ্যাঁ।
কীভাবে?
মানুষটি কোনো কথা না বলে আবার হাসল এবং আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম সে সত্যি কথা বলছে। আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আমার নাম ব্রাতুল। জিগিকে দেখিয়ে বললাম, ও হচ্ছে জিগি।
মানুষটি এক ধরনের অবহেলার ভঙ্গি করে হাত নাড়ল। নিজে থেকে নাম বলল না বলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী?
আমার নাম কী তাতে কিছু আসে–যায় না। যে পরিবেশে একজন মানুষের নাম ব্যবহার করতে হয় আমাকে কখনো সেখানে যেতে দেওয়া হবে না। কাজেই আমার নামের কোনো প্রয়োজন হয় না।
তুমি কি বলতে চাইছ তোমার কোনো নাম নেই?
মাঝে মাঝে আমাকে নুরিগা বলে সম্বোধন করে। এটা আমার নাম কি না আমি জানি না।
তোমার সাথে পরিচিত হয়ে সুখী হলাম নুরিগা।
বাজে কথা বোলো না। আমার সাথে পরিচিত হয়ে কেউ সুখী হয় না। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ।
পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ? কী আশ্চর্য!
নুরিগা ঘুরে আমার দিকে তাকাল, তারপর বলল, কেন? আশ্চর্য কেন?
কারণ পৃথিবীতে একজন সবচেয়ে নিখুঁত মানুষও আছে–তার নাম রিয়া। তাকেও জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরি করা হয়েছে।
নুরিগা খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ আমি শুনেছি। আমি যেরকম পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ, সেরকম পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো একজন মানুষ আছে। সবচেয়ে ভালো এবং নিখুঁত।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, হ্যাঁ আছে।
তার সাথে আমার দেখা করার খুব ইচ্ছে করে।
হঠাৎ আমার বুক কেঁপে উঠল, আমি শুকনো গলায় বললাম, কেন?
কৌতূহল।
তার সাথে দেখা হলে তুমি কী করবে?
নুরিগা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, খুন করব। খুন করায় এক ধরনের আনন্দ আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষটিকে খুন করার সবচেয়ে নিখুঁত আনন্দ।
নুরিগা হঠাৎ শব্দ করে হাসতে শুরু করে, সেই ভয়ংকর হাসি শুনে আমি পিছিয়ে আসি। ভয়ার্ত চোখে আমি জিগির দিকে তাকালাম। জিগি প্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, বলল, কী হয়েছে?
আমি ফিসফিস করে বললাম, না, কিছু হয় নি। আমার শুধু মনে হচ্ছে—
কী মনে হচ্ছে?
এরা নুরিগাকে পরাবাস্তব জগতে পাঠাবে।
কেন?
জানি না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তাকে নিশ্চয়ই পাঠাবে।
জিগি কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
নুরিগা, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষটি তার ছোট খাঁচার ভেতরে বসে হাত এবং পায়ের শিকল নাড়িয়ে বিচিত্র এক ধরনের গান গাইতে থাকে, সেই গানে সুর বা মাধুর্য কিছুই নেই কিন্তু তবুও শুনতে কেমন যেন আনন্দ হয়। আমি এবং জিগি ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে সেই গান শুনতে শুনতে অপেক্ষা করতে থাকি। ঠিক কিসের জন্যে অপেক্ষা করছি জানি না বলে সেটি হয় খুব দীর্ঘ এবং খুব কষ্টকর।
দীর্ঘ সময় পর হঠাৎ করে দরজা খুলে গেল এবং সরীসৃপের মতো দেখতে মানুষটি আরো কয়েকজন মানুষকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। নুরিগার খাঁচাটিকে তারা যন্ত্রপাতি দিয়ে ধরে টেনে বাইরে নিতে থাকে–নুরিগা কোনো রকম উত্তেজনা না দেখিয়ে চুপ করে বসে থাকে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, বিদায় নুরিগা।
নুরিগা কোনো কথা বলল না, সে আমার কথাটি শুনেছে বলে মনে হল না। আমি আবার বললাম, নুরিগা, তুমি কিন্তু আসলে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ নও।
নুরিগা আমার দিকে প্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল। আমি বললাম, প্রথম যখন আমরা তোমার। কাছে আসছিলাম, তুমি কী বলেছিলে জান?
কী?
বলেছিলে আমরা যেন তোমার বাঁচার কাছে না আসি। কাছে এলে শক খাব। তুমি আমাদের ইলেকট্রিক শক থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলে। খারাপ মানুষ কাউকে রক্ষা করে না।
নুরিগা বিভ্রান্তভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে দেখিয়ে বললাম, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ হচ্ছে এরা যারা জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তোমাকে তৈরি করেছে।
নুরিগার মুখ দেখে মনে হল সে কী যেন ঠিক বুঝতে পারছে না, আমি নরম গলায় বললাম, তোমাকে একটা জিনিস বলা হল না।
ততক্ষণে নুরিগাকে তার খাঁচার ভেতরে করে ঘরের বাইরে বের করে নিয়েছে। সে কৌতূহলী হয়ে উঠে দাঁড়াল, বলল, কী জিনিস?
রক্তের রঙ লাল।
কী বললে?
রক্তের রঙ লাল। সবুজ নয়—
আমি বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছ।
ততক্ষণে নুরিগাকে অনেক দূর নিয়ে গেছে–আমি চিৎকার করে বললাম, আবার যখন দেখা হবে তখন বলব।
জিগি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, তুমি কী বলছ?
ঠিকই বলছি।
কী ঠিক বলছ?
নুরিগাকে নিচ্ছে তার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করতে। তাকে পরাবাস্তব জগতে পাঠাবে। সম্ভবত আমার আর রিয়ার অস্তিত্বকে খুন করার জন্যে।
খুন করার জন্যে?
হ্যাঁ। তাই তাদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি।
বাঁচানোর চেষ্টা? কীভাবে?
নুরিগাকে দিয়ে আমার অস্তিত্বের কাছে একটা খবর পাঠালাম।
কী খবর?
আমি বিড়বিড় করে বললাম, রক্তের রঙ লাল।
জিগি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
১০. পলাতক জীবন
আগুনটাকে খুঁচিয়ে তার শিখাটাকে একটু বাড়িয়ে দিলাম, রিয়া দুই হাতে সেখান থেকে খানিকটা উষ্ণতা নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমি কখনোই চিন্তা করি নি আমাকে এভাবে বন্য পশুর মতো লুকিয়ে থাকতে হবে।
আমি খুব দুঃখিত রিয়া।
কেন? তুমি কেন দুঃখিত ত্রাতুল?
আমার সাথে তোমার দেখা হল বলেই তো এই যন্ত্রণা। আমিই তো প্রথম বুঝতে পেরেছি যে এটা আসলে পরাবাস্তব জগৎ আমরা আসলে কৃত্রিম! যদি সেটা তুমি না জানতে তা হলে তোমার চমৎকার গেস্ট হাউজে আরামে থাকতে
একটা সত্য না জেনে আরামে থেকে কী হবে?
তোমার তাই ধারণা?
হ্যাঁ। রিয়া মাথা নেড়ে বলল, আমার মনে হয় সত্য কথাটা জানা খুব দরকার। জেনে হয়তো লাভ থেকে ক্ষতি বেশি হয় কিন্তু তবুও জানা দরকার। সত্য হচ্ছে সত্য।
কিন্তু এটা কী ভয়ংকর একটা ব্যাপার! তুমি চিন্তা করতে পার আমরা কোনো একটা যন্ত্রের ভেতরে রাখা কিছু তথ্য? বিশ্বাস করতে পার?
রিয়া মাথা নাড়ল, বলল, পারি না।
সে আরো কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, আমিও কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম, কোনো একটা বন্য পশু দূর দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। আমি গোপন তথ্যকেন্দ্রের কিছু যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সত্যিকারের ত্রাতুলের কাছে খবর পাঠানোর পর থেকে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন হন্যে হয়ে খুঁজছে। আমরা সেই থেকে বনে–জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
রিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে বলেছিল এখানে সাতদিন থাকতে হবে। আজ তো সাতদিন হয়ে যাবে–এখন কী করবে বলে মনে হয়?
হয়তো তোমার স্মৃতিকে তোমার সত্যিকার অস্তিত্বে স্থানান্তর করে দেবে।
রিয়া চমকে উঠে বলল, আর তোমাকে?
আমি তুচ্ছ মানুষ সাধারণ মানুষ। আমার অস্তিত্বকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করবে না।
তা হলে? তা হলে কী হবে?
যন্ত্রের মাঝে রাখা সেই তথ্যগুলো মুছে দেবে–আমিও মুছে যাব।
রিয়া এক ধরনের যন্ত্রণাকাতর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, মনে হল সে আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। সে মাথা নেড়ে বলল, না না, এ কী করে হয়?
আমার রিয়ার জন্যে এক ধরনের মায়া হল। তার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললাম, তুমি এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। যা হবার হবে।
রিয়া খপ করে আমার দুই হাত ধরে বলল, কী বলছ তুমি যে, যা হবার হবে? তোমার কিছু একটা হলে আমার কী হবে?
তোমার কিছুই হবে না। আমাদের এই কয়দিনের জীবন একটা স্বপ্নের মতো। তুমি কি স্বপ্নে দেখা কোনো মানুষের জন্যে কষ্ট পাও?
না। রিয়া মাথা নেড়ে বলল, এটা স্বপ্ন না। এটা সত্যি।
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। রিয়ার দিকে তাকিয়ে বুকের মাঝে সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের কষ্ট অনুভব করতে থাকি। এই অনুভূতির নামই কি ভালবাসা! রিয়ার সুন্দর মুখটির দিকে তাকিয়ে নিশ্চয়ই আমার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠেছিল, কারণ রিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হল তুমি হাসছ কেন?
আমি বললাম, হঠাৎ একটা কথা মনে হল তাই।
কী কথা?
সত্যিকারের রিয়া আর সত্যিকারের ত্রাতুলের কথা।
তাদের কী কথা?
সত্যিকারের পৃথিবীতে সত্যিকারের রিয়া হচ্ছে রাজকুমারী রিয়া–আর সত্যিকারের ত্রাতুল হচ্ছে একেবারে তুচ্ছ একজন মানুষ। তারা একজন আরেকজনকে চিনেও না। যদি তাদের মাঝে স্মৃতি স্থানান্তর না হয় তা হলে তারা কোনোদিন জানতেও পারবে না এই। পরাবাস্তব জগতে তারা কত কাছাকাছি দুজন মানুষ।
রিয়া আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমি দেখলাম তার চোখে পানি টলটল করছে, সে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল, এটা চিন্তা করে তুমি হাসছ? হাসতে পারছ?
আমি রিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বললাম, তুমি হচ্ছ পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ, তোমার অনুভূতি পৃথিবীর সবচেয়ে পরিশুদ্ধ অনুভূতি! আমার বেলায় সেটা অন্যরকম, যেটা আনন্দের নয় তার মাঝেও কেমন জানি কৌতুক খুঁজে পাই।
রিয়া মাথা নাড়ল, বলল, না, তুমি ওরকম করে কথা বলো না, কখনো বলো না।
আমি কোনো কথা না বলে আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
খুব ভোরবেলা হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আগুনের পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে রিয়া শুয়ে আছে। আমি একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম, কখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। আমার মনে হল কোনো একজন মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, শুকনো পাতা মাড়িয়ে কে যেন এগিয়ে আসছে। ভোরের আবছা আলোতে দেখতে পেলাম একজন। দীর্ঘদেহী মানুষ রিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে–মানুষটি এক হাতে আলতোভাবে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ধরে রেখেছে।
আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইলাম, মানুষটি নিঃশব্দে রিয়ার কাছে এগিয়ে এল, ঘুমন্ত রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল, আবছা আলোতে দেখা যাচ্ছে কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে হল তার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠেছে। মানুষটি আমাকে দেখে নি, আমি নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। যদি সে রিয়াকে আঘাত করার চেষ্টা করে আমার তাকে উদ্ধার করতে হবে। এটি পরাবাস্তব জগৎ হতে পারে, আমাদের অস্তিত্ব কৃত্রিম হতে পারে কিন্তু মানুষগুলো সত্যি।
মানুষটি তার অস্ত্র হাত বদল করল এবং একটা লিভার টেনে অস্ত্রটি পুরোটা রিসেট করে নিল, সেই শব্দে রিয়া হঠাৎ করে জেগে ওঠে। সে ধড়মড় করে উঠে বসল, বিস্ফারিত চোখে মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, কে? কে তুমি?
মানুষটি মাথার এলোমেলো সোনালি চুলকে পেছনে সরিয়ে বলল, আমার কোনো নাম নেই। অনেকে নুরিগা বলে ডাকে। আমি হচ্ছি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষগুলোর জিন্স নিয়ে আমাকে তৈরি করা হয়েছে।
রিয়া কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে নুরিগার দিকে তাকিয়ে রইল। নুরিগা হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমি শুনেছি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ হচ্ছ তুমি। তোমাকে দেখার একটা শখ ছিল।
রিয়া দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, এভাবে দেখা হবে আমি ঠিক বুঝতে পারি নি।
আমিও পারি নি। আমাকে সব সময় একটা খাঁচার মাঝে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখত। এখন কী মনে করে ছেড়ে দিয়েছে।
ছেড়ে দিয়েছে?
হ্যাঁ। শুধু ছেড়ে দিয়েছে তাই নয়, আমাকে একটা অস্ত্রও দিয়েছে। সেই অস্ত্র নিয়ে সারা রাত তোমাকে খুঁজছি।
আমাকে খুঁজছ?
হ্যাঁ। আমাকে বলেছে তোমাকে খুঁজে বের করতে। আমি অবিশ্যি সেজন্যে তোমাকে খুঁজি নি, নিজের কৌতূহলে খুঁজছি।
রিয়া শুকনো গলায় বলল, কিসের কৌতূহল?
দেখার কৌতূহল। প্রতিশোধ নেবার কৌতূহল।
প্রতিশোধ নেবার?
হ্যাঁ। দীর্ঘদেহী সোনালি চুলের মানুষটি তার অস্ত্রটি উদ্যত করে বলল, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ হিসেবে জন্ম নিতে চাই নি, কিন্তু আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ হয়ে জন্ম নিতে হয়েছে এবং শিকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় জীবন কাটাতে হয়েছে। তুমিও পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ হয়ে জন্ম নিতে চাও নি, কিন্তু তুমি সেভাবে জন্ম নিয়ে পৃথিবীর যত আনন্দ–সুখ সব ভোগ করছ। ব্যাপারটি ঠিক নয়–আমি সেই ত্রুটিটি শোধরাব।
কিছু বোঝার আগেই আমি দেখতে পেলাম নুরিগা তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি রিয়ার দিকে তাক করেছে। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, সাতদিন পর এভাবে তা হলে রিয়ার অস্তিত্বকে শেষ করে দেবার পরিকল্পনা করেছে? কিন্তু সেটি তো আমি হতে দিতে পারি না আমি নিঃশব্দে এগিয়ে পেছন থেকে মানুষটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
আমার আচমকা আঘাতে মানুষটি পড়ে গেল, তার হাতের অস্ত্রটি একপাশে ছিটকে পড়ল। আমি মানুষটিকে নিচে চেপে রেখে অস্ত্রটি হাতে তুলে নেবার চেষ্টা করলাম কিন্তু মানুষটির শরীরে অমানুষিক জোর, ধাক্কা দিয়ে আমাকে নিচে ফেলে দিয়ে সে হিংস্র ভঙ্গিতে আমার টুটি চেপে ধরে। তার শক্ত লোহার মতো আঙুল আমার গলায় সঁড়াশির মতো চেপে বসে। আমি প্রাণপণে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করি কিন্তু তার অমানুষিক শক্তির কাছে আমি একেবারে অসহায়। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, এবং এক ধরনের অক্ষম আক্রোশে আমি মানুষটির মুখের দিকে তাকালাম–সোনালি চুল এবং সবুজ চোখের মানুষটিতে কী ভয়ংকর জিঘাংসা–
হঠাৎ করে মানুষটির হাত আলগা হয়ে গেল। সে আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, তুমি? তুমি এখানে?
আমি কাশতে কাশতে কয়েকবার বুক ভরে নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করতে করতে বললাম, তুমি আমাকে চেনো?
মানুষটি অবাক হয়ে বলল, কেন চিনব না? তুমি ভ্রাতুল। একটু আগেই তো তোমার সাথে কথা বললাম!
আমি মানুষটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিকার ভাতুলের সাথে এই মানুষটির যোগাযোগ হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষটির সাথে তার কেমন করে যোগাযোগ হল?
নুরিগা নামের মানুষটি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি এখানে কেমন করে এসেছ?
আমি গলায় হাত বুলিয়ে বললাম, সে অনেক বড় ইতিহাস।
নুরিগা মাথা নেড়ে বলল, তোমার সব কাজ, সব কথাবার্তা হেঁয়ালিপূর্ণ, তুমি সোজা ভাষায় কথা বলতে পার না?
কেন, কী হয়েছে? আমি কী বলেছি?
তুমি একটু আগে আমাকে বললে, রক্তের রঙ লাল।
তাই বলেছি? আর কী বলেছি?
আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? নুরিগা বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি জান না তুমি কী বলেছ!
তবু আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
বলেছ রক্তের রঙ সবুজ নয়। বলেছ আবার যখন দেখা হবে তখন সব বুঝিয়ে বলবে।
আমি নুরিগার দিকে তাকিয়ে রইলাম, নুরিগা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আবার দেখা হল এখন বুঝিয়ে বলল।
আমি কাঁপা গলায় বললাম, বলব। অবিশ্যি বলব। আমাকে একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে দাও।
ঠাণ্ডা মাথায় কী ভাবতে চাও?
আমার কাছে যে তথ্যটা পাঠানো হয়েছে।
কে তথ্য পাঠিয়েছে?
আমি পাঠিয়েছি।
তুমি পাঠিয়েছ? তুমি কার কাছে পাঠিয়েছ?
আমি আমার কাছে পাঠিয়েছি।
নুরিগা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
.
রিগাকে প্রকৃত ব্যাপারটি বোঝানো খুব সহজ হল না। বোঝনোর পরও সে আমাদের কথা বিশ্বাস করল না। শেষ পর্যন্ত যখন সে বিশ্বাস করল তখন তার প্রতিক্রিয়াটি হল অত্যন্ত বিচিত্র। প্রথমে এক ধরনের অবর্ণনীয় আতঙ্ক এবং শেষে এক ভয়ংকর ক্রোধ। ক্রোধটি কার ওপর সে জানে না, একবার মনে হল প্রচণ্ড আক্রোশে সে রিয়া এবং আমাকেই শেষ করে দেবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিল। ক্রোধটি শান্ত হয়ে যাবার পর তার ভেতরে। এক বিচিত্র দুঃখবোধ এসে ভর করল। আহত পশুর মতো সে দুই হাতে নিজের মাথা আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। রিয়া গভীর মমতায় তার হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন কাঁদছ নুরিগা?
আমি ভেবেছিলাম আমাকে ওরা মুক্তি দিয়েছে। আমাকে আর শেকল পরে খাঁচার ভেতরে থাকতে হবে না। কিন্তু আসলে মুক্তি দেয় নি। এই অস্তিত্বকে মুক্তি দিয়েছে–যেই অস্তিত্বের কোনো অর্থ নেই, কোনো মূল্য নেই!
আমি নরম গলায় বললাম, আছে। মূল্য আছে।
কীভাবে মূল্য আছে?
আমি এখনো জানি না। কিন্তু মনে নেই ত্রাতুল তোমাকে দিয়ে আমার কাছে খবর পাঠিয়েছে।
কী খবর পাঠিয়েছে?
রক্তের রঙ লাল, সবুজ নয়।
তার অর্থ কী?
আমি এখনো জানি না–কিন্তু সেই অর্থ খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের জানতে হবে কার রক্ত লাল নয় সবুজ।
কীভাবে সেটি জানবে?
প্রথমে যাই নেটওয়ার্ক কেন্দ্রে। লুকিয়ে থাকার দিন শেষ হয়েছে এখন সামনাসামনি প্রশ্ন করতে হবে।
নুরিগা তার চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল, বলল, চলো।
আমি তার হাত স্পর্শ করে বললাম, নুরিগা!
কী?
তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ কথাটি আমি বিশ্বাস করি না।
নুরিগা একটু হাসল, বলল, তুমি এই কথাটি আগেও আমাকে বলেছ।
সত্যি?
হ্যাঁ। সত্যি। নুরিগা আমার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, তোমাকে ধনবাদ। ত্রাতুল। এই একটি কথা কারো মুখ থেকে শোনা খুব প্রয়োজন ছিল।
ধন্যবাদ।
নুরিগা এবারে ঘুরে রিয়ার দিকে তাকাল, তারপর শোনা যায় না এরকম গলায় বলল, রিয়া আমি দুঃখিত যে তোমাকে আমি খুন করতে চেয়েছিলাম।
রিয়া হেসে ফেলল, আমার মনে হয় কিছু একটা করতে চাওয়া আর কিছু একটা করার মাঝে অনেক বড় পার্থক্য। আমি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ, কিন্তু আমার মাথায় কী চিন্তা আসে এবং আমি কী কী বিদঘুঁটে কাজ করতে চাই শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে।
নুরিগা অনেকটা আপনমনে বিড়বিড় করে বলল, আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি। আমাকে সব সময় বলা হয়েছে আমি খারাপ–আমাকে জঘন্য অপরাধ করতে হবে। কিন্তু এখন দেখছি সেটা সত্যি নয়। তোমাদের সাহায্য করব চিন্তা করেই আমার ভালো লাগছে। অন্য রকম একটা ভালো লাগার অনুভূতি!
হ্যাঁ। রিয়া মাথা নাড়ল, বলল, আমার মনে হয় এটাই হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার গোপন কথা। অন্যের জন্যে কিছু একটা করা।
.
নেটওয়ার্ক কেন্দ্রে আমরা যখন পৌঁছেছি তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। পুরো এলাকাটির মাঝে এক ধরনের শান্ত এবং কোমল ভাব রয়েছে কিন্তু ঠিক কী কারণ জানি না, আজকে তার মাঝেও আমি এক ধরনের অস্থিরতা খুঁজে পেতে ক্ষ করেছি। কেন্দ্রের দরজায় আমি কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার আশঙ্কা করেছিলাম কিন্তু দেখা গেল সেরকম কিছু নেই। আমরা গেট খুলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। লম্বা করিডর ধরে হেঁটে একটা প্রশস্ত ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নুরিগা বলল, এই যে, এখান থেকে আমাকে যেতে দিয়েছে।
আমারও ঘরটির কথা মনে পড়ল, এখানেই আমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং হয়েছিল। নুরিগা ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে দিতেই ভেতরের মানুষেরা ঘুরে আমাদের দিকে তাকাল, তাদের মুখে এক ধরনের বিষয়। আমি মানুষগুলোকে চিনতে পারলাম, এরা আমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করেছিল। লাল চুলের শিরান নামের মানুষটি বলল, তোমরা? তোমরা এখানে কেন এসেছ?
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম, বলছি কেন এসেছি। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমাদের হাতে সময় খুব বেশি নেই। তাই কোনো ভূমিকা না করে আমরা সোজাসুজি কাজের কথায় চলে আসি।
শিরান, রিকি বা ক্লিশা কেউ কোনো কথা বলল না, এক ধরনের স্থির চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি একটা নিশ্বাস নিয়ে বললাম, আমরা জানি এটা পরাবাস্তব জগৎ–এখানে আমরা সবাই কৃত্রিম, সবাই কোনো যন্ত্রের তথ্য। আমরা তথ্য হিসেবে থাকতে চাইছি না, আমাদের প্রকৃত অস্তিত্বের সাথে মিলিত হতে চাইছি। তাই আমরা সত্যিকার পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে এসেছি।
মানুষ তিনজন অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল, রিকি মাথা নেড়ে বলল, তোমরা কী বলছ আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আমি হেসে বললাম, তোমার কথা আমার কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।
নুরিগা হঠাৎ দুই পা এগিয়ে এসে বলল, এরা সোজা কথা বুঝতে চায় না। আচ্ছা মতন রগড়ানি দিতে হবে। আমার চাইতে ভালো রগড়ানি কেউ দিতে পারে বলে মনে হয় না।
নুরিগা সত্যি সত্যি কিছু একটা করে ফেলে কি না সেটি নিয়ে আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠে তাকে থামানোর চেষ্টা করে বললাম, মাথা গরম করো না নুরিগা, কথা বলে দেখা যাক।
নুরিগা তার অস্ত্রটি ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তিনজনের একজনকে খুন করে ফেলি তা হলে অন্য দুটো সোজা হয়ে যাবে।
না না আগেই খুন করতে যেও না।
ঠিক আছে খুন না করতে পারি, কিন্তু রক্তের রঙটা তো পরীক্ষা করে দেখতে পারি বলে কিছু করার আগেই নুরিগা সামনে এগিয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে রিকির মুখে এত জোরে আঘাত করল যে সে এক কোনায় ছিটকে গিয়ে পড়ল। ঠোঁটের পাশে কেটে রক্ত বের হয়ে এল এবং হাত দিয়ে সেই রক্ত মুছে রিকি হতচকিতের মতো আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল।
নুরিগা হিংস্র গলায় বলল, লাল, এই বদমাইশটার রক্ত লাল।
ক্লিশা ফ্যাকাসে মুখে বলল, তোমরা ঠিক বুঝতে পারছ না। এই পরাবাস্তব জগতের নিয়ন্ত্রণে আমাদের কোনো হাত নেই। আমরা সত্যিকার জগতে যোগাযোগ করতে পারি না।
আছে। আমি কঠিন মুখে বললাম, আমি গোপনে সাধারণ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেই বাইরের পৃথিবীতে যোগাযোগ করেছি। তোমরা নিশ্চয়ই পার।
পারি না। ক্লিশার কথা শেষ হবার আগেই নুরিপা তাকে আঘাত করে বসে এবং ক্লিশা ছিটকে গিয়ে দেওয়ালে আছড়ে পড়ল।
কী করছ তুমি নুরিগা– বলে রিয়া ক্লিশার কাছে ছুটে যায় এবং তাকে কোনোভাবে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়। বেকায়দা আঘাত লেগে তার নাক থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে।
নুরিগা হিংস্র চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ, মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার কী করে করতে হয় আমি জানি না। আমাকে যেটা শেখানো হয়েছে সেটাই করছি।
রিয়া মাথা নেড়ে বলল, না নুরিগা, তুমি এটা করতে পার না। মানুষকে আঘাত করতে হয় না।
আমি দুঃখিত রিয়া। কিন্তু আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তা ছাড়া তোমরাই বলেছ এটা পরাবাস্তব জগৎ। এখানে আমরা সবাই নকল। সবাই কৃত্রিম। সবাই কিছু তথ্য।
কিন্তু আমাদের অনুভূতিটি সত্যি।
আমি একমাত্র অক্ষত মানুষ শিরানের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, দেখো শিরান তুমি মনে হয় ব্যাপারটির গুরুত্ব বুঝতে পারছ না।
বুঝতে পারছি। কিন্তু আমাদের কিছু বলার নেই।
আমি কঠিন গলায় বললাম, এই শেষবার তোমাকে বলছি, তুমি আমাদের বাইরে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দাও।
আমরা পারব না।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, নুরিগা, তুমি এদেরকে একটু চোখে চোখে রাখ, আমি দেখি কী করতে পারি।
শিরান ভয়ার্ত গলায় বলল, তুমি কী করতে চাও?
এই রাবাস্তব জগতের সাথে পৃথিবীর একটা যোগসূত্র আছে। সেটা খুঁজে বের করে নষ্ট করতে চাই।
শিরান চমকে উঠল, বলল, অসম্ভব।
মোটেও অসম্ভব নয়। আমাকে তোমরা মোটেও গুরুত্ব দাও নি–কিন্তু এসব কাজ আমি খুব ভালো পারি। আমি পুরো পরাবাস্তব জগতের সব তথ্য ওলটপালট করে দেব। তোমাদের এতদিনের কাজ, গবেষণা এক সেকেন্ডে আবর্জনা হয়ে যাবে।
শিরান এবং তার সাথে অন্য দুজন তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ঘরের চতুষ্কোণ মডিউলটির উপর উঠে ভেতরে উঁকি দিলাম। অনেকগুলো প্রি–প্রসেসরের পাশে বড় বড় হিটশিল্ড লাগানো কিছু প্রসেসর। হোট ঘোট ক্রিস্টাল বসানো আছে দেখে বোঝা যায় অবলাল রশ্মি ভেতর দিয়ে ছোটাছুটি করছে, আমি টেবিল থেকে একটা স্কু ড্রাইভার নিয়ে দুটো ক্রিস্টালের মাঝে রাখতেই ভ্রু ড্রাইভারটি ভস্মীভূত হয়ে গেল, সাথে সাথে মুহূর্তের জন্যে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়, দূরে কোথাও একটা ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল!
শিরান আমার দিকে ছুটে এসে বলল, কী করছ আহাম্মকের মতো? কী করছ তুমি?
আমি মুখে মধুর হাসি ফুটিয়ে বললাম, দেখতেই পারছ কী করছি। চেষ্টাচরিত্র করে পরাবাস্তব জগৎটা উড়িয়ে দিতে চাইছি!
তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
না, হয় নি। খুব ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করছি। তোমরা যদি আমার কথা না শোন এবারে আমি বড় প্রসেসরটা টেনে তুলে ফেলব, আমার হাতটা হয়তো কাবাবের মতো ঝলসে যাবে কিন্তু পরাবাস্তব জগতের কোন অংশটা ধ্বংস হবে বলো দেখি?
শিরান পেছন থেকে আমাকে জাপটে ধরে বলল, না, তুমি এটা করবে না। খবরদার ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে যেতে পারে। এত ভয়ংকর যেটা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না
কেন? কী হয়েছিল?
একবার শরীরের অর্ধেক অংশ উড়ে গেল, সব মানুষের অন্য অর্ধেক ঠিক আছে। ব্যাপারটা চিন্তা করেই শিরান শিউরে ওঠে।
আমি সেরকম কিছু করতে চাই না। কাজেই বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের একটা ব্যবস্থা করে দাও। তাড়াতাড়ি।
শিরান তার লাল চুলে আঙুল দিয়ে কী ভাবল খানিকক্ষণ, তারপর এগিয়ে দেওয়ালের সাথে লাগানো কেবিনেটটি খুলে চতুষ্কোণ একটা ধাতব বাক্স নিয়ে আসে। আমার হাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, সাড়ে তেরো টেরা হার্টজে সেট করে নিলে যোগাযোগ করতে পারবে।
চমৎকার! আমি যোগাযোগ মডিউলটা হাতে নিয়ে বললাম, এটা কি দ্বিপক্ষীয়?
না শিরান গোমড়া মুখে বলল, শুধু তথ্য পাঠাতে পারবে। তথ্য ফিরে আসবে না।
এর সাথে কি ট্র্যাকিং ডিভাইস আছে?
অবিশ্যি আছে, সব সময় থাকে। নিরাপত্তার একটা ব্যাপার আছে না?
তার মানে ব্যবহার করতে গিয়ে আমরা মারা পড়তে পারি?
শিরান কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে ঘরে সবার দিকে তাকালাম, যে যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি যুদ্ধজয়ের ভঙ্গি করে বললাম, এখন আমরা বাইরের পৃথিবীতে খবর পাঠাতে পারব। চলো যাই। তবে যাবার আগে আমাদের পরাবাস্তব জগতের আরো কিছু তথ্য দরকার। আমি রক্তাক্ত রিকি এবং ক্লিশার দিকে তাকিয়ে বললাম, তথ্যগুলো কি তোমরা এমনি দেবে নাকি কিছু মারপিট করতে হবে?
ক্লিশা তার হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখের রক্ত মুছে ফেলার চেষ্টা করতে করতে বলল, দেওয়ার মতো কোনো তথ্য নেই। সব মিলিয়ে ছয়টা ভিন্ন ভিন্ন স্তর আছে। এক স্তর থেকে অন্য কোনো স্তরে যাওয়া যেত না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে এখন যাওয়া যায়।
গোলমাল?
হ্যাঁ, মনে হল প্রোগ্রামিং স্তরে পরিবর্তন করেছে। বেআইনি পরিবর্তন।
আমি আনন্দে হা–হা করে হেসে বললাম, জিগি! জিগি?
হ্যাঁ, জিগি নামে আমার একটা বন্ধু আছে, সে হচ্ছে এই ব্যাপারে মহাওস্তাদ। আমি নিশ্চিত আসল ত্রাতুল আসল জিগিকে নিয়ে তোমাদের নেটওয়ার্কে হানা দিয়েছে।
আমার উচ্ছাসে অন্য কেউ অংশ নিল না। বরং ক্লিশা, রিকি আর শিরান তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি যোগাযোগ মডিউলটা হাতে নিয়ে বললাম, অন্য ছয়টি স্তরে কেমন করে যাওয়া যায়?
ক্লিশা বলল, সব এক সমতলে চলে এসেছে। এই এলাকাটার পরেই অন্য এলাকা, তোমাদের খুঁজে নিতে হবে।
তোমাদের কাছে কো–অরডিনেট নেই?
সার্কুলার কো-অরডিনেট, থাকলেই কী না থাকলেই কী?
আমি রিয়া এবং নুরিগার দিকে তাকিয়ে বলাম, চলো যাই।
রিয়া এবং নুরিগা আমার পিছু পিছু ঘর থেকে বের হয়ে এল। আমরা যখন করিডরে পৌঁছেছি ঠিক তখন নুরিগা হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে বলল, তোমরা একটু দাঁড়াও, আমি আসছি।
কোথা থেকে আসছ? আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই সে প্রশস্ত ঘরটিতে ফিরে গেল, সেখানে প্রথমে একটু হটোপুটি তারপর শিরানের কাতর আর্তনাদ শুনতে পেলাম। প্রায় সাথে সাথেই নুরিগা ফিরে এসে বলল, শিরানের রক্তও লাল। বেশ লাল।
রিয়া হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। এটি কৌতুককর কোনো ব্যাপার নয়, সত্যি কথা বলতে কী বেশ নৃশংস একটি ব্যাপার, তারপরও আমি হাসি আটকে রাখতে পারলাম না।
১১. ক্রানা
জিগি বলল, পুরো ব্যাপারটা একবার পর্যালোচনা করা যাক।
আমি মাথা নাড়লাম। জিগি বলল, তুমি এসে বললে তোমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করে তোমাকে এবং রাজকুমারী রিয়াকে পরাবাস্তব জগতে আটকে রাখা হয়েছে। তাদেরকে সাহায্য করার জন্যে আমি মূল নেটওয়ার্কে ঢোকার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। উল্টো আমার আস্তানাটি ধ্বংস হল।
আমি আবার মাথা নাড়লাম। জিগি বলল, আমার তখনই থেমে যাওয়া উচিত ছিল, কারণ তোমার কিংবা রাজকুমারীর কিছু হয় নি তাদের ম্যাপিং বা পরাবাস্তব অস্তিত্বটি শুধুমাত্র আটকা পড়েছে। তারা যদি মারাও যায় তোমাদের কিছু হবে না–তোমরা ভালোভাবে বেঁচে থাকবে। কিন্তু এই সহজ যুক্তিটি আমার চোখে পড়ল না– আমি বোকার মতো আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম।
আমি আবার মাথা নাড়লাম।
জিগি বলল, আবেগপ্রবণ হলে মানুষ ভুল করে, আমিও ভুল করলাম। খুব বড় ভুল। পালানোর রাস্তা ঠিক না করে এখানে এসে হাজির হলাম। শুধু হাজির হলাম তা নয়, নেটওয়ার্কের পরিবর্তন করে ছয়টি পরাবাস্তব জগৎ এক সমতলে নিয়ে এসে তোমাকে এর ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম। তখন একটা কেলেঙ্কারি হল–আমরা একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলাম। এখন আমাদের কী হবে জানি না।
আমি আবার মাথা নাড়লাম। জিগি বিরক্ত হয়ে বলল, শুধু মাথা নাড়বে না, কিছু একটা বলো।
বলার বিশেষ কিছু নেই।
অন্ততপক্ষে বলল যে তুমি খুব দুঃখিত।
আমি দুঃখিত না হলে কেন মিছিমিছি বলব যে আমি দুঃখিত?
জিগি রেগে উঠে বলল, তোমার একটি পরাবাস্তব অস্তিত্বের জন্যে আমরা এত বড় একটা গাড়ায় পড়েছি–তুমি সেজন্যে দুঃখিত হবে না?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না
কেন না?
সেটা আমি বলতে পারব না
কেন বলতে পারবে না?
কারণ আমি নিশ্চিত আমাদেরকে খুব তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করা হচ্ছে।
অবিশ্যি লক্ষ করা হচ্ছে। কিন্তু কোন ব্যাপারটি এখানে গোপন যেটা আমরা জানি কিন্তু ওরা জানে না?
আমি জিগির কথার উত্তর না দিয়ে বললাম, তোমার কাছে একটা চাকু আছে?
জিগি অবাক হয়ে বলল, না, কেমন করে থাকবে? আমাদের ব্যাগগুলো রেখে দিয়েছে!
খুব ছোট চাকু? যেটা বিপজ্জনক নয়?
জিগি তার প্যান্টের অনেকগুলো পকেট ঘেঁটে একটা ছোট চাকু বের করল, কষ্ট করে এটি দিয়ে ফলমূলের ছিলকে কাটা যেতে পারে। আমি চাকুর ধারটা পরীক্ষা করে বললাম, চমৎকার!
কী চমৎকার?
চাকুর ধারটুকু।
কেন?
আমি ঠিক করেছি আত্মহত্যা করব।
জিগি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, এরকম সময়ে ঠাট্টা তামাশা ভালো লাগে না।
আমারও ভালো লাগে না– এবং সে কিছু বলার আগেই আমি কবজিতে মূল ধমনির ওপর চাকু বসিয়ে দিলাম, নিখুঁত কাজ, সাথে সাথেই ধমনি কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম যেরকম যন্ত্রণা হবে ভেবেছিলাম, সেরকম যন্ত্রণা হচ্ছে না।
জিগি চিৎকার করে আমার হাত ধরে ফেলল, কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা দুজনে রক্তে মাখামাখি হয়ে গেলাম। আমি যথাসম্ভব শান্ত গলায় বললাম, এত ব্যস্ত হবার কিছু হয় নি। আমি যদি মরে যাই শুধুমাত্র তা হলেই তুমি বেঁচে যেতে পারবে।
কেন? কেন একথা বলছ? কারণ আমি বেশি জেনে ফেলেছি–তোমার সেটুকু জানার দরকার নেই।
আমি কথা শেষ করার আগেই একটা এলার্মের শব্দ শুনতে পেলাম এবং কিছুক্ষণের মাঝে দরজা খুলে একজন ডাক্তার ছুটে এল। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে ডাক্তারটির মুখের দিকে তাকালাম, যা আশা করেছিলাম তাই, ডাক্তারটি জানা। তার সাথে যোগাযোগ করার জন্যেই আমি আমার ধমনিটি কেটেছি রক্তপাতটুকু বৃথা যায় নি।
ক্ৰানা আমার ওপর ঝুঁকে পড়ল, কী আশ্চর্য! এটা কোন ধরনের নির্বুদ্ধিতা?
হাতের টিস্যু জোড়া লাগানোর যন্ত্রটি একটি চাপা গুঞ্জন সৃষ্টি করেছে, আমি সেই শব্দের আড়ালে কানার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। ফিসফিস করে বললাম, ক্রানা এটা নির্বুদ্ধিতা না, তোমার সাথে যোগাযোগ করার এটা আমার একমাত্র উপায়।
ক্রানা কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, আমি ফিসফিস করে বললাম, আমাদের খুব বিপদ। পৃথিবীর খুব বিপদ। আমাদের এখান থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দাও।
ক্রানা আমার ধমনিটি জোড়া লাগিয়ে রক্তপাত বন্ধ করে ফিসফিস করে বলল, কেমন করে সেটা করব?
তোমার সিকিউরিটি কার্ড আছে সেটা আমাদের দিয়ে যাও।
ক্ৰানা চোখ বড় বড় করে বলল, তোমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে।
না, হয় নি। বিশ্বাস কর। পৃথিবীর খুব বিপদ।
আমি কেমন করে সেটি বিশ্বাস করব? তুমি হচ্ছ চাল–চুলোহীন ভবঘুরে একজন মানুষ? তোমাকে বিশ্বাস করার কী কারণ আছে?
আছে। দোহাই তোমার– আমি কাতর গলায় বললাম, আমার চোখের দিকে তাকাও–দেখো আমি সত্যি কথা বলছি কি না।
ক্ৰানা আমার চোখের দিকে তাকাল, তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, আমি দুঃখিত। আমি খুব দুঃখিত। আমি পারব না।
ক্ৰানা উঠে দাঁড়াল, হাতের কবজিতে ছোট একটা সার্জিক্যাল টেপ লাগিয়ে আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, এর ভেতরে দুটি বলকারক ট্যাবলেট দিয়েছি। খিদে পেলে খেও। রক্তক্ষরণ হয়েছে, দুর্বল লাগতে পারে।
আমি কোনো কথা বললাম না, অত্যন্ত আশাভঙ্গ হয়ে ক্রানার দিকে তাকিয়ে রইলাম, আমি বড় আশা করেছিলাম যে এই মেয়েটি ব্যাপারটির গুরুত্বটুকু বুঝবে। মেয়েটি বুঝল না।
ক্ৰানা চলে যাবার পর জিগি আমার দিকে এক ধরনের বিস্ময় এবং আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে রইল, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, আমার ধারণা ছিল তুমি মানুষটা স্বাভাবিক। ধীরস্থির, ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ। আমার ধারণাটা সত্যি নয়।
আমি কষ্ট করে হাসার চেষ্টা করে বললাম, তোমার ধারণাটা আসলে সত্যি। বিশ্বাস কর।
কেমন করে বিশ্বাস করব? যে মানুষ এভাবে নিজের হাতের ধমনি কেটে ফেলে প্র
য়োজনে কাটতে হয়—
জিগি চিৎকার করে বলল, প্রয়োজনে? প্রয়োজনে?
হ্যাঁ।
জিগি চিৎকার করে নিশ্চয়ই আরো কথা বলত কিন্তু তার আগেই খুট করে শব্দ হল এবং দরজাটা খুলে গেল। আমি দেখতে পেলাম খ্রাউস ভেতরে এসে ঢুকেছে। আমাদের থেকে খানিকটা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সে খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আশ্চর্য!
ঠিক কোন ব্যাপারটি নিয়ে আশ্চর্য বলেছে আমি জানি না, কিন্তু সেটি নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করল না। উস আবার বলল, আশ্চর্য আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি তোমাদের কাছে এসেছি।
আমি এবারে জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, কী জন্যে এসেছ?
একটা জিনিস জানার জন্যে।
কী জিনিস?
আমি নিশ্চিত তোমরা জান না–তবু কৌতূহল হচ্ছে তাই জিজ্ঞেস করছি। তোমরা কি জান পরাবাস্তব জগতে রিয়া কেন এখনো বেঁচে আছে? তার বেঁচে থাকার কথা নয়। সাতদিন পর তাকে খুন করার জন্যে নুরিগাকে পাঠিয়েছি, তার হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে–তার পরও রিয়া এখনো বেঁচে আছে কেন?
আমার মুখে হাসি ফুটে উঠল, আমি বললাম, হ্যাঁ জানি।
খ্রাউস চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল, সত্যি জান?
হ্যাঁ। সত্যি জানি।
খ্রাউস একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার জানার খুব কৌতূহল হচ্ছে। বলো, কেন?
আমার অনুমান যদি সত্যি হয়ে থাকে তা হলে নুরিগা এখন পরাবাস্তব জগতে আমাকে এবং রিয়াকে সাহায্য করছে।
অসম্ভব। খ্রাউস মুখ বিকৃত করে বলল, নুরিগা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ। তার চরিত্রের প্রত্যেকটা দিক তুলে আনা হয়েছে পৃথিবীর বড় বড় অপরাধীদের ভেতর থেকে। তার চরিত্র হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য মানুষের চরিত্র। শুধু তাই না, রিয়া সম্পর্কে তার মনকে আমরা বিষাক্ত করে পাঠিয়েছি।
আমি আনন্দে হা–হা করে হেসে বললাম, ভুল! তুমি ভুল। নুরিগা পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ নয় সত্যি কথা বলতে কী একজন মানুষ কখনো সবচেয়ে খারাপ হয় না। তোমরা যেসব খারাপ মানুষের জিন্স এনেছ খোঁজ নিয়ে দেখো তারাও খারাপ মানুষ হয়ে জন্মায় নি–তারা ধীরে ধীরে খারাপ হয়েছে। পরিবেশ তাদের খারাপ করেছে।
তুমি বলতে চাইছ নুরিগা স্বাভাবিক একটা মানুষ?
আমি বিশ্বাস করি তাকে স্বাভাবিক একটা মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যাবে।
খ্রাউস মাথা নাড়ল, অসম্ভব। হতেই পারে না।
তুমি নিজেই তার প্রমাণ দেখেছ–নুরিগা এখন রিয়া আর আমার সাথে সাথে পরাবাস্তব জগতে ঘুরছে। আমার ধারণা–
তোমার ধারণা?
আমার ধারণা সেখান থেকে তোমাদের ওপর তারা একটা বড় হামলা করবে।
খ্রাউসকে কেমন যেন হতচকিত এবং ক্রুদ্ধ দেখায়। আমি ষড়যন্ত্রীদের মতো গলায় বললাম, তোমরা কেন নুরিগাকে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ হিসেবে তৈরি করেছিলে আমি জানি না। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।
কী সাহায্য?
তুমি এবং তোমার দলবল নুরিগা থেকে হাজার গুণ বেশি খারাপ মানুষ। তোমরা নিজেদের ব্যবহার করতে পার।
খ্রাউস রক্তচক্ষু করে আমার দিকে তাকাল, তারপর হিংস্র গলায় বলল, তোমার দুঃসাহস দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। তুমি জান আমি তোমাকে কী করতে পারি?
আসলে জানি না। আমি মাথা নেড়ে বললাম, তুমি সম্ভবত আর দশজন মানুষ থেকে অনেক বেশি নিষ্ঠুর আমাদের নিয়ে হয়তো অনেক কিছুই করতে পার। কিন্তু তাতে এখন আর কিছু আসে–যায় না।
খ্রাউস আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন তার যোগাযোগ মডিউলটা শব্দ করে ওঠে, সে কানে লাগিয়ে কিছু একটা শুনে বলল, চমৎকার। দুজনকেই লঞ্চ প্যাডে। নিয়ে যাও। তারপর মডিউলটা পকেটে রেখে আমাদের বলল, তোমরা একদিকে খুব সৌভাগ্যবান যে, আমার হাতে যথেষ্ট সময় নেই। তাই তোমাদের মৃত্যুটাকে সেরকম আকর্ষণীয় করতে পারব না।
তুমি হয়তো সেরকম সৌভাগ্যবান নও। আমি মুখে হাসি টেনে বললাম, নুরিগা যখন পরাবাস্তব জগতে গিয়েছে আমি তখন তাকে দিয়ে একটা খবর পাঠিয়েছিলাম। খবরটা কি শুনতে চাও?
খ্রাউস হিংস্র চোখে আমার দিকে তাকাল, বলল, কী খবর?
রক্তের রঙ লাল। একটু থেমে বললাম, সবুজ নয়!
খ্রাউস বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, মনে হল সে আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, কী বললে?
বলেছি রক্তের রঙ লাল–সবুজ নয়।
এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল খ্রাউস বুঝি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঝাঁপিয়ে পড়ল না, দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে বের হয়ে গেল। জিগি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হচ্ছে এখানে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আমার হঠাৎ এক ধরনের ক্লান্তি লাগতে থাকে। পিছিয়ে এসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আমি জিগির দিকে তাকিয়ে বললাম, মনে আছে একটু আগে তুমি আমাকে পরাবাস্তব জগতে পাঠিয়েছিলে?
হ্যাঁ। মনে আছে।
সেখানে আমি খ্রাউসকে খুন করার জন্যে একটা ধাতব দণ্ড দিয়ে আঘাত করেছিলাম। আঘাতে কানের নিচে ফেটে গিয়ে রক্ত বের হয়ে এসেছিল।
জিগি অবাক হয়ে বলল, তুমি–তু–তুমি আঘাত করেছিলে? খ্রাউসকে?
হ্যাঁ। আমি নিশ্বাস ফেলে বললাম, আঘাত করাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানুষ হঠাৎ করে রেগে গেলে তো একজন আরেকজনকে আঘাত করতেই পারে। যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে–
সেটা হচ্ছে?
খ্রাউসের কানের নিচে কেটে যে রক্ত বের হয়েছিল সেটা। সেই রক্তের রঙ ছিল সবুজ।
জিগি চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ।
অসম্ভব। এটা হতে পারে না।
এটা হয়েছে। আমি জানি।
জিগি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, এর অর্থ কী?
আমার ধারণা খ্রাউস মানুষ নয়।
মানুষ নয়?
না। আমি মাথা নাড়লাম। খ্রাউস এন্ড্রয়েড, সাইবর্গ বা রোবটও নয়। খ্রাউস হচ্ছে। একটা ডিকয়।
ডিকয়?
হ্যাঁ। আমাদের পৃথিবীর প্রযুক্তি পরাবাস্তব জগৎ তৈরি করার জন্যে এখনো প্রস্তুত হয় নি। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ এখানে সেই প্রযুক্তি আছে। কারণ কোনো এক মহাজাগতিক প্রাণী সেই প্রযুক্তি পাঠিয়েছে। পৃথিবীর মানুষের সাথে যোগাযোগ করেছে যে ইন্টারফেস সেটাই হচ্ছে খ্রাউস। খ্রাউস হচ্ছে সেই ডিকয়। মানুষের মতো কিন্তু মানুষ নয়। তাই রক্ত সবুজ।
যারা এত কিছু করতে পারে তারা রক্তের রঙ লাল করতে পারে না?
নিশ্চয়ই পারে। কিন্তু আমি যে খ্রাউসকে দেখেছি সে ছিল পরাবাস্তব জগতে। সেখানে আমার কিংবা আর কারো যাবার কথা ছিল না। সেজন্যে মাথা ঘামায় নি। সেখানে আমি শুধু উসকে দেখি নি–আরো অনেক বিচিত্র জিনিস দেখেছি। যার অনেক কিছু সম্ভবত মহাজাগতিক
কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। তোমাকে বলার সুযোগ পাই নি।
আমি দেওয়ালে মাথা রাখলাম, হঠাৎ করে আমি এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করি। কোনো কিছু করতে না পারা থেকে এক ধরনের অসহায় ক্রোধ। সেই ক্রোধ থেকে ক্লান্তি। জিগি আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
হ্যাঁ। হঠাৎ করে দুর্বল লাগছে।
ডাক্তার মেয়েটি তোমাকে বলকারক একটা ওষুধ দিয়ে গেছে তুমি খাও।
আমি জিগির দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললাম, শরীরে বল বাড়িয়ে কী হবে? খ্রাউস এই মুহূর্তে পরিকল্পনা করছে কীভাবে আমাদের নিশ্চিহ্ন করবে।
করুক। জিগি কানার দিয়ে যাওয়া প্যাকেটের ভেতরে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, কোথায়? এখানে কোনো ওষুধ নেই। একটা কার্ড।
কার্ড?
আমি চমকে সোজা হয়ে বললাম, কী কার্ড?
ক্রানার সিকিউরিটি কার্ড!।
মুহূর্তে আমার শরীর থেকে সকল দুর্বলতা উধাও হয়ে গেল। আমি সমস্ত স্নায়ুতে এক ধরনের তীব্র উত্তেজনা অনুভব করলাম। কানা আসলে আমাকে বিশ্বাস করেছে, তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে আমাকে তার সিকিউরিটি কার্ডটি দিয়েছে, তার মানে আমাদের সামনে এখনো একটি সুযোগ রয়েছে। আমার শরীরে এড্রেনেলিনের প্রবাহ শুরু হয়ে গেল। আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জিগিকে বললাম, চলল।
কোথায়, কেন, কীভাবে, কখন এসব নিয়ে জিগি এতটুকু মাথা ঘামাল না, সেও লাফিয়ে উঠে বলল, চলো।
১২. ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ
ঘর থেকে খুব সাবধানে আমি মাথা বের করলাম। দীর্ঘ করিডরে কেউ নেই। আমি হাত দিয়ে জিগিকে ইঙ্গিত করতেই সে আমার পিছু পিছু বের হয়ে এল। ক্রানার সিকিউরিটি কার্ড ব্যবহার করে বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছি, কাজেই কোথাও কোনো এলার্ম বেজে ওঠার কথা নয় কিন্তু তবু আমি কান পেতে একটু শোনার চেষ্টা করলাম, চারপাশে এক ধরনের সুনসান নীরবতা।
আমি আর জিগি পাশাপাশি দ্রুত হেঁটে যেতে থাকি। এই কেন্দ্রটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই, কোথায় যাচ্ছি ভালো করে জানি না তবুও এখান থেকে একটু দ্রুত সরে যেতে হবে। করিডরের অন্য মাথায় পৌঁছানোর আগেই অন্য পাশ থেকে দুটি সাইবর্গ হেঁটে আসতে দেখলাম, তাদের চোখে-মুখে সাইবর্গসুলত এক ধরনের উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, আমি এবং জিগি মুহূর্তের জন্যে খুব বিপন্ন অনুভব করি কিন্তু সাইবর্গ দুটো আমাদের দুজনকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে গেল। ক্রানার সিকিউরিটি কার্ডটি সম্ভবত আমাদেরকে নিরাপদ মানুষ হিসেবে চারপাশে একটি সংকেত পাঠাচ্ছে।
সাইবর্গ দুটি পাশ কাটিয়ে বেশ খানিকটা দূরে সরে আসার পর জিগি তার বুকের মাঝে আটকে থাকা নিশ্বাসটি বের করে দিয়ে বলল, এভাবে হাঁটা উচিত হচ্ছে না, যে কোনো মুহূর্তে ধরা পড়ে যাবে।
হ্যাঁ। আমি মাথা নাড়লাম, চলো কোথাও আগে লুকিয়ে পড়ি।
করিডরের দুই পাশে ছোট ছোট ঘর। কোথায় কী আছে জানা নেই, সিকিউরিটি কার্ডটি থাকার জন্যে সম্ভবত এর কোনো একটিতে আমরা লুকিয়ে পড়তে পারব। আমি সাবধানে একটি ঘর খুলে উঁকি দিলাম, ভেতরে কেউ নেই। আমি আর জিগি সাবধানে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আবার একটা লম্বা নিশ্বাস ফেললাম। এই ঘরটি ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার এবং ডাটা লাইনের একটা সংযোগ কেন্দ্র বিন্ডিংটির নানা অংশ থেকে নানা ধরনের। তার, ফাইবার এবং ক্যাবল এখানে এসে একত্র হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কান পেতে থাকলে এখানে স্বল্প কম্পনের চাপা একটি গুঞ্জন ধ্বনি শোনা যায়।
আমি মাকড়সার জালের মতো ছড়ানো–ছিটানো তার, ফাইবার এবং ক্যাবল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘরের অন্যান্য যন্ত্রপাতি লক্ষ করছিলাম তখন হঠাৎ করে জিগির বিস্ময়ধ্বনি শুনতে পেলাম, ওরে সর্বনাশ!
আমি জিগির দিকে ঘুরে তাকালাম, কী হয়েছে?
জিগি হাত দিয়ে কালো রঙের মোটা একটি ক্যাবল দেখিয়ে বলল, এই দেখ।
এটা কী?
পাওয়ার ক্যাবল। সুপার কন্ডাক্টিং পাওয়ার ক্যাবল, জিগা–ওয়াট২২ পাওয়ার নেওয়ার ব্যবস্থা।
জিগা–ওয়াট? আমি অবাক হয়ে বললাম, কী বলছ তুমি? এই ছোট বিল্ডিঙের মাঝে জিগা–ওয়াট পাওয়ার ক্যাবল?
হ্যাঁ।
কেন?
সেটা আমারও প্রশ্ন। জিগি ভুরু কুঁচকে চিন্তা করার চেষ্টা করে বলল, এটা অসম্ভব। এই বিল্ডিঙের যে পরিমাণ শক্তি দরকার তার জন্যে এত পাওয়ার লাগার কোনো কারণ নেই। তুমি জান সুপার কষ্টিং পাওয়ার ক্যাবল তৈরি করতে কী পরিমাণ যন্ত্রণা?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, জানি।
শুধুমাত্র লিকুইড হিলিয়াম সাপ্লাই চালু রাখতেই বারোটা বেজে যায়। অন্য ব্যাপার তো ছেড়েই দাও।
তা হলে এটা এখানে কেন আছে?
জিগি তার পোশাকের ঝুলে থাকা অংশগুলো ট্রাউজারের ভেতর খুঁজে নিয়ে বলল, চলো বের করে ফেলি।
বের করে ফেলবে?
হ্যাঁ। করিডর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করলে এমনিতেই ধরা পড়ার ভয়। তার চাইতে ধরো এই পাওয়ার ক্যাবল ধরে ঝুলতে ঝুলতে যাই।
জিগি ঠাট্টা করছে না সত্যি বলছে বুঝতে আমার একটু দেরি হল–আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সে ঠাট্টা করছে না সত্যিই বলছে। আমি ইতস্তত করে বললাম, কাজটা খুব সহজ হবে?
মনে হয় না। কিন্তু সেটা কি বিবেচনার একটি বিষয়?
আমি মাথা নাড়লাম, জিগি ঠিকই বলেছে, এটি বিবেচনার বিষয় নয়। গত দুএকদিনে আমরা যা যা করেছি তার তুলনায় এটা বিবেচনার কোনো বিষয়ই নয়।
পাওয়ার ক্যাবলটি মোটা, সাপের মতো এঁকেবেঁকে গিয়েছে, স্পর্শ করলে ক্রায়োজেনিক পাম্পের কম্পন অনুভব করা যায়। আমি আর জিগি ক্যাবলটির ওপর দিয়ে হেঁটে, কখনো এটা ধরে ঝুলে ঝুলে, কখনো সরীসৃপের মতো পিছলে পিছলে অগ্রসর হতে থাকি। মাঝে মাঝে আরো নানা ধরনের তার, ক্যাবল এবং ফাইবার এটার ওপর দিয়ে চলে গিয়েছে। কিছু। কিছু রীতিমতো বিপজ্জনক, খুব সাবধানে অগ্রসর হতে হয়। ক্যাবলটি সোজা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ করে নিচে নামতে লাগল, জিগি অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য! দেখো এটা কত নিচে নেমে গেছে।
আমিও অবাক হয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি পাওয়ার ক্যাবলটি প্রায় অতল পাতালে নেমে গিয়েছে। এত প্রচণ্ড শক্তি নিচে কোথায় নেমে গিয়েছে চিন্তা করে এবারে আমরা সত্যি। কৌতূহলী হয়ে উঠি।
ক্যাবলটি বেয়ে বেয়ে নিচে নামা সহজ নয়, হাত ফসকে গেলে নিচে কোথায় গিয়ে পড়ব জানা নেই, কিন্তু এখন আর এত ভাবনাচিন্তার সময় নেই। দুজনে ক্যাবলটি জাপটে ধরে সরসর করে নিচে নামতে থাকি। এদিক দিয়ে কখনো মানুষ যায় না, বাতাসের প্রবাহ অপর্যাপ্ত এবং দূষিত। কিছুক্ষণেই আমরা কালিঝুলি মেখে ধুলায় ধূসরিত হয়ে গেলাম। নিচে নামতে নামতে যখন মনে হচ্ছিল হাতে আর শক্তি নেই আর একমুহূর্তও ঝুলে থাকতে পারব না, তখন দুজনে ঝুপঝুপ করে নিচে নেমে এলাম।
জায়গাটি একটি বড় হলঘরের মতো, চারদিকে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি ছড়ানো। হলঘরের মাঝখানে গোলাকার একটা শক্ত কংক্রিটের ঘর। আমরা যে ক্যাবলটি বেয়ে নেমে এসেছি সেটা এই ঘরের ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে, তুলনামূলকভাবে ছোট একটি ঘরের মাঝে এই বিশাল পরিমাণ শক্তি কেমন করে ব্যবহার করা হচ্ছে আমরা বুঝতে পারলাম না।
আমি আর জিগি সাবধানে গোলাকার ঘরটি ঘুরে এলাম, এক পাশে উঁচু টিউবের মতো ছোট একটা করিডর, এর কাছাকাছি একটা লিফট নেমে এসেছে। আমরা যে জায়গাটিতে আছি সেটি মূল অংশের পেছনের সার্ভিস এরিয়া, মানুষজন আসে না। লিফট দিয়ে নেমে এই টিউবের মতো করিডর ধরে লোকজন মাঝখানের গোলাকার অংশটিতে ঢুকতে পারে। লিফট থেকে চাপা গুম গুম শব্দ শুনে বুঝতে পারছি সেটা উপরে উঠছে এবং নিচে নামছে, সম্ভবত লোকজন আসছে এবং যাচ্ছে। আমরা করিডর ধরে হেঁটে একটা দরজা পেলাম, ইচ্ছে করলে এটা খুলে করিডরের ভেতরে যেতে পারি কিন্তু এই মুহূর্তে সেখানে লোকজনের যাতায়াতের শব্দ শোনা যাচ্ছে, কাজেই ভেতরে ঢোকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
আমরা আবার গোলাকার ঘরটির কাছে ফিরে এলাম, জিগির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী আছে এই ঘরটায়?
জিগি মাথা নাড়ল, বলল, জানি না। পরিচিত কিছু নয়, এত ছোট জায়গায় এত শক্তির প্রয়োজন হয় সেরকম কিছু আমার জানা নেই।
আমি ঘুরে চারদিকে তাকালাম, জায়গাটা একটা মঞ্চের পেছনের অংশের মতো– সামনে কী হচ্ছে পেছন থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই।
আমি আর জিগি গোলাকার ঘরটির কাছে এগিয়ে গেলাম। দূর থেকে বোঝা যায় না কিন্তু কাছে এলে দেখা যায় এর দেওয়ালে বিচিত্র এক ধরনের নকশা, পৃথিবীতে কোথাও এরকম নকশা নেই, দেখেই মনে হয় এটি মানুষের হাতে তৈরি নয়। আমি হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই নকশাটি একটু সরে গেল, যেন এটি একটি জীবন্ত প্রাণী। আমি চমকে উঠলাম, দেওয়ালটি সরীসৃপের দেহের মতো শীতল। আমি হতচকিত হয়ে জিগির দিকে তাকালাম। জিগি অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে?
আমি এরকম একটা জিনিস পরাবাস্তব জগতে দেখেছি। খ্রাউস বলেছে এটা মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগের ইন্টারফেস।
নিজের অজান্তেই জিগি দুই পা পেছনে সরে এসে বলল, এটা মহাজাগতিক প্রাণীর ইন্টারফেস?
হ্যাঁ।
তার মানে তার মানে এটা একটা মহাকাশযান?
মহাকাশযান? মাটির তলায়? আমি চারদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললাম, এটা বের হবে কেমন করে? কোথাও তো বের হবার জায়গা নেই।
নিশ্চয়ই স্পেস টাইম কনটিনিউয়াম ভেদ করে যাবে, নিশ্চয়ই ওয়ার্মহোল তৈরি করে বের হয়ে যাবে। এই জন্যে এত বিশাল শক্তির দরকার। জিগির চোখ উত্তেজনায়। চকচক করতে থাকে, এখন বুঝতে পারছি কেন এই সুপার কন্ডাক্টিং ক্যাবল এখানে এসেছে।
আমি হঠাৎ করে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলাম, বললাম, মনে আছে খ্রাউস বলেছিল দুজনকে লঞ্চ প্যাডে নিয়ে যাও। নিশ্চয়ই এটাই সেই লঞ্চ প্যাড। এখান থেকেই মহাকাশযান উড়ে যাবে।
কিন্তু কোন দুজন?
আমার মনে হয় রিয়া আর নুরিগা। পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানবী আর পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানব।
জিগি মাথা নাড়ল, তারপর বলল, ঠিকই বলেছ, সেজন্যেই এখানে এত কাজকর্ম। হচ্ছে। লোকজন যাচ্ছে আসছে। সবকিছু প্রস্তুত করছে।
আমি একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বললাম, কিন্তু এটা তো কিছুতেই করতে দেওয়া যাবে। পৃথিবীর মানুষকে তো মহাজাগতিক প্রাণীর হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই না।
তুমি কী করবে?
থামাব।
কীভাবে থামাবে?
আমি জানি না।
জিগি আমার দিকে তাকিয়ে সহৃদয়ভাবে হেসে ফেলল।
আমি এই বিশাল হলঘরটির দিকে তাকালাম, এটি মূল লঞ্চ প্যাডের আড়ালের অংশটুকু এখানে সচরাচর কেউ আসে না। যন্ত্রপাতিগুলো অবিন্যস্তভাবে ছড়ানো আছে। নানা ধরনের তার এবং ফাইবার ঝুলছে, মনিটর থেকে আলো বের হচ্ছে। বড় বড় ধাতব খণ্ড এখানে সেখানে ছড়ানো। ঘরের ঠিক মাঝামাঝি একটা অতিকায় ক্রেন দাঁড়িয়ে আছে, এই লঞ্চ প্যাড বসানোর সময় নিশ্চয়ই এটা ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে মানুষজন আসে না বলে সত্যিকারের আলো নেই, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং মনিটরের আলোতে জায়গাটাতে এক ধরনের আলো–আঁধারি ভাব ছড়িয়ে আছে।
জিগি চারদিকে তাকিয়ে বলল, মহাকাশযানটিকে থামানোর একটি মাত্র উপায়।
সেটি কী?
এই জিগা–ওয়াট সুপার কন্ডাক্টিং পাওয়ার ক্যাবলটি কেটে ফেলা, যেন মহাকাশযানটি তার প্রয়োজনীয় শক্তি না পায়।
আমি জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললাম, তোমার ছোট চাকুটা দিয়ে এই সুপার কন্ডাষ্টিং পাওয়ার ক্যাবলটি কাটতে পারবে বলে তো মনে হয় না।
না। জিগি মাথা নাড়ল, তুমি যে হাতের ধমনিটা কাটতে পেরেছিলে সেটাই বেশি।
আমি হলঘরটার চারদিকে তাকালাম, বললাম, এই ক্যাবলটা কাটার মতো সেরকম বড় আর ধারালো কোনো যন্ত্রপাতি এই ঘরে নেই?
থাকলেও লাভ নেই। ক্যাবলটা কাটলেই তারা বুঝতে পারবে সাথে সাথে তোমাকে ধরে ফেলবে।
আমি ক্যাবলটার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চমকে উঠে জিগির দিকে তাকালাম, জিগি অবাক হয়ে বলল, কী হল?
ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ!
মানে?
আমরা ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ ব্যবহার করে মহাকাশযান আটকে দিতে পারি!
ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ? তুমি নিশ্চয়ই জান ইলেকট্রনিক্স যে পর্যায়ে গিয়েছে তাতে গত হাজার বছরে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণটি ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় নি।
কিন্তু তাই বলে সমীকরণটি তো মিথ্যা হয়ে যায় নি।
তা যায় নি। কিন্তু তুমি কীভাবে এটা ব্যবহার করতে চাইছ?
খুব সহজ। এই ক্যাবলটা দিয়ে জিগা–ওয়াট শক্তি প্রবাহিত হবে এবং দেখাই যাচ্ছে সেটা বৈদ্যুতিক শক্তি। কাজেই এই ক্যাবলটাকে যদি আমরা একটা কয়েলের মতো পেঁচিয়ে তার মাঝখানে ফেরো ম্যাগনেট বসিয়ে রাখতে পারি তা হলে এটা একটা ইন্ডাক্টরের মতো কাজ করবে। তার মানে বুঝেছ?
জিগির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, বুঝেছি। স্পেস টাইম কন্টিনিউয়াম ভেদ করার জন্যে একমুহূর্তের মাঝে অচিন্তনীয় পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রবাহ হবে, সেই প্রবল প্রবাহ হঠাৎ করে ইন্ডাক্টরে আটকা পড়ে যাবে–যার অর্থ মহাকাশযানটি তার প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক শক্তি পাবে। না!
হ্যাঁ। আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি নিশ্চিত শক্তির প্রয়োজনে একটু হেরফের হলেই এটা কাজ করবে না।
আমিও নিশ্চিত।
তা হলে কাজ শুরু করে দেওয়া যাক। দেখি ক্যাবলটাকে টেনে কতটুকু প্যাচাতে পারি।
দাঁড়াও। জিগি হঠাৎ আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, আমরা কাজটা আরো সুচারুভাবে করতে পারি।
কীভাবে?
যদি হিসাব করে নিই কী পরিমাণ ক্যাবলকে কতটুকু প্যাচাতে হবে, মাঝখানে কতটুকু ফেরো ম্যাগনেট রাখতে হবে, পাশে কতখানি রাখতে হবে, ক্যাপাসিটেন্স কত–
কীভাবে হিসাব করবে?
জিগি দাঁত বের করে হেসে বলল, আমাদের একটা নিউরাল কম্পিউটার আছে। মনে নেই?
আমি চমকে উঠলাম, বললাম, তুমি আবার আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে চাইছ?
অবশ্যই! তা না হলে আমি নিউরাল কম্পিউটার কোথায় পাব?
অসম্ভব। আমি মুখ শক্ত করে বললাম, কখনোই নয়। তা ছাড়া তুমি সেই ইন্টারফেস আর সকেট কোথায় পাবে?
আগেরটা যেখান থেকে পেয়েছিলাম।
আগেরটা কোথা থেকে পেয়েছিলে? আমি ভেবেছিলাম তুমি নিজে তৈরি করেছ।
জিগি মাথা নাড়ল, আমি তৈরি করি নি–জুড়ে দিয়েছিলাম। মূল জিনিসটা পেয়েছিলাম একটা সাইবর্গের কপোট্রন থেকে। আমি নিশ্চিত আমরা ঠিক মেটাকোড বলে একটা সাইবর্গ ধরে আনতে পারব।
আমি হতবাক হয়ে জিগির দিকে তাকিয়ে রইলাম, সে কি সত্যি বলছে নাকি কৌতুক করছে বুঝতে পারছিলাম না–জিগির মুখে অবিশ্যি কৌতুকের কোনো চিহ্ন নেই। আমি কয়েকবার চেষ্টা করে বললাম, তুমি সত্যিই বলছ?
হ্যাঁ, সত্যিই বলছি। এস তোমার সিকিউরিটি কার্ডটি নিয়ে।
খুব সাবধানে করিডরের দরজা অল্প একটু ফাঁক করে আমরা ভেতরে তাকালাম। দূরে গোলাকার মহাকাশযানটিকে দেখা যাচ্ছে, তার সামনে এক ধরনের ব্যস্ততা। অন্য পাশে লিফট থেকে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি নামিয়ে আনা হচ্ছে। করিডর দিয়ে সাইবর্গরা হেঁটে যাচ্ছে–কোনো একটি বিশেষ কারণে এখানে কোনো মানুষ নেই।
আমরা হাইব্রিড দুই টাইপের দুটি সাইবর্গকে দেখতে পেয়ে দরজা ফাঁক করে হাতছানি দিয়ে ডাকলাম। সাইবর্গ দুটো কোনো রকম সন্দেহ না করে আমাদের দিকে এগিয়ে এল– ক্রানার সিকিউরিটি কার্ডটি ম্যাজিকের মতো কাজ করছে।
আমরা তাদের হলঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। একটি সাইবর্গ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে? কেন আমাদের ডেকেছ?
জিগি হাত নেড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আমি সময় নষ্ট না করে সরাসরি মেটাকোডটি বললাম, কালো গহ্বরে এনিফর্মের নৃত্য।
আমার কথাটিতে ম্যাজিকের মতো কাজ হল, হঠাৎ করে দুটি সাইবর্গই পাথরের মতো স্থির হয়ে যায়, তাদের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসে এবং কপোট্রনের কোনো একটা অংশ থেকে একটা লাল আলো জ্বলে এক ধরনের ভোঁতা শব্দ করতে থাকে। জিগি সাইবর্গের কাছাকাছি গিয়ে তার মাথায় লাগানো নানা যন্ত্রপাতির ভেতরে কিছু একটা ধরে টানাটানি করতেই একটা অংশ খুলে আসে–সাইবর্গটির প্রকৃত মাথাটি বের হয়ে আসে, এটি চুলহীন ছোট প্রায় অপুষ্ট একটি মাথা। সাইবর্গটির কপোট্রনের নিয়ন্ত্রণ খুলে নেওয়ায় সেটি অসহায় হয়ে পড়ে, আমাদের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাঁটু ভেঙে নিচে পড়ে বিকারগ্রস্তের মতো কাঁপতে শুরু করে।
আমি কাছে গিয়ে সাইবর্গটিকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করলাম। নরম গলায় বললাম, তোমার কোনো ভয় নেই। আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করব না।
মাথা থেকে কপোট্রন খুলে নেওয়া অসহায় এবং আতঙ্কিত সাইবর্গটি হামাগুড়ি দিয়ে হলঘরের এক কোনায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। যন্ত্র দিয়ে তাকে চালিয়ে নেওয়া হয়, এই যন্ত্রের সহায়তাটুকু সরিয়ে নেওয়া হলে এটি একটি শিশু থেকেও অসহায়। ভীত একটি পশুর মতো সাইবর্গটি বড় একটি ধাতব চৌকোনা বাক্সের পেছনে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল।
আমি এবারে দ্বিতীয় সাইবর্গটির দিকে তাকালাম এটি আমাদের প্রয়োজন নেই কিন্তু সম্ভবত তার কপোট্রন ইন্টারফেস খুলে রাখাটাই সবার জন্যে নিরাপদ। জিগি এগিয়ে তার মাথা থেকে ইন্টারফেসটি খুলে নেয়–এই সাইবর্গের প্রতিক্রিয়া হল আগেরটি থেকেও ভয়ংকর। সেটি মাথা কুটে আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করল। আমি অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করে আগের সাইবর্গটির পাশে বসিয়ে দিলাম। দুজন পর মতো জড়াজড়ি করে চৌকোনা বাক্সটির পেছনে মাথা নিচু করে লুকিয়ে রইল। মানুষের মস্তিষ্কের বড় ধরনের ক্ষতি করে দিয়ে তার সাথে যন্ত্রকে জুড়ে দিয়ে ব্যবহার করার এই অমানবিক প্রক্রিয়াটি একটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
জিগি ইন্টারফেসটি খুলে সেখান থেকে কিছু তার বের করে আনে, যন্ত্রের নানা অংশে টেপাটিপি করে কিছু একটা পরীক্ষা করে বলল, জিনিসটা খুব উঁচুদরের হল না, কিন্তু কাজ করবে।
আমি শঙ্কিত হয়ে বললাম, উঁচুদরের হল না বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছ?
তথ্য আদান–প্রদানের ব্যাপারটা তোমার নিজেকেই করতে হবে।
তার মানে কী?
তুমি নিজেই বুঝবে। জিগি আমাকে ডাকল, এস। কাছে এস।
আমি জিগির কাছে এগিয়ে গেলাম। জিগি আমাকে একটা বড় যন্ত্রাংশের ওপর বসিয়ে দিল। আমার হাতে কিছু যন্ত্রপাতি ধরিয়ে দিয়ে সে আমার মাথার পেছনে গিয়ে কিছু একটা করতে থাকে, হঠাৎ করে মনে হল আমার মাথার ভেতরে একটা বিস্ফোরণ ঘটল, চোখের সামনে বিচিত্র ধরনের আলোর বিচ্ছুরণ হতে থাকে, আমি কানের পাশে লক্ষকোটি ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে থাকি। আমার সমস্ত শরীর পরিপূর্ণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপতে শুরু করে, মনে হয় কেউ আমাকে গলিত সীসার মাঝে ছুঁড়ে দিয়েছে।
কতক্ষণ এরকম ছিল জানি না, হঠাৎ মনে হল আমার সমস্ত শরীর হালকা হয়ে গেছে, আমি বাতাসের মাঝে ভাসছি। মনে হল বহু দূর থেকে কেউ একজন আমাকে ডাকছে, আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। গলার স্বরটি জিগির, সে আমাকে চোখ খুলে তাকাতে বলছে।
আমি চোখ খুলে তাকালাম, মনে হল সমস্ত জগৎটাকে একটা ছোট ফোকাল লেংথের লেন্স দিয়ে দেখছি, চোখের সামনে সবকিছু নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘুরছে। আমি জিগিকে দেখতে পেলাম, সে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে দুই হাত দিয়ে ধরে রেখেছে। সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, ত্রাতুল, তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?
আমি অনেক কষ্ট করে বললাম, পাচ্ছি।
চমৎকার। যা ভয় পেয়েছিলাম!
জিগি কেন ভয় পেয়েছিল কেন জানি সেটা জানার কৌতূহল হল না। কারণ হঠাৎ করে আমার মনে হতে লাগল খুব সহজেই পঞ্চম মাত্রার সমীকরণের একটা সমাধান বের করা যেতে পারে। সমীকরণের রাশিমালাগুলো যখন মস্তিষ্কে প্রায় সাজিয়ে ফেলেছি তখন শুনতে পেলাম জিগি জিজ্ঞেস করছে, দশমিকের পর পাইয়ের পঞ্চাশ নম্বর অংকটি কত?
কেন?
জানতে চাইছি–দেখি বলতে পারি কি না।
আমাকে হিসাব করে বলতে হল। রামানুজনের একটি সিরিজ ব্যবহার করে মস্তিষ্কের মাঝে হিসাব করে বললাম, শূন্য।
তার পরেরটি?
পাঁচ।
তার পরেরটি?
আট। আমি জিগির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক হয়েছে?
কেমন করে বলব? আমি কি পাইয়ের মান কয়েক শ ঘর পর্যন্ত মুখস্থ করে রেখেছি নাকি?
তা হলে?
দেখছি তোমার মস্তিষ্ক হিসাব করার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে কি না।
আমি কিছু না বলে আবার আমার পাঁচ মাত্রার সমীকরণ দিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু জিগি বাধা দিল, সে জিজ্ঞেস করল, এখান থেকে লঞ্চ প্যাডটা দেখতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি।
আয়তনটা অনুমান কর। কী দিয়ে তৈরি হতে পারে আন্দাজ করে ক্যাপাসিটেন্টটা বের কর।
আমি হিসাব করে বের করে বললাম, বেশ খানিকটা অনিশ্চয়তা আছে।
থাকুক। জিগি আমার মাথাটা ঘুরিয়ে সুপার, কন্ডাক্টিং পাওয়ার ক্যাবলটা দেখিয়ে বলল, এখন হিসাব করে বের কর ক্যাবলটা কেমন করে প্যাচাতে হবে, এর মাঝখানে কী ধরনের ফেরো ম্যাগনেট ব্যবহার করবে।
আমি হাত তুলে জিগিকে থামিয়ে দিলাম, হঠাৎ করে পুরো সমস্যাটা আমার কাছে একেবারে পানির মতো সহজ মনে হতে লাগল। আমি মস্তিষ্কের মাঝে ক্যাবলটা প্যাচানো শুরু করতেই শুধু যে চৌম্বকীয় ক্ষেত্রটা দেখতে শুরু করলাম তা নয়, সময়ের সাথে পরিবর্তনের হারটাও স্পষ্ট হয়ে উঠল। ঘরের মাঝে ছড়ানো–ছিটানো নানা লোহা এবং ইস্পাতের যন্ত্রগুলো মাঝখানে নিয়ে আসা হলে চৌম্বক ক্ষেত্রটা কত গুণ বেড়ে যাবে সেটাও হিসাব করে ফেললাম। শুধু তাই নয়, ঠিক কোথায় একটা মাঝারি আকারের লোহার পাত বসালে সেটা ছুটে এসে ক্যাবলটাকে আঘাত করে ভেতরের ক্রায়োজেনিক পাম্পটাকে অচল করে দিতে পারে সেটাও আমি অনুমান করে নিলাম। ঠিক কতক্ষণ সময়ে তরল হিলিয়াম বাষ্পীভূত হয়ে ঘরটার মাঝে একটা উচ্চচাপের সৃষ্টি করবে কিংবা কতটুকু অংশে সুপার কন্ডাক্টিভিটি নষ্ট হয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে ক্যাবল উত্তপ্ত হয়ে আগুন ধরে যাবে এই ধরনের নানা বিষয় আমার মস্তিষ্কের মাঝে খেলা করতে লাগল।
জিগি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, এবারে তাগাদা দিয়ে বলল, বলো।
কী বলব?
হিসাব করে কী করলে?
সবকিছু বের করেছি।
আমাকে বলো।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কেন তোমাকে বলব। আমার সব মনে আছে।
সেই জন্যেই বলছি। তোমার মস্তিষ্কটি এখন একটা নিউরাল কম্পিউটার, তুমি এখন সবকিছু মনে রাখতে পারছ। একটানে যখন ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস খুলে ফেলব, তখন কিছুই তোমার মনে থাকবে না।
আমার কাছে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হল, এই সহজ জিনিসগুলো আমার মনে থাকবে কেন? জিগি আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, দেরি করছ কেন? বলো। যদি না বলে তা হলে কিন্তু মহাবিপদ হয়ে যাবে।
পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে হাস্যকর এবং ছেলেমানুষি মনে হচ্ছিল কিন্তু তবুও আমি জিগিকে বলতে শুরু করলাম। জিগি দ্রুত সেগুলো লিখে নিতে রু করে।
আমি বুঝতে পারছিলাম আমি ঠিক প্রকৃতিস্থ নই, চোখের সামনে সবকিছুই কেমন জানি দুলছে, জিনিসগুলোর আকার–আকৃতিও ঠিক নেই। সবকিছুকেই কেমন জানি তুচ্ছ এবং অর্থহীন বলে মনে হতে থাকে। না চাইলেও মাথার ভেতরে জটিল সমীকরণ চলে আসতে থাকে এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আমি সেগুলো সমাধান করতে থাকি।
জিগি আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলল, সে কী বলেছে আমি সেটাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে দ্রুত একটা চুয়াল্লিশ মাত্রার ম্যাট্রিক্স ওল্টানো শুরু করলাম। আমি টের পেলাম জিগি আমার মাথার পেছনে হাত দিয়েছে, কিছু একটা ধরে যাচকা টান দিতেই মাথার ভেতরে। একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হল, মুহূর্তের জন্যে চোখের সামনে জগৎসংসার অন্ধকার হয়ে গেল।
আমি যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম তখন জিগি আমার ওপরে ঝুঁকে আতঙ্কিত মুখে আমাকে ডাকছে। আমি চোখ খুলে তাকাতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, এন্ড্রোমিডার দোহাই! তা হলে চোখ খুলে তাকিয়েছ।
আমি চোখ এবং কপালে এক ধরনের ভোঁতা ব্যথা অনুভব করতে থাকি, কিন্তু সেটাকে উপেক্ষা করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলাম। জিগি আমাকে ধরে সাবধানে দাঁড় করিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল, চমৎকার! নিউরাল কম্পিউটারকে টার্বো মোডে চলানো যায় কি না। তাও পরীক্ষা করে দেখে ফেললাম!
কী দেখলে?
যায়।
দোহাই তোমার– আমি আমার মাথা দুই হাতে চেপে ধরে বললাম, ভবিষ্যতে আর কখনো এই পরীক্ষা করে দেখবে না।
জিগি মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে দেখব না। শুধু গাণিতিক অংশটুকু উজ্জীবিত করা যায় বলে শুনেছিলাম–আজকে পরীক্ষা করে দেখলাম! সত্যিই যায়! জিগির অজান্তেই তার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
জিগির ধারণা সত্যি–খানিকক্ষণ আগে আমি কী হিসাব করেছিলাম, তার কিছু মনে নেই। জিগি লিখে রাখা হিসাবটুকু দেখে ক্যাবল সাজাতে থাকে। শক্ত মোটা ক্যাবল নাড়তে প্রায় মত্ত হস্তীর শক্তির প্রয়োজন, দুজনের একেবারে কালো ঘাম ছুটে গেল। নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের কয়েল করে তার মাঝখানে বিভিন্ন লোহার যন্ত্রপাতি এনে রাখা হল। কোনটা কোথায় রাখা হবে আমি একেবারে নিখুঁতভাবে বলে দিয়েছি। পুরোটুকু সাজিয়ে যখন শেষ করেছি তখন আমরা দুজনই ঘেমে–নেয়ে গিয়েছি।
দুজনে দেওয়ালে হেলান দিয়ে মুখ হাঁ করে নিশ্বাস নিতে থাকি। জিগি আমার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, চমৎকার! দেখি এখন মহাজাগতিক প্রাণী কেমন করে পৃথিবীর মানুষ নিয়ে পালিয়ে যায়!
আগেই এত উচ্ছ্বসিত হয়ো না জিগি। এখনো অনেক কাজ বাকি।
জিগিকে সেটা নিয়ে খুব বিচলিত্ত দেখা গেল না। এরকম সময়ে আমরা আমাদের পেছনে একটু শব্দ শুনতে পেলাম তাকিয়ে দেখি সাইবর্গ দুটো গুটিসুটি মেরে আমাদের পেছনে এসে বসেছে। তাদের চোখে একই সাথে এক ধরনের কৌতূহল এবং আতঙ্ক। আমাদেরকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে।
আমি তাদের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সাইবর্গ দুটি আমার হাসি দেখে বিন্দুমাত্র আশ্বস্ত হল না, বরং এক ধরনের ভীতি তাদের ভেতর কাজ করল। উবু হয়ে অনেকটা পশুর মতো দুই হাত এবং এক পায়ে ভর দিয়ে আবার চৌকোনা একটা যন্ত্রের পেছনে লুকিয়ে গেল। জিগি হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, মাথায় কপোট্রনের ইন্টারফেসটা লাগানো পর্যন্ত এরকমই থাকবে। কী একটা বাজে ব্যাপার।
মাথায় লাগিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় না?
নাহ্ আমরা ধরা পড়ে যেতে পারি। জিগি মাথা নাড়ল এবং হঠাৎ করে ঘুরে আমার দিকে তাকাল, একটা কাজ করলে কেমন হয়?
কী?
এই সাইবর্গ দুজনের কপোট্রনিক ইন্টারফেসটা যদি আমরা দুজন মাথায় পরে বের হয়ে যাই–তা হলে কেউ আমাদের সন্দেহ করবে না।
আমি ভুরু কুঁচকে জিগির দিকে তাকালাম, কী বললে?
আমরা দুজন মাথায় এই বাইবর্গের ইন্টারফেসটা পরে সাইবর্গ সেজে বের হয়ে যেতে পারি। বাইরে গিয়ে দেখতে পারি কী হচ্ছে।
কিন্তু ওরা বুঝে ফেলবে না?
না। সাইবর্গের মতো হাঁটব, চেষ্টা করব কোনো কথা না বলতে, আর যদি বলতেই হয় তা হলে সাইবর্গদের মতো কথা বলব।
আইডিয়াটা খারাপ না। এই হলঘরের ভেতরে এখন আর দেখার কিছুই নেই। করিডর ধরে হেঁটে গিয়ে মহাকাশযানটিকে হয়তো দেখতে পারি। আমি জিগির দিকে তাকিয়ে বললাম, চলো তা হলে।
১৩. মুখোমুখি
আমি আর জিগি সাবধানে দরজা খুলে বের হয়ে এলাম। মাথার ওপরে কপোট্রনের ইন্টাফেসটা বসাতে বেশ কষ্ট হয়েছে। সত্যিকারের সাইবর্গের মাথার চুলগুলো ইলেকট্রোলাইসিস করে তুলে ফেলা হয়। করোটিতে ইন্টারফেসটা ক্রু দিয়ে আটকানো হয়–আমাদের সেরকম কিছু নেই বলে যে কোনো মুহূর্তে পুরোটা খুলে পড়ে যাবার একটা আশঙ্কা আছে। হাঁটতে হচ্ছে সাবধানে, এক হিসেবে ব্যাপারটি মন্দ নয় কারণ তার ফলে আমাদের দেখাচ্ছে সত্যিকারের সাইবর্গের মতো।
প্রথম কিছুক্ষণ আমরা ধরা পড়ে যাব সেরকম একটা আশঙ্কা আমাদের ভেতর কাজ করছিল। কিছুক্ষণের মাঝেই অবিশ্যি বুঝে গেলাম কেউ কিছু সন্দেহ করছে না। আমরা চোখে–মুখে সাইবর্গীয় একটা উদভ্রান্ত দৃষ্টি ফুটিয়ে হেঁটে যেতে থাকি। করিডরের এক মাথায় একটি লিফট। অন্যপাশে বিচিত্র একটি মহাকাশযান, তার ভেতরে কিছু কাজকর্ম করা হচ্ছে। আমি আর জিগি কাছাকাছি এসে দেখতে পেলাম বড় একটি গোলাকার মঞ্চের মতো জায়গা, সেখানে পাশাপাশি দুটি আসন, আসনগুলো খালি যারা এখানে বসবে তারা এখনো এসে পৌঁছায় নি।
কিছুক্ষণের মাঝেই অবিশ্যি তারা পৌঁছে গেল। নুরিগাকে তার খাঁচার ভেতরে করে এনেছে, সে খাঁচার গারদগুলো ধরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নুরিগার পেছনেই একটি অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে, তাকে দুপাশ থেকে দুটি শক্তিশালী সাইবর্গ ধরে রেখেছে। মেয়েটির চোখে–মুখে একটি বিচিত্র ধরনের আতঙ্ক, মনে হচ্ছে এখানে কী হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। এই মেয়েটি নিশ্চয়ই রিয়া–আমি তার সাথে কথা বলেছি। পরাবাস্তব জগতে আমার একটা অস্তিত্বের সাথে তার একটা অস্তিত্ব আটকা পড়ে আছে। হঠাৎ সম্পূর্ণ অপরিচিত এই মেয়েটির জন্যে আমি আমার বুকে গভীর মমতা অনুভব করলাম, আমার ইচ্ছে হল আমি তার কাছে ছুটে গিয়ে বলি, রিয়া তোমার কোনো ভয় নেই–আমরা তোমাকে রক্ষা করব।
কিন্তু আমি সেটা বলতে পারলাম না, রিয়ার ঠিক পেছনে খ্রাউস, তার আশপাশে অসংখ্য সাইবর্গ–তাদের অনেকে সশস্ত্র।
রিয়াকে দুই হাতে ধরে প্রায় টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তার মাঝে হঠাৎ করে সে থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে ঘুরে তাকাল। খ্রাউসের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে কী হচ্ছে। আমাকে বলবে?
খ্রাউস শীতল গলায় বলল, বিশেষ কিছু নয়।
অবিশ্যি বিশেষ কিছু। তোমরা আমার কাছে খবর পাঠিয়েছ যে আমার মাথার ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেসটা খুলে দেবে। আমি সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছি। এখানে হাজির হওয়া মাত্র আমাকে ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছ যেন আমি একটা খুনি আসামি। আমাকে এভাবে ধরে নিয়ে যাচ্ছ কেন?
কারণ আছে রিয়া।
কী কারণ–সেটাই আমি জানতে চাই।
খ্রাউস কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই রিয়া ক্রুদ্ধ গলায় বলল, তার আগে আমাকে আরো একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।
কী প্রশ্ন?।
রিয়া খাঁচার ভেতরে আটকে থাকা নুরিগাকে দেখিয়ে বলল, এই মানুষটাকে তোমরা খাঁচার ভেতরে আটকে রেখেছ কেন? তোমরা বুঝতে পারছ না কাজটি কী ভয়ংকর অমানবিক?
খ্রাউস হা–হা করে হেসে বলল, তুমি হচ্ছ পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ কাজেই তোমার মানবিক অনুভূতিগুলো অন্য দশজন থেকে ভিন্ন। সবকিছুতেই অমানবিক কারণ খুঁজে পাও।
তুমি বলতে চাও এটা অমানবিক নয়? অন্য দশজনের বেলায়
এটা হয়তো অমানবিক কিন্তু এর বেলায় নয়।
কেন?
খ্রাউস উত্তর দেবার আগেই নুরিগা বিচিত্র ভঙ্গিতে হেসে উঠে বলল, কারণ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ।
রিয়া অবাক হয়ে বলল, কী বললে? পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ?
হ্যাঁ। খুব একটা মজার কথা বলছে এরকম একটা ভঙ্গি করে নুরিগা বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ থেকে জিন্সগুলো নিয়ে আমাকে তৈরি করেছে। তাই আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ।
এটা কী ধরনের যুক্তি মানুষ খারাপ হয়ে যেতে পারে কিন্তু তার জিন্স কেমন করে খারাপ হয়? ছোট বাচ্চা বড় হলে কি তার জিন্স পাল্টে যায়? কখনো একটা ছোট শিশু দেখেছ যে অপরাধী? দেখেছ?
নুরিগা আবার হা–হা করে হেসে উঠে বলল, এটা তুমি ওদের বোঝাতে পারবে না।
রিয়া তীব্র দৃষ্টিতে ব্রাউসের দিকে তাকাল, কিন্তু খ্রাউস তার দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, চল, ওকে নিয়ে চল।
রিয়া ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে বলল, তুমি এখনো বলে নি কেন আমাকে নিয়ে যাচ্ছ।
বলি নি, কারণ সেটা শুনলে হয়তো তোমার ভালো লাগবে না।
রিয়া খানিকক্ষণ নিঃশব্দে খ্রাউসের দিকে তাকিয়ে থেকে কাঁপা গলায় বলল, তোমরা আমাকে আর নুরিগাকে নিয়ে নিশ্চয়ই কোনো একটা অন্যায় কাজ করতে যাচ্ছ। অমানবিক কাজ করতে যাচ্ছ।
ন্যায়–অন্যায় মানবিক–অমানবিক খুব আপেক্ষিক ব্যাপার।
রিয়া ভয়ার্ত মুখে বলল, তার মানে তোমরা সত্যি সত্যি আমাদেরকে নিয়ে ভয়ংকর কিছু করছ।
খ্রাউস রিয়ার কথার উত্তর না দিয়ে সাইবর্গগুলোকে বলল, এদেরকে নিয়ে যাও ভেতরে।
রিয়া আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সাইবর্গগুলো তাকে সে সুযোগ দিল না– অত্যন্ত রূঢ়ভাবে তাকে ধরে টেনেহিঁচড়ে নিতে শুরু করল। আমার আবার ইচ্ছে করল রিয়ার কাছে ছুটে গিয়ে তাকে বলি, তোমার কোনো ভয় নেই রিয়া। আমরা তোমাকে রক্ষা করব–যেভাবে পারি রক্ষা করব। কিন্তু তাকে সেটা বলতে পারলাম না। সাইবর্গগুলোর পেছনে নিঃশব্দে হাঁটতে থাকলাম।
মহাকাশযানের ভেতরে যাবার আগে সবাইকে কোন ধরনের স্পেস সুট পরে নেবে বলে আমার একটা ধারণা ছিল কিন্তু দেখা গেল সেটি সত্যি নয়। সাইবর্গগুলো রিয়াকে তার আসনের কাছাকাছি দাঁড় করিয়ে সরে গেল, খ্রাউস কোথাও কোনো সুইচ স্পর্শ করতেই অদৃশ্য কোনো একটি শক্তির ক্ষেত্র নিচে নেমে এসে রিয়াকে আটকে ফেলল। রিয়া সেই অদৃশ্য ক্ষেত্রকে আঘাত করে কিন্তু সেটাকে ছিন্ন করতে পারে না। আমি শুনতে পেলাম সে কাতর গলায় চিৎকার করে বলছে, আমাকে এখান থেকে বের হতে দাও। তোমরা এভাবে আমাকে আটকে রাখতে পারবে না।
খ্রাউস রিয়ার কাতর চিৎকারকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে নুরিগাকে ভেতরে নিয়ে আসার জন্যে ইঙ্গিত করল। সাইবর্গগুলো তাদের যান্ত্রিক ক্ষিপ্রতায় নুরিগাকে ধাক্কা দিয়ে তার খাঁচাসহ ভেতরে নিয়ে গেল। তার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গায় নুরিগাকে দাঁড় করিয়ে খ্রাউস কোথায় জানি স্পর্শ করতেই ওপর থেকে আবার এক অদৃশ্য শক্তি বলয় নিচে নেমে এসে নুরিগাকে তার ভেতরে আটকে ফেলল। খ্রাউস এবারে একটা সাইবর্গকে ইঙ্গিত দিতেই সে খাঁচার দরজা খুলে নুরিগাকে শক্তি বলয়ের মাঝে রেখে খাঁচাটা টেনে বের করে সরিয়ে নিল। মুরিগা পাথরের মতো মুখ করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, শক্তি বলয়টি স্পর্শ করে দেখারও তার কোনো কৌতূহল নেই। খ্রাউস চাৰ্বদিকে তাকিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বলল, চমৎকার!
রিয়া এতক্ষণে নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়েছে। হঠাৎ করে সে বুঝতে পেরেছে যে তার আর কিছু করার নেই। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তুমি এখন কী করবে?
খ্রাউস মহাকাশযানটির চারদিকে তাকিয়ে ভেতর থেকে বের হয়ে এল। হাতে একটা চতুষ্কোণ কন্ট্রোল প্যানেলের ওপরে সযত্নে হাত বুলিয়ে বলল, তোমরা নিজেরাই দেখবে। তবে মনে হয় এখন সময় হয়েছে তোমাদের বলে দেবার। খ্রাউস মুখে এক ধরনের হাসি ফুটিয়ে গলায় খানিকটা নাটকীয়তা এনে বলল, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানবী রিয়া এবং সর্বনিম্ন মানব নুরিগা তোমাদের দুজনকে অভিনন্দন। কারণ তোমরা পৃথিবীর প্রথম মানব সন্তান যারা মহাজাগতিক অভিযান করে দূর কোনো একটি গ্যালাক্সিতে কোনো এক বুদ্ধিমান মহাজাগতিক প্রাণীর জগতে যাচ্ছ।
রিয়া আর্তনাদ করে উঠল, চিৎকার করে বলল, না!
হ্যাঁ। খ্রাউসের মুখে একটা পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে, সে চোখ নাচিয়ে বলে, বুদ্ধিমান একটি মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। তারা আমাদের দিয়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তি–তার বদলে আমরা তাদের দিচ্ছি দুটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ। সবচেয়ে নিখুঁত এবং সবচেয়ে বড় অপরাধী।
রিয়া শক্তি বলয়ে আটকা পড়ে থেকে রক্তহীন ফ্যাকাসে মুখে ব্রাউসের দিকে তাকিয়ে রইল। খ্রাউস হাতের চৌকোনা কন্ট্রোল প্যানেলের একটা বড় সুইচ স্পর্শ করতেই তীক্ষ্ণ এলার্মের শব্দ বেজে ওঠে। দেয়ালে হঠাৎ করে কিছু সংখ্যা ফুটে ওঠে। সংখ্যাগুলো প্রতি সেকেন্ডে একটি করে কমে কাউন্ট ডাউন ক্ষ হয়ে যায়। খ্রাউস মুখের হাসিকে আরো বিস্তৃত করে বলল, আজ আমার খুব আনন্দের দিন। মহাজাগতিক প্রাণীদের আমি কথা দিয়েছিলাম, আমি আমার কথা রেখেছি! তারাও তাদের কথা রেখেছে, আমাকে দিয়েছে অসাধারণ সব প্রযুক্তি!
রিয়া চিৎকার করে বলল, তুমি এটা করতে পার না। পৃথিবীর মানুষ তোমাকে ক্ষমা করবে না। এটা অন্যায়, এটা বেআইনি।
তুমি সত্যিই বলেছ। এটা বেআইনি। এটা অন্যায় কি না জানি না, কিন্তু এটা বেআইনি। কাজেই এটা কারো জানার কথা নয়। তাই আমার কাজে সাহায্য করার জন্যে আমি সাইবর্গ তৈরি করেছি। অসংখ্য সাইবর্গ। কাজ শেষ হলে তাদেরকে আমি ব্যাক্টেরিয়ার মতো মেরে ফেলব। এই দেখ–তাদেরকে আমি এখানে অচল করে রেখে যাব। এদেরকে নিয়ে এই পুরো এলাকাটা ধ্বংস করে দেওয়া হবে।
খ্রাউস তার হাতের কন্ট্রোল প্যানেলের কোনো একটা সুইচ স্পর্শ করতেই মহাকাশযানটিকে ঘিরে থাকা অসংখ্য সাইবর্গ পা ভেঙে একসাথে লুটিয়ে পড়ল। দুজন ছাড়া আমি এবং জিগি।
খ্রাউস সবিস্ময়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। আমি একটু এগিয়ে নিচে পড়ে থাকা একটা সাইবর্গের হাত থেকে একটা ভয়ংকর দর্শন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে উসের দিকে এগিয়ে গেলাম। নিচু গলায় বললাম, না খ্রাউস, তোমার যন্ত্র ঠিকই আছে। সেখানে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা অন্য জায়গায়। আমরা সাইবর্গ নই।
আমি মাথা থেকে কপোট্রনিক ইন্টারফেস খুলে ফেলতেই খ্রাউস বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল। বলল, তোমরা?
হ্যাঁ।
খ্রাউস হঠাৎ পাগলের মতো হেসে উঠে বলল, তোমরা একটু দেরি করে ফেলেছ! এই দেখ পৃথিবীর মানুষ কীভাবে দূর গ্যালাক্সিতে পাড়ি দেয়–
আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, দেবে না।
পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই যেটি এখন এই অভিযানকে থামাতে পারবে।
আছে।
খ্রাউস চিৎকার করে বলল, নেই।
তুমি নিজের চোখেই দেখো–
খ্রাউস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কাউন্ট ডাউন সংখ্যার দিকে তাকিয়ে রইল। এটি কমতে কমতে শূন্যতে এসে স্থির হতেই প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল। হঠাৎ করে সমস্ত জায়গাটা দুলে উঠল, তীব্র আলোর একটা ঝলকানি দেখতে পেলাম, শক্তি বলয় থেকে রিয়া এবং নুরিগা দুজন দুদিকে ছিটকে পড়ল। কর্কশ এক ধরনের এলার্ম বাজতে থাকে, আঁজালো পোড়া গন্ধ এবং ধোঁয়ায় হঠাৎ করে চারদিকে অন্ধকার হয়ে আসে। খ্রাউস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। দেখতে দেখতে সেই মুখ ভয়ংকর ক্রোধে হিংস্র হয়ে ওঠে, হঠাৎ করে সে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি হাতের অস্ত্রটি দিয়ে তাকে গুলি করার চেষ্টা করলাম কিন্তু সে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় নিজেকে রক্ষা করে আমার টুটি চেপে ধরল। খাউসের শরীরে ভয়ংকর শক্তি–আমার মনে হল তার লোহার মতো হাত দিয়ে বুঝি আমার। ঘাড়টি একটি কাঠির মতো ভেঙে ফেলবে।
ঠিক তখন একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল এবং শক্তিশালী একটি অস্ত্রের গুলিতে খ্রাউসের পুরো মাথাটি উড়ে গেল। প্রায় সাথে সাথেই থ্রাউসের আঙুলগুলো আমার গলায় শিথিল হয়ে আসে। আমি নিজেকে কোনোভাবে মুক্ত করে নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করতে থাকি এবং তখন আমি একটা আর্তচিৎকার শুনতে পেলাম। মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম রিয়া দুই হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে নিজের চিৎকার থামানোর চেষ্টা করছে। কী দেখে সে চিৎকার করছে আমি অনুমান করতে পারি, টলতে টলতে কোনোভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে খ্রাউসের দেহের দিকে তাকালাম। গুলির আঘাতে তার মাথাটি উড়ে গিয়েছে, গলার শূন্য স্থান থেকে প্যাঁচপেচে সবুজ এক ধরনের তরল বের হচ্ছে, তার মাঝে কিলবিলে এক ধরনের প্রাণী। নুরিগা অস্ত্র হাতে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে এইমাত্র গুলি করে খ্রাউসের মাথাটি উড়িয়ে দিয়েছে, কখনো কল্পনাও করে নি তারপর তাকে এই দৃশ্য দেখতে হবে।
আমি বুক ভরে নিশ্বাস নিতে গিয়ে খকখক করে কেশে ফেললাম। কোনোভাবে কাশি থামিয়ে বললাম, এত অবাক হবার কিছু নেই। খ্রাউস মানুষ নয়। মহাজাগতিক প্রাণীর ডিকয়।
নুরিগা মাথা নেড়ে বলল, আমার আনন্দটি পুরো হল না। আমি মানুষটি ভালো নই– মাথার ঘিলু উড়িয়ে দিলে এক ধরনের আনন্দ পাই। এটি তো দেখছি মানুষ নয়–এর মাথাও নেই, ঘিলুও নেই।
রিয়া খ্রাউসের ভয়ংকর পরিণতি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের রক্ষা করার জন্যে তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। আমার নাম রিয়া–
আমি জানি। আমি হেসে বললাম, আমার নাম ত্রাতুল। তোমার সাথে কথা বলেছিলাম মনে আছে?
রিয়ার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ অবিশ্যি মনে আছে। রিয়া আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু জিগি বাধা দিল, উত্তেজিত গলায় বলল, পাশের হলঘরে আগুন লেগে গেছে। আমাদের এক্ষুনি সরে পড়তে হবে। একটা একটা করে সাইবর্গকে চালু করে দাও। তাড়াতাড়ি। সবাই হাত লাগাও।
রিয়া জিজ্ঞেস করল, কেমন করে সাইবর্গ চালু করতে হয়?
এই দেখো–কানের নিচে একটা সুইচ আছে। দু সেকেন্ড চাপ দিয়ে ধরে রেখো, এরা চালু হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণের মাঝেই সবগুলো সাইবর্গ জেগে উঠে ছোটাছুটি শুরু করল। আমরা তাদেরকে লিফট দিয়ে উঠে যাবার নির্দেশ দিয়ে ছুটতে শুরু করি। করিডরের ভেতর দিয়ে ছুটে যাবার সময় হঠাৎ করে একটা করুণ আর্তনাদ শুনতে পেলাম। আমি থমকে দাঁড়িয়ে বললাম, সর্বনাশ!
রিয়া ভয়ার্ত মুখে বলল, কী হয়েছে।
এই হলঘরের ভেতরে আগুন লেগেছে। তোমাদের বাচানোর জন্যে যে কাজটা করেছি তাতে আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু–।
কিন্তু কী? ভেতরে দুজন আটকা পড়ে আছে। সাইবর্গের হোষ্ট। দুজন বুদ্ধিহীন মানুষ।
জিগি আমার দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকাল। আমি কানার সিকিউরিটি কার্ড দিয়ে করিডরের দরজা খুলতেই হলঘরের ভেতর থেকে প্রচণ্ড গরম একটা আগুনের হলকা যেন আমাদের ঝলসে দিল। আমি সাবধানে ভেতরে তাকালাম, দূরে একটা চতুষ্কোণ যন্ত্রের পাশে দাঁড়িয়ে সাইবর্গ দুটি ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করছে, তাদের চারপাশে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আমি চিৎকার করে হাত নেড়ে ডাকলাম, এস–এদিকে চলে এস।
বুদ্ধিহীন মানুষ দুজন আমার কথা শুনল কি না কিংবা শুনলেও বুঝতে পারল কি না জানি না। তারা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগল। আমি আবার হাত নেড়ে ডাকলাম, আমার দেখাদেখি জিগি আর রিয়াও হাত নেড়ে ডাকতে লাগল কিন্তু কোনো লাভ হল না।
নুরিগা একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, ডেকে লাভ নেই।
তা হলে?
গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তোমরা দাঁড়াও আমি যাচ্ছি।
তুমি যাচ্ছ? আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি এর ভেতরে যাচ্ছ? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
না। মাথা খারাপ হয় নি। কিন্তু কাউকে যদি ভেতরে যেতে হয় তা হলে কি আমারই যাওয়া উচিত না? কেউ যদি মারাই যায় তা হলে সবচেয়ে খারাপ মানুষটাই মারা যাক।
নুরিগার গলার স্বরে এক ধরনের জ্বালা ছিল সেটা আমাদের কানে স্পষ্ট ধরা পড়ল। আমি কিছু বলার আগেই রিয়া তার হাত স্পর্শ করে বলল, যে যাই বলুক, আমরা তোমাকে কখনো সবচেয়ে খারাপ মানুষ বলি নি।
নুরিগা মাথা নেড়ে বলল, এসব নিয়ে পরে কথা বলা যাবে, ভেতরে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি যাচ্ছি।
আমাদেরকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নুরিগা ছুটে ভেতরে ঢুকে গেল। আগুনের ভেতর দিয়ে ছুটে গিয়ে সে আতঙ্কিত দুজনকে ধরে টেনে নিয়ে আসতে থাকে। মানুষ দুটো তখনো কিছু বুঝতে পারছে না–একটানা চিৎকার করে যাচ্ছে। দরজার কাছাকাছি এসে একজনকে সে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়, দ্বিতীয় মানুষটা তার হাত থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নিয়ে আবার ভেতরে ছুটে যাবার চেষ্টা করে। নুরিগা আবার তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে নিয়ে আসে। দরজার দিকে তাকে ঠেলে দিতেই হলঘরের ভেতরে প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল। আগুনের একটা জ্বলন্ত গোলা ছুটে এসে হঠাৎ করে নুরিগাকে গ্রাস করে নেয়, আমরা হতবাক হয়ে দেখলাম প্রচণ্ড আগুনে নুরিগার সমস্ত শরীর দাউদাউ করে জ্বলছে। নুরিগা টলতে টলতে কোনোভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না, হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল, কোনোভাবে মাথা তুলে আমাদের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু কথা শেষ হবার আগেই জ্বলন্ত একটি অগ্নিকূপ তাকে পুরোপুরি আড়াল করে ফেলল। চারদিকে শুধু আগুন আর আগুন। তার ভয়ংকর লেলিহান শিখা আর উত্তপ্ত বাতাসের হলকার মাঝে মনে হল আমরা শুনতে পেলাম নুরিগা চিৎকার করে বলছে, যাও! তোমরা যাও।
রিয়া দুই হাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু জিগি তার সুযোগ দিল না, বলল, পালাও, এক্ষুনি পালাও। পুরো এলাকাটি এক্ষুনি ধসে পড়বে।
আমি রিয়ার হাত ধরে টেনে ছুটতে থাকি। জিগি সাইবর্গ মানুষ দুটির হাত ধরে আমাদের পিছু পিছু ছুটতে থাকে। করিডরের শেষ মাথায় লিফটের ভেতরে ঢুকে সুইচ স্পর্শ করার সাথে সাথে পুরো এলাকাটা আরো একটি ভয়ংকর বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল, ভয়ংকর আগুনের লেলিহান শিখা আমাদের দিকে ছুটে আসে কিন্তু তার আগেই লিফটটি উপরে উঠতে শুরু করেছে। জিগি ফিসফিস করে বলল, আমরা বেঁচে গেলাম।
এত নিশ্চিত হয়ো না। আমি জিগির দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললাম, আমরা এখনো এই কেন্দ্রের ভেতরে আটকা পড়ে আছি। এটা উসের আস্তানা। লিফট থেকে বের হওয়া মাত্রই আমরা ধরা পড়ে যাব।
জিগি এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে আমার দিকে তাকাল। রিয়া কাঁপা গলায় বলল, কিন্তু আমরা সত্যি কথাটি সবাইকে জানিয়ে দেব।
কেমন করে জানাবে?
রিয়া হতবুদ্ধির মতো আমার দিকে তাকাল, আমি বললাম, সবাইকে জানাতে হলে আগে এখান থেকে বের হতে হবে। কেমন করে বের হবে?
কেউ নেই সাহায্য করার?
আছে। আমি মাথা নাড়লাম, তার নাম হচ্ছে ক্রানা। ক্ৰানা সাহায্য করেছে বলে আমরা এত দূর আসতে পেরেছি। যেভাবেই হোক আমাদের ক্রানাকে খুঁজে বের করতে হবে।
ঠিক এই সময় লিফট থেমে গেল। লিফটের দরজা নিঃশব্দে খুলে যেতেই দেখি ঠিক আমাদের সামনে জানা উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে কানার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, তোমরা বেঁচে আছ তা হলে
আমি ক্ৰানাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, আমাদের যেভাবে হোক বের হওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দাও
প্রয়োজন নেই?
না।
কেন?
বাইরে সবাইকে বলতে হবে এখানে কী হচ্ছে।
ক্রানা শব্দ করে হেসে বলল, তার কোনো প্রয়োজন নেই।
কেন?
সারা পৃথিবীর সবাই এখন এটি জানে!
কেমন করে জানে?
এস আমার সাথে
ক্ৰানা আমাদের বড় একটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের সামনে নিয়ে গিয়ে বলল, এই দেখ, সারা পৃথিবীতে একটু পরে পরে এই বুলেটিনটি প্রচারিত হচ্ছে।
আমরা রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রইলাম, হঠাৎ করে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে একটি নারীমূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল, আমরা অবাক হয়ে দেখলাম সেটি রিয়া। তার মুখে এক ধরনের ব্যাকুল ভাব, চোখে শঙ্কা। অনিশ্চিতভাবে সামনে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, পৃথিবীর মানুষেরা, আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই তোমরা আমাকে দেখতে পাচ্ছ কি না, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ কি না। আমার নাম রিয়া, পৃথিবীতে অনেকে আমাকে কৌতুক করে ডাকত রাজকুমারী রিয়া, কারণ আমাকে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরি করা হয়েছিল–বলা হয়ে থাকে আমি হচ্ছি পৃথিবীর নিখুঁত মানবী–যদিও আমি সেটা বিশ্বাস করি না, কোনো মানুষ সবচেয়ে নিখুঁত হতে পারে না, তা হলে মানুষের ভেতরের শক্তিকে ক্ষুদ্র করে দেখা হয়।
আমার মনে হয় পৃথিবীর অনেক মানুষই আমার কথা শুনেছে, সেটা নিয়ে খানিকটা কৌতূহল এবং অনেক ক্ষেত্রে কৌতুক অনুভব করেছে। কিন্তু আজ আমি তোমাদের সামনে বলতে এসেছি যে এটি কৌতূহল বা কৌতুকের ব্যাপার নয়। এটি একটি ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের ব্যাপার।
আমি নিশ্চিত তোমরা জান না আমাকে যেরকম পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত হিসেবে তৈরি করা হয়েছে ঠিক সেরকম পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধী হিসেবে একজনকে সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। কাজটি করা হয়েছে গোপনে। সেই মানুষটি কখনো কোনো অপরাধ করে নি কিন্তু তবুও তাকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করে শিকল দিয়ে বেঁধে খাঁচার মাঝে আটকে রাখা হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম নিষ্ঠুরতার কথা কেউ শুনেছে বলে আমার মনে হয় না। পৃথিবীর মানুষেরা, তোমরা এখনো পুরোটুকু শুনো নি–আমি নিশ্চিত শুনলে তোমরা আতঙ্কে শিউরে উঠবে।
আমাদের দুজনকে তৈরি করার পেছনে একটি কারণ রয়েছে। কারণটি বৈজ্ঞানিক কৌতূহল নয়। কারণটি বলা যায় এক কথায়, ব্যবসায়িক। আর সেই ব্যবসাটি হচ্ছে কোনো এক মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে। তারা পৃথিবীতে দেবে প্রযুক্তি তার বিনিময়ে পৃথিবী দেবে দুজন মানুষ। সবচেয়ে ভালো এবং সবচেয়ে খারাপ। একজন পুরুষ একজন মহিলা। আর এই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে গোপনে। পৃথিবীর সকল মানুষের অজান্তে।
পৃথিবীর মানুষেরা–আমি জানি না, তোমরা আমার কথা শুনছ কি না। যদি শুনছ– আমি নিশ্চিত তোমরা নিশ্চয়ই ঘৃণা, আতঙ্ক এবং ক্রোধে শিউরে উঠছ। কিন্তু তোমরা এখনো পুরোটুকু শুনো নি।
এই যে আমাকে দেখছ, আমি কিন্তু সত্যিকারের রিয়া নই। সত্যিকারের রিয়া এখন কোথায় আছে আমি জানি না। সম্ভবত তাকে দূর কোনো এক গ্যালাক্সিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, ল্যাবরেটরিতে যেরকম করে গিনিপিগকে বিশ্লেষণ করা হত সেরকমভাবে বিশ্লেষণ করার জন্যে। আমি প্রকৃত রিয়ার একটি অস্তিত্ব। আমাকে একটা পরাবাস্তব জগতে তৈরি করা হয়েছে। আমার সাথে আরো অনেকে আছে। তারা আমাকে সাহায্য করেছে এই পরাবাস্তব জগৎটি দখল করে তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যে।
পৃথিবীর মানুষেরা। শুধু তোমরাই পারবে এই নিঃসঙ্গ ভয়ংকর পরাবাস্তব জগৎ থেকে আমাদের উদ্ধার করে আনতে। শুধু তোমরাই পারবে এই ভয়ংকর ষড়যন্ত্র রুখে দিতে। শুধু তোমরা। তোমাদের শুভবুদ্ধি আর তোমাদের ভালবাসা।
রিয়ার প্রতিচ্ছবিটি খুব ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে গেল। আমি রিয়ার দিকে তাকালাম, তার চোখে পানি টলটল করছে, আমি নরম গলায় বললাম, খুব সুন্দর করে বলেছ রিয়া।
রিয়া মাথা নাড়ল, বলল, আমি বলি নি। ও বলেছে।
ও আর তুমি এক রিয়া। তোমরা এখন দুজন দু জায়গায় আছ কিন্তু আবার তোমরা এক হবে।
ঠিক এই সময় সমুদ্রের গর্জনের মতো এক ধরনের শব্দ শুনতে পেলাম। আমি অবাক হয়ে বললাম, এটি কীসের শব্দ?
ক্রানা বলল, মানুষের। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ বাইরে এসে একত্র হচ্ছে। তারা সব ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়তে চাইছে।
সত্যি?
হা সত্যি।
ক্রানা রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, মানুষ খুব খেপে উঠছে, তোমাকে একটু বাইরে গিয়ে তাদের শান্ত করতে হবে। তুমি ছাড়া আর কেউ পারবে না। রাষ্ট্রপতি আসছেন, বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতিও আসছেন। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানরা চলে এসেছেন।
রিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, ক্রানা হাত ধরে বলল, এস।
শেষ কথা
হ্রদের তীরে নৌকাটা পুরোপুরি থামার আগেই সবাই হৈ–হুঁল্লোড় করে নেমে এল। পানিতে ঝাপাঝাপি করে সবাই ভিজে গেছে কিন্তু কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই মিলে ছুটি কাটাতে এসেছে–আজ এখানে কারণে–অকারণে আনন্দ এবং হাসির মেলা।
ক্রানা তার দুই বছরের বাচ্চাটিকে ধরে রেখেছিল, সে নামার জন্যে আঁকুপাকু করতে থাকে। তাকে নামিয়ে দিতেই সে থপথপ করে দুই পা এগিয়ে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে হমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। সেভাবেই সে হামাগুড়ি দিয়ে একটা লাল কাঁকড়ার কাছে এগিয়ে যায়। তাকে দেখে কাকড়াটি বালুর ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল, শিশুটি তখন অবাক হয়ে চারদিকে দেখে, হাতের মুঠোর জিনিস যে হারিয়ে যেতে পারে এই অভিজ্ঞতাটুকু বুঝি এমন করেই মানুষের হয়।
ক্রানা হ্রদের উথাল–পাতাল বাতাসে তার উড়ন্ত চুলগুলো সামলানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, আচ্ছা রিয়া এবং ত্রাতুল, তোমরা প্রতি বছর এখানে বেড়াতে আস কেন?
রিয়া আদুরে মেয়ের মতো আমার হাত জড়িয়ে ধরে রহস্য করে বলল, ব্যাপারটা গভীরভাবে রোমান্টিক! আমার সাথে ত্রাতুলের দেয়া হয়েছিল এখানে।
জিগি গলা উঁচিয়ে বলল, বাজে কথা বলে না। তোমার সাথে ত্রাতুলের দেখা হয়েছিল পরাবাস্তব জগতে। একটা যন্ত্রের ভেতরে তার মেমোরি সেলে। তোমরা সত্যিকার মানুষ পর্যন্ত ছিলে না!
রিয়া তীক্ষ্ণ চোখে জিগির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে যে এই জগৎট সত্যি? তুমি সত্যি? তুমি কি বলতে পারবে যে তুমি এই মুহূর্তে অন্য কারো পরাবাস্তব জগতে বসে নেই?
জিগিকে খানিকটা বিভ্রান্ত দেখায়, সে দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, না, তা অবিশ্যি পারব না–কিন্তু
রিয়া মুখে কপট গাম্ভীর্য এনে বলল, কাজেই তুমি বড় বড় কথা বলো না। আমাদের কাছে আমাদের সেই জগৎটাই ছিল বাস্তব। তুমি যেটুকু বাস্তব দেখেছ তার চাইতেও বেশি বাস্তব।
রিয়া একটি গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, সেই জায়গাটা ছিল এরকম। পাহাড়ের পাদদেশে নীল হ্রদ, দীর্ঘ বালুবেলা, বালুবেলার কাছে ঘন অরণ্য। তার সাথে হু–হুঁ করে। উথাল–পাতাল বাতাস। এখানে এলে আমাদের সেই জায়গাটার কথা মনে পড়ে তাই আমরা এখানে আসি।
জিগি হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে বলল, আমি ভাবতেও পারি না। একজন মানুষ তার পরাবাস্তব জগতের স্মৃতি নিয়ে এরকম বাড়াবাড়ি করতে পারে!
ক্রানা বলল, মনে আছে প্রথমবার যখন পরাবাস্তব জগৎ থেকে ত্রাতুল আর রিয়ার মাথায় স্মৃতি ফিরিয়ে নিয়ে আসা হল তখন কী হয়েছিল?
হ্যাঁ! জিগি চোখ বড় বড় করে বলল, স্মৃতি লোড করার আগে দুজন প্রায় অপরিচিত মানুষ। কিন্তু লোড করার পর চোখ খুলেই দুজন দুজনের কাছে ছুটে এসে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে সে কী হাউমাউ করে কান্না!
আমি দুর্বল গলায় আপত্তি করার চেষ্টা করে বললাম, আমার যতদূর মনে আছে কান্নাকাটির অংশটি ছিল রিয়ার।
রিয়া একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ছিলই তো! তা আমি কী করব? জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে আমাকে এমনভাবে তৈরি করেছে যে অল্পতেই আমার চোখে পানি এসে যায়।
জিগি চোখ ঘুরিয়ে বলল, তোমার ভারি মজা রিয়া। কিছু একটা হলেই জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে দোষ দিতে পার। আমাদের বেলায় যাই করি না কেন পুরো দোষটা হয় আমাদের নিজেদের!
জিগির কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে, জিগির চতুর্দশ নম্বর বান্ধবী তার মাথায় একটা হালকা চাটি দিয়ে বলল, নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করো না জিগি। তোমার বেলায় সব দোষ যে আসলেই তোমার সেটা আমার থেকে ভালো করে কেউ জানে না।
এই সাধারণ কথাটি শুনেই আবার সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
.
সূর্য ডুবে যাবার পর আমি আর রিয়া বালুবেলায় হাঁটতে বের হলাম। আকাশে বড় একটা চাঁদ উঠেছে। তার ম্লান আলোতে দূরের পর্বতমালাকে কেমন জানি অপার্থিব দেখায়। সন্ধ্যাবেলার উথাল-পাতাল বাতাসে হ্রদের পানি ছলাৎ ছলাৎ করে তীরে এসে আঘাত করছে। চারপাশে সুনসান নীরবতা, মনে হয় আমরা বুঝি কোনো একটি অতিপ্রাকৃত জগতে চলে এসেছি।
রিয়া আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে যেন আমাকে ছাড়লেই আমি অদৃশ্য হয়ে যাব। এই মেয়েটির সাথে পরিচয় না হলে আমি কখনোই সত্যিকার অর্থে ভালবাসা জিনিসটি কী সেটা বুঝতে পারতাম না। তার ভালবাসার ক্ষমতা এবং সেটা প্রকাশ করার ক্ষমতা দেখে আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই।
মাথার ওপর দিয়ে হঠাৎ করে একটা পাখি শব্দ করে ডেকে ডেকে উড়ে গেল, সেই ডাক শুনে কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যায়। রিয়া একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, মনে আছে ত্রাতুল?
কীসের কথা বলছ?
নুরিগার কথা।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, মনে নেই আবার?
আমি চোখের সামনে সেই দৃশ্যটি দেখতে পাই। পরাবাস্তব জগতে এরকম একটি বালুবেলায় নুরিগা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল। আমরা তখন জেনে গেছি সত্যিকারের পৃথিবীতে দুটি সাইবর্গকে বাঁচাতে গিয়ে সত্যিকারের নুরিগা মারা গেছে, তার এখন পৃথিবীতে ফিরে যাবার কোনো উপায় নেই। পরাবাস্তব একটি জগতে সে চিরদিনের জন্যে আটকা পড়ে থাকবে। গভীর বেদনায় তার ভেতরটা নিশ্চয়ই দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল কিন্তু আমাদের সামনে সেটা প্রকাশ করল না। আমাদের দুজনকে আলিঙ্গন করে সে ফিসফিস করে বলেছিল, বিদায় ত্রাতুল। বিদায় রিয়া। পৃথিবীতে তোমাদের জীবন আনন্দময় হোক।
আমরা কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। নুরিগা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, আমার জন্যে তোমাদের ভালবাসার কথা আমার মনে থাকবে। তোমাদের সাথে দেখা না হলে আমি ভাবতাম সত্যিই বুঝি আমার জীবনের কোনো মূল্য নেই। সত্যিই বুঝি আমি তুচ্ছ। আমি অপরাধী।
রিয়া কোনো কথা না বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। নুরিগা ফিসফিস করে বলেছিল, আমি কখনো ভাবি নি আমার জন্যে কেউ চোখের পানি ফেলবে। তুমি জান রিয়া, আজ আমার কোনো দুঃখ নেই?
তারপর নুরিগা হ্রদের বালুবেলায় বিষণ্ণ পদক্ষেপে হেঁটে হেঁটে চলে গিয়েছিল। আমরা দেখেছিলাম তার দীর্ঘ অবয়ব সন্ধ্যার অন্ধকারে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোথায় আছে এখন সে? কেমন আছে?
আমি রিয়ার দিকে তাকালাম, তার চোখে পানি চিকচিক করছে।