- বইয়ের নামঃ ত্রাতুলের জগৎ
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. ট্রাকিওশানহীন একজন যুবক
দুপুরবেলা এই এলাকাটিতে মানুষ, সাইবর্গ, এন্ড্রয়েড আর রোবটের একটা ছোটখাটো ভিড় জমে যায়। বেশিরভাগ মানুষের চেহারায় ব্যস্ততা আর উদ্বেগের ছাপ থাকে। কারো কারো চেহারায় থাকে ক্লান্তি, অবসাদ, এমনকি হতাশা। ক্বচিৎ এক-দুজনকে তারুণ্য বা ভালবাসার কারণে আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে থাকতে দেখি, তাদের দেখতে আমার বড় ভালো। লাগে–আমি এক ধরনের লোভাতুর দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি। সাইবর্গগুলোর চেহারায় সব সময় এক ধরনের বিভ্রান্তির ছাপ থাকে। তাদের মানুষ অংশটি প্রতিনিয়ত যন্ত্র অংশটির সাথে এক ধরনের অদৃশ্য সংঘাতের মাঝে আটকা পড়ে আছে, সেই সংঘাতের। ছাপটি তাদের চোখে–মুখে ফুটে থাকে। তাদের ভুরু হয় কুঞ্চিত, চোখে থাকে ক্রোধের ছায়া। তাদের পদক্ষেপ হয় দ্রুত এবং অবিন্যস্ত। আমার কাছে সবচেয়ে হাস্যকর মনে হয় এন্ড্রয়েডগুলোকে, তাদের চেহারা মানুষের মতো, সেই কথাটি মনে হয় তারা এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারে না। সব সময়ই তারা মুখে একটা মানবিক অনুভূতির চিহ্ন ফুটিয়ে রাখতে চায়–সেই অনুভূতিটি হয় চড়া সুরে বাধা। যখন ক্লান্তির ছাপ থাকার কথা তখন তাদের মুখে আসে গভীর অবসাদের চিহ্ন, যখন হালকা আনন্দ থাকার কথা তখন তাদের চোখে–মুখে আসে মাদকাসক্ত মানুষের বেপরোয়া উত্তেজনা, যখন বিরক্তির চিহ্ন থাকার কথা তখন তাদের মুখে থাকে দুর্দমনীয় ক্রোধের ছাপ! সেই তুলনায় রোবটগুলোকে দেখে অনেক। বেশি স্বস্তি অনুভব করি। তাদের চেহারা যান্ত্রিক এবং ভাবলেশহীন, তাদের কাজকর্ম বা ভাবভঙ্গিতে কোনো জটিলতা নেই, তাদের আচার-আচরণে কোথায় যেন একটি শিশু বা। পোষা কুকুরের সারল্য রয়েছে। আমি তাদের সাহচর্যকে পছন্দ করি না কিন্তু দূর থেকে দেখে এক ধরনের ছেলেমানুষি কৌতুক অনুভব করি।
আমার মনে হয় আমাকে দেখেও এই রোবট, এন্ড্রয়েড, সাইবর্গ বা মানুষগুলোর কপোট্রনে বা মনে বিচিত্র ভাবনার উদয় হয়। আমি সুউচ্চ সহস্রতল অট্টালিকার দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকি। এই রাস্তায় দুটো ইঁদুর, একটি কবুতর এবং কয়েকটি চড়ুই পাখির সাথে আমার ভাব হয়েছে। দুপুরে খাবার সময় আমি কিছু রুটির টুকরো ছড়িয়ে দিই এবং এই প্রাণীগুলো এক ধরনের আগ্রহ নিয়ে সেগুলো খায়। তাদের একেবারে সোজাসাপ্টা কাড়াকাড়ি করে খাওয়া দেখতে আমার এক ধরনের আনন্দ হয়। প্রাণীগুলো আজকাল আমাকে ভয় পায় না, আমার আস্তিনের নিচে নির্বিবাদে লুকিয়ে থাকে কিংবা আমার কাঁধে বসে কিচিরমিচির করে ডাকাডাকি করে। এই এলাকার রোবটগুলো ভাবলেশহীন মুখে আমাকে লক্ষ করে, কিন্তু তাদের সবুজ ফাটাসেলের চোখে আলোর তারতম্য দেখে আমি বুঝতে পারি তাদের কপোট্রনে খানিকটা হলেও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় এবং তারা নিজেদের ভেতরে কোনো একটা হিসাব মেলাতে পারে না। একজন অল্পবয়সী মানুষের সুউচ্চ অট্টালিকার দেওয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে থাকার কথা নয়, তার শরীরের ওপর দিয়ে পশুপাখির ছোটাছুটি করার কথা নয়। রোবটগুলো কখনোই আমাকে বিরক্ত করে নি কিন্তু সাইবর্গ এবং এন্ড্রয়েডগুলো মাঝে মাঝেই থমকে দাঁড়িয়ে কৌতূহল প্রকাশ করেছে, কখনো কখনো অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য কিংবা ক্রোধ প্রকাশ করেছে। আমাকে দেখে মানুষেরা অবিশ্যি সব সময়ই সহজাত সৌজন্যের কারণে নিজেদের অনুভূতি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেটি কখনো গোপন থাকে নি। আমি বুঝতে পারি তারা আমার জন্যে এক ধরনের কণা এবং অনুকম্পা অনুভব করছে। প্রাচীনকালে মানুষ মানসিক রোগাক্রান্ত হয়ে জীবনবিমুখ হয়ে যেত–গত কয়েক শতাব্দীতে তার কোনো উদাহরণ নেই। এখন যারা সমাজের প্রচলিত নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাস্তার পাশে পা ছড়িয়ে বসে পাখির সাথে কিংবা ইঁদুরের সাথে বসবাস করে তারা পুরোপুরি নিজের ইচ্ছেতেই করে। এটি এক ধরনের বিদ্রোহ, যে বিদ্রোহের কারণ জানা নেই। মানুষ সেই বিদ্রোহকে ভয় পায়, সেই বিদ্রোহীর জন্যে করুণা অনুভব করে।
আমি মানুষের করুণামিশ্রিত অনুকম্পার দৃষ্টি দেখে কিছু মনে করি না। কারণ আমি জানি আমি আমার চারপাশের এই অসংখ্য মানুষ, সাইবর্গ, এন্ড্রয়েড বা রোবট থেকে অনেক ভালো জীবন পেতে পারতাম, কিন্তু সেই জীবনে আমার কোনো আকর্ষণ নেই। আমি দেখেছি সেই জীবন প্রকৃতপক্ষে অর্থহীন– প্রতিটি মানুষের জীবন এত সুনির্দিষ্ট, এত গতানুগতিক যে সেটি একটি সাজানো নাটকের মতো। আমি সেই সাজানো রঙ্গমঞ্চের অভিনেতা হতে চাই নি। তাই একদিন শহরের কমিউনিটি কেন্দ্রে গিয়ে অভ্যর্থনা ডেস্কের মেয়েটিকে বলেছিলাম, আমি আমার ট্রাকিওশানটি ফিরিয়ে দিতে চাই।
মেয়েটি আমার কথা বুঝতে পারল বলে মনে হল না, খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, ট্রাকিওশান! ফিরিয়ে দেবে?
মেয়েটির মুখ দেখে আমি এক ধরনের কৌতুক অনুভব করলাম, মনে হল আমার কথা শুনে সে আকাশ থেকে পড়েছে। আমি মুখে হাসি টেনে এনে বললাম, তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি মনে করছ ট্রাকিওশান নয়, আমি বুঝি আমার মস্তিষ্ক ফিরিয়ে দিতে এসেছি।