গ্রহকণাটি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। কী বিচিত্র এই গ্রহকণাটি! একটি গ্রহকণার আকার যদি কুৎসিত হওয়া সম্ভব হতো, তাহলে নিশ্চিতভাবে এটাকে কুৎসিত বলা যেতো। শুধু কুৎসিত নয়, অশুভ এবং বিপজ্জনক।
রায়ীনাকে তার ইলন শাটলের বেগ কমাতে কমাতে গ্রহকণাটির দিকে এগিয়ে যেতে হবে। ঠিক যখন গ্ৰহকণাটির পাশে পৌঁছাবে, তখন গ্রহকণাটির তুলনায় তাকে স্থির হয়ে যেতে হবে। কোয়াকম্প তার অনেকখানিই করে ফেলতে পারবে, কিন্তু শেষ কাজটি তার নিজের হাতে করতে হবে।
দেখতে দেখতে সে গ্রহকণাটির কাছাকাছি চলে এলো। ইলন শাটলটির থেকে দূরত্ব এখন পাঁচ শ’ মিটার থেকে কম। এখান থেকে জানালা দিয়ে খালি চোখেই রায়ীনা দেখতে পেল গ্রহকণাটি ঘুরপাক খাচ্ছে। দেখে মনে হয়, সেটি বুঝি মহাকাশে স্থির হয়ে আছে। আসলে সেটি স্থির নয়, সেটি অচিন্ত্যনীয় বেগে পৃথিবীর দিকে ছুটে যাচ্ছে। সে যদি গ্রহকণাটিকে ধ্বংস করতে না পারে, তাহলে এই গ্রহকণাটি পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলবে।
রায়ীনা কোয়াকম্পকে গ্রহকণাটির বিচিত্রভাবে ঘুরপাক খেতে থাকার গতিটি বিশ্লেষণ করতে দিয়ে ধীরে ধীরে ইলন শাটলটিকে সেটির কাছাকাছি নিতে থাকে। একশ মিটারের কাছাকাছি এসে সে থেমে গেল। কোয়াকম্প গতিপথটি বিশ্লেষণ করে মনিটরে দেখাচ্ছে এবং সেদিকে তাকিয়ে রায়ীনা চমকে উঠল। একটা গ্রহকণার গতিপথ এরকম হতে পারে না। গ্রহকণার সেন্টার অফ এ্যাভেটি ইলন শাটলের তুলনায় স্থির থাকতে হবে। কিন্তু এটি স্থির নয়, এটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নড়ছে। এটি কোনোভাবেই হওয়া সম্ভব নয়।
রায়ীনা ভুরু কুঁচকে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে রইল। নিজের চোখকে সে কীভাবে অবিশ্বাস করবে? কোয়াকম্পের বিশ্লেষণ যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এই গ্রহকণার ওপর নামা প্রায় অসম্ভব। শেষ মুহূর্তে গ্রহকণাটির একটা অংশ ঘুরপাক খেতে খেতে ইলন শাটলকে আঘাত করে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলতে পারে। থার্মো নিউক্লিয়ার বোমাটি বিস্ফোরিত না হয়ে উড়ে যাবে!
রায়ীনা আবার মনিটরটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মনিটরটির বিশ্লেষণ যদি ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে এই গ্রহকণাটি একটি নিরীহ গ্রহকণা নয়। হয়তো এর ভেতরে অবরুদ্ধ গ্যাস আছে। সেই গ্যাস হয়তো এর ফাঁক ফোকর দিয়ে বের হয়ে এসে গ্রহকণাটাকে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে। কিংবা এটি–
রায়ীনা তার মাথা থেকে চিন্তাটাকে সরিয়ে দিল। এরকম নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে একটা গ্রহকণা যদি ঘুরপাক খেতে থাকে, তাহলে এটি যা হতে পারে সেটি হওয়া সম্ভব নয়। কিছুতেই সম্ভব নয়। সেই সম্ভাবনার কথা রায়ীনা তার মাথায় আনতে চায় না। রায়ীনা এখন কোয়াকম্পের ওপর নির্ভর না করে পুরোপুরি নিজের নিয়ন্ত্রণে ইলন শাটলকে গ্রহকণাটির ওপর নামিয়ে আনবে। তারপর ইলন শাটলে রাখা নিউক্লিয়ার বোমার বিস্ফোরণে গ্রহকণাটিকে ভস্মীভূত করে দেবে।
ইলন শাটলকে নামানোর জন্যে রায়ীনা গ্রহকণার ওপর একটা জায়গা বেছে নেয়। জায়গাটি মসৃণ নয়। খানিকটা এবড়োথেবড়ো, কিন্তু আশেপাশে বড় কোনো উঁচুনিচু জায়গা নেই। রায়ীনা খুব সাবধানে ইলন শাটলকে নামাতে থাকে। গ্রহকণাটি যখন হঠাৎ ঘুরে যায় কিংবা নড়ে যায়, রায়ীনাও তখন ইলন শাটলকে ঘুরিয়ে নেয়, নড়িয়ে নেয়। উঁচু হয়ে বের হয়ে থাকা কোনো অংশ হঠাৎ করে ঘুরে ইলন শাটলের দিকে ছুটে এলে রায়ীনাকেও দ্রুত সরে যেতে হয়। এর আগে ইলন শাটলকে কেউ এইভাবে ব্যবহার করেনি, করার প্রয়োজন হয়নি।
রায়ীনা এক সময়ে তার ইলন শাটলের শক্তিশালী ইঞ্জিনের ধোঁয়া দেখতে পায়। ইঞ্জিনের উত্তপ্ত গ্যাস গ্রহকণায় আঘাত করে ধুলোবালি উড়িয়ে নিতে শুরু করেছে। হঠাৎ গ্রহকণাটি জীবন্ত প্রাণীর মতো নড়ে ওঠে। উঁচু হয়ে থাকা একটা অংশের আঘাতে গুঁড়িয়ে যাবার আগেই রায়ীনা প্রচণ্ড গতিতে নিচে নেমে গ্রহকণাটির ওপর আক্ষরিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল। রায়ীনা একটা প্রচণ্ড সংঘর্ষ অনুভব করে, পুরো শাটলটি কেঁপে ওঠে, যন্ত্রপাতি ভেঙেচুরে যায়। ইলন শাটলের ভেতর বিপদ সংকেতের তীব্র এলার্ম বাজতে থাকে।
প্রচণ্ড সংঘর্ষে রায়ীনা সিট ভেঙে বের হয়ে নিচে ছিটকে পড়েছিল। সে উঠে দাঁড়ালো, তারপর ভাসতে ভাসতে জানালার পাশে দাঁড়াল। সে গ্রহকণাটির ওপর নামতে পেরেছে। সংঘর্ষে ইলন শাটলের কতোটুকু ক্ষতি হয়েছে, সে জানে না। সেটি নিয়ে তার মাথা ঘামাতে হবে না। তার আগে। ইলন শাটলটিকে এই গ্রহকণার সাথে যুক্ত করে নিতে হবে। রায়ীনা কাঁপা হাতে একটা সুইচ স্পর্শ করে। সাথে সাথে যেন এক ধরনের গুঞ্জন শুনতে পায়। ইলন শাটলের নিচ থেকে অতিকায় স্কু বের হয়ে গ্রহকণার মাঝে গেঁথে যেতে শুরু করেছে। এখন শুধু তার নিউক্লিয়ার বোমাটিকে বিস্ফোরণের জন্যে চালু করে দিতে হবে।
রায়ীনা মেঝেতে ধাক্কা দিয়ে ভেসে ভেসে ইলন শাটলের পিছনে যায়। সুইচ টিপে পিছনের গোল দরজাটি খুলতেই থামো নিউক্লিয়ার বোমাটি চোখে পড়ল। একশ কিলোটনের একটি বোমার আকার এতো ছোট হতে পারে, নিজের চোখে দেখেও রায়ীনার বিশ্বাস হয় না।
রায়ীনা বোমাটার পিছনে সুইচ প্যানেল খুলে সেখানে বোতামটি স্পর্শ করে। সাথে সাথে একটা নীল আলো ঝলসে ওঠে। ছোট চতুষ্কোণ একটা জায়গায় রায়ীনা তার চোখ রাখল। সেখানে তার রেটিনা স্ক্যান করা হলো এবং সাথে সাথে স্ক্রীনে একটা ছোট কী বোর্ড স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রায়ীনা কাঁপা হাতে ষোলটি সংখ্যা প্রবেশ করানোর সাথে সাথে কর্কশ স্বরে এলার্ম বাজতে থাকে। মনিটরে একটা লেখা ভেসে ওঠে, “এই বোমাটি বিস্ফোরণের জন্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। দশ মিনিটের ভেতর এটি বিস্ফোরিত হবে।”