- বইয়ের নামঃ তিতুনি এবং তিতুনি
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. তিতুনির খুব মন খারাপ
তিতুনি এবং তিতুনি – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৬
.
উৎসর্গ
মেহেদী হাসান খান আমার মা যাকে জন্ম দেননি। তারপরও যে আমাদের থেকেও তার বেশি খাঁটি একজন সন্তান।
.
০১.
তিতুনির খুব মন খারাপ। তিতুনির যখন মন খারাপ হয় তখন সে তাদের বাসার ছাদে উঠে রেলিংয়ের উপর মুখ রেখে গালে হাত দিয়ে দূরে তাকিয়ে থাকে। তাদের বাসার পিছনে অনেক বড় বড় গাছ, সেই গাছের ফাঁক দিয়ে তাকালে দূরে ধান ক্ষেত চোখে পড়ে। আরো দূরে তাকালে কিন্নরী নদীটার পানিকে চিকচিক করতে দেখা যায়। একটু উপরে তাকালে দেখা যায় নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ। আরো ভালো করে তাকালে দেখা যায় মেঘের ভেতর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি বের হয়ে উড়ে উড়ে যাচ্ছে।
দূরে তাকিয়ে থেকে তিতুনি বাতাসে গাছের পাতার শব্দ শুনে, তখন খুব ধীরে ধীরে তার মনটা একটু শান্ত হয়। মনটা শান্ত হলেও তার ছোট বুকটা ভার হয়ে থাকে, মনে হয় সে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে একদিন দূরে কোথাও চলে যাবে। সেখানে আব্বু আর আম্মু তাকে খুঁজে পাবে না, তার ভাই টোটনও তাকে আর জ্বালাতন করতে পারবে না।
তিতুনির বয়স বারো, তার বড় ভাই টোটনের বয়স চৌদ্দ। তিতুনির মনে হয় টোটনের জন্মের পর নিশ্চয়ই তার মুখে কেউ মধু দেয়নি, কিংবা কে জানে হয়তো মধু মনে করে ভিনেগার ঢেলে দিয়েছিল। তাই টোটন সব সময় চ্যাটাং চ্যাটাং করে কথা বলে। তিতুনির সাথে কথা বলার সময় শুধু যে চ্যাটাং চ্যাটাং করে কথা বলে তা নয়, একটানা তিতুনিকে টিটকারি করতে থাকে। কোনো কারণ থাকুক আর না-ই থাকুক সারাক্ষণ তিতুনিকে বকাবকি করতে থাকে। কিছু একটা হলেই আব্বু-আম্মুর কাছে নালিশ করে দেয়। সব সময় একটা ছুতো খুঁজতে থাকে কীভাবে তিতুনিকে বিপদে ফেলবে। আব্বু আর আম্মু মনে হয় বিষয়গুলো দেখেও দেখেন না, টোটন তাদের বড় ছেলে বলে তার জন্যে তাদের আদর অনেক বেশি। কিছু একটা হলেই তারা সব সময় টোটনের পক্ষে কথা বলতে থাকেন।
যেমন আজ সকালের কথাটাই ধরা যাক। নাশতার টেবিলে বসে তিতুনি আর টোটন আব্বু আর আম্মুর সাথে বসে নাশতা করছে। নাশতা শেষ করে তিতুনি যখন হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাসটা নেবে ঠিক তখন টোটন দিল তাকে একটা ধাক্কা সেই ধাক্কায় হাতে লেগে গ্লাসটা উল্টে পড়ে সারা টেবিলে পানি থই থই করতে লাগল। গ্লাসটাও গড়িয়ে টেবিল থেকে পড়ে যাচ্ছিল, তিতুনি খপ করে গ্লাসটাকে ধরে ফেলতে চেষ্টা করল, গ্লাসটা তখন কেমন জানি হাত থেকে পিছলে বের হয়ে মেঝেতে পড়ে একশ’ টুকরো হয়ে গেল। ভাঙা কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে গেল সারা ঘরে।
আব্বু একটা ছোট চিৎকার করলেন, আম্মু অনেকটা আর্তনাদের মতো শব্দ করলেন আর টোটন এত জোরে চিৎকার করে উঠল যে মনে হলো যে তিতুনি বুঝি ভুল করে ঘরের মাঝে একটা এটম বোমা ছুঁড়ে দিয়েছে।
আম্মু বললে, “কী করলি এটা?”
তিতুনি বলল, “হাতে লেগে পড়ে গেল।”
আম্মু বললেন, “হাতে লেগে পড়ে গেল মানে? নিজের হাতের উপর কন্ট্রোল নাই?”
তিতুনি তখন আসল ঘটনাটা বলার চেষ্টা করল, “পানির গ্লাসটা ধরার চেষ্টা করছিলাম ঠিক তখন ভাইয়া–”
আম্মু ভুরু কুঁচকে বললেন, “ভাইয়া?”
“ভাইয়া একটা ধাক্কা দিল।”
টোটন তখন প্রায় লাফিয়ে উঠে হাত-পা নেড়ে গলা উঁচিয়ে বলল, “আমি? আমি ধাক্কা দিয়েছি? আম্মু দেখেছ কত বড় মিথ্যুক। নিজে গ্লাসটা ভেঙে এখন আমাকে দোষ দেয়। কত বড় মিথ্যুক! কত বড় পাজি দেখেছ আম্মু? তোমরা এই পাজিটাকে কিছু বলো না দেখেই এত সাহস হয়েছে। শুধু মিথ্যা কথা বলে।”
আম্মু বললেন, “ছিঃ তিতুনি। ছিঃ!”
আব্বু বললেন, “মিথ্যা কথা বলে না তিতুনি।”
তিতুনি বলল, “আমি মিথ্যা কথা বলি নাই। ভাইয়া ইচ্ছা করে আমাকে ধাক্কা দিয়েছে।”
টোটন তখন আরো জোরে চিৎকার করে বলল, “দেখেছ আম্মু আব্বু? কত বড় পাজি দেখেছ? কত বড় শয়তান দেখেছ? নিজে জবুথবু-হাত-পায়ের উপর কন্ট্রোল নাই। এত বড় দামড়া হয়েছে এখনো কিছু করতে পারে না। এক গ্লাস পানি খেতে গিয়ে টেবিলটা পানি দিয়ে ভাসায়। গ্লাসটা ভেঙে ফেলে-এই তিতুনিরে তোমরা যদি কন্ট্রোল না করে পুরো বাসার সবকিছু ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিবে। এই মিথ্যুককে, পাজি, বদমাইশ মেয়েটাকে তোমরা কিছু বলল না কেন?”
টোটনের কথায় তিতুনের চোখে প্রায় পানি এসে গিয়েছিল। কোনোমতে চোখের পানি আটকে রেখে ভাঙা গলায় বলল, “আমি মিথ্যুক না। তুমি মিথ্যুক।”
টোটন এবারে রাগে ফেটে পড়ল, তিতুনিকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “চুপ কর বদমাইশ মেয়ে। কত বড় পাজি। এক্ষুনি চুপ কর।”
তিতুনি বলল, “তুমি চুপ করো।”
টোটন তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে তিতুনিকে আরেকটা ধাক্কা দিল। আব্বু বললেন, “অনেক হয়েছে। এখন থামো।”
আম্মু বললেন, “তিতুনি! এসব কী হচ্ছে?”
তিতুনির চোখে পানি এসে গেল। বলল, “আমি কী করেছি? ভাইয়াই তো আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে–”
টোটন বলল, “মোটেই ধাক্কা দেই নাই। খালি, একটু ছুঁয়েছি। তুই এত পাজি, তোকে পিটিয়ে লম্বা করে দেয়া উচিত। বড় ভাইয়ের সাথে মিথ্যা কথা বলিস! মিথ্যুক।”