ক্লারা ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, “বস ত্রাতিনা।”
ত্রাতিনা ক্লারার সামনে চেয়ারটিতে বসল। ডিরেক্টর ক্লারা বলল, “তোমার জন্যে আমার খুব অহংকার হচ্ছে ত্রাতিনা। কেন্দ্রীয় মহাকাশ ইনস্টিটিউট এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ইনস্টিটিউট। এখানে পড়তে সুযোগ পাওয়া খুব ভাগ্যের কথা।”
ত্রাতিনা কিছু না বলে হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়ল।
ক্লারা বলল, “তুমি অবশ্য ভাগ্যের জোরে এই সুযোগ পাওনি। তুমি সুযোগ পেয়েছ নিজের যোগ্যতায়।”
ত্রাতিনা বলল, “তুমি আমাদের লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়েছ, আমাদের উৎসাহ দিয়েছ, আমরা সবাই তাই তোমার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ।”
“ধন্যবাদ ত্রাতিনা। আমি আমার দায়িত্বটুকু শুধু পালন করেছি। তার বেশি কিছু করিনি।” ক্লারা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, “তুমি ইনস্টিটিউটে কী নিয়ে পড়াশোনা করবে ঠিক করেছ?”
ত্রাতিনা একটু লাজুক মুখে বলল, “আমি মহাকাশচারী হতে চাই। মহাকাশযানে করে মহাকাশে অভিযান করার আমার খুব ইচ্ছা।”
ক্লারা এক মুহূর্ত ত্রাতিনার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, “কী আশ্চর্য!”
ত্রাতিনা একটু অবাক হয়ে বলল, “আশ্চর্য! কেন এটি তোমার কাছে আশ্চর্য মনে হচ্ছে? আমি কী মহাকাশচারী হতে পারি না?”
ক্লারা বলল, “অবশ্যই হতে পার। তুমি যেটা চাইবে, সেটাই হতে পারবে। আমি সেজন্যে আশ্চর্য হইনি। আমি আশ্চর্য হয়েছি অন্য কারণে।”
ত্রাতিনা জিজ্ঞেস করল, “কী কারণে?”।
ক্লারা তার চেয়ার থেকে উঠে ত্রাতিনার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, একটু নিচু হয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল, “বাইরে এই অনাথ আশ্রমের ভাই বোনেরা তোমাকে বিদায় দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমি তার মাঝে তোমাকে বলেছি আমার সাথে দেখা করে যাওয়ার জন্যে। সেটি শুধু আনুষ্ঠানিক বিদায় দেওয়ার জন্যে নয়। তার একটি কারণ আছে ত্রাতিনা।”
”কী কারণ?”
“আমি তোমাকে একটি জিনিস দিতে চাই।”
“কী জিনিস?”
“তোমার মা যেদিন তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল, সেদিন আমাকে একটা ছোট ক্রিস্টাল দিয়ে বলেছিল, তুমি যখন বড় হবে তখন আমি যেন সেটা তোমার হাতে দিই।”
ত্রাতিনা ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, বলল, “মা? আমার মা? তুমি আমার মাকে দেখেছ?”
“হ্যাঁ, দেখেছি।”
“তুমি কখনো সেটি আমাকে বলনি–”
“না, বলিনি। আমার বলার কথা না সেজন্য বলিনি। আমি অপেক্ষা করছিলাম, কখন তুমি বড় হবে-এখন বড় হয়েছ, তাই তোমাকে বলছি।”
“আমার মা দেখতে কেমন ছিল? কী করতো আমার মা? আমাকে নিজের কাছে না রেখে কেন অনাথ আশ্রমে রেখে গেল?”
ক্লারা দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করল। বলল, “আমার মনে হয় তুমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর এই ক্রিস্টালটিতে পেয়ে যাবে। তুমি এক সেকেন্ড অপেক্ষা কর।”
ডিরেক্টর ক্লারা উঠে গেল। দেওয়ালে লাগানো সেফটি ভল্টে রেটিনা স্ক্যান করিয়ে খুলে নেয়। তারপর ওপরের তাক থেকে ভেলভেটে মোড়ানো ছোট একটা ধাতব বাক্স নিয়ে আসে। সেটি ত্রাতিনার হাতে তুলে দিয়ে বলল, “এই নাও। এর ভেতরে আমি ষোল বছর ধরে তোমার ক্রিস্টালটি বাঁচিয়ে রাখছি। আজকে আমার দায়িত্ব শেষ হল।”
ত্রাতিনা বাক্সটি প্রথমে কিছুক্ষণ নিজের বুকে চেপে ধরে রাখে। তারপর খুব সাবধানে সেটি খোলে, বাক্সের মাঝখানে নিও পলিমারের ফ্রেমে ছোট একটা ক্রিস্টাল চকচক করছে। এই ক্রিস্টালটি ত্রাতিনার মা ত্রাতিনার জন্যে তৈরি করে রেখেছে। ঠিক কী কারণ জানা নেই, হঠাৎ করে ত্রাতিনার চোখ ঝাঁপসা হয়ে এলো।
ডিরেক্টর ক্লারা ত্রাতিনার পাশে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল, “তুমি যখন বলেছ যে তুমি মহাকাশ ইনস্টিটিউটে মহাকাশচারী হবে, তখন আমি বলেছিলাম কী আশ্চর্য! কেন বলেছিলাম, জান?”
“কেন?”
“তার কারণ, তোমার মাও ছিলেন একজন মহাকাশচারী। মহাকাশচারী রায়ীনা। তোমার মা যেদিন তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল, সেদিন খুব জরুরি একটা কাজে তাকে চলে যেতে হয়েছিল। কী কাজ, সেটি আমি জানি না। আর কোনোদিন ফিরে আসেনি, তোমার মা নিশ্চয়ই জানতো আর ফিরে আসবে না।”
ত্রাতিনা ফিসফিস করে বলল, “মা। আমার মা।”
ডিরেক্টর ক্লারা ত্রাতিনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ত্রাতিনা সোনা তোমার যাবার সময় হয়েছে। বাইরে সবাই তোমাকে বিদায় দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে।”
ত্রাতিনা তার ব্যাগটি খুলে সেখানে ভেলভেট দিয়ে মোড়ানো ধাতব বাক্সটি রেখে উঠে দাঁড়াল। ক্লারা ত্রাতিনাকে আলিঙ্গন করে বলল, “যাও মা। প্রার্থনা করি তোমার অপূর্ব একটি জীবন হোক।”
ত্রাতিনা চোখ মুছে বলল, “আমার মায়ের কথা মনে নেই। মায়েরা কেমন করে সন্তানকে ভালোবাসে, সেটি আমি জানি না। কিন্তু তুমি আমাদের সবাইকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবেসেছ। আমরা সবাই তোমার কাছ থেকে সেই ভালোবাসাটা পেয়েছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ক্লারা।”
ত্রাতিনা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ডিরেক্টর ক্লারা হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। গেটের সামনে একটা বাইভার্বাল দাঁড়িয়ে আছে। সেটি ঘিরে অনাথ আশ্রমের সব ছেলেমেয়ে নিঃশব্দে ত্রাতিনাকে বিদায় দেওয়ার জন্যে অপেক্ষা করছে।
.
পাতাল ট্রেনটি ম্যাগনেটিক লেভিটেশন ব্যবহার করে ঘণ্টায় দুই হাজার ত্রাতিনা কিলোমিটার বেগে ছুটে যাচ্ছে। যদিও ট্রেনের ভেতরে বসে থেকে সেটি বোঝার কোনো উপায় নেই। ত্রাতিনা তার সিটে হেলান দিয়ে নিঃশব্দে বসে আছে। ইনস্টিটিউট থেকে তাকে ট্রেনের টিকিট পাঠিয়েছে ছোট একটা ঘরে সামনাসামনি দু’টি সিট। সামনের সিটে একজন বয়সী মহিলা কানে হেড ফোন লাগিয়ে বসে কিনিস্কির নবম সিম্ফোনি শুনছে। সিম্ফোনির তালে তালে খুব ধীরে ধীরে তার মাথা নড়ছে। এ ছাড়া বোঝার আর কোনো উপায় নেই। ট্রেনের ছোট কামরাটি পুরোপুরি নিঃশব্দ।