“রজনীকান্ত আবার সম্পর্কে কুমারের মেসোমশাই। তিনিই তাকে পালন করেন। পোয্য নেন। মাসিমা-মেসোমশাই-ই তার মা-বাবা।”
“রজনীকান্ত তাহলে ছোট ভাই?”
“হ্যাঁ। বড়র নাম কৃষ্ণকান্ত। দু’ভাই কৃষ্ণকান্ত আর রজনীকান্ত। রাজবাড়ি, জমিদারি, স্থাবর সব সম্পত্তির মালিক আইনত দুই ভাইয়ের সমান সমান। কিন্তু ছোট ভাই রজনীকান্ত হঠাৎ মারা যাওয়ার পর, বড় ভাই নিজেই সব অধিকার করে নেওয়ার মতলব আঁটতে শুরু করেন।”
তারাপদ বলল হঠাৎ, “পারিবারিক ঝামেলা। এসব তো ওল্ড কেস। বড় ভাই ছোট ভাইকে পথে বসাবার ধান্দা করতে শুরু করে দেয়!”
লাটু মাথা হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ।
কিকিরা বললেন, “কৃষ্ণকান্ত মানুষটি তবে সুবিধের নয় বলছ? সম্পত্তি হাতাবার এইসব কাণ্ডকারখানা পুরনো আমল থেকে চলছে, এখনও চলে। মানুষের লোভ সহজে মেটে না। তার ওপর এখানে দেখছি ছোট ভাই নেই, ভাইয়ের স্ত্রী নেই। রয়েছে তাদের পোষ্যপুত্র। …তা কৃষ্ণকান্ত থাকেন কোথায়? বয়েস কত?”
“কুমারের কথায়, তার জেঠার বয়েস পঁয়ষট্টির মতন। থাকেন দেশে। নুরপুরে। নিজেদের ভিটেয়, রাজবাড়িতে।”
“ভাল। তোমার বন্ধু থাকে কলকাতায়, তার জেঠা নুরপুরে। একজন এখানে, অন্যজন দূরে। খুনের আসামি করা হচ্ছে কেমন করে? কে করছে?”
“জেঠা।”
“জেঠা? কীভাবে?”
লাটু আবার রুমাল বার করে মুখ মুছে নিল। ঘরে পাখা চলছিল। সামান্য শব্দ হচ্ছিল।
বগলা চা নিয়ে এল। চায়ের সঙ্গে বাড়িতে ভাজা পকৌড়া।
কোনও কাজে তেমন খুঁত রাখে না বগলা। কাঠের ট্রে থেকে পকৌড়ার প্লেট, চায়ের কাপ তুলে একে একে এগিয়ে দিল সকলকে।
কিকিরা ঘরের বাতি জ্বেলে দিতে বললেন।
বাতি জ্বেলে দিয়ে বগলা চলে গেল।
কিকিরা সহজভাবে লাটুকে বললেন, “নাও, চা খাও। অত ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন? ব্যাপারটা শুনি আগে সব। তোমার বন্ধু কি পুলিশের খপ্পরে পড়েছে?”
লাটু মাথা নাড়ল। “না। এখনও পড়েনি।”
“তবে বলছ খুনের আসামি?”
“অ্যাটেম্পট টু মার্ডার কেসে ফাঁসাবার চেষ্টা হচ্ছে।”
“ও! অ্যাটেম্পট টু মার্ডার! সেটাও জব্বর কেস। জামিন পাওয়া বেশ কঠিন শুনেছি।” বলতে বলতে চায়ে চুমুক দিলেন কিকিরা।
চন্দন ধাঁধায় পড়ে বলল, “কেউ খুন হয়নি তো?”
“না।”
যেন নিশ্চিন্ত হয়ে নিশ্বাস ফেলল চন্দন।
কিকিরা লাটুকে বললেন, “একটু গুছিয়ে বলো তো ঘটনাটা। এলোমেলো কথা থেকে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। ধরতে পারছি না ব্যাপারটা।”
লাটু কয়েক ঢোক চা খেয়ে নিল। তারপর বলল, “ঘটনাটা দিন আট-দশ আগেকার। কৃষ্ণকান্ত নুরপুর থেকে কলকাতায় এসেছেন। নুরপুর রাজবাড়ির একটা ভাড়া করা আস্তানা আছে কলকাতায়। অনেকদিন ধরেই। ব্যবসাপত্রের কাজকর্মের জন্যে কর্মচারীদের থাকতে হয়। কৃষ্ণকান্তও আসেন। দু-একজন কাজকর্মের লোক বরাবরই থাকে।”
“বাড়িটা কোথায়?”
“বি. কে. পাল অ্যাভিনিউতে।”
“আচ্ছা! তারপর? কী ঘটেছিল ব্যাপারটা?”
“কৃষ্ণকান্ত কিছুদিন আগে কলকাতায় এসেছেন। বছরে এক-আধবার তিনি আসেন। কাজকর্ম থাকে। এবার আসার পর তিনি লোক মারফত খবর পাঠান কুমারকে। দেখা করতে বলেন।”
“কেন?” কিকিরা জিজ্ঞেস করলেন।
চন্দনরা চা-পকৌড়া খেতে খেতে মন দিয়ে লাটুর কথা শুনছিল।
লাটু বলল, “জেঠার সঙ্গে কুমারের যোগাযোগ একেবারে নেই তা নয়। তবে সেটা চিঠিপত্রে। তবে সবই দু’তরফের ঝগড়াঝাটি নিয়ে। মানে সম্পত্তির দাবি পাওনাগণ্ডা নিয়ে।” একটু থামল লাটু। আবার দু’ ঢোক চা খেল। বলল, “অনেকদিন ধরে গণ্ডগোলটা চলছে, মেটবার আশা নেই, আইন-আদালত করেও কিছু করা যাবে না দেখে, মানে কুমারের পক্ষে তার জেঠার সঙ্গে যুঝে ওঠা সম্ভব নয় ভেবে শেষ পর্যন্ত কুমার একটা মামুলি মিটমাট চাইছিল।”
“কীরকম মিটমাট?” কিকিরা বললেন।
“কুমার কিছু টাকা চেয়েছিল। নগদ।”
“কত টাকা?”
“প্রথমে লাখ বিশেক টাকা চেয়েছিল। কৃষ্ণকান্ত সটান না করে দিয়েছিলেন।…বিশ লাখ থেকে নেমে নেমে দশে দাঁড়াল। তাতেও কৃষ্ণকান্ত অরাজি। শেষে পাঁচ।”
“পাঁচ লাখ টাকা দাবি ছিল?”
“হ্যাঁ।” লাটু মাথা হেলিয়ে বলল, “কৃষ্ণকান্ত নিমরাজি হন। চিঠিতে জানান, ভেবে দেখছেন।”
“তারপর?”
“তারপর কলকাতা আসার আগে কৃষ্ণকান্ত একটা চিঠি লিখে জানান, তিনি শিগগির বিশেষ কাজে কলকাতা যাচ্ছেন। কলকাতায় এসে তিনি কুমারকে খবর পাঠাবেন। দেখা হলে সামনাসামনি কথা হবে। তবে লাখ দুই-আড়াই টাকা তিনি আপাতত দিতে পারেন। কয়েকটা কাগজপত্রের কাজ শেষ হলে পরে সে বাকি টাকা পাবে।”
“কী ধরনের কাগজপত্র?”
“জানি না। কুমারও জানে না। সে সুযোগ তার হয়নি।”
“কেন?”
খানিকটা উৎকণ্ঠার গলায় লাটু বলল, “কুমার তার জেঠার কথা মতন নির্দিষ্ট দিনে কৃষ্ণকান্তর সঙ্গে দেখা করতে যায়। ওখানকার লোক চেনে কুমারকে। কৃষ্ণকান্ত বলেও রেখেছিলেন তাঁর কর্মচারীদের। কুমার যাওয়ামাত্র তারা ভেতরের ঘরে তাকে পাঠিয়ে দেয়।”
“মানে কৃষ্ণকান্ত যেখানে ছিলেন?”
“হ্যাঁ।”
“কী হল তারপর?”
“কুমার ঘরে গিয়ে দেখে, জানলার কাছে একটা সেকেলে বিশাল আর্ম চেয়ারে কৃষ্ণকান্ত শুয়ে রয়েছেন। তাঁর সামনে একটা গোল টেবিল। পাথরের টপ। টেবিলের ওপর একটা ব্রিফকেস। পাশেই জলের গ্লাস, পানের ডিবে, জরদার কৌটো।”
“কৃষ্ণকান্ত পান খেতেন?”
“ওই নেশাটা ভালমতনই ছিল তাঁর। কুমার তাই বলে।”