“তুমি?”
“দেখতেই পাচ্ছেন!” বলে একবার আড়চোখে তারাপদদের দেখল! সামান্য দ্বিধা নিয়ে বলল, “আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল। প্রাইভেট৷”
কিকিরা লাটুকে দেখলেন ভাল করে। “কেমন প্রাইভেট? একেবারে বেশি প্রাইভেট হলে পাশের ঘরে চলো। আর যদি অন্যরকম কিছু হয় তুমি এদের সামনেই বলতে পারো। ওরা–মানে ওই তারাপদ আর চন্দন আমার রাইট লেফট, মানে ডান হাত বাঁ হাত।”
লাটু যেন কী ভাবছিল। কিকিরার ডান-বাঁয়ের সঙ্গে তার চাক্ষুষ পরিচয় না থাকলেও এদের কথা সে শুনেছে।
কিকিরার খেয়াল হল, লাটুর সঙ্গে তারাপদদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “লাটুকে তোমরা আগে দেখোনি না? লাটুর ভাল নাম, লোকেন। আমরা সবাই ওকে লাটু বলেই ডাকি। লাটু দত্ত। ডাকনামটাই ওর চলে গিয়েছে।” বলে একটু হাসলেন, “লোকেন বললে বাড়ির লোকও ধোঁকা খেয়ে যাবে, বুঝতে পারবে না। লাটুরা হল জুয়েলার্স; তিনপুরুষের বিজনেস।”
লাটু অন্যমনস্ক। তারাপদদের দেখছে একবার, আবার চোখ ফিরিয়ে কিকিরাকে লক্ষ করছে। খানিকটা বিব্রত ভাব। দ্বিধা।
কিকিরা বুঝতে পারলেন। সহজ হতে পারছে না লাটু। বললেন, “বাইরে থেকে এলে, জল খাবে? গরম পড়তে শুরু করেছে। ঘেমে গিয়েছ যেন। জল খাও আগে, চা খাও।” বলে ইশারায় তারাপদকে একবার ভেতরে যেতে বললেন। বগলাকে জল চায়ের কথা বলে আসতে।
তারাপদ উঠে গেল।
“বড়বাবু দোকানে আসছেন না?” কিকিরা বললেন। ঘরোয়া কথা বলে লাটুর অস্বস্তি কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
“বিকেলে আসে।”
“ওষুধটষুধ খাচ্ছেন তো! যা জেদি মানুষ।”
“খাচ্ছে। তবে মেজাজ…
“বুঝেছি। স্বভাব কি পালটায় হে সহজে!…ভেবো না; আজকাল বাজারে কত ওষুধ বেরিয়েছে, সুগার কবজা হয়ে যাবে!” বলে চন্দনের দিকে তাকালেন। “কী বলো ডাক্তার?” বলেই আবার লাটুর দিকে তাকালেন, দেখলেন চন্দনকে, “চাঁদু একজন উঠতি ডাক্তার। ভেরি গুড। বয়েসকালে ধন্বন্তরি হয়ে যাবে।” হাসতে লাগলেন কিকিরা।
তারাপদ ফিরে এল। পেছনে পেছনে বগলা। জল এনেছে।
লাটু জলের গ্লাস তুলে নিল। খেল। সত্যিই তার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল। গরম পড়ার মুখেই যেন এবার কলকাতা শুকোতে শুরু করেছে। সবে ফাল্গুনের মাঝামাঝি, এখনই রোদের কী তেজ! এভাবে চললে চৈত্র-বৈশাখে শহরে হলকা উঠবে দিনে-রাতে।
জল খেয়ে পকেট থেকে রুমাল বার করে লাটু মুখ মুছে নিল।
“বলো কী ব্যাপার? ফ্যামিলির কোনও ব্যাপার নয় তো?” কিকিরা বললেন।
“না।…আমার ব্যাপার?”
“তোমার ব্যাপার?”
“মানে, আমার এক বন্ধুর ব্যাপার!”
“কী হয়েছে?”
“তাকে খুনের আসামি করার ফন্দি আঁটা হচ্ছে।”
“খুনের আসামি?” কিকিরা অবাক! কেমন যেন থতমত খেয়ে গিয়েছেন।
তারাপদরাও অবাক চোখে লাটুকে দেখছিল।
কিকিরা বললেন, “কী বলছ তুমি! খুনের আসামি। তুমি ঠিক বলছ, না, আন্দাজে! ভয় পেয়ে বলছ?”
মাথা নেড়ে লাটু বলল, “ঠিক বলছি।”
“তোমার বন্ধু-খুনের আসামি–”, কিকিরা তখনও বিশ্বাস করছিলেন না। “কী করে বন্ধু? নাম কী?”
লাটু বলল, “ওর নাম নবকুমার। নবকুমার চৌধুরী। আমরা ওকে কুমার বলেই ডাকি। ওর একটা ব্যবসা আছে। ছোট কারখানার মতন। সেখানে পুরনো ফ্রিজ সারাই, এয়ারকুলার রিপেয়ারিং, রং করা–এই সব হয়।”
“কারখানা কোথায়?”
“সুরেশ ব্যানার্জি রোডে।”
“তা খুনের আসামি কেন? বয়েস কত তার?”
“প্রায় আমারই বয়েসি। বছর তিনেকের ছোট।…ব্যাপারটা আপনাকে গুছিয়ে না বললে বুঝবেন না!”
“কেমন করে বুঝব! খুলেই বলো।”
তারাপদরাও কৌতূহল বোধ করছিল। লাটুর দিকে তাকিয়ে থাকল।
লাটু বলল, “রায়দা, আপনি বর্ধমান জেলার নুরপুরের নাম শুনেছেন?”
মাথা নাড়লেন কিকিরা। “না। সেটা কোথায়?”
“বর্ধমান থেকে কাটোয়ার দিকে যেতে পড়ে। আমি কোনওদিন যাইনি, কুমারের মুখে শুনেছি। নুরপুরের নাকি অনেক খ্যাতি। প্রাচীনকাল থেকেই। এখন অবশ্য অত খ্যাতি-প্রতিপত্তি নেই। তবে নুরপুরের রাজবাড়ি, ওরা যাকে বলে ‘রাজবাটি’ তা টিকে আছে। আগে বলত নুরপুরের রাজা, পরে হল জমিদার, আর এখন জমিদারি সেভাবে না থাকলেও বেনামা জমিজায়গা থেকে শুরু করে, চালকল তেলকল কোল্ড স্টোরেজ নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। দেদার সম্পত্তি ওদের।”
“মানে নুরপুরের এক্স-জমিদারদের।”
“হ্যাঁ।…কুমার সেই বাড়ির ছেলে। ছোট তরফ-মানে ছোট ভাইয়ের। আইনত পুরো সম্পত্তির অর্ধেক মালিকানা তার। কিন্তু তার ভাগ্য মন্দ। কম বয়েসেই অনাথ। বাবা-মা মারা যান। ওকে পোষ্য নেওয়া হয়। ওর অন্য কোনও নিজের ভাইবোনও ছিল না। ছেলেবেলা থেকে তার জেঠা ওদের ওপর কর্তৃত্ব করেছেন। জেঠা মানে–কুমারকে যিনি পালন করেছেন তাঁর দাদা। মা যতদিন বেঁচে ছিল তবু সামান্য রয়েসয়ে ছিলেন। মা মারা যাওয়ার পর গ্রাহ্যও করতে চান না।”
“দাঁড়াও, দাঁড়াও–একটু ক্লিয়ার হয়ে নিই। তুমি বলছ, নুরপুরের রাজবাড়ির ছোট ভাই অনাথ একটি ছেলেকে পোষ্য নেন! …তাহলে বড় ভাই দাঁড়াচ্ছে ছেলেটির একরকম জেঠা।…তা ভাইপোর দোষ?”
লাটু বলল, “দোষ বলতে কী বলব! ভাগ্যের দোষ। কুমারের কথায়, সে পালিত পুত্র। মানে, সে ছেলেবেলাতেই অনাথ হয়ে যায়। তার নিজের বাবা মারা যান বছর দুই বয়েসে। নিজের মাকেও সে হারায় পাঁচ বছরে। একেবারেই অনাথ।”
“ভেরি স্যাড!”