দোতলায় পা দিয়ে দেখা গেল, সামনে টানা বারান্দা। ঢাকা বারান্দা অবশ্য। বারান্দার মাঝামাঝি জায়গায় একটা বাতি জ্বলছে। তার আলো এত কম যে, অত বড় বারান্দা প্রায় অন্ধকার। বাড়ির কাউকেই দেখা গেল না।
কিকিরা জহরকে বললেন, “ডাকো কাউকে।”
জহর ডাকল। “কে আছে?”
বারতিনেক গলা চড়িয়ে ডাকার পর বারান্দা-ঘেঁষা ঘর থেকে একটি লোক বেরিয়ে এল। মাঝবয়েসি। পরনে খাটো ধুতি, গায়ে ফতুয়া। দাড়ি গোঁফ কামানো নয়।
লোকটি সামনে এসে দাঁড়াল। দেখছিল কিকিরাদের। কিকিরা জহরকে ইশারা করলেন। জহর বলল, “বাবুকে গিয়ে বলো জহরবাবু এসেছেন। জহর।”
লোকটি জহরদের অপেক্ষা করতে বলে চলে গেল।
কিকিরা চারপাশ দেখছিলেন। কলকাতা শহরে পুরনো বাড়ি অনেক দেখেছেন কিকিরা। এ বাড়ি যেন হার মানায় অন্যগুলোকে। এত জীর্ণ, হতশ্রী, অদ্ভুত এক গন্ধ-খসে পড়া বালি, সুরকির চুন আছে কি না বোঝা যায় না। অথচ ইমারতের গড়ন দেখলে মনে হয়, যে আমলেই হোক বাড়ি তৈরির সময় অন্তত রীতিমতন বাড়ির মালমশলা খরচ করা হয়েছিল।
নীচের ফাঁকা চাতাল থেকে সেই একই কলরব ভেসে আসছে। তবে অত জোরালো নয়।
কিকিরা আর জহর নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। তারাপদ সামান্য পেছনে। তাকে বলা হয়েছে, সিঁড়ির দিকে চোখ রাখতে।
লোকটি ফিরে এল। “আসুন আপনারা। বাবু আসছেন।”
বারান্দা বরাবর দু’তিনটে বন্ধ ঘর পেরিয়ে একটা ঘরে এনে কিকিরাদের বসতে বলল লোকটি।
ঘর খুলে আলো সে জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিল আগেই। এবার সে পাখা খুলে দিল। আলো জ্বেলে দিল অন্য একটা দেওয়ালেরও।
বিশাল ঘর, মানে সাধারণ বড় ঘরের চেয়েও আকারে বড়। ঘর জুড়ে পুরনো আমলের সোফা, চেয়ার, আর্মচেয়ার, ডিভান। কোনওটাই আজ আর উজ্জ্বল নয়। ময়লা। ধুলো জমেছে। কাপড় ছিঁড়ে গিয়েছে এখানে ওখানে। ঘরের একপাশে একটা নকল বাজপাখি, বাঘের মাথা, দেওয়ালে হরিণের শিং। আর কিছু ছবি দেওয়ালে। তার মধ্যে একটা ছবি পাজামশাইয়ের কোনও পূর্ব পুরুষের অয়েল পেন্টিং, মাথায় পাগড়ি, গায়ে রাজকীয় পোশাক।
কিকিরা আবাক হচ্ছিলেন, আবার কেমন যেন শঙ্কিত হচ্ছিলেন, যে চালাকির খেলাটা তিনি খেলতে এসেছেন, সে-খেলায় কি জিততে পারবেন।
হঠাৎ কিকিরার চোখ পড়ে গেল বাজপাখির ওপর। আশ্চর্য, বনেদি বাড়ির কেউ কেউ বসার ঘরে কুকুর, পাখি, এমনকী হায়েনার নকল মাথা সাজিয়ে রাখে। বাজপাখি কিকিরা আগে কোথাও দেখেননি। পাখিটা দেখলে মনে হয় জীবন্ত।
পায়ের শব্দ হল।
পাঁজামশাই ঘরে এলেন। বিনয়ভূষণ পাঁজা।
জহররা উঠে দাঁড়িয়েছিল।
বিনয়ভূষণ কিকিরাদের দেখছিলেন। তাঁর কৌতূহল হচ্ছিল।
জহর বলল, “আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। আপনি বসুন।”
বিনয়ভূষণ বসলেন। হাতের ইশারায় কিকিরাদের বসতে বললেন, “বসুন। আপনারা…”
নমস্কারের সৌজন্যপর্ব চুকিয়ে কিকিরাও বসে পড়েছেন ততক্ষণে।
“ইনি আমার বাবার বন্ধুর মতন ছিলেন,” কিকিরাকে দেখিয়ে জহর বলল, “আমি কাকা বলে ডাকি। নাম কিঙ্করকিশোর রায়। আর উনি কাকার সঙ্গে এসেছেন…!” বলে তারাপদকে দেখাল।
কিকিরা বিনয়ভূষণকে দেখছিলেন। বৃদ্ধই ধরা যেতে পারে, তবে অক্ষম নন শারীরিক ভাবে। এখনও পিঠ সোজা, গাল-মুখ শুকিয়ে কুঁচকে যায়নি। ওঁর পরনে ধুতি, গায়ে হাফ হাতা গেঞ্জি। গলার কাছে বোম দেওয়া। পায়ে তালতলার চটি। বাঁ হাতে চশমার খাপ। চোখে চশমা নেই। বোঝা যায় দূরের জিনিস দেখতে অসুবিধে হয় না, চশমাটা কাছের বস্তু দেখা বা পড়ার জন্যে। ধবধবে ফরসা রং গায়ের। মাথার চুল সাদা এবং স্বল্প। গলায় একটি ছোট মাপের সোনার হার।
জহর বলল, “সেদিন যা ঘটেছিল রায়কাকা স্বচক্ষে দেখেছেন। ওইজন্যে ওঁকে নিয়ে এলাম। পতাকীদার কোনও দোষ নেই।… তা ছাড়া কাকারও কিছু বলার আছে।”
বিনয়ভূষণ বললেন, “আপনি নিজের চোখে দেখেছেন?”
“হ্যাঁ,” কিকিরা বললেন, “একটা কাজে আমি ওদিকে গিয়েছিলাম। ঘটনাটা চোখে পড়ে যায়। পতাকীকে আমি চিনি। অনেকদিন। স্টুডিয়োয় কাজ করে জানি।”
“বুঝতে পারছি। তা আপনি কি এই কথাটাই বলতে এসেছেন?”
মাথা নাড়লেন কিকিরা। বললেন, “না, আমি একটা ব্যাগ আপনাকে দেখাতে এসেছি।”
“ব্যাগ! কীসের ব্যাগ!”
কিকিরার কাঁধে একটা কাপড়ের ঝোলা ছিল। তার মধ্যে হাত ডুবিয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগ বার করলেন। দেখতে প্রায় কালো। লম্বায় ফুটখানেক। পতাকীকে দিয়ে ব্যাগ কিনিয়ে সেটার চেহারা পুরনোর মতন করা হয়েছে। যদিও তা হয়নি।
“এই ব্যাগ,” কিকিরা বললেন “আগে আপনি দেখেছেন?”
বিনয়ভূষণ ব্যাগ দেখতে দেখতে অবাক হয়ে বললেন, “তা আমি কেমন করে বলব! তবে হ্যাঁ, জহরের সেই লোকের হাতে এইরকম ব্যাগ ছিল! …আপনি কি ব্যাগটা উদ্ধার করেছেন?”
জহর তাড়াতাড়ি বলল, “হ্যাঁ। উনি…”
“উনি কুড়িয়ে পেয়েছেন? কেউ দিয়েছে?”
জহর বলল, “আজ্ঞে, মানে ঠিক কুড়িয়ে পাওয়া নয়। দেয়নি কেউ?”
“তবে?”
কিকিরা এবার নিজেই কথা বললেন। “আমি অনেকদিন ধরেই ওদিকে ঘোরাফেরা করি। চেনা লোকজন আছে। চুরিচামারি, পকেটমার, ছিনতাই হলে খোঁজখবর পাই।”
“আপনি পুলিশের লোক?”
“আজ্ঞে না। পুলিশের লোক নয়। তবে ওই যে গুমঘর লেনের কাছে বাচ্চাদের একটা ক্লিনিক আছে। পোলিও পেশেন্টদের দেখাটেখা হয়, তার পাশে একটা ছোট বাড়ি আছে। সেখানে কাঁচা চোরছ্যাঁচড় পকেটমারদের শুধরানোর চেষ্টা করা হয়। থানা পুলিশ থেকেই পাঠায় অনেককে। আমি ওখানে যাই। ধরাপড়া ছোকরাগুলোকে বাবা বাছা করে ধর্মকথা শোনাই, বারণ করি কুকর্ম করতে।” কিকিরা আগেই মনে মনে এসব কথা বানিয়ে রেখেছিলেন।