ঘুমটা হয়তো এজন্যই আসছে না। মানুষের জীবন এক—একটা সময় আসে যখন একজন কাছের জন দরকার হয়ে পড়ে। সারাদিনটা আজ বিদঘুটে সব ঘটনার মধ্য দিয়ে কেটে গেল। শেষমেশ অরুণ মেসোর ফোন। আশ্চর্য, মাসিদের কী কোনো রোগ আছে—অমলা মাসি দেখতে কী সুন্দর—কেমন মিষ্টি কথা বলে, চোখ দুটো দেখলে বড় পবিত্র পবিত্র লাগে। মাসি কোথায় যায় মেসো খবর রাখে না কেন এবং ফোন ধরে কেন জানি অমলা মাসির খোঁজ করতেই তার মার মুখ মনে পড়ে গেছিল। যেমন মা তাকে একা রেখে কোনো কোনো দিন বেশ রাত করেই ফিরেছে। সে ভারি ছটফট করত। অথচ তার ভিতরের দুঃখ অথবা অভিমানের কোনো দামই দিত না। মেসোর ফোন পেয়ে প্রথম মনে হয়েছিল, বেশ জব্দ তুমি বাপ—বউ কোথায় জান না। তারপরই মনে হয়েছে—সে মানুষটাকে দেখেই নি। কেমন দেখতে অরুণ মেসো—বিয়ের সময় সে অথবা মা কেউ আসতে পারেনি। এখানে আসার পরও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে সে কখনও যায়নি। ওর মনে হয়েছে সবাই জানে তার বাবার আত্মহত্যার খবর। যে ছেলের বাবা আত্মহত্যা করে তার মাথা তুলে কথা বলারও যেন অধিকার নেই। এসব কারণেই তার কোথাও আর যাওয়া হয় না। অথবা কী এ—সময়ে মানুষেরা সব্বাই গ্রন্থিমোচনে ব্যস্ত। সম্পর্কহীন মানুষই কী শহরে বেশি—ঠিক তার মতো। ফলে এইসব আজেবাজে চিন্তায় নানুর সত্যি ভালো ঘুম হল না রাতে। শেষ রাতের দিকে সে একটা দীর্ঘ স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নটা জলজ্যান্ত একটা চাটুর। গোল চাটুটা আগুনে দগদগে লাল। চাটুটা ঘুরছে। এবং চাটুটার মধ্যে বাবার সেই চশমাটা। চশমার একটা কাচে নানুর মুখ আর একটা কাচে নবনীতার মুখ। নবনীতা ঠোঁট টিপে হাসছিল।
অদ্ভুত সব ঘটনার মধ্যে স্বপ্নটা শেষ হয়ে গেল। সে দেখল একটা রাজবাড়ি, দরজায় এক হাত গন্ডারের ছবি—এবং ফুটপাথে অজস্র না খেতে পাওয়া মানুষের বিপ্লব। রাজবাড়ির পাঁচিল থেকে ইঁট খসিয়ে কারা নিয়ে যাচ্ছিল। দলের মধ্যে সেও একজন। আবার একটা মস্ত মই দেখল সে সিঁড়ির মতো আকাশে উঠে গেছে। সিঁড়িটা ধরে বেশ উঠে যাচ্ছিল। কখন যেন কারা সিঁড়ির নিচটা আলগা করে দিল। সিঁড়িটা শূন্যে ঝুলে আছে। নিচে দেখল লীলা দাঁড়িয়ে বলছে, তুমি কোথায় যেতে চাও দাদাবাবু। নেমে এসো। সে লাফ দিয়ে পড়তে গিয়ে মনে হল, ডানা গজিয়েছে এবং নীল আকাশের নিচে তখন সে আর লীলা। ওরা পাখি হয়ে গেছে। তখনই দেখল একটা বড় মাঠ, মাঠে নবনীতা ছুটছে। পেছনে ওর বাবা ছুটছে। নবনীতার ম্যাকসি বাতাসে উড়ছিল। চুল উড়ছিল। নবনীতাকে ধরার জন্য এখন আর তার বাবা ছুটছে না, তার পাড়ার দাদারা ছুটছে। একটা নদীর ধারে নবনীতা এসে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে চেয়ে আছে। তখন নবনীতার গায়ে পোশাক নেই। সে দূরে দেখতে পাচ্ছে দাদারা আসছে—ওদের হাতে গাছের ডাল, ইঁটের টুকরো। নবনীতা প্রাণভয়ে নদীতে ঝাঁপ দিল। এখানেই স্বপ্নটা শেষ। দেবী বিসর্জনের মতো জলে ঝাঁপ দিলে যে শব্দ হল সে শব্দমালা তাকে জাগিয়ে দিয়ে গেল। সে উঠে দেখল সকাল হয়ে গেছে। তার অনেক করণীয় কাজ। এবং বাথরুম থেকে আরম্ভ করে সকালের খাবার সে তাড়াতাড়ি শেষ করল। তারপর ব্যাংক এবং দাদু এই দুই কর্তাব্যক্তির সঙ্গে দিনটা কেটে গেল তার।
এর কিছুদিন পরেকার কথা। বাইরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর গরম হাওয়া বইছে। বৃষ্টি হবে হবে করেও হচ্ছে না। রোজই খবরের কাগজে বড় করে বিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাতের কথা থাকে। কিন্তু দিন শেষে না ঝড় না বিদ্যুৎ। কেবল এলোমেলো বাতাস। প্রবল দক্ষিণা বাতাসে ভ্যাপসা গরম এবং সূর্য হেলে গেলে কিছুটা ঠান্ডা আমেজ নেমে আসছে শহরে। শহরতলির একটা বাড়িতে লীলা তখন ভাঙা আয়নার সামনে চুল বাঁধছিল।
তখনই খুট খুট শব্দ দরজায়। এই পড়ন্ত বিকেলে মামাবাবুর সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসতে পারে ভেবে সে দরজা খুলতেই দেখল, দাদাবাবু। খুব মিষ্টি হাসি মুখ। হাতে কীসের একটা প্যাকেট। লীলা বলল, ওরা কেউ বাড়ি নেই।
নানু বলল, তুমি আমাকে ঢুকতে দেবে তো।
লীলা সরে দাঁড়াল। ওর চুল বাঁধা এখনও শেষ হয়নি। সে কিছু না বলেই চুল বাঁধতে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। বসার ঘরটায় তালা ঝুলিয়ে যায়নি, তাই রক্ষা। নানু বসার ঘরে ঢোকার আগে বলল, দরজা বন্ধ করে দিয়ে যাও।
দরজা বন্ধ করতে গিয়ে লীলার হাত কাঁপছিল।
চা করতে পারবে?
লীলা রান্নাঘর থেকে বলল, কিছুই বাইরে নেই দাদাবাবু।
ঠিক আছে। তুমি এসো। ও ঘরে তুমি কী করছ?
লীলার গলাটা কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। দাদাবাবুর চোখের দিকে সে তাকাতে পারে না। তাকালেই ভিতরটা গুড় গুড় করে ওঠে। সে বলল, কী হবে গিয়ে?
এসোই না।
মামিমা বকবে।
কে বকবে?
মামিমা।
গুলি মারো মামিমাকে। আসতে বলছি আসবে।
লীলা কোনোরকমে দরজা পর্যন্ত হেঁটে এল। ভারি ভয় তার। সে ভয়ে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকল।
এই নাও। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন। আমি বাঘ না ভালুক। ভয় পাচ্ছ কেন?
লীলা ভেতরে ঢুকে বলল, কী নেব?
দেখই না খুলে।
লীলার মুখটা ভীষণ লাল হয়ে গেছে। চোখ দুটোতে আশ্চর্য নীরবতা। এবং বুকের মধ্যে সমুদ্রের ঝড়। সে তাকিয়ে থাকল শুধু।
কী হল, নাও। দাঁড়িয়ে থাকলে কেন। ছেঁড়া ফ্রক গায়ে দিয়ে লোককে না দেখালে বুঝি ভালো লাগে না।
লীলা খুব শান্ত হবার চেষ্টা করছে। সে বলল, দাদাবাবু আপনি খুব ছেলেমানুষ।