- বইয়ের নামঃ শেষ দৃশ্য
- লেখকের নামঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
শেষ দৃশ্য
এক
হরিদ্বার থেকে কোনো একদিন ওরা রওনা হয়েছিল—ওরা অন্তত তাই বলে। প্রয়াগ বারাণসীর পথ ধরে গঙ্গার ধারে ধারে ওরা ডেরা বেঁধেছিল। রাজা হরিশ্চন্দ্রের নাম ওরা জানে—তিনি গঙ্গাপুত্র। সে নাম স্মরণ করার সময় ওরা মাটি ছুঁয়ে প্রণাম করে। তার চেয়ে বেশি ওদের জানা নেই। এরা বলবে তখন, না জানে বাবু কাঁহাসে আয়া, লেকিন জানে, হামরা সব আছে গঙ্গা—পুত্তুর। বলবে হরিদ্বারসে কোলকত্তা—তেমন হাজার চটান খুঁজে পাবেন। চটানে হামরা ঘাটের কাঁথা কাপড়ে ডেরা বেঁধেছি। ঘাটের দুচার পয়সায় হামলোগ নসিবকে ঢুঁড়েছি।
চটানে পাশাপাশি কুঁড়েঘর অনেকগুলো। কুঁড়েঘরগুলোর কোনোটায় চাল আছে, বেড়া আছে, দরজা আছে। চাল—ঘাটের ছেঁড়া তোষক এবং কাঁথার, বেড়া—ফালি বাঁশের। কিছু কিছু ঘরের চাল আছে, কিছু ঘরের বেড়া নেই, দরজা নেই। শুধু মেঝের ওপর ফালি বাঁশের মাচান। মাচানের নিচে রাজ্যের হাঁড়ি—কলসি। দরজার বদলে কোনো ঘরে ছেঁড়া কাঁথা ঝুলছে। ছেঁড়া কাঁথাটাই দরজার মতো কাজ করছে। ছেঁড়া কাঁথাটা তেলচিটে নোংরা। কোথাও পোড়া—চিতার আগুনের দাগ। তবু এটাই ওদের দরজার আব্রু, মনের আব্রু, চটানের ভালোবাসার আব্রু। চটানের উঠোনে শুয়োরের খোঁয়াড়, মোরগের ঘর, কুকুরের আস্তানা। ঘরে ঘরে অভাব অনটন মারধোর। আবার ভাব ভালোবাসার কথা। ঘরে ঘরে হল্লা চিৎকার—নাচন কোঁদন। তখন আসেন ঘাটোয়ারিবাবু। তিনি সালিসি সাজেন, বিচার করেন। চটানের মা—বাপ তিনি।
চটানের সঙ্গেই ঘাট—অফিস। এখানে মড়ার নামধাম লেখানো হয়। একটা কাউন্টার আছে—ঘাটোয়ারিবাবু সেখানে একটা কালো চেয়ারে বসে থাকেন সারাদিন। রাতে পাশের তক্তপোশে চুপচাপ শুয়ে থাকেন। ঘরে কতকগুলি ছবি টাঙানো আছে। এই শহরের বনেদি লোকগুলোর ছবি। তারা মরল—তিনি তাদের ছবি রাখলেন। এই ছবিগুলো দেখে কোনোদিন রাত কাটিয়ে দেন অথবা কোনোদিন ঘুমিয়ে পড়েন। ঘাট—অফিস পার হলে বারান্দা। ঘাটের কিছু কাঁথা—কাপড় ইতস্তত ছড়ানো। দুটো কুকুর শীতে কাতরাচ্ছে পাশে। ডোমেদের ছেলেপিলেরা কুকুর দুটোকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা দিব্যি আরামে ঘুমোচ্ছে।
তখন চটানে শীতের রোদ নেমেছে। শীতের ভোরে কাকের শব্দ, কুকুরের শব্দ, মোরগের শব্দ পাশাপাশি কোথাও। পাশাপাশি দুটো ঘরের ফাঁকে একটা শুয়োর পড়ে আছে। ঘোঁৎঘোঁৎ আওয়াজ করছে শুয়োরটা। দুটো বাচ্চা শুয়োর শীতে কাঁদছে।
হরীতকী দরজায় বসে সব দেখছিল। অন্য ঘরে গোমানি ডোম খকখক কাশছে। হরীতকীর কোমরে ব্যথা, তবু বসে বসে সব দেখছিল। কাশির জন্য গোমানি ডোমের গোঁফ কাঁপছে। চোখ দুটো জ্বলছে—জবাফুলের মতো লাগছে। কাঁপতে কাঁপতে মুখ থুবড়ে পড়ছে মাচানের ওপর। হরীতকীর কোমরে ব্যথা, তবু এসব দেখছিল।
গোমানি এদিকে ওদিকে তাকাল। বেলা দেখল। শীতের বেলা—রোদে তাপ নেই, তাপ থাকলে ঘাটের তোষক বালিশ ছেড়ে চটানের উঠোনে কিংবা ঘাট—অফিসের বারান্দায় গিয়ে বসতে পারত। হরীতকী দরজায় বসে এমন সব কিছুই অনুমান করছে। হরীতকী দরজায় বসে রয়েছে এক মালসা গরম জলের জন্যে। দুখিয়ার বৌ ঘাটের পোড়া কাঠে গরম জল করতে গেছে। একটু দেরি হবে—সে ভাবল এত সাধারণ কথা। গোমানির চোখ দুটো কাশির জন্য চোখ থেকে বার হয়ে আসতে চাইল। আবার ভিতরের দিকে পালাতে চাইল। সে দেখল বসে বসে। কোমরে ভীষণ ব্যথা। কোমরটা ধরে টিপল হরীতকী। ব্যথার উপশম খুঁজল। কোমরে চাপ ধরে আছে। সে দাঁড়াল, বাঁশে হেলান দিয়ে উঁকি দিল বাইরে। দুখিয়ার বৌ মংলি আসছে, হাতে গরম জলের মালসা। হরীতকী এত খুশি যে কিছু বলতে পারল না। মালসাটা টেনে নিয়ে পর্দার মতো কাঁথার আব্রু ফেলে দিয়ে গা ধুতে লাগল।
গোমানি মুখ তুলে হরীতকীর খুশি—খুশি ভাবটুকু লক্ষ্য করে বিরক্ত হল। সঙ্গে সঙ্গে শরীরে চটানের নেমকহারাম উত্তাপ জমতে থাকল। রাগ হল ওর। খিস্তি করতে ইচ্ছা হল—মাগি জাত একটা জাত! ওয়ার আবার, ধম্ম ওয়ার আবার স্বভাব! মাগির বাচ্চাটা হয়েছে শ্মশানে—হবে না! মাগির নেই জাতের ঠিক, নেই ধম্মের ভয়—চতুরাকে মদ খাইয়ে খুন করেছে—ও শ্মশানে বাচ্চা বিয়োবে না তো কী হাসপাতালে বিয়োবে! কিন্তু বলতে পারল না। শরীর দুর্বল—শীতের ব্যামোতে ওকে জব্দ করেছে। তা ছাড়া কাল না খেয়ে থাকার জন্য শরীরটা বেজান হয়ে আছে। ভুখা শরীর হল্লা করতে দিচ্ছে না। সেজন্য শরীরে আরও কাঁথা—কাপড় জড়িয়ে পাশের কিছু পোঁটলা—পুঁটলি ঠেলতে থাকল। বলল, উঠ নেলি, সকাল হো গিয়া।
কিছু কাঁথা—কাপড়ের ভিতর থেকে নেলি ধড়ফড় করে উঠে বসল। নেলির মুখটা শুকনো থাকত—যদি না রাতে এত গভীর ঘুমোত। শ্যামলা রঙের শরীর, এক মাথা চুল। চুলগুলো মুখ ঢেকে রেখেছে। চোখ অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখে বিরক্তির চিহ্ন। আরও ঘুমোনোর ইচ্ছে। অথচ সে কিছু বলছে না, আড়মোড়া ভাঙছে শরীরের। চোখ রগড়াচ্ছে। চুলগুলো জড়ো করে তালুতে খোঁপা বাঁধছে এবং মাচান থেকে নামার সময় বলছে, ক্যান ডাকলি বাপ? খোয়াব এয়েছিল, তু ডাকলি ক্যান!
গোমানি কাশল ক’বার। ওর উত্তর দিতে সেজন্য দেরি হচ্ছে, অথচ মেয়েটা নেমে যাচ্ছে—চলে যাচ্ছে। সে দম নিতে পারছে না। কথা বলতে পারছে না। ওর জ্বলন্ত চোখ একবার ভিতরে, একবার বাইরে দেখছে। কোনোরকমে লেপ—তোষকের ভিতর থেকে কচ্ছপের মতো গলাটাকে বার করছে। তবু যেন কোনোরকমে—ভুখ লাগিছে।