- বইয়ের নামঃ মানুষের হাহাকার
- লেখকের নামঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
মানুষের হাহাকার
এক
রোজকার মতো আজও সে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেল। প্রথমে আস্তে, পরে বেশ জোরে। কেউ ডাকছে, কীরে ঘুম ভাঙল না। কত ঘুমোবি। কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ না পেলে কেমন ভীতু গলা হয়ে যায় দাদুর। তখন আরও জোরে—নানু ও নানু, ঘুমোচ্ছিস না জেগে আছিস? এত বেলায় কেউ ঘুমোয়! ওঠ, আর কত ঘুমোবি? কথা বলছিস না কেন?
সে সকালে ঘুম থেকে উঠে একদিন চুপচাপ বসেছিল, ইচ্ছে করেই সাড়া দেয়নি। ইচ্ছে করেই ঘুম থেকে উঠে দরজা খোলেনি, জানালা খোলেনি—কেমন আর্ত গলা তখন দাদুর, ‘নানু দরজা খোল ওঠ ভাই।’ নিচ থেকে ছোট মাসি, দিদিমা পর্যন্ত ছুটে এসে দরজায় হামলে পড়েছিল। ‘নানু নানু!’ সারা বাড়িটা তটস্থ হয়ে উঠেছিল। ভারি মজা। এরা সবাই ভেবেছে, সেও একটা কিছু তার বাবার মতো করে বসবে।
নানু বিছানায় পাশ ফিরে অত্যন্ত সহিষ্ণু গলায় সাড়া দিল—’কী হচ্ছে!’ এই একটা কথাই যথেষ্ট। সে ঘরেই আছে, সে জেগে আছে, কিছু একটা করে বসেনি, তার সাড়া পেলেই দাদু এটা বেশ বোঝে। তারপর বীণাদি আসবে—’তোমার চা দাদাবাবু’। চা নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ওই একটি কথাই বলবে, আর কিছু বলবে না। ওরা কি জানে, চা—এর কথা শুনলে নানু আর বিছানায় শুয়ে থাকতে পারবে না। দরজা খুলে দেবে।
নানু উঠে পাজামা পরল। একটা গেঞ্জি গায়ে দিয়ে দরজা খুলে দিল। বীণাদির যা স্বভাব, ‘খুউব! চা রাখার সময় ওই আর একটি কথা। তারপর টেবিলে চা রেখে আর কথা না বলে দরজাটা ভেজিয়ে চলে যায়। এটাও নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। আগে নানুকে বলতে হত, দরজাটা যাবার সময় ভেজিয়ে দিয়ে যেয়ো। কখনও কখনও ভুলে যেত বাণীদি। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এই সংসারে সব কিছুই অভ্যাস—এবং মনে হয় নানুর বেঁচে থাকাটাও একটা অভ্যাসের ব্যাপার। এবং দাদুর বিশ্বাস এই অভ্যাসটা নানুর ঠিক গড়ে ওঠেনি। অথবা বাবার মতো সে অভ্যাসটার প্রতি বিরক্ত হয়ে যদি কিছু করে ফেলে। বাবা, তার বাবা। নানুর এ—কথাটাও চায়ে চুমুক দেবার সময় মনে হল। ভারি সুন্দর ছিল তার বাবা দেখতে। খুব উঁচু লম্বা নয়, মাঝারি সাইজের। তার বাবাটির চোখ মুখ ছিল ভীষণ মায়াবী। বাবার কথা মনে হলে, তার চোখ এখনও ঝাপসা হয়ে আসে। সে গোপনে কাঁদে।
শহরের এদিকটায় এখন অনেক নতুন ঘরবাড়ি উঠে যাচ্ছে। সে জানালায় বসে দেখল ক’টা পাখি উড়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি পার হয়ে। বাড়িটা পুবমুখো বলে, সূর্য উঠলেই রোদ এসে যায়। সামনে অনেকটা জমি। সেখানে কিছু ফুলের গাছ। এই যেমন কিছুদিন আগে একটা কলকে ফুলের গাছ ছিল।
সে এখানে আসার পরই দাদু একদিন কলকে ফুলের গাছটা কেটে ফেলল। বাড়ির কাজের লোকটাকে বেশ সতর্ক গলায় ডেকেছিল সেদিন, ‘নিধু গাছটা বুড়ো হয়ে গেল। ফুল হয় না। রেখে লাভ নেই। বরং এখানে একটা শ্বেতজবার গাছ লাগিয়ে দিবি।’ নানু বলেছিল, ‘দাদু এমন সুন্দর গাছটা তুমি কাটছ!’ দাদু হেসেছিল ‘গাছ সুন্দর হয় না। ফুল না হলে গাছ দিয়ে কী হবে।’
—তা ঠিক। সে চলে এসেছিল এবং জানালা থেকে সে দেখতে পেয়েছিল কলকের গোটাগুলি খুব সতর্ক চোখে তুলে নিচ্ছে দাদু। তার ভারি হাসি পেয়েছিল।
চা শেষ হতে না হতেই সে জানে দাদু আবার উঠে আসবে। খবর দেবে, নানু কাগজ এসে গেল। আয়।
সকালে এটাও অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। সেই শৈশবে সে যখন স্কুলে পড়ত, বাবা বেঁচে থাকতে, বাবা ও জ্যাঠামণি তখনও একসঙ্গে এক বাড়িতে, জ্যাঠামণির জন্য ইংরেজি কাগজ—আর বাড়ির সবার জন্য একটা বাংলা কাগজ—সে খেলার পাতাটা প্রথম দেখত, তারপর সিনেমার পাতা, এবং পরে সব কাগজটাই পড়ার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
সে চা খাবার সময় দেখল একটা রেলগাড়ি যাচ্ছে। এই জানালাটা দিয়ে অনেক কিছু দেখা যায়। সামনে বড় একটা পুকুর, কিছু গাছপালা, বাড়িঘর, এবং বড় রাস্তা থেকে একটা পথ বেঁকে বাজারের দিকে গেছে। সেখানে চায়ের দোকান, লোহা লক্করের দোকান, একটা ম্যাচ কারখানা, ক্লাব ঘর, ছোট্ট খেলার মাঠ, গোটা দুয়েক তিনতলা বাড়ি, বাড়ির জানালা, একজন বুড়ো মতো মানুষ ব্যালকনিতে বসে থাকে। এবং সব পার হয়ে রেল—লাইন।
এ—ঘরে দুটো জানালা, সামনে পুবমুখী দরজা, তারপর রেলিং ঘেরা বারান্দা। এখানে আসার পর এ—ঘরটাই থাকার মতো মনে হয়েছিল তার। দোতলার এক প্রান্তে আলগা এই ঘরটায় সে কিছু বই আমদানি করেছে। গোপনে সে বইগুলি পড়ে। বইগুলি পড়লেই কেন জানি পৃথিবীটাকে তার বদলে দিতে ইচ্ছে করে। এবং একতলার কোনো শব্দই এখান থেকে শোনা যায় না। ঘরের মধ্যে আছে একটা আলনা। ওটায় সে তার জামাকাপড় রাখে। একটা টেবিল, কিছু বি—কম পার্ট ওয়ানের বই এবং চেয়ার একটা। এক পাশে লম্বা খাট, দুটো মোড়া। সুটকেসটা খাটের নীচে। ওতে টুথ ব্রাস, পেস্ট, দাড়ি কামাবার সাজসরঞ্জাম সব থাকে। যেন কোথাও যাবার কথা থাকে তার সব সময়—সে সেজন্য কাজ হয়ে গেলে আবার স্যুটকেসের ভিতর পুরে রাখে। একটা তাক রয়েছে। ওটা খালি।
মানুষ যেখানেই থাকে সেটা এক সময় বড় নিজস্ব হয়ে যায়। অথচ তার মনে হয়, সে কিছুদিন এখানে থাকবে, তারপর আবার কোথাও চলে যাবে।