- বইয়ের নামঃ সোনালী বালির নদীর চরে
- লেখকের নামঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
সোনালী বালির নদীর চরে
১
সোনালী বালির নদীর চরে রোদ হেলে পড়েছে। ঈশম শেখ ছইয়ের নিচে বসে তামাক টানছে। হেমন্তের বিকেল। নদীর পাড় ধরে কিছু গ্রামের মানুষ হাট করে ফিরছে। দূরে দূরে সব গ্রাম মাঠ দেখা যাচ্ছে। তরমুজের লতা এখন আকাশমুখো। তামাক টানতে টানতে ঈশম সব দেখছিল। কিছু ফড়িং উড়ছে বাতাসে। সোনালী ধানের গন্ধ মাঠময়। অঘ্রানের এই শেষ দিনগুলিতে জল নামছে খাল-বিল থেকে। জল নেমে নদীতে এসে পড়ছে। এই জল নামার শব্দ ওর কানে আসছে। সূর্য নেমে গেছে মাঠের ওপারে। বটের ছায়া বালির চর ঢেকে দিয়েছে। পাশে কিছু জলাজমি। ঠাণ্ডা পড়েছে। মাছেরা এখন আর শীতের জন্য তেমন জলে নড়ছে না। শুধু কিছু সোনাপোকার শব্দ। ওরা ধানখেতে উড়ছিল। আর কিছু পাখির ছায়া জলে। দক্ষিণের মাঠ থেকে ওরা ক্রমে সব নেমে আসছে। এ সময় একদল মানুষ গ্রামের সড়ক থেকে নেমে এদিকে আসছিল–ওরা যেন কি বলাবলি করছে। যেন এক মানুষ জন্ম নিচ্ছে এই সংসারে, এখন এক খবর, ঠাকুরবাড়ির ধনকর্তার আঘুনের শেষ বেলাতে ছেলে হয়েছে।
ঈশম শেষ কথাটা শুনেই কোটা ছইয়ের বাতায় ঝুলিয়ে রাখল। কলকে উপুড় করে দিল। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে বের হল। উপরে আকাশ নিচে এই তরমুজের জমি আর সামনে সোনাল৷ বালর নদী। জল, স্ফটিক জলের মতো। ঈশম এই ছায়াঘন পৃথিবীতে পশ্চিমমুখো হয়ে দাঁড়াল। বলল, সোভান আল্লা। শেষে আর সে দাঁড়াল না। নদীর পাড় অতিক্রম করে সড়ক ধরে হাঁটতে থাকল। ধনকর্তার পোলা হইছে-বড় আনন্দ, বড় আনন্দ। সব খুদার মেহেরবানি। সড়কের দু’ধারে ধান, শুধু ধান-কত দূরে এইসব ধানের জমি চলে গেছে। ঈশম চোখ তুলে দেখল সব। বিকেলের এইসব বিচিত্র রঙ দেখতে দেখতে তার মনে হল, পাশাপাশি এইসব গ্রাম–তার কত চেনা, কতকালের মেমান সব–নিচে খাল, মাছেরা জলে লাফাচ্ছে। সে সড়কের একধারে গামছা পাতল। নিচে ঘাস, গামছা ঘাসের শিশিরে ভিজে উঠছে। সে এসব লক্ষ করল না। সে দু’হাঁটু ভেঙে বসল। খালের জল নিয়ে অজু করল। সে দাড়িতে হাত বুলাল ক’বার। মাটিতে পর পর ক’বার মাথা ঠেকিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে কেমন তন্ময় হয়ে গেল। অঘ্রানের শেষ বেলায় ঈশম নামাজ পড়ছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে বলে ওর ছায়াটা কত দূরে চলে গেছে। খালের জল কাঁপছিল। ওর ছায়াটা জলে কঁপছে। কিছু হলদে মতো রঙের ফড়িং উড়ছে মাথার উপর। সূর্যের সোনালী রঙে ওর মুখ আশ্চর্যরকমের লাল দেখাচ্ছিল। যেন কোন ফেরেস্তার অলৌকিক আলো এই মানুষের মুখে এসে পড়েছে। সে নামাজ শেষ করে হাঁটতে থাকল। এবং পথে যাকে দেখল তাকেই বলল, আঘুনের শেষ ফজরে ধনকর্তার পোলা হইছে। ওকে দেখে মনে হয় তরমুজ খেত থেকে অথবা সোনালী বালির চর থেকে একটি খবর সকলকে দেবার জন্য সে উঠে এসেছে। সে সড়ক অতিক্রম করে সুপারি বাগানে ঢুকে গেল। বৈঠকখানাতে লোকের ভিড়। বাইরে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। সে প্রায় সকলকেই আদাব দিল এবং ভিতরে ঢুকে নিজের জায়গাটিতে বসে তামাক সাজতে থাকল।
সোনালী বালির নদীতে সূর্য ডুবছে। কচ্ছপেরা ধানগাছের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আছে। এইসব কচ্ছপ এখন একটু শক্তমতো মাটি পেলেই পাড়ে উঠে ডিম পাড়তে শুরু করবে। অনেকগুলি শেয়াল ডাকল টোডারবাগের মাঠে। একটা দুটো জোনাকি জুলল জলার ধারে। জোনাকিরা অন্ধকারে ডানা মেলে উড়তে থাকল। পাখিদের শেষ দলটা গ্রামের উপর দিয়ে উড়ে গেল। নির্জন এবং নিরিবিলি এইসব গ্রাম মাঠ। অন্ধকারেও টের পাওয়া যায় মাথার উপর দিয়ে পাখি উড়ে যাচ্ছে। সে জানে ওরা কোথায় যায়। ওরা হাসান পীরের দরগাতে যায়। পীরের দরগায় ওরা রাত যাপন করে। শীতের পাহাড় নেমে এলে ওরা তখন দক্ষিণের বিলে চলে যাবে। ঈশম এবার উঠে পড়ল।
ঈশম ডাকল, ঠাইদি আমি আইছি।
দরজার বাইরে এসে ছোটকর্তা দাঁড়ালেন।
–ঈশম আইলি?
–হ, আইলাম। ধনকর্তারে খবর দিতে পাঠাইছেন? না পাঠাইলে আমারে পাঠান। খবর দিয়া আসি। একটা তফন আদাই কইরা আসি।
ছোটকর্তা বললেন, যা তবে। ধনদাদারে কবি, কাইলই যেন রওনা দেয়। কোনও চিন্তার কারণ নাই! ধনবৌ ভাল আছে।
–তা আর কমু না! কি যে কন! ঠাইনদি কই?
–মায় অসুজ ঘরে। তুই বরং বড় বৌঠাইনরে বল তরে ভাত দিতে।
ঈশম নিজেই কলাপাতা কাটল এবং নিজেই এক ঘটি জল নিয়ে খেতে বসে গেল।
বড়বৌ বলল, পাতাটা ধুয়ে নাও।
ঈশম পাতাটার উপর জল ছিটিয়ে নিল। বলল, দ্যান।
বড়বৌ ঈশমকে খেতে দিল। ঈশম যখন খায় বড় নিবিষ্ট মনে খায়। ভাত সে একটাও ফেলে। এমন খাওয়া দেখতে বড়বৌর বড় ভাল লাগে। ঈশমকে দেখতে দেখতে ওর বিবির কথা মনে হল। ঈশমের ভাঙা ঘর, পঙ্গু বিবি, নাড়ার বেড়া এবং জীর্ণ আবাসের কথা ভেবে বড়বৌ-এর কেমন মায়া হল। অন্যান্য অনেকদিনের মতো বলল, পেট ভরে খাও ঈশম। একটু ডাল দেব, মাছ? অনেক দূর যাবে, যেতে যেতে তোমার রাত পোহাবে।
ঈশম নিবিষ্ট মনে খাচ্ছে, আর হাত-দশেক দূরের অসুজ ঘরটা দেখছে। সেখানে ধনমামি আছেন, ঠাইনদি আছেন, ঈশম ঘরের কোণায় কোণায় বেতপাতা ঝুলতে দেখল। মটকিলা গাছের ডাল দেখল দরজাতে। ঘরে প্রদীপ জ্বলছে। বাচ্চাটা দুবার টাও ট্যাও করে কাঁদল, ভিজা কাঠের গন্ধ, ধোঁয়ার গন্ধ, ধূপের গন্ধ মিলিয়ে এ বাড়িতে একজন নবজাতকের জন্ম। টিনকাঠের ঘর, কামবাঙা গাছের ছায়া–ধনমামি বড়মামি–এবং এ-বাড়ির বড়কর্তা পাগল, একথা মনে হতেই ঈশম বলল, বড়মামি, বড়মামারে দ্যাখতাছি না।