- বইয়ের নামঃ নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি
- লেখকের নামঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি
এক
অনেকটা পথ, রাস্তায় ঝড় বৃষ্টি এবং কিছুটা রাস্তা জল কাদা ভেঙে বারদীর স্টিমারঘাটে তাকে এনে তুলেছিলেন জগদীশ। পথশ্রম লাঘবের জন্য লোকনাথের আশ্রমেও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিলেন। বাল্যভোগের সময় তখনও পার হয়ে যায়নি। জগদীশকে দেখে সেবাইত কুলদাচরণ খুবই পুলকিত—আরে ভুঁইঞামশায়, এদিকে হঠাৎ। এটি কে?
জগদীশ এসব ক্ষেত্রে সে যে তার বড় পুত্র এমন পরিচয় কখনই দেন না। বাবার সঙ্গে গেলে এটা টের পেতে অসুবিধা হয়নি অরণির। আশ্রমেও আসন পেতে দিলে বাবা বলেছিলেন, ঠাকুরের কৃপা, বাল্যভোগ সেরে যাব ভেবেই আশ্রমে এসে উঠেছি। আপনার সব কুশল তো! যাচ্ছি কর্মস্থলে। সামান্য উঁজিয়ে স্টিমার ধরব বলে চলে এলাম। এবারে অরণি মাইনর পাশ করেছে। কাছাকাছি হাইস্কুল কোথায়! তাই নিয়ে যাচ্ছি।
কুলদাচরণ এবং তার লোকজন জগদীশকে খুবই খাতির করল, একটা লোক বালতি করে জল এনে দিয়েছিল, হাত মুখ ধুয়ে বাল্যভোগ সেরে আবার রওনা হওয়া। আশ্রম থেকে ঘাটের দূরত্ব সামান্য। স্টিমারের আওয়াজ আশ্রমে বসে শোনা যায় এমন সে শুনেছে।
বাবা লোকনাথের বাল্যভোগের স্বাদই আলাদা। গোবিন্দভোগ চালের ভাত, এক গণ্ডূষ ঘি এবং সঙ্গে আলু বেগুন কুমড়ো সেদ্ধ। এই দিয়ে সকালের জলযোগ। খুবই পরিতৃপ্ত তারা এবং দু ক্রোশ দুর্গম রাস্তার পথকষ্ট নিমেষে উবে গেলে সে তার বাবার সঙ্গে রওনা হবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিল।
জগদীশ বললেন, তা হলে এবার যাত্রা করা যাক। স্টিমারে ওঠার আগে বাবা লোকনাথের কৃপার বড় দরকার ছিল। তাই উজিয়ে চলে এলাম। স্টিমারে গেলে বেশি সময়ও লাগবে না।
চৌচালা ছোট্ট কুটিরে লোকনাথের অতিকায় ফটোটির সামনে তাঁর প্রণিপাত দেখে সেও লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছিল—দূর দেশে যাচ্ছে, মন তার ভালো ছিল না। সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাতের পর, অরণির মনে হয়েছিল, বাবা লোকনাথই তাকে রক্ষা করবেন।
কর্মস্থলে অবশ্য হেঁটেও যাওয়া যায়—দশক্রোশের মতো পথ। হেমন্তের শেষাশেষি সময়। মাঠ— ঘাট থেকে বর্ষায় জল নেমে গেছে ঠিক, তবে জায়গায় জায়গায় মাঠ ভাঙতে এত বেশি কাদা ভাঙতে হয় যে তাতে তার পক্ষে সুস্থ শরীরে পৌঁছানো সম্ভব কিনা এমন ভাবতেই পারেন জগদীশ। দু ক্রোশের মতো রাস্তা যে করে হোক পার হয়ে স্টিমারে ওঠার সময় সে বুঝেছিল, বাবার কর্মস্থলে পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে।
সারা রাস্তায় বাবা তাকে এত বেশি বুঝ প্রবোধ দিয়েছেন যে সে মাঝে মাঝে বিরক্ত না হয়ে পারেনি।
যেমন বাড়ি থেকে নেমে সে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে ছিল।
বাবা বললেন, পেছনে তাকাতে নেই। হোঁচট খাবে।
তখন সে দেখেছিল পুকুরপাড়ে মা তোতন নীলু ফুলু ছোটকাকা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে যতক্ষণ দেখা যায় সবাই তাকে দেখবে। খেজুর গাছের নিচে তারা শুধু দাঁড়িয়ে নেই, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যে কাঁদবে, কিংবা সবারই অশ্রুপাতের কথা ভেবে সে বিষণ্ণ হয়ে না যায় সেই ছিল আতঙ্ক। জল— কাদায় তাকে হেঁটে যেতে হবে। আর মাস দু এক আগে হলে সোজা নৌকায় সে তার বাবার কর্মস্থলে চলে যেতে পারত। কিন্তু মা মনস্থির করতে পারেননি। মামার বাড়ি রেখে পড়ানো যায় যদি—এবং বেশি দূরও না, ক্রোশ দুই রাস্তা পার হতে হয়। পুষ্পতারা হাইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়ারও কথা হয়েছিল।
তবে বাবার মনঃপূত নয়। পুষ্পতারা স্কুলের রেজাল্ট মোটেই সুবিধের না। সেদিক থেকে ভবনাথ হাইস্কুলের বিশেষ সুনাম আছে। স্থানীয় জমিদারদের আনুকূল্যে স্কুলটি চলে। স্কুলে ফুটবল খেলার মাঠ পর্যন্ত আছে। এসব বিষয়ে বাবার পরামর্শ দেবার লোকের অভাব নাই। তিনি জমিদারদের এক শরিকের কাছারি বাড়িতে থাকেন। আদায়পত্র সব তারই জিম্মায়। বিশ্বস্ত খুব।
হাফপ্যান্ট হাফশার্ট গায় সে বারবার বাবার পেছনে পড়ে যাচ্ছিল। টিনের স্যুটকেসটি বাবার হাতে। ছোটকাকা সঙ্গে আসতে চেয়েছিলেন, বাবা রাজি হননি। কতটুকু রাস্তা, আমরা ঠিক চলে যাব। তোকে সঙ্গে আর যেতে হবে না।
আসলে বাবার বোধ হয় ধারণা, ছোটকাকা সঙ্গে থাকলে স্টিমারে ফের আর একটা সিন তৈরি হবে। ছোটকাকা ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকলে সে রেলিং থেকে কিছুতেই সরে যাবে না। তার ফের অশ্রুপাত শুরু হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই বাবা খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলেন, এতদূরে সে শেষ পর্যন্ত যেতে রাজি হবে কি না। এক গ্রীষ্মের বন্ধে কিংবা পূজার বন্ধে সে শুধু আসতে পারবে। এতদিন বাড়ি ছাড়া হয়ে থাকার কষ্ট ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে।
কিছুটা হেঁটে এসেই সে দেখেছিল, সে আগে, বাবা তাকে এগিয়ে দিয়ে পেছনে তিনি আসছেন। সে আর পেছন ফিরে তাকাতেও সাহস পায়নি।
রাস্তা যে খুবই দুর্গম—সে বল্লভদির মাঠে নেমেই বুঝতে পেরেছিল। পায়ে তার রবারের জুতো। গাঁয়ের ভেতর দিয়ে কিছুটা হেঁটে একটা সাঁকোর সামনে দাঁড়ালেন বাবা। তার যে কী হয়েছে, কিছুতেই বাবার সঙ্গে হেঁটে পারছে না। কিছুটা গিয়েই তিনি তার জন্য অপেক্ষা করছেন। গাঁয়ের লোকজন বাবার যে খুবই পরিচিত তাও সে টের পেল। এত সকালে তাকে নিয়ে তিনি কোথায় যাচ্ছেন এমন কথাবার্তা শুনেও বাবার সেই এক কথা, অরুকে নিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে থাকবে। ওখানকার স্কুলে ভর্তি করে দেব।
সাঁকোর ঠিক নিচে এসে জগদীশ বলেছিলেন, জুতো খুলে নাও অরু। আমরা সোজা সাঁকো পার হয়ে যাচ্ছি না। আমরা যাব দক্ষিণে। সোজা গেলে দনদির বাজার পড়বে। আরও দূরে নদীর পাড়ে প্রভাকরদি। গঞ্জ মতো জায়গা। ওখানে মেলা পাটের আড়ত আছে। একটা বড় সাঁকো আছে। বড় হলে সবই জানতে পারবে। আমরা এবার মাঠে নেমে যাব। কিছুটা রাস্তা জলকাদা ভাঙতে হবে।
অরণি সাঁকোর উঁচু জায়গা থেকে খালের পাড়ে দৌড়ে নেমে গিয়েছিল। ঘাস পাতায় ঢাকা রাস্তা, তারপর আরও নিচে ধানখেতের লম্বা আল পড়েছে দেখতে পেল। এই আলের রাস্তায় নওঁগা পর্যন্ত হেঁটে না গেলে সড়কে ওঠা যাবে না। সকালের দিকে ঠান্ডার আমেজ থাকে। সূর্য উঠে গেছে। ঘাসে শিশির পড়ে আছে। ধানের জমিগুলো হলুদ রঙের—যতদূর চোখ যায় মনে হয়েছিল হেমন্তের মাঠ বড় নিরিবিলি।
অবশ্য আলের রাস্তায় বকের মতো পা ফেলে কিছুটা হেঁটে আসতেই দেখতে পেল— সামনের জমি সব উঁচু। রাস্তায় জলকাদাও নেই—দু—পাশের জমিতে কলাই সর্ষে বুনে দেওয়া হয়েছে। কীটপতঙ্গের আওয়াজও উঠছিল, দূরে একটি নদী আছে টের পেল—এবং এটা যে ছাগলবামনি নদী অরণি জানে। নদীর পাড় ধরে হেঁটে গেলে পায়ের কাদা ধুয়ে আবার জুতো পরে নেওয়া যেত, কিন্তু জগদীশ তাকে নিয়ে সেদিকে গেলেনই না। সোজা সামনে তিনি বেশ দ্রুত পায়েই হেঁটে যাচ্ছেন, এবং দম ফেলতে না ফেলতেই ফের সেই কাদাজল ভাঙা—ধানজমির মাঠ উঁচুনিচু হয়ে আছে—সামনের দিগন্ত প্রসারিত মাঠের শেষ দিকটায় বাবা আঙুল তুলে বললেন, আর ঘণ্টাখানেকের পথ, ওখানে আমাদের শেষ সাঁকোটি পার হতে হবে। নদীর জলে ইচ্ছে করলে পা ধুয়ে নিতে পারবে।
তারপর হাঁটতে হাঁটতেই বলেছিলেন, বারদীর আশ্রমে আমাদের একটু তাড়াতাড়ি উঠে যাওয়া দরকার। আশ্রমের বাল্যভোগ প্রসাদ পা চালিয়ে না হাঁটলে পাবে না। বাল্যভোগ তুমি খেয়েছ, তবে স্মৃতিতে সে অমৃতস্বাদের কথা মনে নাও থাকতে পারে। একবার তোমাদের সবাইকে নিয়ে জ্যৈষ্ঠমাসে বাবা লোকনাথের উৎসবে এসেছিলাম—তোমার কি মনে পড়ে।
অরণির কিছুই মনে নেই।
সে বলেছিল, কবে?
তখন তুমি খুবই ছোট। তোমার মা মানত করেছিল, আশ্রমে মিসরি বাতাসা ভোগ দেবে। তোমার ঠাকুমা তখন বেঁচে।
অরণি আর কোনও কথাই বলছিল না। কারণ ঠাকুমার কোনও স্মৃতি তার মনে নেই। আর সে ভেবে পাচ্ছিল না, বাবা তার সঙ্গে আজ এত কথা কেন বলছিলেন!
যেমন জমির কথা।
যেমন ঋতুর কথা।
যেমন এই মাঠ এবং গ্রামগুলো সম্পর্কে শোনা কথা।
জগদীশ বলেই চলেছেন, আশেপাশের গ্রামগুলোর নামে অদ্ভুত মিল আছে। যেমন ধরো আমরা বল্লভদি পার হয়ে এলাম—পূর্বে গেলে সুলতানসাদি, দক্ষিণে গেলে বাণেশ্বরদি, বারদি, হামচাদি, দামোদরদি। সব গ্রামের শেষে ‘দি’ শব্দটি আছে। আসলে ওটা ‘দি’ হবে না। ‘ডিহি’ হবে। জলা দেশ, আমাদের পূর্বপুরুষরা এই জলা দেশে মাটি ভরাট করে বাড়িঘর বানিয়েছিলেন। দেখবে সবার বাড়ির সামনেই একটা করে পুকুর আছে। মাটি তুলে নেওয়ার প্রয়োজনেই পুকুর কাটতে হয়েছে। মাটি তুলে ডিহি তৈরি করে বসতবাড়ি গড়া হয়েছে। যত উত্তরে যাবে সব ‘দি’। ব্রাহ্মণনদী, মনোহরদি, গোপালদি, নরসিংদি। তোমার পায়ে কি লাগল!
না বাবা!
বসে পড়লে কেন! অরণি দেখেছে বাবা তাকে গুরুত্বপূর্ণ কথায় কখনো সখনো তুমি বলে, আবার কখনো তুইতোকারিও করেন। আজ বাবা একটু বেশি মাত্রায় তুমি তুমি করছেন। অরণি পা থেকে জড়ানো কিছু যেন তুলে নিচ্ছে। বোধ হয় লতাপাতা কিছু জলকাদা ভাঙতে গিয়ে পায়ে জড়িয়ে গেছে।
জলা জায়গায় পোকামাকড়ের উপদ্রব এমনিতেই বেশি মাত্রায়। যদি জোঁকের উপদ্রবে পড়ে যায় অরু—জগদীশ নুয়ে দেখলেন, শ্যাওলা জাতীয় কিছু পায়ে আটকে গেছে। কাদা শুকিয়ে যাওয়ায় পায়ের গোড়ালিতে টান ধরে যেতে পারে। হাঁটতে অস্বস্তি হতে পারে। প্রায় হাঁটুর কাছেও কাদার দাগ। তিনি বললেন, আর বেশি দূর না। এবারে আমরা নওগাঁর সড়কে উঠে যাব। নওগাঁর শচীন ডাক্তারের কথা মনে আছে?
অরণি বলল, আছে। সোম শুক্র সাইকেলে আমাদের বাড়ি যেতেন।
তা হলে মনে করতে পারছ। দীর্ঘদিন কালাজ্বরে ভুগে ভুগে বড়ই রুগণ হয়ে পড়েছিলে। তোমার গায়ের রঙও পুড়ে গিয়েছিল—আমরা তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। ভাগ্যিস শচীন যুদ্ধফেরত সোজা দেশে চলে এসেছিল—তা না হলে কী যে হত! খবর পাঠাতেই সোজা এসে দেখে গেল তোমাকে। নওগাঁতেই তার বাড়ি।
আমার সবই মনে আছে বাবা। তিনি আমাকে ব্রহ্মচারী ইনজেকসান দিতেন। সপ্তাহে দু—বার।
ঠাকুরের কৃপায়, আর শচীন ডাক্তারের হাতযশে সেবারে তুমি আরোগ্য লাভ করলে। শচীন কিন্তু পাশ করা ডাক্তার না। আর পাশ করা ডাক্তার পাওয়াই যে কঠিন। দশ পনেরো ক্রোশের মধ্যে একজনও নেই। পাঁচদোনার মল্লিক বাড়ির ছেলে অমিয় শুনেছি কলকাতা থেকে এল এম এফ পাশ করে এসেছে। খুবই বড় ডাক্তার। তবে সে গাঁয়ে বসছে না। শহরেই ডিসপেনসারি খুলেছে। শচীনই আমাদের ব্রহ্মা বলো বিষ্ণু বলো, মহেশ্বরও বলতে পারো—একমাত্র পরিত্রাতা। তোমার এত বড় কঠিন অসুখ সেই নিরাময় করে তুলল। সামনে যে গাছপালা দেখা যাচ্ছে, সেখানেই শচীন থাকে। গ্রামটি খুবই বর্ধিষ্ণু। গাঁয়ে একটি পোস্টাফিসও আছে। তবে পাকা বাড়ি নেই। কষ্ট না করলে কেষ্ট পাওয়া যায় না। বারদী গাঁয়ে ঢুকলেই পাকা বাড়ি কেমন হয় বুঝতে পারবে। এই অঞ্চলে একমাত্র বারদী গ্রামেই চৈতন্য নাগের প্রাসাদতুল্য কোঠাবাড়ি আছে—স্টিমারঘাটে যাওয়ার রাস্তায় দেখতে পাবে। আর একটু কষ্ট করে পা চালিয়ে হাঁটো। সড়কে উঠে গেলে আর জলকাদা ভাঙতে হবে না।
অরু অবশ্য বলতে পারত তার মামাবাড়ির দেশে পাকাবাড়ি কেমন হয় সে দেখেছে। তবে সে কিছুই বলল না। দু ক্রোশ রাস্তায় এই সাঁকোটি পার হলেও সড়কে উঠে যাওয়া যাবে। জগদীশ হাতের পুঁটুলি এবং টিনের বাক্সটি নদীর পাড়ে রেখে ঘাটে নেমে গেলেন। অরু তার বাবার পিছু পিছু নামছে। কাঠের গুঁড়ি ফেলে অস্থায়ী ঘাট। গাঁয়ের মানুষজনের ভিড় আছে ঘাটে। জগদীশকে এলাকার লোক সবিশেষ চেনে। ব্রাহ্মণই শুধু নন, তিনি গোস্বামী বংশের সন্তান। তাঁর পিতাঠাকুরকে এলাকার লোক এক ডাকে চেনে। তাঁকে দেখে স্ত্রী—পুরুষ নির্বিশেষে ঘাট থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল।
জগদীশ সবার কুশল নিতে নিতে ঘাটে নেমে যাচ্ছিলেন। পুত্রেরও পরিচয় দিয়ে তারা যে স্টিমার ধরার জন্য রওনা হয়েছেন, রাস্তায় বাবা লোকনাথের আশ্রমে বাল্যভোগ গ্রহণের পর আবার রওনা হবেন, নদীর জলে নামার আগে সেই প্রসঙ্গেই নানা কথা বলছিলেন।
নদীর জল খুবই স্বচ্ছ। জলে স্রোত আছে। নিজে এক গণ্ডূষ জল খেলেন। কারণ রাস্তায় যত্রতত্র আহার এবং জলপান নিষিদ্ধ। তা—ছাড়া পুকুর কিংবা নদীর জলই তৃষ্ণা নিবারণের একমাত্র উপায়। যদিও জগদীশের পিতাঠাকুর তাঁর বাড়িতে একটি ইঁদারা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। যে দুটি গ্রামের উপর দিয়ে এলেন, সেখানে একটিমাত্র সরকারি টিউকল—ইউনিয়ন বোর্ড থেকে করা। তবে কলটির হাতল চুরি যাওয়ায় দীর্ঘকাল অব্যবহারে পড়ে থেকে থেকে বাকিটুকুও অদৃশ্য হবার অপেক্ষায় আছে।
জগদীশ পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন, রাস্তায় আহার এবং জলপানের সমস্যা আছে। পুঁটুলির মধ্যে একটি হলুদ রঙের তরমুজের সাইজ বাঙ্গি আছে। কৌটায় ঝোলা গুড়। স্টিমারে আহারের সুবন্দোবস্ত থাকলেও তাঁর এবং অরুর পক্ষে সেসব স্পর্শ করলে বিধর্মীর কাজ হবে। জাতপাতের বিচার জগদীশের মধ্যে একটু বেশি মাত্রাতেই আছে।
অরণি জগদীশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার যথেষ্ট জল তেষ্টা, অথচ খাওয়া উচিত অনুচিত প্রশ্নে সে গণ্ডূষ করে জল খেতে পারছিল না।
জগদীশেরও জল তেষ্টা পেয়েছে। তিনি গণ্ডূষ করে জল খাবার আগে বলেছিলেন, নদীর জলে কোনও দোষ থাকে না। পতিত পাবনি গঙ্গারই শাখা—প্রশাখা সব। সবাই সাগরের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। তুমি নির্মল চিত্তে জল পান করতে পারো। নদীর জলে কোনও দোষ থাকে না।
অরু বাবা লোকনাথের আশ্রম থেকে নেমে বলল, চৈতন্যনাগের বাড়ি পার হয়ে গেলেই কি স্টিমারঘাট?
জগদীশ বললেন, না। চৈতন্যনাগ নদীর ধারেই বাড়ি করেছিলেন, কিন্তু কীর্তিনাশা নদীটি বর্ষায় কখন কোন পাড় ভেঙে ধেয়ে চলবে কেউ জানে না। নদীর পাড়ে বাড়ি করে চৈতন্যনাগ এই এক সমস্যায় ভুগছিলেন। বাবা লোকনাথই অভয় দিয়েছিলেন, আমি যদ্দিন আছি, তোর গৃহনাশের ভয় নেই। নদী যতই উত্তাল হোক, তোর বাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে সাহস পাবে না।
অরু বাবা লোকনাথের অনেক অলৌকিক কাহিনী শুনেছে। কেমন আশ্চর্য মুগ্ধতা এই সব অলৌকিক বিস্তারের মধ্যে থেকে যায়। বাবা লোকনাথের ব্রহ্মবাক্যে অভিশপ্ত খ্যাপা নদীটি তার উত্তাল তরঙ্গমালা নিয়ে শেষ পর্যন্ত খাত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। নদীটি দেখার ইচ্ছা যেমন প্রবল হতে থাকে তেমনি যে প্রাসাদটি চার পুরুষ ধরে অক্ষত থেকে গেছে, সেটি দেখার বাসনাও তার কম নয়।
লোকনাথের আশ্রম থেকে নেমেই একটি বড় মাঠ পার হতে হয়। আজ হাটবার নয়। হাটবার মানুষের ভিড়ে হাঁটা যায় না। মাঠে গোরু মোষ চরে বেড়াচ্ছে। অঞ্চলে বারদীর হাট বিখ্যাত। নদীর পাড়ে হাটের দিন দু মাল্লা তিন মাল্লা নৌকার ভিড় হয়। যে দিনের যে সবজি, আনারসের নৌকা, তালের নৌকা, হাড়িপাতিলের নৌকা, করলা ঝিঙেও বাদ যায় না—নদীর পাড়ে অজস্র নৌকার ভিড়—দূরদেশ থেকে মানুষজন সওদা করতে আসে নৌকায়—বর্ষাকালে জায়গাটা একটা গঞ্জের মতো হয়ে যায়, পাটের নৌকাও নিয়ে আসে ব্যাপারীরা—তবে অরণি আশ্চর্য হল, লোকনাথের মন্দির সংলগ্ন যে নদীটি আছে, তার বিস্তার তো নেই—ই বরং কিছুটা যেন আবদ্ধ জলার মতো। কচুরিপানায় ঠাসা—হাঁটু জল ভেঙে এ—পাড় ও—পাড় করা যায়। এটা যে মূলনদী থেকে কোনও শাখা বের হয়ে বাবা লোকনাথের চরণ ছুঁয়ে চলে গেছে বুঝতে কষ্ট হয় না। এই জলাদেশটা এতসব নদীনালার ঘোরপ্যাঁচে পড়ে আছে সে তার বাবার কর্মস্থলে না গেলে যেন জানতে পারত না।
অরু এই প্রথম দূরদেশে যাচ্ছে। পাকাবাড়ি কিংবা প্রাসাদ দেখার অভিজ্ঞতা তার নেই বললেই চলে। তবে মামাবাড়ি গেলে চৌধুরীদের পাকাবাড়ি সে দেখেছে। সামনে দিঘি আছে একটা। দিঘির পাড়ে মন্দিরও আছে। মামাবাড়ির দেশটা এজন্য তার কাছে একটি বিশেষ রহস্যময় দেশ। সাদারঙের পাকাবাড়ি, ঘাট বাঁধানো দিঘি, সবুজ ঘাসের মাঠ বাড়ি—সংলগ্ন, সবই তার কাছে অসীম কৌতূহলের বিষয়। মামাবাড়িতে গেলে দিঘির ঘাটলায় বসে থাকলে কেমন সে অন্য গ্রহের মানুষ হয়ে যেত। কেউ এসে তার হাত ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলে সে কেমন মুহ্যমান হয়ে যেত। ঘরের পর ঘর, ছাদে রঙিন কাচের ঝালর, এবং কিছু তৈলচিত্র, সুন্দর প্রতিমার মতো দেখতে মেয়েরা তাকে আদর করে অন্দরে নিয়ে গেলে সবাই হইচই বাধিয়ে দিত। ও মা দ্যাখো এসে কাকে নিয়ে এসেছি! বাসনাদির ছেলেটা না চুপচাপ আমাদের ঘাটলায় একা বসেছিল!
বাড়িটায় ঢুকলেই মনে হত চারপাশে যেন সাজানো গোছানো সবকিছু। শান বাঁধানো মেঝে চক চক করছে। খালি পায়ে হাঁটলে ঠান্ডায় পা কেমন শির শির করত। বারদী গ্রামটায় ঢুকে বুঝল, শুধু পর পর পাকাবাড়ি, তারপর দু—মাথা সমান উঁচু পাঁচিল কতদূর চলে গেছে! পাঁচিলের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্যাঁতলা ধরা দেয়াল, টিন—কাঠের বাড়িঘরও চোখে পড়ল। রাস্তাটা গ্রামের ভেতর দিয়ে গেছে বলে সে সবই দেখতে পাচ্ছে। তার বাবাকে এই এলাকার মানুষজনও যে চেনে, এতে তার কিছুটা অহঙ্কার হচ্ছিল। বাবার সঙ্গে এত লোকের পরিচয় আছে সে জানতই না। বাবাকে সে এমনিতেই সমীহ করে, বাবার সঙ্গে বের হয়ে দূরদেশে যাবার সময় মনে হল বাবা তার একজন মুসাফির। তিনি এই সব গ্রাম মাঠ ভ্রমণ শেষে নদীর শেষ প্রান্তে গিয়ে শেষে তাঁর কর্মস্থলে উঠেছেন।
জগদীশ বলল, শোনা যায় চৈতন্যনাগের পিতাঠাকুর বিখ্যাত ডাকাত সর্দার ছিলেন। মেঘনা নদীতে তার লোকজন, নৌবহর, ছিপনৌকা, সবই মজুত থাকত। পঞ্চাশটা বৈঠায় নৌকা নদীর উপরে উড়ে যেত। এখন আর সেই ছিপ নৌকাও নেই, ডাকাতিও কেউ করে না। চৈতন্যনাগের বংশধরদেরও পাত্তা নেই। তারা শহরে বাড়িঘর বানিয়ে থাকে। এমন অজ পাড়াগাঁতে কার পড়ে থাকতে ইচ্ছে হয় বল!
শহরে সব পাকাবাড়ি না বাবা?
সব কেন হবে। সব কি কখনও পাকাবাড়ি হয়? সবার হাতে এত পয়সা কোথায়। গরিব মানুষজনেরও তো অভাব নেই শহরে।
অরণি জানে বাবাকে বাবুদের মামলা মোকদ্দমার তদারকি করতে প্রায়ই শহরে যেতে হয়। বাবা শহরে রাত্রিবাসও করেন। সেই বাবার সঙ্গে সে হেঁটে যাচ্ছে। সোজা কথা!
শহরের পাকা রাস্তায় আপনি কখনও হেঁটে গেছেন।
হ্যাঁ গেছি, কেন?
আমি একবার আপনার সঙ্গে যাব।
যাবে। বড় হও।
আচ্ছা বাবা মদনগঞ্জে পাকা রাস্তা আছে?
আছে। হরিহরবাবুর প্রাসাদের সামনের কিছুটা রাস্তা পাকা। ঠিক পাকা বলা যায় না, আসলে নদী পাড় না ভাঙে, সেজন্য নদীর ধারের কিছুটা এলাকা বাঁধিয়ে দিয়েছেন বাবুরা। গেলে সবই দেখতে পাবে।
মদনগঞ্জে কি সব পাকাবাড়ি।
গেলেই দেখতে পাবে।
বাবুদের বাড়ির প্রাসাদে পরী ওড়ে নাকি?
জগদীশ হেসে ফেলেছিলেন।
ওড়ে। যে যেমন দেখে অরু।
তারপরই মোক্ষম কথাটা বলে ফেলল অরু।
আমি আবার কবে ফিরব? মাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়।
জগদীশ বললেন, ঐ দেখ নদী। স্টিমারঘাটে লোকজন জড়ো হচ্ছে। মানুষতো এক জায়গায় থাকে না, তাকে স্থানান্তরে যেতেই হয়। তাড়াতাড়ি ভর্তি করে না দিতে পারলে একটা বছর নষ্ট হবে। মাসখানেক বাদেই এনুয়েল পরীক্ষা। ক্ষিতিমোহনবাবু তো বললেন, ভর্তি করে দিন ভুঁইঞামশায়। ছেলের একটা বছর নষ্ট করবেন কেন। পড়াশোনায় ভালো যখন ঠিক পাশ করে যাবে।
পরীক্ষা হয়ে গেলে আমি কিন্তু চলে আসব।
জগদীশ অগত্যা বললেন, ঠিক আছে পরীক্ষা দাও। কাউকে না হয় তোমার সঙ্গে পাঠাব। আমার তো সময় হবে না, দেখি কাকে পাঠাতে পারি।
অরু তখনই দেখতে পেল সেই নদী—মেঘনা। পারাপারহীন হয়ে আছে নদী—ও—পাড় দেখা যায় না। অনন্ত জলরাশি ছাড়া সামনে যেন কিছু নেই। এদিকটায় নদীর চড়া পড়ায় স্টিমারঘাট দূরে সরে গেছে। বাবা লোকনাথের অভ্রান্ত নির্দেশে নদী আর এদিকটায় এগোতে সাহস পায়নি। চড়ার জমিতে চাষ—আবাদও হচ্ছে।
তারা আল ধরে দ্রুত হাঁটছিল।
জমিতে লতার মতো গাছ বাড়ছে।
জগদীশ বললেন, এগুলো সব পটলের জমি। এগুলো সব পটলের লতা।
জগদীশ যেতে যেতে পুত্রকে রাস্তায় দু—পাশের মাঠঘাট চেনাচ্ছিলেন। কিছু যাযাবর পাখিও উড়ে এসেছে—চড়ার যেদিকটায় এখনও জোয়ারের সময় জলে ডুবে যায়, সেখানে চাষ—আবাদ নেই। কিন্তু হাজার হাজার পাখির ওড়াউড়ি আছে।
যাযাবর পাখিরা যে হিমালয় পার হয়ে উষ্ণতার জন্য এ—দেশে চলে আসে, এবং শীতের শেষে আবার সাইবেরিয়ায় উড়ে যায় যেতে যেতে জগদীশ পুত্রকে তাও জানালেন।
অরু তার গ্রাম মাঠ চেনে। তাদের গ্রামে কোনও পাকাবাড়ি নেই। তাদের গাঁয়ে কেন, কাছাকাছি কোনও গাঁয়েই পাকাবাড়ি নেই। সেতো ছোট কাকার সঙ্গে বাজার হাট করতে দু—এক ক্রোশ কখনও হেঁটে গেছে, বর্ষাকালে নৌকায় বাজার হাট করতে যাওয়ারও মজা কম না।
কিন্তু সে কোনও গাঁয়েই পাকাবাড়ি দেখেনি। কেবল দনদির বাজার পার হয়ে লাধুর চরের দিকে যাবার রাস্তায় একটি ছোট্ট মিনা করা শান বাঁধানো মসজিদ দেখেছে। কাচ হতে পারে, অথবা অন্য কিছুও হতে পারে। রোদ উঠলে মসজিদের মিনার এমন সোনালি রঙ ধরে যে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। গাঁয়ের সব বাড়িঘরই হয় টিন কাঠের, না হয় মুলিবাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি। মাটির ভিটে। গরিব মানুষেরা খড়ের ঘরে থাকে—ছোট ছোট কুটিরের মতো লাগে দেখতে।
এই গাছপালার মধ্যে, নদীনালার পাড়ে পাড়ে অবিশ্রান্ত এই নিবাস তৈরি করে বসবাসের মধ্যে মানুষের আশ্চর্য এক মোহ তৈরি হয়ে যায়। অরু হাঁটে।
যেদিকে চোখ যায়, এখন শুধু ধু ধু বালি রাশি। সে চড়া পার হয়ে যায় বাবার সঙ্গে। অদূরেই সেই বিশাল অশ্বত্থ গাছ, তার নিচে স্টিমারঘাটের স্টেশনবাবুর আটচালা বাড়ি। চা সিগারেট বিড়ির দোকান, একদিকে একটা কুঁড়েঘরে একজন সাধুবাবা ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন। স্টিমারযাত্রীদের ভিড়। সবই অতি দেহাতি মানুষ। মাথায় বোচকা। কাঁধে ঝোলানো কাস্তে এবং মাথলা। পরনে লুঙ্গি, ফতুয়া গায়। তারা উজানে ধান কাটতে বর্ষায় বের হয়ে গেছে, হেমন্তের শেষাশেষি দেশে ফিরছে। কিছু বাবুমতো মানুষ, তাদের পরিবার যাত্রীনিবাসের, বাঁশের মাচানে বসে আছে। কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে কিছুটা হেঁটে যেতে হবে। চিরপরিচিত পৃথিবী তার, এখানটায় এসে যেন একেবারেই হারিয়ে গেছে।
সে বারবারই মুখ তুলে বাবাকে দেখছে।
জগদীশ বললেন, নারাণগঞ্জ থেকে স্টিমারটা ছাড়ে। উদ্ধবগঞ্জ, বৈদ্যেরবাজার হয়ে বারদীর ঘাটে এসে ভিড়বে। বেলা দেখে সময়ের আন্দাজ করতে হয়। তবে জগদীশ জানে, দশটার মধ্যেই স্টিমার ঘাটে ভিড়বে।
এখানটায় নদী খুব চওড়া, এবং বাঁক আছে বলে, ঠিক বেলতলির মুখে না এলে স্টিমার দেখা যায় না। সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে, ঐ বুঝি আসছে, ঐ বুঝি দেখা যায়। জগদীশ বুঝতে পারছেন না—ঠিক কতটা আর দেরি। তার পকেট ঘড়িটা সময় ঠিক দিচ্ছিল না, নারায়ণগঞ্জে সুধাকরের ঘড়ি মেরামতের দোকানে দিয়ে এসেছিল, ফেরত আনা হয়ে ওঠেনি। সেখানে যেতে হলেও যে স্টিমারে যেতে হয়—যেতে আসতে একটা দিন কাবার হয়ে যায়। মামলা মোকদ্দমা উপলক্ষেই যাওয়া এতদূর, তবে যে হেঁটে যাওয়া যায় না তাও নয়, শীত কিংবা গ্রীষ্মে হেঁটেই যেতে হয়। প্রায় পনেরো ক্রোশের মতো রাস্তা হেঁটে শুধু ঘড়ি মেরামতের খবর নেওয়াও কঠিন।
অগত্যা পাশের ভদ্রলোকটিকে বলতেই হল, বাবুমশায়, কটা বাজে?
লোকটি পকেট থেকে ঘড়ি বের না করেই বলল, দশটা বেজে গেছে। মনে হয় লেট আছে।
ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়তে পারে, চড়ায় আটকে যেতে পারে। কতরকমের দুর্দৈবই যে যাত্রাপথের অপেক্ষায় থাকে। জগদীশ অগত্যা অশ্বত্থ গাছের গুঁড়িতে বসে পড়লেন। পাশে অরু দাঁড়িয়ে আছে। সে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। হাওয়ায় নদীতে বড় বড় ঢেউ—পাখিরা উড়ছে, ফিঙে পাখির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে নদীর উপর দিয়ে। কাক চিলও উড়ছে। ঢেউ—এর মাথায় ভেসে বেড়াচ্ছে বালিহাঁস—বাজপাখিরাও উড়ে উড়ে নদীর জলে শিকারের খোঁজে আছে। পাটাতনটা লম্বা হয়ে চলে গেছে বেশ দূরে—পাটাতনের নিচে বেদেদের নৌকাগুলি বাঁধা। ঢেউএ খুবই দুলছিল।
গাদাবোটও কম নেই। জেলে ডিঙ্গি সব মাছ নদীতে জাল ফেলে বসে আসে। অদূরে নদীর ঘাটে দুটো কেরায়া নৌকা লগি পুঁতে অপেক্ষা করছে। যাত্রী পেলেই বোধ হয় ঘাট থেকে নৌকা ছেড়ে দেবে। আর যতদূর চোখ যায় শুধু জল, আর কাশের জঙ্গল নদীর বুকে জেগে ওঠা চরগুলিতে। আশ্চর্য এক রূপকথার দেশে যেন অরু ঢুকে যাচ্ছে।
তখনই জগদীশ ডাকলেন, অরু আয়। স্টিমার আসছে।
অরু বেলতলির ঘাটের দিকে তাকাল—না কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সে শুনেছে, সাদারঙের স্টিমারটা অনেক দূর থেকেই দেখা যায়। কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে স্টিমারের বিন্দুমাত্র চিহ্ন দেখতে পেল না।
সে বলল, কোথায়?
আসছে। চলো এগিয়ে থাকি।
এগিয়ে থাকি বলতে জগদীশ অরুকে কোথায় যেতে বলছেন বুঝতে পারল না।
সে দেখল বাবা তার আর কোনও কথা না বলে পাটাতনের দিকে হেঁটে যাচ্ছেন।
সে এবার যেন কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলল, কোথায় স্টিমার?
বাবা বললেন, শব্দ শুনতে পাচ্ছ না। গুমগুম আওয়াজ। কান পাতলেই শোনা যায়। তোমার স্টিমার আসছে।
দুই
বাবার হাতে ফুল—তোলা টিনের স্যুটকেস, বগলে পুঁটুলি—তিনি পাটাতনের শেষ মাথায় প্রায় চলে গেছেন—সেও দৌড়তে পারত, কিন্তু কোথায় স্টিমার, গুমগুম আওয়াজও শুনতে পাচ্ছে না, সে দাঁড়িয়েই আছে। সারাটা রাস্তা বাবা কিছুতেই স্যুটকেসটা তার হাতে দেননি—এমনকি বোঁচকাটিও নয়, সে কি এতই ছেলেমানুষ! এই সব ভেবেই তার এত রাগ হচ্ছিল যে, স্টিমার না দেখে যেন এক পা—ও নড়বে না সে। আর বাবা কেন যে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তাও সে বুঝতে পারছে না। স্টিমারটা কি তাদের ফেলে চলে যেতে পারে!
বাবা ডাকছেন, অরু আয়, দাঁড়িয়ে থাকিস না। আগে উঠতে না পারলে বসার ভালো জায়গা পাবি না। কতদূর আমাদের যেতে হবে!
তখনই সাদা রঙের স্টিমার নদীর বাঁকে ঢুকে গেছে। ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। ক্রমে স্টিমারটা এগিয়ে আসছে। কী বিশাল, যেন নদীর জল তোলপাড় করে সিটি বাজাতে বাজাতে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছে—নদীর পাড়ে এসে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছিল। নৌকাগুলি দুলছিল—নদীর দু’পাড় জলময় হয়ে যেতে যেতে কখন যে স্টিমার থেকে সিঁড়ি নেমে গেল, তাও যেন অরুণ খেয়াল নেই। কেমন এক বিস্ময় তার মধ্যে নিয়ত খেলা করে বেড়াচ্ছিল।
হঠাৎ সে দেখল বাবা তার কাছে ছুটে এসেছেন।
কী হল! আয়।
অরু বুঝল তাকে যে স্টিমারে উঠে আরও অনেক দূরে চলে যেতে হবে—যেন মনেই নেই। যেন নদীর পাড়ে সে বেড়াতে এসেছিল, কোথাও যাবার কথা ছিল না তার, স্টিমার দেখে সে বাড়ি ফিরে যাবে—বাবা এসে তার হাত ধরে টানতেই তার খেয়াল হল সে পাটাতনের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীরা সব উঠে যাচ্ছে সিঁড়ি ধরে, সে তাড়াতাড়ি বাবার হাত ছাড়িয়ে দৌড়তে থাকল। আর স্টিমারে উঠে যাত্রীদের ভিড় ঠেলে সিঁড়ি ধরে আপার—ডেকে উঠে গেল। রেলিং—এ ঝোলানো সাদা রঙের গোল গোল লাইফবয়া পরম কৌতূহলে সে দেখছে।
বাবাকে দেখেই প্রশ্ন, এগুলো কী!
পরে সব জানতে পারবে। আগে আমার সঙ্গে এসো। জাহাজের সারেঙসাবের সঙ্গে দেখা করে আসি। তিনি তোমাকে দেখতে চেয়েছেন। সুলতানসাদির বাজারের কাছে এককালে তাঁর বাড়ি ছিল। তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি শুনেই বললেন, কর্তারে নিয়া আসেন, দেখি। আশরাফ মিঞার নাম নিশ্চয়ই শুনেছ।
আশরাফ মিঞার নাম সে কখনোই শোনেনি। সে জানে বাবার এই স্বভাব, যে—মানুষ এতবড় স্টিমারটা চালিয়ে নিয়ে যায়, তার নাম না জানলে হবে কেন! ঝড়জলে কিংবা প্লাবনে, অথবা জলের ঘূর্ণি যার এত চেনা, সে মানুষটার নাম না জানা খুবই অন্যায়, এমনও মনে হল বাবার মুখ দেখে। তা ছাড়া মানুষটা যখন তাদের এলাকার মানুষ।
সে ডেক—ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। এটা যে স্টিমারের নিষিদ্ধ এলাকা, তার জানা নেই। পাশের ঘরটা হুইল রুম। একটা লোক সেখানে দাঁড়িয়ে চাকার মতো দেখতে জিনিসটাকে ডাইনে—বাঁয়ে ঘোরাচ্ছে। রঙ—বার্নিশের গন্ধ উঠছে। দু’পাড়ে নদীর চড়া, সামনে নদীর জল, মাথার ওপর আকাশ দিগন্ত প্রসারিত যেন। গাছপালা, নদীর তীর এবং সামনের জলরাশি—সব মিলে তাকে কিছুটা কেন জানি উন্মনা করে দিয়েছে। জায়গাটা ছেড়ে চলে যেতে তার ইচ্ছে হচ্ছে না।
জগদীশ বললেন, কী হল, এসো! দাঁড়িয়ে থাকলে কেন?
এখন আমার যেতে ইচ্ছে করছে না বাবা।
তাঁর সঙ্গে তোমার দেখা করা উচিত। তাঁরই স্টিমারে তুমি যাচ্ছ, আমি তো সব সময় তোমার স্কুলের ছুটিছাটায় সঙ্গে আসতে পারব না। আশরাফের স্টিমারে উঠিয়ে দিলে, সে—ই তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। আমাদের এলাকার লোক, সবাই তাকে চেনে।
আমার ভালো লাগছে না বাবা।
কেন ভালো লাগছে না! কী হয়েছে? মোয়ামুড়ি আছে, খিদে পেলে খেতে পারো।
ভালো না লাগারই কথা। বাড়ি ছেড়ে এই প্রথম দূরদেশে যাচ্ছে। বাড়ির কাছাকাছি কোনও হাইস্কুল নেই বলেই, তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া। মন খারাপ হতেই পারে। বাড়িতে তার জননীও কান্নাকাটি করেছে আসার সময়।
আসলে অরুর মনে হচ্ছিল, সেই নির্বাসিত দেশে সে যাচ্ছে। সেখানে কে আছে জানে না, যতক্ষণ দেখা যায়। এই দু’পাড়ের মানুষজন ছেড়ে গেলেই যেন সেই নির্বাসিত দেশটায় ঢুকে যাবে। যতক্ষণ পারা যায়, দেখা। ঘরবাড়ি, মানুষের পদচিহ্ন এত আগ্রহ সৃষ্টি করে, সে জীবনেও টের পায়নি!
সে রেলিং—এ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে।
স্টিমারটা গতি পেয়ে গেছে—দু’পাশের চাকাদুটো ঘুরছিল—কেমন ঝমঝম শব্দ। তার কাছে সবকিছুই একটা নতুন গ্রহের মতো। পরনে হাফপ্যান্ট, হাফশার্ট গায়, মাথার চুল উড়ছিল, সে জানেই না বাবা তার পাশে এখনও দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে যতদূর চোখ যায় দেখা, এবং যখন টের পেল বাবা তাকে নিয়ে যাবেনই, সে বলল, ওটা কী বাবা?
ওটা নবাব ঈশাখাঁর কেল্লা। এখন ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। এই কেল্লা থেকেই নবাব, চাঁদ রায় কেদার রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
নবাব ঈশাখাঁর নাম সে জানে। চাঁদ রায় যাত্রাপালায় নবাব ঈশাখাঁ, সোনাই এবং সেই ঝলমলে তরবারিটির কথাও তার কেন জানি এ সময় মনে পড়ল। কেন যে এসব মনে পড়ে তার! তার নিজের বাড়িঘর, পুকুর, গোপাট, পুকুরপাড়ের অতিকায় তেঁতুলগাছটিও তার চোখে ভেসে উঠল। বাড়িতে ভাইবোনেরা, দাদা বাড়ি নেই বলে কিছুটা ছন্নছাড়া, সে বোঝে। ছোটকাকা হয়তো এখন বিগ্রহের সেবায় ঠাকুরঘরে ঢুকে গেছেন। মা বিগ্রহের পূজার আয়োজনে ব্যস্ত। কাকিমা রান্নাঘরে। হালের বলদ দুটিকে বিধুদা খড় কেটে দিচ্ছে। বৈঠকখানা ফাঁকা। তার পড়ার টেবিল—চেয়ার ফাঁকা। বই, খাতাপত্র কিছুই পড়ে নেই। গৃহশিক্ষক সমতুল সার ছুটিতে দেশে গেছেন। ফিরে এলে তিনি একাই রাতে বৈঠকখানায় শোবেন। মাথার কাছে একটা হারিকেন জ্বলবে। বাড়ি থেকে কেউ চলে গেলে কতটা ফাঁকা লাগে গৃহশিক্ষক ফিরে এলে ঠিক টের পাবেন। সে রাতে বৈঠকখানায় শুত। একটা তক্তপোশে সমতুল সার। পাশের তক্তপোশে সে। সামনের জানলা খুলে দিলে গরমেও ঠান্ডা হাওয়া উঠে আসত গোপাট থেকে।
এখন থেকে সমতুল সার তার ভাই—বোনদের নিয়ে তক্তপোশেই হয়তো গোল হয়ে বসবেন। মাইনর স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক সমতুল সার তাদের বাড়িতেই থাকেন, খান। তাদের পড়াশোনার সব দায়িত্ব তাঁর। সে নেই। সে আর সন্ধ্যায় হারিকেন জ্বেলে বৈঠকখানায় সারের সামনে গিয়ে পড়ার জন্য বসতে পারবে না।
স্টিমারে উঠে এই সব অতি—তুচ্ছ ঘটনাই এত বেশি তাকে পীড়া দিচ্ছে যে সে আশরাফ মিঞার সঙ্গে দেখা করার কোনও উৎসাহই পাচ্ছে না।
আশরাফ মিঞা কখন তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে টের পায়নি। বাবা তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই গেলি না, আশরাফ নিজেই উঠে এসেছে।
আপনারা এখানে!
অরু আর কী করে!
সে নদীর দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারল না। বাবার সেই অসামান্য মানুষটি তাদের খোঁজে ডেক—ছাদে চলে এসেছে। সে পেছন ফিরে তাকাতেই আশরাফ বলল, কী—গ কর্তা, মন ব্যাজার কেন এত! মানুষ কি কখনও এক জায়গায় থাকে! পড়ালিখা করতে যাচ্ছেন, কত সুখবর বোঝেন না! ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়? বড় হয়েছেন না!
অরু দেখল, লুঙ্গি পরে ফতুয়া—গায়ে লোকটি প্রায় আত্মীয়ের মতো কথা বলছে। তাকে আশ্বস্ত করছে, বাড়ির খবর ইচ্ছে করলে রোজই পেয়ে যাবেন। মা—র জন্য মন খারাপ করবেন না। রোজ না পারি, এক—দু’দিন অন্তর বাড়ির খবর দিয়ে আসব। আসেন আমার সঙ্গে। স্টিমারটা ঘুরে দ্যাখেন—কত মজা আছে ইঞ্জিন—ঘরে ঢুকলে বুঝতে পারবেন।
আশরাফ তাকে নিয়ে আপার ডেক থেকে লোয়ার ডেকে নেমে গেল। জগদীশ সঙ্গে গেলেন না—আশরাফ দেশের লোক, সে নদীতে স্টিমার চালায় বলে কর্মস্থল যেতে আসতে নানা সুবিধাও থাকে। আশরাফের সঙ্গে তাঁর খুবই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক—একটাই মুশকিল, আশরাফের আদর—আপ্যায়ন একটু বেশি মাত্রায়—যেমন সে আলাদা বন্দোবস্ত করে জগদীশকে খাওয়াতে চায়। লস্করদের একজন জগদীশের স্বজাতি—সেই আসন পেতে চিঁড়ে—মুড়ি অথবা দই দিয়ে ফলারের বন্দোবস্ত করে দেয়। এতে জগদীশ যে খুবই বিব্রত বোধ করেন, আশরাফ কিছুতেই বুঝতে চায় না। স্টিমারে আশরাফের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার এই একটা বিড়ম্বনা আছে। যাত্রীবোঝাই স্টিমারটিতে পা ফেলার জায়গা থাকে না। যে যেখানে পারছে আসন পেতে বসে থাকে। দূরের যাত্রীরা বিছানাপত্রও তুলে আনে। তিনি একা থাকলে আশরাফের কেবিনের দিকে সহজে পা মাড়ান না। যতটা পারেন আশরাফকে এড়িয়ে চলেন।
কিন্তু এবারে কী যে মনে হল তাঁর, অরুকে নিয়ে যাচ্ছেন, আশরাফের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা খুবই জরুরি। এই ভেবেই তিনি লোয়ার ডেক ধরে ইঞ্জিন—রুম পার হয়ে কেবিনে ঢুকে গেছিলেন। অরু তখন দৌড়ে কোথায় যে সিঁড়ি ধরে উঠে গিয়েছিল!
পরে ডেক—ছাদে খুঁজে পেলে তাকে নিয়ে যেতে চাইলেন, অথচ অরু কিছুতেই গা করল না। আশরাফ মনে মনে কী না ভাবল!
তিনি আর ডেক—ছাদ থেকে নামলেন না। আসন পেতে বসে থাকলেন। জায়গাটি নিষিদ্ধ এলাকা হলেও তার এখানে বসে থাকতে অসুবিধা হয় না। হুইল—ঘরের লোকটিও জানে কর্তার সঙ্গে আশরাফ সারেঙের দোস্তি আছে।
পাঁচুডাঙ্গার পাশ দিয়ে স্টিমার যাচ্ছে। এখানকার পাটালি গুড়ের সুখ্যাতি আছে খুব। আশরাফ মাঝে মাঝে তার কাছারিবাড়িতে পাটালি গুড়ও ভালো পেলে দিয়ে আসে। এমনকি স্টিমার ছাড়তে দেরি থাকলে আশরাফ তাঁর সঙ্গে কাছারিবাড়িতে দেখা করেও যায়। সেই আশরাফ এখনও ফিরছে না অরুকে নিয়ে। স্টিমারে বসে থাকলে ঘরবাড়ি, গাছপালা, মানুষজন কেমন আলগা হয়ে যায়, মাঝে মাঝে মনে হয় সম্পর্ক সব শিথিল হয়ে যাচ্ছে, উদাস লাগে। তিনি নিজেও তখন ভালো থাকেন না।
তিনি জানেন, অরুর অজস্র কৌতূহল, একবার যদি আশরাফের আশকারা পেয়ে যায়, তবে তাকেই হয়তো শেষ পর্যন্ত নিচে নেমে যেতে হবে অরুকে খুঁজতে। কাছারিবাড়ি পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে, আহারের বন্দোবস্ত বলতে চিঁড়াগুড়, কিছু মুড়কি এবং মোয়া জলে ভিজিয়ে খাওয়া। রাতে কখন পাত পড়বে, যদিও বড় শরিকের তরফের বউঠান জানেন, অরু আসছে। শুধু বউঠান কেন, বড় শরিক দেবকুমারবাবুর অনুমতি না পেলে তিনি অরুকে নিয়ে সেখানে তুলতে পারতেন না। তিনিই আশ্বাস দিয়েছেন, দেশে পড়ার বন্দোবস্ত করতে না পারো এখানে নিয়ে চলে এসো। তোমার সঙ্গেই না—হয় থাকবে। থাকা—খাওয়ার যখন কোনও অসুবিধা নেই, তুমি এত সঙ্কোচ করছ কেন, জগদীশ বুঝছি না।
নদী এখানে তার কিছুটা বিস্তার হারিয়েছে।
দু’পাড়ের গ্রাম মাঠ ঘরবাড়ি ফেলে স্টিমার এগিয়ে যাচ্ছে।
গোপালদির ঘাটে কিছু যাত্রী নামিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে, স্টিমারে ভিড় এখন বেশ হালকা। এরপর আসমানদির চরে যাত্রী নেমে যাবে। নবিনগর পার হলেই আর ঘণ্টাখানেকের পথ। এই নদীনালায় বেষ্টিত দেশটির জন্য জগদীশ খুবই গর্ববোধ করেন। অরুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যাত্রা করেছিলেন, দুশ্চিন্তাও আছে, অরুর শেষ পর্যন্ত মন টিকলে হয়! তবে আশরাফের জিম্মায় চলে যাওয়ায় তিনি যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত। যেমন একবার অরু ডেকে গেল, বাবা, আশরাফ চাচা গোপালদির ঘাট থেকে দই—মিষ্টি আনিয়েছে। অরুর সঙ্গে উদ্ধবও হাজির। কলাপাতায় দই চিঁড়া মুড়ি সযত্নে রেখে বলেছে, আপনি খেতে বসেন কর্তা। বেলা তো পড়ে আসছে। ইস, আশরাফ যে কী করে! মোয়া মুড়ি চিঁড়া সবই অরুর মা পুঁটুলিতে দিয়েছে। কী যে করে না আশরাফ!
কে শোনে কার কথা! আশরাফও ওপরে উঠে এসেছে। তার কাজ—কাম মেলা জাহাজে। ইচ্ছে করলেই সে সব সময় হাজির থাকতে পারে না। জগদীশ কিছু বলতেও পারেন না। ডেক—ছাদে আসন পেতে ফলার খাওয়ার মজাও কম না। অরু খেয়েছে কি না জানে না। আশরাফ সামনে হাজির। অরুকে জিজ্ঞেসও করতে পারছে না সে খেয়েছে কি না। বললে যেন আশরাফকে ছোট করা হবে।
জগদীশ গণ্ডূষ করে কলাপাতার চারপাশে জল ছিটিয়ে দেওয়ার সময় বললেন, তোমাদের খাওয়া হয়ে গেছে আশরাফ!
কর্তা আহারপর্বটি আপনার সারা না—হলে মুখে দানাপানি দিই কী করে।
জগদীশ বললেন, এই ভয়েই তোমার স্টিমারে উঠি না আশরাফ। উঠলেও গা ঢাকা দিয়ে থাকি। দশ ক্রোশ হেঁটেই ছুটি পেলে দেশে চলে যাই। কাজ—কাম ফেলে আমাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লে চলে!
আপনি খান তো!
অরু বলল, ক্ষীরের চমচম দারুণ। পাতক্ষীরও খেয়েছি। হাঁড়িতে কলাপাতায় বেঁধে দিয়েছে বাকিটা।
গোপালদির পাতক্ষীরের খ্যাতি আছে খুব। ক্ষীরের চমচমেরও। আশরাফ অরুকে এমন সুস্বাদু খাবার না খাইয়ে ছাড়ে কী করে! শুধু খাইয়েই তৃপ্তি নেই তার, সঙ্গে ক্ষীরের চমচম, পাতক্ষীর হাঁড়িতে আলাদা কলাপাতায় বেঁধে দিয়েছে। গোপালদির ঘাটে স্টিমার ভিড়ল, অথচ অরুকে তা খাওয়ানো গেল না, আশরাফের মতো মানুষ তা মানতে রাজি না। আশরাফ যে এককালে পিতাঠাকুরের আমলে তাদের বাড়িতেই মানুষ হয়েছে—অরু সে খবরও রাখে না। অনাথ আশরাফ বৈঠকখানায় থাকত, জগদীশ আর সে একই সঙ্গে বড় হয়েছে, আশরাফ তারপর কিছুদিন নিখোঁজ হয়ে থাকল, পিতাঠাকুর বেঁচে থাকতে নিখোঁজ আশরাফ একবার দেখা করেও গেল, কারণ পিতাঠাকুর, আশরাফ না বলে না কয়ে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় বড়ই আন্তরে পড়ে গিয়েছিলেন, খোঁজাখুঁজিও কম হয়নি। শেষে পিতাঠাকুর হাল ছেড়ে দিয়ে একদিন কেন যে বলে ফেললেন, বেইমান। দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছিলাম। ছোবল মেরে পালিয়েছে।
সেই আশরাফ যখন ফিরে এল তখন তাকে চেনাই যায় না। বাবরি চুল, পাজামা পাঞ্জাবি পরনে, পায়ে রাবারের জুতো, বাড়ি ঢুকেই হাঁকডাক, জ্যাঠাবাবা। কোথায়! অরু তখন হয়নি। সবে জগদীশের বিয়ে দিয়েছেন, কল্যাণীকে বালিকাই বলা চলে, একজন অপরিচিত লোকের ভেতর বাড়িতে ঢুকে যাওয়ায়, কিছুটা কল্যাণী বিরক্তও হয়নি বলা যায় না, সেই ডেকে বলেছিল, বাবা একটা লোক উঠোনে দাঁড়িয়ে কাকে জ্যাঠাবাবা জ্যাঠাবাবা করছে।
পিতাঠাকুর ঠাকুরঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখতেই, কেমন আহ্লাদে পূজা—আর্চার কথা ভুলে বাইরে বের হয়ে বলেছিলেন, তুই, তুই আশরাফ না।
জি!
জি তোমার বের করছি। বেরো বাড়ি থেকে। বেরো—বলছি। বলা নেই কওয়া নেই, চলে গেলি! তুই কিরে।
তারপর যা হয়, পিতাঠাকুর কেঁদে ফেলেছিলেন, ঠাকুর তুমি আমার মুখ রক্ষা করেছ। আশরাফ আবার ফিরে এসেছে।
জগদীশের জননী পুকুরঘাট থেকে ছুটে এসেছিলেন, আশরাফ ফিরে এসেছে। তারপর যা হয়, আশরাফের উপর কড়া হুকুম জারি হয়ে গিয়েছিল, বাড়ি থেকে না বলে কয়ে বের হলে ঠ্যাঙ ভেঙে দেওয়া হবে।
আশরাফ হাসতে হাসতে বলেছিল, জ্যাঠাবাবা আমার কাজ ফেলে থাকি কী করে। বাড়ি থেকে বের হতে না দিলে আমার মনিব মানবে কেন! কিছু একটা করে খেতে হবে বলেই বের হয়ে গেছি। লসকরের কাজ নিয়েছি জানতে পারলে তখনই যে খড়মপেটা করতেন। আমার কী দোষ বলেন!
আশরাফের কাজ হয়েছে শুনে পিতাঠাকুর কিছুক্ষণ গুম মেরে বসেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, এলি যখন, দুটো দিন থেকে যা। তুই না থাকায় বাড়িটা আমার কত খালি হয়ে গেছে বুঝবি না আশরাফ!
আশরাফ জ্যাঠাবাবার কথা ফেলে কী করে! সে থেকে গেল। পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরল, পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে গেল, দোয়া ভিক্ষা করল, এবং সে যে একসময় বাড়ির ভালোমন্দের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল, বাড়িটা ঘুরে ঘুরে সব ঠিক আছে কিনা দেখতে গিয়ে না বলে পারল না, ঘাটের জামগাছটা নেই কেন?
ঝড়ে পড়ে গেছে।
গোপাটের জমিতে তামাকপাতার চাষ বন্ধ কেন?
কে করবে! কে এত খাটবে।
বাগানের সব বাঁশ দেখছি সাফ হয়ে গেছে।
বিক্রি করে দেওয়া হল। অজন্মার বছরে বাঁশ আর রাখা গেল না। সংসার চলবে কী করে! খাব কী দিয়ে!
পুকুরপাড়ের কয়েতবেল গাছটাও নেই?
সেবার প্লাবন হল, জলে ডুবে গেল পুকুরপাড়। গাছটা মরে গেল।
আশরাফ যে বাড়িরই একজন, হম্বিতম্বি করতে ছাড়ল না। বিধুভূষণকে বলল, বিধু তুই যখন তখন গামছা পেতে শুয়ে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাস, গোরুর খোঁটা পালটাস না, তোকে রেখে হবেটা কী!
জগদীশের সবই মনে পড়ছিল—কিঞ্চিৎ ম্রিয়মাণ তিনি। তবু কেন যে তাঁর মুখে সামান্য হাসি ফুটে উঠল। কোথাকার আশরাফ এককালে তাদের বাড়ি এসে উঠেছিল, সেই আশরাফ স্টিমার চালিয়ে নদী ধরে কতদূরে চলে যায়, বন্দরের কাছে নদীর পাড়ে বাড়িও করেছে, আশরাফের সংসার হয়ে যাওয়ায় সে আর দু ক্রোশ হেঁটে বারদীতে নেমে তাঁর বাড়ির সঙ্গে কোনোই যোগাযোগ রাখতে পারে না—দেখা হলে আপ্যায়নের শেষ থাকে না—বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় অথবা তিনি দু ক্রোশ রাস্তা ধরে অরুকে নিয়ে যে হেঁটে এলেন, একবারও কেন যে আশরাফের কথা মনে হয়নি ভেবেই হেসে দিয়েছেন। ম্রিয়মাণ হাসি—আশরাফ ঠিকই বলেছে, এক জায়গায় কেউ থাকে না।
অরু হয়তো নিজের মতো একদিন তার পৃথিবীটাকে খুঁজে নেবে। বাড়ির সঙ্গে সেও তার নাড়ির সম্পর্ক হারিয়ে ফেলতে পারে। স্টিমারে সে যে তাঁর সঙ্গে দূরদেশে যাচ্ছে কে বলবে? সারাটা দিন স্টিমারের এ—মাথা ও—মাথায় দৌড়াচ্ছে। লাফালাফিরও শেষ নেই। রেলিং—এ ভর দিয়ে সিঁড়ি ধরে আপার—ডেকে উঠে গেছে। আবার লোয়ার—ডেকে নেমে গেছে। তার বাবা স্টিমারে আছে, না তাকে ফেলে নেমে গেছে, নেমে যেতেই পারেন, ভুলভাল তো মানুষেরই হয়, অরুর সে ব্যাপারে কোনোই ভ্রূক্ষেপ নেই। জগদীশ অরুকে নিয়ে যতটা দুশ্চিন্তায় ছিলেন এমনকি, হাঁটাপথে তাকে যতটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, এখন দেখলে মনে হয় না সে ক্লান্ত। আশরাফ কিছুতেই অরুকে তার কেবিনে নিয়ে যেতে পারেনি। কেবিনের বাঙ্কে ইচ্ছে করলেই গড়াগড়ি দিতে পারত, অন্তত আর কিছু না হোক, অরুর বিশ্রাম হত কিছুটা, অরু ওর কেবিনে ঢুকেছে, বাঙ্কে শুয়ে ঘুমিয়ে নিতে বললে, সে আবার লাফিয়ে বের হয়ে এসেছে। কখনও বিশাল চিমনিটার পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছে চুপচাপ, অথবা ইঞ্জিন রুমে যে লোকটা কয়লা মারছিল বয়লারে তার বলিষ্ঠ শরীর এবং আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে লোকটা, সোজা কথা—সে কিছুতেই তার পাশ থেকে সরে আসতে চাইছিল না।
একসময় মদনগঞ্জ ঘাটও চোখে ভেসে উঠল দূর থেকে।
সেখানে একটিমাত্র থামের উপর বড় গ্যাসবাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়। রাতে সেই গ্যাসবাতির আলোতে স্টিমারটা চিনতে পারে, কাছে এসে গেছে মদনগঞ্জের ঘাট।
নদীর দু—পাড়ে অন্ধকারে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। কোথাও কুপির আলো, কোথাও বা হারিকেনের আলো। মদনগঞ্জের সড়ক ধরে মানুষজন যে হেঁটে যাচ্ছে বোঝা যায়। লোকজন রাস্তায় বের হলে সঙ্গে হয় টর্চবাতি, না হয় হারিকেন হাতে রাখে। অন্ধকারে গাছপালার ছায়ায় রাস্তার কিছুই দেখা যায় না। সড়কের সুরকির রাস্তা বড়ই এবড়োখেবড়ো। বাবুদের প্রাসাদ এখনও চোখে পড়ছে না—স্টিমার তার গতি কমিয়ে দিয়েছে। এতক্ষণ পুবের দিকে মুখ ছিল স্টিমারের এখন তার মুখ উত্তরদিকে ঘুরে গেছে। শান বাঁধানো নদীর পাড়ে স্টিমারটা এবার ভিড়বে।
আলোগুলো জ্বালিয়ে দিতেই মনে হল জগদীশের একটা জ্যান্ত শহর হয়ে গেছে যেন স্টিমারটা। উজ্জ্বল আলোর নিচে যাত্রীরা তাদের লটবহর গুছিয়ে নিচ্ছে। অরু যে কোথায়! এবার তো নামতে হবে।
তিনি ব্যস্ত হয়ে অরুকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিলেন। আশরাফ বোধহয় নোঙরের ঘরে ঢুকে গেছে। তার দায় মেলা। সে যে কেবিনে নেই জগদীশ জানেন। আর তা ছাড়া আশরাফ খুবই ব্যস্ত মানুষ, তাকে অরু সম্পর্কে কোনও কথা বলতেও সঙ্কোচ হচ্ছিল। স্টিমারের এদিকটায় মুরগির মাংসের গন্ধ উঠছে। স্টিমারে উঠলে তার কেন জানি গন্ধটা সহ্য হয় না। লোয়ার ডেকের শেষ দিকটায় তিনি সেজন্য কখনই যান না। ইলিশ মাছের ঝোল ভাত প্লেটে করে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। কোনওরকমে নাকে রুমাল দিয়ে কিচেনের দিকটা পার হয়ে গেলেন। যদি কৌতূহল বশে অরু গেরাফি ফেলার ঘরটার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। না সেখানেও নেই। কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন—তারপর না পেরে ফরোয়ার্ড পিকে উঠে গেলেন। যেখানটায় স্টিমারের সার্চলাইট নদীর জল ঘেঁষে দূরে চলে গেছে, অবাক হয়ে দেখলেন, সার্চলাইটের ঠিক নিচে অরু দাঁড়িয়ে আছে। নদীর বুকে আলো পড়ে যে রহস্য তৈরি হয়েছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাই দেখছে অরু।
এই উজ্জ্বল আলোর উৎস অরু জীবনেও প্রত্যক্ষ করেনি। সার্চলাইটের আলোতে নদীর পাড়, গাছপালার সব যেন ভেসে যাচ্ছে। অজস্র পাখি ওড়াউড়ি করছিল এবং কোথাও কোনও গাছের ডাল থেকে একঝাঁক বাদুড় উড়ে গিয়ে ঘুরে ঘুরে গাছটা প্রদক্ষিণ করছে। ইঞ্জিন বন্ধ করে দেওয়ায় বাদুড়ের কিচমিচ শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল। ঘাটে মানুষের ভিড়। আলোতে সব কিছু এত বেশি উদ্ভাসিত হয়ে আছে যে অরু নড়তে পারছিল না।
এই অরু!
হুঁ।
চল, আমাদের নামতে হবে।
অরু যেন কিছুটা ঘোরে পড়ে গেছে। সে দাঁড়িয়েই আছে।
জগদীশ বোঝেন, জীবনের এই সব নতুন অভিজ্ঞতায় অরু কিছুটা বোধহয় ধন্দে পড়ে গেছে। সে ভাবতে পারে এমন আশ্চর্য এক গ্রহের খোঁজ স্টিমারে না এলে পেত না।
জগদীশ টের পেল গেরাফি নেমে যাচ্ছে। গড় গড় করে অতিকায় গেরাফিটা জলের অতলে নেমে যাচ্ছে। মোটা রশি দিয়ে পাটাতনের থামের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হচ্ছে স্টিমারটিকে। যাত্রীদের ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। অরুর কিছুতেই হুঁশ ফিরে আসছে না যেন!
সবাই নেমে যাচ্ছে। অরু বলল।
আমরা নামব! হ্যাঁ। এতক্ষণ কী বলছি তোমাকে।
অরুর মধ্যে আবার সেই বিষণ্ণতা, সে যেন কিছুতেই উৎসাহ পাচ্ছে না। প্রায় জোর করেই ধরে নিয়ে যাচ্ছেন জগদীশ, আশরাফকে এই সময় খোঁজা অর্থহীন—কোনওরকমে নেমে যাওয়া দরকার। টিনের স্যুটকেস, মিষ্টির হাঁড়ি এক হাতে, অন্য হাতে অরুকে ধরে রেখেছেন। পাড়ে লেগে গেলে স্টিমারটা দুলে উঠল। জগদীশ নিজেকে সামলে, অরুকে সামলে নেমে যাচ্ছেন, তখনই দেখলেন আশরাফ ছুটে আসছে। অরুকে বলল, সাবধানে নামবেন। বাবার কথা শোনবেন। বাড়ি ছেড়ে বিদেশ—বিভুঁইয়ে পড়াশোনা করতে চলে এলেন—তারপর বড় হয়ে দূরদেশে যখন যাবেন, আমারে সঙ্গে নিবেন, মন খারাপ করলে চলে! কেউ তো এক জায়গায় থাকে না।
অরু কিছু না বলে শুধু হাত তুলে দিল।
তিন
নদীর ঘাটে নেমে জগদীশ বললেন, পা চালিয়ে এসো। আর বেশি দূর না। সামনেই আমবাগান, সেখানে আমি থাকি। ঐ যে দেখছ, টিনে কাঠের ঘর। দেখতে পাচ্ছ, অন্ধকার হয়ে আছে বলে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আর একটু এগুলেই দেখতে পাবে। বাবুদের সবাইকে মান্য করবে। আমি ওদের কাছারি বাড়িতে থাকি। মেলা দাদা দিদি আছে তোমার। তারা যেন তোমার ব্যবহারে কোনও কারণেই ক্ষুণ্ণ না হয়। কাল দশটায় স্কুলে যাবে। গুরুপদবাবু তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। গুরুপদবাবু স্কুলের হেডমাস্টারই শুধু নন, তিনি একটি আস্ত বিদ্যার জাহাজ।
অরণি বাবার পেছনে পেছনে সেই টিনকাঠের ঘরটার সামনে উঠে যেতেই বুঝল, জায়গাটা যেন কিছুটা পরিত্যক্ত এলাকা। নিশুতি রাতের মতো নিঝুম হয়ে আছে। সিমেন্ট বাঁধানো উঁচু ভিটি, ঘরে ঢোকার সিঁড়িটিও পাকা—বাবা তখন তালা খুলছেন এবং কথা বলেই যাচ্ছেন, স্কুলে ভর্তি হয়ে যাও। এখানেও তোমার মেলা বন্ধুবান্ধব জুটে যাবে। আর বড়বাবু, ছোটবাবুর মতো মানুষ হয় না। দুই শরিকের মধ্যে রেষারেষি আছে ঠিকই তবে তুমি রেষারেষি যতটা পারো এড়িয়ে চলবে। আপাতত বড়বাবুর পালিতে আছি, সেখানেই আমাদের দু—বেলা আহারের ব্যবস্থা। মাসে মাসে পালি বদল হবে। সে থাকতে থাকতে বুঝে যাবে। আপাতত জামাপ্যান্ট ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে নাও। বলে তিনি দরজা ঠেলে দিলেন। অন্ধকারেই হাতড়ে বের করলেন একটা হারিকেন। আলো জ্বেলে একটা থামের তারকাঁটায় ঝুলিয়ে দিলেন।
ঘরটা যে পার্টিশান করা তাও টের পেল অরু। পাশের দরজা ঠেলে দিতেই চোখে পড়ল, মেলা কাঠের র্যাক, তাতে পুরনো লাল মলাটের সব খাতাপত্র—কেমন একটা অচেনা গন্ধ বের হয়ে আসছে ঘরটা থেকে। একটা বালতি এবং কাঁসার ঘটি ঘর থেকে বের করে দরজা ফের বন্ধ করে বললেন, দু’মিনিট বিশ্রাম করে হাতমুখ ধুয়ে নাও। পাশেই টিউকল। আমার সঙ্গে এসো, বলে হারিকেন তুলে দূরে টিউকলটি দেখালেন। আমি এখুনি আসছি। ভয়ের কিছু নেই। বউঠানকে খবরটা দিয়ে আসি, আমরা এসে গেছি, রাতে খাব। বড়বাবু হয়তো বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছেন, তাঁকেও খবরটা দেওয়া দরকার।
তারপর অরণি দেখল, বাবা অন্ধকারে কোথায় হারিয়ে গেলেন।
সে কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে যে পড়েছে—তার মুখচোখ দেখেই বোঝা যায়। কোথায় কতদূরে সেই বৈঠকখানা—সে ঘর থেকে যে বের হয়ে যাবে তাও পারছে না। বাবা তাকে সঙ্গে নিয়ে গেলে কতটা কি ক্ষতি হত!
সারাদিনের পথশ্রমে সে যে খুবই কাহিল! দরজা খোলা। বাবা সামনের জানালাও খুলে দিয়ে গেছেন। নদী থেকে ঠান্ডা হাওয়া উঠে আসছে। সে তক্তপোশে বসে আছে। তার আর নড়তে ইচ্ছা করছে না। রাতের বেলা একা থাকতে তার এমনিতেই অস্বস্তি হয়। ভয় ভয় করে। অশুভ আত্মাদের ভয়ও আছে তার। সে বেজায় সাহসীও নয়। চারপাশের গাছপালার মধ্যে একটা মাত্র টিনের ঘর, মানুষের কোনও সাড়াশব্দই পাওয়া যাচ্ছে না। দূরে, বহুদূরে স্টিমারটা যে দুকূল জলে ভাসিয়ে চলে যাচ্ছে, তার গুমগুম আওয়াজ কান পাতলে এখনও শোনা যায়। তক্তপোশের নিচে কী আছে সে জানে না, সে দু—পা উঠিয়ে বসল। উঠে গিয়ে যে তারকাঁটার আংটা থেকে হারিকেনটা তুলে এনে তক্তপোশের নিচটা দেখবে তারও যেন সাহস নেই। কীটপতঙ্গের আওয়াজ উঠছে। গাছপালা থেকে পাতা পড়ছে টুপটাপ, এবং অন্ধকার ভেদ করে সেই শব্দমালার মধ্যে কোনও ভূতুড়ে আওয়াজের মতো টিনের চালে অনবরত কেউ যেন করাত চালিয়ে যাচ্ছে।
তার গলা শুকিয়ে উঠছে।
বাবা কতদূরে গেল!
তক্তপোশে হামাগুড়ি দিয়ে জানালার কাছে উঠে গেল। উঁকি দিল—না শুধু নিশীথের জোনাকি ছাড়া আর কিছুই গোচরে আসছে না।
সে ভেবেছিল, জমিদার বাড়ির সংলগ্ন কোনও গৃহে বাবা থাকেন। বাবা দেশে গেলে নিজের থাকা—খাওয়া নিয়ে মাকে মাঝে মাঝে যেসব খবর দিতেন, তাতে সে বুঝতেই পারেনি, বাবাকে এমন একটা পরিত্যক্ত আবাসে থাকতে হয়। বাবা একা ঘরটায় থাকেন, তবে দু—একজন পাইক কি লেঠেল জমিদারদের থাকবে না, হয় কী করে! এ যে একেবারে ন্যাড়া! কাঠের কড়ি বরগার উপর মুলিবাঁশের আচ্ছাদন, এখানে সেখানে ঝুলকালি, কাঠের একটি তাক এবং সেখানে তোষক বালিশ মাদুর—কোনও মৃত মানুষের মুখও তার চোখে যেন ভেসে উঠল। এই বাড়িতে কোনও এক অপমৃত্যুর দিনে বাবা রাতে টের পেয়েছিলেন, টিনের চালের উপর কারা সব নৃত্য করছে। কারণ সে রাতে টিনের চালে ঝম ঝম শব্দ, ঠিক ঝড়বৃষ্টিতে টিনের চালে যেমন শব্দ হয়ে থাকে, বাবা কোনও অশুভ ইঙ্গিত পেয়ে দিশেহারা যে হয়ে গেছিলেন, তাও সে জানে। বাবা আতঙ্কে সে রাতে ঘুমোতে পারেননি।
সকালে উঠেই ছুটে গিয়েছিলেন জমিদার বাড়ির অন্দর মহলে। রাতে যে তাঁর টিনের চালে অশুভ আত্মারা নৃত্য করে গেছে তারও খবর দিলেন। কেমন অমঙ্গলের আভাস পেয়ে দেবকুমারবাবু গুম মেরে গেছিলেন। বিন্দুমাত্র বৃষ্টি না, শিলাবৃষ্টিও না—শকুন উড়ে এসে বসলেই এমন শব্দ হয়ে থাকে—তারপর বাবাকে ইঙ্গিতে বসতে বলেছিলেন।
তুমি ঠিক শুনেছ, টিনের চালে দাপাদাপি হচ্ছে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
বের হয়ে দেখলে না কেন?
আজ্ঞে….
মনে হয় রাতে চালে শকুনের পাল উড়ে এসে বসেছিল। ঠিক আছে, আর কাউকে বলতে যাবে না। এতে গোটা বাড়িটাই ত্রাসে পড়ে যেতে পারে। শনি সত্যনারায়ণের পূজার ব্যবস্থা করো। শান্তি স্বস্ত্যয়ন করা দরকার। কিছুই ভালো বুঝছি না। বাড়িতে কেউ কেউ এভাবে অমঙ্গলের আভাস দিয়ে যায়।
বাবার মুখেই শোনা, বাবুর বড় কন্যাটির মৃত্যুর খবর এসেছিল তার ঠিক এক সপ্তাহের মাথায়। কেরোসিন ঢেলে শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এই পরিবারের এই সব দুর্ঘটনার খবর আগাম কে যে জানিয়ে যায়। ঘরের চালে শকুন উড়ে এসে বসলে এমনিতেই খারাপ লাগে, ভয়েরও কথা, আতঙ্কও কম থাকে না। দিনের বেলাতেই একবার একপাল শকুন উড়ে এসে তাদের কাঁঠাল গাছের মাথায় বসে পড়েছিল—সারা গাঁয়ে হইচই—লোকজন ছুটে এসে গাছের মাথা থেকে শকুন তাড়ানোর দৃশ্যটির কথা তার মনে পড়ছে। শকুন ওড়ে, গাছের মগডালে বসেও থাকে, তবে সবই পরিত্যক্ত এলাকায়, যেমন সিংগিদের পুকুর পাড়ের জংলায় যে বটগাছটা কত যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তার মগডালে সে শকুন বসে থাকতে দেখেছে। প্রভাকরদির বাজারে যাবার রাস্তায় প্রায় একটি জনশূন্য প্রান্তরের গাছটিতে শকুনের বাসা আছে। তবে রাতে সে রাস্তায় কেউ যায় না। বাজার থেকে কেউ ফেরেও না সেই রাস্তায়।
সে ভেতরে ভেতরে ভয়ে যে গুটিয়ে যাচ্ছে টের পেতেই তার মুখ চুন হয়ে গেল।
দরজা খোলা।
সে কোনোরকমে প্রায় টলতে টলতে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
ঠিক তখনই তক্তপোশের নিচে সরসর শব্দ।
ঠিক তখনই টিনের চালে কীসের যেন ঘষ্টানোর শব্দ।
তারপর শো শো আওয়াজ।
জানালাটার কাঠ দুটো ঝোড়ো হাওয়ায় ফসকে গিয়ে পাল্লা দুটো দমাস করে বন্ধ হয়ে গেল, এবং সঙ্গে সঙ্গে আবার খুলেও গেল।
হারিকেনের আলো দপ দপ করে জ্বলছে।
সে ঘামছিল।
হারিকেনটা দুলছে।
কোনও এক প্রাগৈতিহাসিক খণ্ড বিখণ্ড উপদ্রবে সে যে পড়ে যাচ্ছে, সে ঘোলা ঘোলা দেখছে সবকিছু, বাবা তাকে ফেলে এভাবে কোথায় চলে গেলেন—সে যেন মূর্ছা যাবে।
আর তখনই জানালায় এক সুন্দর বালিকার মুখ। বড় বড় ফোঁটায় বোধহয় বৃষ্টি হচ্ছে। বালিকার মুখে বৃষ্টির ফোঁটা লেগে আছে। জানালার গরাদ ধরে কিছুটা উপরে উঠে ডাকছে। এই অরুদা, তোমরা কখন এলে!
সে কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এমন একটি পরিত্যক্ত জায়গায় এতটুকুন একটা মেয়ে একা আসতেই পারে না। ফ্রক গায়, দু বিনুনি চুলে, বোধ হয় বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে, একবারও বলছে না, দরজা খুলে দাও। কেবল জানালায় দাঁড়িয়ে বলছে অরুদা, তোমার ভয় করছে না তো। আমি জানি, একা তুমি ভয় পাবে। থাকতে পারলাম না। সারাদিন নদীর ঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি, কখন তুমি আসবে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কত কিছু যে মনে হয়। আমিতো জানি, স্টিমার সাঁজবেলায় আসে কিন্তু কী যে হয়, সকাল দুপুর যখনই সময় পেয়েছি ছুটে গেছি নদীর পাড়ে। অরুদা আসবে। কাকা যে বলে গেছে, আজ তোমাকে নিয়ে কাকা ফিরবে। তুমি ভয় পাচ্ছো না তো! নতুন জায়গা, ভালো নাই লাগতে পারে। দরজাটা খোলো না। এই কী কথা বলছ না কেন? চোখ গোল করে আমাকে এত দেখছ কেন! আমি বাঘ না ভালুক। দেখছ না বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি, দরজা খুলে দিতে পারছ না!
মেয়েটা ফের বলল, আমার নাম তিথি। ভুইঞা কাকা আমাকে নটসুন্দরী বলে ডাকে। বাজারে আমার বাবা জিলিপি ভাজে। তুমি দরজাটা খুলে দাও না। কেবল আমাকে হাঁ করে দেখছ!
তখনই দূরে টর্চবাতির আলো জ্বলে উঠল।
আর তিথি লাফিয়ে নেমে গেল অন্ধকারে।
কে রে ছুটে পালাচ্ছিস!
তিথি বলল, আমি ছুটে পালাইনি। তাড়াতাড়ি এসো। অরুদা না, আমাকে দেখতে দেখতে কেমন হিম হয়ে গেছে।
জগদীশ প্রায় দৌড়েই দরজার দিকে ছুটে গেলেন। অরুকে একা রেখে যাওয়া ঠিক হয়নি। ঝড় শিলাবৃষ্টি, আকাশ মেঘলা ছিল ঠিক, তবে এতটা ঝড় এবং শিলাবৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে বুঝতে পারেননি। দরজায় এসে ডাকলেন, অরু দরজা খোল। আমরা ভিজে যাচ্ছি।
অরুর কেমন কিছুটা বাহ্যজ্ঞান লোপ হয়ে গেছিল। সে আবার নিজের মধ্যে ফিরে আসছে। দরজা খুলে দিতেই ঠান্ডা হাওয়ায় তার শরীর কিছুটা যেন তাজা হয়ে গেল। তিথিকে দেখে আবার সাহস পেল বোধ হয়। এতটুকুন মেয়ে প্রায় তারই বয়সি, বিন্দুমাত্র ভয়ডর নেই, ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে তাকে দেখবে বলে চলে এসেছে।
সে কিছুটা লজ্জায় পড়ে গেল।
জগদীশ বললেন, তোর কী হয়েছিল?
কিছু না তো।
তবে তিথিকে দরজা খুলে দিসনি কেন। হাতমুখ ধুয়েছিস?
অরু বলল, না।
তিথি বলল, বালতিটা কোথায়?
তিথি বালতি খুঁজতে দরজা ঠেলে পাশের ঘরটায় ঢুকে গেলে জগদীশ বললেন, ওখানে পাবি না, চকির নীচে আছে দ্যাখ।
হেমন্তে যে মাঝে মাঝে এ সময়ে শিলাবৃষ্টি হয় অরু জানে। ঝড়বৃষ্টি দুপদাপ করে এল, দুপদাপ করে আবার চলেও গেল। তিথি বালতি হাতে বের হয়ে গেল, কল থেকে জল টিপে সিঁড়িতে তুলে রাখল। কাঁসারবাটি এগিয়ে দিয়ে বলল, যাও বাইরে। কাকা তুমি আমাকে টর্চটা দাও তো। দরজায় হারিকেন নেওয়া যাবে না, নিভে যাবে। অরুর দিকে তাকিয়ে বলল, বসে থাকলে কেন? হাতমুখ ধুয়ে নাও। খাবে না। সেই কোন সকালে বের হয়েছ!
জগদীশ জানেন, তিথির কথাবার্তায় বেশ পাকামি আছে। তিথি সবাইকে বড় বেশি নিজের ভাবে। কাছারি বাড়ির এক কোণায় মাঠের ঝুপড়িতে থাকে। তিনিই বাবুদের বলে কাঠা দু’এক জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। সেখানে ঝুপড়ি বানিয়ে বছর দশেক হল গৌর ওরফে গোরাচাঁদ উঠে এসেছে। বছরখানেকের বয়স ছিল তখন মেয়েটার। কত তাড়াতাড়ি যে বড় হয়ে গেল।
তিথিকে কিছু বলতে হয় না।
যেমন জগদীশের জামাকাপড় কেচে রাখা, জল তোলা এবং বিছানা করার কাজটিও সে করে দিয়ে যায়। জগদীশ এসব পছন্দ করেন না। তবে তিথি তাকে পাত্তাই দিতে চায় না। সে তার মতো কাজ খুঁজে নেয়—শুধু তারই নয়, বড় তরফের ছোট তরফের সবার হেঁসেলেই তার অবাধ যাতায়াত।
তিথি হামাগুড়ি দিয়ে দড়ি থেকে গামছা তুলে এনে অরণির হাতে দিল।
অরুর ইচ্ছে নয়, মেয়েটা এভাবে তার উপর মাতব্বরি করুক। কেমন বিরক্ত হয়ে বলল, রাখো, আমি নিজেই নিতে পারব।
নিজে নিতে পারবে তো, চুপ করে বসে আছো কেন? কাকাকে জ্বালাতে বুঝি খুব ভালো লাগে! কখন থেকে বলছে, হাতমুখ ধুয়ে নে অরু, জামাপ্যান্ট ছেড়ে ফেল, তোমার কোনও গেরাহ্যি আছে।
অরু বুঝে পেল না, মেয়েটাকে কে এত আশকারা দেয়। সে তাকে চেনেই না, বাবাও তিথির কথা কিছু বলেনি, কিন্তু যেভাবে তার পেছনে লেগেছে, শেষে না জানি কী হয়! তারও রাগ কম না। আর কোথা থেকে উদয়! বাবাকে পর্যন্ত সমীহ করে না। তাঁর সামনেই তাকে হেনস্থা করতে চাইছে।
সে এখানে যতটা জলে পড়ে যাবে ভেবেছিল, তিথিকে দেখে সহসা কেন জানি মনে হল, না তাকে বিশেষ অসুবিধায় পড়তে হবে না। তিথি বড়ই সতর্ক তার ভালো মন্দ নিয়ে। সে কিছুটা নরম হয়ে গেল। বলল, কোথায় থাকিসরে তুই?
কোথায় থাকি, সে দিয়ে কি হবে? দয়া করে তুমি হাতমুখ ধুয়ে নাও। আমি দেখছি বড়গিন্নি কী করছে। তোমাদের খাওয়ার কতদূর। তারপরই বলল, এই নাও পাউটি। খালি পায়ে হাঁটবে না বলে দিলাম।
তিথি দরজা দিয়ে মাঠের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যাবার আগে কোথা থেকে একজোড়া পাউটি বার করে রেখে গেল তার জন্য।
তিথি থাকায় তার জামাপ্যান্ট ছাড়তে লজ্জা হচ্ছিল। কখন আবার উঠে আসবে, কে জানে। সে সিঁড়িতে হাত পা ধুয়ে কাঠের পাউটি পরে ঘরে ঢুকে গেল। ভিজা গামছা দিয়ে গা মুছল, টিনের স্যুটকেস থেকে হাফপ্যান্ট হাফশার্ট বের করে নিল। ছাড়া প্যান্ট সার্ট চকিতে রাখলে জগদীশ বললেন, নিচে ফেলে রাখ। চকিতে রাখলে মেয়েটা চোপা করতে পারে।
বাবা দেখছি মেয়েটার কাছে জব্দ। এমন একটা পুচকে মেয়ের কাছে বাবার এত জব্দ থাকার কী কারণ সে বুঝল না। মনিবের মেয়েও নয়, মনিবের বাড়িতে আশ্রিতই বলা চলে। চকির উপর ছাড়া কাপড় রাখলে মেয়েটা ক্ষুব্ধ হতে পারে। এতটাই জব্দ যে সে জামাপ্যান্ট চকির একপাশে রেখে দিলেও বাবা তা নিয়ে ঘরের এক কোণায় রেখে দিলেন। সে কিছু আর বলতে পারল না। দেয়াল ঘড়িতে আটটা বাজে। তার খিদেও পেয়েছে—সারাদিনে সেই বাবা লোকনাথের আশ্রমে সামান্য বাল্যভোগ ছাড়া পেটে ভাত পড়েনি। ভাত না খেলে সে শরীরে জোর পায় না। তার তিনবেলা ভাত চাই।
সেই অরু বসে আছে, কখন তিথি খবর নিয়ে আসবে। কখন খেতে ডাকবে।
বাবা আয়না চিরুনি তাক থেকে নামিয়ে বললেন, মাথা আঁচড়ে নাও।
এখন দরজাও খোলা।
ঠান্ডা হাওয়ায় অরুর শীত শীত করছে। যেন গায়ে একটা চাদর জড়ালে ভালো লাগত।
সে একসময় না বলে পারল না, চালে ঘসটানো শব্দ হচ্ছিল খুব।
ও হয়। হাওয়া উঠলে হয়। আমগাছের একটা ডাল চালে এসে পড়েছে। হাওয়ায় নড়ে।
টিনের চালের এই দোষ। বৃষ্টি হলে ঝম ঝম শব্দ হয়। আবার শকুন উড়ে এসে বসলেও টের পাওয়া যায়। এমনকি কাক শালিখ চালে এসে উড়ে বসলেও কীরকম মৃদু শব্দ পাওয়া যায়। টালির চাল থাকলে এতটা হয় না। খড়ের চাল থাকলে একদম কিছুই টের পাওয়া যায় না। অরু বাড়ির বৈঠকখানায় থাকে। খড়ের চাল—চৌচালা ঘরটা ঠান্ডা রাখার জন্য খড় দিয়ে ছাওয়া।
নতুন জায়গা, ঘরটার কোনদিকে কী আছে সে কিছুই জানে না। তিথিরা কোনদিকে থাকে তাও না। ঘরে যদি কখনও একা থাকতে হয় তবেই মুশকিল। বাবাকে মাঝে মাঝেই আদায়পত্রে বের হয়ে যেতে হয়। মামলা মোকদ্দমার জন্য শহরে যেতে হয়, তখন এই ঘরটায় কেউ থাকে কিনা সে জানে না। না ঘরটা খালি পড়ে থাকে!
অরণি এসব ভেবে খুব কাতর হয়ে পড়ছিল।
বাবা।
বল।
তুমি না থাকলে রাতে ঘরে কে শোয়?
ঠিক নেই। যার যখন সুবিধা সেই থাকে। রাতে ঘর পাহারা দেবার জন্য মাঝে মাঝে তিথিও এসে শোয়। তোমার কোনও অসুবিধা হবে না।
না তা বলছি না।
দরকারে ওর বাবাও থাকে। হরমোহনও থাকে।
হরমোহন কে বাবা?
বাবুদের পেয়াদা।
ওকে দেখছি না!
আছে। সকাল হোক। সব বুঝতে পারবে, কখন রান্না বাড়ি থেকে তিথি আসে দ্যাখ। তাড়াতাড়ি তোমার শুয়ে পড়া দরকার।
তিথিও শোয়। সে একা শোয়, না আর কেউ সঙ্গে থাকে। তিথি সম্পর্কে সে কোনও প্রশ্ন করতে চায় না। সে যে বড় হয়ে যাচ্ছে বাবা কি টের পান না! বড় হয়ে গেলে তার তো একাই এ ঘরে শোওয়া উচিত। সে থাকলে, অন্য কেউ শুতে আসবেই বা কেন!
তিথি সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন করতেই তার সংকোচ হচ্ছিল।
তখনই তিথি বলল, দেরি হবে। এই নাও, ধরো। জল থাকল। সেজদা শিকারে গেছিলেন। বড় বড় দুটো বালিহাঁস শিকার করে এনেছেন। ছাল—চামড়া ছাড়ানো হচ্ছে।
রেকাবিতে ফুলকো লুচি এবং সন্দেশ। আলাদা রেকাবিতে ভাগ করে তিথি বলল, গিন্নিমা অরুদাকে দেখতে চেয়েছে। খেতে তোমাদের দশটা। এখন এই খেয়ে নিতে বলেছে। তুমি খাও অরুদা। পরে এসে নিয়ে যাব। এত বড় হাঁস। ছাল—চামড়া ছাড়ানো হচ্ছে। তুমি যাবে আমার সঙ্গে!
জগদীশ জানে, মেয়েটার বড় উৎসাহ, সারাক্ষণ পাখি ছাড়ানো দেখবে। বউঠান বঁটি নিয়ে বসলে সে থালাবাসন এগিয়ে দেবে। রান্না বাড়িতে জল বাটনা দেবার লোক থাকলেও গিন্নিমা রান্না নিজের হাতে করেন। বামুনঠাকুর পোষার মতো ক্ষমতা কখনোই ছিল না, মাত্র এক আনার শরিক তা আবার দু—তরফের মধ্যে ভাগ। জমিদারির আয়ও কমে গেছে। আদায়পত্র আগের মতো নেই। তিথি বড় বিশ্বাসী বউঠানের। যতক্ষণ বাড়ির খাওয়া চলবে, কিংবা বউঠানের রান্নার সময় সে ছুটে ছুটে ফুটফরমাস খাটবে। তারপর বউঠান যখন বলবেন, তিথি তুইও আমাদের সঙ্গে বসে যা। খেয়ে নে। তিথির কী আনন্দ তখন।
তিনি এই আশায় আশায় সারাদিন বুঝি ছুটে বেড়ায়। সারাদিন কাজ করার উৎসাহ পায়।
মেজদার সব কথাই অরু জানে। ভালো শিকারি, তুখোড় ফুটবল খেলোয়াড়, ঢাকা শহরে ওয়ারি টিমে হাফ ব্যাকে খেলে। বাবুদের খবর বাড়িতে বসেই সে জেনেছে। যে ক’দিন বাড়ি থাকবেন বাবা, দেবকুমার বাবুর পুত্রদের প্রশংসা। সব সোনার টুকরো ছেলে বাবার ভাষায়। ভুইঞা কাকা বলতে অজ্ঞান। বড় দেখতে ইচ্ছে হত মেজদাকে। বড়দির বিয়ে হয়ে গেছে। সেই বড়দি মরেও গেছে। আর আছে ছোড়দি। সে নাকি অরুরই বয়সি। পরীর মতো দেখতে। সারা বাড়িতে সুঘ্রাণ। রোয়াক ধরে হেঁটে গেলে এক এক ঘরের খাট পালঙ্ক দেখলেই নাকি ভিরমি খেতে হয়। বৈঠকখানায় সব বড় বড় মানুষ সমান ছবি। পেল্লাই সব দরজা জানালা। হরিণের শিং, বাঘের ছাল দেয়ালে, সে সবই বাবার মুখে শুনেছে।
তিথি বলল, কী অরুদা যাবে? হাঁসটার পেটে ডিম ছিল জানো!
পাখির মাংস খুব সুস্বাদু। আজ সেই পাখির মাংস হচ্ছে বাড়িতে। তার খুবই খেতে ইচ্ছে করছিল, তবে তিথির সব আগ বাড়িয়ে বলার স্বভাবের জন্যই যেন বলল, তুই যা। আমি পরে যাব।
পরে আর যাবে কখন? ততক্ষণে মাংস রান্না হয়ে যাবে।
আসলে তিথি চায়, অরু তার সঙ্গে সেই রান্নাবাড়িতে যেন যায়।
কারণ, একটা বালিহাঁসের ছালচামড়া ছাড়ানো হয়নি। হাঁসটা বেঁচে আছে। গুলি লেগে হাঁসটার ডানা ভেঙে গেছে। ধরতে গেলে ঠুকরে দিচ্ছে। মেজদাকে ক্লাবের লোক এসে বৈঠকখানায় ডেকে নিয়ে গেছে। কীসব কথাবার্তা হচ্ছে সে জানে না। ওরা চলে না গেলে পড়ে থাকা হাঁসটার ছালচামড়া ছাড়ানো হচ্ছে না। মেজদা বড় নিষ্ঠুর এই সব কাজে। তখন বাড়ির কেউ বড় একটা কাছে ঘেঁষে না।
মেজদারই বড্ড শিকারের নেশা।
মেজদার উৎসাহে মাঝে মাঝে পাখি শিকার করে আনা হয়।
ক্লাবের ছেলেরা চলে গেলেই মেজদা আবার রান্নাবাড়িতে ঢুকে যাবে। জখমি হাঁসটার ছালচামড়া ছাড়িয়ে দেবে। গিন্নিমার কাজ বঁটি নিয়ে বসা। তার কাজ গিন্নিমাকে সাহায্য করা। সে যে এই বাড়ির লোকজনের কাছে কত প্রিয় অরু তার সঙ্গে গেলে টের পেত।
জগদীশই বলল, যা না। বসে থেকে কী করবি। আমি যাচ্ছি। বউঠান তোকে দেখতে চেয়েছে।
অরু যাও যাবে বলে উঠে দাঁড়িয়েছিল, বাবার কথায় তার উৎসাহে যেন জল ঢেলে দিল। বউঠান তাকে দেখতে চেয়েছেন, সেই বউঠানের সামনে সে নিজে গিয়ে একা হাজির হয় কী করে! বাবা না গেলে তার পক্ষে কোনওভাবেই যাওয়া সম্ভব না। তিথির সঙ্গে তো নয়ই।
এই চলো না অরুদা। এক দৌড়ে চলে যাব। বলে তিথি অরুর হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিল।
ইস কী যে করে না!
কী করেছি তোমাকে! গেলে দেখতে পেতে, কত বড় বালিহাঁস! সেজন্যই তো যেতে বলছি।
কেন যে তাকে হাঁসটাকে দেখানোর এত আগ্রহ তিথির, বুঝতে পারছে না। একটা হাঁসের ছালচামড়া ছাড়ানো হয়ে গেছে, আর একটার ছাড়ানো হয়নি, এখনও পড়ে আছে, আহত হাঁসটাকে দেখাতে না পারলে তিথির যেন নিস্তার নেই। বাবা বাইরে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকেছেন খড়ম পায়ে। গামছায় শরীর মুখ মুছে বোধ হয় আহ্নিকে বসবেন। বাবা যে সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে বসে আহ্নিক সারেন, সকালেও বাবার নদীর জলে প্রাতঃস্নান এবং আহ্নিক সেরে কাছারি বাড়িতে ফিরে আসার স্বভাব সে ভালোই জানে। বাবা বাড়ি গেলে, তার নৈমিত্তিক কাজের বহর সম্পর্কে মাকে বিশদ বর্ণনা দিতে ভালোবাসেন, রাত হয়ে গেছে বলে, হয়তো ঘরেই জপতপ সেরে নেবেন, কিংবা যদি মঠে যান, তাও নদীর পাড়ে। বাবা যে কী করবেন সে বুঝতে পারছে না। আবার যদি তাকে একা ফেলে জপতপের অছিলাতে বাবা বের হয়ে যান তবেই মুশকিল। তখন তিথি সহজেই তাকে কবজা করে ফেলতে পারে।
সে বলল, বাবা তুমি যাবে না?
কোথায়?
এই যে আমাকে নিয়ে যেতে বলল।
ও হ্যাঁ। যাব। তোমাকে দেখার আগ্রহ সবার। বউঠান দু—বার খবরও নিয়েছেন। স্টিমার এত লেট করবে কে জানত!
অরু ফের বলল, তুমি কি আহ্নিকে বসবে!
কেন?
দেরি হয়ে যাবে না।
তিথির সঙ্গে যা না। বলবি, আহ্নিক সেরে আমি যাচ্ছি।
তিথি বলল, হল তো! চলো না অরুদা!
তিথি তার হাত কিছুতেই ছাড়ছে না।
চলো বলছি।
আগে তুই আমার হাত ছাড়।
আমার হাতে কী আগুন আছে? ছুঁলে হাতে কি তোমার ফোসকা পড়বে!
এত আস্পর্ধা হয় কি করে! বাবা কেন যে ধমক দিচ্ছেন না। বাবা তো বলতে পারেন, ঠিক আছে যাবে, হাত ধরা যখন পছন্দ করে না। না ধরলেই পারিস।
জগদীশ খড়ম পায়ে কোথায় আবার বের হয়ে যাচ্ছেন।
অরুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আহ্নিক সেরে আসছি ঘাট থেকে। বেশি দেরি হবে না।
বাবা আর কোনও কথা না বলেই বের হয়ে গেলেন।
তিথির এখন যেন ভারী মজা।
বাবার উপর অরণির ক্ষোভ বাড়ছে। এই অচেনা জায়গায় তার জন্য বাবার যেন কোনও ভাবনা নেই। তার কোনও বিন্দুমাত্র বিপদের আশঙ্কা আছে বলেও বোধ হয় তিনি মনে করেন না।
তিথি এবার গম্ভীর গলায় বলল, কী যাবে? না বসে থাকবে। আমি অত সাধাসাধি করতে পারব না বাপু। একা বসে থাকলে জানো ভূতে ধরে।
কত সহজে তিথি কথাটা বলে ফেলল। তাকে যে ভূতে ধরেছিল তিথি বোধ হয় টের পেয়ে গেছে। সে ঘামছিল, চোখ গোল গোল করে তিথিকে দেখছিল, সে কোনও সাড়া দিতে পারেনি, তিথি জানলায় উঁকি দিয়ে সব টের পেয়েছে।
বাবার খড়মের শব্দও মিলিয়ে গেল।
সে কী করবে বুঝতে পারছে না। যদি তিথি এখন এক লাফে বের হয়ে চলে যায়, যদি বলে ঠিক আছে, ভুইঞা কাকা এলেই যেয়ো, আমি যাচ্ছি। আমার মেলা কাজ। তা হলেই হয়েছে।
তিথি তাকে নিয়ে এখন যে কতরকমের মজা করতে পারে।
তিথির সঙ্গে চলে যাওয়াই ভালো। সে আর এই ঘরটায় একা বসে থাকতে পারবে না। কিছুতেই না। একা থাকলে সত্যি ভূতে ধরে। ভূতের যত ধান্দা রাতে। বিধুখুড়োর কথা। রাতেই তারা ঘুরে বেড়ায়—যত অন্ধকার তত তাদের মজা। সিঙ্গিদের সেই বটগাছটায় যে জোড়া ভূত থাকে, কিংবা খালের পাড়ে সাঁকোর নিচে ভেতো ভূত থাকে, কেবল ভাত চুরি করে খেতে ভালোবাসে বিধু খুড়ো ছাড়া সে খবর কেউ রাখে না। নানাপ্রকারের ভূতের গল্প বিধুখুড়োর পেটে গোলমাল পাকায়। রাতে গোরু—বাছুর গোয়ালে তুলে, বৈঠকখানায় এসে টুলে চিত হয়ে শুয়ে পড়বে, আর গামছা ঘুরিয়ে মশা তাড়ানোর সঙ্গে রাজ্যের যত ভূত এসে তার কাছে হাজির হয়। অরু আর তার ভাইবোন মিলে জপতপ করার মতো বিধুখুড়োর শিয়রে বসে থাকে—তারপর কী হল খুড়ো।
হয়েছে তোদের মাথা। রান্নাঘরে দেখে আয় পাত পাড়তে কত দেরি! তোদের মা কাকিরা সারাদিন কী করে! কখন খাব, কখন ঘুমাব। কত রাত হল টের পাস না।
অরুর তখন এক কথা, তুমি খাও না খাও—আমি একা যেতে পারব না।
রান্নাঘরটা যে তাদের ভেতরের উঠোন পার হয়ে অন্দরের উঠোনের শেষ দিকটায়। ঠিক বাঁশঝাড়ের পাশে। এতটা রাস্তা রাতে জ্যোৎস্না থাকুক, অন্ধকার থাকুক—হারিকেন হাতে থাকুক, টর্চ থাকলেও সে একা যেতে সাহস পায় না। তবু বাড়িতে একরকম, কিন্তু এই অচেনা জায়গায় সে যে কী করে!
তিথির কথারও গুরুত্ব আছে।
ঘরে একা থাকলে ভূতে ধরে।
সে বলল, তিথি একটু বসবি। বাবা আসুক। তারপর আমরা যাব।
হয়ে গেল। ভূতের ভয়ে এত কাবু। কাকার ফিরতে দেরি আছে।
কেন, দেরি কেন?
বারে মঠে শিবলিঙ্গ আছে জানো?
তা থাকতেই পারে।
থাকতেই পারে না, আছে। খুবই জাগ্রত। কাল সকালে আমার সঙ্গে যাবে। সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাব। আটআনা জমিদারবাবুর কত বড় প্রাসাদ দেখতে পাবে। নদীর পাড়ে কাকা ঘাটের স্টেশন মাস্টারের ঘরে বসে খবরের কাগজ না পড়ে ফিরবেন না। আহ্নিক সারা হলেই ফিরে আসবেন, তা হলেই হয়েছে।
মঠে শিবলিঙ্গ আছে জানো না? কেন যে বলল তিথি! জাগ্রত ঠাকুর, সেই না হয় হল। জাগ্রত বলেই বাবার দেরি হবে ফিরতে তাই বা কেমন আবদার। তা হলে কি রাতে তাকে এই ঘরে পাঠ্যবই নিয়ে একাই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে!
বাবা তার আহ্নিকের নামে মঠে যাবেন, জাগ্রত ঠাকুর বলে পরিবারের সবার মঙ্গলের জন্য ধ্যানে বসবেন, তারপর স্টেশন মাস্টারের ঘরে ঢুকে সেজবাতির আলোয় অর্ধসাপ্তাহিক আনন্দবাজার কাগজখানা পড়বেন। পড়া শেষ না হলে আবার পড়বেন—এই অজুহাতে যে বাবা রাতে ঘরে ফিরতে বেশ দেরি করবেন তাও অরু বুঝে গেল। তিথির সঙ্গে তার বরং ভাব করেই চলা দরকার।
অরু কিছুটা চালাকি করে বলল, তোর বাবা কী করে রে?
বাবা জিলিপি ভাজে। কতবার বলব!
কোথায়?
কেন বাজারে।
তোদের বাড়িটা কোন দিকে।
আঙুল তুলে দেখাল, চলো না আমাদের বাড়ি হয়ে যাবে। জানো আমার মা না কোথায় চলে গেছে?
তোর মা বাড়ি থাকে না?
লোকে যে বলে মা আমার জলে ভেসে গেছে।
এইরে, এ যে আর এক ভূতের দোসর।
কী করে জলে ভেসে গেল?
আমি তার কী জানি? ছোট ছিলাম তো। মা’র কথা আমার মনেই নেই।
তোর মা নেই তবে?
তিথি জিভ কেটে বলল, অমন কথা বলো না অরুদা। আমার মা সাক্ষাৎ লক্ষ্মীঠাকরুণ। মা না থাকলে বাবা নাকি বিবাগি হয়ে যেত। ভুইঞাকাকাই জোরজার করে ফের বাবাকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করে তুললেন।
তোর ভাইবোন আছে?
হাতের পাঁচ আঙুল তুলে দেখাল।
মানে পাঁচটি ভাইবোন নিয়ে তিথি বিমাতার সংসারে থাকে।
তিথির কথা ভেবে অরুর খারাপই লাগল।
আসলে সে যে চালাকি করে তিথির বাবা—মার কথা বলে আটকে রেখেছে বুঝতেই দিল না। কথা বললে মেয়েটা নড়তেই চায় না। শিকারের সেই মৃত হাঁসটা দেখানোর আগ্রহ যেন আর তিথির মধ্যে নেই। তাঁকে সামান্য ভালোবেসে কথা বললে, এমন চোখে তাকিয়ে থাকে যে কিছুতেই আর অবহেলা করা যাবে না।
তিথি ঠিক অরুর পাশের চকিতে বসে পা দোলাচ্ছে। রোগা এবং কিছুটা লম্বা, অরুর মতোই লম্বা হবে, সংকোচ সংশয় কোনওকিছুই যেন তার মধ্যে নেই। চোখ দুটো বড় তাজা। খুবই ফর্সা, মুখের গড়নটা সরল সুন্দর এবং কিছুটা গম্ভীর। মেয়েটা চুপচাপ থাকলে দেবী বিসর্জনের বাজনা বেজে ওঠে। চুল কোঁকড়ানো, কপাল বেশ চওড়া এবং ঘন চুলে নারকেল তেলের গন্ধ।
অরু দেখল, সামান্য কথাবার্তা বলায় তিথি খুব খুশি। তারপরই কেন যে বলল, তুমি ওঠো তো। বিছানাটা একেবারে করে দিয়ে যাই। খেয়ে এসে শুয়ে পড়বে। বালিশ চাদর ওয়াড় সব কেচে রেখেছি। কাকার মশারিটা ছোট। দু’জনের হয় না। বলে কয়ে কাকাকে দিয়ে তোমার আলাদা মশারি আনিয়েছি। কাকার শুতে শুতে অনেক রাত হবে।
এখন বিছানা করতে হবে না। বাবা আসুক।
তিথি বলল, তা হলে আমি যাই। বলেই সিঁড়ি ধরে লাফিয়ে নেমে গেলে অরু দৌড়ে দরজার কাছে চলে গেল।
এই যাস না। আমি তোর সঙ্গে যাব।
এসো না। আমি তো দাঁড়িয়েই আছি।
কোথায় দাঁড়িয়ে আছিস! দেখতে পাচ্ছি না!
নেমে এসো, দেখতে পাবে।
দরজা বন্ধ করে দেব।
শিকল তুলে দাও না!
অরু শিকল তুলে দিতেই তার চারপাশ রাতের অন্ধকার ঘিরে ধরল। কিছুই চেনে না। বড় বড় আমগাছের ছায়ায় জায়গাটা কীভাবে কতটা ছড়িয়ে আছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। জানালা দিয়ে সামান্য আলো এসে বাইরে পড়েছে। সেদিকে তাকিয়েও কিছু বুঝতে পারল না। একবার ভাবল দরকার নেই তিথির সঙ্গে গিয়ে, কোথায় দাঁড়িয়ে আছে বুঝতেই পারছে না, সে ঘাবড়ে গেলে তিথি আরও মজা পেয়ে যাবে।
সে সিঁড়িতে উঠে শিকল খুলতে গেলেই, তিথি কোথা থেকে ডাকল, এই তো আমি। তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ না!—ঠিক যেখানে জানালার আলো এসে পড়েছে, তিথি সেখানে দু—হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
সে ফের ঘরে শেকল লাগিয়ে জানালার আলোর দিকে এগিয়ে গেল।
না, তিথি নেই।
পাশেই সাড়া পাওয়া গেল, এসো।
অরু অন্ধকারে খুঁজছে তিথিকে। কোনও গাছের আড়াল থেকে যেন কথা বলছে। যতই অন্ধকার হোক, আবছামতো কিছু তো দেখা যাবেই। একটা কুকুর দৌড়ে গেল। ঘেউ ঘেউ করছে।
অরুর মহা মুশকিল। এখন ইচ্ছে করলেই সে যেন আর ঘরে ফিরতে পারবে না। আমবাগানের এলাকাটা যে অনেকটা জায়গা জুড়ে তিথিকে খুঁজতে গিয়ে টের পেল। কোনও আলো পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। শুধু তিথির এক কথা, আমি তো তোমার সঙ্গেই আছি। এসো না।
তুই আমার সঙ্গে নেই? গাছের আড়াল থেকে কথা বলছিস! কতদূর! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাকে তুই ভয় দেখাবি না বলে দিচ্ছি।
সামনে একটা সুপারি বাগান পড়বে। বাগানটা নদীর পাড়ে চলে গেছে। রাস্তা হারিয়ো না অরুদা। আমার পিছু পিছু চলে এসো। আমি ভূত নই, আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই।
মেয়েটি ভারী বজ্জাত। তাকে বেকুব বানাবার তালে আছে। জমিদারবাড়ি বিশাল এলাকা নিয়েই হয়ে থাকে সে জানে। যেমন এই আমবাগান কিংবা সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে যেতে যেতেই হয়তো কোনও সাদারঙের বাড়ি আবিষ্কার করে ফেলবে। কারণ স্টিমারের আলোতে সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে সে যেন সত্যি একটা সাদারঙের বাড়ি দেখে ফেলেছিল।
বাবা তাকে কোথায় এনে তুললেন! সে কার পাল্লায় পড়ে গেল! মা নদীর জলে ভেসে গেছে, বাপ বাজারে জিলিপি ভাজে—তিথির ভাইবোনও আছে, কোন দিকটায় তিথি তার বাবার সঙ্গে থাকে তাও সে বুঝতে পারছে না। চারপাশে গাছ, কোথাও জঙ্গল, সুপারির গাছগুলো সোজা দাঁড়িয়ে আছে। সামান্য ঝড়বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় টুপটাপ পাতাও ঝরছে না, দু—একটা মরা ডাল পায়ে লাগতেই সে উবু হয়ে বসে পড়ল। তিথি তাকে যেন কোনও অশরীরী আত্মার পাল্লায় ফেলে দিচ্ছে।
এই অরুদা, বসে পড়লে কেন।
যেন একেবারে পাশ থেকে বলছে।
বিশাল একটা গাছের কাণ্ড তার সামনে রাস্তা রুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে এগোতে পারছে না।
এত পাঁচিল। ঐ তো দরজা।
অরু বলল, তুই কোথায়?
এই তো আমি।
তিথি একেবারে সামনে এসে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
এই ছাড়। কী হচ্ছে।
কিছু হচ্ছে না। তুমি এত ভীতু। নদীর জল কল কল শব্দ—শুনতে পাচ্ছ না। সুপারিগাছের ফাঁক দিয়ে দেখ না, ঘাটে নৌকায় কত লণ্ঠন জ্বলছে।
তুই আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?
নদীর পাড়ে।
কেন?
এমনি এমনি।
আমি যাব না। তোর ইচ্ছে হয় তুই যা। বাবা আসুক, সব না বলছি তো। তুই না আমাকে অন্দরে নিয়ে যাবি বললি। গিন্নি মা আমাকে দেখতে চেয়েছেন, পাখি শিকার, মেজদা, রান্নাবাড়ি কত কিছু না বললি!
আমি তো তোমাকে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি।
এত দূর!
দূর, কী বলছ! ঐ তো দেখা যাচ্ছে। সাদামতো বাড়ি দেখতে পাচ্ছ না আবছামতো। বৈঠকখানায় সেজবাতি জ্বলছে। রকে হারিকেন জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। দেখতে পাচ্ছ না! নদীর পাড় ধরে গেলে তুমি খুব খুশি হতে অরুদা। সেখানে কত বড় আকাশ, কত নক্ষত্র আকাশে, কত সব জেলে ডিঙ্গি নদীর ঢেউ—এ ভাসছে, আমার যে কেবল মনে হয় খুব বর্ষায় কোনও ডিঙ্গিতে নদীর ঢেউয়ে ভেসে যাই। ঝড়বৃষ্টি নদীর ঢেউ ফুলেফেঁপে উঠবে, লম্বা ছিপনৌকায় আমি বসে থাকব। চারপাশে ঘন আঁধার, ঝিরঝির করে কুয়াশার মতো বৃষ্টি ঘিরে থাকবে আমাকে, কেউ দেখতে পাবে না, কেউ না, তুমি ছাড়া।
তিথি এত সুন্দর কথা বলে! কে বলায় তাকে! কেমন এক আশ্চর্য প্রকৃতির মধ্যে তিথি বড় হয়ে উঠতে উঠতে বোধহয় কখনও সে কোনও স্বপ্নের দেশ আবিষ্কার করে ফেলে! সে তো সবে এসেছে, সে এখানেই থাকবে। এও বুঝতে পেরেছে, বাবা আদায়পত্রে বের হলে এই মেয়েটার সাহচর্য তার সম্বল।
পাঁচিলে শ্যাওলার গন্ধ। অরণি ভেতরে ঢোকার সময় গন্ধটা পেল। দরজা দিয়ে ঢোকার সময় তিথি বলল, তুমি আমার হাত ধরো।
কেন? তোর হাত ধরব কেন?
কিছু এখানটায় দেখা যায় না।
কেন দেখা যায় না?
দুটো চালতা গাছ আছে। নালা নর্দমা আছে বাড়িটার। পড়ে যেতে পারো।
বাস্তবিক জায়গাটায় পা বাড়াতেই ভয় করছিল অরুর। প্রায় অন্ধের মতো পার হয়ে যাচ্ছে জায়গাটা। তিথি তার হাত ধরে রেখেছে। এবং রকে তুলে দিলে বুঝল, তার আর হাঁটতে অসুবিধা হবে না। মেলা মানুষজন বারান্দায়, বৈঠকখানাও সে দেখতে পেল। সেখানে চার—পাঁচজন প্রৌঢ়মতো মানুষ পাশা খেলায় ব্যস্ত।
তিথি বলল, গিন্নিমা, অ গিন্নিমা, তুমি অরুদাকে দেখবে বলেছিলে, এই তো অরুদা দাঁড়িয়ে আছে।
মৌমাছির মতো মানুষজন যেন উড়ে আসছে। গুঞ্জন।
এই ছোড়দি—তিথি কাকে যেন ডাকল।
ছোড়দি ছোড়দি করছিস কেন? ওকে ঘরে নিয়ে বসা।
তিথি কোন ঘরে নিয়ে যাবে! বড় বউদির ঘরে, গিন্নিমার ঘরে, মেজদার ঘরে—সে ঠিক বুঝতে পারছে না বলেই রোয়াকে দাঁড়িয়ে আছে।
অরু বড়ই অসহায় বোধ করছে। বাবার সঙ্গে এলে বোধ হয় এতটা অস্বস্তি হত না।
গিন্নিমা ডাকলেন, তিথি, তুই তো আচ্ছা মেয়ে, কোথায় যাস, কোথায় থাকিস, ডেকে ডেকে সাড়া পাচ্ছি না। কখন থেকে খুঁজছি।
বারে তুমি যে বললে, অরুদাকে দেখবে!
কখন বললাম!
বললে না, জগদীশকে বলবি, অরুকে যেন নিয়ে একবার আসে।
বলেছি বুঝি। কোথায় ছেলেটা! কোথায় দাঁড়িয়ে আছে! আমি যাই কী করে—হাত জোড়া আমার। এখানে নিয়ে আয়। সব ঘরগুলোর সামনেই লম্বা রোয়াক অথবা বারান্দা বলা যায়, বারান্দা পার হয়ে তিথি বলল, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন অরুদা, সবাইকে প্রণাম করতে হয়।
অরু রোয়াকে দাঁড়িয়েই আছে।
পাকাবাড়ি বুঝি এমনই হয়ে থাকে। একতলা বাড়িটা এতবড় ভেতরে না ঢুকলে সে বুঝতে পারত না। বাড়ির মানুষজন সবাই বড় সুপুরুষ। ঘরের ভেতর পালঙ্কে শুয়ে সুন্দরমতো মেয়েটা কে সে জানে না। বালিশে ভর করে তাকে দেখছিল। সাদা ধবধবে বিছানা, পালঙ্কের পায়ায় সিংহের থাবা। চকচকে লাল মেঝে এবং ছাদে ঝাড়বাতি ঝুলছে। হাওয়ায় রিন রিন করে বাজছিল। বয়স্ক এক মহিলা তাকে কাছে টেনে আদর করতে চাইলে সে কেমন জড়ভরত হয়ে গেল। তিথি বলল, ছোটপিসি, ভয় কি অরুদা।
ছোটপিসিকে সে কেন যে বয়স্ক ভাবল বুঝতে পারছে না। সাদা ধবধবে থান পরনে। হারিকেনের আলোতে আবছামতো মুখ। ভালো করে নজর করতেই বুঝল, সাদা থান পরলেই বয়স্ক হয়ে যায় না। তার চেয়ে কিছু বড় হতে পারে। কাকিমার বয়সিই হবে। ছোটকাকার বিয়ের কথা তার মনে আছে। সে বরযাত্রী গিয়েছিল। বালিকা বয়সে ছোট কাকিমা যদি তাদের বাড়িতে আসে, তবে এখন তার কতই বা বয়স হতে পারে।
ছোটপিসি থুতনি ধরে বলল, আয় আমার ঘরে।
অরু কিছুতেই যেতে চাইল না।
আর আশ্চর্য তিথির হাতে সেই হাঁসটা। ছালচামড়া ছাড়ানো হয়নি। হাঁসটা মৃতও নয়। তবে ভালোমতো জখম হয়েছে। তিথি হাঁসটাকে প্রায় বুকে করে ধরে রেখেছে।
পাকা ঝাপটাচ্ছিল হাঁসটা।
কিন্তু উড়তে পারছে না। জোরজার করে তিথি চেপে রেখেছে কোলে।
হাঁসটা যে আদৌ মরে যায়নি, শিকারের পাখি এমনই হয়ে থাকে, খোঁড়া হতে পারে, কিংবা পাখায় ছররার গুলি লাগতে পারে, বোধহয় হাঁসটার ডানা ভেঙে গেছে, বড়ই কাতর চোখে হাঁসটা মাথা তুলে হারিকেনের আলোতে উড়ে যাবার চেষ্টা করছে, পারছে না, বৃথাই চেষ্টা—তখনই ছোটপিসি বলল, তোর কি তিথি ঘেন্নাপেত্তা নেই। বুকে তুলে রেখেছিস। নিয়ে যা। আমি সহ্য করতে পারছি না।
অরুও কেমন দমে গেল।
এই জখমি হাঁসটা যেন না দেখলেই ভালো হত।
অরু বলল, আমি যাই।
তিথি বলল, একা যেতে পারবে, কাছারিবাড়িতে! রাস্তা হারিয়ে ফেলতে পারো।
অরুর মনে হল, সে সত্যি একা যেতে পারবে না। তিথি রাস্তা চিনিয়ে না নিয়ে গেলে, রাতের অন্ধকারে গাছপালার ছায়ায় কাছারিবাড়িটা যেন কখনোই আর খুঁজে পাবে না।
।চার
জগদীশ পাঁচটা না বাজতেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন। খড়ম পায়ে বাইরে বের হয়ে সূর্য প্রণাম, তারপর নুয়ে এই বসুন্ধরা এবং যাকে তিনি জগজ্জননী ভাবেন তাঁর উদ্দেশ্যে চোখ বুজে কিছুক্ষণ ধ্যান, ফের ঘরে ঢুকে পেতলের গাড়ুটি হাতে নিয়ে হাঁটা দেন—সামনের সুপারিবাগানে ঢুকে যান, কিছুদূর হেঁটে গেলেই ঝোপের মতো জায়গায় তিনি অদৃশ্য হন। তারপর নদীর জলে অবগাহন, স্তোত্রপাঠ এবং ফেরার পথে মঠের শিবলিঙ্গের মাথায় একটি ধুতুরা ফুল এবং নদীর জল ঢেলে শিবস্তোত্র পাঠ করেন।
এত সকালে তার পুত্র অরণির ওঠার অভ্যাস নেই। দেশের বাড়িতে মাইনর পাশ করে বসেছিল, গতকাল তাকে নিয়ে তিনি তাঁর কর্মস্থলে চলে এসেছেন। স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করে দেবার ব্যবস্থাও হয়ে গেছে। রাতে পথশ্রমে অরণির বোধ হয় ভালো ঘুম হয়নি। সারারাতই ছটফট করেছে। বাড়ি ছেড়ে থাকারও কষ্ট কম না। ভোররাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ায় তিনি তাকে এখনও ডেকে তোলেনি। মনে মনে স্তোত্রপাঠ করছেন, এবং খড়ম পায়ে হাঁটাহাঁটি করলে অরণির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে—যতক্ষণ না হরমোহন নাজিরখানার দরজা খুলে দেবে, তিনি ঘর ছেড়ে যেতেও পারেন না।
অরণিকে তাঁর কিছু বলার আছে। তাকে ঘুম থেকে তোলাও দরকার। ডাকতে কষ্ট হচ্ছিল, অঘোরে ঘুমোচ্ছে, অথচ সব না বলে গেলেও চলবে না। তাকে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে বগলে বই নিয়ে জমিদারবাবুর পুত্রদের ঘরে চলে যাওয়া দরকার। সেখানে মাস্টারমশাই তাদের পড়াতে আসেন। অরণিও তাদের সঙ্গে পড়বে।
একবার, ভাবলেন ডাকেন। বলেন, অরু উঠে পড়ো। কারণ সকাল হয়ে গেছে। হাতমুখ ধুয়ে নাও। তোমার দেরি দেখলে বিশু চলে আসতে পারে। এ—বাড়িতে কেউ এত দেরি করে ওঠে না।
বাড়ি থেকে খুব সকালে রওনা হয়ে, কিছুটা পথ হেঁটে, বাকি পথ স্টিমারে যখন এই কাছারিবাড়িতে এসে উঠেছিলেন তিনি, তখন রাত হয়ে গেছিল। স্টিমারের আলোতে সুপারিবাগান এবং জমিদারদের খানিকটা প্রাসাদ ছাড়া অরণির চোখে কিছুই দৃশ্যমান ছিল না। আমবাগানের পরিত্যক্ত কাছারিবাড়িতে অরণিকে একা থাকতে হবে ভেবে সে খুবই মনকষ্টে ছিল। কিছুটা আতঙ্কও চোখেমুখে লক্ষ করেছেন তিনি।
এখন ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পাবে, সুপারিবাগান পার হয়ে নদীর জল কলকল ছলছল—নদীর পাড়ে গেলে ছবির মতো দেখতে জমিদারবাবুদের গ্রামটিও সে দেখতে পাবে। প্রাসাদগুলির জাঁকজমক অরণিকে অবাক না করে পারে না। নদীটি এত বিশাল আর নদীর চর, পাখির ওড়াউড়ি নিয়ে এত ব্যস্ত যে নদীটিকে দেখলেই ডুব দিতে ইচ্ছে হয়। তিনি এক আনা জমিদার দেবকুমারবাবুর আমলা। প্রাসাদ, দিঘি সহ নদীর পাড়ে তাঁর এলাহি ব্যবস্থা। ফুলের রকমারি বাহারও কম নেই বাড়িটাতে। অরণি ঘুম থেকে উঠে হাই তুললেই দেখতে পাবে সামনের সুপারিবাগান পার হয়ে পুণ্যতোয়া নদীটির জল, জলে ঢেউ, পালতোলা সব নৌকা।
গ্রামের পাশে নদী থাকলে স্থানমহিমা যে কত বেড়ে যায়, অরণি ঘুম থেকে উঠলেই বুঝতে পারবে।
তখনই তিথি জানালায়—ও বাব্বা, অরুদা তুমি ঘুমোচ্ছ, তুমি কি গো। কত লোক কত দূর দেশে চলে গেল, এখনও তোমার ঘুম ভাঙল না।
জগদীশের মনঃপূত নয়, তিথি তাকে ডেকে জাগিয়ে দিক—কিন্তু, এতই চঞ্চল, আর হতভাগ্য মেয়েটি, যে তাকে তিনি কোনও কড়া কথাই বলতে পারেন না। আর এত কাজের, আসলে সে চলে এসেছে, বিছানা তুলে ঘর ঝাড় দিয়ে চলে যাবে। অরণি আসায় এ—ঘরে তার যেন দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে। ওর বাবা গোরাচাঁদকে বাড়িঘর করার মতো কিছুটা জমি পাইয়ে দেওয়ার পর থেকে গোরাচাঁদের বউ যমুনার কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না। আগে যমুনা করে দিত, তিথি বড় হয়ে যাওয়ায় সে এখন করে দেয়। জিলিপি, তেলেভাজার দোকানের জায়গাটিও তিনি ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বাজারের ওই একফালি জায়গা নবকুমারবাবুকে বলে ব্যবস্থা না করে দিলে গোরাচাঁদ একপাল ছেলেপিলে নিয়ে অথৈ জলে পড়ে যেত। তবে জগদীশের পছন্দ নয়, তিনি আগে মানাও করতেন, তাতে যমুনা কিংবা গোরাচাঁদের দুজনের মুখই ভারী ব্যাজার হয়ে যেত। ভুঁইঞামশায়ের মর্জিতেই জমিদারি চলে, তিনি এটুকু সেবা না নিলে, তারা কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে।
তিনি আর তারপর থেকে, কাজ করে দিলে মানা করেন না, কাজের কথা ভুলে গেলে ডেকে মনেও করিয়ে দেন না। নিজেই করে নেন। কোনওদিন তিথি হয়তো সকালেই নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ঘাটে পুণ্যস্থান থাকলে, নদীর জলে ডুব দিয়ে হয়তো পয়সা তুলছে। পয়সা সংগ্রহের উত্তেজনায় মনেই নেই, সকালে এক বালতি জল ভুঁইঞাকাকার ঘরে তুলে রাখতে সে ভুলে গেছে।
জগদীশ তখন নিজেই জল তোলেন।
জগদীশ তখন নিজেই ছাড়া জামাকাপড় ধুয়ে তারে মেলে দেন। এসব কাজের জন্য তিথি কিংবা যমুনার উপর নির্ভর না করে নিজে করে নিতে পারলে কিছুটা আত্মতুষ্টিতেও ভোগেন।
তারপরই হয় মুশকিল।
গোরাচাঁদ শুনে খেপে যায়, কোথায় তিথি, কোথায় গেছে। ভুঁইঞামশাই তারে কাপড় মেলছে, সারাদিন ছুক ছুক করে বেড়ানো, তোর এত লোভ! বউকেও বলবে, তুমি খেয়াল রাখতে পারো না, তিথি ছেলেমানুষ, তার দোষ কি! ইস কী যে হবে!
জগদীশের কানেও কথা উঠে আসে।
ইস, মেয়েটাকে গোরা গোরু খোঁজা খুঁজছে।
কেন? ও কী করেছে! অন্দরে থাকতে পারে। গোরাকে ওখানে খোঁজ নিতে বলো।
না, ওখানে নেই।
ওখানে না থাকলে, নদীর চরে শালুক তুলতে যেতে পারে।
না, সেখানেও যায়নি!
তবে গেল কোথায় মেয়েটা! এক দণ্ড চুপ করে বসে থাকতে পারে না। নদীর ঘাটে পুণ্যস্নান, মেলার চরে পালতোলা নৌকার ভিড়। মানুষজনও মেলা। পায়ে হাঁটা পথে, স্টিমারে কেউ কেউ এসে নেমে থাকে। মাঠের চারপাশে ভিড় থাকে, তারপর মানুষজন নদীর ঘাটে পুণ্যস্নান সেরে চলে যাবে বাজারের দিকটায়। সড়ক ধরে, একপাশে বিশাল সব প্রাসাদ ফেলে সোজা হেঁটে গেলেই বাজার—চরের উপর দিয়েও হেঁটে যাওয়া যায়, তারপর বিন্নির খই লালবাতাসা খেয়ে যে যার নৌকায় কিংবা হাঁটাপথে বাড়ির দিকে রওনা হবে। অষ্টমী স্নানেই বেশি ভিড়, ছোটখাটো পুণ্যস্নানও বছরে যে কিছু না থাকে—তাও নয়। তিথির তখন কেমন দিশেহারা অবস্থা। নদীর জলে ডুব দিয়ে পয়সা তুলবে। দুটো পাঁচটা যা পায়, সেই দিয়ে সেও বিন্নির খই লালবাতাসা কিনে কোঁচড়ে নিয়ে খাবে আর নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াবে। আর নদীর পালতোলা নৌকা, যেমন কাঁঠালের কিংবা আনারসের, তালের নৌকাও থাকে, এই সব নৌকার দিকে তাকিয়ে আপন মনে নদীর সঙ্গে কথা বলবে। নৌকার ব্যাপারীদের সঙ্গে কথা বলবে।
এই তিথি!
সে অবাক হয়ে তাকাবে।
তুই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? কী খাচ্ছিস?
কী খুশি তিথি! সে তার কোঁচড় খুলে দেখাবে।
যা বাড়িতে, খাওয়া তোর বের করবে।
তিথির চোখ মুখ শুকিয়ে যায়।
জগদীশ জানেন, গোরাচাঁদের ওই এক দোষ। বড় চণ্ড রাগ তার। মাথা গরম হয়ে গেলে সে ভালোমন্দ বোঝে না, মেয়েটার সজল চোখও তাকে আটকাতে পারে না। বড় নির্মম হয়ে ওঠে।
জগদীশের এই হয়েছে মুশকিল। মেয়েটাকে ধরতে পারলেই গোরাচাঁদ টেনে হিঁচড়ে বাড়ি নিয়ে আসবে।
তুই মার খেয়ে খেয়ে মরবি! ভুইঞামশাইর ঘরে জল তুলে রাখিসনি! ছাড়া কাপড় কেচে তারে মেলে দিসনি। তোর এত নোলা।
জগদীশ এই সব জানেন বলেই, তিথিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শুনলেই কিছুটা হতভম্ব হয়ে গিয়ে বলেন, কোথায় গেল! তারপর নিজেই খুঁজতে বের হয়ে যান। গোরাচাঁদের ভয়, মেয়েটার জন্য তার সব না শেষ হয়ে যায়। বাবুদের অনুগ্রহে জমিদারিতে তার আশ্রয়। একখানা নোটিস ঝুলিয়ে দিলেই তার সব গেল। তিথি তার সর্বনাশ না করে ছাড়বে না।
জগদীশ সুপারিবাগানের এক কোণায় গিয়ে ডাকবেন, গোরাচাঁদ, গোরা আছিস?
আজ্ঞে উনি তো তিথিকে খুঁজতে গেছেন।
যমুনা দরজার বাইরে একগলা ঘোমটা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ওকে বলবে, তিথির গায়ে যেন হাত না তোলে। হাত তুললে খুব খারাপ হবে। আমার মনে হয় মঠের ঘাটে গেছে। পুণ্যস্নান হচ্ছে, মেলা বসেছে, তালপাতার বাঁশি বাজছে, মেয়েটার মন ঘরে টিকবে কেন!
মেলায় নেই।
তা হলে জলে আছে। আমি যাচ্ছি, দেখছি খুঁজে পাই কি না।
আর তখনই তিনি ঠিক দেখতে পান গোরাচাঁদ নদীর পাড় থেকে মেয়েটাকে হাতে ধরে টেনে আনছে। নদীর জলে সারা সকাল যে ডুবে ডুবে পয়সা খুঁজছে, চোখ দেখেই বোঝা যায়। তারপর পাড়ে উঠে নদীর হাওয়ায় ফ্রক শুকিয়েছে, তাও বোঝা যায় শুকনো ফ্রক দেখে, বিন্নির খই, লালবাতাসা কোঁচড়ে নিয়ে নদীর পাড়ে ঘুরে ঘুরে কিছুটা খেয়েছে, বাকিটা ভাইবোনদের জন্য লুকিয়ে নিয়ে আসার মতলবে ছিল, তাও বোঝা যায় ওর এক হাতে কোঁচড় ধরে রাখার চেষ্টায়। হাত টানাটানিতে না আবার কোঁচড়ের মুঠি ফসকে যায়, যতই গোরাচাঁদ তার মেয়েকে টেনে আনার চেষ্টা করুক না, তিথি তার কোঁচড় ছাড়ছে না।
গোরাচাঁদ জগদীশকে দেখেই থমকে গিয়েছিল। তিথির হাতও ছেড়ে দিয়েছিল।
ভুঁইঞামশায় আমার কী হবে! যমুনা খবর পাঠাল, আপনি তারে কাপড় মেলছেন, তিথি সকালে বেপাত্তা। চরণকে বসিয়ে ছুটে এসেছি। এই দেখুন কী কাণ্ড!
দেখছি। কি রে তিথি কটা পয়সা হল।
তিথির সব ভয়ডর নিমেষে জল।
সে মুচকি হেসে বলল, পাঁচ পয়সা।
এত জল ঘাঁটলে জ্বর হবে যে! বাবার কথা শুনিস না কেন!
তিথি বড় বড় চোখে তাকিয়ে শুধু তাঁকে দেখছিল।
কোঁচড়ে কী আছে?
খুবই আহ্লাদের গলায় বলল, খই বাতাসা। বলে, কোঁচড় মেলে দেখাল।
যা বাড়ি যা। বাড়ি থেকে গেলে বলে যাবি। তুই বড় হয়ে যাচ্ছিস বুঝতে পারিস না।
বড় হয়ে যাওয়ার কথায় তিথির কী লজ্জা! সে প্রায় পড়িমরি করে ছুটতে থাকল। কোঁচড় দু—হাতে সামলে, সেই মুলিবাঁশের বেড়া দেওয়া ঘরটার দিকে ছুটতে থাকলে তার ভাইবোনগুলো বের হয়ে এল প্যাক প্যাক করতে করতে।
গোরাচাঁদ আফসোসের গলায় বলল, বলেন, এই কর্মনাশা মেয়েকে নিয়ে আমি কী করি! কোথায় যাই।
তিথিকে দেখতে দেখতে জগদীশের পলকে মনে পড়ে যায় সব। চোখের সামনে বড় হয়ে উঠছে। ছেঁড়া ফ্রকে তাকে খারাপও দেখায় না। মেয়েটার দস্যিপনায় তার বাবা অস্থির। নতুন ফ্রক কিনে দিলে দু—চার মাসও যায় না। ওর বাবাও পেরে ওঠে না। বউঠান, তুলির পুরনো ফ্রক থাকলে মাঝে মাঝে ওকে ডেকে দেন। কী খুশি তখন। ফ্রকটা ছোড়দি গায়ে দিত, সেই ফ্রক সে গায়ে দিচ্ছে। আর যা হয়, তখনই তার কত আবদার সবার কাছে, গাছপালা, জীবজন্তু, পাখপাখালি সবাই তার বন্ধু হয়ে যায়। সে যেন ফ্রকটা গায়ে দিয়ে ইচ্ছে করলে উড়ে বেড়াতেও পারে।
তখন সর্বত্র তার চোখ।
কে রে? কে সুপারির বাগানে ঢুকেছিস।
সে তেড়ে যায়।
গরিবগুর্বো মানুষেরা এই সব ভূস্বামীদের উচ্ছিষ্ট খেয়ে যে বেঁচে থাকে জগদীশ ভালোই জানেন। সুপারির খোল বাগানে পড়ে আছে, কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে, তিথির জ্বালায় তা নিয়ে যাওয়া কঠিন। বাবুদের বাড়ির সবকিছুর উপরই তার যেন হক আছে।
সুপারির খোল নেবে সাধ্য কি!
তার চেঁচামেচির শেষ থাকে না।
অমলদা, দ্যাখো এসে আমাদের সুপারির বাগানে কে এসে ঢুকেছে।
কারও সাড়া না পেলে সে খোল নিয়ে গরিব মানুষটির সঙ্গে টানাটানি শুরু করে দেবে।
এটা আমাদের, তুই মেঘা কোন সাহসে বাগানে ঢুকলি! ভুইঞাকাকাকে দাঁড়া খবর দিচ্ছি।
এই হয়, সুপারির বাগানে হাওয়ায় পাকা সুপারি ঝরে পড়ে। গাছের ডগা থেকে খোল খসে পড়ে। যাওয়া আসার রাস্তায় গরিব মানুষদের চোখ কান শকুনের মতো সজাগ। শব্দ হলেই হল, তাল পড়তে পারে, নারকেল পড়তে পারে, সুপারির খোল পড়তে পারে, এতবড় মহলার মধ্যে কোথায় কী পড়ে থাকে কারও খেয়াল থাকার কথা না, কিন্তু তিথির সব খেয়াল থাকে—বিশাল এলাকায় আম জাম জামরুল গাছেরও অভাব নেই—তিথির মতো কেউ খবর দিতে পারে না, কোন গাছে কী ফল ধরে আছে, কোন গাছে কত আম পেকে আছে। তিথির জ্বালায় গাছের ফল পাকুড় কুড়িয়ে নিয়ে কারও হাওয়া হয়ে যাবার ক্ষমতাই নেই। সে কেড়েকুড়ে সব এনে বউঠানের কাছে জিম্মা দেবে।
আর নালিশ, জানো, নিয়ে পালাচ্ছিল। বাতাবি লেবুটা গাছের নীচে কখন পড়ে আছে, আমিও জানো খেয়াল করিনি। শ্রীশ ধরের ব্যাটা নিয়ে পালাচ্ছিল। আমাকে দেখে ফেলে দৌড়োছে।
তিথি ঘরে ঢুকে গেছে ততক্ষণে। সে তাঁর বিছানা মশারি গুটিয়ে কাঠের তাকে তুলে রাখছে। তিথির ডাকাডাকিতে অরু বিছানায় উঠে বসল। নতুন জায়গা—এটা একটা কাছারিবাড়ি কিছুই বোধহয় তার মনে ছিল না। চোখ কচলে হাত পা ঝাড়া দিতেই বুঝল সে তা বাবার কর্মস্থলে—তিথিকে দেখে তার সব মনে পড়ল—রাতের অন্ধকারে কেমন সব কিছু রহস্যাবৃত ছিল, এই সকালবেলায় সে বিছানা ছেড়ে নামার সময়ই, দেখল সামনে সুপারিবাগান, তার ভেতর দিয়ে নদীর পাড়, চড়া, সাদা কাশফুলের ওড়াউড়ি। বাবার স্নান জপতপ সারা। কারণ বাবা একটি ফতুয়া গায়ে দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছেন আয়নায়। সে কিছুটা যে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে বোঝা যায়। দরজায় দাঁড়াতেই বুঝল, চারপাশে বড় বড় সব আমগাছ, তার ডালপালায় কাছারিবাড়িটা তপোবনের মতো।
তিথি বলল, দাঁড়াও জল এনে দিচ্ছি।
অরুর ভীষণ হিসি পেয়েছে। সে তিথির কথার তোয়াক্কা করছে না। সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে গেলে টের পেল মেলা ঝোপজঙ্গলও আছে কাছারিবাড়ির চারপাশে। তারপর বেশ বড় মাঠ, বাঁশের বেড়া, সেখানে ফুলের সব গাছপালা, সাদা রঙের ছোটখাটো প্রাসাদও চোখে পড়ল। সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যেন নদীর পাড় ধরে যতদূর চোখ যায়, সবই বড় সুন্দর করে সাজানো গোছানো।
জগদীশ বের হবার সময় বললেন, তুমি গোলঘরে চলে যাবে অরু। হাত মুখ ধুয়ে নাও। বইখাতা নিয়ে যাবে। অমল কমলের ঘরে পড়বে।
রাতে খেতে বসে সবাইকে সে দেখেছে। অমলদা তার চেয়ে বেশ বড়ই হবে। ক্লাশ নাইনে পড়ে। কমল তার বয়সি কমলদা ঠিক বলা যায় না, সমবয়সিকে সে দাদা বলতে রাজি না। সবাই অবশ্য এখানে বাবু হয়ে আছে। অমলবাবু, কমলবাবু, কারণ জমিদারি যতই সামান্য থাক, ঠাটবাট আছে পুরো মাত্রায়।
খেতে বসেই টের পেয়েছে বাড়িটায় আশ্রিতজনেরও অভাব নেই। লম্বা রান্নাঘরে আসন পেতে সারি সারি পাত পড়েছে। ঝি—চাকরেরও অভাব নেই। একটা ধিঙ্গি মেয়েকে কোলে করে তুলে এনেছে—ঘুম থেকে তুলে খাওয়ানোর ফ্যাসাদও সে টের পেয়েছিল। কোল থেকে নামিয়ে দিলে সে বুঝেছিল ইনিই সেই ছোড়দি, গায়ে সাটিনের ফ্রক, ফ্রকের ফাঁক দিয়ে হাতির দাঁতের মতো দুটো লম্বা ঠ্যাং বের হয়ে আছে। মাথায় লাল রিবন বাঁধা, কিছুতেই চোখ খুলছে না—আসনে বসিয়ে দিলেও ঢুলছে। সবাই তাকে খাওয়াবার জন্য যে বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, এবং সে না খেলে বাড়িতে মহামারি শুরু হয়ে যাবে যেন, আহ্লাদ আবদারের শেষ ছিল না।
এই তুলি, কী হচ্ছে! ইস জলের গেলাসটা দিলি তো ফেলে। এ কি রে বাবা, কিছুতেই মুখে দিচ্ছে না।
পাশে যিনি বসে তুলিকে খাওয়াবার চেষ্টা করছেন, তাকে সে চেনে না। পরে অবশ্য তিথি বলেছে, বড়বাবুর সম্পর্কে মাসি হয়—এই বাড়িতেই থাকেন।
তারা যখন খাচ্ছিল—তিথি রোয়াকে বসেছিল, নুন জল লেবু সে পাতে পাতে দিয়েছে। কাঁচালংকা দিয়েছে। পায়ে আলতা পরা বউটিকে বাবার বউঠান, ভাতের টাগারি এগিয়ে দিচ্ছেন পরিবেশনের জন্য। সারাক্ষণ বউমা বউমা করছেন। এই নাও মাছভাজা। বড় বড় কইমাছ ভাজা পাতে পাতে। ডাল পাতে পাতে। আলু পটলের ডালনা, পাখির মাংস, আর ছোট বাটিতে এক বাটি দুধ সবার। ঘোমটায় ঢাকা মুখ, আর নিষ্প্রভ হারিকেনের আলোতে বউটির মুখ সে দেখতে পায়নি, তবে আলতা পরা পা দু—খানি তার এত সুন্দর, একেবারে দুধে আলতায় যার রঙ সে যে খুবই সুন্দরী তাতে তার কোনও সন্দেহ ছিল না। সে মাথা নিচু করে বাবার পাশে চুপচাপ খাচ্ছিল, আর তুলির আবদারে বিরক্ত হচ্ছিল।
কী দিয়ে খাবি?
খাব না।
পাখির মাংস দিয়ে খা।
না খাব না।
তবে কী দিয়ে খাবি?
কিছুই খাব না।
দুধ মেখে দিচ্ছি।
দাও।
দু—গ্রাস খেয়েই কেমন ওক তুলে দিচ্ছে।
অরুর বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল, মারব থাপ্পড়।
তিথির বয়সিই হবে। সারা বাড়ির মানুষজন, একটা পুঁচকে মেয়ের খাওয়া নিয়ে যেন অস্থির হয়ে পড়েছিল। আদরে আদরে যে মাথাটি গেছে অরুর বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
তিথি রাতে খেয়েছে কি না জানে না।
খেতেও পারে, নাও পারে।
তার বাবা জমিদারবাবুর আশ্রিত। বাড়ির কাজে কিংবা গিন্নিমার ফুটফরমাস খেটে না দিলে যে তাদের সবই যেতে পারে।
তিথি কি সেই আতঙ্কেই থাকে!
পাঁচ
তারপর অরণির এইভাবেই দিন যায়, বছর যায়।
একদিন সে স্কুল থেকে ফিরে না বলে পারেনি, এই তিথি শোন।
তিথি তার ঘরে জল তুলে দিয়ে গেছে। তারপর সে ছুটছিল বাড়ির অন্দরের দিকে। কাছারিবাড়ির পরে মাঠ, ঘাসের লন এবং দুটো জবাফুলের গাছ পার হয়ে পাঁচিলের দরজায় হয়তো ঢুকে যেত। তার জলখাবার, এই যেমন কখনও তেলমাখা মুড়ি, অথবা চিড়ে ভাজা, সঙ্গে বাদাম ভাজা কিংবা নাড়ু, কখনও ফুলুরি অথবা ফুলকপির সিঙারা, যা তাকে দেয়, সে নিয়ে আসে।
তিথি জবাফুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বলল, ডাকছ কেন?
শুনে যা।
আমার এখন শোনার সময় নেই।
আছে। শুনে যা বলছি।
অরুদা। কোনও কারণে রেগে যেতে পারে, সে ইতস্তত করছিল, গাছের নীচ থেকে নড়ছিল না।
শুনে যা বলছি।
কী যে করো না। কী হয়েছে? কখন সেই সকালে দুটো মুখে দিয়ে গেছ, না খেলে পিত্তি পড়বে না। আমি আসছি।
না, আসছি না। আগে আয়।
অরু স্কুলের জামাও ছাড়েনি। এত নজর মেয়েটার। কখন সে ফিরবে, সেই আশায় হয়তো নদীর পাড়ে কিংবা সুপারিবাগানে হেঁটে বেড়ায়। না হলে, সে ফিরেই দেখতে পাবে কেন, এক বালতি জল আর কাঁসার ঘটিটি সিঁড়িতে রাখা আছে। না হলে ফিরেই দেখবে কেন, তার জামাপ্যান্ট ভাঁজ করা, চকির এক কোনায় সাজিয়ে রাখা, চাঁপা ফুল তুলেও একটা কাচের গেলাসে জলে ডুবিয়ে রাখে। এই ঘরের সব সৌন্দর্য তৈরি হয় তার হাতে। সে যা কিছু এখানে সেখানে ফেলে রাখে, তিথির কাজ তা গুছিয়ে রাখা।
এ জন্য অরুর নিজের উপরও রাগ হয়।
কিন্তু মুশকিল, কমলদা কিংবা বিশুদা ডাকলে তার ছুটে যাবার অভ্যাস—শীতে ব্যাডমিন্টন, বর্ষায় স্কুলের মাঠে ফুটবল, কিংবা স্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবসে নাটক, এ—ছাড়া কত যে আকর্ষণ, মেজদা ঢাকা থেকে এলে তার সঙ্গে শিকারে যাওয়া, অথবা নদীর চরে ডাল ফেলে রাখা হয়, জোয়ারের জলে ডুবে যায় ডালপালা, ভাটার মুখে জল নামার আগে সব ডালপালা ঘিরে ফেলা হয় বাঁশের বানা দিয়ে। জল নেমে গেলে, সেই ডালপালা সরিয়ে দিলে জলে কাদায় তাজা মাছের ছড়াছড়ি। গলদা চিংড়ি, কালিবাউশ, ভেটকি থেকে কই পুঁটি ট্যাংরা কিছুই বাদ থাকে না। দাদারা পছন্দমতো মাছ ঝুড়িতে তুলে দিতে বলে, জেলেরা মাছের ঝুড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়, সে আর তিথি তার পেছনে পেছনে ছোটে।
তখন তার মনেই থাকে না, সে তিথির জন্য কাজ বাড়িয়ে রেখে যাচ্ছে। বই খাতা সব চকিতে ছড়ানো ছিটানো। কলম পেনসিল, জিওমেট্রি বক্স যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। স্কুল থেকে ছুটে আসে। যেন সে তাড়াতাড়ি বের হতে না পারলে তার মজা উপভোগ করার সময় পার হয়ে যাবে। তিথি আছে, সে—ই সব করবে।
সে—ই সব তুলে রাখে। সাজিয়ে রাখে। জিওমেট্রি বক্স খোলা, বাক্সের সবকিছু এলোমেলো, তিথির কাজই হল, ঠিকঠাক তুলে রেখে দেওয়া। এত যে মজা উপভোগ করতে পারে তিথি আছে বলেই।
তিথি কেমন ভীরু পায়ে লন পার হয়ে এগিয়ে আসছে।
সে বুঝতে পারছে না তার কী দোষ।
অরু সিঁড়ি থেকে নড়ছে না।
তিথি অত্যন্ত ভীরু মুখেই বলল, আমি কী করেছি?
আগে কাছে আয়।
তিথি ভয়ে কাছে যাচ্ছে না।
বলোই না। আমি তো কাছেই আছি।
ঘরে আয়।
না ঘরে ঢুকব না।
ঢুকবি না?
তুমি কি আমাকে মারবে?
তোকে মারতে পারলে ভালো হত। তুই কখন রাতে বাড়ি যাস? সারাদিন বাবুদের বাড়িতে পড়ে থাকতে ভালো লাগে?
তিথি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
রাতে তুই রোয়াকে বসে থাকিস কেন? তুই কি রাতে বাবুদের বাড়িতে খাস। তোকে কি তারা দু—বেলা খেতে দেয়।
দেবে না কেন? যখন যা বেশি হয় দেয়। সবাই খেলে কিছু তো পড়ে থাকেই। আমি আলাদা থালায় তুলে রাখি। ওতেই পেট ভরে যায়।
সারাদিন ধরে বাবুদের বাড়ির সবার উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে বেড়াস? তোর খারাপ লাগে না।
বারে, খারাপ লাগার কী আছে। তুমি কি এজন্য আমাকে ডেকেছ? আমার কত কাজ জানো? তুমি জানো, ছোড়দির আজ পুতুলের বিয়ে। আমি না গেলে সব কাজ পড়ে থাকবে। পুতুলের জামাকাপড় আমি না গেলে পরাবে কে! দেরি হলে রাগ করবে। আমাকে খামচে দেবে। আমার ফ্রকও ছিঁড়ে ফেলতে পারে। ছোড়দির বেজায় রাগ জানো? আমাকে কি বলেছে জানো?
কী বলেছে!
তুমি নাকি ছোড়দিকে দেখলে পালাও।
মিছে কথা।
ছোড়দি মিছে কথা বলে না। ছোড়দি তো কাউকে ভয় পায় না। মিছে কথা বলতে যাবে কেন?
পালাই! বেশ করেছি। বলবি বেশ করেছি।
ছোড়দির সঙ্গে কথা বলো না কেন? তাই তো খেপে যাচ্ছে। তোমাকে দূর থেকে দেখলেই বলবে, দাঁড়া না অরুকে আমি মজা দেখাচ্ছি। ভুঁইঞাকাকাকে বলে এমন মার খাওয়াব না, জীবনেও ভুলতে পারবে না।
তিথি তার সঙ্গে এতদিন নিজের কথাই বলেছে—সে কারও নিন্দামন্দে থাকে না। তুলির কোনও কথাই এতদিন বলেনি। আজ কি তিথি বুঝতে পেরেছে, সে উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেড়ালে, তার অরুদাকে ছোট করা হয়। অরুদাকে বিশ্বাস করে সে কি তাকে নিজের মানুষ ভেবে ফেলেছে।
তিথি বলল, ঠিক আছে পরে কথা হবে। বলেই ছুট। একদণ্ড আর দাঁড়াল না। বাটিতে মুড়ি আর দুটো সন্দেশ নিয়ে এসে হাজির। ঘরে আলাদা তার কাঁসার গেলাস আছে, কুঁজো থেকে গেলাসে জল ভরে একটা টিপয়ে রেখে বলল, আমি যাচ্ছি অরুদা। দরজা খোলা রেখে উধাও হবে না। শেকল তুলে দিয়ে যাবে। কুকুর বিড়ালের উৎপাত আছে বোঝ না।
তারপর আর তিথি একদণ্ড দাঁড়াল না। বড় বেশি লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে, লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়ায়। তিথি দৌড়ে মাঠ পার হয়ে লনের ভেতর ঢুকে গেল। অরু বাইরে দাঁড়িয়েছিল, তিথি একসময় পাঁচিলের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
তার এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে বের হয়ে যাওয়া দরকার। দেরি হলে বিশুদা, অমল, কমল সবাই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। শহর থেকে মেজদা নতুন র্যাকেট নিয়ে এসেছে। কর্ক এনেছে এক ডজন। শীতের শেষাশেষি নদীর পাড়ে নেট টাঙিয়ে আজ থেকে ব্যাডমিন্টন খেলা শুরু হবে। সে সঙ্গে না থাকলে বাঁশ, খোনতা কে নিয়ে যাবে! সে একজন আমলার পুত্র, এ—কাজটা তারই করা উচিত।
গোলঘরে যাবার সময়ই ভাবল, তিথিকে বড় বড় কথা না বললেই পারত। তিথি খারাপ পেতে পারে। তিথি এভাবে বাবুদের উচ্ছিষ্ট খেয়েই বড় হয়ে উঠেছে। কেন যে মনে হল বাবাও তার উচ্ছিষ্টভোজী এবং সেও। তার মুখে অত বড় বড় কথা শোভা পায় না। তিথি তার কথা শুনে ভাগ্যিস হেসে ফেলেনি।
তারপরেই মনে হয় কাজ করলে মানুষ ছোট হয়ে যায় না। হাতে র্যাকেট নিয়ে সেও খেলবে। খেলার নামে তার মধ্যে ঘোর সৃষ্টি হয়। নদীর পাড়ে যখন তারা নেট টাঙিয়ে খেলছিল, তখন আর নিজেকে কিছুতেই খাটো ভাবতে পারেনি। ফেরার সময় মনে হল সে রাজ্য জয় করে ফিরছে।
তবে তুলি বাবাকে মিছে অভিযোগ করে মার খাওয়াবার পরিকল্পনা করছে, ভাবতেই ভারী দমে গেল। তুলির সঙ্গে যাও ইচ্ছে হয়েছিল, দেখা হলে একদিন কথা বলবে, তাও আর বোধহয় হবে না। কি বলতে কি ভেবে নেবে কে জানে। আর তুলিকে সে কী কথা বলবে? তুমি ভালো আছো? তুমি দেখতে খুব সুন্দর। খুব বোকা বোকা কথা! তুলির সঙ্গে কথা বলার মতো ভাষাই তার জানা নেই।
সবাই চলে গেছে, নদীর পাড়ে মানুষজন কমে আসছে, দূরে স্টিমারঘাটে গ্যাসবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘাটে যাত্রীদের ভিড় আছে। রাত আটটায় স্টিমার আসবে, যাত্রী নামবে, যাত্রী উঠবে। আশরাফ সারেঙ জাহাজ ভর্তি করে লোক তুলে নিয়ে যাবে। তার খুবই ইচ্ছে হয়েছিল, আশরাফ সারেঙের সঙ্গে ঘাটে গিয়ে একদিন দেখা করে। কিন্তু হয়ে ওঠে না। গোলঘরে তখন সবার সঙ্গে তাকেও পড়তে বসতে হয়। মাস্টারমশাই প্রাসাদের বড় বড় জানালা দেখিয়ে বলেন, এই হচ্ছে আয়তক্ষেত্র। ঘরের মেঝে দেখিয়ে বলেন, এই হল বর্গক্ষেত্র—যার চারটি বাহুই সমান।
পড়াশোনার পীড়নও কম নয়। ক্লাশে পড়া না পারলে ঠিক বাবার কানে কথা উঠে যায়।
ভুঁইঞামশায় আছেন?
দ্বিজপদ সার এসে হাজির।
তোমার বাবা কোথায়।
সে বুঝতে পারে দ্বিজপদ সার নালিশ জানাতে এসেছেন। সে দরজা খুলে সামনের বারান্দায় একটা টিনের চেয়ার বের করে দেয়। তারপর বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। ইংরেজি গ্রামার ট্রানস্লেশনে সে কাঁচা, তার নাকি মনোযোগেরও অভাব আছে—দ্বিজপদ সার সে—সব কথা বলতেই হয়তো এসেছেন। সে তার বাবাকে খুঁজতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে যায়।
এভাবে সে কতদিন কত কারণে নদীর পাড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কাছারিবাড়িতে ঢুকতে ইচ্ছে হয় না। বাড়ির জন্য মন কেমন করে তখন। পূজার ছুটিতে সে বাড়ি যেতে পারবে, পূজার তো এখনও অনেক দেরি। নতুন উপসর্গ তুলি। তাকে ভয় দেখিয়েছে, তুলি মিছে কথা বলে না। তুলি কাউকে ভয় পায় না। ভয় না পেলে যেন মিছে কথা বলা যায় না।
নদী থেকে হাওয়া উঠে আসছে। জোয়ারে নদীর জল বাড়ছে। দেখতে না দেখতে বর্ষা এসে যাবে। বর্ষায় নদী বিশেষ করে এই কোয়ালা নদীতে কুমির পর্যন্ত ভেসে আসে। তিথিই তাকে একদিন খবর দিয়েছিল, জমিদার হেমন্ত রায়চৌধুরীর বৈঠকখানার বারান্দায় শ্বেতপাথরের টেবিলে একটা কুমিরের ছাল আছে। তিথি তাকে সেখানে একদিন নিয়ে যাবে, এমনও কথা দিয়েছে।
নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকলে কত কথা মনে হয়। আর কত পাখির ওড়াউড়ি, কোথা থেকে আসে, কোথায় যায় সে কিছুই জানে না। বর্ষা এলে দু—পাড়ের চর ডুবে যায়। নদীর ঘাটগুলিতে যত সিঁড়ি আছে সব জলে ডুবে যায়। তিথিই সব খবর দেয় তাকে। কিন্তু তুলির খবরটা না দিলেই পারত। এমন সুন্দর মেয়েটা এত কুবুদ্ধির ডিপো ভাবতেই তার কষ্ট হচ্ছিল।
তবে বাবা তাকে কখনোই গায়ে হাত তোলেনি। বাবাকে বলে মার খাওয়ানো সহজ না। বাবা কি পুতুল! সে সাহস পায়। ঘাটলার সিঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়ায়। আকাশ আর মেঘমালায় ঢেকে আছে চারপাশ। দুটো একটা নক্ষত্রের প্রতিবিম্ব জলে ভাসছে। ছলাত ছলাত জলের শব্দ। গুন টেনে নিয়ে যাচ্ছে মাঝিরা। কত দূর দেশে চলে যায় কত লোক। সেও চলে এসেছে—তিথির জন্যই হোক কিংবা এই গ্রাম, মাঠ, স্কুল, মজা খাল বিশাল সব প্রাসাদ আর বাবুদের জাঁকজমক, যেমন জমিদার হেমন্ত রায়চৌধুরীর আস্তাবলে বিশাল দুটো আরবি ঘোড়া এবং ঘোড়ায় চড়ে নদীর পাড় ধরে হরিশবাবুর ছোটা, যে না দেখেছে, সে জানেই না, এক আশ্চর্য অশ্বারোহী কদম দিতে দিতে বিন্দু থেকে বিন্দুবৎ হয়ে যেতে পারে। হরিশবাবু দেশে এলে তিথি তাকে নিয়ে নদীর পাড়ে ছুটে যাবেই কারণ হরিশবাবু বিকেলে ঘোড়ায় চড়ে নদীর পাড়ে হাওয়া খেতে বের হন। তিথি তাকে গোপনে একটা চিরকুট ধরিয়ে দেয়। চিরকুটে কী লেখা থাকে সে জানে না। তিথি চিরকুট হোক, চিঠি হোক খুবই গোপনে হরিশবাবুর হাতে দিয়ে দেয়। ঠিক ঘাটলার পাশে কদম দিতে দিতে তিথির সামনে এসে দাঁড়াবেন। তারপর ভারী সতর্ক নজর। ঘোড়ার উপরেই তিনি বসে থাকেন। নুয়ে তিথির চিঠিটা নিয়েই দিঘির পাড় ধরে অদৃশ্য হয়ে যান।
আসলে অরুর মাঝে মাঝে কেন জানি মনে হয় কোনও স্বপ্নের পৃথিবীতে সে এসে উঠেছে। বাড়ির জন্য প্রথম প্রথম খুবই মন খারাপ করত, কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, তত তার মনে হয় মন খারাপ আর আগের মতো হয় না। সে তো দেখতে পায় তুলি সাটিনের ফ্রক গায় দিয়ে মাথায় সুন্দর লাল রিবন বেঁধে কখনও সুপারিবাগানে, কখনও নদীর চরে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে কেউ থাকে। সে কাছে থাকে না, ঝোপজঙ্গলের আড়াল থেকেই সে তুলিকে দেখতে বেশি ভালোবাসে। তুলি কাছাকাছি এলেই সে দৌড়ে পালায়—যদি তুলি টের পেয়ে যায়, সে চুরি করে চরের উপর একটা জ্যান্ত পরীর ওড়াউড়ি দেখছিল—ধরা পড়লে কেলেঙ্কারির একশেষ—সে না পালিয়ে থাকে কী করে!
তুলি মিছে কথা বলে না, তিথি ঠিকই বলেছে।
তুলি ঠিক টের পেয়েছে সে তাকে দেখে, তাকে দেখার জন্য নদীর পাড়ে কিংবা কাছারিবাড়ির বড় বড় আমগাছের আড়ালে সে দাঁড়িয়ে থাকে। কখনও বাবুদের সঙ্গে স্টিমারঘাটে গেলেও সে যে তুলির পিছু নেয়, তাও টের পেতে পারে। কখনোই তুলির সামনে যেতে সাহস পায়নি। রান্নাবাড়িতেই কখনও রাতে সে কাছ থেকে তুলিকে দেখতে পায়। রোজদিন দেখা হয় না। তুলি আগে খেয়ে নিলে দেখা হওয়ার কথাও নয়, তার যে কি হয়, সে রান্নাবাড়িতে মাথা নিচু করেই খায়। চোখে চোখ পড়ে গেলে কত বড় বেয়াদপি, সেটা সে বোঝে। তুলি অপছন্দও করতে পারে। বাড়ির একজন আমলার পুত্রের এত আস্পর্ধা হয় কী করে! সাটিনের ফ্রকের নিচে তুলি আজকাল টেপ দেওয়া জামাও পরে।
তুলির এত সে জানে, তুলি কেন জানবে না, তুলিকে দেখলেই সে পালায়।
কাছারিবাড়ির দিকে সে হেঁটে যাচ্ছে। বাবার সঙ্গে তার কমই দেখা হয়। বাবার ছুটিছাটা নেই। রবিবার শনিবার নেই। সেই আটটায় গিয়ে নাজিরখানায় বসেন, তক্তাপোশে সাদা ধবধবে ফরাস পাতা—দু—তিনটে তাকিয়া, সামনে কাঠের একটা বড় ক্যাশবাক্স, দেয়ালের দিকে গোটা দুই লম্বা টুল, লোকজন সব সময় বাবার কাছে বসেই থাকে—আদায়পত্র, কিছু সুদেরও কারবার আছে, নদী থেকে বড় রকমের রোজগার আছে বাবুদের—নদীর ডাক হয়—ইলিশমাছের জো পড়লে আদাইয়ের পরিমাণ বাড়ে।
সকালবেলাতেই ভেতর বাড়ি থেকে একটা লম্বা ফর্দ চলে আসে। বাবা ফর্দ মিলিয়ে সব কিছু নিয়ে আসার জন্য হরমোহনকে বাজারে পাঠিয়ে দেন। যার যা দরকার, বাবার কাছে দরকারমতো চিরকুট আসে। লম্বা খেরো খাতায় বাবা সব খরচখরচা এবং আদায় কী হল সব টাকার জমা খরচ তুলে রাখেন। সাঁজবেলায় দেবকুমারবাবু কিংবা নবকুমারবাবুর কাছে সারাদিনের খরচ খরচা এবং আয়ের হিসাব অর্থাৎ খেরো খাতাটি সম্বল করে বাবা তাদের কাছে চলে যান। মামলা মোকদ্দমা অথবা তালুকের প্রজাদের বাদবিসংবাদে বাবাকেই ছুটতে হয়।
যত তার কথা রাতে।
তোমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো অরু?
আজ্ঞে না।
বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে না তো?
আজ্ঞে না।
মন দিয়ে লেখাপড়া করবে। পড়া বুঝতে না পারলে দ্বিজপদকে বলবে।
তখনই একদিন সে তার বাবাকে কেন যে বলল, আচ্ছা বাবা আমার জামাপ্যান্ট আমি কেচে নিতে পারি না।
পারো।
সকালে তিথির জল তুলে দিয়ে যাওয়ার কিন্তু দরকার হয় না। আমিই তুলে রাখতে পারি।
ইচ্ছে করলে সবই করা যায় অরু। এতে সাবলম্বী হওয়া যায়। সবকিছু নিজে করে নিতে পারার মতো বড় কিছু নেই।
আমি তিথিকে ঘরে ঢুকতে বারণ করে দেব।
কেন? সে কী করেছে।
কিছু করেনি। তিথির কত কাজ ভেতর বাড়িতে। সে সব করে কখন?
অঃ এই কথা। তবে তিথি কি দমবার পাত্র। আমার তো মনে হয় না রাজি করাতে পারবে।
বাবার কথাই ঠিক।
সে তিথিকে নিষেধ করেছিল।
শোন তিথি, এই কাজটুকু তোর না করলেও চলবে।
তিথি বড় বড় চোখে তাকিয়েছিল তার দিকে। যেন কিছুই বুঝতে পারছে না।
জলটল আমিই তুলে রাখব। বিছানা করে নিতে আমার অসুবিধা হবে না। জামাপ্যান্ট গোলা সাবানে কাচতে কতটুকু সময় লাগে বল।
ঠিক আছে করে নেবে। করতে পারলে তো ভালোই। তারপরই তিথি সিঁড়ি ধরে নামার সময় ভেংচি কেটে বলল, কত মুরদ। জানা আছে। তিনি সব করে নেবেন তা হলেই হয়েছে!
কিন্তু তিথি বোধহয় শেষে অবাকই হয়ে গেছিল, সে তো ছেড়ে দেবার জন্য বসে নেই। তিথি যখন দেখল, কোনও কাজেই তার ত্রুটি থাকছে না, কেমন দিন দিন বিমর্ষ হয়ে যেতে থাকল। স্কুলে যাবার সময় দেখতে পায় তিথি সিঁড়িতে গালে হাত দিয়ে বসে আছে, স্কুল থেকে ফিরেও দেখতে পায় গালে হাত দিয়ে বসে আছে। কাজের কোনও খুঁতই ধরতে পারছে না, ক্ষোভে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। আর একদিন এসে দেখল, সারা ঘর তছনছ করে রেখেছে কে! মেঝেতে বালতির সব জল ঢেলে দিয়েছে কেউ। ঘরে ঢুকেই অরুর মাথা খারাপ। তিথির কাজ। তিথিই শেকল খুলে সব তছনছ করে দিয়ে গেছে। কাজ কেড়ে নেওয়ায় তার বোধ হয় সহ্য হচ্ছে না।
তিথি! তিথি!
সে দরজার বাইরে লাফিয়ে নেমে গেল।
তারপর তিথিদের বাড়ির দিকে ছুটল।
না কোথাও তিথি নেই।
কোথায় গেলে মেয়েটা?
অরণি কাউকে বলতেও পারছে না, আমার ঘর তিথি তছনছ করে দিয়েছে। বইটই পেনসিল খাতা সারা চকিময়। জলে ভাসছে মেঝে। কাঁসার ঘটি গেলাস গড়াগড়ি খাচ্ছে চকির নিচে। এটা যে তিথিরই কাজ বলে কি করে!
শেষে সে তিথিকে খুঁজে পেল সুপারিবাগানের ভেতর। গাছগুলো খুবই পাতলা, দূর থেকেও দেখা যায় ভেতরে কেউ বসে থাকলে। তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে নদীতে। নদীর জল তেমনি ছলাত ছলাত। পাড় ভাঙারও শব্দ পেল। হরিশবাবুর ঘোড়াও ছায়ার মতো দূরে ভেসে উঠল।
অরু ছুটে যাচ্ছে।
সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে সোজা ছোটা যায় না। সে এ—গাছ ও—গাছ ডাইনে বাঁয়ে ফেলে বাগানে ঢুকে যাচ্ছে।
আর ডাকছে, এই তিথি, এখানে লুকিয়ে থেকে রক্ষা পাবি ভাবছিস! তোর বাবাকে ডেকে সব না দেখাচ্ছি তো আমার নাম অরণি না। তোর এত জেদ!
এই কি, কাছে গিয়ে কী দেখছে!
তিথি গাছের গুঁড়িতে বসে আছে মাথা নিচু করে। ডাকলেও সাড়া দিচ্ছে না।
অরু জোর করে মুখ দেখার জন্য তিথিকে চিৎ করে দিল। তিথি বিন্দুমাত্র জোরাজুরি করল না। কারণ তিথি বোকার মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদছে—আমি কী করব বলে দাও। আমি কী নিয়ে থাকব বলে দাও।
অরণি হতভম্ব। বুঝতে পারছে না, সে হাসবে না রাগ দেখাবে। আমি কী করব, কী নিয়ে থাকব—এত পাকা পাকা কথা মেয়েটার, এটুকুন মেয়ে কেমন সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে। তিথির পক্ষেই সম্ভব?
নে ওঠ। ঘরে চল। যে হাতে সব তছনছ করেছিস সেই হাতে সব সাজিয়ে রাখ। স্টিমারঘাট থেকে বাবা ফিরে এলে মুশকিলে পড়ে যাবি।
তিথি হি হি করে হাসতে হাসতে উঠে বসল, তারপর ছুটতে থাকল, যেন সে জয়লাভ করে খুবই খুশি—ছোটার মধ্যে তিথির এত সজীবতা থাকে যে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এক বিনুনি বাঁধা, মার্কিন কাপড়ের ঢোলা সেমিজ গায়ে, উসখোখুসকো চুলে মেয়েটার লাবণ্য যেন আরও বেড়ে যায় তখন। আর তখনই মনে হয়েছিল, তিথি চিৎ হয়ে পড়ে থেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল ঠিক, আবার সঙ্গে সঙ্গে এমন চোখে ওকে দেখছিল যেন কিছু একটা হয়ে যাক। আর কিছু না হোক, অরুদা তাকে আদর করলে সে আপত্তি করবে না।
এই সব মনে হলেই তিথির জন্য তার কষ্ট হয়। সে ধীরে ধীরে হাঁটে। তার কিছু ভালো লাগে না। অমলদা যাবার সময় তাকে ডেকে গেছে, এই অরু ঘাটলায় গিয়ে আবার বসলি কেন? পড়াশোনা নেই।
সে সাড়া দেয়নি। কিন্তু গোলঘরে সবাই পড়তে চলে যাবে। তাকেও হাতমুখ ধুয়ে মাস্টারমশাইর সামনে গিয়ে পড়তে বসতে হবে, সে না গেলে দাদারাই খুঁজতে বের হবে। কাছারিবাড়িতে এসে খুঁজবে তাকে।
সে পা চালিয়ে হাঁটছে। সুপারিবাগান পার হয়ে কাছারিবাড়ির মাঠে ঢুকতেই মনে হল কারা যেন মাঠে তার জন্য অপেক্ষা করছে। কাছে গেলে দেখল তিথি আর তুলি। তুলিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। তার সঙ্গে তুলির ভাব না হলে তিথি বোধহয় স্বস্তি পাচ্ছিল না।
তিথি বলল, কোথায় একা একা ঘুরছিলে। জানো সাঁজবেলায় তেঁতুলতলা দিয়ে কেউ আসে না। জায়গাটা ভালো না। একা একা তেঁতুলতলা দিয়ে চলে এলে!
আসলে রাস্তা সংক্ষিপ্ত করার জন্যই সে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তেঁতুলতলার নিচ দিয়ে উঠে এসেছে। জায়গাটা যে ভালো না সেও শুনেছে। ছোটপিসিকে এখানে একবার ভূতে ধরেছিল—সাঁজ লাগলে রাস্তাটা দিয়ে কেউ বড় আসে না। তুলির আক্রোশের কথা ভাবতে গিয়ে এতই দমে গিয়েছিল, তার কোনও কিছুই প্রায় খেয়াল ছিল না। সেই তুলি অরুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক, তবে তাকে দেখছে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রিয় কোনও নক্ষত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে যেন।
তিথি না পেরে বলল, এই ছোড়দি, অরুদাকে কী বলবে বলেছিলে?
কী বলব?
কেন, বললে না, চল তো, অরুর সঙ্গে আমার কথা আছে।
কখন বললাম?
জানি না বাপু, তা হলে আসার কী দরকার ছিল। অরুদা তুমি যাও। হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসোগে।
অরু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সে পা বাড়াতেই তুলি বলল, সেদিন মাঠের আড়ালে দাঁড়িয়ে কী দেখছিলে?
কবে?
মনে নেই তোমার। আমি চরের বালিতে বাণীপিসির সঙ্গে হাওয়া খাচ্ছিলাম।
অরু সোজাসুজি বলল, না। মনে নেই।
না, আচ্ছা নাই মানলাম। তারপরই বলল, আমি বাঘও নয় ভালুকও না। আমার সঙ্গে কথা বললে জাত যাবে না। কি মনে থাকবে?
কী কথা বলব?
কথার কি শেষ আছে। আমাকে চুরি করে দেখলে খুব রাগ হয় আমার জানো?
ঠিক আছে আর দেখব না।
তিথি বলল, তুমি ছোড়দিকে তবে সত্যি চুরি করে দ্যাখো!
কী বলব, ও যখন বলছে—
ও বললেই তুমি মেনে নেবে। এ কেমন কথা। চুরি করে দেখার কী আছে!
অরু কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। এই চুরি করে দেখার মধ্যে কি কোনও অন্য অনুভূতি কাজ করে। সে বড় হয়ে যাচ্ছে। সে নিজেকে যতই আড়াল করে রাখুক তার ভেতর একজন নারী যে স্বপ্নে বড় হয়ে উঠছে বুঝতে পারে। এই সব গোপন কথা যদি সত্যি ফাঁস হয়ে যায়, তবে সে মুখ দেখাবে কী করে! বাবা যে তবে খুবই জলে পড়ে যাবেন। সেদিনের ছেলে, ক্লাশ এইটে সে পড়ে, তার মধ্যে একজন নারী স্বপ্নে বড় হয়ে উঠলে যে রোগব্যাধির পর্যায়ে পড়ে। কলঙ্কও কম না।
তখনই তুলি বলল, আমি কাউকে কিছু বলতে যাচ্ছি না। আমার পুতুলের বিয়ে আজ। তুমি খাবে। তিথি এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। না গেলে রাগ করব।
পুতুলের বিয়ে নিয়ে অরুর এক ধন্দ। সে খাবে। কী খাবে? সে যাই হোক অরু বুঝল, সে তুলিকে দেখে যা ভাবে, তুলিও তাকে দেখলে তেমনই কিছু একটা ভাবে। তুলি তার বিরুদ্ধে খুব বেশি কিছু রটাতে সাহস পাবে না। তুলি নিজেও ভেতরে ভেতরে বড় হয়ে যাচ্ছে। তুলিও তার শরীর নিয়ে ঠিক কিছু ভাবে।
এভাবে সন্ধ্যার ম্লান অন্ধকারে অরুর মুখ রক্তাভ হয়ে গেল। ভেতরে এক অতীব স্পৃহা শরীরের কোষে কোষে ঢেউ তুলে দিচ্ছে। সে কোনওরকমে কাছারিবাড়িতে ঢুকে তক্তাপোষে বসে পড়ল।
হাতমুখ ধোয়ার কথা মনে থাকল না।
কেমন ভ্যাবলু বনে গেছে যেন।
মনে হয় তার জীবনে এই প্রথম এক পালতোলা নৌকা এসে হাজির। নৌকায় উঠে গেলেই এক রহস্যময় দেশ, শরীরে সুঘ্রাণ—হাতে পায়ে জংঘায় পদ্মফুলের ছড়াছড়ি। নরম পাপড়ি, কোমল ত্বকের ভিতর ফুটে থাকা নরম স্পর্শে তার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। সে হাত পা টান করে একটা বালিশ টেনে শুয়ে পড়ল। কেমন অসাড় হয়ে যাচ্ছে তার শরীর।
তখনই দ্বিজপদ সারকে অরুর নামে নালিশ।
সার দিন দিন অরু ফাঁকিবাজ হয়ে যাচ্ছে। এখনও তার আসার নামগন্ধ নেই। কখন পড়তে বসবে!
দ্বিজপদ বুঝতে পারেন, যতক্ষণ তিনি পড়ান, ততক্ষণ বাবুদের ছেলেরা হাজতখানায় বসে থাকে। অরু না আসায়, তাদের ক্ষোভ বাড়ছে। হাজতখানার আর এক কয়েদির পাত্তাই নেই। সার শুধু একবার বলেছিলেন, অরুর শরীর খারাপ।
কমল বলল, ডাহা ফাঁকিবাজ সার। পড়ার নামে মাথায় বাজ পড়ে। কী করছে, কাছারিবাড়িতে! দেখে আসব সার?
দ্বিজপদ হাসলেন। আসলে পড়া থেকে ফাঁকি দেবার সুযোগ খুঁজছে। ভুঁইঞামশায়ের পুত্রটি পড়াশোনায় বেশ ভালো। পড়াশোনায় অরুর যথেষ্ট আগ্রহও আছে। যথাসময়েই সে চলে আসে। দ্বিজপদ ঘরে ঢুকে আর কাউকে দেখতে না পেলেও, অরুকে দেখতে পান। দ্বিজপদ ঘরে ঢুকলে সে উঠে দাঁড়ায়। নম্র স্বভাবের ছেলেটির পড়াশোনার ভার ভুঁইঞামশায় তার হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন, সে যদি না আসে, চিন্তারই কারণ। আমবাগানের এক কোনায় কাছারিবাড়িতে একাই তাকে থাকতে হয়। দ্বিজপদ কী ভেবে বললেন, ঠিক আছে। আমিই দেখে আসছি।
এতে সবাই একবাক্যে সায় দিল, সেই ভালো সার।
অর্থাৎ তিনি যতক্ষণ না থাকবেন, ততক্ষণই তাদের রেহাই।
বিশু বলল, আমি যাব সঙ্গে।
কী দরকার!
কমল বলল, টর্চ নিলেন না?
তা সাপখোপের উপদ্রব আছে। নদীর পাড়ে বাড়ি। ঝোপজঙ্গল, কোথাও কোথাও প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপও আছে। বিষধর ভুজঙ্গের উৎপাতও কম না। তিনি কী ভেবে টর্চ বাতিটা সঙ্গেই নিলেন।
ঘর থেকে বের হলেই দুটো করবীফুলের গাছ, তারপর একটা হাসনুহানার গাছ। গাছটায় দু—একটাই ফুল ফোটে। ফুলের তীব্র গন্ধ ছড়ালেই বোঝেন, গাছে কোথাও ফুল ফুটেছে। গাছটা মাথায় আনারসের ডিগের মতো লম্বা ঘন পাতায় ঝোপ সৃষ্টি করে রেখেছে। গাছটার নিচ দিয়ে যাবার সময় তিনি খুব সতর্ক থাকেন। কেন যে মনে হয় যে—কোনও মুহূর্তে পাতার ঝোপ থেকে পোকামাকড় লাফিয়ে পড়বে। খুবই দুর্লভ ফুলের গাছ। দিনের বেলাতেও ফুল খুঁজে বের করা কঠিন—অথচ ফুল যে ফুটেছে, গন্ধেই টের পাওয়া যায়। বিষধর সাপেদের বড় প্রিয় এই ফুলের ঘ্রাণ। একেবারে রাস্তার উপর গাছটা জমিদারবাবুরা না লাগালেই পারতেন। তিনি কী ভেবে গাছটার নিচে ঢুকে যাবার আগে টর্চ মেরেও দেখলেন। প্রায় বিশাল ছত্রাকার হয়ে আছে গাছের মাথাটি। ঘন সবুজের সমারোহ।
গাছটা পার হলেই সবুজ লন। শীত বসন্তে নীল রঙের বেতের চেয়ার টেবিল পাতা থাকে। বাবুরা বিকালে হাওয়া খান এখানটায় বসে। নদীর জলে নৌকা ভাসে। রাতে স্টিমারের সার্চলাইটে কেমন নীলাভ দেখায় এলাকাটা। বাবুদের আত্মীয়স্বজনও কম না। এখানে বসে তাস পাশার আড্ডাও জমিয়ে তোলার ব্যবস্থা থাকে।
দ্বিজপদ যাচ্ছিলেন, তার ছাত্রটি কাছারিবাড়িতে একা একা কী করছে, শরীর যদি খারাপ হয়, এই সব ভেবেই আমবাগানে ঢুকে গেলেন। এক ইটের দেয়াল, মাথায় টিনের চাল, আটচালার উপরে গাছের ডালপাতায় জায়গাটা খুবই অন্ধকার হয়ে আছে। মূল বাড়ি থেকে বড়ই আলগা কাছারিবাড়িটা। অরু ছেলেমানুষ সে এমন একটি পরিত্যক্ত জায়গায় একা বসে থাকতেও ভয় পাবে।
সে কি ঘরে নেই?
দরজা খোলা?
টর্চ মেরে দূর থেকেই সব টের পাচ্ছেন।
কেউ হারিকেনও জ্বালিয়ে দিয়ে যায়নি।
দ্বিজপদ কিছুটা দ্রুতই হেঁটে যেতে থাকলেন।
ঘরে ঢোকার আগে ডাকলেন, অরু আছিস! অরু।
কোনও সাড়া নেই।
তাজ্জব। ছেলেটা গেল কোথায়?
ভেতরে টর্চ মারতেই দেখলেন, অরু শুয়ে আছে একটা লম্বা সাদা চাদরে মুখ মাথা ঢেকে। সে কি ঘুমোচ্ছে!
এই অসময়ে!
এই অরু, অরু।
অরু ধড়ফড় করে উঠে বসল।
ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছিস, কী ব্যাপার, শরীর খারাপ!
টর্চের আলো চোখে পড়ায়, অরু তাকাতে পারছিল না। সে হাতে চোখ আড়াল করে বোঝার চেষ্টা করল, কে তাকে ডাকছে!
তার যে কী হয়েছিল! সে কী বলবে। লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে থাকা ছাড়া তার যেন আর অন্য কোনও উপায় নেই। সার নিজে চলে এসেছেন। এতে সে আরও শঙ্কিত হয়ে উঠল। সে ঘরে কখন ঢুকে গেছে, কখন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিল—শরীরে তার যেন কীসের ঘোর উপস্থিত। চোখ মুখ জ্বালা করছিল, এবং শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে আশ্চর্য এক ঝড়ের আভাস। ঝড়ে তাকে বড়ই বিপর্যস্ত করে দিয়ে গেছে—সে কিছুটা যেন চৈতন্যও হারিয়েছিল—এক গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত পৃথিবীতে সে স্বপ্নের বালিহাঁস হয়ে গেছিল। কোনও শিকারের দৃশ্য, সে মজবুত হাতে হাঁসটার ডানা, কিংবা পালক ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে।
লজ্জায় সে কথা বলতে পারছিল না।
কী হয়েছে? শরীর খারাপ অরু?
আজ্ঞে। সে কথা বলতে পারছে না।
ভয় পেয়েছিস?
আজ্ঞে… সে কথা বলতে পারছে না।
ঘরে হারিকেনও জ্বালিসনি!
আজ্ঞে আমি যাচ্ছি সার।
আয়। তোর একা থাকতে ভয় করলে, কারও এ—ঘরে থাকা দরকার। সত্যি তো, তুই থাকিস কী করে। ঠিক আছে, ভুঁইঞামশায়কে বলছি।
আজ্ঞে না সার বলবেন না। আমার একা থাকতে ভয় করে না। আপনি বাবাকে কিছু বলবেন না।
হারিকেন ধরা।
সে চকি থেকে নেমে হারিকেন ধরাল।
এখন তার ধীরে ধীরে সবই মনে পড়ছে। তিথি হারিকেনের চিমনি মুছে তেল ভরে রেখে গেছে। দরকারে সে জ্বালিয়ে নেয়। নিবিয়ে দেয়। আজ ঘরে ঢুকে কিছুই মনে ছিল না। শরীরে ঘোর উপস্থিত হলে এমনই বুঝি হয়—সে তার দ্বিতীয় সত্তা আবিষ্কার করে কেমন নির্বোধ হয়ে গেছে আজ।
সে খুবই ধীর পায়ে বই খাতা নিয়ে ঘর থেকে বের হবার আগে আলো কমিয়ে দিল হারিকেনের। তারপর দ্বিজপদ সারের পিছনে প্রায় চোরের মতো হেঁটে যেতে থাকল। তার মনেই থাকল না, তুলি তার পুতুলের বিয়েতে খেতে বলেছে। বড়লোকের মেয়ে তুলি, তার পুতুলের বিয়ে—সেখানে একমাত্র নিমন্ত্রিত অতিথি বোধহয় সেই ছিল। কারণ সকালে তিথির গালিগালাজে প্রায় ভূত ভেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। তুমি কী অরুদা! ছোড়দি কত আশা নিয়ে বসেছিল, তোমাকে সে সামনে বসিয়ে লুচি পায়েস খাওয়াবে। তুমি পাত্তাই দিলে না। ভুঁইঞাকাকার সঙ্গে রান্নাবাড়িতে খেতে ঢুকে গেলে! তোমার কপালে অনেক দুঃখ আছে।
অরু খেপে গিয়ে বলল, আমার কপালে না তোর কপালে!
বারে, আমার কী দোষ!
হরিশবাবুকে ছোটপিসির চিরকুট গোপনে পাচার করিস, ওটা বুঝি দোষ না।
তুমি অরুদা নিষ্ঠুর। জানো, ছোটপিসি বালবিধবা?
জানব না কেন? তাই বলে তোকে দিয়ে চিঠি পাচার করাবে! জানতে পারলে তোর কী হবে জানিস?
কী হবে?
অন্দর থেকে তোকে বাবুরা তাড়াবে।
জানবেই না, জানতে দেবই না। তুমি ছাড়া আর কেউ যে জানে না।
চিঠিতে কী লেখা থাকে জানিস?
হ্যাঁ, জানি।
বড় অকপটে তিথি স্বীকার করে ফেলল।
কী লেখা থাকে বল তো!
স্বপ্নের কথা লেখা থাকে। জানো স্বপ্নের কথা পড়তে নেই, পড়লে অভিশাপে পাথর হয়ে যেতে হয়। আমি পাথর হয়ে যাই, তুমি কি চাও?
তারপর তিথি আর দাঁড়াল না। সুপারিবাগান পার হয়ে নদীর চড়ায় কাশবনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। কেন যে গেল! তিথি কী চায়! সে কিছুটা দৌড়ে গিয়েও ফিরে এল। তার সাহস নেই। তিথির সঙ্গে নদীর চরে কাশের জঙ্গলে হারিয়ে গেলে বড় পাপ কাজ হবে। সে ধীরে ধীরে কাছারিবাড়িতে উঠে গেল।
ছয়
তারপর এ—দেশে ঋতু পরিবর্তনের পালা শুরু হল। চৈত্রমাসে নদীর চর যতদূর দেখা যায় ধুধু করছে। ফুটি তরমুজের চাষ সর্বত্র। হাওয়ায় ধূলিকণা ওড়াওড়ি করছে। গাছপালা সব গৈরিক রঙ ধারণ করছে। স্টিমার আসে না নদীতে। জল শুকিয়ে গেলে যা হয়। শীর্ণ জলধারা নদীর। পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি। তারপরই মেঘ গুরু গুরু—আকাশ মেঘমালায় ভরে যায়। কালবৈশাখীর ঝড়ে গাছের ডালপালা সব তোলপাড় হয়। আমবাগানে তিথি প্রায় সব সময় পড়ে থাকে। ঝোড়ো হাওয়ায় আম পড়লে মেয়েটা ত্বরিতে ছুটে আসে। আম কুড়িয়ে নেওয়ার এই মোহ থেকে অরণি বাদ যায় না। গাছ থেকে ঝুড়ি ভর্তি আম পেড়ে হরমোহন ভেতরে বাড়িতে দিয়ে আসে।
আজকাল অরণি যতটা পারে তুলিকে এড়িয়ে চলে। আমবাগানে তুলিও আসে। তার সঙ্গে বীণা পিসি। তুলি এসেই আর আগের মতো লাফায় না। কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির হয়ে গেছে। অরণির তেজ তার সহ্য হয় না। অরণি তার পুতুলের বিয়েতে না খাওয়ায় ক্ষোভও কম না তার। সে সুযোগ খুঁজতে পারে।
—ধিঙ্গি হচ্ছিস দিন দিন—তোর কি না পুতুলের বিয়ে! এজন্য তুলি আমবাগানে কিংবা কাছারিবাড়ির আশপাশে বের হয়ে এলেই সে এক দৌড়ে বিশুদার ঘরে ঢুকে যায়। যেহেতু বিকেলবেলায় স্কুল থেকে ফিরে, কোনও খেলাধুলোর ব্যবস্থা থাকে না, ইচ্ছে করলে স্কুলের মাঠেও যাওয়া যায় না—ফুটবল খেলা আপাতত বন্ধ, বিশুদার ঘরে গেলে ক্যারাম পেটাতে পারে। তুলি সেখানে বড় যায় না। ছুটির দিনেই হয় মুশকিল, সারাটা দিন একা একা সে যে কী করে! তিথি তাকে গোপনে পাহারা দেয়, কারণ সে কাছারিবাড়ি থেকে বের হলেই টের পায় তিথি কোথাও না কোথাও দাঁড়িয়ে আছে।
এক সকালে জগদীশ নদীর ঘাট থেকে প্রাতঃস্নান সেরে ফিরে এসে দেখলেন, অরণি খুবই মনোযোগ সহকারে অঙ্ক করে যাচ্ছে। অরণিকে বলা দরকার। চার—পাঁচদিনের জন্য তাঁকে শহরে যেতে হবে। ত্রিশ ক্রোশ রাস্তা, কিছুটা নৌকায়, কিছুটা হাঁটাপথে যেতে হবে। যেতে আসতেই প্রায় দুদিন কাবার। অরণিকে একা থাকতে হবে রাতে। তবে তিনি গোরাচাঁদকে বলে ব্যবস্থা করে গেছেন, গোরাচাঁদের মেয়ে তিথি রাতে তার ঘরে শোবে। অরণি কিছুই জানে না। মামলা—মোকদ্দমার ব্যাপার, উকিল—মুক্তার তাঁকে ছুটি না দিলে তিনি ফিরতে পারবেন না। বলি বলি করেও বলা হয়নি। এই মুহূর্তে না বললেও চলে না। কারণ আজই পুঁটুলিতে চিড়াগুড় বেঁধে তাঁকে রওনা হতে হবে।
তিনি তাঁর ভিজা গামছা দড়িতে মেলে দেওয়ার সময় বললেন, আমি আজ থাকছি না। বুলতা, কালীগঞ্জ হয়ে রাতে রাতে ধামগড় পৌঁছাব। সেখানে আমার রাত্রিবাস। সকালে উঠে আবার রওনা হতে হবে। কবে ফিরতে পারব জানি না, তবে চার—পাঁচদিনের আগে কাজ উদ্ধার হবে বলে মনে হয় না। তুমি সাবধানে থেকো। রাতে তিথি এ ঘরে শোবে। চিন্তা করবে না।
অরণি আগেই জানে, বাবা না থাকলে তিথি তার ঘরে রাতে শোবে। বাবাই তাকে কবে যেন বলেছিলেন। তখন অবশ্য তিথির থাকা নিয়ে তার কোনও সঙ্কোচ ছিল না। তবে ঋতুর রঙ বদলে গেলে বয়স যে এক জায়গায় থাকে না, শরীর এবং মন দুই—ই বিদ্রোহ করে। তিথি থাকবে শুনে, তিথিকে অবশ্য পরে বুঝিয়ে বললে হয়—দ্যাখ তিথি আমার ঘরে তোর থাকার কোনও দরকার নেই। বাবা সেকেলে মানুষ, সব সময় আমার কিছু বিপদ না হয়, এমন ভাবে। আমি একাই শুতে পারব। বিছানা করে দিয়ে তুই চলে যা, এইসব যখন ভাবছিল তখনই বাবা বললেন, সাঁজ লাগলে একা এই ঘরে তোমার না থাকাই ভালো। সেদিন কী হয়েছিল জানি না, দ্বিজপদও বললেন, ছেলেমানুষ, এমন পরিত্যক্ত আবাসে একা থাকলে ভয় পেতেই পারে। ভয়ে সে মূর্ছা গিয়েছে, দ্বিজপদ সার নিজের চোখে দেখেছেন, এভাবেই সব চাউর হয়ে যায়। সে যতই সেদিন স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুক, দ্বিজপদ সারের অমোঘ কথা বাবা বিশ্বাস না করে পারেন না। নিজেকে গোপন করার জন্য সেদিন সে চাদরে শরীর ঢেকেও নিয়েছিল। কেউ গায়ে চাদর জড়িয়ে কি মূর্ছা যায়! দ্বিজপদ সার কেন যে বলতে গেলেন! শুধু বাবাকেই না, মনে হয় বাবুদের বাড়ির সবার কাছেই প্রচার হয়ে গেছে, অরণি অন্ধকারে তক্তপোশে পড়েছিল, কোনও হুঁশ ছিল না!
কী যে বিপদ—সে বলল, হরমোহনদাদু থাকলে হয় না!
সেও তো আমার সঙ্গে যাচ্ছে। তিথি শুলে কি তোমার আপত্তির কিছু আছে!
আপত্তির কথা বলার অর্থই সে সব বুঝতে শিখে গেছে। এই বুঝতে পারাটা এই বয়সে কত বড় অপরাধ গুরুজনদের কাছে সে বোঝে।
সে বলল, না না আপত্তির কী আছে? তবে কেউ না শুলেও আমার অসুবিধা হবে না। আমার জন্য আবার তিথিকে বিরক্ত করা…
সে বিরক্ত হয় না। তার এই সুন্দর স্বভাবের জন্যই সে জীবনে সুখী হবে। একবার তার কাজকাম বন্ধ করে দিয়ে তো বুঝেছিলে, কী অনর্থ ঘটতে পারে!
বাবা সকাল সকাল রওনা হয়ে গেলেন। হরমোহনদাদু মাথায় ফেট্টি বেঁধে পেছনে রওনা হল। কাঁধে লম্বা বেতের লাঠি। মাথায় একটা পুঁটুলি। বাবা ক্যাম্বিসের জুতো পরে হাঁটুর সামান্য নিচে কোঁচা লুটিয়ে দুগগা দুগগা বলতে বলতে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। সিঁড়ি ধরে নামার সময় বলেছিলেন রোদে ঘুরে বেড়াবে না, নদীতে চান করতে গেলে দু ডুব দিয়ে উঠে আসবে। জলে পড়ে থাকবে না। এ সময়টা দেবী ওলাওঠার আবির্ভাব হয়, নদীর জল না খাওয়াই ভালো। গুটি বসন্তের কাল, রোদের তেজ প্রখর, ঝোড়ো হাওয়ায় বেশি ঘুরে বেড়াবে না। হাওয়ার সঙ্গে গুটি বসন্তের জীবাণু উড়ে বেড়ায়।
তারপর বাবা বলেছিলেন, ঋতুটির রঙ বড়ই অগ্নিবর্ণ। ওলাওঠায় চরের মানুষজন সাফ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিষেধকের কোনও ব্যবস্থা নেই। চৌকির নিচে নিমের ডাল রেখে দেবে রোজ। এতে কিছুটা প্রতিষেধকের কাজ করবে।
এটা ঠিক, এই ঋতুটির আবির্ভাবের সঙ্গে বাবা রোজ কিছু নিমপাতা বালিশের নিচে রেখে দেন। কখনও নিমের ডাল এনে চকির নিচে ঢুকিয়ে রাখেন। রান্নাবাড়িতে কচি নিমবেগুনের ব্যবস্থা হয়। টিউকল কিংবা ইঁদারার জল ছাড়া পানীয় জলের ব্যবহার থাকে না। নদীর জল কিংবা পুকুরের জল যে খাওয়া হয় না তাও নয়। তবে ফুটিয়ে। তার জন্য বাবার দুশ্চিন্তার যে শেষ থাকে না, এইসব বাধা নিষেধে সে ভালোই টের পায়। চরে কিংবা নদীর পাড়ে ছুটতে ছুটতে তেষ্টা পেলে নদী থেকে গণ্ডূষ করে সে কেন, সবাই জল তুলে খায়। বর্ষায় কিংবা শীতে খাওয়া গেলেও এ—সময়টায় খাওয়া একেবারেই অনুচিত, বের হওয়ার আগে পই পই করে মনে করিয়ে দিয়ে গেছেন।
বাবা বের হয়ে গেলে সেও কিছুটা হেঁটে গেল। নদীর পাড় পর্যন্ত সে গেল। নদীতে নৌকা লেগে আছে। চরের ওপর দিয়ে অনেকটা রাস্তা হেঁটে গিয়ে বাবা নৌকায় উঠে পড়লেন। কালীগঞ্জ পর্যন্ত যাওয়া যাবে। তারপর আর নৌকা যাবে না। বর্ষা না নামলে নদী নাব্য হয়ে উঠবে না।
যতক্ষণ বাবার ছই দেওয়া নৌকাটি দেখা যাচ্ছিল, অরণি পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। এত নিরিবিলি এই ঘাট যে কাকপক্ষী উড়ে গেলেও ডানার শব্দ পাওয়া যায়। আজ ছুটির দিন বলেই সে বেশি একা। স্কুলে গেলে সময় কোথা দিয়ে কেটে যায় এবং বিকেলে তারা সবাই মিলে হইহই করতে করতে স্কুল থেকে একসঙ্গে ফেরে। গাছে ফলপাকুড়েরও অভাব থাকে না। লটকন ফলের গুচ্ছ সহজেই লাফিয়ে গাছ থেকে পেড়ে নেওয়া যায় কিংবা মজাখালের পাড় ধরে ফিরলে কার্তিক অঘ্রাণে সহজেই বেতঝোপে বেথুনফলের খোঁজে ঢুকে যাওয়া যায়। ছুটির দিনটি এমনিতেই তার কাটতে চায় না, আজ বাবা না থাকায় কেমন বিমর্ষ লাগছে—কিছুটা নিরুপায় যেন সে! আর তখনই কোনও জঙ্গলে বসে তিথি ‘কু’ দিচ্ছে।
তিথি না অন্য কেউ! তবে কেন যে মনে হল তিথি ছাড়া তার সঙ্গে মজা করার সাহস কারও নেই। ডানদিকের সড়ক পার হয়ে গেলে জেলে পাড়া, তার বয়সি ছেলেছোকরার অভাব নেই। তার বয়সি মেয়েও অনেক। তবে ভুঁইঞামশায়ের পুত্র বলেই তাকে যথেষ্ট সমীহ করে। কেউ কেউ তার সঙ্গে আপনি—আজ্ঞে করে— সুতরাং চরের কাশবন থেকে যেই তাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করুক, সে পাত্তা দেবে না। তার মন ভালো নেই। কাছারিবাড়িতে ফিরে যেতেও ভালো লাগছে না। গরমও পড়েছে। বেলাও বিশেষ হয়নি, অথচ মনে হচ্ছে হাওয়ায় আগুনের ভাপ ছড়াচ্ছে। নদীর জলে ডুবে থাকলে এ সময় বেশ আরাম পাওয়া যায়।
সে নদীর চর ধরে দৌড়ে যেতে থাকল।
তখনই মনে হল ঝুপ করে কেউ জঙ্গলে উঠে দাঁড়িয়েছে। সে ফিরেও তাকাল না। কারণ তিথি যদি সত্যি হয়, তবে এই পেছনে লেগে থাকা তার পক্ষে সহ্য করা কঠিন হবে।
সে জলে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
নদীর জলে সকাল সকাল মানুষের ভিড় থাকলেও বেলা বাড়লে ভিড় কমে যায়। প্রায় লু বইবার মতো অবস্থা। নদীর ওপারের ঘাটে কেউ কাঠ কাটছে, নদীতে এদিক—ওদিক নৌকা পড়ে আছে ঠিক, তবে মাঝিমাল্লাদের দেখা যাচ্ছে না। কাঠ কাটার শব্দ নদীর পাড়ে বড় বেশি আওয়াজ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। জলে ডুব দিয়েও সেই আওয়াজ শোনার সময় মনে হল তার পা কিছুতে জড়িয়ে ধরেছে।
জল এদিকটায় এখন গভীর। সে ভোঁস করে ভেসে উঠল। তীর থেকে বেশ দূরেই সে চলে এসেছে। ঘাট থেকে মানুষজন ডুব দিয়ে উঠে যাচ্ছে, তার পায়ে কে যে জড়াজড়ি করে সরে গেল, সে ভোঁস করে ভেসে উঠেও কিছু দেখতে পেল না। তারপরই মনে হল পাশেই কেউ আছে—তার দিকে জল ছিটাচ্ছে। তিথি ছাড়া আর কারও যে সাহস হবে না তাও সে জানে।
সে দেখবে না। তিথি যাকে সে এড়িয়ে চলতে চায়, সেই তাকে নিষ্কৃতি দিচ্ছে না।
সে যে কত অসহায়, বাবা যেন তিথিকে রাতে তার ঘরে শুতে বলে আরও বেশি করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল। মেয়েটার উপদ্রবে শেষে সে কি অস্থির হয়ে উঠবে!
সে তিথিকে অনায়াসে তেড়ে যেতে পারত। তিথি যতই ভালো সাঁতার জানুক, সে ইচ্ছা করলে তিথিকে গিয়ে অনায়াসে ধরে ফেলতে পারে। ডুবসাঁতারে চিতসাঁতারে সেও কম দক্ষ নয়, কিন্তু তার ইচ্ছেই করছে না তিথির দিকে তাকাতে। বাবা তিথিকে রাতে তার ঘরে শুতে না বললেই পারতেন। তারা যে বড় হয়ে গেছে বাবা কিছুতেই বোঝেন না।
সে যে তিথির ওপর খুবই ক্ষুব্ধ।
তিথি অন্তত বুঝুক কাছারিবাড়িতে তার রাতে থাকা সে পছন্দ করছে না। তিথিটা বোকা না পাগল তাও সে বোঝে না। তাছাড়া সেও কম অসহায় নয়, তিথিকে সে বারণ করে দিতে পারে, বেরও করে দিতে পারে ঘর থেকে, কিন্তু নিঝুম রাতে পাখিরা কলরব করলে, কিংবা কীটপতঙ্গের আওয়াজও উঠতে পারে, হাওয়ায় টিনের চালে ডালপালার ঘর্ষণের বিদঘুটে আওয়াজ, একা ঘরে শুয়ে খুবই উপদ্রবের শামিল সে বোঝে। আর রাতে ঝড়বৃষ্টি হলে সে যে খুবই ফাঁপরে পড়ে যাবে। শুয়ে থাকলে, কড়িবরগায় ফেলে রাখা মুলিবাঁশের ছাদে ধস্তাধস্তি যদি শুরু হয়, রাতে অশুভ আত্মারাও তাকে একা পেয়ে নানা তামাশায় মত্ত হতে পারে—এইসব চিন্তাতেই তিথিকে সে ঘাঁটাতে সাহস পাচ্ছে না। তিথি ইচ্ছে করলে রাজি নাও হতে পারত, বাবা তবে আর কারওকে বলে যেতেন। কিন্তু তিথি যে এক পায়ে খাড়া। বাবাও বোঝেন না, তিথিও তুলির মতো বড় হয়ে গেছে। এবং তার ভেতর নিজের শরীর নিয়ে এক গোপন অভিমান গড়ে উঠছে—তার মূর্ছা যাওয়ার কথাও একরকম যেন জোর করেই চাপানো—এতে আর কারও সুবিধা না হোক, তিথির খুবই সুবিধা হয়েছে। যেন সে নিজের অধিকারেই তাকে পাহারা দেওয়ার অধিকার পেয়ে গেছে।
সে তিথিকে কিছু বলছে না।
তার দিকে জলের ঢেউ তুলে দিচ্ছে তিথি।
তাকে ডাকছে, অরুদা চলো সামনে যাই। তুমি কতটা দূরে যেতে পারো দেখি। চলো নদী পার হয়ে ওপাড়ে উঠি।
সে তীরের দিকে উঠে যাচ্ছে। তিথির কথায় সাড়া দিচ্ছে না।
তিথি তার পিছু নিয়েছে।
এই অরুদা উঠে যাচ্ছ কেন? আমি তোমাকে কিছু বলেছি?
অরণি ভ্রূক্ষেপ করছে না। তার মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে আছে।
এই অরুদা ঠিক আছে, আর জল ছিটাব না। তুমি ডুবে মাটি তুলতে পারবে? আমি পারি,দেখবে?
অরণি ঘাটের কাছে, যেখানে কাদামাটি এবং খুবই পিছল, পা টিপে টিপে এগোচ্ছে।
তিথি মানবে কেন?
সে লাফিয়ে জল থেকে উঠে অরণির কাছে গিয়ে হাত চেপে ধরল। তিথি তাকে জলে নিয়ে নামবেই। তিথি তাকে জল থেকে উঠতে দেবে না। সে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। জোরাজুরি করলে তিথি জলে কাদায় আছাড় খেয়ে পড়ে যেতে পারে। না করেও উপায় নেই, সে এক ধাক্কায় তিথিকে সরিয়ে এগিয়ে যেতেই দেখল তিথি পড়ে গেছে চিত হয়ে। পড়ে গিয়ে সড়াৎ করে নদীর ঢালুতে পিছলে গেছে।
তিথির ফ্রক কোমরের উপরে উঠে যাওয়ায় সে পুরোদস্তুর বেকুব। তিথি ইজের পরেনি। শুধু ফ্রক গায়ে জলে নেমে এসেছে। সে লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ছি! সে এটা কী করল! খুবই অপরাধ তার। তিথির কাছে ক্ষমা চাওয়ারও সে অযোগ্য। সে জানবে কী করে তিথি ইজের না পরেই জলে নেমে এসেছে। তার শরীর রোমাঞ্চিত, আবার অপরাধবোধও আছে, সে তিথির দিকে আর তাকাতে পারছে না। ভাগ্যিস ঘাটে কিংবা নদীর পাড়ে কাছাকাছি কেউ নেই!
তিথির দিকে সে ফিরে তাকাতেও পারছে না।
তিথি এখন কী করছে তাও সে জানে না।
তিথি যদি দেবী দুর্গার মতো জলের কিনারে একইভাবে পড়ে থাকে, তবে আর যাই হোক, তাকানো যায় না। সে নিদারুণ সঙ্কটে পড়ে গেল। কাছে যেতেও পারছে না। হাত ধরে তুলে দিয়ে বলতে পারছে না, ওঠ তিথি। তোর লাগেনি তো!
তিথি কোনওরকমে ততক্ষণে উঠে বসেছে। ফ্রক দিয়ে হাঁটু, শরীর সব দ্রুত ঢেকে পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল, তুমি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে!
সে খুবই কাতর গলায় বলল, ওঠ। আর ফেলব না। আমি কি জানি তুই পড়ে যাবি! ধাক্কা দেব কেন!
তিথি ছাড়ার পাত্র নয়। সে বলল, আমার সব তুমি দেখে ফেললে কেন? বলো কেন দেখে ফেললে!
না, আমি তোর কিছু দেখিনি বলতে পারত। কিন্তু বড় মিছে কথা হবে। সে সবই দেখেছে, এমনকি সবুজ নিথর প্রান্তরটিও। এত কুহক, এই শরীরে, সে চোখ ফেরাতে পারছে না, নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। যেন প্রকৃতি আর শরীরের এক অসীম অনন্ত লীলারহস্যের যুগপৎ খেলায় সে অস্থির হয়ে উঠছে। প্রকৃতি তার বাহু মেলে দিয়েছে তিথির শরীরে।
তিথির কাছে এখন যাওয়া যায়। তিথি সব ঢেকে হাঁটুর কাছে ফ্রক টেনে কাদার মধ্যেই লেপটে বসে আছে। সে উঠছে না।
অরণি হাত ধরে না ওঠালে, সে যেন উঠবে না।
সে কাছে গিয়ে বলল, ওঠ। বাড়ি যাব।
তিথির চোখে জল। তিথি কোনও জবাব দিচ্ছে না।
অরণি কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।
তিথির সবকিছু সে দেখে ফেলে কেমন কিছুটা মুহ্যমান। সে কাছেও যেতে সাহস পাচ্ছে না। তিথির রোষ শেষ পর্যন্ত কীভাবে ফুটে বের হবে, সেই আতঙ্কেই সে অস্থির।
তিথি ওঠ। আমি কী জানি তুই পড়ে যাবি। আমার কী দোষ বল? তুই কাঁদছিস কেন তাও বুঝছি না। আমি ইচ্ছে করেও তোকে ফেলে দিইনি!
তিথি সহসা লাফিয়ে তার জামা খামচে ধরল। আঁচড়ে খামচে দিচ্ছে।
কেন তুমি আমার সব দেখে ফেললে! আমার আর কী থাকল!
অরণি হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
এই আমার লাগছে তিথি। তুই কী করছিস বল তো।
লাগুক। একশোবার লাগবে। তুমি আমার সঙ্গে কখনও আর কথা বলবে না।
ঠিক আছে, বলব না। চল এবার।
আমি তোমাকে মজা দেখাচ্ছি, দাঁড়াও।
এবারে সত্যি ভয় পেয়ে গেল অরণি। তিথি কি তুলিকে সব বলে দেবে! মেয়েদের কত গোপন কথা থাকে। তুলির সঙ্গে যে এত ভাব, সেই গোপন কথার সুবাদে। সে বাবুদের বাড়িতে থাকে। বাবা তার বাবুদের আমলা। বাবুদের মেয়ে তুলির হাতে এভাবে অস্ত্র তুলে দিলে সে যে খুবই বিপদে পড়ে যাবে। এখন তিথিকে বশে না আনতে পারলে সত্যি কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সেই সবুজ নিঃসঙ্গ প্রান্তরটি কিছুতেই চোখ থেকে তার সরছে না। তিথির সব মাহাত্ম্য সবুজ প্রান্তরে সে গোপন করে রেখেছিল। তাই যদি কেউ দেখে ফেলে তবে আর তিথির ইজ্জত থাকে কী করে!
সে ভারী বিষণ্ণ হয়ে গেল।
গরমের তাপে তার জামাপ্যান্ট শুকিয়ে যাচ্ছে। তার হাফপ্যান্টের নিচে কাদা লেগে আছে। হাতে—পায়ে কাদা। তিথি তাকে কাদায় মাখামাখি করে দিয়েছে আঁচড়ে খামচে দেওয়ার সময়।
সে সোজা জলে নেমে আবার ডুব দিল—নদীর জল এত ঠান্ডা হয়ে আছে নিচে যে উঠতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু তিথির সামনে তার দাঁড়াবার আর সাহস নেই। সে জল থেকে উঠে সোজা দৌড়াতে থাকল। যা হয় হবে। কিন্তু তিথি রাতে আসবে। তখন যদি সে কিছু করে বসে। তার তো আর ইজ্জত ধর্ম কিছু নেই। বাবুদের বাড়ির এঁটোকাঁটা খেয়ে বড় হয়ে উঠেছে যে তিথি, তারও যে এত ইজ্জতবোধ জানবে কী করে!
সে কিছু করেই বসতে পারে।
কিছুটা এসেই মনে হল এভাবে তিথিকে একা ফেলে চলে যাওয়া বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। নদীর চর এখন সামনে পেছনে। নদীর পাড় ধরে ইতস্তত দু—একজন চাষী কিংবা ব্যাপারী মানুষ বাজারের দিকে যাচ্ছে। কোথাও আজ হয়তো হাটবার আছে, চরের পাশে কিছু নৌকায় আনাজ তরকারি উঠছে। কেউ নেমে যাওয়ার সময় বলল, অরুবাবু যে! এত রোদে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! গরমে কাহিল হয়ে পড়েছেন দেখছি। মুখ রোদে পুড়ে গেছে। ভুঁইঞামশায় কবে ফিরবেন!
সে বলল, জানি না।
সে মরছে তার আতান্তরে।
কারণ আরও দূরে সেই মেয়েটি কী করছে, দেখারই বেশি বাসনা তার।
তিথি জলে নেমে গেল, ডুবও দিল, তারপর পাড়ে উঠে দৌড়াতে থাকল তার পিছু পিছু।
যাক, মাথা ঠান্ডা হয়েছে।
সে দাঁড়িয়ে গেল।
তিথিও দাঁড়িয়ে গেল।
বোধহয় তিথি তার সঙ্গে ফিরতে চায় না।
সে আবার দাঁড়াল। তিথিও দাঁড়িয়ে গেল।
তিথি কি তাকে মুখ দেখাতে লজ্জা পায়! এতবড় অঘটনের পরে তিথিরও দোষ দেওয়া যায় না। মাথা ঠান্ডা হওয়ায় তার লজ্জায় পড়ে গেছে।
সে আবার হাঁটতে থাকল।
তিথিকে সঙ্গে না নিয়ে ফিরলে, আবার কোথায় কী করে বসবে, তিথিও তাকে যথেষ্ট নির্যাতন করেছে, তিথির মধ্যে প্রবল ক্ষোভ ছিল, এখন মাথা ঠান্ডা হওয়ায় সে নানা ফন্দিও আঁটতে পারে। সে তো তাকে ডাকেনি। ওই যে দোষ তিথির, সব সময় নজর রাখা, কখন সে ঠিক দেখেছে অরুদা নদীর পাড়ের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। বড় বড় সব কড়ুই গাছের নিচ দিয়ে অরুদা তার বাবার পিছু পিছু ঘাটের দিকে যাচ্ছে। তিথি এইসব ভেবেই সুপারিবাগান থেকে বের হয়ে পড়েছিল বোধহয়। তারপর তাকে জলে নেমে যেতে দেখে লোভ আর সামলাতে পারেনি।
কিন্তু তিথির পরনে ইজের ছিল না। তিথির বাবা খুবই গরিব। দস্যি মেয়ের প্যান্ট কিনে দিলেও দু—এক মাসে সেলাই খুলে যায় বোধহয়, ফেঁসেও যেতে পারে। তিথি সেমিজের মতো মার্কিন কাপড়ের ঢোলা জামা গায়ে দিয়ে থাকে—ঝুল আছে অনেকটা, হাঁটুর অনেক নিচে সেমিজ ঝুলে থাকে—তার কি ইজের পরার অভ্যাস নেই! কারণ তার শরীর ঢাকাই থাকে। ইজের না পরলেও চলে যায়, গরিব হওয়ার জন্য তিথি এমন ভাবতেই পারে। বাপের কাছে বারবার ইজের চাইতেও তার সম্ভবত লজ্জাবোধ হয়। সে তো কিছু চাইতেই জানে না। দয়া করে যে যা দেয় তাতেই খুশি মেয়েটা।
তাহলে তিথি তার ঘরে আসে ইজের না পরেই। সে জল তুলে রাখে, ঘরদোর ঝাঁট দেয় ইজের না পরেই। তার কাছে এটা বোধহয় বেআব্রু মনেই হয় না। এত গরিব হলে চলে!
এবং এসব মনে হতেই তিথির জন্য কেমন এক কান্না ভেতরে গোল গোল দলা পাকিয়ে গলার কাছে থমকে গেল।
সে আবার দাঁড়াল। এখান থেকে দূরের প্রাসাদ সব দেখা যায়। কার্নিসের মাথায় পরী উড়ছে। উঁচু লোহার রেলিং দিয়ে বাগান মাঠ এবং পুকুর সব ঘেরা। বৈভব এত চারপাশে, আর তিথি একটা ইজেরের কার্পণ্য করে গরিব বাপের টাকা বাঁচায়।
অরণি আবার পেছন ফিরে তাকাল।
তার কেন যে মনে হল এই অভাগা মেয়েটাকে ফেলে চলে যাওয়া কোনও কারণেই উচিত হবে না।
কিন্তু যা হয়।
তিথিও দাঁড়িয়ে গেছে।
সে আর পারল না। তিথিকে ধরার জন্য এবার সে নিজেই দৌড়াতে লাগল।
বৈশাখের খরতপ্ত বালিরাশিতে দু’জনেই নেমে গেল। কিন্তু তিথির নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। তিথি যে কত বন্য হয়ে উঠতে পারে চরের এই বালিরাশি মাড়িয়ে না গেলে টের পেত না। তার পায়ে ছ্যাঁকা লাগছে। কিছুটা গিয়েই সে আর এগোতে সাহস পেল না। তরমুজের জমিতে উঠে তরমুজের লতাপাতার ওপর দাঁড়িয়ে গেল।
তিথি কিন্তু দৌড়ে চলে যাচ্ছে।
সে খুবই অসহায় বোধ করতে থাকল।
তিথি কোথায় যাচ্ছে! কাকে ডাকবে! কাছারিবাড়ি উঠে গিয়ে কমলদা কিংবা বিশুদাকে খবর দিতে পারে। সে আর তাদের নাম ধরে ডাকে না। কমল অমল বিশুরা তার কাছে সোনাদা, সেজদা, ছোড়দা হয়ে গেছে। সোনাদাকে তিথি ভয় পায়। একদিন কী কারণে সোনাদা তিথির কানও মলে দিয়েছিল। তিথি মাথা নিচু করে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেছে, কিন্তু সোনাদা কানও মলে দিয়েছে বলে কাউকে নালিশ করেনি। তিথিও তার কাজের জন্য বাবুর বাড়ির সবার কাছে প্রিয়। শুধু প্রিয় না, বিশ্বস্তও। ছোটপিসির চিরকুট সে হরিশবাবুকে গোপনে পৌঁছে দেয়। শুধু সেই খবরটা রাখে। তিথি কখনও চিরকুটটি তার হাতে দেয়নি, পড়তেও দেয়নি। ছোটপিসি বালবিধবা। তার যে কত কষ্ট তিথিই বোধহয় একমাত্র টের পেয়েছে। তবু একদিন তিথিকে না বলে পারেনি, চিরকুটে কী লেখা থাকে জানিস?
তিথি সরল বিশ্বাসে বলেছিল, স্বপ্নের কথা লেখা থাকে। ও চিঠি পড়তে হয় না। পড়লে পাথর হয়ে যেতে হয়।
তিথিও কি কোনও স্বপ্নের চিঠি নিয়ে ছুটছে! সে কাছে থাকলে জোরজার করে পড়ে ফেলতে পারে ভয়েই কি ছুটছে! পড়লে সে পাথর হয়ে যেতে পারে—সে পাথর না হয়ে যায়, কারণ সে যে তার সবকিছু দেখে ফেলেছে। অরুদা পাথর হয়ে গেলে সে কার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে!
অরণি বুঝতে পারে নদীর চরায় তিথি ক্রমে বিন্দু থেকে বিন্দুবৎ হয়ে যাচ্ছে। সব আজগুবি চিন্তায় সে মাথা ঠিক রাখতে পারছে না।
তিথি শেষে কিছু করে বসবে না তো!
এখুনি বাড়িতে গিয়ে খবর না দিলেই নয়।
কারণ নদীর পাড়ে তিথি অদৃশ্য হয়ে গেছে, সেখানে কি কোনও অরণ্য আছে, অথবা কোনও স্পৃহা থেকে, এমনকি তাকে লোভে ফেলে দেওয়ার জন্যও যে ছুটছিল না তারই বা ঠিক কি!
কিছুক্ষণ সে তরমুজের জমিতে দাঁড়িয়ে থাকল।
চাষি মানুষটি পাতার আড়াল থেকে উঠে বলল, আপনি বাড়ি যান বাবু। তিথির জন্য ভাববেন না। ও এরকমেরই। চাষি মানুষটি তো জানে না, আজ নদীর পাড়ে বড় অঘটন ঘটে গেছে তাদের। তিথি তার মুখ কাউকে আর বোধহয় দেখাতে চায় না।
সে বড়ই অস্থির হয়ে উঠছে।
তার পা চলছে না। একবার একটা গাছের গুঁড়িতে ধপাস করে বসেও পড়ল।
তিথি নেই, উত্তপ্ত বালির চড়া ডিঙিয়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল তিথি।
কেন গেল?
কী হয়েছিল!
তখন সে কী বলবে?
তাকে মিছে কথা বলতে হবে।
এই করে সে যখন কাছারিবাড়ি পৌঁছাল—সবাই ছুটে এসেছে।
এই তুই কোথায় গেছিলি! কত বেলা হয়েছে, খাবি না! রান্নাবাড়িতে মা বারবার খোঁজ নিচ্ছে, তুই কোথায়! সে তো খেতে এল না!
তার খাওয়ার ইচ্ছা নেই। রোদে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত। চুল উসকোখুসকো। চোখ জবাফুলের মতো লাল। তিথি যে কোথায় চলে গেল, প্রায় কেঁদেই ফেলত—আর তখনই তিথি সুন্দর একটি ফ্রক গায়ে তুলির সঙ্গে হাজির। তুলির কাছ থেকে পাউডার চেয়ে নিয়ে মুখে পর্যন্ত মেখেছে।
তার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল যেন।
তিথির সঙ্গে একটা কথাও বলল না। তুলি তাকে দেখে মুচকি হাসছে। এতে তার রাগ আরও বেড়ে গেল। দৌড়ে সে কাছারিবাড়ির ঘরে ঢুকে গেল। ঘরের দরজা বন্ধ করে জামাপ্যান্ট ছেড়ে রাখল। তারপর কাচা হাফপ্যান্ট হাফশার্ট গায়ে দিয়ে রান্নাবাড়ির দিকে হাঁটা দিল। সে খায়নি বলে বাবার বউঠান এখনও না খেয়ে আছে।
এই বাড়ির আলাদা যে রুচিবোধ আছে, ভেতরবাড়ি গিয়েই সে টের পেল। সে শুধু খায়নি, আর সবাই খেয়ে নিয়েছে এ বাড়িতে বোধহয় তা হয় না। আসন পাতা আছে পর পর। জলের গেলাস থালা দিয়ে ঢাকা। কাগজিলেবু, নুন, কাচালংকা সাজানো—সে ভেতরবাড়ি ঢুকতেই সোনাদা চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে, বাবু এয়েছেন মা। রোদে কোথায় টো—টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ভুঁইঞাকাকা নেই, তিনিও স্বাধীন। আসুক ভুঁইঞাকাকা, কোথায় যাস!
বাবার বউঠানকে সে জেঠিমা ডাকে। সামান্য স্থূলকায় এবং ফর্সা দেখতে, হাতে চকচক করছে সোনার বালা, পায়ে আলতা, তাঁর বউমাটিও হেঁশেলে অপেক্ষা করছেন, তার জন্য সবারই পাতে বসতে দেরি হয়ে গেল, তিথি কতভাবে যে ভোগাচ্ছে!
জেঠিমা বললেন, কীরে তোর চোখমুখ এত শুকনো কেন! তোর বাবা কাজে বাইরে গেছেন বলে, যেখানে—সেখানে ঘুরে বেড়াবি! কী চিন্তা হচ্ছিল!
তারপর বললেন, বলে যাবি তো! কেউ কিছু বলতে পারল না। তিথিও না।
পা থেকে মাথায় রক্ত উঠে গেল। তিথি এত বেইমান! সারাটা সকাল—দুপুর তাকে ঘুরিয়ে হয়রান করেছেন, সে বলেছে, কিছু জানে না!
তিথির কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সে সেই আগের মতো পা ছড়িয়ে বসে আছে রোয়াকে। সেই যে আসন পেতে দিয়েছে, গেলাসে গেলাসে জল ঢেলেছে, এবং থালায় কাগজিলেবু, কাঁচালংকা সাজিয়ে রেখেছে, বসে পড়লেই সবার পাতে পাতে সব সে দেবে—অথচ ঘুণাক্ষরেও জানাল না, সে চরে তরমুজের জমিতে তার জন্য কতক্ষণ যে অপেক্ষা করেছে! নিজে কোথা থেকে কীভাবে যে ঠিক উঠে এসেছে, সে কি একবারও দেখতে পায়নি, কেউ তার জন্য নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে! এত শয়তান মেয়েটা! সে তো রাস্তাঘাট ভালো জানে না। বাবা তাঁর কর্মস্থলে নিয়ে এসেছেন। স্কুলে সেই কবে ভর্তি করে দিয়েছেন। সে একা নদীর পাড় ধরে বেশিদূর হেঁটেও যায় না। ভয়, সে না কোথাও হারিয়ে যায়। নদীর ওদিকটায় সে কখনও যায়ওনি। সে জানবে কী করে, আসলে তিথি দৌড়ে একা উঠে আসার জন্যই তাকে নদীর চরে ফেলে রেখে এসেছে।
গরমে চরাচর যেন হাঁসফাঁস করছে। খাওয়া হয়ে গেলে সে কোনওরকমে মাঠ পার হয়ে শেকল খুলে ঘরে ঢুকে গেল। চকির কাঠ পর্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে আছে। রোদে এত তেজ যে বাইরে তাকানো যাচ্ছে না। কাকগুলির কর্কশ চিৎকারে কেমন তার মাথা ধরে যাচ্ছে। জানালা খুলে দিয়ে ভেবেছিল, নদী থেকে ঠান্ডা হাওয়া উঠে আসবে। তাও এল না। গরম বাতাসে মুখ যেন ঝলসে যাচ্ছে। এই ঘরে শুয়ে থাকার অর্থ ভাপে সেদ্ধ হওয়া। কোনও গাছতলায় গিয়ে বসে থাকলেও বোধহয় আরাম পাওয়া যেত। কিন্তু শরীর আর দিচ্ছে না। জামা খুলে বালিশ টেনে শুয়ে পড়তে গিয়ে টের পেল, বালিশ চাদর তোশক সবই তেতে আছে। তার যেন আর নড়ারও ক্ষমতা নেই। সে শুয়ে পড়তেই ঘুমে তলিয়ে গেল।
টিনের ঘর বড় সহজেই গরম হয়ে যায়, আবার ঠান্ডাও হয়ে যায়। ঘুমের মধ্যেই সে টের পেল, তিরতির করে চোরা ঠান্ডা স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, মেঘ গর্জনও শুনতে পেল। বাইরে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়েছে কখন, জানালা দিয়ে ছাঁট আসছে, সে ধড়ফড় করে উঠে বসল। জানালা দিয়ে দেখল, গাছের শাখা—প্রশাখা দুলছে। বেশ জারে হাওয়া দিচ্ছে। টিনের চালে বৃষ্টির জলতরঙ্গ আওয়াজ। কখনও ঝমঝম, কখনও রিনরিন। প্রকৃতির চেহারাই পালটে গেছে। তার শীত শীত করছিল। বিছানার চাদর গায়ে জানালার ধারে অঝোরে বৃষ্টির দাপাদাপি দেখার জন্য সে কেমন পাগল হয়ে উঠল। দুরন্ত তিথি তাকে কিছুতেই ছাড়ছে না—কিংবা তুলি। বারবার তাদের চোখ মুখ শরীরের তাজা গন্ধ বৃষ্টির ছাটে মিলেমিশে গোলমাল পাকিয়ে দিচ্ছে।
আর তিথি তখনই একটা ছেঁড়া ছাতা মাথায় পা টিপে টিপে এসে হাজির। তার জল তোলা আছে, হারিকেনে তেল ভরা আছে, চিমনি মুছে তার সাফসোফ করার কাজও আছে। সে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না। কখন থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তাও জানে না। মাঠে জল জমে গেছে। জলে কীটপতঙ্গ ভেসে বেড়াচ্ছে, আর বিচিত্র শব্দতরঙ্গ উঠে আসছে—কোথাও জল নেমে যাচ্ছে, কোথাও মাটি পাগলের মতো জল শুষে নিচ্ছে— অজস্র বুড়বুড়ি জলে ভেসে মিলিয়ে যাচ্ছে। পাখপাখালির ওড়াওড়ি বন্ধ—ডালে বসে বৃষ্টির জলে ভিজছে, কখনও পাখা ঝাপটাচ্ছে। তিথি ঘরে কাজ করছে তার, সে তিথির দিকে তাকাচ্ছে না, সেই পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটাই তাকে বারবার তাড়া করছে।
তিথিকে এখন ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিলে যেন সারা সকাল—দুপুরের প্রতিশোধ নেওয়া যেত—কিংবা তিথিকে বললে হয়, রাতে আমার ঘরে তোকে শুতে হবে না, রাতে তুই আসবি না। এইসব ভাবতে ভাবতেই তিথি কখন যে চলে গেল, কোনও কথা বলল না, সন্ধ্যাও হয়ে গেল।
তিথির পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা কেমন তার মাথার মধ্যে গেঁথে আছে। তাকে তাড়াও করছে। সে কখনও বিমর্ষ হয়ে যাচ্ছে, কখনও সেই শরীর এক আশ্চর্য সুবাতাস বহন করে আনছে। সে তিথির এই পড়ে যাওয়ার ঘোর থেকে নিষ্কৃতি পাচ্ছে না। কত রাত হয়েছে তাও জানে না। গোলঘরে গিয়েও বসেছিল কিছুক্ষণ। ছুটির দিন বলে দ্বিজপদ সার তাদের পড়াতে আসেননি। সে একটা ছাতা মাথায় বাবার টর্চটি নিয়ে পড়ার ঘরে চলে গিয়েছিল, ঘোর থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য কিছুক্ষণ ক্যারাম পিটিয়েছে, তারপর রাতের খাওয়া সেরে আবার ঘরে ঢুকে গেছে। তিথি আসেনি।
তিথি এলে কী হবে?
সে দরজা বন্ধ করে দিল।
দূরে শেয়ালেরা ডাকছে। এই বিভীষিকাকে সে গ্রাহ্য করতে চায় না।
তিথি একফাঁকে তার বিছানা করে রেখে গেছে। মশারিও টাঙানো। চকির অন্যপাশে বাবার বিছানা গোটানো। তিথি এসে শোবে কোথায়!
তিথি তার আলাদা বিছানাও পেতে রাখেনি। তিথির সঙ্গে তার একটাও কথা হয়নি আর। সে এই ঘরে শুতে নাও আসতে পারে।
কিছুটা হালকা হয়ে গেল। জানালা খোলা আছে—ঝিরঝিরে বৃষ্টির ক্লান্তি নেই—বর্ষা শুরু হয়ে গেল বোধহয়। জোনাকি জ্বলছে ঝোপে জঙ্গলে—কেমন নিথর হয়ে আছে চরাচর। সে শুয়ে পড়ল।
তিথির কথা ভাবতে ভাবতেই সে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না। তখনই দরজায় টোকা। খুবই সন্তর্পণে।
সে সাড়া দিল না।
তারপর কড়া নাড়ার শব্দ।
সে পাশ ফিরে শুল।
এই অরুদা দরজা খোল। কী হল রে বাবা! কুম্ভকর্ণের নিদ্রা!
সে নাক ডাকাতে থাকল।
দ্যাখ অরুদা সারাটা দিন, অনেক জ্বালিয়েছ, কিছু বলিনি। মটকা মেরে পড়ে আছো, তুমি মনে করো আমি কিছু বুঝি না। কাকা বারবার বলে গেছে, না হলে তোমার ঘরে শুতে আমার ভারী বয়ে গেছে।
সে যেন সাহস পেয়ে গেল এবার। সে বলল, একা শুতে আমার অসুবিধা হবে না। তুই যা। এত রাতে আর জ্বালাবি না।
জ্বালাব না! কে জ্বালায়? আমি না তুমি! দরজা খোলো বলছি। খোলো বলছি।
তিথি দরজা ধাক্কাতে থাকল।
তিথি চেঁচামেচিও শুরু করে দিতে পারে। এত রাত্রে চিৎকার—চেঁচামেচি কেউ শুনতে পেলে কী ভাববে! অবশ্য ঘরটা মাঠের মধ্যে—জমিদারবাবুদের প্রাসাদও কাছে নয়, যে শোনা যাবেই, তবু যদি কেউ শুনেই ফেলে—সে তাড়াতাড়ি মশারি তুলে চকি থেকে নেমে গেল—হারিকেন উসকে দিল। দরজা খুলে অবাক, কোনওরকমে তালিমারা ছাতায় তিথি তার মাদুর বালিশ বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচিয়ে সিঁড়িতে উঠে এসেছে।
নাও ধরো। বলে বগলের মাদুর বালিশ তাকে দিয়ে ছাতাটা বন্ধ করার আগে বলল, এক ঘটি জল দাও। পায়ে কাদা লেগে আছে।
তিথি যা বলছে, অরু বাধ্য ছেলের মতো সব করে যাচ্ছে। তিথির ফ্রকের নিচে যদি ইজের না থাকে—তার মাথাটা ফের কেমন গোলমালে পড়ে গেল।
সেই এলি!
আসব না কেন?
সে আর কিছু বলল না।
তিথি মেঝেতে মাদুর পেতে তারপর বালিশ ঠেলে দিল ওপরের দিকে। সে আলগা হয়ে মাদুরে বসেছে। গামছা দিয়ে পা মুছল।
তিথি আজ আলতা পরেছে পায়ে।
তিথি তার বোধহয় পুজোর ফ্রক গায়ে দিয়েছে। সুন্দর লতাপাতা আঁকা ফ্রকে তিথির স্তন কিছুটা ভেসে উঠেছে। এই প্রথম তিথিকে সে চুরি করে দেখছে। তিথির দিকে তার এতদিন যেন কোনও নজরই ছিল না। এমনকি নদীর জলে তিথিকে সামান্য তিথি বলেই এত ঝগড়া করতে পেরেছে। তিথি যেন সহসা হাওয়ায় বড় হয়ে গেল তার কাছে—ফ্রকটা যে কিছুটা টাইট তাও বুঝতে পারল। সে যে ঢোলা সেমিজের মতো মার্কিন কাপড়ের ফ্রক পরে থাকে—তার কোনও অন্তর্বাস থাকে না, সে চিত হয়ে পড়ে না গেলে কিছুই টের পেত না। পড়ে গিয়েই তাকে এতটা বিপর্যস্ত করে দিয়েছে, এই মুহূর্তে তিথিকে দেখে তাও বোঝা গেল।
তিথি মুখে প্রসাধনও করেছে। তুলির কাছ থেকে ইচ্ছে করলে সবই চেয়ে নিতে পারে। চুল দু’বিনুনি করে মাথায় টেনে বেঁধেছে। হাতে পিতলের চুড়ি পরেছে। নাকে নথও ঝিলমিল করে উঠল। কিন্তু তিথির ফ্রকের নিচে যদি ইজের না থাকে!
তিথি এবার তাকাল। কী হল, বসে থাকলে কেন, শুয়ে পড়ো।
তোর মশারি আনলি না? মশারি টাঙিয়ে না শুলে মশা কামড়াবে।
অতীব এক তির্যক চোখে তার দিকে তাকিয়ে খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, মশা আমাকে কামড়ায় না।
মশা তোকে কামড়ায় না?
না। কামড়ায় না। বললাম তো।
মশারি না টাঙালে শুতে দেব না।
তুমি শুতে দেওয়ার কে? অযথা ঝগড়া করবে না। মশারি টাঙালে কতটা আর আব্রু থাকবে বলো! যা দেখার দেখে ফেলেছ।
কত সহজে কথাটা বলে ফেলল তিথি! এতবড় নির্লজ্জ কথা বলতে বিন্দুমাত্র আটকাল না তিথির।
সেও তেরিয়া হয়ে উঠল, কী দেখে ফেলেছি! আমি কিছু দেখিনি!
দেখেছ! মিছে কথা বলবে না। মিছেকথা বললে আমার মাথা ঠিক থাকে না। রাত হয়েছে শুয়ে পড়ো। হারিকেন নিভিয়ে দিচ্ছি।
না, নেভাবি না।
আলো থাকলে আমার ঘুম হয় না।
তাহলে জেগে শুয়ে থাক।
সেই ভালো। তুমি ঘুমিয়ে পড়লে নিভিয়ে দেব। বলে সে বালিশ টেনে চিত হয়ে শোওয়ার আগে বলল, দুগগা দুগগা। তিথির হাই উঠছে। সে বালিশে থাবড়া মেরে কীসব ঠিক করে নিল। পাকা বুড়ির মতো আচরণ। নিশুতি রাতে কতরকমের আতঙ্ক থাকে, ঠাকুরের নাম করে সেই আতঙ্ক থেকে যেন রক্ষা করতে চাইছে অরণিকে।
অরণি কিছুতেই মশারির নিচে ঢুকছে না।
কী হল, বসে থাকলে কেন!
অরণি গুম মেরে বসে আছে?
ইস আলোটা চোখে কী লাগছে! বলেই উঠে পড়ল তিথি। হারিকেনটা থামের আংটা থেকে তুলে এক কোনায় নিয়ে রেখে দিল।
ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে তিথি বলল, আলোটা একটু কমিয়ে দিলে তোমার অসুবিধা হবে?
হ্যাঁ হবে।
আচ্ছা, ঠিক আছে। এবারে শুয়ে পড়ো।
অরণি এবার তক্তপোশে উঠে সে তার বাবার মশারিটা তিথির দিকে ছুঁড়ে দিল।
নে, এটা টাঙিয়ে নে।
তুমি খেপেছ। কাকার মশারি আমি টাঙাতে পারি। কাকা জানতে পারলে কী ভাববে বলো! মেঝেতে চুপচাপ শুয়ে থাকব, তাও তোমার সহ্য হচ্ছে না! তোমার মনে এত পাপ অরুদা।
পাপ কথাটা এত অশ্লীল লাগে শুনতে অরণি জীবনেও টের পায়নি। পাপ আছে তার মনে। আছে, সত্যি আছে, পাপ না থাকলে, সারাদিন সে তিথির ঘোরে পড়ে থাকবে কেন! তিথি সহজভাবেই যদি সব মেনে নেয়, নিতেই পারে, সে পড়ে গেছে কাদায় পিছলে এবং যা কিছু দেখার দেখা হয়ে গেছে, এখন আর ভেবে কী হবে! তিথি তাকে বোধহয় মনে মনে ক্ষমাই করে দিয়েছে।
সে তাড়াতাড়ি চোরের মতো মশারির ভিতর ঢুকে গেল। চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। ঠান্ডা হাওয়ায় শীত শীত করছে তার। তিথি গায়ে দেওয়ার কিছু আনেনি। তিথিকে মশায় কামড়ায় না, তিথির শীতও করে না বুঝি! মশারি কিছুতেই টাঙাল না। ভাঁজ করে বাবার বিছানার নিচে রেখে দিয়েছে। চাদর দিলেও হয়তো গায়ে দেবে না—বলবে, কী যে করছ না, কাকার চাদর আমি গায়ে দিতে পারি! কত বড় গুরুজন তিনি।
অরণি বিছানায় শুয়ে স্বস্তি পাচ্ছিল না।
অনেকদূর থেকে যেন বলল অরণি, তোর শীত করছে না তিথি।
করছে। হঠাৎ কীরকম ঠান্ডা হয়ে গেল সব কিছু।
চাদর গায়ে দিবি?
তিথি পাশ ফিরে হাঁটু ভাঁজ করে শুল।
অরণি মশারির ভেতর থেকেই তার চাদরটা বের করে বলল, ধর। এটা গায়ে দে।
তুমি কী গায়ে দেবে?
বাবার চাদরটা বের করে নিচ্ছি।
তাহলে দাও। তিথি উঠে বসল। তার ফ্রক হাঁটুর নিচে নেমে গেছে। জঙ্ঘা, ঊরু দেখা যাচ্ছে—সব যেন ফুলের উষ্ণতা নিয়ে ফুটে আছে। তিথির শরীর এত পুষ্ট, এত সাবলীল, এত সুষমা হাতে পায়ে, সে কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছে না। তবে রক্ষা নিচে আজ অন্তর্বাস আছে। ফ্রকের নিচে শরীর যে উদোম করে রাখেনি। তার সব অস্বস্তি শরীর থেকে সহজেই মুছে গেল।
তিথি চাদরটা দিয়ে শরীর ঢেকে শুয়ে পড়ল।
অস্বস্তি থেকে রেহাই পেয়ে হালকা বোধ করল। তিথি চাদরে সারা শরীর ঢেকে নিয়েছে। এমনকি মুখও। মশার কামড় থেকে আত্মরক্ষার এটাই বোধহয় একমাত্র উপায় তিথির।
অরণি যেন কিছুটা নিশ্চিন্তে এবার শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। কেউ আর কথা বলছে না। তিথি ঘুমিয়ে পড়তে পারে।
তখনই তিথি বলল, আলোটা নিভিয়ে দিই, চোখে বড় লাগছে।
চোখ কনুইতে ঢেকে শুয়ে আছে অরণি। তিথি যা খুশি করুক, সে কিছু বলবে না। হারিকেন নিভিয়ে দিতে হয় দিক, আলো থাকলে তার ঘুমের যখন ব্যাঘাত হয়—
কি নিভিয়ে দেব?
দে না! আমার কিন্তু ঘুম পাচ্ছে, এত কথা আর ভালো লাগছে না।
তিথি হারিকেন নেভালো না। সে শুয়েই আছে। ঘরের কোনায় হারিকেন। বিছানা থেকে উঠে গেলে, মাদুরের ঘস ঘস শব্দ পাওয়া যেত, কারণ সে বুঝেছে তিথি এপাশ—ওপাশ করলেও টের পাওয়া যায়। বৃষ্টি ধরে গেছে। গাছের পাতা থেকে টুপটাপ ফোঁটা পড়ছে টিনের চালে। এত নিঝুম হয়ে আছে যে হাই উঠলে, কিংবা জোরে শ্বাস ফেললেও টের পাওয়া যায়।
একটা কথা বলব অরুদা?
বললাম তো, আলো নিভিয়ে দে। আবার কী কথা!
তুমি রাতে ওঠো?
ঠিক নেই।
আমি কিন্তু উঠি।
ভয় পেলে ডাকবি। দরজায় দাঁড়াব।
টর্চটা বালিশের পাশে আছে। দেখে নাও।
কথাই বলছে, আলো নেভাচ্ছে না।
সে চিত হয়ে শুয়ে আছে বলে তিথিকে দেখতে পাচ্ছে না। শিয়রের পাশেই মেঝেতে তিথির বিছানা, হাত বাড়ালে নাগাল পাওয়া যায়, তিথি কী করছে দেখতে হলে তাকে উঠে বসতে হয়। তার মনে পাপ আছে, তিথি যে এত সুন্দর এবং এবার থেকে সে রহস্যময়ী নারী হয়ে যাবে—তার ভেতর পাপ আছে বলেই জেনে ফেলেছে। সেও বড় হয়ে যাবে, তিথির সঙ্গে ঠিক আগের মতো কোনও অকপট কথাবার্তায় জমে যেতে পারবে না। নদীর পাড়ে গেলে, কিংবা চরে নেমে গেলে সে তিথিকে কতদিন সঙ্গে নিয়ে গেছে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকারও নেশা তার কম না। নৌকায় উঠে এক নৌকা থেকে আর এক নৌকায় লাফিয়ে পড়েছে, তিথি সঙ্গে আছে।
নৌকায় বাদাম তুলে দিয়েছে মাঝিরা, তিথি সাঁতরে নৌকায় উঠে গেছে। সেও। কিছুটা দূরে গিয়ে নৌকা থেকে লাফিয়ে পড়েছে, দু’জনেই। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে পাড়ে উঠে এসেছে। কখনোই মনে হয়নি সে এত সুন্দর।
তিথি ফের বলল, একটা কথা বলব?
তিথির কথা কি শেষ হবে না! তাকে কি কথার ভূতে পেয়েছে!
সে সাড়া দিল না।
তুমি কি ঘুমিয়ে পড়লে!
সে কিছুতেই সাড়া দেবে না। কারণ সে ভেতরে ভালো নেই বুঝতে পারছে। আশ্চর্য এক কৌতূহল তিথির শরীর নিয়ে—কেমন সে ভেতরে ভেতরে পাগল হয়ে উঠছে। সে জোর করে নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। যেন নেমে গেলেই দু’জনের মধ্যে উষ্ণতার ছড়াছড়ি শুরু হয়ে যাবে।
তিথি নিজের মতোই কথা বলছে—তুমি তো আমাকে ভালোবাস। ভালোবাসলে জানো কাচের চুড়ি কিনে দিতে হয়। অষ্টমী স্নানের মেলায় গোবর্ধন দাসের দোকানে তোমাকে নিয়ে যাব। কত রকমের চুড়ি, কী রঙ, কী বাহার! কাচের চুড়ি পরতে আমার খুব ভালো লাগে।
না, সে আর পারছে না। সে উঠে বসল। চোখ জ্বলছে। মুখে ঘাড়ে জল দিতে পারলে ভালো হত।
আর তখনই তিথি উঠে হারিকেনের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। মশারির নিচে সে বসে আছে, তিথি জানে না। তার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়েছে। আর এত অন্ধকার যে কিছুই দেখা যায় না। টর্চ জ্বেলে দেখতে পারে। জানালা খোলা—প্রকৃতির আশ্চর্য বাহার—জ্যোৎস্না উঠেছে। এবং আকাশও দেখা যায়। সে কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় গাছপালা দেখার চেষ্টা করল। তিথির শরীর তাকে পাগল করে দিচ্ছে। সে কিছুতেই অন্যমনস্ক হতে পারছে না। আকাশে তারা ফুটে আছে বোধহয়। জানালায় বসে আকাশে তারা খুঁজে বেড়ালেও শান্তি পেত বোধহয়। কারণ সে আর যাই করুক, তিথির কাছে খাটো হতে পারবে না। প্রকৃতির মতোই তিথির কোনও স্থিরতা নেই। এই চঞ্চল, এই শান্ত, এই বৃষ্টি, এই রোদ। কখন দু’পাড় ভেঙে দ্রুত সব তরঙ্গের মধ্যে নদীর জলে ভেসে যাবে, কখনও জ্যোৎস্নায় চরের কাশফুলে হাওয়ায় দুলে উঠবে, তার কিছুই জানে না অরণি।
সে ধীরে ধীরে নেমে গেল। তারপর টর্চ জ্বালতেই দেখল, তিথি ঘুমোচ্ছে। সত্যি ঘুমোচ্ছে। পাশ ফিরে, দু’হাঁটুর মধ্যে প্রায় মাথা গুঁজে তিথি অসাড়ে ঘুমোচ্ছে। সে তিথিকে ছুঁতে সাহস পেল না।
সে অনভিজ্ঞ। সে কিছুই জানে না, যেটুকু করেছে ভেতরের তাড়না থেকে। শরীর স্পর্শ করার এক অমোঘ তাড়নাতেই সে চকি থেকে নেমে এসেছিল—তার কেন জানি ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়েছিল, তিথির শরীর ছুঁয়ে দিলেই এক আশ্চর্য পৃথিবীতে ঢুকে যাবে এমন মনে হয়েছিল তার। তিথিকে ছুঁয়ে দেখার মতো সাহস নেই তার। ছুঁয়ে দিলেই সে অপবিত্র করে দেবে তিথিকে।
সাত
দু’কূল ছাপিয়ে এবারে নদী জলে ভেসে গেল। জ্যৈষ্ঠের শেষাশেষি সেই যে দুর্যোগ শুরু হয়েছিল, দিনরাত ঘনবর্ষণ, ঝোড়ো হাওয়া, আকাশে মেঘের দাপাদাপি, ঘর থেকে বের হওয়াই দায়। ছাতা মাথায় দিলেও রক্ষা নেই, ঝোড়ো হাওয়ায় ছাতা উড়িয়ে নিচ্ছে। ভেতরবাড়িতে অরণি যাচ্ছিল ছাতা মাথায় দিয়ে, তখনই দেখল তিথি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। তিথিও ভিতরবাড়িতে যাবে। কিন্তু ছাতা নেই বলে কারও অপেক্ষায় আছে। তাকে দেখেই সে দৌড়ে এসে ছাতার তলায় ঢুকে গেল।
ওর ইচ্ছে হয়েছিল নিজেই ডেকে বলবে, এই তুই ভিজছিস কেন! চলে আয়।
কিন্তু আজকাল সে আগের মতো তিথিকে কাছে ডাকতে সাহস পায় না।
এই যে দুর্যোগ যাচ্ছে, সে কোনওদিন স্কুলে যেতে পারে, কোনওদিন পারে না। রেনি ডেরও ছুটি থাকে, তবে স্কুল কামাই করার পাত্র সে নয়। বাতাস এতই প্রবল যে ছাতা মাথায় যাওয়া যায় না। বর্ষাকাল আসার মুখে ঋতুর এই খেপা স্বভাবের কথা তার জানা আছে। কিন্তু তিথির কী ইচ্ছে হবে বোঝা ভার।
সে ছাতার ভেতর ঢুকেই বলল, ও ভিজে গেলাম! বলে প্রায় শরীর ঘেঁষে লেপটে যেতে চাইছে।
তিথির শরীরে এত আগুন আছে, কাছে এলেই যেন পুড়ে যেতে পারে, সে যতটা পারে আলগা হয়ে হাঁটে, কিন্তু হাঁটতে দিলে তো! তিথি নিজেই ছাতা কেড়ে নিয়ে বলল, এসো। কাছে এসো। জলে ভিজে যাচ্ছ।
ছপ ছপ পায়ের শব্দ উঠছে জলে।
ভেতরবাড়িতে পাত পড়েছে এমন খবর পাওয়ার পরই সে বের হয়ে পড়েছে। বাবা নাজিরখানা থেকে সোজা চলে যাবেন। আবার খেয়েদেয়ে সোজা নাজিরখানায় যাবেন। তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে দিবানিদ্রা তিনি সেখানেই সেরে নেন। তিথি আগে হলে তার ঘরে ঢুকে যেত, তাকে ডেকে নিয়ে যেত, সেই যে ভেতরবাড়ির সঙ্গে কাছারিবাড়ির দুতিয়ালি করে থাকে, কিন্তু ইদানীং তিথি একা আর তার ঘরে আসে না, সঙ্গে ওর কোনও ভাই না হয় বোন থাকে। সেই কোলে করে নিয়ে আসে, বড়দের হাত ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে আসে।
অরণি তখন ভেতরে ভেতরে বড় অপমান বোধ করে। সে যে রাতের অন্ধকারে তিথির পাশে গিয়ে বসেছিল, আনাড়ি বলেই কী করতে হয় জানে না, তবুও বসেছিল, বোধহয় তিথি তা জানে। বোকার মতো কিছু একটা করে বসলে তিথিরও যে মান থাকে না। সে ছোট হয়ে গেলে তিথিও বোধহয় ছোট হয়ে যাবে।
হাসনুহানার গাছের নিচ দিয়ে পাঁচিলের পাশ ধরে হাঁটছে। তিথির দেরি হয়ে গেছে, সে অনেক আগেই রান্নাবাড়িতে গিয়ে বসে থাকে! তবে ঘর থেকে বের হতে পারছিল না। ছাতা না থাকলে কী করা! ভাঙা ছাতাটি তার বাবা নিয়ে যেতে পারে। ঘরে বসে বোধহয় তিথি লক্ষ্য রাখছিল, তার অরুদা কখন মাঠ পার হয়ে ভেতরবাড়িতে যায়, এবং তাকে দেখেই বড় চালতা গাছটার নিচে এসে দাঁড়িয়েছিল। অরুদার ছাতার নিচে ঢুকে গেলে তার রান্নাবাড়িতে যেতে অসুবিধা হবে না।
তিথি ঠিক করবী গাছটার নিচেই ফিসফিস করে বলল, এই একটা কথা বলব?
একটা কথা বোধ হয় আর শেষ হবে না।
কী বলবি?
বলো রাগ করবে না।
রাগ করার কথা হলে মানুষ রাগ না করে পারে?
তা হলে তো বলা যাবে না। তুলিদি যদি জানতে পারে আমাকে খেয়ে ফেলবে।
বাবুদের বাড়ির মেয়ে। এখন সে আরও লম্বা ফ্রক পরে। তাকে দেখলে আড়ালে চলে যায়—তুলির খুব আজকাল লজ্জা। তিথি বলল, আগে তুমি তুলিদিকে চুরি করে দেখতে, এখন তুলিদি তোমাকে দেখে।
তুলি বলল তোকে!
আমাকে বলবে কেন। তুলিদির চাওনি দেখলেই সব বোঝা যায়।
এই কথা!
আজ্ঞে না। এই কথা না। আরও কথা আছে।
কী কথা, শোনার কোনও আগ্রহ বোধ করল না সে। বাবুদের মেয়ে, কত রকমের শখই থাকে। মেজদা শহর থেকে একটা সাদা রঙের বাচ্চা কুকুর এনে দিয়েছে। খরগোশের চেয়ে সামান্য বড়। কুকুরটা আর বড় হবে না। তুলি বিকাল হলেই পরীর মতো সেজে গুজে কুকুরটা বুকে নিয়ে কাছারিবাড়ির বাগান, না হয় নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াবে। তার জানালা থেকে যতটা দেখা যায় ততটা রাস্তাতেই তুলি হাঁটাহাঁটি করে। বেশি দূরে যায় না। কখনও বীণা পিসি থাকে, কখনও থাকে না।
পাঁচিলের দরজা দিয়ে ঠিক ভেতরে ঢোকার মুখেই তিথি ছিটকে ছাতার তলা থেকে সরে যাওয়ার সময় বলল, তুমি তো শুনতে চাইলে না পরে বলব।
এক ছাতার তলায় তিথিকে এত ঘনিষ্ঠ দেখলে তুলি কি খেপে যাবে! তিথির ছিটকে যাওয়া দেখে এমনই মনে হল তার। এবং আজকাল তার যা হয় সঙ্গে সঙ্গে সেই দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে। তিথি জলে কাদায় চিত হয়ে পড়ে আছে। তিথিকে না দেখে কেন যে তুলিকে দেখতে পেল—ঠিক একইভাবে জলে কাদায় তুলি চিত হয়ে পড়ে আছে।
এসব কেন যে সে দেখে!
রোয়াকে উঠে এক কোনায় সবার সঙ্গে সেও ছাতা রেখে হেঁটে গেল। লম্বা কার্নিসের নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। রান্নাবাড়ির এলাকাটা বাড়ির ভেতর মহল পার হয়ে। সবাই এসে গেছে—সে এদিক—ওদিক চোখ তুলে তাকায় না। মাথা নিচু করে হাঁটার স্বভাব। চোখ তুললেই যেন, জানালার পাশে কিংবা খাটের বাজুতে দেখতে পাবে তুলি থুতনি রেখে তাকে দেখছে।
অবশ্য তুলি বের হবেই। সে না দেখলেও বের হবেই।
কারণ তার কুকুরটা কী শুঁকতে শুঁকতে রোয়াকে বের হলেই তুলি ছুটে আসবে। একবার পলকে তাকে দেখে কুকুরটাকে বুকে করে তুলে নিয়ে যাবে। তাকে দেখার জন্য তুলির এই ছলনায় সে ভেতরে ভেতরে মজা পায়। তুলি মনে করে সে কিছু বোঝে না।
দুর্যোগের দিনে আজ রান্নাবাড়িতে খিচুড়ি লাবড়া বেগুনভাজা চাটনি দিয়ে সবাই বেশ হুঁসহাস করে খেল। ছোড়দার থালায় খিচুড়ি থেকে গেছে। চাটনি দিতে এলে, ছোড়দা খিচুড়ি পাত থেকে ঠেলে ফেলে দিতে চাইলে জেঠিমা হা হা করে উঠলেন।
ফেলিস না। তিথি খেয়ে নেবে। খেতে পেলে খুশি হবে।
এসব দেখার অভ্যাস তার আছে। পাতে তার কিছুই বেশি হয় না। বেশি হলেও খেয়ে নেয়। না খেলে তিথির জন্য তুলে রাখা হবে। ভেতরে তখন তার বড় কষ্ট হয়। তিথিকে এ নিয়ে শাসনও করা যায় না। তার বাপের যা অবস্থা, বর্ষাকাল বলে অবশ্য তার বাবা ফুলুরি, জিলিপি ভাজার দোকানটায় বসে না। নদীনালার দেশ, বর্ষায় তিথির বাবা একটা ভাঙা কোষা নৌকায় গাওয়াল করতে বের হয়ে যায়। পান, সুপারি, ছোলা, মটর, বিস্কুট, ময়দার কড়ি ভাজা নিয়ে বের হয়। ঘাটে ঘাটে পাটের বদলে গ্রাহকদের ছোলা মটর বিস্কুট দেয়। বাড়ির বউ—ঝিরা চুরি করে পাট দিয়ে জিলিপিও কেনে। এতে তিথির বাবার পড়তা অনেক বেশি পড়ে। এসময় তিথির মা বাবা ভাইবোনগুলি পেট ভরে হয়তো খেতেও পায়। কিন্তু তিথির যখন এক জায়গায় ব্যবস্থা আছে, তখন তার জন্য যেন ভাবার দরকার নেই। তিথির মা যে তার বাবার দ্বিতীয়পক্ষের, তা বোধহয় সে ভুলেই গেছে। সে তার মাকে সবসময় বড় লক্ষ্মীমতী ভাবে। মার জন্যই বাবা বিবাগী হয়ে যায়নি, সোজা কথা!
নদীনালার দেশ। পোকামাকড়ের উপদ্রব আছে। বর্ষায় তিথির বাবার ভাঙা নৌকাই সম্বল। তাপ্পি মারা। গাবের কষ খেতে খেতে পোড়াকাঠের মতো হয়ে গেছে।
ওর বাবার রাতে ফিরতে দেরি হলে নদীর পাড়ে চালতে গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তিথি উসখুস করলেই সে টের পায়—কিছু একটা হয়েছে।
তিথি বলবে, বাবা ফেরেনি। একা সে চালতে গাছটার নিচে গিয়ে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় পায়। ভয় পায়, না, সঙ্গে যাওয়ার জন্য ভয়ের ছলনা, সে ঠিক বুঝতে পারে না। সে সঙ্গে থাকলে কথায় কথায় তিথি হেসে গড়িয়ে পড়ে। আবার তার বাপের ফিরতে দেরি দেখলে, চোখ জলে ভেসে যায়। বাবা না থাকলে যে কেউ থাকে না।
অরণি খেয়েদেয়ে বের হয়ে দেখল, বৃষ্টি আরও ঝেঁপে নেমেছে।
জগদীশও বৈঠকখানা ঘরে বসেছেন। সেও একটা বড় টুলে বসে আছে। বাবুরা কিংবা বাবুদের ছেলেরা বাড়ির করিডর ধরে যে যার ঘরে ঢুকে গেছেন। বৃষ্টির তোড় না কমলে বের হওয়া যাবে না।
জগদীশই বললেন, একটু বসে যাও। বৃষ্টি ধরে আসুক। তারপর যাবে।
বাবা তার সঙ্গে যাবেন না, সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে বাবা নাজিরখানায় চলে যাবেন। আসলে একসময় কাছারিবাড়িটায় যে নায়েব—গোমস্তাদের ভিড় ছিল, বোঝা যায়। বাবুদের অবস্থা পড়ে যাওয়ায় কাছারিবাড়ি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কবে অরণি জানে না। কাছারিবাড়িতে শুধু তার বাবা থাকেন। পাশের ঘরটায় দলিল—দস্তাবেজে ভর্তি। পরের ঘরটায়, লাঠি সড়কি বল্লম এবং তরবারিও সে ঝুলতে দেখেছে। ঘরটায় সবসময় তালা দেওয়া থাকে। পরের ছোট ঘরটায় থাকে হরমোহনদাদু—পাইক পেয়াদা এবং বাজার সরকার যখন যা দরকার সেই কাজই করেন!
এত বড় ঘরটায় তার ফিরে যেতেও ভালো লাগছে না। অবশ্য খুবই ঠান্ডা লাগছে। কাঁথা গায়ে দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তেও পারে। বই খাতা নিয়ে বসতে পারে। চলিত নিয়মের কিছু অঙ্ক করা বাকি। কিন্তু যা দুর্যোগের ঘোর চলছে, তাতে হারিকেন জ্বেলে না দিলে কিছুই দেখা যাবে না। বৃষ্টি ধরে আসতেই সে বের হয়ে পাঁচিলের দিকে যাওয়ার সময় দেখল তিথি পা টিপে টিপে তার ছাতার তলায় ঢুকে যাচ্ছে। তিথি কিছু বলতে চায়।
মানুষ সমান পাঁচিলের এপাশে সে ছাতা মাথায় বৃষ্টিতে হেঁটে যাচ্ছে। পাশে তিথি তেমনি তার গা ঘেঁষে হাঁটছে। তার কনুইয়ে তিথির নরম স্তনের সামান্য আভাস ছুঁয়ে যাচ্ছে। তার ভালো লাগছিল। তিথি কী যে চায়, তার ছাতার নিচে ঢুকে তার সঙ্গে কাছারিবাড়িতে উঠে যেতে পারে, কিন্তু তিথি আজকাল তার ঘরে একা ঢোকে না—যেন তিথি খুবই সতর্ক হয়ে গেছে। তার মনে পাপ আছে, সে কিছু যদি করে বসে, এসবও ভাবতে পারে। নিজেকে সাধু প্রতিপন্ন করার চেষ্টাতেই যেন বলল, যা বাড়ি যা।
বাড়ি যাব কি! তুমি তো আমার কথাই শুনলে না।
আবার কী কথা!
বারে বললাম না, আরও কথা আছে।
আবার বোধহয় ঝেঁপে বৃষ্টি আসছে! সে ছুটতে চাইলে ছাতার ডগা ধরে ফেলল তিথি।
কী যে লাফাচ্ছ না! জলে সব ভিজে যাচ্ছে।
চারপাশে জল জমে যাওয়ায় ইচ্ছে করলেই ছুটে যাওয়া যায় না।
বকের মতো পা ফেলে হাঁটতে হয়। তিথির আরও কথা আছে, কিছুতেই এই বৃষ্টির মধ্যে না শুনিয়ে ছাড়বে না। অথচ দু’জনেই ভিজে যাচ্ছে।
তুমি কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বলবে না।
কী বলব না।
এই যে তুলিদি তোমাকে চুরি করে দেখে। তুলিদি সব লক্ষ্য রাখে জানো। কী বলল জানো, দেখিস অরুর আর কদিন বাদেই গোঁফ উঠবে।
সে বলল, তাই বুঝি।
আমাকে বকল। তুই একা ঘরে যাস লজ্জা করে না। দামড়া হয়ে উঠছে জানিস না!
এসব কথা শুনতে তার ভালো লাগছে না।
আর যাবি না একা। খবরদার। একা গেলে ছোটপিসিকে বলে দেব। হুমকি।
এসব শুনতে ভালো লাগছিল না তার।
ঠিক আছে। চল তোকে বাড়ি দিয়ে আসি। না হলে সব তোর ভিজে যাবে।
যাক, গোঁফ উঠলে দামড়া হয়ে যায় একথা কি ঠিক?
জানি না।
তুমি তো কিছুই জানো না। আর ক’দিন বাদে তোমার গোঁফ উঠবে, তুলিদি জানে, অথচ তুমি জানো না। যার গোঁফ সেই ঘুমিয়ে থাকে। আয়নায় দেখে তো বুঝতে পারো, না তাও বোঝ না। তুমি কী বোঝ বলো তো!
তিথির কথা এমন যে মায়া না জন্মে পারে না। তিথি না থাকলে সে কত একা তাও বোঝে। বড় হওয়ার মুখে তিথির সাহচর্য তার চারপাশ ভরে রেখেছে। সে না থাকলে তার যে সবই অর্থহীন হয়ে যেত, সে অতিষ্ঠ হয়ে হয়তো চলেই যেত। একা এমন দূর দেশে মাকে ছেড়ে এভাবে কারও পক্ষে থাকাই সম্ভব হত না। মাঝে মাঝে মনে হয় বাবাকে বলে সে তিথির জন্য ভালো ফ্রক প্যান্ট আনিয়ে দেবে। কিন্তু সে বলে কী করে! তিথির প্রতি তার আকর্ষণ যদি বাবা টের পেয়ে যান!
সে এত নিরুপায় যে তিথিকে কোনও কারণেই সামান্য ভর্ৎসনা পর্যন্ত করতে পারে না। তিথির পক্ষে তার ঘরে একা আসা উচিত নয় সেও এটা বোঝে। তুলির চোখকে ফাঁকি দেওয়া কঠিন।
তারপরই তিথি বলল, মনে আছে তো! এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? তুমি আমাকে কাচের চুড়ি কিনে দেবে, মনে নেই!
দেব।
তারপরই তিথি কেন যে সহসা বলল, আমি যাই। নদীতে বান এসে গেছে, কী মজা হবে না! তুমি যাবে?
কোথায়?
নদীতে।
কেন?
বারে নৌকায় ভেসে যাব আমরা। তারপর নৌকা যেখানে যায় যাবে। আমরা বসে থাকব। হাটবারে বাবা গাওয়ালে যায় না। নৌকাটা নদীর পাড়ে পড়ে থাকে। যাবে আমার সঙ্গে?
না।
কেন যাবে না? আমি কী করেছি! আমার সঙ্গে গেলে তাজা ইলিশ দেখাব। ঝকঝকে রুপোর ইলিশ। লাফাচ্ছে, পাটাতনে লাফাচ্ছে।
তিথির পক্ষে সবই সম্ভব। গেছো মেয়ে, ভালো বৈঠা চালাতে পারে, আর বর্ষায় নদীর জলে স্রোতের মুখে সাঁতরাবার সময় কখন যে শুশুক মাছ হয়ে যায়, কখন যে জলের নিচে ডিগবাজি খায়, দূর থেকে কখনোই মনে হয় না তিথি জলে সাঁতার কাটছে, জলে ডিগবাজি খাচ্ছে, যেন নদীর জলে নেমে মৎস্যগন্ধা হয়ে গিয়ে কোনও সুপ্রাচীন কাব্যগাথা তিথি। সে পাড়ে দাঁড়িয়ে দেখত। ভরা কোটালে মাঝনদীতে যাওয়ার সাহসই নেই তার। ঘোর বর্ষায় নদীর জলে ঘূর্ণি দেখলেই তার মাথা ঘোরায়। তিথি কিছুই গ্রাহ্য করে না। তাকে তাজা ইলিশমাছের প্রলোভনে ফেলে দিচ্ছে। সে যেন এবার তাকে নিয়ে নদীতে ভেসে যাবেই। তাজা ইলিশ তাকে জেলেদের নৌকায় দেখাবেই।
মানবাজারের ওদিকে মেলা মন্দির আছে। বিশ্বনাথের মন্দির, কালভৈরবের মন্দির, রুদ্রদেবের, অন্নপূর্ণার মন্দির। ওদিকটায় তখন ঘন জঙ্গল। অষ্টমী স্নানের মেলায় জমিদারবাবুরা লোক লাগিয়ে জঙ্গল সাফ করে দেয়। ওখানেই তো মেলা বসে। কাচের চুড়ি ওখানেই কিনতে পাওয়া যায়।
তিথির সঙ্গে থাকার এই মুশকিল। কিছুতেই তার কথা শেষ হয় না। তাকে রাজি না করিয়ে যেন তিথি কিছুতেই যাবে না।
সে কেমন প্রলোভনে পড়ে গিয়ে বলল, ঠিক আছে যাব। হাটবার আসুক।
ঠিক যাবে?
হ্যাঁ, ঠিক যাব।
তিন সত্যি।
তিন সত্যি।
আমার গা ছুঁয়ে বলছ!
এই গা ছুঁয়ে বলছি।
তিথি এতই আপ্লুত তার কথায়, প্রায় বুকের কাছে মাথা ঠেকিয়ে দিয়েছে।
ঘনবর্ষণে দু’জনেই ভিজে যাচ্ছিল। তিথি কি এই বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে চায়! তিথির শরীরে কি উত্তাপ জমা হচ্ছে! বুকে মাথা ঠেকিয়ে দিলে কেন যে মনে হয়েছিল, তিথির গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
খুবই বিব্রত হয়ে পড়ল সে।
তিথি তোর গা গরম! জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিস!
যা ভাগ! আমার কিছু হয়নি।
এতই ঘনবর্ষণ যে দু—দশ হাতের কাছাকাছি কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যেন এক আচ্ছাদন চারপাশে তাদের ঘিরে রেখেছে। এমন মুহূর্তে তার ইচ্ছেই করছে না তিথিকে ফেলে যেতে। কাছারিবাড়িতে গিয়ে উঠতে পারে—কিন্তু তিথি তার বুক থেকে কিছুতেই মাথা তুলছে না।
জানো, তোমাকে আমার ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হয় না। তুমি আমাকে স্বপ্নে দ্যাখ?
এমন প্রশ্নের সে কী জবাব দেবে! সে কখনোই তিথিকে স্বপ্নে দেখেনি।
সে বলল, না।
বা তা হয় নাকি! ভালোবাসলে স্বপ্ন দেখতে হয় জানো!
তুই দেখিস?
হ্যাঁ, দেখি। কত রাতে স্বপ্নে দেখেছি, আমি নদীর জলে ডুবে যাচ্ছি, পাড় থেকে লাফিয়ে পড়েছ তুমি—দু হাতে চুলের ডগা ধরে তুলে আনছ। তারপর পাঁজাকোলে করে…
পাঁজাকোলে করে… কী?
কী আবার, ধ্যাত, আমার লজ্জা লাগে। শুনতে খুব ভালো লাগে… পাঁজাকোলে করে কী… এখন বলব না। পরে বলব।
তারপর বৃষ্টির মধ্যেই সে দৌড়ে সুপারিবাগানের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
মেয়েটার মাঝে মাঝে কী যে হয়!
মাঝে মাঝে তারও কী যে হয়!
মাথা কান গরম হয়ে যায়। চোখ মুখ ঝাঁঝাঁ করে।
পরের বর্ষায় তিথি সত্যি একদিন হাত ধরে টানতে টানতে নদীর পাড়ে গেছিল। সেদিনও অবিশ্রান্ত বর্ষণে পৃথিবী যেন কুহেলিকাময়। ঝাপসা কুয়াশার মতো বৃষ্টির আড়ালে তারা যে নৌকায় উঠে বসেছে কেউ দেখতেই পায়নি। বাবা সেদিনও কাজে বাইরে গেছেন। ফিরবেন দুদিন বাদে। রাতে তিথি এখন তার ঘরে পাহারায় আর থাকে না। তিথির মামা চরণ রাতে তার ঘরে শোয়।
বাবাই কেন যে সেবারে বললেন, তিথির এখন সমন্দ আসছে। গোরাচাঁদ যাকে দেখছে, বলছে, কন্যে উদ্ধার করে দিন। তিথির মামা চরণ তোমার ঘরে শোবে। তিথির আর তোমার ঘরে শোওয়া ঠিক হবে না। আমিই তিথিকে বারণ করে দিয়েছি।
তিথির বিয়ে! যা হয় নাকি! কতটুকুন মেয়ে—বড় না হলে মেয়েদের বিয়ে হওয়া মানায় না।
সে তিথিকে ডেকে বলেছিল, কী রে তোর বাবা নাকি পাত্র খুঁজছে?
ধুস, তুমি যে কি না। আমি বড় হয়ে গেছি না! তাই তোমার ঘরে শুলে কেউ খারাপ কিছু ভাবুক কাকা চায় না। আমার পাত্র দেখা হচ্ছে, আমি জানব না!
এও হতে পারে, মেয়ে বড় হতে থাকলে বাপের চিন্তা বাড়ে। হয়তো বাবাকেই ধরতে পারে, কোনও সুপাত্র যদি জোগাড় হয়। সুন্দরী মেয়ের পাত্রের অভাব হয় না। কিন্তু যা হয়, এসব ভাবলেই খুব মুষড়ে পড়ে অরণি।
তিথি হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলে সে না গিয়ে পারে! তিথি যে কী সুঘ্রাণ ছড়িয়ে রেখেছে—তিথির কাছে থাকলে তার শরীরে যে সুবাতাস বয়—তার সাধ্য কি তিথিকে ফেরায়!
চালতে গাছের নিচে তাপ্পিমারা কোষা নৌকাটা দড়িতে বাঁধা ছিল। পাটাতনের নিচে বৈঠা। একটা লগিও আছে। বৃষ্টিতে পাটাতনের নিচে জল জমে গেছে—তিথি উবু হয়ে বসল। জল সেঁচে ফেলছে—তিথির দুই উরুর দিকে কিছুতেই তাকাচ্ছে না অরণি, যদি কিছু দেখে ফেলে।
সহসা কেন যে অরণির মনে পড়ে গেল তিথি তাকে ফের হয়রানি করতে পারে। নদীতে তাজা ইলিশ দেখাবার নাম করে তাকে নিয়ে গিয়ে শেষে কোথায় ফেলবে জানে না। তিথির যদি কোনও দুষ্টবুদ্ধি কাজ করে, সারা সকাল—দুপুর রোদের সেই হয়রানির কথাও মনে পড়ল।
মুশকিল তিথি কোথায়, কী করছে, দেখার প্রায় কেউ নেই বললেই চলে। তিথি বাড়ি না থাকলে ধরেই নেয় সে বাবুদের রান্নাবাড়িতে আছে, নয়তো তুলির ঘরে, ছোটপিসির ঘরেও থাকতে পারে। কিন্তু তার ওপর বাবুদের বাড়ির সবারই কমবেশি নজর আছে। সেজদা কিংবা সোনাদা কাছারিবাড়িতে এসে উঁকি দিতে পারে, তাছাড়া দুপুরেও তাকে রান্নাবাড়িতে হাজির থাকতে হয়। সে না গেলেই কার নির্দেশে যে ভেতরবাড়িতে তোলপাড় পড়ে যায়—সে তিথির সঙ্গে এই দুর্যোগে কিছুতেই নদীতে নৌকা ভাসিয়ে দিতে পারে না।
নৌকা থেকে লাফ দিয়ে পাড়ে উঠে এল অরণি।
তার খালি গা। প্যান্টের ওপর কোমরে গামছা জড়ানো। সে নদীতে ডুব দিয়ে বলল, এই তিথি বাড়ি চল। যেতে হবে না।
কেন, গেলে কী হবে?
ফিরতে দেরি হয়ে গেল সবাই ভাববে।
ফিরতে দেরি হবে কেন? জাল থেকে পাটাতনে যখন ফেলে, ইলিশ মাছ কী লাফায়! তারপর মরে যায়। মাছের মরে যাওয়া দেখবে না!
আচ্ছা তিথি মাঝে মাঝে তোর এত বাই চাপে কেন বল তো! মাছের মরে যাওয়া দেখার মধ্যে কোনও আনন্দ আছে?
তিথি আর কথা বলল না। সে পাড় থেকে নৌকা ঠেলে পাটাতনে লাফিয়ে উঠে গেল। কী যে করে তিথি! নদীর দু’কূল দেখা যায় না।
ভরা কোটাল। প্রবল স্রোতে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, চরের কাশবন সব ডুবে গেছে। সামনে নদীর এত বড় চড়া অদৃশ্য—মনে হয় নদী ফুলে ফেঁপে দু’পাড় ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে গেছে। মাঝগাঙে মেলা জেলে নৌকা পর পর, খড়ের নৌকাও মেলা। গয়না নৌকার মাঝি গুণ টেনে স্রোতের বিপরীতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি যেন বড় বেশি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে উঠেছে। সারা আকাশে মেঘ আর বজ্রবিদ্যুতের ছড়াছড়ি।
এই কি, তিথি সত্যি বৈঠা মেরে মাঝগাঙে চলে যাচ্ছে!
সে চিৎকার করে ডাকল তিথি যাস না। গেলে ভালো হবে না। আকাশ তোর মাথায় ভেঙে পড়বে।
তিথি পাটাতনে দাঁড়িয়ে বলল, আমার ভালো দিয়ে তোমার কী হবে?
হবে। তুই ফিরে আয়। তুই ফিরে এলেই হবে।
তুমি কথা রাখো না। আমার গা ছুঁয়ে বলেছ, আমার সঙ্গে নদীতে যাবে। ফিরে গেলে আমার আর কতটা ভালো হবে?
কতটা ভালো হবে জানি না। তবে তুই এলে পরামর্শ করা যাবে। তুই না থাকলে তুলি আমাকে নিয়ে যা খুশি ইচ্ছে করবে। তোর ভালো লাগবে?
এতেই যেন জব্দ। তিথি পাটাতনে বসে পড়ল। পাড়ের দিকে আসার চেষ্টা করছে।
সে কোমর জলে নেমে গেল। তারপর সাঁতার কাটতে থাকল। নৌকার কাছে গিয়ে ঝুঁকি মেরে পাটাতনে উঠল। এবং বৈঠা আর তিথির হাতে রাখল না। সে প্রায় জোর করেই কেড়ে নিল।
তিথি তুই আমাকে নিয়ে কোথায় যেতে চাস বল। আমরা কতদূর যেতে পারি। মাথা খারাপ করে লাভ আছে!
আমি কী করব অরুদা, তিথি কেমন পাগলের মতো হা—হুতাশ করছে।
অরণি ঠিক বুঝতে পারছে না, তিথি এত ভেঙে পড়েছে কেন! তিথির কি কোনও দুঃসংবাদ আছে—অথবা কোনও এক অতিকায় হাঙরের পাল্লায় পড়ে গেছে তিথি! তার বিয়ের কথা কি পাকা হয়ে গেছে!
তবু তার কেন জানি হাঙরের কথাই মনে পড়ল। তিথিকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে।
সেজদা কিংবা জমিদারবাড়ির আর কেউ। তিথির শরীরে লাবণ্য এত বেশি, যে—কেউ যেন তিথিকে দেখলে মোহিত হয়ে যাবে।
সে ডাকল, তিথি।
বলো।
তোর কিছু হয়েছে?
কী হবে?
আচ্ছা আমাকে নিয়ে তুই কোথায় পালিয়ে যেতে চাস?—
তা তো জানি না।
আজকে কী মতলব ছিল তোর?
কী যে ছিল, বলতে পারব না। তুমি আমাকে স্বপ্নে দ্যাখো না, আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখি—ভাবলে যে মন খারাপ হয়ে যায়।
স্বপ্নে যদি তোকে দেখি খুশি হবি?
তিথি মাথা নিচু করে বসে থাকল।
বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। সঙ্গে দামাল হাওয়া। হালকা কোষা নৌকাটি সহজেই উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে। সে জলের নিচে বৈঠা ঢুকিয়ে হাল ধরেছে। ইচ্ছে করলেই হাওয়ার উপায় নেই নৌকা উড়িয়ে নেয়। বরং হাওয়ার গতির জন্য নৌকা পাড়ের দিকে ভেসে যাচ্ছে। এত ঘন বৃষ্টির ছাট যে এখন পাড়ও ভালো করে দেখা যায় না। তবে সামনের বাঁশের জঙ্গল বিশেষ করে স্টিমারঘাটের বয়ার আলো দুলছিল বলে সে জানে তারা দিকভ্রান্ত হয়ে নদীর অন্য কোনও মোহনায় হারিয়ে যাচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই নদীর তীর পেয়ে যাবে।
কী চুপ করে থাকলি কেন, স্বপ্নে যদি তোকে দেখি খুশি হবি?
তিথি বলল, তুমি তুলিদিকে কখনও স্বপ্নে দ্যাখো না?
না।
কাউকে দ্যাখো না।
কাউকে দেখব না কেন। আর স্বপ্নের কথা কি মনে থাকে। কত কিছুই দেখি, ঘুম থেকে উঠে আর মনে করতে পারি না। আমার কী দোষ বল।
আমাকে স্বপ্নে দেখলে তুমি ভুলে যেতেই পারো না। ঠিক তোমার মনে থাকত।
তা অবশ্য বোধহয় থাকত।
বোধহয় না। থাকত।
ঠিক আছে, আয় আমরা এসে গেছি। নাম।
তুমি তো বললে না, কবে তুমি স্বপ্নে আমাকে দেখবে!
তিথির কাছে এই মুহূর্তে কোনও মিছে কথাও বলতে পারছে না। সে বলতে পারত, নারে, আমি তোকে স্বপ্নে দেখি, তবে বলতে লজ্জা হয়। তুই না আবার কী ভাবিস! মিছে কথা বললে, তিথি সহজেই তাকে বিশ্বাস করবে। নিছক একটা স্বপ্ন নিয়ে তিথির কাতর মুখ সহজেই উচ্ছল হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু তিথির কাছে কিছুতেই মিছে কথা বলতে মন সায় দিল না।
শোন অরুদা। স্বপ্ন কখন দ্যাখে জানো?
না, জানি না।
সারাদিন যাকে ভাববে, রাতে সেই স্বপ্নে হাজির হয়, জানো?
অরণি বলল, হতে পারে।
হতে পারে না। হয়। আমি তো প্রায়ই তোমাকে দেখি। সেই এক দৃশ্য, আমি ডুবে যাচ্ছি, তুমি আমাকে জল থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছ। ভাবতে গেলেই আমার শরীর কেমন শিউরে ওঠে। এই দ্যাখো, দ্যাখো না, আমার গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে গেছে! স্বপ্নটা ভাবতে গেলেই শরীর অবশ হয়ে যায়।
শিগগির নাম।
নৌকাটা খুবই দুলছিল। নৌকাটাকে আয়ত্তে রাখাই কঠিন। যেন পাড়ে এসে ডুবে যাবে। সে লাফিয়ে কোমর জলে নেমে গেল। নৌকাটা একটা গাছের গুঁড়িতে বেঁধে ফেলল।
এই নাম। ঠান্ডায় হাত—পা অবশ হয়ে আসছে।
নামব না।
তুই কি আমাকে মেরে ফেলতে চাস?
তখনই পাড়ের দুটো গাছ অদূরে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে জলে পড়ে গেল। স্রোতে গাছ দুটো ভেসে যাচ্ছে। কোথা থেকে উড়ে এল দুটো বক। ভাসমান গাছের ডালে বসে পড়ল। এক সময় মনে হল এই দুর্যোগ থেকে তিথিকে কিছুতেই রক্ষা করা যাবে না। সেও ভেসে যেতে পারে। নদীর এমন ভয়ঙ্কর রুদ্ররূপ সে যেন জীবনেও দেখেনি। সে ইচ্ছা করলে আত্মরক্ষার্থে তিথিকে ফেলে চলে যেতে পারে—তিথি যা খুশি করুক। কিন্তু তিথিকে ফেলে যাওয়ার যে তার ক্ষমতাই নেই। মরে গেলেও তিথিকে নিয়েই মরে যেতে হবে।
সে না বলে পারল না, কী হল বসে থাকলি কেন? দ্যাখ কী অবস্থা। বুঝতে পারছিস না। দুর্যোগ সব গাছপালা উড়িয়ে নিতে চাইছে। তুই কী মরতে চাস!
তিথি পাটাতনে উঠতে গিয়ে নৌকার দুলুনিতে টাল সামলাতে পারল না। জলে পড়ে গেল। নৌকার কিনার ধরে ফেলায় স্রোতের মুখে ভেসে গেল না ঠিক, তবে কেমন অসহায় চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। নৌকার কিনার ধরে সে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়ালে তিথি জলের মধ্যে সহসা অদৃশ্য হয়ে গেল।
তিথি! তিথি!
কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির ঝাপটায় তার যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে পাগলের মতো শুধু চিৎকার করছে, তিথি! তিথি!
মুহূর্তে মনে হল তিথি অদূরে ভেসে উঠেছে জলের ওপরে। জন্ম থেকে সে এই নদীকে চেনে। নদীর ক্ষমতাই নেই তাকে ডুবিয়ে দিতে পারে। সে ভুস করে জলে মুখ দেখিয়ে আবার ডুবে গেল! আবার কিছুটা দূরে চলে যাচ্ছে, আবার ভুস করে ভেসে ওঠে তার মুখ দেখাচ্ছে। সে পাড়ে পাড়ে ছুটে যাচ্ছে। সে চিৎকারও করতে পারছে না, তিথি জলে ডুবে যাচ্ছে। জলে ডুবে যাচ্ছে না, তাকে নিয়ে নদীর পাড়ে মজায় মেতেছে, তখনই তিথি পাড়ের জঙ্গল আঁকড়ে তাকে ডাকছে—অরুদা, আমি এখানে। সে দৌড়ে কাছে গেলে বলল, একটা কথা বলব?
জীবনমৃত্যুর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তিথির এ কী খেলা! জঙ্গল থেকে তার হাত ফসকে গেলেই তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। জলের ঘূর্ণি এখানটায় প্রবল। দুর্যোগের মুখে স্টিমার পর্যন্ত জায়গাটা এড়িয়ে চলে। যতই সে নদীকে চিনুক, এই প্রবল ঘূর্ণিতে সে হাত ছেড়ে দিলেই জলের নিচে খড়কুটোর মতো তলিয়ে যাবে।
তিথি কি তার শেষ কথা তাকে বলার জন্য অপেক্ষা করছে? তা হলে ফেললেই আর তার মরার ভয় থাকবে না?
সে দাঁড়িয়েই আছে।
তিথি স্রোতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
সে লাফিয়ে জলে নেমে যেতে পারছে না। নামার সময় মাটি ধসে যেতে পারে। মাটি ধসে গেলেই ঝোপজঙ্গলসহ তিথি আবার তলিয়ে যাবে।
সে চিৎকার করে বলল, আমি আর পারছি না। তোর আর কী কথা আছে বল! আমাকে আর কত আতঙ্কে রাখবি?
অরুদা তুমি তুলিদিকে কিন্তু কখনও স্বপ্নে দেখবে না। কথা দাও।
অরণি হাসবে না কাঁদবে না ভয়ঙ্কর বিরক্তিতে চুল ধরে জল থেকে তুলে আনবে বুঝতে পারছে না। সে মুখ খিঁচিয়ে বলতে গিয়ে ভাবল, তা হলে আর এক বিড়ম্বনা শুরু হবে। হয়তো সত্যি হাত ছেড়ে দিয়ে তিথি নদীর অতলে মৎস্যকন্যা হয়ে ঘুরে বেড়াবে।
আর আশ্চর্য, তার কথারই প্রতিধ্বনি যেন করছে তিথি। বলছে অরুদা আমি তো অন্য জন্মে নদীতে মৎস্যগন্ধা হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। এ—জন্মে তিথি হয়ে জন্মেছি। তুমি তো কিছুই জানো না।
কত নিশ্চিন্তে এমন কথা বলছে, তার মাথা ধরে যাচ্ছিল। মৃত্যুর মুখে পড়ে গিয়ে, ঠিক পড়ে গিয়ে নয়, যেন কোনও আত্মবিনাশের প্রবণতা থেকে মেয়েটা তার সঙ্গে এভাবে কথা বলছে।
সে আর পারছে না। বলল, ঠিক আছে, সাবধানে উঠে আয়। নে, বলে সে গামছার প্রান্তভাগ ছুঁড়ে দিল তিথির দিকে। তিথি ইচ্ছে করেই যেন ধরল না। এমনকি চেষ্টাও করেও দেখল না, গামছাটা ধরা যায় কিনা।
শুধু বলল, কী দেখবে না তো?
না, দেখব না।
তুমি আমাকে স্বপ্নে না দেখলে তুলিদিকেও স্বপ্নে দেখবে না।
দেখব না, দেখব না।
তিন সত্যি।
তিন সত্যি।
তারপরই তিথি জলের ঘূর্ণিতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আট
শেষে অবশ্য তিথিকে খুঁজে পাওয়া গেল ইলিশ মাছের নৌকায়। জেলেরা টের পেয়েই জলে লাফিয়ে পড়েছিল।
তারপর সেই দুর্যোগের মধ্যে তিথিকে নিয়ে বাড়ি আসতে পেরেছিল ঠিক, তবে সেদিনই জ্বরে পড়ে গেল অরণি। জ্বর বাড়ল। বাবা বাড়ি নেই—তিনদিনের মাথায় বুকে কফ জমে গেল—কবিরাজ অমূল্যধন, এলাকার ধন্বন্তরি, তিনি বলে গেলেন, সান্নিপাতিক জ্বর—ভোগাবে।
অরণি প্রায় মাসখানেক বিছানায় পড়ে থাকল। এত দুর্বল হয়ে গেল যে প্রায় উঠতে পারে না। বিছানায় লেগে আছে। বাবা ফিরে এসে খুব প্রমাদ গুণলেন। তিথি বলতে গেলে সারাদিন তার ঘরেই পড়ে থাকে। সেবা—শুশ্রূষারও শেষ ছিল না। বাবাই তিথিকে অনুপান—সহ কখন বড়ি মেড়ে খাওয়াতে হবে বলে দিয়েছেন। যেমন বাসকপাতা, তুলসিপাতা, মধু এবং পুনর্ণবার পাতা তিথিও ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করত। একেবারে একজন শিশুকে যেভাবে পরিচর্যা করা দরকার, তিথি তাকে সেভাবেই অতি যত্নে বিছানা থেকে তুলেছে, কপালে জলপট্টি দিয়েছে, এবং তিথি যে কত দায়িত্বশীল তার এই পরিচর্যার বহর না দেখলে বিশ্বাসই করা যেত না। তার আরোগ্য কামনায়, সে সেই জঙ্গলের মন্দিরগুলিতে মাথা ঠুকে এসেছে, মানত করেছে, অরুদা ভালো হয়ে উঠলে তাকে নিয়ে যাবে। বাতাসা মিসরিভোগ দেবে।
বিকেলের দিকে বাবুরা আসতেন। বাবা ক’দিন ঘর থেকে বেরই হলেন না। জেঠিমা, তুলিও তাকে দেখে যায়। ছোট পিসি ঘরে ঢোকেন না। বাইরে থেকেই, মুখ বাড়িয়ে বলবেন, মুখে তোর রুচি কীরকমের?
তার খাওয়ায় রুচি ফিরে এলে বলেছিলেন, আর ভয় নেই। এবার ভালো হয়ে উঠবি। আর ভয় নেই। তিথির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, মেয়েটা তোর জন্য যা করেছে!
তিথি এসব কথায় খুবই লজ্জায় পড়ে যেত। টিপয়ের গেলাসে জল রেখে দিত ঢাকনা দিয়ে। বেদানার খোলা ছাড়িয়ে প্লেটে সাজিয়ে দিত। প্রথম পথ্যের দিনে হেলানচার ডগা সেই তুলে এনেছে। জঙ্গল থেকে গন্ধপাঁদাল। মৌরলা মাছ দিয়ে গন্ধপাঁদালের ঝোল পথ্য। তিথিই তাকে ধীরে ধীরে বাইরে নিয়ে এল একদিন। কাছারিবাড়ির বারান্দায় একটা ইজিচেয়ার পেতে বলেছিল, আমার জন্য এই ভোগান্তি। কিছু হলে আমার যে কী হত! আমি আর কাউকে মুখ দেখাতে পারতাম না। বলেই ফুঁপিয়ে তার কি কান্না।
কাঁদছিস কেন? আমি তো ভালো হয়ে গেছি। অরণি বলত।
তিথি তখন তার কথায় জবাব না দিয়ে পালাত। সে দেখতে পেত তিথি সুপারিবাগানে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। যেন এক দিশেহারা কিশোরী—সে শুধু দেখত। জোরে আর ডাকতে পারত না।
তিথি বড় সুন্দর দেখতে।
অরণি সুপারিবাগানের দিকে তাকিয়ে এমন ভাবছিল। চুল কোঁকড়ানো। চোখ টানা টানা—গায়ের রঙ যেন ফেটে পড়ছে। নাকে নথ ঝুলিয়ে দিলে দুগ্গা ঠাকুর।
সে জানে ভেতর বাড়িতে তিথি ফুটফরমাস খাটতে ভালোবাসে—তিথি গামছাটা নিয়ে আয়, তিথি দ্যাখ বৃন্দাবনদা এল। ভাঁড়ার থেকে চাল, ডাল বের করে দে। ভেতর বাড়িতে দাদাদের সঙ্গে গেলে এমন কত কথা শুনতে পেত অরণি। বাজার থেকে ঝুড়ি ভর্তি সওদা এলে ফ্রক গুটিয়ে ছোট পিসির সঙ্গে বাজার গোছাত। কোথায় কী রাখতে হবে তিথি ঠিক জানে। কখনও বীণাপিসির সঙ্গে মাছ কুটতে বসে যায়—ঘাট থেকে কাটা মাছ ধুয়ে আনে। কোচরে থাকে থোকা থোকা লটকন ফল। ফাঁক পেলেই খোসা ছাড়িয়ে খায়। তার ঘরে এসে তাকেও দেয়।
যখনকার যে ফল, কোঁচড়ে নিয়ে ঘোরার স্বভাব। কামরাঙ্গা, লটকন, আঁশ—ফল—কোথায় যেসব পায়! জমিদারবাবুদের বাড়িগুলি পার হয়ে গেলেই মজা খাল, মজা খালের পাড়ে পাড়ে অজস্র গাছপালা, ঝোপজঙ্গল। তিথি জানে কোথায় কোন গাছ কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে। কোন গাছে কী ফল পেকেছে—জমিদারিতে এলাহি গাছপালা। জঙ্গলেরও যেন ব্যবস্থা আছে। দিঘির পাড়ে বিলাতি গাব গাছের ছায়া বিকালে লম্বা হতে হতে দিঘিটাকে অন্ধকার করে দেয়। কালো জল, থামের মতো বড় বড় সব গজার মাছ ভেসে উঠলে তিথিই তাকে নিয়ে গেছে সেখানে—তিথিই খবর দিত, গাছে বিলাতি গাব পেকেছে। যেমনি গাছ, তেমনি তার বিশাল কাণ্ড। আর গাছে বড় বড় তেল চুকচুকে পাতা। গভীর ঘন ছায়ার মধ্যে লাল রঙের পাকা বিলাতি গাব তিথির চোখ এড়ানো কঠিন। জমিদারবাবুদের দেশটা সে যেন চিনেছে তিথির চোখ দিয়ে।
তিথি একটা বালিশ দিয়ে গেছে মাথার কাছে। ইজিচেয়ারে মাথায় বালিশ দিয়ে সে তিথির কথাই ভাবছিল।
মেয়েটার মাঝে মাঝে কী যে হয়?
এভাবে জীবন নিয়ে খেলা তিথির পক্ষেই সম্ভব। কারণ তিথি অনাথ। বাবুদের বাড়ির এঁটোকাটা খেয়ে সে বড় হয়ে উঠছে।
অরণি ভাবল অষ্টমী স্নানে এবারে তিথিকে নিয়ে যেতেই হবে। কাচের চুড়ি কিনে দিতে হবে। মেয়েটাও বেশি কিছু চায় না। ভালোবাসলে কাচের চুড়ি কিনে দিতে হয়—ভালোবাসার দাম সামান্য কটা কাচের চুড়ি—ভাবলেই কেন জানি মন খারাপ হয়ে যায় তার।
একমাত্র পূজার ছুটিতে অরণি বাড়ি যেতে পারে। স্টিমারে পাঁচ সাত ঘণ্টা লেগে যায় বারদি যেতে। সেখান থেকে গয়না নৌকায় সে বাড়ি যায়। বাবা সঙ্গে থাকেন। গেল পূজায় সে একাই গেছে। গাঁয়ের লোকজন বারদির ঘাটে কেউ না কেউ থাকে। ছোটকাকাও চলে আসেন তাকে নিতে।
বাড়ি গেলেই এক কথা কাকিমার, ও সেজদি দ্যাখ এসে, অরু আমাদের কত বড় হয়ে গেছে! সেদিনকার ছেলে, দেখলে চেনাই যায় না। এক একটা বছর যায় আর সে লম্বা পা ফেলে যেন দৌড়ায়। তিথিরও হয়েছে তাই।
পূজার ছুটিতে বাড়ি যাবার সময় তিথিই তার সব গোছগাছ করে দেয়। জামা—প্যান্ট কেচে সব ধোপা বাড়ি দিয়ে আসে। তার বইপত্র গুছিয়ে দেয়। এবং স্টিমারঘাটেও যাওয়া চাই তার। হাতে টিনের স্যুটকেসটি তিথি কিছুতেই কাউকে দেয় না। স্টিমারে উঠে আসে বাবার সঙ্গে। তারপর স্টিমার ঘাট থেকে ছেড়ে দিলে মঠের চাতালে দাঁড়িয়ে যতক্ষণ স্টিমার দেখা যায়—দাঁড়িয়ে থাকে।
অকারণে ঝগড়ারও শেষ নেই।
ব্যাটবল খেলার জন্য স্টাম্প বানাচ্ছে সে। মেজদা শহর থেকে ব্যাট কিনে এনেছে। একটি টেনিস বলও। তার উপর স্টাম্প বানাবার দায়িত্ব পড়েছে। সে জঙ্গলে ঢুকে জারুলগাছে উঠে গেছে ডাল কাটছে। তিথির তখন নিচ থেকে হাজার রকমের প্রশ্ন।
গাছে উঠেছ কেন? নামো। পড়ে হাত—পা ভাঙলে কে দেখবে।
শোন তিথি সবতাতে মাতব্বরি করবি না। ভাগ এখান থেকে।
ডাল কাটছ কেন বলবে তো!
আমার ইচ্ছে, কাটব।
না কাটতে পারবে না।
তোর গাছ?
হ্যাঁ আমার গাছ। নামো বলছি। উনি অবেলায় বাবুদের কথায় গাছে উঠে গেছেন!
ডালে কোপ দিতেই তিথির চেঁচামেচি শুরু।
অ হরমোহনদাদু, দ্যাখো এসে অরুদা গাছের ডাল কাটছে।
আর তখনই হরমোহনদাদুর তড়পানি শুরু হয়ে যায়। গাছের নীচে এসে তাড়া—নামেন গাছ থেকে। কে অবলায় আপনাকে গাছে তুলে দিয়েছে। পড়ে—টরে হাত—পা ভাঙলে কী হবে?
গ্রীষ্মের ছুটি, পুজোর ছুটি, বড়দিনের বন্ধে তিথির শুধু অপেক্ষা বাবুদের আত্মীয়স্বজনরা কে কবে আসবে। কেউ আসার কথা থাকলেই সে দৌড়ে সবার সঙ্গে স্টিমারঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মালপত্র নামানো হয়। তিথি দেখেশুনে সব মালপত্র নামায়। ছোট তরফের বউদিমণি এলে ত কথাই নেই। সে বউদিমণির ব্যাগ—এটাচি হাতে নিয়ে বাড়ি চলে আসে।
বউদিমণি এলে সে কিছু পায়।
যেমন সেবারে তাকে একটা গন্ধ সাবান দিতেই কি খুশি! নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুঁকছে। তার ঘরে ছুটে এসে বলেছে, ছোট তরফের বউদিমণি দিল। একবার মেলা থেকে পেতলের মাকড়ি কিনে দিয়েছিল বাবার বউঠান—কী খুশি তিথি। বাড়ি বাড়ি সে কানে মাকড়ি পরে ঘুরেছে।
কে দিল রে?
গিন্নিমা দিয়েছে। গিন্নিমা বলল, তিথি, মেয়েদের কান খালি থাকলে ভালো দেখায় না। পেতলের মাকড়ি জোড়া দিলাম। সব সময় পরে থাকবি। কান খালি রাখলে বাড়ির অমঙ্গল হয়।
তিথি ভালো ফ্রক গায়ে দিলে, স্নো পাউডার মাখলে সবার এক প্রশ্ন—কে দিল?
অকপটে তিথি সব বলে দিত, কে কখন ডেকে তাকে কী কী দিয়েছে।
তিথির সঙ্গে তার যে দু—একবার হাতাহাতি হয়েছে, তাও আজ কেন যে মনে পড়ল!
সেই যে বছর সে এখানে চলে আসে, বোধ হয়, সেবারেই হবে। তখনও সবার সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি হয়নি। তিথির মামা, তার সমবয়সিই হবে, চরণের সঙ্গে ডাংগুলি খেলার জন্য গাছের ডাল খুঁজে বেড়াচ্ছিল। পেয়ারা গাছের সোজা ডাল হলে ভালো হয়। পেয়ারা গাছের ডাল ওজনেও ভারী। উৎকৃষ্ট ডাং পেয়ারা গাছের ডাল থেকেই তৈরি করা যায়। ডাল কাটার দা নিয়ে বাগানে ঘোরাঘুরি করতেই সহসা তিথি উদয় গাছতলায়। চেঁচাচ্ছে—ও বৃন্দাবনদা, পেয়ারা গাছের ডাল কাটবে অরুদা। গাছের নীচে ঘুর ঘুর করছে।
মারব এক থাপ্পড়। আমি ডাল কাটব, তোকে কে বলেছে?
ডাল না কাটলে দা নিয়ে পেয়ারাতলায় কেন?
তোদের গাছ?
হা আমাদের গাছ।
বৃন্দাবনদা চেঁচাচ্ছে, অরুদাদা ও গাছের ডাল কাটবে না। কানে উঠলে বড়কর্তা রাগ হজম করতে পারবেন না।
অবশ্য গাছটা যে খুব দামি সে জানত। কাশীর পেয়ারা—এক একটা পেয়ারা পোয়াটেক ওজনের। বড়কর্তা গাছটা কাশী থেকে আনিয়েছিলেন কি না সে জানে না, তবে গাছটার প্রতি বড়কর্তার তীক্ষ্ন নজর থাকে সে জানে। সে গোপনে ডাল কাটবে ভেবে গাছের নিচে ঘুর ঘুর করছিল। মেয়েটার স্বভাব এত মন্দ, ঠিক খেয়াল রেখেছে। নিজের হলেও কথা ছিল।
সে বলেছিল, অমলদা বলেছে কাটতে।
কে অমলদা?
যেন তিথি বাড়ির ছোটবাবুকে চেনেই না।
ডাকব, অমলদাকে। তুই বাড়ির ছোটবাবুকে চিনিস না। তাদের এঁটো খেয়ে তুই মানুষ।
আমি কাউকে চিনি না। সোজা কথা বলে দিলাম, ডাল কাটবে না। কাটলে বিপত্তি হবে।
অমলদাও ছুটে এসেছিল।
কি হয়েছে রে অরু?
ডাল কাটতে দেবে না।
সহসা তেড়ে গেল তিথিকে, তুই কে রে? যা ভাগ।
তিথি কি সে মেয়ে! সে ছুটে এসে তার হাত থেকে প্রায় জোরাজুরি করেই দাটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করল। এবং এতেই লেগে গেল ধুন্ধুমার কাণ্ড। সে কিছুতেই ডাল কাটতে দেবে না। সে হাতের দা ছাড়বে না। সহসা তিথি তাকে জাপটে ধরে দা কেড়ে দৌড়। সে কিংবা অমল কেউ তার নাগালই পেল না।
পরে দেখা হলে বলেছিল, এমন সুন্দর গাছটায় ডাল কেউ কাটে! মায়া হয় না!
কত কথাই যে মনে হচ্ছিল অরণির।
অরু তারপর ক্রমশ আরোগ্যলাভ করতে থাকলে একদিন তিথিই তাকে ধরে ধরে নদীর পাড়ে নিয়ে গেল। স্কুলেও সে ক্রমে যেতে পারছে। এবং এভাবে নদীর ঘাটে এক সময় অষ্টমী স্নানের পরবও শুরু হয়ে গেল।
বর্ষায় নদীর দু—পাড় এমনিতেই দেখা যায় না। কত সব একমাল্লা, দোমাল্লা নৌকায় পুণ্যার্থীরা চলে আসছে। পানসি নাও দেখা গেল। নদীর উত্তরের চরের দিকটায় ললিত সাধুর আশ্রম, সেখানেও হাজার হাজার পুণ্যার্থীর ভিড়। সড়ক ধরে ক্রোশখানেক হেঁটে গেলে সেই মঠ মন্দির—সেখানেও পুণ্যার্থীরা জড়ো হয়েছে। সারা নদী জুড়ে বজরা, পানসি। আনারস, তালের নৌকারও বিশাল বিশাল বহর। নদীর পাড়ে বাবুদের সব প্রাসাদের পর প্রাসাদ, সেই সব প্রাসাদেও দূর দেশ থেকে এসেছে আত্মীয়স্বজনরা। নদীতে ডুব দিয়ে কুরুক্ষেত্র গয়াগঙ্গা বলবে বলে এসেছে।
তিথিও বসে নেই। সকাল থেকে সে ছোটপিসির সঙ্গে ফুল দুর্বা তুলেছে। তিল তুলসী কাঠের বারকোশে সাজিয়ে রেখেছে, সঙ্গে হরীতকী। বাবুদের মেয়ে বউরা ঘাটে ডুব দিতে যাবে। হরমোহনদাদুও বসে নেই। মাথায় ফেট্টি বেঁধে কাঁধে বাঁশের লাঠি ফেলে সবার আগে আগে যাচ্ছে।
তিথি অরণির দরজায় এসে ডাকল, কী হল? বসে থাকলে কেন! ঘাটে ডুব দিতে যাবে না। সবাই যাচ্ছে। এ—দিনে নদীর জলে ডুব দিলে কাশীবাসের পুণ্য হয় জানো!
অরণি চারপাশে খাতা বই মেলে বসে আছে। ওর এসবে খুব একটা বিশ্বাস নেই। তাছাড়া একগাদা টাস্ক বাকি। দ্বিজপদ সার টাস্ক দিয়ে গেছেন রাতে। সে বই—এর ভেতর ডুবে থেকেই বলল, তোরা যা, আমি পরে ডুব দিয়ে আসব।
পরে ডুব দিলে হবে! সময় পার হয়ে যাবে না। তুমি কিছুই জানো না। পড়া তো তোমার সারাজীবনই থাকবে—কিন্তু এই পুণ্যস্নান, এত গ্রহ সমাবেশ আবার কবে হবে কেউ জানে! সব বছর অষ্টমী স্নান হয়। মহাঅষ্টমী স্নান কালে ভদ্রে হয়।
আসলে তিথি ভেতর বাড়িতে যা শোনে তাই এসে উগলে দেয়।
অগত্যা, তাকে যেতেই হল। ডুবও দিতে হল। কুরুক্ষেত্র গয়াগঙ্গাও বলতে হল।
তিথি আজ শাড়ি পরেছে। তিথিকে এত লম্বা লাগছিল দেখতে যে সে অবাক না হয়ে পারেনি। ফেরার পথে এক ফাঁকে সে তার কাছে এসে অতি সতর্কভাবে বলছিল, মন্দিরে যাব। আমাকে তুলিদি সঙ্গে নেবে বলেছে। তুলিদির সঙ্গে যাব না। বলেছি, ছোট তরফের বউদিমণির সঙ্গে যাব। বউদিমণি খবর পাঠিয়েছে। তুমি কিন্তু রেডি থেকো।
তারপরই আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বলেছিল, মনে আছে?
কী মনে আছে, কী জানতে চাইছে, অরণি বুঝতে পারছে না।
তিথি মনে করিয়ে দিল, তোমার অসুখের সময় মন্দিরে মানত করেছি। বাতাসা মিসরি কিনতে হবে। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে কালভৈরবীর মন্দিরে যাব।
তিথি ঠিক দুপুরেই চুপি চুপি তার ঘরে হাজির। তাড়াতাড়ি রওনা না হলে মন্দির দর্শন করে বাড়ি ফেরা যাবে না। তিথির জন্য বাতাসা মিসরি কিনতে হবে, অরু সেজন্য বাবার কাছ থেকে টাকা নেবার সময় বলল, তিথি যে কি না, আমার জন্য মন্দিরে মানত করেছে। ও পয়সা পাবে কোথায়। থলে থেকে তোমার টাকা নিয়েছি।
জগদীশ আজ নাজিরখানায় যাননি। সকাল থেকেই তাঁর কাজের শেষ ছিল না। বাবুরা সবাই ঘাটে ডুব দিতে যাবেন। নতুন কাপড় গামছা সে ঘরে ঘরে হরমোহনকে দিয়ে পৌঁছে দিয়েছে। বউঠানের জন্য লালপেড়ে, নলিনীর জন্য সাদা থান, তুলির জন্য লম্বা নতুন ফ্রক, বউমাদের জন্য তাঁদের শাড়ি—ডুব দিয়ে বাড়ি ফিরে সবাই আজ নতুন জামা—কাপড় পরবে। ধর্মাচরণের কোনও ব্যাঘাত না ঘটে সেই নিয়েও তাঁর ভাবনা কম ছিল না। অরণিকে নিয়ে তিথি মন্দিরে যাবে, মানত থাকলে না গিয়েও উপায় নেই, অরণি টাকা নেবার সময় এজন্য তিনি না বলে পারলেন না—বেশি করে নাও। মেলায় গেলে কেনাকাটা করতে হয়। তিথি কিছু নিতে চাইলে কিনে দিয়ো। ওর তো দেখার কেউ নেই।
তিথিকে সঙ্গে নিয়ে যেতে অরণির আর কোনও সংকোচ থাকল না।
নদীর পাড়ে গিজ গিজ করছে লোক। চাদর টাঙিয়ে অস্থায়ী তাঁবু তৈরি হয়েছে। স্টিমারঘাটের বিশ্রামাগারে মানুষজন গিজ গিজ করছে। রাস্তার দু—দিকেই জিলিপির দোকান, বিন্নি খই বস্তা খুলে বিক্রি হচ্ছে। লাল বাতাসা, আর কোথাও রসগোল্লা, বুঁদে, যে যা পারছে নদীতে ডুব দিয়ে এসে শালপাতায় খাচ্ছে।
তিথির কোনও দিকেই যেন খেয়াল নেই।
সে হেঁটে যাচ্ছে। ভিড় দেখলেই সরে দাঁড়াচ্ছে। হেমন্তবাবুর প্রাসাদ পার হয়ে, সেই বড় মাঠ, মাঠেও তাঁবু পড়েছে। কোথাও আয়না, চিরুনি, তাবিজের মালা, মণিহারি দোকানে সুগন্ধ তেল, সাবান, কী নেই! যেন সারা দেশ থেকে যে যা পেরেছে, সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
তিথির কোনও দিকেই খেয়াল নেই।
ক্রোশখানেক পথ হাঁটতে হবে। এদিকটায় বেশ ফাঁকা। তারপর বাজার। তার বাবা গোরাচাঁদ মেলায় জিলিপির দোকান দিয়েছে, সে ওদিকটায় কিছুতেই গেল না। যেন সে তার বাবাকে এড়িয়ে কোনওরকমে এখন মন্দিরে পৌঁছতে চায়। হাতে কাঁসার ঘটি, তাতে নদীর জল—মন্দির সংলগ্ন মাঠে মিসরি, বাতাসার দোকান—অরু বলল, মিসরি বাতাসা কিনতে হবে তো!
তিথির গায়ে ভারী সুঘ্রাণ। শাড়ির আঁচল বিছিয়ে বলল, কী সুন্দর না, কত কারুকাজ করা রেশমি সুতোয়। বাতাসা মিসরির ঠোঙা শাড়ির আঁচল মেলে তুলে নিল। এক হাতে কাঁসার ঘটি আর আঁচলে বাতাসা মিসরির ঠোঙা। সে ভিড় ঠেলে অরণির হাত ধরে মন্দিরে ঢুকে গেল। তারপর সোজা লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। অরণি কিছুই বলতে পারছে না। জায়গাটা মানুষজনের যাওয়া—আসায় জল—কাদায় মাখামাখি।
তিথি সবই করছে, যেমন ফুল বেলপাতা তার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে, শিবের মাথায় জল ঢালতে বলছে। এক মন্দির থেকে আর এক মন্দিরে লাফিয়ে লাফিয়ে ঢুকছে, ভোগের মিসরি বাতাসা কলাপাতায় রেখে দিচ্ছে। তিথি প্রণাম করে উঠে তার দিকে তাকিয়ে আছে, অরণি আর কী করে, সেও হাঁটু গেড়ে প্রণাম করছে।
ফেরার সময়ই অরণি না বলে পারল না, কিরে, তোর সেই দোকান দেখছি না! দু—হাত ভরে কাচের চুড়ি পরবি বললি, তুই কেমন হয়ে যাচ্ছিস। গোবর্ধন দাসের দোকান কোথায়?
তিথি হাসল। তুমি আমাকে কিনে দেবে?
কোথায় দোকান।
তিথি বলল, থাক।
না থাকবে না। কোথায় দোকান বল!
অরণি মেলায় সেই দোকান কোথায় খুঁজে বেড়াতে থাকল। তিথির লজ্জা হয়েছে। তিথির এই আচরণে সে কিছুটা বেকুফ। চারপাশে এত জিলিপির দোকান মিষ্টির দোকান, সে কিছুই যেন দেখছে না।
অরণি এবার নিজেই বলল, আয়। জিলিপি খাই। গরম গরম জিলিপি আমার খেতে বেশ লাগে।
তুমি খাও, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
তোকে কেউ কিছু বলেছে?
কী বলবে!
আমার সঙ্গে আসায়?
না। কেউ কিছু বলেনি। বললেই শুনব কেন! তুলিদি ডেকে পাঠিয়েছিল, মেলায় আমার সঙ্গে যাবে। আমি তো সব বুঝি অরুদা। তোমার সঙ্গে মেলায় ঘুরি তুলিদির পছন্দ না। আমিও বলে দিয়েছি, না, যেতে পারব না। ছোট তরফের বউদিমণি ডেকে পাঠিয়েছে।
তারপরই মেলায় মন্দিরের সামনে টেনে নিয়ে গেল তাকে।
একটা কথা বলব!
বল।
তুমি মন্দিরে দাঁড়িয়ে বলবে, তুলিদিকে কখনও স্বপ্নে দেখনি!
অরু বলল, কেন তুলি তোকে কিছু বলেছে?
তুলিদি যে বলল, তুমি তাকে প্রায়ই স্বপ্নে দ্যাখো।
মিছে কথা।
মন্দিরে ঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে বলো, মিথ্যে কথা।
সে ভেতরে ঢুকে দেবতার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, মিথ্যে কথা। তুলিকে আমি কখনোই স্বপ্নে দেখিনি।
তিথি কী খুশি!
সে তার নিজের মধ্যে ফিরে এসেছে। অরুর হাত ধরে হাঁটছে। এতক্ষণ চারপাশে কী ছিল, কারা ছিল সে কিছুই খেয়াল করেনি। কাচের চুড়ির কথাও মনে ছিল না। অরুদা, তুলিদিকে স্বপ্নে দেখে এই তাড়নাতেই সে কাহিল ছিল। দেবতার সামনে কেউ মিছে কথা বলে না। অরুদা দেবতার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছে, তুলিদিকে কখনোই স্বপ্নে দেখেনি। স্বপ্নে না দেখলে ভালোবাসাও হয় না। সে কিছুতেই এতক্ষণ নিজের কথাটা বলতে পারছিল না—তাকে অরুদা স্বপ্নে দ্যাখে কি না।
অরণি বানিয়ে বলল, জানিস সেদিন রাতে তোকে স্বপ্নে দেখলাম। তুমি আমি মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। গরম জিলিপি ভাজা খাচ্ছি। তারপর নদীর চরে নেমে গেলি, জলে মাটির প্রদীপ ভাসালি।
আর তিথিকে পায় কে? মন্দিরে না নিয়ে এলে সে কিছুই জানতে পারত না। তার যে কত কাজ এখন। পুণ্যার্থীরা নদীর পাড়ে জড়ো হয়ে ডুব দিয়েছে। যে যার মতো ব্রত উদযাপন করছে। কেউ অঘোর চতুর্দশী ব্রতের জন্য ধুতুরা ফুলের মালা গলায় পরে পুরোহিতের সামনে বসে গেছে। কেউ মৌনি স্নান করছে—ভূত চতুর্দশী ব্রত, সাবিত্রী চতুর্দশী—যার যেমন মানত। নদীর বুকে যতদূর চোখ যায় শুধু নৌকা আর নৌকা, কোনওটায় ছই দেওয়া, গয়না নৌকাও আছে। পানসি বজরা—যেদিকে চোখ যায়, শুধু মানুষের সমারোহ। জলে প্রদীপ ভাসাচ্ছে কেউ। তিথি তার অরুদার কল্যাণ কামনায় জলে প্রদীপ ভাসিয়ে তীরে দাঁড়িয়ে থাকল। স্রোতের মুখে প্রদীপ ঘুরে ঘুরে কতদূর নিমেষে চলে যাচ্ছে।
মন্দিরতলায় সাধু সন্নেসিদের ভিড়। মাঠের দিকটায় নাগরদোলা, হাড়ি পাতিলের দোকান, জাদুকরের তাঁবু, কোথাও আবার হরিসংকীর্তন, খোল করতালের সঙ্গে জায়গাটায় যেন মাটি ফুঁড়ে ধ্বনি উঠছে। অরু হাত ধরে তিথির কেন জানি মনে হচ্ছিল আশ্চর্য এক করুণাধারায় সে ভেসে যাচ্ছে। সে মোহিত হয়ে গেছে সব দেখে। কিছুতেই তার নড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না।
এই তিথি! দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? গোবর্ধন দাসের দোকানে যাবি না!
যে সম্বিত ফিরে পেল সে। তার তো আর কিছুই দরকার নেই। সে তো সবই পেয়ে গেছে। চুড়ি পরে আর কী হবে! তবু অরুদার কথা সে ফেলতে পারল না। গোবর্ধন দাসের দোকান আস্তাবলের কাছে। সে সেখানে ছুটে যেতে চাইলেই সহসা কে যেন বলল, এই তুই তিথি না!
সে থমকে দাঁড়াল। লোকটাকে সে কোথায় যেন দেখেছে! আবার মনে হল লোকটাকে সে যেন চেনে। গলায় কণ্ঠি, মাথায় ছাঁটা চুল, ধুতি পরনে, ফতুয়া গায়। কপালে তিলক কাটা—লোকটা রাস্তা আগলে আছে। সামনে তাকে কিছুতেই এগোতে দিচ্ছে না।
কী রে জবাব নেই কেন। তুই তিথি না! গোরাচাঁদের আগের পক্ষের মেয়ে না তুই!
তিথি বলল, হ্যাঁ, কেন!
তোকে কত ছোট দেখেছি। তুই কবে এতবড় হয়ে গেছি—তোর বাপের দোকানে গেলাম। বলল, দেখুনগে হয় বাড়িতে আছে, নয় মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। বললাম, তোর তো এঁটো খাওয়ার অভ্যাস! অভ্যাসটা আছে, না গেছে।
অরুর ভীষণ রাগ হচ্ছিল। একজন আগন্তুক যদি গায়ে পড়ে তিথিকে অপমান করতে চায়, সে ছাড়বে কেন।
অরণি বলল, কে বলেছে ও এঁটো খায়! আপনি কে!
আরে আমি জানি না ভাবছ। বাবুদের আমি তোলা আদায় করতাম। তোমার বাবা আমাকে চেনে। তিথির বাবাকে পালমশাই খবর পাঠিয়েছেন। ঐ যে দেখছ, দূরে, ঠিক বরাবর দেখ, দেখছ না, নদীর বুকে বজরা নৌকা একখানা, ওখানে কর্তামশাই তার পরিবার নিয়ে আছেন। মহাঅষ্টমী স্নান বলে কথা। আমাকেই পাঠাল, আমি তো খুঁজে বেড়াচ্ছি, পাই কোথা। এখানে এসে গোরাচাঁদের কথা মনে পড়ে গেল। আয় মা, তুই যে অন্নপূর্ণা, কে না জানে! চল আমার কর্তামশাইকে দর্শন দিয়ে আসবি।
লোকটা কি পাগল! অরণির এমনই মনে হল। কিন্তু লোকটা যে বলল, সে তার বাবাকে চেনে! তিথির বাবাকেও চেনে। লোকটাকে চটাতেও পারে না! সে কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে জানতে পারলে বাবা খুবই দুঃখ পান।
কী করে আর অরু! শুধু বলল, রাস্তা ছাড়ুন আমরা যাব।
কোথায় যাবে? তুমিও সঙ্গে চল না। কর্তামশাই তোমাকে দেখলে খুশিই হবেন। তোমার বাবা বন্দরে গেলে, মহাজনের সঙ্গে একবার দেখা না করে আসেন না। বাবুরাও চেনে। কত বড় মানুষ, বড় মনকষ্টে ভুগছেন।
অরণি ফিক করে হেসে দিল। লোকটার কাতর অনুনয় তাকে ভারী কৌতূহলের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কে মহাজন, সে নামই শোনেনি। অথচ লোকটা যেভাবে কথা বলছে, তাতে কর্তামশাইটি যে খুবই ধনাঢ্য ব্যক্তি বুঝতে অসুবিধা হয় না। বজরায় চেপে পুণ্যস্নানে এসেছেন। তার দাসী বাঁদি চাকর—বাকরের মধ্যে বোধ হয় এই লোকটিও পড়ে। বজরার পাশে আলাদা নৌকায় তারা আছে। অরু খুব গম্ভীর গলায় বলল, ঠিক আছে পরে যাবে। ওর বাবাকে না বলে যায় কী করে?
তখনই তিথি কেমন লোকটার শরীরে দুর্গন্ধ পেল। লোকটার হাবভাব একদম ভালো না। মেলায় দুষ্টু লোকের অভাব থাকে না। সে অরুর দিকে তাকিয়ে বলল, শিগগির চলে এসো অরুদা। বলেই ছুটতে থাকল। দ্রুত এবং যত সত্বর সম্ভব লোকটার নাগাল থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য যেন ছুটছে।
অরণিও ছুটতে থাকল। তিথি কি ভয় পেয়ে গেছে! ঝাউতলার কাছে গিয়ে দেখল তিথি দাঁড়িয়ে পড়েছে। হাঁপাচ্ছে। চোখ মুখে ভীষণ উত্তেজনা। এত হাঁপাচ্ছে যে কথা বলতে পারছিল না। প্রচণ্ড ঘামাচ্ছে।
অরণিও দম নিতে পারছিল না। মন্দিরতলা থেকে এই ঝাউতলার দূরত্ব কম না। তিথি কখনও নৌকায় লাফিয়ে পড়েছে—এক নৌকা থেকে আর এক নৌকায়। সোজা রাস্তায় ভিড়ের জন্য হাঁটা যাচ্ছে না। তিথি পালাবার জন্য নৌকাগুলির উপর দিয়ে ছুটছিল। কোনও নৌকা কাত হয়ে যাচ্ছে, কোনও নৌকা টলে উঠছে, নৌকার আরোহীরাও তাকে তেড়ে গেছে—কি দস্যি মেয়েরে বাবা! কার মেয়ে? মেলায় এসে সাপের পাঁচ পা দেখেছে।
কিন্তু তাকে কিছু বলার আগেই তিথি আর এক নৌকায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে, চরের কাছে রাস্তায় এত ভিড় নেই। সে ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে যখন উঠছিল, সব নৌকা থেকেই মানুষজন চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে।
কার মেয়ে?
কোথায় থাকে?
পরীর মতো জলে উড়ে বেড়ায়। মা—বাবাই বা কেমন।
কেউ বলল, কচি খুকিটিও নও। লজ্জাশরম খেয়ে বসে আছো। পায়ের শাড়ি তুলে নৌকা থেকে নৌকায় লাফিয়ে ছুটে যাচ্ছ!
তিথি কিছুই গ্রাহ্য করছিল না। সে ঘাটের সিঁড়ি ধরে আবার জনারণ্যে মিশে গেছে। লোকটা তাকে খুঁজে পেলেই যেন তার মরণ।
অরুকেও সবাই দেখেছে, মেয়েটার পিছু পিছু নৌকা থেকে আর এক নৌকায় লাফিয়ে পড়ছে।
এই তিথি, কী হল তোর?
শিগগির চলে এসো।
কেন!
বলছি, চলে এসো! কেন, পরে বলব।
এখন তারা দুজনেই মজা খালের সাঁকোর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপর বিশাল বিলাতি গাবের গাছ। তার ঘন ছায়ায় ঠান্ডা হয়ে আছে জায়গাটা। মানুষজনের চলাচল কম।
দুজনই এতক্ষণ হাঁপাচ্ছিল। দুজনেই এবারে যেন কিছুটা ধাতস্থ। তিথি বলল, লোকটা ভালো না অরুদা। মহেশ পাল বাজারে তোলা আদায় করত। এতক্ষণ সব মনে পড়ছে। লোকটা ছ্যাঁচড়া স্বভাবের। বাবুরা তাড়িয়ে দিয়েছিল। আবার কেন এখানে উদয় কিছুই বুঝছি না।
অরু বলল, তোর বাবাকে সত্যি চেনে?
চিনবে না কেন? বাবাকে বাজারে কিছুতেই বসতে দেবে না। আমাদের বাড়ি পর্যন্ত আসত। বাবার তো জানো তখন মাথা খারাপ। ঠাঁই নেই কোথাও। বাজারের ফাঁকা জায়গায় ফুলুরি ভেজে পয়সা হত, লোকটার হম্বিতম্বিতে বাবা খুবই ঘাবড়ে গেল। পরে দেখেছি, আমাদের বাড়িতেও আসত। বাবা না থাকলে…
তিথি চুপ করে গেল। যেন বোবা হয়ে গেছে।
ঠিক আছে চল। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না।
যেন কোনও গত জন্মের পাপের বোঝা বয়ে তিথি হাঁটছে। তার বোধহয় পা চলছিল না। লোকটা তার শরীর কচলাত। বাবা বুঝত কি বুঝত না সে জানে না, সেও কিছু বলত না, লোকটা বাড়ি উদয় হলেই আতঙ্কে সে পালাবার চেষ্টা করত।
তারপর তার আর কিছু মনে পড়ছে না। তার বয়সই বা কত তখন। মহেশ পাল যে ছ্যাঁচড়া স্বভাবের বাবুদের কানেও কথাটা উঠে গেল। ভুঁইঞা কাকা না থাকলে কি যে হত! লোকটাকে ডেকে বললেন, ‘মহেশ অনেক হয়েছে। তোমার অনাচারে বাবুদের ইজ্জত যেতে বসেছে। কাল থেকে যেন সকালে উঠে আর তোমার মুখ দেখি না। তিথি তোমার হাত কামড়ে দিয়েছে কেন—তুমি এত বড় অমানুষ!’
তারপর থেকেই লোকটা হাওয়া।
তিথির সবই মনে পড়ল। লোকটা যে তার আবার পেছনে লেগেছে, সেও টের পেল। ভাবতে গিয়ে চোখমুখ এত কাতর হয়ে পড়ছে যে সে আর একটা কথা বলতে পারছে না। ভয়ে বুক থেকে কান্না উঠে আসছে।
তখন সাঁজ লেগে গেছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে নদীর পাড়ে। অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে গ্রামগুলি—শুধু মঠের দিকটায় কিংবা নদীতে লণ্ঠন জ্বলছে—দোকানে দোকানে হ্যাজাক, ডেলাইট। এবং দূরে সেই বজরায় বোধ হয় হ্যাজাকের আলো জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। ওটা গোপীবল্লভ মহাজনের বজরা—চাউর হয়ে গেছে সারা মেলায়। কারণ যারা পুণ্যস্নান করে নদীর পাড়ে খড়কুটো জ্বেলে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করছে, তারাই বলাবলি করছিল—তীর্থ মাহাত্ম্যের কথা। মহাজনের মতো জাঁদরেল মানুষও বিধাতার কোপের শিকার হতে চায় না। অষ্টমী স্নানে নদীতে ডুব দিতে এসেছে।
তিথি হাঁটছিল ঠিক, তবে তার মধ্যে কোনও বিসর্জনের বাজনা বাজছে বুঝতে কষ্ট হয় না। কাছারিবাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যাবারও তার ক্ষমতা নেই। অন্ধকার গাছপালার ছায়ায় তিথি কেমন নিস্তেজ গলায় ডাকল, অরুদা।
কী হল, এত পেছনে পড়ে থাকলি কেন?
তিথি নড়ছে না।
অরু কাছে গিয়ে বলল, শরীর খারাপ?
তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরো।
অরুর খুবই সংকোচ হচ্ছিল, রাস্তার উপর যে জড়িয়ে ধরা যায় না কিছুতেই তিথি বুঝছে না। কে কখন দেখে ফেলবে, বাড়ি ফেরার এই রাস্তাটা যতই নির্জন হোক, বাবা নাজিরখানা থেকে এখন ফিরে আসতে পারেন। বৃন্দাবনদা, হরমোহনদা, কিংবা অন্য কেউ, কত লোকই এই রাস্তায় হেঁটে যায়, সে কিছুতেই তিথি বললেও তাকে জড়িয়ে ধরতে পারে না।
সুপারিবাগানের ভেতর ঢুকে গেলে কিছুটা আড়াল মিলতে পারে। বাগানের শেষ দিকটায় মুলিবাঁশের ঘর তিথিদের। দাওয়ায় কুপি জ্বলছে দূর থেকেও বোঝা যায়। তিথির ভাইবোনদের কোলাহলও টের পাওয়া যাবে কিছুটা ভেতরে ঢুকে গেল। বোধ হয় এভাবে পাগলের মতো ছোটা তিথির উচিত হয়নি। খুবই কাহিল হয়ে পড়তে পারে।
সে বলল, চল তোকে বাড়ি দিয়ে আসি। তুই এভাবে না ছুটলেই পারতিস।
তিথি সহসা ক্ষিপ্ত হয়ে গেল।
কেন আমি ছুটেছি, তুমি জানো?
লোকটাকে তোর এত ভয় কেন বুঝি না।
বুঝবে না। আমি মরে গেলেও বুঝবে না কিছু, কেন তিথি মরে গেল।
আবার পাগলামি শুরু করলি।
লোকটা বাবাকে টোপ দিচ্ছে। লোকটার কাছে, বাবার কাছে আমি এখন টোপ ছাড়া কিছু না। নিজেকেই ঘেন্না হচ্ছে। আচ্ছা অরুদা আমার শরীরে কী আছে বলো তো, আমি কেন টোপ হয়ে ঝুলব। শরীর জ্বালিয়ে দিলে তোমাদের সবার শিক্ষা হবে।
তিথির মধ্যে আবার আগেকার সেই তিথি হাজির। তাকে জড়িয়ে না ধরায় সে অপমানিত বোধ করছে। সমবয়সি এই মেয়েটিকে সে ঠিক যেন বুঝতে পারছে না। তিথিকে কেন টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হবে! কীসের টোপ। কে সেই শিকারি, যে টোপ নাকের ডগায় ঝুলিয়ে ফেলে দেবে। কবে থেকেই যেন তিথি এটা অনুমান করতে পেরে তাকে নিয়ে বারবার উধাও হবার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না, অরুর এতে বিন্দুমাত্র সায় নেই বলে। তিথির যা সাজে, তার তা সাজে না।
অরু তো ইচ্ছে করলেই তিথিকে নিয়ে দেশান্তরী হতে পারে না। সে এখানে পড়তে এসেছে। স্কুলের মাস্টারমশাইরা তার ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল এমনও ভাবে। বাবুদের বাড়ির সবাই তাকে খুব ভালো এবং বিনয়ী বলে জানে। বাবার সে খুবই অনুগত। সে ইচ্ছে করলেই তিথির মতো পাগল হয়ে যেতে পারে না।
সে নিজেকে সামলে নিচ্ছিল।
তিথি তাকে জড়িয়ে ধরেছে। তিথি কিছু চায়। কী চায় সে—যে বোঝে না তাও না। কিন্তু সে তো মনে করে এতে তিথি খাটো হয়ে যাবে। সেও খাটো হয়ে যাবে। এই সব আশঙ্কাতেই সে তিথিকে জড়িয়ে ধরতে সাহস পাচ্ছে না।
সুপারির বাগান বলে যথেষ্ট আড়াল রয়েছে। জ্যোৎস্না রাতেও কিছুটা ম্রিয়মাণ অন্ধকার এবং নদী থেকে হাওয়া উঠে আসছে। সুপারি গাছগুলো হেলছে দুলছে। নীচে সবুজ ঘাস। তাকে জড়িয়ে তিথি ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছিল।
আর এ—সময়ে তিথি বড়ই বিহ্বল গলায় বলছে, অরুদা আমি আর পারছি না। কেমন নিস্তেজ গলার স্বর, এবং কিছুটা গোঙানির মতো শোনাচ্ছে। তুমি আমার সব দেখেছ। আমার আর কিছু গোপন করার নেই। আমার সব ভেসে যাচ্ছে অরুদা।
আবার সেই স্খলিত গলার স্বর—আমি ডুবে যাচ্ছি। তুমি আমাকে জড়িয়ে না ধরলে বাঁচব না।
আর অরু কেমন এক আশ্চর্য গন্ধ পেল তিথির শরীরে। ভেসে গেলে কিংবা ডুবে গেলে মেয়েদের শরীরে এসময় এক আশ্চর্য গন্ধে ভরে যায় বোধ হয়।
প্রথমে মনে হল, পদ্মপাতার গন্ধ।
তারপর মনে হল নদীর জলের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা শ্যাওলার গন্ধ এবং শেষে কেন যে মনে হল নদীর জলে মাছের ঝাঁক ভেসে গেলে যে গন্ধ ওঠে, কেমন এক আঁশটে গন্ধ তিথির শরীরে।
নারী রহস্যে পরিপূর্ণ হয়ে গেলে মেয়েদের শরীরে এমনই বুঝি ঘ্রাণ পাওয়া যায়। এবার তিথিকে আলিঙ্গনে অবারিত মুগ্ধতায় নিয়ে যেতে চাইল অরু। তিথির হুঁশ নেই। তারও না। স্বপ্নের মতো এক অস্পষ্ট ইচ্ছার জগতে তারা ভ্রাম্যমাণ। কেন যে মনে হচ্ছিল অরুর, যে—কোনও সময় তাঁর হাত থেকে পিছলে যেতে পারে তিথি। নদীর জলে পড়ে গেলে তিথি সত্যি কোনওদিন মীন হয়ে তার অপেক্ষায় নদীতে ঘুরে বেড়াতে পারে।
নদীর জলে ডুবে গেলে তাকে আর সে কিছুতেই খুঁজে পাবে না।
যখন উভয়ের হুঁশ ফিরে এল, অরণি কেমন লজ্জায় পড়ে গেল। তিথিকে অস্পষ্ট ছায়ার মতো দেখাচ্ছিল। সে তার শাড়ি সায়া ব্লাউজ বুকে জড়িয়ে রেখেছে। এবং বারবার বলছে, তুমি যাও অরুদা, তুমি কিচ্ছু জানো না। তুমি বোকা আছো।
অরু কিছুটা হতভম্বের মতো দাঁড়িয়েছিল। সত্যি সে কিছু জানে না।
তুমি যাও না অরুদা! কে আবার দেখে ফেলবে। এবং এও বুঝতে পারছে, তিথি খুব দ্রুত সায়া গলিয়ে দিচ্ছে। তারপর শাড়ি পেচিয়ে এক দৌড়। তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। সুপারিবাগানের ভেতর দিয়ে তিথিদের বারান্দায় যে কুপিটা জ্বলছিল, দপ দপ করে তাও নিভে গেল।
অরণি বুঝে পেল না, স্বপ্নের জগতে তিথিকে সে মীন হয়ে জলে ভেসে যেতে কেন যে দেখল!
জলের গভীরে তিথি ডুব দিচ্ছে, ভেসে উঠছে, আবার ডুবে যাচ্ছে। ঠিক ভরা গাঙে যেন একটা শুশুক মাছ। স্তন্যপায়ী মাছের ডুবে যাওয়া ভেসে ওঠা সে কতদিন নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তিথির সঙ্গে সে দেখেছে। তিথির যে কী হত, শুশুক মাছ দেখলেই জলে লাফিয়ে পড়তে চাইত। মাঝ নদীতে কিংবা কিনারে সে শুশুক মাছ ভেসে যেতে দেখলেই কেন যে বলত, অরুদা তোমার ইচ্ছে হয় না, পাখির মতো আমরা কোথাও উড়ে যাই, মাছের মতো আমরা কোথাও ভেসে যাই।
তারপরই কেন যে মনে হল, সে তিথির শরীরে আবিষ্ট হয়ে ডুবে যেতে পারেনি। আসলে জড়িয়ে ধরার উষ্ণতাই তাকে এত কাবু করে দিয়েছিল যে, সে বেশিদূর এগোতে পারেনি, কিংবা সাহস পায়নি, কিংবা স্তন অথবা শরীরের সঙ্গে তার শরীর মিশেই যায়নি, তার আগেই সে বুঝি হেরে গেছে, অথচ ভ্রাম্যমাণ কোনও শুশুক মাছের মতো জলের তলায় কেন যে মনে হয়েছিল তার, দীর্ঘক্ষণ সে বিচরণ করেছে। তার করুণ অবস্থা দেখে তিথি বোধ হয় শেষ পর্যন্ত ক্ষেপেই গিয়েছিল—তুমি যাও অরুদা, তুমি যাও না। সে কাপুরুষের মতো কাজটা করে ফেলে বড় অসহায় বোধ করছে।
অথবা কোনও ঘোর থেকে সে যদি এসব দেখে ফেলে। দেখতেই পারে।
তিথিকে নিয়ে ঘুরে বেড়ালে তিথির শরীর তার মধ্যে নানা মোহ তৈরি করে দেয়। তিথি আজ শাড়ি পরায় সেই মোহ অতীব অনন্ত হয়ে বিরাজ করেছে তার মধ্যে। সারা দুপুর বিকেল অষ্টমীর মেলায় তিথির চঞ্চল স্বভাব তাকে যে তাড়া করেছে, সে তাও বোঝে। তিথিকে নিয়ে সে ফিরছিল, এবং এই নির্জন জায়গায় তিথিকে নিয়ে ঢুকে গেছে। ঢুকে গেছে না, ঘোরে পড়ে গিয়ে তিথির সর্বস্ব লুটে নেবার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল, কী যে হয়েছিল, সে কিছুই আর ঠিকঠাক মনে করতে পারছে না।
সে যখন কিছুই করতে পারছিল না, কারণ সে তো জানে না, কীভাবে শরীরে শরীর বিভোর হয়ে থাকে—তার অপটুত্ব নিশ্চয়ই তিথিকে পীড়া দিচ্ছিল। তিথি তাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে হা হা করে বুঝি হেসেও উঠেছিল। তারপর দৌড়াতে পারে। কিংবা তিথি দাঁড়িয়ে আছে, সায়া শাড়ি বুকে জাপ্টে তাকে যে দেখছিল, সেটাও যে কোনও ঘোর থেকে দেখে ফেলেনি তার নিশ্চয়তা কি!
তারপরই মনে হল সে তার জামাপ্যান্টে হাত দিয়ে দেখতে পারে। রাতে স্বপ্নে কতবার প্যান্ট নোংরা করে ফেলেছে, চুপি চুপি উঠে গিয়ে প্যান্ট পালটেছে, দু—একবার বাবার কাছে সে ধরাও পড়েছে, বাবার এক কথা, বাইরে যাবি? যা। আমি জেগে আছি, ভয়ের কিছু নেই।
বাবা কি জানেন, এ—বয়সেই সবার এটা হয়। এবং সেই ভেবেই বাবা তাকে অভয় দিয়ে গেছেন। রাতে ওঠার অভ্যাস সবারই কমবেশি থাকে, বাবা কি ভেবে অভয় দিতেন তার কোনও স্পষ্ট ধারণা তার নেই। বাইরে বের হলে অন্ধকার মাঠ কিংবা বনজঙ্গলের এক ভূতুড়ে অবয়বের মধ্যে পড়ে যাবার সম্ভাবনাও থাকে—সেই ভেবে যদি বাবা অভয় দেন। সে টর্চ জ্বেলে বের হয় ঠিক, এবং ধোওয়া প্যান্ট হাতে আলগা করে তুলে নেয়। তারপর বাইরে বের হয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়া প্যান্ট খুলে খুব সতর্কভাবে জংঘা এবং আশ্চর্য সব নীলাভ বনরাজিনীলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে জল ঢেলে সব সাফ করে নিলে পবিত্রতা সৃষ্টি হয়। তারপর ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়লে সহজেই ঘুমিয়ে যেতে পারে। আর যদি তা না হয়, সারা রাত তার অস্বস্তিতে ঘুম হয় না।
ঘোর যদি হয়।
সে তার প্যান্টের উপর প্রথমে হাত রাখল। না কিছুই ভিজে যায়নি। কিংবা পিচ্ছিল হয়ে নেই তার জংঘাদেশও। তবে তার এটা কী হল! কী দেখল! কিছুই হয়নি তার! অথচ কেন যে দেখল তিথিকে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ শুশুক মাছ হয়ে গেছে জলের নিচে। কেন যে দেখল, তিথি সায়া শাড়ি বুকে জাপ্টে উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জ্যোৎস্না রাত, নদীর ঢেউ, জলে অজস্র নৌকায় লম্ফের আলো, বাঁশবনে পাখির কলরব এবং স্টিমারঘাটের গ্যাসের বাতি তাকে কেমন কুহকে ফেলে দিয়েছে। অথবা তিথিও তাকে কুহকে ফেলে দিতে পারে। সে কিছুটা অন্যমনস্কভাবে তিথির খোঁজে বাড়িটায় গিয়ে দেখলে হয় সে বাড়িতে আছে, না মেলায় এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সারাটা দিন সে যে তিথিকে নিয়ে মেলায় ঘুরেছে, তার কেন যে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিংবা সুপারিবাগানে ঢুকে সে তিথিকে নিয়ে মজে গিয়েছিল, তাও ভাবতে তার কষ্ট হচ্ছে। খুবই একা এবং নিঃসঙ্গ সে। মনে মনে সে তিথিকে নিয়ে কত কিছু ভাবে—তিথির জন্য এই আকুলতাই তার এই ঘোরে পড়ে যাওয়ার মূলে। তিথিকে টোপ হিসাবে কে ব্যবহার করতে চায়—যদি চায়ই, তিথি ইচ্ছে করেই তাকে আজ টোপ দিল কেন, কিংবা তিথির অন্তরালে কোনও দৈব যদি তাকে তাড়া করে থাকে। কোনও দৈব যে ছলনা করেনি কে বলবে! তিথি সেজে যদি হাজির হয়, সাধ্য কি সে তাকে অবহেলা করে।
নানারকমের সংশয়ে সে ভুগছিল এবং কখন কাছারিবাড়ি ফিরে ঘরের জানালায় চুপচাপ বসে আছে, টেরই পায়নি।
জানালায় কেউ যেন তখনই উঁকি দিয়ে গেল।
কে?
সে ঠিক দেখতে পাচ্ছে না। ফ্রক গায় মেয়েটা তিথি না তুলি তাও বুঝতে পারছে না। সে কিছুটা বোকার মতো দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে গেল। না কেউ না। তারপর ফের কাছারিঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে জানালায় বসলে সে দেখল এবারে শাড়ি পরা কোনও নারী তার দিকে এগিয়ে আসছে।
সে আর পারল না।
সে চিৎকার করে ডাকল, কে ওখানটায়। কদম গাছের নিচে কে দাঁড়িয়ে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে সেই নারী অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
অরণি ভালো করে চোখ কচলে দেখল, না কাউকে আর দেখা যাচ্ছে না। অরণির ভয় ভয় করছে। একবার ছুটে পড়ার ঘরে চলে গেলে হত। বাবার ফিরতে রাত হবে। অষ্টমী স্নানে বাবার একদণ্ড ফুরসত থাকে না। জমিদারবাবুদের সঙ্গে মেলায় ভলান্টিয়ার থেকে জলছত্রের সব ব্যবস্থাই তাকে দেখতে হয়। চিঁড়ে গুড় বাতাসার ব্যবস্থা করতে হয়। বেশি রাত হয়নি। স্টেশন মাস্টারের ঘরে বসে বাবা যদি পাশাখেলায় মত্ত হয়ে পড়েন—তবে ফিরতে অনেক রাত হবে। বাবা কোথায়, সে তাও জানে না। তবে বাবা আজ নাজিরখানায় যাননি, সারাদিন তাঁবুতে বসে ছিলেন—তারপর কোথায় সে জানে না। পাইক—বরকন্দাজদের কারও পাত্তা নেই। বাবুদের ছেলেরা হয় যাত্রা দেখতে গেছে। আজ যে ‘তরণী বধ’ পালা হবে তাও সে জানে। আট আনা অংশের জমিদার অম্বিকাবাবুর নাটমন্দিরে যাত্রাপালা দেখার জন্য বাড়ির ভেতরও কেউ থাকবে বলে মনে হয় না। স্কুল ছুটি, পড়া থেকে ছুটি, সামনে তার টেস্ট পরীক্ষা, অথচ সারাটা দিন তিথিকে নিয়ে ঘুরছে, কেবল মনে হচ্ছে, তিথি না, অন্য কেউ। কোনও দৈব তার সঙ্গে সারাদিন ছলনা করে গেছে। তিথি হয়তো তার সঙ্গে যায়ইনি।
সে বড়ই বিভ্রমে পড়ে যাচ্ছে।
কদম গাছের ছায়া কিংবা কলাতলায় কেউ যদি ফের আসে। আর আশ্চর্য তখনই মনে হল, ঘরে কে তবে হারিকেন জ্বালিয়ে রাখল! তিথি মেলায়, তার সঙ্গেই তো তিথি ফিরছে। তিথিই ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে রাখে—কখন তার ঘরে ঢুকে গেল মেয়েটা।
এতসব বিভ্রমে পড়েই সে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে এল। এদিকটায় এত নিরিবিলি যে একদণ্ড দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভয় করছে। কে কখন তার সামনে ফ্রক কিংবা শাড়ি পরে হাজির হবে ঠিক কি। আসলে মাথাটাই কেমন গণ্ডগোল শুরু করে দিল।
আসলে সে সকাল থেকেই নিজের মধ্যে নেই। সে কুহকে পড়ে গেছে সকাল থেকেই।
তবু নিজের উপর চরম আস্থা বজায় রেখে সে কোনওরকমে কেয়াফুল গাছের নিচে ছুটে গেল। পড়ার ঘরে অন্ধকার। কারও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। ভেতর বাড়ির দিকের রাস্তায় ঢুকে বুঝল গোটা এলাকাটাই রহস্যময় হয়ে গেছে। কেবল বৈঠকখানায় একটি অতি মৃদু সেজবাতি জ্বলছে। সেখানে বাবার হুজুর নবকুমারবাবু বদরি হুঁকোয় চোখ বুজে তামাক সেবন করছেন। পাশে আরও একজন।
তিনি কে?
তাঁকে সে কখনও দেখেনি।
বয়স্ক মানুষ। গোঁফ আছে। পাকা গোঁফ। গলায় কণ্ঠি। ঘরে মৃদু সৌরভ তামাকের। লোকটার মুখ ধোঁয়ায় কিছুটা আচ্ছন্ন। তবে খুবই ধনাঢ্য ব্যক্তি বোঝাই যায়। পায়ে পাম্প সু। মোজা। সিল্কের পাঞ্জাবি গায়। হাতের আঙুলে হীরের আংটি—কারণ এই নিষ্প্রভ সেজবাতির আলোতে আঙুলের আংটি থেকে হীরের দ্যুতি উঠছে। কোনও কূট গভীর পরামর্শে তাঁরা দুজনেই যে মগ্ন ছিল, অরুর বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
তখনই স্তিমিত গম্ভীর গলা—কে দরজায় দাঁড়িয়ে।
অরু অর্থাৎ অরণি সঙ্গে সঙ্গে সরে দাঁড়াল। সে কোনও জবাব দিল না।
এ—সময় এদিকটায় বোধহয় তার আসা উচিত হয়নি। কারণ এতবড় প্রাসাদতুল্য বাড়িতে কোথায় কে আছে বোঝাও দায়। তুলির ঘর বন্ধ। রোয়াক থেকে সে উঠোনে নেমে যাবার সময়ই মনে হল বীণাপিসির দরজা হাট করে খোলা। ঘরের ভেতর হ্যাজাক বাতি জ্বলছে।
আর অবাক, সে দেখল, জেঠিমা—বীণাপিসি এবং আরও দু—একজন অপরিচিত মহিলা ফরাসের ওপর বসে আছেন। পানের বাটা থেকে পান তুলে মুখে দিচ্ছেন কেউ। বেশ হাসিমশকরা যে চলছে তাও বোঝা যায়। রান্নাবাড়ির দিকে সরে যাওয়ায়, তাকে কেউ দেখছে না।
তুলি কোথায়?
তা যাত্রাপালা দেখতে যেতে পারে।
প্রাসাদের সুন্দর বউমাটিও নেই। কিংবা থাকতে পারে, ভেতরের দিকে থাকতে পারে। সে তো ঘরের সবটা দেখতে পাচ্ছে না। বিশাল জানালাগুলি প্রায় দরজা সমান। খড়খড়ির পাল্লা। জানালা বন্ধ। খড়খড়ি তোলা আছে বলে, বাইরে আলো এসে পড়ছে।
কিছুটা যেন এই বাড়িতে গোপন গম্ভীর অবস্থা, যে—কেউ ইচ্ছে করলেই এদিকটায় ঢুকতে পারে না। বৃন্দাবনদাকেও দেখা যাচ্ছে না। রান্নাবাড়িতেও কেউ নেই। আজ রাতের খাওয়া কি হবে তাও সে বুঝতে পারছে না। শুধু দাওয়ায় হারিকেন জ্বলছে একটা।
সে পাঁচিলের দিকে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। কেন যে আছে, কীসের এক রহস্য যেন তাকে তাড়া করছে। ‘টোপ’ কথাটা তার ভালো লাগেনি। কার টোপ, কীসের টোপ, পাঁচিল সংলগ্ন অন্দরের দরজায়, তার আড়ালে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে থাকা যায়, এমন ভাববার সময়ই সে দেখল, সুপারিবাগানের ভেতর থেকে একটা আলো এসে তার পায়ের কাছে পড়ছে। সে চোখ তুলতেই টের পেল, বাগানের ভেতর দিয়ে কেউ হারিকেন হাতে এগিয়ে আসছে।
এ—জায়গাটাও নিরাপদ নয়। আসলে কি সে তিথিকে খুঁজতে এদিকটায় চলে এসেছে!
তিথি রান্নাবাড়িতেই পড়ে থাকে। যদি তিথির দেখা পাওয়া যায়। দেখা হলে সে তার মনের সংশয় খুলে বলতে পারত।
তিথি তুই কি দৈব তাড়িত?
তিথি তুই সত্যি সারাদিন আমার সঙ্গে মেলায় ছিলি?
তিথি তুই নৌকা থেকে আর এক নৌকায় লাফিয়ে পড়লি, মিসরি বাতাসা মন্দিরে দিলি, কিন্তু আমার যে কী হয়েছে, কেন যে মনে হচ্ছে সবই অলীক ঘটনা। কোনও ঘোরে পড়ে গেছি। তুই সত্যি করে বল তো…
কী বলব?
সত্যি করে বল তোর সঙ্গে আমার কিছু হয়েছে কি না!
কী হবে?
বারে তুই যে বললি, তুমি কী অরুদা, আমার কিছুই খুঁজে পাচ্ছ না।
তুমি আমার কী খুঁজছিলে?
আমি মুখ ফুটে বলতে পারব না। আমি কী খুঁজছিলাম, তুই জানিস না?
কী করে জানব, না বললে!
তারপরই অরণি ঘাবড়ে গেল।
কার সঙ্গে কথা বলছে! এ তো বাগানের ভেতর দিয়ে হারিকেন হাতে বৃন্দাবনদা পাঁচিলের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। কেমন একটা গোপন শলাপরামর্শ চলছে। কে কথা বলল, কার গলার স্বর? তিথির মতো অবিকল নকল করে কে কথা বলল!
সে দরজায় আড়াল থেকে পা টিপে টিপে কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখল, বৃন্দাবনদা হারিকেন রোয়াকে রেখে করজোড়ে প্রণিপাত সারছে। তারপর যা বলল, তাতে অরণির হৃৎকম্প উপস্থিত হবার জোগাড়।
ধরে এনেছে হুজুর। সাজানো হচ্ছে। কোথায় যে থাকে। একটু চঞ্চল স্বভাবের। সাজিয়ে দিচ্ছে বউমা। গোরাচাঁদ আমাকে পাঠাল। দোষ নেবেন না। ছেলেমানুষ, বুদ্ধিসুদ্ধি পরিপক্ব নয়।
অরণি আড়াল থেকেই টের পেল এই যে আর্জি পেশ সবই ধনাঢ্য ব্যক্তিটিকে উদ্দেশ্য করে।
নবকুমারবাবু বললেন, তা ঠিক, ঐ সেদিন হল মেয়েটা। থাকার জায়গা নেই, বাগানের এক কোণায় ঘর তুলে নিতে বললাম। এখন পালমশাই আপনার দয়ার শরীর। কন্যেটিকে উদ্ধার করে নিলে, গোরাচাঁদের বড়ই কল্যাণ হয়।
বৃন্দাবনদাই বললেন, যা হোক শেষ পর্যন্ত হুজুর রাজি করানো গেছে। গোরাচাঁদ তো হুজুর কেঁদেই ফেলল। এতবড় সুযোগ হাতের কাছে, তুই অবহেলায় নষ্ট করবি। আমাদের পাকাবাড়ি হবে, বাজারে মুদির দোকান করে দেবে, সংসারে এতবড় সুখের খবর, তুই রাজি হয়ে যা।
নবকুমারবাবু গড়গড়া থেকে মুখ তুলে বললেন, মেয়েটি বড়ই শান্ত প্রকৃতির। বয়সকালে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী হবার সম্ভাবনা আছে। গোরাচাঁদের মেয়েটিকে আপনার যখন দেখার সাধ হয়েছে তখন দেখে যাওয়াই ভালো। মেয়েটি সাক্ষাৎ দেবী দুর্গা।
অরণি দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছে, শুনতেও পাচ্ছে সব। নদীর পাড়ে বাড়ি বলে নির্জনতা সামান্য বেশিমাত্রায়, সে কান খাড়া করে শুনছে।
অস্পষ্ট আলোতে লোকটার মুখ মাঝে মাঝে কেন যে বাঘের মতো হয়ে যাচ্ছে। অথবা শিকার ধরার লোভে চোখ চক চক করছে। হাই তুলছে, কথাও বলছে, আজ্ঞে বাবুমশাই, মহেশই বছরখানেক আগে খবরটা দিয়েছে, বাড়ছে, দেবী দুর্গার শরীর পুষ্ট হচ্ছে। সেই খবর রাখত, কখনও নদীর জলে সাঁতার কাটছে, কখনও ছুটছে নদীর চর পার হয়ে, চুল উড়ছে। সে যা দেখত, বন্দরের ঘাটে নেমে গদিতে হুবহু বর্ণনা দিত। শুনতে শুনতে কেমন আমার আবেগ সৃষ্টি হয়ে গেল। দুই পত্নীর পরামর্শ নিতে হয়। পুত্রসন্তান না থাকলে মরেও যে শান্তি পাবে না তারা। তারা রাজি হয়ে গেল। বাড়িঘরের সৌন্দর্য রক্ষার্থেই মহাঅষ্টমী স্নানে আসা—একবার দেখেও যাওয়া। এমনকি পাখনাওয়ালা কন্যা যে ফুরুত করে হাত থেকে উড়ে যাবে।
অরণি বুঝল, আসলে লোকটা টাকার গরমে সেদ্ধ হচ্ছে। তিথির মতো অনাথ বালিকার পক্ষে উড়ে যাওয়া যে কিছুতেই সম্ভব না, ‘ফুরুত করে উড়ে যাবে’ কথাটাতে সে আরও বেশি টের পেল।
অরণি এখন যে কী করে!
তার অবশ্য করবারও কিছু নেই।
সে রেগেমেগে নদীর পাড়ে গিয়ে শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। অথবা দৌড়ে গিয়ে সে তার বাবাকে খবর দিতে পারে। মহেশ তিথিকে কচলাত, বাবা খবরটা শোনার পরই ডেকে পাঠিয়েছিলেন এবং দেশ ছাড়া করেছিলেন।
বাবা খবর পেলে ছুটে চলে আসতে পারেন, গোরাকাকাকে ধমকও দিতে পারেন, তুই কি পাগল হয়ে গেছিস! এতটুকুন মেয়েটাকে টাকার লোভে একটা পিচাশের হাতে তুলে দিচ্ছিস! টাকার পিচাশ! টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না। বয়সের গাছ পাথর নেই, তুই কী রে! দু—দিন বাদে যমের দুয়ারে দৌড়বে, তোর এতটুকু কাণ্ডজ্ঞান নেই গোরা!
আর তখনই কেন যে নদীর পাড়ে চিৎ হয়ে তিথির পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা অরণির চোখে ভেসে উঠল। মেয়েটার সেই অসহায় মুখ এবং ক্ষোভ দুই—ই তাকে যেন তাড়া করছে।—কেন আমার সব দেখে ফেললে, কেন! সব দেখে ফেলার পরও উষ্ণতায় জড়িয়ে ধরার সময় কিছুই খুঁজে পাও না কেন? বলো! বলো!
তিথি তুই কোথায়! আমি তোকে দেখতে পাচ্ছি না। তোর কথা শুনতে পাচ্ছি। সে তার চারপাশে তিথিকে খুঁজছে। কেউ নেই। চারপাশে শুধু ম্রিয়মাণ জ্যোৎস্না।
এখন তার একটাই কাজ, বাবাকে দৌড়ে গিয়ে খবরটা দেওয়া।
অরণির মনে হল বাবাকে গিয়ে খবরটা দিতে পারলে তিনি ছুটে আসতে পারেন।—আবার মহেশের কবজায় পড়ে গেল মেয়েটা! তুই কী রে, ধম্ম অধম্ম নেই! কচি মেয়েটার পেছনে সেই থেকে লেগে আছিস। অনাথ বলে কি ফ্যালনা! যার যা খুশি তাকে নিয়ে যেভাবে খুশি ফুর্তি করবে। বের করছি ফুর্তি করা। বাবা এলেই মহেশের জারিজুরি যেন ভেস্তে যাবে।
সে এই ভেবে প্রাসাদের অন্দরমহল পাড় হয়ে দিঘির পার ধরে ছুটবে ভাবল। সেই সব পেয়ারা গাছ, লিচু গাছের বাগান পার হয়ে নদীর পাড়ে চলে যাবে ভাবল—এক্ষুনি খবরটা না দিতে পারলে তিথির সমূহ সর্বনাশ।
সে তখনই দেখল তিথিদের বাড়ি থেকে কারা বের হয়ে আসছে। জঙ্গলের মধ্যে সে ঝুপ করে বসে পড়ল। শুধু জঙ্গলের ফাঁকে মাথাটা বের করে রেখেছে।
আগে গোরাকাকা—হাতে প্যাট্রোম্যাক্স।
আলোয় আলোয় ভরে গেছে তিথিদের বাড়িঘর—সুপারিবাগান।
এই কী দেখছে!
ঐ তো বাবা।
বাবা তিথিকে যেন জোর করে ধরে নিয়ে আসছেন। প্যাট্রোম্যাক্সের আলোয় দেবীর মুখ ঝলমল করছে। বেনারসি শাড়ি পরনে, তিথির হাতে বালা, কঙ্কন, কোমরে সোনার বিছেহার, তিথির শাড়ির কুঁচিতে সোনার ঝলমলে লেসের কারুকাজ, মাথায় টায়রা, চোখ বিস্ফারিত, তিথি যেন হাঁটতে পারছে না, শাড়ি আর অলঙ্কারের ভারে জবুথবু হয়ে গেছে। যেন যে—কোনও মুহূর্তে শাড়ির প্যাঁচে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে।
আর তার পাশেই তুলি। বোধহয় পড়ে গেলে তুলে ধরবে। তুলির শরীরে ভর করে তিথি যেন কোনওরকমে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই বুড়ো লোকটার কাছে যাবে, কিংবা নদীতে বজরা ভেসে আছে, সেখানে তুলে নিয়ে যেতে পারে—কী যে হবে, সে কিছুই জানে না।
তিথি জমিদারবাবুদের এঁটো খেয়ে বড় হয়েছে, তার পক্ষে বেশি আশাও করা বোধ হয় ঠিক না, তাকে যেভাবে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে তিথির বলারও কিছু থাকতে পারে না। তাকে একবার দেখবেন সেই গোপীবল্লভ না কি যেন, শীর্ষ পালও হতে পারে—তার মাথা ঠিক নেই, সে ঠিক মনে করতে পারে না। মহেশ নৌকায় তুলে নিতে চেয়েছিল তিথিকে, বড়ই মহাজন ব্যক্তি মানুষটি বজরায় শুয়ে আছেন, আরাম করছেন, তিথিকে নিয়ে যেতে পারলে তিনি দেখে খুবই খুশি হবেন—এমন সব কথাবার্তা মেলাতে তিথিকে বোধ হয় বলেইছিল—তিথি লোকটাকে একদম পাত্তা দেয়নি। নৌকার পর নৌকা লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে গেছে। সে তো দেখতেই পাচ্ছে, তিথিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বাবুদের বৈঠকখানায়। অনাথ মেয়েটির এত হেনস্থা। কেউ টের পাচ্ছে না। বাবাও না। মহেশ কচলাত বলে, তাকে দেশান্তরী করতে চেয়েছিলেন, এখন এই কালভৈরবের হাত থেকে কে উদ্ধার করবে তাকে?
কেন তুমি?
কে?
বারে দেখতে পাচ্ছ না আমি তিথি। আমাকে নিয়ে যাচ্ছে, আমার দাসদাসীর অভাব থাকবে না জানো, সোনার অলঙ্কারে আমাকে মুড়ে দেওয়া হয়েছে, দেখতে পাচ্ছ না—পছন্দ হলেই বজরায় নিয়ে তোলা হবে।
তিথি তুই কোথা থেকে কথা বলছিস?
কেন এই যে দূরে, আমি যাচ্ছি, গাছপালা ভেদ করে আমাকে নিয়ে তোলা হচ্ছে বাবুদের বৈঠকখানায়, নদীর পাড়, কাশবন, জলের ঢেউ, চড়ায় পাখিদের ওড়াউড়ি থেকে আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, অন্ধকার প্রেতপুরীতে, তুমি অরুদা কিছুই বুঝতে পারছ না।
হঠাৎ কেউ ইচ্ছে করলেই তুলে নিয়ে যেতে পারে?
বারে আমার কর্তাটির যে ইচ্ছে হয়েছে, আমাকে চিবোবে।
তিথি আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আর বুঝতে হবেও না।
আমি তোকে নিয়ে কোথাও চলে যাব।
কোথায়?
যেখানে বলবি।
তবে গেলে না কেন? ঘোর উজানে তোমাকে নিয়ে সাঁতার কাটব বলে বের হলাম, নদীর জলে টেনে নামাতে চাইলাম, তুমি তো কিছুতেই রাজি হলে না। আমাকে ফেলে কতবার নদী থেকে উঠে এসেছ, মনে নেই। এখন যত কষ্টের কথা তোমার মনে পড়ছে। আমি মরে গেলে রক্ষা পাও তোমরা, আমি বুঝি না।
তিথি তুই চুপ করবি!
চুপ করব কেন? আমি তোমার খাই না পরি।
প্যাট্রোম্যাক্সের আলো, লোকজন, তিথি, বাবুদের অন্দরমহলে কখন ঢুকে গেছে! সে একাই দাঁড়িয়ে আছে ঝোপের আড়ালে। এতক্ষণ তিথির সঙ্গে কথাও বলেছে। সে আর তিথি, তিথি এত কাছ থেকে কথা বলে, অথচ সে তাকে দেখতে পায় না কেন? তিথি বলে, না সে নিজেই তিথির হয়ে কথা বলে।
এই প্রবাসে তিথি ছাড়া সেও যে বড় অনাথ।
ঝোপজঙ্গলে জোনাকি উড়ছে। ভাদ্রমাসের আকাশ—সব নক্ষত্র আকাশে যেন ফুটে আছে। নীল এবং সবুজের সমারোহে সে ডুবে যাচ্ছিল। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। কাছারিবাড়িতে ফিরে যাওয়া ছাড়া তার গত্যন্তর নেই। খুব গোপনে কাজটা হচ্ছে, তিথিকে দেখানো হচ্ছে, তিথির বাবা অকুল পাথারে পড়ে আছে—তিথিকে পালমশাই—এর হাতে তুলে দিতে পারলেই পাকাবাড়ি, বাজারে পাকা বন্দোবস্ত এমন সব সুযোগ কে হাতছাড়া করে!
সবার উপরই সে ক্ষুব্ধ।
বাবার উপরও।
কেউ মানুষ না।
তিথির দুঃখ কেউ বুঝল না।
ভাবতে ভাবতে কখন সে স্টিমারঘাটে চলে এসেছে। একা দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভয়ও করছে। নদীতে সারি সারি নৌকা। লণ্ঠন জ্বলছে। কোনও নৌকায় রান্না হচ্ছে। তিথি পাশে থাকলে তার কোনও ভয় থাকত না। সে ঠিক নৌকায় উঠে পড়তে পারত। এবং টালমাটাল নৌকায় তিথিকে নিয়ে ছোটাছুটি করতে পারত।
তার কিছুই ভালো লাগছে না।
আজ দিনটাই তার খারাপ।
সে কিছু করতেও পারে না। তবে তিথি এত সহজে ধরা দেবে, কেন যে তার বিশ্বাস হচ্ছে না।
এই ভেবেই মনে সাহস সঞ্চয় করে ফেলল অরণি। শরীরও আর দিচ্ছে না। সাহস সঞ্চয় হতেই টের পেল, সে খুবই ক্লান্ত। খিদেও পেয়েছে। রান্নাবাড়িতে খাওয়ার আজ কোনও বন্দোবস্ত হয়নি। কোথায় খাবে, কী খাবে, তাও সে জানে না। অষ্টমী স্নান উপলক্ষে উপবাসের নিয়ম যদি থাকে—তাই বা কী করে হবে, তা হলে সারাদিন না খেয়ে থাকা যে বড় কষ্টের।
এইসব সাত—পাঁচ ভাবতে ভাবতে, নদীর পাড় থেকে চালতে গাছের জঙ্গল পার হয়ে কাছারিবাড়ির মাঠে ঢুকে গেল। মাঠে কেউ নেই—দূরে বাবুদের প্রাসাদে ঢোকার মুখে হাসনুহানার জঙ্গলে কেউ হারিকেন নিয়ে ভেতর বাড়িতে ঢুকে যাচ্ছে।
সে কোনওরকমে শরীর টানতে টানতে কাছারিবাড়ির দরজায় উঠে গেল। ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল। আর অবাক মেঝেতে আসন পেতে কেউ তার ভাত ডাল তরকারি মাছ ঢাকা দিয়ে রেখে গেছে একটা বগি থালায়।
থালা তুলে তো সে আরও অবাক। দই মাছ মিষ্টি সহ কিছুটা পলান্ন এবং সাদা ভাত। পলান্নের সুবাসে তার জিভে জল এসে গেল।
ক্লান্ত অবসন্ন, তার কেমন চোখ বুজে আসছে। তার হাত মুখ ধোওয়া দরকার। বালতি ভর্তি জল রেখে গেছে কেউ। সে চোখে মুখে জলের ঝাপ্টা দিয়ে কেমন এক ঘোরের মধ্যে খেতে বসে গেল। এবং লণ্ঠন জ্বলছে সামনে। টিনের চালে গাছের ডাল নড়ানড়ি করছে বাতাসে।
খস খস শব্দ, এবং এই শব্দমালায় সে আগে বড়ই ভয় পেত, এখনও এইসব শব্দমালা উচ্ছ্বল না হয়ে উঠলেই তার কেমন সব মৃতবৎ মনে হয়। কেমন স্থবির মনে হয় চরাচর। সে একা এই কাছারিবাড়িতে থাকতে থাকতে খুবই অভ্যস্ত হয়ে ওঠায়, সে সহজেই দরজার বাইরে গিয়ে কীটপতঙ্গের আওয়াজ শুনতে ভালোবাসে। পাখির কলরব, নদীর জলে ছলাত ছলাত শব্দে তার কখনও মনেই হয় না সে কাছারিবাড়িতে একা আছে। আম জাম গাছের ছায়াও তার বড় অবলম্বন। রাতের অন্ধকারে দূরের মাঠে শেয়ালেরা ডেকে গেলেও সে ভাবে, সে আর একা নয়। সবাই আছে তার আশেপাশে। মানুষই শুধু মানুষের নির্ভর এটা তার তখন আর মনে হয় না।
সে খাচ্ছিল।
আর কেমন সুস্বাদু খাবার তার জিভে স্বাদের রহস্য সৃষ্টি করতে করতে, টিনে ডালপালার শব্দ শুনতে শুনতে আবার কেন যে মনে হচ্ছে তিথি কথা বলছে।
শুনছ?
কী শুনব?
বারে আগের জন্মে জানো আমি নদীতে ডুবে থাকতাম। ভেসে উঠতাম।
কেন ডুবে থাকতিস?
বারে আগের জন্মে আমি শুশুক মাছ ছিলাম। ভেসে উঠতাম।
যা, বাজে কথা।
তুমি কিছুই জানো না? ভরা কোটালে নদীর পাড়ে এলেই তারা আমায় ডাকে।
কে ডাকে?
বারে নদীর গর্ভে তারা যে উঠে আসে।
বাজে কথা।
তুমি আমার কিছুই বিশ্বাস করতে চাও না। কিছুই বিশ্বাস করতে চাও না। কিছুই তুমি আর আমার শরীরে খুঁজে পাও না। তুমি জানোই না কেন তুমি আমার শরীরে আঁশটে গন্ধ পাচ্ছিলে!
আঁশটে গন্ধ কোথায়? বাজে কথা? পদ্মপাতার গন্ধ পাচ্ছিলাম।
তুমি তো নিজের মধ্যে নেই অরুদা। কিছুই তুমি মনে করতে পারছ না। শরীরে আমার শ্যাওলার গন্ধ, তারপর পদ্মপাতার গন্ধ—শেষে আঁশটে গন্ধ। আমি তো ভেসে উঠেছিলাম, শ্যাওলার জঙ্গল ফুঁড়ে, পদ্মপাতার নিচে ডুব দিলাম। শরীরে পদ্মপাতার গন্ধ পেলে। আরও ভেসে উঠলে আঁশটে গন্ধ। তুমি কেমন ঘাবড়ে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলে—অথচ শরীরে কিছুই খুঁজে পেলে না। মাছের শরীরে মানুষ কী করে খুঁজে পাবে সব।
তা ঠিক। তুই মাছ হয়ে গেছিলি।
শুশুক মাছ। নদীর জলে ভেসে যেতে চাইলাম, নড়লে না, দাঁড়িয়ে থাকলে। আমি যে তোমাকে নদীর জলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। নদীতে ডুবে ডুবে আমরা শুশুক মাছ হয়ে গেলে কেউ আর আমাদের খুঁজেই পেত না। আমার সঙ্গে চলো না?
কোথায়?
কেন নদীতে?
কী হবে গিয়ে?
দুজনে মাছ হয়ে থাকব।
যা, তুই একটা পাগল।
আমি পাগল, না তুমি পাগল! জলের নীচে শুশুক মাছ হয়ে থাকলে কত সুবিধে বলো তো!
কীসের সুবিধে!
তুমি যাবে কি না বলো। কেউ টের পাবে না। বলেই তিথি তার শরীর থেকে সব সায়া শাড়ি সেমিজ খুলে ফেলতে থাকল, তারপর নদীর চরে ছুটতে থাকল।
সেও নেমে গেছে তিথির পিছু পিছু।
সব চরাচর একেবারে স্তব্ধ হয়ে আছে। নীল জল এবং জলরাশি খেলা করে বেড়াচ্ছে চারপাশে। ঢেউ উঠছে। তারা দুজনেই হেঁটে হেঁটে পার হয়ে গেল নদী।
তারপরই এক বিশাল বালির চর সামনে। কেমন এক অন্য গ্রহে তাকে নিয়ে তিথি উঠে এসেছে।
ঐ যে দেখছ?
তিথি তুই আমাকে কী দেখাচ্ছিস?
ঐ যে দেখছ, নদীর চড়ায় একটা স্টিমার আটকে আছে। ওটাই আশরাফ সারেঙের স্টিমার। কবে কোন কালে নদীর গর্ভে ডুবে গিয়ে বালির চড়ায় ভেসে উঠেছে।
তিথি তাকে কোথায় নিয়ে এল! কিছুই সে চিনতে পারছে না। কেমন তেপান্তরের মাঠে নেমে আসার মতো এবং সে যেদিকে তাকাচ্ছে, সর্বত্রই সে অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখতে পাচ্ছে। একটা বজরা দেখতে পেল। বজরটা বালির চড়ায় প্রায় সবটাই ডুবে আছে। জেগে আছে শুধু তার মাস্তুল আর গলুইর দিকটার একটা ঘর। এভাবে ভাঙা—জাহাজের কবরখানায় সে কী করে যে এসে হাজির হল বুঝতে পারছে না।
তিথিও পাশে নেই।
কোথায় গেল।
এক অতি অবধারিত লীলা দেখতে পেল তিথির। অথচ তিথি নেই।
তিথি তখনই উড়ে উড়ে হাজির।
অরুদা।
কোথায় থাকিস।
আমার সঙ্গে এসো। আশরাফ সারেঙের ঘরটা খুঁজে পেয়েছি। ঐ যে স্টিমারটা দেখছ, বালিতে ডুবে আছে, ঐ যে ডেক ছাদের ঘরটা দেখছ, ওখানটায় আশরাফ সারেঙ থাকতেন। ওর লুঙ্গি, ফতুয়া, দড়িতে ঝুলছে। একটা জানালাও আছে। চলো না, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন?
ওরা দু’জনই এখন উড়ে যেতে পারছে। শরীর এত হালকা হয় বাতাসে উড়ে গিয়ে এই প্রথম টের পেল অরণি। তিথি পাশে থাকায় এটা হয়েছে। তিথির শরীরে তো কিছুই নেই। সে হালকা হয়ে যেতেই পারে। কিন্তু তার শরীরে জামা এবং প্যান্ট—জামাপ্যান্টে হাওয়া এসে ঢুকলেই বিপদ। জামাপ্যান্ট হাওয়ায় পত পত করে ওড়ে অথবা জামার মধ্যে হাওয়া আটকে গিয়ে নৌকার পালের মতো ফুলে ওঠে—তখন সে অবশ্য অনায়াসে হালকা হয়ে গিয়ে দূরের নক্ষত্রও ছুঁয়ে আসতে পারে, তার শরীরে জামাপ্যান্ট থাকায় কোনও অসুবিধাই হচ্ছিল না।
তখনই বালির চরে জেগে থাকা একটা ডেক ছাদের ঘরে তিথি ঝুপ করে নেমে পড়ল।
এই অরুদা কোথায় যাচ্ছ আমাকে ফেলে—
সে যেন কত শত কোটি বছর আগেকার এক ছোট্ট গ্রহাণু—তার নিজস্ব কোনও বেগ আর গতি নেই—সে এক মহাশূন্যে অখণ্ড হয়ে আছে, তিথি ডেক ছাদে দাঁড়িয়ে। আশরাফ সারেঙের একটা ভাঙা সানকি হাতে সে অপেক্ষা করছে তার অরুদা যেখানেই যাক, তার কাছে আবার ফিরে আসবে।
তখনই তাকে কে যেন ঝাঁকাচ্ছে। ডাকছে, এই অরু ওঠ। খাবি না। কত রাত হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে পড়লি!
আমি খাইনি!
না খাওনি।
বাবা তিথি কোথায়?
ওকে মহাজন বজরায় তুলে নিয়ে গেছে।
আমি খাব না।
খাবি না কেন?
আমার একদম খেতে ইচ্ছে করছে না। এই তো কিছুক্ষণ আগে খেলাম। তারপর…
তারপর কী!
আমি আর কিছু জানি না।
মেলায় খেয়েছিস।
অরণি চুপ করে থাকল।
অরণি এই প্রথম তিথিকে স্বপ্নে দেখেছে। সত্যি দেখেছে। কিন্তু তিথিকে তার স্বপ্নের কথা আর কখনোই বলা হবে না। তিথিকে বজরায় তুলে নিয়ে গিয়েছে গোপীবল্লভ পাল। তিথি আর কখনোই নদীর গভীর জলায় শুশুক মাছ হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে না।
নয়
জগদীশ কিছুতেই অরণিকে ঘুম থেকে তুলতে পারলেন না।
হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলেন, হাত ছেড়ে দিলেই শুয়ে পড়ছে। ঘুম জড়ানো চোখে। তার এক কথা।
আমি খেয়েছি, এই তো খেয়ে শুলাম। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
অগত্যা জগদীশ আর কী করেন!
রান্নাবাড়িতে ঢুকে গেলেন। রাত কম হয়নি। অরণির জন্য সবাই বসে আছে। মহাজন গোপীবল্লভ তার বামুন ঠাকুর দিয়ে জমিদারবাবুর বাড়িতে পেল্লাই ভোজের ব্যবস্থা করেছেন। পাত পেতে কেউ কেউ খেয়ে গেছে। অরণি না খেলে বউঠান কিংবা বাবুরা খেতে পারছেন না, অগত্যা কী করা যায়, জগদীশ বউঠানকে বললেন, অরু খাবে না। ওর খিদে নেই বলছে।
নবকুমারবাবু বারান্দায় বের হয়ে আসছেন। বাড়ির আরও সবাই, লম্বা বারান্দায় কিংবা বিশাল রান্নাঘরে আসন পাতা। জলের গেলাস থালা দিয়ে ঢাকা। সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়ার রেয়াজ এই রান্নাবাড়িতে।
তুলিকেও তুলে আনা হয়েছে। সেও খাবে। কিছুটা বনভোজনের মতো ব্যবস্থা করেছিলেন গোপীবল্লভ পাল। তার লোকজন জঙ্গল সাফ করে নদীর পাড়ে রান্নার বন্দোবস্ত করেছিল। তার বামুন ঠাকুর অত্যন্ত নিয়ম নিষ্ঠা বজায় রেখে রান্না করেছে। বাবুরা নদীর পাড়ে যাবেন না, বাড়িতে সব পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা সুচারুভাবেই করা হয়েছে। কিন্তু অরণির জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল, সে এসে গেলেই খেতে বসা হবে, সেই অরুকেই কাছারিবাড়ি থেকে নিয়ে আসা গেল না।
বৃন্দাবন বলল, আমি একবার যাই।
জগদীশ বললেন, গিয়ে লাভ হবে না। ওতো বলছে, সে খেয়েছে।
তুলি বলল, কখন খেয়েছ?
তাতো জানি না।
বউঠান বললেন, ঘুমের ঘোরে বলছে, তুমি আর একবার যাও!
না বউঠান। ও ঘুমিয়ে পড়লে, তুলে খাওয়ানো খুবই ঝামেলা। একটা তো রাত। না খেলেও কিছু হবে না।
বউঠান সহজে ছাড়বার পাত্র নন।
ও কী খেল! রান্নাবাড়িতে ওকে কে খেতে দিল!
বড়দা বলল, আসলে, বাহানা। আমি গিয়ে দেখছি।
বড়দা মেজদা সবাই আসনে বসে গেছেন। তুলি, নবকুমারবাবু, বাড়ির কেউ বাদ নেই। জগদীশও বসে গেছেন—অরণি সারাদিন কোথায় ঘুরেছে মেলায় তিনি কিছুই জানেন না, মেলায় জলছত্র থেকে ভলান্টিয়ারদের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল তাঁর—সারাদিনে একবার অরণির সঙ্গে তাঁর দেখাও হয়নি, অবশ্য তাঁর টাকার থলে থেকে অরণি কিছু টাকা চেয়ে নিয়েছে, তিথিকে নিয়ে মেলায় যাবে, এমনও ভাবতে পারে অরণি, কাজেই মেলায় তারা যদিও মিঠাই মণ্ডা পেট ভরে খেয়ে থাকে, এমন সাত— পাঁচ ভাবনাই অরণিকে জোরজার করে তুলে খাওয়াবার বিষয়ে জগদীশকে কিছুটা নিস্পৃহ করে রাখতে পারে। তিনি মেজদার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে যেতে হবে না। খেয়ে নাও। কতক্ষণ তোমরা আর বসে থাকবে!
জগদীশ রান্নাবাড়ি থেকে ফেরার সময় টের পেলেন, আকাশ ভেঙে বজ্রপাত নেমে আসছে। সারা আকাশ জুড়ে বিদ্যুতের ঝলকায় ভেসে গেল চরাচর। ঝড় উঠবে। বৃষ্টিও নামতে পারে জোরে। সারাদিন যা গরম গেছে, ভ্যাপসা গরমে শরীরের সব রক্ত যেন ঘাম হয়ে বের হয়ে আসছিল—তিনি খুবই ক্লান্ত, নদী থেকে ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়ায় তার শরীর জুড়িয়ে গেল।
তিনি টের পেলেন আকাশ বড় গুরুগম্ভীর।
তিনি কিছুটা পা চালিয়ে হাঁটছেন আবার কিছুটা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছেন। আকাশ যেন খুবই নিচে নেমে এসেছে। এলোমেলো হাওয়ায় গাছের ডালপালা দুলছে। শীতল হাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে আরাম বোধ করছিলেন।
নদীর দিকে তাকালেন তিনি। সুপারিবাগান পার হয়ে নদী দেখাও কঠিন। মিশকালো অন্ধকারে সব ঢেকে গেছে। মনে হল হঠাৎ হাওয়া পড়ে গেল। চরাচর কেমন থম মেরে গেছে। নদীর পাড়ে তার কাছারিবাড়ি বলে ঝোড়ো হাওয়া উঠলে বেশ জোরেই এসে কাছারিবাড়িতে আছড়ে পড়ে। ঘরের দরজা জানালা সব ঠাস ঠাস করে বন্ধ হয়, খুলেও যায়। দরজা খোলা রেখে অবশ্য আসেননি। শেকল তুলে দিয়ে এসেছেন—কিন্তু জানালাগুলি সব খোলা। জোর বৃষ্টি হলে বিছানা সব ভিজে যায়।
তিথিও নেই যে সব নজর রাখবে। গোপীবল্লভ নদীতে রাত কাটিয়ে সকালে পাল তুলে দেবেন বজরার। মানুষজন তাঁর মেলা। বজরার সঙ্গে নৌকার বহর। কোনওটায় বামুনঠাকুর, কোনওটায় গদির সরকারমশাই—সবাই সপরিবারে হাজির কর্তার সঙ্গে। এমন পুণ্যস্নানের সুযোগ কেউ ছাড়তে রাজি হয়নি। ঝি—চাকরদের আলাদা নৌকা। বজরায় শুধু তার দুই স্ত্রী, তিথি উঠে যাওয়ায় অবশ্য তিনজন। তার দুই স্ত্রী সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে তিথিকে। শুভদিনে বিবাহ। দেশে রেখে যেতে কেউ রাজি হয়নি। মহাজনের ইচ্ছের উপর কারও কথা নেই। নবকুমারবাবু অবশ্য বলেছিলেন, কিছুদিন এখানে থেকে গেলেও অসুবিধা হবে না। আপনার যখন পছন্দ হয়েছে। দিনক্ষণও ঠিক—গোরাচাঁদের ভাঙা ঘরে না রাখেন, আমাদের বাড়িতেও তিথি থাকতে পারবে।
গোপীবল্লভ রাজি হননি।
অত্যন্ত সদাশয় মানুষটি কেবল বলেছিলেন, থাকতে পারে, তবে এটোকাঁটা খেয়ে না আবার আমার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করে। যা স্বভাব!
তখন সবাই একবাক্যে বিষয়টি নিয়ে মনস্থির করে ফেলে। গোঁরাচাদও রাজি। তার তো বাড়িতে পাকা দালানকোঠা হবার কথা। বাজারে মুদিখানাও খুলে দিতে পারেন। মহাজন মানুষটি কম কথা বলেন। তার পাকা গোঁফ এবং নাদুসনুদুস শরীরটি তেল মাখনে যে ডুবে আছে দেখলেই বোঝা যায়। তিথি তার সেবাযত্ন করতে পারবে, আসলে এখানে রেখে যেতে মন তাঁর সায় দেয়নি। বাবুরাও ও মহাজন ব্যক্তিটিকে খুশি রাখতে পারলে অসময়ে ধার কর্জ পেতে অসুবিধা হয় না। জমিদারির খাজনা সরকারের ঘরে জমা দেবার সময় বাবুদের মহাজনের গদিতে ছুটতেই হয়। শুধু যে গোপীবল্লভের পাটের ব্যবসা, তেজারতির কারবার নিয়ে এমন রমরমা অবস্থা তাও নয়। ইস্টিমার কোম্পানির তিনি একজন বড় অংশীদার। তিথির সৌভাগ্য এমন হবে জগদীশ স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। তিনি অন্ধকারে দাঁড়িয়েই মেয়েটার ভালো হোক বলে কপালে হাত ঠেকালেন।
তিথি না থাকায় কাছারিবাড়িটাই শুধু খালি হয়ে গেল না, জমিদারবাবুর প্রাসাদ, সুপারির বাগান, নদীর চর, দিঘির পাড়ের ঝোপজঙ্গল সবই খালি হয়ে গেল। নদীর জলে আর যখন তখন কেউ ঝাঁপিয়ে পড়বে না। কিংবা কোঁচড়ে খই—বাতাসা নিয়েও ইস্টিমার ঘাটে কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে না। তিথির কথা ভাবতে গিয়ে জগদীশ কেমন কাতর হয়ে পড়লেন।
তখনই ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
জগদীশ দৌড়ে ঘরের সিঁড়িতে উঠেই টের পেলেন, তীরবেগে ঝড় ছুটে আসছে। হাওয়ায় যেন তাকে উড়িয়ে নেবে।
তিনি দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা—জানালা বন্ধ করে দিতে থাকলেন। অরণি ঘুমুচ্ছে। মশারি না টাঙিয়েই শুয়ে পড়েছে। মশার কামড়ে ছেলেটা জেরবার, কোনোই হুঁশ নেই। চালে আমের বড় ডালের ঘসটানিতে ঘরটা কাঁপছে। তিনি হারিকেনের আলো উসকে দিলেন। বৃষ্টির ছাট এত তীব্র যে টিনের চালে বড় রকমের দাপাদাপি শুরু হয়ে গেছে। তারপরই মনে হল ডাল ভেঙে পড়ার শব্দ। আমগাছের অতিকায় ডালটি কেটে ফেলা উচিত ছিল, ঝড়বৃষ্টির সময়ই এ—কথাটা তিনি ভাবেন, কিন্তু কাটা আর হয় না। সেই ডালটি ভেঙে পড়ল কি না কে জানে! সামনের দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে দেখতে পারেন, কিন্তু দরজা খুলতে সাহস পাচ্ছেন না—বাড়িতেই এই অবস্থা, নদীতে না জানি কী হচ্ছে—ভাদ্র—আশ্বিনের এই সময়টায় নদী মাঝে মাঝে ক্ষেপে ওঠে—অসময়ে ভরা কোটালেরও আবির্ভাব হয়। দুর্যোগ শুরু হয়ে যায়। নদীর দু—পাড় জলে প্লাবিত হয়। নদীতে কেউ নৌকা রাখতে সাহস পায় না। ইস্টিমার মাঝনদীতে থাকলে কিনারে ভিড়িয়ে দেওয়া হয়। গেরাফি ফেলে, মোটা কাছিতে বেড় দিয়ে দেওয়া হয়।
মহাজনের বজরায় কী অবস্থা, কে জানে! তবে বজরার মাঝিরা হাওয়ায় গন্ধ শুঁকে টের পায় সব। তারা যথেষ্ট সাবধানী। মহাজনের বজরা আসিনুল মাঝির হেপাজতে থাকে। সে বড় দড়িয়ার মাঝি ছিল একসময়, তার ঝড়বৃষ্টির অভিজ্ঞতা যথেষ্ট—ঘূর্ণিঝড়েও তার নাও কাত করতে পারে না। সে ঠিকই টের পেয়ে গেছে, নদীর কুহেলিকার কথা। বড় শরিকের অতিথিনিবাসের কাছে বজরা নিয়ে তুলতে পারে। ঝড়ের দাপটে কোনও অঘটন ঘটে গেলে যাতে নৌকাডুবির আশঙ্কা না থাকে, তার ব্যবস্থাও তার জানা।
জগদীশ বারান্দায় নেমে যাবার জন্য দরজা খুলতে কিছুতেই সাহস পাচ্ছেন না। ঝড়ে ডাল ভেঙে পড়ল, না বিশাল আমগাছটির গোড়া উপড়ে গেল! কী যে করেন তিনি। তখনই চারপাশে আর্ত চিৎকার, কোথাও শাঁখ বাজছে, কাঁসি—ঘণ্টার শব্দও কানে আসছে—বাবুদের প্রাসাদেও তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। চারপাশে শুধু শঙ্খধ্বনি। উলুধ্বনিও শোনা যাচ্ছে। আসলে দুর্যোগ যে অতিমাত্রায় আতঙ্কে ফেলে দিচ্ছে মানুষজনকে বোঝাই যায়। তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। এই দুর্যোগের রাতে ঝড়ের ছোলায় কাছারিবাড়ির টিনের চাল উড়ে গেলে অরুণিকে নিয়ে বিপদে পড়ে যাবেন। হুড়মুড় করে মাথার উপরের মুলিবাঁশের পাটাতনও ভেঙে পড়তে পারে। হরমোহন থাকলে তাঁর এত আতঙ্ক হত না। অরুণির কথা ভেবেই তিনি কাতর হয়ে পড়ছেন। ডেকে তুললে হয়—এ যে কুম্ভকর্ণের নিদ্রা, কোনও হুঁশ নেই।
এই অরণি, অরণি!
সাড়া নেই। দরজা খুললে বৃষ্টির ছাটে সব ভিজে যাবে। হাওয়ায় হারিকেনও নিভে যেতে পারে। তিনি তাড়াতাড়ি মাথার উপরের পাটাতন থেকে টর্চটা নামিয়ে হাতের কাছে রেখে দিলেন। একবার মাঠ পার হয়ে প্রাসাদের দিকে যেতে পারলে ভালো হত। নিরাপদ জায়গা। কিন্তু অরণিকে যে ঘুম থেকে তোলাই যাচ্ছে না।
এই, কিরে তুই! কী ঝড় শুরু হয়েছে। ওঠ। শিগগির ওঠ।
তিনি অরণির হাত টেনে বসিয়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু এ কি, সে তো বসে থাকছে না। হয়েছেটা কী! কেমন নেশাখোর মানুষের মতো সে বেহুঁশ।
অরু! তোর কী হয়েছে!
অরণি সাড়া দিচ্ছে না।
সারাদিন কোথায় ছিলি! মেলায় কী খেয়েছিস?
জগদীশ ভয় পেয়ে গেছেন। তাকে ডাকছেন, তাকে ঠেলে পাশ ফিরিয়ে দিচ্ছেন, অথচ অরণি চোখ খুলে তাকাচ্ছে না। বজ্রপাতের শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছে, অরণি স্বাভাবিক থাকলে, কখনোই এভাবে বিছানায় পড়ে থাকতে পারত না। তিথিকে বজরায় তুলে নিয়ে গেছে শোনার পর থেকে সে যেন আরও বেহুঁশ।
এখন জগদীশ যে কী করে! ঝড়ে, নদীর প্লাবনে সবকিছু তছনছ হয়ে গেল।
একটা গাছ ভেঙে পড়ল, অরণি কিছুই টের পাচ্ছে না। লম্বা হয়ে পড়ে আছে।
অরণি বাবুদের প্রাসাদে যাবি? এখানে থাকা আমাদের উচিত হবে না। অরণি তুই ওঠ, ঘরের নিচে আমরা চাপা পড়ে থাকব। অরণি, তিথিকে বজরায় তুলে নিয়ে গেছে, এই দুর্যোগে, বজরার অবস্থা কীরকম বুঝতে পারছি না। আসিনুল যদি বাতাসের গন্ধ শুঁকে ঝড়ের আভাস টের না পায়, বজরা ডুবে যেতে কতক্ষণ!
অরণি এবার তাকাল।
তাকাল ঠিক। তবে ওর চাওনি স্বাভাবিক নয়। কোনও অতি দ্রুত ধাবমান জলরাশি পার হয়ে সে যেন নদীর পাড়ে উঠে এসেছে। চোখে কিছুটা দুঃস্বপ্ন, কিছুটা দুশ্চিন্তা এবং ক্ষোভ জ্বালাও হতে পারে—তিথির জন্য অরণির কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক, নানা ধন্দ দেখা দিতেই জগদীশ বললেন, এখন ঘুমাতে নেই, অবস্থা বিশেষ ভালো ঠেকছে না। দেখি ভেতর বাড়িতে যাওয়ার কোনও অবস্থা করা যায় কি না।
ছাতায় যে কাজ হবে না তিনি জানেন।
বৃষ্টি মাথায় ছুটে যেতে পারেন, তবে, যা ঝড়, গাছটাছ মাথার উপর উপড়ে পড়া বিচিত্র নয়। এবং অরণি যাবে কি না, সে তো উঠেও বসল না। তার যেন জীবন নিয়ে কোনও চিন্তাই নেই। সে যেন সব সুখ দুঃখ এবং অনুভূতির বাইরে।
অরণি তোর কী হয়েছে?
অরণি এবার উঠে বসল ঠিক, তবে মাথা দু হাঁটুর ফাঁকে গোঁজ করে রাখল।
আর একটা ছোলা এত জোড়ে এসে ঘরে ধাক্কা মারল যে, মনে হয় সব এবার সত্যি উড়িয়ে নেবে। কবে থেকে তাঁর এই নদীর পাড়ে বাস, কখনও এমন ভয়ঙ্কর ঝড়ের সোঁ সোঁ আওয়াজ টের পাননি। কোথাও যেন বড় রকমের ধ্বংসকাণ্ড শুরু হয়ে গেছে।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠল অরণি!
শুনতে পাচ্ছেন, আপনি শুনতে পাচ্ছেন বাবা!
তিনি অনেক কিছুই শুনতে পাচ্ছেন, মহাপ্রলয়ের মতো অবস্থা, মনে হয় নদীর জল ফুলেফেঁপে পাড় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের ঘাসের জমি জলে ডুবে গেছে দেখতে পেলেন। বাতাসের শব্দে নানাপ্রকার কুহক তৈরি হচ্ছে। নদীর জলে বাতাসের প্রচণ্ড চাপ, জল উথাল—পাতাল হচ্ছে নদীতে, তার শব্দও কান পাতলে শোনা যাচ্ছে—কিছু ঝড়ের পাখি বাঁশঝাড়ের ভেতর আশ্রয় নিয়েছে, বাঁশের তাণ্ডব নৃত্য শুরু হয়ে যাওয়ায় কোথাও দূরে কোঁ কোঁ আওয়াজ উঠছে। আর তার ভেতর সেই সব অসহায় পাখিরা আর্তনাদ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু অরণি কী বলতে চাইছে! তিনি তার কিছুই বুঝতে পারছেন না।
কোনও শব্দ কিংবা নদীর পাড়ে কোনও তরঙ্গমালার আঘাত যদি ভাসমান কিম্ভূতকিমাকার হাহাকার হয়ে ভেসে আসে, সেই সব শব্দমালার কথা কি অরণি বলতে চাইছে! সে কি কোনও হাহাকারের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
অরণিকে না বলে পারলেন না, তুই কী শুনতে পাচ্ছিস?
তিথি আমাকে ডাকছে?
তিথি ডাকছে! তোকে কেন ডাকবে?
ডাকছে। শুনতে পাচ্ছেন না, অরুদা, তুমি যাবে না!
তুই কোথায় যাবি তিথির সঙ্গে।
সে তো আমাকে নিয়ে যেতে চায়।
স্বভাব লাজুক অরণির এমন কথায় তিনি ঘাবড়ে গেলেন। সামনে টেস্ট পরীক্ষা, অরণি সতেরো বছরে পড়েছে। মেয়েদের সম্পর্কে সে খুবই লাজুক, কখনোই সে তুলির সঙ্গে কথা বলতে পারে না। জমিদারবাবুর মেয়েটা একটু চঞ্চল স্বভাবের, কিন্তু অরণি কখনোই তার সামনে পড়তে চায় না, তুলি এক দরজা দিয়ে ঢুকলে সে অন্য দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়, সেই অরণিকে তুলির বয়সি তিথি এই ঘোর দুর্যোগে কোথায় নিয়ে যাবে!
তিনি কিছুটা বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। ছেলেটার মাথা বিগড়ে যায়নি তো! ধমকও দিতে পারেন না, ছেলেটা এমনিতেই তার ভারী কোমল স্বভাবের, তাকে বড় হতে হবে, পড়াশোনা করে মানুষ হতে হবে, তার মায়ের এমন ইচ্ছের কথা ভালোই জানে, সে কেন দুর্যোগের রাতে তিথির কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে!
কী আজেবাজে বকছিস? তিথি কেন মরতে আসবে, সে তো বজরায় আছে, বজরা না থাকলেও, বড় শরিকের অতিথিনিবাসে গিয়ে উঠেছে। নদী যদি সত্যি খেপে যায় তবে আসিনুল আগেই তা টের পাবে। সে বজরা পাড়ে ভিড়িয়ে দিয়েছে ঠিক, সে খুব হুঁশিয়ার মাঝি, বহু ঝড়ঝঞ্ঝার সে সাক্ষী। জলে জলে তার জীবন কেটেছে, সেটা বুঝতে শেখো।
তবু যে ডাকছে তিথি! ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে সে ছুটে আসছে!
অরণি, তুই স্বপ্ন দেখছিস। তাই স্বপ্নে বকছিস। তোর স্বপ্ন দেখা কী শেষ হয়নি! শুয়ে শুয়ে বিড় বিড় করে সেই কখন থেকে—
স্বপ্ন কেন হবে বাবা! আমি তো দেখতে পাচ্ছি, ওর বগলে একটা পুঁটুলি, সে পাগলের মতো নদীর পাড় ধরে ছুটে আসছে। বজরাখানা নদীর পাড়ে ডিমের খোলার মতো তুফানে এসে আছড়ে পড়েছে। খান খান হয়ে গেছে বজরা। আশরাফ চাচার স্টিমার ডুবে যাচ্ছে।
মহাজন খুবই সদাশয় মানুষ—তিথিকে ফেলে তিনি কিছুতেই অতিথিনিবাসে গিয়ে উঠতে পারেন না। বজরা ডিমের খোলার মতো তছনছ হয়ে পড়ে আছে পাড়ে, জানলি কী করে!
আর তখনই কড়াৎ করে বজ্রপাতের শব্দ। চরচর কেঁপে উঠল, কোনও বৃক্ষের উপর পড়তে পারে—বজ্রপাতের সাদা গন্ধও নাকে এসে লাগল জগদীশের।
তিনি তাড়াতাড়ি দোহাই জয়মুনি বলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করলেন। জয়মুনির দোহাই দিলে বজ্রের ধার কমে আসে—মুনিঋষিদের বাক্য কখনও বিফল হয় না। জয়মুনি সহজেই বজ্রের ব্যাপকতা নষ্ট করে দিতে পারেন। নিজের এবং পুত্রের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তিনি জয়মুনির দোহাই না দিয়ে পারেননি।
কিন্তু অরণির কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সে হাঁটুর মধ্যে মাথা গোঁজ করে বসেই আছে চারপাশের ব্যাপ্ত তাণ্ডবলীলা তাকে বিন্দুমাত্র সচকিত করছে না।
সহসাই ফের অরণি বলল, আমি যাব বাবা।
কোথায় যাবি!
তিথি নদীর পাড়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আর পারা যায়! কেন সে অপেক্ষা করবে। সে মহাজনের এখন আশ্রিত জন, তার জন্য ভাবতে হবে না। মহাজনের লোকজনের অভাব নেই—তাদের কাছ থেকে তিথি কখনোই ছাড়া পেতে পারে না। সব মনের ভুল। হাতমুখ ধুয়ে, মাথায় মুখে ভালো করে জল দে। বায়ুচরা হয়ে গেলে লোকে ভুলভাল কথা শুনতে পায়। ভুলভাল বকে। ওঠো। মাথায় জল ঢেলে দিচ্ছি। ওঠো, বালতিতে জল আছে, হাতমুখ ধুয়ে নাও।
অরণির এক কথা, আমি যাব বাবা। নদীর জল তালগাছ সমান উঁচু হয়ে ভেসে যাচ্ছে। হাজার হাজার শুশুক মাছ সাঁতার কাটছে। ওরা তিথিকে নিতে এসেছে, আমি জানি।
তুই সব জানিস। যতসব আজগুবি চিন্তা!
আজগুবি নয়। সত্যি কথা। তিথি আর জন্মে শুশুক মাছ ছিল। সে আমাকে বলেছে।
আর কী বলেছে? জগদীশ বিরক্ত হয়ে গালে চড়ই কষাতে যাচ্ছিলেন।
ও যে বলেছে, তুমি আমাকে স্বপ্নে দ্যাখোনা অরুদা?
স্বপ্ন দেখলে কী হয়?
বারে ওর তো বিশ্বাস, স্বপ্ন দেখলে ভালোবাসা হয়। ভালোবাসলে স্বপ্ন দেখতে হয়। আমি ওকে মিছে কথা বলেছি বাবা। ওকে আমি স্বপ্নে আগে কখনও দেখিনি। তবু বলেছি, স্বপ্নে দেখেছি। ও যদি খুশি হয় তাই বলেছি।
ওতে কিছু হয় না। উঠে আয়। তুই নিজের মধ্যে নেই।
ও যে বলেছে, তুমি অরুদা তুলিকে কখনও স্বপ্ন দ্যাখো না তো?
আসলে জগদীশ জানেন গোরার মেয়েটা বড় হতে হতে কিছুটা ইঁচড়ে পক্ব হয়ে গেছে। মেয়েটা এমন সব কথা বলেই অরণির মাথা বিগড়ে দিয়েছে।
তা না হলে তার স্বভাবলাজুক ছেলের এই পরিণতি হয় না। বেজায় নির্লজ্জ না হয়ে গেলে বাবাকে কেউ ভালোবাসার কথাও বলতে পারে না। এমনও হতে পারে অরণি তার অস্তিত্বের কথাই ভুলে গেছে। সে যে তার বাবার সঙ্গে কথা বলছে, তেমনও হুঁশ না থাকতে পারে। জগদীশ খুবই বিচলিত হয়ে পড়ছেন। কাউকে যে ডাকবেন, ডেকে কথা বলবেন, অরণি ধীরে ধীরে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। আপনারা আসুন, কিছু তার উপর নিশ্চয়ই ভর করেছে। নদীর জলে মেয়েটা ভেসে গেল না তো! মরে গেল না তো! ভূত হয়ে অরণির মাথায় ঢুকে গেল না তো! ভূত প্রেতে জগদীশের প্রবল বিশ্বাসও আছে—তিনি ভাবলেন সকাল হলে অনাদি ওঝাকে ডেকে দেখাবেন, এখন রাতটা কাটলে হয়।
তখনই অরণি দাঁড়িয়ে গেল। চোখমুখ কেমন তার থমথম করছে।
অরণি চিৎকার করে উঠল, ডুবে গেল—স্টিমারটা ডুবে গেল। আশরাফ চাচা ডেকে ছোটাছুটি করছে। লাইফ জ্যাকেট, বয়া সব ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে। সবাই নেমে না গেলে তিনি নামতে পারছেন না।
অরণি, বাবা তুই কী হয়ে যাচ্ছিস? কোথায় স্টিমার?
ঐ দ্যাখো বাবা, ডেক ছাদে তিথি চাচার ভাঙা সানকি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দেখতে পাচ্ছি সব। তিথিকে স্বপ্নটার কথা না বললে পাপ হবে। আজ সত্যি তিথিকে স্বপ্নে দেখেছি।
এবারে তিনি তিরস্কার না করে পারলেন না—বের করছি তোমার পাগলামি। টানতে টানতে বালতির কাছে নিয়ে যাচ্ছেন, মাথাটা ধুয়ে দিলে আরাম পেতে পারে। ওর ঘুমানো দরকার। আসলে কোনও ঘোর থেকেও এসব দেখতে পারে। মাথাটা ধুয়ে দিলে শরীর ঠান্ডা হবে। কিন্তু অরণি কিছুতেই যেতে চাইছে না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অরণি যে তার পুত্র এখন কিছুতেই মনে হচ্ছে না জগদীশের। যেন এক নতুন জগৎ আবিষ্কারে অরণি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছে।
তারপরই অরণি কাণ্ডখানা ঘটিয়ে ফেলল। হাত ছাড়িয়ে ছুটে গেল দরজার দিকে, আমি আসছি তিথি, তুই দাঁড়া বলে দরজা খুলে দুর্যোগের মধ্যে ছুটতে থাকল।
জগদীশ হতভম্ব। মাথায় কিছু দিচ্ছে না তাঁর। তিনি কিছুটা উদভ্রান্ত। তারপর কী ভেবে যে টর্চটা হাতে নিয়ে বের হয়ে ডাকতে থাকলেন—তুই যাস না অরণি। তিনি প্রাসাদের দিকে ছুটে যেতে পারতেন, প্রবল বর্ষণে তার শরীর ভিজে যাচ্ছে, ঝোড়ো হাওয়ায় এগোতে পারছেন না। সবকিছু ঝাপসা। টর্চ জ্বেলে দেখলেন, অরণি সুপারিবাগানের মধ্যে ঢুকে গেছে। তিনিও সুপারিবাগানের মধ্যে যাবার জন্য ছুটছেন, বৃষ্টি কিংবা বন্যার জলে থইথই করছে মাঠ, তারও যেন হুঁশ নেই। টর্চ জ্বেলে কাউকেই দেখতে পেলেন না, একা অরণি নদীর পাড়ের দিকে ছুটছে। এক অতিকায় অজগরের মতো নদী ফুঁসছে, গাছপালা তছনছ করে ঝড় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সব, একবার কী ভেবে চিৎকার করেও ডাকলেন, কে কোথায় আছেন আপনারা, শিগগির আসুন, অরণি উন্মাদ হয়ে গেছে।
তারপর তিনি যা দেখলেন! হতবাক। পাড়ে বগলে পুঁটুলি নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ঝাপসামতো অস্বচ্ছ টর্চের আলোয় কিছুই স্পষ্ট নয়। কে দাঁড়িয়ে আছে তাও বোঝা যায় না, তবু কেউ দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে যেন এক জলাভূমি হয়ে গেছে নদীর পাড়, গাছ সব উপড়ে পড়েছে, সুপারিগাছগুলিও আস্ত নেই—তিনি ছুটতে ছুটতে কেবল অসহায় আর্তনাদে ভেঙে পড়ছেন, অরণি, বাবা যাস না। সামনে দ্যাখ কত বড় ঢেউ এগিয়ে আসছে। সাবধান।
আর সাবধান!
কড়াৎ করে আবার বাজ পড়ল।
সারা আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি—মেঘ ডাকছে গুরু গুরু। অজস্র বর্ষণে নদী ভরা কোটালের চেয়েও ভয়ঙ্কর। আর দেখলেন, কারণ টর্চটাও তার হাতে নেই। কোথায় ছিটকে পড়েছে—এক কঠিন লণ্ডভণ্ড অবস্থা তার। চোখ স্থির। তিনি তারপর চোখ বুজে ফেললেন আতঙ্কে। অরণি আবছামতো এক নারীর হাত ধরে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। নদীর ঢেউ তাকে কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল।
আর সকালেই খবর, তিথিও হারিয়ে গেছে। ঝড় ওঠার পর সবাই দেখেছে, তিথি বজরা থেকে লাফিয়ে ছুটে গেছে নদীর পাড়ে পাড়ে। কেউ আটকাতে পারেনি—বাঁচাও বাঁচাও, এই ছিল তার মুখে একমাত্র কথা। একবার শুধু বলেছে, আমাকে বাঁচাও অরুদা। অরুদা তুমি কোথায়।
তারপর যা খবর, নদীর বুকে কোনও চড়ায় আশরাফের স্টিমার ডুবি হয়েছে। ঝড়ে ক্ষতির শেষ নেই। মানুষজনও ডুবে মরেছে নদীতে। তবে মরার লাশ পাওয়া গেলেও অরণি কিংবা তিথির লাশ আবিষ্কার করা যায়নি,—এবং এভাবেই তিথি এবং অরণির এই কাহিনী বছর পার না হতেই কিংবদন্তির রূপ পায়।
কেউ বলে, তিথি শুশুক মাছ হয়ে গেছে। অরণিকে সঙ্গে নিয়ে নদীর জলে হারিয়ে গেছে। কেউ পূর্ণিমা রাতে ভরা কোটালে গভীর রাতে দু’জনকেই ঢেউ—এর মাথায় সাঁতার কাটতেও দেখেছে।
কেউ বলে, মোহনার কাছে চড়া জেগে উঠেছে, খুঁজলে তাদের সেখানে পাওয়া যেতে পারে।
আবার কারও সোজা কথা, ওসব বাজে কথা। আসলে অরণি উন্মাদ হয়ে গেছিল। তিথিকে ভালোবেসে সে উন্মাদ হয়ে গেছে। এটা বয়সেরই দোষ। তিথি সেই সুযোগে ওকে নিয়ে নদী পার হয়ে কোথাও চলে গেছে। মেয়েটা জলের পোকা, তাকে আটকায় কে!