- বইয়ের নামঃ নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি
- লেখকের নামঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি
এক
অনেকটা পথ, রাস্তায় ঝড় বৃষ্টি এবং কিছুটা রাস্তা জল কাদা ভেঙে বারদীর স্টিমারঘাটে তাকে এনে তুলেছিলেন জগদীশ। পথশ্রম লাঘবের জন্য লোকনাথের আশ্রমেও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিলেন। বাল্যভোগের সময় তখনও পার হয়ে যায়নি। জগদীশকে দেখে সেবাইত কুলদাচরণ খুবই পুলকিত—আরে ভুঁইঞামশায়, এদিকে হঠাৎ। এটি কে?
জগদীশ এসব ক্ষেত্রে সে যে তার বড় পুত্র এমন পরিচয় কখনই দেন না। বাবার সঙ্গে গেলে এটা টের পেতে অসুবিধা হয়নি অরণির। আশ্রমেও আসন পেতে দিলে বাবা বলেছিলেন, ঠাকুরের কৃপা, বাল্যভোগ সেরে যাব ভেবেই আশ্রমে এসে উঠেছি। আপনার সব কুশল তো! যাচ্ছি কর্মস্থলে। সামান্য উঁজিয়ে স্টিমার ধরব বলে চলে এলাম। এবারে অরণি মাইনর পাশ করেছে। কাছাকাছি হাইস্কুল কোথায়! তাই নিয়ে যাচ্ছি।
কুলদাচরণ এবং তার লোকজন জগদীশকে খুবই খাতির করল, একটা লোক বালতি করে জল এনে দিয়েছিল, হাত মুখ ধুয়ে বাল্যভোগ সেরে আবার রওনা হওয়া। আশ্রম থেকে ঘাটের দূরত্ব সামান্য। স্টিমারের আওয়াজ আশ্রমে বসে শোনা যায় এমন সে শুনেছে।
বাবা লোকনাথের বাল্যভোগের স্বাদই আলাদা। গোবিন্দভোগ চালের ভাত, এক গণ্ডূষ ঘি এবং সঙ্গে আলু বেগুন কুমড়ো সেদ্ধ। এই দিয়ে সকালের জলযোগ। খুবই পরিতৃপ্ত তারা এবং দু ক্রোশ দুর্গম রাস্তার পথকষ্ট নিমেষে উবে গেলে সে তার বাবার সঙ্গে রওনা হবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিল।
জগদীশ বললেন, তা হলে এবার যাত্রা করা যাক। স্টিমারে ওঠার আগে বাবা লোকনাথের কৃপার বড় দরকার ছিল। তাই উজিয়ে চলে এলাম। স্টিমারে গেলে বেশি সময়ও লাগবে না।
চৌচালা ছোট্ট কুটিরে লোকনাথের অতিকায় ফটোটির সামনে তাঁর প্রণিপাত দেখে সেও লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছিল—দূর দেশে যাচ্ছে, মন তার ভালো ছিল না। সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাতের পর, অরণির মনে হয়েছিল, বাবা লোকনাথই তাকে রক্ষা করবেন।
কর্মস্থলে অবশ্য হেঁটেও যাওয়া যায়—দশক্রোশের মতো পথ। হেমন্তের শেষাশেষি সময়। মাঠ— ঘাট থেকে বর্ষায় জল নেমে গেছে ঠিক, তবে জায়গায় জায়গায় মাঠ ভাঙতে এত বেশি কাদা ভাঙতে হয় যে তাতে তার পক্ষে সুস্থ শরীরে পৌঁছানো সম্ভব কিনা এমন ভাবতেই পারেন জগদীশ। দু ক্রোশের মতো রাস্তা যে করে হোক পার হয়ে স্টিমারে ওঠার সময় সে বুঝেছিল, বাবার কর্মস্থলে পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে।
সারা রাস্তায় বাবা তাকে এত বেশি বুঝ প্রবোধ দিয়েছেন যে সে মাঝে মাঝে বিরক্ত না হয়ে পারেনি।
যেমন বাড়ি থেকে নেমে সে একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে ছিল।
বাবা বললেন, পেছনে তাকাতে নেই। হোঁচট খাবে।
তখন সে দেখেছিল পুকুরপাড়ে মা তোতন নীলু ফুলু ছোটকাকা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে যতক্ষণ দেখা যায় সবাই তাকে দেখবে। খেজুর গাছের নিচে তারা শুধু দাঁড়িয়ে নেই, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যে কাঁদবে, কিংবা সবারই অশ্রুপাতের কথা ভেবে সে বিষণ্ণ হয়ে না যায় সেই ছিল আতঙ্ক। জল— কাদায় তাকে হেঁটে যেতে হবে। আর মাস দু এক আগে হলে সোজা নৌকায় সে তার বাবার কর্মস্থলে চলে যেতে পারত। কিন্তু মা মনস্থির করতে পারেননি। মামার বাড়ি রেখে পড়ানো যায় যদি—এবং বেশি দূরও না, ক্রোশ দুই রাস্তা পার হতে হয়। পুষ্পতারা হাইস্কুলে ভর্তি করে দেওয়ারও কথা হয়েছিল।
তবে বাবার মনঃপূত নয়। পুষ্পতারা স্কুলের রেজাল্ট মোটেই সুবিধের না। সেদিক থেকে ভবনাথ হাইস্কুলের বিশেষ সুনাম আছে। স্থানীয় জমিদারদের আনুকূল্যে স্কুলটি চলে। স্কুলে ফুটবল খেলার মাঠ পর্যন্ত আছে। এসব বিষয়ে বাবার পরামর্শ দেবার লোকের অভাব নাই। তিনি জমিদারদের এক শরিকের কাছারি বাড়িতে থাকেন। আদায়পত্র সব তারই জিম্মায়। বিশ্বস্ত খুব।
হাফপ্যান্ট হাফশার্ট গায় সে বারবার বাবার পেছনে পড়ে যাচ্ছিল। টিনের স্যুটকেসটি বাবার হাতে। ছোটকাকা সঙ্গে আসতে চেয়েছিলেন, বাবা রাজি হননি। কতটুকু রাস্তা, আমরা ঠিক চলে যাব। তোকে সঙ্গে আর যেতে হবে না।
আসলে বাবার বোধ হয় ধারণা, ছোটকাকা সঙ্গে থাকলে স্টিমারে ফের আর একটা সিন তৈরি হবে। ছোটকাকা ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকলে সে রেলিং থেকে কিছুতেই সরে যাবে না। তার ফের অশ্রুপাত শুরু হয়ে যেতে পারে। এমনিতেই বাবা খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলেন, এতদূরে সে শেষ পর্যন্ত যেতে রাজি হবে কি না। এক গ্রীষ্মের বন্ধে কিংবা পূজার বন্ধে সে শুধু আসতে পারবে। এতদিন বাড়ি ছাড়া হয়ে থাকার কষ্ট ভুক্তভোগী মাত্রেই জানে।
কিছুটা হেঁটে এসেই সে দেখেছিল, সে আগে, বাবা তাকে এগিয়ে দিয়ে পেছনে তিনি আসছেন। সে আর পেছন ফিরে তাকাতেও সাহস পায়নি।
রাস্তা যে খুবই দুর্গম—সে বল্লভদির মাঠে নেমেই বুঝতে পেরেছিল। পায়ে তার রবারের জুতো। গাঁয়ের ভেতর দিয়ে কিছুটা হেঁটে একটা সাঁকোর সামনে দাঁড়ালেন বাবা। তার যে কী হয়েছে, কিছুতেই বাবার সঙ্গে হেঁটে পারছে না। কিছুটা গিয়েই তিনি তার জন্য অপেক্ষা করছেন। গাঁয়ের লোকজন বাবার যে খুবই পরিচিত তাও সে টের পেল। এত সকালে তাকে নিয়ে তিনি কোথায় যাচ্ছেন এমন কথাবার্তা শুনেও বাবার সেই এক কথা, অরুকে নিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে থাকবে। ওখানকার স্কুলে ভর্তি করে দেব।