কালিদাস বলল, এই হচ্ছে আলোক, এই হচ্ছে কাশী আর এই আমাদের জয়া। পৃথিবীর নতুন নতুন সব খবর এর ঝোলায় ভরা আছে।
ওরা হাত তুলে নমস্কার করল জয়াকে। জয়া দেখল একজন বড় গোঁফঅলা মানুষ। লম্বা গোঁফ। গালপাট্টায় অধিকাংশ মুখটা ঢেকে আছে। লোকটার নাম কাশী। কাশীনাথ দত্ত। ওর কবিতার বিষয় মৃত জীবজন্তু নিয়ে। যুবতী নারীর কোনো গন্ধ নেই কবিতায়। জয়া মনে মনে বলল, কিচ্ছু হবে না। গবেট। গবেট ছাড়া মুখটাতে লোকটার আর কোনো চিহ্ন নেই।
ক্রমে ক্রমে আরও দুজন, পরে একজন, আবার একজন শেষে পাঁচ—সাতজন এল। কবিতা পাঠ করতে বেশ সময় লাগবে। চারটেয় আরম্ভ হওয়ার কথা। কিন্তু যার বাড়িতে কবিতা পাঠ, তিনি কোথায়! তার দেখা নেই। অথচ সুন্দর করে সতরঞ্চি পেতে রেখেছে। মাঝখানে মাটির কাজ করা ফুলদানি! একগুচ্ছ রজনীগন্ধা ফুটে আছে ওপরে। দেয়ালে রবিঠাকুরের ছবি। আর কোনো ছবি নেই। সতরঞ্চির ওপর ফুল—ফল আঁকা চাদর পাতা। সবার খুব গম্ভীর চোখ মুখ। কবিতা ব্যতিরেকে আর কিছু জানা নেই। পাশেই জয়া, কিছুক্ষণের ভেতরেই ফুল্লরা, আর একজন কেউ হবে, সেও যুবতী, এল। তবে এত কালো আর শীর্ণ যে কেউ ওর দিকে তাকাচ্ছে না। ফুল্লরা দেখতে মন্দ না, তবে জয়া সবার চেয়ে সুন্দরী। কেবল যখন কোনো সভায় সেই বজ্জাতটা আসে, নবীনা না কী যেন নাম, তখন নিষ্প্রভ হয়ে যায়। এবং তখন কালিদাস, বিনয়, এমনকি যে নীরদদা এত গম্ভীর মানুষ, তিনিও খুব বিচলিত হয়ে পড়েন! জয়া সে সব ঘয়োয়া আসরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বড়লোকি চাল, গাড়ি, সোফার উড়ু উড়ু চুল, চোখে টানা আইল্যাশ আর দামি পারস্য দেশের আতর বোধহয় শরীরে মেখে রাখে। যতক্ষণ থাকে একইভাবে গন্ধটা ম ম করে। জয়ারও কম জানা নেই। বাজারে কার কী রকম গন্ধ সব সে জানে। কেবল নবীনার গন্ধটা তার এখনও জানা নেই, কোথায় কোন পৃথিবীতে কিনতে পাওয়া যায়। নবীনা মেয়েটিই একমাত্র ঈর্ষার উদ্রেক করতে পারে তার।
নীরদদা এবার বোধহয় বেশ গুরুগম্ভীর গলায় কবিতা কত পবিত্র ব্যাপার এ সম্পর্কে সামান্য বক্তব্য রাখবেন। যিনি উদ্যোক্তা তাকেও দেখা গেল। আদ্দির পাঞ্জাবি, ফিনলে ধুতি পরে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে হাত তুলে সবাইকে অভিবাদন করলেন। নীরদদা তখন তার কথাবার্তা আরম্ভ করে দিয়েছেন। হাত তুলে ইশারায় বসতে বললেন। ধূপ জ্বেলে দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ খাতা খুলে দেখছে কিছু। জয়ার কিছু দেখতে হয় না। তার কবিতা মুখস্থই থাকে। তবু কোথাও আটকে গেলে অসুবিধা হবে ভেবে খাতাটা অথবা দুটো একটা মুদ্রিত কবিতা সামনে রাখার স্বভাব।
সেই কাশীনাথ দত্ত উঠে বলল, নীরদদা, আজ আপনাকে দিয়েই কবিতা পাঠ আরম্ভ হোক।
সে হবে’খন। বোস।
প্রায় এক ধমকে বসিয়ে দেবার মতো। জয়ার ভীষণ হাসি পাচ্ছিল, সে এক ফাঁকে সামান্য হেসেও নিল। তারপরই মনে হল, বাথরুমে গেলে মন্দ হত না। সে চারপাশে তাকাল। মানুটা খুব দুঃখ পেয়েছে। মানুর জন্যে একটা দুঃখবোধ শরীরে খেলা করে বেড়াচ্ছে। কবিতা পাঠ ভারি উজ্জ্বল ঘটনা জীবনে। একটা সুখানুভব খেলা করে বেড়াচ্ছে শরীরে। গুঁফো লোকটার চোখ মাঝে মাঝে তাকে বিব্রত করছে। সামান্য অস্বস্তিও বোধ করছে। এ সব অনুভূতি একই শরীরে খেলা করে বেড়ালে সে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এবং সে জানে কবিতা পাঠ প্রথম তাকে দিয়েই আরম্ভ হবে। সে উঠে এক মিনিট সময় চেয়ে নিল নীরদদার কাছে। তারপর বলল, আজ কিন্তু সবার শেষে আমি।
নীরদদা আবারও হাত তুলে ওকে বসতে বললেন। তিনি সুন্দর বর্ণনা সহকারে কবিতার কথাবার্তা বলতে পারেন। এবং বলতে বলতে ভারি নিমগ্ন হয়ে যান। চারপাশে কোথাও দুঃখ—টুঃখ আছে বোঝাই যায় না। এই বড় শহরে ফুটপাতে লোক থাকে, একবেলা আহার জোটে না মানুষের, মৃত্যু এবং ঈর্ষা অথবা অনুতাপে দগ্ধ হয় শহর—এখন এই সরু গলির অন্ধকারে টের পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হয় সর্বত্রই ফুল ফুটে আছে। কেবল কবিতা পাঠই মানুষের একমাত্র কাজ।
নীরদ হাজরা বলে চলেন, শরীর মন ঈশ্বর অথবা যন্ত্রণা মানুষের কবিতার বিষয়বস্তু হতে পারে। কবিতা দুঃখ জাগায়। কিছু না পাওয়ার দুঃখ থেকেই কবিতার জন্ম। আমরা নিয়তি—তাড়িত, অথচ কখনও পরাজিত হতে চাই না।
ফুল্লরা তখন শাড়ি টেনে পা ঢেকে দিল। ফুল্লরা আলতা পরেছে। ফুল্লরা আজ চুলে শ্যাম্পু করেছে। ওর চুল সারা পিঠে ছড়িয়ে আছে। কবিতা পাঠের সময় ফুল্লরার খুব ঘাম দেখা দেয়। দুটো রুমাল ওর বটুয়াতে থাকে। একটা ঘামের আর একটা গন্ধের। গন্ধের রুমাল বের করে সে চশমা মুছছে।
গুঁফো কাশীনাথের চোখ ট্যারছা হয়ে যাচ্ছে। সে বার বারই জয়ার পিঠের খালি অংশটা দেখার চেষ্টা করছে। সুড়সুড়ি লাগছিল জয়ার। সে শাড়ির আঁচল টেনে ভালো করে পিঠ ঢেকে দিল।
এবং গুঁফো কাশীনাথ ভাবল এই মেদ মাংস ভেদ করে একটা ফুসফুস থাকে মানুষের। অন্তঃকরণ থাকে পাশে। দুটোই এখন জ্বলছে আর নিভছে। এবং শরীরে করাত চালালে দুটো আলাদা ভাগে ফুসফুসের অর্ধাংশ, অন্তঃকরণ সবটাই একদিকে, পাকস্থলী, মূত্রাশয় সব সমান দু’ভাগ হয়ে যায়। সে পাশাপাশি বসা দুজন মেয়ের শরীর ভাগ করে দেখছিল। সে অ্যানাটমির ছাত্র। মেয়েদের দেখলেই ফুসফুস এবং জরায়ু দুটোর রঙের কতটা আসমানজমিন ফারাক বুঝতে পারে।