কিন্তু এবারে কী যে মনে হল তাঁর, অরুকে নিয়ে যাচ্ছেন, আশরাফের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা খুবই জরুরি। এই ভেবেই তিনি লোয়ার ডেক ধরে ইঞ্জিন—রুম পার হয়ে কেবিনে ঢুকে গেছিলেন। অরু তখন দৌড়ে কোথায় যে সিঁড়ি ধরে উঠে গিয়েছিল!
পরে ডেক—ছাদে খুঁজে পেলে তাকে নিয়ে যেতে চাইলেন, অথচ অরু কিছুতেই গা করল না। আশরাফ মনে মনে কী না ভাবল!
তিনি আর ডেক—ছাদ থেকে নামলেন না। আসন পেতে বসে থাকলেন। জায়গাটি নিষিদ্ধ এলাকা হলেও তার এখানে বসে থাকতে অসুবিধা হয় না। হুইল—ঘরের লোকটিও জানে কর্তার সঙ্গে আশরাফ সারেঙের দোস্তি আছে।
পাঁচুডাঙ্গার পাশ দিয়ে স্টিমার যাচ্ছে। এখানকার পাটালি গুড়ের সুখ্যাতি আছে খুব। আশরাফ মাঝে মাঝে তার কাছারিবাড়িতে পাটালি গুড়ও ভালো পেলে দিয়ে আসে। এমনকি স্টিমার ছাড়তে দেরি থাকলে আশরাফ তাঁর সঙ্গে কাছারিবাড়িতে দেখা করেও যায়। সেই আশরাফ এখনও ফিরছে না অরুকে নিয়ে। স্টিমারে বসে থাকলে ঘরবাড়ি, গাছপালা, মানুষজন কেমন আলগা হয়ে যায়, মাঝে মাঝে মনে হয় সম্পর্ক সব শিথিল হয়ে যাচ্ছে, উদাস লাগে। তিনি নিজেও তখন ভালো থাকেন না।
তিনি জানেন, অরুর অজস্র কৌতূহল, একবার যদি আশরাফের আশকারা পেয়ে যায়, তবে তাকেই হয়তো শেষ পর্যন্ত নিচে নেমে যেতে হবে অরুকে খুঁজতে। কাছারিবাড়ি পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে, আহারের বন্দোবস্ত বলতে চিঁড়াগুড়, কিছু মুড়কি এবং মোয়া জলে ভিজিয়ে খাওয়া। রাতে কখন পাত পড়বে, যদিও বড় শরিকের তরফের বউঠান জানেন, অরু আসছে। শুধু বউঠান কেন, বড় শরিক দেবকুমারবাবুর অনুমতি না পেলে তিনি অরুকে নিয়ে সেখানে তুলতে পারতেন না। তিনিই আশ্বাস দিয়েছেন, দেশে পড়ার বন্দোবস্ত করতে না পারো এখানে নিয়ে চলে এসো। তোমার সঙ্গেই না—হয় থাকবে। থাকা—খাওয়ার যখন কোনও অসুবিধা নেই, তুমি এত সঙ্কোচ করছ কেন, জগদীশ বুঝছি না।
নদী এখানে তার কিছুটা বিস্তার হারিয়েছে।
দু’পাড়ের গ্রাম মাঠ ঘরবাড়ি ফেলে স্টিমার এগিয়ে যাচ্ছে।
গোপালদির ঘাটে কিছু যাত্রী নামিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে, স্টিমারে ভিড় এখন বেশ হালকা। এরপর আসমানদির চরে যাত্রী নেমে যাবে। নবিনগর পার হলেই আর ঘণ্টাখানেকের পথ। এই নদীনালায় বেষ্টিত দেশটির জন্য জগদীশ খুবই গর্ববোধ করেন। অরুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যাত্রা করেছিলেন, দুশ্চিন্তাও আছে, অরুর শেষ পর্যন্ত মন টিকলে হয়! তবে আশরাফের জিম্মায় চলে যাওয়ায় তিনি যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত। যেমন একবার অরু ডেকে গেল, বাবা, আশরাফ চাচা গোপালদির ঘাট থেকে দই—মিষ্টি আনিয়েছে। অরুর সঙ্গে উদ্ধবও হাজির। কলাপাতায় দই চিঁড়া মুড়ি সযত্নে রেখে বলেছে, আপনি খেতে বসেন কর্তা। বেলা তো পড়ে আসছে। ইস, আশরাফ যে কী করে! মোয়া মুড়ি চিঁড়া সবই অরুর মা পুঁটুলিতে দিয়েছে। কী যে করে না আশরাফ!
কে শোনে কার কথা! আশরাফও ওপরে উঠে এসেছে। তার কাজ—কাম মেলা জাহাজে। ইচ্ছে করলেই সে সব সময় হাজির থাকতে পারে না। জগদীশ কিছু বলতেও পারেন না। ডেক—ছাদে আসন পেতে ফলার খাওয়ার মজাও কম না। অরু খেয়েছে কি না জানে না। আশরাফ সামনে হাজির। অরুকে জিজ্ঞেসও করতে পারছে না সে খেয়েছে কি না। বললে যেন আশরাফকে ছোট করা হবে।
জগদীশ গণ্ডূষ করে কলাপাতার চারপাশে জল ছিটিয়ে দেওয়ার সময় বললেন, তোমাদের খাওয়া হয়ে গেছে আশরাফ!
কর্তা আহারপর্বটি আপনার সারা না—হলে মুখে দানাপানি দিই কী করে।
জগদীশ বললেন, এই ভয়েই তোমার স্টিমারে উঠি না আশরাফ। উঠলেও গা ঢাকা দিয়ে থাকি। দশ ক্রোশ হেঁটেই ছুটি পেলে দেশে চলে যাই। কাজ—কাম ফেলে আমাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লে চলে!
আপনি খান তো!
অরু বলল, ক্ষীরের চমচম দারুণ। পাতক্ষীরও খেয়েছি। হাঁড়িতে কলাপাতায় বেঁধে দিয়েছে বাকিটা।
গোপালদির পাতক্ষীরের খ্যাতি আছে খুব। ক্ষীরের চমচমেরও। আশরাফ অরুকে এমন সুস্বাদু খাবার না খাইয়ে ছাড়ে কী করে! শুধু খাইয়েই তৃপ্তি নেই তার, সঙ্গে ক্ষীরের চমচম, পাতক্ষীর হাঁড়িতে আলাদা কলাপাতায় বেঁধে দিয়েছে। গোপালদির ঘাটে স্টিমার ভিড়ল, অথচ অরুকে তা খাওয়ানো গেল না, আশরাফের মতো মানুষ তা মানতে রাজি না। আশরাফ যে এককালে পিতাঠাকুরের আমলে তাদের বাড়িতেই মানুষ হয়েছে—অরু সে খবরও রাখে না। অনাথ আশরাফ বৈঠকখানায় থাকত, জগদীশ আর সে একই সঙ্গে বড় হয়েছে, আশরাফ তারপর কিছুদিন নিখোঁজ হয়ে থাকল, পিতাঠাকুর বেঁচে থাকতে নিখোঁজ আশরাফ একবার দেখা করেও গেল, কারণ পিতাঠাকুর, আশরাফ না বলে না কয়ে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় বড়ই আন্তরে পড়ে গিয়েছিলেন, খোঁজাখুঁজিও কম হয়নি। শেষে পিতাঠাকুর হাল ছেড়ে দিয়ে একদিন কেন যে বলে ফেললেন, বেইমান। দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছিলাম। ছোবল মেরে পালিয়েছে।
সেই আশরাফ যখন ফিরে এল তখন তাকে চেনাই যায় না। বাবরি চুল, পাজামা পাঞ্জাবি পরনে, পায়ে রাবারের জুতো, বাড়ি ঢুকেই হাঁকডাক, জ্যাঠাবাবা। কোথায়! অরু তখন হয়নি। সবে জগদীশের বিয়ে দিয়েছেন, কল্যাণীকে বালিকাই বলা চলে, একজন অপরিচিত লোকের ভেতর বাড়িতে ঢুকে যাওয়ায়, কিছুটা কল্যাণী বিরক্তও হয়নি বলা যায় না, সেই ডেকে বলেছিল, বাবা একটা লোক উঠোনে দাঁড়িয়ে কাকে জ্যাঠাবাবা জ্যাঠাবাবা করছে।