‘দুঃস্বপ্ন’ (১৯৮৫) উপন্যাসেরও কেন্দ্রে আছে এক নারী, সোমা। উদ্বাস্তু পরিবারের উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেয়ে সোমা। তার মা’র সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এক ধনী পুরুষের, সেই অপবাদ সহ্য করতে না পেরে তার বাবা আত্মঘাতী হয়। সোমা নিজেও খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও বহু পুরুষের কামনার বস্তু। কিন্তু মনে মনে সে চায় এমন এক স্বপ্নের নায়ককে, যে তার জীবনে এনে দেবে সুখ, আরাম, স্বচ্ছলতা। সব পুরুষ—বন্ধুর মধ্যে সোমা তাই বেছে নেয় ধনী ব্যবসায়ী মনীষকে, যার রয়েছে অগাধ ঐশ্বর্য এবং সেই ঐশ্বর্যের মূলে রয়েছে নানা দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপ। মনীষও সোমার রূপ ও শরীরের ভক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু সোমা ও মনীষের বন্ধুরা এক উদ্ভট ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। চারপাশে যখন বুভুক্ষু মানুষের হাহাকার তীব্র হয়ে উঠেছে, দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করে তাদের হত্যা করা হচ্ছে, সেইরকম বাস্তবতায় তারা সোমার চোখে মনীষের স্বরূপকে খুলে দিয়ে উদ্যোগী হয়ে ওঠে। সোমা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, মনীষ কোনও স্বপ্নের নায়ক নয়, সে তার স্বপ্নের নায়কের জন্য মরীয়া হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সোমাকে একটু একটু করে হারানোর যন্ত্রণায় মনীষ পাগলের মতো হয়ে ওঠে, এর সঙ্গে একের পর এক উড়ো চিঠি তাকে ভয়ার্ত ও তাড়িত করে চলে, আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কায় সে মানসিক ভারসাম্য হারায় এবং শেষপর্যন্ত আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। মনীষকে এইভাবে তার ঈর্ষাপরায়ণ বন্ধুরা এক প্রবল ভয়ের ফাঁদে ফেলে বাধ্য করে মৃত্যুকে বেছে নিতে এবং এইভাবেই তারা সোমাকে না পাওয়ার শোধ তোলে।
‘নারী এবং নদীর পাড়ে বাড়ি’ (২০০২) উপন্যাসেরও কেন্দ্রে রয়েছে এক আশ্চর্য নারী, যার নাম তিথি। পড়াশুনো করবে বলে নিজের বাড়ি ছেড়ে বাবার সঙ্গে চলে এসেছিল অরণি, সেখানেই তার সঙ্গে আলাপ হয় তিথির। গরিব, অভাবী পরিবারের মেয়ে তিথি, জমিদার বাড়ির দয়ার ওপর তাদের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। কিন্তু আশ্চর্য প্রাণচঞ্চল তার মন, সতেজ, সংবেদনশীল, কল্পনাপ্রবণ তার হৃদয়। অরণিকে সে যেমন অসুস্থ হলে সেবা করে, তেমনই তার মনকে নিয়ে যায় এক কিংবদন্তীকে রাজ্যে। এভাবেই তার শরীর ও মনকে অধিকার করে নেয় তিথি। অরণির কাছে তার বাস্তবতা তুচ্ছ হয়ে যায়, তিথির সঙ্গে সে হারিয়ে যায় এক কল্পজগতে, লিপ্ত হয় নানা দুঃসাহসিক কার্যকলাপে। তারা একে অপরের কাছে অনিবার্য ও নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। তিথির সূত্রেই অরণি প্রথম যৌনতার স্বাদ পায়, নারী শরীরকে দেখে সে একেবারে অভিভূত হয়ে যায়। কিন্তু এভাবে বেশিদিন চলে না, তিথিকে বিয়ে দেওয়ার জন্য জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়, তাও আবার এমন এক পাত্রের সঙ্গে যার আগের পক্ষের দুটি স্ত্রী রয়েছে। তিথি কিন্তু স্টিমার থেকে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যায়, আর সঙ্গে সে নিয়ে যায় অরণিকে। তিথি আর অরণি, দু’জনেই কিংবদন্তীর অংশ হয়ে যায়। লোকে বলে, তারা শুশুক হয়ে গেছে আর তাদের ঢেউয়ের মাথায় সাঁতার কাটতে দেখা গেছে।
এই বিপুলায়তন সংকলনটি প্রকাশের জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ প্রাপ্য দীপ প্রকাশনের কর্ণধারশ্রী শংকর মণ্ডল, তাঁর সুযোগ্য পুত্র শ্রী দীপ্তাংশু মণ্ডল এবং তাঁদের কর্মসহযোগী শ্রী আশিস চৌধুরীর। সবশেষে বলা যায়, পাঠকদের হাতে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো এক অতুলনীয় লেখকের ছ’টি উপন্যাসের এই স্মরণীয় সংকলন তুলে দিতে পারায় আমরা সকলেই গর্বিত। বাংলা উপন্যাসে এ এক গৌরবময় সংযোজন, বলা বাহুল্য, এ কথা অনস্বীকার্য।