- বইয়ের নামঃ দুঃস্বপ্ন
- লেখকের নামঃ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
দুঃস্বপ্ন
এক
তবে তুমি এখানে দাঁড়াও আমি দেখছি ভিতরে কেউ আছে কিনা!
সোমা দাঁড়িয়ে থাকল। মনীষ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে যাচ্ছে। সে উঠে যাচ্ছে। সোমা তাকে উঠে যেতে দেখছে। সিঁড়ির বাঁকে মনীষ হারিয়ে গেলে সোমা সংস্কৃত কলেজের পাশে সেই পুরনো বইয়ের দোকানগুলো দেখল। এখানে সে নানাভাবে এসেছে। মনীষের সঙ্গে সামনের দেবদারু গাছটার নিচেই প্রথম আলাপ হয়েছিল।
এখানে এসে সেই প্রথম আলাপের দিনক্ষণগুলো কেমন মনে পড়ে গেল। বিয়ের পর সে যে এখানে দু—একবার আসেনি তা নয়, এসেছে। প্রথম বেশ কয়েকবারই এসেছে। কিন্তু এলেই সে দেখেছে বন্ধুবান্ধবদের আর আগের কৌতূহল সোমা সম্পর্কে আদৌ নেই। সে ওটা চাইছেও না। তবু মনে হয়েছে কেন জানি মনীষকে বিয়ে করার পর সব পুরুষবন্ধুদের কাছে তার দাম কমে গেছে। সেজন্য পরে আর এদিকে মাড়ায়নি সোমা। বরং মনীষই গিয়ে মাঝে মাঝে খবর নিয়েছে সবার।
তখনই মনে হল পিছন থেকে কে ডাকছে। সে তাকাল। মনীষ নয়। ওর অন্য চেনা পুরুষবন্ধু। বলল, এসো সোমা।
ও কোথায়?
বসে গেছে। আমি তোমাকে নিতে এলাম।
তুমি কেমন আছ?
ভালো। তুমি?
ভালো। তবে মাঝে মাঝে তোমাদের কথা মনে হলে খুব এখানে আসতে ইচ্ছা করে।
হয়েছে থাক। কী করছ বল?
কী আর করব। বাড়িতে আর বসে থাকতেও পারি না। ও অফিস চলে গেলে একা একা ভালো লাগে না বলে কলেজে একটা কাজ নিয়েছি।
ভালো করেছ। যা দিনকাল পড়েছে!
সোমা ওপরে উঠে দেখল জাঁকিয়ে বসে গেছে মনীষ। যেন সে এখানে একাই এসেছে। তার সঙ্গে কেউ ছিল না। সোমা যে ঢুকল সে তা পর্যন্ত টের পায়নি। হা হা করে কী কথায় হাসছে। সোমা কাছে যেতেই বলল, এতগুলো অকালকুষ্মাণ্ড একসঙ্গে বসে আছে দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না সোমা। বসে গেলাম। তুমি বসো। এই বিনু একটা চেয়ার এনে দে তোর বৌদিকে। এতদিন পর আমরা এসেছি, সোমার নামে কিছু আজ সেলিব্রেশান হোক।
বিনু সোমার সহপাঠী ছিল। সে সোমাকে, সোমা বলে ডাকত। তুই—তুকারি করত। সোমা এই বছর চারেকের ভিতর সামান্য ভারী হয়েছে। এবং চুল সে সবসময়ই শ্যাম্পু করত। চোখ খুব টানা, তার ওপর সোমার ভারি বদ স্বভাব ছিল, সে এলেই খুব একটা জাঁকজমক করে আসত না। খুব সাদাসিদে পোশাক, যেন সে ঘরেই ছিল পথ ভুল করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে নেমে এসেছে। বিনু কতদিন বলেছে, এই সোমা শোন, তুই একদিন চোখে কাজল টেনে আয় না। তোকে ভালো করে দেখি।
নিমেষে বিনুর সে সব কথা মনে পড়ে গেল। এবং মনীষ যেহেতু ওর সমবয়সি ছাত্র এবং সহপাঠী, সে তার চোখে—মুখে কোনো পূর্বস্মৃতি ধরা পড়ুক তা চাইল না। খুব হয়েছে। শালা তুমি তো খুব এখন সাঁতার কাটছ আর আমি চেয়ার টেনে মরব এমন বলার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু বলতে পারল না। সে একটা টিনের চেয়ার টেনে নিল। অন্য চেয়ারে নানারকমের মানুষ বসে গেছে। ওর ইচ্ছা ছিল না সোমা একটা সামান্য টিনের চেয়ারে বসুক। সে নিজে উঠে যাবার সময়ই বলে গেল, তুই বস সোমা। আমি নিয়ে আসছি। সোমা বিনুর দিকে তাকাল। কেমন আছিস?
তুই?
খুব ভালো।
আমরা ভালো নেই।
কেন কী হয়েছে? ভালো নেই কেন? একটা বিয়ে করে ফেল।
কী সময় পড়েছে! এ—সময়ে কেউ বিয়ে করে!
সুধীর বলল, এখন বিয়ে বিয়ে ভাল্লাগে না! কে আজ সেলিব্রেট করছে বল?
বিনু বলল, আমার পকেটে ভাই পয়সা নেই।
অশোক বলল, তোর পকেটে কোনদিন পয়সা থাকে?
বিনু বলল, না থাকলে কী করব।
সোমা বলল, তোমরা বিনুকে চটিও না। বরং আমি তোমাদের সবাইকে আমার নামে সেলিব্রেট করছি।
মনীষ বলল, হল! বললাম তোদের আজ কিছু খসাব, এখন শালা উলটো চাপ।
কী হচ্ছে! শালা শব্দ মনীষ উচ্চারণ করায় সোমার যেন সম্মানে লেগেছে। না মাইরি বিনু, এখন আর আমাদের—স্বাধীনতা নেই।
আমাদের বলছিস কেন? বল তোর নেই। একটু খিস্তি—খেউড় করলে সোমা, মানুষ ছোট হয়ে যায় না। কেমন গম্ভীর গলায় বিনু এমন বলল।
তাই বুঝি।
সুধীর ডাকল, এই আবদুল, আজ স্পেশাল কী আছে রে?
চিকেন প্যাটিস, চিলি চিকেন।
ওসব চিলি ফিলি চলবে না? মনীষ তুমি কী খাবে। সোমা শীতকাল বলে একটা মেরুন রঙের চাদর গায়ে দিয়েছে। এবং চাদরে ওর মুখের অর্ধেকটা ঢাকা। সে যখন কথা বলে চাদরটা নামিয়ে নেয়। বিনুর এসব সহ্য হচ্ছে না। অশোকের সঙ্গে এখন পর্যন্ত সোমা কোনো কথা বলছে না। সে একবার রেস্তোরাঁতে সোমাকে খাওয়াবে বলে নিয়ে গিয়ে অযথা ইচ্ছার বিরুদ্ধে কী সব করতে চেয়েছিল, পারেনি। সেই থেকে সে অশোকের সঙ্গে দেখা হলে বেশি কথা বলত না। বিয়ের পর বন্ধ করেই দিয়েছিল। এখানে ওর যতটুকু অসুবিধা হচ্ছে এই মানুষের জন্য। কিন্তু অশোকই প্রথম আলাপ করিয়ে দিয়েছিল মনীষের সঙ্গে। এবং অশোক মনীষের খুব বন্ধু লোক। তবে এই যে রক্ষে, অশোক কখনও বন্ধুত্বের দাবিতে ওর বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেনি। কেন জানি আজ অনেক দিন পর সোমার সবার সঙ্গেই ভালো ব্যবহার করতে ইচ্ছে হল।
সোমা বলল, অশোক তুমি কী খাবে?
সে কেমন উদাসীন গলায় বলল, বল কিছু একটা।
কেন, তুমি বলতে পার না? সোমা পুরনো জলছবি মুছে দেবার চেষ্টা করছিল। অশোকই সহসা বলল, তোমরা হঠাৎ? তুমি তো এখন বড়মানুষের বউ।