২৮.
মানুষটার মতিভ্রম হয়েছে। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। উলটো দিকের রাস্তা থেকে একজন গলা ছেড়ে সোডাজলের গান গাইল। দেড়তলার খোলা জানালা দিয়ে বুক গলিয়ে পানের পিচ ফেলল আর-একজন। নাচের সাথে ডুগি তবলার বোল বাজছিল আশেপাশে কোথাও। আমার মুখোমুখি বাড়িটার সরু ছোট খোলা সদরের দিকে চোখ পড়তে দেখলাম, তিন ধাপ সিঁড়ি, তিন সিঁড়িতে তিনটে মেয়ে বসে। প্রথম ধাপের মেয়েটা পা ফাঁক করে বসে পায়ের গোড়ালির কাছে সায়া টানছে আর হাসছে। …সহদেবদা এল, কাঁধে হাত রাখল। কাঁধের কাছটা এমন জোরে থাবা দিয়ে ধরেছিল, মনে হল যেন ওর সমস্ত শরীরের ভারটা আমার ওপর ফেলে দিয়েছে। আস্তে আস্তে গলা জড়িয়ে ধরল সহদেবদা। শোষা শোষা গলায় বলল, ওই মেয়েটার কাছে চল, জানলার মেয়েটা…একলা আছে।
২৯.
সহদেবদাকে এগিয়ে দিয়ে পিছু ফিরতে যাচ্ছি খপ করে আমায় ধরে ফেলল। এত জোরে এমন করে কখনও আমার হাত আর কেউ ধরেনি। মনে হচ্ছিল, আমায় ছাড়া আর এক পা এগোবার সাধ্য সহদেবদার নেই। ইচ্ছে করলে হাতটা হয়তো আমি ছাড়িয়ে নিতে পারতাম। ছাড়ালাম না। বললাম, তুমি যাও, আমি একটু পান খেয়ে আসি। দুজনেই এক জায়গায়…। আমায় কথা শেষ করতে দিল না সহদেবদা, ওর হাতের আঙুলগুলো আরও শক্ত হল, আমার কবজির কাছটায় হাড় কনকন করে উঠল, সহদেবদা বলল, দুজনেই এক সঙ্গে যাব। তুই সাক্ষী থাকবি, ফটিক। আমি শালা পুরুষ মানুষ কি না স্বচক্ষে তুই দেখবি। সহদেবদার গলা কর্কশ রুক্ষ, চোখে ফুলকি। আমার হাত ধরে টানছিল সহদেবদা, টকটকে লাল শাড়ি পরা বেশ্যাটা দেওয়ালে পিঠ হেলিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছিল।
৩০.
কতটা রাত হয়েছিল জানি না। রিকশা করে সহদেবদাকে নিয়ে ফিরছিলাম। সোনাগাছির গলিটা যেন থকে গিয়ে মড়ার মতন পড়ে ছিল। গ্যাসবাতিগুলো বাড়ির বউয়ের মতন পথ চেয়ে চেয়ে জড়ানো চোখে ঢুলছে। নোংরা ঘিঞ্জি ঠাণ্ডা বাড়িগুলোর গা বেয়ে দিশি মদ কাঁকড়া ভাজা আর পেঁয়াজের গন্ধ ব্যাড় ব্যাড় করছে। রিকশাটা আস্তে আস্তে চলেছে। সহদেবদা মাল খেয়ে আমার ঘাড়ে মাথা গুঁজে পড়ে আছে। …গলির জট ছাড়াতে ছাড়াতে আমরা যে কোথায় এসে পড়লাম কে জানে। আমি কিছু ঠাওর করতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, কোথায় এসেছি কোথায় যাচ্ছি আমরা কেউ জানি না–আমি না, সহদেবদা নয়, রিকশাঅলাও না। আমাদের যাওয়া কোনও জানা ঠিকানায় নিয়ে যায় না শেষ পর্যন্ত। সহদেবদা যেখানে এসেছে সেটা না বাড়ি না বেশ্যাপাড়া। বোধহয় এটা দোকানপাড়া। সহদেবদা দোকান খুলে বসে বুড়ো বয়স পর্যন্ত বশীকরণ শিক্ষা বিক্রি করবে। বাড়িতে তার কলমকরা ছেলে বড় হবে, বেশ্যাপাড়ার আজকের মেয়েটা বুড়ি হবে; সহদেবদা কোনওটাকেই বশ করতে পারবে না। ছেলের নাম দিয়ে আরও একটা বশীকরণ লিখবে। বেচবে। গাঁট গাঁট বেচবে আর দোকান বন্ধ হয়ে গেলে ট্রাম রাস্তায় নেমে দেখবে–জগতে কোনও কিছু তার বশে নেই। কাঁদবে সহদেবদা, রোজ–প্রত্যহ, আজকের মতন। কিংবা হাসবে, যেমন করে আমায় দেখে প্রথম দিন হেসেছিল।
৩১.
রিকশা থামিয়ে আমি নেমে পড়লাম। তারপর ভীষণ ভয়ংকর একটা বোঝার মতন যেন সহদেবদাকে ঘাড় থেকে নামিয়ে দিয়ে হন হন করে ছুটে পালালাম।
.
ছয়
০১.
ময়রার দোকানের সামনের এঁটো পাতার যেমন ঠিক-ঠিকানা নেই, কখনও ভিখিরি কখনও কুকুরের মুখে মুখে একখান থেকে আর-একখানে গিয়ে পড়ে, শেষে দমকা হাওয়ায় উড়ে উড়ে কোথাও চলে যায়–আমার জীবনটাও সেইভাবে কাটছিল। শশী কোম্পানির ছবি বাঁধাইয়ের দোকান থেকে মাধবমোহন অপেরায় এসেছিলাম। সেবার অপেরা নতুন পালা খুলেছিল নহুষের প্রেতাত্মা। আমায় সারাটা শীত কলকাতার বাইরে মফঃস্বলে নহুষের প্রেতাত্মা সেজে কাটাতে হয়েছে। ছাতার কাপড়ের কালোবোরখা পরে রাতের পর রাত জেগে থাকা আর যাত্রার আসরের বাইরে এলেই খেকি কুকুরগুলোর তাড়া খাওয়া আমার ভাল লাগত না। আমি জানতাম, ধুতি জামা পরা এই মানুষটাই আসল প্রেতাত্মা কালো বোরখাটা নেহাতই কাপড়, তার আত্মা নেই। মাধবমোহন অপেরার মালিক আমায় বাপ মা তুলে গাল দিয়ে বলেছিল, ওরে আমার বিদ্যেসাগর, খুব যে কুলোয় করে বিদ্যে ঝাড়ছিস, আত্মা দেখার জন্যে কেউ বায়নার টাকা দিয়ে যায় না-বুঝলি। ..আমি জানতাম কালো কাপড়টার জন্যেই মানুষ দাম দেয়।
০২.
অপেরা ছেড়ে দিয়ে মাস দুই নীলাম হাঁকার কাজ করলাম ডাববাবুর দোকানে। নীলাম হাঁকার গলা আমার ভালই ছিল। ডাববাবুর ধারণা হল, আমার গলার স্বর তেমন ভাবে চড়তেই পারে না, খদ্দের যে ভাববে এই বুঝি হাতছাড়া হল হল তেমনটি হয় না। ডাববাবু বললেন, নীলামের কারবারে খদ্দেরকে গরম করে দিতে হয়, তুমি ঠিক গরম করতে পারো না। ..চল্লিশ টাকা মাস মাইনের আর কত গরম করার মতো আগুন থাকে শরীরে আমি বুঝতে পারিনি।
০৩.
ছেঁড়া-খোড়া শুকনো পাতার মতন আমি যখন যে-পাশে হাওয়ার দমকা সেই পাশে উড়ে যাচ্ছিলাম। দেখতে দেখতে আর একটা বছর কেটে গেল। দরজিপাড়ার দিকে এক গেঞ্জিকলে চাকরি পেয়েছিলাম। চাকরিটা কিছু নয়, কিন্তু কারখানার বাড়িটা আমার অদ্ভুত লাগত। ভাঙা গেটঅলা কতকালের পুরনো এক বাড়ি, গায়ে একরত্তি চুন সুরকি নেই, ইটগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে ঝরছে, নাট-মন্দিরের মতন বাড়িটার পেল্লায় মাথাটা লম্বা লম্বা তালগাছের মতো থামের ওপর ভর করা। কত যে ঘর ছিল ওবাড়িতে কে জানে, বিশ-পঁচিশ পঞ্চাশও হতে পারে। কাঠের সিঁড়ি, ঘুটঘুঁটে অন্ধকার কুঠরি, হাঁটুড়োবা ধুলো, কেমন এক পাতাল পাতাল গন্ধ। একরাশ পায়রা আর এক গাদা চড়ুই সারাদিন বারান্দায় ঝটপট করছে। দালানের সামনে একটুকরো জমি। একটা ন্যাংটো মেয়েছেলের মূর্তি হেঁট মুখে পিঠ নুইয়ে পায়ের তলা থেকে কাপড় তুলে নিচ্ছে, যেন দালানে কারুর পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে লজ্জায় মরি মরি। জমিটার একপাশে কামিনী ফুলের গাছ একটা, আর কিছু জবা গাছ। …উত্তর দিকের দালানের কুঠরিতে আমাদের গেঞ্জিকল, ওপাশে সাইনবোর্ড লেখার কারখানা–মাঝের কুঠরিগুলোয় ছাপাখানা। দোতলায় এক জ্যোতিষী বসে, গয়নার বাক্স তৈরি করে দু-তিন জন কারিগর, থিয়েটারের সিন আঁকে শশিবাবু আর তার সাকরেদ দুজন। বাড়িটার আর কোথায় কী আছে জানতাম না। অথচ দোতলার উত্তর দিকের জানলার আধখানা বন্ধ পাপড়ির ওপর দিয়ে প্রত্যহ ভিজে শাড়ি ঝুলত, প্রত্যহ। সকালে যখন কারখানায় আসতাম, দেখতাম শাড়িটা ভিজে; দুপুরে দেখতাম শাড়ির বদলে ধুতি ঝুলছে। আমাদের মধ্যে কেউ জানত না, ওই ঘরটায় কে থাকে। কেউ কোনওদিন জানলায় কারুর মুখ দেখেনি। সবাই ভাবত, এ বাড়ির বুড়ো ম্যানেজারের ওটা অন্দরমহল। বুড়ো ম্যানেজারকে দুপুরবেলা একবার দেখা যেত। খড়ম পায়ে সিঁড়ির রেলিং ধরে আস্তে নেমে আসত দালানে। ন্যাংটা মেয়ের মূর্তিটার কাছে এসে বেতের বাটি থেকে ভাতের দানা ছিটিয়ে পায়রা আর চড়ুইগুলোকে খাওয়াত। তারপর খট খট করে আবার চলে যেত, মনে হত মানুষটা এই মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে, আবার এখুনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। কারও দিকে তাকাত না, কথা বলত না; মাঝে মাঝে শুধু সিঁড়ি ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাত।