১. ছেলেমেয়ে কুড়িয়ে নিয়ে
০১.
বাসটা ছেলেমেয়ে কুড়িয়ে নিয়ে বেলা নটা নাগাদ এখানে হাজির হয়, আসার কথা আটটায়, আসতে আসতে ওই সময়টুকু যায়। পথ মাইল পাঁচেক অবশ্য, কিন্তু পথের হিসেবে কিছু আসে যায় না। ছেলেমেয়েগুলোকে শুধু কুড়িয়ে আনা তো নয়, গুছিয়ে আনাও। ঘুরে-ফিরে এর-ওর দরজায় দাঁড়াও, প্যাঁক-প্যাঁক হর্ন দাও, সজোরে কড়া নাড়ো, কোনও ছেলের ঘুম ভাঙিয়ে ইজের পরাও, কোনও মেয়ের বাসি-চুলে একটু আলগা চিরুনি বুলিয়ে নাও, তারপর বাচ্চাগুলোকে গাড়িতে তোলো। এই রকম করে আসা। রোজ, নিত্য। সময় বয়ে যাবে তাতে আশ্চর্য কী! পাঁচ মাইলের পথ যদি আট-দশ মাইলের পেট্রল খায়, তাতেও অবাক হবার কিছু নেই। তবু তো বাসটা নিয়মিত আসে।
কী করে আসে সেটাই এক আশ্চর্য। আসার কথা নয়, যে কোনওদিন যে কোনও জায়গায় ওটা দমবন্ধ নিশ্চল-অসাড় হয়ে পড়ে থাকতে পারে। বিন্দুমাত্র ভরসা নেই, মাঝেই-মধ্যেই নাড়ি হারায়, তবুও ওই গাড়িকেই ভরসা। নুটু মিস্ত্রি, যে এই অদ্ভুত মজার গাড়ি তৈরি করেছিল, তার হাতে গড়াপেটা বলেই নয় শুধু, তারই হাতে লালিত-পালিত হচ্ছে বলেই সবাইয়ের যেটুকু ভর ভরসা।
নুটু মিস্ত্রির এই গাড়ির গায়ে মিস্ত্রি নিজেই সাদা রং আর ব্রাশ দিয়ে নাম লিখেছে ইংরেজিতে। মিস্ত্রির যে ইংরেজি বর্ণ-জ্ঞান আছে তা মনে করার হেতু নেই। গত বছর বাঘা দাদাকে দিয়ে খড়িতে করে বাসের গায়ে হরফগুলো লিখিয়েছিল, তারপর নিজে সাদা রং দাগে দাগে বুলিয়ে গেছে। ফলে ইংরেজিতে এই বাসের নাম মেজর গাড়ি–অর্থাৎ বাংলায় যা হবে মজার গাড়ি। নামটা বাচ্চাগুলোই দিয়েছিল, লিখেছিল অবশ্য বাঘা। লেখার দোষ বাঘার নয়। তার বয়স ছিল মাত্র দশ, মিস্ত্রির কাঁধে বসে ঘাড়ের পাশ দিয়ে পা দুটো গলিয়ে তাকে লিখতে হয়েছিল। একটা করে অক্ষর শেষ হয় আর মিস্ত্রি এক পা করে সরে যায় পাশে।
বাঘা আর নেই, গত শীতে তার বাবা বদলি হয়ে গেলে বাঘা চলে গেছে, তার লেখাটা থেকে গেছে। নুটু মিস্ত্রির খুবই ইচ্ছে ছিল বাসের অন্য পাশে সে বাংলাতেও নামটা লিখে নেবে। বাঘাদাদা চলে যাওয়ায় হয়নি, না কি অপেক্ষা করছে জ্যোতিবাবু কবে নিজে থেকেই গোটা গোটা করে নামটা লিখে দেন। জ্যোতিবাবু ছবি আঁকান ছেলেমেয়েদের, পড়ান, তাঁর হাতে লেখা খাসা হবে।
নুটুর কথা, নুটুর গাড়ির কথা তাকে জিজ্ঞেস করলে সে সাত কাহন বলবে। কবে কোথায় কোন উইলিসাহেবের সোফার হয়ে দশ বছর কাটিয়েছে, কেমন করে সেই বিশ্বকর্মা সাহেবের হাতে তার গাড়ির কাজের যাবতীয় যা কিছু শিক্ষা, তারপর উইলিসাহেব মরে গেলে পাটনায় আগরওয়ালার মোটর কারখানায় টানা কবছর হরেক রকম গাড়ির মেরামতি করেছে, কোন বিশারদ নুটুকে সার্টিফিকেট দিয়েছিল এই বলে যে, নুটু নেভার সেজ নো–এসব কথা প্রত্যেকটি মনে আছে নুটুর। বলতে পারলে নুটু খুশি হয়। কিন্তু সব গল্পের পর নুটুর শেষ গল্পটা বড় কষ্টের। সেটা সে বলতে চায় না।
সেই গল্পেরই পরিণতি এই মজার গাড়ি, নুটু যার জন্মদাতা। একটা ফোর্ড গাড়ির ইঞ্জিনই শুধু সে পেয়েছিল। পুরনো বনেদি বংশ বলে জঞ্জালের মধ্যেও নুটু ইঞ্জিনটার চরিত্র বিষয়ে নিঃসন্দেহ হল। লোহার দরেই ওটা সে কেনাল সাহেবদাদুকে দিয়ে। তারপর দিনের পর দিন মাসের পর মাস সে মেতে থাকল। শহরের সারাইখানা, কামারবাড়ি আর কাঠমিস্ত্রিদের সঙ্গে সমানে গতর দিয়ে লড়ে এই গাড়ি সে তৈরি করেছে। নুটুই গাড়ির সব, ড্রাইভার ক্লিনার মেকানিক সব কিছু।
এই গাড়ি না হওয়া পর্যন্ত শহর থেকে বাচ্চাদের আনা যেত না। মধুবাবুর ঘোড়ার গাড়ি চেপে পাঁচ-সাত জন যা আসত, বাকিরা এখানে থাকত। বাকি বলতে জনা তিরিশ ছাত্র। এখন আরও বিশ-পঁচিশ বেড়েছে, দু-দশ জন মাইল দেড়-দুই দূর থেকে হেঁটেও আসে।
মজার গাড়ির সবটাই মজা। তার হাত-পা গুটোনো, কচ্ছপের মতন একটা খোলা আছে পিঠে, ভেতরে তিনটে সরু লং বেঞ্চ, জানলার ফুটোয় ক্যাম্বিসের পরদা গুটোনো থাকে। গাড়িটা ফট ফট শব্দ করে, ধোঁয়া ছাড়ে চিমনির মতন, তার সারা গা নড়ে, বিচিত্র স্বর আওড়ায় সর্বদা, চলতে গেলেই বাঁয়ে হেলে পড়ে, ডাইনে দোল খায়–তবু গাড়িটা চলে।
এই গাড়ি নিয়ে নুটু ভোরের কাক ডাকতেই ছেলেমেয়ে আনতে যাত্রা করে দেয়। পনেরো মিনিটের পথ, হাতে আরও বাড়তি একঘণ্টা সময় নিয়ে বেরোয়। বাধা-বিপত্তি তো থাকবেই। যত রকম কলকবজা যন্ত্রপাতি যাবতীয় গাড়ির মধ্যে সিটের নীচে মজুত নুটুর।
শহরে ঢুকে–ঢাকার ঠিক মুখেই শান্তি কুটিরের সামনে গিয়ে গাড়িটাকে প্রথমে দাঁড় করিয়ে দেয় নুটু।
জানলা দিয়ে গলা বাড়ায় তুষার দিদিমণি। কোনওদিন সবে ঘুম ভেঙে উঠেছে, ফোলা-ফোলা চোখ, এলোমেলো চুল। মুখ বাড়িয়ে সকালের প্রথম মিষ্টি হাসিটুকু হেসে হাত নেড়ে বারান্দায় এসে বসতে বলেছে তুষার দিদিমণি, তারপরই জানলা ফাঁকা।
নুটু গাড়ি থেকে নেমে শান্তি কুটিরের কাঠের ফটক খুলে বাগানে ঢুকেছে। বাগানে কয়েকটি গাছ, কিছু দেশি ফুল, যখন যা ফোটে। নুটু জানে বলেই বেছে বেছে কয়েকটি ফুল তুলে নেয়। তারপর বারান্দার ছোট সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সূর্য-ওঠা-সকাল দেখে। একটু পরেই একগ্লাস চা আসে ভেতর থেকে, কামিনীঝি দিয়ে যায়। নুটুর এটা বাঁধা।