০২.
কলকাতা শহর নাকি ইন্দ্রপুরী। আমার কাছে শহরটা কিছুদিন কাঠ হয়ে থাকল। চারপাশে কেবল যেন ফাঁকা ফাঁকা। আমি এই শহরের কথা বুঝতে পারতাম না। এখানের সব কিছুই আমাকে অবাক করত। মনে হত, সমস্ত শহরটা বিরাট এক তাঁবুর তলায় সার্কাসের খেলা দেখাচ্ছে।
০৩.
হাঁদুবাবুর বস্তিতে ওরা আমার কাছ থেকে এক মাসের ভাড়া আগাম নিয়ে নিয়েছিল। কাশীর গলির চেয়েও বস্তিটা ঠাণ্ডা, অন্ধকার, দুর্গন্ধভরা। ঠিক কত যে লোক থাকত এই বস্তিতে আমি কিছুতেই ঠাওর করে উঠতে পারিনি। ভোর হবার আগে থেকে মানুষের গলার স্বর শুনতে পেতুম, রাত বারোটার পরও বস্তিটা চুপ হত না। যারা কথা বলত, তারা কি মেয়ে কি মন্দবাই যেন গলার সহজ স্বর হারিয়ে ফেলেছে। কেমন কর্কশ, ভাঙা, ফাঁপা সুর গলায়। আমার মনে হত, এদের বুকে অনেক বুঝি শ্লেষ্ম জমা হয়েছে।
০৪.
মাঝে মাঝে মনে হত, কাশী ফিরে যাই। কিন্তু ফিরে যেতে পারতাম না। মানুষ একবার যা ফেলে আসে সহজে সেখানে আর ফিরে যেতে পারে না। কলকাতা আসার সময় আমার মনে একটা জীয়ন্ত ফুলের চারা যেন মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে নাচছিল, হু হু করে বাড়ছিল; কলকাতায় আসতে না আসতেই সেই চারা কে যেন উপড়ে ছিঁড়ে টান মেরে ফেলে দিল।
০৫.
গ্যাসবাতির আলোয় একদিন নিজের ছায়া দেখলুম। ছায়াটা রাস্তার ধার বয়ে দেওয়ালে পেচ্ছাপখানার ওপর তালপাতার ভূতের মতন পড়েছিল। যেন আমার পা গা মেরুদণ্ড মুখ মাথা বলে আর কিছু নেই। ছায়াটা বেশিক্ষণ দেখতে পারলাম না, কেমন একটা ভয় হল হঠাৎ। হন হন করে হেঁটে গলি ধরে ভেতরে চলে এলাম অনেকটা। দাঁড়ালাম হঠাৎ। গলি আরও সরু হয়ে পথ বন্ধ হয়ে গেছে। লম্বা মতন এক বাড়ির তলায় দাঁড়িয়ে দুটো মেয়ে সিগারেট খাচ্ছিল ভাগাভাগি করে। অনেক খড়িগুড়ো আর আলতা ওদের মুখে, কপালের টিপ জোনাকির মতন পিটপিট করছে। আচমকা আমার মনে হল, সত্যি কি আমার শরীরটা ছায়া হয়ে গেছে? আস্তে আস্তে একটি মেয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, রেল স্টেশনের টিকিটঘরে যেমন করে মানুষ টিকিটের টাকা গুণে দেয়, আমি ঠিক সেইভাবে ওর হাতে টাকা গুণে দিলাম। আর টাকা গুণে দিয়ে আমি এমন এক টিকিট কিনলাম যে-টিকিট আমায় ছায়া থেকে মাংস ও রক্তের ঠিকানায় নিয়ে যাবে।
০৬.
একটা বাচ্চা ককিয়ে ককিয়ে কাঁদছিল। ঘুম ভাঙল আমার। ফরসা হয়েছে। ভাঙা খড়খড়ির জানালার ওপারে বাচ্চাটা কাঁদছে। এপারে আমরা। আমি আর গোলাপ। গোলাপ মুখ থুবড়ে হাত ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে, ঠিক যেন মরা জন্তু। দিশি মদের বোতলটা গড়িয়ে গড়িয়ে গোলাপের বাসনের কাছ-পর্যন্ত চলে গেছে। বাচ্চাটা কাঁদছিল। …গোলাপকাল বলছিল, তার একটা ছেলে হয়েছিল একবার। মা মা বলতে শেখার পর মাত্র দুটো দাঁত নিয়ে মরে গেছে।
০৭.
গোলাপকে জাগিয়ে দিয়ে আমি চলে আসছিলাম। গোলাপ শুধোল, আবার কবে আসা হবে? কথার কোনও জবাব দিলাম না। একটু হাসি হাসি মুখ করলাম শুধু। ..আর আসা হবে না। আমি কেন এসেছিলাম গোলাপ জানে না। গোলাপের জন্যে খরচ করার মতন পয়সাও আর আমার নেই।
০৮.
বইয়ের দোকানের চাকরিটা আমায় সহদেবদাই দিয়েছিল। কেন দিয়েছিল জানি না। ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াই তখন চিৎপুরের রাস্তায়, কাশী থেকে আনা পুঁজি ফুরিয়েছে; পকেট মেপে একবেলা চিড়ে মুড়ি খাই অন্যবেলা উপোস। একদিন সন্ধে তখন উতরে গেছে, শ্রাবণের ধরা বৃষ্টি আবার এল হুড়মুড় করে। রাস্তা থেকে উঠে দোকানের সরু বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। চিৎপুরের রাস্তা জলের ঝাঁপটা খাচ্ছে সকাল থেকেই, মাগুর মাছের মতন কালো পিছল তার চেহারা, বাতিগুলিতে তেমন রোশনাই নেই। অনেক পরে পরে ঠং ঠং করে ঘন্টা বাজিয়ে জানলা-আঁটা ট্রাম এক-আধটা যাচ্ছিল। বৃষ্টি আর ধরে না। কানে গেল, দোকানের মধ্যে বসে কে যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পালা পড়ছে। এ আমার চেনা পালা, শোনা পালা। ছেলেবেলায় শুনেছি, ইন্দ্রদের কাছে থাকবার সময় গাঁ-গ্রামে এ-পালা কতবার গেয়ে গেছে যাত্রার দল। বারান্দা ছেড়ে দোকানের চৌকাঠে এসে দাঁড়ালাম। সহদেবদা পালা পড়ছে–দোকান ফাঁকা। …কখন যেন আমি ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছিলাম সহদেবদাও পালা পড়তে পড়তে হঠাৎ আমায় দেখতে পেয়ে থেমে গেল। কী চাই? সহদেবদা শুধোল। চটক ভাঙল আমার, আধভেজা চেহারা, মুখ ভর্তি দাড়ি, চিট ময়লা জামাকাপড়। ভয় হল, আমায় না চোর ভাবে। তাড়াতাড়ি ঢোঁক গিলে বললাম, পালা কিনব। .কোন পালা? আপনি যেটা পড়ছিলেন। সহদেবদা একটুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল, আমি কোন পালা পড়ছিলাম? কর্ণার্জুন। .সহদেবদা সামান্যক্ষণ আর কথা বলল না, হাঁ করে চেয়ে চেয়ে আমায় দেখল। তারপর একটা বিড়ি ধরিয়ে নিয়ে বলল, কর্ণের বাপের নাম কী? …আমি থতমত খেয়ে গেলাম। সহদেবদা সরাসরি চেয়ে আছে, আমার দিকে। শেষে ঘাবড়ে গিয়ে বলে ফেললাম, সূর্যদেব। সহদেবদা শুনল, বিড়িতে টান দিল জোরে জোরে। তারপর বলল, কর্ণর বাবার নাম নারায়ণচন্দ্র শীল। আমি কর্ণ বলে খ্যাপার মন হা হা করে হাসতে লাগল সহদেবদা। এমন হাসি আমি আর শুনিনি। হাসিটা যেন দপ দপ করে হলকা তুলে জ্বলছিল। আমার মনে পড়ল, কাশীতে একজন ম্যাজিক দেখাত, একগলা স্পিরিট খেয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে হাসত, মুখ খুললে আগুন জ্বলত, বন্ধ করলে নিবত।