শীতের শেষবেলা দেখতে দেখতে মরে এল, আলো নিস্তেজ ও নিষ্প্রভ হল। বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে ঘরে এসে পোশাক বদলে নিল অমল। গরম পুল- ওভারটা পরার সময় দেখল, বাইরে ছায়া জমেছে, পাতলা অন্ধকার ক্রমশ ঘন হয়ে এল।
ভ্রমর বোধ হয় অপেক্ষায় বসেছিল। অমল ঘরে ঢুকে দেখল, আয়া ঘর পরিষ্কার করে বিছানা পেতে চলে গেছে। ঘরটা মাঝারি ধরনের, দু-বোনের দুটি বিছানা দু-পাশে, পড়ার টেবিল একটা, গোটা-দুই চেয়ার; একপাশে কাঠের ছোট আলমারি, আলনায় দুই বোনের কাপড়জামা গোছানো, ড্রয়ারের মাথায় আয়না লাগানো, টুকটাক কিছু খুচরো জিনিস সাজানো রয়েছে।
অমল বলল, “দেখতে-দেখতে কেমন সন্ধে হয়ে এল। এখন যেন আরও তাড়াতাড়ি অন্ধকার হয়ে আসে।”
বিছানার ওপর অলসভাবে বসেছিল ভ্রমর। তার মুখ চোখ সকালের মতন অবসাদে ময়লা নয়, কালো শুকনো চুলগুলি আঁট করে বাঁধা, শাড়ি জামা গোছানো। তবু শুকনো ও মলিন ভাবটুকু মুখে পাতলা ছায়ার মতন লেগে আছে। মনে হচ্ছিল, ভ্রমর সকালের চেয়ে এখন অনেকটা ভাল।
ভ্রমর সামান্য গুছিয়ে বসল। তার পিঠের দিকের জানলা দিয়ে বাতাস আসছিল বলে গায়ের গরম চাদর ঘন করে জড়িয়ে নিল।
অমল বলল, “জ্বর দেখেছিলে?”
“না।” ভ্রমর ছোট করে জবাব দিল।
“না কি! তখন যে বললে—”
“সেরে আসছে!…এখন বেশী জ্বর নেই।”
“তবু জ্বর দেখা উচিত—” অমল এগিয়ে গেল, “কই, হাত দেখি—”
ভ্রমর সঙ্কোচ অনুভব করল বুঝি। বলল, “কাল সকালে আর জ্বর থাকবে না। তুমি বসো।”
অমল ভ্রমরের হাত স্পর্শ করে দেখল, কপালে হাত দিল। মনে হল, জ্বরটা কমছে। ভ্রমর চুপ করে বসে থাকল। এ-সময়, যখন অমল তার কপালে হাত রেখেছিল, তখন ভ্রমরের বুকের মধ্যে কেমন যেন ভার হয়ে আসছিল।
“জ্বর কম।” অমল বলল। বেশ বিচক্ষণ ডাক্তারের মতন তার ভাবভঙ্গি। জ্বর দেখা হয়ে গেলে অমল ভ্রমরের মুখোমুখি হয়ে তার পায়ের দিকে বসল। ভ্রমর আরও একটু পা গুটিয়ে নিল।
সামনে জানলা; অমল জানলার দিকে তাকিয়ে বাইরের সন্ধে দেখতে দেখতে হঠাৎ বলল, “নতুন জায়গায় সন্ধেবেলা কেমন যেন লাগে, না ভ্রমর!…মন কেমন করে।”
ভ্রমর কথাটা বোঝবার জন্যে অমলের মুখ লক্ষ করল। ওকে অন্যমনস্ক, উদাস লাগল বুঝি। ভ্রমর ভাবল, বাড়ির জন্যে বোধ হয় অমলের মন কেমন করছে। বলল, “বাড়ির জন্যে মন খারাপ লাগছে!”
“বাড়ি! না, বাড়ির জন্যে নয়।” বলে অমল জানলা থেকে ঝোখ সরিয়ে ভ্রমরের দিকে তাকাল। এমরের মুখটি ছোট, কপাল সরু, গাল দুটি পাতার মতন, চিবুক একেবারে প্রতিমার ছাঁদ। রঙ শ্যামলা। ঘন টানা টানা ভুরুর তলায় কালো কালো ডাগর দুটি চোখ। পাতলা নাক, পাতলা ঠোঁট। মানুষের মুখ দেখলে এত মায়া হয়—অমল জনত না। ভ্রমরের মুখ দেখে অমলের কেন যেন মনে হয়, এমন মুখ আর সে দেখে নি। ফুলের মত ভাল। সুন্দর, দুঃখী, শান্ত মুখ।
অমলের হঠাৎ কেন যেন মনে হল, ভ্রমরের জন্যেই তার মন কেমন করছে।
“বাড়িতে চিঠি লিখেছ?” ভ্রমর জিজ্ঞেস করল।
“উঁ! চিঠি! হ্যাঁ, লিখেছি। আজ রোববার, পোষ্টঅফিস বন্ধ।” বলে অমল কি ভেবে হাসি-ভরা মুখ করে বলল, “বাড়িতে থাকলে আজ দু-দুটো কাপড় পেতাম; খুব খাওয়াদাওয়া চলত।”
“কেন?”
“বা রে, আজ ভাইফোঁটা। ভাইফোঁটায় কিছু পাওয়া যায়।” অমলের হঠাৎ বুঝি মনে হল ভ্রমর হয়ত ভাইফোঁটা বোঝে না। বলল, “ভাইফোঁটা কাকে বলে তুমি জানো?”
“দেখেছি।”
“তবে ত জানোই। কালীপুজোর পর পরই ভাইফোঁটা।” কালীপুজোর কথাতেই বোধহয় অমল কি ভেবে আচমকা বলল, “ভ্রমর, তুমি…তুমি খুব ভগবান বিশ্বাস করো, না—?”
ভ্রমর যেন কিছুক্ষণ কেমন অবাক হয়ে থাকল। তারপর ঘন চোখ তুলে বলল, “ভগবান বিশ্বাস না করলে পাপ হয়। যীশু ভগবানে বিশ্বাস রাখতে বলেছেন।”
বলে ভ্রমর অন্ধকারে দেওয়ালের দিকে তাকাল। যীশুর ছবি ছিল দেওয়ালে।
অমল অভিভূতের মতন বসে থাকল।
৩
সন্ধ্যাবেলায় বসার ঘরে আনন্দমোহন ও হিমানী বসেছিলেন। অমলরা এইমাত্র এসে বসল; বেড়াতে বেরিয়েছিল, সবে ফিরেছে।
আনন্দমোহন মাঝখানের সোফায় বসে; বিশ্রাম-সুখ উপভোগের শৈথিল্য তাঁর সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে আছে। নতুন ইলাস্ট্রেটেড উইক্লির পাতা ওলটাচ্ছিলেন অলসভাবে, অমলদের পায়ের শব্দে মুখ তুলে দেখলেন।
“কতদূর গিয়েছিলে?” আনন্দমোহন জিজ্ঞেস করলেন। তাঁর ডান হাতের আঙলে সিগারেট পুড়ছিল।
প্রশ্নটা কাকে করা হল কেউ বুঝল না। অমল, ভ্রমর, কৃষ্ণা—তিনজনের যে কোনো একজনকে করা চলতে পারত। অমলই জবাব দিল, “এই কাছেই বেড়াচ্ছিলাম, রাস্তায়—।”
আনন্দমোহন সিগারেটের ছাই ফেলে একমুখ ধোঁয়া গলায় নিলেন। “এখানকার কিছু দেখলে? মিউজিআমে গিয়েছিলে?”
“না। যাব।”
“যাও একদিন, দেখে এসো। মিউজিআমটা ছোট, রিসেন্টলি হয়েছে; তবু দেখা উচিত। মুসলিম এজের কয়েকটা আর্ট-ওয়ার্ক আছে দেখার মতন—” কথাটা শেষ করে উনি ভ্রমরের দিকে তাকালেন। “তোরা এখানকার গাইড, ওকে কোথাও নিয়ে যাস না কেন?” হাতের কাগজটা নামিয়ে রেখে দিলেন সামনে।
ভ্রমর সামান্য তফাতে দেরাজের কাছে দাঁড়িয়েছিল। সোফায় আড়াল পড়ায় তার সামান্য বাঁকা হয়ে দাঁড়ানো ভঙ্গিটা নজরে পড়ছিল না। ভ্রমর কথাটা শুনল, বাবার দিকে তাকিয়ে থাকল দু-পলক, কোনো জবাব দিল না।
“এখানে দেখার জিনিস নানারকম—” আনন্দমোহন অমলের দিকে তাকালেন আবার, যেন কি-কি দেখা দরকার তার বিবরণ দিচ্ছেন এমন গলা করে বললেন, “জল-চাঁদমারি দেখেছ? আমাদের এখানের ওল্ড প্যালেসে যাও একদিন, প্যালেস কম্পাউণ্ডের মধ্যে জু আছে একটা, ভ্যারাইটি অফ বার্ডাস্ দেখবে। এ ছাড়া, ওল্ড টাওয়ার—একশো দেড়শো বছরের পুরনো, ভেঙেচুরে জঙ্গল হয়ে পড়েছিল, আজকাল সারিয়ে-টারিয়ে বেশ করেছে। তা কম উঁচু নয়, দু-আড়াইশো সিঁড়ি; আমি বাবা উঠতে পারি নি, বয়স হয়ে গেছে, এখন কি আর…” আনন্দমোহন প্রবীণত্বের স্মিত হাসি হাসলেন।