আকাশে চাঁদ রয়েছে। জ্যোৎস্না রাত্রি। কুয়াশা এবং হিম চাঁদের আলো শুষে রেখেছে। খুব পরিষ্কার নয়, জ্যোৎস্না, মরা-মরা লাগছিল, মলিন আয়নার কাচের মতন। কনকনে শীত, বাতাস যেন গা গুটিয়ে বসে পৌষের প্রখর ও শুকনো ঠাণ্ডাকে জমে উঠতে দিচ্ছিল।
ভ্রমরকে যথাসাধ্য সাবধানে বেরুতে হয়েছে, যাতে ঠাণ্ডা না লাগে তার জন্যে বাবা নিজেই একশোবার করে এক কথা বলেছে: তুই সোয়েটারের ওপর লং-কোট পরবি, তুই পুরো মোজা পরবি, স্কার্ফ নিবি—মাথা কানে যেন ঠাণ্ডা না লাগে, ট্রেনে ঠাণ্ডা লাগবে খুব। ভ্রমর গরম সব কিছুই পরে বেরিয়েছে: ভেস্ট, গরম কোট, মোজা—বাদ দেয় নি কিছু। গাড়িতে ওঠার সময় হিমানীমা’র কথায় মাথার স্কার্ফও বেঁধে নিয়েছে।
মোতি রোডে গাড়ি ওঠার পর মনে হল, গাড়ির চাকা আরও অক্লেশ হল, ঘোড়ার কদম জোর পেল।
ভ্রমরই কথা বলল প্রথমে। বলল, কারণ, অমল একেবারেই চুপচাপ ছিল, সারাদিনই প্রায় চুপচাপ থেকেছে, বিকেল থেকে তাকে অনেকক্ষণ ভ্রমর বাড়িতে দেখতে পায় নি, অমল রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ভ্রমরের ভাল লাগে নি। এভাবে অমলকে রেখে যেতে, ছেড়ে যেতে তার খুবই কষ্ট হচ্ছে; তবু যখন উপায় নেই, যখন ভ্রমর একটা দরকারী কাজে যাচ্ছে—ডাক্তার দেখাতে, তখন অমলের খানিকটা বোঝার মন ও সহ্য করার শক্তি থাকা উচিত ছিল। কি রকম ছেলে-মানুষ! আমি না-হয় আগে যাচ্ছি, নয়ত আর ক’দিন পরে তুমিও ত যেতে, তখন কি ভ্রমর এইরকম করত, করলে তোমার কেমন লাগত বল! সন্ধেবেলায় অমলের সঙ্গে এক ফাঁকে দেখা হলে ভ্রমর বলেছে কথাটা ‘তুমি এরকম করছ কেন, ছেলে-মানুষের মতন! দুঃখ যেন নিজেরই, আর কারও নয়, না—! যখন তুমি যাবে আমিও এইরকম করব—একবারও কাছে আসব না।’
বাড়ি থেকে বেরোবার সময় ভ্রমরের নিজের মনও বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। হওয়া স্বাভাবিক; সে আগে আর কখনও এমন করে বাড়ির বার হয় নি। তা ছাড়া, মানুষের আচরণ এক ধরনের অর্থ বোঝায়। বাবা, হিমানী-মা এবং অমলের ব্যবহার থেকে ভ্রমর অনুভব করতে পারছিল, কোথাও যেন কিছু একটা ঘটেছে। এতকাল বাবা তার ব্যাপারে খুব একটা গা দিয়ে কখনও কিছু করে নি, হচ্ছে হবে, চলছে চলুক করে কাটিয়েছে, এখন একেবারে অতিব্যস্ত। কেন এত ব্যস্ত? কেন হিমানী-মা তার ওপর হঠাৎ মায়া মমতা দেখাতে শুরু করল? হিমানী-মা অবশ্য বাবার মতন ব্যস্ত ভাব দেখাচ্ছে না, মাথা গোলমাল হয়ে যাবার মতন ছটফটে ব্যবহারও কিছু করে নি। তবু, হিমানী-মা’র সামান্য কিছু, কথা, জিনিসপত্র গোছগাছ করে দেবার চেষ্টা থেকে, চোখ এবং মুখের ভাব থেকে বোঝা যাচ্ছিল, ভ্রমরের অসুখের ধাত নিয়ে এই একটা কি দেড়টা দিন মা বিরক্ত নয়। বরং এমন কথাও মা বলেছে যা মানুষ মায়া-মমতা অনুভব করেলেই বলে। হিমানী-মা আজ সন্ধের মুখে-মুখে একবার প্রমরকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গিয়ে কৃষ্ণার ঘরে বসেছে। তখন কৃষ্ণা ঘরে ছিল না। চুপচাপ একটু বসে থাকার পর হিমানী-মা বলল, ‘দূরে যাচ্ছ, একা থাকবে—ভয় পেও না, মন খারাপ করো না, বুঝলে।…প্রভুকে সব সময় মনে করো। তিনিই মানুষের সবচেয়ে বড় সঙ্গী, রোগ বল দুঃখ বল, তাঁর চেয়ে বড় ভরসা আর নেই। এই বলে হিমানী-মা চোখ বন্ধ করে বসে থাকল কিছুক্ষণ, যেন প্রার্থনা করল মনে-মনে, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ভ্রমরের মাথায় একটু, হাত ছুঁইয়ে রাখল, ‘সাবধানে থেকো, মন ভাল রেখো।’…হিমানী-মা’র ব্যবহার এবং কথাবার্তায় ভ্রমরের তখন মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। হয়ত সে কেঁদে ফেলত, অনেক কষ্টে সামলেছে। কিন্তু ভ্রমরের কেমন সন্দেহ হল, হঠাৎ হিমানী-মা এত আদর-যত্ন করে কথা বলছে কেন? কেন এত উপদেশ দিচ্ছে? ডাক্তারের কাছে অসুখ-বিসুখ দেখাতে গেলে মানুষ কি এই-রকম করে? তবে? …অমলের ব্যবহারও ভাল লাগছিল না ভ্রমরের। অমল সারাক্ষণ আড়াল-আড়াল হয়ে থাকছে। মুখ শুকনো, করুণ, কেমন যেন নিষ্প্রাণ; চোখ দুটি উদাস, চোখের তলায় জল জমে থাকার মতন ভিজে-ভিজে। ভ্রমর বুঝতে পারছিল না, এই অমলই এতদিন তাকে বড় ডাক্তারের কথা, জব্বলপুর যাবার কথা বলেছে; বলেছে ভ্রমরের শরীর ভাল করা উচিত, ভ্রমরের অসুখ সারাবার জন্যে তার কত আগ্রহ ছিল, অথচ আজ যখন ভ্রমর শরীর থেকে রোগ তাড়াতে চলেছে তখন অমল একটুও সুখী নয়, সান্ত্বনা দিচ্ছে না, আশা-ভরসার কথা বলছে না। কেন? অমল কেন এতটা মুষড়ে পড়েছে?
ভ্রমর তার সন্দেহ এবং আশঙ্কার কথা ক্ষীণভাবে জানাল এবার। সে স্পষ্ট করে কিছু বুঝছিল না, জানতে পারছিল না বলেই, এখন—গাড়িতে উঠে, যেতে-যেতে, অমলকে খুব কাছে এবং একা পেয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করল, প্রথম কথা বলল, “আমার কি হয়েছে বল ত?”
অমল রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এখন পর্যন্ত সে ভ্রমরের দিকে চোখ তুলে তাকায় নি, একবার বুঝি তাকিয়েছিল—গাড়ি যখন মোড় ঘুরে মোতি রোডে উঠল। ভ্রমর টাল খেয়ে পড়ে যায় কি না, ঝুঁকে পড়ে কি না দেখছিল। ভ্রমর সামান্য দলে আবার সোজা হয়ে বসায় অমল চোখ ফিরিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকল। গাড়ি চলছিল।
ভ্রমরের কথা কানে গিয়েছিল অমলের, তবু, সে মুখ তুলল না, তাকাল না।
সামান্য অপেক্ষা করে ভ্রমর অমলের গায়ে হাত রাখল, “এই—!”