অমলের ভাল লাগছিল না। তার মনে হচ্ছিল, ভ্রমর যেন কাল কিংবা পরশু এ-বাড়ি ছেড়ে নাগপুরের হাসপাতালে চলে যাবে। নাগপুর কোথায়, কতদূরে, অমল জানে না; সেখানের হাসপাতাল কেমন কে জানে; ভ্রমরকে সেখানে কি করা হবে, ভ্রমর কেমন থাকবে—অমল কিছু দেখতে পাবে না, না, জানতে পারবে না। অমলের চোখের আড়ালে কি ঘটবে সে কল্পনা করবার চেষ্টা করল, পারল না; বরং নানারকম ভীতিকর দুশ্চিন্তা এসে তাকে আরও আকুল করে তুলল।
দুপুরবেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে অমল ভ্রমরের হোম সাইন্স-এর বই দেখল, কিছু, পেল না। মেসোমশাইয়ের ঘর থেকে চেম্বার্স ডিকশনারী এনে ঘাঁটল। বানান না-জানা থাকায় কতক্ষণ যে ঘাঁটতে হল অভিধান! শেষে শব্দটা পেল। অমল বুঝল, এ-রোগে মানুষের শরীরের শ্বেত রক্তকণিকা খুব বেড়ে যায়। অমল জানত, শরীরের রক্তে লাল এবং সাদা দু-রকম রক্তকণিকা থাকে; কিন্তু সে জানত না এদের কমাবাড়ায় কি ক্ষতি হতে পারে। তার জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, জানাবার লোক ছিল না। তার মনে হল, হয়ত এমন হতে পারে, রক্ত আর রক্ত থাকে না, শ্বেতকণিকায় ভরে যায়। অমলের ভয় হল ভাবতে। সে আর ভাবতে চাইল না।
দুপর পেরিয়ে বিকেল হয়ে গেলে অমল মেসোমশাইয়ের চেহারা দেখে ভয় পেল। মেসোমশাইকে খুব উদ্ভ্রান্ত এবং বিহ্বল দেখাচ্ছিল। তাঁর চোখ মুখ যেন ক্রমশ বসে আসছে, উদ্বেগের আঁচড়গুলি ওঁর মুখের সদাপ্রসন্নতা ও হালকা ভাবটি সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলেছে। হিমানীমাসিকেও বিকেল থেকে আরও গম্ভীর চুপচাপ দেখাচ্ছিল। এবং বিকেল থেকেই বেশ বোঝা গেল, এই বাড়িতে খুব অদৃশ্য-ভাবে একটি অস্বস্তিকর ভীত উদ্বিগ্ন আবহাওয়া নেমে এসেছে।
মেসোমশাই বিকেল ফুরিয়ে যাবার পর-পরই যেন কোথায় বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। অমল লক্ষ করল, তিনি খুব অন্যমনস্ক ও ব্যস্ত হয়ে আছেন। অমল এই সময় ভয়ে-ভয়ে একবার জিজ্ঞেস করল, “ভ্রমরের কি অসুখ, মেসোমশাই?” আনন্দমোহন বললেন, “খুব খারাপ অসুখ, বাবা। মেয়েটার কি হবে কে জানে! ওই আমার একটি মাত্র মেয়ে।” বলতে-বলতে আনন্দমোহন বরঝর করে কেঁদে ফেললেন। তারপর অমল বুঝতে পারল উনি ডাক্তারবাড়ি যাচ্ছেন। এ-বাড়ির গোপন উদ্বিগ্নতার মধ্যেই সন্ধে নামল। সন্ধের পর ওরা তিনজনে বসে ক্যারাম খেলছিল—অমল, কৃষ্ণা, ভ্রমর। অমল খেলতে পারছিল না। তার মন ছিল না খেলায়, চোখও ছিল না। ক’বারই হারল। খেলা শেষ হয়ে গেলে কৃষ্ণা উঠে গেল।
ভ্রমর বলল, “তুমি আজ খুব ভাল ছেলে হয়ে গেছ! সারাদিন চুপচাপ।”
অমল জবাব দিল না। আজ সারাদিন সে ভ্রমরকে এড়িয়ে-এড়িয়ে থাকছে। ভ্রমরের কাছে আসতে তার সাহস হচ্ছিল না, যদি ভ্রমর তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে ডাক্তারবাবুর কথা, তবে অমল কি বলবে! বা অমলও যদি বোকার মতন আচমকা বলে ফেলে ভ্রমরকে অসুখের কথা—তবে?” কে জানে, কাছাকাছি থাকলে অমল কি বলে বসবে, কিংবা অমলের মুখ দেখে ভ্রমর কি বুঝবে—এইসব চিন্তা করে অমল, একটু, দূরে-দূরেই কাটিয়েছে।
এখন ভ্রমরের কথায় অমল হঠাৎ বেশ ভয় পেল, তার বুক কাঁপল; সে ভাবল, ভ্রমর এখুনি তাকে অসুখের কথা জিজ্ঞেস করবে। ভ্রমর যাতে সে সুযোগ না পায় অমল তাড়াতাড়ি অন্য কথায় চলে গেল। “কাল নতুন বছর পড়ছে—নিউ ইয়ার্স ডে। কাল তোমরা কি করবে?”
ভ্রমর অমলকে দেখছিল। ওর চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার নয়। ভ্রমর বলল, “কাল সকালে তা বলে আমি তার গানটান গাইছি না; তুমি খুব ঘুমিয়ো।”
অমল, মুখ তুলল। কথাটা তার কানে ঠাট্টার মতন শোনাল না। কি বলবে বুঝতে না পেরে অমল বলল, “কেন? নতুন বছরে তোমাদের গান নেই?”
“আছে; অনেক আছে—” ভ্রমর বলল, তারপর অল্প সময় থেমে খুব মৃদু, জড়িত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি জানো না?”
“কি?”
“কাল বাবা আমায় নিয়ে নাগপরে যাচ্ছে।”
“কা-ল?” অমল চমকে উঠল যেন।
“মা বলেছে, কাল। কখন যাওয়া হবে জানি না, রাত্তিরে বোধ হয়।”
অমল স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকল। যেন সে ভ্রমরের মুখের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে তার অজ্ঞাত অতি দূর কোনো শহরের একটি ভীষণ বড় হাসপাতালের স্তব্ধ নির্জন একটি কক্ষ দেখছিল। ভ্রমর হাসপাতালের সাদা কনকনে বিছানায় শুয়ে আছে। তার লাল রক্তকণাগুলি প্রতি মুহূর্তে যেন ফুরিয়ে আসছে। অমলের মখে কেমন ভেঙে আসছিল। কান্না এসে তার গাল ও ঠোঁটের মাংস কুঁচকে দুমড়ে দিচ্ছিল। ঠোঁট কাঁপছিল।
ভ্রমর বলল, “আমি ফিরে না-আসা পর্যন্ত তুমি থেকো, থাকবে না?”
মাথা হেলিয়ে অমল বলতে যাচ্ছিল, হ্যাঁ, সে থাকবে, কিন্তু তার আগেই অমল ছেলেমানুষের মতন কেঁদে উঠল।
১১
গাড়ি দুটো চলতে শুরু করেছিল। সামনের টাঙায় আনন্দমোহন আর কৃষ্ণা, পেছনে ভ্রমর ও অমল। মালপত্র বেশী নেই, তবু, দুটো সুটকেশ, বাস্কেট, টুকিটাকি আরও কিছু, আনন্দমোহনরা নিয়েছেন, ভ্রমরদের টাঙায় মোটা হোল্ডঅল আর বেতের টুকরিটা কোচোআনের পাশে বসানো রয়েছে। ভ্রমরকে স্বাচ্ছন্দ্য দেবার জন্যে এখন সবাই ব্যস্ত; এমন কি মেসোমশাই বার বার বলা সত্ত্বেও হিমানীমাসি ভ্রমরকে গাড়িতে উঠিয়ে দেবার সময় অমলকে বললেন, একটু সাবধানে নিয়ে যেও।
কটেজগুলো ছাড়িয়ে গাড়ি মোতি রোডে পড়ল। সামনের টাঙাটা সামান্য এগিয়ে আছে, বিশ পঁচিশ গজ হবে হয়ত। এখন সাড়ে সাতটা সন্ধে, আটটা পঞ্চাশে ট্রেন; স্টেশনে পৌঁছতে সোয়া আটটা হবে।