ভ্রমর চলে গেল। অমল সামনে থেকে সরে এল। তার মনে হল, সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত হবে না। সরে এসে টবের কাছে দাঁড়াল, মেসোমশাইদের পিছন দিকে।
মজুমদারডাক্তার এবার বাকি চা শেষ করলেন আস্তে আস্তে। আনন্দমোহন সিগারেট দিলেন, সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া টানলেন মজুমদারডাক্তার।
আনন্দমোহন বেশ উদ্বিগ্ন ও ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন, বললেন, “ইমপ্রুভড্ মনে হল না তোমার?”
মজুমদার কিছু বললেন না সঙ্গে-সঙ্গে, খানিকটা পরে বললেন, “খানিকটা।” তিনি আর কিছু বললেন না যদিও, তবু, তাঁর গাম্ভীর্য ও সহসা অবিচ্ছিন্ন নীরবতা কেমন কঠিন মনে হল। অদ্ভুত একটি আশঙ্কা অকারণে ঘনিয়ে আসছিল যেন।
অর্ধেকটা সিগারেট চুপচাপ শেষ করার পর মজুমদারডাক্তার এবার বললেন, “আপনি নাগপুরে যান একবার। যাওয়া ভাল।”
আনন্দমোহন উদ্বিগ্ন চোখে তাকালেন। হয়ত তিনি ভেবেছিলেন, মজুমদার নাগপুর যাবার কথা তুলবে না। হতাশ গলায় বললেন, “তুমি এখনও ইনসিস্ট করছ?”
“হ্যাঁ, আপনি যান।” মজুমদার আনন্দমোহনের চোখের দিকে তাকালেন, থেমে-থেমে বললেন, “আমি বড় ডাক্তার নই, বিশ্বাসদা। আপনি আমার উইকনেসও বুঝতে পারবেন। এ-রকম কেস হাতে রাখতে আমার ভয় হয়…”
“তুমি ত বল অ্যানিমিয়া।”
“কিন্তু ক্রনিক অ্যানিমিয়া ভাল না। আমি বোধ হয় গত এক দেড় বছর ধরে ভ্রমরের ট্রিটমেন্ট করছি। কখনও এটা, কখনও ওটা লেগেই আছে। ওষুধপত্রে অ্যানিমিয়া একটু কমে, ক’দিন পরে আবার। খুব কমপ্লিকেটেড হয়ে উঠেছে। ডাক্তারখানায় ওর সব ব্লাড রিপোর্ট-টিপোর্ট আমি কালও দেখেছি। বেটার টু টেক সম গুড অ্যাডভাইস।”
“খারাপ কিছু?” আনন্দমোহন বেশ ভয় পেয়ে গেলেন, “টিউবারকুলেসিস?”
“না, সে-রকম কিছু নয়।”
“তবে?”
“ঠিক করে কিছু বলা যায় না। তবে ভয় হয়, লিউকোমিয়ায় না গিয়ে দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত।”
“লিউকোমিয়া! সেটা কি?”
“রোগটা খারাপ, খুব ভয়ের রোগ; এ ডিজিজ অব ব্লাড; ব্রেকিং অফ রেড ব্লাড সেলস্—” মজুমদারডাক্তার সিগারেটের টুকরো ফেলে দিয়ে পা দিয়ে নিবিয়ে দিলেন। দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আপনমনে কথা বলার মতন করে বললেন, “ক্রনিক অ্যানিমিয়া, এনলার্জমেন্ট অফ দি স্প্লীন্ অ্যান্ড লিম্ফ্যাটিক প্লাণ্ডস মোটেই ভাল না।” চোখ ফিরিয়ে মজুমদারডাক্তার এবার অত্যন্ত সহানুভুতিবশে আনন্দমোহনের দিকে তাকালেন, আস্তে-আস্তে বললেন, “বিশ্বাসদা, আপনি আমার স্বজাতি, আমরা প্রবাসে রয়েছি; যদি আমার হাতে আপনার মেয়ের কিছু মন্দ হয়ে যায়, সে-আপসোস আমার যাবে না। আমি রিস্ক নিতে রাজী না। আপনার মেয়ে গেলে আপনারই বেশী যাবে। আপনি নাগপুরে যান, আমি ভাল ব্যবস্থা করে রেখেছি, চিঠিপত্র লেখালেখি করেছি।…হয়ত আমারই ভুল হচ্ছে রোগ বুঝতে। তবু যান একবার দেখিয়ে আসুন—”
আনন্দমোহন পাথরের মতন বসে, তাঁর মুখে খড়ির দাগ ফুটছে যেন, শুকনো বিবর্ণ দেখাচ্ছে। চোখের পলক পড়ছিল না, মুখ হাঁ হয়ে ছিল। ভীষণ ভয় পেলে মানুষ যেমন স্তম্ভিত হয়ে থাকে, আনন্দমোহন সেই রকম হয়ে গিয়েছিলেন।
বসে থাকতে বোধ হয় অস্বস্তি লাগছিল মজুমদারডাক্তারের। গলার শব্দ করে, চেয়ার সরিয়ে, সামান্য শুকনো করে কেশে উনি শেষ পর্যন্ত উঠলেন। বললেন, “কবে যাবেন ঠিক করে আমায় জানাবেন। যত আরলি হয়…! আমার রিপোর্ট আর একটা চিঠি দিয়ে দেব—”
মজুমদার চলে যাবার উদ্যোগ করতেই আনন্দমোহন ধরা বসা ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “মেয়েটা বাঁচবে না?”
মজুমদার দাঁড়ালেন। সামান্য সময়ের জন্যে তাঁর মুখ হঠাৎ খুব ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অত্যন্ত বিব্রত ও আড়ষ্ট হলেন। কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “মরা বাঁচা ভগবানের হাত।…তা বলে এখন থেকেই ভেঙে পড়বেন না। হয়ত আমার ভুল—” কথা শেষ না করেই মজুমদারডাক্তার বিদায় নিলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামলেন আস্তে-আস্তে, অন্যমনস্ক। মোটরবাইক ঠেলে ঠেলে ফটকের দিকে এগিয়ে গেলেন।
অমল কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পায়ের তলায় যেন মাটি নেই, সব ফাঁকা লাগছিল। অসাড়, স্পন্দনহীন। নিজের হাত-পা, মুখ—কোনো কিছু সে অনুভব করতে পারছিল না। চোখের সামনে রোদ-ভরা বাগান, গাছ, ফুল, পাতা সবই স্থির হয়ে আছে, কিন্তু অমল কিছু দেখতে পাচ্ছিল না, অত্যন্ত ধারালো এবং ধাঁধানো রোদে দৃষ্টি যেমন সহসা অন্ধ হয়ে যায়, অমলের সেই রকম লাগছিল।
ডাক্তারবাবুর মোটরবাইক যখন গেটের বাইরে গিয়ে হঠাৎ এঞ্জিনের তীব্র ও বিশ্রী একটা শব্দ তুলল, তখন অমল যেন তার চেতনা ফিরে পেল। সে কেঁপে উঠল হঠাৎ, পা কাঁপতে লাগল, হাতের তালুতে ঘাম জমেছে, বুক ধকধক করছিল।
মানুষের সমস্ত ভয় অন্ধকারে। অন্ধকার তাকে কোনো কিছু জানায় না, দেখায় না। অমল খুব ভয় পেয়েছিল। মজুমদারডাক্তারের কথাবার্তার ভঙ্গি থেকে সে অনুভব করতে পেরেছিল, ভ্রমরের কোনো কঠিন রোগ হয়েছে; মেসোমশাইয়ের মুখের ভাব দেখে সে বুঝতে পারছিল, উনি ভীষণ বিচলিত ও ভীত হয়ে পড়েছেন। ভ্রমর বাঁচবে কি বাঁচবে না—এই ভীষণ কথাটাও তিনি ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। ডাক্তারবাবুও সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে কথাটা এড়িয়ে গেলেন।
অসুখটা কি, কেমন তার চেহারা, কি হয় না-হয়, অমল কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। সাধারণ জ্বরজ্বালা, হাম, জল-বসন্ত এমন কি টাইফয়েড হলে অমল বুঝতে পারত; সে এ-সব দেখেছে এবং জানে। কিন্তু ভ্রমরের অসুখ তার জ্ঞানের বাইরে, কখনও সে শোনে নি নামটা, কি হয় না-হয় তার জানা নেই। তবু, অসুখটা যে ছোট বা সাধারণ নয় বোঝা যাচ্ছিল, নয়ত ডাক্তারবাবু, ভ্রমরকে ওভাবে নাগপুরের হাসপাতালে পাঠাবার জন্য জোর করতেন না; মেসোমশাইকে বলতেন না, “মেয়ে গেলে আপনারই বেশী যাবে…।”