অমল ভ্রমরকে ডাকতে চলল। সহসা তার আবার একটু ভাল লাগছে: যদি ভ্রমর না যায়, তার হাসপাতালে যাওয়া না হয়, তাহলে ভাল হয়। নাগপুরের হাসপাতালে গিয়ে ভ্রমর পড়ে থাকবে এই চিন্তা তাকে অত্যন্ত ক্লিষ্ট ও কাতর করছিল। সে ভেবে পাচ্ছিল না, ভ্রমর চলে গেলে সে এ-বাড়িতে একা থাকবে কি করে? তাকে এখনও দশ বারো দিন থাকতে হবে।
বসারঘরের মধ্যে দিয়ে যেতে-যেতে অমল হঠাৎ দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে দরজার মাথায় তাকাল। মেহগনি কাঠের সেই যীশু, মূর্তি। ভেন্টিলেটারের ফাঁক দিয়ে আসা আলো অনেক দূরে সরে গেছে। অমল অত্যন্ত কাতর হয়ে যীশুর কাছে মনে-মনে ভ্রমরের না-যাওয়া প্রার্থনা করল।
খাবারঘরে হিমানীমাসির পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। অমল ভ্রমরকে ডাকতে চুলল।
“ভ্রমর কোথায় মাসিমা?”
“দেখ, ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিল দেখলাম। কেন?”
“ডাক্তারবাবু, ওকে দেখবেন।”
“ও!”
অমল ভ্রমরের ঘরের দিকে পা বাড়াল।
ঘরের সামনে রোদে ভ্রমর দাঁড়িয়ে ছিল। চুল খুলেছিল। ওর পায়ের কাছে তার বেড়াল ঘুরঘুর করছে।
অমল বলল, “তোমায় বাইরে ডাকছে।”
“আমায়! কে ডাকছে?”
“ডাক্তারবাবু। মেসোমশাই রয়েছেন।”
ভ্রমর এমন চোখ করে অমলের দিকে তাকাল যেন মনে হল সে অমলকে জিজ্ঞেস করছে, কেন ডাকছে বল তো?
অমল বলল, “ডাক্তারবাবু, তোমায় দেখবেন।…তোমাদের নাগপরে যাবার কথা হচ্ছে।”
ভ্রমর বুঝতে পারল অথচ যেন পরিষ্কার সব জানতে পারল না। সামান্য বিস্মিত অথচ চিন্তিত মুখ করে বলল, “নাগপুর!”
অমল কিছু ভাবছিল, বলল, “তোমার শরীর যদি ভাল হচ্ছে দেখেন ডাক্তার-বাবু, তবে হয়ত যেতে হবে না।” বলে অমল আজ এই মুহূর্তে আগ্রহের চোখে ভ্রমরকে দেখতে লাগল। সে দেখছিল, ভ্রমরের শরীর সেরে উঠছে কি না। মনে হল, আগের চেয়ে সেরেছে।
“তোমার কি রকম মনে হয়, ভ্রমর?” আগের চেয়ে ভাল না?”
“খানিকটা।”
“তোমার মুখ মধ্যে একেবারে ফ্যাকাশে দেখাত, এখন অতটা দেখায় না।” অমল বলল, “তুমি সেরে উঠছ। এবার সেরে যাবে পুরোপুরি।”
ভ্রমর চুল খুলতে-খুলতে বলল, “তুমি যাও; আমি আসছি।”
অমল ফিরে এল। ফিরে এসে দেখল, মজুমদারডাক্তার এবং মেসোমশাই অন্য কথা বলছেন। ভ্রমর এখুনি আসছে জানিয়ে অমল সামান্য পাশে সরে গিয়ে ফুলগাছের টবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। এখন কত বেলা হয়েছে, বেশ বোঝা যাচ্ছিল। এখানে থাকতে-থাকতে রোদের স্বভাব দেখে অমল বেলা বুঝতে শিখছে। প্রায় দশটা হবে। সূর্য সামান্য হেলতে শুরু করেছে, শিরীষগাছের তলায় দোলনার ছায়াটা বেঁকেছে সামান্য। আকাশ সাদাটে নীল, কালচে দু-চারটি রেখা লেগে আছে উত্তরের দিকে। ফটকের ও-পাশ দিয়ে টাঙা যাচ্ছে, ঘণ্টি শোনা যাচ্ছিল। একটা কুকুর ডাকছে কোথায়।
বারান্দায় পায়ের শব্দ পেয়ে অমল মুখ ফিরিয়ে তাকাল। ভ্রমর। ভ্রমর চা কেক-টেক সাজিয়ে নিয়ে বারান্দা দিয়ে আসছে। অমলের সঙ্গে চোখাচোখি হল। অমল বুঝতে পারল, ভ্রমর তাকে গোল বেতের টেবিলটা ডাক্তারবাবুদের সামনে এনে দিতে বলছে।
অমল বেতের গোল টেবিল মেসোমশাইদের সামনে এনে দিল। ভ্রমর চা ও খাবারের প্লেট সমেত ট্রে-টা নামিয়ে রাখল সাবধানে। চা তৈরী করেই নিয়ে এসেছে।
মজুমদারডাক্তার ভ্রমরকে দেখছিলেন। ভ্রমরের মুখ যেন খুব খুঁটিয়ে নজর করছিলেন। “কি, কেমন আছ?” মুখে বললেন, কিন্তু মনোযোগ বিন্দুমাত্র শিথিল হল না। “কি রকম লাগছে আজকাল?”
ভ্রমর কথা বলল না। চোখ নামিয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।
“কি, বলছ না যে! কেমন মনে হচ্ছে আজকাল?”
“ভাল।”
“কি রকম ভাল?” বেশী না খানিকটা?” মজুমদার হাসিমুখে শুধোলেন।
“আগের চেয়ে ভাল।”
“ভাল!…ভালই লাগছে, কি বল?”…শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে আজকাল, খিদে ঘুম…কই, বসো, আমার সামনে বসো একবার দেখি।”
বসার চেয়ার ছিল না। অমল বারান্দায় গিয়ে আরও একটা চেয়ার এনে দিল। ডাক্তারবাবুর মুখোমুখি রাখল। ভ্রমরের বসতে অস্বস্তি হচ্ছিল, তবু বসল। একটু জড়সড়, বিব্রত ভঙ্গিতে।
চামচে করে কেক কেটে নিয়ে মজুমদারডাক্তার মুখে দিলেন। দিয়ে ভ্রমরের হাত তুলে নিয়ে ভ্রমরের চামড়ার রঙ দেখলেন যেন, তারপর হাত দেখলেন, শেষে নখের ডগা দেখতে লাগলেন।
“ওকে একটু, ভালই দেখায় আজকাল—” আনন্দমোহন বললেন। যেন তিনি বার বার কথাটা ডাক্তারকে মনে করিয়ে নিজেও সাহস পেতে চাইছেন। আনন্দ-মোহন তাঁর চায়ের পেয়ালা তুলে নিলেন আলগা হাতে।
মজুমদারডাক্তার কোনো জবাব দিলেন না, সামান্য ঝুঁকে বসে ভ্রমরের চোখের ভেতরকার কোল দেখতে লাগলেন। বার কয়েক দেখলেন। দেখে আবার সোজা হয়ে বসলেন, আর-একটুকরো কেক মুখে দিলেন। চোখের দৃষ্টি বেশীর ভাগ সময়েই ভ্রমরের ওপর। আরও একবার হাতের নখের ডগাগুলি পরীক্ষা করলেন।
মনে-মনে সম্ভবত কিছু ভাবছিলেন, হয়ত কোনো কথা মনে করার চেষ্টা করছিলেন। চায়ের পেয়ালা তুলে নিয়ে চা খেলেন এক চুমুক। “জ্বরটর হয়েছে আর?”
“না।” ভ্রমর আস্তে করে মাথা নাড়ল।
“শরীরে কোথাও ব্যথাট্যথা আছে?” পেটের দিকে যেটা হত?”
“না।” ভ্রমর মাথা নাড়ল।
অমল সঙ্গে-সঙ্গে বলতে যাচ্ছিল, ব্যথা আছে, ভ্রমরের পা থেকে কোমর পর্যন্ত ব্যথা হয়েছিল সেদিনও। ক’দিন ছিল। ভ্রমর কথাটা কেন চেপে গেল অমল বুঝল না।
“তোমার তাহলে বেশ ভালই লাগছে, কি বল? …কই, দেখি, হাতটা বাড়াও। ঢিলে করে রাখ।” মজুমদারডাক্তার ভ্রমরের হাত সামনে টেনে নিয়ে এসে আস্তে-আস্তে মণিবন্ধের খানিকটা ওপরে, ভেতর দিকের হাতের মাংসের ওপর যেন খুব আলতো করে আঙুল বোলালেন, বোলাতে-বোলাতে হঠাৎ নিজের আঙুলের ডগা দিয়ে ক্যারামের গুটি মারার মতন জোরে মারলেন মাংসের ওপর, মেরে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে থাকলেন। একটু, পর-পর, থেমে-থেমে এই রকম চলল ক’বার, কখনও আঙুলের ঠোক্কর, কখনও চিমটি কাটার মতন মাংস টেনে দিলেন। শেষে বললেন, “আচ্ছা, এবার তুমি যাও।”