অমল এখন কিছুটা অস্বস্তি বোধ করল ভ্রমরের কথায়। ইতস্তত করে বলল, “আমি আজ যাব না।…” বলে একটু থেমে আবার বলল, “আজ আমার গির্জায় যাওয়া ভাল দেখায় না।”
ভ্রমর বেশ অবাক হল যেন। বলল, “ভাল দেখাবে না কেন?”
“না, দেখাবে না।…আমি পরে তোমায় বুঝিয়ে বলব!” তাড়াতাড়ি অমল বলল। বলে হাসির মুখ করল সুন্দর করে। “তোমায় খুব চমৎকার দেখাচ্ছে। কেমন সন্ন্যাসিনী-টন্ন্যাসিনী। পবিত্র-পবিত্র লাগছে।”
ভ্রমরের চোখে শান্ত মধুর একটু হাসি নামল, মুখের ভাব সেই রকম নরম ও আনন্দময়। ভ্রমর বলল, “আমি একদিন সন্ন্যাসিনী হব ভাবতাম কি না, তাই!”
অমল কান করে শুনতে চায়নি, তবু ভ্রমরের কথাটা তার কানে বাজল। চোখ চঞ্চল হল অমলের। “সন্ন্যাসিনী হবে ভাবতে!”
“ভাবতাম—।” ভ্রমর যাবার জন্যে পা বাড়াল, এক মুঠো রোদ তার গালে পড়ল তখন। পা বাড়িয়ে ভ্রমর বলল, “তুমি তবে একলা একলা থাক বাড়িতে, আমাদের ফিরতে বেলা হবে।”
অমলও ভ্রমরের পাশে-পাশে হাঁটতে লাগল। “আমি এখন বেরুবো।”
“কোথায়?”
“বেড়াতে। বাজারের দিকে।” অমল কেন বাজারের দিকে যাবে তা গোপন রাখল।
দু-পা এগিয়ে অমল হঠাৎ বলল, “ভ্রমর, তুমি আজ আমায় খুব ঠকিয়েছ।”
যেতে-যেতে ভ্রমর দাঁড়াল; দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে অমলকে দেখল। অবাক হয়েছিল ভ্রমর। তার চোখের দৃষ্টি বলছিল, ঠকালাম! কি ঠকালাম!
অমল বলল, “আমি সকালে উঠে ঘরে কিছু পাই নি।”
“পাও নি?” ভ্রমরের চোখের পাতা বড় হয়ে এল।
“না, কিচ্ছু না। সমস্ত ঘর খুঁজেছি।”
ভ্রমর অমলের চোখে চোখে তাকিয়ে থাকল দু-মুহূর্ত। “ঘরে খুঁজেছে!”
“ঘরেই ত বলেছিলে!”
“তাহলে ঘরেই আছে।” ভ্রমর এবার যেন সব বুঝে ফেলে সকৌতুক মুখে হাসল, হেসে মুখ ফিরিয়ে নিল।
ও-পাশ থেকে কৃষ্ণা ডাকাডাকি করছে, হিমানীমাসির গলাও পাওয়া গেল। ভ্রমর চলে যাচ্ছিল।
অমল বলল, “ঘরে কিছু নেই। কিচ্ছু না।”
“চোখ থাকলে ঠিক খুঁজে পাবে।” ভ্রমর মুখ ফিরিয়ে, ঘাড় হেলিয়ে খুব মিষ্টি করে বলল। বলে চলে গেল।
অমল রীতিমত বোকা হয়ে থাকল।
সারাটা দিন আনন্দে কাটল। গীর্জা থেকে ভ্রমরদের ফিরতে বেলা হয়ে গিয়েছিল। ওরা যখন ফিরল, ওদের সঙ্গে বিচিত্র সব অতিথি। মেয়ে-পুরুষ বাচ্চা-কাচ্চা। সবাই অবাঙ্গালী। মেয়ে-পুরুষেরা বসার ঘরে বসল, চা কেক খেল, হোহো করে হাসল, গল্পগুজব করল; আর বাচ্চাগুলো বাইরে মাঠে ছুটোছুটি করে খেলা করল, দোলনায় দুলল। ওরই মধ্যে কৃষ্ণা শাড়ি বদলে তার এক সমবয়সীর সঙ্গে খানিকটা ব্যাডমিন্টন খেলে নিল। কাল মেসোমশাই ঝুড়ি সাজিয়ে কোথায় যেন ডালি পাঠিয়ে-ছিলেন, আজ দু-দফা এ-বাড়িতে ডালি এল। অমল অবাক হয়ে দেখল, একটা ঝুড়িতে এক বোতল মদ এসেছে। হিমানীমাসি নিজের হাতে সেটা সরিয়ে রাখলেন।
হু-হু করে দুপুরে এসে গেল, দেখতে-দেখতে দুপুরও ফুরিয়ে গেল। দুপুর থেকেই বাড়ি আবার ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। মনে হল, সামান্য যেন ক্লান্তি নেমেছে এ-বাড়িতে। আজ দিনটাও সেই রকম শুকনো, কনকনে প্রবল শীত যত, তত তপ্ত অনাবিল রোদ আর আলো; যত ঝোড়ো বাতাস, তত যেন দেবদারুপাতার সুগন্ধ। দুপুরবেলায় অমল আজ ঘুমিয়ে পড়েছিল।
বিকেলে আবার বাড়ি জেগে উঠল। মেসোমশাই, মাসিমা যাবেন এক নিমন্ত্রণে; কৃষ্ণা যাচ্ছে তার বন্ধুদের সঙ্গে ট্রেনে করে কোথায় যেন সার্কাস দেখতে। ফিরতে। বেশ রাত হবে, বেশী রাত হয়ে গেলে ওরা ফিরবে না, লীলাদের আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে যাবে।
কৃষ্ণা বিকেলের গোড়াতেই চলে গেল; হিমানীরা বেরোলেন সন্ধের দিকে। টিসরিকেও আজ ছুটি দেওয়া হয়েছে বিকেলে। কাজকর্ম সেরে সে বেরিয়ে গেছে, ঠিরবে সন্ধের পর।
কাল থেকে ক্রমাগত যে-রকম পরিশ্রম, হই-হই চলছিল, তাতে ভ্রমর বেশ ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। অবেলায় সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুমিয়ে উঠল যখন, তখন বিকেল ফুরিয়ে গেছে, কৃষ্ণা বাড়ি নেই। কিছু খুচরো কাজ ছিল, ভ্রমর আর গা পেল না, বাঁ পায়ে কেমন যেন ব্যথা হয়েছে, টান ধরে আছে। টুকটাক এটা-ওটা সেরে ভ্রমর বাথরুমে গেল। কলঘর থেকে ফিরে বিকেলের পোশাক বদলাতে সন্ধে হয়ে এল। হিমানীরা আর একটু পরেই নিমন্ত্রণে চলে গেলেন।
সমস্ত বাড়ি ফাঁকা, নিস্তব্ধ। উৎসবটা যেন হঠাৎ এসেছিল এ-বাড়িতে, হঠাৎই চলে গেল, সারা বাড়ি নিরিবিলি নীরব শান্ত রেখে গেল। বসার ঘরটি সেই রকম সাজানো থাকল, বারান্দায় দেবদারুপাতা এবং লাল নীল কাগজের ফুল বাতাসে ছিঁড়ে যেতে লাগল। তবু, বারান্দায় একটি উজ্জ্বল বাতি জ্বালানো থাকল, ভাড়া-করা পেট্রম্যাক্স।
হিমানীরা চলে যেতেই অমল নিজের হাতে মালসায় আগনে রেখে ভ্রমরের ঘরে দিল, নিজেই চা করল। মাথা খাটিয়ে গরম জল করে হট্ ওয়াটার ব্যাগে ভরল, ভরে ভ্রমরের পায়ের তলায় দিল, বলল, “পায়ে টান ধরেছে, শিরার টান, গরম দাও সেরে যাবে।”
সামান্য সময় আর পাঁচটা কথা বলে অমল যেন একটা ভূমিকা লুকিয়ে-লুকিয়ে সেরে নিল, তারপর বলল, “আচ্ছা ভ্রমর, তুমি সবচেয়ে কি বেশী ভালবাস?”
ভ্রমর বুঝল না। না বুঝে সরল অবাক চোখ তুলে চেয়ে থাকল।
অমল অপেক্ষা করল সামান্য, পকেটে হাত ঢোকাল আড়াল করে। বলল, “বাইবেল বাদ দিয়ে বলছি। কি ভালবাস বেশী?”
“কেন?”
“জিজ্ঞেস করছি।…জিজ্ঞেস করতে নেই?”