আয়া একা পেরে উঠছিল না। একটা মেয়ে ধরে এনেছিল, কমবয়সী। সে ঘরের ঝুল ঝাড়ল ঝুলকাঠি মাথায় তুলে, মেঝে ঘরদোর পরিষ্কার করল, এটা ওটা ফরমাস খাটল, যাবার সময় ভ্রমরের গায়ের গরম স্কার্ফটা চুরি করে নিয়ে চলে গেল।
কথাটা ভ্রমর গোপন রেখেছিল। অমলকে শুধু বলেছিল আড়ালে। অমল হাসিঠাট্টা করেছিল খুব: ‘শীতের দিনে গরম বস্ত্র দান করা পুণ্যকাজ, বুঝলে ভ্রমর। তোমার অনেক পুণ্য হল।’ পরের দিন ধোবী এসেছিল। নিজের জামা-কাপড় কাচতে পাঠাবার সময় অমল অবাক হয়ে দেখল, তার একটা সুতির শার্ট, একটা গেঞ্জি এবং ময়লা পাজামাটা বেপাত্তা।
চুরির কথাটা বাড়িতে জানাজানি হলে হিমানী আয়াকে গালমন্দ করতেন। ভ্রমরও তার স্কার্ফ খখাওয়া যাওয়ার জন্যে মা’র বকুনি শুনত। বেচারী টিসরির কথা ভেবেই চুরির ঘটনাটা ওরা চাপা দিয়ে রাখল। আয়াকে ভ্রমর পরে কথাটা বলল, অমলের জামাটামা চুরি যাবার পর।
সেদিন দুপুরবেলা টিসরি তাড়াতাড়ি বাড়ির কাজ সেরে কোথায় যেন বেরিয়ে গেল। দিনটা ছিল রবিবার। কোনো-কোনো রবিবারে আয়া কয়েক ঘণ্টার ছুটি নিত, সাধারণতঃ দুপুরের দিকে, হিমানীরা গির্জা যাবার সময়-সময় ফিরে আসত। এবারে বিকেল হবার মুখে-মুখে চলে গেল। ভ্রমররা বাড়িতে থাকবে জেনে তার ফেরার গা ছিল না তাড়াতাড়ি। ভ্রমর অন্তত বিকেল হয়ে গেছে দেখে সেই রকম ভাবছিল সেদিন।
হিমানী আনন্দমোহন কৃষ্ণা গির্জা চলে গিয়েছিলেন। আজ গির্জা থেকে বেরিয়ে হিমানীরা আসিবেন বাজারে, ক্ৰীশমাসের অনেক কেনাকাটা আছে। শীতের কথা ভেবে সবাই বেশ সাবধান হয়ে বেরিয়েছেন। আনন্দমোহন তাঁর মোটা ওভার-কোটটা হাতে নিয়েছেন; হিমানী গরমজামা গায়ে দিয়েছেন, পায়ে মোজা পরেছেন, শাল নিয়েছেন, কৃষ্ণাও তার পরোহাতার গরম কোর্ট নিয়েছে, মাথায় বাঁধার স্কার্ফ নিয়েছে।
ভ্রমরের গির্জায় যাবার ইচ্ছে ছিল। অসুখে পড়ে তার গির্জা বন্ধ হয়েছে। আনন্দমোহন সাহস করে নেন নি। ভ্রমরের শরীর না সারা পর্যন্ত ঘোড়ার গাড়ি করে দশ মাইল পথ এই ঠাণ্ডায় তাকে আসা-যাওয়া করতে দিতে তিনি রাজী নন। সামনে ক্রীশমাস; আর ছ’সাতটা দিন। ভ্রমর এ-সময় সুস্থ থাকুক।
বাড়ি একেবারে ফাঁকা। বিকেলের শুরু, আর শেষ চোখে দেখা গেল না। পৌষের আকাশ থেকে সন্ধ্যার জোয়ার এসে গেল। পাখিগুলি কিছুক্ষণ শূন্যে এবং বৃক্ষচূড়ায় তাদের কলরব ভরে রাখল, তারপর সর্বত্র একটি নীরবতা নামল ক্রমশ। হিম এবং কুয়াশা অন্ধকারে ঘনীভূত হয়ে এল।
আয়া ফিরছে না। ভ্রমর বিকেলের পোশাক বদলে ঘরে-ঘরে বাতি জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। অমল দরজা জানলাগুলো বন্ধ করছিল ভ্রমরের সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরে। বাতি জ্বালানো হয়ে গেলে ওরা রান্নার ঘরের দিকে গেল। একটা লোহার উনুন আয়া জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছিল, সে-আগুন নিবে গেছে। ভ্রমর ভাবছিল, কোনো রকমে একটু, আগুন জ্বালানো যায় কিনা। এই কাজটা সে পারে না। অমল বলছিল, সে পারবে; পিকনিকে গিয়ে তারা কতবার মাঠে ঘাটে পাহাড়ে আগুন জ্বালিয়েছে।
“তুমি আমায় কেরোসিন তেল কোথায় আছে বলো, আমি জ্বালিয়ে দিচ্ছি। কাঠ দিয়ে আগুন ধরানো খুব ইজি।” অমল বলল।
ভ্রমর আগ্রহ বোধ করল না। বলল, “থাক; আর খানিকটা দেখি। আয়া ফিরবে এখুনি।”
“যখন ফিরবে তখন ফিরবে—আগুনটা আমরা ধরিয়ে দি। তোমার ঘরে আগুন রাখতে হবে। আমি চা খাব।” অমল বেশ উৎসাহের সঙ্গে আগুন জ্বালাবার তোড়জোড় শুরু করল।
ভ্রমর বলল, “তুমি অত হুড়োহুড়ি করছ কেন? একটু, সবুর করা যায় না!”
“সবুরে মেওয়া ফলবে নাকি!” অমল ঠাট্টা করে বলল, “বসে থাকলে আগুন জ্বলবে না।” বলে রান্নাঘরের বাইরে থেকে শুকনো কাঠ আনতে গেল।
আয়ার ওপর রাগই হচ্ছিল ভ্রমরের। কখন গেছে, এখনও ফেরার নাম নেই। কোথায় গেছে তাও বলে যায় নি। সারা বাড়ির কাজকর্ম ফেলে চলে গিয়ে সে কেমন করে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে ভ্রমর বুঝতে পারছিল না। আয়া এ-রকম লোক নয়।
ভাবতে ভাবতে আয়া এসে গেল। অমল যখন সত্যি-সত্যি কেরোসিন তেলের বোতল কাঠের ওপর উপুড় করে ঢেলে দিয়ে দেশলাই কাঠি দিয়েছে এবং মুহূর্তে একটি ভয়ংকর অগ্নিশিখা দপ্ করে জ্বলে উঠেছে, সেই সময় আয়া পৌঁছে গেল। আয়া এসে না পড়লে আগুনটা সামলানো দায় হয়ে উঠত।
ভ্রমর রাগ করেই কিছু বলতে যাচ্ছিল আয়াকে, কিন্তু ওর মুখ দেখে মনে হল কিছু যেন হয়েছে একটা; ভ্রমর সামান্য অনুযোগ করল, কিছু বলল না আর।
অমল হাত ধুতে চলে গেল।
আগুন উঠোতে, মালসায় কাঠকয়লা তুলতে, চা করতে খানিকটা সময় গেল। ততক্ষণে সন্ধে পেরিয়ে গেছে। অমল তার নিজের ঘরে ছিল। ভ্রমর এসে ডাকল, “এস। তোমার চা হয়েছে।”
ভ্রমরের ঘরে এসে বসল অমল। মালসায় আগুন দেওয়া হয়েছে। দরজা বন্ধ, ঘর এখনও ঠাণ্ডা হয়ে আছে। এ ক’দিনে ভ্রমরের ঘরের চেহারা আরও কিছুটা বদলেছে। আয়না এসেছে, মেরীর ছবি এসেছে, ড্রয়ার বসেছে একপাশে।
ভ্রমর বলল, “আয়া কোথায় গিয়েছিল জানো?”
“কোথায়! গির্জায়?” অমল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল হালকা গলায়।
“ইয়ার্কি করো না।” ভ্রমর ধমক দেবার মতন গলা করল।
“ইয়ার্কির কি! আমি ত তোমায় আগেও বলেছি, আজ হয়ত ও ওদের গির্জায় গেছে।”
“গির্জায় যায় নি। সেই মেয়েটার বাড়ি গিয়েছিল খুঁজে খুঁজে। অনেক দূর।”