তারপর একদিন আবু সারাদিন পরিশ্রম করিয়া যখন রহমানকে বাতাস করিতেছিল তখন আমেনা তাহার অস্বাভাবিক ভদ্রতা বশে বলিয়া উঠিয়াছিল–“মিস্টার আবু, সেবাকার্যে স্ত্রীলোকের দাবিই অধিক। আপনি আর কষ্ট করিবেন না।” মিস্টার আবু বলিয়াছিলেন–“আমার কোনো কষ্ট হইতেছে না।”
প্রত্যুত্তরে আমেনা বলিয়াছিলেন–“মিস্টার আপনাকে অমন করিয়া বাতাস করিতে দিয়া আমি নিজে কিছুতেই বসিয়া থাকিতে পারিব না। উহাতে আমার অধিক কষ্ট হইবে।”
আমেনা আজ এতদিন পরে ভাবিতেছিল–ছিঃ ছিঃ! হয়তো মিস্টার আবু সে-সময়ে মনে মনে কতই না হাসিয়াছিলেন!
ব্যথায় বুক চাপিয়া ধরিয়া আমেনা বলিয়া উঠিল–খোদা!
আমেনা কঠিনভাবে প্রতিজ্ঞা করিয়া ফেলিল–আজ হইতে আর মিস্টার আবুর সম্মুখে যাইবে না; তাহার সম্মুখে সে আর কথা কহিবে না। এই সময়ে একজন দরজার ফাঁক দিয়া
আমেনার উজ্জ্বল মুখোনি দেখিয়া বলিয়া উঠিল–“কী সুন্দর!” সে আবু সাইদ।
.
ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ
জামালপুরের এক ঘড়ির দোকানে ঘড়িওয়ালা লোহারামের সঙ্গে তাহার বন্ধু রমাকান্তের কথা হইতেছিল।
রমাকান্ত লোহারামের হাত হইতে ঘড়িটা লইয়া বলিল–আরে, এটার স্প্রিং নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ছয় টাকা দেবে বলেছে?
লোহারাম বলিল–ঘড়িটে বেশ। মাত্র স্পিংটা ভাঙ্গা। বলেছে, পাঁচ টাকা দিবে। ঘড়ির কথা ফেলে রাখ। শুনলাম, বাজারে একটা মেয়ে এসেছে। সে নাকি ভারি সুন্দরী। চল, আজ দুপুর বেলা মেয়েটাকে দেখে আসি।
“আরে, এ কাজ! মালিক বলেছে, তার আজই কলকাতা যেতে হবে। নইলে তার ৫০০ টাকা ক্ষতি হবে। এই ঘড়িটার জন্যে সে তো দু’দিন বসে আছে তার খরব রাখন?”
“আরে ফেলে রাখ! মনের সুখের চেয়ে তার ৫০০ টাকা বড় নয়।”
“বেশ তো তোমার ধর্ম! এক ব্যক্তির ৫০০ টাকার ক্ষতি, আর তোমার বাজারে যেয়ে মদ খাওয়া, আর অশ্লীল আমোদে মত্ত হওয়া! এই না ভদ্র লোককে সকাল বেলা বললে–দুপুরেই ঘড়ি ঠিক হয়ে যাবে। বেচারা কত অনুনয়-বিনয় করে বলে গেল। তুমি কী রকমের লোক বল তো লোহারাম?”
লোহারাম হাসিয়া কহিল–“আরে মনটা বড় খারাপ হয়েছে। মন যাতে ভালো হয়। তার চেষ্টা করা আবশ্যক! যখন সে আশা করে দুপুর বেলা ঘড়িটি নিতে আসবে তখন দেখবে আমাদের দোকান বন্ধ। হা করে খানিক তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে ঘড়ি ফেলে থুয়েই সে বাড়ি ফিরে যাবে। অন্তত ছয় মাসের মধ্যে সে আর ফিরবে না। আমিও ইত্যবসরে অর্ধের দামে কোনো গ্রাহকের কাছে বেচে ফেলবো।”
”যখন ছ’মাস পরে আবার সে ঘড়ির তাগাদায় আসবে?”
“বলবো, সবাই ঠিক হয়েছিল বাবু! সেইবারেই আর দু’ঘণ্টা দেরি করলেই ঘড়ি নিয়ে যেতে পারতেন। একেবারে ছয় মাস আপনার দেখা নাই। কী বলবো, হঠাৎ পরশু দিন ধা করে স্পিংটা কেটে গেল। যে সে-স্প্রিং দিয়ে আর এবার হবে না। ভাল স্প্রিং আনতে কলকাতা চিঠি পাঠিয়েছি।”
“আর সে বুঝি তোমার স্প্রিং আর ঘড়ির জন্য শহরে বসে বসে দশ দিন কাটিয়ে দেবে?”“সে কি করবে তা জানি!”
“কী করবে”।
“সে, তোমার সব-কথা বেদবাক্য বলে মেনে নেবে। বলবে, লোহারাম বাবু, কাজের ভিড়ে, আর ঘড়ির আশায় শহরে বসে থাকতে পাচ্ছি না। আপনি দয়া করে ভি.পি.-তে বাড়ির ঠিকানায় ঘড়িটি পাঠিয়ে দেবেন।”
“বেশ বটে, তোমার জ্ঞান।” লোহারাম একটু হাসিয়া বলিল, একটু জ্ঞান ট্যান না থাকলে কি সংসারে বেঁচে থাকা যায় ভাই! এ-কালে ধর্ম ধর্ম করলে কি আর চলে? দেখিয়ে দাও তো একটা ধার্মিক লোক!” এমন সময় ঘড়িতে ১১টা বাজিল। লোহারাম হাতের কাজ ফেলে রেখে রমাকান্তকে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিতে বললে–তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে চলো, একবার ঘুরে আসা যাক। যতদিন বেঁচে থাকি ভাই, একটু আরাম করে নেওয়া যাক। সংসারে কে ক’দিন সুখ করে যেতে পারি তাই সঙ্গে যাবে। করে মরে যাব! রোগ-শয্যায় শুয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষ রসগোল্লা খেতে চায়, তা জানত?”
রমাকান্ত বলিল–“লোহারাম বাবু, আচ্ছা ক’ বৎসর বাড়ি যান না? বাড়িতে খরচ টরচ পাঠিয়ে থাকেন তো? আপনার কেদির চলে কি করে?”
লোহরাম শয়তানের মতো সহজভাবে বলিলন–“কাদম্বিনীর কথা বলছ? সে আর টাকা পয়সা কি করবে? সাত বছর বাড়ি থেকে আসছি। এর মধ্যে নিজেই খরচ কুলিয়ে উঠতে পারি না। ফুর্তির প্রাণ ভাই! কী করি বল?”
ধরণীতে যদি কোনো বিপদ থাকে তবে সে পতিতাদের আড্ডা। চাঞ্চলচিত্ত ক্ষুদ্রমতি যুবকগণ এই পৈশাচিক নরককে স্বর্গের সোপান মনে করে। একটা অতি পৈশাচিক ও ভয়ানক আনন্দ এই স্থানের আলো-বাতাসকে ভরিয়া রাখে চাঁদের জ্যোতির্মণ্ডলের মতো প্রত্যেক পতিতার অঙ্গ ঘিরিয়া একটা পৈশাচিক মহিমা বিরাজ করে। কুলবধূদের সতীত্ব গৌরব ভরা মুখের সম্মুখে মানুষের মাথা শ্রদ্ধা ও ভয়ে নত হয়। পতিতাদের দৃষ্টি মানুষের মনে একটা জঘন্য বেদনাময় লালসা সৃষ্টি করে।
লোহারাম ও রমাকান্ত তাম্বুল রাগরঞ্জিত অধরে জামালপুরের পতিতাদের আড্ডায় যাইয়া উপনীত হইল। কলঙ্কিনীরা হাসিয়া হাসিয়া রূপের ঢালি লইয়া নামজাদা মহাজন লোহারামের নিকট যাইয়া উপনীত হইল। অহে, সমস্ত পৃথিবী বিনিময়ে মানুষ যে সম্মানকে টানিয়া রাখে ইহারা হাসিয়া হাসিয়া তাহাই সর্বসাধারণের কাছে বিক্রয় করে। কী ভয়ানক কথা।