- বইয়ের নামঃ বাসর উপহার
- লেখকের নামঃ লুৎফর রহমান
- প্রকাশনাঃ আবরার পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. দুই বন্ধু
১. দুই বন্ধু
যশোহর জেলায় মহম্মদপুরের অদূরবর্তী মধুমতী তীরের জ্যোৎস্নাসুন্দর নৈশ আকাশতলে বসিযা দুইটি যুবক। প্রথম বন্ধু দ্বিতীয় বন্ধুর কোলে মাথা রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–”ভাই, তুমি কি জীবনে বিবাহ করবে না”?
২য় বন্ধু কহিলেন–না এই মুক্ত জীবন–এই উদার–গম্ভীর, শান্তমধুর, অশ্রু-শীতল, করুণা-বিহ্বল প্রকৃতির সঙ্গে নিত্য নূতন পরিচয়ে জীবন শেষ করতে চাই। আর বেশি কী দরকার?
১ম বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন–তবে কেন চাকরি কর?
“চাকরি করি কেন? অনেক লোককে আমার দেবার আছে–নিজের স্ত্রী-পুত্র ছাড়া কি জগতে আর কাউকে ভালোবাসতে নেই? নিজকে ত্যাগ করে পরের কথা ভাবতে কত আনন্দ, কত রস, তা তুমি বুঝবে না!”
১ম–আমাকে একটু বুঝিয়ে দাও।
২য়–আমি তা পারব না। প্রেম করাতেই আমার আনন্দ।-এই মাত্র আমি বলতে পারি। এর মাঝে আমার কোনো কৃতিত্ব বা গৌরব নেই। আমি তোমাদেরকে সুখী দেখতে চাই–সমস্ত দুঃখী নর-নারী সুখী হোক-এই আমি চাই।
১ম–আমাকে তুমি সুখী দেখতে পাবে না। এ জীবনে নয়–কিছুতে নয়।
২য়–কী বলছো! তোমার কথা আমায় খুলে বল দেখি। জীবন যদি ২/১ দিনের হতো, তা হলে দুঃখ সহ্য করা কঠিন হতো না। জীবন দীর্ঘ, এ জীবন সরস মধুর না হলে কী করে বাঁচা যায়? মনুষ্য-জীবনকে সুখময় করে তোলবার জন্য পৃথিবীর মোল আনা কাজ।
১ম–তা ঠিক। কিন্তু আমার জন্যে পৃথিবীর সমস্ত আনন্দ নিরর্থক। তুমি জান না, আমার পিতা অতি উগ্র প্রকৃতির লোক ছিলেন। মা ছোট বেলাতেই মারা যান। বাড়িতে টিকতে না পেরে আমি এক ভদ্রলোকের বাড়িতে আশ্রয় নেই, তার কন্যাকে বিবাহ করি। দুঃখের বিষয়–কোনো শান্তিই জীবনে লাভ হয় নাই। যেন আগুনের ভিতর থেকে অগ্নি সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। আমার পত্নী অতিশয় বিদ্রোহিণী এবং বদ। আমি যা বলি, তার বিপরীত চলাই তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। শ্বশুর বাড়িতে আমাকে অতিশয় সঙ্কোচে এবং ভয়ে কাল কাটাতে হতো। আমার মানসিক যন্ত্রণার অবধি ছিল না। বাপের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতেও সে রাজি নয়।–এই আমার দুঃখের কারণ। আমি তাকে ত্যাগ করতে চাই।
২য়–কাজটা কি ভালো হবে? ধৈর্য ধারণ কর, দুর্বল নারীজাতির প্রতি ক্ষমাশীল হওয়াই জ্ঞানীর কাজ।
১ম–তোমার ভিতর নারী চিত্তের দুর্বলতা আছে। পুরুষের ও কথা নয়। ভাবপ্রবণতায় জগৎ চলে না। একটা অশিক্ষিতা মূর্খ নারীর জন্যে একটা পুরুষ মানুষ তার জীবনকে ব্যর্থ করে দিতে পারে না। আমার মনে হচ্ছে, বিলম্ব করে কাজ খুব খারাপ করেছি। পরীর এই দুর্ব্যবহার ও ধৃষ্টতায় আমি মরে আছি। আমি যা সিদ্ধান্ত করেছি, তার এদিক-ওদিক হবে না। বৃথা আলেয়ার পেছনে পেছনে ছুটে আমার জীবন দুঃখময় হয়ে উঠেছে। এই সঙ্কল্পের পরই যেন জীবনটা অনেক হালকা মনে হচ্ছে। আমার ঘাড় থেকে আজ এ বড় দৈত্য নেমে যাবে।
২য়–তোমাদের বিয়ে পূর্বেই বাতিল হয়েছে, বিবাহ জবরদস্তির বাধন নয়। বিবাহে আত্মার সম্মতি থাকা চাই। যেখানে শান্তির পরিবর্তে অশান্তি হয়, মিলনের পরিবর্তে কলহের সূচনা হয়? বুঝতে হবে, সেখানে কেউ কাউকেও চায় না সুতরাং বিবাহও বাতিল হয়ে যায়।
১ম–আরও দুঃখের বিষয় এই যে, একটি ছয় বৎসরের ছেলে আছে।
২য়–পত্নী ত্যাগ করা কোনোমতে ভালো কাজ নয়। অপেক্ষা কর, নিজের কাছে এনে। নিজের রুচিমত গড়ে নিতে চেষ্টা কর। ভবিষ্যৎ জীবনে এই পুত্রের মুখ কি কণ্টকের মতো তোমাকে ব্যথা দেবে না?
১ম–ছেলের জন্য তার মায়ের উচিত ছেলের জন্মদাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা। নারী ছেলেকে সোহাগ করে, কিন্তু তার কি ভাবা উচিত নয় এ ছেলে সে কোথা থেকে পেয়েছে? নারী বড় অবোধ। ছেলের পিতাকে ভুলে গিয়ে, ছেলেকে বুকে চেপে ধরতে নারীর লজ্জা করে না। ইসলাম ধর্মে অবাধ্য, কলহপ্রিয়, ভক্তিহীনা নারীকে শিক্ষা দেবার জন্যেই তালাকের ব্যবস্থা আছে। তালাক জিনিসটার আদৌ আবশ্যকতা না থাকলে ইসলাম ‘তালাক’কে সমর্থন করতো না।
২য়–অবাধ্য ও ব্যভিচারী–এই দুই অপরাধী নারীকে ত্যাগ করা যায়।
১ম–আমার পত্নী ব্যভিচারিণী নয়, কিন্তু সে আমাকে চায় না। আমারও উচিত নয় তাকে কষ্ট দেওয়া-ছাড়াছাড়ি হওয়াই ভালো।
২য়–যেখানে রুচি ও সভ্যতার বিভিন্নতা সেইখানেই প্রণয়ের অভাব। মাংসের ক্ষুধা চিরদিন থাকে না। একজন কৃপণের কন্যার সঙ্গে একজন দানশীল দেশসেবকের পুত্রের। বিবাহ ঠিক নয়। কোনো মনে জুড়ে-গেঁথে দিলেই বিপদ শেষ হয় না। বেমানান বন্ধুত্ব। টেকসই হয় না। যে দুই পরিবার একই রকম মানসিকতা পোষণ করে, তাদের মাঝে বিবাহ ও আত্মীয়তা হলে ভালো হয়।
১ম–বিয়ের আগে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একটু দেখাশুনা হওয়া কেমন?
২য়–কন্যা দেখানো সুন্নত। এতে অনেক বিপদের হাত থেকে বাঁচা যায়। তবে সমাজের অনেকে কন্যা দেখানো পছন্দ করেন না। তারা ভাবেন, এতে তাদের অপমান হবে। সমাজ যা ভালো বোঝে, তার উপর কোনো কথা বলতে চাই নে।
১ম–প্রাচীন কালে মুসলমান জাতির মধ্যে কেমন প্রথা ছিল? ইতিহাস কি কিছু বলে না।
২য়–এর অর্থ ভালো। স্বামী বা কন্যাকে সঙ্গী গ্রহণ করবার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। ভালো-মন্দ বিচারের অধিকার নর-নারীকে দেওয়া হয়েছে। আত্মার অসম্মতিতে বিবাহ ইসলাম অনুমোদন করে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেয়েকে জবরদস্তি করে ‘কবুল’ বলানো হয়।–তা বড়ই অন্যায়।