- বইয়ের নামঃ প্রীতি উপহার
- লেখকের নামঃ লুৎফর রহমান
- প্রকাশনাঃ আবরার পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-০৫. বসন্তের নূতন বাতাসে
প্রথম পরিচ্ছেদ
বসন্তের নূতন বাতাসে পৃথিবীতে একটা নূতন জীবনের অভিনয় অনুভূত হইতেছিল। আম গাছের নূতন মুকুলে মৌমাছিরা ঝাঁকে ঝাঁকে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত। লতাপত্রে নবীনতা-প্রকৃতি হাস্যময়ী। মাঠের পার্শ্বে শ্যামশল্প কুঞ্জসারিগুলি পুলক সৌন্দর্যে মুখরা।
হালিমার বয়স চৌদ্দন সবে যৌবন সীমায় পদার্পণ করিয়াছে, কয়েক মাস পরে চাচাত ভাই আবদুল গণির সহিত তাহার বিবাহ হইবে।
হালিমা ভিতর ও বাহিরের সৌন্দর্যে সম্পদশালিনী কুসুমে কমনীয়তা, নূতন পাতার নবীনতা, জোছনার মাধুরী তার মধ্যে বিদ্যমান।
হালিমার পিতা নাই, মা আছেন। তিনি ইচ্ছা করেছেন, মেয়েকে দূরে বিবাহ না দিয়া দেবর-পুত্র আবদুল গণির সহিত বিবাহ দেন।
আবদুল গণিও পিতৃহীন। তাহার মায়ের ইচ্ছাও হালিমাকে বধূরূপে গ্রহণ করেন, কারণ সৎস্বভাবা কন্যা সব সময় পাওয়া কঠিন। তাহা ছাড়া বিশ্বস্তসূত্রে বুঝিয়েছেন, তাহার পুত্র হালিমাকে বড় পছন্দ করে।
আবদুল গণি বাংলা সাহিত্যের ব্যুৎপন্ন, ম্যাট্রিকুলেশন পাশ। জগতের খবর রাখা তাহার অভ্যাস। সে চাকরি করে না। কোনো ব্যবসায়ীর দোকানে কিছুদিন ছিল, এখন নিজেই ব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছে।
মহকুমায় তাহার দোকান। নানা রকমের ফসল কিনিয়া ভিন্ন ভিন কেন্দ্রে চালান দেয়।
বসন্তের এক স্নিগ্ধ অপরাহে হালিমা ছাদের উপর বসিয়া দূর গ্রাম্য গগনের পানে চাহিয়াছিল, এমন সময় কুলসুম আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন। কুলসুম হালিমার ভাবি।
হালিমার বড় ভাই হাকিমী চিকিৎসা করেন। মৌলবী হইবার পর কয়েক বৎসর শাস্ত্র। অধ্যয়ন করিয়া এখন কলিকাতায় ব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছেন। তিনি বেশ বিচক্ষণ ব্যক্তি।
কুলসুম সুন্দরী এবং বুদ্ধিমান, চিত্ত ও রুচি তাহার মার্জিত। তিনি হালিমাকে ভালবাসেন। তার ইচ্ছা হালিমা বিবাহের পর আদর্শ বধূ হয় এবং শুভ আকাঙ্ক্ষা পূর্ব হইতেই নন্দাকে কতকগুলি উপদেশ দিবেন এই কল্পনা করিয়াছেন।
বিবাহিত হইয়া কুলসুম অনেক নূতন জ্ঞান লাভ করিয়াছেন এবং এই জ্ঞানলাভ যে খুব সহজে হইয়াছে তাহা নহে। ঠেকিয়া শিখিবার পূর্বে, তিনি ইচ্ছা করিয়াছেন, হালিমাকে কিছু শিখাইয়া দেন। কুলসুম হালিমার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হালিমা, কী ভাবছ?”
হালিমা বিস্ময়ে চাহিয়া কহিল, “ভাবি, আসুন। বিকেল বেলায় জীবনভরা বাতাস বয়ে যায়, আপনি নিচে পড়ে কী কচ্ছিলেন”?
কুলসুম : আম্মা একা একা মাছগুলি নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন, আমি ঠিক করে কেটেকুটে দিয়ে এলাম।
হালিমা : এ এক জ্বালা। সময় নেই, অসময় নেই সব সময়েই কাজ। বিয়ে হলে চাচিজানের তো আমার উপর অসীম আধিপত্য হবে।
কুলসুম : ছিঃ! শাশুড়ী কি বেটার বউয়ের উপর আধিপত্য খাটাতে যান, না কর্তব্য শিখাতে যান? অমন কথা বলতে নেই। যাকে তুমি ভালবাস, সে তোমার অতি আদরের
অতি প্রিয় স্বামী, তার মা কি কম ভালবাসার, শ্রদ্ধার জিনিস?
হালিম : তা ঠিক। আমার কথাটা ভালো হয় নাই–স্বামীর মার চেয়ে বউয়ের আপনার জন আর কে? মেয়ে-ছেলেকে নিজের মা অপেক্ষা স্বামীর মাকেই বেশি করে আপন মনে করতে হবে এবং সম্ভবত তাঁর কষ্ট দূর করতে হবে। ভাবি, তোমার মতো বউ ক’টা?
কুলসুম : বলি, আকাশের দিকে চেয়ে কী ভাবছ?
হালিমা : ঠিক বলব?
কুলসুম : আমি জানি না, তুমি আমার কাছে কোনো দিন অঠিক কথা বলবে। হালিমা কুলসুমের স্কন্ধে হাত রাখিয়া মুখের কাছে মুখ লইয়া কহিল, স্বামীর কথা।
কুলসুম : এ আর লজ্জার বিষয় কী?
হালিমা : বলেন কী? আপনার কাছে লজ্জা বোধ করি না বলে কি যার তার কাছে বলব, স্বামীর রূপ চিন্তা কচ্ছি?
কুলসুম : যুবতী মেয়ে-ছেলে যে মোটেই পুরুষ-ছেলের কথা ভাবে না, একথা তো সবাই জানে।
হালিমা তার ভাবির চুল টানিয়া দিল।
কুলসুম কহিলেন–স্বামীর কথা যেমনি করে ভাবছ তোমার কথাও তোমার স্বামী এমনি করে ভাবছেন।
হালিমা : আমার এমনি কপাল। আবার কহিল এখনও তো স্বামী হয় নি।
কুলসুম : আবদুল গণি তোমাকে ভালবাসে।
হালিমা : তা জানি। আশীর্বাদ করুন ভাবি যেন তাঁর এই ভালবাসা চিরকাল অটুট থাকে। যেমন আমার ভাই আপনাকে ভালবাসেন, তেমনি আমার স্বামীও যেন আমাকে ভালবাসেন।
কুলসুমের আখিদ্বয় উষ্ণ আঁখিজলে ভরিয়া উঠিল। কহিলেন খোদা করুন তোমার ভাগ্য যেন চিরকাল অটুট হয়ে থাকে। তবে একটা কথা-স্বামীর ভালবাসা অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে প্রত্যেক মেয়ে-ছেলেকে কিছু তদ্বির করতে হবে। বাইরের রূপের গৌরব করা স্ত্রীলোকের সাজে না, বাইরের রূপ ক’দিন থাকে? রূপ থাকলেও স্বামীর চোখে দুই এক বছরের মধ্যে তাঁর ওজ্জ্বল্য মাদকতা নষ্ট হয়ে যায়।
হালিমা : ওমা! বল কি সর্বনেশে কথা?
কুলসুম : সর্বনেশে কথা নয়। চিরকাল কি পুরুষের মনে উদ্দাম মাদকতা থাকে? স্ত্রীলোককে এমন কতকগুলি গুণ লাভ করতে হবে, যাতে স্বামীর হৃদয়ে এই উদ্দাম মাদকতার স্থানে পত্নীর প্রতি একটা শ্রদ্ধার ভাব জেগে উঠে। যাতে পাড়া-প্রতিবেশী, শ্বশুর শাশুড়ী, ননদ-ভাসুরের সম্মান-সুনজর লাভ করা যায় তার চেষ্টাও মেয়েমানুষকে করতে হবে সে জন্য কিছু সাধনা চাই।