- বইয়ের নামঃ প্রীতি উপহার
- লেখকের নামঃ লুৎফর রহমান
- প্রকাশনাঃ আবরার পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-০৫. বসন্তের নূতন বাতাসে
প্রথম পরিচ্ছেদ
বসন্তের নূতন বাতাসে পৃথিবীতে একটা নূতন জীবনের অভিনয় অনুভূত হইতেছিল। আম গাছের নূতন মুকুলে মৌমাছিরা ঝাঁকে ঝাঁকে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত। লতাপত্রে নবীনতা-প্রকৃতি হাস্যময়ী। মাঠের পার্শ্বে শ্যামশল্প কুঞ্জসারিগুলি পুলক সৌন্দর্যে মুখরা।
হালিমার বয়স চৌদ্দন সবে যৌবন সীমায় পদার্পণ করিয়াছে, কয়েক মাস পরে চাচাত ভাই আবদুল গণির সহিত তাহার বিবাহ হইবে।
হালিমা ভিতর ও বাহিরের সৌন্দর্যে সম্পদশালিনী কুসুমে কমনীয়তা, নূতন পাতার নবীনতা, জোছনার মাধুরী তার মধ্যে বিদ্যমান।
হালিমার পিতা নাই, মা আছেন। তিনি ইচ্ছা করেছেন, মেয়েকে দূরে বিবাহ না দিয়া দেবর-পুত্র আবদুল গণির সহিত বিবাহ দেন।
আবদুল গণিও পিতৃহীন। তাহার মায়ের ইচ্ছাও হালিমাকে বধূরূপে গ্রহণ করেন, কারণ সৎস্বভাবা কন্যা সব সময় পাওয়া কঠিন। তাহা ছাড়া বিশ্বস্তসূত্রে বুঝিয়েছেন, তাহার পুত্র হালিমাকে বড় পছন্দ করে।
আবদুল গণি বাংলা সাহিত্যের ব্যুৎপন্ন, ম্যাট্রিকুলেশন পাশ। জগতের খবর রাখা তাহার অভ্যাস। সে চাকরি করে না। কোনো ব্যবসায়ীর দোকানে কিছুদিন ছিল, এখন নিজেই ব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছে।
মহকুমায় তাহার দোকান। নানা রকমের ফসল কিনিয়া ভিন্ন ভিন কেন্দ্রে চালান দেয়।
বসন্তের এক স্নিগ্ধ অপরাহে হালিমা ছাদের উপর বসিয়া দূর গ্রাম্য গগনের পানে চাহিয়াছিল, এমন সময় কুলসুম আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইলেন। কুলসুম হালিমার ভাবি।
হালিমার বড় ভাই হাকিমী চিকিৎসা করেন। মৌলবী হইবার পর কয়েক বৎসর শাস্ত্র। অধ্যয়ন করিয়া এখন কলিকাতায় ব্যবসায় আরম্ভ করিয়াছেন। তিনি বেশ বিচক্ষণ ব্যক্তি।
কুলসুম সুন্দরী এবং বুদ্ধিমান, চিত্ত ও রুচি তাহার মার্জিত। তিনি হালিমাকে ভালবাসেন। তার ইচ্ছা হালিমা বিবাহের পর আদর্শ বধূ হয় এবং শুভ আকাঙ্ক্ষা পূর্ব হইতেই নন্দাকে কতকগুলি উপদেশ দিবেন এই কল্পনা করিয়াছেন।
বিবাহিত হইয়া কুলসুম অনেক নূতন জ্ঞান লাভ করিয়াছেন এবং এই জ্ঞানলাভ যে খুব সহজে হইয়াছে তাহা নহে। ঠেকিয়া শিখিবার পূর্বে, তিনি ইচ্ছা করিয়াছেন, হালিমাকে কিছু শিখাইয়া দেন। কুলসুম হালিমার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হালিমা, কী ভাবছ?”
হালিমা বিস্ময়ে চাহিয়া কহিল, “ভাবি, আসুন। বিকেল বেলায় জীবনভরা বাতাস বয়ে যায়, আপনি নিচে পড়ে কী কচ্ছিলেন”?
কুলসুম : আম্মা একা একা মাছগুলি নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন, আমি ঠিক করে কেটেকুটে দিয়ে এলাম।
হালিমা : এ এক জ্বালা। সময় নেই, অসময় নেই সব সময়েই কাজ। বিয়ে হলে চাচিজানের তো আমার উপর অসীম আধিপত্য হবে।
কুলসুম : ছিঃ! শাশুড়ী কি বেটার বউয়ের উপর আধিপত্য খাটাতে যান, না কর্তব্য শিখাতে যান? অমন কথা বলতে নেই। যাকে তুমি ভালবাস, সে তোমার অতি আদরের
অতি প্রিয় স্বামী, তার মা কি কম ভালবাসার, শ্রদ্ধার জিনিস?
হালিম : তা ঠিক। আমার কথাটা ভালো হয় নাই–স্বামীর মার চেয়ে বউয়ের আপনার জন আর কে? মেয়ে-ছেলেকে নিজের মা অপেক্ষা স্বামীর মাকেই বেশি করে আপন মনে করতে হবে এবং সম্ভবত তাঁর কষ্ট দূর করতে হবে। ভাবি, তোমার মতো বউ ক’টা?
কুলসুম : বলি, আকাশের দিকে চেয়ে কী ভাবছ?
হালিমা : ঠিক বলব?
কুলসুম : আমি জানি না, তুমি আমার কাছে কোনো দিন অঠিক কথা বলবে। হালিমা কুলসুমের স্কন্ধে হাত রাখিয়া মুখের কাছে মুখ লইয়া কহিল, স্বামীর কথা।
কুলসুম : এ আর লজ্জার বিষয় কী?
হালিমা : বলেন কী? আপনার কাছে লজ্জা বোধ করি না বলে কি যার তার কাছে বলব, স্বামীর রূপ চিন্তা কচ্ছি?
কুলসুম : যুবতী মেয়ে-ছেলে যে মোটেই পুরুষ-ছেলের কথা ভাবে না, একথা তো সবাই জানে।
হালিমা তার ভাবির চুল টানিয়া দিল।
কুলসুম কহিলেন–স্বামীর কথা যেমনি করে ভাবছ তোমার কথাও তোমার স্বামী এমনি করে ভাবছেন।
হালিমা : আমার এমনি কপাল। আবার কহিল এখনও তো স্বামী হয় নি।
কুলসুম : আবদুল গণি তোমাকে ভালবাসে।
হালিমা : তা জানি। আশীর্বাদ করুন ভাবি যেন তাঁর এই ভালবাসা চিরকাল অটুট থাকে। যেমন আমার ভাই আপনাকে ভালবাসেন, তেমনি আমার স্বামীও যেন আমাকে ভালবাসেন।
কুলসুমের আখিদ্বয় উষ্ণ আঁখিজলে ভরিয়া উঠিল। কহিলেন খোদা করুন তোমার ভাগ্য যেন চিরকাল অটুট হয়ে থাকে। তবে একটা কথা-স্বামীর ভালবাসা অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে প্রত্যেক মেয়ে-ছেলেকে কিছু তদ্বির করতে হবে। বাইরের রূপের গৌরব করা স্ত্রীলোকের সাজে না, বাইরের রূপ ক’দিন থাকে? রূপ থাকলেও স্বামীর চোখে দুই এক বছরের মধ্যে তাঁর ওজ্জ্বল্য মাদকতা নষ্ট হয়ে যায়।
হালিমা : ওমা! বল কি সর্বনেশে কথা?
কুলসুম : সর্বনেশে কথা নয়। চিরকাল কি পুরুষের মনে উদ্দাম মাদকতা থাকে? স্ত্রীলোককে এমন কতকগুলি গুণ লাভ করতে হবে, যাতে স্বামীর হৃদয়ে এই উদ্দাম মাদকতার স্থানে পত্নীর প্রতি একটা শ্রদ্ধার ভাব জেগে উঠে। যাতে পাড়া-প্রতিবেশী, শ্বশুর শাশুড়ী, ননদ-ভাসুরের সম্মান-সুনজর লাভ করা যায় তার চেষ্টাও মেয়েমানুষকে করতে হবে সে জন্য কিছু সাধনা চাই।
হালিমা : ভাবি, দয়া করে আমাকে শিখিয়ে দিন কী উপায়ে স্বামীর শ্রদ্ধা চিরকাল সমভাবে লাভ করা যায়। এত প্রেম ও প্রণয় সবই কি ফাঁকি?
কুলসুম : এ সম্বন্ধে অনেক কথা বলা দরকার। এখন সন্ধ্যা হয়েছে, চল নিচে যেয়ে নামাজ পড়ি।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রাত্রি এগারটার সময় আকাশে দু-একটা তারা দেখা যাইতেছিল। হালিমার মা আপন মনে মধুর কন্ঠে কোরান পাঠ করিতেছিলেন।
হালিমা তার ভাবির কাছে তখন শুইয়াছিল। জানালা দিয়ে মন্দ মন্দ সমীরণ, বহিতেছিল। হালিমা জিজ্ঞাসা করিল–ভাবি, যুবক-যুবতীর মধ্যে এই যে প্রেম প্রণয় এসব কি মিথ্যা?
কুলসুম : মিথ্যা নয়, প্রেমের মধ্যে যেটুকু শান্ত ও স্নিগ্ধ সেইটুকুই খাঁটি। প্রথম বয়সের মোহটুকু সাধারণ প্রেম নামে যুবক যুবতীর কাছে সমাদৃত। এই মোহ বেশিদিন টেকসই হয় না, তবে এই মোহকে আমি অশ্রদ্ধার চোখে দেখি না। মোহকে প্রেমে পরিণত করতে হবে, এই জন্য সাধনা চাই।
হালিমা : মোহ কি একটু ভালো করে বুঝিয়ে দিন।
কুলসুম : মোহ একটা উদ্দাম আবেগ-মনের মিথ্যা চাঞ্চল্য। ”তোমাকে না দেখলে থাকতে পারি না, তুমি আমার চোখের তারা তোমাকে আলতা পরিয়ে রানীর বেশে দেখতে চাই”–এসব মোহের কথা। আর প্রেম সে তত বাচাল নয়, প্রিয়তমের মঙ্গল, সুখ ও শান্তিই প্রেমের আকাক্ষিত বস্তু।
হালিমা : মোহ তাহলে ভালো জিনিস নয়?
কুলসুম : ভালো নয় সত্য, খারাপ বলেও মনে করতে নেই। স্বামী যদি এই মোহের মদিরা দিয়ে স্ত্রীকে পূজা করতে আরম্ভ করেন তো খুব সরল মনে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। স্বামীমোহ শেষকালে অবহেলায় পরিণত না হয়ে যাতে শ্রদ্ধায় পরিণত হতে পারে।
হালিমা : কোনো পুরুষই বিবাহের সময় ইচ্ছা করেন তা তাঁরা স্ত্রীকে শেষে ঘৃণা করবেন, বরং ইচ্ছা করেন তার স্ত্রীকে রত্নসিংহাসনে বসিয়ে নিজে দাস হয়ে স্ত্রীর চরণ পূজা। করবেন। মনের নেশা চাঞ্চল্য যখন কেটে যায়, তখন তিনি স্ত্রীর ব্যবহার অজ্ঞাতসারে লক্ষ। করতে থাকেন। যেমন স্ত্রীলোক ভাগ্যহীনা তারাই স্বামীর মনের এই পূজার ভাবকে না বুঝে দলিয়ে দেন। যারা চালাক তারা সদ্ব্যবহারের দ্বারা স্বামীর নাকে রসি লাগিয়ে রাখেন। স্বামীর নেশা কেটে গেলেও ক্ষতি হয় না। স্বামী স্ত্রীকে প্রতি শ্রদ্ধার অর্ঘ্য দিয়ে পূজা আরম্ভ করেন। পুরুষের নেশা যখন কেটে যায়, উদ্দাম আবেগের আগুন যখন নিবে যায়, তখন। তিনি সুবিধা পেলে অর্থাৎ স্ত্রীর উপর রিবক্ত হবার পথ পেলে স্ত্রীকে অবহেলা করেন। বুদ্ধিমতী, সৎস্বভাব স্ত্রী স্বামীকে সদ্ব্যবহারে মুগ্ধ করে রাখেন। স্বামী স্ত্রীকে অশ্রদ্ধা করতে বা কঠিন কথা বলতে সাহস পান না। তাঁর ভালবাসা অক্ষুণ্ণ থাকে স্বামীর মনের মত্তা মন্দীভূত হলেও স্ত্রীর কৌশলে না নূতন করে জেগে উঠে।
হালিমা কহিল : ভাবি, ঘোমটা জিনিসটা কী? নববধূরা স্বামীর সম্মুখে মুখ খোলেন–এতে কি কোনো লাভ আছে?
কুলসুম : ঘোমটা টেনে স্বামীর মনের ক্ষুধা বা পিপাসা বাঁচিয়ে রাখা আমি পছন্দ করি। নে। ছেলে-মেয়ে না হওয়া পর্যন্ত অনেক মেয়েরা স্বামীর কাছে ধরা দেয় না, এইভাবে মুখ ঢেকে রাখলে স্বামী মনে করেন, ওখানে যেন কি আছে।
হালিমা : ঘোমটা টানাটানি এক ভয়ানক ব্যাপার–যেমন বিরক্তিকর, তেমনি অসুবিধাজনক।
কুলসুম : অভ্যাসে সব ঠিক হয়ে যায়। ছেলে-মেয়ে হলেও কি স্বামী-স্ত্রীর বিরক্ত হতে পারেন না? যে সমস্ত স্ত্রীলোক স্বামীর ভালবাসার অপেক্ষা না করে ভাত-কাপড়ের জন্য। স্বামী গ্রহণ করে তারাই ছেলে-মেয়ে হওয়া পর্যন্ত স্বামী বশে রাখবার জন্য এই কৌশল করে। ছেলে হলে কিন্তু স্বামী মনে মনে স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট থাকলেন, দায়ে পড়ে স্ত্রীর ভাত কাপড় যোগালেন, এতে স্বামী স্ত্রী সুখ পান না। ছেলে হওয়া পর্যন্ত ঘোমটা টানাটানি, তারপর আবার স্বামীর ভালবাসার তোয়াক্কা না করা বুদ্ধিহীন রমণীদের কাজ।
হালিমা : স্ত্রীলোক স্বামীর প্রেমকে গ্রাহ্য করে না, এও কী সম্ভব?
কুলসুম : এমা! বার আনা স্ত্রীলোকই এইরূপ। স্ত্রীলোকের অমনোযোগ ও বেপরোয়া ভাবের ফলে অনেক স্বামী বিরক্ত হন, এমন কি অনেকে চরিত্রহীন হয়ে যান। নিজের নিবুদ্ধিতার দোষে রমণীদের কপাল যখন পুড়ে যায়, তখন তারা কাঁদতে থাকেন, তখন কাদলে কোনো লাভ হয় না। স্বামী যে স্ত্রীকে কটু কথা বলেন না স্ত্রীকে অবহেলা করেন, এর জন্য স্ত্রীলোকেরাই সাধারণত বেশি দোষী। অবশ্য সব জায়গায় একথা খাটে না।
হালিমা : তাহলে আপনি স্বামীর সম্মুখে মুখ ঢেকে রাখবার পক্ষপাতী নন?
কুলসুম : মোটেই না, স্বামীর সম্মুখে মুখ মাথা সবই খুলে রাখতে হবে। লোকের সামনে কিন্তু মাথা খুলতে নেই। একাকিনী যখন স্বামীর কাছে থাকবে, তখন গা মাথা কাপড় দিয়া মুড়ে একটা পোটলা বিশেষ হয়ে থেকো না। রমণীর সাজসজ্জা, রূপ, গহনা সব স্বামীর মনস্তুষ্টির জন্য। এতএব স্বামীর চোখ থেকে নিজেকে ঢেকে রেখে পাড়ার। মেয়েদের সামনে রূপ আগলা করে বেরিয়ে লাভ কী? ঘোমটা টেনে স্বামীর মনকে জয় করার কাজ নেই।
হালিমা : আচ্ছা বিয়ে তো হয়ে গেল, তারপর বাসরঘরে আমাকে সবাই নিয়ে যাবে, তখন কী করবো?
কুলসুম : ধীরে ধীরে যাবে। কোনো কোনো মেয়ে বাসর ঘরে কিছুতেই যেতে চায়। স্বামী যদি বুঝতে পারেন যে তার স্ত্রী তার কাছে আসতে খুবই বিরক্তি প্রকাশ করছে তাহলে তিনি মনে মনে বিরক্ত হবেন। ধীরভাবে, ঘরে ঢুকে স্বামীর পার্শ্বে বসে পড়াই বিধি।
হালিমা : বিয়ের সময় কবুল বলা কাজটা বড় ভয়ানক। ‘কবুল’ বলতে বল্লে বলতে হবে, না অনেক অনুরোধের পর ‘কবুল’ উচ্চারণ করতে হবে?
কুলসুম : অনেক মেয়ে কবুল করার সময় খুব ঝঞ্ঝাট বাধায়। কেউ হয়তো কথাই বলে না। ধীরভাবে প্রথমবারের অনুরোধেই কবুল উচ্চারণ করা উচিত। বিবাহ ব্যাপারটির মধ্যে লজ্জার কিছুই নাই। স্বামী গ্রহণ কাজটা অপমানজনক নয়, সুতরাং এতে লজ্জা বোধ করার কোনো কারণ নেই।
হালিমা : স্বামীর পার্শ্বে বসে পড়বো, তারপর?
কুলসুম : স্বামী যদি কোনো কথা জিজ্ঞাসা করেন, তবে খুব আদবের সঙ্গে উত্তর। দেবে। চুপ করে নির্বাক হয়ে থাকবে না।
হালিমা : আপনি করে বলবো, না তুমি করে বলবো?
কুলসুম : কেন? তুমি করে বলবে। স্বামী তো আর পীর সাহেব নন? হবে হুঁ হাঁ না বলে জি, জে ব্যবহার করবে। হুঁ, হাঁ বল্লেও বিশেষ দোষ নেই। আপনি করে বলে যেন পর করে দেওয়া হয়।
হালিমা : বাইরে অনেক মেয়ে বর-কন্যার কথা শোনার জন্যে উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, এমন অবস্থায় কী করে কথা বলা যায়?
কুলসুম : যারা থাকতে পারেন তাঁরাই থাকেন। বর-কন্যার মিলন দেখে তারা তামাসা করে খুশি প্রকাশ করেন। অবশ্য কাজটি সরাহ বিরুদ্ধ।
হালিমা : স্বামী সাধারণত কী প্রশ্ন করেন?
কুলসুম : হয়তো নাম জিজ্ঞাসা করতে পারেন–কিংবা কী পড় তাই জিজ্ঞাসা করে থাকেন।
হালিমা : কন্যা কী বলবে?
কুলসুম : টপ করে করে নাম বলে ফেলবে। কী কী বই পড়েছ বলবে? পড়তে কেমন লাগে জিজ্ঞাসা করলে বলবে, খুব ভালো লাগে। যা পড়েছ তাই বলবে, বাড়িয়ে বলবে না। বন্ধুদের কথা জিজ্ঞাসা করলে বন্ধুদের নাম বলে দিতে হয়। স্বামীসঙ্গই ভালো লাগে, না বন্ধুদের কাছে থাকতে মন চায়–জিজ্ঞাসা করলে বলবে, স্বামীসঙ্গই ভালো লাগে। তোমার এত প্রশ্নের ভয় নাই। তোমার তো জানা লোক-লুকোচুরি করে যার সঙ্গে আগেই প্রেম। করেছ।
হালিমা হাসিয়া তাহার ভাবির চুলের খোঁপা ধরিয়ে কহিল-তাই বুঝি?
কুলসুম বলিলেন-তা না তো কি–আলাপ, হাসাহাসি কত কী?
হালিমা : ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে নাই নাকি? ওমা, আমি কোথায় যাবো? ছিঃ ছিঃ। হালিমা হাসিয়া হাসিয়া তাহার ভাবির গায়ের উপর শুইয়া পড়িল।
.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সবেবরাতের সন্ধ্যায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা পথে পটকা ফুটাইতেছিল, আর বাড়িতে বাড়িতে রুটি হালুয়া বিলাইয়া বেড়াইতেছিল, ইহা যে সরাহ-শরীয়ত বিরুদ্ধ তাহা তাহারা আদৌ চিন্তা করবার অবসর পায় নাই। আবদুণ গণি সেদিন বাড়ি আসিয়াছিল। সবেবরাত উপলক্ষে আবদুল গণি ভগ্নি হালিমার জন্য একখানি পুস্তক উপহার আনিয়াছে।
সন্ধ্যায় যখন চাচির আহ্বানে রুটি খাইতে আসিল, তখন পার্টির উপর বসিয়া প্রদীপ আলোকের সম্মুখে ঝকঝকে বইখানি রাখিয়া দিয়া কহিল-চাচি, হালিমার জন্য এনেছি।
চাচি জিজ্ঞাসা করিলেন–কী উপহার বাবা? বইয়ের দিকে চাহিয়া আবদুল গণি কহিল-এই বইখানি।
বেশ বাবা বলিয়া চাচি হালিমাকে ডাক দিয়া বারান্দায় যাইয়া দাঁড়াইলেন। অল্প অন্ধকারে হালিমা, মায়ের বুকের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। মা কন্যার হাতে বইখানি দিয়া কহিলেন–তোমার ভাই তোমার জন্য উপহার এনেছে।
মেয়েকে বইখানি দিয়া চাচি ফিরিয়া আসিয়া আবদুল গণির পার্শ্বে বসিয়া কহিলেন–কদিন বাড়ি আছ বাবা?
আ-গণি। বেশি নয়, দু’দিন থাকবো। নিজের কাজ নিজে না দেখলে ক্ষতি হয়, তাই কোথাও ক’দিন কাটাতে পারি নে। বাড়িতে না এলেও চলে না, ব্যবসা-বাণিজ্য তদারকও হয় না।
চাচি : টাউনে নূতন বাড়িটি কি শেষ হয়েছে?
আ-গণি। হয়েছে। পনের দিন পরে আপনাদের জন্য নৌকা পাঠিয়ে দেবো। সকলেই যাবেন। মা, আপনি, হালিমা, আর ভাবি।
চাচি : বেশি দিন তো থাকতে পারবো না।
ততক্ষণে আবদুল গণির খাওয়া হইয়াছিল। সে নূতন কলসী হইতে পানি ঢালিয়া লইতে অগ্রসর হইল, চাচি তাহার হাত গ্লাস লইয়া পানি ঢালিতে ঢালিতে কহিলেন–ওমা, পানি নাই, গ্লাসে।
আবদুল গণি বাহিরে হাত ধুইতে ধুইতে কহিলেন–একটু পরিবর্তন চাই, নইলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে না।
চাচি : তাতো ঠিক।
এমন সময় ভাবি সাহেবা আসিয়া আবদুল গণির কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। গণি উঠিয়া শ্রদ্ধা জানাইল। ভাবি সাহেবা-দেবরকে বসিতে বলিয়া কহিলেন-তা ভাই, কবে আমাদের টাউনে যাওয়া হচ্ছে?
আ-গণি। আপনাদের যে দিন মরজি হয়।
ভাবি : হালিমা বিবি বলছেন মঙ্গলবারে। হালিমা বাহির হইতে সহসা ক্রোধে একবার ভাবির দিকে তাকাইল।
হালিমার মা কাহলেন–না এই মঙ্গলবারে নয়, যে মঙ্গলবার আসছে, এর পরের মঙ্গলবারে।
হালিমার ভাবি কাহিলেন–আচ্ছা মা, তাই হোক না?
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
নীরব সন্ধ্যায় ছাদের উপর বসিয়া হালিমা তাহার ভাবিকে জিজ্ঞাসা করিল–ভাবি, স্বামী। সেবার অর্থ কী?
ভাবি : স্বামীকে সুখ দেওয়া।
হালিমা : কেমন করে?
ভাবি : এই যেমন স্বামীকে পাখা করা, তামাক খাবার অভ্যাস থাকলে তামাকে সাজিয়ে দেওয়া, গায়ে মাথায় হাত বুলান, সামনে বসিয়ে খাবার খাওয়ান ইত্যাদি।
হালিমা : স্ত্রী কি স্বামীর চাকর?
ভাবি : কেন? এসব কি চাকরের কাজ? বন্ধু কি বন্ধুকে সেবা করে না–বন্ধুকে সুখ দিয়ে আনন্দ পায় না? মা সন্তানকে পালন করেন সেকি দাসীরূপে?
হালিমা : স্ত্রীর নিকট হইতে স্বামীর এই সেবা দাবি করবার কি অধিকার আছে?
ভাবি : অধিকার আছে। স্বামী ইচ্ছা না করলেও স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীকে সুখ দেওয়া, সেবা করা। নারী জীবনের সাতকতাই এতে।
হালিমা : স্ত্রীর কি পাখার বাতাসের দরকার হয় না? তার নিজের গরম লাগলে তাকে কে বাতাস দেবে?
ভাবি : স্বভাবের এই অংশে নারী পুরুষ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ-নারীদের সব সম্পর্কেই স্নেহময়ী জননীর ভাব ফুটে উঠবে। স্বামী স্ত্রীর সেবা না চাইলেও স্ত্রী জোর করে স্বামীর সেবা করবে।
হালিমা : যাদ কেউ না করে? তা হলে তাকে হতোদর হতে হবে?
ভাবি : দেখ, সহানুভূতিই সব।-আমি তোমার জন্য কষ্ট করি, তুমিও আমার জন্য কষ্ট কর। স্বামী সুখ-দুঃখে, বিপদে-সম্পদে পত্নীর মঙ্গল চান, তার পরিশ্রমজাত দ্রব্যসম্ভার পত্নীকে বন্টন করে দেন, স্ত্রীর বিপদে প্রাণ পর্যন্ত দান করেন। অতএব স্ত্রীরও কর্তব্য এহেন বন্ধুকে সর্বদা সুখী করতে চেষ্টা করা। স্বামীকে নিজের শরীর ও আত্মার অংশ ভাবতে হবে। বিয়ের অর্থ–দুটি প্রাণীর একসঙ্গে বন্ধুরূপে বন্ধন। কে কাকে কতখানি সুখ দেবে তা অঙ্ক কষে হিসাব করে বলা যায় না।
হালিমা : ভাবি, আপনি বলছেন বিয়ের পর মাত্র বৎসর খানেক স্বামী স্ত্রীর জন্য মাদকতা অনুভব করেন।
কুলসুম : এই মাদকতাকে বিশ্বাস করতে হবে না। সদ্ব্যবহার দ্বারা স্বামীর শ্রদ্ধা লাভ করতে হবে।
হালিমা : ভাবি, ক্ষমা করুন; বলতে লজ্জা করে। আপনি আমার বন্ধু। আপনাকে আর লজ্জা কি? চাচির ছেলের জন্য আমার মনে অনুরাগের সঞ্চার হয়েছে। তার জন্য মনে মনে কষ্ট পাই। এই কথা বলিয়া হালিমা একটু হাসিল।
কুলসুমর না, না, এতে লজ্জা কি? যিনি স্বামী হবেন, তাঁর প্রতি অনুরাগের সঞ্চার হওয়া দোষের নয়।
হালিমা : স্বামীর প্রেম যেমন এক বৎসরেই শেষ হবে, আমার এই অনুরাগের আয়ুও কী এক বৎসর মাত্র।
কুলসুম : আশ্চর্য নয়।
হালিমা : তা ভাবতে আমার কষ্ট হচ্ছে।
কুলসুম : নারীর হৃদয়ের এই পরিবর্তনের কথা আর একদিন বলবো। আজ স্বামীকে কীভাবে সেবা করতে হয়, তাই শোন।
হালিমা : আচ্ছা বলুন।
কুলসুম : দেখ বিবাহিত জীবনে বাপের বাড়ির খামখেয়ালী সকলের আগে ত্যাগ করতে হবে। কোনো প্রকার উচ্ছল স্বভাব থাকবে না। পিতা-মাতা মেয়ের আবদার, জেদ সহ্য করেন, শ্বশুরবাড়ির কেউ তা সহ্য করে না; বরং তোমাকেই তাদের আবদার সহ্য করতে হবে। লোকে বউকে লালন পালন করবার জন্যে, তার আবদার উচ্ছৃঙ্খলতা সহ্য করবার জন্যে ঘরে নেয় না, বউই তাদের উচ্ছলতা সহ্য করবে এবং তাদেরকে পালন করবে। প্রথম কথা, খুব প্রাতঃকালে উঠবে।
হালিমা : রাত্রি তিনটার সময় কী?
কুলসুম : নামাজের ওয়াজের আধ ঘন্টা আগে। তিনটার সময় ওঠার কোনো দরকার নেই।
হালিমা : তার পর?
কুলসুম : স্নানের প্রয়োজন হরে গোসলখানায় যেয়ে গোসল করবে।
হালিমা : ভাবি, প্রাতঃকালে স্নান করতে যাওয়া বিড়ম্বনা। ছিঃছিঃ! সকলের সামনে সকাল বেলায় মাথায় পানি ঢালা কি লজ্জার কথা নয়?
কুলসুম : সবার সম্মুখে কেন? প্রত্যেক ঘরের পাশ্বেই একটা গোসল খানা থাকা চাই। ঘরের পেছনের চাল একধারে দৈর্ঘ্যে চার হাত, প্রস্থে চার হাত করে বাড়িয়ে গোসলখানা
করে নিতে হয়। এই স্থান শোবার স্থানের পাশেই হবে। প্রত্যেক মহিলার জন্য স্বতন্ত্র গোসলখানা থাকা উচিত। বাইরে স্নান করা কিছু অসভ্যতা। যে দিকে গোসলখানা সেদিকে চলাচলের পথ যেন না থাকে। এক বাড়িতে অনেকগুলি দম্পতি বাস না করলে সুবিধা হয়।
হালিমা : আচ্ছা, নারীকে পরের বাড়িতে সম্পূর্ণ অপরিচিত লোকের মধ্যে এসে বাস করতে হয় কেন? স্বামীর উপর তার দাবি আছে সুতরাং তারই সেবাসুখ চিন্তা করতে সে বাধ্য। অন্যের মন যুগিয়ে চলা কি কঠিন নয়? এতে কি মনের স্বাধীনতা এবং মনুষ্যত্ব নষ্ট হয় না?
কুলসুম : বিলাতে ছেলে বড় হলে বিয়ের পর তাকে স্বতন্ত্র স্থানে নূতন সংসার করে দেয়। আমাদের দেশে সে প্রথা নেই। ইংরেজের আচার-পদ্ধতি আমরা মানতে পারি না। স্বামীর কর্তব্য তাঁর মাতাপিতার সেবা করা, শান্তি ও সুখ দেয়া, ছোট ভাই বোনদের আবদার রক্ষা করা। স্বামী অর্থোপার্জনে বিদেশে যায় ও কম্যে ব্যস্ত থাকে; সুতরাং স্বামীর হয়ে স্ত্রীকে ঐ সমস্ত কর্তব্য করতে হয়। ইহাও একরকম স্বামীসেবা। কর্তব্যের নামে যে কাজ করা, তাকে স্বধীনতা এবং মনুষ্যত্ব নষ্ট হয় না। স্বামী স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে বাধ্য, সুতরাং স্বামীর বাড়িতে নিজেকে বাজে লোক মনে করবার কোনো কারণ নেই। স্বামীর কাছেও নিজের সম্মান ও দাবির মূল্য অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য কাবিনের ব্যবস্থা আছে। আমাদের সমাজে সাধারণত যত টাকার কাবিন হয়ে থাকে, তা অপেক্ষা বেশি টাকার কাবিন হওয়া উচিত; নইলে মেয়েদের মর্যাদা থাকে না। স্বামী বা শ্বশুর-শাশুড়ী যখন তখন বিপুল অসম্মানে বধুকে পথের ভিখারিনী করে দিতে পারেন। কাবিন অন্তত হাজার টাকার হবে। এই টাকা কখনও মাফ করতে নেই। কাবিনের পরিবর্তে কিছু জমি লিখে নেওয়াও মন্দ নয়, বরং তাই ভালো।
হালিমা : কিন্তু এতে স্বামীর স্বাধীনতা থাকে কি? স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী যেরূপ ইচ্ছা সেইরূপ ব্যবহার করতে পারে, এমনকি নারী চরিত্রহীনা হলেও স্বামী কিছু বলতে পারে না!
কুলসুম : পুরুষ চরিত্রহীন হলে নারীর কি বলবার থাকে? স্বাধীনতা ও শক্তি হারিয়ে নারীর কারো সঙ্গে প্রেম করা অসম্ভব। এরূপে প্রেম হতেই পারে না। যে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে স্বামীর কৃপার পাত্র মনে করে থাকে, সে কোনো প্রাণে স্বামীর প্রেমচুম্বন হাসিমুখে গ্রহণ করে? অসম্ভব! পুরুষ বহু স্থলে নারীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে থাকেন। নারী কবে কোথায় স্বামীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে? স্বামীর নিকট তার এমন কিছু আছে যা না পেলে তার জীবন মিথ্যা হয়ে যায়। নারীর কি ধর্ম ও বিবেক নেই?সে কি খোদাকে স্বীকার করে না? পুরুষ যে আবার বিয়ে করতে পারে।
হালিমা : স্বামী যা বলেন, তাই করতে হবে। তাকে ভক্তি করতে হবে। এসব কথার অর্থ কি? এত শ্রদ্ধার আদান-প্রদান, যেখানে-সেখানে প্রেম প্রণয় কি প্রকারে সম্ভব? স্বামীকে এত ভয় করে কি জীবনী ধারণ করা যায়? স্ত্রীলোককে স্বামীর বাড়ি যেয়ে দরকার কি? পুরুষ তার শ্বশুর শাশুড়ীর আজ্ঞা পালন করতে বাধ্য নয়, নারী তার শ্বশুর-শাশুড়ীর আজ্ঞা পালন করতে বাধ্য, এর অর্থ কি? পুরুষ শ্বশুর-শাশুড়ীর আজ্ঞা অনুযায়ী কাজ করলে লোকে তাকে কাপুরুষ বলে; নারী শ্বশুর-শাশুড়ীকে অবজ্ঞা করলে সকলের কাছে সে নিন্দনীয় হয়। এর কারণ কি?
কুলসুম : সাধারণত স্বামী স্ত্রী অপেক্ষা জ্ঞানী হয়ে থাকেন, সুতরাং তার কথামতো কাজ করতে কোনো ক্ষতি নেই। কাজ হওয়াই চাই–স্ত্রী ও স্বামীতে আড়াআড়ি ভাব থাকলে পরিবারে সুখ-শান্তি তাকে না, কোনো কাজও হয় না। স্বামী-স্ত্রীর অমঙ্গল চান না–বন্ধুর কথামতো কার্য হওয়া চাই তাতে নিরানন্দের কারণ কি? স্ত্রী যদি স্বামী অপেক্ষা শিক্ষিতি ও জ্ঞানী হন, তাহলে স্ত্রীর কথামতো কাজ হতে পারে। শিক্ষিত ও জ্ঞানী স্বামীকে ভক্তি শ্রদ্ধা করার অর্থ দিবারাত্র পদপ্রান্তে লুটিয়ে থাকা নয়। পিতার কাছে পুত্রের ব্যক্তিত্ব বা কথার মর্যাদা বা দাবি নাই, স্ত্রীর তা আছে; সুতরাং স্ত্রীর দুঃখ করবার কিছু নাই। অতএব প্রেম প্রণয় পূর্ণ গতিতে চলতে পারে। স্বামীকে ভয় করতে হয় না। স্বামীর ভালবাসাকে বিশ্বাস। করতে হবে। নারীর হাতে যদি কাবিন থাকে–সে যদি শিক্ষিতা হয়, সে যদি সম্মান বজায়। রেখে প্রয়োজন মতো এখানে ওখানে যাওয়ার ক্ষমতা পায়, তা হলে তার স্বামীকে বিশেষ ভয় করতে হয় না। স্ত্রীলোকের স্বামীর বাড়ি থাকার কারণ এই বাঙালি সংসারের নূতন নূতন পরিবার গঠন করা কঠিন। আমরা স্বামীর মাতা-পিতাকে নিজের মাতাপিতা মনে করি, সুতরাং তাদের খেদমত করতে আনন্দই হয়। পুরুষ স্ত্রীর গৃহে এলে স্ত্রীরই ক্ষতি। তাতে পুরুষের সম্পর্ক খর্ব করা হয়। ফলে সন্তানাদি কাপুরুষ হয়ে জন্মে। বাৰ্হিজগতের সঙ্গে পুরুষের সম্বন্ধ অধিক-জতের ভাব ও কর্মকে সেই গতি প্রদান করি। সে নারীর বাড়ি এসে নারীর মাতাপিতার বাক্য অনুযায়ী চলতে পারে না–তাতে তার জীবন মিথ্যা হয়ে যায়।
হালিমা : ঊষার স্নান শেষ করে বধূ কি করবে?
কুলসুম : স্বামীর তামাক খাবার অভ্যাস থাকরে তামাক ঠিক করে রাখবে। বদনায় পানি ভরে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দেবে। গোছলখানায় গামোছা আর কাপড় রেখে অজু করে নামাজ পড়বে। নামাজ পড়ে বাড়িতে দাসী না থাকলে কলমদানীতে পানি দেবে বদনাগুলি মেজে নির্দিষ্ট স্থানে গামছাসহ রেখে দেবে। শ্বশুরের তামাক খাবার অভ্যাস থাকলে হুঁকায় পানি বদলিয়ে কলকায় তামাক দিয়ে দেশলাই ও কয়লা কাছে রেখে দেবে। শ্বশুরের খেদমত শাশুড়ীও করতে পারেন-বধু সাধ্যমতো শাশুড়ীকে সাহায্য করবে।
হালিমা : ছেলে হলে স্বামীর খেদমত ঠিক মতো করা যায় না বোধ হয়?
কুলসুম : একটু বাধা আছে। যতটুকু সম্ভব তা করতে অবহেলা করবে না।
হালিমা : স্বামী যখন আহার করেন তখন স্ত্রীর কিছু কর্তব্য আছে না কি?
কুলসুম : নিশ্চয়ই। সে কথা জিজ্ঞেস করে আর কষ্ট করার দরকার কি আসন দিয়ে দস্তরখানা ও পানি দিও। দাস-সাসী অনেক সময় পানি ও দস্তরখানা না দিয়েই ভাত নিয়ে হাজির হয়। এরূপ দাস-দাসীকে আদব-কায়দা শিখাবে। বিনা দস্তরখানে বাড়ির কেহ যেন ভাত না খায়।
হালিমা : পানি ও দস্তরখানা দিয়ে বুঝি ভাত দিতে হবে?
কুলসুম : হ্যাঁ, প্রথমে সামনে যে ভাত দেবে তা যেন কখনও বেশি না হয়। স্বতন্ত্র থালায় সম্মুখে ভাত রেখে চামচ দিয়ে নিজ হস্তে অল্প অল্প ভাত স্বামীর পাতে উঠিয়ে দিতে থাকবে। এক সময়ে অনেক ভাত স্বামীকে দিও না। পাত্রে তরকারি দেবে। নিজ হস্তে তরকারি তুলে দিতে হয়। খাবার সময় স্বামীকে আদর করে আরও কিছু নিতে অনুরোধ করতে হয়। স্বামীর পরিতুষ্ট আহারে তুমি খুব খুশি এরূপ ভাব দেখান চাই। স্বামী যত কম খান ততই স্ত্রী খুশি হন, এরূপ সন্দেহ যেন কখনও স্বামীর মনে না আসে।
হালিমা : অনেক রমণীকে দেখে থাকি স্বামীর ভাত খাবার সময় পাখা দিয়ে তার। স্বামীকে বাতাস করতে থাকে।
কুলসুম : এতে খুব ভালো কথা-স্বামীর আহারকালে বাতাস দেওয়া খুব ভালো। গরম ভাতের উপর স্বামী উপুড় হয়ে ফুঁ দিচ্ছেন তা দেখে চুপ করে থাকতে নেই। বাতাস দিয়ে ভাত ঠাণ্ডা করে দেবে। স্বামীকে যেন পানি বা লবণ দিতে ভুল না হয়। ভাত খাবার সময় ভাতের উপর মাছি না বসে, সেদিকেও লক্ষ রাখবে। ছেলেপিলেকে ছেড়ে দিয়ে। খাবার সময় বিরক্তি করা ঠিক নয়। ছেলেপিলেকে স্বতন্ত্র স্থানে খেতে দিলে, কাঁদা কাটির অভিনয় বন্ধ হতে পারে।
হালিমা : স্বামী পরিশ্রান্ত হয়ে এলেও তাঁকে পাখা দিয়ে বাতাস করতে হবে না কি? লোকে কী বলবে? লজ্জা লজ্জা!
কুলসুম : লোকে কী বলবে–এই ভেবে ক্লান্ত স্বামীর নিকট যে রমণী অগ্রসর না হয় তার জীবন বৃথা। স্ত্রী তো আর উপপত্নী নয় যে লোকের কথা শুনবে। এমন নরপিশাচ কে আছে যে স্ত্রী লোকের স্বামীর প্রতি ভালবাসা দেখে বিরক্ত হয়?
হালিমা : এত সেবা করে কি জীবন ধারণ করা যায়?
কুলসুম : এই স্বামী সেবায় রমণীরা আনন্দ বোধ করেন। এতে আদৌ তার কষ্ট হয় না। তাদের প্রেমে ও মধুর ব্যবহারে সংসার স্বর্গে পরিণত হয়। যে সমস্ত রমণী স্বামীকে ভালবাসে না, তারাই স্বামীর সেবা করা বা স্বামীকে সুখ দিতে কষ্টবোধ করে। আমি তোমার ভাইকে গরমকালে ঘুম না আসা পর্যন্ত বাতাস দিয়ে থাকি। এতে আমার আনন্দ ছাড়া কষ্ট হয় না। এতে আমার সম্মানও নষ্ট হয় না।
হালিমা হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল-বটে? আচ্ছা, স্বামীকে রাত্রিকালে ঘুম হতে জাগান কি ভালো?
কুলসুম : আবশ্যক থাকলে তাতে দোষ নাই। ধীরে ধীরে মিষ্টি কথায় স্বামীকে জাগালে স্বামী বিরক্ত হন না বরং সুখী হন। যদি বোঝা যায় স্বামী জাগতে ইচ্ছুক নন, তা হলে ঘুমাতে না দিয়ে উপায় কি? অবশ্য স্বামীর এরূপ ব্যবহার স্ত্রীর মনে কষ্ট হতে পারে তা স্বামীরই বিবেচনা করা উচিত।
হালিমা : স্বামী যদি স্ত্রীকে জাগান?
কুলসুম : তা হলে স্ত্রী আদৌ বিরক্ত প্রকাশ করবে না বরং সুখী হয়েছে এইরূপ ভাব দেখাবে। সাবধান, কখনও স্বামীর সোহাগের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করো না–তাতে রমণী জীবনে সমূহ বিপদ ঘটতে পারে। স্বামীর সকল আদর মাথা পেতে নেবে। বস্তুত স্ত্রী এমন কোনো কথা বলবে না বা এমন কোনো ব্যবহারের পরিচয় দেবে না যাতে মনে হতে পারে স্ত্রী স্বামীর প্রতি তত আসক্ত নয়।
হালিমা : ভিতরে ভালবাসা রইল, বাইরে তার পরিচয় না দিলাম। নিষ্ঠুর কথা বলে বা অবজ্ঞা ভরা ব্যবহার করে ভিতরে প্রেম পোষণ করলে কি ক্ষতি? গভীর প্রণয় ভিতরেই থাকে। বাইরে তার সাড়া পাওয়া যায় না।
কুলসুম : এটা পাগলের কথা। যে প্রেমের কোনো সাড়া পাওয়া যায় না, সে প্রেমের কোনো মূল্য নাই। কাজের মধ্যেই প্রেমের পরিচয়। ভিতরে প্রেম আছে কাজে তার পরিচয় নাই, এরূপ প্রেম দিয়ে কী লাভ? নারীর পক্ষে নিষ্ঠুর কথা বলা বা অবজ্ঞাপূর্ণ ব্যবহার করা বড়ই বিপজ্জনক। এতে নারীর কপাল পুড়ে যায়। সে নিজ হাতে নিজের বিপদ টেনে আনে। কখনও কোনো নারী এরূপ করবে না। মুখে হাসি সহানুভূতিপূর্ণ কুশল জিজ্ঞাসা, মধুর আলাপ, সরস রসিকতা, প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার নারীর ভূষণ। মায়ের মতো গভীর ভালবাসা এ জগতে কার?-মাতা সন্তানকে বাচালতা কথা দিয়ে সোহাগ করেন তা জান? নারী কথা ও ব্যবহারের ভিতর দিযে সর্বদা স্বামীর প্রতি ভালবাসার পরিচয় দিবে।
হলিমা : শুনেছি, স্বামী স্ত্রীকে চুম্বন করে থাকেন, স্ত্রীও স্বামীকে চুম্বন করে থাকেন। এটা বড়ই জঘন্য কাজ, কেমন?
কুলসুম : আশ্চর্য! কে বললে জঘন্য! স্বামী স্ত্রীতে চুম্বনের বিনিময়ে কারো মনে কোনো অবিশ্বাস আসতে পারে না। চুম্বন বিনিময় অতি উত্তম প্রথা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কেউ কারো উপর বিরক্ত হলে চুম্বনে তা দূর হয়। ভদ্রলোকে ভদ্রলোকে যেমন আলাপ করে বা হামেশা কুশল জিজ্ঞাসা করে পরস্পরের সদ্ভাব সঞ্জীবিত করে রাখেন, স্বামী স্ত্রীর মধ্যেও তাই। তবে স্বামী-স্ত্রীর চুম্বন বিনিময় কাজটি গোপনে হওয়া চাই।
হালিমা : স্ত্রীও কি স্বামীকে চুম্বন করবে?
কুলসুম : স্ত্রী স্বামীকে বেশি চুম্বন করবে। এতে দোষ নেই। স্বামী স্ত্রীর উপর রেগে থাকলে স্ত্রীর চুম্বন তা দূর করতে সক্ষম। চুম্বন জিনিসটি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া তো আর কিছুই নয়। বিলাতে তো রাস্তাঘাটেই বন্ধুতে বন্ধুতে চুম্বনের বিনিময় হয়।
হালিমা : এরূপ করলে স্বামী স্ত্রীকে বেহায়া মনে করতে পারেন।
কুলসুম : কেন? স্ত্রী কি রক্ষিতা যে তার এত লজ্জা? যে পুরুষ মুখে নারীকে সমকক্ষ মনে করে অথচ কার্যের বেলায় তাকে সকল দাবি বুঝিয়ে দেয় না, সে পুরুষের মূল্য কী? স্ত্রী পুরুষের চেয়ে কিছুতেই ছোট নয়–তার ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতা আছে। পুরুষের যদি সোহাগ করার অধিকার থাকে, নারীরও তা আছে।
হালিমা : স্বামী যখন বাহির হতে আসেন তখন কী করতে হবে?
কুলসুম : উঠে দরজার কাছে যাবে এবং মৃদু হাস্যে সাদর অভ্যর্থনা করবে।
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
বর্ষাকাল–সমস্ত মাঠখানি বন্যা প্লাবিত। শ্যামল সজীব শৈবালে পরিষ্কার জলরাশি অপূর্ব শ্রী ধারণ করিয়াছে।
আবদুল গণি, তাঁহার মা, হালিমা ও ভাবি সাহেবাদের লইয়া শহরে বেড়াইতে যাইতেছেন। জোছনার স্নিগ্ধ অমিয় বিশ্বে আনন্দের ধারা ঢালিতেছিল। মৃদু মধুর মলয় হিল্লোল জীবনকে পুলকিত পূর্ণ করিতেছিল।
নৌকার ছাদের উপর বসিয়া হালিমা ও কুলসুম কথা বলিতেছিলেন। দূরে জল বিস্তারের উপর চাহিয়া চাহিয়া তাঁহারা নাতিউচ্চ স্বরে কথা কহিতেছিলেন।
দীর্ঘ ওড়না তাহাদের গায়ে। ঘোমটা টানিয়া দিয়া অসঙ্কোচে তাঁহারা প্রকৃতির মহিমা ভোগ করিতেছিলেন।
হালিমা জিজ্ঞাসা করিল-ভাবি, বিশৃঙ্খলা জিনিসটা আমি আদৌ ভালবাসি নে।
কুলসুম : কারণ বিশৃঙ্খলা জিনিসটা আদৌ ভালো নয়। মনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সকল বিষয়ে শৃঙ্খলা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করবার ঝোঁক তো হবেই। কথায়, মনে, ব্যবহারে, কাজে-কর্মে,-সব জায়গায় পরিষ্কার হওয়াই ভালো লোকের কাজ।
হালিমা : বিশৃঙখলাকে ঘৃণা করলেও বিশৃঙ্খলা এসে পড়ে।
কুলসুম : সকাল বেলা উঠেই টপ করে ঘরখানি ঝাট দেওয়া চাই তার পর স্নান শেষ করে নামাজ পড়ে জিনিস-পত্রগুলি গুছিয়ে রাখবে। বিছানাপত্র অযত্নে পোঁটলার মতো ফেলে রাখবে না। ছেলেরা বিছানায় পেশাব করলে সে বিছানা ঊষাকালেই বাইরে সরিয়ে রাখতে হয়। দুপুর বেলা পর্যন্ত সেগুলি ঘরের মধ্যে রাখবে না। এতে মন খারাপ হয়, অসুখ-পীড়ার পথ তৈরি হয়। কাপড়-চোপড়, বই-খাতা দোয়াত-কলম, আরশী-চিরুনী সব ঠিকমতো রাখবে। সপ্তাহে যদি একবার মাত্র শৃঙ্খলার দিকে মন দাও, তা হলে শৃঙ্খলা কোনোকালে রক্ষা করতে পারবে না। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায়, দিনের মধ্যে তিনবার করে দেখবে, জিনিসপত্র যথাস্থানে আছে কি না। পথে কোন জিনিস কাকেও রাখতে দেখলে তৎক্ষণাৎ বিরক্তি প্রকাশ করবে। শৃঙখলা রাখবার জন্য সব সময় সজাগ থাকবে। বিশৃঙ্খলা ভালবাস
বলেই বিশৃঙ্খলা দূর হবে না। কুড়ে আলসেরাও বেশি রকম বিশৃঙ্খল। বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্বভাব থেকে প্রথম হতেই এই দোষ দূর করে দিতে হয়। কাপড়-চোপড়, জুতা-জামা, রান্না ঘরে ফেলে ভাত খেতে বসা ছেলেদের অভ্যাস। এই বদ অভ্যাস দেখলেই বিরক্তি প্রকাশ করবে। যথস্থানে জিনিসপত্র রাখবার প্রবৃত্তি তাদের শিক্ষা দিতে সর্বদা সচেষ্ট হবে। ভবিষ্যৎ জীবনে তাদের জীবনের অনেক দুঃখ তাতে কমে আসবে।
হালিমা : ছেলের ভাবনা ভাববার ঢের দেরি।
কুলসুম : বিয়ের পর এক বছরেই ছেলে হতে পারে।
০৬-১০. আবদুল গণি শহরে
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
আবদুল গণি শহরে যে নূতন বাড়িটি প্রস্তুত করিয়াছেন তাহা তাঁহার অফিস ঘর ও শহরের সদর স্থল হইতে কিছু দূরে।
তিনতলা মাঝারি অবয়বের বাড়িটি, প্রাচীর বেষ্টিত। ঘরের সম্মুখে প্রাচীরের মধ্যেই নবীন শ্যামল দূর্বাচ্ছাদিত ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের মাঝখানে একটা পুকুরের চারিধারে লতাগুল্ম শোভিত ফুটপাথ। বহিঃদরজার পার্শ্বের ভিতরের দিকে একটি আলোক স্তম্ভ। সারারাত্রি সেখানে বাতি জ্বলে।
তখন ঊষা হইয়াছিল। লতা-পত্রের গায়ে গায়ে বিন্দু বিন্দু শিশির জমিয়াছিল। ঊষার স্নিগ্ধ বাতাস রহিয়া রহিয়া বহিতেছিল। দুইটি সুন্দ। যুবতী পুকুরের ধারে পদচারণা করিতেছিলন। বলা বাহুল্য বাড়ির ভিতর কাহারও প্রবেশ করিবার অধিকার ছিল না। প্রতিবেশী ছেলেমেয়ে বা বউ-ঝিদের আসার কোনো বাধা ছিল না।
লতা-পত্রের মাঝখানে হালিমা ও তাহার ভাবিকে বড় সুন্দর দেখাইতেছিল। পরীবালা বলিয়া ভ্রম হইতেছিল। তাহাদের অঙ্গ হইতে মাধুরীর স্নিগ্ধ জ্যোতি বিকীর্ণ হইতেছিল।
কিছুক্ষণ হাঁটিয়া তাহারা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করিলেন। নিচের তলায় একখানা টেবিলের সম্মুখে আবদুল গণি বসিয়া সংবাদপত্র পাঠ করিতেছিলেন। হালিমা ও কুলসুম পার্শ্ব দিয়া উপরে উঠিয়া গেলেন।
আবদুল গণি ও হালিমার মাতা কোরান পাঠ করিতেছিলেন। হালিমা ও কুলসুম প্রবেশ করিলে তাহারা কোরান পাঠ বন্ধ করিলেন। হালিমার মাতা রহিমা জিজ্ঞেস করিলেন, কোথায় গিয়েছিলে মা?
কুলসুম কহিলেন-পুকুর পাড়ের বাতাস সকাল বেলায় মধুর লাগে। রহিমা হাফিজাকে কহিলেন-বু, বিকেল বেলা পুকুরে আমরা ছিপ দিয়া মাছ ধরবো।
হাফিজা আবদুল গণির মায়ের নাম। হালিমার দিকে ফিরিয়া কহিলেন–হালিমা, তুই তোর ভাবির সঙ্গে চা তৈরি কর।
কুলসুম শাশুড়ীকে জিজ্ঞেস করিলেন–ক’টি হুইল আছে?
রহিমা বলিলেন-তোমরা দুটো নেবে, আমরা দুই জা দুটো নেবো! ঠিক ঠিক চারটি হুইলই আছে।
হাফিজা কহিলেন : চারের মসলা আছে তো?
কুলসুম : না, তা তো নেই।
আবদুল গণি আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন। হালিমা যেমন ছিলেন তেমনি দাঁড়াইয়া রহিলেন।
আবদুল গণি কহিলেন–মসলার জন্য এখনই লোক পাঠাচ্ছি।
দুপুর ভরিয়া হালিমা ও কুলসুম চার প্রস্তুত করিলেন। শেষ বেলায় সূর্যকর যখন স্নান হইয়া আসিল, তখন হাফিজা, রহিমা, কুলসুম ও হালিমা ছোট পুকুরটির ধারে হুইল হাতে বসিলেন।
পুকুরের পশ্চিম ধারে বসিলে হাফিজা ও রহিমা।
অর্ধ ঘণ্টার মধ্যে একটা মাছও ধরিল না। হালিমা বিরক্ত হইয়াছাই, একটা মাছও পুকুরে ধরছে না। মাছ নেই। তখন হলিমার মা হুইল আকর্ষণ করিলেন।
একটা ছোট এক হাত রুই ঘাটের উপড় পড়িয়া লাফাইতে লাগিল।
উৎসাহে হালিমা ও কুলসুম হুইল ফেলিয়া পশ্চিম ঘাটে আসিলেন। আবদুল গণি ঘরের মধ্যে বসিয়া ব্যবসায়ের খাতা পত্র দেখিতেছিলেন। মাছ ধরা পড়িয়াছে জানিয়া তিনিও হাসিতে হাসিতে বাহিরে আসিলেন। হালিমা, কুলসুম, আবদুল গণি, রহিমা ও হাফিজা এক জায়গায় বসিয়া আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। এইখানেই মাছ ধরা শেষ হইল।
আবদুল গণি হুইলগুলি গুটাইয়া ঘরে রাখিয়া আসিলেন।
সেদিন রাত্রিকালে আহারের খুব ঘটা হইল। কোর্মা, পোলাও, মাছ, দই, ফিনী, হালুয়া, পারাটা, ভাজি, ডাল প্রভৃতি নানাবিধ রসনাতৃপ্তিকর খাদ্যের বন্দোবস্ত হইল। পাচিকা কুলসুম ও হালিমা। আবদুল গণি রান্না ভালো হইয়াছে বলিয়া ভাবি সাহেবাকে প্রশংসা করিলেন। কুলসুম কহিলেন-রান্নার জন্য হলিমাকেই তারীফ করা উচিত, কারণ হালিমাই রাঁধিয়াছেন, আমি কেবল একটু যোগাড় দিয়াছি মাত্র।
আবদুল গণি কহিলেন–হালিমা বেশ রাঁধতে পারে। আমি এটা জানতাম না। হালিমা গম্ভীর মুখে প্রশংসা গ্রহণ করিল।
রহিমা, হাফিজা, আবদুল গণি একস্থানে আহার করিতেছিলেন। হালিমার হাতের প্রস্তুত সুন্দর একখানি দস্তরখানের উপর তাহারা খাইতেছিলেন।
সেখানে কোনো কাঁচ বা চীনা মাটির বাসন ছিল না। সুন্দর দামী পরিপাটীরূপে নির্মিত কাঁসার শক্ত গ্লাস বরতনেই দস্তরখানের শোভাবর্ধন করিতেছিল। যে সব দ্রব্য নিজের দেশে প্রস্তুত হয় না, সে সব জিনিস আবদুল গণি ব্যবহার করেন না। তিনি বলেন, এতে জাতির অগৌরব কালির রঙ্গে ফুটে উঠে। পরের দেওয়া দানে ভদ্র সাজতে যাওয়া কাপুরুষের পক্ষেই সম্ভব।
আবদুল গনি পানি চাহিলেন।
হলিমা সোরাই হইতে কেওড়া দেওয়া পানি গ্লাসে ঢালিয়া আবদুল গণির হাতে দিলেন।
কুলসুম তাহার শাশুড়ীদ্বয়কে—’আর একটু দেই–আর একখানা গোস্ত-একটু চাটনী দেই’ বলিয়া বালিয়া হয়রান করিতেছিলেন। রহিমা ও হাফিজা সমস্বরে কহিতেছিলেন-না মা, আর কাজ নেই, তুমি আমাদেরকে মেরে ফেলবে দেখছি।
.
সপ্তম পরিচ্ছেদ
অনেক দিন শহরে থাকিয়া হালিমা ভাবি ও চাচি সহ বাড়ি ফিরিয়া আসিয়াছিলেন।
একখানি পুস্তক লইয়া ছাদের উপর হালিমা পড়িতেছিলেন, কুলসুম শুনিতেছিল। হালিমা জিজ্ঞেস করিলেন–ভাবি বিয়ে জিনিসটা সুখের কিন্তু ছেলেপিলে হলে জীবনের ঝঞ্ঝাট খুব বেড়ে ওঠে।
কুলসুম : তা বেড়ে ওঠে বৈকি?
হালিমা : বেশি জ্বালা হয়, রাতদিন ঘ্যানঘ্যানানি, বাহ্যি আর প্রস্রাবে। শীতকালে শুয়ে আছে-লেপের ভিতর বেশ আরামে, সেখানেই খোকা পায়খানা করবেকী বিপদ? লেপ তোষক, বিছানা-চাঁদর সব বরবাদ হয়ে যায়।
কুলসুম : ছেলেকে সব সময় মাইয়ের দুধ না দিলে এই বিপদের হাত থেকে অনেকটা উদ্ধার পাওয়া যায়। বাইরের স্ত্রীলোকদের হাতে ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া দোষ। সন্তানের জন্য স্বতন্ত্র বিছানা চাই। নিজের কছে শোয়াবে না। তিন তিনটি ভালো ‘ফিডিং’ বোতল কিনে রাখতে হয়, দুধ গরম করে নেবার জন্য একটা ছোট স্পিরিট ল্যাম্প রাখতে হয়। মোটা ছোট ছোট ৮/১০ খানা তোয়ালে রাখা উচিত। মাই-এর দুধ না দিলে বিশেষ ক্ষতি–দুধ না হলে অনেক মা গরুর দুধ দিয়ে থাকেন, তাতে খোকার অসুখ হয় না। ভার বিছানার উপর খোকাকে শোয়াবে না, দুই এক মিনিটের জন্য আদর করে শোয়ালে দোষ নেই। কাপড় না দিয়ে থোকা খুকিকে কোলে নিতে নেই। পেশাবে কাপড় পচে অল্প দিনেই ছিঁড়ে যায়। রাত্রিকালে শিয়রে দুধ, স্পিরিট ল্যাম্প, ফিডিং বোতল রেখে দিতে হয়। বোতলে দুধ পুরে নল শিশুর মুখের ভিতর ভরে দিলে মোটেই কাঁদে না কিংবা মাকে জ্বালাতন করে না। সারারাত্রি মায়ের কোলের জন্য খোকা কাঁদতে থাকলে প্রসূতির স্বাস্থ্য নষ্ট হয়। বিছানা, কাপড়-চোপড় নষ্ট হয়ে যায়। শুধু খোকাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে চলবে na, গৃহিণীকে সব দিকে চাইতে হইবে। নিজের একটুখানি সুযুক্তি ও বন্দোবস্তের অভাবে অনেক সময় স্বামীকে সেবা-সুখ দিতে পারা যায় না, নিজের জীবনের কষ্টও বেড়ে ওঠে। ছেলের কোমরের সঙ্গে একটা মোটা লেঙ্গটের মতো আবরণ বেঁধে রাখবে, তাতে হঠাৎ কাপড় বা ঘর নষ্ট হবার সম্ভবনা থাকে না। ভাত রাঁধা বা রান্নাঘরের কাজের জন্য দাসী রাখার পক্ষপাতী আমি নই; শুধু ছেলে রাখার জন্য একটা মেয়ে চাকর রাখা হয়। এই মেয়ে চাকরটিকে বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকবার তাগিদ দিতে হবে। নিজে সাবান ব্যবহার কর বা না কর এই দাসীটি যেন প্রত্যহ স্নানের সময় সাবার ব্যবহার করে, সে যেন কখনও ময়লা কাপড় না পড়ে, তার কাপড় নিজের কাপড়ের সঙ্গে বোপর বাড়ি যাওয়া চাই। দাসী জুটলে নিজের কাজ নিজেকে করতে হবে–আলসেমি করে কখনও নোংরা থাকবে না।
হালিমা : বিছানাপত্র কিরূপ হওয়া চাই?
কুলসুম : ছোট ছোট ছেলেপিলের জন্য ভালো বিছানার দরকার নেই। কোনো দরিদ্র রমণীর দ্বারা মোটা কাথা সেলাই করে তাদের জন্য ব্যবহার করবে। আদর করে খোকাকে ফরাশে শোয়ালে পেশাবে ফরাশ পচে যায়; এই ধরনের আদর তাদের বিরক্তিকর। ছেলেপিলের বিছানা স্বতন্ত্র হবে স্বামীর জন্য যে বিছানা রচনা করবে তা যেন ছেলেপিলের বাহ্য প্রস্রাবে নোংরা না হয়। একটা তোষক, একখানা বিছানার চাঁদর ও একটা বালিশ এই-ই একটা শয্যার জন্য যথেষ্ট।
হালিমা : পরবার কাপড়-চোপড় কীরূপভাবে কোথায় রাখতে হবে? স্বামীর নিজের ও সকলের কাপড় এক জায়গায় রাখা উচিত, না আলদা আলাদা করে রাখা ভালো?
কুলসুম : প্রত্যেকের কাপড় আলাদা আলাদা করে রাখা উচিত। প্রত্যেকের জন্য স্বতন্ত্র ব্রাকেটের ব্যবস্থা না করতে পারলে দড়ি ঝুলিয়ে নেবে।
হালিমা : ছোট ছোট ছেলের জন্যও ভিন্ন ভিন্ন ব্রাকেটের দরকার? তাদের তো বেশি কাপড় থাকে না।
কুলসুম : বেশি কাপড় না থাকলেও শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য শিক্ষা দেবার জন্য তাদের আপন কাপড় নিজের মতো আলাদা আলাদা করে রাখতে বলবে। যেখানে সেখানে কাপড় চোপড় ফেলে রাখা তাদের একটা বদ অভ্যাস।
হালিমা : সত্যি তারা বড় জ্বালাতন করে। মামার ছেলেরা এখানে কয়দিনের জন্য এসেছিল, তাদের দৌরাত্মে অমারা অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। মারামারি, শোরগোল, কাদাকাটি হরদম লেগেই ছিলো। প্রতি সন্ধ্যায় কে-কেথায় জুতো ফেলেছে ঠিক নেই–বাতি জ্বেলে সারা উঠান খুঁজে বেড়ান একটা নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্নানের সময় কোথায় কাপড় কোথায় গামছা ঘর বার তোলপাড় করে।
কুলসুম : পা না ধুয়ে বিছানার উপর লাফিয়ে উঠা তাদের আর একটা বদ অভ্যাস। বোকা মায়ের মতো ছেলেমেয়েকে কখনও প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়।
হালিমা : ঘরের বারান্দায় ফুলের গাছ রাখা কেমন?
কুলসুম : ফুলের গাছ বারান্দায় রাখা ঠিখ নয়। দুই একটা ছোট গাছ রেখে দেওয়া যেতে পারে। ঘরের ধারে বা বারান্দায় জঙ্গল করে রাখলে মশার উপদ্রব বাড়তে পারে।
হালিমা : বাড়িতে ফুলের বাগান না থাকলে মন নিষ্ঠুর হয়ে উঠে।
কুলসুম : সে তো নিশ্চয়। প্রত্যেক বাড়ির সম্মুখে একটা স্বল্পবিস্তৃত ময়দান এবং একটি সজীব শ্যামল ফুল বাগান থাকা চাই। মনকে আধ্যাত্মিক ভাবাপন্ন করবার এক প্রকৃত পন্থা হচ্ছে–প্রকৃতির সবুজ গাছপালার সঙ্গে যোগ রাখা। যারা গাছপালার সৌন্দর্য উপভোগ করতে জানে না তাদের মন কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের সংসারী দৃষ্টিহীন প্রাণে কোমলভাবের উদ্রেক হয় না।
হালিমা : চন্দ্রকরোজ্জ্বল নৈশ গগনের নিচে জীবনের বন্ধুকে নিয়ে প্রাণভরা হাস্যময়ী বৃক্ষ পল্লবীর মাঝখানে নিশি কাটিয়ে দেওয়া কী সুন্দর, কী স্বর্গীয়!
কুলসুম : সত্যি! কেবল পবিত্রতা ও প্রেমের মঙ্গল দৃশ্য! মরবার সময় প্রিয়ের বাহুর উপর মাথা রেখে এমন স্থানেই মরা উচিত।
হালিমা : সংসারের সব কাপড়গুলিই কি বোপর বাড়ি দিতে হবে?
কুলসুম : সব কাপড় ধোপার বাড়ি পাঠান অনেক পরিবারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ধোপর বাড়ি দিতে পারলে ভালোই হয়। কারণ নিজেরা কাপড় ধুলে দুই-এক দিনেই ময়লা হয়ে যায়। প্রতি সাত দিনে বিশ-কুড়িখানা কাপড় বাড়িতে ধোয়া কঠিন। প্রতি ১৫ দিনে ধোপাকে কাপড় দেবে। পরবার কাপড় ছয়খানা, কি আটখানা থাকা চাই। তা হলে আর নোংরা কাপড়ে বের হতে হবে না। নোংরা বিছানা, বালিশের ওয়াড় সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। সর্বদা পরিচ্ছন্ন থাকা চাই। যাদের দুই একখানা কাপড় বেশি নাই তারা সেগুলি বাড়িতে ধুয়ে নেবেন। দুই-একখানা কাপড় থাকা লজ্জার বিষয় নয়–লজ্জা অপরিষ্কার থাকায়। বিনা চাঁদরে বিছানা এবং বিনা ওয়াড়ে বালিশ ব্যবহার করবে না।
হালিমা : ধোয়া কাপড়-চোপড় পরলে মনে অহঙ্কার আসে কি?
কুলসুম : ছিঃ, কেন অহঙ্কার আসবে? পরিষ্কার থাকা দরকার তাই পরিষ্কার থাকা। মনে অহঙ্কার আসা বড় লজ্জার কথা। যাদের পরিষ্কার থাকার অভ্যাস হয়েছে, তারা যে অপরিষ্কার বা নোংরা কাপড় পরা কোনো লোককে দেখে ঘৃণা কাবে–সেটাও অন্যায়। অনেক জ্ঞানী ভদ্রলোক আছেন, যারা ময়লা নোংরা কাপড়ে থাকেন, অবশ্য অনেক জ্ঞানী লোক নোংরা কাপড়ে থাকেন বলে সেটাকে গুণ বলে স্বীকার করে নিতে হবে না।
হালিমা : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাই দরকার বটে; ছোট ছেলেপেলেকে পরিষ্কার রাখা কিন্তু অসম্ভব।
কুলসুম : ছেলেপেলেরা ধূলামাটির মধ্যে মানুষ হয়ে উঠে সেই ভালো। ছোটকাল তাদের মন বেশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে গেলে হয়তো ভবিষ্যতে খারাপ হতে পারে। তবে মাঝে মাঝে অর্থাৎ প্রতি সাত দিনে তাদের গা পরিষ্কার করে দেওয়া উচিত।
হালিমা : রান্নাঘরেই কাপড় ময়লা হয় বেশি। —
কুলসুম : কেন? রান্নাঘরে সব সময়ে কাঁধের উপর একখানা করে গামছা রাখবে। কখনও পরনের কাপড়ে হাত মুছবে না। অনেক মেয়ে ও বধূর কাপড়ে হাত মোছার অভ্যাস আছে। এ একটা খারাপ অভ্যাস।
হালিমা : আমি দেখেছি, অনেক পরিবার প্রায়ই জিনিসপত্র, কাপড়-চোপড় হারায়। হারাবার অর্থ কোথায় থাকে কারো ঠিক থাকে না। খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির সবসুদ্ধ লোক হয়রান হয়। অনেক পরিবারে এটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। ওগো আমার কাপড় কোথায় গেল–আমার গামছা কী হল–আমার জ্যাকেট কে নিয়েছে–আমার জুতা কই ইত্যাকার হাঁকাহাঁকি, চীৎকার হরদম চলতে থাকে।
কুলসুম : এমন ধারা অমনোযোগী, বিশৃঙ্খল পরিবারে হয়ে থাকে। প্রত্যেকের কাপড়, জিনিস আলাদা জায়গায় থাকলে আর বিড়ম্বনা না। বোপা কাপড় দিয়ে গেলে যার যার কাপড় তার তার কাছে থাকবে। একখানা রুমালের জন্য চব্বিশ গণ্ডা বাক্স হাতড়িয়ে বেড়ান বাড়িসুদ্ধ লোকের পক্ষে বিরক্তিকর। যে জিনিস যেখানে থাকা দরকার সেই জিনিস ঠিক সেই জায়গায় রাখতে হবে। পরিবারের মধ্যে যদি সেয়ানা কারো ঠিক জায়গায় জিনিসপত্র রাখবার অভ্যাস না থাকে, তবে তার সঙ্গে ঝগড়া-ফ্যাসাদ না করে তার কাজটি নিজেই করে দেবে। প্রত্যেকের জন্য স্বতন্ত্র গামছা থাকা উচিত। বাড়ির প্রত্যেকের জিনিস নির্দিষ্ট স্থানের একটু এদিক-ওদিক যাতে না থাকে, সেদিকে গৃহিণীর বিশেষ দৃষ্টি আবশ্যক।
হালিমা : থালা, বাটি এ সব নিত্য পরিষ্কার করা বড় জ্বালা, অথচ না পরিষ্কার করলেও ব্যবহার করা যায় না।
কুলসুম : নিত্য সকাল বেলা থালা, বাটি ছাই দিয়ে বেশ মাজতে হবে। চিনা মাটির বা কাঁচের বাসনপত্র বিশেষ মাজতে হয় না। ছেলেপেলে যে বাড়িতে আছে, সে বাড়িতে এ বিলাসিতার প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। বিদেশী জিনিস দিয়া জিনিসের দ্ৰতা করা ও বিলাস প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেওয়ায় গৌরব নেই–বরং তাতে লজ্জাই বেশি। কোনো কোনো হতভাগা মনে করে, চিনামটির বাসন ব্যবহার করলে তাদের বংশ মর্যাদা বেড়ে যাবে। মনুষ্যত্ব, জ্ঞান ও মহত্ত্বই যে মানুষকে বড় করে-এ তারা জানে না। বিদেশী বণিকেরা দয়া করে তাদের বিবাহ মজলিশ ও মিলাদ মাহফিলের শোভাবর্ধন করে-লজ্জার কথা, ঘৃণার কথা। নিজেদের কোনো শক্তি নেই, পরের অনুগ্রহে তাদের মর্যাদা বাড়ে। থালা বাটি নিজে পারলে নিজেই মেজে যথাস্থানে গুছিয়ে রাখবে। যে দাসীরা ভিতরে ভিতরে বড় অপরিষ্কার, তাদের থালা বাটি মাজতে না দেওয়াই ভালো। উপায় না থাকলে তারাই মাজবে।
হালিমা : বড় পরিবারে রাশি রাশি থালা জোটে।
কুলসুম : বড় পরিবার হলে একজনের পক্ষে পরিবারের সকল কাজ সুচারুরূপে সম্পাদন করা খুব ভয়ানক কথা। এক পরিবারে অনেক লোক না থাকাই ভালো। এতে সমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে। কতগুলি লোক অকারণে আলসে ও কুঁড়ে হয়। যার যার ভাবনা সেই সেই ভাববে, বিলেতে ছেলে বড় হলে তাকে পৃথক করে দেওয়া হয়। অনেক লোক এক সঙ্গে থাকলে বাড়ির বৃদ্ধ মাতা-পিতাকে বিপন্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত হতে হয়।
হালিমা : ভাবি!
কুলসুম : জি।-।
হালিমা : ভাবি, আপনাকে ডাকলে সব সময় ‘জি’ বলেন কেন–আমি তো ছোট। আপনি আমার ভাবি-ভাইয়ের বউ।
কুলসুম : ভদ্রতার পরিচয় দেওয়ায় দোষ কী?
হালিমা : পোশাক-পরিচ্ছদ কীরূপ হওয়া দরকার?
কুলসুম : যেমন পর, এমনি হবে।
হালিমা : মুসলমান মেয়েকে হিন্দুর মেয়ে হতে চিনে নেবার তো কোনো উপায় থাকবে না।
কুলসুম : যে পুরুষেরা নিজেদের বিশিষ্টতা ঠিক রাখে, তারাই জাতি গঠন করে। নারী যদি পোশাকের দ্বারা আমাদের বিশিষ্টতা রক্ষা করেন–তবে তা ভালোই হয়–ভিন্ন জাতির পোশাক পরে নিজের অসম্মান হয়-এও ঠিক।
হালিমা : ভাবি, তুমি সব সমযে সেমিজ, কোর্তা, ব্যবহার করো কী করে?–এতে কষ্ট হয় না?
কুলসুম : পুরুষ জামা, জুতা, কোট, পাতলুন পরে সব সময়ে অফিসে বসে থাকে কী করে? গরম লাগে বলে কি খালি গা থাকা যায়? মেয়ে মানুষের পক্ষে এক কাপড় পরে থাকা। বড়ই দোষের।
হালিমা : ছেলে হলে সেমিজ পরা চলে না। খোকা জামা ছিঁড়ে মাই খেতে চায়। গা ভরে পেশাব করে।
কুলসুম : ছেলে হলে কি কাপড় জামা ফেলে দিয়ে নেংটা হয়ে থাকতে হবে? ফিডিং বোতল মুখের কাছে ধরলেই তো কাজ চলতে পারে। রাত-দিন-টানাটানি করাবার দরকার কি? এক রকম বোতল আছে তাতে একবার সের দেড়েক মতো গরম দুধ যদি ভরে রাখা যায়, তা হলে সেই দুধে ২৪ ঘণ্টা চলে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঠাণ্ডাও হয় না। দিনে রাতে। যতবার ইচ্ছা ফিডিং বোতলে দুধ ঢেলে খোকাকে খাওয়ান যায়।
হালিমা : মাইতে দুধ জমলে মাই ফুলে ওঠে না? অবস্থায় না কুলোলে মাই এর দুধ ছাড়া উপায় কী?
কুলসুম : এক রকম যন্ত্র আছে। ডাক্তারখানায় পাওয়া যায়-তাই দিয়ে দুধ গেলে ফেললে মাই জ্বালা করে না। দুধে যদি প্রসূতির কষ্ট হয়, তবে ডাক্তারের সাহায্য নেওয়া উচিত। দরিদ্র অবস্থার কথা ভাবলে চলবে না–খোকার জন্যে দুধ চাই-ই চাই। দুধ যে তার আহার। একেবারে নিরুপায় হলে মাই-এর দুধ দেবে। এজন্য তোমাকে খালি থাকতে হবে না।
হালিমা : হিন্দু মেয়েরা জুতো পায়ে দেয় না–কারণ কী?
কুলসুম : কারণ কি, তা তো জানি না। রান্নাঘরের পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করবার জন্য হয়তো তারা জুতো ব্যবহার করে না।
হালিমা : এক একটা তাদের অন্যায় রীতি। পায়খানায় যাবার সময় জুতো খুলে রেখে গেলেই হয়। তার পর হাত-পা ধুয়ে বা অজু করে রান্নাঘরে প্রবেশ করতে পারবে। আসল কথা তারা বড় কুসংস্কারাচ্ছন্ন।
কুলসুম : তাই ঠিক।
হালিমা : কী জুতো ব্যবহার করা ভালো?
কুলসুম : মেয়েদের পক্ষে বিশেষ করে আমাদের দেশের মেয়েরা বুট বা সু পরতে পারে না। তাতে তাদের কাজের অসুবিধা হয়। চটি বা পামসু জুতোই প্রশস্ত। যে সব বাড়িতে চেয়ার-টেবিল আছে সেখানে মেয়েরা মাঝে সু পরতে পারে। অনেকবার জুতো খোলা অসুবিধা বলেইচটি ব্যবহার করতে হবে।
হালিমা : আচ্ছা ভাবি, আপনাকে তো গয়না পরতে দেখি নে–কারণ কী? গয়না না পরলে কী করে রূপ ফোটে? ভদ্রসমাজে কীভাবে বের হওয়া যায়।
কুলসুম : আমার গয়না না পরবার কারণ আছে-সে কারণ তোমাকে বলবো না। হালিমা আব্দার ধরিয়া কহিল-কারণ বলতেই হবে।
কুলসুম বলিলেন-তুমি বড় দুষ্ট-কারণ বলছি শোন, রেলে ভ্রমণ করবার সময় দেখেছি মেয়েরা লোককে গয়না দেখাবার জন্য কাপড় সরিয়ে হাতখানি বাইরে ঝুলিয়ে রেখে দেয়। সব মেয়েরই এই দস্তর। গয়না পরলেই স্ত্রী লোকের মন অহঙ্কারে ভরে ওঠে। গয়না ও রূপের চটক দেখাবার জন্য তারা অস্থির হয়ে ওঠে। নিজের মনকে এইভাবে বিভ্রান্ত করে তুলতে আমি অত্যন্ত ঘৃণা বোধ করি।
হালিমা : তা হলে কি আপনি গয়না পরতে একদম নিষেধ করেন?
কুলসুম : না, তা করি না। তোমার মতো সুন্দরীর গায়ে যদি গয়না ওঠে তা হলে রূপ শত গুণে বেড়ে উঠবে। বোন, কত মেয়ে মানুষ ছেঁড়া কাপড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে–কত ভদ্রঘরের মেয়ে অভাবে বিবস্ত্র হয়ে আছে–আমি কি করে এদের সামনে গয়না পরে রূপ দেখাই, বড় লজ্জা ও বেদনা হয়। এ বড় মানুষেমির ডঙ্কা বাজাতে চাই নে। বাইরের রূপ ও চটকের মূল্য কী? মনের উন্নতি, সৎস্বভাব নিরহঙ্কার ব্যবহার এবং আত্মমর্যাদাবোধ। মানুষের সৌন্দর্যের মূল্য। তুমি ছেলে মানুষ তোমার গয়না মানাবে ভালো।
হালিমা : ভাই বাড়ি এলে তো আপনি গয়না পরেন, দিনে সাতবার সিঁথি তোলেন–দিনে দুই তিনবার কাপড় বদলান।
কুলসুম হাসিয়া কহিলেন–পাগলি, বিয়ে হলে বুঝবে স্বামীর সম্মুখে এলে মেয়ে মানুষের মনে কি আনন্দ হয়। স্বামীর সম্মুখে পেত্নীর মতো থাকা নারীর পক্ষে অশোভন। প্রেম, মোহ যত পার স্বামীর সম্মুখে সৃষ্টি কর–আপত্তি নেই। এতে স্বামীও আনন্দ পান।
হালিমা : কি কি গয়না পরা উচিত?
কুলসুম : হাজার গণ্ডা গয়না পরে লাভ নাই–গয়না দুদিনের মোহ সৃষ্টি করে। খোদার দেওয়া সৌন্দর্যই যথেষ্ট। মোটামুটি হার, বালা, সোনার চুড়ি, অনন্ত ব্যবহার করবে। গয়না পর আর না-পর সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে, চুলগুলি ঠিক করে রাখবে?
হালিমা : মেখলা, নথ, মল-এসব?
কুলসুম : ওগুলির মধ্যে ভয়ঙ্কর মাদকতা মাখান থাকে। এ সব স্বামী ছাড়া যদি বাড়িতে আর কেউ না থাকে তা হলে ব্যবহার করা যায়। সাবধান! লোক দেখানোর জন্যে গয়না পরবে না–স্বামী মনোরঞ্জনের জন্যেই গয়না পরতে হয়–মনে যেন অহঙ্কার না আসে–অহঙ্কার এলে খোদার অভিশাপ আসে। যে মানুষ পায়ের তলে থাকতে লজ্জা বোধ করে না, তাকেই খোদা বড় করেন। পায়ের তলে থাকার অর্থ আত্মার অবনত অবস্থা নয়–কিংবা শয়তান লোকের প্রভাব স্বীকার করা নয়।
হালিমা : স্বামীর জন্যেই যে গয়না পরতে হবে, এটা জানতাম না।
কুলসুম : অন্যায় কথা। রাস্তাঘাটে কিংবা কুটুম্বের বাড়ি যেতে হলে, পায়ে অলতা পরে ফ্যাশন করে বের হবার দরকার কী? তোমার অনেক গয়না আছে–তুমি বড় মানুষের বউ-এসব কাউকে জানিয়ে লাভ কী? লোকে তোমাকে গরিব মনে করে, করুক। যে সমস্ত অসভ্য মেয়ে মানুষ গয়না ও অর্থ দেখে সম্মান জানাতে আসে, তাদের সম্মান নিয়ে দরকার নেই। যারা সৎস্বভাব, জ্ঞান ও মানসিক সৌন্দর্যকে সম্মান জানাতে জানে না, সে অভাগীদের সঙ্গে না মেশাই ভালো। গয়না ও চিত্তের চটক দেখিয়ে কারো নিকট হতে সম্মান আদায় করতে যেয়ো না।
হালিমা; ভাবি, তুমি পাতলা ফিনফিনে শাড়ি পর না, কারণ কী?
কুলসুম : এসব বড্ড কাম-গন্ধ মাখান, বড় মোহ সৃষ্টি করে, স্বামী ছাড়া অন্য করো কারো সামনে এসব পরতে নাই। অশালীন পোশাক ছেড়ে আমাদের ভদ্র পোশাক পরাই উচিত।
হালিমা : আমরা যে অনেক দিন থেকে শাড়ি পরতে অভ্যস্ত হয়েছি। নূতন পোশাক পরলে আমাদের সঙ্গিনীরা হাসবেন না?
কুলসুম : মুসলমান নারীদের অতি চমৎকার পোশাক আছে–পরলে দিব্যি দেখায়। আসল কথা পোশাকের নিজের কোনো সৌন্দর্য নাই–সভ্য, শিক্ষিত, বীর-প্রসবিনী জননীরা যা পরেন তাই ভালো। যে জাতির ভিতর অধিকাংশ মানুষ কাপুরুষ, যারা জগতকে কিছু দিতে পারে না–যারা পরকে বাঁচাতে জানে না, অপরের অনুগ্রহে বেঁচে আছে, যাদের নৈতিক ও সামরিক শক্তি নেই, তারা ভালো পোশাক পরলেও কদর হয় না। মানুষই পোশাক পরিচ্ছদকে অনেকাংশে সৌন্দর্য দেয়। তুমি কি ইচ্ছা কর–আমরা আমাদের বিশিষ্টতা হারিয়ে জগতে কৃপার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকি?
হালিমা : না, কিছুতেই না!
অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হালিমা পুনরায় কহিল–গরমের ভিতর চুল নিয়ে বড় জ্বালা হয়-ইচ্ছা করে চুলগুলি কেটে ফেলে দেই। কেউ কেউ গরমের মধ্যে চুল তাড়াতাড়ি করে ঝুঁটি করে রেখে দেয়।
কুলসুম : ছিঃ ছিঃ, দেখলে ঘৃণা হয়!
হালিমা : সব সময় খোঁপা করে রাখা কি সম্ভব?
কুলসুম : কেন, বেণী করে রাখলেই হয়। একটা বেণীতে অশান্তি সৃষ্টি হবার কোন কথা নাই, দেখতেও পরিপাটি। লাল ফিতে দিয়ে মুখটা এঁটে রাখবে–দেখলে মনে হবে, একটা গোলাপ গাছ মাথায় একটা প্রস্ফুটিত কুসুম নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হালিমা : বৌ কী করে মানুষকে তার মাথা দেখাবে?
কুলসুম : কেন স্বামী দেখবে। কুন্দ দন্তের মুক্তা শোভা, লোহিত ওষ্ঠের স্মিত হাসি, বিস্ফারিত নয়নের মোহন কটাক্ষ, চঞ্চল চরণের মাধুরী লীলা-এসব স্বামীকে দেখাবে। সতী-সাধুনীর কলহসি, বীণা বিন্দিত কণ্ঠ রাগিণী, সরল রসিকতা সবই স্বামীর হৃদয়রঞ্জনে ব্যয়িত, পথের মানুষের জন্য নয়।
হালিমা : কোনো কোনো নারী স্বামীর সম্মুখে পেত্নী–বাইরে বেরুতে হলে রানী হয়ে বের হন।
কুলসুম : তারা কি ধরনের স্ত্রী লোক তা আমি বুঝি না।
হালিমা : আঁচলে চাবি পরা কী রূপ? দেখতে মন্দ লাগে না।
কুলসুম : বাজারে আঁচলে পরবার জন্য এক রকম চাবির গোছা কিনতে পাওয়া যায়, তাই কিনে অনেক মেয়ে পরেন। বাক্স নাই অথচ চাবি আঁচলে গুঁজে লোককে দেখাতে হবে, এটা নীচতা। নিজের বাক্স থাকে সুবিধার জন্য তবে চাবি আঁচলে বেঁধে রাখতে পারে, নইলে নয়।
হালিমা : আলতা পরা কেমন?
কুলসুম : খুব ভালো। সুন্দর চরণপদ্মকে আলতা দিয়ে রাঙা করলে খায়ের সৌন্দর্য বড়ই বাড়ে। সুন্দরীরা আলতা পরা পায়ে যখন হাঁটতে থাকে, তখন মুগ্ধ মাটি কাঁপতে থাকে।-স্বামী অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন। তবে আলতার চেয়ে মেহেদী পরা ভালো, তাতে পা ভালো থাকে।
হালিমা : রাস্তাঘাটে আলতা পরে বের হওয়া কি উচিত?
কুলসুম : নিতান্তই বেহায়ামি। স্বামীর সম্মুখ ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় নারী নিজেকে। শ্রীভূষিত করবে না। শ্রী অর্থ যা পুরুষের মনে মুহূর্তের মাঝে মাদকতা সৃষ্টি করে। যে পোশাক পরলে বা যে ভাবে বের হলে মানুষের তরলভাব আসা অসম্ভব বা সহজ নয় সেই পোশাক নিয়ে বাড়ির বাইরে বের হবে। তরল ভাব-উদ্দীপক চরণ বিক্ষেপ, বিলাসময় অঙ্গভঙ্গি এসব স্বামী ছাড়া অন্য কেউ যেন না দেখে। এ সবেরই মধ্যে আবার নারীর নারীত্ব। অস্বীকার করে নিতান্ত পুরুষের মতো স্বামীর সম্মুখে গম্ভীর বদখত হয়ে দাঁড়াতে যেয়ো না। তা হলে স্বামী বিরক্ত হবেন। নারী স্বামীর কাছে হবে একখানা মূর্তিমতী কবিতা, সেখানে জ্ঞান-আনন্দ, দুই-ই পাওয়া যায়।
হালিমা : নারীদের পান তামাক খাওয়া কেমন?
কুলসুম : পান খাওয়া মন্দ নয়। পান খেয়ে লাল ঠোঁটে যুবতী যখন কথা বলেন, তখন বড়ই সুন্দর দেখায়। এতে শরীরের কোনো উপকার হয় না, আরামের একটা উপকরণ। তামাক কোনো কোনো মহিলা খেয়ে থাকেন, এতে মুখের সৌন্দর্য নষ্ট হয়।
হালিমা : হাত মোছার জন্যে সর্বদা একখানা গামছা ব্যবহার করা উচিত। অনেকে আঁচলে হাত মোছেন, আমারও অভ্যাস ছিল।
কুলসুম : রান্নাঘরে সর্বদা একখানা গামছা কাঁধের উপর ফেলে রাখতে হয়। অনেক নোংরা মেয়ের পাছার কাপড় ও আঁচলে হাত মোছবার অভ্যাস আছে। কোমরে একখানা রুমাল গুঁজে রাখাও মন্দ নয়।
হালিমা : অনেক মানুষ হঠাৎ মাটিতে বসে পড়বার অভ্যাস আছে।
কুলসুম : ঐটি বড় মন্দ অভ্যাস। এতে যেমন কাপড় খারাপ হয় অন্য দিকে মনেরও তেমনি অবনতি হতে থাকে। মনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ে। যে বাড়িতে চেয়ার আছে, মেয়েরা সেইসব চেয়ার ব্যবহার করবেন। চেয়ার না থাকলে লম্বা বেঞ্চ, টুল বা ফরাস পাতা তক্তপোষে বসবেন। মাটিতেও পাটির উপর বসা যায়। রান্না ঘরে মাটিতে বসে রান্না না করাই ভালো। চুলগুলি মাটি থেকে দুই হাত উঁচুতে হওয়া উচিত, এতে খাবার জিনিসে ধুলোমাটি বা ময়লা ছড়ানোর ভয় থাকে না।
হালিমা : আতর মাখা ভালো, না এসেন্স মাখা ভালো? সুগন্ধি মাখা কি বিলাসিতা?
কুলসুম : মাঝে মাঝে একটু আধটু মাখতে পার। আতরই আমাদের জন্য প্রশস্ত। আতর মাখার সম্মুখে যে থাকে তার মুখে বা কাপড়ে একটু লাগিয়ে দেবে। সামান্য দরিদ্র। হলেও তাকে একটু সুগন্ধি দেবে। একা একা গন্ধ-দ্রব্য মাখতে নেই।
হালিমা : কদিন পরে সাবান মাখা উচিত?
কুলসুম : আজকাল অনেক মেয়ে নিত্য সাবান ব্যবহার করেন। নিত্য সাবান ব্যবহারে বিশেষ আবশ্যকতা নেই। যারা সৌন্দর্য বাড়াবার জন্যে সাবান ব্যবহার করেন তারা ভুল করেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য সাবান ব্যবহার করা উচিত। নিত্য সাবান মাখলে গায়ের চামড়া শিথিল হয়ে যেতে পারে। সাতদিন বা পনের দিনে ব্যবহার করা উচিত।
হালিমা : যে সে সাবান ব্যবহার করা য় কি?
কুলসুম : না, যে সে সাবান ব্যবহার করলে চর্মের অনিষ্ট হতে পারে। কোনো ভালো। বিশ্বাসযোগ্য কোম্পানীর নিকট থেকে সাবান খরিদ করা উচিত।
হালিমা : মাথায় সব সময় সুগন্ধি তেল দেওয়া সকলের পক্ষে কি সম্ভব?
কুলসুম : অসম্ভব নিশ্চয়ই, দেশের লোক ভয়ঙ্কর গরিব, কোনো রকমে শাক পাতা খেয়ে এরা বেঁচে থাকে। ছোট ছোট সুগন্ধি তেলের শিশি রীতিমতো মাখলে ২/৩ দিনে শেষ হয়। নারিকেল তেল মাখলেও মাথাগরম হয়। অনেক লোক আছে তারা যেমন দরিদ্র তেমনি জোচ্চোর। ভেজাল দিয়ে জিনিসপত্র একদম নষ্ট করে ফেলে। এই জুয়াচুরি ও চুরির কারণ হয়তো দারিদ্র ও অভাব। যাই হোক, তেল না মাখ সেও ভালো, ভেজাল দেওয়া নারিকেল তেল ব্যবহার করবে না–মাথায় টাক পড়বে, মাথা গরম হবে। সুগন্ধি তেলেও অনেক জোচ্চোরি আছে। তেল সংগ্রহ করতে খুব সাবধানতা অবলম্বন করা চাই। যদি ভালো খাঁটি তেল সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তা হলে খাঁটি সরষের তেল ব্যবহার করতে পারা যায়। যে সরষের তেল বাজারে বিক্রি হয় তারও বিশ্বাস নেই। কেবল ভেজাল। কেবল ভেজাল! ভেজালে বাঙালি জীবন রসাতলে যাচ্ছে।
হালিমা : দেশের এই দরিদ্র দূর করবার উপায় কী?
কুলসুম : বিলাসী পুরুষগুলির কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। পাছে স্ত্রী অসন্তুষ্ট হন এই ভয়ে তারা অসঙ্কোচে সংসারে বিলাসিতার প্রশ্রয় দিচ্ছেন। ছেলে-বুড়ো, ধনী-মজুর যদি প্রতিজ্ঞা করে যে, তারা দেশীয় জিনিস ছাড়া বিদেশী জিনিস কিনবে না, তা হলেই আমাদের দুঃখ দারিদ্র ঘুচতে পারে-নইলে রক্ষা নেই, বাঙালির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
হালিমা : আমি প্রতিজ্ঞা করলাম আজ হতে দেশী দ্রব্য ছাড়া বিদেশী দ্রব্য ব্যবহার করবো। মোটা কাপড় পরতে পারি কিন্তু আমার ভাই-ভগ্নীকে মরে যেতে দেখতে পারি না।
কুলসুম : আবেগে হালিমাকে বুকের সহিত চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, হে আমার। পরদুঃখকাতরা প্রিয়তমা। আশীর্বাদ করি যেন তুমি তোমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পার। দেশের আর্ত দুঃখী মানুষকে ফেলে প্রাণহীনের মতো শুধু নামাজ পড়লে কী লাভ হয়? খোদা হৃদয়হীনের নামাজ দিয়ে কী করবেন? খোদা দরিদ্রের বেশে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়ান-ইসলামই তার খবর রাখে।
.
নবম পরিচ্ছেদ
পাহাড়ের পার্শ্বদিয়া দুইটি হাতি যাইতেছিল। একটার পিঠে হালিমা ও কুলসুম বসিয়াছিলেন। দুইজনের হাতে দুইটি বন্দুক ছিল। অন্যটির পৃষ্ঠে আবদুল গণি, তাহার মা ও চাচি। আবদুল গণির হাতেও, একটা বন্দুক ছিল।
চারিজন বরকন্দাজ দীর্ঘ লাঠি ও ছড়ি লইয়া হাতির পশ্চাৎ হাঁটিতেছিল।
আজ আবদুল গণি, রহিমা, হাফিজা, কুলসুম ও হালিমা সখ করিয়া শিকারে বাহির হইয়াছেন। হাতি দুইটির মধ্যে একটি ভট্টাচার্যদের। বরকন্দাজেরা কাহাকেও হাতির খুব। নিকটে আসিতে দিতেছিল না। হালিমার ব্যবহারে কোনো অসুবিধা হইতেছিল না।
তখন বেলা এক প্রহর হইবে। বাড়ি হইতে সকলে নাস্তা করিয়া আসিয়া ছিলেন। সঙ্গেও কিছু খাবার ছিল। সারাদিন শিকার অন্বেষণে পাহাড়ে কাটাইবেন–দুপুর বেলা ‘ওসমান ঝরনার নিকটবর্তী বড় পাহাড়ী গাছটার নিচে আহার করিবেন। ঘি, ডাল, চাল, মুরগী হাতির পিঠের উপর বাঁধিয়া দেওয়া হইয়াছিল। মুরগীর ডাকে হাতি ভয় পাইতেছিল বলিয়া সেগুলি আলী আহমেদের হাতে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। আহমদ বালক ভূত্য।
হঠাৎ ঝোঁপের আড়াল হইতে একটি মুরগী বাহির হইল। আবদুল গণি ইশারা করিয়া জানাইলেন, যে যেখানে আছ সেইখানে থাক। মুরগী কক্ কক্ করিয়া মাটি খুঁড়িতেছিল–এতগুলি শিকারী তাহার চারিপার্শ্বে দাঁড়াইয়া তাহা সে আদৌ লক্ষ্য করিতেছিল না।
তাহার ডাক শুনিয়া আর একটা কালো মোরগ আসিল। আবদুল গণি ইঙ্গিত করিয়া কুলসুমকে লক্ষ্য করিতে অনুরোধ করিলেন–হয়তো তিনি হালিমাকেই শিকার মারিবার আনন্দ দিতে ইচ্ছা করিতেছিলেন।
কুলসুম হালিমাকে কহিলেন–হালিমা, তুমি মোরগটার উপর সন্ধান কর–আমি মুরগীটিকে সন্ধান করি।
দেখিতে না দেখিতে কয়েকটি ছানা লইয়া আর একটি মুরগী সেখানে আসিল। কুলসুম বলিলেন-এতগুলি শিশুর মাকে হত্যা করে কাজ নেই।
হালিমা বলিলেন–কিন্তু তিনটি যেরূপভাবে একস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, গুলি ছুঁড়লে যে কার গায়ে লাগবে বলা যায় না। একটু অপেক্ষা করা যাক।
হঠাৎ মোরগটি উড়িয়া উপরের ডালে বসিল। হয়তো সে শিকারীর গন্ধ পাইয়াছিল। বিলম্ব না করিয়া হালিমা গুলি ছুঁড়িলেন, সঙ্গে সঙ্গে শিকার পড়িল। উৎসব কোলাহলে বনভূমি মুখরিত হইল। আহমদ উৎসাহে দৌড়িয়ে গিয়ে ধরিল।
সকলেই হাতি হইতে নামিলেন, মোরগটাকে নাড়িয়া চাড়িয়া আনন্দ লাভ করিতে লাগিলেন।
প্রায় অর্ধ ঘণ্টা পর তাঁহারা পুনরায় হাতির পিঠে উঠিলেন।
তোফেল কহিল–মিঞা, বাম ধারে আর একটু অগ্রসর হলে সেই হরিণের আড্ডায় পৌঁছবে। তোফেল ভৃত্য। আবদুল গণি কহিলেন–চল, সেই দিকে যাই।
তাঁহারা পুনরায় অগ্রসর হইতে লাগিলেন বনভূমির শ্যাম শোভার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কুলসুম কহিলেন এই পাহাড়ের মাঝে একখানা কুটির তৈরি করলে হয়।
হালিমা : সত্যি, সংসারের কর্মকোলাহল হতে যদি নির্জন পাহাড়ের মাঝে কিছুক্ষণ থাকা যায়; তা হলে মনের সঙ্কীর্ণতা দূর হয়।
কুলসুম : এইজন্য হয়তো ফকির দরবেশরা এবাদত সাধনার জন্য পাহাড়কে ভালো স্থান মনে করেন।
হালিমা : শুনেছি কবির নির্জন শ্যাম-লতা পত্রাচ্ছাদিত পাহাড় প্রান্তরে হ্রদের পার্শ্বে বাস করেন। সেখানে তার গভীর ও সূক্ষ্ম ভাবের সন্ধান পান।
কুলসুম : হ্যাঁ তাই। মাঝে মাঝ সংসারের কাজ থেকে বিদায় নিয়ে দূরে যাওয়া উচিত–তাতে মনকে নূতন দৃষ্টি দেওয়া হয়। অতি আপনার জন যারা, তাদের সঙ্গ ছেড়ে মাঝে মাঝে দূরে যাওয়া ভালো। এতে নূতন নূতন জ্ঞান ও ভাবের সঙ্গে পরিচয় হয়।
হালিমা : স্ত্রীলোকের পক্ষে পাহাড়ে বাস করা সম্ভব নয়।
কুলসুম : স্ত্রীলোকের পক্ষে নির্জন আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন একটু অসুবিধা জনক বটে।
হালিমা : আমাদের এই পাহাড়ে ঘর তুলে আবাস প্রস্তুত কি সম্ভব? বাঘ এসে ঘাড় মটকে দিতে পারে। বাঘের ভয়ে চিন্তা ও ভাব পালিয়ে যায়।
কুলসুম : এখানে আবাস প্রস্তুত সম্ভব নয়। এমন এক স্থান ঠিক করা চাই, যেখানে বাঘের ভয় নাই, জিনিসপত্র পাওয়া যায় প্রাকৃতিক দৃশ্য ভাবময় করুণাভরা। কিছু কিছু বসতি থাকে। কিন্তু কোনো বিবাদ নেই।
হালিমা : আমাদের এই পাহাড়ে দিনরাত থাকবার সুবিধা না হতে পারে। খুব প্রাতকালে এলাম আবার সন্ধ্যাবেলা চলে গেলাম-এমন হলে কেমন হয়।
কুলসুম : বেশ হয়। রাতে থাকলেও যে ক্ষতি হবে তা নয়, তবে একটু কেমন কেমন লাগে। হালিমা : ভাইকে একখানা কুটির তুলতে বলুন। কোন জায়গাটা ভালো?
কুলসুম : যে জায়গাটার শোভা খুব মনোহর এবং যেখানে মানুষের যাতায়াত আছে।
হালিমা : একটু উঁচুস্থানে হওয়া চাই।
কুলসুম : যেখান হতে বহু দূর পর্যন্ত নজর চলে।
হালিমা : ঘরের চারদিকে প্রাচীর থাকবে কি?
কুলসুম : না, তাতে পাহাড়ে থাকার আমোদ নষ্ট হবে।
হালিমা : চারদিকে রেলিং থাকবে?
কুলসুম : হ্যাঁ।
হালিমা : একটা রান্নাঘরও থাকবে। কুলসুম। তা থাকলে মন্দ হয় না, প্রয়োজন হলে রান্না পর্যন্ত হতে পারে।
হালিমা : ঘরের মধ্যে একটা ছোট লাইব্রেরি থাকবে, কেমন?
কুলসুম : পাহাড় ঘুরে বেড়াবে, না পড়বে? পাহাড়ের শ্যাম মাধুরী, গল্প চিন্তা এই সবই যথেষ্ট। যদি দিন-রাত্রে সমানভাবে থাকবার সুবিধা হয়, তা হলে কিছু পুস্তক রাখা ভালো। একটা টেবিল বসবার জন্যে একটা ফরাস বা খান কতক চেয়ার থাকলেই যথেষ্ট। কাগজ কলম সব সময়েই দরকার। একটি ছোট বাক্স বা আলমারীতে কাগজ-কলম রেখে দিতে হয়। পাহাড়ের মধ্যে মনে যে সব চিন্তা উদয় হয়, সে সব কাগজে লিখে রাখা উচিত। পণ্ডিত ও কবিরা পাহাড়ে বা নির্জন মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেই নাকি ভালো ভালো উপকরণ সংগ্রহ করেন।
হালিমা : মৃদু সতর্ক-কণ্ঠে কুলসুমের গায়ে ঠেলা দিয়া বলিলেন-হরিণ! হরিণ।
কুলসুম : আবদুল গণিকে ইশারা করিয়া জানাইলেন সম্মুখে হরিণ দেখা গিয়াছে। সকলেই নিশ্চল পাষাণ মূর্তির মতো স্থির হইয়া গেলেন।
রাইফেল বন্দুক–দূর হইতেই শিকার লক্ষ করা যায়। হাতির পৃষ্ঠ হইতেই আবদুল গণি বন্দুক তুলিলেন। মুহূর্তের মধ্যে একটা বিরাট হরিণ পাহাড়ের সবুজ ঢালুর উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া গেল।
আবার আনন্দ কোলাহল।
আহমদ দৌড়াইয়া গিয়া অর্ধমৃত হরিণের গলা ঠিক করিয়া ধরিল, কাঁটায় বাঁধিয়া তাহার কাপড় ছিঁড়িয়া গিয়াছিল, কিন্তু সেদিকে তাহার ভ্রুক্ষেপ ছিল না।
হাতি হইতে সকলেই নামিলেন। হালিমা, কুলসুম ও আবদুল গণির উৎসাহের সীমা রহিল না। তোফেল তাড়াতাড়ি হরিণটাকে জবেহ করিয়া দিল।
মুখ টান দিবার পূর্বে রক্তধারা আহমদের মুখে ও মাথায় যাইয়া লাগিল। অতঃপর একটা গাছের ছায়ায় বসিয়া তাহারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিলেন।
ঠিক হইল, এত বড় হরিণ যখন সামান্য এই কয়জনের পক্ষে বেশি হইয়া পড়িবে, তখন আপতত সেটাকে রান্না করিয়া কাজ নাই। শিকার আরও কিছু পাওয়া দরকার, আরও দুই একটা মুরগী বা ছোট এক-আধটা হরিণ পাইলে সুবিধা হয়।
বাম ধারে সহসা একটা মিহিন উচ্চ ভয়াবহ চীৎকার শোনা গেল। তাহা কোনো বিপন্নার আর্তনাদ বা ব্যধের আস্ফালন নহে। হরিণ যখন নির্জন পাহাড়ের শীর্ষে দাঁড়াইয়া ডাকে তখন সমস্ত বনভূমি প্রতিধ্বনিত হইতে থাকে।
আবদুল গণি সকলকে সেখানে অপেক্ষা করিতে বলিয়া তোফেলকে সঙ্গে লইয়া চীৎকার লক্ষ্য করিয়া বনে প্রবেশ করিলেন। তোফেল হালিমা বিবির বন্দুক লইল।
উদ্বেগে সকলে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। পনের মিনিট কটিল। অদূরে প্রতিধ্বনি করিয়া শব্দের পর শব্দ হইল। তোফেলের আনন্দসূচক চীৎকার শুনিয়া জানা গেল গুলি ব্যর্থ হয় নাই।
তোফেল এরফান ও কাজেমকে ডাকিল।
হাফিজ, রহিমা, কুলসুম ও হালিমা লতাপাতার ভিতর দিয়া মাথা নোয়াইয়া দেখিতে লাগিলেন।
হালিমার মুখোনি তখন প্রসন্ন ও ঈষৎ হাসিমাখা। উল্লাস চাঞ্চল্যে চোখে-মুখে-রক্ত লাবণ্য বিন্দু বিন্দু মুক্ত সদৃশ ফুটিয়া উঠিয়াছিল।
বনান্তের ফাঁক দিয়া কপাল ও চিবুকে সূর্যরশ্মি পড়িয়া তাহাকে অভিনব করিয়াছিল। তোফেল শিকার টানিয়া আনিল। ছোট একটা হরিণ-সেটা ছাগলের মতো। অতপর তাঁহারা হরিণ দুইটি ও মুরগী লইয়া নির্ধারিত স্থান অভিমুখে যাত্রা করিলেন। ঝরনাটির নাম ‘ওসমান ঝরনা’–নির্জন স্থান ছায়াময় ও পুচ্ছাদিত। সেখানে যাইয়া তাহারা আহারের আয়োজন করিলেন।
বালক ভৃত্যের সাহায্যে কুলসুম ও হালিমা নানা প্রকার খাদ্য প্রস্তুত করিলেন। বেলা যখন দুইটা তখন রান্না শেষ হইল। ছোট স্নানের তাবুটি তুলিয়া কুলসুম ও হালিমা স্নান করিলেন।
আহারাদি শেষ করিতে করিতে বেলা চারটা বাজিয়া গেল।
তোফেল ও আহমদ কহিল–আপনাদের হাতে আজ এমন তৃপ্তিসহ আহার করলাম, এরূপ তৃপ্তি সহকারে জীবনে কখনও আহার করি নি।
.
দশম পরিচ্ছেদ
হালিমা : ভাবি, ছালাম-আলায়কুম।–বাহির হইতে হালিমা ঘরের মধ্য প্রবশ করিলেন।
হালিমা কুলসুমের পার্শ্বে বসিয়া কহিলেন–ভাবি, বিয়ের পর স্বামীর প্রতি অনুরাগ জন্মে তা কি বেশি দিন স্থায়ী হয় না?
কুলসুম : স্বামী যেমন বিয়ের পর বৎসরখানেক পর স্ত্রীর জন্য তত পাগল হন না-রমণীরাও তেমনি স্বামীর প্রতি অনুরাগ হারান।
হালিমা : বড় কষ্টের কথা।
কুলসুম : অনুরাগ বা প্রবল আকর্ষণের জ্বালা অনুভব না করলেও কথা ও ব্যবহারে তা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যে দম্পতিতে তা না হয় তাদের মধ্যে নিত্য কলহ হয়। শান্তির পরিবর্তে অশান্তি এসে দেখা দেয়।
হালিমা : পুরুষের কথা শুনেছি, স্ত্রীলোকের কীভাবে মতিচ্ছন্ন হয় তা জানতে চাই।
কুলসুম : কারো প্রতি যদি আকর্ষণ অনুভব না করা যায়, তবে আর তার কথা মনে থাকে না। বয়সের গুণে স্ত্রীলোকের মনে এক সময় পুরুষের জন্য ব্যাকুলতা জন্মে–যখন এই ব্যাকুলতা দূর হয়, তখন তারা স্বামীকে দায়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে প্রাণের আবেগে নয় কিংবা প্রেমেও নয়। বিবাহ হয়েছে করা কী? স্বামীর ভাত রাঁধতে হবেই।
হালিমা : আশ্বর্য! মেয়ে মানুষের মনে এত শোচনীয় পরিবর্তন হয়!
কুলসুম : খুবই বিস্ময়ের কথা। সকল ক্ষেত্রেই কি এরূপ হয়? প্রাণের জ্বালাময় আকর্ষণে আগুন না থাকুক–একটা স্নিগ্ধ-শান্ত কর্তব্য গন্ধ মাখা অনুরাগ ধারা বইতে থাকবে তো। দিবারাত্রি স্বামীকে চোখে চোখে রাখবারে আকাক্ষা না থাক, স্বামীর জন্য বেদনা বোধ থাকা চাই। যখন কাপড় নেই, যখন ছেলেদের জন্য খেলনা দরকার, যখন চাল ফুরিয়ে গিয়েছে তখনই স্বামীর আবশ্যকতা অনুভব করা আর অন্য সময় গম্ভীর হয়ে বসে থাকা বা
নীরস কর্কশ কথা বলা–নারীরজীবনের বড় খারাপ কথা। স্বামীর মৃত্যুতে অনেক রমণী ভাত কোথায় পাবে এই ভাবনায় কাঁদে-মমতায় নয়। তার জীবনের প্রিয় বন্ধু মরে গেলো, এজন্য সে কাঁদে না। যখন বিয়ে হয় তখন মুখে হাসি ধরে না–পুরানো হলে রমণীর মুখ স্বামীর সম্মুখে আর তত প্রফুল্ল হয় না। কারণ, তখন তার মনে আসক্তি থাকে না।
হালিমা কানে হাত দিয়া কহিলেন, ওমা, আর শুনতে চাই নে। ভাবি এসব আমি বিশ্বাস করি নে।
কুলসুম : খোদার কাছে প্রার্থনা করি, তুমি যেন এইসব বিশ্বাস না কর। ছিঃ ছিঃ! যে মেয়ে মানুষ এত নীচতার পরিচয় দেয়, সে বড়ই হতভাগিনী। শিক্ষা না হলে মনের অবনতি ঘটে, যে স্ত্রীলোকের শিক্ষা নেই মনও তাদের ছোট। সর্বদা স্বামীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। কোনো কোনো রমণী সদ্ব্যবহার কাকে বলে তা বোঝে না। স্বামী যাতে সন্তুষ্ট থাকেন তাই করলেই তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা হলো। স্ত্রীলোকেরা স্বামীর বাড়িতে যখন একটু আসন করে নেন–তখন স্বামীকে বাজে জিনিস বলে মনে করেন, তখন আর স্বামীর কোনো উপদেশ গ্রাহ্য করেন না। মনে করেন আমি তো একজন হয়েছি। ছেলেপেলে হলে কোনো কোনো নারীর মনে বিলক্ষণ অহঙ্কার জন্মে। এসব কথা বলতে কষ্ট হয় কিন্তু তবুও না বলে পারছি না। তারা মনে করেন যখন ছেলেপেলে হয়েছে তখন আর আমাদের পায় কে? স্বামী কোনো কারণে স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট হলে তারা মনে মনে হাসতে থাকেন। স্বামী হয়তো দুঃখে মরে যান, স্ত্রী মজার সঙ্গে পালঙ্কে বসে কৌতুক করেন। ভাবেন এই আপদটার যদি বিশেষ অসুবিধে হয়ে থাকে তা হলে দেখুক না। এইসব স্ত্রীলোক নারী জাতির কলঙ্ক। যাদের মধ্যে বিদ্যা নাই, বুদ্ধি নাই, জ্ঞান নাই, যারা একটা পয়সা উপায় করতে পারে না, তাদের আবার
অহঙ্কার কীসের? স্বামীর গৌরবেই স্ত্রীলোকের গৌরব। স্বামীকে বাদ দিয়ে মেয়ে মানুষের। কীসের গৌরব? বি, এ, পাস বা বিত্তশালিনী বউ হলে না হয় আলাদা কথা। টাকা সম্মানের লোভে স্বামী-স্ত্রীর কোনো দোষ ধরে না। আবার লেখাপড়া জানা মেয়ে, বউ বেহায়া বা। প্রাণহীন হন না, স্বামীকে বাতাস করতে তার গা টিপে দিতে, স্বামীর আদর-যতে করতে। লজ্জা, কষ্ট বা অপমান বোধ হয় না। তিনি স্বামীর পা ধুয়ে দিতে আনন্দ বোধ করেন, দাসীরূপে নয়-বন্ধুরূপে। তিনি ভাবেন, পুরুষ পত্নী ও পুত্রের জন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ দেয়, অতএব,স্বামীকে খেদমত করলে তার অপমান হবে না। পরীর সুখের কথা মনে করে পুরুষ কামানের সম্মুখে যেয়ে দাঁড়ায়–সেই পুরুষের কাছে নারীর শুধু কৃতজ্ঞতা নয়–সহৃদয়তা দেখান একান্ত আবশ্যক। এতে অপমান কী? এইতো আনন্দ! সহৃদয়তা ও সেবার দ্বারাই প্রেম প্রণয় হয়। নেশা কয়দিন থাকে? স্বামীর হাতে গামছাখানি এগিয়ে দেওয়া, তাড়াতাড়ি জুতো, ছাতি ঠিক করে দেওয়া, স্বামী কোনো জিনিস খুঁজতে থাকলে নিজে খুঁজতে আরম্ভ করা, স্বামীর জন্যে এক বদনা পানি ভরে রাখা, এসব হৃদয়তা ছাড়া আর কিছু না। এতে স্বামী সন্তুষ্ট হন। এসব কাজে অসম্মান নেই–এসব বন্ধুত্বের প্রীতি অবদান।
হলিমা : সে তো নিশ্চয়ই।
কুলসুম : ও পাড়ার মধুর মা তার বড় তিনটি ছেলের সঙ্গে যোগ হয়ে বুড়ো স্বামীকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
হালিমা : মাগী তো বড় শয়তানী।
কুলসুম : বেচারা স্বামীর গায়ে এখন জোর নেই কিনা! বিবাহিত জীবনের পিপাসা এখন কেটে গিয়েছে কিনা!
হালিমা : তাড়িয়ে দিয়েছে না রাগ করে বের হয়ে চলে গিয়েছে?
কুলসুম : নিজে যদি রাগ করে বের হয়ে চলে গিয়েই থাকে, তাই বলে কি তাকে ফিরিয়ে আনা যায় না? স্বামীকে বাড়ির বাইরে রেখে কি করে এরা ভাত খায়, আমোদ আহ্লাদ করে। এটা তাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া আর কি? স্বামী তো নয় যেন বাড়ির ভৃত্য। দাস দাসী, ছেলে-পেলে, টাকাকড়ি, দালান-সম্পত্তি পেয়ে অনেক নারীর মনে অহঙ্কার আসে।
হালিমা : একেবারে দোজখে যাবে।
কুলসুম : ওমা, এই সমস্ত স্ত্রীলোকের দোজখ বলে ভয় আছে, তুমি মনে কর? ক’টি মেয়ে মানুষের দোজখের ভয় আছে, শতকরা একজনারও না। যারা নামাজ পড়ে, তারাও দেখাদেখি পড়ে, খোদার মমতায় নয়–দোজখের ভয়ে নয়। মন যাদের অনুন্নত তারা। আবার কি ছাই নামাজ পড়বে? অন্ধ বিশ্বাস, মূর্খতা ও কুসংস্কারের ফলে রমণী যা তা করে, তাতে তাদের একটুও লজ্জা হয় না। দোজখের আগুনের কথা, পরকালের কষ্টের কথাগুলিকে অনেক রমণী রসিকতা করে ভীত না হয়ে হাসতে থাকে।
হালিমা : গর্বিত স্ত্রী যে স্বামীর সঙ্গে এমন ব্যবহার করে–আচ্ছা, স্বামী যদি রেগে একটা ভয়ানক কিছু করে বসে?
কুলসুম : সাত ছেলের মাকে কেউ তালাক দেয় না। হালিমা : দিলে কী হয়?
কুলসুম : দিলে দুঃখের একশেষ। কঁদতে জীবন যায়-পথের ভিখারিণী হতে হয় ছেলেরা বাপের বাড়ি থুয়ে মার সঙ্গে যায় না। যতই যা করপেটের চিন্তায় সব উৎসাহ মায়া নিবে যায়। তালাক দিলে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে স্ত্রীলোকের যেতেই হবে–না যেযে। উপায় নেই। তবে এরূপ ভয়ানক কাজ কোনো স্বামী করে না। মূর্খ স্ত্রীলোক না বুঝে স্বামীর সঙ্গে অনেক সময় দুর্ব্যবহার করে। তাই বলে তাকে হত্যা করা মানুষের কাজ নয়। সহ্য করাই পৌরুষ, প্রতিশোধ নেওয়া কাপুরুষতা।
হালিমা : তা হলে পুরুষকে অত্যাচারী রমণীদের অত্যাচার সয়ে থাকতে হবে। এতে যে জীবনের অনেক শক্তি কমে যায়। ঘরের ভিতর অশান্তি ও বেদনা ভোগ করে, কোনো পুরুষ কোনো কর্ম করতে পারে না।
কুলসুম : স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া-ফ্যাসাদ না করে বা তাকে দূর করে না দিয়ে সতর্ক করে দেওয়া উচিত। তাদের কথার উত্তর না দেয়াটাই কর্তব্য। অনেক সময় পুরুষেরা স্ত্রীর অত্যাচারে নূতন স্ত্রী গ্রহণ করেন এবং স্বতন্ত্র সংসার প্রতিষ্ঠা করেন। অভাগিনীদের এই দুরবস্থার কারণ তাদের নিজের দোষ।
হালিমা : স্বামী যখন দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন,তখন আগেকার স্ত্রীর মনে কি খুব কষ্ট হয়?
কুলসুম : খুব কষ্ট হয়–কিন্তু তখন আর উপায় থাকে না–চিরদিনের জন্যে সে স্বামী হারা হয়।
হলিমা : সখের বসে কোনো স্বামী নূতন স্ত্রী গ্রহণ করে নাকি?
কুলসুম : তোমার মতো সাধ্বী পতিগতপ্রাণ, সদালাপী, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সুন্দর স্ত্রী যার ঘর উজ্জ্বল করবে, সে কোনো দুঃখে নতুন স্ত্রী গ্রহণ করবে? স্ত্রীলোকের রূপ অপেক্ষা কথা বলার শক্তি স্বামীকে গভীরভাবে মুগ্ধ করে। আনারী অসভ্য স্বামীর কাছে আদর না। থাকতে পারে, কিন্তু শিক্ষিত লোকের কাছে আছে।
হলিমা : স্বামীকে কথার দ্বারা মুগ্ধ করা কি কম কথা? মেয়ে মানুষের এমন শক্তি কোথায়??
কুলসুম : নারীর মুখের একটা জ্ঞানপূর্ণ মধুর কথা, স্বামী দশটি বলেই গ্রহণ করেন। সুতরাং ভয়ের কোনো কারণ নেই।
হালিমা : নারীর লেখাপড়া শেখা নিতান্ত আবশ্যক।
কুলসুম : পুরুষ জাতির মঙ্গলের জন্য-বাঁচিবার জন্য-পুরুষকে পাপ ব্যভিচার থেকে রক্ষা করিবার জন্য বিদ্যালাভ করা আবশ্যক। বিদ্যা ব্যতীত নারী যে পশু অপেক্ষা অধম।
১১-১৫. স্বামীর বাড়িতে বিশেষ সতর্কতা
একাদশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম : প্রিয় বন্ধু, স্বামীর বাড়িতে একটা বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা চাই।
হালিমা : সেটি কী?
কুলসুম : বাহুল্য ব্যয় করা যাবে না।
হালিমা : স্বামী যখন সংসারের ব্যয় নিজ হাতে করেন, তখন আর ব্যয় বাহুল্যের ভয় কী?
কুলসুম : স্বামী বাইরে থেকে যে জিনিস-পত্র নিয়ে আসবেন, তা দেখে শুনে খরচ করলে যে জিনিসে স্বামীর অবস্থা ভালো হলেও খরচ সম্বন্ধে বেপরোয়া হতে নেই। হিসাব করে খরচ করলে যে জিনিসে দুদিন চলতো সেই জিনিসেই তিন দিন চলবে। ভালো গৃহিণীর হাতে অল্প টাকাতে সংসার বিনা কষ্টে চলে। পরিবারে অন্য সকলে বেহিসেবী হতে পারে, গৃহিণী বেহিসেবী হলে বড়ই বিপদের কথা। তেল, লবণ, একটা মরিচ, একটা পেঁয়াজ বা নগণ্য দুই ফোঁটা কেরোসিন তেল নষ্ট হলে কি ক্ষতি, এ কখনোও ভেবো না। আমাদের মহানবীকে অনুকরণ করা সকল মুসলমান নারীর উচিত। তিনি পরিত্যক্ত বাতির পলতে টিপে তেল বের করতেন। স্বামী বাইর থেকে জিনিসপত্র কিনে আনতে পারেন, সেগুলি কীভাবে খরচ হবে তার হিসাব তিনি রাখেন না। সে হিসাব গৃহিণীর কাছে।
হালিমা : বাড়িতে কী প্রকারে খাবার জিনিসপত্র ব্যয় করতে হয়?
কুলসুম : সকাল বেলা উঠে সকলের কিছু নাস্তা চাই (দরিদ্র পরিবারে এজন্য বিশেষ কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় না, সুতরাং খরচও নাই)। মুড়ি, বিস্কুট, পাউরুটি, মোহনভোগ, চিড়ে, কলা, গুড়, চিনি, মিছরি, টাটকা দুধ বা বাসি দুধ সাধারণত নাস্তারূপে ব্যবহার করা যায়। সকালে ছেলেরা ঠাণ্ডা ভাতও খেয়ে থাকে-নাস্তার সুবিধা করতে পারলে বাসি ভাত
খাওয়াই ভালো। সকাল বেলায় ছেলেদের এই ভাত খাবার দৌরাত্মে কাজের ঝঞ্ঝাট বড় বেড়ে ওঠে। মুড়ি, বিস্কুট, পাউরুটি, চিনি নাস্তার জন্য ব্যবহার করলে বেশ হিসাব করে খরচ করতে হবে। চিনি ছেলেপেলেরা একদিনেই দু-সের শেষ করতে পারে। অথচ হিসাব করে খরচ করলে আড়াই সের চিনিতে একমাস চলে। মুড়ি, বিস্কুট, একজায়গায় বসে একা অনেক খেয়ে ফেলা যায়–নিয়ম মতো ব্যবহার করলে দুজনের তা পনর দিন চলে। খাওয়া দাওয়ার একটা নিয়ম থাকা চাই-রাতদিন মুখে হাত বেঁধেই আছে–এ ভালো নয়। সবাইকে নিয়ম ও পরিমাণ মতো খাওয়াবে। নাস্তার জিনিসপাতি দেওয়ালের আলমারির ভিতর বন্ধ করে রাখতে হয়। কোনো কোনো মা নীচতা ভেবে ছেলেদের খাওয়া-দাওয়ার হিসেব রাখেন না-এতে অনেকখানি অসুবিধা হয়। ছেলেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সংসারের ব্যয়ের উপর কড়া নজর রাখতে হবে। সপ্তাহে বা মাসে একদিন কোনো ভালো জিনিস যত খুশি পেট ভরে খাওয়া যায়-রোজ এমন করলে ফকির হতে হয়।
হালিমা : নাস্তায় ঘি, ডিম ও রুটি ব্যবহার কর কেমন?
কুলসুম : এগুলি গুরুপাক, তা ছাড়া সকল পরিবারের সংগ্রহ করাও কঠিন। যত ভালো খাওয়া যায় তত ভালো–আবার আয় বুঝে ব্যয় না করলে শেষকালে মন্দ খাবারও জোটে না। রুটি তৈরী করে নেওয়া যায় সুতরাং বিশেষ কোনো অসুবিধা হয় না। প্রত্যহ ডবল ডবল চুলো ধরান অসুবিধা, একটা স্টোভ কিনলে কাজ চলতে পারে। স্টোভেও যে বিরক্তি নাই তা বলা যায় না–যে নাস্তার সঙ্গে চুলো ধরানোর সম্বন্ধ নাই সেইরূপ নাস্তা ব্যবহার করাই ভালো। ছেলেদের জন্য কতকগুলি রুটি তৈরি করে রাখলে মন্দ হয় না। বারে বারে ভাতের জন্য হাঁড়িতে হাত দেওয়া বিরক্তি কর। যখন ইচ্ছে তখনই তারা নিজ হাতে রুটি নিয়ে খেতে পারে। এতে এটো কম হয়, ছেলের ক্ষুধা হলেই খাবে।
হালিমা : ভাত কোন সময় খাওয়া উচিত? কুলসুম : যার যার সময় মতো, তবে তা প্রত্যহ এক সময় হওয়া উচিত। হালিমা : খাবার আয়োজন কেমন হবে?
কুলসুম : খাবার আয়োজন কেমন হবে, তা ঠিক করে বলা কঠিন। সাধ্যমতো খাওয়া ভালো করতে পারলে লাভ ছাড়া লোকসান নেই। কারো কারো ধারণা যা তা খেয়ে দিন। গুজরিয়ে দিতে পারলেই হল। আয় বেশি না হলে যা তা খেতে পারা যায়। হাতে যদি টাকা। থাকে তবে খাবার বেলা কৃপণতা করতে নেই। বাবুগিরি করে টাকা উড়িয়ে দিয়ে খাবার বেলা মাটি খাওয়া ঠিক নয়। সংসারের জন্য সব খরচ কমিয়ে খাবার ব্যবস্থা ভালো করতে পারলে তাই করবে। আয় না থাকলে পক্ষান্তরে খাওয়া কমাতে হবে সেইটাই মনুষ্যত্ব। দেনা শোধ না দিয়ে ভালো খাবারের ব্যবস্থা অভদ্রতা। বধূ বাপের বাড়িতে খুব খরচ করে এসেছেন বলেই স্বামীর বাড়িতে সেইভাবে চলতে হবে, এমন কোনো কথা হতে পারে না। মেয়েরা স্বামীর বাড়িকেই নিজের বাড়ি মনে করবেন। স্বামীর যেমন অবস্থা, তেমনি করে চলতে হবে। মাসে কতখানি তেল খরচ করতে হবে, তা স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া। উচিত। এতে অপমান বোধ করতে নেই। নিজের ইচ্ছামত রান্নার ব্যবস্থা করবে না। মাছ,মাংস,তরকারি একেবারে শেষ করতে হবে না, কয়বার চালাতে হবে, তা নরম ভাষায় ভদ্রতার সঙ্গে স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া উচিত। অবজ্ঞাপূর্ণ ভাষায় এ সব জিজ্ঞাসা করা ভালো না। কোনো জিনিস রান্না হলে বা বাইর হতে কোনো জিনিস এলে একবারেই সে-সব শেষ না করে দিতে চেষ্টা করবে। গৃহিণী সব নিজে খেয়ে ফেলেন এ বলছি না। ফল কথা, স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা করবে।
হালিমা : জিনিসপত্র কীভাবে খরচ করতে হবে তা জিজ্ঞাসা করায় মেয়ে মানুষের। বিরক্তি জন্মে না কি?
কুলসুম : অনেকে বিরক্ত হন, যেমন ইচ্ছা খরচ করে যান, তাতে স্বামী জেলে যাক, স্ত্রীর তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। স্বামীর প্রতি সহানুভূতি রাখা নারীর কর্তব্য। অনেক রমণী স্বামীর খরচপত্রের প্রতি বিদ্রূপবাণ বর্ষণ করেন–এমন করতে নাই। এতে স্বামী বড় আঘাত পান।
হালিমা : গৃহিণীরা ইচ্ছামত রান্না করেন নাকি?
কুলসুম : অনেক মহিলা স্বামীর কোনো জিনিস খেতে যদি বিরক্তি হয় তবে গৃহিণীর নিজের কাছে যা ভালো লাগে তিনি তাই রান্না করেন। মন যাদের বড় তারা নিজের সুখের চেয়ে পরের সুখের দিকে দৃষ্টি রাখেন। পরকে খাইয়ে যেমন সুখ লাগে, নিজে খেয়ে কি তেমন সুখ লাগে?
হালিমা : তা তো ঠিক। আচ্ছা, পরিবারের মধ্যে তৈরি জিনিস কাকে কতটুকু দেওয়া হবে?
কুলসুম : এক পরিবারে বহু লোক থাকলে তৈরি জিনিস দেওয়া নিয়ে একটু বিপন্ন হতে হয়। বহুলোক একসঙ্গে না থাকাই আমার কাছে ভালো লাগে। একসঙ্গে থাকলে পরিবারের অনেকে মনে করে তাদের উপর গৃহিণীর অত্যাচার হচ্ছে। সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন। হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবার সৃষ্টি করাই ভালো, এতে মেয়েদের কাজ কমে, পরিবারে সকলে আত্মনির্ভরশীল হয়ে গেলে কুড়ের মতো বসে না থেকে সকলে নতুন নতুন উপায়ের পন্থা অবলম্বন করেন।
হালিমা : কাজকর্মের সুবিধা হয়, অনেক ঝগড়া অশান্তির হাত থেকেও অব্যাহতি পাওয়া যায়। কিন্তু যেন কেমন লাগে! ভাগ ভাগ হয়ে যাওয়া–এর ভেতর যেমন। অনেকখানি নিষ্ঠুরতা আছে। যার যার মতো সেই সেই-কেউ কারো দিকে ফিরে তাকাবে না–কেমন কথা!
কুলসুম : এতে নিষ্ঠুরতার কিছুই নেই–ভিন্ন ভিন্ন হয়েও একজন অন্যজনের সহায়তা করতে পারেন। না করলে ভয়ানক অন্যায় হবে। কাজের সুবিধার জন্য স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র খাবার। ব্যবস্থা ছাড়া এ আর কি, ভাগ হয়ে গেলে মানুষের চৈতন্য হয়। কুঁড়েমি করে উদাসীনতা দ্বারা জীবনকে হীন করে দেবার লোভ দূর করে। পরের ঘাড়ে চড়ে খাওয়া আর একটু শুকিয়ে মরা নিজের কাছে বিরক্তিকর ও অন্যায়। বিলাতে ছেলেমেয়ের বিয়ে হলেই স্বতন্ত্র ব্যবস্থা বা পরিবারের সৃষ্টি হয়। আমরা অতদূর যেতেই পারি না। মা-বাপকে ছেড়ে নতুন ব্যবস্থা করা আমরা অধর্ম মনে করি। এদেশের মাতা-পিতা ছেলেপিলেকে লেখাপড়া শিখান, ভবিষ্যৎ জীবনে ছেলেদের সম্মান ও সুখের অংশী হবার জন্যে। উন্নত দেশে বাপেরা ছেলেকে সংসারে প্রতিষ্ঠিত হলে তারা সুখী হন–অধিক চান না। তাঁরা খাবার বা সম্মানের লোভ করেন না। কারণ তারা বড় মানুষ।
হালিমা : তৈরি জিনিস কাকে কতটুকু দিতে হবে?
কুলসুম : তার একটা বাধাধরা নিয়ম নেই। ছেলেরা বারে বারে চায় সুতরাং তাদের অল্প অল্প করেই দিতে হবে। গৃহিণী যাকে যা দেওয়া ঠিক মনে করেন, তাই দেবেন, এ সম্বন্ধে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম বলে দেওয়া যায় না। পরিবারের কর্তা যিনি, তিনি নিজে ইচ্ছা করে বেশি খেতে ন চাইলেও তার খাওয়া-দাওয়ার দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা উচিত। সব দিয়ে নিজে কিছু খাবে না তাও ভালো নয়। স্বামী অনিচ্ছা প্রকাশ করলে তাকে অনুরোধ করে খাওয়াবে। অন্তরের ভালবাসা কাজে প্রকাশ করে দেখাবে। অন্তরে-ভালবাসা। আছে–বাইরে কোনো কাজে তার প্রকাশ নেই-এরূপ ভালবাসার কোনোই মূল্য নেই। অকৃত্রিম বন্ধু যিনি, তাকে খাওয়াতে হবে–উপহার দিতে হবে। পরম অত্মীয় বা পরম বন্ধুকে, সামান্য হলেও উপহার দিয়ে এবং খাইয়ে মায়ার পরিচয় দিতে হবে।
হালিমা : অনেক বাড়ি দেখেছি-ভাত তরকারি পচে যাচ্ছে–বাইরে পড়ে থাকে–কাক-কুকুরে খেয়ে যায়।
কুলসুম : আহ, এ বড় অন্যায়-বড় গোনাহ্। ভাত তরকারি কখনও ফেলে দেবে না। নিজেরা না খেতে পার–যত্ন করে তুলে রেখে কোনো দরিদ্রকে দিয়ে দেবে। বস্তা বস্তা ভাত তরাকরি পচান-বড় অন্যায়। হিসাব করে রান্না করলে ভাত নষ্ট হতে পারে না। বাসি তরকারি ফেলে না দিয়ে গরম করে ব্যবহার করা যায়। শরীর খারাপ হবার সম্ভাবনা। হলে বাসি না খাওয়াই উচিত। ডাল, তরকারি পেয়ালা ছাড়া ভাতের উপর দিতে নেই, যাকে যতটুকু দেওয়া দরকার একবার দিয়ে বলে দেবে–এই শেষ। যে খায় তার মুখে অনবরত এ দাও, আর একটু চাই,-এ-সব ভালো নয়। যত পাওয়া যায় ততই খেতে ইচ্ছা হয়। প্রত্যেক কাজেই সীমা বা সংযম রক্ষা করতে হবে-সংযমই সুখ-শান্তির মূল।
হালিমা : ধান চালের বিনিময়ে জিনিসপত্র কেনা কি ভালো?
কুলসুম : সর্বনাশ, অমন কাজ করতে নেই! জুয়াচোর ফেরিওয়ালারা মূর্খ মেয়েদের কাছ থেকে চাল-ধান বা অন্যান্য দ্রব্য দিয়ে জিনিসের চতুগুণ দাম আদায় করে।
হালিমা : আবশ্যক না থাকলেও হাতে পয়সা থাকলে সস্তা পেলে কোনো জিনিস দেখলে, কোনো ভালো নয় কি?
কুলসুম : বড় খারাপ। মনে কর মাছ দরকার নেই, কেউ মাছ নিয়ে বাড়িতে হাজির হল। তুমি মাছ দেখে লোভ সংবরণ করতে না পেরে বললে মাছ দাও, নেবো। মিঠাইওয়ালা এসে হাজির হল–তুমি আর ঠিক থাকতে পারলে না–হাতে পয়সা আছে কিনা সে জ্ঞানও নেই, কিনে ফেললে দুই সের; এক চতুর মনোহরী দ্রব্য বিক্রেতা কতগুলি মনভুলানো জিনিসপত্র এনে তোমাকে সহজেই ভুলিয়ে ফেলতে পারে। সংসারের কত্রী হচ্ছেন গৃহিণী। যদি খরচপত্র সম্বন্ধে বেহিসাবী হন, তা হলে পরিবারের উন্নতি হয় না। বেহিসাবী গৃহিণীদের দোষে অনেক পরিবারের বড় শোচনীয় অবস্থা হয়।
হালিমা : ছেলেদের বা নিজের কখানা কাপড় থাকা দরকার?
কুলসুম : এ সম্বন্ধে ঠিক করে কিছু বলা কঠিন। অনেক কাপড় থাকা অন্যায়, এ আমি বলি না। অনেক মেয়ে আছে তারা প্রচুর কাপড় কেনে কিন্তু ব্যবহার করে না–নতুন নতুন কয়েকদিন ব্যবহার করে তারপর হয়ত শুধু শুধু বাক্সবন্দি করে রাখে! দরিদ্র স্বামীর পয়সা অপব্যবহারে তাদের একটুও কষ্ট হয় না। মূর্খ যেমন, তার মনে না আছে দয়া-না আছে তার হিসাব। ছেলের অনেক কাপড় আছে, তবুও গৃহিণী অনেক সময় হুকুম দেয়, আরো কাপড় চাই। কোনো কোনো মেয়েকে দেখেছি, তারা গায়ের জামা, সেমিজ এবং দামি শাড়ি দিয়ে থোকার বিছানা রচনা করেন। কখনও সেগুলি দিয়ে পা মুখ মোছা হয়। কী বিড়ম্বনা!
হালিমা : আশ্চর্য!
কুলসুম : লেখাপড়া না জানলে মানুষের কত যে মতিভ্রম হয় তার কি ইয়ত্তা আছে? জ্ঞান ব্যতীত মানুষ অসভ্য হয়। বাপ-মা মেয়েদের লেখাপড়া শিখান না, ফলে মেয়েরা পুরুষ সমাজের দুঃখ বাড়িয়ে দেয়। দুই-একটা মেয়ে আপনা-আপনি গুরুজনের মৌখিক শিক্ষা ও তাড়নার ফলে কিছু সভ্য হয় কিন্তু কয়েকটা মেয়ে তো আর বঙ্গের ঘরে ঘরে যেতে পারে না।
হালিমা : লেখাপড়া শিখলে প্রত্যেক কাজে বিবেচনা আসে–কী করতে হবে, কীভাবে চলতে হবে, ঠিক করে নেওয়া যায়।
কুলসুম : সব কাজে হিসাবের পরিচয় দিতে হবে যেমন আয় ঠিক তেমনি ব্যয় করা চাই। বিয়ে করে পুরুষ স্ত্রীর দাস হয় না, তার প্রতি স্ত্রীর সহানুভূতি থাকা আবশ্যক। নইলে স্ত্রীর জীবেনের সার্থকতা কী? পুরুষ গোল্লায় যাক, তাতে আমার কি-এরূপ চিন্তা করে রমণীর মনে স্থান দেওয়া ঠিক নয়! জিহ্বাকে প্রশ্রয় দাও, যখন যা মনে সে তাই কর, সংসারের ব্যয় সম্বন্ধে কোনো হিসাব রাখো না–এতে জীবনে দুঃখ বাড়বে বই কমবে না, সংসার রসাতলে যাবে। মাথায় কোনো ব্যারাম নেই তুবু শিশি শিশি গন্ধতেল কেনা কি দরকার? এত পয়সা আয়ের পথ কোথায়? অবশ্য সখ করে মাসের মধ্যে দু-একদিন ব্যবহার করা যেতে পারে স্ত্রীর বেহিসাবী চালচলনের জন্য স্বামীকে একজন আস্ত চোর হতে হয়। অনেক নারী আছেন যারা নিজের গয়না ও খরচের সুবিধের জন্যে প্রকারান্তরে স্বামীকে অত্যাচারী ও ঘুষখোর হতে উৎসাহ দেন। হিসেব মতো জিনিসপত্র করলে সংসারে দুঃখ প্রবেশ করে না। ঘরের জিনিস আছে-ফুরিয়ে গেলে ভারে ভারে আবার আসবে–অতএব ভয় কি-দেদার খরচ কর, ফেলে দাও-কাক-কুকুরে খেয়ে যাক–যে মেয়ে এইরূপ কাজ আরম্ভ করেন তিনি বড় অবোধ-অল্প দিনেই তিনি দুঃখে পড়েন।
হালিমা : নিশ্চয়ই।
কুলসুম : অনেক বাড়িতে পান, চুন ও সুপারির কী অবস্থা হয় জান?
হালিমা : না।
কুলসুম : গৃহিণীর সম্মুখে পান পচে, চুন শুকিয়ে যায় ও সুপারি গড়িয়ে বাইরে পড়তে থাকে, কেউ দেখে না।
হালিমা : গৃহিণী বুঝি পান খান না।
কুলসুম : ফরমাইস করলেই যখন নতুন আসে, তখন আর এতে চিন্তার কারণ কী?
হালিমা : আশ্চর্য কথা!
কুলসুম : আরো শোন–অনেক বাড়িতে সারারাত্রি বাতি জ্বলতে থাকে, গৃহিণী তা গ্রাহ্য করেন না। বৃথা তেল পোড়ান কী ভালো?
হালিমা : না, তাতে খরচ বাড়ে।
কুলসুম : নির্জন কামরায়–স্বামী-স্ত্রী ছাড়া যেখানে আর কেউ থাকে না–সেখানে রাত্রিকালে একটি ক্ষীণ প্রদীপ জ্বলতে থাকলে বিশেষ ক্ষতি নেই।
হালিমা : গ্রামে সেইরূপ হওয়া উচিত নয়।
কুলসুম : যে পরিবারে স্বামী স্ত্রীর সম্মানের প্রতি কারো বিশেষ লক্ষ্য নেই–সেখানে ভয় করেই চলতে হবে।
হালিমা : এটা বড় বিরক্তিকর।
কুলসুম হাসিয়া কহিলেন–মেয়েদের আর একটা অভ্যাস আছে তারা স্বামীকে সর্বদা পুরানো গয়না ভেঙ্গে নতুন রকমে গড়ে দেবার জন্য অনুরোধ করেন। নাকের ফুল, গলার হার, কানের মাকড়ি, হাতের বালা, কটির মেখলা যেমন করেই গড়ে দেওয়া হোক না–কিছুদিন ব্যবহার করে গৃহিণী স্বামীকে অনুরোধ করেন–এইরূপ নয় ঐ যে আমির মিঞার বিবির গায়ে যেরূপ দেখলাম, অমনধারা করে গড়ে দিতে হবে। কিছুদিন পরে আবার নতুন ফরমাইস হবে। বেচারা স্বামীকে জব্দ করা ছাড়া এ আর কি?
হালিমা : দাদীর একটা গায়ের কাপড় আছে, সেটা নাকি পনর বৎসর আগে কেনা হয়েছিল–কোনো দিন সেটা তিনি ব্যবহার করেন না। ব্যবহার যদি করা না হবে, তবে এইভাবে জিনিসপত্র কিনে পয়সা নষ্ট করে লাভ কী?
কুলসুম : কোনো লাভ নাই। মেয়েদের অভ্যাস, তারা জিনিসপত্র কিনবে, গয়না পরবে, কিন্তু ব্যবহার করবে না। বছরে এক বা দুই দিন তোক দেখানোর জন্য শাড়ী-গয়না পরা নীচতা। বাইরে সাত লোকের কাছে যত সাদাসিদে হয়ে বের হওয়া যায় ততই ভালো। শুধু লোককে দেখাবার জন্য পয়সা ব্যয় করা ঠিক নয়। অনেক মানুষ বিলাস উপকরণ যোগাড়ে পথের ফরিক হন–সম্মান চটকে বাড়ে না–সম্মান হয় জ্ঞানে, পবিত্রতায় ও মনের শান্তিতে। এ হতে আবার মনে করো না, শুধু সম্মানের জন্য মানুষকে জ্ঞানী ও পবিত্র হতে হবে। জ্ঞানী, চরিত্রবান ও নীতি-শক্তিতে বলীয়ান হলে সম্মান আপনি এসে জোটে।
হালিমা : চটক দেখাতে গিয়ে অনেকে ফকির হয় নাকি?
কুলসুম : গয়না পরে চটক দেখানোতে বিশেষ ভয়ের কারণ নেই। গয়নার পয়সা নষ্ট হয় না–ঘরেই থাকে। অনেকে স্ত্রীর গয়নাকে সম্পত্তির মধ্যে ধরেন। এইভাবে সম্পত্তি করার কোনো অর্থই নেই। স্ত্রীকে গয়না দিতে হবে না–এ আমি বলছি না। গয়নাকে সম্পত্তিরূপে মনে করা বোকামি।
হালিমা : গয়না পরে চমক দেখানোতে বিশেষ ভয় নেই কেন?
কুলসুম : না এতে ভয় নেই,তবে হরদম নতুন নতুন অলঙ্কার তৈরি হচ্ছে কেবল বাক্সে তুলে রাখবার জন্যে! গয়না তৈরির টাকা ব্যাঙ্কে রাখা হয় তবে তা দেশের ও দশের কাজে লাগে।
হালিমা : সব কাজেরই একটা সীমা আছে। যেগুলি মানায় এবং পরিমিত বলে মনে হয় এমন কতকগুলি গয়না গড়ালেই চলতে পারে।-কেমন?
কুলসুম : হ্যাঁ তাই কিরূপে চটক দেখাতে গিয়ে মানুষ ফকির হয় বলছি, শোন–সংসারে খাবার পরার দরকারই বেশি এই কথা ভুলে-ভবিষ্যতে খোদার ঘাড়ে সোপর্দ করে বোকার মতো অনেক মানুষ বাহুল্য ব্যয় করে। কাপড়ে-চোপড়ে, নাচে তামাসায়,বন্ধু মহলে অনেক নরনারী অজস্র টাকা ব্যয় করে সর্বস্বান্ত হয়। অবশ্য পয়সা থাকলে হিসেব মতো কাপড়-চোপড় বা কোমা-কালিয়া খাওয়া, তামাসা-উৎসবে বা বন্ধুমহলে ব্যয় করা দোষাবহ নয়; বিশেষ করে খাদ্য সম্বন্ধে ব্যয় যত বেশি সম্ভব তা করা উচিত। বলছি আয় বুঝে ব্যয় করতে হবে। অনেক নারী পরিবারের খাবার পরবার টাকা। কোথা হতে আসে কোন খবর রাখেন না। স্বামী যোগাড় করতে না পারলে স্ত্রী ভাবেন এটা স্বামীর চালাকি। ছেলেদের ছাতা, জামা, জুতা, নিজের গয়না, ময়দা, চিনি, লুচি, হালুয়া এবং মুরগীর ফরমাইস দেবার আগে বধূ যেন ভবিষ্যতের কথা ভাবেন, স্বামীর আয় সম্বন্ধে একটু হিসেব করে দেখেন!
.
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম কহিলেন–কার বাড়িতে কেমন রান্না হয়, গৃহিণী কত রকম খাদ্য ও আচার প্রস্তুত করতে পারেন, এই দেখে অনেক লোক পরিবারের কদর সম্বন্ধে ধারণা করে, এটা কিছু নয়। রান্নার মধ্যে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব খুঁজতে না যাওয়াই ভালো
হালিমা : তা ঠিক, রান্না করতে জানাই যদি মনুষ্যত্বের নিদর্শন হতো, তা হলে বাবুর্চির দলকে বেশি সম্মান করা কর্তব্য।
কুলসুম : কোনো কোনো মেয়ে অনেক রকম জিনিস তৈরি করতে জানে বলে লোকের কাছে গর্ব করেন। তাদের মন কত ছোট–তারা সংসার ও জ্ঞানের কোনো খবর রাখেন না, এজন্য লজ্জা বোধ করেন না। ভালো রান্না করতে পারা মেয়েদের এটা গুণ–তাই বলে এতে গৌরবের কিছু নেই।
হালিমা : আমার বোধ হয় অনেকে আজকাল কেবল খাবার চিন্তায় ব্যস্ত।
কুলসুম : কত রকম পেট ও জিহ্বার সেবা করা যায়, তার লিস্ট শুনলে হাসি পায়। জিহ্বা ও পেটের সেবা বেশি রকম আরম্ভ হয়–মানুষের যখন নৈতিক অধঃপতন হতে থাকে। মোটামুটি কয়েক রকম খাদ্য ব্যবহার করা যেতে পারে-তার বেশি একদম বাদ দেওয়া উচিত।
হালিমা : সে গুলি কী কী?
কুলসুম : ভাত, মাংস, ভাজি, এ তো সাধারণভালো খাবার বললে পোলাও, কোর্মা ক্ষীর, দুই একরকম মিষ্টান্ন-এর বেশি নয়।
হালিমা : রান্নার কাজ কে করবে! রান্না করলে কি সম্মান হানি হয়?
কুলসুম : রান্না করলে সম্মান হানি হয় না। দাস-দাসীর উপর ভর দিয়ে রান্নার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকা গৃহিণীর উচিত নয়। মন যাদের ছোট–যারা হীন স্বভাব, তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষ নজর থাকে না। দাস-দাসীরা অশিক্ষিত নীচমনা–তাদের কাজ-কাম পরিষ্কার নয়। তাদের উপর যদি রান্নার ভার দেওয়া হয়, তা হলে অজ্ঞাতসারে তোমার পেটের ভিতর কত কি যাবে তা আর কি বলব। হীনা স্ত্রীলোক চাকরাণীকে মোটেই বিশ্বাস করতে নেই। পুরুষ খাসামাকেও বিশ্বাস করা উচিত নয়। শিক্ষিত বুদ্ধিমতী নারীর হাত ছাড়া অন্য কোনো রমণীর হাতের জিনিস খাওয়া ভালো নয়।
হালিমা : নওয়াব বাড়ির মেয়েরা কি নিজে রান্না করেন?
কুলসুম : অপদার্থ লোকেরা মনে করে, নওয়াব পরিবারের মতো মহাকুলীন আর কেউ নয়। আমি তাদের সঙ্গে মিশি নি–আমার মনে হয় নওয়াব পরিবারের কি পুরুষ, কি নারী, কারো মন উন্নত নয়। সেখানে মনুষ্যত্ব ও উচ্চচিন্তার বিশেষ আদর নেই। টাকার জোরে শান-শওকত রক্ষা করে তারা চলে–তাই দেখে মূর্খ লোকেরা ভয় পায়। নওয়াব বাড়ির মেয়েরা পান খায়, অলসের মতো পিকদানিতে থু থু ফেলে, বিছানায় বসেই হাত ধোয়। আমার বিশ্বাস তারা যেমন বোকা, তেমন সঙ্কীর্ণরূপে বেহিসেবী এবং অহঙ্কারী গাধার পিঠে জরির গদি যেমন, অশিক্ষিত নওয়াব নন্দিনী গায়ের গয়নাও তেমনি। নওয়াব বাড়ির মেয়েদের কথা বলো না, তারা সাধারণের কৃপার পাত্র।
হালিমা : রান্না মেটে হাঁড়িতে করা ভালো, না লোহা-তামার পাত্রে করা উচিত।
কুলসুম : মেটে হাঁড়ি আদৌ ব্যবহার করা উচিত নয়। গরিব লোক যারা তারা পয়সা জমিয়ে লোহা বা তামার দু-একখানা পাত্র ইচ্ছা করলে কিনতে পারে। যাদের হাতে দুপয়সা আছে, তাদের পক্ষে তো কথাই নেই। পানি ঠাণ্ডা রাখার জন্য কলসি রাখা যায়। পানি খাবার কলসি ছাড়া বাকি সব কলসিগুলি পিতলের হওয়া উচিত। মেটে হাঁড়ি-কলসি বছরে যে পয়সার কিনতে হয়, তার হিসেব রাখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। একটা পিলটার বোতল কিনলে খুব ভাল হয়, দাম বেশি নয়। একটা বোতল অনেক বছর চলে। ফিলটার বোতলে পানি ঠাণ্ডা ও পরিষ্কার দুই-ই হয়। পল্লী গ্রামের অপরিষ্কৃত পানিই অনেকের মৃত্যুর কারণ অথচ পল্লীবাসীরা একথা বিশ্বাস করে না। কলেরার সময় প্রত্যেক বাড়িতে এক একটা ফিলটারের বোতল থাকা চাইই-চাই। গরিবেরা অন্তত মেটে কলসির ফিলটার বানিয়ে নেবে।
হালিমা : শুনেছি মেড়োরা তেল খায় না, তেলের গন্ধ নাকি তারা সহ্য করতে পারে, কেবল ঘি খায়।
কুলসুম : ঘি যত ব্যবহার করা যায়, ততই ভালো। আজকালকার দিনে জিনিসপত্রে বড় ভেজাল আরম্ভ হয়েছে। কাউকে বিশ্বাস নেই; বাজারে ঘি. এর ভিতর মরা মানুষের চর্বি যে নেই, তা কে জানে? সাপের চর্বি যে নেই, তা কে জানে? চর্বি তো আছেই-গোয়ালাকেও বিশ্বাস নেই। সেদিন উমাচরণ গোয়ালা খানিকটা ঘি দিয়ে গিয়েছিল-তাতে এত দুর্গন্ধ যে আমি একেবারে বিস্মিত হয়ে গেলাম। প্রত্যেক পরিবারের দু-চারটি গাই পোষা উচিত। দুধ ও ঘি ছাড়া মানুষের শরীর ধ্বংস হয়ে যায়। বাঙালি সব কথা ভাবে, কিন্তু শরীরের কথা ভাবে না। রাতদিন পড়ে টাকা উপায় কর-সম্পত্তি বাড়াও, অবসর মতো দেশসেবা কর–সকলেই শুধু এই কথা বলে। শরীর রক্ষা কর এ কেউ বলে না। ভালো খাবার বা শরীর রক্ষা করার যে আবশ্যকতা এ কেউ জানে না। বাল্যে ভালো খাবার না পেলে শরীর ধ্বংস হয়ে যায়, সারা জীবন ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে থাকতে হয়। মেড়োরা। তেল ব্যবহার করে না। তার কারণ তারা মাছ খায় না। আমরা তেল ব্যবহার না করে পারি নে–এই সরিষার তেলেও ভেজাল আরম্ভ হয়েছে! জমিনে বেশি করে সরষে বপন করা। উচিত। কলুর বাড়ি থেকে সরষে ভাঙ্গিয়ে আনলে চমৎকার তেল পাওয়া যায়! বাজারের তেলে কোনো বিশ্বাস নেই। গোয়ালাকে দূর করে তাড়িয়ে দিয়ে ভদ্রলোকের ঘি তেলের ব্যবসা আরম্ভ করা উচিত। জাতির জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, এ বিষয়ে সকলেরই মনোযোগ দেওয়া উচিত। আমাদের খাবার উপকরণ, যা আমরা বাজার হতে সংগ্রহ করি–তা যদি শিক্ষিত ব্যবসায়ীর হাত থেকে পাবার সুবিধে পেতাম, তা হলে বড়ই ভালো হতো।
হালিমা : রান্না যাদি গৃহিণীকেই করতে হয়, তা হলে তাকে যে রাতদিনই ঐ কাজ করতে হবে, একটুও বিশ্রাম উপভোগ করবার উপায় থাকবে না। যে পরিবারে দশ-বারজন লোক, সে পরিবারের কাজের চাপ বড় বেশি, দাস-দাসী ছাড়া এক গৃহিণীর পক্ষে এতকাজ করা কি সম্ভব? কাজ করতে করতেই জান বেরিয়ে যাবে, স্বামীর সঙ্গে প্রণয় হবে কোন সময়? অবসন্ন ক্লান্ত শরীর ও মন নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হয় কি?
কুলসুম : যাদের ভালবাসি, যারা আমার অতি প্রিয়তম, তাদের জন্য কাজ করতে কোনো কষ্ট হয় না। স্বামীর প্রণয় চুম্বন, তাঁর প্রগাঢ় ভালবাসা নারীর হৃদয়ের সর্বদা শক্তি দান করে, কোনো কাজে স্ত্রীর কষ্ট হয় না। স্বামীরও কর্তব্য স্ত্রীর সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করা। নীচমনা দাসী না রাখাই ভালো, কিন্তু ছেলেপেলে হলে তাকে রাতদিন রাখার জন্যে-সামর্থে কুলায় এমন একটা চাকরাণী চাই। নইলে মায়ের জীবনে সুখ-শান্তি একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। রান্নার কাজে সাহায্য করবার জন্য একটা বালক ভৃত্য দরকার। জিনিসপত্র এগিয়ে দেওয়া, পানি ঢেলে দেওয়া, আবর্জনা জমা হওয়ামাত্র সেগুলি ফেলে দেওয়া, দোকান থেকে জিনিস আনা, মরিচ পেষা–এইসব কাজ সে করবে। শুধু রান্নাবান্নার কাজে সে সাহায্য করবে। একজনের দ্বারা যদি কাজের সুবিধা না হয়, তা হলে আরও একটা ছেলে চাকর রাখতে হবে। নিজের কোনো দরিদ্র আত্মীয় থাকলে তার দ্বারাও রান্না চলতে পারে।
হালিমা : রান্না স্টোভে করলে কেমন হয়?
কুলসুম : কোনো ক্ষতি নেই। দুই-একজনের রান্না স্টোভে চলতে পারে। যে স্টোভে কালি জমে তাতে রান্না চলে না। ভাত তরকারির জন্য না হোক দুধ ও চা তৈরির জন্য স্টোভ ব্যবহার করা সুবিধা।
.
এয়োদশ পরিচ্ছদ
হালিমা : ছোঁকরাদের দ্বারা সব কাজ কি সম্ভব? মেয়ে মানুষের চাকরাণী মেয়ে মানুষ হলেই তো সুবিধে হয়।
কুলসুম : দাসীদের দ্বারা পরিবারের মধ্যে অনেক কেলেঙ্কারি হয়। তা ছাড়া বড় নোংরা–তারা যে মানুষ এ জ্ঞানও তাদের নেই।
হালিমা : দেশে অনেক মেয়ে মানুষ আছে, পরের বাড়ি চাকরি পেলে তাদের অনেক উপকার হতে পারে।
কুলসুম : অনেক দরিদ্র মেয়ে মানুষ আছে সত্যি, কিন্তু তাই বলে নোংরা চোর মেয়ে মানুষকে কী করে বাড়িতে স্থান দেওয়া যায়? ভালো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মেয়ে পেলে আপত্তি নেই।
হালিমা : দাসীদের মাইনে অনেক জায়গায় মাত্র ৩ টাকা। শুনলে হাসি পায়।
কুলসুম : দরিদ্র দেশে সবই আশ্চর্য। অভাবে মানুষ হীন ও দুর্মতি হয়ে ওঠে। সকলেরই অভাব, দয়া মায়া ও মনুষ্যত্ব একদম দেশ থেকে উঠে যাচ্ছে। সমবেত জাতির কম আয়, কারণ দেশে শিল্প বাণিজ্যের অভাব। একমাত্র ধান ও পাটের টাকা থেকে জীবনের শত অভাব ও বিশাল উপকরণ সংগৃহীত হচ্ছে বলে দেশের দারিদ্র বাড়ছে বৈ কমছে না। ভালো দাসীর মাইনে অন্তত ৪০/৫০ টাকা হওয়া উচিত। দাসী কথাটা না বলাই ভালো, তাদের জন্য কোনো সম্মানসূচক আখ্যা দেওয়া উচিত। দাসীদের সম্মান যদি বাড়ে, তা হলে দরিদ্র ভদ্র লোকের মেয়েরাও পরিচারিকারূপে পরের বাড়িতে চাকরি গ্রহণ করতে পারে।
হালিমা : কুল-কন্যারা পরের বাড়িতে পর-পুরুষের সম্মুখে কী করে বের হয়ে কাজ করবে?
কুলসুম : মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র অন্তঃপুর থাকাই নিয়ম। তা ছাড়া অত অবরোধের কথা ভাবলে কাজ চলবে না। প্রয়োজন হলে ভাত না থাকলে পরদা টানিয়ে লাভ কি? কৃষক মেয়েরা কাজের খাতিরে বাইরে বের হলে দোষ কি? পেটের দায়ে কাজ করে পয়সা উপায় করবার সুবিধে না করতে পেরে, বহু রমণী পতিতা হতভাগিনীর জীবন গ্রহণ করে। আহ! তাদের কথা ভাবলে চোখে পনি আসে! পরদার অর্থ বাক্সের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকা নয়, পদার অর্থ শরম–গা ঢাকা ও পুরুষ হতে একটু দূরে থাকা। প্রয়োজন হলে মেয়েমানুষের পুরুষের মতো মাঠে কাজ করা উচিত–পথে পথে দোকান খোলা উচিত। কলকাতায় দেখেছি–ফেরিওয়ালা যে-সব মেয়েমানুষ তরিতরকারি নিয়ে বাসায় আসতে, তারা কি সব অসতী? সেদিন পাহাড়ে যে সব জুমিয়া যুবতী দেখলাম ওরা কি সব অসতী? অনেক মেয়েমানুষ ভয়ে অনিচ্ছায় বাধা দেবার শক্তি নেই বলে পাপ করে-তা জান? দেবর ভাজকে আক্রমণ করে–অন্তঃপুরে পরদার ভিতর! ভাই ভগ্নিকে কলঙ্কিত করে–সেও অন্তঃপুরে, পরদার ভিতর। অবিশ্বাস করো না এ সত্য। মেয়েমানুষকে শক্তি দেওয়া চাই–তাকে স্বাধীনতা দেওয়ার দরকার-তার মুখে ভাষা তুলে দেওয়া কর্তব্য–সে নিজের মর্যাদা নিজে বাঁচিয়ে রাখবে। কেউ খারাপ হয়-হোক-পুরুষও তো খারাপ হয়।
হালিমা : যারা পরিচারিকা হয়ে কাজ গ্রহণ করবে, তাদের সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করা উচিত?
কুলসুম : কোনো কোনো ভদ্রলোক চাকর-বাকরকে কুকুর অপেক্ষাও অধম মনে করেন। চাকর-বাকরেরা অমানুষ হতে পারে–কিন্তু এর কারণ হয়তো প্রভুর দুর্ব্যবহার। অনেক অসভ্যও সভ্য মনুষ্যত্ব সম্পন্ন হতে সক্ষম হয়েছে। চাকর বাকর যদি বিছানায় বসে তাতে রাগ করো না। চাকর ছাড়া বাইরের কোনো দরিদ্র কোনো ভদ্রলোকের বাড়িতে এসে চেয়ারে বসলে ভদ্রলোক তাতে অপমান কতো লজ্জা বোধ করেন। যারা হীন তারাই মানুষকে অপমান করেন। এইসব দরিদ্রের কর্তব্য এই প্রকৃতির ভদ্রলোকদের দাঁড় করে রেখে নিজেরা চেয়ারে বসে। আঘাত ছাড়া কোনো কালে কারো চৈতন্য হয় না–এটা সত্য কথা। চাকরের সাথে সদ্ব্যবহার করলে জাত যায় না। ঘৃণা করে ছোট বলে গালি দিয়ে মানুষকে সত্যকার ভালো করা যায় না। মানুষের মধ্যে যে সুবুদ্ধি আছে সব সময় তার দোহাই দিয়ে কাজ করতে হবে। চাকর যদি চেয়ারে বসে তাতে কি ক্ষতি হয়? চাকরাণী। যদি তোমার মখমলের বিছানায় শোয় তাতে মনে মনে কষ্ট বোধ করো না। চাকর-বাকর তাদের কাজ বা সেবার মূল্য নেই-সেবা করে বলেই সে ছোট হতে পারে না। জ্ঞান, বুদ্ধি ও ব্যবহারে সে ছোট হতে পারে-চাকর বলে সে ছোট নয়। যার জ্ঞান নেই, যার ব্যবহার অমার্জিত তার সঙ্গে ভালো কথা বলে তাকে সম্মান করলে দিন দিন তার মনের উন্নতি হয়। চরিত্র ও বুদ্ধিতে সে ছোট; এ কথা ঢেকে ফেলতে সে সচেষ্ট হবে দেশের শ্রেষ্ঠ লোকেরা যদি দেশের ছোট ও দীন-দরিদ্রের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন–যদি তাদের সুবুদ্ধির দোহাই দিয়ে কাজ করতে চেষ্টা করেন তা হলে জাতির উন্নতি অল্প সময়ে হওয়া সম্ভব।
হালিমা : দাস-দাসীদের পোশাক-পরিচ্ছেদ কীভাবে দিতে হবে? ছোঁকরা চাকর কাপড় পেলেই পালিয়ে যায়।
কুলসুম : দাস-দাসী শব্দ দুটি ব্যবহার না করাই ভালো। অপেক্ষাকৃত সম্মানসূচক দুটি শব্দ বেছে বের করতে পারলে ভালো হয়। খাদেম-খাদেমা বলা যেতে পারে। পরিচারক, সহচর, লাড়কা সহচরী, মেয়ে বাবুর্চী এইরূপ ধরনের নামও মন্দ নয়! কাপড়-চোপড় দাস দাসীকে না দেওয়াই উচিত। মাইনে কিছু বেশি ধরে দিলেই হয়, কাপড়, দেওয়ার দায় হতে মুক্তি পাওয়া যায়। পরের কাছ থেকে কাপড় পেলে দাস-দাসীদের মনের অবনতি ঘটে। ফলে তারা নীচ প্রবৃত্তি হয়ে পড়ে।
হালিমা : অনেক লোকের বাড়িতে অনেক যুবতী দাসী দেখেছি-তার যেকোথা থেকে এসেছে তার ঠিকানা নেই; তারা প্রভুর কাছ থেকে বেতন পায় না। কোনো কোনো গৃহিণী তাদের দয়া করে রঙ্গিন শাড়ি, হাতের চুড়ি ইত্যাদি কিনে দিয়ে থাকেন। এদের জীবনের ঠিক উদ্দেশ্য যে কী তা ভেবে কিনারা করতে পারি নে।
কুলসুম : এ সব বড় দুঃখের কথা! নিজেদের সুবিধার জন্য একটা মানুষের জীবনকে অর্থশূন্য করে দেবার নিষ্ঠুর চেষ্টা। নারী যে মানুষ, রক্ত-মাংসের শরীরে তার সুখ-দুঃখ বোধ আছে–এ অনেক মানুষই ভুলে যায়। মানুষ কেন? আমাদের দরিদ্র ভগিনীদের ব্যথা আমরা নারী হয়ে ভুলে যাই–মনে করি তারা কুকুরী অপেক্ষা ঘৃণিত। সংসারে তাদের কোনো স্থান নেই–আমাদের কাছেও না। যাক এই যে যুবতী দাসীর কথা বলছ, এরা নানা উপায়ে সংগৃহীত হয়ে থাকে। বড় লোকেরা অনেক সময় টাকা দিয়ে এদের সংগ্রহ করে। কোথাও মেয়েদের চুরি করা হয়–কোথাও দরিদ্র বাপের কাছ থেকে কিনে নেওয়া হয়। কোনো কোনো স্থানে স্বামীও টাকা পেলে বউকে বড় লোকের কাছে দাসীরূপে বিক্রি করে। সেইসব মেয়ে প্রায় নিদোষ কুমারী হয় না জীবনের প্রথমে কোনো মেয়ে হয়তো ভুলে বিপথে গিয়েছিল, কত বিচিত্র ঘটনার ভিতর দিয়ে শেষকালে সে দাসীর জীবন গ্রহণ করে দাসী হতে বাধ্য হয়। পশুর মতো খাওয়া ও পরের সেবা করা ছাড়া আর যে দাসীদের কোনো কাজ আছে একথা ভুলে যায়। একটা মানুষের জীবনকে এইভাবে ব্যর্থ করে দেওয়া কি পাপ নয়? এইসব দাসী যদি কোনো কেলেঙ্কারি করে, তবে তাদের যে মারে সে পশু। তাদের কারো সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সংসারী করে দেওয়া উচিত-কাজ নিজে করা ভালো তবুও মানুষের জীবনকে অর্থশূন্য করে দেওয়া ঠিক নয়। এই পাপে মানুষ জাতির পতন হয়েছে। অভিশাপে সুবর্ণ সিংহাসন ধুলোয় মিশেছে।
হালিমা : অনেকের বাড়িতে দাসী আছে বলে গৌরব করে।
কুলসুম : তারা বড় হীন। নিজেরাই নিজেদের কাজ করাতে গৌরব। কুঁড়ের মতো বসে থাকবে-দাসদাসীতে তোমার কাজ করবে এতে কি গৌরব? পরের কাছে হীনভাবে মাথা নত করতে দোষ-মূর্খের মতো পরকে বেদনা দেওয়া দোষ–ঘুষ খাওয়া, অন্যায়ের সমর্থন করা, দরিদ্রের পয়সা নিয়ে বাবুগিরি করাতে দোষ, কাপুরুষ যারা, যাদের সমান তালি দেওয়া, তারাই নিজের কাজ নিজে করতে লজ্জা বোধ করে। বাবু, তস্কর, অত্যাচারী দারোগার বউ-এর চেয়ে সৎস্বভাবা নামাজের সংসারে কর্ম ক্লিষ্টা দরজির বউ-এর সম্মান বেশি। মানুষ ছোট হয় নিজের অজ্ঞতায়, নীচ প্রবৃত্তিতে ও মনের সংকীর্ণতায়। যে নারী বুদ্ধিমতি, বাকপটু, চরিত্রবতী, শিক্ষিতা, সে যে কাজই করুক না, যে অবস্থায়ই থাকুক না, তার সম্মুখে স্বৰ্ণবরণ শোভিত সংকীর্ণ হৃদয়া; নিরক্ষরা, পরনিন্দা চর্চাকারিণী দাসদাসী পরিবৃতা নওয়াব বধূর কোনো মূল্য নেই।
হালিমা : শুনেছি দাসদাসীরা চুরি করে খায়।
কুলসুম : সেটা ঠিক কথা। তাদের খুব অল্প করে খেতে দেওয়া হয় বলে, তারা অনেক। সময় চোর হয়। মাঝে মাঝে তাদের ভালো জিনিস খেতে দেওয়া উচিত। মাঝে মাঝে কিছু কিছু করে পকেট খরচ দেওয়া উচিত–এতে তাদের মন ও প্রবৃত্তি উদার ও উন্নত হবে। হাটবাজার নিজে করা উচিত। অনেক অপদার্থ লোক আছে যারা হাট-বাজারে যায় না বলে গৌরব করে।
হালিমা : গ্রীষ্মকালে দাসীরা মশারির অভাবে অনেক সময় খালি গায়ে রাত্রি কাটায়। অন্ধকারের জানালাহীন মশা-ভরা রান্নাঘরে তাদের থাকতে দেওয়া হয়।
কুলসুম : অর্থাৎ তারা গরুর মতোই এক-প্রকার জীব, এইরূপ ধরে নেওয়া হয়। দাসীরা মানুষ তাদের রক্তমাংসের শরীর, এটা বিবেচনা করা উচিত। তাদের মশারি, পাখা, জানালাযুক্ত ঘরে থাকতে দিলে নিজেদের সম্মান বাড়ে বই কমে না। আমরা পরাধীন জাতি। শক্তিমান ও বিত্তশালী ব্যক্তির অত্যাচার ও অন্যায় ব্যবহার দরিদ্রকে সইতে নেই। নিজেদের মর্যাদা ও দাবি বুক ঠুকে আদায় করার শক্তি আমাদের সমাজের কোনো লোকের নেই। এখানে দরিদ্র মানুষ বড়কে ‘বাপ’ ‘মা’ বলেই মনে করতে বাধ্য হয়। শাস্ত্রে আছে–বাপ মায়ের অত্যাচার নীরবে সহ্য করলে পুণ্য হয়।
হালিমা : সত্যি গরিব লোকের মেয়েরা বড় ঘরের বউকে মা বলে ডেকে, পায়ে চুমো খেয়ে নিজেদের অস্তিত্বকে একেবারে মুছে ফেলে। বোন বলে সাহসের সঙ্গে বলবার অধিকার কারো নেই।
কুলসুম : এই ‘মা-বাপ’ বলে ডাকা আর পা ছুঁয়ে ছালাম করার ভেতরে তাদের মনে। যে কতখানি গভীর ব্যথা কাঁদতে থাকে, তা দৃষ্টিমান ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ টের পায় না। দাসীকে কখনও মা বলে ডাকতে দেবে না বা পা ছুঁয়ে ছালাম করতেও দেবে না, এটা অনৈসলামিক। ইসলাম ব্যক্তিত্বকে চূর্ণ করে ফেলা পাপ মনে করে। আহা, মানুষ পরিশ্রম করে দুটি অন্ন মুখে দেবে, তাতেও সে যেন কত অপরাধী! দাসীদের জীবন কত দুঃখময়। সে যে কোনোরূপ আমাদের সামনে দাঁড়াবার দাবী রাখে একথা মানি না। এদেশে দরিদ্র নরনারীর সংখ্যা খুব বেশি, সেই জন্য হয়তো দাস-দাসীর কপালে এত অসম্মান।
হালিমা : দাসী রাখতে হলে কী বয়সের দাসী রাখা হবে? কোন, দাসীটি ভালো হবে, কোটি মন্দ–জানবার উপায় কী?
কুলসুম : বুড়ো দাসী না রাখাই ভালো–তাদের ভালোমন্দ অভ্যাসগুলি এমন দৃঢ় হয়ে গেছে যে, সেগুলির আর পরিবর্তন হয় না। আশা-আনন্দহীন জীবন তাদের বড় শক্ত এবং কঠিন-ভালোমন্দ কোনো কথাই তাদের কানে পৌঁছায় না। নোংরা ম্লেচ্ছ কোনো মানুষকেও বাড়িতে স্থান দেওয়া ঠিক নয়। দাসী নিযুক্ত করবার আগে তার চেহারাটা একটু ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে, সে কিরূপ লোক; একটু কথা বললেও তার বুদ্ধি ও স্বভাব সম্বন্ধে অনেকটা ধারণা করতে পারা যায়। দাসী নিযুক্ত করবার সময় লজ্জা ফেলে তার কাজের সব কথা বলে দেবে। অনেক সময় দাসীদের সঙ্গে তার আত্মীয়-স্বজন এসে বাড়িতে দিকদারী করে। সেটা যাতে না ঘটে তা পূর্ব হতেই দাসীকে বলে দিতে হবে-হরদম নানা বিশৃঙ্খল আদেশ ও সমালোচনায় মানুষের বুদ্ধি লোপ পায়।
হালিমা : যুবতী দাসী দেখে বাড়ির কর্তা ভুলে যান’?
কুলসুম : বাড়ির কর্তা বা স্বামী কি ভদ্রলোক নন? এমন জঘন্য নীচ প্রকৃতিবিশিষ্ট স্বামীর সঙ্গ অবিলম্বে পরিত্যাগ করা উচিত। স্ত্রীলোক নিঃসহায়, দরিদ্র ও অশিক্ষিত বলে অনেক সময় এরূপ ঘটনা ঘটে থাকে। দাসীগুলি যদি পশু না হয়, তারা যদি আত্মজ্ঞানসম্পন্ন হয়, তা হলে তারা বাড়ির কর্তার এই নীচ প্রকৃতি দেখে তৎক্ষণাৎ চাকরি ত্যাগ করবে। বাইরে সমাজকে ভয় করে, আমাদের দেশের অনেক লোক পবিত্র জীবন যাপন করে–যাদের সমাজের ভয় নেই, তারা অনেক সময় পাপ করতে লজ্জা বোধ করে না। মানুষ সমাজ অপেক্ষা নিজের বিবেককে বেশি শ্রদ্ধা-ভিতর হতে পাপের প্রতি একটা ভীষণ ঘৃণা পোষণ করে, তখনই সে যথার্থ ভদ্রলোক হয়। স্ত্রী যদি বুদ্ধিমতী, জ্ঞানী ও শক্তিশালিনী হন, তা হলে স্বামীর এত বড় নীচ সাহস হয় না। দাসীদের কি ধর্ম জ্ঞান ও লোকলজ্জা নেই।
হালিমা : স্বামীর প্রতি ঘৃণা পোষণ করে স্ত্রীর কি স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করা সম্ভব?
কুলসুম : আমাদের দেশে নারী পুরুষের কৃপার পাত্র। সকলেই নারীকে পথে ভাসাতে চেষ্টা করে। বাপের সম্পত্তি বোনকে বাদ দিয়ে ভাইয়েরাই ভাগ করে নেয়। নারীর কোথাও স্থান নেই। স্বামীর অত্যাচার অনেক সময় স্ত্রীকে দায়ে পড়ে সহ্য করতে হয়। স্বামী হয়তো এক বেশ্যাকে ভালবাসে, স্ত্রী সেই বেশ্যাকে আদর করে, ভালবাসে, স্বামীর কৃপা লাভ করতে চেষ্টা করে, এ আমি জানি। এর চেয়ে দুঃখ আপমানের জীবন নারীর পক্ষে আর কি। হতে পারে? নারীকে শক্তি দেওয়া চাই–বিপদে পড়লে কোনো কাজ করে নিজের অন্ন নিজে সংগ্রহ করে খেতে পারে, সংগ্রাম করে বিবাহের সময় এরূপ শর্ত করে নিতে হবে-যাতে স্বামী লম্পট হয়ে স্ত্রীকে অপমান করতে না পারে। যাতে নারী ইচ্ছা করলে পুরুষকে তালাক দিতে পারে। লম্পট বলে প্রমাণ করতে পারলে সাহেব মেমকে, অথবা সাহেবকে আদালতের সাহায্যে যে-কোনো সময় পরিত্যাগ করতে পারে। শক্তি, ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের স্বাধীনতা ব্যতীত নারীর রূপের কোনো মূল্য আছে বলে মনে হয় না। তার পক্ষে প্রেম প্রণয় একটি জাজ্বল্যমান মিথ্যা কথা।
.
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম কহিলেন, বোন, রান্নাঘরের পার্শ্বেই পানি ফেলা মেয়েদের একটা খারাপ অভ্যাস।
হালিমা : নিরুপায় হয়ে তারা এরূপ করে কি?
কুলসুম : যে সব মেয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তারা রান্নাঘরের চারপার্শ্বে নোংরা করে রাখতে ভালবাসে না।
হালিমা : ময়লা-ধধায়া পানি কোথায় রাখা হবে?
কুলসুম : বড় হাঁড়ি কিংবা বালতিতে ময়লা জমা করে রাখা উচিত, তারপর স্নানের আগে দূরে ফেলে দিতে হয়। হাত ধোয়া পানি, হাঁড়ি ধোয়া পানি, সব এক জায়গায় জমা করে রাখবে। ঘরের পার্শ্বে পুনঃ পুনঃ একটু একটু করে পানি ফেললেই সেই জায়গা নোংরা। এবং দুর্গন্ধ হয়ে ওঠে। ভাতের ফেনাও ময়লা পানির হাঁড়িতে রেখে দিতে হয়।
হালিমা : গোছলখানার পানিতে কি ঘরের পার্শ্ব নোংরা হয়ে ওঠে না?
কুলসুম : গোছলখানার পানিতে জায়গা বড় নোংরা হয় না। দিনে একবার মাত্র এক জায়গায় অনেক পানি ঢাললেও ক্ষতি নেই। অনবরত সারাদিন এক জায়গায় একটু একটু করে পানি ফেলা দোষ এবং জঘন্য রুচির পরিচায়ক। ঘরের বারান্দায় বসে, অনেকের মুখ। ধোয়ার অভ্যাস আছে এও বড় জঘন্য অভ্যাস। রান্নাঘর বা ঘরের পার্শ্বে ময়লা পানি ফেলার মতোই এ কাজটা খারাপ। রান্নাঘরের পার্শ্বে ময়লা পানি ফেলা যেমন অন্যায়, তেমনি তরকারির খোসা, দস্তরখানার পরিত্যক্ত আবর্জনা, মাছের আঁইশ ফেলাও নোংরা কাজ। চাকর না থাকলেও নিজে সেই অপরিষ্কৃত পানি এবং আবর্জনা দূর করে ফেলে দিয়ে আসবে। রান্নাঘরের একেবারে পার্শ্বেই কাউকে হাতমুখ ধুতে দিবে না। কোনো কোনো কুড়ে চিলুমচীতে মুখ ধোয়, এতে হাত মুখ ধধায়া পানিতে জায়গা নষ্ট হয় না সত্য। এ কালেও অনেক কাপুরুষ মনে করে চিলুমচীর কাশ ও থুথু তাদের সামনে না ধরলে তাদের অপমান করা হলো।
হালিমা : খাওয়া-দাওয়া রান্নাঘরে হওয়া উচিত, না অন্য ঘরে হওয়া উচিত?
কুলসুম : অনেকে রান্নাঘরেই খেয়ে থাকেন। রান্নাঘরে খাওয়া ঠিক নয়, তাতে মেয়েদের কাজে অসুবিধা হয়। রান্নাঘরে কতকটা মেয়েদের ড্রইংরুম সুতরাং পুরুষ লোকের সেখানে না যাওয়াই ভালো। খাবার জন্য স্বতন্ত্র স্থান নির্দিষ্ট থাকা উচিত।
হালিমা : রান্না করা জিনিসপত্র কোথায় রাখবে? সেগুলি কি দাসী চাকরের হেফাজতে রান্নাঘরে রাখা উচিত?
কুলসুম : রান্নাকরা জিনিসপত্র সিকা, মিটসেফ বা আলমারিতে বন্ধ করে রাখাই ভালো। সবচেয়ে মিটসেফে রাখাই সুবিধা। চাকর-দাসীরা অনেক সময় চুরি করে খায়। ইঁদুর-বিড়াল-কুকুর সুযোগ পেলে ঘরে ঢুকে মাছ মাংসের সদ্ব্যবহার করতে পারে না।
হালিমা : মেয়েরা কোথায় খাবে?
কুলসুম : পুরুষের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খেতে পারেন–তাতে লজ্জা কি? মেয়ে মানুষ যে ভাত খেয়ে থাকেন এ কথা পুরুষ বিলক্ষণ জানেন। যদি স্বতন্ত্র খাবার ঘর থাকে তবে সেখানে বাড়ির সকলেই পুরুষ মেয়ে গৃহিণী এক সঙ্গে বসে খেতে পারেন। খাবার ঘরে একটি রেফ্রিজারেটর রাখতে পারলে খুবই ভালো হয়, এটা বৈজ্ঞানিক উপায়ে তৈরি। এতে খাবার জিনিস নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে না। নিজেদের খাওয়া হলে দাসীরা খাবে। গৃহিণী নিজে খেয়ে দাসীদের খাওয়াবেন। দাস-দাসীরা যখন খায়, তখন গৃহিণী যেন তাদের এটা ওটা চাই বলে আদর করতে না ভোলেন।
হালিমা : খাওয়া মাটিতে বসেই ভালো, না একটু উঁচুতে হলে ভালো হয়?
কুলসুম : একখানা লম্বা বড় তক্তপোষের উপর বসে খাওয়া যেতে পারে। একখানা উঁচু মাচা ও টেবিলের উপর খেলেও দোষ হয় না। এজন্য ছোট ছোট হাতবিহীন কয়েকখানি চেয়ার অথবা দুখানা লম্বা বেঞ্জ তৈরি করে নিলে ভালো হয়। খাবার জন্য টেবিল চেয়ার ব্যবহার করাও ভালো, তবে এতে অনেক অপদার্থ লোক গর্ব ও গৌরব অনুভব করে! এতে গর্ববোধ করার কিছুই নেই।
হালিমা : দাসীরা কি মাটিতে বসে খাবে?
কুলসুম : দাসীরা যদি বাড়ির প্রভুকীর আসনে বসে ভাত খায় তা হলে কীর সম্মান কমবে না। একটু থেমে কুলসুম আবার বললেন-তরকারি, মাংস পেয়ালায় আগেই তুলে রাখা মন্দ নয়। অনেক সময় বাড়ির সকলকে খাওয়াতে কিছুই বাকি থাকে না। এ ভারি অন্যায়। হাঁড়িতে কিছু রেখে–যে কজন মানুষ সেই কটা পেয়ালা তৈরি করা ভালো। কেউ যদি আবদার ধরে, তা হলে হাঁড়ি হতে সম্ভব হলে তাকে কিছু দেবে। বাড়ীর বৃদ্ধ বা কর্তাকে হিসেব করে কোন কিছু দেবে না। শাশুড়ী বা বাড়ির মেয়ে মুরুব্বী সম্বন্ধেও সেই কথা। এদের আলাদা করে পরিতোষপূর্বক আহার করাবে। যে সব জিনিস রান্না হবে তার পরিমাণ অল্প হলেও সকলকে দেবে। ভালো জিনিস সবশেষে খেতে দিতে হয়। আগে ভালো জিনিস খেতে দিলে মন্দ জিনিস কেউ খেতে চায় না। কোনো জিনিস বেশি পরিমাণে দেওয়া উচিত নয়, এতে রান্না ভালো হয় নি, এই কুৎসা শুনতে হয়।
হালিমা : কতকগুলি অসহিষ্ণু লোভী ছেলে আছে, যারা রান্নাঘরে যেয়ে পাখীর মতো চুপ করে থাকে।
কুলসুম : ছেলেদের রান্নাঘরে বসতে নেই–এইকথা বলে দেবে। ছোট শিশুর স্বতন্ত্র কথা। খাবার লোভ না করে যদি শুধু মায়ের সঙ্গ-সুখের জন্য ছেলেরা রান্নাঘরে বসে থাকে। তবে দোষ নেই।
হালিমা : রান্নাঘরে অনেক সময় কলিকা হাতে করে অনেকে উপস্থিত হয়।
কুলসুম : তাদের উপর বিরক্ত প্রকাশ না করাই উচিত। কোনো মুরুব্বী যদি আসেন, তা হলে সম্ভ্রমের সঙ্গে তার হাত থেকে কলিকাটি নিয়ে দাসীকে আগুন তুলে দিতে বলবে-দাসী না থাকলে নিজ হাতেই আগুন তুলে, সময় থাকলে ফুঁ দিয়ে দেবে–দূরে আগুন ফেলে দেবে না। কলকেতে অনেক আগুন দেবে, অল্প আগুনে তামাক খাওয়া হয় না। মুরুব্বী ছাড়া অন্য লোক সম্বন্ধে অন্য কথা।
হালি : রান্নাঘরের জিনিসপত্রগুলি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা উচিত নয় কি?
কুলসুম : নিশ্চয়ই–সুন্দর করে সার বেঁধে জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখবে। এলোমেলো কোনো জিনিস থাকলে দাসী চাকরের উপর বিরক্তি প্রকাশ করবে। যে চাকর বা দাসী তোমার ইচ্ছামতো কাজ করবে না, তাকে প্রথমে সাবধান করবে, সংশোধন না হলে বরখাস্ত করবে। গোলাম হারামজাদা বলে গালি দেওয়া ভালো নয়। জিরে, গোলমরিচ প্রভৃতি মসলা রাখবার জন্যে ছোট ছোট বয়েম অভাবে হাঁড়ি ব্যবহার করা ভালো। রান্নাঘরে কোনো জিনিসপত্র যেন আলগা না থাকে। খাবার পানির কলস সব সময় ঢাকা থাকা চাই। কোনো ঢাকনি ব্যবহার না করে পরিষ্কৃত গামছা দিয়ে ভরা কলসী ঢেকে রাখতে পার,সে গামছা মাথা মোছবার জন্যে ব্যবহৃত হবে না।
হালিমা : পুকুরে কিংবা কুপের পানি ফিলটার বা গরম না করে খাওয়া উচিত কি?
কুলসুম : লোকের পবিত্রতার প্রতি বিশেষ মনোযোগ নেই, এটা দুঃখের বিষয়।পানির প্রতি লোকে যে কত অত্যাচার করে, তার ইয়ত্তা নেই। পানি ফিলটার করে খাওয়া উচিত।
হালিমা : বাড়িতে মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র পায়খানা থাকা উচিত কি?
কুলসুম : নিশ্চয়ই।
হালিমা : এঁটো ঝুটো সম্বন্ধে খুব সাবধান হতে হবে, নয় কি?
কুলসুম : এক কণা এঁটো কোথাও যাতে পড়ে না থাকে, সে সম্বন্ধে সাবধান হতে হবে। জায়গা বাড়ি নষ্ট করে ছেলেরা বেশি। তাদের খাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই পরিষ্কৃত করে ফেলতে হবে।
.
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম : বাল্যকালে বাপের বাড়িতে যখন মেয়েরা থাকবে তখন যেন তারা শুধু হেসে-খেলে না বেড়ায়।
হালিমা : বাপের বাড়ি তো হাসবার খেলবারই জায়গা।
কুলসুম : স্বামীর বাড়িও হাসবার খেলবার জায়গা। জীবনের সঙ্গে সব অবস্থায় হাসি খেলা জড়িয়ে থাকবে। শুধু হাসি-খেলাকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। স্বামীর ঘরে যেয়ে যাতে আদর্শ পত্নী হয়ে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-বন্ধুকে তুষ্ট করা যায়, তার বন্দোবস্ত বাপের বাড়ি হতেই করে নিতে হবে। কোনো মুরব্বী বলে থাকেন–দুদিন পরে যখন মেয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, তখন তাকে দিয়ে কোনো কাজ করান উচিত নয়। সে শুধু হেঁটে বেড়াবে, আর বসে খবে। এরূপ মুরুব্বী মেয়ের উপকার না করে বরং অপকার করেন।
হালিমা : মেয়ের দ্বারা তা হলে খুব কাজ করিয়ে নেওয়া উচিত?
কুলসুম : হ্যাঁ, দাসী থাকলেও মেয়েদের সংসারের সব কাজ করা উচিত। মেয়ে বড় মানুষের ঘরে পড়তে পারে, হয়ত শ্বশুরবাড়িতে মেয়েকে মোটেই কাম কাজ করতে হবে না–তবু বাপের বাড়িতে তাকে সব কাজ শিখিয়ে দেওয়া উচিত। কাজ করলে অসম্মান হয় না, এটা মেয়েকে শেখাতে হবে। মেয়ে কলেজ বা হাইস্কুলে পড়েছে বলে সে রান্না করতে শিখবে না এ হতে পারে না। বাবু মেয়ে জামায় ময়লা লাগে এই ভয়ে বাসন মাজবে
এও হতে পারে না। যেমন ঘরের হোক না, বাল্যকালে তাকে পরিশ্রমী জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত করে দিতে হবে। কুঁড়ে মেয়েরা মানুষের বেদনা বোঝে না-তারা বড় হলে নির্বোধ নিষ্ঠুর সংকীর্ণ হৃদয় এবং কটুভাষী হয়।
হালিমা : মা যদি মেয়ে দিয়ে বেশি কাজ করান, তা হলে মেয়ে মাকে নিষ্ঠুর মনে করতে পারে?
কুলসুম : মেয়েকে যদি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া শিখান যায়, তা হলে বাল্যজীবনে যে মায়ের কাছ থেকে তালিম পেয়েছে, এজন্য সেয়ানা হয়ে সে কৃতজ্ঞ হবে।
হালিমা : মেয়েদের কী কী কাজ শিখতে হবে?
কুলসুম : সংসার চালানোর জন্যে যত কাজ শেখা দরকার–সব। ঘর ঝাঁট দেওয়া, জিনিসপত্র যথাস্থানে রাখা, মাজা, কাপড় কাঁচা, রান্না করা, একটু রিপু-সেলাইয়ের অভ্যাস, একটু ঔষধের জ্ঞান, চুল বাঁধতে জানা, পানি তোলা–এ সব শিখে রাখা উচিত। বাড়িতে যদি দুই তিনটি মেয়ে থাকে, তা হলে একটা ছোঁকরা চাকর ছাড়া মেয়ে দাসী না রাখাই ভালো। বাল্যকালে মেয়েরা যাতে অলস বা বিলাসী না হয়, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।
হালিমা : লেখাপড়া এবং সংসারের কাজ এক সঙ্গে চালানো কি সম্ভব?
কুলসুম : কেন সম্ভব নয়? লেখাপড়া শেখার আজুহাতে কাজ করবার অভ্যাস ত্যাগ করা অন্যায়। কাজ করবে, সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া শিখবে। পড়াশুনা বা কোনো শিল্প শেখার জন্যে বেশি সময় দরকার হয় তা হলে অল্প হলেও সংসারের কাজ একেবারে ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। বিদেশী মেয়েদের জীবন অনুকরণ করলে চলবে না, নিজের দেশে কিন্তু তারা যথেষ্ট কাজ করে।
হালিমা : বাল্যকালে মেয়েদের প্রথম কর্তব্য কী?
কুলসুম : প্রথম কর্তব্য ধর্ম শেখা। বিদ্যালয়ে পড়ার সঙ্গে ধর্ম-পুস্তক পড়তে হবে। অন্তত নামাজ পড়ার মতো শিখতে হবে।
হালিমা : ইংরেজি পড়া কি দোষের?
কুলসুম : কে বলল দোষের? ইংরেজি, বাংলা, ফারসি, আরবী যে কোনো ভাষা শেখা যায়, তাই ভালো। অনেক স্ত্রীলোক আছেন, যারা মনে করেন, আরবী ও উর্দু পড়লেই বেহেস্তের পথ পরিষ্কার হয়–এটা মিথ্যা কথা। লেখাপড়া শেখবার উদ্দেশ্য-মনের উন্নতি ও জ্ঞান লাভ করা,ধর্ম, মনুষ্যত্ব ও স্রষ্টাকে ভালোরূপে বুঝতে পারা। মনের উন্নতি লাভ করার জন্যে মানব-সমাজ, মানব-চরিত্র, শাসন ও মনের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয় ভালো করে বুঝবার জন্যে, যতগুলি ভাষা শেখা দরকার, নারীকেও তা শিখতে হবে। শুধু আরবী ও উর্দু পড়লে বেহেস্তে যাওয়া যায়-এ বিশ্বাস করা বড়ই ভুল।
হালিমা : আরবী ফারসী পড়ে কি প্রভূত জ্ঞান হয় না।
কুলসুম : আরবীর সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজি পড়তে হবে, নইলে বর্তমান সময়ে অনেক কাজে বে-অকুফ হতে হয়। চতুর্দিকে বাংলা ইংরেজির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে, আমি তুমি দেমাক করে বসে থাকলে চলবে না। কেউ কেউ বলেন, মেয়েদের জন্যে সামান্য একটু লেখাপড়াই যথেষ্ট। আমার মনে হয় পুরুষ ছেলের চেয়ে মেয়েছেলের লেখাপড়া বেশি দরকার! এতে জাতির মুক্তি অতি অল্প সময়ে হয়। রান্নাঘরে শিশু মায়ের কাছে যা শেখে–ভালো হোক, মন্দ হোক, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সে তা মনে করে রাখে-মারলে, কাটলে, টাকা দিলে কিছুতেই মানুষ যেন সে শিক্ষা ভুলতে পারে না। মায়ের বিশ্বাস ও, কুসংস্কারকে অবহেলা করতে পারে–অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত লোকে এরকম পারে না। মায়ের মহিমায় জগতে ইতরও শ্রেষ্ঠ পরিবারে প্রতিষ্ঠা হয়। নীচমনা লোকের ছেলে ছোট, ভদ্রঘরের ছেলে ভদ্র হয়। অবশ্য এই কথা অবিসংবাদী বলে মেনে নেওয়া কিন্তু নীচতা ও জাতির পক্ষে অকল্যাণকর। ছোটলোকের ছেলেও মহাপুরুষ হতে পারে। কাওকে ছোটলোক বলা পাপ।
হালিমা : মেয়েরা কোথায় পড়বে? কে পড়াবে?
কুলসুম : শিক্ষিত পরিবার হলে মেয়ে বাড়িতে ভাই বা বাপের কাছে পড়তে পারে। স্কুল-কলেজে পড়লেই সুবিধে হয়। অনেক মানুষের সঙ্গে মেলামেশা না করলে মন ও মাথায় বুদ্ধি খেলে না। ঘরের মধ্যে একই রকমের মানুষের সঙ্গে নিত্য মিশলে মনের জাতি হয় না, বুদ্ধির বিকাশ হয় না এবং চরিত্র এবং বিনয় ভূষিত হয় না। মেয়েরা অনেক মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না বলে, সাধারণত তারা বোকা দাম্ভিক প্রকৃতির হয়ে থাকে। এ দেশে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখার কোনো ভালো মেয়ে স্কুল বা কলেজ নেই–এটা বড়ই দুঃখের কথা। যে সমস্ত লোকের বহু অর্থ আছে তারা কি জন্য যে এত অর্থ জমা করে রাখে জানি। মানব মঙ্গলে যদি অর্থ ব্যয়িত না হয় তবে টাকাকড়ি উপায় করে বিশেষ লাভ কী?
হালিমা : শুনেছি বাংলাদেশে মেয়েদের জন্য বিদ্যালয়, কলেজ ও শিল্পাশ্রম খোলা হবে। মেয়েরা বোডিং-এ থাকবেন। কারো কিছু খরচ লাগবে না। বিদ্যালয়, কলেজ ও শিল্পাগারে দশ হাজার ছাত্রীর স্থান হবে। শিল্পাশ্রমে দরিদ্র, নিঃসহায়, যে-কোনো মেয়ে যে কোনো বয়সে শিল্প শিক্ষা করার সুবিধা পাবেন।
কুলসুম : এরূপ তো শুনেছি কত নরী খাবার অভাবে, পাপে চূর্ণ হচ্ছে। তাদের কথা ভাববার কারো অবসর নেই।
হালিমা : বিয়ে হবার আগে সাজসজ্জা করা কি ভালো?
কুলসুম : না, স্বামীর বাড়ি ছাড়া মেয়েমানুষের অন্য কোনো জায়গায় খুব সাজসজ্জা অকর্তব্য। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাই যথেষ্ট। তেড়ী কেটে গয়না পরে, বাইরে বের হওয়া। ঠিক নয়। এদেশে অবাধে নারীদের বাইরে বের হবার অবস্থা নাই বলে, তাদের সাজসজ্জা দেখে পুরুষের মনে তরল ভাব আসতে পারে।
হালিমা : মেয়েকে বাল্যকাল হতে সচ্চরিত্রা, শিক্ষিতা, মার্জিত, রুচি, মধুরস্বভাব করে তুলবে কে? এর জন্য কি বিশেষ দৃষ্টি আবশ্যক? দায়িত্ব বেশি কার?
কুলসুম : অধিকাংশ পরিবারে দেখতে পাওয়া যায়, মেয়েকে মধুরস্বভাব, ভদ্র ও বুদ্ধিমতি করে তোলার বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই। আপনা-আপনি মেয়ে যে শিক্ষা পায়, তাই যথেষ্ট মনে করা হয়। রীতিমতোভাবে উপদেশ ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কাজে-কর্মে উঠা-বসায় তাই বলে মেয়েকে অনবরত গালি দেওয়া অবশ্য কর্তব্য নয়। কাজ-কামে একটু আধটু সমালোচনা করা যেতে পারে তবে তাকে সর্বগুণালঙ্কৃতা করতে হলে রীতিমতো শিক্ষা দিতে হবে। মেয়েকে বড় করে তোলবার জন্য মা-বাপ দায়ী। কানো কৈানো অপদার্থ বাপ মেয়েকে বিয়ে দিয়ে স্বামীর ঘাড়ে সব কর্তব্য ফেলে দেন। মেয়ের প্রতি যে নিজেদের কতখানি কর্তব্য আছে, তা তাঁরা জানেন না। কোনো কোনো পিতা বিয়ের জন্য মেয়েকে এক আধখানা পুঁথি পড়িয়ে দেন। এক আধখানা পুঁথি পড়তে পারলে বা জঘন্য অক্ষরে দুই এক লাইন লিখতে পারলে মেয়ে দেবী হয়ে বসেন।
হালিমা : সে তো ঠিক। আচ্ছা, আজকাল বাপ মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে পথের ফকির হচ্ছে। বিয়ের সময় বাপ কি মেয়েকে কিছুই দেবে না?
কুলসুম : পণপ্রথার কথা বলছো? মেয়ের বাপের কাছ থেকে পণ গ্রহণ করা ভালো কাজ বলে মনে হয় না। বাপ মেয়েকে গয়না দিতে বাধ্য নন। প্রয়োজন হলে মেয়েকে বাপের বাড়িতে এসে অতিথি বা ভাই-বউদের যাতে কৃপার পাত্রী না হয়ে থাকতে হয় সে সম্বন্ধে পিতার পূর্ব হতেই বিবেচনা করা উচিত। ভাই-বউরা স্বামীর ভগ্নীকে যে ঘৃণা করেন–এ বলছি না, তবুও প্রত্যেকের দাবি স্বাধীনতা বজায় রাখা দরকার। কোনো স্বামী যদি স্ত্রীকে কাবিনের টাকা মাফ করে দিতে বলেন বা স্ত্রীর সম্পত্তি বেচে ফেলতে ইচ্ছুক হন তবে তিনি স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুরের ন্যায় ব্যবহার করেন। বিশেষ ভালবাসা ও জুলুমের দ্বারা কাবিনের টাকা মাফ নিলেও আল্লাহর কাছে তা গৃহীত হয় না। স্বামী যদি বিবাহের আগে মনে করেন তিনি দেনমোহর আদায় করবেন না, মাফ লইবেন, তা হলে বিবাহ সিদ্ধ হয় না। স্ত্রী তার সম্পত্তি স্বামীকে ভোগ করতে দেবেন, কিন্তু নষ্ট করতে দেবেন না! বাপের বাড়ির সম্পত্তি যদি বিক্রয় করা দরকার হয়, তবে স্বামীর কর্তব্য সেই টাকা দিয়ে স্ত্রীর নামে নতুন সম্পত্তি ক্রয় করে দেওয়া। যদি কোনো স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তি নষ্ট করে ফেলেন তবে তার জন্য স্ত্রী যেন স্বামীর সঙ্গে কলহ-বিবাদ না করেন! নিজের মনের দুঃখ গোপন করে রাখবে। বাপ যেন কোনো সময় মেয়েকে ভাগ প্রাপ্য অংশ হতে বঞ্চিত না করেন।
হালিমা : মেয়ের সঙ্গে শ্বশুরবাড়িতে থালা, ঘটি অর্থাৎ নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেওয়া উচিত নয় কি?
কুলসুম : সেসব জিনিস স্বামী দিতে বাধ্য। যেদিন স্বামী বিয়ে করলেন সেদিন হতে স্ত্রীর সকল সুখের ব্যবস্থা স্বামীকেই করতে হবে। অনেকে ইচ্ছা করেন বধূ, খাট, চেয়ার, বাক্স, বদনা, ঘটি, এ-সব বাপের বাড়ি হতে নিয়ে আসবেন। পরের বাড়িতে যখন থাকা, তখন সঙ্গে কিছু কিছু জিনিস না নিয়ে গেলেও অপ্রস্তুত হতে হয়। এসব জিনিস মেয়ে যদি সঙ্গে না নেন, তবে তাকে কিছু বলবার অধিকার কারো নেই। যেসব জায়গায় মেয়েকে খোশামোদ করে বিয়ে দিতে হয়, সেখানে অনেক বিড়ম্বনা ভোগ করতে হয়। মেয়েকে খোশামোদ করে বিয়ে দেওয়া অত্মমর্যদা জ্ঞানসম্পন্ন লোক পারেন না। বড় মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ করে বড় হতে চেষ্টা করা ভালো কাজ বলে বোধ হয় না; জ্ঞান, বিদ্যা, ও চরিত্রের দ্বারা বড় হতে চেষ্টা করা উচিত।
হালিমা : বাপ জামাইকে টাকা অর্থাৎ পণ, গয়না কিছু দিতে বাধ্য নয় কি?
কুলসুম : না, বাপ শুধু মেয়েকে মানুষ করে দিতে বাধ্য। যিনি বিয়ে করবেন, তিনি গয়না দিয়ে সজ্জা দিয়ে বধূ নিয়ে যাবেন। তার নিকট হতেও জোর করে গহনা আদায় করবার কারো অধিকার নেই। যার বউ তিনি ইচ্ছা হয় গয়না দেবেন, নইলে না দেবেন। এ সম্বন্ধে বাজে লোকের কোনো কথা না বলা উচিত। বধূরও উচিত নয় স্বামীর কাছ থেকে কিছু জোর করে আদায় করা। রূপ স্বামী দেখবেন। স্বামী যদি স্ত্রীকে রূপসী করে না তুলতে চান, তবে স্ত্রীর কি? গয়না অপেক্ষা, জ্ঞান, চরিত্রশক্তি ও মানসিক বলের ভিতরই রূপ বেশি আছে।
বাপের সম্পত্তির টাকা এক পয়সা হলেও, বিবাহিত মেয়েদের কাছে অংশমতো মাসে মাসে আত্মীয় বা ভাইদের কর্তব্য পাঠিয়ে দেয়। মেয়ে যেন এই অংশ আদায় করতে কোনোও রকমে সঙ্কোচ বোধ না করেন। যে পিতা মেয়ের অংশ শুধু ছেলেদের দিয়ে যান–তিনি অপদার্থ পিতা। যে ভাই ভগ্নীকে-বোন ভিন্ন মায়ের পেটের বা এক মায়ের পেটের-সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করতে চান, তিনি বড় অন্যায় কাজ করেন। তিনি পাপ করেন।
হালিমা : অনেকে পড়ার খরচ পাবার আশায় বিয়ে করে, পরে বাপ টাকা না দিলে চিরকাল মেয়েকে আপমান সইতে হয়।
কুলসুম : অনেক শ্বশুর জামাইকে টাকা দেওয়া হবে বলে মেয়ে দেন; এর ফল শেষে খারাপ হয়। এরূপ কোনো বন্দোবস্ত জামাই-শ্বশুরে না হওয়াই ভালো। কোনো দান শ্বশুরের কাছ থেকে না নেওয়াই উচিত। আগে বলেছি শ্বশুরের মাঝে মাঝে জামাইকে উপহার দেওয়া ভালো, জামাইয়ের কিন্তু উচিত শ্বশুরের কোনো কিছু গ্রহণ না করা।
হালিমা : বিবাহের পর মেয়েকে জামাই এবং শ্বশুরের হাতে সঁপে দেয়া কেমন প্রথা?
কুলসুম : মেয়ের হাতখানি জামাই এবং জামাই এর বাপের হাতে তুলে দেওয়ার কথা? এ একটা জঘন্য ব্যাপার। এতে যেন কত অপরাধী তাই দেখান হয়। মেয়ের যদি কোনো গুণ থাকে, তাহলে তার শ্বশুরবাড়ি যেয়ে অসম্মান হবে না। যেখানে মেয়েকে খোশামোদ করে বিয়ে দেওয়া হয়, সেখানে বিয়ে না দেওয়াই উচিত। মেয়ের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অপরাধ স্বামী শ্বশুরের আদৌ লক্ষ করা উচিত নয়। তাদের নিজেদের অনেক ভুল আছে। সকলেরই ভুল হয়। কারো চরিত্রের যদি বিশেষ ভুল থাকে, তা হলে সেটা সম্ভবত মেনে নেওয়া উচিত। বধূ যদি শিক্ষিত ও বিত্তশালিনী হন, তা হলে তার উপর কারো প্রভুত্ব ও সমালোচনা বিশেষ চলে না। কাজের অনবরত বিরক্তিকর সমালোচনা হতে থাকলে মানুষের মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়।
হালিমা : বিয়ের সময় পাত্রী ও বর নিয়ে অনেক কেলেঙ্কারি হয়! এমন হবার কারণ কী?
কুলসুম : এর জন্য পাত্রপক্ষ এবং পাত্রীপক্ষ উভয়েই দোষী। বিয়ের আগে সকল বিষয় ঠিক করে নিলে আর সেই কেলেঙ্কারী হয় না। পূর্বে সকল কথা ভালো করে মীমাংসা করে নিতে লজ্জা করলে চলবে না। কত টাকার কাবিন হবে, কি গয়না বা কি কি জিনিস লাগবে, আগেই ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। কাবিনের টাকা অনেক সময় আদায় হয় না, স্বামীর পিতা অর্থাৎ শ্বশুরের কর্তব্য বধূকে কিছু জমি দেয়া। বস্তুত টাকার কাবিন হয়ে যদি জমির কাবিন দেওয়া যায়, তাই ভালো। এতে স্বামীর বা স্বামীর পিতার কিছুমাত্র সঙ্কোচ বোধ করা উচিত নয়। একটি কুলকন্যা কোন সাহসে বাপের সঙ্গে সকল সম্বন্ধ কেটে ফেলে পরের বাড়িতে আশ্রয় নেবে। সে সম্বন্ধে সকলেরই বিবেচনা করা উচিত। গয়না-পত্র সম্বন্ধে বিয়ের মজলিসে অনেক সময় কলহ-বিবাদ হয়। গয়নার জন্যে পাত্রী পক্ষই বেশি কলহ করেন। এ বড় অন্যায়। মেয়ে যার পত্নী হবে, সে যদি স্ত্রীকে গাছের বাকল পরিয়ে সুখী হয়, তাতে পাত্রীপক্ষের কোনো আপত্তি থাকা উচিত নয়। মেয়ে কি চায়?-স্বামীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ। বিবাহের দিন স্বামী যদি স্ত্রীকে মলিন বেশে ঘরে নিয়ে যেতে চান, তাতে অপরের কি ক্ষতি? এক সময়ে অনেক টাকা একসঙ্গে জমা করা অনেকের পক্ষে কঠিন। স্ত্রীর কর্তব্য নয় গয়না, কাপড়ের জন্য স্বামীকে ঋণজালে জাড়িত করা। গয়নার টাকা বা বাজে খরচ যোগাড় করতে না পারলে কি লোকে অবিবাহিত থাকবে? বলতে পরো, কেউ যদি টাকা জমা করতে না পারে, সে কি গুণহীন কন্যাকে বিয়ে করবে? আমি বলি ভদ্রলোকেরাই বেশি করে। যারা গরিব তাদের একসঙ্গে অনেক টাকা জমা করা কঠিন। সব ভদ্রলোকেরাই যে গরিব হবে এ আমি বলছি না।
হালিমা : কিন্তু খালি হাতে পুরুষের উচিত নয় বিয়ে করা। বিবাহের দিন স্বামীর . কর্তব্য স্ত্রীকে উপহার অর্থাৎ গয়না কাপড় যৌতুক দেয়া।
কুলসুম : নিশ্চয়ই কর্তব্য। স্ত্রীর মনে বিশ্বাস হওয়া চাই স্বামী তাকে ভালবাসবে। উপহার ছাড়া শুষ্ক মৌখিক ভালবাসার মূল্য নেই। বংশের সম্মানের জন্য অনেকে জামাই পক্ষ হতে নগদ টাকা চায়; এরূপ লোকের কন্যাকে ঘৃণার সঙ্গে যাদি লোকে প্রত্যাখ্যান করেন তবে তাতে রাগ করা কঠিন।
হালিমা : বিবাহের অযথা খরচের অর্থ কী?
কুলসুম : এই যেমন পান, তামাক, মিঠাই এবং অযথা কতকগুলি বরযাত্রী সমাগমে বিস্তর খরচ হয়। বিবাহের সময় কয়েকজন নিকট আত্মীয় ছাড়া বেশি বরযাত্রী সমাগম ভালো নয়। অনেকগুলি লোক একসঙ্গে এক সন্ধ্যায় কোনো জায়গায় গেলে গৃহস্থের অনেক টাকা খরচ হয়। এমনিভাবে টাকা বরবাদ না করে কোনো সৎ উদ্দেশ্যে যদি সেগুলি দান করা হয় তবে সমাজের বড়ই উপকার হবে।
হালিমা : সে কথা ঠিক। অনেক সময় বরযাত্রীদের প্রতি বড় অসম্মান দেখান হয়।
কুলসুম : নিকট আত্মীয় না হলে বরযাত্রী হওয়া ঠিক নয়।
হালিমা : বিয়ে মেয়ে বাড়িতে হওয়া উচিত না অন্য কোনো স্থানে হওয়া ভালো? বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত বরপক্ষ যখন সম্পূর্ণ অজানা লোক তখন তারা কি বলে মেয়ের বাড়িতে উপস্থিত হবে?
কুলসুম : খুব ভালো কথা বলেছ বোন। বিয়ে মেয়ের বাড়িতে হওয়া আদৌ ঠিক নয়। দূর দেশে অজানা অচেনা স্থানে উপস্থিত হয়ে অনেক সময় বরপক্ষকে যারপরনাই বিপন্ন হতে হয়। বিয়ে কোনো মসজিদে হওয়া ভালো। সেখানে কারো ব্যক্তিগত প্রাধান্য নেই। মেয়েকে সাজিয়ে মসজিদে উপস্থিত করার দরকর নেই। মেয়ের প্রতিনিধিরা মেয়ের হয়ে সব কাজ করতে পারেন।
হালিমা : রাত্রিতে বিয়ের প্রকৃষ্ট সময় নয় কি?
কুলসুম : রাত্রিতে বিয়ে না হওয়া উচিত–এতে রত্রি জাগরণ ভয়ঙ্কর অনিয়ম, ফলে স্বাস্থ্যনাশ ঘটে।
হালিমা : বিয়ে দূরদেশি হওয়াই উচিত, না খুব কাছে হওয়া ভালো?
কুলসুম : বিয়ে দূরদেশে না হওয়াই ভালো।
হালিমা : যদি ভালো বর না পাওয়া যায়।
কুলসুম : তবে অগত্যা দূরদেশেই যেতে হবে। একদল নতুন লোক যাদের রুচি ও সভ্যতা অন্য রকমের-তাদের মধ্যে পড়লে মেয়ের খুব কষ্ট হয় বলে মনে হয়, মেয়ে যেন বনবাসিনী হয়ে পড়ে। মেয়ের মত নিয়ে কাজ করলেও মন্দ হয় না। যাতায়াতের সুবিধা থাকলে দূরে বিয়ে হতে পারে। এতে সন্তান-সন্ততির দৃষ্টি ও মন উদার হয়। আবার কতগুলি লোক আছে, যারা নিজেদের আওতাধীন স্থানকেই পৃথিবী মনে করে।
হালিমা : বিয়ের জন্য কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া কেমন?
কুলসুম : বিজ্ঞাপন দেওয়া উচিত; এতে কারো আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে না। বিয়ের প্রস্তাব ব্যাপারে অনেক সময় অনেক অপমান সহ্য করতে হয়-মেয়ের মাতা বা পিতার পক্ষে যা সহ্য করা বড় কষ্টকর।
মেয়ে বা ছেলে নিজেরাই মেয়ে ঘটক দিয়ে নিজের নিজের ভাবি স্বামী বা পত্নীর কাছে বিয়ের প্রস্তাব করে পাঠাতে পারেন। পরস্পরে কথা ঠিক হলে, বাপ-মায়ের সম্মতি নিতে হবে। বিশেষ বাধা না থাকলে তাদের সম্মতি দেওয়া উচিত। এতে কোনো পক্ষেরই অসম্মান হয় না। স্বামী বা পত্নী ঠিক করে নেওয়া পাপ বা লজ্জাজনক কাজ নয়।
১৬-২০. স্ত্রীকে স্বামীর মত নিয়েই চলতে হবে
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
কুলসুম : স্ত্রীকে স্বামীর মত নিয়েই চলতে হবে। নইলে স্বামীর শ্রদ্ধা হারাতে হয়, ফলে স্বামীর সঙ্গে মিল হয় না।
হালিমা : যা কোনো দিন করি নি, হঠাৎ স্বামীর ইচ্ছায় তা কি করা সম্ভব?
কুলসুম : বাপের বাড়ির সকল সংস্কার, সকল অভ্যাস ভুলে যেতে হবে; নইলে রমণী জীবনে সমূহ বিপদ উপস্থিত হয়। দুটি লোক দু রকমের হলে তাদের কি করে মিল হবে?
হালিমা : স্বামী স্ত্রীর ইচ্ছায় চললেই পারেন।
কুলসুম : মেয়েরা সাধারণত পুরুষ অপেক্ষা কম বুদ্ধিমতী, তাদের রুচি স্বামী অপেক্ষা কম মার্জিত। মানসিক শক্তি ও দৃষ্টিতে মেয়েরা পুরুষ অপেক্ষা হীন, সুতরাং নারীকে স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী কাজ করা উচিত। স্ত্রী যদি স্বামী অপেক্ষা অধিক শিক্ষিত হন তা হলে স্বামী স্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে পারেন, তাতে কোনো দোষ নেই। স্বামী সম্ভবত স্ত্রীর মন যুগিয়ে কাজ। করবেন; স্ত্রী ও সর্বদা স্বামীর ইচ্ছা মেনে চলবেন। বন্ধুজনের মধ্যে এইরূপ কার্যনীতিই প্রশস্ত। মনে কর স্বামী ইচ্ছা করেন স্ত্রী বিশেষ কোন রকমের কাপড় পরেন; স্ত্রী সেরূপ কাপড় পছন্দ করলেও তাই পরতে হবে, কোনো স্বামী ছাড়া অন্য কারো জন্য স্ত্রীর রূপ নয়।
হালিমা : সেকালের মেয়েদের সঙ্গে বর্তমান কালের মেয়েদের চালচলন অনেক তফাত।
কুলসুম : অনেক তফাৎ ঠিকই। তবে অনেকে আছেন, তাঁরা মা-দাদীর উপদেশ অনুযায়ী বাপের বাড়ি চালচলনের দস্তুর অনুসারে সেকালেন বুড়ী সাজতে যান; স্বামীর কথা উপেক্ষা করেন, মা যা শিখিয়েছেন সেই রকমই চলেন। আজকালকার ছেলেরা ইচ্ছা করেন, মেয়েরা কিছু চটপটে হয়–বেশ বই পড়তে পরে, উচ্চাসনে বসতে লজ্জা করে না, গুছিয়ে কথা বলতে জানে, একটা ফুটফুটে পরিষ্কৃত পরিচ্ছন্ন বাবু পরীর মত বধূ সামনে ঘুরে বেড়ায়, লজ্জাবতী ধানের বস্তার মতো এক পাশে ঘোমটা টেনে পড়ে না থাকে, কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতে জানে, পৃথিবীর খবর রাখে, হাতের লেখাটা খুব ভালো হয়। কিছুকাল আগে, যা তা একটু লিখতে পারলেই স্বামী এবং পাড়া প্রতিবেশীর কাছে মেয়েরা প্রশংসা লাভ করতো, আজকাল আর তা হবার যো নেই। কোনো কোনো হতভাগিনী বলে থাকে, মেয়ে যখন চাকুরীর জন্যই লেখাপড়া, পরের পদলেহন করার জন্যেই বিশ্বে লক্ষ লক্ষ জ্ঞানকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা এত স্কুল, কলেজ।
হালিমা : তা হলে স্বামী যেরূপ ইচ্ছা করেন সেই মতোই চলতে হবে।
কুলসুম : নিশ্চয়ই, তা না করলে স্বামীর সঙ্গে মিল হবে না। ভিতরে ভিতরে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হবে। লেখাপড়া না জানলে নিজের মধ্যে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকলে, অনেক সময় স্বামীর ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করার প্রবৃত্তি মেয়েদের হয় না। স্বামীর ইচ্ছামতো চলতে, পাড়া-প্রতিবেশী বা অন্য লোকের কাছে লজ্জাবোধ হয়। এতে লোককে ভয় করবার বা লজ্জা করবার কোনো দরকার নেই। মেয়েরা যদি জ্ঞানী ও বুদ্ধিমতী হন তা হলে তাঁরা স্বামীর মত অনুসারে কাজ করতে লজ্জা করেন না।
হালিমা : প্রাতঃকালে উঠেই স্বামীর সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করতে হবে?
কুলসুম : স্বামী যদি সে সময় ঘুমিয়ে থাকেন, তা হলে ধীরে ধীরে পদে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। নামাজ পড়বে, তৎপর কোরান শরীফ আস্তে পড়বে। কোনো কোনো স্বামী অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকেন। যদি স্বামী বেনামাজী হন, তা হলে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া না করে নামাজ পড়ার জন্য তাকে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করবে, উপদেশ দেবে। স্ত্রীর ব্যবহার ও পবিত্র জীবন দেখে স্বামীও পবিত্র হয়ে উঠবেন। সুপ্ত স্বামীর কাছে জিনিস পত্রের খুটখাট শব্দ করা উচিত নয়। স্বামী জাগলে হাসিমুখে তার কুশল জিজ্ঞাসা করবে।
শীতকালে বাড়ির দাসীকে প্রাতঃকালে পানি গরম করে রাখতে বলবে; দাসী না থাকলে নিজেকেই এই কাজ করতে হবে। রাত্রির রান্না শেষে খানিক পানি চুলোর উপর দিয়ে রাখলেও পানি গরম থাকে।
হালিমা : কতকগুলি স্বামী স্বভাবত খিটখিটে মেজাজের হয়ে থাকেন, কিছুতেই তাঁরা সন্তুষ্ট হন না।
কুলসুম : অনেক লোক খিটখিটে হয়ে থাকে; এর কোনো প্রতিকার নেই। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া না করে স্ত্রী নিজের কর্তব্য করে যাবেন। বুদ্ধি, ভালো কথা, সৎস্বভাবে ও মিষ্ট ব্যবহারের জয় হবেই হবে। স্বামী কোনো কথা জিজ্ঞাসা করলেন, মনে রাগ থাকলেও চট করে কথার উত্তর দিতে হবে। অভিমান করে ঘাড় ও মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে, দরাজায় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে না। স্বামীর ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে হাঁড়ি, বাসন মাটির উপর শব্দের সঙ্গে রাখতে নেই।
হালিমা : পরিবারে যখন কাজের সাড়া পড়ে যায়, তখন স্বামীর কীরূপ ব্যবহার করতে হবে?
কুলসুম : বিবাহের অব্যবহিত পরে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মনই উদ্দাম আবেগপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্ত্রীর ইচ্ছা হয়, সব সময় স্বামীর সঙ্গে গল্প করেন। ঘরের মধ্যে স্বামীর সঙ্গে হাসাহাসি ও আলাপ করেন। একটু পুরোনো হল অর্থাৎ বিয়ের দু-এক বছর পর, এ আবেগ। থাকে না। এরূপ দেখে অনেক অনুন্নত-হৃদয় ব্যক্তি বিরক্ত হন। যুবক-যুবতীর পবিত্র মধুর প্রেমের প্রতি এদের মোটেই সহানুভূতি নেই। ইংরাজেরা বিয়ের পরে মানুষের কুদৃষ্টি হতে ছেলেমেয়েকে ২/১ মাসের জন্য দূরে পাঠিয়ে দেন। মনের আবেগ কমলে যুবক-যুবতী বাড়ি ফিরে আসেন–এ প্রথাটা মন্দ নয়। যা তুমি বলছিলে–প্রাতঃকালে যখন সংসারের কাজকর্মের সাড়া পড়ে যায়–গাছপালা যখন স্বর্ণ রৌদ্রে অভিসিক্ত হয়ে ওঠে তখন স্বামীর কাছে বসে হাসাহাসি গল্প করতে নেই, তাতে দুষ্ট লোকের মন একটা ঈর্ষা এবং অপবিত্রভাবে পূর্ণ হয়। এইরূপ করলে কোনো দোষ হয়, এ আমি বলি না! উন্নত ও শিক্ষিত পরিবারে এরূপ করা দোষের বলে মনে করে না। আবার কাজ নষ্ট করে স্বামীর সঙ্গে গল্প কারও ঠিক নয়। যদি এই সময়ের মধ্যে মানুষের অগোচরে স্বামীর সঙ্গে দেখা হয় তা হলে স্বামীকে একটা মমতার কটাক্ষ, একটু ওষ্ঠের মৃদু হাসি দেখাতে ছাড়বে না। স্বামীর সঙ্গে দেখা হলে জীবনের কোনো সময় গম্ভীর হয়ে থাকবে না। লোক থাকলে স্বামীর সামনে গম্ভীর হয়ে থাকা ভালো। গৃহে যদি স্বামী ছাড়া আর কেউ না থাকে, তবে সঙ্কোচ বোধ করাবার দরকার নেই।
হালিমা : দুপুরবেলা স্বামী এলে তার গায়ে বাতাস দিতে হবে নাকি?
কুলসুম : দুপুরবেলা ঘুমানো অন্যায়; বাতাস দিয়ে ঘুম আনা কাজেই তত ভালো কাজ নয়। স্বামীর যদি একই ঘুমাবার অভ্যাস হয়ে থাকে, তবে একটু আধটু বাতাস দিতে পার। বাতাস দিতে নিজের ক্লান্তি বোধ হলে বাড়িতে ছোট চাকর-বাকর থাকলে তাকে বাতাস দিতে বলবে। আর বাতাস তারই দেওয়া ভালো-স্ত্রী বা অন্য কোনো নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য কারো দ্বারা বাতাস খাওয়া বা জুতা খোলা বর্বরতার লক্ষণ। কোনো মেয়ে চাকরাণীকে কখনও স্বামীকে বাতাস দিতে বলবে না। দুপুরবেলা কখনও স্বামীর কাছে শোবে না, এতে স্বামীর শরীর খারাপ হতে পারে। কথা বললে, গল্প করলে কোনো দোষ নেই। শ্বশুর-শ্বাশুড়ী যদি বিরক্ত হন তবে তাঁদের সামনে বা তারা শুনতে পান, এমন স্থানে স্বামীর সঙ্গে কথা বলবে না। স্বামী যদি বাহির হতে পরিশ্রম করে আসেন তবে তাড়াতাড়ি পাখা নিয়ে তাঁকে বাতাস করলে মমতার পরিচয় দেওয়া হয়–এতে মোটেই লজ্জা করবে na। স্বামীর সেবায় অপমান নেই। বাড়িতে যদি একখানা ছোট চালানো পাখা তৈরি করে নেওয়া যায়, তবে বড়ই ভালো হয়। পরিশ্রান্ত হয়ে তার নিচে একখানা আসন নিয়ে বসে কাউকে দু’মিনিটের জন্য পাখা টানতে বললে সকল ক্লান্তি দূর হয়। স্ত্রীও কাজ করতে পারেন। এই টানা-পাখা তৈরি করতে বিশেষ খরচ হয় না। গ্রীষ্মকালে শোবার ঘরেও এরূপ পাখা ব্যবহার করা যায়। প্রাচীর বা বেড়ার ভেতরে দিয়ে পাখার দড়ি বের করে দিতে হয়। বাইরে হতে ঘুম আসা পর্যন্ত বা আধঘণ্টা মতো চাকর বসে বসে পাখার দড়ি টানতে পরে। আর শহরে যাদের বৈদ্যুতিক পাখা আছে তাদের এইসব ঝামেলার কোনো বালাই নেই।
হালিমা : মাঝে মাঝে স্বামীকে পান সেজে দেওয়া কেমন?
কুলসুম : পান-তামাক খাওয়া অনেক স্বামীর অভ্যাস নেই। স্বামীর পান-তামাক খাওয়ার অভ্যাস থাকলে, প্রয়োজন আছে কিনা নিজেই জিজ্ঞাসা করবে। কোনো কোনো সময় জিজ্ঞাসা না করেই তার কাছে পান-তামাক নিয়ে উপস্থিত হবে। নাস্তা থাকলে স্বামীকে যেন তা জিজ্ঞাসা করে, খুঁজে না নিতে হয়। খাবার জন্য স্বামীকে সময় সময় অনুরোধ করবে। খেতে দাও, নাস্তা খেতে দাও এরূপভাবে চেয়ে যেন স্বামীকে না খেতে হয়। স্বামী যখন ইচ্ছা তখন খাবে–এতএব স্ত্রীর উদ্যোগের কোনো কারণ নেই, এরূপ ব্যবহার অন্যায়। বেলা হয়ে গেলে স্বামীকে খাবার জন্য অনুরোধ করবে। ভালো জিনিসপত্র স্বামীকে খেতে দিতে যেন কখনও ভুল না হয়। পরী যেমন স্বামীর সুখের ব্যবস্থা করতে সদা ব্যস্ত থাকবেন, স্বামীও যেন তেমনি স্ত্রী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যতার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখেন।
হালিমা : নারীর কর্তব্যই আমি বেশি করে শুনতে চাই। স্বামীর কর্তব্য স্বামীই পালন করবেন।
কুলসুম : স্বামীর কাপড়-চোপড়, গামছা, জুতা গুছিয়ে আলাদা করে রাখা ভালো। অনেক সময় জিনিসপত্র খুঁজে বের করা যায় না–কাজের বড় ক্ষতি হয়, বিরক্তও কম হয় না।
স্বামীকে পানি দিতে হলে সব সময় গ্লাস মেজে দেবে। পানি দেওয়ার সময় দেখে নিও গ্লাসের ভিতর ময়লা পড়ছে কিনা। চাকরানীরা ঘাট থেকে যে পানি তুলে আনে তা স্বামীকে দিতে নেই। স্বামী বলে নয়, চাকরানীর তোলা পানি খাওয়ার জন্য ব্যবহার না করাই ভালো। পরিবারের প্রতি যিনি মায়া পোষণ করেন তারই হাতে খাবার পানি ঠিক রাখবার ভার দেওয়া উচিত। তাঁরই রান্না করা উচিত। এ সমস্ত কথায় মনে করো না, দাসীদের হুঁতমার্গ সেবাকারী হিন্দুদের মতো দূর দূর করতে হবে! বস্তুত খাবার পান ও রান্নার উপর নিজের বিশেষ দৃষ্টি থাকা চাই।
স্বামীর ভাত খেতে বিলম্ব হলে, নিজেরও স্বামীর জন্য অপেক্ষা করা ভালো। মুখে যাই বলুন মনে মনে স্ত্রীর এই অপেক্ষায় স্বামী সন্তুষ্ট হন।
হালিমা : খুব যদি ক্ষুধা লাগে তা হলেও কি স্বামীর জন্য বসে থাকতে হবে?
কুলসুম : স্বামীর প্রতি সাধারণত স্ত্রীরা খুব ভালবাসা পোষণ করেন। স্বামীর জন্য অপেক্ষা করলে তাদের কোনো কষ্ট হয় না। বিশেষ কষ্ট হলে বা স্বামীর কোনো জায়গা হতে ফিরে আসবার কোনো কথা আগে না হয়ে থাকলে, স্বামীর আগে খাওয়া যেতে পারে।
স্বামী কোনো জায়গা হতে বাড়িতে এলে স্ত্রীর কর্তব্য উঠে দাঁড়ান, দাসীর মতো সম্ভ্রম দেখাবার জন্য নয়, বন্ধুর ন্যায় প্রীতি-ভালবাসার চিহ্ন দেখাবার জন্যে স্বামীর হাতে কোনো জিনিস থাকলে নিজের হাতে নেবে। হাসিমুখে তার কুশল জিজ্ঞাসা করবে। কথা না বলে আপন মনে দূরে, মাথা গুঁজে থাকা অন্যায়। সাদর সম্ভাষণ ও প্রীতির আহ্বান জানান ভালো। স্ত্রীর মনে করা উচিত নয়–এসব করলে তার সম্মান নষ্ট হবে শরীরের রূপ অপেক্ষা কথা ও আলাপ ব্যবহারের রূপ বেশি।
কুলসুম আবার বলিলেন–স্বামীর গায়ের বা পরনের কাপড় যদি ময়লা হয় তা হলে তার কোনো কথা বরবার আগে সেগুলি নিজ হাতে পরিষ্কার করে দেবে। পরিষ্কার করবো কি না, এ কথা স্বামীকে জিজ্ঞাসা করবে না। এসব ব্যবহারে স্বামী সন্তুষ্ট হন।
হালিমা : দরিদ্র পরিবার হলে এত সাবান কোথা হতে পাওয়া যাবে?
কুলসুম : কাপড়, শরীর ও ঘর-দুয়ার পরিষ্কৃত রাখতেই হবে। যেমন করে হোক পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকা চাই।
কুলসুম পুনরায় কহিলেন–স্বামী কোনো কথা জিজ্ঞাসা করলে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে হয়। অনেক বধূর অভ্যাস আছে তারা কথার উত্তর দিতে দেরি করেন, নিজের গৌরব প্রচার করবেন-বস্তুত এইভাবে গৌরব বা মান বাড়ে না।
স্বামী যদি কোনো রকমে বেদনা পান, তা হলে তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করবে। স্বামীর হাত কাটলে বা কোনো আঘাত পেলে তাকে কিছু সমবেদনার কথা জানান ভালো। স্বামী যদি স্ত্রীর কোনো ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হন, কিংবা কোনো কাজের জন্য স্ত্রীকে দোষারোপ করেন, তা হলে স্ত্রীর মুখ বুজে বসে থাকা উচিত। নিজের ভুল নিজে স্বীকার করা ভালো। স্বামীর দোষারোপ অন্যায় হলে তাকে বুঝিয়ে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করা চাই। চুপ করে বসে থাকা–যারপরনাই বোকামি। জ্ঞানী ও বুদ্ধিমতীর মতো যদি স্বামীর দোষ ধরে দেওয়া। যায় তা হলে স্বামীর অসন্তুষ্ট হবার কারণ নেই। কথায় কোনো ক্রোধ বা দুঃখের আবেগ যেন ফুটে বের না হয়। ধীর প্রশান্ত কণ্ঠে যুক্তির সঙ্গে কথা বললে মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে চুপ করে বসে থাকা ভাগ্যহীনার লক্ষণ।
স্বামী যদি কোনো কারণে ক্রুদ্ধ হয়ে বসে থাকেন তা হলে তাকে দেখে দূরে থাকতে নেই। তাঁর কাছে যেয়ে কথা বলবে ও আলাপ করবে। যে অতি বড় লম্পট, সেও স্ত্রীর সদ্ব্যবহার ও মধুর আলাপে মনে মনে সন্তুষ্ট হয়। সাত্ত্বিক জিনিসের জন্য মানুষের আত্মার একটা স্বভাবজাত ক্ষুধা আছে। প্রবৃত্তির মুখে আনন্দ যোগাবার জন্যে যে পতিতার পা চাটতে পারে, কিন্তু হৃদয়ের পুণ্য ক্ষুধা ও আনন্দের জন্য সে স্ত্রীর কাছে আসা! অতি হীন ব্যক্তির ভিতরের একটি সাত্ত্বিক ক্ষুধা থাকে, সেই ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় সদ্ব্যবহারে, করুণা ও মায়ায়-যা জননী ও স্বাৰ্ব্ব স্ত্রীর অঞ্চলে জড়ানো থাকে। যা সকল স্থানে পাওয়া যায় না।
স্বামী যদি বাজার বা হাট হতে কোনো জিনিস ক্রয় করে আনেন তা দেখে কখনও ঘৃণা বা অবজ্ঞা প্রকাশ করবে না, প্রশংসা করবে। অগ্রসর হয়ে তার হাত হতে জিনিসপত্র নামিয়ে নেবে।
স্বামী যদি নিকটে আসেন তা হলে মাথা তুলে কিছু কথা আছে কি না জিজ্ঞাসা করবে।
স্বামী যদি কোনো দুঃখ কষ্টের কথা বলতে থাকেন, তা হলে আপন মনে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকবে না। স্বামীর কথা শুনতে ও বুঝতে চেষ্টা করবে। তার কথার উত্তর দেবে।
স্বামী যদি কোনো অন্যায় বা পাপ কাজে রত হতে যান, যদি তিনি নীচ ও হীন প্রকৃতির লোক হন তা হলে, স্ত্রীর কীভাবে তাঁর সঙ্গে চলতে হবে তা বলা বড়ই শক্ত। সর্বদা মিষ্ট কথায়, স্নেহ মায়ায় স্বামীকে উন্নত করতে চেষ্টা করবে। তাকে সাধু পবিত্র ও পর দুঃখকাতর হতে উদ্বুদ্ধ করবে। দরিদ্র হওয়া ভালো, তবু পাপের পথে, অন্যায়ের পথে হাঁটা কর্তব্য নয়, এই কথা স্বামীকে বারবার শুনাবে। স্ত্রীর মঙ্গল শক্তিতে স্বামীর চিত্ত মহত্ত্বে ভরে উঠতে পারে। বহু স্বামী ঘুষ খেয়ে, অন্যায় করে সাংসারিক অবস্থাকে উন্নত করতে চেষ্টা করে। স্বামীর এই প্রকার উন্নতিতে স্ত্রীর সহানুভূতি না থাকা নিতান্ত দরকার। দালান দিয়া কাজ নেই। গয়না ও শাড়ী দিয়ে কি লাভ? যদি তাতে স্বামীর আত্মা কলঙ্কিত হয়। স্বামী যাতে অন্যায় না করে, হারামি পয়সা উপায় না করেন, সেদিকে স্ত্রীর লক্ষ্য থাকা আবশ্যক। মানুষের আশীর্বাদ পবিত্রতার মঙ্গল শক্তিতে পরিবার যাতে শান্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে স্ত্রীর সেই চেষ্টা করা কর্তব্য। স্বামীকে পাপ পথে টেনে নেবার জন্যে স্ত্রী যেন সহায়ক না হয়ে দাঁড়ান।
হালিমা : স্ত্রীর অনুরোধ ও অশ্রুজলে স্বামী যদি অন্যায়ের পথ পরিত্যাগ না করেন?
কুলসুম : তা হলে স্ত্রীর মনে অসীম দুঃখ এসে উপস্থিত হবে। সেরূপ স্বামীকে কিরূপ ভাবে গ্রহণ করতে হবে, তা চিন্তার কথা। স্ত্রীলোকের জীবনে এর মতো দুঃখ আর নেই। পাপীও অপদার্থ স্বামীর সঙ্গে বাস করে বহু পবিত্র হৃদয় নারীর আত্মার পতন হয়। স্বামীর আত্মার পতন হলেও স্ত্রীর নিজের আত্মার যেন পতন হয়। স্বামীর নীচতার প্রতি ভিতরে ভিতরে সহানুভূতি পোষণ করবে না। স্বামীকে ভালো ও উন্নত করতে চেষ্টা করবে, না পারলে কি করা যায়? নিজের দুঃখ বেদনা নিজের ভিতরে গোপন করে রাখাই ঠিক।
কুলসুম আবার বলিলেন–স্বামী যদি কোনো বিশেষ কাজে বিদেশে থাকেন তা হলে তাকে অনবরত কাজ ফেলে বাড়িতে আসতে অনুরোধ করবে না। বিরহের কথা জানাবে না, এতে স্বামীর কাজে অমনোযোগ আসতে পারে-কর্মশক্তি নষ্ট হতে পারে।
স্বামী যদি কলেজের ছাত্র হন, তা হলে তাকে আদৌ পত্র না দেওয়া উচিত। যদি পত্র লেখা নিতান্ত দরকার হয়, তা হলে, অল্প কথায় লিখবে। প্রণয়ের কথা ভালবাসার কথা লিখতে নেই। পত্রে স্বামীকে উপদেশ দিতে লজ্জা করা উচিত নয়। ঠিক উপদেশ রূপে কথা না বলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মিষ্টি করে কথা বলতে হবে। কর্তব্য কার্যে অবহেলা করে স্বামী যেন স্ত্রীর কাছে কখনও না আসেন, সে দিকে লক্ষ থাকা চাই। পত্র না লেখার কারণ স্বামীকে পূর্ব হতেই বলে রাখবে নইলে স্বামী রাগ করতে পারেন।
স্বামীর কাজ বা কথার প্রশংসা করা উচিত। অনর্থক তর্ক করা বড় খারাপ ও অভদ্রতা, এরূপ করলে স্বামী-স্ত্রীতে প্রণয় হয় না। স্বামী কোনো কারণে ক্রুদ্ধ হলে কখনও তাঁর সামনে হাসতে নেই। হাই তোলাও দোষের।
স্বামীর সঙ্গে বিদেশে যেতে কোনো প্রকার লজ্জা বা সঙ্গোচ করা ভালো নয়। বিশেষ বাধা না থাকলে স্বামীর সঙ্গে থাকতে বরং পীড়াপীড়ি করা উচিত। স্বামীর নিকট হতে চলে আসবার জন্যে কোনোরূপ জেদ কখনও করতে নেই। এটা বড় দোষের কথা। এতে স্বামীর শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস নষ্ট হতে পারে।
কোনো কোনো পুরুষ স্ত্রীকে ফেলে বিদেশে থাকে। পাঁচ বৎসরেও দেশে ফেরে না। স্ত্রী-পুত্রের জন্য অর্থ উপায় করার উদ্দেশ্যে তারা সাধারণত দূর দেশে যায়, এ খুব প্রশংসার কথা। দুঃখের বিষয়, অনেক লোক চরিত্র হারিয়ে অর্থ উপার্জন করে। যদি এইরূপ কোনো ভয় থাকে, তা হলে স্বামীকে বিদেশে না যেতে দেওয়াই ভালো। চরিত্র হারিয়ে অর্থ উপার্জন। করা মূর্খতা ছাড়া আর কি?
.
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম বলিলেন–প্রিয় বোন, পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি অনেক পরিমাণে হাতে। এ যেন সব সময় মনে থাকে। বধূর মনোযোগে দরিদ্র পরিবারেও প্রেম, শান্তি ও সচ্ছলতা বিরাজ করে। পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই পরিবারের মঙ্গলকাক্ষী হয়।
বধূকে সব কাজে বুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে। স্বামী ভালবাসেন বলে বধূ যেন উজ্জ্বল এবং সংসারের কাজে অমনযোগী হয়ে বা অহঙ্কারে নিজের সুনাম নষ্ট না করেন। কাজের শৃঙখলা-সৌকর্যের প্রতি সব সময় তার নজর থাকা চাই।
হালিমা : দরিদ্র পরিবারে কেমন করে মেয়ে মানুষের চেষ্টায় সচ্ছলতা আসে শুনতে চাই।
কুলসুম : কোনো জিনিস নষ্ট হতে দিতে নেই। দেখে-শুনে হিসাব করে খরচ করলে, সব জিনিসই বেশি দিন চলে। টাকা পয়সা বেশি আছে বলে অনর্থক ভাত, তরকারী বেঁধে পচিয়ে ফেলে দেওয়া উচিত নয়।
কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে গেলে একটু রিপু করে নিতে হয়। কাপড়-চোপড় অবহেলা করে ফেলে না দিয়ে যদি একটু-আধটু সেরে দরিদ্রকে দেওয়া যায়, তা হলে তাদের যথেষ্ট উপকার হয়। সতরঞ্চি কেনবার সঙ্গতি না থাকলে ধোয়া পুরনো কাপড় দিয়ে কাঁথা সেলাই করে নিতে হয়। কাঁথা তৈরি করতে অনেক মেয়ে আলসেমি বোধ করেন; কত দিনে শেষ। হবে, এই ভয়ে অনেকে কাঁথা তৈরি করার নাম শুনে চমকে ওঠেন। এতে অনেক সময় লাগে তা ঠিক, কিন্তু গল্প ও হাসি-তামাসা করার সময় যদি একটু আধটু বা একটা লাইন করে দৈনিক সেলাই করা যায়, তা হলে সতরঞ্চি ও অল্প শীতে রাত্রে গায়ে দেবার কাপড় কেনবার জন্য পয়সা ব্যয় করতে হয় না। নিজেরা বড় মানুষ হলেও গল্পে সময় নষ্ট না করে কাঁথা তৈরি করে, দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন অথবা দরিদ্র মানুষকে দেওয়া যায়। পরখে সুখ দিয়ে মনে যে আনন্দের সঞ্চার হয়, তার তুলনা কোথায়? মূল্যবান কাজ নষ্ট করে কাঁথা সেলাই করতে বলছি না। অবস্থার উপর লক্ষ রেখে কাজ করতে হবে। পরিবারের সকলে ও ছেলেপেলেদের শোবার কষ্ট দেখে বধূদের বিবেচনা চাই।
বাড়িতে তরকারি গাছ লাগিয়ে দেওয়া উচিত, এতে সংসারের অনেক খরচা বেঁচে যায়। কুমড়া, লাউ, সীম, বরবটি, বড় কচু, মেটে আলু প্রভৃতি অনেক প্রকার তরকারি বিনা চাষাবাসে হয়। অনেক দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা মুরগি, ভেড়া, ছাগল পালন করেন। এতে বেশ লাভ হয়। ছাগল ভেড়ায় পরের অনিষ্ট করে, সে দিকে নজর রাখা চাই। দারিদ্রভার ঘুচাতে গিয়ে যদি সহানুভূতিহীন প্রতিবেশীর গালি খেতে হয়, তবে সেও বড় কষ্টের কথা। কেরোসিন তেল, লবণ, মরিচ, সাগুদানা কিনে যদি পাড়ার লোকদের কাছে বিক্রি করা যায় তা হলেও দরিদ্র গৃহিণীর অনেকটা উপকার হয়। আজকালকার লোক বড় ধূর্ত–কাউকে বাকি দিতে নেই। কোনো ভদ্রলোকের কর্তব্যও নয় দরিদ্র মেয়েদের কাছ থেকে কোনো জিনিস বাকি নেন। ফসলের সময় কালই, পেঁয়াজ বা গুড় কিনে রেখে দিলে বেশ ভালো। হয়। অবশ্য কিছু মূলধন চাই।
যে সমস্ত মেয়ে বাল্যকালে কোনো শিল্প বা সেলাই-এর কাজ শিখে রাখেন, ভবিষ্যৎ জীবনে দুঃখে পড়লে তাহাদের ভয়ের কোনো কারণ থাকে না।
বাড়ির পার্শ্বে হলুদ ও আদার গাছ লাগিয়ে দেওয়া ভালো। আনারসের গাছ জঙ্গলের মধ্যেই হয়। চেষ্ট থাকলে যেমন করেই হউক, গাছের বীজ অথবা গাছ সংগ্রহ করে নেওয়া যায়। দুই-চারটা তরকারি, কলাগাছ থাকলেও পয়সা হয়। এসব কাজ করতে পুরুষের সাহায্য প্রয়োজন হয় না। মূলা শাকের ক্ষেত করতে মাটি তৈরি করার দরকার হয়, মাটি কোপান শুরু পুরুষ লোকেই পারে, এমন কোনো কথা নয়। জোছনা রাত্রে কোমরে কাপড় জড়িয়ে মাটি কোপালে কি ক্ষতি? এতে সম্মান নষ্ট হয় না। সম্মান নষ্ট হয় অন্যায় কাজে-পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকায়, আর ভিক্ষা করায়। ধান ভানলে বা কাজ করলে জাতি যায়, এ যারা মনে করে তারা অপদার্থ।
বড় বড় শহরে কলমের চারা পাওয়া যায়। পোস্টকার্ড লিখে অর্ডার দিলেও নিজের নামে নিকটস্থ রেল স্টেশনে বাক্সে চারাগাছ এসে উপস্থিত হয়। টাকা দিয়ে ডাকঘর হতে রসিদ দিয়ে স্টেশন থেকে কোনো সহৃদয় প্রতিবেশী দিয়ে গাছগুলি নিয়ে এসে বাড়ির ধারে পুঁতে দিলে দুই-চার বৎসরের মধ্যেই লাভ ভোগ করা যায়। ভালো কুল, লিচু এবং বড় কাশীর পেয়ারার দাম বাজারে বেশি। বাড়ি থেকেও লোকে কিনে নিয়ে যেতে পারে।
দুই-মর জোড়া পায়রা পুষলে দুই-চার মাসের মধ্যে এক একখানা কাপড়ের দাম সংগ্রহ করা যায়। মুরগী ও ডিম বিক্রি করলেও পয়সা হয়। দুঃখিনা সহায়হীনা রমণীর বাঁচবার অনেক পথ আছে–তার ভয় কি? কেবল চেষ্টা ও বিশ্বাস চাই।
হালিমা : পরদানশীন স্ত্রীলোকের পক্ষে এতগুলি কাজ করা কি সম্ভব? এত বুদ্ধি করে কাজ করলে লোকে যদি বেহায়া বলে?
কারো প্রতি যেন কোনোও প্রকার অশ্রদ্ধা না দেখান হয়। মেয়েরা অনেক সময় স্বামীর আত্মীয়-কুটুম্বকে রান্না ঘরে বসে এরূপ অন্যায় কথা বলে থাকেন যা শুনলে বন্ধু অবাক হয়ে অবিলম্বে বন্ধুর বাড়ি ত্যাগ করেন। ভাগ্যে তারা শোনেন না। সাবধান-এরূপ কথা কখনও বলবে না। বাজে লোকের অত্যাচার বেশি হলে একটি বিরক্ত মেয়েরা না হয়ে পারেন না তাও ঠিক। যাদের বাড়ি শহরে তাদের এখানে বহু অবিবেচক লোকের সমাগম হয়। শহরে থেকে সকলকে পরিতুষ্ট করা অসম্ভব, এটা সকলের বোঝা উচিত। দুটি পান, একটু নাস্তা অন্তত তাদের দেওয়া যায়।
টাকা দিয়ে কেউ যদি কারো বাড়ি খেতে চায় তাহলে বন্ধুরা অসম্মানের ভয়ে, তাতে স্বীকৃত হয় না। পাছে লোকে হোটেলখানা বলে বা অতিথি মনে করেন পরিবারের লোকেরা তার দেওয়া টাকায় লাভবান হচ্ছেন এই ভয়ে বধূরা সরে দাঁড়ান।
হালিমা কলিলেন, এতে বধূদের কিছু অসম্মান হয় বৈকি?
কুলসুম বলিলেন কিছুই না, যে কোনো দ্ৰসন্তানকে টাকা নিয়ে বাড়িতে রাখা যায়। এতে বধূদের কোনো অসম্মান নেই। পক্ষান্তরে বহু ভদ্র সন্তানকে উপকার করা হয়। উন্নত দেশে এরূপ প্রথার প্রচলন আছে। বিদেশীদের উপকার করা হয়।
বাইরে কোনো জিনিস যদি পড়ে থাকে তা ঘরের মধ্যে তুলে রাখতে হবে। সন্ধ্যার আগে বাইরে কাপড় আছে কিনা একবার চিন্তা করে দেখা উচিত।
যেখানকার জিনিস ঠিক সে জায়গায় রাখা একান্ত কর্তব্য। যেখানে সেখানে বাড়িতে কেউ যেন গৃহস্থের আবশ্যক জিনিসপত্র ফেলে না রাখে, এতে কাজের বড় অসুবিধা হয়। পরিবারের কেউ যদি এ নিয়ম পালন না করে, তবে তার উপর ক্ষুদ্ধ হবে।
বধূকে সব কাজে বুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে। তা হলে বধূর সুনাম বের হবে। ছেলে ম্যাচ নষ্ট করে জেনেও তার হাত থেকে ম্যাচ কেড়ে না নেওয়া, শুধু ছেলেকে মন্দবলা। বুদ্ধিমতী স্ত্রীলোকের কাজ নয়। ম্যাচ কাটি এলিয়ে ফেলবার আগে, ঘড়া হতে পানি ঢেলে ফেলবার পূর্বেই সতর্ক হওয়া উচিত। কুকুরে ভাত খেয়ে ফেলবার পরে বিরক্তির পরিচয় দিয়ে লাভ কি?
বাক্সের উপর কখনও কোনো জিনিস রাখতে নেই। এতে হঠাৎ বাক্সের কভার খুলতে গিয়ে জিনিস নষ্ট হয়।
বিছানা-পত্র দিনে রোদ থাকতে শুকিয়ে নিতে হবে–সন্ধ্যাকালে সিক্ত বিছানাপত্র হাতে করে, খোকা-খুকুদের সঙ্গে রাগারাগি করে কোনোই লাভ নেই।
গৃহস্থালীর কোনো জিনিস ফুরালে, পূর্ব হতেই সতর্ক হওয়া উচিত। পল্লী-গ্রামে, হাটের দিন স্বামীকে কী কী জিনিস কোনো দরকার, আগেই মনে করিয়ে দেওয়া উচিত। খালি হাত হবার পূর্বে জিনিসপত্র নতুন করে আনার নিয়ম।
বধূরা অনেক সময় বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকে। ছেলে-পিলে হলে মেয়েদের সারারাত্রি অনিদ্রায় কেটে যায়, সেইজন্যই সকাল সকাল ওঠা কঠিন হয়। রাত্রি অনিদ্রার জন্য, দিনে একটু ঘুমিয়ে নেওয়াই সুবিধা। সকাল বেলা নামাজ নষ্ট করে না ঘুমানই ভালো।
মনে রেখ, নামাজ নষ্ট করা বড়ই অন্যায়। ছেলেপেলের অত্যাচারে অনেক সময় নামাজের বড় ক্ষতি হয়। ছোট শিশু হলে তাকে ফিডিং বোতলে অভ্যস্ত করানো উচিত। গো-দুগ্ধ ছাড়া বাজারের কোনো খাদ্য কখনও ব্যবহার না করাই উচিত। ছেলের হাতে মিষ্টি বিস্কুট দিলে অনেক সময় তাদের কান্না থামে। ( কখনও নতুন জুতো যেন বাইরে না পড়ে থাকে। শেয়াল বা কুকুর নতুন জুতো পেলেই নিয়ে পালায়।
পরিবারের বিছানাপত্র ও লেপ দুই-চারটা বেশি করে তৈরি করে রেখে দিতে হয়। লেপ ও বিছানাপত্রের দিকে স্বামী যেন বিশেষ মনোযোগ দেন। বধূরও সম্ভব হলে কাঁথা তৈরি করে স্বামীকে সাহায্য করা উচিত। বাজারের তৈরি লেপ ভালো নয়। ধুনকারদের সেলাই করা লেপ আবার নতুন করে সেলাই করলে সহজে তুলা সরে না; নইলে এক বছরেই লেপ নষ্ট হয়ে যায়। প্রত্যহ একটু একটু করে সেলাই করলে কয়েক দিনেই একটা লেপ সেলাই করে ফেলা যায়।
হালিমা জিজ্ঞাসা করিলেন-তোষক না কিনলে কি চলে না?
কুলসুম : খুব চলে। ছেলেপেলেদের তোষকের কোনো দরকার নেই। স্বাস্থ্য যাদের ভালো, মনে যাদের চিন্তা–উদ্বেগ নাই, যারা ঘুমে আকুল, তাদের তোষক না হলেও চলে। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঘুমকে কাজ রূপে গ্রহণ করতে হয় তখন কিছু নরম বিছানার দরকার হয়। যাদের বেশি মানসিক পরিশ্রম করতে হয়, তাদের জন্য যত নরম বিছানা হয় ততই ভালো।
দরজার গোড়ায় আঁধারে অনেক সময় কুকুর দাঁড়িয়ে থাকে, অন্ধকারে হঠাৎ তাদের গায়ে পা দিলে কামড়াতে পারে। না দেখে তাদের গায়ে পানি ফেললে গা ঝেড়ে হঠাৎ কাপড়-চোপড় নষ্ট করে দেয়। কুকুর-বিড়ালকে কখনও শুধু মুখে দূর দূর করতে নেই তাতে লাভ হয় না। সর্বদা লাঠি দিয়ে ভয় দেখাবে।
বাড়িতে স্বতন্ত্র পায়খানার ব্যবস্থা থাকা চাই। স্ত্রীলোকের পায়খানায় কখনও যেন পুরুষ যায়, নিজের ছেলে বা অন্য কোনো পুরুষ কেউ নয়। অবশ্য একথা শহরে খাটে না।
অনেক সময় বাড়ির দাসীদের পেশাব-পায়খানা করবার বড় অসুবিধা হয়! সেদিকে গৃহিণীর বিশেষ দৃষ্টি থাকা আবশ্যক। দাসদাসী বলে তাদের জীবন ও অভাব-অসুবিধা উপেক্ষিত হবার নয়।
হালিমা জিজ্ঞাসা করিলেন-ধোপার কাপড় ও দুধের হিসাব কে রাখবে? বাজার খরচ কার হাত দিয়ে হওয়া ভালো?
কুলসুম : কাপড় ও দুধের হিসাব স্ত্রীদের রাখা উচিত। খরচপত্র স্বামীর হাতে থাকাই ভালো। অনেকে বুদ্ধিমতী স্ত্রীর হাতে মাসের প্রথমে বা শেষে বাজার খরচের টাকা দিয়ে থাকেন। স্ত্রী পরিবারের খাওয়ানোর ভার নিজের হাতে নেন। বাজার খরচ নিজের হাতে নিলে রীতিমতোভাবে খরচের হিসেব রাখা চাই।
কুলসুম আবার কহিলেন–অনেক সময় তাড়াতাড়ি বসবার টুল, হুঁকার কলকে বা গ্লাসের পিঠে বাতি রাখেন, এটা অন্যায় ও কদর্য রুটির পরিচায়ক।
রান্না ঘরে ল্যাম্প না জ্বালানোই ভালো। ঝুলানো বাতি ব্যবহার করলে ঘরে বা কাপড়ে কালি পড়ে না।
অনেক বাড়িতে সংসারের জিনিসপত্র কেবল গড়িয়ে বেড়ায়, এ ভালো নয়। হয় জিনিসপত্র ব্যবহার করতে হবে না হয় যত্ন করে তুলে রাখতে হবে।
পরিবারের মধ্যে যদি কেউ শৃঙখলা ও ভালো রুচির পরিচয় না দেয়, তাহলে নিজে ভালো বলে নিরন্তর তার সঙ্গে ঝগড়া-ঝাটি করাও ঠিক নয়। তার দোষ বা আর সকলে সেরে নেবে। ক্ষমাশীল, দয়ার্দ্র হৃদয়, শান্ত স্বভাব ও হওয়া ভদ্রমহিলার স্বভাব। বেশি কড়াকড়ি নিয়মে ফল খারাপ হতে পারে।
রোজার দিনে পূর্ব হতেই চাকর পরিচারিকা দিয়ে হোক অথবা নিজ হস্তে অথবা ছেলে-মেয়ে দিয়ে এফতারী প্রস্তুত করবে। রোজার সময় সন্ধ্যাকালে রাগারাগি করা দোষ।
কারো কাছে কিছু পাওনা থাকলে মাঝে মাঝে তাগাদা দিতে হয়। নইলে তা আদায় হয় না। তাগাদার জোরে অনেক সময় নিতান্ত বদ লোকের কাছে থেকেও টাকা আদায় হয়। প্রথমেই রূঢ় ব্যবহার নিষেধ।
ঘরের মেটে দাওয়ার ধান গড়ান ধরনের হলে, ভাঙ্গে না। নদীর ধারের মতো করতে হয়। টিনের ঘর তো স্বাস্থ্যকর নয়। তুলতে নিচে ছাত দেবে।
.
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম বলিলেন-হালিমা অনুন্নত সংসারে অনেক সময় শিক্ষিতা মার্জিত রুচি বালিকাঁদের বড় দুরবস্থা হয়। অনুদার, বহির্জগৎ সম্বন্ধে খবরহীন অথচ অহঙ্কারী পরিবারের বধূদের বড় জ্বালা হয়। শ্বশুর-শাশুড়ী, পাড়া প্রতিবেশী সকলেই বধূকে বিব্রত করে তোলেন। স্বামী এতগুলি লোকের কথা ও মতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না। স্বামী ও আত্মীয়-স্বজনের হয়ে স্ত্রীর উপর অত্যাচার আরম্ভ করেন। বধূকে চূর্ণ করে স্বামী মনুষ্যত্বের পরিচয় দেন। বধূ কি চাকরি করতে যাবে?
হালিমা : চাকরি করলে দোষ কী?
কুলসুম : অসভ্য দুর্মতি লোক যারা তারা দুনিয়ায় পশুর মতো বেঁচে থাকতে পারলেই যথেষ্ট মনে করে। তারা যে নিজে একটু লেখাপড়া শেখে, সে কেবল ঘুষ খেয়ে লোকের তোষামোদ করে বা পরকে ফাঁকি দিয়ে নিজেরা সুবিধা করে নেবার জন্যে। জ্ঞানী, সভ্য ও ভদ্র হবার জন্যে তারা লেখাপড়া শেখে না। নারীকে লেখা-পড়া শিখতে দেখলে তারা তো রাগবেই।
কুলসুম পুনরায় বলিলেন–কোনো দুঃস্থ নারীকে দেখে যদি বধূ সহানুভূতি প্রকাশ করতে যান, তা হলে শঙ্কীর্ণ হৃদয় শাশুড়ী বধূর উপর রেগে থাকেন। বাড়িতে দুপুর বেলা বা অন্ধকার রাত্রির সন্ধ্যায় অতিথি এসে উপস্থিত–বধু তাদের কারো দিয়ে সাদর অভ্যর্থনা। জানাতে ইচ্ছে করবে, স্বামী-শ্বশুরের জ্বালায় তা পিরবার যো নেই। কোনো দরিদ্র আত্মীয় স্বজন বাড়িতে এলে তাকে যত্ন করা দরকার, না করলে অনেক স্বামী বিরক্ত হন। এই প্রকার ব্যক্তিদের মধ্যে থাকা অনেক বধূর কষ্টকর হয়ে পড়ে। যাদের মধ্যে বাস করতে হয়, তাদের ব্যবহার ও প্রবৃত্ত যদি বেশি নীচ হয়, তাহলে বধুর জীবনে কোনো সুখ থাকে না। কোনো কোনো পরিবারে অশ্লীল ও কুৎসিত কথা অসঙ্কোচে উচ্চারিত হয়; এই সমস্ত লোকের মধ্যে বসা করাও বড় কঠিন।
একই ভাব ও প্রবৃত্তি বিশিষ্ট লোকের মিল হয় ভালো। যে মেয়ে বাল্যকাল হতে অন্য রকমে গঠিত হয়েছে তার পক্ষে দুর্মতি লোকদের সঙ্গে বাস করা কঠিন নয় কি? হয় তাকে নিচে নেমে আসতে হবে, নইলে ভিতরে ভিতরে মৃত্যু পর্যন্ত প্রাণে দুঃখে পোষণ করতে হবে। সে দুঃখের কোনো মীমাংসা নেই। শয়তান প্রকৃতির স্বামীর স্পর্শে এসে কত শুভ্র। নারী–আত্মার শোচনীয় পতন হয়। কোনো কোনো আড়ী ভদ্রবংশের মেয়ে বিয়ে করে ভদ্র হতে চেষ্টা করে। কন্যার পিতার তাকে বলে দেয়া উচিত–এইভাবে ভদ্র হতে চেষ্টা করে, নিজে চরিত্রবান ও শিক্ষিত হয়ে ভদ্র হতে চেষ্টা করুন। ইতর ও অর্ধ শিক্ষিত ব্যক্তির হাতে মেয়ে পড়লে তার জীবনে দুঃখ বাড়ে।
কুলসুম : কথা শুনে মর্মাহত হলাম। জান বাঁচান ফরজ, পরদা অপেক্ষা প্রাণের মূল্য বেশি। যে সমস্ত কথা বললাম, এসব কথা কাজে পরিণত করার জন্য, বেপরদা হবার তো কোনো দরকার নেই। স্ত্রীলোক বুদ্ধির পরিচয় দিলে লোকে তাকে বেহায়া বলে, এ আমি কোনো দিন শুনি না।
হালিমা : সময় সময় মুরগীর অত্যাচার বড় বেশি হয়ে পড়ে।
কুলসুম : মেঝের উপর দাওয়া না করলে মুরগীর অত্যাচার থেকে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যায়। উঁচু স্থানে হাঁড়ি রাখবে। ঘরের মধ্যে মুরগীকে যেতে দিতে নেই। এঁটো ফেলার সম্বন্ধে বিলক্ষণ সাবধান হবে। মাটির উপর বসে না খেলে শুধু মুরগী নয়-বিড়াল, কুকুর, ধুলাবালি অনেক কিছুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সকলের এক সময় খাওয়া উচিত। এতে এঁটো কম হয়। যখন তখন হাঁড়িতে হাত দেবে না। বিশেষ কারণ না থাকলে ঘরের দুয়ার বন্ধ রাখবে।
কুলসুম পুনরায় কহিলেন–প্রাতঃকালেই থালা মেজে ফেলা উচিত। ছেলেপেলের ঘরে চীনা মাটির কিংবা কাঁচের বাসন ব্যবহার না করাই ভালো।
ছেলেরা কখনও মাটিতে খাবে না। এদের জন্য মেঝের পার্শ্বে ছোট ছোট টুল রেখে দিলে ভালো হয়। মাটিতে খেলে মুরগীর উপদ্রব বড় বাড়ে। জায়গা বাড়ি নোংরা হয়ে ওঠে।
চালের হাঁড়ি নিচে রাখতে নেই চালের গন্ধে ঘরের মধ্যে মুরগী এসে হল্লা করে।
বদনা, বাটী, থালা কখনও মেঝেয় বা হাঁটবার পথে যেন না থাকে। ছেলেরাই এই অপরাধ বেশি করে। এই কু-অভ্যাসগুলো সংশোধিত না হলে, চিরকাল তারা কষ্ট ভোগ করে।
কোনো জিনিস যদি মাটির উপরে পড়ে থাকে, তাহলে তৎক্ষণাৎ সেগুলি তুলে রাখতে হবে। চাকর-বাকরের সুবুদ্ধির উপর নির্ভর করলে চলবে না। সকল কাজে চাকর-বাকর সুবুদ্ধির পরিচয় দেবে, এ আশা করা যায় না।
গোছল করে অনেক সময় কাপড় পানিতে ভিজিয়ে রাখেন। যখন তখন ধুয়ে ফেললে আপদ চুকে যায়। বেশিক্ষণ পানিতে কাপড় থাকলে পচে যাবার সম্ভাবনা।
অনেক পরিবারে বদনা, ঘড়া এক মাসেও মাজা হয় না। প্রতিদিন বদনা মাজা উচিত।
বাড়িতে দাস-দাসী না থাকলে খাবার পর যার যার থালা, এঁটো সেই সেই পরিষ্কার করে ফেলা ভালো। এঁটোব্লুটো, ফেলে রাখলে মেজাজ ভালো থাকে না, দুর্গন্ধও সৃষ্টি হয়।
কখনও অন্ধকারে জিনিসপত্র খুঁজতে নেই।
শোবার সময়, বাতি ও ম্যাচ ঠিক করে শুতে হয়। বৃষ্টি-বাদলার দিনে ম্যাচ কাপড়ের ভিতর রেখে দেওয়া উচিত-নইলে ম্যাচ জ্বলে না। বিদেশে, বৃষ্টি বাদলের দিনের জন্যে পূর্ব হতে জ্বালানি কাঠ ঠিক করে রেখে দিতে হয়, নইলে অনেক সময় না খেয়ে থাকতে হয়। চুলো ও অগম্ভীর হলে কম খড়িতেই রান্না হয়।
হালিমা : খড়ি কাঠ ঠিক করে রাখা কি মেয়ে মানুষের কাজ?
কুলসুম : না, স্বামীকে পূর্ব হতেই হুশিয়ার হতে বলতে হবে। ধানের খোসা এবং গোবরে জ্বাল দেবার সাহায্য হয়। পল্লী ছাড়া এসব সংগ্রহ করতে পারা যায় না।
হালিমা : গোবরে হাত দিতে আমার বড় ঘৃণা বোধ হয়।
কুলসুম : অবস্থা নিয়ে ব্যবস্থা। খড়ি কেনার পয়সা না থাকলে, গোবরে হাত দিলে দোষ কি? গোবর নোংরা জিনিস নয়।
হালিমা : গোয়াল ঘরের ভিতরে এবং কাছে যে আবর্জনা জন্মে তা দেখলে ঘৃণায় গা বমি করে। এমন জঘন্য দৃশ্যও মানুষকে দেখতে হয়। ছি!
কুলসুম : গরুতে অনেক উপকার হয়। প্রত্যেক জ্বগৃহে দু’একটা ভালো গাভী থাকা নিতান্ত দরকার। অন্য কোনো জিনিস থাক বা না থাক, একটা গাভী এবং কয়েকটি মুরগী পোষা উচিত। দুধ-ঘিতেই মানুষের জীবন; মুরগীর ডিম শরীরের পক্ষে বড় উপকারী। যে কথা বলছিলাম, গোয়াল ঘরের ধারে যে আবর্জনা হয় তা অনেকটা বিরক্তিকর বটে। আষাঢ় মাসে কোনো কোনো বাড়ির ঘর বড় জঘন্য হয়ে ওঠে।
গোয়ালঘর বাড়ি হতে দূরে হওয়া ভালো। ভদ্রগৃহে একটি বা দুইটি গাভীর বেশি থাকা উচিত নয়। এতে বাড়ির পার্শ্বে বড় নোংরা হয়ে ওঠে। দেশে ভালো দুধ-ঘি তৈরি করবার জন্য ব্যবস্থা থাকলে গৃহস্থকে আর কষ্ট করতে হয় না। গ্রাম হতে দূর মাঠের মাঝে মাঝে কেউ যদি দুধ-ঘি সরবরাহের ব্যবসা খোলে তা হলে সে ব্যবসায় বেশ লাভজনক হতে পারে। এই কাজে দেশের লোক যেন বড় উদাসীন। শিক্ষিত নর-নারী যদি এদিকে মনোযোগ দেন তবে লোকের বড় মঙ্গল হয়। দুধ-ঘিতেই মানুষের জীবন।
হালিমা : দরিদ্র মেয়েরা যদি দুধ হতে ঘি তৈরি করে বিক্রি করেন, তাহলে ক্ষতি আছে কি?
কুলসুম : ক্ষতি নেই। একটা রাখাল রেখে মেয়েরা বাড়িতেও এ ব্যবসা করতে পারেন। দূরে গোয়ালঘরে রাখালের তত্ত্বাবধানে গাভীগুলি থাকবে; প্রয়োজনমতো গাভী বাড়িতে সে নিয়ে এ মূলধন নিয়ে একবার পরীক্ষা করে দেখলে মন্দ হয় না। রাখাল চাকরকে কঠিন কথা বলবে না, তা হলে ব্যবসা মাটি হবে।
হালিমা : কি প্রতিক্রিয়ায় ঘি তৈরি করা সুবিধা?
কুলসুম : জমানো দুধ হতে ঘি তৈরি করাই বড় সুবিধা।
হালিমা : কোনো কোনো গৃহিণী গাভীর বাচ্চার উপর বড় অত্যাচার করেন।
কুলসুম : সে আর বলো না বোন। সারাদিন সারারাত্রি বাচ্চা বেঁধে রাখা বড় অন্যায়। দিনে দুবার দুধ বের করা নিষ্ঠুরতা। সন্ধ্যায় বাচ্চা ধরে রাখতে হয়। প্রাতঃকালে নামাজ সেরেই দুধ টানা নিয়ম। দিনের মধ্যে মাত্র একবার দুধ নেবে, আর নয়।
হালিমা : বধূরা কি দুধ টানতে জানে?
কুলসুম : গাভীর তত্ত্বাবধান ও যত্ন বধূদের হাতেই থাকা ভালো। দুধ টানা বন্ধুদেরই কাজ। দুগ্ধ, ঘি, অমৃতসুষমা, মাধুরীশক্তি–এসব জিনিসের মালিক বধূ।
কুলসুম বলিলেন–সন্ধ্যাকালে বাতি পরিষ্কার করা ও বাতিতে তেল ভরা নিয়ে একটা সোরগোল পড়ে যায়। প্রত্যহ স্নানের পূর্বে বাতি ঠিক করে রাখলে সন্ধ্যাকালে হৈ-চৈ হয় না।
হালিমা : পরিবারের সদস্যগণের শোবার ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত?
কুলসুম : স্বামী-স্ত্রী, ঘরের মধ্যে আর কারো থাকা অন্যায়। প্রত্যেক দম্পতির স্বতন্ত্র ঘর থাকা একান্ত কর্তব্য। এক কামরায় কথা বললে অন্য কামরা হতে শোনা যায় এরূপ স্থানে থাকাও অবৈধ। স্বামী-স্ত্রীর জন্যে একই ঘরে স্বতন্ত্র কিন্তু পাশাপাশি বিছানা হওয়া উচিত। ছেলেমেয়ে সেয়ানা হলে তাদের আলাদা প্রকাষ্ঠে শুতে দেবে। তাতে ছেলেমেয়েকে অবজ্ঞা করা হলো, এ মনে করা ভুল।
কুলসুম আবার কহিলেন–তি পরিষ্কার করে বা মাছ ধুয়ে ছাই বা সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হয়, নইলে হাতে কাপড়ে গন্ধ থাকে। হাতে, পায়ে বা কাপড়ে ময়লা জড়ালে তা ভালো করে ধুয়ে ফেলা উচিত। একটা ছোট পাত্রে সাবান রাখা নিয়ম, নইলে অসুবিধা হয়।
হালিমা জিজ্ঞাসা করিলেন–বাড়িতে ফুলের গাছ থাকা কেমন?
কুলসুম : একান্ত দরকার। লতা-পাতা ও ছোট ছোট ফুলের গাছ দেখলে মনের রূঢ়তা নষ্ট হয়। সঙ্কীর্ণ মন উদার হয়ে ওঠে। বাড়ির পার্শ্বে ছোট বাগান ছাড়া বারান্দায়; দরজার ধারে এবং উঠানে টবে করে দুই একটা গাছ রেখে দেওয়া খুব ভালো।
গ্রীষ্মকালে ছারপোকার জ্বালায় অনেক সময় অস্থির হয়ে উঠতে হয়। দারুণ–গ্রীষ্ম তার উপর মশা আর ছারপোকার অত্যাচার প্রাণকে অতিষ্ঠ করে তোলে। খাট-পালঙ্কের মাপে একটা কাগজের চাঁদর প্রস্তুত করবে। দুই পরদা বা তিন পরদা কাগজ আটা দিয়ে এঁটে একটা বিছানায় চাঁদরের মতো বড় আবরণ করবে। তার পর খাটের উপর সেইটা পেতে তার উপর তোষক বিছাবে। কাগজের চাঁদরের ধারগুলি আধ হাত বা তারও খানিক বেশি প্রত্যেক দিকে ঝুলে পড়া চাই এতে ছারপোকার উপদ্রব কমে। বিছানাপত্র রৌদ্র দেওয়া উচিত-খাট পালঙ্কও রৌদ্র দেওয়া কিংবা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা উচিত।
কোনো কোনো পরিবার ঘরে আদৌ জানালা রাখেন না। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এরূপ ঘরের সংখ্যা অনেক। ঘরে প্রচুর জানালা থাকা উচিত। যে ঘর অন্ধকার, জানালাহীন সে ঘরে বাস করবে না। পাছে লোকে ঘুমঘোরে সরমের অবস্থা দেখে এই ভয়ে অনেকে সামান্য ছিদ্রটুকু পর্যন্ত কাগজ দিয়ে বন্ধ করে রাখেন। ঘরে প্রচুর জানালা থাকা চাই। ইজ্জত বাঁচানোর অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। ঊষাকালে একটু হুঁশিয়ার হয়ে শুলে ভয়ের কোনো কারণ নেই। ভদ্র পরিবারে বাড়ির সকলেই সাবধান ও হিসেবী হয়ে থাকেন। বাড়ির ঘরগুলি এমন ভাবে বিন্যস্ত হওয়া উচিত যাতে কাউকে সরমের মধ্যে না পড়তে হয়।
ছেলেদের প্রত্যেকের জন্য স্বতন্ত্র কাপড় রাখার স্থান করে দেওয়া মন্দ নয়। তাদের জিনিসপত্রের খোঁজে অনেক সময় হয়রান হয়ে যেতে হয়। প্রত্যেক জিনিসপত্রের হিসেব নিজেই রাখবে। একজনকে একটা বাক্স দেওয়া মন্দ নয়। ছেলেদের জন্য স্বতন্ত্র দস্তরখানা থাকাও ভালো। এ সম্বন্ধে বিশেষ সতর্ক হওয়া উচিত।
পরিবারের কেউ যদি ভাত খেতে বসেন, সর্বপ্রথম তার সামনে পানি দেবে, তারপর ভাত দিবে। ছেলেরা অনেক সময় ঘরের মধ্যেই হাত ধোয়–এরূপ করতে তাদের নিষেধ করবে।
কাউকে পান দিলে, সঙ্গে সঙ্গে পানের টুকরায় খানিক চুন পাঠিয়ে দেবে। অতিথি বা স্বামীকে চুনের জন্য যেন দ্বিতীয় বার না বলতে হয়।
সুপারীগুলি বাক্সে বন্ধ করে রেখে দিও নইলে নষ্ট হয়।
বাড়িতে কোনো ভালো জিনিস তৈরি হতে থাকলে, ছেলেদের তা বলতে নেই; প্রস্তুত, হলে তাদের সামনে দেবে। ভালো জিনিস খাব বলে যদি তারা আনন্দ করতে থাকে, তাহলেও বাধা দেওয়া ঠিক নয়।
প্রতিবেশীকে সব সময়ই বাড়ির ভালো জিনিসের অংশ দেবে। তোমার উপহার অল্প হলেও প্রতিবেশী তাতে সন্তুষ্ট হবে।
বেশি করে কোনো জিনিস কোনো অতিথিকে দিতে নেই–তাতে তোমার রান্না করা জিনিসের উপর অতিথির অবজ্ঞা হবে। মানুষের স্বভাবই বোধ হয়–এই সুতরাং অতিথির উপর বিরক্ত হতে নেই।
অসময়ে স্বামীর কোনো বন্ধু বা অতিথি-কুটুম্ব বাড়িতে এলে কোনো কোনো বন্ধু বিরক্ত হন–এটা ভালো কথা নয়। স্বামীর বন্ধুকে ছেলে দিয়ে বা স্বামী দিয়ে নিজের সাদর অভ্যর্থনা জানাবে। স্বামীর বন্ধুর সাধুতার দ্বারাই শ্রেষ্ঠতর হওয়া যায়। এইসব কথা ভুলে বাঙালি জাতি নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। বোয়া কাপড় ও জুতা পরলে, কিংবা কুঁচিয়ে কাপড় পরলে কোনো কোনো শ্বশুর মনে মনে বিরক্ত হন। এদের সম্মুখে আতর মাখা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাও দোষের বলে মনে হয়। এই সমস্ত লোকের মধ্যে যে সব মাতা পিতা মেয়েকে ফেলে দেন, তারা বড় হৃদয়হীন। কোনো কোনো পরিবার বধূর ভাত খাওয়ার মধ্যে পর্যন্ত দোষ খোঁজেন।
বধূর সুখের প্রতি অনেক শাশুড়ী ঈর্ষা পোষণ করেন। তারা সন্দেহ করেন, পুত্র মায়ের কথা ভুলে বধূতেই আত্মসমর্পণ করেছে। তাই বধূর গৌরব, সাজসজ্জা, ও রূপ দেখে শাশুড়ী বিরক্ত হন। পুত্রবধূ যে তাদের কন্যাসদৃশ, একথা তারা ভাবতে পারে না। অনুন্নত পরিবারে পরস্পরের মনোমালিন্য ও ভুল ধারণার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। বধূ এবং পুত্র যদি গৃহের মুরুব্বীদের সম্মান ও সুখের প্রতি কিছু চিন্তা ও দৃষ্টিশূন্য অমার্জিত পরিবারে বাস করা বিড়ম্বনা।
কোনো কোনো হীন পরিবারে স্ত্রীলোকদের পায়খানা-প্রস্রাব করার সুবন্দোবস্ত নেই।
হালিমা বিস্ময়ে কহিলেন–ছিঃ ছিঃ লজ্জা, ঘৃণার কথা!
কুলসুম : নিশ্চয়! স্ত্রীলোকদের পায়খানা-প্রস্রাব করবার বিশেষ বন্দোবস্ত থাকা। আবশ্যক। যেন কোনো প্রকার অশ্লীলতা প্রকাশ না হয়, সেদিকে প্রত্যেক ভদ্রলোকের নজর থাকা চাই।
.
উনবিংশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম বলিলেন–প্রিয় হালিমা, মানুষের সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করতে হবে এ জানতে হলে পূর্ব হতে প্রভৃতি জ্ঞান লাভ করা চাই। কার সঙ্গে কেমন ব্যবহার আবশ্যক, এ জানা খুব শক্ত কথা।
লোকের সঙ্গে ব্যবহারে মনের বল যেন কোনো সময় নষ্ট না হয়। স্ত্রীরা যখন চাকরি করতে যায় না, তখন তাদের মনের বল বাড়াবার বিশেষ আশঙ্কা নেই। অলঙ্কারপরা ধনী গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অনেক মনে দুর্বলতা অনুভব করেন, অতএব সেরূপ লোকের স্পর্শে না যাওয়াই ভালো। মনের দুর্বলতা বোধ না করলে যাওয়ায় দোষ নেই।
কুলসুম আবার বলিলেন–হালিমা, জিহ্বাই সকল অনিষ্টের মূল। জ্ঞানী ব্যক্তিরা অল্প কথা বলেন। যে বেশি কথা বলে না তার অপরাধও অল্প। বিচক্ষণ ব্যক্তির মতো কথা বলতে না পারলে চুপ থাকাই শ্রেয়। অবশ্য একেবারে কথা বন্ধ করা অনুচিত। স্বামী ও পাড়াপ্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলা ও আলাপ রহস্য করাও নিতান্ত প্রয়োজন।
স্ত্রীলোকে স্ত্রীলোকে দেখা হলে সাধারণত এক দফা পদচুম্বন হয়ে থাকে। একটা সঙ্গত নয়। কোলাকুলি করা, দুই হাত দিয়ে না হোক অন্তত এক হাতে মোসাফা বা সালাম আলেকুম করাই বাঞ্ছনীয়। পায়ের উপর উপুড় হয়ে পড়ে–এসব হিন্দুয়ানী চলন। এরূপ কখনও করবে না।
হালিমা জিজ্ঞাসা করিলেন, মুরুব্বীদের সঙ্গে কি মোসাফা করা বেয়াদবী নয়?
কুলসুম বলিলেন–আমাদের মুরুব্বীরা সাধারণত ছোটদের ব্যক্তিত্বকে চূর্ণ করেই সুখী হন। ছোট যে, সে পশু, তার জন্য জ্ঞান নাই, মুরুব্বীদের মুখের দিকে চেয়ে কথা বললে পাপ হয়, এ সমস্ত কথা মুরুব্বীদের সব সময় বলা উচিত নয়। মাতাপিতা এবং মুরুব্বীরা যদি পুত্র কন্যাদের সঙ্গে করমর্দন করেন বা তাদের হৃদয়ে ধারণ করেন তা হলে তাদের কোনো সম্মান নষ্ট হয় না। কেহ যদি পায়ের উপর উপুড় হয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসে, তবে কদাপি সুখী হবে না–ক্ষিপ্র হস্তে তাকে বাধা দেবে। সে আত্মীয় বেগানা যেই হোক না। মধুর নম্র ভাষায় তাকে এমন কাজ করতে নিষেধ করবে।
কারো সঙ্গে দেখা হলে কোনো না কোনো প্রীতির চিহ্ন দেখাই চাই। নিতান্ত বন্ধু যে, তার সঙ্গে ভদ্রতা না দেখালে ক্ষতি নেই।
হালিমা কহিলেন-বধূ স্বামীর পদচুম্বন করবার জন্য সাধারণত আদিষ্ট হয়ে থাকেন।
কুলসুম : এরূপ শ্রদ্ধার কোনো দরকার নেই। স্বামী যদি বন্ধু রূপে পান তাহলে তিনি বেশি সুখি হবেন। ভক্তির দ্বারা মানুষকে জয় করা যা না, মূল্য ও গুণই মানুষ জয় করবার শ্রেষ্ঠ অস্ত্র।
হালিমা স্বামী দাঁড়িয়ে আছেন, স্ত্রীর কি তখন বসে থাকা বা আসন অধিকার করে থাকা উচিত?
কুলসুম : স্বামী তো আর কোনো রাজকর্মচারী নন্ যে তাকে ভয় করে চলতে হবে। স্বামীর যদি বসবার দরকার হয় তাহলে তিনি স্ত্রীকে সরে যেতে বলবেন। স্বামীর বসার দরকার থাকলে, স্ত্রী নিজেই আসন ছেড়ে দূরে যাবেন।
কুলসুম আবার কহিলেন-বাড়ির দাস-দাসী বা ছোটদের সঙ্গে নিরন্তর ঝগড়া-ঝাটি করা ভালো নয়। প্রত্যেক কাজেই যে মানুষ সর্বাঙ্গ সুন্দর হবে এমন আশাও করতে নেই। কারো চরিত্রে কোনো দুর্বলতা আছে; তাই নিয়ে হৈ-চৈ করা নির্বুদ্ধিতা। সে হয়তো অন্য কোনো কাজে বিশেষ গুণের পরিচয় দেবে।
হালিমা : কোনো কোনো বধূর ভয়ানক ক্রোধ থাকে। তারা যখন বড় গৃহিণী হন তখন তাদের জ্বালায় বাড়িময় অশান্তি হয়।
কুলসুম : মুরুব্বীদের সব সময়ে ছোটদের ভুল ও দুর্বলতার প্রতি সহানুভূতি থাকা চাই–নইলে ফল খারাপ হয়। বধূরা অনেক সময় গাল ফুলিয়ে বসে থাকেন। স্বামী সেই চেহারার মধ্যে মাধুরী দেখলেও অন্য লোক সে চেহারাকে ঘৃণা করে। মানুষের ঘৃণা এবং অভিশাপকে ভয় করা উচিত।
কোনো কোনো বন্ধু শব্দের সহিত গলা ঝেড়ে থাকেন। এই অভ্যাসটি বর্জন করতে হবে। এতে লোক সন্দেহ করে, বধূ হয়তো দাম্ভিক প্রকৃতির।
হালিমা জিজ্ঞাসা করিলেন-শ্বশুর-শাশুড়ীকে সাধারণত কীরূপভাবে সম্মান করতে হবে? তাদের কেমনভাবে অভ্যর্থনা করতে হবে।
কুলসুম : পদচুম্বন যখন দেশের রেওয়াজ হয়ে পড়েছে, তখন বর্তমান যুগের বৃদ্ধ শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হলে পদচুম্বন করবে। নিজে যদি কোনো কালে শাশুড়ী হও, তাহলে বধূকে হৃদয় ধারণ করো বা তার হাতখানি নিজের হাতে নিয়ে প্রীতির চিহ্নরূপে চাপ দিও, পদচুম্বন গ্রহণ করো না।
দুই ঈদের নামাজের সময় বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে স্নেহ, প্রীতি ও মমতার আদান-প্রদান হয়ে থাকে। এই সময় শ্বশুর-শাশুড়ীকে শ্রদ্ধা জানাবে। পদচুম্বন করা যদি একান্তই আবশ্যক হয় তাহলে বাপ-মা ও শ্বশুর শাশুড়ীকে করবে, অন্য কাউকে না। পীর-দাস-দাসী, নানা-নানী সকলকেই বাদ দেবে। তারা যদি জ্ঞানী হন, তাহলে এই অপমানে ক্ষুণ্ণ হবেন না।
হালিমা : স্বামীকেও কি মাঝে মাঝে সম্মান জানানো দরকার?
কুলসুম : কিছু না। স্ত্রী তো আর স্বামীকে কোনো দাসী নয়। স্বামীর সঙ্গে আলিঙ্গন করে মাঝে মাঝে প্রীতি-মমতার চিহ্ন দেখাতে পার। দুই ঈদ ছাড়া বৎসরের অন্য সময় ঊষাকালে হাসিমুখে স্বামীর সঙ্গে হাত মিলান ভালো। সুপ্রভাত বলা, সালাম আলেকুম করাও উত্তম।
গাল ফুলিয়ে থাকা, সর্বদা রাগে রাগে কথা বলা, দাম্ভিকজনেরই কাজ! অহঙ্কার ও দাম্ভিকতার পরিচয় দিলে, পেটের ছেলেপিলে জগতে উচ্চাসন লাভ করতে পারে না।
ছোট ও নিম্নশ্রেণীর লোক যদি তুমি করে বলে তাহলে রাগ করো না, তারা যদি এসে বাড়ির চেয়ার বা বিছানায় বসে তাহলেও ক্রুদ্ধ হয়ো না। তাদের সঙ্গে এক বিছানায় বসতে অনেকে লজ্জা বোধ করেন, এও অন্যায়।
বাড়ির দাসীকে বা দরিদ্র রমণীকে কঠিন ভাষায় গালি দিও না। খানকী ও নটি পেশাকার বলে গালি দেওয়া অনেক মেয়ের অভ্যাস। এরূপ কঠিন কথা মুখ দিয়ে বের করে মানুষের অভিশাপ মাথায় নিও না। অভিশাপ ভয় করা উচিত। সেয়ানা, ছোটকে কঠিন ভাষায় গাল দিও না। ইতর ও নিচ ভাষায় কোনো তাম্বি, কোনো ফল হয় না বরং যাদের উদ্দেশ্যে সেইসব ইতর ভাষা প্রয়োগ করা হয়, তাদের আরও নৈতিক অধঃপতন হয়। কখনও বংশগৌরব করো না। এতে আত্মার ও বংশের অধঃপতন হয়।
কোনো কোনো স্ত্রীলোক বাড়ির মধ্য হতে বা বুঝে সামান্য কারণে ভদ্রলোকদের অযথা জঘন্য ভাষায় গালি দিয়ে থাকেন। এটা খুবই অন্যায় কথা।
নৈতিক বলে ছোট যারা, তাদের সঙ্গে বাচালতার পরিচয় দিতে নেই; তারা তোমাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না; তোমার কথাকে তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনবে না। তবে নির্দোষ রসিকতায় কোনো দোষ নেই।
তোমার কথার মূল্য যদি কেউ না বুঝে তাহলে হঠাৎ অগ্নিশর্মা হয়ে যাওয়া ভালো নয়। মানুষের মূর্খতাকে সহানুভূতির চোখে দেখা মনে হয় ভাল। শান্ত, স্থিরচিত্তে মানুষের সঙ্গে কথা বলা উচিত।
কোনো কোনো মেয়ের অভ্যাস আছে পরের কথা নিয়ে খুব করে আলোচনা করা। পরনিন্দা করা, কথা লাগান মেয়েদের চরিত্রের বড় খারাপ দোষ। শশুর শাশুড়ী বা দেবরদের নিন্দা করে স্বামীর ভালবাসা লাভ করতে যেও না। অগোচরে অনেকে অনেক কথা বলে, সেইসব কথা কুড়িয়ে নিয়ে স্বামী ও শাশুড়ীর কাছে বলা দোষ।
কথা লাগালে নিজের সম্মান নষ্ট হয়, এ জানা উচিত। যার কাছে পরের কথা বলা যায় সে সেই সময়ের জন্য তোমার উপর কিছু সন্তুষ্ট হতে পারে, কিন্তু জেনো, তার কাছে তোমার আর সাবেক সম্মান রইল না। যার নিন্দা করা গেল সেও তোমার স্বভাব বুঝতে পারলে তোমাকে ঘৃণা করবে।
পরের নিন্দা করে কারো সঙ্গে ভাব করতে যাওয়া মূর্খতা।
যুবতী বয়সে স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে হেসে কথা বলতে নেই। কি দেবর, কি শ্বশুর, কি দেবরপুত্র, কারো সম্মুখে হাসবে না। দেবরের সঙ্গে রসিকতা করা একান্ত বর্জনীয়। দেবরকে ছোট ভাইয়ের মতো মনে করবে।
কেউ তোমাকে দেখে ভয় করুক, তোমাকে আগে আগে সালাম জানাক, তোমার পদচুম্বন করুক এরূপ আশা পোষণ করো না। যারা হীন প্রকৃতির লোক তারাই এরূপ আশা করে! সকলে তোমার বন্ধু হোক এইরূপ আশা করো না। সকলে তোমার গোলাম হবে, এরূপ ইচ্ছা করা পিশাচ ও যথেচ্ছাচারীদের কাজ। দুঃখের দিনে যারা তোমার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ছিল, সুখের দিনে তাদের অপরাধের কথা মনে করে তাদের সঙ্গে অসদ্ব্যবহার করা নীচতা। যাকে এক সময় ন্যায় মত হোক, অন্যায় মত হোক সম্মান করেছ বা পিতার আসন দিয়েছ, সম্পদের সময় মনুষ্যত্বের খাতিরে তার সঙ্গে তেমনি ব্যবহার করাই উচিত। অন্যায় ও অপমানের বেদনা সয়ে চুপ করে থাকা অধর্ম, কিন্তু যখন একবার থেকেছ তখনই চিরকালই চুপ করে থাকা বোধ হয় ভালো। এ সম্বন্ধে ঠিক করে কিছু বলা শক্ত। সুযোগ পেলেই সাধারণত মানুষ প্রতিশোধ নেয়, পীড়িতের শ্রদ্ধা ভালবাসা ও ভক্তি-কথা মিথ্যা হয়ে যায়।
অবস্থাপন্ন ঘরের স্ত্রীরা ছোট লোক, বান্দীর বাচ্চা, গোলামজাদী বলে লোককে গালি দেয়। মানুষের উপর এরূপ অবিচার করলে মুসলমান জাতি শেষ যুগে রাজত্ব ও স্বাধীনতা হারিয়েছে।
স্ত্রীরা অনেক সময় গয়না দেখাবার জন্য মেয়েমানুষের সঙ্গে আলাপ করতে যায়, এটা বড়ই নীচতা। যার গয়না নাই তার সামনে পরো না। গয়না না পরলে রমণীর শোভা অনেকটা কম পড়ে কিন্তু গুণ ব্যতীত গয়নার কোনো মূল্য নেই। যার গুণ আছে তার গয়নার দরকার নেই।
কোনো কোনো মেয়ে মনে করেন ভালো রান্না করতে পারা; কাপড়ে ফুল তুলতে জামাই রমণী জীবনের শ্রেষ্ঠ গুণ! নারী বলে শুধু রান্না শিখলেই বা দুখানা রুমাল তৈরি করতে পারলেই তার জীবন সার্থক হয়ে গেল–এটা মূর্খের ধারণা। গরু, হাতী এবং অশ্ব রান্না করা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কাজ করে থাকে, তাদের সম্মান তাহলে নারী অপেক্ষা বেশি। ভালো রান্না করতে জানা খুব ভালো, কিন্তু এই কারণেই নিজেকে বড় মনে করা দোষ। বিদ্যা, চরিত্র ও বুদ্ধি ছাড়া আর কোনো জিনিসকে গুণ বলা উচিত নয়।
শ্বশুরবাড়িতে কখনও বাপের বাড়ির গল্প করবে না। স্বামীর বাড়িতে নিজের ভাই বোনকে রাখবে না, এতে নিজের অকল্যাণ হয়, স্বামীর কাছে এবং শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় স্বজনের কাছে নিজের সম্মান নষ্ট হয়।
পুরুষেরা বলে থাকে স্ত্রীলোকে স্ত্রীলোকে কখনও প্রণয় হয় না। নিরন্তর ঝগড়া করা এবং পরস্পরের কুৎসা রটনা করাই তাদের স্বভাব–এ কথাটা প্রায় ক্ষেত্রে সত্য। এর একমাত্র কারণ, স্ত্রীলোকেরা সর্বদা ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকে মুক্ত বাতাসে না বেড়ালে, অনেক মানুষের সঙ্গে না মিশলে, চরিত্র উন্নত হয় না, মন সঙ্কীর্ণ, অনুদার ও অহঙ্কারী হয়ে ওঠে। নারীর অধঃপতনের প্রধান কারণ শিক্ষার অভাব-ভালো কথা এবং বহির্জগতের খবর সম্বন্ধে একদম অনভিজ্ঞ থাকা।
বাইরে বের হবার সুবিধা না থাক; স্ত্রীরা যেন তাদের চরিত্রের এই কলঙ্ক দূর করতে চেষ্টা করেন।
নিজের কানে শোনা এবং নিজের চোখে দেখা ব্যতীত কোনো গুজবে বিশ্বাস করবে। এই কথাটি স্বর্ণাক্ষরে প্রাণের পাতায় লিখে রেখো। অনুমান ও কল্পনার দ্বারা পরিবারের পনেরো আনা অনর্থ সৃষ্টি হয়। বালকের কথা যাচাই না করে সব সময় বিশ্বাস করতে নেই।
রমণীরা অনেক সময় অভিশাপ দেয়। অভিশাপ দেওয়া অন্যায়, এরূপ করা নীচ ব্যক্তির কাজ। ব্যথিত আর্তের মুখ দিয়ে যে অভিশাপ বের হয় তা স্বতন্ত্র। কথায় কথায় পাগলের মতো অভিশাপ দেওয়া নীচতা।
অনেক সময় বাইরের স্ত্রীলোকেরা সম্বন্ধ পাতিয়ে আসে। বালিকা বয়সেও অনেকে সই পাতায়। সম্বন্ধ পাতান কাজটা খারাপ। কেউ বলে, ‘তুমি আমার মা’, কেউ বলে তুমি আমার বুবু। এছাড়াও ধর্মের মা-বোন বা অন্য কোনো সম্বন্ধ পাতিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়। এসব ভালো নয়। বুবু বা মা ডাকতে দোষ নেই। ঘটা করে সম্বন্ধ করা দোষের। এর শেষ ফল মনোমালিন্য ছাড়া আর কিছু নয়। স্ত্রীলোকেরা সরলা কুলবধূদের সঙ্গে ‘মা’ বা ‘বোন’ পাতিয়ে অনেক সময় অনেক ক্ষতি করে। ইসলামের সবাই ভাই-বোন, এর উপর আবার সম্বন্ধ পাতাবার ঘটা কেন?
প্রতি বৈকাল বা সন্ধ্যাকালে পরিবারের সবাইকে ডেকে এক জায়গায় খানিক বসা মন্দ নয়। মেলামেশা, আলাপ ও হাস্য-পরিহাসে পরিবারের সকলের মধ্যে মনোমালিন্য দূর হয়। শুধু শুধু সকলকে এক জায়গায় ডেবে বসান একুট বিরক্তিকর। কিছু নাস্তার বন্দোবস্ত করা উচিত। দু’চামচ দুধ আর কিছু চিনি আর আর মুড়িতে বিশেষ খরচ হয় না। গুড় হতে নিজেরাই চিনি তৈরি করে নেয়া যায়। পরিবারের বারে বারে ভাত খাবার ব্যবস্থা না করে একবার নাস্তা আর দুবার ভাত খাবার ব্যবস্থা থাকা উচিত। চা ব্যবহার করাও মন্দ নয়।
বেলা ১টা হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করা যেতে পারে। কোনো কোনো অত্যাচারী পরিবার আছে, যেখানে দিবারাত্রি কাজ করতে হয়। অর্থের লোভে স্বাস্থ্যের প্রতি উদাসীন হওয়া ঠিক নয়।
কুলসুম পুনরায় বলিলেন–পরিবারের কারো কোনো ভুলের সমালোচনা পুনঃ পুনঃ করবে না। এতে উদ্দেশ্য পণ্ড হয়।
পরিচিত সকলের কাছে চিঠিপত্র লেখা চাই। এজন্য ঘরে কতক ভালো চিঠির কাগজ রাখা উচিত। মানুষের সঙ্গে আদান-প্রদান হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। ভাত, মাছ ও কাপড়ের জন্য যেমন পয়সা ব্যয় হয়, তেমিন পোষ্ট কার্ড অর্থাৎ চিঠিপত্র লেখার জন্যে কিছু পয়সা রেখে দিও। সামান্য ক’টি পয়সার মাথায় কি একটা বন্ধু হারান উচিত? সর্বদা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে চিঠিপত্র বিনিময় হওয়া আবশ্যক। মানুষের সংবাদ নেওয়া সভ্যতার লক্ষণ। মাসে এক ব্যক্তির কাছে একখানা পত্র লেখাই যথেষ্ট। পরপর দুই পত্র কারো কাছে লিখবে না। পত্রের উত্তর না পেলে পুনরায় পত্র লিখতে নেই। পত্রে-আদাব হাজার হাজার, বাদ কদম বুছি, পাক কদমে আরজ, এই যে ফিদবী, খাকছার, এসব না লেখাই ভালো। মোটের উপর লেখা জীবনের চমৎকার গুণ।
বিদার নেওয়ার সময় মেয়েরা সাধারণত কাদাকাদি করেন, এরূপ করা ছেলেমি। কোনো জায়গায় যাবার দরকার হয়েছে চলে যাও। কাদাকাদির বা বিদায় নেবার দরকার নেই।
অনেক দিন পরে অনেক দিনের জন্য কোথাও যেতে হলে যাবার সময় প্রীতি-উৎফুল্ল চিত্তে হাতের সঙ্গে হাত বা হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয় মিলাবে। বিদায়কালে চোখের পানি ফেলবে না।
স্বামীর যদি পড়াশুনা থাকে, তাহলে তার কাজের সময় কখনও তার কাছে যাবে না। অন্য সময় যাবে। দিনের বেলায় স্বামীর খুব কাছে বসবে না। পুরাতন হলে, এ নিয়ম মানবার দরকার নেই। দূরে থাকবার কারণ স্বামীকে বুঝিয়ে বলবে, নইলে স্বামী মনে মনে কোনো কিছু ভাবতে পারেন। কখনো কোনো কাজে চুপ করে থাকতে নেই; চুপ করে। থাকাতে জীবনে অনেক বিপদ ঘটে। স্বামীর কাছে নিজের কাজের ব্যাখ্যা দিলে, তার মনে কোনো গোল আসে না।
কেউ যদি হঠাৎ কোনো অন্যায় কথা বলে ফেলে, তাহলে রেখো না। হতে পারে যে, কথাটা সে হঠাৎ ভুল করে বলে ফেলেছে। কোনো কাজে বা কথায় হঠাৎ লাগলে নিজের সম্মান নষ্ট হয়, এ যেন মনে থাকে।
বাড়িতে এক ডাকে চাকরে যদি উত্তর না দেয়, তাহলে তাকে যাচ্ছে তাই গালি দিও। চাকরকে বেত দিয়ে পিটান এবং শুয়রের বাচ্চা বলা বিদেশীদের ফ্যাসন। এ যেন মনে। থাকে যে যারা চাকর তারা আমাদেরই দেশের মানুষ। সদ্ব্যবহার ও যুক্তিতে মানুষ উন্নত হয়, ভয় দেখিয়ে মানুষকে শুধু দুর্মতি দাসে পরিণত করা হয়। দাস অর্থ চাকর নয়, নীচ ও হীন, সে সুযোগ ও ক্ষমতা পেলে মানুষকে জবেহ করে। ইংরেজিতে দাসকে টাইরেন্ট বলে।
মানুষের সহিত সদ্ব্যবহার করাই ভালো। এমন কি বাড়ির কুকুর বিড়ালের সঙ্গেও নিষ্ঠুর ব্যবহার করা অনুচিত।
স্বামীকে যদি নিজের পিতা মাতা অপমান করেন, খবরদার মাতাপিতার হয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো কথা বলো না–কি সামনে কি অগোচরে। এটা স্ত্রীলোকদের জন্য শ্রেষ্ঠ উপদেশ। স্বামীর জন্য মাতাপিতার সঙ্গে যদি সম্বন্ধ ত্যাগ করতে হয়, তাও করবে।
হালিমা : জিজ্ঞাসা করিল-নারীর জীবন বড় নিঃসহায়। বাপ-মাকেই বা কি করে। অসন্তুষ্ট করবে? সে বিধবা হলে বাপ-মার বাড়িতে তো তাকে ফিরে আসতে হবে।
কুলসুম বলিলেন-বাস্তবিক, জীবনে নারীকে সব সময়েই হীন ও ছোট হয়ে থাকতে হয়। মুখ ফুটে প্রাণের কথা বলা তার পক্ষে অসম্ভব। সে নিজে নিঃসহায়, তার নৈতিক শক্তি ঠিক রাখা খুব কঠিন। জোর করে কথা বাও তার সাজে না। স্বামী যদি বুদ্ধিমান হন তবে স্ত্রীর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে নিজের মৃত্যু হলে স্ত্রীকে যাতে পথে না দাঁড়াতে হয়, তার ব্যবস্থা করে যেতে হবে। বালিকাঁদের বাল্যকাল হতেই লেখাপড়া শিখাতে হবে–তাদের কোনো হাতের বা শিল্প-বিষয়ক কাজ শিখান চাই–যাতে সে বিপদে পড়ে নিজেকে একেবারে অনাথ মনে না করে। নারীর চিত্তে শক্তি ও স্বাধীনতা দিতে হবে। এই দুই জিনিস যেখানে নাই, সেখানে মনুষ্যত্ব থাকে না। নারীর এই দুই জিনিসে আদৌ নাই, সুতরাং তার মনুষ্যত্ব নাই। সে পিতা, স্বামী ও পুত্রের খরিদা দাসী। পুরুষ ভাবে নারী জীবন মোনাফেকিতে পূর্ণ। নারীর প্রেম মুখস্থ করা। আহা, নারীর কি দুঃখের জীবন, তা কে। ভাবে? এ ব্যাপারে সমাজদরদীরা চুপ করে আছে। পীরেরা আধারে বসে তছবী টিপছে।
নারীর দুরবস্থার জন্য তার বাপ-মাই দায়ী। নারী জীবনে কখনও তারা ঘৃণা ও অসন্তোষ প্রকাশ করতে সাহস পায় না; যা না করতে পারলে মানুষ পশু হয়। মেয়েকে বড় করতে হলে মেয়ের মাকে পূর্ব হতে সতর্ক হতে হবে। নারীর বেদনা নারী ছাড়া আর কেউ বোঝে না।
দেশে ছেলে ও মেয়ের বিয়ের সময় পাড়ার বউ ঝি নেবার প্রথা আছে। বর্তমান সময় কোনো বিয়ে বাড়িতে না যাওয়াই ভালো; বিয়ে বাড়িতে অনেকে অনেক সময় অনেক রকমে অসম্মানিত হয়। যদি অসম্মানের ভয় না থাকে, থাকবার এবং শোবার রীতিমতো ব্যবস্থা থাকে, তাহলে যাওয়া যেতে পারে। অনেক লোকের সঙ্গে মেলামেশা করলে জ্ঞান বাড়ে।
যেখানে সম্মান হয় না, সেখানে কখনও যাবে না। নিজের মর্যাদা অনুযায়ী বসবার স্থান না পেলে সেখানে বসবে না। গরিবের বাড়ি নিরহঙ্কার চিত্তে ঘেঁড়া মাদুরে বসবে। জেনো, অহঙ্কারী লোককে ছোট করে দেন।
মাঝে মাঝে বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীকে দাওয়াত করে খাওয়ান একান্ত কর্তব্য। স্বামী পুরুষ লোককে, স্ত্রী-নারী সমাজকে দাওয়াত করবেন। নারী পুরুষকে একই সময়ে বাড়িতে আনতে হবে, এমন কোনো কথা নয়। হাজার হাজার লোককে খাইয়ে, হাজার হাজার টাকা ব্যয় করলে বিশেষ লাভ নাই। বাঙালীর অনেক টাকা এইভাবে মাটি হচ্ছে। ফলে সমাজ দরিদ্র হয়ে পড়ছে। কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীকে প্রীতিভোজ দেওয়ায় বৃথা পয়সা নষ্ট হয় না। অতিথিকে পরিতোষপূর্বক আহার করাতে পারবে না বলে, একদম কাউকে না খাওয়ান ঠিক নয়।
যার খাওয়ার সঙ্গতি নেই তার কাছ থেকে জোর করে খাওয়া আদায় করতে নেই–আর যে কৃপণ, জোর করে তার বাড়িতে খেয়ে লাভ কি? অবস্থা খারাপ হলে প্রীতিভোজ দিয়ে পরিবারের দুঃখ বাড়ান ভালো নয়।
প্রতিবেশীর বাড়িতে মাঝে মাঝে তোমার বাড়ির ভালো জিনিস পাঠিয়ে দেবে। অল্প হলে ক্ষতি কি?
অত্যাচারী, সুদখোর, জালেমের বাড়িতে পুরুষের খেতে নেই। নারীর অন্য কোনো নারীর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করাতে দোষ নেই-কারণ নারীর বহির্জগতের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ নেই। আধুনিকাঁদের কথা স্বতন্ত্র।
বধূকে সকল কাজে নিজের বুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে। জীবনকে চালানোর জন্যে কতগুলো বাধাধরা নিয়ম দেওয়া অসম্ভব।
কোনো কথার প্রতিবাদ করলে কোনো কোনো মানুষ চটে। তবুও ভুল দেখলে মানুষের প্রতিবাদ করা উচিত। স্বামীর কোনো কথার প্রতিবাদ তখন করবে না। স্বামীর ভাবকে মেনে নেওয়া স্ত্রী জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্যে। স্বামীর মধ্যে কোনো ভুল পেলে মিষ্টি কথায় যখন তখন না হোক, অন্য সময় বলবে।
অনেক সময় লোকে খামাখা কতগুলি কথা বলে, তার প্রতিবাদ না করলেও বিশেষ আসে যায় না।
স্বামীর ভাব ও চিন্তার প্রতি সর্বদা সহানুভূতি রাখতে চেষ্টা করা কর্তব্য। তর্ক করার খাতিরে বা খারাপ উদ্দেশ্যে স্বামীর সঙ্গে তর্ক করবে না; এরূপ করলে দাম্পত্য জীবনের সুখ নষ্ট হয়। স্ত্রীর কার্য সম্ভবত অন্ধ বন্ধু হওয়া–গুরু হওয়া নয়।
নারীরা ঘরের কোণায় বসে অনেক সময় বড় বড় লোককে পর্যন্ত গালি দিয়ে বসেন; শিক্ষিত ভদ্র নারীদের কর্তব্য নয় পণ্ডিত ও সজ্জন ব্যক্তির প্রতি অশ্রদ্ধা দেখান।
স্বামী ও কয়েকজন নিকট মুরুব্বী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ দেখে কখনও আসন ছেড়ে সম্ভব জানাতে উঠবে না। নারী সর্বদা সকল পুরুষের সম্ভ্রমের পাত্রী, সে আবার কাকে সম্ভব জানাবে?
অনেক সময় সৎ অনুষ্ঠানের জন্য সেবক সম্প্রদায়রা মুষ্টি চালের জন্যে হাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তাদের হাঁড়িতে ভাত রান্নার আগে এক-আধ মুঠা চাল রাখতে ভুলবে না। এতে গৃহিণীদের বিশেষ লোকসান হয় না। চালগুলি কোনো সৎ অনুষ্ঠানে না দিলেও এক মাস পরে তাতে সংসারের অনেক উপকার হয়।
অন্ধকার রাত্রে বাইরে থেকে বা হাট-বাজার থেকে যদি বাড়ির কেউ আসে, তবে তাড়াতাড়ি একটা প্রদীপ নিয়ে পথে এসে দাঁড়াতে হয়। এতে আগন্তুকের অভ্যর্থনা করা, তার পরিশ্রান্ত মনে আনন্দ দেওয়া, সব কাজই হয়।
স্বামী যদি বাইরে থেকে পরিশ্রমের কাজ করে আসেন, তবে তাকে দুটি তৃপ্তিদায়ক কথা বলতে ভুলবে না। স্বামীর কোনো ভালো কাজে খুব আনন্দ প্রকাশ করবে।
আমাদের দেশে কোনো কোনো পরিবারের স্ত্রী স্বামীর কর্মের কোনো খবর রাখতে ভালোবাসেন না, এসব নারীর জীবন বড় ছোট।
কোনো কোনো নারীর বাল্যকাল হতে কতগুলি বদভ্যাস থাকে। সেগুলি দেখে স্বামী যদি কোনোরকম বিরক্তি প্রকাশ না করে, তাহলে সে কু-অভ্যাসগুলি পরিহার করতে সচেষ্ট। হবে জেনো, একই ভুল পুনঃপুনঃ হওয়া দোষের। মনের মতো বউ না হলে স্বামী মনে কড় কষ্ট অনুভব করেন। স্বামীকে সুখ দেওয়া নারী জীবনের প্রধান উদ্দেশ্যে। স্ত্রীর স্বভাবে বিরক্ত হয়ে অনেক স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং কখনও স্ত্রীকে একদম বর্জন করেন। স্ত্রী বর্জন করা অত্যন্ত হীন নরপিশাচের কাজ। ভদ্রলোক এরূপ কাজ করে না; দ্বিতীয় বার বিয়ে। করাও পুরুষের বোকামি।
স্বামী তো বন্ধু। বন্ধুর হৃদয়ে যত সুখ দেওয়া যায় ততই ভালো। তার বিরুক্তি উৎপাদন করলে গোনাহ হয়। বিবাহিত জীবনের কর্তব্য সর্বাংশে পালন করবেন বলেই স্ত্রী বিবাহ দিনে খোদাকে সাক্ষী করে স্বামী গ্রহণ করেন; কেমন?
কুলসুম পুনরায় বললেন-কোনো স্ত্রীলোক যদি তোমার খুব তোষামোদ আরম্ভ করে, তাহলে আহ্লাদে গদগদ হতে নেই। স্তাবককে বন্ধু মনে না করে, উচিতবাদীকে বন্ধু মনে করাই ভালো। মানুষ তোষামোদে নিজের শক্তি হারিয়ে ফেলে–অন্ধ হয়ে যায়। শঠ ও দুষ্ট লোক অনেক সময় তোষামোদ করে করে নিজের কাজ আদায় করে। তোষামোদ ও আহ্লাদে আটখানা হওয়া অনুন্নত স্বভাব। কোনো কোনো হৃদয়বান সরল মনে তোমার কোনো গুণের কথা উল্লেখ করে সন্তোষ প্রকাশ করতে পারেন, তার উপর অবশ্য লাগবে। না। বস্তুত তোষামোদ করা বা তোষামোদ গ্রহণ করা, উভয়ই দুর্বল হৃদয় ব্যক্তির কাজ।
রেল স্টীমারে ভ্রমণকালে অনেক পাজী মেয়ে অভদ্র ব্যবহার করে। এদের মুখের উপর চড়া কথা শুনিয়ে দেওয়াই বিধি। নিজের অন্যায় কথা সহ্য করা বোকামি ও কাপুরুষের কাজ। দুষ্ট ও অন্যায় কথা শুনে বিরক্তি প্রকাশ করা উচিত। রেল স্টীমারে ভ্রমণকালে রাস্তার যদি রুটি গোস্ত নিয়ে যেতে হয়, তাহলে প্রয়োজনমতো, বের করে খাবে, কে কী ভাববে একথা ভাববার কোনো দরকার নেই। সঙ্গে ভাত নিয়ে গেলে ছেলেপেলেকে খেতে দেবে; তাতেও কোনো সঙ্কোচবোধ করবার নেই। খোকারা যাতে কারো গায়ে ভাত ছুঁড়ে না মারে। সেদিকে লক্ষ্য রাখবে।
যাদের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ আছে, অত্যধিক ভক্তির সঙ্গে তাদের ডাকবার কোনো দরকার নেই। সম্বোধনের শেষে ‘জান’ শব্দ ব্যবহার করবে না। মামাজান, খালুজান, চাচাজান, এরূপ না বলে মামা, খালা, চাচা, বলাই ভালো। কাউকেই অতিরিক্ত ভক্তি দেখানো ভালো নয়। অত্যধিক ভক্তি দেখাতে গিয়ে অনেক সময় মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং অগোচরে আত্মীয়-স্বজন কুৎসা গ্লানি প্রচার করবার প্রবৃত্তি জাগে।
কারো সঙ্গে অতিরিক্ত ভদ্রতার আদান প্রদান করবে না, এতে জাতির জীবন ভুলময় হয়ে ওঠে। মনের অসন্তোষ মুরুব্বীর সামনে প্রকাশ করবার অভ্যাস থাকা চাই–অগোচরে কুৎসা রটনা করা দোষের। অত্যধিক ভক্তি দেখানোতে মন শক্তিহীন ও অবশ হয়ে যায়।
একশ’বার মুরুব্বী বা গুরুজনকে দেখে চেয়ার ছেড়ে ওঠা আর বসায় বৃথা সময় নষ্ট হয়। কোনো কাজের বাড়াবাড়ি ভালো নয়। অবশ্য মুরুব্বী সামনে এলে আসন ছেড়ে ওঠা ভাল। চকিত-ভীতি বিহ্বল ভাব দোষের।
আলাপ রহস্য করা জীবনের একটা আব্যশক কাজ। তবে যে সমস্ত মানুষ ভিতরে হীন, তাদের সঙ্গে সংযমের কথা বলবে, নইলে অপদস্ত হতে হবে।
বৈকাল বেলা পান খাচ্ছ এমন সময় কোনো মেয়ে বন্ধু এসে উপস্থিত হলেন। তার সঙ্গে খানিক গল্প করার যদি, যদি অন্য জায়গায় যাবার দরকার হয়, তবে চলে যাব। অনিচ্ছায় বন্ধুর সঙ্গে বসে থেকে তাকে অপদস্থ করবে না। কিংবা নিজের ক্ষতি করবে না। মিষ্ট কথায় তার কাছ থেকে বিদায় নিলেও চমৎকার হয়।
দাম্পত্য-জীবনে একটা গুরুতর বিপদ আছে। অনেক সময় স্বামী আপন মনে স্ত্রীর সম্বন্ধে অনেক কথা ভাবেন। স্বামীর মুখ ভার দেখলে, ডেকে তাকে কারণ জিজ্ঞাসা করবে। লজ্জায় সঙ্কোচে তুমিও আপন মনে মুখ ভার করে বেড়াবে না। স্বামীকে দুঃখিত করে কোনো কাজে মন দেওয়া উচিত নয়। নিজের যদি কোনো অপরাধ হয় তবে স্বামীর কাছে ত্রুটি স্বীকার করবে। স্বামীর পা ধরবার কোনো দরকার নেই। জোড় হাত করে দাঁড়াবার কোনো দরকার নেই। বলবে মাপ কর। এই মাপ কর কথাটি বড় মধুর! এ বললে নিজের সম্মান স্বামীর কাছে খুব বেড়ে যায়।
কোনো কথা পুনঃপুনঃ বলা নিষেধ। এতে কথার মূল্য নষ্ট হয় এবং নিজের হালকামির পরিচয় দেওয়া হয়।
নিতান্ত বন্ধুদের সঙ্গে ভদ্রতার আদান-প্রদানের কোনো দরকার নেই। তাদের দেখে উঠে দাঁড়াবারও কোনো দরকার নেই।
দুর্বল, শক্তিহীন প্রতিবেশী যেন তোমার ব্যবহারে নিজেকে বেশি করে দুর্বল ও শক্তিহীন মনে না করে সেদিকে লক্ষ রাখবে।
কথা সর্বদা মিষ্টি ও মধুর হওয়া উচিত। সর্বদা যেন রেগে আছে, কথায় অসন্তোষ ও রাগ ভরা এরূপ যেন কেউ না ভাবে। খোদা অহঙ্কার সহ্য করেন না। অহঙ্কারী মানুষের হাত পা আপনা আপনি ভেঙে যায়।
কারো উপর অসন্তুষ্ট হলে তোমার অসন্তোষের কারণ তাকে জানাবে। এতে ভয় বা লজ্জা করবে না। কারো কাছে তার নিন্দা করা ভালো নয়। নিজেরা গরিমা অন্যের উপর জোর করে চেপে দেওয়ার নাম অহঙ্কার।
ন্যায্যমতো মনে মনে অহঙ্কার থাকা কিন্তু আবার নিতান্ত দরকার। নইলে মনুষ্যত্ব থাকে না। সে জগতে কোনো কাজ করতে পারে না। এই অহঙ্কার হবে বিনয় মধুর এবং অত্যন্ত শান্ত। এটা ঠিক অহঙ্কার নয়, এর নাম আত্মবিশ্বাস।
কখনও সচেতন পদার্থের উপর ক্রোধ প্রকাশ করতে নেই, অথচ মেয়ে মানুষের এ একটা স্বভাব।
হালিমা বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলেন–সে কেমন?
কুলসুম বলিলেন–প্রাণহীন বস্তুর উপর রাগ। বদনা, থালা, কাপড় বা খন্তা, কুড়োলের উপর রাগ করা অনেক মেয়ের স্বভাব। যদি দাসী বা নিজের অমনোযোগিতায় টেকিতে হাত কেটে যায়, তা হলে পেঁকিতে গালি দেওয়া ভালো কি? এরূপ করলে বুদ্ধির পরিচয় দেওয়া হয় না, নিজের দোষে কোনো খারাপ করে ফেলে অন্যের উপর রাগ করা নীচতা।
মেয়েমানুষ কারণে অকারণে অনেক সময় শাশুড়ী বা স্বামীর প্রশ্নের উত্তরে বলে থাকেন, আমি কি জানি? আমি কি করবো? সংসারের কেন্দ্র যখন ঘরের বধূ, তখন তার মুখে এরূপ উত্তর শোভা পায় না। কিছু না জানলেও প্রশ্নের উত্তর খুব মোলায়েম করে। দেওয়া ভালো। মনে রাগ থাকলে অনেক সময় এরূপ উত্তর আসে সত্য, কিন্তু স্বামীর যেরূপ স্ত্রীর অপরাধ মনে করে রাখা অবৈধ, স্ত্রীরও তেমনি স্বামীর অপরাধ মনে করে রাখা অবৈধ। অভদ্র ব্যবহার করাও নারী জীবনের একটি গুরুতর অপরাধ।
অনেক নারী স্বামীর শরীর খারাপ হলে তাকে মোটেই গ্রাহ্য করে না। ভদ্রমহিলা কখনোও এমন করে না, দুর্বল ও রুগ্ন হলে তাকে ঔষধ খেতে উপদেশ দেবে। কোনো আনাড়ী মানুষের ঔষধ স্বামী না খান, তাতে বিপরীত ফল ফলবে। স্বামীর শরীর যাতে ভালো থাকে, সে দিকে সর্বদা দৃষ্টি রাখা উচিত। দুগ্ধ ও ঘি শরীর রুক্ষার প্রধান উপকরণ। বিলাসিতার জন্যে পয়সা ব্যয় না করে যাতে স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো খাবারের জন্য পয়সা ব্যয় হয় সেদিকে নজর চাই।
আর একটি কথা–বিলাসের কথা বলতে গিয়ে একটা ভালো কথা মনে পড়ে গেল। বিদেশী বিলাস-দ্রব্য কিনে কিনে আমাদের দেশের লোক ক্রমশ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। দেশী জিনিস পেলে বিদেশী জিনিস ব্যবহার করবে না। নারীরা যদি প্রতিজ্ঞা করে বলেন, আমরা
বিদেশী দ্রব্য হারাম বলে ত্যাগ করলাম, তাহলে অল্প দিনে আমাদের দেশের লোকের। অবস্থা ভালো হয়। আমাদের ভাই, স্বামী ও পিতার অর্থে বিলাত ও জাপানের লোকেরা এত বাহাদুরী করছে, অথচ আমরা দিন দিন না খেয়ে না পরে ক্ষুধায়, শীতে, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে মরে যাচ্ছি। বলতে পার, আমরা নিজে তো না খেয়ে মরছি না? আমরা না। মরি আমাদের দেশের ভাই-বোন মরে যাচ্ছে। অন্ন-কাঙ্গাল দেশের ভাই-বোনকে ভিখারী। করে নিজেরা কোর্মা-পোলাও খেয়ে লাভ কী? রাস্তায় মোটর গাড়ি হাকিয়ে বাহাদুরী কি? দেশের শিল্প-বাণিজ্যের উন্নতির জন্যে নারীকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। সিল্কের শাড়ী পরে ক্ষুধিত পেটে না থেকে, মোটা কাপড়ে খালি পায়ে ঘি-মাংস খাওয়াই ভালো।
স্বামীর ভালবাসায় অনেক সময় নারীরা দাম্ভিক হয়ে পড়েন। বাড়ির বধূ সকলের ভালবাসার পাত্রী, সুতরাং সকলের সঙ্গে তার সদ্ব্যবহার থাকা চাই। আসলে অহঙ্কার খারাপ জিনিস। লোকে অহঙ্কারীর স্পর্শে আসতে ঘৃণা বোধ করে। সকলের সঙ্গে স্নেহ-মধুর ব্যবহার করা কর্তব্য।
মোটে কথা না বলা ভালো নয়। মাঝে মাঝে লোকের সঙ্গে আলাপ করা উচিত। আবার প্রয়োজনে বাচালতার পরিচয় দেওয়া ভালো নয়। অনেক মেয়ের গরম বলে গায়ে জামা দেবার অভ্যাস নাই.। স্বামী ছাড়া অন্য কারো সামনে খালি গা হয়ে না বেরোনো উচিত। অন্তঃপুর ছাড়া মেয়েদের সব সময় শরীরে জামা ব্লাউজ থাকা দরকার।
মাঝে মাঝে পাড়ার মেয়েদের ডেকে যদি ভালো কথার আলোচনা করা যায়, তাহলে তাদের বড়ই উপকার করা হয়। মেয়েমানুষ অমানুষতার গভীরে আঁধারে পড়ে আছে। মানুষ কি এত ছোট হতে পারে, তা ভেবে ঠিক পাই নে। অবরোধ এর এক গুরুতর কারণ হতে পারে।
রাত্রিতে ছোট ছোট মেয়েদের একটু একটু যদি পড়াতে পার, চেষ্টা করো। না বুঝে মাথা কুটে কোরান পড়তে পারলেই কাজ হল, এরূপ মনে করা ভুল। ইংরেজি না হোক। বাংলা সাহিত্যের বিলক্ষণ জ্ঞানলাভ করতে হবে, নইলে চরিত্র ও স্বভাবের কোনো উন্নতি হবে না। রুচি মার্জিত হওয়াও অসম্ভব। বর্তমান শিক্ষা ও সভ্যতার সঙ্গে যোগ না রাখলে মেয়েদের ভালো বিয়ে হওয়া সুকঠিন। বধূর শিক্ষা চরিত্র ও মানের উন্নতির উপর ভবিষ্যৎ বংশের উন্নতি নির্ভর করে। অশিক্ষিতা, অমার্জিতা হৃদয়, চরিত্র ও মানের উন্নতির উপর ভবিষ্যৎ বংশের উন্নতি নির্ভর করে। অশিক্ষিতা, অমার্জিতা হৃদয়, নীচ প্রকৃতির মেয়ের ছেলে কখনও বড় হয় না। অশিক্ষিত মাতৃদলের জন্য আমাদের পুরুষ সমাজের জীবন মিথ্যা ও ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। নারীর শক্তিতে জাতি অল্প সময় মহা জাতিতে পরিণত হয়।
বিশেষ গুরুতর কারণ না থাকলেও সর্বদা স্বামীর দোষ ধরতে চেষ্টা করো না। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাই অনুরাগের ভিত্তি। কলহ ও দোষ অনুসন্ধান করলে একে অন্যকে ঘৃণা করে।
সংসারে নিরানন্দের ছায়া আসতে দিতে নেই; দুঃখের মধ্যেও আশার কথা বলা উচিত। পরিবারে কেউ কোনো ভুল করছে–করুক না, কিছুই হয় নাই বলে দাঁড়াতে হবে, এতেই জয়ী হওয়া যায়। বসে বসে কাঁদাকাদি করে দরকার নেই। আশা, উৎসাহ ও আনন্দই উন্নতি ও জীবনের মূল।
.
বিংশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম বলিলেন–প্রিয় হালিমা, গৃহস্থালী সম্বন্ধে বলেছি আরও কিছু বলতে চাই। হালিমা কহিলেন-বলুন, আমি মন দিয়ে শুনছি।
কুলসুম বলিলেন–দোকান থেকে বাকি করে জিনিস আনলে সংসারে শ্রী থাকে না। মহাজনদের কাছে যেমন কৃষক সম্প্রদায় নিজেদের স্বাধীনতা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিক্রয় করে। ফেলে, যে সমস্ত ভদ্রলোক দোকান হতে বাকি নেওয়া আরম্ভ করে, তারাও প্রকারান্তরে দোকানদারদের খরিদ গোলাম হয়ে পড়েন।
স্বামীকে দোকানদারের গোলাম হতে একদম নিষেধ করবে। তাকে স্বাধীন উৎফুল্ল দেখাতেই নারীর ইচ্ছা হওয়া দরকার। ঋণদানে জড়িত চিন্তাক্লিষ্ট স্বামীর মলিন মুখ দেখে নারীর রাত্রে ঘুম না হওয়া উচিত। যেদিন থেকে সংসারে টাকা হাওলাত এবং দোকান হতে বাকি জিনিসপত্র আনা শুরু হয়েছে, সেই দিন হতে পরিবারে উন্নতির পথে একটা ভয়ানক বাধা এসেছে, এটা বিশ্বাস করো। না খেয়ে শুয়ে থাকো, বিনা তেলে তরকারি খেও, ছেঁড়া কাপড় পরো। তবু কাপড়ের বা মুদীর দোকান থেকে কোনো বাকি জিনিস এনে শরীরের শোভা বর্ধন করে বা রসনাকে তৃপ্ত করে দরকার নেই।
বাজে কাজের জন্য স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া না করে এই সব ভুল কাজের জন্য ঝগড়া করা ভালো। বাকি করে হাতি কেনা অনেক পুরুষ মানুষের অভ্যাস। সর্বদা বাকি জিনিস কিনতে নিষেধ করবে।
ঋণগ্রস্ত লোক বা ভয়-ভীতি বিপন্ন স্বামীর পত্নী হওয়া কি অসম্মানের বিষয় নয়?
সংসারে অপব্যয় একদম নিষেধ, আবার পয়সা একদিক দিয়ে বাঁচিয়ে অন্যদিকে বৃথা খরচ করাও মূর্খতা। অতিথি-কুটুম্বের জন্যে সর্বদা আলাদা করে কয়েকটি টাকা রেখে দিলে ভালো হয়। অনেক পরিবার অতিথি-কুটুম্ব দেখে ভীত হয়; এটা যারপর নাই লজ্জা ও ঘৃণার কথা। অতিথি-কুটুম্বের সমাদর করা জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্তব্য।
বেশি করে লেপ ও বিছানা তৈরি করে রেখে দিতে হয়। করছি করবো বলে অপেক্ষা করলে কোনোকালে হবে কিনা সন্দেহ। শীতের সময় মানুষকে লেপ-কাঁথা না দিতে পারলে, বড়ই দুঃখের বিষয়।
আজকাল কতকগুলি লোকের ধারণা হয়েছে, ইংরেজি ফ্যাসনে ঘরে ডিস ও পেয়ালা, রাখলেই ভদ্রলোক হওয়া যায়। এই সমস্ত জিনিসে মানুষ ভদ্র হয় না। মানুষ ভদ্র হয় জ্ঞানে, চরিত্রে ও মনুষ্যত্বে। মানুষের বাপ যেই থাক, সে বর্তমানে যে ব্যবসাই করুক–দেখবার দরকার নেই। দেখতে হবে তার আত্মা, তার রুচি, কথা ও ব্যবহার।
চীনে মাটির বাসন না কেনাই ভালো। একে এগুলি বিদেশী জিনিস, তার উপর ঠোকা লাগলেই ভাঙ্গে। এসব জিনিস না দেখে যে সমস্ত বোকা নারীর দল নাক ছিটকায়, তাদের কথায় ভ্রূক্ষেপ করবার দরকার নেই। শুনছি, আজকাল দেশী চীনে বাসনের কারখানা হয়েছে। দেশী চীনে বাসন ঘরে ২/১ খান রাখা হয়।
কাবুলীদের কাছ থেকে প্রাণ গেলেও ধারে জিনিস কিনতে নেই। দু’টাকার জিনিস এরা। পাঁচ টাকায় বিক্রি করে। অনেক সময় এদের হাতে ভদ্রলোকদের অপমান হয়। এদের সাহসকে কিন্তু খুব ধন্যবাদ দিতে হয়। কোনো দূর দেশ থেকে এসে এরা বাংলার মানুষের গলা চেপে ধরতে ভয় করেন না।
বাড়িতে ফুল কপি, বাঁধা কপি ও গোল আলুর চাষ করতে পারলে ভালো হয়। চাকর রেখে বাগান তৈরি করবার সখ অনেকের হয়ে থাকে, তাতে কিন্তু কোনো লাভ হয় না। নিজের হাতে সব কাজ করতে হবে। ছেলেপেলে এবং স্বামী যদি নিজের হাতে পানি টানে বা কোদাল কোপায়, তাহলে তাদের সমান নষ্ট হবে না। কাপুরুষ ভদ্রলোক যারা, তারাই। হাতে কাজ করতে লজ্জা বোধ করে; ঘুষ খেতে পাপ করতে তাদের লজ্জা হয় না! পবিত্র, পরিচ্ছন্ন, নির্ভীক ও জ্ঞানী আত্মার মূল্যই বেশি।
স্ত্রীলোকদের ঠাণ্ডা লাগান অভ্যাস। শীতে কাঁপবেন তবুও গায়ে কাপড় দেবেন না। পায়ে গায়ে ঠাণ্ডা লাগলে পীড়া হয়। দরিদ্র স্বামী এবং সংসারশুদ্ধ সকল লোককে ব্যস্ত করা বড়ই অন্যায়।
চাকু, কাঁচি ছুরি প্রায়ই হারিয়ে যায়। এগুলি সর্বদা সাবধানে রাখতে হয়। কাজ সেরে যখন তখন বাক্সে বন্ধ করে রাখবে। ছেলেদের হাতে চাকু দেবে না।
ঘরের কাপড়-চোপড় সব সময় গুছিয়ে ঠিকঠাক করে রাখবে। যার যার কাপড় আলাদা করে রাখাই ভালো। কাপড় গামছা খোঁজবার জন্যে যেন সময় নষ্ট না হয়।
দোয়াত-কলম বই-খাতা সব গুছিয়ে রাখবে। ঘরের জিনিসপত্রের ধুলো সব সময় ঝেড়ে ফেলতে হয়।
ছেলেপেলেরা যেন বই-পুস্তক ও কালি কলম নষ্ট করে না ফেলে, সেদিকে নজর রাখবে।
সুঁই ঠিক থাকে না; কাজ হয়ে গেল যেখানে সেখানে ফেলে রাখা হয়। কাজ শেষে যত্ন করে ভালো জায়গায় তুলে রাখাই উচিত। নিত্য নূতন করে সুঁই কিনে সংসারে পয়সা নষ্ট করে লাভ কি? একটি পয়সা বৈধ নয়, একথা কোনো বধূর মুখ থেকে বের হওয়া উচিত নয়। একটা একটা পয়সা দিয়েই তৈরি হয়।
অবস্থা যদি ভালো না হয় তাহলে একবারে বেশি জিনিস কিনবে না। বেশি আনলে, বেশি খরচ হয়।
আহারের জন্য যত সম্ভব ব্যয় করা ভাল, তবু নিজের আয়ের কথাও ভাবতে হবে। হাতে টাকা নেই বা আয় বেশি নয় এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে কম কম খরচ করতে হয়। নইলে উপায় তো নেই। আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করলে জীবন শেষে শাক-ভাতও জোটে না।
নিজেদের যদি বাড়ি না থাকে তাহলে একটা বাড়ি প্রস্তুত করা ভাল, নইলে স্বামীর অবর্তমানে নিজের ইজ্জত হুরমত থাকে না, অপমানে জীবন যাপন করতে হয়। টাউন অপেক্ষা পল্লীগ্রামে কম খরচ লাগে। টাউনে থেকে দারুণভাবে অনেক বিপন্ন অভাব। পীড়িতা নর-নারী দুষ্ট বদমাইশ হয়, চরিত্র হারায়। পল্লীগ্রামে মানুষের সহানুভূতি বেশি। পাওয়া যায়, অল্প খরচে সংসার চলে।
পয়সা থাকতে কিছু সম্পত্তি কিনা উচিত–পল্লী টাউন যেখানেই হোক। দেশে মাটির মূল্যই বেশি। এ দেশ কৃষিপ্রধান। যার দু’বিঘা জমি আছে, তার ভাবনা নেই। জলে মাছ, মাঠে সোনা-বাঙালির নাই একটু ভাবনা। রাস্তা ঘাট ছাড়া বহির্জগতের সঙ্গে সম্বন্ধহীন নিতান্ত পল্লীগ্রামে বাস করলে আবার পরিবারের উন্নতি হয় না।
মাসে মাসে কিছু কিছু জমা করা চাই। স্বামীকে কিছু জমা করবার জন্যে পুনঃপুনঃ অনুরোধ করবে। পুরুষের অভ্যাস কেবল খরচ করে যাওয়া। সঞ্চয়ী হবার জন্যে স্বামীকে বিশেষ করে বলবে। স্বামী যদি কিছু না রাখেন তবে তার সঙ্গে ঝগড়া করাও ভালো। জমানো টাকা যেন কিছুতেই খরচ না করা হয়। নিজের নামে ডাকঘরে টাকা রাখলেও মন্দ হয় না–স্বামীর কাছ থেকে মাঝে মাঝে কিছু কিছু আদায় করে ডাকঘরে নিজের লোক দিয়ে জমা রাখবে।
হাতে পয়সা আছে বলেই অনবরত খরচ করতে নেই। সর্বদা কিছু কিছু জমাতে চেষ্টা করবে। তাই বলে নরপিশাচের মতো না খেয়ে, না পরে, টাকা জমানো ভালো নয়।
বিপদের দিনের জন্য কিছু কিছু টাকা রেখে দিতে হবে।
টাউনের পার্শ্বে যেখানে স্কুল ও শিক্ষিত সমাজ আছে, অথচ পল্লী, সেখানেই দরিদ্র পরিবারের বাসের উত্তম স্থান।
মেয়েমানুষের কিছু হুনর হেকমত শিখে রাখা নিতান্ত প্রয়োজন। স্বামী বিহনে যাতে একেবারে পথে না দাঁড়াতে হয় আগেই তার বন্দোবস্ত করতে হয়। ঘরে বসেই যাতে দু’পয়সা উপায় করা যায় তার জন্য ব্যবস্থা হওয়া চাই। নারীরা ঘরের মধ্যে বসে বই বাঁধাই, সোনা, রূপা, কাপড় ও কাঠের কাজ করতে পারেন। নারী না খেয়ে মরবে কেন? কত ইংরেজি মহিলা জামা-কাপড়ের কাজ করে কত টাকা উপায় করেন, তার খবর। আমাদের মেয়েরা কি রাখেন? কত নারী অভাবে দুঃখে পল্লীগ্রামের অন্ধকার ম্লান প্রদীপের। পাশে কাঁদছে! নারীরা দুঃখে কে কাঁদে? তারা যেন বিধাতার জীবন নয়! তাদের কথা চিন্তা করলে মানুষের পতন হতে পারে। তারা ধর্ম পথের কণ্টক। কী বিড়ম্বনা!
কুলসুম আবার বলিলেন–প্রিয় হালিমা, বাড়ির কর্তাকে ভাত দিলে, শুধু ভাত ডাল সামনে রেখে দিলেই বধূর কর্তব্য শেষ হয় না। আগে জায়গা ঠিক করতে হয়; ধুলা বালি থাকলে ঝেড়ে দিতে হয়, তারপর দস্তরখানা ও পানি দিয়ে ভাত দেবে।
রান্না হলেই স্বামী ও মুরুব্বীদের স্নান করে আসতে অনুরোধ করবে। সকলকে এক সঙ্গে ভাত দেবে। ভাতের জন্য কর্তাকে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। যদি বিশেষ দেরি থাকে, তাহলে মিষ্টি কথায় অপেক্ষা করতে বলবে।
বাড়িতে বেশি কেরোসিন তেল রাখবে না; দৈবাৎ যদি টিনে আগুন ধরে তাহলে সমূহ বিপদ হতে পারে।
নাইট্রিক এসিড, কার্বলিক এসিড বা কোনো বিষ জাতীয় ওষুধ খুব সাবধানে রাখবে। ইঁদুর মারবার জন্যে অনেকে ট্রিনিয় বিষ ব্যবহার করেন এরূপ করা নিষেধ।
বাড়িতে অনেক সময় গৃহিণীকে রাশি রাশি কাপড় সাফ করতে হয়। যার কাপড় সেই পরিষ্কার করলে একজনের মাথায় পাহাড় চাপে না।
পরিবারের সব কাপড় ধোপর বাড়িতে দেওয়া পল্লী-গৃহস্থের সাজে না। নিজেরাই মাড় ছাফ করলে কোনো ক্ষতি নাই। কাজের ক্ষতি না হলে এবং সময়ে কুলালে নিজেরাই অপরিষ্কার না থেকে ধুয়ে নেবে। ধোয়া কাপড় নীল লাগালে কাপড় শীগগীরই ময়লা হয় না। একটা ইস্ত্রি করবার যন্ত্র কিনে ঘরে রাখলে অনেক সময় নিজেরাই সার্ট-কোর্ট পলিশ করে নেওয়া যায়। ধোপারা কী প্রতিক্রিয়ায় কাপড় ধোয় এবং ইস্ত্রী করে তা ধোপার কাছে জিজ্ঞাসা করলেই সে বলে দেবে।
আজকাল এক রকম যন্ত্র বেরিয়েছে, দাম বেশি নয়, তাতে ৫/৬ মিনিটে নাকি ৬০/৭০ খানা কাপড় কাঁচা হয়, তা একটা কিনে পরীক্ষা করে দেখলে হয়।
বেশি বাসি খাদ্য কখনও ব্যবহার করতে নেই। এক দিনের বেশি মাছ জ্বালিয়ে খাবে না। সরু সাদা চাল ব্যবহার না করে লাল চাল ব্যবহার করা উচিত। সাদা চাল উপকারী নয়।
কৃপণতা করে বা বাজে খরচ করে কখনও খাওয়া-দাওয়ার ব্যয় কমাবে না। খারাপ খেলে শরীর টেকে না।
অবস্থা ভালো না হলে, কখনও লজ্জার খাতিরে, লোকে কি বলবে, এই ভেবে কোনো কিছু কিনো না, দরকার নেই অথচ অনুরোধে জিনিসপত্র কেনা মূর্খতা। যেমন অবস্থা তেমনি চলবে কারো পরোয়া করবার দরকার নাই।
বিক্রেতার মুখে জিনিস-পত্রের অন্যায় দাম শুনে রেগে ওঠা অভদ্রতা। বিক্রেতার মিষ্ট কথায় মুগ্ধ হয়ে অনুচিত মূল্যে কোনো কিছু কেনা বোকামি। বিক্রেতার ঠাট্টা উপহাস যতই কড়া হোক না, কানে তুলতে নেই। জিনিসপত্র এক দামে কিনতে চেষ্টা করা উচিত।
সোডা দিয়ে কাপড় না ধুলে বেশি টেকে। কলার পাতার ছাই উত্তম।
ঘর ঝাঁট দেবার সময় যেখানে সেখানে জুতো টান দিয়ে ফেলে। এরূপ করতে নিষেধ করবে।
কুলসুম বলিলেন-বোন, একটা অতি মূল্যবান কথা বলা হয় নি। পরিবারের কারো রোগ-ব্যামো হলে নারীরা সারারাত্রি জেগে কাটান, এটা নারী জীবনের শ্রেষ্ঠ গুণ। ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ যেই হোক, প্রাণ দিয়ে তাকে সেবা করবে রক্তের সঙ্গে বিশেষ সম্বন্ধ নেই বলে যে পীড়িতাকে অবহেলা করতে হবে এমন যেন কখনও না হয়। সেবা করবার লোক। যদি যথেষ্ট থাকে, তাহলে অনবরত একজনের রাত্রি জাগরণ ঠিক নয়। কিন্তু রাতে যদি দরকারই হয়, তবে তা জাগাতেই হবে। ছোট অন্য কাউকে জোর করে রোগীর পার্শ্বে বসিয়ে রাখা ঠিক নয়। অনেক মানুষ আছেন যারা নিজে নাক ডেকে ঘুমিয়ে, পরকে সারারাত্রি জেগে থাকতে বলেন, একটু ত্রুটি হলে গালাগালি দিয়ে নিজের হীনতার পরিচয় দেন। মানুষকে দেবার জন্যে দুঃখী রোগাক্লিষ্ট মানুষের সেবার জন্যে রাত জাগাতে যে কী আনন্দ হয়, তা কি এক মুখে বলা যায়?
নিথর নৈশ আকাশ,তারাগুলি মৃত্যুর গান শোনাচ্ছে,-করুণ শোকের মূর্ধনা দিয়ে বাতাস বিশ্বজোড়া যৌনতার বুকের উপর দিয়ে হা হা করে ছুটছে–এমন সময় রোগজীর্ণ মরণ পথের যাত্রীকে দেখে কে ঘুমাতে পারে? কেউ না! হালিমা! সহানুভূতি, স্নেহ আর আঁখিজল নারীকে যে কত, বড় করেছে, তা আমি ঠিক করে বলতে পারি নে। কে বলে ভাগ্যহীনরাই নারী হয়ে জন্মগ্রহণ করে? নারীর দেহলাবণ্যে স্বর্গের সংবাদ এনে দেয়, তার হৃদয়ে বিশ্বজীবনের প্রাণরস নিহিত, তার হাসিতে আলোক-বাতাস অধীর আবেগে ছোটে, সাগর কল্লোলে নারীর জয়-সঙ্গীত শোনা যায়, তার চোখে মুখে প্রভাতের স্নিগ্ধ শান্তি-উৎসব হাসে, তার ললাটে গগনপ্লবী জোছনার মাধুরী ফোটে, সে কি সহজ? এহেন নারীকে যে অশ্রদ্ধা করে, সে নরাধম, সে নরপিশাচ।
নারীদের কিছু কিছু ঔষধের জ্ঞান থাকা নিতান্ত আবশ্যক। এতে কত নারীর যে উপকার করা যায়, তা বলে শেষ করা যায় না। নারীরা অনেক কষ্টে বিনা চিকিৎসায় মরে যায়, কেউ তাদের দেখবার থাকে না। কাউকে ঔষধ দিতে হলে কিছু মূল্য নিতে হয়। আর সেধে কাউকে ঔষধ খাওয়াবে না। কেউ তোমার নিতান্ত যে দয়া ভিক্ষা করে এবং ঔষধের প্রতি শ্রদ্ধা দেখায় তার কাছ থেকে দাম কম নেবে। অক্ষমতা প্রকাশ করলে মোটেই নেবে না। আমি চিকিৎসার কি জানি, এরূপও মনে করবে না, সব কাজেই সাহস ও বিশ্বাস চাই। গ্রামসুদ্ধ লোককে সেবা করে বেড়াতে হবে, এ আমি বলছি নে। যার কেউ নেই, তুমি হবে তার আত্মীয়। যেখানে সেবা-যত্ন করবার যথেষ্ট লোক আছে সে ক্ষেত্রে জোর করে সেবা করবার দরকার নেই।
খ্রিষ্টানদের ভিতরে একদল নারী আছেন যারা চিরকাল অবিবাহিতা থেকে রোগী বা। আর্তের সেবা করে বেড়ান। বাইরে এতে এদের জীবন নিয়ে কল্পনা করতে মনে খুব শ্রদ্ধার ভাব জাগে, কিন্তু স্বভাবকে অস্বীকার করে মনুষ্যত্বের পরিচয় দেওয়াও দোষের। এদের জীবনে বহু গোপন পাপ রয়েছে। ইসলামের প্রত্যেককে পরিপূর্ণ মানুষ হতে হবে। যিনি রানী, তিনিই পত্নী, তিনিই মা, তিনিই দাসী, তিনিই সেবিকা, তিনিই আর্তের বন্ধু।
কুলসুম আবার বলিলেন–যদি কোনো বিপন্ন আত্মীয়া বা স্বামীর বোন অনাথিনী হয়ে বাড়িতে আসেন, তবে তার সঙ্গে কখনও কঠিন ব্যবহার করবে না।
হালিমা মুখ ভার করিয়া বলিলেন–ওমা, এমন ধারা কি কখনও হয়ে থাকে?
কুলসুম-বোন, হয় বই কি? অভাব হলে সংসারে আপন জনের মধ্যে কলহ বিবাদ উপস্থিত হয়। তবে এরূপ হওয়া মোটেই বাঞ্ছনীয়। আল্লা রুজির মালিক, তিনি সকলকে খোরাক দেন, মানুষ উপলক্ষ মাত্র। অনেক সময় অভাব না থাকলেও, যে অনাথিনী, যে দরিদ্র, তার উপর বড় চাপ দেওয়া হয়। আহা, অনাথিনী হওয়া, আর অভাগিনী হয়ে ভাই এর বাড়ি অনুগ্রহ চাইতে আসার মতো কষ্ট কি আর আছে? এ অবস্থায় যে নারী স্বামী ও সন্তানের গর্বে আশ্রিতাকে কঠিন কথা বলেন তিনি বড় হীন। বাড়িতে যে আশ্রয় নিয়েছেন তার অপরাধটা স্নেহের চোখে দেখো। তার ছেলেমেয়েকে কখনও অনাদর করবে না,–বিশেষ করে সে নিজের আত্মীয় কেউ হলে।
অসভ্য বর্বর শ্রেণীর রমণীকে বাড়িতে স্থান দিলে জীবনে অশান্তি বেড়ে ওঠে। তাদের জন্য কোনো স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করে দেবে। স্বভাব যাদের ভালো, তাদের প্রতি শত রকমে করুণা প্রকাশ করলেও কোনো ক্ষতি নেই। তবে স্বভাব ঠিক মন্দ কি ভালো, এ ঠিক করা অনেক সময় কঠিন। যার কিছু নেই, যে পরমুখাপেক্ষী, তার দোষের অন্ত নেই, মানুষ তাকে খেয়ে ফেলতে চায়, তার গুণ কারো নজরে পড়ে না। যার নিতান্ত কপাল পুড়েছে, জীবনে বেঁচে থাকবার কোনো পৰ্থ যার নেই, সে-ই পরের দ্বারস্থ হয়।
২১-২৩. কী করে সন্তান গঠন করতে হয়
একবিংশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম বলিলেন–কী করে সন্তান গঠন করতে হয় তা তোমাকে জানতে হবে। মায়ের দোষে ছেলে বড় ও ছোট হয়। ছেলে বেয়াদব এ কথা যেন কেউ না বলে। সন্তানের বেয়াদবির জন্য বাপ এবং বেশি করে মা দায়ী। মা যেমন মানুষের ভক্তির পাত্র, তার কাজ। এবং দায়িত্বও তেমনি বেশি। শুধু কাঁদলেই ছেলে বড় হবে না (বড় অর্থ বয়সে বড় নয়,)। ছেলেকে বড় করতে হলে মাকে বিচক্ষণ ও চিন্তাশীল হতে হবে। ছেলের পাঁচ বৎসর পর্যন্ত মা-ই তার চরিত্র গঠন করবেন। তারপর ছেলের অভিভাবক পিতা।
হালিমা জিজ্ঞাসা করিলেন–ছেলের জন্য মা কেন দায়ী?
কুলসুম : ছেলে সর্বদা বাল্যকালে মার কোলে পালিত হয়। মা’র কথা, ব্যবহার শিশু অনুকরণ করে। মার মন যদি উন্নত হয়, তার কথা, এবং আলাপ জ্ঞানপূর্ণ হয়, শিশুর স্বভাব, চরিত্র এবং মনও বাল্যকাল হতে উন্নত ধরনের হতে থাকে। মা যদি বাচাল ও মূর্খ হন, ছেলেও ঠিক তেমনি হবে। মার মুখে ছেলে বড় বড় কথা শিখতে পারে, মার কাছে শিশু নীচতা ও মূর্খতার দান পায়। মা যদি যুক্তির সঙ্গে কথা বলেন, শিশুও যুক্তির সঙ্গে কথা বলতে শেখে। মা শিশুর কাছে একটা জীবন্ত জ্ঞান-ভাণ্ডার, যা পড়বার জন্যে শিশুকে ‘ক’ ‘খ’ শিখতে হয় না। কাগজের ক’ ও ‘খ’ না শিখেও শিশু উপযুক্ত মাতার সঙ্গ-শক্তিতে জ্ঞানে বড় হতে পারে।
পুরুষানুক্রমে মায়ের রুচি ও চরিত্র সন্তানের স্বভাবে প্রতিফলিত হয় বলে অশিক্ষিত লোকেও বংশ-গৌরব করে থাকে। অনেক সময় এই বংশ গৌরব মিথ্যা ভড়ংয়ে পরিণত। হয়, এও ঠিক।
সন্তানের উন্নতির কথা ভাববার আগে মা নিজের জ্ঞান, রুচি ও চরিত্র মার্জিত করতে চেষ্টা করবেন।
মা’র মানসিক শক্তি স্বাধীনতাবোধ ও ব্যক্তিত্ব সন্তানের চরিত্রে ফুটে ওঠে, সন্তানের মনকে স্বাধীনতাবোধসম্পন্ন করতে এবং তার ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলবার জন্যে মাকে মানসিক বল সংগ্রহ করতে হবে।
অনেক সময় খুব শিশু বয়সেই সন্তানকে পড়তে বাধ্য করা হয়। এ ভালো নয়। এতে শিশু পড়াশুনাকে ঘৃণা করতে শেখে।
অনেকক্ষণ বসিয়ে শিশুকে ‘ক’ ‘খ’ শিখাবে না। হাঁটবার সময়, কথা বলবার সময় অক্ষর চেনাবে।
একদিন হতে এক সপ্তাহ ধরে মাত্র একটি করে অক্ষর শেখাতে হয়, কিছু হচ্ছে না বলে ধৈর্যহারা হয়ো না। অক্ষর শেখা হলে, প্রতিদিন ১০/১৫ মিনিট করে বই নিয়ে বসতে অভ্যস্ত করবে। খুব বাল্যকালে ছেলেকে পড়াবার জন্যে স্কুলে পাঠাবে না। স্কুলে শিশুর পক্ষে ৩/৪ ঘণ্টা এক জায়গায় বসে থাকা খুব কঠিন। এই নির্যাতনে শিশুর মন ভিতরে ভিতরে নিষ্ঠুর ও নিচ হতে থাকে। স্কুলে যদি পড়া অপেক্ষা খেলার ব্যবস্থা বেশি থাকে, তাহলে শিশুকে স্কুলে পাঠান যেতে পারে।
শিশুরা ছোটকালে বড় লোভী হয়। এ সম্বন্ধে জননীদের বিশেষ সাবধানতা আবশ্যক। লোকে কি বলবে ভেবে ভয় করো না। অন্যে যা ভাবে ভাবুক। শিশুর লোভকে একটা অপরাধ বলেই মনে করতে হবে। লোভের জন্য ছেলেমেয়েকে শাস্তি দিতে হবে।
কোনো ব্যক্তির মনস্তুষ্টির জন্য সন্তানকে মারতে নেই। এতে নিজেই অসম্মান হয়; ছেলেমেয়ে ছোট হলেও তাদের সম্মানে বাপের সম্মান বাড়ে, বিনা কারণে ছেলেপেলের অসম্মান করবে না।
বাল্যকাল হতেই ভাইবোনদের মধ্যে ভাই-এ ভাই-এ, বোন-এ বোন-এ যাতে সদ্ভাব স্থাপিত হয়, সেদিকে যেন লক্ষ থাকে। ঝগড়া করলে এক ভাইকে অন্য ভাই-এর ও এক বোনকে অন্য বোন-এর কপাল চুম্বন করতে বলবে।
এই প্রসঙ্গে একটা অন্য কথা মনে পড়ে গেল–অন্তঃসত্তা হলে স্ত্রীরা সাধারণত অযত্নের ভয়ে মায়ের বাড়ি চলে যান। এটা রমণী-জীবনের একটা মস্ত ভুল। বিয়ের পর স্ত্রীকে ছেড়ে থাকা স্বামীর পক্ষে অন্যায়, এ কথা আমাদের দেশের মানুষ বোঝে না। স্ত্রীর কর্তব্য সর্বদা স্বামীর কাছে থাকা, বিশেষ করে ছেলেপেলে হবার সময়। শিশু অবস্থাতেই সন্তান যদি বাপের কোলে পিঠে মানুষ হবার সুবিধে না পায় তাহলে সে সন্তানের উপর বাপের মায়া হয় না-এ কথা অতি সত্য। এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলে নিই। মেয়ের বিয়ের পর মেয়ের বাপ মেয়েকে স্বামীর বাড়ি হতে মাঝে মাঝে নিয়ে যান। মাঝে মাঝে ২/৩ দিনের জন্যে বাপের বাড়ি যাওয়া মন্দ না, বাপ যে ছেলেপেলে না হওয়া পর্যন্ত ঘন ঘন মেয়ে নিয়ে যান, তার কারণ হচ্ছে জামাই-এর প্রতি শ্রদ্ধা ও অনুরাগ বাড়ান।
স্বামীকে ছেড়ে বাপের বাড়িতে বসে থাকা মেয়েদের একটা ভয়ানক বোকামি। যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া স্ত্রীর সর্বদা স্বামীর সঙ্গে থাকাই আবশ্যক। আজকাল যে দিন পড়েছে তাতে পুরুষের মনকে পবিত্র রাখার জন্যে নারীকে সর্বদা স্বামীর পাশে থাকতে হবে। পরদার বাড়াবাড়িতে স্বামীর সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ মুসলমান নারীর পক্ষে কিছু অসুবিধা, কিন্তু বর্তমান এই যন্ত্র যুগে বেঁচে থাকতে হলে এই পরদাটাকে একটুখানি ছিঁড়ে ফেলতে হবে। পিঞ্জরাবদ্ধ পাখি হয়ে শূন্যে বাস করা সম্ভব, মানব সমাজে নয়। নিজে সতী হয়ে পুরুষকে কাজে ও চিন্তায় সকল সময় নির্মল করে রাখাও স্ত্রীর জীবনে একটা বড় কাজ। পুরুষের চরিত্রবলের খুব অভাব; অধিকাংশ পুরুষের কাজে না হোক চিন্তায় পাপ ও দুর্বলতা জড়িয়ে আছে। এটা হয়তো তার স্বভাব, সুতরাং এর জন্যে তাকে দোষ দেওয়া চলে না। প্রাণহীন মিঠাই এর দলা অপেক্ষা মরে যাওয়াই ভালো। কাকে ছোঁ মেরে নিয়ে পালাবে। নারী নিজের মর্যাদা ও চরিত্রের মূল্য নিজেই বুঝুক, সঙ্গীন তলোয়ারধারী পাহারাওয়ালাদের পেছনে কোষাগারে প্রাণহীন রূপার পিঠা হয়ে থাকলে চলবে না।
যা বলেছিলাম-ছেলেমেয়েরা যাতে লোকের সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলে, সেদিকে দৃষ্টি রাখা চাই। যদি সন্তানকে ভদ্রতা শিখান তাহলেই সে ভদ্র হয়ে ওঠে। শিশুকালে ছেলেমেয়ের সঙ্গে ৪/৫ বৎসর পর্যন্ত খুব সম্ভ্রম করে কথা বলা ভাল। মা বলে ডাকলে ‘জি’ বলা উচিত। এতে ছেলেমেয়েরা শিশু বয়সেই ভদ্র হয়ে ওঠে। বাপ-মা ছেলের সঙ্গে যেমনভাবে কথা বলেন, যেমন করে ব্যবহার করেন সন্তানেরাও তেমনি করে কথা বলতে ও লোকের সঙ্গে ব্যবহার করতে শেখে।
পোশাক-পরিচ্ছেদ সম্বন্ধে আমাদের ছেলেমেয়েরা যেন স্বজাতীয় বৈশিষ্ট্যতা হারিয়ে না ফেলে। ইংরেজ মহিলারা যে পোশাক পরেন এটা কিন্তু মুসলমানদের পোশাক। তবে বর্তমানে হাঁটুর উপরে মেয়েদের পোশাক সেটা কিন্তু নয়। মেয়েকে মেমের পোশাক দিতে বলছি, এ মনে করো না। নারীদের টুপি পরাও ইসলাম সভ্যতা। ছেলের মতো মেয়ের পোশাক কোনো প্রকারেই হওয়া উচিত নয়।
হিন্দু ছেলেমেয়েরা বাল্যকাল হইতেই মানুষকে ঘৃণা করতে শেখে। সঙ্গদোষে নিজের ছেলেমেয়ের, যেন তেমনি রুচি বিকৃতি না ঘটে। মানুষকে ঘৃণা করা পাপ ও অন্যায়, ছেলেমেয়েকে এটা বুঝিয়ে দিতে হবে। এতে জাতির অকল্যাণ হয়। পৃথিবীর কোনো মানুষের স্পর্শে মুসলমান বা অন্য কোনো জাতির পানি বা ভাত নষ্ট হয় না, এ কথাও তাকে বলতে হবে। পৃথিবীতে একমাত্র হিন্দুরাই এই রোগে ভুগছে।
সন্তানকে বাল্যকাল হতে বীরত্ব শেখাতে হবে। কুকুর, বিড়াল ও শেয়ালের ভয় দেখাবে। বাঘকে মেরে এস, বন্দুক তলোয়ার নিয়ে লড়াই করতে যাও প্রভৃতি কথা বললে ছেলের মনের সাহস হয়, পরন্তু আত্মমর্যাদাজ্ঞান বাড়ে–সে কাপুরুষ ও দুর্বল হয় না।
শিক্ষক ছেলেমেয়েকে মারলে, অনেক অশিক্ষিত মা বাপ বিরক্ত হন। শিক্ষক বা কোনো মঙ্গলাকা ব্যক্তি যদি ছেলেমেয়েকে মারেন, বিরক্তি প্রকাশ করবে না।
শিক্ষক ছেলেমেয়েকে বিশেষ কোনো অপরাধে খুব প্রহার করলেও কিছু মনে করবে না। ছেলেমেয়ের কোনো কোনো ভুলকে ক্ষমা করতে হবে, কখন তাকে ভালবাসতে হবে, সে চিন্তাশীল শিক্ষক জানেন। ছেলেমেয়েকে মেরে ফেলা তার উদ্দেশ্যে নয়। না মেরে কাজ চললে তিনি কোনো ছেলেমেয়েকে মারেন না। প্রহার করে তার আনন্দ হয় না কিংবা ঐভাবে তিনি বীরত্বের পরিচয় দেন না।
সন্তানরা যে বই পড়ার উপযুক্ত তাই তাকে পড়তে দিও, লোভ করে ধৈর্য হারিয়ে বেশি পড়তে দিও না। তাতে তার জীবন মাটি হোক। গৃহে অবিবাহিতা শিক্ষক রাখবে না। বিচক্ষণ শিক্ষকই সন্তানের চরিত্র গঠনে সাহায্য করতে পারেন। রাত-দিন পড়বার জন্য শিক্ষক দরকার নেই। শিশুকে অনবরত পড়তে বাধ্য করবে না। তাতে তারা ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহী হয় এবং প্রতারণা করবার স্বভাব তৈরি হয়। প্রবীণ শিক্ষকের সংস্পর্শে থাকলে ছেলের মন উন্নত হয়; তার ধারণাশক্তি ও দৃষ্ট প্রসার লাভ করতে থাকে।
কোনো প্রবীণ শিক্ষকের বাড়িতে যদি ছেলেকে .খা যায়, তাহলে বড় ভালো হয়। রাত-দিন পড়বার জন্যে ছেলে সেখানে থাকবে না। হাসি, খেলা, নৃত্য, চীৎকার যদি ছেলে করে, তা যেন ছেলে শিক্ষকের সামনেই করে।
শিশুর শয়তানী ও উল্লাস চীৎকার দেখে বিরক্ত হবে না; তাই বলে ঘরের মধ্যে বিছানার উপর মারামারি-শয়তানী ও ভালো নয়।
ছেলে যেন বাবু না হয়ে ওঠে। তাকে দিয়ে অনবরত কাজ করানো ভালো। তার দ্বারা হীন ও ছোট কাজ করাতে লজ্জা বোধ করবে না।
ছেলেদের গায়ে কখনও সাহেবি পোশাক দেবে না। সাহেবি পোশাক দিতে ঘৃণাবোধ করবে। এতে ছেলে নিজেকে ও নিজের জাতিকে ছোট ভাবতে শেখে।
ছেলেমেয়েরা অনেক সময় অন্ধকারে হাঁটে; কুকুর-বিড়াল দেখে ভয়ে চীকার করে ওঠে; ফলে নানা ব্যাধি হবার সম্ভাবনা।
অত্যধিক মুরুব্বী ভক্তি, কথায় কথায় পায়েল ধুলা মাথায় নেওয়ায় ছেলে-মেয়েদের, মন দুর্বল হয়ে ওঠে। সে মনে করে তার নিজের কোনো মূল্য নেই।
অনুন্নত সমাজ মানুষকে অত্যধিক বিনয়ী ও ভদ্র করে রাখতে চায়। বাড়িতে যদি কোনো প্রতিবেশীর ছেলেমেয়ে আসে, ছেলেমেয়েকে তার হাত ধরে সমাদর করে বসাতে শিক্ষা দেবে।
বাপকে ছেলেমেয়ে যেন ভয় করে, সে দিকে মায়ের দৃষ্টি থাকা চাই। বাপের চরিত্রবল থাকলে সন্তান তাকে ভয় করবেই। যে মায়ের চরিত্রবল নাই সে মাকে ছেলেমেয়ে ভালো করে না।
নিম্নলিখিত কারণে ছেলেমেয়ে মাকে ভয় করে না, এমনকি বার্ধক্যে মায়ের অযত্ন করে।
১. মায়ের চরিত্রবলের অভাব।
২. মা যদি কথায় কথায় সামান্য কাজে বা তুচ্ছ কারণে ছেলেমেয়ের উপর লাঠি নিয়ে ওঠেন।
৩. মা যদি বাচালতার পরিচয় দেন।
৪. একই সময় কোনো হুকুম দেওয়া এবং তৎক্ষণাৎ দ্বিতীয় হুকুম দেওয়া।
৫. ছেলেমানুষের মতো ছেলেমেয়ের সঙ্গে অনবরত রাগারাগি করা।
৬. সর্বদা নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাওয়ান; এর ফলে ছেলেমেয়ে মনে করে–মা মোটেই খায় না বা তার খাবার কোনো প্রবৃত্তি নেই। মা অপরাধিনী, সে শুধু খাওয়াতে পরাতে এবং ভালবাসতে এসেছে, ভালবাসা পেতে বা খেতে তিনি জানেন না।
৭. সন্তানের সামনে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করা; স্বামীর কর্তব্য নয় ছেলেমেয়ের সামনে স্ত্রীর সঙ্গে কখনও কোনো বচসা করেন।
৮. প্রথমেই রেগে কোনো হুকুম দেওয়া। আগে কোনো কথা না বলেই হঠাৎ ছেলেমেয়ের উপর রেগে ওঠা। এতে মায়ের ভয়ঙ্কর অসম্মান হয়। সন্তানের সঙ্গে হামেসা রাগারাগি করা বড়ই ভুল। তার বহু দুর্বলতাকে ক্ষমা করতে হবে। ছেলেমেয়েকে হামেসা কথায় প্রহার করলে, সে অমানুষ ও পিশাচ হয়ে ওঠে। তার অনেক অন্যায় মেনে নিতে হবে।
৯. বুদ্ধিমান ও সেয়ানা হবার আগে অর্থাৎ ৫/৬ বৎসর বয়স পর্যন্ত শিশুর কাছে কোনো বক্তৃতা দেবে না। বক্তৃতা ও জ্ঞানের কথাকে শিশুরা প্রলাপ মনে করে। কারণ দেখিয়ে ছেলেমেয়েকে কোনো কাজ করতে বলবে না, কারণ দেখালে সেও কারণ দেখাতে চেষ্টা করে, অবাধ্য হবার পথ খোঁজে। সোজা হুকুম দেবে। তাহলে কাজ হবে।
১০. অনবরত ছেলেমেয়েকে ঠোনা দিতে নেই।
১১. মারবার সময় কোনো কথা বলবে না। শুধু একটি কথায় তার অপরাধটা কী জানিয়ে দেবে। যখন তখন মারবে না, মারলে বেশি করে মারবে। চিক্কণ কঞ্চি ছাড়া কিল ঘুষি দেবে না। অসতর্ক আঘাতে শিশু হঠাৎ মরে যেতে পারে। একই বিষয় নিয়ে কখনও বারে বারে গালি দিও না। মারবার সময় কথা বললে মারার মূল্য নষ্ট হয়। শাসন বা প্রহার থেমে থেমে হওয়া বড় দোষের। ছেলেমেয়েকে সোজা কথায়, বাজে কথা না। বলে হুকুম দেবে, বাজে কথা বলা দোষ। ছেলেমেয়েকে আদর করা, সোহাগ করা, এতে ছেলেমেয়ের ভিতর মনুষ্যত্বের বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে। ছেলেমেয়ে যদি রাগ করে, তবে মারবার এক ঘণ্টা পরে তাকে ডেকে খাওয়াবে।
মারবার অব্যবহিত পরে আদর করলে মারবার ফলনষ্ট হয়। সাধাসাধি দরকার নেই। খাবার জন্য ডাকবে অর্থাৎ গম্ভীরভাবে খেতে বলবে, আর ভোজনটা পরিপাটি করে দেবে।
ছেলেমেয়েকে প্রথমেই যাও না, খাও না, করে কথা বলবে না। প্রথম যেতে বলবে, না শুনলে বলতে পার ‘যাও না’। ‘যাও না’ এরূপ করে হুকুম দিতে নেই। প্রথম কোনো কাজ করতে বলো না, শুনলে, জিজ্ঞাসা করো–তোমাকে অমুক বললাম, না শুনবার কারণ কী? তাতেও যদি ছেলেমেয়ে কথা না শোনে তাহলে আপাতত তখনকার মতো চুপ থাকাই শ্রেয়। যে কাজ করতে ছেলেমেয়ে নিতান্ত নারাজ, তা করবার জন্যে তাকে জোর জবরদস্তি করো না। সব কাজেই চিন্তা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। ছেলেমেয়ে ছাড়া পরিবারের অন্য কারো দ্বারা কোনো কাজ করাতে ইচ্ছা হলে, নিজের ইচ্ছা জানাবে, না শুনলে রাগারাগি করো না। চিন্তাহীন, পাগল মনের দ্বারা কোনো কাজই হয় না, কাউকে চালানো যায় না।
ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শিখল না, সে বদমাইশ ও শয়তান হয়ে উঠেছে, তার জন্য ছেলেমেয়ে অপেক্ষা বাপ-মাই বেশি দায়ী। অনুন্নত ও অশিক্ষিত বাপ-মায়ের ছেলেমেয়ে সাধারণত শিক্ষিত ও বড় হয় না। বাল্যকাল হতেই ছেলেমেয়েগুলি বাপ-মায়ের অদুরদর্শিতা, মানসিক শক্তির অভাবে অবাধ্য ও হীন হয়ে ওঠে। ছেলেমেয়েকে মানুষ ও বড় করে তোলার জন্যে বড় মনের দরকার। মূর্খ বাপ মায়ের ছেলেমেয়েও ভীত হয়।
ছেলেমেয়ের উপর বেশিরকম অত্যাচার করলেই সে মানুষ হয়ে ওঠে না, তার স্বাভাবিক চপলতা দেখে বিশেষ বিরক্ত হবে না। সে হাসুক, খেলা করুক–কী ক্ষতি? দৌড়াক, মাছ ধরুক, গাছে চড়ুক, সে বর্ষাকালে পানির মধ্যে ডুবোডুবি করুক। সে যে খোকা–সে কেবল আনন্দ চিন্তা ও ভাবশূন্য একটা কেমন শক্তি-তার আনন্দ থাকবে না?
অবশ্য বেশি শয়তানি ভালো নয়।
অত্যধিক শাসন-অত্যাচারে ছেলেমেয়ে কালে চরিত্রহীন ও লম্পট হয়ে ওঠে। ছেলেমেয়ের বাপ-মায়ের স্নেহ-মায়া পাপের কথা ভাবতে অবসর পায় না। বাপ-মায়ের কাছে নিরন্তর আঘাত পেলে সে সুখ ও শান্তির জন্য জঘন্য পথের আশ্রয় খোঁজে।
ছেলেমেয়ের বয়স যখন ১৪/১৫ বৎসর তখন তাদের দিয়ে দিবারাত্রি কাজ করাবে, নইলে রক্ষা নেই। এই বয়সে ছেলেমেয়ে গোপন পাপ করতে শেখে। সোনার হৃদয় পাপ কলঙ্কে ছাই হয়ে যায়। তার জীবনীশক্তি নষ্ট হতে থাকে। খবরদার ছেলেমেয়ের সঙ্গে এই সময় কোনো খারাপ ব্যবহার করো না, অশ্রদ্ধা ও উপহাসের সঙ্গে তার দুর্বলতা ও অন্যায় কাজ নিয়ে কোনো আলোচনা বা ভর্ৎসনা করো না। তোমার সহানুভূতি, তোমার গভীর স্নেহ ও পুণ্য শক্তির প্রভাবে সে পাপকে জয় করতে শিখুক।
ছেলেকে ১৪/১৫ বৎসরের সময় কোনো জ্ঞানী মানসিক শক্তিশালী পণ্ডিতের কাছে রাখা ভালো। এই সময় অনবরত দেহ ও মনে কাজ হওয়া দরকার। পড়বে এবং সঙ্গে কাজ করবে, মায়ের সঙ্গে সাংসারিক কাজ করলেও তার সময় কাটে, বাপের সঙ্গে সঙ্গে থাকাও উত্তম।
ছেলে যদি বদনায় করে শিক্ষকের পায়খানার পানি দিয়ে আসে, কোনো ক্ষতি নেই। কাঠ ফাড়া ও মাটি টানা অর্থাৎ কঠিন কাজ করা বড়ই ভালো। বাড়ির পার্শ্বে একটা বাগান থাকা উচিত, যেখানে ছেলেমেয়েরা কাজ করতে পারে। নিজের তৈরি কাজের প্রতি তাদের। মমতা হয়; বাজে পাপ কথা ভাববার সময় পায় না।
পাড়ার কোনো কোনো বদমাইশ ছেলে ছোট শিশুকে কু-পথে নেবার চেষ্টা করে। এমনকি অনেক অবিবাহিত যুবক শিক্ষকেরও এই দোষ থাকতে পারে। যাদের সঙ্গে বয়সের বিশেষ তারতম্য আছে তাদের সঙ্গে ছেলে মেয়েকে মিশতে দেবে না বা একসঙ্গে শুতে দেবে না। এমন কি দুই ভাইকে এক সঙ্গে শুতে দেওয়া ঠিক নয়।
সন্ধ্যার পর ছেলে যেন বাইরে না থাকে, সেজন্যে তাম্বি চাই। সর্বদা ছেলেমেয়েকে চোখে চোখে রাখা দরকার। তবে ছেলেমেয়ে যেন না বুঝতে পারে, তার উপর কড়া পাহারা চলছে, তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে, এতে তার বেশি রকম অধঃপতন হতে পারে।
যে জিনিসই ছেলে বাইরে হতে ঘরে আনে, যে বয়সেই হোক, মায়ের হাতে তুলে দিতে তাকে শিক্ষা দেবে। কোনো জিনিস নিয়ে ছেলেমেয়েরা যেন নিজে নিজে কামড়া কামড়ি না করে। সামান্য জিনিস হলেও মাতা ছেলে মেয়ের মধ্যে বণ্টন করে দেবেন।
চিনি, মিছরি, আম, এসব ছেলেমেয়েরা নিজ হাতে নিয়ে যেন না খায়। সব জিনিস মা দেবেন। সামান্য জিনিস বলে অবহেলা করা ঠিক নয়। এর মধ্যে শিক্ষা আছে।
ছেলেমেয়ের সামনে স্বামী স্ত্রীতে ঝগড়া করো না। বাপ ছেলেমেয়েকে কোনো হুকুম দিলে ভালো হোক মন্দ হোক মায়ের চুপ থাকাই উচিত। যখন তখন একটা বিরুদ্ধ কথা বলবে না। এতে ছেলেমেয়ের বাপ-মা কারও উপর শ্রদ্ধা থাকে না। পরী ছেলেমেয়েকে কোনো কথা বললে স্বামীরও কোনো কথা বলা ঠিক নয়।
ছোট শিশুদের হাত-পা ধুয়ে না শোবার, আর মুখ না ধুয়ে খাবার অভ্যাস আছে। পা ধুয়ে বিছানায় যেন তারা না চড়ে। ছেলেমেয়েরা ছোটকালে যার তার কাছে ইচ্ছামতো বেয়ারিং পত্র লেখে। টের পেলেই বকুনি দেবে। বেয়ারিং পত্র লেখা অভদ্রতা। চিঠি-পত্র লেখা দোষের নয় বরং ছেলেমেয়েকে ছোট-বড় আত্মীয়-স্বজনের সংবাদ রাখতে চিঠি লিখে তাদের খোঁজ নিতে উৎসাহ দেওয়া উচিত।
ছেলেমেয়েকে মাঝে মাঝে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে পাঠানো দরকার। নইলে বড় হলে সে প্রাণহীন হয়ে ওঠে। আত্মীয়-বন্ধুর জন্যে তার মনে বেদনা জাগে না।
সেয়ানা হলে ছেলে ঘুষ খেয়ে মানুষের কাছ থেকে ফাঁকি দিয়ে মিথ্যা করে টাকা আনবে, এই ইচ্ছা নিয়ে তাকে লেখাপড়া শিখিও না। অনেক মা ছেলে যাতে অত্যাচার ও মিথ্যে করে পয়সা উপায় করতে সক্ষম হয় এ জন্যে রোজা রাখেন নামাজ পড়েন। এ সমস্ত মা বড় নীচ ও মূর্খ। মা হয়ে ছেলেকে অন্যের মায়ের বুকে ছুরি চালাতে বলা কি ভালো?
খেয়ে থাক, তবু ছেলেকে অন্যায় করে পয়সা উপায় করতে বলো না। হারাম রুজি খাওয়া সুদ গ্রহণের চেয়ে খারাপ কাজ। দেশের মৌলবীরা কেবল কোরানের অক্ষর নিয়ে টানাটানি করছেন, ভাবের ধার ধারেন না। তারা সুদখোরকে ঘৃণা করেন, কিন্তু অত্যাচারী ঘুষখোরের বাড়ি খেতে লজ্জা বোধ করে না। ঘুষখোর শুধু নিজের পেট ভরে তোলে; সে নীচ হৃদয়, অসরল ও অত্যাচারী, সে চোর ও মানুষের অবমাননাকারী, সুদখোর অপেক্ষা সে ছোট লোক।
ছেলেমেয়ে বড় হয়ে মানুষের মঙ্গল করবে, সে জ্ঞানী ও চরিত্রবান হবে এই শুভ ইচ্ছা নিয়ে ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শিখাবে। কোনো নীচ কল্পনা নিয়ে লেখাপড়া শিখাতে ইচ্ছা করলে খোদা তাকে বড় করবেন না। লেখাপড়া শিখে ছেলে একজন নীতি-জ্ঞানহীন মানুষ হয়ে উঠুক এরূপ ইচ্ছা করা ভালো মায়ের কাজ নয়। বড় কল্পনা অনেক মা-ই পোষণ করেন না, ছেলে শয়তান ও ঘুষখোর হলে বহু মা নিজের সুবিধায় অসন্তুষ্ট হন না বরং সন্তুষ্ট হন। আশ্চর্যের বিষয় এই সব মা নামাজ-রোজা করেন, তৃপ্তির সঙ্গে তসবিহ গনেন।
পরকালে মুক্তি পাবো, বেহেশতে যাবো, এ আশাও রাখেন!
মনে বড় কল্পনা নিয়ে ছেলেমেয়েকে জ্ঞানের পথে তুলে দাও, ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই বড় হবে, সঙ্গে সঙ্গে বহু অর্থ ও সম্মান লাভ হবে। অর্থ ও সম্মানের কথা ভাবাও বিশেষ ভালো নয়–সেটা আপনা আপনি হবে। কর্তব্যের খাতিরে ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া শেখাবে।
সেয়ানা পুত্রের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা উচিত। কর্কশ কথায় মহাজনদের মতো ছেলের কাছ থেকে টাকা চেয়ো না। নাতি-নাতনী ও পুত্রবধূকে ঘৃণা করলে ছেলের মন হাত ছাড়া হয়ে যায়। মানুষের মায়ের প্রতি যেমন কর্তব্য আছে স্ত্রীর প্রতিও তেমনি একটা কর্তব্য আছে। ছেলে বাপ-মাকে মনে মনে অত্যন্ত ভালবাসে, দুর্ব্যবহারের দ্বারা তাকে পর করে দিও না।
ছেলের বউকে কষ্ট জ্বালা দেওয়া মহাপাপ, কারণ সে এক দুর্বলা নারী, তার উপর আশ্রিতা। আশ্রিত শত্রুকেও সম্মান করা নিয়ম, অত্যাচারে খোদা নারাজ হয়।
বাপ-মা যদি দুর্ব্যবহার করেন, তবে সন্তানের উচিত তা সহ্য করা। স্বামী ও ছেলেপেলে কর্তব্য কথা বলার অবসর আমার এখানে নেই।
ছেলে যদি বাপ-মাকে না-বলে বিয়ে করে তাহলে কিছুমাত্র ক্রোধ প্রকাশ করো না। ক্রোধ প্রকাশ করলে বিপরীত ফল ফলবে। ছেলের বিবাহিত পত্নীকে তখন তখন নিয়ে আসবে। বয়স্ক ছেলেমেয়ের বিয়ে করবার অধিকার আছে। খোদার দেওয়া বিধানে বিরক্তি প্রকাশ করে লাভ নাই।
পুত্রবধূর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। তাকে উপহাস করো না, বধূর বাপ কি দিয়েছে, দিয়েছে সে কথা তুলো না। মিষ্টি কথায়, মধুর ভাষায় বধূকে আদব-কায়দা শেখাবে। সদ্ব্যবহার, মিষ্টি কথা এবং ধৈর্যের ফল, মনে হয় একটু দেরিতে ফলছে, কিন্তু এই ভাবেই ভালো ফল ফলে থাকে।
ছেলেকে মনের শান্তি হারিয়ে পরের চাকরি করতে উৎসাহ দিও না। যারা চাকরি করে না, সেই সব দেশের সাধারণ মানুষের মর্যাদা কম নয়-একথা কঠিন ভাষায় ছেলেকে বলে দিতে হবে। কৃষি এবং ব্যবসা অসম্মানের জিনিস নয়, একথাও তাকে জানাতে হবে। মুষ্টিমেয় সাহেবী পোশাকপরা রাজকর্মচারীরাই আদর্শ মহাপুরুষ, একথা ছেলে যেন না ভাবে। ছেলেকে আরও বলবে, মানুষ নিজে সম্মানের পিতা। নিজের সম্মান নিজেকে রচনা করতে হবে; পরের কাছে সম্মান নেই। শিক্ষিত নৈতিকশক্তিসম্পন্ন মানুষ যে কাজই করুক, যেখানেই দাঁড়াক, সেইখানেই তার সম্মান।
অনেক অপদার্থ লোক অন্যায় ক্ষমতার মালিক হয়ে নিজেকে কতগুলি লোকের কাছে সম্মানী করে তোলে সত্য, সেই সব যথেচ্ছারী, দাসচরিত্র অত্যাচারী সম্মানের জন্য ছেলের লালায়িত হওয়া ঘৃণার বিষয়। অসন্তুষ্ট পীড়িত-প্রাণ মানুষের উপর কর্তৃত্ব করতে ঘৃণা বোধ কর উচিত।
এক ভাই পড়ে গেলে বা আঘাত পেলে অন্য ভাই যেন তাকে সহানুভূতি দেখায়। ভালবেসে সহানুভূতি দেখাতে শিক্ষা দেবে।
ছেলেপেলে যদি পড়ে যায় বা হাত কেটে ফেলে, তাহলে ওমা কি হল বলে কেঁদে উঠ। কী হয়েছে, কিছু হয় নি, তুমি তো বীর-এইরূপ ধরনের কথা বলা ভালো। ছেলেপেলেকে মোটা কাপড় তৈরি করে দেবে। মোটা তহবন বা পাজামা ভালো, তারা যদি ময়লা কাপড়ে বেড়ায় তাহলে লজ্জাবোধ করা উচিত নয়। শিশুদের ময়লা কাপড়ে থাকার দোষ নেই। ১৪/১৫ বৎসর পর্যন্ত ছেলেমেয়েকে মোটে বাবু হতে না দেওয়া উচিত। সঙ্গীদের চটক দেখে অনেক সময় আবদার করবে, কিন্তু সে আবদার সহ্য করতে হবে।
বছর বছর ঈদের সময় কিছু কিছু ভালো জিনিস কিনে দিও। বিলাসদ্রব্য মোটেই ব্যবহার না শিখান ভালো। ছেলেমেয়েকে ভালো খেতে দিও-বাবু হবার পথ পরিষ্কার করে দিও না। কাপড়-চোপড় পরেই মানুষ শ্ৰেষ্ঠ হয় না–একথা তাকে মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত। কোনো ভালো কাপড়-চোপড়পরা লোকের সামনে ছেলেমেয়েরা অনেক সময় নিজেদের দীন মনে করে–এটা খারাপ। ছেলের মনের শান্তি যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে সেদিকে লক্ষ থাকা আবশ্যক।
ছেলের বিয়ে হলে প্রস্তাব করবার আগেই ছেলেকে বিদেশে বউ নিয়ে যেতে বলবে। সংসারের অবস্থা খারাপ হলে বা অন্য কারণ থাকলে সেয়ানা ছেলে নিজে যা কর্তব্য মনে। করে, করবে।
সংসারের অবস্থা ভালো হলে দরিদ্র ছেলের উপর ট্যাক্স বসিও না। ছেলের কর্তব্য বুদ্ধির উপর নির্ভর করবে; সেয়ানা ছেলের সঙ্গে মারামারি ঝগড়া করলে ফল খারাপ হয়। অবস্থা ভালো হলে, ছেলেকে দুই-চার টাকার জন্য গোলামি করে, উৎকোচ নিয়ে নীচতার পরিচয় দেওয়ার চেয়ে বাড়ি থেকে স্বাধীনভাবে শাক-ভাত খাওয়া ভালো।
বিবাহিত ছেলে দূরদেশে থাকলে হামেসা বাড়ি আসবার জনে পীড়াপীড়ি করো না; কারণ বড় লোক না হলে ভ্রমণ খরচা সংগ্রহ করাও তার পক্ষে অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। সম্ভব হলে নিজে যেয়ে ছেলের কাছে থাকবে।
বাল্যকাল হতে ছেলেকে গৃহস্থালীর কাজ শিক্ষা দেওয়া উচিত। মাঝে মাঝে সংসারের চাপ তার ঘাড়ে দেওয়া ভালো। ভুল হবে বলে ভীত হতে নেই, সংসার কার্যে অভিজ্ঞতা থাকলে ভবিষ্যতে বিপন্ন হতে হয় না।
বিদেশে ছেলেকে শান্তিহীন পত্র দিও না। পত্রের ভাষা সর্বদা মিষ্টি ও মধুর হওয়া উচিত। মুখে যাই বল, পত্রে কোনো কু-কথা লিখো না। ছেলে যখন স্কুলে পড়তে থাকে তখন তাকে সাংসারিক বেদনা ও অপর অভিযোগের কথা কিছু বলো না, তাতে তার পড়ার ক্ষতি হবে।
শীতকালে ছোট ছেলেমেয়েরা আলস্যে গায়ে কাপড় দেয় না, ফলে পড়বার সময় ভালো পড়তে পারে না; অসুখ হয়। সন্ধ্যার সময় যাতে ছেলেমেয়েরা গায়ে জামা দেয়, তা দেখবে।
ছেলেমেয়েকে খুব বাল্যকালে মুখে মুখে দোয়া দরুদ শেখাতে হয়, নইলে জীবনে আর তা শেখা হবে না।
শিশু পড়া না বুঝলে বা না পড়লে উগ্র হয়ো না, বারে বারে বুঝিয়ে দিতে হবে। তোমার উগ্রমুখ দেখে ছেলেমেয়েও লোকের সঙ্গে কথা বলবার সময় উগ্র ও কঠিন হয়ে উঠবে, যা অত্যন্ত দোষের। তার বুদ্ধিও লোপ পাবে।
ছেলেমেয়েকে পড়বার সময় নিজে আগে আগেই পড়া বলে দিও না। তাকে জিজ্ঞাসা করবে, তার চিন্তাশক্তি জাগিয়ে তোলবার জন্য তাকে উত্তর দেবার সময় দেবে সেই পড়বে, নিজে বেশি কিছু বলো না, তাতে ছেলেমেয়ের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি অবশ হয়ে যায়।
অপরিণত বুদ্ধির ছেলেমেয়ে যদি তার শিক্ষক বা অভিভাবকের নিন্দা করে তা বিশ্বাস করো না।
অনেক মেয়েলোক সতীনের ছেলেমেয়েকে নানা রকমে ছোট হীন করতে চেষ্টা করেন। স্বামী যদি ভুল করে আবার বিয়ে করে, তবে তাকে ভালবেসে ঘরে তুলে নিও। ঝগড়া-বিবাদ করা উচিত নয়। নিজের দুঃখ নিজের মধ্যে পুষে রাখাই ভালো। কিছু প্রকাশ করো না। সতীনের ছেলে মেয়েকে ঘৃণা করো না, চিরদিন সমান যায় না। সতীনের দাবিকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করা অমানুষের কাজ।
বাড়ির ছেলে-মেয়েরা অনেক সময় শিয়রে বাতি জ্বালিয়ে শুয়ে থাকে এতে অনেক সময় বিপদ হয়।
কোনো কোনো ছেলেমেয়ে ভালো জিনিস খেয়েছে বলে অন্য ছেলেমেয়েদের কাছে বড়াই করে। কাপড়ের, আহারের বংশের মর্যাদা ও ধনদৌলতে বড়াই করতে দেখলে ছেলেমেয়েকে গালি দেবে। এটা বড় দোষের কথা, পতনের পূর্ব সূচনা।
ছেলেমেয়ে কোনো অপরাধ করলে নিজে যাই বল না; কখনও পরের কাছে তার নিন্দা করো না। অপরের কাছে ছেলেমেয়ের চরিত্র সমালোচনা করলে নিজেরও সম্মান নষ্ট হয়। ছেলেমেয়েকেও বড় বেদনা দেওয়া হয়। সে ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহী ও হীন হয়ে যায়।
ছেলেমেয়েদের দুপুরবেলা বাড়ির উঠোনে বা সন্ধ্যাকালে ঘরের মধ্যে বা বিছানার উপর চীৎকার লাফালাফি ও মারামরি করতে দেবে না। সোরগোল ও লাফালাফি করবার জন্য স্থান না থাকলে, উঠোনেই করবে।
শিশুরা অনেক সময় পথের উপর এবং পুকুরের ভিতর পায়খানা করে শুচি হয়-এর জন্য সাবধান থাকবে।
ছেলেমেয়েরা অনেক সময় বাইরে জুতো-কাপড় ফেলে আসে সেদিকে মায়ের লক্ষ থাকা চাই। যখন ছেলেমেয়ে বাড়িতে ঢোকে তখনই তার দিকে তাকিয়ে দেখো, যে জিনিস নিয়ে বাইরে গিয়েছিল তা নিয়ে ফিরে এসেছে কিনা।
ছেলেমেয়েকে হিম, ঝড়, বৃষ্টি, বাতাস, সহ্য করাতে একটু শিক্ষা করানো ভাল। একেবারে ননীর পুতুল করে তোলা অন্যায়। একটু বাতাসে ছেলের ঠাণ্ডা না লাগে, একটু বৃষ্টিতে ছেলের নিউমোনিয়া যেন না হয়।
ছেলেমেয়েদের যদি হজম হয় তাহলে যত পার খেতে দেবে। বাল্যকালে শরীর যদি একবার ভালো হয়ে যায়, তাহলে সে শরীর আর কোনো কালে নষ্ট হবে না। শিশুদের মাংস, দুধ ও যথেষ্ট ডিম খেতে দেবে। এতে তাদের শরীরে শক্তি হবে। ছোট শিশুকে যথেষ্ট দুধ প্রভৃতি পুষ্টিকর খাদ্য খেতে না দিলে কালে শরীর ভেঙ্গে যায়, অনেক সময় স্বাস্থ্য হারিয়ে মরে যায়। সংসারের অবস্থা ভালো না হয় তাহলে ছেলেমেয়েদের খাবারের জন্য স্বামীকে কিছু বলবে না। অবস্থা ভালো হলে শুধু ছেলেমেয়ে বলে নয়, সকলেই ভালো খাওয়া উচিত! জীবন ধারণের জন্য ভালো টাটকা মাছ, মাংস, ঘি, দুধ ও ডিম প্রধান সহায়; শুধু মাছ ও শাক খেয়ে বেঁচে থাকা কঠিন; মাংসের পরে দুধ খেতে নেই। ছেলেমেয়ে সেয়ানা হলে তাদের স্বতন্ত্র থাকবার জায়গা করবে। তাদের প্রতি তাতে অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয় না।
ছেলেমেয়ের সামনে তৃতীয় ব্যক্তির চরিত্র সমালোচনা করবে না। ছেলে মেয়েরা মায়ের কাছ থেকেই পরনিন্দা ও পরিচর্যা শেখে। ছেলেমেয়েরা যার যার কাপড় জামা সেই যেন ব্যবহার করে। একজনের জামা কাপড় নিয়ে যেন অন্যে টানাটানি না করে।
ছেলেমেয়েরা আলস্য করে শীতকালে স্নান করে না। স্নান না করলে মনের অবনতি ঘটে।
ছেলেমেয়েকে গালি দিতে হলে সর্বদা সভ্য ও ভদ্র ভাষায় দেবে। ছেলে মেয়েরা অভদ্র। নীচু ভাষা বাপ-মার কাছ থেকেই শেখে।
শিশুদের জন্যে মায়ের পার্শ্বে আলাদা বিছানা ও লেপের ব্যবস্থা করবে, তাতে তারা মাকে কম বিরক্ত করবে।
রাত্রি ১০টা হইতে প্রাতঃকাল পর্যন্ত শিশুদের মোটেই কিছু খেতে না দিতে অভ্যাস করবে। ভয়ের কোনো কারণ নেই, বরং শরীর ভালো থাকে। খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে তাদের জন্যে একটা নিয়ম থাকা চাই। নিয়ম করে নিলে পূর্বে যে ফিডিং বোতলের কথা বলেছি, সে সব জঞ্জালের দরকার হবে না। কাঁদলেই মুখে মাই দিতে হবে, তার কোনো মানে নেই।
ছোট শিশুকে ছয় মাস বয়স হতেই কাপড় পরাতে হবে, নইলে ভবিষ্যৎ জীবনে তার স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়।
শিশুদের নাকে শ্লেষ্ম জমলে তখন তখন মুছিয়ে দেবে, সেই অবস্থায় তারা যেন কারো কাছে খাবার না চায়।
বড় ছেলের দেখাদেখি ছোট ছেলেমেয়েরা অনেক সময় পানিতে নেমে পড়ে। ছোট ছেলেমেয়েকে পানির কাছে না যেতে দেওয়া উচিত। পানির মধ্যে ছেলেদের উৎসাহ ক্রীড়াও না দেখতে দেওয়া উচিত।
ছোট ছেলেমেয়ে জামা-কাপড়ে পেশাব করলে তখন তা শুকাতে দেবে, ফেলে রাখবে না।
প্রতিবেশী বাড়িতে মুরগী বা ছাগল জবেহ হতে থাকলে ছেলেমেয়েরা সেখানে যেন আনন্দ না করে।
ছেলেমেয়েদের মধ্যে বড় ভাই বা বোনের, ছোটদের সামনে যাতে অসম্মান না হয়। সেদিকে নজর চাই। বড় ভাই অন্যায় করলে তার শাস্তি হবে না তা বলছি না; একটু আড়ালে হওয়া ভালো।
ছেলে-মানুষ বোঝে নাবড় হলে সেরে যাবে একথা ছেলেমেয়ের সামনে কখনও বলবে না।
শিশুর নাগালের বাইরে ঘরের জিনিসপত্র রাখবে; ছোট ছেলেমেয়ে জিনিস নষ্ট করে ফেলবে তার জন্য বচসা করা বৃথা। অতি ক্ষিপ্র হস্তে তাদের হাত থেকে জিনিস-পত্র কেড়ে নেবে। দেরি করলেই বিপদ!
স্ত্রীর অসাবধানতায় শিশুরা অনেক সময় অনেক ক্ষতি করে।
ছেলেমেয়েরা কারো অসাক্ষাতে বা কারো কথা বলতে হলে, যেন অসম্মানের সঙ্গে না বলে। ‘গিয়েছে’, ‘এসেছে’, ‘বলেছে’–এরূপ করে না বলে ‘গিয়েছেন ‘এসেছেন’ এরূপ করে বলতে বলবে।
ছোট শিশুকে স্কুলে ৫/৬ ঘণ্টা আবদ্ধ করে না রাখতে দিয়ে, যদি বাড়িতে রাখা যায় তাই ভালো। বাড়িতে কু-সঙ্গের ভয় থাকলে স্কুলেই পাঠাতে হবে। অবস্থায় কুলোলে সারাদিন ছেলেদের নিয়ে থাকবার জন্য বাড়িতে একজন শিক্ষক রেখে দেওয়া উচিত। শিশু সারাদিন পড়বে বা এক জায়গায় অধিকক্ষণ আবদ্ধ হয়ে থাকবে সে জন্যে নয়।
শিশুকে খেতে দেবার সময় কখনও জিজ্ঞাসা করো না–কী খেতে চাও মাছ খাবে, না ভাজি খাবে, না দুধ খাবে–এরূপ ধরনের কথা জিজ্ঞাসা করতে নেই। যা ইচ্ছা খেতে দেবে। সব জিনিস খেতে দিলে কি ক্ষতি? অমুক জিনিস খাবে, না অমুক জিনিস–বললে ছেলেমেয়ে খারাপ মেজাজের হয়ে ওঠে।
ছেলেপেলেকে অনবরত সমালোচনা করবে না। হরদম তাম্বি করলে, ভুল ধরলে, তার ব্যক্তিত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। তাকে স্বতন্ত্র রকমের জ্ঞান ও উপদেশ দেওয়া বেশি ভালো। তার ভিতরের অন্যায় ও খারাপ কাজের প্রতি ঘৃণা কর। নিজের সংশোধন সে নিজে করবে। এ নীতি সকলের সম্বন্ধেই সত্য।
ছেলেমেয়েকে বেশি ঔষধ খাওয়ান দোষ। তাতে তার স্বাস্থ্যভঙ্গ হতে পারে।
মেয়েলোকের প্রশ্রয় পেয়ে অনেক সময় ছেলেমেয়েরা তামাক খেতে শিখে একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। কোনো সন্তানকে সামনে তামাক খেতে দেখলে, উগ্র হয়ে ওঠা উচিত।
ছেলেমেয়েরা কারো নিন্দা করলে চোখ গরম করবে। তাদের কথা বিশ্বাস করা মূর্খতা।
“তুমি মিথ্যা বলেছ”-এরূপ কথা ছেলেমেয়েদের সামনে কখনও বলবে না। ছোট ছেলেমেয়ে হোক, বড় ছেলেমেয়ে হোক, তাদের স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ নজর রাখবে। সন্তানের অসুখ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে কখনও কৃপণতা করো না। দরিদ্র পরিবার হলে স্বতন্ত্র কথা।
সন্তানের কাজের কখনও কঠিন সমালোচনা করো না, তাতে খারাপ ফল হয়। অন্যায় কাজ করলে প্রথমে শুধু অসন্তোষ প্রকাশ করাই নিয়ম।
সন্তানকে স্কুলে দিয়ে সর্বদা শিক্ষকের কাছ থেকে দৈনিক পড়া সম্বন্ধে সংবাদ গ্রহণ করতে ভুলবে না।
ছেলেমেয়ে যদি পড়াশুনা ভালো না চালাতে পারে; তাহলে তাকে নিচের সহজ বই পড়তে দেবে। ধৈর্য হারিয়ে শক্ত বই পড়তে দিয়ে কখনও তার জীবন মাটি করো না।
ছেলেমেয়ে অল্প নম্বর পেয়ে প্রমোশন পেলে তাদের নিচেই বই পড়তে দেবে। উপরে যেতে দিবে না।
যদি সন্তানের বুদ্ধি কম বলে মনে হয়, তাহলে এক বৎসর বা দু বৎসর তাকে নানা প্রকার শিশু পাঠ্য বই পড়তে দিও। তার ভিতরে বিবেক ও বিচক্ষণতার সৃষ্টি হবে। ফলে তার কঠিন বিষয় বোঝবার ক্ষমতা লাভ হবে।
বন্ধের সময় ছেলেপেলেকে বাড়ি আসবার জন্য চাকর থাকলে চাকর পাঠিয়ে দেবে বা কোনো লোক পাঠাবে।
অবশ্য নিতান্ত খারাপ না হলে, ছেলেকে কখনও পরের বাড়ি থেকে পড়তে দিও না। এতে ছেলের মন ছোট হয়ে যায়; ভবিষ্যৎ জীবনে তার কর্ম করবার বা সাহস করে সত্য কথা বলবার ক্ষমতা থাকে না। বিদেশে সন্তানের খাওয়া-দাওয়া, সুখ-সুবিধার দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা চাই।
সন্তানের জন্য বাড়িতে যদি শিক্ষক থাকেন, তবে তাকে অসম্মান করো না; নিরন্তর তার কাজকে সমালোচনা করে তার ব্যক্তিত্ব নষ্ট করো না। সন্তানের সামনে মাষ্টারকে অসম্মান করলে ছেলেমেয়ের লেখাপড়া হবে না।
ছোট শিশুর জন্য পাহলোয়ানদের মতো ৮/১০টি নেংটি তৈরি করে নিও। শিশু সন্তান কাকেও নেংটা থাকতে দেবে না। ছোট ছেলেমেয়েদের সর্বদা নেংটি পরতে বাধ্য করা উচিত। এতে ছেলেমেয়েদের নৈতিক শক্তি বাড়ে।
ছেলেমেয়েরা খাওয়া-দাওয়া নিয়ে যেন মোটেই কামড়া-কামড়ি না করে, এক ভাই বোন আর এক ভাই বোনকে না দিয়ে নিজে খেতে চেষ্টা করলে তাকে বলবে, নিজে না খেয়ে পরকে খাওয়াই ভালো। বার বার সন্তান যদি খাওয়ার ব্যাপারে নীচতার পরিচয় দেয়, অন্য ভাই বা বোনদের কথা না ভেবে নিজের পেটের কথা বা নিজের সুবিধার কথা। বেশি ভাবে, তাহলে তাকে প্রহার করবে। সন্তান যদি হাঁড়ি বা পেয়ালা হতে সব মাছ বা ডিম তুলে খেয়ে শেষ করতে চায়, তাহলে থাকে নিষেধ করবে। পরের কথা না ভেবে, নিজের বিষয়ে বেশি করে ভাবার অভ্যাস ভালো নয়, এতে বড় হলে সে নীচ ও স্বার্থপর হবে। অনেকে মনে করে ছেলেমেয়ে বড় হলে তার সকল দোষ সেরে যাবে, এটা ঠিক কথা নয়।
সন্তান সেয়ানা হলে তার চিন্তা ও ভাবকে অবহেলার চোখে দেখো না। তাকে সম্মান করবে। ছেলেমেয়ে যা হতে চায়, তাতেই তাকে উৎসাহ দেবে, নইলে সন্তানের জীবন মিথ্যা হয়ে যাবে। অনেক বাপ-মা সন্তানকে জোর করে নিজের ইচ্ছামতো পথে চালাতে চান, এর শেষ ফল খারাপ। সন্তান বড় হলে সে বুদ্ধিমান হয়, কিন্তু কোনো মাতা-পিতা সন্তানকে চিরকালই বোকা ও অপদার্থ মনে করেন। ছেলেমেয়ে বুদ্ধিমান হলে বাপ-মার সন্তুষ্ট হওয়া উচিত। চিরকাল সন্তান বোকা থাকবে এরূপ মনে করা অন্যায় এবং বাপ-মার পক্ষেই অগৌরবের বিষয়। সন্তানকে অনবরত বোকা বললে বাস্তবিক সে বোকা হয়ে যায়, তার মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়।
বাপ-মায়ের উৎসাহ পেলে সন্তান সাগর লঙ্ঘন করতে পারে। বাপ-মার বুদ্ধির দোষে আবার বহু বড় বড় জীবন মাটি হয়ে যায়।
সন্তান যা করতে চায় না, যা হতে চায় না, তা করতে বা হওয়াতে বাধ্য করো না। সন্তানের কোনো সঙ্কল্প সাহায্য করবার আগে তার সঙ্কল্প সত্য ও দৃঢ় কিনা দেখতে হবে। সঙ্কল্প ও কাজ আলাদা কথা। ছেলেমেয়েরা অনেক সময় মিথ্যা উৎসাহ প্রকাশ করে থাকে।
সন্তান যদি চরিত্রবান হয়, সে যদি উৎকোচ গ্রহণ করতে ঘৃণা বোধ করে, সে যদি গোলামি করতে না চায়, তবে অসন্তুষ্ট হয়ো না।
সে কিন্তু দরিদ্র হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু ছোট ও অবহেলিত হয়ে থাকা ভালো লোকের ধর্ম নয়। বড় হওয়া তার স্বভাব। সে বড় হবেই।
সন্তান ঘুষখোর ও শয়তান নীচ-হৃদয় ও গোলাম না হলে যে বাপ-মা অসন্তুষ্ট হন, তারা বড় ছোট।
কুলসুম বলিলেন-বাপ মার দোষেই জগতের পনর আনা দোজখে যাবে। মানুষের নৈতিক অধঃপতন কারণ মাতাপিতার নীচ প্রবৃত্তি ও জঘন্য রুচি।
কতকগুলি লোক আছেন, তাঁরা বলে থাকেন–মুক্তির প্রধান কারণ পিতৃ-মাতৃ ভক্তি। এ কথা কিন্তু সর্বদা মিথ্যা। পবিত্র, জীবন, জ্ঞান এবং সূক্ষ্ম কর্তব্য-বোধই মুক্তির শ্রেষ্ঠতম দাবি। মাতা-পিতাকে ভক্তি করতে যেয়ে যদি নিজের মাথায় মূর্খতা পতন ও পাপের ডালি তুলে নিতে হয় তবে সেরূপ ভক্তিতে কী লাভ? তুমি চোর বদমাইশ অত্যাচারী ও মূর্খ–তোমার পিতৃ-মাতৃ ভক্তির মূল্য কি? তুমি যদি মানুষ হও তোমাকে শ্রেষ্ঠ পিতৃ-মাতৃ ভক্ত বলা হবে।
মাতা-পিতার দুর্বলতা সন্তানের যথাসম্ভব মেনে নেওয়া উচিত। সেটাও কম মনুষ্যত্ব নয়, উগ্রভাবে তাদের সঙ্গে তর্ক করা অসভ্যতা। শান্তভাবে ভালো উদ্দেশ্যে কথা বলা যেতে পারে।
মাতাপিতাকে অন্যায় রকমে কষ্ট দেওয়া পাপ এবং কাপুরুষতা।
সন্তান বয়স্ক হলে যদি সে কোনো অন্যায় করে ফেলে, তবে কোনো কথা বলো না। সে যদি কোনো ভুল করে ফেলে, তাকে উৎসাহ দিয়ে বলবে–কিছু হয় নাই–চল অগ্রসর হও। সন্তানের ভুল তার গতিরোধ করবে না। শিক্ষিত ছেলে যে পথে হাঁটতে চায়, তাকে সেই পথে ভীম বেগে চলতে বলবে। উৎসাহ দেবে, তাকে পাগল বলো না, তাতে নিজের ‘ এবং ছেলের দুয়েরই ক্ষতি হবে। সন্তান যা বলে, যা ভাবে তা সত্য কি না ভেবে দেখো! সন্তান যদি তোমার চেয়ে অপেক্ষাকৃত জ্ঞানের কথা বলে, তবে আনন্দ প্রকাশ করবে।
সেয়ানা সন্তানকে জ্ঞানদানে মাতাপিতা বন্ধু মনে করেন, সন্তানকে সম্মান করেন–তাতে তাঁদের অসম্মান হয় না। সন্তান তো নিজেরই প্রতিকৃতি।
কি বড় কি ছোট–কাউকে প্রথমে কঠিন ভাষা বলো না। শুধু সন্তান বলে নয়–প্রথম সম্বোধনেই কারো সঙ্গে কঠিন কথা ব্যবহার করতে নেই। বেশি কঠিন কথার ফল সম্পূর্ণ বিপরীত হয়। প্রথমে গম্ভীর হয়ে শুধু নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করবে–অপরাধী তাতেই শরমে মরে যাবে।-শেষ মুহূর্তে বা নিতান্ত অপারগ হলে-কঠিন কথা বলো বা একটা কঠিন ব্যবহার করো। যে নিতান্ত নরপিশাচ, কঠিন কথা না বলে তার সঙ্গে সম্বন্ধ ত্যাগ করা উচিত।
ছোট ছেলেমেয়ের সম্মুখে কখনও দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে কথা বলো না-শান্ত, ধীর ও গম্ভীরভাবে কথা বলা উচিত। মুহূর্তে মুহূর্তে সন্তানের সঙ্গে রাগ করলে, তাদের মন বড় না হয়ে ছোট হতে থাকে। বাপ-মার কাছ থেকে ছেলেমেয়েরা যে রূপ ব্যবহার পায় তারাও লোকের সঙ্গে তেমনি ব্যবহার করে।
সন্তানকে মাঝে মাঝে মেঝেতে খাড়া করে দিয়ে বক্তৃতা দিতে বলবে। মায়ের চেষ্টা ও ইচ্ছায় সন্তান কালে একজন ভালো বক্তা হতে পারে। বক্তা হওয়া জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ। যারা বক্তা নয়, তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাপুরুষ হয়ে পড়ে। সত্য কথা বলবার সাহস সঞ্চয় করা প্রত্যেকের জন্য ফরজ।
সন্তানকে বক্তা করে তোলা বড় উত্তম। এজন্য সাধনা চাই। বক্তৃতাকালে ধীর ও স্বাভাবিক হলেই সফল হওয়া যায়।
ছেলেমেয়েদের ১০-১২ বৎসর বয়স হলে অর্থাৎ কিছু বুদ্ধি হলে, তাদের সভার উপদেশপূর্ণ বক্তৃতা শোনাবে। পাড়া-প্রতিবেশী ছেলেমেয়েকে একত্র করে যদি তাদের মধ্যে উপদেশপূর্ণ বক্তৃতা দেওয়া যায়, তাহলে যে উপকার হয়, তা দশ বছর বই পড়িয়ে হয় না। ছোট বড় সকলের কাছেই বক্তৃতা উপকারী।
সন্তান যদি কারো বিরুদ্ধে নিন্দা করে, তবে হঠাৎ তা বিশ্বাস করা ঠিক নয়। তার অভিযোগ যদি সত্য বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে বিবেচনা করে যা করতে হয় করবে।
তামাসা বা খেলার ছলে, সন্তানকে মুহূর্ত বিলম্ব না করে আজ্ঞা পালন করতে অভ্যস্ত করবে। ছোট ছেলেমেয়ে তখন আজ্ঞা পালন না করলে, অনেক সময় বিলম্ব না করে শাস্তি দেওয়া উচিত। একটু বড় হলে এ নিয়ম খাটে না, বারে বারে শাস্তিদান এবং ক্রোধ প্রকাশ নিষেধ।
ছেলেমেয়ে তামাক খেলে, সেজন্য বেদম প্রহার করো না-তাকে বলবে এ কাজটা খারাপ। ছেলেমেয়ের এরূপ কাজ খুব দুঃখের বিষয় বটে, কিন্তু বেদম প্রহার করলে তার চরিত্রের আরও পতন হতে পারে। সে ভাববে, না জানি এইসব কু-জিনিসে কি মধু না আছে।
ছেলেপেলেকে তামাক সাজতে বলা বা হুক্কা আনতে বলা নিষেধ।
ছেলেমেয়েদের বসন্ত প্রভৃতি ছোঁয়াচে রোগে অধীর হয়ে অবিবেচনার পরিচয় দেওয়া উচিত নয়। সর্বদা স্বতন্ত্র করে রাখবে।
হোমিওপ্যাথিক ‘ভরিওলিনাম’ নামক ঔষধ খেলে বসন্ত হয় না।
সন্তানকে গালি না দিয়ে বা লজ্জা না দিয়ে কাজটা অন্যায় তা বলে দিতে হবে। এ সব ব্যাপারে শাসন বা গালি শিক্ষকদের হাত হতেই হওয়া উচিত।
মেয়েদের সাজসজ্জা করতে দোষ নেই, বরং না করাই দোষের।
ছেলেমেয়ের শিক্ষক দুর্বলচিত্ত হলে ছেলেমেয়েদের চরিত্রের উন্নতি হয় না। যে শিক্ষক-শিক্ষিকা সন্তানকে শাসন করতে ভয় করেন না, যে শিক্ষক শিক্ষয়িত্রী ছাত্র-ছাত্রীর মাতাপিতাকে ভয় করেন, সে শিক্ষক-শিক্ষিকার দ্বারা সন্তানের ভালো শাসন হয় না।
ছেলেপেলে যেন মায়ের বিনা অনুমতিতে কখনও কোথাও না যায়। ইচ্ছামতো ছেলেমেয়েরা যেখানে সেখানে গেলে, তাদের স্বভাবে নানা দোষ ঢুকবার সম্ভাবনা। দোষ ঢুকুক, চাই না ঢুকুক, বিনা অনুমতিতে ছেলেমেয়েদের বাইরে ঘুরে বেড়ান দোষের। ছেলেমেয়েদের জন্য বাড়িতে কতকগুলি আকর্ষণ সৃষ্টি করতে হবে, মিষ্টি ভাষায় বাড়িতে থাকতে বলা চাই, এজন্য হরদম তাম্বি নিষেধ।
উত্তম পুষ্টিকর খাদ্য হলে, অল্প ব্যায়ামেই শরীর ভালো থাকে। ছেলেমেয়ের আহারের প্রতি বিশেষ নজর চাই। সকলের জন্যেই পুষ্টিকর খাদ্য আবশ্যক-নইলে শুধু ব্যায়াম করলে শরীর থাকে না। পুষ্টিকর খাদ্য না খেয়ে, কঠিন ব্যায়াম করলে কঠিন পীড়া হয়। অবসন্ন পেশিগুলো খাদ্য না পেলে হৎপিণ্ড ও ফুসফুস হতে অন্যায় রকমে খাদ্য সংগ্রহ করে। ফলে হৃৎপিণ্ড ও শরীরের অতি উপকারী যন্ত্রগুলি দুর্বল হয়ে ব্যাধি আক্রমণের পথ প্রশস্ত করে দেয়। মাংস ডিম, দুধ, ঘি, এই সবই ভালো খাদ্য। মুরগি ও পায়রার মাংস উপকারী। বাজারের মিষ্টান্ন খেয়ে লাভ নাই। পুষ্টিকর খাদ্য ব্যতীত স্বাস্থ্য রক্ষা করা সম্ভব নয়। ওষুধ খেয়ে শরীরকে শক্তিশালী করবার চেষ্টা মূর্খ।
ছেলে-মেয়েকে মাঝে মাঝে বাপ, মা এবং বড় ভাই-বোনকে আদর করে খাওয়াতে শিক্ষা দেওয়া ভালো। এতে শিশু উদার-হৃদয় ও পরার্থ হয়ে উঠবে। নিজের সুখের কথা
অপেক্ষা অন্যের সুখের কথা ভাববার অভ্যাস বাপ-মাকেই শিক্ষা দিতে হবে।
সন্তান কারো কাছে অপরাধ করলে সে যদি বিচার প্রার্থনা করে, তবে নিজের সন্তান বলে কখনও তাকে মাফ করো না। ছেলেমেয়ে কু-কাজে অনেক সময় প্রশ্রয় দিয়ে সর্বনাশ করেন। মায়ের দোষে বহু সন্তানের জীবন মাটি হয়ে যায়। কেউ সংশোধন করতে পারে না। ছেলেপেলেদের সব ভাই-বোন সব সময় এক সঙ্গে বেড়ান উচিত। যার যার মতে বেড়ালে বিশেষ ভয়ের সম্ভাবনা। দলে দলে একসঙ্গে বেড়ালে কু-পথে যাওয়ার ভয় থাকে না।
সন্তানদের পতন আরম্ভ হয়েছে এরূপ সন্দেহ হলে তাদের সহানুভূতিভরা প্রাণে বলবে–তুমি সুন্দর, তুমি পবিত্র। তোমাকে কি কেউ দুষ্ট কথা বলে থাকে, বাপ?–তোমাকে। কি কেউ খারাপ কাজ করতে বলে? সেই সব দুষ্টদের তুমি ঘৃণা করো, কারণ, তুমি ভালো–তাদের চেয়ে বড়। মানুষ অনেক সময় কু-কাজ করে–নিরুপায় হয়ে মানসিক শক্তির অভাবে যদিও সে কাজকে ঘৃণা করে। বন্ধুর মতো সন্তানের ভিতরে পাপ ও অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করবে। তার মানসিক শক্তিকে সহানুভূতির দ্বারা প্রবল করে তুলতে হবে। তখন তখন সন্তান সংশোধিত হতে না পারে, কিন্তু সে ফিরে আসবেই। গম্ভীরভাবে বন্ধু বেশে পাপ হতে ছেলেপেলেকে রক্ষা করবার জন্য তাদের পার্শ্বে দাঁড়াতে হবে।
সন্তানের অভিমান ও ক্রোধ দেখে অনেক সময় ধৈর্য ধারণ করা উচিত। সন্তানেরা পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধার সঙ্গে কথা বলবে—’তুই-তুই’ বা ‘রে-রে’-করে কথা বললে বিরক্তি প্রকাশ করবে।
মানুষের পেছনে বিক্রম প্রকাশ করতে ছেলেমেয়েদের নিষেধ করবে, যা বলার আছে। তা সামনে প্রকাশ করার জন্য বলবে। –বড় ছেলে বা মেয়েদের কথা ও কাজ সমালোচনা করা নিষেধ। তাতে তাদের উন্নতি না হয়ে ক্ষতি হয়। সোজাসুজি তখন তখন দোষের অনবরত সমালোচনা হতে থাকলে, বিশেষ লাভ হয় না। বরং এরূপ সমালোচনাকে বড় হীনআসন পেতে হয়। মানুষের ভিতরে স্বতন্ত্র রকমের অন্যায়ের ঘৃণা সৃষ্টি কর, দোষের কথা মোটই না ভেবে, তাকে শুধু জ্ঞান দিতে থাক, তাকে মহত্ত্ব ও পুণ্যের কথা শুনাও, তাকে ভালবাস, তাকে লেখাপড়া শেখাও তার মনকে উন্নতি করতে চেষ্টা কর, তার ভুল আপনা আপনি ঝরে পড়বে। মানুষকে এই ভাবেই বড় করা যায়।
ছেলেকে বর্তমানযুগে ব্যবসায়ী করতে চেষ্টা করা উচিত। শুধু রাজকর্মচারী ছাড়া দেশের আর কারো সম্মান নেই, একথা মনে করা ভুল। সাধারণ দেশবাসী ও ব্যবসায়ীদের সম্মান রাজকর্মচারীদের চেয়ে বেশি একথা আমাদের দেশের লোক বোঝে না। কারণ আমরা ছোট, আমরা ছোট হয়ে গিয়েছি, তাই আমরা নিজকে নিজে বড় মনে করতে শিখি, নাই। রাজকর্মচারী দেখে ছেলে-মেয়ে যেন ভয়ে কাঁপতে না থাকে, রাজকর্মচারীদের সঙ্গে ছেলে করমর্দন করবে, তাদের সেজদা করতে ছেলেমেয়েকে একদম নিষেধ করবে। রাজকর্মচারীরা দেশের লোকের চাকর-একথা ছেলেমেয়েকে বলে দিতে হবে। স্বাধীনভাবে ব্যবসা করে ছেলে কোটি কোটি টাকা উপায় করতে পারে–এরূপ বিশ্বাস মনে পোষণ করা উচিত। একটা ছোট হীন দারোগাগিরি চাকরির জন্য লালায়িত হওয়া রোজা করা কি দারুণ অসম্মানের কথা নয়? সন্তানেরা চাকরির জন্য কাউকে খোশামোদ করো না। নবাব সাহেব বা নবাব সাহেবের বেগমের সাথে সই পাতিও না।
সন্তানদের গায়ে খুব বেশি ছেঁড়া-ফাটা জামা না দেওয়াই উচিত-এটা দীনতার বিবৃত চিত্র।
বৎসর শেষে প্রমোশনের সময় ছেলেমেয়েরা বই কেনার নাম করে অনেক টাকা নিয়ে যায়। তা ছাড়া অন্য সময়েও সন্তান একথা ওকথা বলে ফাঁকি দিয়ে মার কাছ থেকে টাকা চায়। উপযুক্ত কারণ থাকলে টাকা না দেওয়া ভালো নয়। ষোল সতেরো বছরের সন্তানকে স্বাধীনভাবে টাকা পয়সা নিয়ে কোথাও থাকতে দেওয়া অনুচিত।
সন্তানকে সর্বদা সত্য কথা বলতে উৎসাহ দেবে। শত অপরাধ করেও সত্য সন্তান যদি সত্য কথা বলে, কিছু বলো না, চুপ করে থেকো।
সন্তান যদি লজ্জাজনক কাজ করে ফেলে, তাহলে তার সঙ্গে বিশেষ রাগারাগি করো না, বুঝিয়ে দিও। এরূপ কাজ অন্যায় ও খারাপ। সন্তান যাতে লজ্জা পায় এরূপ কাজ করা মাতা পিতার কর্তব্য নয়। ছেলেমেয়ের নিন্দা ও কুৎসা কখনও তৃতীয় ব্যক্তির নিকট করো না।
ছেলে শিক্ষার জন্যে যেমন আমরা ব্যস্ত হই মেয়ের শিক্ষার জন্যে তেমনি করে ব্যস্ত হতে হবে।
হিন্দুরা মেয়ে হলে ভয়ে কাঁপতে থাকে। মুসলমানদের ছেলে এবং মেয়ের কোনো। তফাৎ নেই। মেয়েকেও ছেলের মতো লেখাপড়া শিখতে হবে। আজকাল টাকার লোভে লোকে সন্তানকে লেখাপড়া শিখায়; আসলে কারো ধর্ম ভয় নেই। কোরানের হুকুমও কেউ মানে না। মেয়েকে বাল্যকালে হুনর, হিকমত এবং শিল্প শেখাবে, কি জানি ভবিষ্যৎ জীবনে তার কপাল যদি খারাপ হয়, তাহলে তাকে পথে ভাসতে যেন না হয়।
মেয়েকে অর্থ ও জমাজমি লিখে দিলেও শিক্ষা ও বহির্জগৎ সম্বন্ধে জ্ঞান ব্যতীত সে তা রক্ষা করতে পারে না। অনেক মেয়েই জানে না, কলকাতা কোনো মানুষের নাম, না কোনো স্থানের নাম। জেলা কাকে বলে, মহকুমা ও রাজধানী কাকে বলে-মেযেকে-শেখাতে হবে! ক্রিমিনাল কোর্ট, সিভিল কোর্ট থানা রেজিষ্ট্রারী অফিস কাকে বলে এসবও মেয়েকে জানান চাই। আমাদের দেশ কোথায়; পৃথিবীটা কেমন এ সমস্ত জিনিস যেন মেয়ের মনে শুধু কল্পনার, জিনিস হয়ে না থাকে। শিক্ষিতা মেয়েই মানুষের মতো মানুষ সন্তান প্রসব করতে সক্ষম।
অনেক স্থানে বোরকা পরতে হয়। বোরকা পরতে হলে লক্ষ্ণৌতে এক রকম বোরকা পাওয়া যায়, তা মেয়ের জন্য একটি কিনবে। এ বোরকা গায়ে দিয়ে পাড়াগাঁয়ের বোরকা পরিহিতা মেয়েদের ন্যায় একটা ঝুড়ির মতো চেহারা হয় না। লক্ষ্ণৌ-এর বোরকার আরও উন্নতি হওয়া আবশ্যক। এখনও তা পরে হাতে-পায়ের স্বাধীন মুক্ত ব্যবহারের সুবিধা হয় না। কিন্তু তবুও সেগুলি বোরকার আরও উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারা যায়। দেখতে মন্দ নয়। ছোট থাকতেই মেয়েকে সর্বত্র পাঠাবে। জগৎ ও মানুষের মধ্যে না গেলে। মানুষের বিকাশ হয় না লেখাপড়ার উন্নতি হয় না, জ্ঞান পূর্ণ হয়ে ওঠে না। বই পড়ার চেয়ে চোখে দেখে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। চোখে কিছু না দেখে, পুরুষ সমাজ যদি শুধু বই পড়েই বিদ্যা খতম করতো তা হলে তারা একপাল গাধা হয়ে থাকতো। বাল্যকাল হতেই মেয়েকে বাইরে শহরে, রাজধানী, কোর্টে রাস্তায় এবং সভায় পাঠাবে। অন্তঃপুরে পিঞ্জিরাবদ্ধ হয়ে থাকবার অভ্যাস যদি একবার হয়ে যায়, তাহলে জীবনে আর বের হওয়া যাবে না। বাল্যকাল হতেই মেয়েকে বাইরের সঙ্গে সংস্রব করে দেবে; সে পুরুষের মতোই একটা শক্তি হয়ে উঠবে। বর্তমান সময়ে সভ্য জাতির সঙ্গে প্রতিযোগিতা আমাদের করতে হবে, নইলে জাতি হিসাবে ছোট ও দুর্বল হয়ে পড়তে হবে, বেঁচে থাকা কঠিন হবে; উভয়কে কাজ করতে হবে; নইলে জীবন সংগ্রামে পৃথিবীর উন্নত জাতির কাছে আমরা হেরে যাবো।
চরিত্র হারাবার কোনো ভয় নেই। পুরুষ কি নিজের চরিত্র শহরে যেখানে শত বিলাসিনী রূপ মেলে পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে বীরের মতো পাপকে উপহাস করে ঘুরে বেড়ায় না?
পাড়ার অন্যান্য মেয়ের সঙ্গে মেয়েকে কথা বলতে শিখতে উৎসাহ দেবে। ছেলে যেমন ছেলেদের সঙ্গে মেশে, মেয়েও তেমনি মেয়েদের সঙ্গে মিশবে। মানুষের সঙ্গে না মিশলে মানুষের বুদ্ধিশক্তি বাড়ে না।
মেয়েকে খবরের কাগজ এবং মাসিক পত্রিকার গ্রাহক করে দেবে। মেয়েকে মানুষ করবার কাজ মা-বাপের, স্বামীর নয়। অনেক অপদার্থ মা-বাপ মেয়ের শিক্ষার ভার স্বামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে কাপুরুষের মতো সরে দাঁড়ান।
মেয়েদের মাঝে মাঝে বৈঠক করে সভাসমিতি করতে এবং বক্তৃতা দিতে উৎসাহ দিও। হায়দ্রাবাদে মেয়েরা দোকান দেয়, বেড়াতে বের হয়। স্যার সৈয়দ আমীর আলী তাঁর ইতিহাসে লিখেছেন, ইসলামের প্রথম যুগের আরব মহিলারা কোনো বোরকা ব্যবহার করতেন না, মেয়েরা গান গাইতেন, তাতে কোনো দোষ হতো না। খলিফা ওমর রাস্তায় থেকে অনেকে সময় সেই গান শুনতেন।
ছেলেমেয়েরা বড় ভাই বা বোনকে বা মুরুব্বীদের বাঘের মতো ভয় করুক–এটা ভালো নয়। সন্তানের সুবুদ্ধি ও বিবেক জাগাতে চেষ্টা করবে। সে যেন তার বিবেককে বেশি ভয় করে।
ছেলেমেয়েরা যেন ব্যক্তিত্বহীন একটা মাংসপিণ্ড না হয়ে ওঠে, ব্যক্তিত্ব অর্থ বিদ্রোহ নয়। সন্তান মুরুব্বীদের অবাধ্য হোক বা তাদের অশ্রদ্ধা করুক এ বলছি না। সৈনিকেরা নিজের ব্যক্তিত্ব না হারিয়েও সেনাপতির আদেশে কামানের সম্মুখে প্রাণ দেয়।
ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে চেষ্টা করবে। এর অর্থ–সন্তান যেন সত্য অপেক্ষা মানুষের হুমকিকে বেশি ভয় না করে, কারো সম্মুখে যে নীচ ও হীন হয়ে না দাঁড়ায়, কারো সঙ্গে কথা বলতে তার গলা না কাপে। ভয়ে অনিচ্ছায় সে যেন না হাসে বা কাঁদে, প্রয়োজন হলে। প্রতিবাদ করতে ভয় না পায়, অনুগ্রহ বা কারো কৃপা দৃষ্টি লোভে কুকুরের নীচতায় কারো কাছে মাথা নত না করে।
ছোট ছেলেমেয়েকে মাঝে মাঝে ক্ষেপা কুকুরে কামড়ায়। সাবধান, পল্লীগ্রামের আনাড়ী বৈদ্যের ওষুধে শান্ত হয়ো না। ক্ষেপা কুকুরের নিচের চোয়াল ঝুলে পড়ে, মাথায় তার কখনও কখনও ঘা থাকে–অনবরত মুখ হতে লালা নির্গত হতে থাকে, চোখ দুটি লাল হয়, লেজটি ঝুলে থাকে, এরূপ কুকুরে কামড়ালে আর রক্ষা নেই। কুঁড়েমি করে বাড়িতে বসে সর্বনাশ করো না, মহকুমা বা জেলার ম্যাজিষ্ট্রেট জানাতে হয়! তিনি সরকারি খরচে হসপিটালে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দেন। ভালো পোষা কুকুরে কামড়ালে বা আঁচড়ালে বিশেষ ভয়ের কারণ নেই। তবুও সাবধান হওয়া ভালো। বিশেষ বিবেচনা করে দেখবে কুকুরটি ভালো কি ক্ষেপা। কোনো ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া ভালো। কামড় দেবার পর এক সপ্তাহের মধ্যে যদি কুকুর পাগলা হয়, তাহলে বিশেষ ভয়ের কারণ থাকে। ক্ষেপা। কুকুরকে কিছু খেতে দিলে সে খায় না বলে মনে হচ্ছে-সাবধান খুব সাবধান।
সন্তানকে সাপে কামড়ালে তৎক্ষণাৎ দংষ্ট্র স্থানের উপর দিয়ে বাঁধের উপর বাঁধ দেবে। দংশিত স্থান চাকু দিয়া কেটে ফেলবে-মায়া করেছ কি সর্বনাশ হয়েছে।
একটা কথা জানি। এক ভদ্রলোক ছেলে নিয়ে রাত্রে শুয়েছিলেন। ঘুমঘোরে একটা সাপ এসে ছেলের হাত কামড়েছিল। ছেলের চীৎকার শুনে বাপ জাগলেন। অন্ধকারেই হাত দিয়ে দেখলেন, সাপটি হাতের সঙ্গে তখনও লেগে আছে। কিছুতেই ছাড়ছে না। বাপ সাপের গা চেপে ধরে টেনে দূরে ফেলে দিলেন। তারপর কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে হাতের উপর বাঁধনের উপর বাঁধন দেওয়া হল। ক্রমে বহু লোকজন সেখানে জমা হল। কতকগুলি ডাক্তারও এলেন। আশ্চর্যের বিষয় তারা কেউ কিছু বললেন না, কেবল হা-করে চেয়ে রইলেন। সাপটিকে ইত্যবসরে মেরে ফেলা হয়েছিল।
একজন প্রবীণ ডাক্তার বললেন–এ সাপের বিষ নেই–অতএব সন্তানকে আর কষ্ট দিয়ে লাভ কি? বাঁধন খুলে দাও–ভোর হতে এখনও বিলম্ব আছে। ছেলেটি একটু ঘুমোক,–তখন। সকলে বারান্দার উপর বসেছিল। বাধনের যাতনায় ছেলে একটু একটু কাঁদছিল।
হায়, বন্ধন খোলামাত্র সোনার সুন্দর ছেলেটি কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। মুহূর্তের দেরি সইল না। ছেলেটি চিরদ্রিায় অভিভূত হল। সকলে নির্বাক, স্তব্ধ ও স্তম্ভিত হয়ে গেল। হায়! দুর্ভাগ্য, ভুল!
ছোট ছোট ছেলেপেলেকে দেখলেই আদর করবে। ভবিষ্যৎ কালে সে তোমার পায়ের ধুলা নেবে বলে তাকে আদর করো না, সে মানুষ হোক, দেশ সেবক হোক এই কামনা করো। সন্তানের পায়ের কোনো স্থান থেকে রক্ত পড়লে তাৰ্পিন তেল দিয়ে এঁটে বেঁধে দিও। কাটা ঘায়ে পানি-পট্টি দিও। আগুনে পা পুড়ে গেলে চুনের পানি ও নারিকেল তেল লাগাবে। হাত ভাঙ্গলে দুই পার্শ্বে কাঠ দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলে হাড় জোড়া লাগে। কোনো বিষ ছেলে-মেয়ের পেটে গেলে তৎক্ষণাৎ বমি করাবে। গরম পানিতে লবণ মিশিয়ে খাওয়ালে বমন হয়। বোলতা কামড়ালে পেঁয়াজ বেঁটে লাগিও।
সন্তানদের বিছানায় মুতা একটা ব্যারাম। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খাওয়ালে সহজে আরোগ্য হয়।
হালিমা জিজ্ঞাসা করিলেন–ছেলেমেয়েকে কিরূপ স্থানে বিয়ে দেওয়া উচিত?
কুলসুম বলিলেন, জ্ঞান ও চরিত্রের সেবা না করে শুধু হছব নছব (সম্বন্ধ) করে নিজের বংশমর্যাদা বাড়াতে চেষ্টা করা লজ্জার বিষয়। সাধারণের কাছে ছোট লোক আখ্যার ছাপ মাথায় নিয়ে তথাকথিত ভদ্রলোকের সঙ্গে সম্বন্ধ করা ভালো কাজ নয়। সামনে সামনে সম্বন্ধ হওয়া ভালো। এক শ্রেণীর লোক আছে, তারা পাপকে ঘৃণা করে না–জ্ঞান ও চরিত্রকে সম্মান করে না, শুধু সাদীর দ্বারা সম্মান অর্জন করতে চেষ্টা করে–এরা কৃপার পাত্র। আত্মমর্যাদা নিয়ে স্বাধীনভাবে দাঁড়ানই সম্মান। সম্মান নিজের ভিতর–নিজের সম্মানের মালিক নিজে।-এ জিনিস ভিক্ষা করবার নয়। স্বাধীনচিত্ত লোক তথাকথিত বড়লোক ও বড় ঘরের কন্যাকে বিয়ে করতে অপমান বোধ করেন। তোমার প্রীতি-উপহার বইখানিতে যে সংস্কৃত শ্লোকটি লেখা আছে, তার অর্থ–যে নিজের নামে পরিচিত সে উত্তম, যে পিতার নামে পরিচিত সে অধম, যে মামার নামে পরিচিত সে অধম, যে শ্বশুরের নামে পরিচিত সে অধমের অধম।
আবার কহিলেন–অমুক ছোট লোকের মেয়ে বা ছেলে, এ কথা বলা পাপ ও অনৈসলামিক। যেখানে জ্ঞান ও চরিত্র সেখানেই সম্বন্ধ করবে। পণ্ডিত ব্যক্তিকে ছোট লোক বলা পাপ-হউক তার আত্মীয়-স্বজন ছোট, বিয়ের পর মেয়ের স্বামীকে সর্বদা আদর-যত্ন করা উচিত। জামায়ের সেবার কোনোরূপ অসুবিধা যেন না হয়।
কুলসুম আবার বলিলেন, ছেলে যদি দূর দেশে যেতে চায়, আঁখিজলে বুক ভাসিও না। মায়ের অঞ্চলের নিধি হয়ে বাড়িতে থেকে চিরকাল দুঃখ, অসম্মান ও দারিদ্র্য-জ্বালা সহ্য করা মূখের কাজ। ছেলেকে প্রয়োজন হলে মিশর, জাপান, চীন, রাশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকাতে পাঠাতে চেষ্টা করবে। এতে ভয়ের কোনো কারণ নেই।
ছেলে বিদেশী ভাষায় পরীক্ষায় ফেল করলে কাদাকাদি করা ভালো নয়। পাসের জন্য রোজা রাখা, সিন্নি মানত করা মূর্খতা। একবার ফেল করেছে তাতে কি ক্ষতি, পরের বারে সে সফল হবে। কোনো বিশেষ বিষয়ে ছেলেমেয়ে যদি কাঁচা থাকে, তবে সেজন্য প্রাইভেট শিক্ষক রাখবে। পাস না করেও চেষ্টা করলে ছেলেমেয়ে শ্রেষ্ঠ ও বড় লোক হতে পারে। পরীক্ষায় ফেল করলে তার জীবন মাটি হয়ে গেল, এমন কোনো কথা নয়। তাকে চরিত্রবান জ্ঞানী করতে পারলেই যথেষ্ট, আর কিছুই দরকার নেই।
ছেলেমেয়েকে খুব বাল্যকাল হতেই বাপকে শ্রদ্ধা করতে শেখাবে–তুমি যেমন শেখাবে তেমনি সে শিখবে। বড় হলে তাদের নতুন করে কিছু শেখান যায় না। ছেলেমেয়েকে মাঝে মাঝে পায়খানায় নিজের জন্য পানি দিয়ে আসতে বলবে। শীতকালে সকাল বেলা পানি গরম করতে বলবে। মিষ্টি কথায় মধুর ব্যবহারে পুত্র কন্যাকে বাল্যকাল হতেই সেবাকার্য শিক্ষা দেবে-বৃদ্ধকালে, বিপদকালে হাসিমুখে পূর্বের অভ্যাস মতো তারা তোমাদের সেবা করবে। তাতে তাদের কোনো কষ্ট হবে না। হাসিমুখে প্রিয়তম বাপ-মাকে তারা সেবা করবে।
ছোট ছেলেপেলেকে উপুড় হয়ে শুতে দেখলে নিষেধ করবে। বলবে উপুড় হয়ে শোওয়া দোষ, আর কিছু না। মাঝে মাঝে বাড়ির ছেলেমেয়েদের হাতে ২/১টি পয়সা কিছু কিনে খাবার জন্যে দেবে। শুধু ছেলেমেয়ে নয়, চাকর-দাসীকেও মাঝে মাঝে কিছু দেওয়া উচিত। পয়সা নেই এ কথা বলো না।
বিয়ের পর ছেলেমেয়েকে স্বাস্থ্য সম্বন্ধে কোনো অশ্লীল উপদেশ দিও না।
.
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম বলিলেন-সংসার করতে হলে, ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে বাস করতে গেলে আরও কতকগুলি বিশেষ দরকারি কথা তোমাকে জানতে হবে।
হালিমা কহিলেন-বলুন ভাবি।
কুলসুম : ঘরের মেঝে ভিজে হওয়া বড় দোষের, এরূপ হলে শরীর নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। আর্দ্র মেঝেতে শুকনো মাটি বা বালি ছড়িয়ে দিয়ে উপরে চাটাই বা মাদুর পেতে দিতে হয়।
মাঝে মাঝে বর্ষাকালে অনেক ছেলেমেয়ে পানিতে ডোবে। আমার মনে হয়, অনেক স্থানে তাজা সন্তানকে মরা মনে করে লোকে দাফন করে।
হালিমা কহিলেন–কি ভয়ানক কথা।
কুলসুম : ভয়ানকই বটে।
হালিমা : মানুষ মরলে চেনাই যায়, এতে আর ভুল হবার কি আছে?
কুলসুম : মানুষকে অনেক সময় মরা বলে ভ্রম হয়। কিন্তু আসলে তারা মরে না। আচ্ছা বল দেখি, কেমন করে মানুষ মরেছে বোঝা যায়?
হালিমা : নিশ্বাস যখন চলে না, হাত-পাগুলি যখন শক্ত হয়ে যায়, দৃষ্টি স্থির তখনই জানা যায় মানুষ মরেছে।
কুলসুম : তোমার ধারণা ভুল। অনেক সময় দেহে প্রাণ থাকা সত্ত্বেও মানুষের এই অবস্থা হয়। মরা মানুষ পুনরায় বাঁচবার কাহিনী অনেক শোনা যায়। নিশীর রাত্রে গোরস্থানে বা নদীর ঘাটে অনেক মরা মানুষ আবার বেঁচে ওঠে। অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকেরা ভূত মনে করে প্রাণভয়ে পালায়। এইসব খোদার অনুগ্রহপ্রাপ্ত পুনরুজ্জীবিত মানুষের মাথায় কত লাঞ্ছনা ও অত্যাচারের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়।
হালিমা : কী করে ঠিক বোঝা যায় যে মানুষ মরেছে?
কুলসুম : কয়েকটি ভালো পরীক্ষা আছে। একটি ২ চ্ছ আগুনেও মৃতদেহ ফোস্কা হয় না। কোনো কোনো তথাকথিত মৃতদেহ ৭/৮ দিন পর্যন্ত প্রাণ থাকে। আহা খোদার কি মহিমা!
হালিমা : পানিতে ছেলে ডুবলে কি করতে হবে?
কুলসুম : চৈতন্যহীন শিশুর চৈতন্য আনা যায় কিনা, তার চেষ্টা করতে হবে। চিৎ করে শোয়াবে। পিঠের নিচে একটা বালিশ দিয়ে বুকটা মাথা হতে কিছু উঁচুতে রাখবে তার পর মাথার দিকে বসে শিশুর হাত দুখানি কনুইয়ের উপর ধরে লম্বা করে একসঙ্গে মাথার দিকে নিয়ে আসবে, তারপর আবার বুকের দিকে নিয়ে হাত দু’খানি ভঁজ করে বুকের পার্শ্বে লাগাবে। এইরূপ ঘন্টা ধরে করবে, আর এক কথা–ঐ সঙ্গে মুখের ভিতর থেকে জিভ বের করে টেনে ধরে রাখতে হয়, এইরূপ করলে শীঘ্র শ্বাসক্রিয়া হবার সম্ভাবনা। পঁচিশ মিনিটের বেশি পানিতে থাকলে কোনো আশা নাই।
বাড়ির কাউকেও সাপ কামড়াইলে দংষ্ট্র স্থানের উপরে অবিলম্বে ২/৩টি বাঁধ দিতে হয়। হালিমা শিহরিয়া উঠিয়া কহিল–ভাবি আমার বড় ভয় হচ্ছে, ওকথা আমি শুনতে চাই নে।
কুলসুম : না শুনলে চলবে না। সংসারে বাঁচতে হলে আমাদের নিরন্তর সতর্ক থাকতে হবে।
হালিমা : তা তো ঠিক।
কুলসুম : সাপে আমাদের দেশে দরিদ্র লোককেই বেশি কামড়ায়। বাড়ির চারদিক সর্বদা সাফ রাখতে হয়–এদিকে প্রত্যেক গৃহস্থের বিশেষ মনোযোগ চাই। বাড়ির ধারে . জঙ্গল বড়ই আপত্তিজনক।
রাস্তায় যখন আলোক জ্বলে এইরূপ করে বাড়িতে সারারাত্রি না হোক, ১০/১১টা পর্যন্ত বড় বাতি জ্বালানো উচিত, যাতে বাড়িখানি আলোকময় হয়ে ওঠে। বাড়ির রাস্তাগুলি ইটের কুচি দিয়ে বাঁধিয়ে নেওয়া উচিত। ঘরের পার্শ্বে বহু শিকরবিশিষ্ট গাছ থাকাও অন্যায়। ঘরের মেঝে অবস্থায় কুলোলে ইট ও সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে নেওয়া উচিত। যাক, যা বলছিলাম–সাপে কামড়ালে বাঁধ দিয়ে দংষ্ট্র স্থানের মাংস ছুরি দিয়ে কেটে ফেলবে, তারপর গরম পানি দিয়ে ক্ষতস্থান ধুয়ে, সেখানে পটাশ-পারম্যাঙ্গানেট লাগিয়ে দেবে। এ ওষুধ শহরে বা মহকুমার ডাক্তারদের কাছে পাওয়া যায়। সাপে কামড়িয়েছে কিনা সন্দেহ হলে মরিচ খেতে দেওয়া উচিত। সাপ কামড়ালে মরিচের তীব্রতা জিভে লাগে না।
কুলসুম : আবার বলিলেন,-ঘরে কতকগুলি ওষুধ রেখে দেওয়া উচিত। এক বাক্সে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ এনে ঘরে রেখে দেওয়াই সুবিধা।
হালিমা : বড় শহর হতে ওষুধ এনে ঘরে রাখা অনেকের পক্ষে অসুবিধা ও অসম্ভব। বুড়িরা তো অনেক ওষুধ জানেন।
কুলসুম : আমিও জানি। যদি মনে করে রাখতে পার তাহলে মোটামুটি ব্যাধির ওষুধের কথা বলছি। এসব ওষুধ আমাদের ঘরের কোণায় বা বেনেদের কাছে পাওয়া যায়। ওষুধের কথা বলবার আগে আমি আরও একটি দরকারি কথা বলে নিচ্ছি।
হালিমা : কী কথা?
কুলসুম : কারো গায়ে যদি আগুন ধরে যায়, তবে কখনও হতবুদ্ধি হবে না। কখনও আগুন নিয়ে তাকে লাফাতে বা দৌড়াতে দেবে না। কাপড়-জামা খুলতে চেষ্টা করা বৃথা। কাপড়ে আগুন ধরলে হাতে আগুন ঠেসে ধরে বিশেষ লাভ হয় না।
হালিমা : আগুনে পুড়ে মরা বড় সাংঘাতিক কথা।
কুলসুম হাই ফেলিয়া বলিলেন–খোদা যেন কাকেও এমন দুর্ঘটনার মধ্যে না ফেলেন। একটু নীরব থাকিয়া কুলসম আবার বলিলেন–ক্ষেপা কুকুর কামড়ালে কী করতে হয়। আগেই বলেছি। আরও একটু বলি,-কামড়ান মাত্র, লোহা লাল করে দংষ্ট্র স্থানে ঠেসে ধরবে। ফিউমিং নাইট্রিক এসিড লাগালেও বিশেষ উপকার হয়। যাই হোক, সেই যে শহরের হাসপাতালের কথা বলেছি, সেখানেই কারো বাধা না শুনে যাওয়া উচিত। সব টাকা গভর্নমেন্ট হতে পাওয়া যায়। সে টাকা দেশের লোকেরই, সুতরাং তার উপর সকলেরই দাবি আছে। ভালো কুকুরে কামড়ালে কিছু হয় না।
শরীরের কোনো জায়গা হতে রক্ত পড়তে থাকলে সেখানে ন্যাকড়া পোড়ার ছাই লাগবে; অনেকক্ষণ চেপে ধরাও মন্দ নয়। ঠাণ্ডা জলে আহত স্থান অনেকক্ষণ ডুবিয়ে রাখলেও রক্ত বন্ধ হয়!
কাউকে বোলতায় কামড়ালে মধু গুড় লাগাতে বলবে। পেয়াজের রস দেওয়া ভালো।
কেউ দেশলাইয়ের কাঠি বেশি চুষলে বমি করিয়ে ফেলানো উচিত। ছেলেপেলেদের ঘরে ম্যাচ বাক্স লুকিয়ে রাখাই নিয়ম।
চোখে কিছু পড়লে চোখ রগড়ান নিষেধ। তীক্ষ্ণ কোনো পদার্থ পড়লে ডিমের সাদা ভাগ চোখে দেওয়া মন্দ না। চোখে দু’টি চাল দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে থাকা ভালো। চোখে চুন পড়লে লেবুর রসের পানি দেবে; শুধু পানি চোখে দেবে না।
কেউ হঠাৎ অচৈতন্য হলে ঘরের দরজা-জানালা খুলে চোখেমুখে শীতল পানি ঝাঁপটা দিতে হয়। হুঁশের জন্য বলপ্রয়োগ করবে না। স্বামীর বা কারো ভয়ানক বিষম লাগলে হাঁচতে বলবে।
জ্বর বা ব্যাধি শেষে অরুচি হলে পুরানো কচি ডালিমের রস, জীরের গুড়ো, চিনি, মধু ও ঘি একসঙ্গে মিশিয়ে মুখে রাখলে অরুচি থাকে না।
বাড়ির কারো ভালো পরিপাক না হলে হরিতকি পুড়িয়ে সৈন্ধব লবণ, বিট লবণ ও বোয়ান সমভাগ করে বাটবে। তারপর আধ তোলা বা এক তোলা বড়ি করে খাবার পরে গরম পানির সঙ্গে খেতে বলবে। এতে বেশ পরিপাক হবে। এসব জিনিস হাটে বেনেদের কাছে পাওয়া যায়।
কারো যদি কোনো আঙুল ফুলে ওঠে ও জ্বালা করে তাহলে তাকে একটি কচি বেগুনের ভিতর লবণ ভরে তার মধ্যে ফোলা আঙ্গুল কয়েক ঘণ্টা ভরে দিয়ে রাখতে বলবে।
আমাশয় হলে পুরানো তেঁতুল চিনি ও মর্তমান কলা এক সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হয়, তাতে আমাশয় সেরে যায়।
হালিমা হঠাৎ বলে উঠলেন–ভাবি, উকুনের কোনো ওষুধ আছে? কুলসুম বলিলেন-চাঁপা ফুলের পাতায় রস মেখে শুকালে উকুন মরে যায়। ময়লা জমে সময় সময় কান বন্ধ হয়ে যায়।
কুলসুম আবার বলিলেন–ছেলেমেয়েরা অনেক সময় কান পাকায় ভোগে। রোজ সকাল কানে ২/৩ ফোঁটা কচি বাছুরের চোনা দিলে কান পাকা সারে। ক্রিমি হলে আনারসের পাতার রস একটু সামান্য চুন দিয়ে মিশিয়ে খেতে হয়।
কুলসুম হালিমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন–আর কিছু শুনবে নাকি?
হালিমা : বলুন।
কুলসুম : বহেড়া বেঁটে ঘি-এর সঙ্গে গরম করে খেলে গলার বেদনা কমে। বেশি নয় ২/৩টি বহেড়া হলেই হবে। বহেড়া বেনেদের থলের মধ্যে থাকে।
চোখ উঠলে ছটাকখানেক ঠাণ্ডা পানিতে একটুখানি লবণ দিয়ে সেই পানিতে ২/৩ বার চোখ ধুলে বিশেষ শান্তি হয়।
নারিকেলের শিকড় থেঁতো করে পানিতে সিদ্ধ করে তাই দিয়ে কুলি করলে দাঁতের গোড়া শক্ত হয়। অনেক প্রৌঢ় মহিলার দাঁত নড়ে।
কুলসুম বলিলেন–তোমার ভাই যখন পড়তেন তখন একবার ফোড়ার যন্ত্রণায় অস্থির হয়েছিলেন। আমি পুরানো তেঁতুল আর একটা জবা ফুল বেঁটে সেখানে দেওয়াতে ফোড়াটি ফেটে গেল। সাবান আর চিনি এক সঙ্গে চটকিয়ে ফোঁড়ার মুখে দিলেও ফোড়া পাকে। যুবতীদের মুখে ব্রণ হলে তাতে একটু তাজা চুন দিতে হয়, নইলে মুখ ব্যথা করে, হাত দেওয়া যায় না।
অনেক সময় নির্দোষ বাগি হয়। মাদার (শিমুল) গাছের আঠা আর একটু নুন তুলায় করে ফোলা স্থানে দিয়ে কোনো গরম কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখবে বাগি একদিনেই বসে যাবে।
কোনো কোনো স্থানে যদি মচকে যায় আর ব্যথা করে, তাহলে চুন আর হলদি বাটা এক
সঙ্গে করে গরম করবে-তারপর বেদনা স্থানে প্রলেপ দেবে। এতে বেশ উপকার হবে।
মেয়েদের মাঝে মাঝে ভারি মাথা ধরে–রাই বা দারুচিনি বেঁটে কানের পাটিতে দিতে হয়।
মুখে ঘা হলে ভেড়ার দুধ লাগাতে পারলে সেরে যায়। কিন্তু ভেড়া পাওয়া তো মুশকিল। বেলের পাতা চিবালে উপকার হয়।
পেট ব্যথার বেশি কোনো ওষুধ আমি জানি নে। হোমিওপ্যাথিক কলোসিস্থ, ম্যাগনেসিয়া, ফস, আর্সেনিক প্রভৃতি ওষুধে যাতনা হতে অব্যাহতি পাওয়া যায়।
কুলসুম বলিলেন–অনেক সময় ঘরে চিনি মিছরির গন্ধে পিঁপড়ে ওঠে। মিছরির পাত্রের সঙ্গে কর্পূর দিলে পিঁপড়ে আসে না।
.
এয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম বলিলেন–প্রিয় হালিমা, তোমার বিয়ের দিন চলে এসেছে, আমার কথা বলা শেষ হয়েছে। আর কয়েকটি কথা বলেই আমি শেষ করব।
বাড়িতে কেউ মরলে মাথা ভাঙ্গাভাঙ্গি করে কেঁদো না। আঁখিজল নির্জনে ফেলবে। লোকে যেন না দেখে। মরণে খুব বেশি দুঃখ করা গোনাহ। মরণকে উপহাস করতে হবে। এ জগৎকে প্রাণের সঙ্গে মিথ্যা মনে করা বা কর্তব্য সম্পাদনে জগৎকে মিথ্যা মনে করা উচিত নয়।
আরও শোন–দেখ অনেক সময় বন্ধুর জন্যে পরিবারে অশান্তির সৃষ্টি হয়। স্বামী ও শ্বশুর শাশুড়ীর মধ্যে মনোমালিন্য আরম্ভ হয়। অভাব, মূর্খতা ও অনুন্নত মনই এইসব মনোমালিন্যের কারণ। অনেক সময় অনেক মাতা সন্দেহ করেন, বিবাহের পর তার স্থান ছোট হয়ে গেল। পুত্র আর তেমনি করে মাতাকে ভালবাসে না। এই সন্দেহ বড়ই মারাত্মক। শাশুড়ীর উপর খুব শ্রদ্ধা রাখবে; স্বামীকে খাওয়াবার আগে সর্বদা শ্বশুর শাশুড়ীকে খাওয়াবে। উপহার ও অর্থ দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ীকে নিজেদের ভালবাসা ও বশ্যতা জানাবে।
শ্বশুরবাড়িতে বধূর সম্মান না হলে অনেক সময় বধূরা স্বামীর কাছে তার শ্বশুর শাশুড়ীকে খেলো করতে চেষ্টা করেন। নিজের সম্মান না হলেও স্বামীর কাছে কোনো কথা
বলাই শ্রেয়। নারীর দুঃখের শেষ নেই। স্নেহ, মমতা, প্রীতি, অনুরোধের আদান-প্রদানই পরিবারের শান্তির কারণ। একজন অন্যজনের দোষকে সর্বদা ক্ষমা করবে, প্রত্যেকে প্রত্যেকের ভাবের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করবে, কেউ কারোর উপর অত্যাচার করবে না, তাহলেই পরিবারের মঙ্গল হয়। সুখ, শান্তি ও উন্নতি বাড়ে।
কুলসুম আবার বলিলেন-দেখ, ইংরেজি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নবীন যুব সমাজ ও পুরাতন বৃদ্ধ সমাজের ভিতর একটা দ্বন্দ্ব বেঁধে উঠেছে। প্রাচীনেরা যা ভাবেন, নবীনেরা তার উল্টা কথা বলেন। নবীনের চিন্তা সম্পূর্ণ নতুন রকমের; জীবন ও সমাজ সম্বন্ধে তার যে ধারণা তা শূন্যে প্রাচীন উপহাস ও অবজ্ঞা করেন, ফলে বহু পিতা-পুত্রে মনোমালিন্য হয়। বহু পরিবারে অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে। ওর মীমাংসা কী তা বলা কঠিন। উভয়ে উভয়ের উপর খড়গহস্ত না হয়ে, প্রত্যেক প্রত্যেকের কথা সম্বন্ধে ভেবে দেখা উচিত। একে অন্যকে বুঝতে চেষ্টা করতে চাই। তাহলেই বোধ হয় একটা মীমাংসা হতে পারে। প্রাচীনেরা যদি নবীনের কাছে কিছু শেখার থাকে তাতে প্রাচীনেরই গৌরব, তাতে প্রাচীনের লজ্জার কারণ নেই, কারণ প্রাচীনের বুক ভেঙ্গে নবীন বের হয়।
নিজের বা পরিবারের আকস্মিক কোনো বিপদ হলে যে-কোনো ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের সঙ্গে দেখা করা যায়, এ কথা জেনে রাখা উচিত। চুপ করে থাকা নিষেধ। আইন একটা নূতন জিনিস নয়। বুদ্ধিই শ্রেষ্ঠ আইন। সাধারণ বুদ্ধি নিয়ে লোকের সঙ্গে কথা বললেই জয় হবে।
আর একটি কথা, বাড়ি যাতে দেখতে সুন্দর হয় তা দেখবে, কতকগুলি ঘর হিজিবিজি করে তুলে রাখা ঠিক নয়। বাড়িগুলি সর্বদা চতুষ্কোণ আকার হবে। সামনে ফুলের বাগান থাকবে, শ্যামপুষ্পচ্ছাদিত একটা ছোট ক্ষেত থাকাও নিতান্ত উচিত।
বাড়িতে ধান মাড়াবার জন্য একটা স্বতন্ত্র স্থান পাকা করে বাধিয়ে নেওয়া ভালো। বাড়ির ভিতরকার উঠোনে খানিকটা স্থান ইট দিয়ে বাঁধিয়ে নিয়ে সেখানে ধান শুকান যেতে পারে।
সংসারে অনেক বিপদ ও কষ্টের কারণ এসে জোটে, সে সমস্ত কথা চিন্তা করে শরীর নষ্ট করা ভুল।
মেয়ে বিয়ে দিলে জামাই বা বৈবাহিক যখনই মেয়ে নিতে আসেন তখনই তাকে যেতে দেবে। মেয়ে না দিয়ে কখনও অভদ্রতার পরিচয় দিও না।
পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে কুটম্ব বা শিক্ষিত ভদ্রলোক এলে তাকে দাওয়াত করে খাওয়ান ভালো। অবস্থায় না কুলোলে দরকার নেই। দুধ, দই বা ক্ষীর খাবার থাকলে অতিথি বা যে কেউ হোক আগেই সামনে দিতে হয়। খাওয়া শেষ হয়ে গেলে সেসব হাজির করাই উচিত।
শ্বশুর-শাশুড়ী বুড়ো হয়ে গিয়েছেন বলে কখনও মনে করো না–তাদের খাবার পরবার কোনো ইচ্ছা নাই, তারা কেবল মৃত্যুর কথা ভাবেন, এ কথা ভেবো না। বধূর হাতে প্রাণ ভরে খাবেন বলে অনেক শ্বশুর-শ্বাশুড়ী জীবন ভরে আশা করে থাকেন, সুতরাং তাদের খাবারের প্রতি বিশেষ নজর চাই। শ্বশুর-শাশুড়ীর জন্য স্বামীকে বিদেশ থেকে মাঝে মাঝে নানাপ্রকার ফলমুল, বিস্কুট, হালুয়া, ও কেক আনতে বলবে। অল্প হলেও তাদের নানা সুস্বাদু জিনিস খাওয়াবে–এতে তারা কত সুখী যে হন, তা ভাষায় প্রকাশ করে বলা যায় না। খাবার সময় কখনও ছেলেপেলেকে তাঁদের কাছে যেতে দেবে না।
স্বামীকে বলল, যেখানে বাধা দেওয়া দরকার সেখানে যেন তিনি বাধা দেন, যেখানে ঘাড় শক্ত করা দরকার, সেখানে যেন তিনি কাপুরুষের মতো ঘাড় নরম না করেন। বাধা
দিলেই মৃত্যু হয়, ঘাড় নরম করলেই বেশি করে অসম্মান হয়। তাই বলে একগুঁয়েমি ভালো নয়।
নারী চরিত্রে একগুঁয়েমি ভাবটা অনেক সময় বড় প্রবল। সংসারের যত রকম খরচই। হোক না, কখনও বাজার খরচের টাকা কাউকে দেবে না। কেউ মাথায় লাঠি মারলেও এ টাকা ঘর থেকে বের করতে নেই। বাজার খরচ ভেঙ্গে ঋণ পরিশোধও নিষেধ। সোজা। বলে দিও, না খেয়ে মরতে পারি নে।
আর একটা বিশেষ কথা–যেমন করে তোক টাকা কিছু জমাতে হবে। কি জানি, স্বামীর যদি কোনো বিপদ হয়, পয়সার জন্যে যেন মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে না হয়। পয়সার জন্যে যেন নীচ ব্যক্তির কাছে অন্যায়ের সম্মুখে মাথা নত করতে না হয়। অন্যায় ও নীচতাকে মেনে নিয়ে এবাদতে লাভ কী?
বর্তমানকালে স্বামীকে পরের গোলামি না করে কোনো স্বাধীন কাজ করতে বলা উচিত; গোলামিতে স্বামী-স্ত্রীর দুইয়েরই অসম্মান।
অপরিচিত স্থানে যেয়ে কোনো হীন কাজ করে যদি স্বামী উন্নতির পথ করে নিতে পারে সেও ভালো। চরিত্র হারিয়ে অর্থ উপার্জন নিষেধ।
অপ্রয়োজনে বা সময়ের পূর্বে কোনো কথা বলতে নেই; তাতে বধূর বদনাম হয়।
স্বামীকে সেবা করতে যদি কষ্ট হয়, তাহলে স্বামীর সেবার জন্যে নিজে দূরে থেকে, একটা সুন্দরী কোমলাঙ্গী বালিকা দাসী নিযুক্ত করো, সে তোমার স্বামীর সেবা করবে। তাহলে দু’দিনেরই বুঝবে স্বামীর সেবায় কী আনন্দ।
জোর করে কারো কাছ থেকে দাওয়াত আদায় করতে নেই। ছেলেমেয়েকে বাদ দিয়ে স্বামীকে যদি কেউ দাওয়াত করে, তবে সে জন্য অসন্তুষ্ট হওয়া ভালো নয়। দাওয়াত না করলে ছেলেমেয়েকে ছোট বলে স্বামীর সঙ্গে পাঠানো উচিত নয়।
অর্থশালী লোক অপেক্ষা জ্ঞানী ও পণ্ডিত ও সাহিত্যিক, সুধীদের প্রতি বেশি শ্রদ্ধা পোষণ করা উচিত, নইলে আত্মার অবনতি হয়।
স্বামী খেতে চাইলে তৎক্ষণাৎ তাঁকে খেতে দেবে। যাই থাক না, যত্ন করে খাওয়াবে।
স্বামী কোনো কারণে অসন্তুষ্ট হলে অসন্তোষের কারণ জিজ্ঞাসা করবে এবং তা দূর করতে চেষ্টা করবে। আপন মনে চুপ করে থাকতে নেই।
পরের চিঠি কখনও পড়তে নেই। পিয়ন বাড়িতে চিঠি দিয়ে গেলে মালিকের কাছে পাঠিয়ে দিতে কখনও ভুলবে না। ছেলেদের কাছে ডেকে চিঠি ফেলে দিতে বললে অনেক সময় তারা বইয়ের ভিতরেই রেখে দেয়। এ যেন মনে থাকে।
পিয়ন চিঠি দিয়ে গেলে অনেক সময় মালিককে তা কখনও দেওয়া হয় না, এর মত নীচতা আর নেই।
মেয়েরা অনেক সময় দোষ করে অচেতন পদার্থের উপর ক্রোধ করেন। নিজে দোষ করে ‘দুরো’ ‘ছাই’ এই সমস্ত কথা বলো না।
স্ত্রীকে যেন দুইবার করে কোনো কথা না বলতে হয়। কতকগুলি মেয়ে আছেন তাঁরা কোনো কথা বললেই ‘কী বললেন’–বলে পুনরায় প্রত্যেক কথা শুনতে ইচ্ছা করেন। কথা প্রথমবারেই শুনতে চেষ্টা করা উচিত।
ধোয়া কাপড় বা অলঙ্কার পরে মনে যেন কোনো অহঙ্কার না আসে।
ঘরের মেঝেতে যেন কোনো প্রকার ময়লা না জমে। মুরগি যাতে ঘরে না ঢোকে সেজন্য রেলিং নিয়ে বা বেড়া দিয়ে ঘরের বারান্দা ঘিরে রাখবে। কতকগুলি মুরগি আছে, তারা আদৌ ঘরে ঢোকে না। ঘরের মধ্যে মুরগি পায়খানা করলে তখন তখন ছাই দিয়ে দূর করে ফেলে দেবে। একটা ছোট এক ইঞ্চি পরিমাণ খুরপো তৈরি করে নেওয়া ভালো। যে সমস্ত মুরগি অনবরত ঘরে ঢোকে, সেগুলি না পোষাই উচিত।
স্বামী রাগ করে কোনো কাজ করতে অগ্রসর হলে, মিষ্ট ভাষায় তাকে সে কাজ না। করতে অনুরোধ করবে। বোকার মতো চুপ করে থেকো না।
বাড়িতে একটা ছোট লাইব্রেরি থাকা নিতান্ত দরকার। বাজে অকেজো বইতে লাইব্রেরি ভর্তি করা ঠিক নয়। ভালো ভালো বই পড়লে পরিবারের বড়ই কল্যাণ হয়।
কেউ যদি কোনো বই নিয়ে যায়, খাতায় তার হিসাব রাখবে, নইলে বই হারিয়ে যাবেই। নিজে গুছিয়ে, খোঁজ করে না রাখলে হারাবেই, বই নিয়ে ফেরত না দেওয়া মানুষের স্বভাব। এজন্য রাগ করা বৃথা।
খবরের কাগজের গ্রাহক হতে কখনও ভুলো না। খবরের কাগজ না পড়া–জগতের খবর না রাখা, চরম অসভ্যতা।
একটা বিশেষ কথা মনে রেখো মানুষের পনের আনা ব্যাধি তাড়াতাড়ি খাবার দরুণ হয়। কখনও তাড়াতাড়ি খাওয়া উচিত নয়। পরিবারের সকলে গল্পে আলাপে একসঙ্গে একঘণ্টা বসে খাওয়া উচিত।
শীতকালের জন্য গরম কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা হওয়া বড়ই দরকার। শীতে মানুষের শক্তি ও আয়ু ক্ষয় হয়। যেমন করেই হোক পরিবারের প্রত্যেকের জন্য যথেষ্ট কাপড়ের বন্দোবস্ত চাই। কাপড় যদি না জোটে, তা হলে তুলা দিয়ে গায়ের কাপড় ও জামা তৈরি করে নেওয়া উচিত। গায়ের কাপড়ের জন্যে অন্য খরচ না হয়, তাও ভালো।
অতিথি অভ্যাগতদের জন্য অন্দর বা বাইর বাড়িতে একই রকমের বরতনের ব্যবস্থা করবে। কারো জন্য চমৎকার থালা, তারই পার্শ্বে লোকের জন্য অপেক্ষাকৃত মন্দ বরতন দেওয়া অভদ্রতা। সকলের জন্য একই রকমের বিছানা চাই। কারো জন্যে গদি তোষক, কারো জন্যে মন্দ বিছানার বন্দোবস্ত করলে ভদ্রলোকের এবং ভদ্রমহিলাদের অপমান করা হয়। খেতে বসিয়ে কাউকে বিশেষভাবে আদর-যত্ন করবার দরকার নেই। খাবার জিনিসপত্র পেয়ালায় পূর্ব হইতে ঠিক করে রাখা উচিত। নইলে কাউকে আগে দিতে হয়, কাউকে বসিয়ে রাখতে হয়। দশজনকে তুলে একজনকে সম্মান জানানো প্রাচীন লোকদের রীতি।
যাদের দাওয়াত করবে তারা বাড়িতে এলে তাদের অভ্যর্থনার জন্য বিশেষ করে একজন লোক নিযুক্ত করবে। নইলে তাদের অসম্মান করা হয়। চীনা মাটির বাসনে ভদ্রলোক হওয়া যায়–এ ধারণা কিন্তু ঠিক নয়। বিদেশী জিনিসে ভদ্র না হয়ে গাছের পাতা এবং মাটির বাসনপত্র দিয়ে অভদ্র নাম অর্জন করা ভালো।
হাত মুখ ধোবার জন্যে অতিথিদের চিলমচী দেবার দরকার নেই। সকলের জন্যে বারান্দায় পানি রেখে দেওয়া উচিত। চিলমচীতে কেউ হাত ধুইয়ে দিলে বেশি সম্মান হয়-এ বিশ্বাস করা বিশেষ প্রশংসাজনক বলে মনে করি না।
জোর করে জীবনের অভাব সৃষ্টি করো না, এ ভাবেই মানুষের বহু দুঃখ বাড়ে।
কাজ শেষ হলে জিনিসপত্র যেখানে সেখানে টান দিয়ে ফেলা, তারপর যখন আবার দরকার হয় তখন সেই জিনিসের জন্য সারাদিন ছুটোছুটি করা বড়ই দোষ। দরকার অ দরকারে সব জিনিস যথাস্থানে ঠিক করে রাখা উচিত। শৃঙ্খলা সভ্যতার লক্ষণ।
স্ত্রীলোকের ব্যক্তিত্ব অর্জন করা সংসার কার্যে অভিজ্ঞতা লাভ করা দরকার। কারণ, কে জানে জীবনে কোন সময় কি বিপদ হয়! মাঝে মাঝে স্বামীকে ছুটি দিয়ে সংসার কার্য নিজে চালাতে চেষ্টা করা উচিত।
মেয়ে মানুষের যত্রতত্র গমনে সমাজ বাধা না দিলেও ধর্ম বাধা দেয়, এ আমার মনে হয় না। বর্তমানে যে অবরোধ প্রথার চলতি হয়েছে, তাতে মুসলমান রমণীর পক্ষে জগতে অন্তত বর্তমানে বেঁচে থাকা কঠিন। হযরত মোহাম্মদের (সঃ) অনেক পরে এই কু-প্রথা স্থায়ীভাবে নারীর গলা চেপে ধরেছে।
পরিবারের সুবিধার জন্য বাড়িতে একটা হোমিওপ্যাথিক বাক্স থাকা ভালো। ছেলেপেলে নিয়ে পল্লীগ্রামে এবং শহরেও অনেক সময় বড় বিপদে পড়তে হয়। কথায় কথায় ডাক্তার ডাকা কঠিন, তাছাড়া হাতুড়ে ডাক্তারের এলোপ্যাথিক ওষুধ খেলে শেষ শরীর খারাপ হয়ে পড়ে।
জীবনের সব সময় মানুষকে চরিত্র, জ্ঞানে ও অর্থে বড় করতে চেষ্টা করা উচিত, কারণ সেটাই ধর্ম। মানুষকে জ্ঞানের কথা শোনান, বই পড়তে উপদেশ দেওয়া বড় ভালো। মাঝে মাঝে পাড়ার মেয়েদের নিয়ে সভা করা ভালো।
মূর্খ ও দুর্বৃত্ত মানুষের কথা ও ব্যবহারে হঠাৎ উগ্র হতে নেই, ধৈর্য সহ্যগুণ ছাড়া মানুষকে বড় করা যায় না। মানুষের জঘন্য দুর্বলতা দেখে ক্রুদ্ধ হলে চলবে না, মনে করতে হবে–মানুষের এটা স্বভাব।
কারো কোনো কথা বা কাজের কঠিন সমালোচনা করতে নেই; কার মধ্যে কি সত্য আছে তা বোঝার ক্ষমতা অনেক সময় আমাদের থাকে না।
অবুঝ ও অপদার্থ লোকের সঙ্গে ভালো কথা নিয়ে তর্ক করাই ভাল। তাতে নিজের সম্মান নষ্ট হয়। মূর্খ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেও কোনো ভালো কথা নিয়ে তর্ক করতে নেই; তাতে ভালো হয় না।
প্রতিবেশীর দুঃখ-বেদনায় সর্বদা সহানুভূতি দেখান চাই। মানুষের দুঃখ-বেদনা বোধ আবশ্যক।
যে কথা শুনে বা যে কাজে গম্ভীর হওয়া আবশ্যক তাতে হাসবে না, তাতে ছেলেমি পরিচয় দেওয়া হয়।
কারো-মন-সন্তোষের জন্য কখনও কোনো অন্যায় কথা বলবে না, সত্য কথা শুনে কেউ রাগে রাগুক।
পরিবারের, সাহিত্যের সঙ্গে যোগ থাকা চাই-ই-চাই। যে পরিবারের সাহিত্যের সঙ্গে সংস্রব থাকে, তাদের কোনো কালে পতন হয় না। ছেলে বুড়ো সকলেরই বই খবরের কাগজে মাসিক পত্রিকা পড়বার অভ্যাস থাকা উচিত।
বিদেশী ভাষা পরীক্ষায় অকৃতকার্য, জীবন মাটি হয়ে গেল, এরূপ যেন মনে করো না। পরীক্ষায় ফেল করেও মানুষ দেশমান্য হতে পারে। জীবনের উন্নতির পথ কোনো বাইরের বাধাতে রুদ্ধ হতে পারে না। সাহিত্যের ভিতর দিয়ে মানুষ সকল অবস্থায় জ্ঞান ও শক্তি অর্জন করতে পারে। একথা পরিবারের সকলেরই বিশ্বাস করা উচিত।
ঘরের মেঝেতে কখনও মাদুর পেতে রেখে দিতে নেই। উঠে যাবার সময় মাদুর গুছিয়ে বেড়ার ধারে হেলান দিয়ে রাখা নিয়ম।
বাড়িতে কোনো অতিথি এলে তাকে অতি সমাদরে গ্রহণ করবে। অব্যশ স্বামী অমত করলে সে অবস্থায় উপায় নেই। অতিথিকে পরের বাড়ি দেখিয়ে দেওয়া ভালো নয়।
স্বামী দূরে গেলে কখনও কোনো ভালো জিনিস তৈরি করতে নেই। তৈরি করলে যত্ন করে স্বামীর জন্যে তুলে রাখবে। স্বামী দূরে থাকলে ভালো জিনিস তৈরি করলে স্বামী অসন্তুষ্ট হন, তা বলছি নে।
ফাতেহা উপলক্ষে বহু মানুষ খাওয়ানোতে কোনো সার্থকতা নেই। ফাতেহার দ্বারা বেহেশতে যাওয়া সম্ভব, এ বিশ্বাস না করাই ভালো। বহু টাকা ফাতেহায় ব্যয় না করে কোনো সৎ কাজে সে টাকা ব্যয় করবে। মসজিদ প্রতিষ্ঠা করলেই খুব বেশি পুণ্য হবে-এ কথা মনে করা ভুল। লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা, অনাথ আশ্রম খোলা, নিরাশ্রয় বিধবার জন্য সাহায্য করা উত্তম। না খেয়ে, উলঙ্গ থেকে, মূর্খ হয়ে কী করে লোকে মসজিদে যাবে?
অনেক সময় গ্রামে অংশ করে ছাগল জবেহ হয় এই উৎসবে যোগ দেবে না।
স্বামী কোনো কাজ করতে বললে বিবেক ও ধর্মবিরুদ্ধ না হলে তা করা উচিত। তাতে যদি নিজের কোনো ক্ষতি হয়, তা স্বীকার করে নিতে হবে।
দরিদ্র প্রতিবেশী কোনোও গৃহস্থালীর জিনিস চাইলে কখনও বলতে নেই, নাই।
সংসারের কাজ করলে পরিশ্রম করলে অসম্মান হয় এ যেন কখনও মনে না আসে। যারা অপদার্থ ও দুর্বল-হৃদয়, তারাই এই কথা মনে করে। যে মর্যাদায় দারিদ্র্য আনে, তা পরিত্যাজ্য।
জীবনে কখনও কোনো কাজে পরের উপর নির্ভর করে বসে থেকো না, তাতে লাভ হয় না। বন্ধুর পক্ষেও বন্ধুর গরজ বোঝা কঠিন।
সুযোগের আশায় ভবিষ্যৎতের পানে চেয়ে থাকতে নেই; সুযোগের আশায় বসে থাকলে হয়তো জীবনে আদৌ সুযোগ আসে না।
টাকা অপেক্ষা পয়সার উপর যার নজর বেশি, সে-ই জীবনে উন্নতি লাভ করে। বেশি লোভ করলে আদৌ কিছু হয় না।
ধীরে ধীরে কিন্তু অনবরত যে অগ্রসর হতে যায়, সে-ই অগ্রসর হতে পারে, অন্য লোকের পক্ষে আদৌ অগ্রসর হওয়া সম্ভব কিনা জানি নে।
ভালো আহারে টাকা অপব্যয় হয়, এ মনে করতে নেই।
দেশ-দশের কাজের জন্যই এ জীবন-সর্বদা এই কথা মনে করতে হবে। ভোগ বিলাসের জন্য কোনো কাজ নেই। জীবনকে একেবারে নীরস ও আনন্দহীন করা কিন্তু খারাপ।
প্রত্যেক মানুষের একটা মূল্য আছে–এ কথা সে বিশ্বাস করুক। এ বিশ্বাসের মধ্যে উন্নতি নিহিত। এই বিশ্বাস যে করে, সেই বাঁচে। স্বাতন্ত্র, বৈশিষ্ট্যতা, বিশিষ্টতা ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে মানুষের জীবন।
আজ যা নতুন ও বর্তমান বলে মনে হচ্ছে, কাল তা প্রাচীন ও সুদূর অতীতের কথা বলে মনে হবে।
যাদের অবস্থা খারাপ, তাদের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করতে নেই।
ঘরগুলি যত বড় হয় ও জানালাযুক্ত হয় ততই ভালো। ছোট ঘরে বাস করবে মন ছোট হয়ে যায়। জীবনে অবসাদ আসে।
সালাম ও নজর স্বরূপ কারো কাছ থেকে টাকা নিতে নেই–এটা ছোট মনের কাজ।
প্রতিকার বা সংশোধনের ব্যবস্থা না করে শুধু অনবরত দুঃখ প্রকাশ করা অনেক মেয়ের স্বভাব। যেমন করে কর-পথে একটা কাটা রয়েছে, সেটাকে না সরিয়ে ফেলে অনবরত হাঁটার অসুবিধা প্রকাশ করা অন্যায়।
তোমার চেয়ে যারা অল্পবুদ্ধির লোক, তাদের সঙ্গে তা বলতে খুব হুঁশিয়ার হবে–তোমার রহস্য বা তোমার সরল কথায় অকারণে অনেক সময় তারা ভয়ানক রেগে যেতে পারে–বিনা কারণে শত্রু হতে পারে!
বাপ ও শ্বশুর ছাড়া কোনো পুরুষকে সম্মান জানাবার জন্যে নারীর আসন ছেড়ে উঠতে নেই। কোনো পুরুষকে সালাম করাও নারীর পক্ষে অবৈধ। নারী সর্বদাই পুরুষের সম্মানের পাত্র, বিশেষ কারণ না থাকলে কোনো পুরুষের সঙ্গে আগে কথা বলবার দরকার নেই।
পরমাত্মীয় ছাড়া কোনো পুরুষের সামনে হাসবে না।
অনেক মেয়ে মনে করেন–দুই একখানা উপন্যাস পড়তে পারলেই লেখাপড়া শেষ হলো এটা ভুল ধারণা। ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক, বিজ্ঞান, সাহিত্য, ব্যাকরণ প্রভৃতি সকল বিষয়ে জ্ঞানলাভ না করতে পারলে, লেখাপড়া শেখার কোনো মূল্য নেই। ভূগোল ইতিহাসের জ্ঞান ছাড়া, লেখাপড়ায় কোনো লাভ হয় না। খবরের কাগজ মাসিক পত্রিকা, বইপুস্তক রীতিমতো ভাবে না পড়লে মেয়েরা জাতি ও সন্তান গঠন কার্যে কোনো কিছু করতে পারেন না। তাদের মনের উন্নতি হবে না। স্বামীর ভাব ও চিত্তকে বোঝা যাবে না, সংসার ও পরিবার শ্রীময় হয়ে উঠবে না। অশিক্ষিত স্ত্রীলোক যেমন নিজে ছোট; যারা তাদের স্পর্শে আসে তারাও হীন ও ছোট হয়ে যায়।
মানুষকে ভক্তির দ্বারা জয় করতে চেষ্টা না করে, আত্মমর্যাদাবোধ ও প্রীতির দ্বারা জয়। করাই ভদ্রতা ও মনুষ্যত্ব।
যা সত্য তাই করবার স্বাধীনতার জন্যে জগতে লড়াই বাঁধে, ভয়ে মিথ্যে মেনে নিলে মৃত্যু হয়।
বাঙালি পরিবারে অনেক বাড়িতে বৃষ্টি বাদলার দিনে উঠোনে বড় কাদা ও ময়লা জমে, এটা বড় দোষের।
নিজের শানশওকাত, গহনা ও কাপড় দেখাবার জন্যে কোনো ভদ্র মহিলাকে দাওয়াত করে বাড়িতে আনবে না।
দামি খাট পালঙ্ক কিনে, বিলাসিতার পরিচয় দিয়ে অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। এইসব জিনিসের দ্বারা পরিবারের সম্মান বাড়াতে চেষ্টা করা ভুল। অনুন্নত সমাজে অনেক সময় বাইরের সাজসজ্জা দরকার হয়ে পড়ে–এ কথা ঠিক, কিন্তু অবস্থা বুঝে না চললে জীবনে দুঃখ হয়। বাইরের শানশওকাতে মনে অহঙ্কার আসা পাপ।
মনের অসন্তোষ প্রকাশ করতে হলে খোলা শান্তভাবে গম্ভীর ভাষায় তা করবে, লাঠি নিয়ে উঠতে হবে না। ভয়ানক উগ্র হয়ে যাওয়া বা প্রথমেই কাউকে ভয়ঙ্কর গালি দিলে ফল হয় না। কোনো কাজে বা কথায় সহজে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠা ছেলেমি।
নিতান্ত গোবেচারী, অত্যন্ত বিনয়ী লোককে খুব শ্রদ্ধার চোখে না দেখা উচিত। যে মানুষ কিছু বিদ্রোহী, সমালোচক সকল কথাই মাথা নত করে মেনে নেয় না,–যে নিজের দাবির কথা জানায়–সেই উপযুক্ত লোক। যে মানুষ বেশি দ্ৰ, সে নিজেকে ছোট করে এবং যার প্রতি ভদ্রতা দেখায়, তাকেও ছোট করে। সন্তুষ্ট অবিদ্রোহী মানুষের শেষ-মৃত্যু ও অসম্মান। অপ্রয়োজনে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে খামাখা কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করা, কারো প্রতি অসন্তোষ পোষণ করা বড় দোষের।
তর্ককালে কখনও রাগবে না, হাসবেও না। নিতান্ত খোলা কথা শুনেও শান্তভাবে উত্তর দেবে।
যতদিন বেঁচে থাকা যায় বই-পুস্তক পড়তে হবে, জগতের খবর রাখতে হবে, নইলে আত্মা অবনত হতে থাকে। মানুষের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারের ও কাজে কামে চিন্তায় কোনোটি ঠিক কোনোটি অঠিক ভালো করে বোঝবার জন্য আমাদের বই পড়তে হবে। নিজেকে
পণ্ডিত ও সম্পূর্ণ মনে করে বই পড়া কোনো সময়ে ইস্তফা দিলে চলবে না।
চিন্তাশূন্য পাঠে লাভ হয় না। যে চিন্তা করে সেই বেশি পণ্ডিত।
কোনো কোনো লোক বলে থাকে–নারীর পড়াশুনার দরকার নেই, তারা সাধারণত অল্পশিক্ষিত লোক। কোনো কোনো অপদার্থ নরপিশাচ বলে থাকে–চাষারাই লেখাপড়া শিখে ভদ্র হতে চেষ্টা করে।
মানুষের সঙ্গে কথা ও ব্যবহারে সর্বদা স্বাভাবিক হবে, এটা বিশেষভাবে স্মরণ করে রাখতে হবে।
পরের অনুগ্রহ বেঁচে থাকার মতো কষ্টের কারণ আর নেই।
কোনো লোক উপহাস বা ঠাট্টা করে বললেও রাগবে না! উপহাসকেই উপহাসরূপে গ্রহণ না করে ধীরে ও শান্তভাবে উত্তর দেবে। মূর্খ বলে ঘৃণা করে থাকা সব সময় ঠিক নয়, পাপী-মূর্খকে সত্যপথে আনা উত্তম কাজ।
কোনো মানুষকে কোনো নতুন কথা বলা তার অজানা বিষয় বোঝাতে হলে কখনও উগ্র হয়ো না, বিশেষ ধৈর্য চাই–গাধা, মূর্খ এই সমস্ত কথা বললে, ফল খারাপ হয়। শিশু ও ছেলেপেলে সম্বন্ধেও এই কথা সত্য।
প্রত্যেক মানুষের একটা বিশেষত্ব ও স্বাতন্ত্র্য আছে। কখনও ইচ্ছা করো না–কোনো মানুষ তার সমস্ত বিশেষত্ব হারিয়ে তোমার মতো হতে পারে। কথায় কথায় ছোটর
সমালোচনা করলে অন্যায় কাজ করা হয়। কি ছোট কি বড় সকলেই বিবেক বুদ্ধির দোহাই। দিয়ে কথা বলে। ডেস্পট ও অটোক্রাটের কথা ও কাজ মূল্যহীন!
ভক্তির দ্বারা এ জগতে বেঁচে থাকা যায় না। স্বাধীনতা ও নিজের মূল্যই জীবন। আনাড়ী ও অপদার্থ লোককে কখনও বেশি সম্মান করবে না–তাদের ভালবাসলে, সম্মান করলে তাদের অধঃপতন হবে।
কর্তব্যের জন্যে প্রাণ অসীম যন্ত্রণা চেপে রাখতে হবে। অসীম ধৈর্য ছাড়া মানুষকে বড় করা যায় না।
মনে অনিচ্ছায় কোনো কাজ করতে নেই। অল্প অল্প করে করলেই কাজ হয়। যা তুমি ভালো করে জান, যা স্বাভাবিক বলবে ও করবে। এইরূপ করলে সিদ্ধি লাভ হয়, অন্যথা হয় না।
কারো পদচুম্বন করে বা দয়া ভিক্ষা করে জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করো না, বস্তুত এইভাবে বাঁচতে পারা যায় না। মানুষকে বেশি ভক্তি জানান পাপ।
অনেক পুরুষ বিয়ের পর অন্ধের মতো হীনস্বভাব পত্নীর মতো হীন হয়ে যান, অনেক সৎস্বভাবা নারীও হীনপ্রবৃত্তির স্বামীর স্পর্শে এসে হীন হয়ে যায়। কুচরিত্র স্বামীর সঙ্গে বাইরে ঝগড়া না করে, তাকে মিষ্টি কথায় সংশোধন করতে চেষ্টা করবে।
যৌবনের ভালবাসায় স্বামীর নীচস্বভাব হয়ে যাওয়া ঠিক নয়। মানুষের এই ভাবের পতন যার পর নাই ঘৃণিত। যেকোনো কাজই হোক না, তা তোমার অনায়ত্ত নয়। সাহসের সঙ্গে একটু একটু করে আয়ত্ত করতে চেষ্টা কর। পাহাড় দেখে ভীত হয়ো না, একটু একটু করে আঘাত কর,-পাহাড় ধুলা হয়ে তোমার গায়ে পড়বে। পরের চোখে না দেখে নিজের চোখে দেখার মধ্যে সফলতা আছে।
অনুগ্রহ লাভের আশায় কারো কাছে প্রাণের গোপন দুঃখের কথা বলতে নেই।
দেশের লোক ছোট ও হীন হলেও তাকে ঘৃণা করো না। যতদিন না তারা বড় হচ্ছে। ততদিন আমরাও বড় হতে পারবো না। ভিতরের দৃষ্টি জ্ঞান ছাড়া কোনো ধর্মপুস্তক মানুষকে বা জাতিকে ধ্বংস হতে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না।
অপ্রিয় সত্যের পরিবর্তে নির্দোষ মিথ্যা বলা উচিত। সত্যটি ঠিক অপ্রিয় কিনা, এ বিষয়ে বিবেচনা চাই। শিশু ও অবোধের কাছেও অনেক সময় নির্দোষ মিথ্যা বলা বিশেষ আপত্তিজনক নয়।
মানুষকে অনেক সময় নিজের গুণ বুঝতে দিতে হবে, নইলে তাদের কাছে তোমার সম্মান হবে না; তাই বলে আত্মপ্রকাশ সব সময় ভালো নয়। নিজের গুণ অন্যকে কাজের খাতিরে জানানো দরকার।
কোনো কোনো লোকের সামনে চুপ করে থাকা উচিত। মূর্খ ক্ষমতাশালী ব্যক্তির সামনে জ্ঞানের কথা বললে তারা রাগে।
মানুষকে বড় করতে হলে, অনেক সময় তাকে প্রশংসা করতে হয়।
জনমত, পুণ্যশক্তি বা আর্থিক প্রভা ব্যতীত জগতে টেকা যায় না। জনমত ও পুণ্যশক্তির মূল্যই বেশি। বাঁচবার জন্য অর্থ, না হয় জনমত সৃষ্টি করতে হবে।
অবাধ্য ও বেগানা লোককে আস্তে আস্তে তোমার শক্তি উপলব্ধি করিও। হঠাৎ তাকে বাধ্য করতে চাইলে সে বিদ্রোহী হবে। কারো সঙ্গে ‘তুই’ ‘তুই’ করে কথা না বলাই ভালো। মানুষ যতই ছোট ও হীন হোক না, কাউকে ছোটলোক বলে গাল দিও না। এরূপ করা পতিত জাতির অভ্যাস-অধঃপতিত মানুষের স্বভাব।
মানুষকে গালি দিয়ে বেদনা দিয়ে কখনও বড় করতে যেয়ো না। পরিশ্রম বৃথা হবে। অন্যায় কথা শুনে বা অন্যায় কাজ দেখে প্রয়োজনমতো মিষ্টি বিনয়-নম্র বা উগ্র ভাষায় প্রতিবাদ করা চাই। যে ভুল করে–তার এবং নিজের অর্থাৎ উভয়েরই মঙ্গল এতে নিহিত আছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা পাপ ও মূর্খতা।
দুর্বলচিত্ত ব্যক্তিরা এক পক্ষের কথা শুনেই প্রকাশ করে।
অতি আত্মীয়ও কোনো অভিযোগ করলে, ঠিক কি না, চিন্তা করে দেখে নিতে হবে।
কেউ কোনো অন্যায় করলে, তা সাধারণকে জানিয়ে দেওয়া উচিত। জনসাধারণের ঘৃণা ও সমালোচনা সহ্য করা কঠিন। অস্ত্র অপেক্ষা জনমতের শক্তি প্রবল।
সেধে দেওয়া দান গ্রহণ না করা দোষ।
অনুগ্রহ দৃষ্টি লাভ করবার আশায় জীবনে কখনও কারো সেবা করতে নেই। মনুষ্যত্বের খাতির ছাড়া অন্য কোনো লোভে মানুষের সেবা করা নিষেধ।
ধনী ব্যক্তিদের ব্যাধিশৰ্যাপার্শ্বে উপস্থিত হলে, লোকে সন্দেহ করে বলে থাকে এই ব্যক্তির সেবা ও সহানুভূতি তোষামোদ ছাড়া আর কিছু না।
যে সম্মান আদায় করে না, তাকে মানুষ সম্মান করে না। মানুষের স্বভাব প্রভুত্বপ্রিয়তা, সে যতই কেন সাম্যের কথা মুখে বলুক না। মানুষের এই কুস্বভাবকে জোর করে ভাঙ্গতে হবে।
মানুষের সঙ্গে শান্তভাবে বুঝিয়ে কথা বললে বেশি কাজ হয়। মূর্খ ও অপদার্থের কথায় উত্তর দেওয়া অনেক সময় অপমানজনক মূখের কটু কথা হাসির সঙ্গে গ্রহণ করাই ভালো।
বয়সে বুড়ো অপেক্ষা জ্ঞানের বুড়ো মানুষের মূল্য বেশি।
কুলসুম বলিলেন–প্রিয় হালিমা, অনেক কথা বলেছি। কথার কি অন্ত আছে? মানুষের ভিতরটা উন্নত হলে পরের কথার জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। সে নিজেই নিজের পথ ঠিক করে নেয়। বাঁধাধরা নিয়ম নারীকে, এমনকি কোনো মানুষের সমাজকে বড় করে রাখতে পারে না। দৃষ্টিই মানবজীবনের প্রধান অবলম্বন।
কুলসুম হালিমার গলা ধরিয়া বলিলেন-প্রার্থনা করি, আল্লাহ, তোমাকে আদর্শ বধূ করেন।
হালিমা জিজ্ঞাসা করিলেন-বধূ জীবনের কথা শুনলাম। স্বামী ও শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর কি কোনো কর্তব্য নেই?
কুলসুম : আছে–প্রত্যেকের আছে। তাঁদের মঙ্গলকামী বন্ধু যাঁরা, তাঁরাই তাদের কর্তব্য কথা শোনাবেন। হালিমা আঁখিজলে কহিলেন–ভাবি, আশীর্বাদ করুন বধূ জীবনের কর্তব্যগুলি যেন সর্বাংশে পালন করতে পারিনারী জীবনকে সার্থক করে তুলতে সমর্থ হই।