- বইয়ের নামঃ পথহারা
- লেখকের নামঃ লুৎফর রহমান
- প্রকাশনাঃ বাংলাদেশ তাজ কোম্পানী লিঃ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-০৫. হরিদয়াল ঠাকুর
প্রথম পরিচ্ছেদ
হরিদয়াল ঠাকুর তাঁর স্ত্রী একটা শিশু-কন্যাকে লইয়া গঙ্গার ঘাটে স্নানে আসিয়াছিলেন। অসংখ্য লোকের ভিড়–কে কার খোঁজ রাখে।
স্নান শেষে হরিদয়ালের স্ত্রী কন্যা বুকে করিয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন। ঠাকুর কিছু জলযোগ করিয়া ঘাটে জল খাইতে গিয়াছেন, এমন সময় শান্তা কাঁদিয়া চিৎকার করয়া উঠিলেন–“আমার খুকি কই?”।
ঘাটে ঘটি ফেলিয়া ঠাকুর ফিরিয়া আসিলেন। যাহা দেখিলেন তাহাতে মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। কই তাঁহার খুকি? সেই হাসিমাখা সুন্দর খুকি–যাহাকে কোলে করিয়া একঘণ্টা আগে তিনি আদর করিয়াছেন–সে কোথায় গেল! শান্তা কহিলেন–তাঁহার একটু তন্দ্রা আসিয়াছিল–সহসা একখানা কঠিন হস্তের স্পর্শ তিনি অনুভব করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলিয়া দেখিলেন তাঁহার খুকি নাই। তখনও বুকেতে শিশুর মুখের ক্ষীরধার লাগিয়াছিল। জননী আকুল আর্তনাদে গঙ্গার ঘাট কাঁপাইয়া তুলিলেন। কে কাহার কথা শুনে–সকলেই স্নানে ও ধর্মকর্মে ব্যস্ত।
বুকের বেদনা কণ্ঠ ভাঙ্গিয়া বাহির হইতে ছিল। সমস্ত দৃশ্যটা তাহার কাছে সহসা বিষাদে ভরিয়া উঠিল। যে প্রকৃতি এই মাত্র তাঁহার মাতৃ-হৃদয়ে আনন্দ ও হাসির ধারা বহাইয়া দিতেছিল, সহসা একি তাহার মৌন মলিন বদন।
কী ভীষণ বেদনা! মাতৃহৃদয়ের অসীম জ্বালা কে বুঝিবে তখন? জনকতক লোক শুষ্ক সহানুভূতি ও কৌতূহল লইয়া শান্তার উপর বিরক্তি প্রকাশ করিয়া জ্ঞানেরও অধিক স্নেহের পরিচয় দিতেছিল।
সহসা একটি টুপিপরা যুবক জনতা হইতে মাথা ঠেলিয়া বলিয়া উঠিল, “কী বাছা! কী হয়েছে?”
পথের লোক স্নান শেষ করিয়া সেখানে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়াছিল, অপবিত্র হইবে ভয়ে তাহারা সরিয়া গেল। যুবক সেদিকে আদৌ লক্ষ্য না করিয়া আবার জিজ্ঞাসা করিল–“কী মা, কী হইয়াছে?”
শান্তা কাঁদিয়া বলিয়া উঠিলেন–বাবা! সর্বনাশ হইয়াছে। গুণ্ডায় আমার মেয়েকে চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে। ওগো আমার কী হবে? কেন গঙ্গার ঘাটে পুণ্যি করতে এসিছিলাম!” বলে শান্তা মূৰ্ছিতা হইয়া পড়িলেন।
যুবক ব্রাহ্মণকে সেই স্থানে দাঁড়াইয়া থাকিতে বলিয়া ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেলেন।
সেবক-সমিতির ছেলেদের সহিত মোয়াজ্জেম বেড়াইতে আসিয়াছিল। সে এই হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখিয়া অত্যন্ত বেদনা অনুভব করিল। সেবক-সমিতির নেতা হেমেন্দ্র তাহার –বন্ধু। হেমেন্দ্র লাঠি হাতে করিয়া চতুর্দিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। এমন সময় মোয়াজ্জেম যাইয়া কহিল–“হেমেন্দ্র, সর্বনাশ হইয়াছে। শান্তা নাম্নী এক ব্রাহ্মণ মহিলার মেয়ে চুরি হইয়া গিয়াছে।”
ভাবিবার সময় ছিল না। তড়িত বার্তার মতো ছেলেদের সাহায্যে এই আকস্মিক দুর্ঘটনার সংবাদ সর্বত্র প্রচারিত হইয়া পড়িল। প্রায় পঞ্চাশজন কলেজের ছাত্র ঘাটে পথে যাত্রীদের মধ্যে কোনো বিপদ হয় এই ভয়ে সর্বত্র পাহারা দিতেছিল।
ছেলেদের আশ্বাস বাক্যে শান্তার বুকে বল আসিল। হরিদয়াল ও শান্তা মনে করিলেন শীঘ্রই তাঁহারা তাহাদের শিশুকে ফিরাইয়া পাইবেন।
সমস্ত দিন অতিবাহিত হইল। কোনোও খবর পাওয়া গেল না। সন্ধ্যার আঁধারের সঙ্গে সঙ্গে শান্তার হৃদয়ে পুনরায় আঁধার ও বেদনায় ভরিয়া উঠিল। ধীরে ধীরে যাত্রীদের ভিড়ও কম হইয়া আসিল। আপনাদের ক্ষুদ্র ছোট কথা লইয়া চলিয়া যাইতে লাগিল।
আজই সন্ধ্যায় তাঁহারা বাড়ি ফিরিয়া যাইবেন, ইহাই সকাল বেলা শান্তা স্বামীর সহিত ঠিক করিয়াছিলেন। কিন্তু একি বজ্রাঘাত! যাহা স্বপ্নেও তিনি কখনো ভাবেন নাই তাহাই আজ তাহার ভাগ্যে ঘটিল। দেবতাকে তিনি কি এইরূপে পূজা করিতে আসিয়াছিলেন? ইহাই কি সেবার ফল?
সারা বছরের ছোট-বড় ভুল মুছিতে তিনি স্বামীর সহিত মন্দাকিনী-নীরে অবগাহন করিতে আসিয়াছিলেন। এমন করিয়া তাহার বুকের মানিক হারাইয়া যাইবে–যদি তিনি। জানিতেন, তাহা হইলে কখনো গঙ্গাস্নানে আসিতেন না।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
দশ বছর পরেকার কথা। হুগলীর মুসলমান-বোর্ডিং-গৃহের যে পার্শ্বে গঙ্গা সেইদিকের একটি স্তম্ভে বসিয়া দুই বন্ধু হাসিয়া হাসিয়া খুন হইতেছিলেন।
সমস্ত রাত্রি মোয়াজ্জেম হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গে শহর ঘুরিল–কিন্তু কোনো ফল হইল না।
বোর্ডিং-গৃহের এই দিককার দৃশ্য অতি চমৎকার। নদীর ভিতর হইতে সারি সারি স্তম্ভ শ্ৰেণী, সুরক্ষিত দীর্ঘ প্রাচীরের উপর প্রাচীর। যখন দৈনন্দিন জোয়ার আসিয়া এই প্রাচীর পাদমূলে আছড়াইয়া পড়ে, তখন স্তম্ভের উপর দাঁড়াইয়া মনে হয় সমুদ্রকে জয় করিবার জন্যই তাহার বুকের উপর দাঁড়াইয়া আছি। যখন রাত্রিকালে গগনে চন্দ্রোদয় হয় তখন সেই নৈশ শোভাই বা কী সুন্দর! সংসার-তাপক্লিষ্ট মানুষ পিনিসে চড়িয়া যখন সেই চন্দ্রকরোজ্জ্বল গঙ্গার বুকের উপর দিয়ে ভাসিতে ভাসিতে যায়, তখন মনে হয়–এই পাপ ও নীচতা ভরা সংসার ছাড়িয়া অনির্বচনীয় আধ্যাত্মিক আনন্দে গঙ্গার শীতল বুকে সাঁতরাইতে সাঁতরাইতে অনন্তের সন্ধানে আকাশ ও সমুদ্রের যেখানে মিলন সেই দূর-অতি নির্জন গম্ভীর ভাবময় প্রান্তে চলিয়া যাই।