ফেলী বলিল–আমরা কয়েকদিন খাই নাই। চাকরটি বলিল–হারামজাদি, বাজারে যেয়ে পয়সা উপায় কর। ভদ্রলোকের জাত মারতে এসেছি। সকলেরই ওজু নষ্ট করুলি!
ফেলীর মা আবার বলিল–কিছু ভিক্ষা চাই। চাকরটি বিলম্ব না করিয়া ঘাড় ধরিয়া তাহাকে এক প্রচণ্ড আঘাত করিল।
ফেলী বলিল–মা, চল যাই, ফিরে যাই। আমরা দাই। দাই, ছোট লোকের কোথাও স্থান নেই।
.
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
রাত্রি তখন তিনটা। সহসা তিনটা মেয়ে তিনখানা থালা লইয়া এদের ঘরে প্রবেশ করিল।
এই গভীর রাতে আকাশ হইতে তিনটি সুরবালা তিনখানি অমৃত থালা লইয়া এবাদের সম্মুখে উপস্থিত। প্রত্যেক থালায় নানাবিধ মিষ্টান্ন, সঙ্গে তিনটি কাঁচের গ্লাসে স্বর্গীয় গন্ধামোদিত সরবৎ।
একটি বৃদ্ধা নারী একটা তীব্র আলোকবিশিষ্ট প্রদীপ রাখিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরখানি গন্ধে ও আলোতে ভরিয়া উঠিল।
কামরার ভিতরে ঘরে–টেবিলের উপর মিষ্টান্ন রাখিয়া প্রথম সুন্দরী এবাদের মুখে জল ছিটাইয়া দিয়া কহিল–জামাই শ্রেষ্ঠ! মুখ ধোও।
সন্ধ্যা হইতে একাকী জনমানবহীন প্রকোষ্ঠে বসিয়া থাকিতে এবাদের ঘুম। পাইতেছিল। এবাদ চিন্তার কোনো ধার ধারে না। পার্শ্বের চৌকিতে সে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইয়াছিল।
মুখ দেওয়া হইলে তিনখানি মিষ্টান্ন থালা এবাদের সম্মুখে রাখা হইল। এবাদ নির্বিকারচিত্তে সেগুলি গলাধঃকরণ করিতে লাগিল।
প্রকোষ্ঠ কার্পেট মোড়া। অতঃপর কার্পেটজড়িত মেঝের উপর তালে তালে পা ফেলিয়া বিচিত্র ভঙ্গিতে এ উহার গায়ে হেলিয়া সুরবালার নর্তন আরম্ভ করিল।
এবাদের মুখে কথা নাই। তিনি নয়ন ভরিয়া দেখিতে লাগিলেন। যুবতীরা গান ধরিল। এস, এস, বিদেশী দেবতা, তুমি আমাদের মহারানী ফিনির প্রাণ কেড়ে নিয়েছ। মিস্ ফিনি আজ গলায় ফুলের মালা পরবে না! মিস্ ফিনি কুয়াশাময় মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়েছিলেন।
সহসা তার মাথার উপর একরাশ ফুলের বাহার ঝরে পড়েছে। রানী ফিনি আজ তাঁর প্রিয়কে নিয়ে চাঁদের আলোতে খেলা করবেন।
এবাদ একটি কথাও বলিতেছিল না। সমস্ত জীবন সে আর এমন উন্মাদনা কখনও অনুভব করে নাই। একখানি সম্পদ ভরা দেহের কল্পনায় সে সহসা উদ্বেল হইয়া উঠিল। সে সকল কথা ভুলিয়া গেল! কে সে, তাহার বাড়ি কোথায়? কেন তাহার এই বর্তমান অবস্থা? কিছুই তাহার খেয়াল আসিল না।
ওঃ! যে মিস ফিনি তাঁহার অপূর্ব যৌবনমাধুরী লইয়া তাহার আশে-পাশে কত ঘুরিয়া বেড়াইয়াছেন, আজ সেই ফুলরানী মিস্ ফিনির সহিত তাহার বিবাহ! এবাদ ভাবিল, মিস ফিনিকে লইয়া সে চিরজীবী বন্দি থাকিতে পারে না! অন্ধ অন্তর যেন আজ তাহার খুলিয়া গেল। তাহার জীবনের একটা পাশ এতকাল একেবারে ঘুমাইয়াছিল।
আজ যেন তার নূপুর শিজ্ঞনে সমস্ত লুপ্ত আকাঙ্ক্ষা বাধাহীন উত্তেজনায় তাহার শিরায় শিরায় নাচিয়া উঠিল।
মৌন, ভাবহীন কল্পনাহীন এবাদ মধুর হাসি হাসিয়া সেবিকা ও নাচওয়ালী সুন্দরীর দিকে তাকাইয়া কহিল–সুন্দরী, আর এক পেয়ালা শরবত। সেবিকা স্বর্ণাধারে আরও খানিক লালরক্ত ঢালিয়া দিল।
এবাদ তাহা পান করিল। আহা! সংসার কী মধুর! এখানে দুঃখ নাই, বেদনা নাই–কেবল আনন্দ! কেবল সুখ। এবাদ আরও ভাবিল–পৃথিবীর এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত। পর্যন্ত কেবল ফুলের বাগান। অনন্ত সুন্দরী তাহাদের নগ্ন সৌন্দর্যমুক্ত করিয়া হাসিয়া খেলিয়া বেড়াইতেছে। যে এই আনন্দ ও সৌন্দর্য ভোগ করে না সে নিতান্তই অপদার্থ। এবাদ ছোখ পুঁজিয়া দেখিল রমণীরা কুসুমের মালা রচিয়া এ উহার গায়ে হানিতেছে। তাহাদের হাসিতে সুধা ঝরিয়া পড়িতেছে। ওহে! কে এমন নরাধম আছে যে, এইসব সুন্দরীদের পায়ের তলে সুখের আবেশে আপনাকে চূর্ণ করিয়া দেয় না?
কীসের মনুষ্যত্ব? কীসের ঈশ্বর? রমণীই ঈশ্বর!!
আহা, রমণীর চুলগুলি কী সুন্দর! কী মাদকতাভরা! উহা অনুভব করিবার বলিবার নহে। এক একটা চুলের জন্য এক একটা রাজত্ব দেওয়া যাইতে পারে। রমণী বেলীর তীব্র মধুর বিষ কী মহাআবেগে সমস্ত আত্মাটাকে গ্রাস করিয়া ফেলে। রমণীর মুখোনিতে ধরার তাবৎ মধু-মাখান। ওষ্ঠের বঙ্কিম হাসি কামানের গোলা অপেক্ষা ভয়ঙ্করী। নিতম্বে তার আত্মার জীবন-রস তরঙ্গায়িত হইতে থাকে। পা দিয়া সে সমস্ত সংসারটা চূর্ণ করিয়া দিতে পারে। যখন সে সংসার বুকে বিচরণ করিতে থাকে তখন মাটি অসীম পুলকে কাঁপিয়া উঠে। তাহার তীব্র কটাক্ষে পৃথিবীর গতি সৃষ্টি হইয়াছে। তাহার মাদকতা ভরা রামধনুর মতো সমস্ত আলো-বাতাসে রঙ ফলায়। রমণী রানী! রমণী মহারানী!
এবাদ চোখ খুলিয়া চাহিল দেখিল মিস্ ফিনি মহারানীর বেশে তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান। সারা বিশ্বের সৌন্দর্য সংগ্রহ করিয়া মিস ফিনির চারু মোহিনী মূর্তি নির্মিত। পরণে রক্তবস্ত্র। এবাদের বুকের ভিতর কামনার আগুন দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। স্বর্গের শ্রেষ্ঠ ও সুখ ও সৌন্দর্য পরী-মূর্তি গ্রহণ করিয়া তাহার সম্মুখে উপস্থিত।
বৃদ্ধ পুরোহিত মিস্ ফিনিকে এক রৌপ্যনির্মিত আসনে বসাইলেন। অতঃপর পুরোহিতের নির্দেশমতো নর্তকী বালিকারা এবাদের পোশাক খুলিয়া ফেলিল।
কোনো সময়ে পুরোহিত তাহার পবিত্র পুস্তক ও মন্ত্রপুত দণ্ড লইয়া তাহাদের বিবাহ কার্য সুসম্পন্ন করিতে আসিয়াছেন এবাদ তাহা জানে না। তাহার হৃদয় আনন্দে চিত্তে নাচিয়া উঠিল। কোনো পুণ্য কার্যপ্রভাবে এবাদের আজ এত সুখ? স্বর্গ যেন আপন ইচ্ছায় তাহার মাথার উপর ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। গর্বে ও উল্লাসে এবাদের মন ভরিয়া উঠিল।