না। মোরে মনির আইয়া খবর কইছে।
মোগ কথা কিছু কয় নাই।
না। ঢাকায় যাইতে পাইরা ও খুব খুশি। কইছে আর কনুদিন ও ফিরা আইবে না।
সেয়ানা পোলা।
ও খুব দুখু পাইছে, না বাবো।
পাইছে মনে অয়।
হঠাৎ করে রাহানুম ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
ও মোগ ভুইল্যা গেল ক্যামনে?
তখন আবুল হাশেম আজকের দিনের তৃতীয়বারের মতো আচমকা হাসি হেসে ওঠে। হা-হা হাসতেই থাকে। নিমেষে স্তব্ধ হয়ে যায় রাহানুমের কান্না, বিস্ফারিত চোখে শুকিয়ে থাকে আবুল হাশেমের দিকে। আবুল হাশেমের হাসি থামার পরও ও কেন হাসল এই প্রশ্ন করতে পারে না। আবুল হাশেম ঘরের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও ফিরে। দাঁড়ায়। বলে, মোরাই তো ভুইল্যা গিয়া ওরে এতিম বানাইয়া দিলাম। হেইলে ও ভুলবে না ক্যা? ‘
কন দোষ কি মোগ?
ও যা হরছে ভালই হরছে। মোগ আর দুকুখ কি? মোরা তো ওরে তাড়াইতেই চাইলাম। ঠিক না মাগো?
রাহানুম আচমকা প্রশ্ন করে, বাবো আমনহে কি মোরেও তাড়াইতে চান?
মুই চামু ক্যা? তুমিতো যাইতে চাইল্যা মাগো? কতো সব পাকা অইছে।
বলতে বলতে আবুল হাশেম ঘরে চলে যায়। রাহানুম নড়তে পারে। আবুল হাশেম তো ঠিকই বলেছে। মিথ্যে নয়। তবু রূঢ় কথা শুনতে খারাপ লাগে। কোনো কিছু খারাপ লাগলে মাথাটা ঝিম মেরে যায়। তবু ও জোর করে শক্তি সঞ্চয় করে এবং সব ঝেটিয়ে নিজের হৃদয়ের দিকে তাকায়, সত্যিইতো ও তো চেয়েছিল সুখদীপের কাছ থেকে মুক্তি। সুখদীপ নিজের পথ বেছে নিয়ে চলে গেছে। ওকে বলে কয়ে বিদায় নেয়নি। তাতে কি এসে যায়? ও কেন এটা ভেবে আহত হচ্ছে? ছেলেটাকে আঘাত করার আগে ও তো সুখদীপ কতটা আঘাত পাবে তা একবারও ভাবেনি।
সন্ধ্যা হয়েছে। মাথার ওপরের গাছটায় পাখিগুলো তারস্বরে চেঁচামেচি করছে। ঘর তো আশ্রয়, তবে ওরা চেঁচায় কেন এমন? আনন্দেই? নিশ্চয়ই আনন্দের কলরব। এই ঘরের আকাঙ্ক্ষাইতো ওর মধ্যে দীপ্র হয়ে উঠেছে। ও আরো কিছুক্ষণ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে করব শোনে, নিজের হৃদয় মেলে দেয়, ভরুক, এই শব্দে ভরে যাক ওর হৃদয়, যেন নিতে না হয় অনেক দূরের পাড়ি, আর কোনো অপেক্ষা নয়। রাহানুম দু’পা এগিয়ে আবার ফিরে আসে।
অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে, আকাশে মেঘ এবং চাঁদ, পূর্ণিমার শেষ। সামনের ধানক্ষেত, মেঠো রাস্তা, দূরের বাড়ি সবটাই জবেদ আলীর বুক। এবং পিঠের মতো। মনে হয় ওই রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে একজন মানুষ, তেল চপচপে চুলগুলো উল্টিয়ে আঁচড়ানো, সিথি নেই। গায়ে নীল রঙের জামা, পরনে সবুজ লুঙ্গি, লোকটার বুকে পাখিদের কলরব। রাহানুম দেখতে পায় কলরব বিস্তৃত হচ্ছে, প্রথমে ধানক্ষেতে। কলরবে ধানক্ষেতের মাথা কাঁপছে, কাপুনি মাদকতাময় শিহরণের জন্য, ওখানে লুকিয়ে আছে জবেদ আলী, এই অন্ধকারের মতো কালো শরীর, অনেকটা পোড়া কাঠের মতো। এরপর কলরব বিস্তৃত হয়ে মেঠো রাস্তায়, কলরবের তুমুল উদ্দামে মাটি চৌচির, গুঁড়িয়ে যায়, ধুলোতে ভরে যায়। পথ, লাল ধুলো ঢেকে ফেলে চারদিক, কোথাও কোনো মানুষ নেই, কিছুই দেখা যায় না, শুধু জবেদ আলী ভেসে থাকে ধুলোর ওপর, ওর সঙ্গে আকাশের মিতালী।
এরপর কলরব বিস্তৃত হয় গাছে, গাছের পাতার শিরা-উপশিরায় ধ্বনি, প্রবল ধ্বনি গর্জে ওঠে শাখায়, বাকলে, পত্রের রঙে, কোথাও কোনো নিঃশব্দ-নির্জন জায়গা নেই, ওই ধ্বনি একজনের কণ্ঠস্বর, সে মানুষ জবেদ আলী–একমাত্র মানুষ, যার কণ্ঠস্বর রাহালুমের অন্তর পর্যন্ত পৌঁছায়।
কলরব আরো বিস্তৃত হয় ঘরবাড়িতে, যে বাড়িগুলোতে মানুষেরা বসে আছে, প্রবল কলরব বুকে চেপে বসে আছে, ওরা অপেক্ষা করছে একটি আহ্বানের জন্য–সে আহ্বান জবেদ আলীর। ও ওদের ডেকে বলবে, আমি বউ নিয়ে এসেছি, তোমরা ওকে বরণ করো।
সঙ্গে সঙ্গে সব মানুষের হৃদয়ের অর্গল খুলে যাবে, ওরা গান গেয়ে উঠবে, নতুন কুলোয় ধান-দুর্বো, সুপোরি রেখে ওকে বরণ করবে।
গুরুজনের আশীর্বাদে ভরে যাবে ওর সৌভাগ্য। দুকান ভরে কলরব শুনতে শুনতে নিমগ্ন হয়ে যায় রাহানুম।
আবুল হাশেম বারান্দা থেকে তীক্ষঋরে ওকে ডাকে, ও শুনতে পায় না। ওর কানে তো একটাই কণ্ঠস্বর, সেটা ভেঙে ভেঙে শত হয়–সমবেত কণ্ঠ ওর মঙ্গলধ্বনি উচ্চারণ করছে। রাহানুম এতক্ষণে নিজেই এক থেকে বহুর মধ্যে বিস্তৃত হয়। বিস্তার সাগরের মতো বাড়ে।
আবুল হাশেম দ্বিতীয়বার আরো উচ্চকণ্ঠে ওকে ডাকে। ও শুনতে পায় না। এখনতো অন্যকিছু শোনার সময় নয়, এখনো তো কারো আহ্বানে সাড়া দেবার সময় নয়। ও নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।
তখন আবুল হাশেম দ্রুত পায়ে এসে ক্রোধে ফেটে পড়ে। রাহানুম কোথায় থাকতে পারে অন্ধকারে তা অনুমান করে নেয়। চিৎকারে কণ্ঠে আলো প্রস্ফুটিত হয়, সে আলোয় রাহানুম দেখতে পায় আবুল হাশেমকে, সাদা ধবধবে চুল, দাড়ি, খালি গা, বুকের পশমও সাদা, সাদা লুঙ্গি পরে আছে, বাহাতুরে বুড়ো।
কতকুন ধইরা বোলাই কানে হোনো না?
ক্যা, বোলান ক্যা?
রাহানুম চড়াও হওয়ার চেষ্টা করে অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে, সেটা মুখ্য নয়। একজন মানুষ আর একজনকে হাজারবার ডাকতে পারে। কিন্তু কেন ডাকবে? আবুল হাশেম কেম ওর নিজস্ব সময় নষ্ট করবে? ওরওতো কিছু ভাবনা থাকতে পারে, যেখানে ও কোনো গোলযোগ চায় না। ওরওতো কিছু একান্ত সময় দরকার, যেটা শুধু ওর একলার, আর কারো নয়, যেখানে ও কোনো ঝামেলা ঢুকতে দিতে চায় না। ও আবুল হাশেমকে উপেক্ষা করে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়।