এবার আর জবেদ আলীর বাপের ভুরু কপালে ওঠে না। সরাসরি প্রশ্ন করে, হাসেন ক্যা মহাজন?
তোমার রাগ দেইক্যা হাসি।
মুই গরিব মানু। মোর আর রাগ কী?
বেড়া মানু রাগ করলে মনের জোর বাড়ে।
গরিবের ঠ্যাংয়ে জোর নাই, কোমরেও জোর নাই। কেবল মনের জোর দিয়া কি প্যাডের খিদা পুরে? যারা প্যাডের খিদা পুরাইতে পারে না হেরা কি বেড়া মানু? হেরা গলে মাইয়া মানু। মুই বেড়া মানু না। মহাজন।
কি কইলা?
হাছা কতাই কইছি। মুই ক্যাবল শাড়ি পিন্দি না। তফাৎ এই। মুই আর মোর বউ হমান। হেওতে ধান ভাইনা দুইডা টাকা কামাই করতে পারে। হাটে যাওনের সময় নিজের খুতি ভাইঙা টাহা দেয়। মুই সওদা আনি। হে ভাত রানধলে মোরা খাই। মোগ খিদা মিডে।
জবেদ আলীর বাপ কথাগুলো বলে ঈষৎ হাসে। এখন ওকে একজন পীরের মতো দেখাচ্ছে। আবুল হাশেম যেন ওর মুরিদ। কতকাল ধরে এই দরগায় পড়ে আছে ও। অথচ এই লোকটিকে এত কাছে থেকে আগে এমন করে দেখা হয়নি। আবুল হাশেম মনে মনে চমকে ওঠে। জবেদ আলীর বাপের হাসিতে ব্যঙ্গ না দুঃখ তা আবুল হাশেম বুঝতে পারে না।
একটু আগে আবুল হাশেম ওকে বিদ্রুপ করে দু’বার হেসেছে। এখন মনে হচ্ছে ও বেকুবের মতো হেসেছে। এই অর্থহীন হাসি হাসার জন্য আবুল হাশেম লজ্জিত হয়।
জবেদ আলীর বাপ মুখে হাসি রেখেই বলে, কিছু কইলেন না যে মহাজন?
থামো, বেশি বক বক কইরো না।
ও নিজেকে সামলে নিয়ে ধমক দেয়। কিন্তু দেখতে পায় জবেদ আলীর বাপের ঠোঁট থেকে হাসি মুছে যায় না। লোকটি আবার উদাস হয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। এগিয়ে আসছে গ্রাম। নৌকা খালে ঢুকেছে। ওর বাড়ির সীমানা দেখা যাচ্ছে।
ওর বাড়ি যত এগিয়ে আসে ততই শরমে মরে যায় আবুল হাশেম। নৌকা থেকে লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে ওর একটা পা কাদায় পড়ে। স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা ঢুকে থাকে কাদার মধ্যে। হা-হা করে ওঠে জবেদ আলীর বাপ। মাঝিকে কষে ধমক দেয়, হারামজাদা চোহে দেহ না? কাদার মধ্যে নৌকা গুলি ক্যা?
আর কোনহানে থুমু? জাগাতো নাই। অহন ভাটি না?
মাঝি গজগজ করে।
মহাজন চোহে দেইক্যা লাফ দেবে না?
হইছে, হইছে থাম তোরা।
আবুল হাশেমের রাগে শরীর কাঁপে। কিন্তু কিছু করার নেই। জবেদ আলীর বাপ কাদার মধ্যে থেকে ওর স্পটা টেনে বের করেছে।
খালের পানিতে পা ধুয়ে জুবেদ আলীর বাপের উঠোনে এসে দাঁড়াবার পরও ওর মনে হয় ও শরমে মরে যাচ্ছে। খিদেয় মাথা চক্কোর দিচ্ছে, তবু ওর খাবার কথা চিন্তা করতে ভালো লাগে না। একটু পর খাবার আয়োজন হয়। জবেদ আলীর মা রান্না ভালো করে। কিন্তু ঠিকমতো খেতে পারে না আবুল হাশেম, যেন কোনোকিছু ঠিকমতো গলা দিয়ে নামতে চায় না। ও ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করে। জবেদ আলীর বাপ দু’টুকরো ইলিশ উঠিয়ে দিতে গেলে বাম হাত দিয়ে বাধা দেয়।
দিও না, খাইতে ভাল্লাগে না।
রান্দা ভালো অয় নাই?
অইছে। মোর জিহ্বায় স্বাদ নাই।
বাড়ির লাইগ্যা মন পোড়ে?
ক্যা? পুড়বো ক্যা? বাড়িতে কেডা আছে?
মাইয়া।
আবুল হাশেম জবাব দেয় না। জবেদ আলীর বাপের মাইয়া শব্দটি শানে কেবল। জবেদ আলীর বাপ বিভিন্ন চেষ্টায় আবুল হাশেমের মনে মাইয়া শব্দটি প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ওর মনে মতলব কাজ করে। তাই আবুল হাশেম উপেক্ষা করে–উপেক্ষা করে বোঝাতে চায় যে গায়ের জোরে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় না। তার জন্য খুব গভীর ভিত লাগে। রাহানুম এবং সুখদীপের সঙ্গে আবুল হাশেমের সম্পর্ক ছুটে গেছে। ও কাচের বাসনের ধারে মুখ লাগিয়ে ফুডৎ করে ডাল টানে। কিন্তু জবেদ আলীর বাপের দিকে তাকাতে পারে না। কিছুতেই ওর গ্লানি কাটে না।
হাত ধোয়ার সঙ্গে সঙ্গে পান এসে যায়। পানের খিলি মুখে পুরে আর দেরি করে না আবুল হাশেম। এখন না বেরুলে সন্ধ্যার আগে পৌছুতে পারবে না। এই মন খারাপের মধ্যে খুব আকস্মিকভাবে বাড়ির জন্য একটা টান ওঠে। একটু আগেও জবেদ আলীর বাপের প্রশ্নের উত্তরে ও বাড়ির কথা অস্বীকার করেছিল।
মহাজন, কতা তো পাকা?
হ। কতা পাকা। ছামনের মঙ্গলবার। তোমরা কয়জন আবা?
ধরেন চাইর-পাঁচজন আমু।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
দরজার পাশ থেকে জবেদ আলীর মা কথা বলে, আবারো আইবেন মহাজন।
দেহি।
আবুল হাশেম পা বাড়ায়। ও পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। সূর্য ঠিক ওর মুখের ওপর। খাড়া রোদ মাথা তাতিয়ে দেয়। দ্রুত পায়ে হাঁটে ও ঘাটে নৌকা তৈরি।
০৪. সন্ধ্যার আগেই নিজের গ্রামে
সন্ধ্যার আগেই নিজের গ্রামে পৌঁছে যায় ও। আলীপুর বাজার থেকে তিন মাইলের পথ। আগের মতো হাঁটতে পারে না। বুকে হাঁফ ধরে। নইলে ও অনেক আগেই পৌঁছে যেত, তখনো হালকা আলো চারদিকে ছড়িয়ে। রাহানুম বাড়ির বাইরের রেন্ডি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে, কিছুটা বিষণ্ণ এবং উদাস। আবুল হাশেম ওকে দূরে থেকে চিনতে পারে না। ভাবে অন্য কোনো নারী। কাছাকাছি আসতেই রাহানুম চেঁচিয়ে ওঠে, ও বাবো।
কি অইছে?
আবুল হাশেম গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়ায়, তখনো বুকের হাফ ছাড়েনি, শরীরে ঘাম, যেন গা পুড়ে যাচ্ছে এবং মনে গ্লানি। এতদিনে আবুল হাশেম বোঝে যে গ্লানি কাটিয়ে ওঠা কঠিন কাজ। বাবো সুখদীপ কুয়োকাটা গোনে চইল্যা গেছে।
কোম্মো?
ঢাকা।
ক্যামনে গেছে?
এক বেডা আর মাতারি আইলো বেড়াইতে। হেরা হেগো কামের মানু বানাইয়া লইয়া গেছে। সুখদীপ হেগো হামনে কান্দাকাটি করছে। কইছে মুই এতিম। মোরে আমনহেগো লগে লইয়া যান।
তোর ধারে কইয়া গেছে?