জামাল ওকে নিয়ে বেড়াতে অলোবাসতো। পুকুরপাড় থেকে উঠে আসতে রাত হয়ে যেত–ওদের চারদিকে জোনাকির ভিড় জমে উঠত। মাত্র দুটো বছর, তবুতো এখনো জামালই–সবকিছু ফুরিয়ে যাবার পরও ছয় বছর পেরিয়েছে তবু জামালই ওর জীবনে সত্য হয়ে আছে। এই সত্য এখন আর ওর মানতে ভালো লাগে না–এই সত্যকে ও অস্বীকার করে নতুনের প্রতিষ্ঠা চায়। যেমন করে একদিন জামাল ওর জীবনে নতুনের দরজা খুলেছিল। কত রাত, কত দিন ওদের ভালো লাগার মুহূর্ত পেরিয়েছে। ওদের খুনসুটি দেখে রাগ করত ওর ভাশুর। রাগী মানুষটির কাছে হৃদয়ের ব্যাপারগুলো ছিল উপেক্ষণীয়, মূল্যহীন। কিন্তু জামাল তার বড় ভাইয়ের মনোভাব কখনো মানেনি। রাহালুমের সঙ্গে ওর শারীরিক সম্পর্কের চেয়ে অনেক গাঢ় সম্পর্ক ছিল মনের। তাহলে জামালই কি ওর জীবনের একমাত্র মানুষ থাকবে? রাহানুম পাতাটা পায়ের নিচে রাখে। মনে মনে বলে, না, এই শুকনো পাতার মতো ঝরে যাবে জামাল। আবার বসন্ত, আবার নতুন পাতা গজানোর দিন। আমি কিছুতেই ফুরিয়ে যাব না।
আমি কি একজন মানুষ? না, অনেকজন? আমি কি ঢেউয়ের মতো ভেঙে ভেঙে বিশাল হই? ঢেউ যেমন স্রোতে মিশে যায়—খলখল কলকল শব্দে গড়ায়–গড়াতে গড়াতে–আহ আমি আর ভাবতে চাই না। ও তখন শুকনো পাতা পায়ের নিচে মাড়িয়ে চলে, একটি দিনের শুরু, আর একটি দিনের শেষ। অতএব আমি অনেক, অনেকজন। চারদিক থেকে সাদা আলো মুছে যাচ্ছে–দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। উঠবেই। তাই সরে যাচ্ছে গাছের মাথার ওপর থেকে ফিকে অন্ধকার। রাহানুম অস্থির বোধ করে। এক পা দুপা ফেলে জঙ্গলের ভেতর খানিকটা হেঁটে আসে। এখানে অন্য কোনো প্রাণী নেই, ভয় শুধু সাপ, নয়তো শুয়োপোকা। শুয়োপোকা ভীষণ ভয় পায় রাহানুম। হঠাৎ করে সেই ভয়ে ও চারদিক তাকায়–পাতার নিচ, পাতার ওপর দেখে। না কোথাও খুঁয়োপোকা নেই। সামনে পিছনে সাপও নেই। এই মুহূর্তে এটা ওর জন্য ভীষণ নিরাপদ জায়গা। তবুও ওকে ঘরে ফিরতে হবে।
এই মেঠো শুকনো মাটির পথ বেয়ে আমাকে পৌছুতে হবে ঘরে–ঘরে আমার জন্য অনেক কাজ অপেক্ষা করছে। আমি গেলে নড়বে গৃহস্থালি, সুস্থির হবে গৃহস্থালি–সেই ভুবন একটি স্বাভাবিক আকার পাবে। নইলে নকশা উল্টে যাবে, বেঢপ আকার গ্রাস করে ঘরের মানুষকে–প্রত্যেকে বিরক্ত হয়, মন খারাপ করে এবং তা কারোই কাম্য নয়। সুতরাং আমাকে যেতেই হবে। নিজের জন্যও এই যাওয়া। আমি এখন বৃত্তের মধ্যে প্রবেশ কর।
রাহানুম হিংরার টুকরি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। গাছের আড়াল থেকে তখনো বের হয়নি। পা দুরে কি দাবে না তখন পেছনে শুনতে পায় গানের সুর–কেউ বুঝি গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছে। পরিচিত সুর নয়–গাঁয়ের চেনা কেউ হবে বলে ওর মনে হয় না। লোকটি এগিয়ে এসেছে। রাহানুম গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখে। না, লোকটিকে ও চেনে না। সম্ভবত ও ভিন্ন গায়ের কেউ। লোকটি অনেকটা এগিয়ে গেলে ও রাস্তায় ওঠে। পেছনে আর কেউ নেই, সামনে একজন মানুষ চলে যাচ্ছে। একজন মানুষকে চলে যেতে দেখলে মন খারাপ হয় ওর। ও দুপা এগিয়ে থমকে দাঁড়ায়। ওর এগুতে ইচ্ছে করছে না। লোকটি চলে যাক–একদম ওর দৃষ্টির আড়ালে গেলে তারপর ও এগুবে। ও জঙ্গলের ভেতর ঢুকে একগোছা স্বর্ণলতা ঘেঁড়ে, জানে না কী করবে? ছিড়লই বা কেন? স্বর্ণলতা দিয়ে দু’হাতে দড়ি পাকায়। তারপর ছুঁড়ে দেয় দূরে। ওটা কপলা গাছের ডালে গিয়ে আটকে থাকে।
মানুষটি চলে গেলে ওর মাথা এমন দড়ির মতো পাকিয়ে থাকে। মনের বিনুনি এমন জটিল হয়ে উঠেছে যে, ও কোনো শক্ত বাঁধনে নিজের সবটুকু বেঁধে রাখতে চায়। ও ঝরাপাতা না মাড়িয়ে নিঃশব্দে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে। আজ অনেক বেলা হয়ে গেল ফিরতে। আর কোনোদিন ও এত দেরিতে ফেরেনি। এই দেরিতে ফেরার জন্য ওর কেমন সংকোচ হয়। গায়ে ভিজে শাড়ি লেপ্টে থাকলে ওর তি হওয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। দু-একজন মানুষ পথে বেরিয়েছে, সবাই ওর চেনা, ওরা ট্রলারে যাচ্ছে। মাছ ধরতে যাবে। ওদের কারো পিঠে জাল, কারো ঘাড়ে পানিভরা কলস। নোনা সমুদ্রে গেলে মিঠে পানি সঙ্গে না থাকলে ওরা তৃষ্ণায় মরে যাবে। রাহালুমের বুক শিউরে ওঠে। তৃষ্ণা যে কত হাজার রকমের! ওহ মানুষের তৃষ্ণা কত প্রবল। মানুষ কেবল তৃষ্ণা নিয়ে ছটফট করে। ও বুঝতে পারে যারা ওর দিকে তাকিয়ে থাকছে তাদের ভাষা। ও কারো দিকে তাকায় না। দ্রুত পায়ে হাঁটে। সুখদীপের কথা মনে হতেই ওর মন খারাপ হয়ে যায়। ও হয়তো ঘুম থেকে উঠে কান্নাকাটি করছে–হয়তো ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে। আহা বেচারা আবুল হাশেমের কথা মনে হতেই ওর ভয় করে। হয়তো চোয়াল কঠিন করে বারান্দায় বসে আছে, পছন্দ করতে পারছে না ওর এতটা বেলা পর্যন্ত ঘরে না ফেরা।
পথে বুড়ো মুনসি একগাল হেসে কুশল জিজ্ঞেস করে, কেমন আছো মা?
আছি ভালো।
রাহানুম হেসে মাথা নাড়ে। মুনসি চাচাকে ওর ভালো লাগে। হাসিভরা মুখের দিকে তাকালে মনে হয় আপনজন। মুনসির চেহারায় একজন পিতার প্রশ্রয় আছে। মুখ থেকে হাসি ফুরোয় না। কখনো রাগতে দেখা যায় না। আবুল হাশেম বলে মুনসি পুরুষ মানুষ না। রাগ না থাকলে পুরুষ মানুষকে মানায় না। আসলে মুনসির জালে প্রচুর মাছ ওঠে এটা আবুল হাশেমের ঈর্ষা এবং ক্রোধ। রাহানুমকে প্রায়ই এই কথা শুনতে হয়। এসব কথা মনে করে রাহানুম হেসে ফেলে, আমনহে ভালো। আছেন চাচা?