সাত দিনের মাথায় আয়শা খাতুন উঠে বসলেন। প্রতিদিন এসেছেন ডা. আশরাফ। সারাক্ষণই চিন্তিত থেকেছেন। আকমল হোসেনকে বলেছেন, বুঝতেই পারছি না ব্যাপারটা। সব ধরনের রক্ত পরীক্ষা করালাম। কিছুই পাওয়া গেল না। আমার মনে হয়, কোনো বড় ধরনের সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম থেকে এই অসুস্থতা হতে পারে। ভাবির অসুস্থতা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে।
আকমল হোসেন ধীরে ধীরে মাহমুদার কথা বলেন। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত মাহমুদা কীভাবে শান্তি কমিটির নেতার বাড়িতে বোমা ফাটিয়েছে, সে কথা বলেন।
ও যে আর ফিরে আসতে পারেনি, সেটাও কষ্ট হয় আশরাফের কাছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর মাথা নাড়িয়ে বলেন, বুঝেছি। ভাবির অসুস্থতা নিয়ে আমাকে আর ভাবতে হবে না। তবে বিপদ কেটে গেছে। দুএক দিনের মধ্যে পুরো সুস্থ হয়ে যাবেন।
মেরিনা চা নিয়ে আসে।
আশরাফ জিজ্ঞেস করেন, তুমি কেমন আছ, মা?
ধাক্কাটা আমি সামলাতে পেরেছি। আম্মা পারেননি।
বুঝেছি। দুদিন ধরে ধানমন্ডি ২৮ নম্বর রোডের বাড়িতে একজন যোদ্ধাকে দেখতে হয়েছে। রেকি করতে গিয়ে বুকে গুলি লেগেছে।
কেমন আছে? সুস্থ হবে তো?
মেরিনার কণ্ঠে উদ্বেগ।
বিপদ কেটে গেছে। সুস্থ হতে এখন যে কয় দিন লাগে।
কয় দিন লাগতে পারে?
আমি মনে করছি, সাত-আট দিন লাগবে। তারপর ওকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে পুরো বিশ্রামের জন্য। ওর বাড়িতে পাঠানো যাবে না। অন্য কোথায় রাখব, তা খোঁজ করছি।
ওরা কেউই বিশ্রাম নেবে না, চাচা। ওই একটি শব্দ ওরা বাতিল করে দিয়েছে।
তুমি দাওনি, মা?
হ্যাঁ, আমিও দিয়েছি। যুদ্ধের ভেতরে কত হাজার রকম কাজ থাকে, সেগুলো তো করতে হয়।
আশরাফ মৃদু হাসেন। হাসিতে আনন্দ। সময় জয়ের গল্প এখন চারদিকে। কোনো কিছুই থেমে নেই। ছুটছে আপন নিয়মে। কখনো প্রবল তীব্রতায়, কখনো নিজস্ব নিয়মের স্বচ্ছতায়। ছুটতেই হবে।
আশরাফ কপালের ওপর পড়ে থাকা এলোমলো চুল হাত দিয়ে মাথার ওপরে ঠেলে দিয়ে বলেন, সজীবের বুকে গুলি লাগলে ওকে একটি লাল শার্ট পরিয়ে স্কুটারে করে ধানমন্ডিতে আনে শিপন। একজন রক্তাক্ত মুক্তিযোদ্ধার পাশে আরেকজন। প্রত্যেকেই দ্রুত বুঝে নেয় যে কী করতে হবে। ওরা এই শহরের আকাশে আলো জ্বালিয়ে রেখেছে।
কথা শেষ হলে আকমল হোসেন বলেন, আমাদের সময়টা এমন। আশরাফ খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে বলেন, সময়টা এখন ঝুঁকির এবং মৃত্যুর।
না, চাচা, শুধু মৃত্যুর না, সাফল্যেরও। আমরা স্বাধীনতার পথে এগোচ্ছি। আমরা জয়ী হবই।
মা, তোমাকে দোয়া করি।
আশরাফ চায়ে চুমুক দিয়ে কাপ টেবিলের ওপর রাখলে ঠক করে শব্দ হয়। শব্দটা ঘরে টুনটুন করে বাজে। তিনজন মানুষ চারদিকে তাকায়। মনে হয়, একটি স্কুটার রক্তাক্ত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে ছুটে যাচ্ছে এবং ফার্মগেটের ভাড়া করা বাড়িতে অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে যোদ্ধারা। টার্গেট পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্নর মোনায়েম খানের বাড়ি। বাষট্টি সালে গভর্নর হয়ে স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের হুকুমের দাস হয়েছিল লোকটি। নিজে বাঙালি। তার জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি-শিল্প-সাহিত্য আর সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনের প্রতি তার কোনো অঙ্গীকার ছিল না। উল্টো অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিল। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় আইয়ুব খানের পতনের আগে তার বিদায় হয়। তারপর বেশ কিছুকাল লোকচক্ষুর আড়ালে গোপনে ছিল। এখন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেয় তাকে খতম করার।
একজন বলে, আমি একাই পারব। দুই দিন তার বনানীর বাসা রেকি করেছি। দরজা খোলা রেখে সন্ধ্যায় চামচাঁদের নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসর জমায়। ওকে মারতে আমাদের দুই জন লাগবে না।
ঠিক তো?
একদম ঠিক। দরকার হলে আরও একদিন রেকি করব। রেকি করতে আমাকে সহযোগিতা করছে বাড়ির গরুর রাখাল। ওর সঙ্গেই আমি একদিন ভেতরে ঢুকেছিলাম। কোথায় থেকে কী করা যায়, সব দেখে এসেছি। যেদিন আক্রমণ করতে যাব, সেদিন পেছনের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকব। সামনের গেট দিয়ে ঢাকা রিস্কি হবে। লোকটা একটা নরকের কীট। ওকে ধ্বংস করতে চারজন মুক্তিযোদ্ধার শক্তি ব্যয়ের দরকার নেই।
আরেকজন বলে, একই দিনে আমরা আরও একটি ঘটনা ঘটাতে চাই।
কোথায়?
কোথায় ঘটাব সেটা বুঝতে হবে।
লালবাগের শান্তি কমিটির নেতা আমাদের তালিকায় আছে। আমি ঠিক করেছি, সকাল থেকে ওর বাড়ির সামনে থাকব। বের হলে পিছু নেব। তারপর সুযোগ বুঝে গুলি।
গুলি! আশরাফ চায়ের কাপটি হাতে নিয়ে আবার রাখেন। বুকের ভেতর থেকে উঠে আসে শব্দটি, গুলি! মাথা ঝাঁকিয়ে নেন। যুদ্ধের সময় গুলির ছোঁয়া দুপক্ষকেই নিতে হয়। তবে যোদ্ধারা নেয় বুকে, আর শত্রুপক্ষের কাপুরুষেরা নেয় পিঠে! আশরাফ মেরিনার ডাকে ঘুরে তাকান। মেরিনা বলে, আমি কি আপনার জন্য আরেক কাপ চা আনব, চাচা?
হ্যাঁ, মা। আমি আরেক কাপ চা চাই।
মেরিনা উঠে গেলে আকমল হোসেন বলেন, ফার্মগেট এলাকায় আমরা একটি চমৎকার দুর্গবাড়ি পেয়েছি। বেশ জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা। নিরাপদও মনে হয়। ছেলেরা তাই বলে। আমি একটু পরে ওখানে যাব। মাসের ভাড়ার টাকা দিয়ে আসব। আর গেরিলাদের পরবর্তী পরিকল্পনার কথাও জানব।
আমি বুকে গুলি নেওয়া ছেলেটিকে দেখে বাড়ি যাব। ভেবে আনন্দ পাই যে ঘরকুনো বাঙালির ছেলেরা কত অনায়াসে গুলির সঙ্গে যোঝযুঝি করছে। আমাদের আর কেউ ভিতু বলতে পারবে না।