- বইয়ের নামঃ অপেক্ষা
- লেখকের নামঃ সেলিনা হোসেন
- প্রকাশনাঃ শামীম পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃগল্পের বই
০১. অনিমা ও রাজীবের প্রেমের কথা
অনিমা ও রাজীবের প্রেমের কথা বেশি দিনের নয়। দূরখালি স্টেশনে অনিমার বাবা বদলি হয়ে এসেছে মাত্র ছ’মাস হলো। এর মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। যেভাবে জমে উঠলে ভালোবাসার অতিরিক্ত আরো নানা ধরনের আসক্তির জন্ম হয় তেমন পর্যায়ে ওরা পৌঁছেনি।
স্টেশন মাস্টারের মেয়ে অনিমা। বাবার সঙ্গে স্টেশন থেকে স্টেশনে ঘুরে বেড়ায়। নতুন নতুন জায়গায় গিয়ে থাকতে ভালো লাগে। ওর। বছর দুয়েক আগে মা মরে গেছে। ওর কোনো ভাইবোনও নেই। বি.এ পরীক্ষা দিয়েছে। ইচ্ছে আছে কোনো প্রাথমিক স্কুলে চাকরি করার। এখনো সে সুযোগ আসেনি। রাজীবের বাবা দূরখালি গায়ের কৃষক, অবস্থা মোটামুটি ভালো। সংসারে অভাব নেই। তবে ছেলেকে বি.এ পাসের পরে ঢাকায় পাঠিয়ে এম.এ পড়াবে এমন ইচ্ছে তার নেই। কিন্তু ছেলের জোর তাগাদা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে একটা কিছু করবে এমন স্বপ্ন ওর ভেতরে আছে। এর পাশাপাশি বাড়তি যেটুকু ইচ্ছে তা হলো এম.এ পাস করতে পারলে দূরখালি গায়ের প্রথম ডিগ্রিধারী যুবক হবে ও। বাবাকে এই শর্তে রাজি করিয়েছে। ছেলে এম.এ পাস করলে বাবারও নামডাক হবে গাঁয়ে, এমন লোভ কোন বাবার না হয়!
একদিন ঢাকা যাওয়া ঠিক হয় রাজীবের। স্টেশনের প্লাটফর্মের শেষপর্যন্ত বাবা রাজি হয়েছে। খরচ চালাতে বাবার একটু কষ্ট হবে, তারপরও বাবা খুশি যে, আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি নিতে পারব। বাবা গাঁয়ের প্রথম মানুষ হবেন, যার ছেলে এম.এ পাস করেছে।
হা হা করে হাসে রাজীব। সঙ্গে অনিমাও। হাসি থামলে রাজীব বলে, তবে আমি চেষ্টা করব টিউশনি করে বাবার কাছ থেকে যত কম টাকা নেয়া যায়। আর চেষ্টা করব কোনো কারণে সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি লেখাপড়া শেষ করে বাড়ি ফিরতে।
অনিমার দু-চোখে ঝিলিক ওঠে।
সত্যি ফিরবে তো? এম.এ পাস করে তুমি ঢাকায় থেকে যাবে না তো?
মোটেই না, ঢাকায় থাকব কেন? আর যদি থাকতেই হয়, যদি চাকরি করি, তাহলে তুমি যাবে তো আমার সঙ্গে?
অনিমার ছেলেমানুষি কণ্ঠস্বরে কিছুটা বিস্ময় ধ্বনিত হয়, আমাদের ঘর হবে?
হবে, হবে, হবে। দুজনে আনন্দের স্রোতে ভেসে যায়। হাসি থামলে রাজীব দ্বিধা নিয়ে বলে, কিন্তু আমার একটা ভয় আছে অনিমা।
ভয়? অনিমার দম আটকে আসে।
ভয়ই তো। আমার দুবছরের পড়ার ফাঁকে তোমাকে যদি তোমার বাবা বিয়ে দিয়ে দেয়!
অনিমার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস ধ্বনিত হয়, বাবা সে রকম চেষ্টা করলে আমি রাজি হবো না। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
কত দিন অনিমা? কত দিন?
অনিমা মাথা ঝাকিয়ে অবলীলায় বলে, যত দিন তুমি না ফিরো।
তাহলে এখন থেকে আমাদের অপেক্ষার শুরু।
হ্যাঁ, শুরু।
দুজনে হাত ধরে। দুজনের মাথার ওপর উড়ে বেড়ায় প্রজাপতি। দুজনে প্লাটফর্ম থেকে লাফিয়ে নেমে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে যায়। প্লটফর্ম ধরে নয়, ধানক্ষেতের আল ধরে যতটা পথ পাড়ি দেয়া যায় তত দূরে।
দুদিন পরে চলে যায় রাজীব। স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ট্রেনের লেজটুকু অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরেও অনিমার মনে হয় রাজীব যায়নি–ও একটু পরই রাজীবের কণ্ঠ শুনতে পাবে। অকস্মাৎ এই ফাঁকা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকতে ওর ভয় করে। মনে হয় চারদিক থেকে হলুদ জামা গায়ে অসংখ্য মানুষ ছুটে আসছে। ওদের ফ্যাকাশে চেহারায় আলো নেই। ও চারদিকে তাকায়। যেন হলুদ আলোর প্রলেপ পড়েছে চারদিকে। গাছগুলো নিথর, পাতাগুলোর রঙ আর সবুজ নেই। চারপাশের ধানক্ষেতের ওপর হলুদের ছোঁয়া। গত বছর জন্ডিসে আক্রান্ত হলে বাবার চেহারাটা অমন হয়ে গিয়েছিল। ও বাবার কাছে যেতে ভয় পেত মনে হতো বাবাকে ধরতে গেলে বাবা মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। আর বাবা না থাকলে ও কার সঙ্গে কথা বলবে, কে ওকে বকুনি দেবে, কে ওকে বলবে, মেয়েটা আমার বুকের ভেতরে একটা বড় মাকড়সা হয়ে আটকে আছে, জাল বুনছে। আমি সেই জালে আটকা পড়া মাছি। অনিমা ভয়ে কুঁকড়াতে থাকে। মনে হয় ফাঁকা স্টেশনের গরুগুলো তেড়ে আসবে ওর দিকে, আর রাখাল বালকেরা ভাববে ও একটা ডাইনি, গরুগুলোকে নিয়ে গুহার ভেতরে চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে তেমন কিছু ভাবার সঙ্গে সঙ্গে ওর মায়ের কথা মনে হয় মরে যাওয়ার আগে মাকেও অমন হলুদ দেখাচ্ছিল–ফ্যাকাশে, বিবর্ণ। মৃত্যুর রঙ কি তাহলে হলুদ? নাকি কালো? ও দুহাতে মুখ ঢাকে।
তখন পেছন থেকে ওর বাবা তৌফিক ওর ঘাড়ে হাত রাখে।
একা একা দাঁড়িয়ে আছিস যে মা?
বাবা, মৃত্যুর রঙ কী?
মৃত্যুর আলাদা রঙ নেই। সব রঙের ভেতরই মৃত্যুর ছায়া আছে।
লাল রঙে আছে?
কেন থাকবে না। সন্ত্রাসীর গুলিতে মানুষ তো রক্তের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে। রক্তের রঙ লাল ছাড়া আর কী?
বাবা, মায়ের মৃত্যুর রঙ কী?
হলুদ।
হলুদ! আশ্চর্য, আমারও তাই মনে হয়েছিল।
বাড়ি চল মা। বাড়ি গিয়ে আমরা দুজনে তোর মায়ের ছবি দেখব।
ঠিক। চলো। ছবিতে মা আমাদের কাছে ফিরে আসবে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমার মনে হবে মা মরেনি। মা আমাদের সঙ্গেই আছে। ভাগ্যিস, দুটো অ্যালবাম ভরে মায়ের ছবি রেখেছি আমরা।
অনিমা বাবার হাত ধরে বাড়ি ফিরে, যেন ও শৈশবের অনিমা। বাবা ওকে গুড়বালি গাঁয়ের মেলায় নিয়ে অনেক খেলনা কিনে দিয়েছে। সেদিন গুড়বালি স্টেশন থেকে লোকাল ট্রেনটা ছেড়ে যাবার পরে দুর্ঘটনায় পড়েছিল। কে বা কারা রেললাইনের খানিকটুকু তুলে নিয়েছিল। বাবা ভীষণ মন খারাপ করেছিল। অনেক দিন ভাত খেতে পারেনি। এক গভীর রাতে ওর ঘুম ভেঙে গেলে ও দেখেছিল, মা বাবাকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে।