মেরিনার কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর মিশে যায় অন্ধকারে।
আয়শা খাতুন অন্ধকার চিরে স্পষ্ট কণ্ঠে বলেন, আজ রাতে আমরা না ঘুমিয়ে অস্ত্র পাহারা দেব। আমাদের গেরিলাযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্রের দরকার। এই মুহূর্তে আমাদের সামনে যুদ্ধই বড় কথা। যোদ্ধাদের কাছে গানও অস্ত্রের সমান হয়ে গেছে।
আয়শা খাতুন থামলে অন্য দুজন কথা বলেন না।
তাঁর কণ্ঠস্বর গুনগুন ধ্বনির মতো আচ্ছন্ন করে রাখে তাঁদের। জীবনের নিঃশ্বাস অন্ধকারের হাওয়ায় ভাসে।
গ্যানিজ ও ভোগ অপারেশনের জন্য তৈরি হয়েছে ক্র্যাক প্লাটুনের তিনজন সদস্য। আজই সেই দিন। আগের দিন রেকি করেছে ওরা। আকমল হোসেন জানেন, বিকেল চারটার দিকে আক্রমণ করা হবে। দুপুরের আগেই এ বাড়ি থেকে অস্ত্র নিয়ে গেছে জুয়েল আর গাজী। দুপুরের পর থেকে বাগানে পায়চারি করেন তিনি। তারপর চেয়ার নিয়ে বারান্দায় বসে থাকেন। গেটের কাছ থেকে নড়ার হুকুম নেই আলতাফের-কেউ যদি আসে। কারও যদি কোনো দরকার হয়!
গতকাল গেরিলারা রেকি করার পর তিনি নিজেও রেকি করতে গিয়েছিলেন। গ্যানিজের ভেতরে ঢুকেছিলেন। তীক্ষ্ণ নজরদারিতে দেখেছিলেন গেরিলা অপারেশনের জন্য পরিবেশ বৈরী নয়। ফোনে তাঁর পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়েছিলেন গাজীকে।
বিকেল চারটার দিকে একজন অবাঙালির হাইজ্যাক করা ৯০ সিসি হোন্ডায় চড়ে তারা গুলিস্তানে আসে। রাস্তায় বাস চলাচল স্বাভাবিক। ভিড় তেমন নেই। ওদেরকে একটি টয়োটা গাড়িতে করে কভার দিয়ে এসেছে সামাদ, উলফত আর জুয়েল। ওরাও চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, এই সামান্য ভিড়ে একটানে গাড়ি চালিয়ে যেতে ওদের অসুবিধা হবে না। তা ছাড়া আক্রমণের সময় গাড়ি-রিকশা নিজেদের উদ্যোগেও সরে যেতে থাকে। ওদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
ঘরে বসে আকমল হোসেন ঘড়ি দেখেন। ঘড়ির মিনিটের কাঁটার দিকে তিনি তাকিয়ে থাকেন। সময় দেখে বুঝতে পারেন, ছেলেরা বেরিয়ে গেছে। দুপুরের আগে তিনি জুয়েলের হাতের ব্যাগে একটি স্টেনগান, পাঁচটি গ্রেনেড৩৬ ও ফসফরাস বোমা দিয়েছেন। ওরা কীভাবে যাচ্ছে, সে দৃশ্যটি আর দেখা হলো না। তিনি চেয়েছিলেন গাড়ি নিয়ে ওদের পিছে পিছে যেতে। রাজি হয়নি জুয়েল। চেঁচিয়ে বলেছে, না, আপনি যাবেন না। আমাদেরকে কভার দেওয়া গাড়ি থাকবে। একমুহূর্ত থেমে আবার বলেছে, আপনার কিছু হোক—এটা আমরা চাই না, চাচা। আপনারা যারা আমাদের দুর্গ, তাদের কিছু হলে আমরা তো আশ্রয় হারাব। যুদ্ধটা কত দিন চলবে, তা তো আমরা জানি না, চাচা। আপনারা আমাদের পাশে থাকুন।
আকমল হোসেন ওর চেঁচামেচির উত্তর দেননি। মনে হয়েছিল, এই কথার উত্তর হয় না। জুয়েল পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলে তিনি ওর মাথায় হাত রেখেছিলেন। তিনি জানেন, এই অপারেশনে জুয়েল সামাদের গাড়িতে আছে।
হাইজ্যাক করা হোন্ডা সিসিটা চালাচ্ছে মানু। তার পেছনে আছে মায়া আর গাজী। গাজীর কাছে আছে স্টেনগান। বেশ খানিকটা দূর থেকেই ওরা দেখল প্রতিদিনের মতো গ্যানিজের গেটে পাহারায় আছে চারজন পুলিশ। ওরা অবাঙালি। হোন্ডা সিসি চালিয়ে রেকি করে ওরা। সামাদের টয়োটা কার গেট থেকে সামনের দিকে রাখা হয় স্টার্ট অন রেখে। রেকি করার সময় তিনজনই কালো রুমাল দিয়ে মুখ বেঁধে নেয়। তারপর ফিরে আসে মেইন গেট থেকে কয়েক হাত পেছনে। হোন্ডা থামলে প্রথমে নামে গাজী। স্টেনগান হাতে দৌড়ে যায় সামনে। সেই অবস্থায় স্টেনগানে ম্যাগাজিন ভরে নেয়। পেছনে মায়া। ও চিৎকার করে বলে, হ্যান্ডস আপ।
পুলিশরা হতভম্ব। হ্যান্ডস আপ করে না, কিন্তু বন্দুক হাতে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে। চারদিকে হইচই। বাইরে চিৎকার করে পথচারীরা। ভেতরে আছে। দোকানে কর্মরত লোকেরা। সঙ্গে বেশ কয়েকজন ক্রেতা। তারা ছোটোছুটি করে দোকানের ভেতরের আসবাবপত্রের আড়ালে নিজেদের লুকানোর চেষ্টা করছে। তাদের পায়ের ধাক্কায় ছোট ছোট ঝুড়ি বা ওয়েস্টপেপার বাস্কেট কিংবা কাগজের বাক্স ইত্যাদি উল্টে গিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। কেউ কারও দিকে তাকায় না। প্রত্যেকে নিজেকে লুকানোয় ব্যস্ত।
দুজনের কেউই তখনো দোকানের ভেতরে ঢোকেনি। পুলিশ চারজন কী করবে বুঝে ওঠার আগেই গাজী ওদেরকে ব্রাশফায়ার করে। পড়ে যায় ওরা। রক্তাক্ত ফুটপাত থেকে রক্তের স্রোত নামে রাস্তায়। উধ্বশ্বাসে মানুষজন পালায়। আশপাশের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। বায়তুল মোকাররমের সামনের ফুটপাত থেকে দোকানিরা পাততাড়ি গোটায়। মুহূর্তে রাস্তা জনশূন্য হয়ে যায়।
মেইন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মায়া দোকানের ভেতরে গ্রেনেড-৩৬ ছুড়ে মারে। সঙ্গে একটি আগুনে ফসফরাস বোমা। ভেতরে হইচই-চেঁচামেচিচিৎকার, ক্রন্দন ভেসে আসে ওদের কানে।
গাজী দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে, বুঝে দেখ, পঁচিশের রাতে তোদের সেপাইরা আমাদের কী করেছে। ভেবে দেখ, আমাদের ইপিআর সদস্যদের কীভাবে মেরেছিস!
আয়। দেখ, আমাদের কভার দেওয়া গাড়ি আড়াআড়িভাবে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।
দেখতে পাচ্ছিস কি জুয়েলের হাতে স্টেনগান। স্টেনের নল বের করে রাস্তার দিকে তাক করে রেখেছে ও।
দুজনে ফুটপাত ধরে দৌড়ে গিয়ে হোন্ডায় ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে স্টার্ট দিয়ে রাখা হোন্ডা চালাতে শুরু করে মানু। সামনেই আছে কভার দেওয়া টয়োটা। স্টেনগানের নল আর দেখা যায় না। সেটা ভেতরে ঢোকানো হয়েছে। পেছনের দিকে মুখ ফিরিয়ে ওদের দিকে হাত নাড়ে জুয়েল। দুআঙুল তুলে ভি দেখায়। দূর থেকে ওরা কিছু বলতে পারে না।