আইকা এমন এলোমেলো অবস্থায় কোনওদিন দেখেনি রুপিনকে। ওর মনে হয়েছিল কিছু একটা হয়েছে নির্ঘাত।
“কী হয়েছে আপনার?” আইকা তাকিয়েছিল রুপিনের দিকে।
রুপিন সময় নিয়েছিলেন একটু। তারপর বলেছিলেন, “আইকা, আমার কলেজ লাইফ থেকে প্রায় অনেকটা সময় কাটে ইংল্যান্ডে। সেখানে সোনম নামে একটা পঞ্জাবি মেয়ের সঙ্গে আমার প্রেম হয়েছিল। উই ওয়্যার ইন লাভ। কিন্তু আমার বাড়ি মানেনি। ওর বাড়িও মানেনি! সোনমও আমার সঙ্গে ইলোপ করতে চায়নি। আই ওয়জ় ডিভাস্টেটেড! আমি কাজ ছেড়ে দেশে ফিরে আসি! আমার নার্ভাস ব্রেক ডাউন হয়ে পড়ে। ইট টুক মি টু ইয়ার্স টু রিকভার! রেজ়াল্ট ভাল ছিল। বিদেশে জব এক্সপিরিয়েন্স ছিল, আমার চাকরি পেতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু আর বিয়ে করিনি। আমার দুই ভাই বিয়ে করেছে। দে আর সেটলড! এখন এই বয়সে সবাই আমার বিয়ে দিতে চায়। আই অ্যাম অলমোস্ট ফিফটি। কিন্তু কেউ কথা শুনছে না।”
আইকা বলেছিল, “ফিফটি তো কী হয়েছে? এখন এসব কেউ মানে?”
“আসলে তা নয়, আমি বিয়ে করতে চাইলে…” রুপিন থমকে গিয়েছিলেন একটু, “তোমায় চাইব। আমি তোমায় পছন্দ করি। তোমায় বিয়ে করতে চাই! ওঃ! আই হ্যাভ সেড দ্যাট!”
আইকা ঘাবড়ে গিয়েছিল। রুপিনকে দেখে মনে হচ্ছিল কোনও বিশাল কঠিন কাজ করে ফেলেছেন! মানুষটার মুখ-চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল একদম!
আইকা নিজেও কী বলবে বুঝতে পারছিল না। রুপিন! ওকে বিয়ে করতে চায়! কিন্তু কেন! এটা কী করে সম্ভব!
আইকা আমতা-আমতা করে বলেছিল, “আমায়? কেন?”
“কারণ, আই লাইক ইউ আ লট! আমি জানি আমার বয়স বেশি। তোমার ‘হ্যাঁ’ বলার চান্স কম। কিন্তু তাও আমার যা মনে হয় বললাম। আমি সিরিয়াস এই ব্যাপারে। না, এখনই কিছু বলতে হবে না। আমি জোরও করব না। তুমি যদি ‘না’ বলো, আমি মেনে নেব। আই টোটালি আন্ডারস্ট্যান্ড ইয়োর সিচুয়েশন। তাই ডোন্ট সোয়েট অন ইট। টেক ইয়োর টাইম, তারপর জানিয়ো।”
সে দিনের পর রুপিন এই নিয়ে একবারও কিছু বলেননি। আইকাও কিছু উত্তর দেয়নি। কী বলবে ও! কাকে বলবে! দূর্বাকে বলার প্রশ্ন নেই, কারণ এক অফিস। মাকে বলারও মানে হয় না। মা শুনে যে কী প্রতিক্রিয়া দেবে সেটা মা নিজেও জানে না। তাই কিছু বুঝতে না পেরে ও ভেবেছিল পুশকিনের কাছে একবার যাবে!
পুশকিন। সেই স্কুলজীবনের লাজুক মনমরা পুশকিন। ক্লাস ইলেভেনে নতুন স্কুলে ভরতি হয়ে প্রথম পুশকিনকে দেখেছিল আইকা। সেই আইকা অনেক গম্ভীর, চাপা আর রাগী ছিল। এমন একটা বলয় দিয়ে নিজেকে ঘিরে রাখত যে, কাউকে কাছে আসতে দিত না! কিন্তু নিজের অজান্তেই সেই ঘেরাটোপ ভেঙে কী করে যেন পুশকিনকে ভাল লাগতে শুরু করেছিল ওর!
ওদের সঙ্গে রিয়া বলে একটা মেয়ে পড়ত। একটু গায়ে-পড়া ধরনের ছিল মেয়েটা। ছেলেদের সঙ্গে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াত। কথায়-কথায় পুশকিনের গায়ে হাত দিত। ঢলে পড়ত। দেখে কী যে রাগ হত আইকার! কিন্তু কিছু বলতে পারত না।
এমন করে ক্লাস টুয়েলভে একদিন সেই রিয়া একটা চিঠি দেখিয়েছিল। ফোর্থ পিরিয়ডের ইংরেজি ক্লাসের পরে টিফিন ছিল। সেই সময় রিয়া চিঠি বের করে দেখিয়েছিল সবাইকে। বলেছিল, “দেখ। লাভ লেটার! কে লিখেছে বল তো?”
সেটা মোবাইলের সময় ছিল না। তখনও টাকায় চারটে ফুচকা পাওয়া যেত, নীল-হলুদ কাগজে চিঠি আসত! কালো ঢাউস টেলিফোন যে সব বাড়িতে থাকত, তাদের বড়লোক বলা হত। সে সময় ছেলে আর মেয়েদের মাঝে একটা অদৃশ্য রেখা ভেসে থাকত সারাক্ষণ। সে সময় সেই রেখা টপকে মাঝে মাঝে কিছু কাগজ উড়ে আসত, যাকে উত্তেজিত টিনএজরা বলত, ‘লাভ লেটার!’
“তোকে অফার করেছে? কে রে?” রিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল পাশে বসা সুদীপা।
সেই সময় প্রোপোজ করাকে বলা হত ‘অফার’ করা!
রিয়া সবার সামনে লটারির ফার্স্ট প্রাইজ় দেখানোর মতো করে দেখিয়েছিল সেই চিঠিটা, তারপর বলেছিল, “তলায় নাম নেই তো কী হয়েছে? হাতের লেখা দেখে চিনতে পারছিস না? এত সুন্দর হাতের লেখা আমাদের ক্লাসে কার আছে?”
“পুশকিন!” সমবেতভাবে গুঞ্জন উঠেছিল। আর আইকার মনে হয়েছিল, কে যেন ওর বুকে ছুরি বসিয়ে দিল! পুশকিন! পুশকিন রিয়াকে ‘অফার’ করেছে! লাভ লেটার দিয়েছে! এত সাহস! এত বাজে ছেলে! আইকার মনে হয়েছিল কে যেন শিরার ভেতর বিষ ভরে দিয়েছিল ওর! যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠেছিল ও। দাঁতে দাঁত চেপে মনে হয়েছিল, পুশকিনকে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে।
টিফিনের পরের ক্লাস ছিল হেডস্যারের! আইকা আর সময় নষ্ট করেনি, রিয়ার ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে সোজা স্যারের টেবিলে গিয়ে বলেছিল, “স্যার, পুশকিন মেয়েদের এই সব লিখছে! নাম নেই তলায়, কিন্তু হাতের লেখা মিলিয়ে নেবেন!”
সারা ক্লাস স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল! রিয়া কী বলবে বুঝতে না পেরে বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়েছিল। আর সেকেন্ড বেঞ্চে বসা পুশকিন ফ্যালফ্যাল করে দেখেছিল আইকা ওর দিকে বিরক্তি আর ঘেন্না নিয়ে তাকিয়ে আছে!
দু’সপ্তাহ সাসপেন্ড ছিল পুশকিন। বাবাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। সারা স্কুলে ঢিঢি পড়ে গিয়েছিল। সবাই বলেছিল, আইকার সাহস আছে! এসব নোংরামোর একটা শেষ হওয়া দরকার!
শুধু রিয়া একদিন স্কুল ছুটির পরে ওর কাছে এসে বলেছিল, “এটা কী করেছিস তুই! চিঠিটা পুশকিন লিখলেও নিজের জন্য লেখেনি। শোভনের জন্য লিখে দিয়েছিল! শোভন ভালবাসে আমাকে। ও বলেছে আমায়। আর তুই সবটা না জেনে… এটা কী করলি তুই!”